Home Blog Page 9

পাগল দ্বিজদাসের গান

বৈকুণ্ঠনাথ চক্রবর্তী। মাতৃহারা; পিতার আদরের দুলাল। দুই বিবাহ করেছিলেন। নিঃসন্তান। পালক পুত্র ছিলো। ছিলেন রাজকর্মচারী। জমিদারের সেরেস্তাদার। কালীগঞ্জ-আড়িখোলা খ্রিস্টান মিশন, নরসিংদীর শিবপুরের যোশর কাচারি বাড়ি, দেওয়ান শরীফ খাঁ-জয়নব বিবির নগর নরসিংহপুর— এসব জায়গায় তাঁর কর্ম ও সম্পর্ক ছিলো বলে জনশ্রুতি। জ্ঞানানন্দ গোস্বামী, যিনি মাস্টার দা’ সূর্যসেনের সাথী। তিনি একবার এসেছিলেন বৈকুণ্ঠনাথের কাছে। দুজনে মিলে গড়ে তুলেছিলেন শিক্ষালয় ‘শ্রীকৃষ্ণের পাঠশালা’, ‘শক্তিমঠ’, দেবালয় ও চিকিৎসালয়।

বৈকুণ্ঠনাথের আড়ালে থাকার স্বভাব ছিলো। তাঁর উপার্জন যথেষ্ট ছিলো। মানুষের পাশে দাঁড়াতেন সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে। ছিলেন রাজকর্মচারী। আসা-যাওয়ার পথে গান লিখতেন। জ্ঞানানন্দ গোস্বামীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ‘শক্তিমঠ’ থেকে প্রকাশ করা হয়েছিলো ‘পাগল দ্বিজদাসের গান’। সংরক্ষণের অভাবে অনেক গান হারিয়ে গেছে। তাঁর আত্মীয়-স্বজনের অধিকাংশই ভারতে চলে গেছেন। তাঁরা গানগুলো সাথে করে নিয়ে গেছেন বলে মনে করা হয়। পৈতৃক ভিটা জন্মস্থান পারুলিয়ায় তাঁর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। চিকিৎসালয় নেই। শক্তিমঠ নেই। তবে পাঠশালাটি আছে নবরূপে। অত্র এলাকার আলোকবর্তিকা ঐতিহ্যবাহী ‘পারুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে।

দ্বিজদাস ও জ্ঞানানন্দ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘শ্রীকৃষ্ণ পাঠশালা’, যা বর্তমানে ‘পারুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে পরিচিত

বৈকুণ্ঠনাথ চক্রবর্তী সম্পর্কে যতোটুকু জানা যায়, ততোই ধোঁয়াশা বাড়ে। তাঁর সম্পর্কে প্রকৃত সত্য ও বিস্তারিত জানা একান্ত প্রয়োজন। যার স্মৃতিচিহ্নসহ সব মুছে গেছে। এমন একজন মহামানবকে কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে এই সমাজ, এই রাষ্ট্রের কি কোনো দায়িত্ব নেই?

বৈকুণ্ঠ গান লিখতেন ‘দ্বিজদাস’ ছদ্মনামে। নিদারুণ জীবন বাস্তবতা ও স্পষ্টভাষ্যে। গানের কথায় গভীর জীবনবোধ নিরপেক্ষ বাস্তবতার আলোকে তাঁকে বস্তুবাদী বলে থাকেন অনেকে। এ-কথার সত্যতা কতোটা? জানতে হলে ডুব দিতে হবে দ্বিজদাসের গানের ভুবনে। তাঁর গানের কথায় যেমন সত্যতা আছে, আবার আছে ভাবনার উদ্রেককারী অনেক উপসর্গ। বরাক নদীর জল যেখান থেকে বাংলায় প্রবাহিত হয়, দ্বিজদাসের জন্মস্থান থেকে সে-পর্যন্ত তাঁর গানের ব্যপক প্রভাব। গ্রামীণ জনপদে ও পদাবলির আসরে তাঁর গান প্রাণে শিহরণ জাগায়। নাগরিক সমাজেও তিনি সমাদৃত। হালের জনপ্রিয় বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম, দূরবীন শাহ প্রমুখ তাঁর গানে গভীরভাবে প্রভাবিত। প্রখ্যাত বাউল সাধক সুনীল কর্মকারসহ বর্তমানের প্রায় সব বাউল শিল্পীর মুখেই ভাসে দ্বিজদাসের গান। হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখেছেন তাঁর গান নিয়ে। কবিয়াল হরিচরণ আচার্য্য সরাসরি দ্বিজদাসের দীক্ষায় ধন্য হয়েছেন। জ্ঞানানন্দ গোস্বামী বামপন্থী ছিলেন। দ্বিজদাসের বাড়ি পারুলিয়া এলাকার অনেকেই বামপন্থী স্বদেশী আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। তাঁর গানের কথাকে বামপন্থীরা একান্ত আপন বলেই মনে করেন। সেই সাথে তাঁকে বস্তুবাদী বলে থাকেন অনেকে। তাঁর বিখ্যাত গান :

কেহ শোনো বা না-শোনো, মানো বা না-মানো,
তাতে আমার নাই কোনো লাভ-লোকসান।

শুনে যারে ওরে পাগল দ্বিজদাসের গান।

 

দ্বিজদাসের ভাবনায় সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে অমীমাংসিত সাবলীল উচ্চারণ আছে এ-গানে। এক পর্যায়ে অকপট উচ্চারণ :

কেহ বলে আছ তুমি, কেহ বলে নাই,
আমি বলি থাকো থাকো না থাকলে নাই।
…মানতে মানতে শাস্ত্র— পাই না অন্ন বস্ত্র,
লোটা বটি অস্ত্র ক্রমে তিরোধান
শুনে যারে ওরে পাগল দ্বিজদাসের গান।।

এ-কথার উপর ভিত্তি করেই তাঁকে বস্তুবাদী বলাটা যৌক্তিক হবে? নিজ ধর্ম চেতনায় অন্তিম পর্ব শ্মশানের কথা বহুবার এসেছে তাঁর কথায় :

তরুলতা কন্যার সাথে বিয়া হবে বিধি মতে
সমন ঠাকুর ঘটক তাতে, রাজ ঝোটক সম্মেলন
কর হে বিয়ার আয়োজন।

তাঁর গানের প্রতিটি কথাই গভীর চিন্তার উদ্রেক ও সাধনার পথ উন্মোচিত করে।

আমি বিনে তোমার কিসের বড়াই
আবার
পঞ্চত্বের কালে, পঞ্চে পঞ্চ মিলে
পাঁচ গেলে, পাছে রলো না রলো না।

দর্শনে স্পর্শনে শ্রবণে কি ঘ্রাণে
কিছুতেই না হয় ঠিকানা।

এ-গানগুলো প্রতিটি ভাবুক হৃদয়ে ভাবনার খোরাক জোগায়। তাঁর গানে মানুষ ও গুরু ভজনার কথাও এসেছে সহজ সারল্যে।

মানুষে মানুষ বিরাজে খুঁজে নেওয়া বড় দায়
মানিক চিনে, দুই এক জনে, শ্রীমহাজনের কৃপায়।

সংসারের যাতনা ও পারিপার্শ্বিক প্রভাব দ্বিজদাসকে তিক্ত স্বাদ দিয়েছিলো ষোলোআনা। গানে যার যথার্থ প্রমাণ রয়েছে অনেকটা অংশজুড়েই :

সংসারের সংসারী, মাইনা নাই চাকরী
এ ঝকমারি করে দেখেছি
এবার হলো যা হবার, বাকি নাই রে আর
সকাল সকাল গেলে বাঁচি।

এই জীবন-সংসারের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণাও প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কথায়। মৃত্যু-শ্মশান-অন্তিম যাত্রাÑ এসবে আচ্ছন্নতা প্রকাশ পায় :

এই যে সংসার সকলই অসাড়

পবনের যেদিন গতি রুদ্ধ হবে
ভুজঙ্গ গিয়া গুরুকে দংশিবে
পতঙ্গ সেই দিন মাতঙ্গে নাশিবে
সিংহের হবে শিয়ালের ভয়
একদিন নিরাকার হবে জলে জলাময়।

লালনের গান আর দ্বিজদাসের গানের মৌলিক পার্থক্য হলো, লালন যেখানে ভাববাদী, দ্বিজদাস সেখানে যুক্তিবাদী। লালনের গানে সাধন-ভজনের সাথে কর্মপরিণতি ও মুক্তির বাসনায় করুণ মিনতি আছে। আর দ্বিজদাসের আছে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর নিঃসঙ্কোচ অভিপ্রায়। দ্বিজদাস বলেছেন :

আমি তোমার অধীন, হই চিরদিন, তোমার প্রত্যাশী
আনিয়াছ, আসিয়াছি, যেতে বললে তৈয়ার আছি
নাচাইতেছ, নাচিতেছি, বসতে বললে বসি
তুমি করাও আমি করি, না করাইলে কি আর পারি
কাঁদাও যখন কেঁদে মরি, হাসাইলে হাসি
আমি কিসে দোষী দয়াল আমি কিসে দোষী।

তাঁর জন্মস্থান নরসিংদী-পলাশ-পারুলিয়ায় পূর্ব থেকেই বাউল-ফকিরদের পদচারণা ছিলো। ছিলো কবিগানের চারণভূমি। নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষের মিলে-মিশে বাস। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁরা একসাথেই থাকে। স্বাভাবিকভাবেই তা দ্বিজদাসকেও প্রভাবিত করেছে। এক জায়গায় লিখেছেন :

রাম রহিম না জুদা ভাবো আসল ঠিক রাখিও ভাই।

ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে দ্বিজদাস গভীর জ্ঞান রাখতেন, যা তাঁর গানের কথায় বিভিন্ন জায়গায় এসেছে।

এক বিনে দুজন নাই।

আবার মৃত্যু নিয়ে তাঁর কতো চমৎকার অভিলাষ :

যে জন জানে, মরণ কি বিষয়
মধুরেণ সমাপণ, তার মরণ মধুমেয়।

জন্মান্তরবাদ, সমাজ-সংসার, যুক্তি, কামতত্ত্ব, মানুষ ভজন, শ্যামাসঙ্গীত, দেশাত্ববোধক প্রভৃতি বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যময় গানের ঝাপি নিয়ে বাংলা সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করে গেছেন দ্বিজদাস। অথচ আজ কোথাও তাঁর স্মৃতিচিহ্নটুকু পর্যন্ত নেই। এর ফলে একদিকে তাঁর মহামূল্যবান সৃষ্টিগুলো যেমন হারিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে হচ্ছে বিকৃত ব্যবহার। তাঁর সৃষ্টি-সঙ্গীত ও সামাজিক অবদানগুলো সংরক্ষণ করে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে রাষ্ট্র উদ্যোগী হবে, এটাই প্রত্যাশা। শেষ কথা, দ্বিজদাসের স্বপ্নের ভাষায় আশাবাদী উচ্চারণ :

সময়ে ফুল ফুটবে সত্য
গোড়ায় জল ঢাল নিত্য।


মো. জাকারিয়া
কবি ও গবেষক।

আমীরগঞ্জের ইতিহাস | পর্ব ৩

0

ফরাজে ও লাখেরাজ ভূমি ও পত্তনী মালিকানা ১৪৭ টাকা মূল্যে বিক্রয়ের সাফ কবলা হইয়াছে বির্দ্দরী মির্জা মোহাম্মদ, পিতা- মৃত মির্জা মোহাম্মদ কাজেম, সাকিন- চান্দখার পোল ও শ্রীমতি বনী বেগম, পতি- শ্রী মৌলভী মকরেম আলী, সাকিন- বড় কাটারা, থানা- সদর, জাতি- মোসলমান, পেশা- তালুকদারী, জেলা- ঢাকা স্থানে লিখিতং, শ্রী মীর গোলাম হোসেন, পিতা- মৃত ইয়াদ ওয়ারেছ আলী, জাতি- মোসলমান, পেশা- জমিদারী, সাকিন- গের্দ্দ হুসনি দালান, ঢাকা সদর, জেলা- ঢাকা কোট মৌজাস্থিত লাখেরাজ জমি ও পত্তনী ও মিরাশি জমি ও ওয়ার্কফ ইষ্টাটের মোল হেবা ও হাবেলী ঘর তৎতহতি জমিন ইসাদি বিক্রয় সাফ কবলা পত্র মিদং কার্যাঞ্চে আমি আমার কন্যা মৃত মরিয়ম নেছা বেগমের ওয়ারিশপ্রাপ্ত নিম্ন তফসিলের লিখিত চৌহদ্দি ভুক্ত ষোল আনি বিত্তের দুই আনা অংশ অন্যের নিরাপত্তে মালিক দখলকার আছি ঐ বিষাদির দুই আনা হিস্যা আমি আপন অধিকার মতে উচিত মূল্য মবলক ১৪৭ টাকাতে সাফ বিক্রয় করার উদ্যত হইলে, তোমরা উক্ত মৃত বেগমের পুত্র ও কন্যা ও আমার দৌহিত্র দৌহিত্রি বিধায় এবং মৃত বেগমের বক্রি দুই আনা অংশের মালিক তোমরা যথায় আমা হইতে ঐ দুই আনা অংশের খরিদ করার উদ্যত হওয়ায় আমি আমার প্রাপ্য দুই আনা অংশের মধ্যে এক আনা অংশ তুমি মির্জা মোহাম্মদ নিকট মং ৭৩ টাকা আট আনা মূল্যে ও এক আনা অংশ তুমি শ্রী মতি বনি বেগম নিকট মং ৭৩ টাকা আট আনা মূল্যে একুনে উভয়ের নিকট মং ১৪৭ একশত সাত চল্লিশ টাকা নগদ দস্ত বদস্ত বেবাক বুঝিয়া পাইয়া আপন ইচ্ছায় ও সৎজ্ঞানের রাজি রগবতে বহাল তবিয়তে সাফ বিক্রয় করিয়া লিখিয়া দিতেছি ও অঙ্গিকার করিতেছি যে, নিম্নের তপসিলের লিখিত বিষাদির আমার প্রাপ্ত দুই আনা অংশ কাত তোমরা উপরোক্ত অংশানুসারে আপন ২ পুত্র ওয়ারিশ ও স্থলবর্তি গণক্রমে অংশানুসারে সদর খাজনা ও মিউনিসিপালিটি টেকস মতে আদায় করিয়া আমার নাম খরিজে আপন ২ নাম অংশ মতে রেজিষ্ট্রারী করিয়া প্রজা উঠাইয়া কি বানাইয়া রাস্তা বাগান বানাইয়া হাবেলী ইসাদি ভাংগিয়া কি উক্ত নাল করিয়া প্রজাগণ হইতে কর কবুলিয়ত লইয়া দিঘি পুস্কনি খনন করিয়া দান বিক্রয় সর্ব প্রকার কন্যধিকারী হইয়া পরম সুখে ভোগ বিনিত্তগ দান বিক্রয় দখল তছরূপ করিতে রহেন। নিম্ন লিখিত বিষাদির আমার ওয়ারিশ প্রাপ্ত উক্ত দুই আনা অংশে আমি ও আমার পুত্র পৌত্রাদি ওয়ারিশ ও স্থবর্ত্তি গণ ও ভাবি উত্তরাধিকারীগণের সর্ব প্রকার দাবী দাওয়া সম্পূর্নরূপে রহিল না ও রহিলেক না, করিলে অগ্রাহ্য হইবেক। আর প্রকাশ থাকে যে, নিম্নের লিখিত ২/৩/৪/৫ নং সম্পত্তি ভিন্ন অন্য কোনো সম্পত্তি কেহর নিকট দায়বদ্ধ নাই। তপছিলের লিখিত ২/৩/৪/৫ নং সম্পত্তি দায়বদ্ধ থাকা ও বক্রি সম্পত্তি নির্দায় অবস্থায় থাকা এবং তপছিলের লিখিত সমস্ত সম্পত্তি কেহর নিকট কোন বয়, হেবা ও দান বিক্রয় মিরাশ পত্তনী কি দর পত্তনি কি কম জমায় ইজারা ইসাদি করি নাই ও দেই নাই তাহা তোমাদের নিকট প্রকাশ করায় তোমরা আমার আত্মীয় বিধায় আমার কথা বিশ্বাস করিয়া বিনা অনুসন্ধানে ও বিনা যাচাইতে খরিদ করিলা যদি খরিদের পর আমার উল্লেখিত কোন কার্য প্রকাশ পায় তাহাতে তোমাদের অনিষ্ট ঘটে তাহা হইলে আমি আইনানুসারে ফৌজদারিতে দণ্ডনিয় হইব, এতদ্বার্থে মূল্যের সমস্ত টাকা অংশানুসারে তোমাদের স্থানে নগদ দস্ত বদস্তে বুঝিয়া পাইয়া আপন ইচ্ছায় দলিলের সমস্ত মর্মর্থ ভাল মত পাঠ করিয়া ও বুঝিয়া শুনিয়া অত্র সাফ কবলা লিখিয়া দিলাম। ইতি সন ১৩০৮ সন ২১ শে অগ্রাহায়ন তপছিল সম্পত্তি ১/১২৬৯ সালের ১৪ ভাদ্রের লিখিত মৃতে ছৈয়দ আলী মেহেন্দী খা বাহাদুরের স্ত্রী মৃত মরিয়ম বেগম সাহেবার ওয়ার্কফ নামার লিখিত জেলা ঢাকার কালেক্টরীর তৌজি ভূক্ত ৯৯৬৫ নং জমিদারী তপে রন ভাওয়াল হিঃ। চার আনা ১৫ গন্ডা মরিয়ম বেগম ও আমিনদ্দিন হায়দর ও ৬৪৪৭ নং ডেয়ারা বন্দবস্ত ভূমি চরকান্দা ও পাবনীরা ও রায়পুরা পোলিশ স্টেশন ও সাব রেজিষ্টারের অধীন জোয়ার হাসনাবাদ তাহার চার আনা নয় গন্ডা ও ৯৯৫৪ নং তালুকের হিঃ চার আনা ১৫ গন্ডা অংশ স্থাবর তাহার মোতাউল্ল আমি গোলাম হোসেন ঐ মোতাউল্ল ইষ্টেটের হইতে মৃত মরিয়ম নেছা বেগম বার্ষিক ৬০ টাকা মালিকানা পাওয়ার অধিকারী ছিল। ঐ ৬০ টাকা মালিকানা ষোল আনা বয়সে মৃত মরিয়ম নেছা বেগমের ওয়ারিশ সূত্রে দুই আনা অংশ আমি অত্র সিকিউরিটি ঐ দুই আনা অংশের রাখা ৭ টাকা ৫ আনা বার্ষিক মালিকান বিক্রি করিলাম (১২৯৮ সালের ১৯ পৌষের লিখিত পত্তনী কবুলত পাট্টা আবু আহাম্মদ আবদুল বাছেদ লকনগ মোতউল্লির পক্ষে উনছ খান, পিতা মৃত মৌলভী আলীমুদ্দিন আহম্মদ নিকট প্রাপ্ত ৯৯৬৫ নং জমিদারী তপে রনভাওয়াল হিঃ চার আনা ১৫ গন্ডা জমিদারী বনামে আমিরদ্দিন হায়দর ও মরিয়ম বেগম সদর জমা ১৭১৯ টাকা ছয় আনা ৮ পাই জেলা ঢাকার রায়পুরার পুলিশ ষ্টেশন ও সাব রেজিষ্টারের অধিন পোক্তার চর মধুয়া মধ্যে মৌজা বিরগাও ও আলিয়াবাদ ও লক্ষীপুরা ও মরিয়ম নগর ও গাজীপুরা গং পোক্তার হাসনাবাদ মধ্যে মৌজা ফতেপুর, দরি হাইর খারা ও বির হাইর খারা ও জেলা ত্রিপুরার অধিন দাউদকান্দি থানা ও সাব রেজিষ্টারের অধীন পোক্তার মৃজার চর ও মৌজা আমিরাবাদ ও ভিটিগাও বাঘাকান্দি ও গোদাকান্দি মৌজা রায়পুর ও সিন্দি ও মুরাদনগর পোলিশ ষ্টেশন ও সাব রেজিষ্টারের অধীন মৌজে খোয়ার চর ও জেলা ফরিদপুরের অধিন পালঙ্গের থানা সাব রেজিষ্টারের অধীন মৌজে পাইকতলি ও শখিপুরা ৯৯৫৪ নং তালুক খলিলের রহমান সদর পক্ষে ২১০ টাকা ৭ আনা ২ পাই যে নিযুক্ত আছে উক্ত তালুকের ভুমি জেলা ঢাকার রায়পুরার পোলিশ ষ্টেশন ও সাব রেজিষ্টারের অধিন পোক্তার হাসনাবাদ মধ্যে মৌজে নলবাটা ও আমির গঞ্জ ও করিম গঞ্জ ও আগানগর ও হাসনাবাদ মৌজে পূর্ব পারা ও পশ্চিম পারা ও বিঃ পূর্ব পারা ও মির কান্দি ও নেবুর কান্দি ও আট কান্দি ও হাট হাসনাবাদ উক্ত জমিদারী (৯৯৬৫ নং তালুক) ও তালুকের (৯৯৫৪ খারেজী তালুক খলিলুর রহমান) সোলা আনার সে হিঃ ৭ আনা ৮ গন্ডা মৃত মরিয়ম নেছা বেগমের মৃত মাতা খায়রুন নেছা ওরফে নতে বেগমের ওয়ারিশি মতে ও মৃত মরিয়ম নেছা বেগমের পিতা মির গোলাম হোসেনের হেবা সূত্রে ২ আনা ৮ গন্ডা একুনে ১০ আনা অংশ জাহা উক্ত সন তারিখের পত্তনী কবুলত পাট্টা অনুসারে সদর খাজনা ও পথবর পাবলিক ওয়ার্ক ছেদ ও ডাক টেকস ইসাদি বাদে জমিদারীর বার্ষিক পত্তনী খাজনা ১০০ টাকা তালুকের বার্ষিক পত্তনী খাজনা ৪৪ টাকা একজাই মং ১৪৪ টাকা মালিকানা খাজনা উক্ত আবু আহাম্মদ আবদুল বাছেদ নিকট পাত্তা ন্যায় উক্ত মালিকানা খাজনার টাকার মধ্যে ষোল আনা রকমের ২ আনা অংশে বার্ষিক মং ১৮ টাকা পাত্তা জায় তাহা…

এমতাবস্থায় ৯,৯৬৫ নং জমিদারি ঢাকা কালেক্টরিতে প্রায় ১৪ বছর অংশীদারদের যথাযথ স্বত্ব বণ্টনাধীনে থাকে তদোপলক্ষে মীর গোলাম হোসেন সাহেব এর কতোক অংশ (সম্ভবত শুধু খলিলুর রহমানের তালুক থেকে সৃষ্ট ১৩,১৭৩ নং মহালটি) বাংলা ১৩১২ সনের ২৯ শ্রাবণ তারিখে ওয়াকফনামাভুক্ত সম্পত্তি দাউদকান্দি থানার কাশীপুর গ্রাম নিবাসী পোকন চন্দ্র কর্মকারের পুত্র রাজচন্দ্র কর্মকারের নামে পত্তনী বিলি করেন, যা আইনত বে-আইনি ও অগ্রহণযোগ্য। কারণ, গোলাম হোসেন মরিয়ম বেগমের ওয়াকফ সম্পত্তির তার প্রাপ্য সমুদয় স্বত্ব ইতোপূর্বে বাংলা ১৩০৮ সনের ২১ অগ্রহায়ণ তারিখে বিক্রি করে দিয়েছেন। তদানুসারে রাজচন্দ্র কর্মকার ও তাহার ভ্রাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্র ঐ-সকল সম্পত্তি দখল করতে থাকে। প্রায় চার বছর পর রাজচন্দ্র কর্মকার উক্ত পত্তনপ্রাপ্ত ১৩,১৭৩ নং মহালের তালুকদারির স্বত্বের আট আনা অংশ ঢাকার ১৩ নং বেচারাম দেউরী নিবাসী মৌলভী আলীমুদ্দিনের নিকট বাংলা ১৩১৬ সনের ২২ মাঘ তারিখে বিক্রি করে দেন। উল্লেখ্য যে, এই মৌলভী আলীমুদ্দিনের জন্মস্থান হাসনাবাদ গ্রামে, তার পিতার নাম মৌলভী জমির উদ্দিন। তিনি ঢাকার নবাব বাড়িতে মুন্সির চাকরি করতেন এবং বগুড়ার নবাব বাড়ির নবাব কন্যাকে ছলচাতুরির মাধ্যমে বিবাহ করেন। তিনি আটকান্দির কুঠিবাড়ি মসজিদ নির্মাণ করেন। উল্লেখ্য যে, আমার গ্রাম আমীরগঞ্জ ও করিমগঞ্জের ১৩,১৭৩ নং তৌজি বা মহালের সেটেলমেন্ট জরিপের সিএস পর্চায় পত্তনী তালুকদারের নাম রাজচন্দ্র কর্মকার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। রাজচন্দ্র কর্মকারের ৪৬৮ নং তালুকের অংশ আট আনা এবং মৌলভী আলীমুদ্দিনের ৪৬৯ নং তালুকের অংশ আট আনা ও রাজচন্দ্র কর্মকার আবার তার তালুক নং ৪৬৮-র আট আনার খাজনা আদায় করে দেয়ার শর্তে অর্ধেক অর্থাৎ চার আনা আমীরগঞ্জ নিবাসী সদর উদ্দিন বেপারী গংদের নিকট দরপত্তন দেন। অর্থাৎ সদর উদ্দিন গং রাজচন্দ্রের অবশিষ্ট পত্তনী তালুকের খাজনা আদায় বাবদ ৪৬৮-ক নামীয় তালুকের একটি মধ্যস্বত্ব লাভ করেন।

এদিকে মির্জা মোহাম্মদ, মরিয়ম বেগমের মৃত্যুর প্রায় ৩৩ বছর পর মরিয়ম বেগম পাবলিক ওয়াকফ এস্টেটের মালিকানা ও দখল পুনরুদ্ধার নেয়ার নিমিত্তে অপেক্ষমান থাকেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা কালেক্টরিতে ওয়াকফ এস্টেটের বেনিফিশিয়ারি ও মোতয়াল্লী হিসেবে নিজের আইনগত ভিত্তি ও মালিকানার অধিকার অর্জনের অপেক্ষমান থাকাবস্থায় বৃটিশ সরকার কর্তৃক ১৯১৩ সালে ভারতীয় মুসলমান ওয়াকফ ভেনিডেটিং আইন গঠিত হয় এবং ১৯৩৪ সালের বঙ্গীয় ওয়াকফ আইন জারি হয়। কিন্তু ইতোমধ্যে কোনো-এক সময়ে মির্জা মোহাম্মদের মৃত্যু হয়। মির্জা মোহাম্মদের মৃত্যুর পর তার পুত্র মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ ঢাকা কালেক্টরির তৌজিভুক্ত ৯,৯৫৪ নং মহালের ষোলো আনা (চার আনা ১০ গণ্ডা) ও ৯,৯৬৫ নং মহালের (তিন আনা ১০ গণ্ডা)-সহ অন্যান্য মহালকে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করার জন্যে ১৪ঃয ঈডঘ কলিকাতা হাইকোর্টে এক আর্জি দায়ের করেন। ফলে কলকাতা হাইকোর্ট ‘মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেট’কে পাবলিক ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে বৈধ প্রমাণ করেন। তারপর তিনি কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিংয়ে অবস্থিত বঙ্গীয় ওয়াকফ প্রশাসকের কার্যালয়ে ১৯৩৪ সালের বঙ্গীয় ওয়াকফ আইনের ৪৪ ধারা মোতাবেক মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেটকে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার লক্ষ্যে বঙ্গীয় ওয়াকফ কমিশনার সাহেব বাহাদুর বরাবর প্রয়োজনীয় দালিলিক প্রমাণাদিসহ দরখাস্ত দাখিল করেন। ফলে মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেটকে বঙ্গদেশীয় মহামান্য ওয়াকফ বোর্ড ও কমিশনার কর্তৃক উক্ত এস্টেট ওয়াকফ আইনের ৪৬ (ক) ধারার বিধান মোতাবেক ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে মীমাংসিত হইয়া ওয়াকফ বোর্ডে রক্ষিত রেজিস্ট্রারিতে ৪,৭২১ নং ওয়াকফ এস্টেট হিসেবে ইনরোলড হয়। পরবর্তীতে মির্জা মোহাম¥দ আশরাফ ২২ নভেম্বর ১৯৩৭ তারিখে সেন্ট্রাল কোর্ট, ২ চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ে অবস্থিত ওয়াকফ বোর্ডের কমিশনার বরাবর কমিশনার কর্তৃক পূর্বে প্রেরিত পত্র, যার স্মারক নং সি/৮২৫১, তারিখ ১০ নভেম্বর ১৯৩৭-এর জবাবে মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেটের তার মালিকানার স্বপক্ষে ঢাকা কালেক্টরির ৯,৯৫৪ ও ৯,৯৬৫ নং তৌজিভুক্ত তালুকদার ও কবুলিয়ত প্রজাদের দুটি পৃথক তালিকাসহ দালিলিক প্রমাণাদি দাখিল করে তাকে উক্ত ওয়াকফ স্টেটের দখলদারের ক্ষমতা প্রদান ও মোতওয়াল্লী হিসেবে গ্রহণ করার জন্যে আবেদন করেন। আবেদনে তিনি ৯,৯৫৪ নং মহালের চার আনা ১০ গণ্ডা (ষোলো আনা) ও ৯,৯৬৫ নং মহালের তিন আনা ১০ গণ্ডা (ষোলো আনা) শেয়ার দাবি করে নির্দিষ্ট প্রজাদের নিকট থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে তার নামে দুটি মহালের নাম জারি করতে এবং ঢাকা কালেক্টরির ‘ডি’ রেজিস্ট্রার সংশোধন করতে ঢাকা কালেক্টরকে আদেশ প্রদান করার জন্যে অনুরোধ করেন। মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে মরিয়ম বেগমের ওয়াকফ সম্পত্তির মূল্য উল্লেখ করেছেন তৎকালীন সময়ের ২,০৫,০০০ টাকা। উপর্যুক্ত বিষয়ের প্রামাণিক দলিলাদির ছায়ালিপি এই নিবন্ধের লেখকের নিকট রক্ষিত আছে।

অবশেষে মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ তার আবেদনের প্রেক্ষিতে মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেটের ৯,৯৫৪ ও ৯,৯৬৫ নং তৌজিভুক্ত তালুকের মোট দশ আনার স্বত্ববান ও মোতয়াল্লী হিসেবে ওয়াকফ আইনের ৪০ ধারার বিধান মোতাবেক বেঙ্গল ওয়াকফ বোর্ডের কমিশনার কর্তৃক গণ্য হন।

অতঃপর মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ সম্পূর্ণ ওয়াকফ এস্টেটের মোতয়াল্লীভাবে দখল করে ঢাকা দ্বিতীয় সাব-জজ আদালতের ১৯৪০ সালের ২১ নং দেওয়ানী মোকদ্দমা স্থাপনে ডিক্রি লাভ করেন এবং ঢাকা কালেক্টরিতে ওয়াকফকৃত উপর্যুক্ত মহাল (৯,৯৫৪ এর ১৩,১৭৩, ১৫,৭৮৩ ও ১৫,৭৮৪ এবং ৯,৯৬৫ নং মহাল) ও অন্যান্য মহালসমূহের নামজারিক্রমে মোতওয়াল্লীভাবে মালিক ও দখলকার হিসেবে ঢাকা কালেক্টরিতে রক্ষিত ‘ডি’ রেজিস্ট্রার সংশোধন হয়ে মির্জা মোহাম্মদ আশরাফের নাম লিপিবদ্ধ হয়। উক্ত দ্বিতীয় সাব-জজ আদালতের উক্ত মামলার রায় ও ডিক্রি দ্বারা মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেটের ওয়াকফ প্রভৃতির বিরুদ্ধে যেসব হস্তান্তর বা অষরবহধঃরড়হ হয়েছে, উক্ত সমুদয় হস্তান্তরই আইনত পণ্ড, ভুয়া, তঞ্চকী ও যোগসাজসী বলে সাব্যস্ত হয়েছে এবং উক্ত ডিক্রিবলে উপর্যুক্ত ওয়াকফ মহালান্তর্গত যে সমুদয় পত্তনী, সিকিমী পত্তনী, দত্ত পত্তনী বা অন্য প্রকার স্থায়ী মধ্যস্বত্বের লিপি সেটেলমেন্ট জরিপী (সিএস) রেকর্ডে প্রকাশ পায়, তা সমুদয়ই পণ্ড, ভুয়া, বে-আইনি, তঞ্চকী ও যোগসাজসী। অতঃপর তিনি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ঢাকার কোর্ট বরাবর বিবাদী রাজচন্দ্র কর্মকারের বিরুদ্ধে একটি মিস কেইস (নং ৬৪) দাখিল করেন, পূর্বের বে-আইনিভাবে নামজারি বাতিল ও মরিয়ম বেগমের ওয়াকফ এস্টেটের মোতওয়াল্লী হিসেবে তার ব্যক্তিগত বার্ষিক আর্থিক ভিত্তি নির্ধারণের জন্যে। বার্ষিক আর্থিক ভিত্তি নির্ধারণের পর মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ রাজচন্দ্র কর্মকার, আলীমুদ্দিন মৌলভী ও অন্যান্য ভূমধ্যধিকারীর নিকট অদ্যাবধি ১ নং তফসিলের তার আইনত প্রাপ্ত জোতের ষোলো আনার অর্থ এবং ২ নং তফসিলের সমুদয় পথকরসহ বকেয়া কর পরিশোধের জন্যে তাগাদাপত্র প্রেরণ করেন। কিন্তু বিবাদীগণ উক্ত টাকা পরিশোধ করেন নাই। ফলত পরবর্তীতে মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ উপর্যুক্ত বে-আইনি হস্তান্তরের জন্যে দাতা মীর গোলাম হোসেন ও হস্তান্তর গ্রহীতা পত্তনী তালুকদার রাজচন্দ্র কর্মকার, ভূমধ্যধিকারীর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চাহিয়া ঢাকা মুন্সেফ আদালতে এক নালিশী মামলা দায়ের করেন। এদিকে আমীরগঞ্জ, করিমগঞ্জ ও নলবাটায় রাজচন্দ্র কর্মকার থেকে চার আনা দরপত্তনধারী সদর উদ্দিন বেপারীগণ খাজনা আদায়ের চেষ্টা করলে আমীরগঞ্জ নিবাসী আফসার উদ্দিন মৌলভী, ছৈযুদ্দিন মৌলভী, সুরুজ খা এবং করিমগঞ্জের কাবিল মৃধা, পিতা : আলাবক্স মৃধা, ওয়াকফ সম্পত্তিতে বে-আইনিভাবে পত্তন পাওয়া জমিতে খাজনাদি পরিশোধে অস্বীকার করেন এবং সদর উদ্দিন বেপারী গংদের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ মুন্সেফ আদালতে নালিশী মামলা দায়ের করেন, যা এই প্রতিবেদক খাঁ বাড়ির রুকুন উদ্দিন খাঁ’র মুখে ও অন্যান্য বয়স্কদের মুখে শুনেছেন।

প্রাপ্ত উপর্যুক্ত কার্যাদি সমাধান্তে পূর্ব বাংলায় কৃষক প্রজা পার্টি আনিত জমিদারি উচ্ছেদ তথা রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এসে যাওয়ায় মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ জমিদার সাহেব মরিয়ম বেগমের জমিদারি ও খলিলুর রহমানের খারেজী তালুকের নিজ স্বত্ব ও মোতয়াল্লী হিসেবে বেশি সুবিধা করতে পারেননি। খাজনা আদায়ের রশিদ প্রমাণে দেখা যায়, এ-জনপদে মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ ২৪ আষাঢ় ১৩৬৫ বঙ্গাব্দ তারিখ পর্যন্ত কর্মচারীসহ নিজে খাজনাদি আদায় করতে পেরেছিলেন। অবশেষে মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ ১৯৮১ সনের ১৭ জুলাই ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন (মৃত্যুসনদ মোতাবেক)। মৃত্যুকালে তিনি পাঁচ ছেলে ও দুই কন্যা রেখে যান। প্রথম পুত্রের  নাম মির্জা খোরজো আয়ায, দ্বিতীয় পুত্রের নাম মির্জা খুসরু, তৃতীয় পুত্রের নাম মির্জা খোরুম, চতুর্থ পুত্রের নাম মির্জা দিলশাদ ও পঞ্চম পুত্রের নাম মির্জা নেহাল। কন্যাগণ হলেন নাজমা ও নিজাকাত। পুত্রদের মধ্যে দুজন জীবিত আছেন। একজন ইরানে বসবাস করেন এবং বাংলাদেশে মির্জা নেহাল সাহেব সপরিবারে বসবাস করছেন। জাতীয় পরিচয়পত্রে মির্জা নেহাল সাহেবের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে ১ নং ইটাওয়ালা ঘাট, ইসলামবাগ পশ্চিম, লালবাগ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা। এনআইডি নং ২৩৫৯১৪০০২৩। বর্তমানে তিনিই বাপ-দাদাদের হারানো জমিদারির প্রামাণি, দলিল-দস্তাবেদ সংরক্ষণ করছেন, যদি কখনো হারানো জমিদারি পুনরুদ্ধার বা ক্ষতিপূরণ আদায়ে প্রামাণ্য দলিল-দস্তাবেজের প্রয়োজন হয়।

উপর্যুক্ত আলোচনা, বিভিন্ন প্রামাণিক দলিল-দস্তাবেজ, তৎকালীন ভূমি বন্দোবস্ত, একসালা, দশসালা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন ও ওয়াকফ আল আওলাদ আইন পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, আমার আমীরগঞ্জ গ্রাম বা এ-জনপদে স্থানীয় কোনো ভূস্বামী জমিদার বা তালুকদার শ্রেণির কেউ ছিলো না। দাউদকান্দির রাজচন্দ্র কর্মকার এই জনপদের খলিলুর রহমান নামীয় খারেজী তালুকের কিয়দাংশ (যা মরিয়ম বেগমের জমিদারি ও পরে মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেট হিসেবে গণ্য ছিলো) অবৈধভাবে মীর গোলাম হোসেন থেকে পত্তন নিয়েছেলেন। তবে একসময়ের হাসনাবাদ নিবাসী আটকান্দি মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মৌলভী আলীমুদ্দিন এবং তার সুযোগ্য পুত্র মৌলভী আবু আহম্মদ বাছেতের মির্জানগর, আটকান্দি, বীরকান্দি, আব্দুল্লাপুরসহ ঢাকার কেরানীগঞ্জের মতো দূর জনপদে কয়েকটি বৈধ তালুক ছিলো, যা তিনি ইংরেজ নীলকর ও মুঘল ঘরানার জমিদার থেকে পত্তন নিয়েছিলেন। আলীমুদ্দিন মৌলভী তার পত্নী (বগুড়ার নবাবের মেয়ে) বিয়োগের পর আমীরগঞ্জ ও করিমগঞ্জের ১৩,১৭৩ নং মহালের তার আট আনার অংশ ওয়াকফ করে দেওয়ায় উক্ত গ্রামদ্বয়ের রায়তদের কোনো খাজনা পরিশোধ করতে হয় নাই। অনেকেই আমীরগঞ্জের সদু বেপারী গংদের দৃষ্টিনন্দন দ্বিতল কোঠাবাড়ি ও একতলা বৈঠকখানা দর্শন করে সদু বেপারী গংদের জমিদার মনে করে বিভ্রান্ত হন। মূলত তারা ছিলেন হলুদ, গুড়, পাটের বেপারী ও রেলওয়ে জমির ইজারাদার এবং  অবৈধ ও বে-আইনিভাবে প্রাপ্ত পত্তনী তালুকদার রাজচন্দ্র কর্মকারের অবশিষ্ট আট আনা পত্তনী তালুকের চার আনার মধ্যস্বত্বাধিকারী, যা তারা রাজচন্দ্র কর্মকারের পক্ষে খাজনা আদায় করার শর্তে প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তবে মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ মরিয়ম বেগমের জমিদারির আইনগত মোতওয়াল্লী হলে এবং আমীরগঞ্জ ও করিমগঞ্জের রায়তগণ সদু বেপারী গংদের খাজনা দিতে আপত্তি জানালে সদু বেপারী গং এই মধ্যস্বত্বের কোনো ফায়দা নিতে পারেন নাই। রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ পাশ হয়ে গেলে ১৯৫৭ সাল থেকে ভূমির মালিকানা হয়ে যায় রাষ্ট্রের। তখন থেকে বঙ্গীয় কৃষক ও রায়তগণ জমিদার ও তালুকদারদের পরিবর্তে রাষ্ট্রকে খাজনা দিতে শুরু করেন। (সমাপ্ত)


আমির হোসেন
গবেষক, আয়কর পরিদর্শক

আমীরগঞ্জের ইতিহাস | পর্ব ২

0

রাণী ভিক্টোরিয়ার আমলে ভূমি বন্দোবস্ত (১৮৫৭-১৯৪৭)
পরবর্তীকালে খলিলুর রহমান তালুকের অংশীদারদের উত্তরাধিকার বা বেনেফিশিয়ারগণ হাসনাবাদ মৌজায় আমীরগঞ্জ বা হাসনাবাদ বাজারের মূল অংশ তিনজন ভূমধ্যধিকারীর নিকট কবুলত পাট্টা দেন। পূর্বোক্ত হাসনাবাদ বাজারস্থ তিনটি  সিএস পর্চার খতিয়ান নং যথাক্রমে ৩৭৫, ৩৭৬, ৩৭৭।  সিএস পর্চার ক্রমানুসারে এই তিনটি ভূমধ্যধিকারীগণ হলেন (খতিয়ানের ক্রমানুযায়ী) আমীরগঞ্জের সোনা উল্লাহ ভূঁইয়া (পিতা : কোবাদ ভূঁইয়া), রহিমাবাদের হরচন্দ্র সাহা (পিতা : কিশোর সাহা) ও আমীরগঞ্জের সদর উদ্দিন বেপারী (পিতা : আছান উল্লাহ বেপারী)। খলিলুর রহমান তালুকের পশ্চিম অংশ, আড়িয়াল খাঁ নদের তীরঘেঁষা বর্তমান আমীরগঞ্জ ও বৃহত্তম করিমগঞ্জ, ১৩১৭৩ নং মহালটিকে রাজচন্দ্র কর্মকারের নিকট পত্তনী তালুক হিসেবে পত্তন দেয়া হয়। বর্তমানে উক্ত গ্রামদ্বয়ের সিএস পর্চা তার সাক্ষ্য বহন করছে। উল্লেখ্য, উপর্যুক্ত খলিলুর রহমানের খারেজী তালুকটি বিস্তৃত ছিলো আমীরগঞ্জের পূর্ব ও পশ্চিম চক করিমগঞ্জ, নলবাটা, আগানগর, হাসনাবাদ পূর্বপাড়া, পশ্চিমপাড়া, মীরকান্দি (বীরকান্দি), নেবুরকান্দি, আটকান্দি ও হাসনাবাদ বাজার পর্যন্ত। পরে আমার এক অনুসন্ধানে তার সঠিক ইতিহাস বের হয়ে আসে, যার বিস্তারিত বিবরণ সামনে পর্যায়ক্রমে আসবে। এ-সকল গ্রাম ছিলো খলিলুর রহমান তালুকের ৪ আনা ১০ গণ্ডার অংশ, যা জমিদার মরিয়ম বেগমের অংশ। অবশিষ্ট অংশ ছিলো অন্যান্য শরিকগণের। এখানে উল্লেখ্য যে, মৃত মরিয়ম বেগমের ১৩১৭৩ নং মহালের রায়ত ছিলেন পুটিয়ার রাম কুমার নাথ (ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছেÑ থানা : রায়পুরা, জেলা : নরসিংদী) নরসিংদী সদর উপজেলাধীন বীরপুরের রামারুদ্দিন, মুলকজান, রাধা গোবিন্দ সাহা ও হরি গোবিন্দ সাহা। বর্তমান এ-নিবন্ধ লেখার (১১ এপ্রিল ২০২২) খানিক পূর্বে আমার অগ্রজ জাকির ভাই (দলিল লেখক)-এর কল্যাণে আমাদের গ্রামের এক কৃষক পরিবার কর্তৃক জমিদারদের জমির খাজনা প্রদানের প্রমাণপত্র (প্রজার অংশ) দাখিলা আমার হস্তগত হয়। ২৪ আষাঢ় ১৩৬৫ বঙ্গাব্দ তারিখে আদায়কৃত ১৩৬০-৬১ বাংলা সনের খাজনার লিখিত দাখিলা পাঠে দেখা যায়, জিলা ঢাকা কালেক্টরির তৌজিভুক্ত ১৩১৭৩ নং মহাল, ১০ ওয়াকফ এস্টেট, থানা : রায়পুরা, ৩৭২ নং মৌজা হাসনাবাদ প্রকাশ রণভাওয়াল হিং ১, ষোল আনা মালিক দখলকার মোতোয়াল্লী মৌলভী মির্জ্জা মোহাম্মদ আশ্রাফ জমিদার সাহেব, সাকিন : ২৫ নং বড় কাটারা, থানা : লালবাগ, ঢাকা। উক্ত দাখিলায় মরিয়ম বেগম জমিদারির নিচে ব্র্যাকেটবন্দী খারিজা তালুকদার খলিলুর রহমানের নাম উল্লেখ আছে, প্রজার নাম ছমির খা (পিতা : মৃত আমির খাঁ, গ্রাম : আমীরগঞ্জ। দাখিলায় যার মাধ্যমে খাজনা প্রদান করা হয়েছে, তার দস্তখতে নাম লিখা আছে রুকুন উদ্দিন খাঁ (পিতা : ছমির খা)। সেই হিসেবে রুকুন উদ্দিন খাঁ’র সাথে দাখিলার সত্যতা নিয়ে আমার সাথে কয়েকবার আলাপচারিতা হয়। তিনি জানান, তিনি নিজে এই স্বাক্ষর দিয়েছেন এবং মির্জা মোহাম্মদ আশ্রাফকে স্বচক্ষে দেখেছেন। এটি পাওয়ার পর আমার এ-জনপদের পূর্বের জমিদার ও তালুকদারদের ধারণা পাল্টে যায় এবং আমি এ-জনপদের ভূমি মালিকানা ইতিহাসের এক তমসাচ্ছন্ন অধ্যায়ে পড়ি। ভাবতে থাকি, কে কার থেকে পত্তনী নিয়েছেন? এই জনপদের সিএস পর্চায় উল্লেখিত রাজচন্দ্র কর্মকার কার থেকে পত্তনী নিয়েছেন?  কারণ, দাখিলা পাঠে জানা যায় যে, এ-জনপদ ঢাকা (২৫ নং বড় কাটারা, থানা : লালবাগ) নিবাসী মুঘল অমাত্যের বংশধর মরিয়ম বেগমের ওয়াকফ এস্টেট এবং এই মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেটের সর্বশেষ মোতয়াল্লী ও মালিক হলেন মির্জা মোহাম্মদ আশ্রাফ। কয়েক বছর পূর্বে আমার চাচাতো ভাই জনাব কাঞ্চনের কাছে স্থানীয় জমিদারদের নাম জানতে চাইলে তিনি ঢাকার লালবাগের এক মির্জা আলীর নাম বলেন, যিনি আমীরগঞ্জে আগমন করতেন মরিয়ম বিবির মাজারের বাতি খরচ নিতে। কাঞ্চন ভাই তার পিতা রমিজ উদ্দিন মুন্সির সাথে বালক বয়সে এই মির্জাকে সিকদার বাড়ি (বর্তমান চুন্নু ও ইকবাল ভাইদের বাড়ি), বড় বাড়ি (সদু বেপারীর বাড়ি) ও খাঁ বাড়িতে দেখতে পেয়েছেন। দাখিলা পাঠের পর প্রাচীন ঢাকার উল্লিখিত ঠিকানায় সফর করার ইচ্ছে জাগে। কিন্তু সরকারি চাকরি ও আমার অসুস্থতা এই সফরের প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। গত ১ এপ্রিল ২০২২ তারিখের কয়েক সপ্তাহ পূর্বে আমি ২৫ নং বড় কাটারা সফর করি এবং জমিদার মির্জা মোহাম্মদ আশ্রাফের খান্দানের সত্যতা পাই এবং তাঁর পুত্র-কন্যাদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করি। আরো জানতে পারি যে, ২৫ নং বড় কাটারা, জমিদার মির্জা মোহাম্মদ আশ্রাফের বসত বাড়িটি ও তার পাশের ভিটি ১৯৮৬ সালে হাজী মোহাম্মদ সেলিম (একসময়ের বিএনপির এমপি, পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের এমপি) কমিশনার থাকাবস্থায় খরিদ করে নিয়েছেন, যা বর্তমানে ৩০ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়। গত ১ এপ্রিল ২০২২ তারিখে বিকাল ৪ ঘটিকায় মরিয়ম বিবি ওয়াকফ এস্টেটের মোতোয়াল্লী মির্জা মোহাম্মদ আশ্রাফের ছেলে মির্জা নেহালের সাথে দেখা হয় এবং তার সাথে মরিয়ম বিবির জমিদারি ও ওয়াকফ এস্টেট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং তিনি মরিয়ম বিবির জমিদারি ও ওয়াকফ এস্টেটের প্রায় সমস্ত দালিলিক প্রমাণাদির ফটোকপি আমাকে দেন। উক্ত প্রমাণাদি প্রাপ্তির পর উক্ত জনপদে জমিদারি ও তালুকদারির ইতিহাস আমাকে নতুন করে লিখতে হচ্ছে। প্রমাণাদি পর্যালোচনা করে অবগত হওয়া যায় যে, আমাদের এই জনপদসহ অন্যান্য স্থানের জমিদার ছিলেন মরিয়ম বেগম, যার ঢাকা কালেক্টরির তৌজি নং ৯৯৬৫ (সদর জমা ছিলো ১৭১৯ টাকা)। তবে রায়পুরার কয়েকটি ইউনিয়নে আমির উদ্দিন হায়দার ও মরিয়ম বেগমের যৌথ জমিদারি ছিলো। গুগলক্রমে বরদাখাত (ত্রিপুরার একটি পরগণার নাম) লিখে সার্চ দিলে একটি ফিচার আসে, সেখানে উপরে লেখা আছে, গভর্নমেন্ট গেজেট ১৮৯৪ সাল ১৩ই মার্চ এবং মরিয়ম বিবি হিং। ১৫ (চার আনা ১৫ গণ্ডা) পরগণা রণভাওয়াল, তৌজি নং ৯৯৬৫ নং জমিদারির অংশ দেখতে পাওয়া যায়। এই মরিয়ম বিবির জমিদারি বিভিন্ন জেলায়, বিভিন্ন পরগণায় তালুক অবস্থান ছিলো। যেমন : সাবেক ত্রিপুরা হালে কুমিল্লার হোমনা, মুরাদনগর ও দাউদকান্দি, সাবেক ফরিদপুর জেলার বেদেরগঞ্জ, সাবেক ত্রিপুরা জেলার হালে নারায়ণগঞ্জ জেলার বৈদ্যের বাজার, বর্তমান নরসিংদীর সাটিরপাড়ার তালুকদারের (সাটিরপাড়া বয়েজ ও গার্লস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ললিতমোহন রায় গং)-এর ঢাকা জিলার কেরানীগঞ্জের ২৭৬ নং তালুক, ঈশানচন্দ্র পাল গংয়ের ২৭৩ নং তালুক, মৌলভী আলীমুদ্দিন আহম্মদের ২৭৪ ও ২৭৭ নং তালুক, মৌলভী আবু আহাম্মদ আবদুল বাছেদের (যিনি মৌলভী আলীমুদ্দিনের পুত্র) ২৭৫ নং তালুক, আছমতন্নেছার ২৭৮ নং তালুকসহ সবই তপ্পা রণভাওয়াল পরগণাস্থিত, যার ভূমির অবস্থান ছিলো ঢাকা কেরানীগঞ্জ থানার ২৭৯ নং কামারঘোপ মৌজাস্থÑ এ-সকল ভূমিই মরিয়ম বিবির জমিদারি থেকে বন্দোবস্ত নেওয়া। জাহাঙ্গীরনগর পরগণার লালবাগ থানার লাখেরাজ এস্টেট, যার একজন মধ্যস্বত্বাধিকারী ছিলেন রায় আনন্দলোচন মিত্র, যা মরিয়ম বিবি ভারত সম্রাট থেকে লাখেরাজ সম্পত্তি হিসেবে বংশ পরস্পরায় মালিক হয়েছিলেন। এ-জনপদের পূর্বোক্ত আরেকজন তালুকদার ছিলেন, যার নাম খলিলুর রহমান। তার তালুকটি খারেজী তালুক ছিলো, যা অন্য কোনো বৃহৎ তালুক থেকে বের হয়ে নতুন মালিকানা সৃষ্টি হওয়াকে বোঝায়। এ-তালুকের অবস্থান ও জোত কবুলতদের বাসস্থান ছিলো বর্তমান রায়পুরা থানার আমীরগঞ্জ (বর্তমানে লেখকের জন্মস্থান) বৃহত্তর করিমগঞ্জ, হাসনাবাদ ও হাসনাবাদ বাজার, নলবাটা, আগানগর, মির্জানগর, আটকান্দি, চরসুবুদ্ধি, হাইরমারা ইউনিয়নসহ বীরকান্দি, মেহেন্নাঘর, আদিয়াবাদ, খাস উল্লাহ, পুটিয়া ও বীরপুরে (নরসিংদী)। খলিলুর রহমান তালুকের ঢাকা কালেক্টরির তৌজি নং ৯৯৫৪ এবং তার  (খারেজী তালুক খলিলুর রহমান), যার সদর জমা ২১০ টাকা। এ-তালুকে হাসনাবাদ মৌজাস্থ আরেকটি ঈশানচন্দ্র পালের ১০৪ নং মধ্যস্বত্ব দেখতে পাই, যার জোতের মালিক ছিলেন সোনা গাজী এবং দখলদার নাম হরিচরণ নাথ (পিতা : মৃত স্বরূপ নাথ)। এই খারেজী তালুকটি বিভিন্ন মহালে যেমন : ১৩১৭৩, ১৫৭৮৩ ও ১৫৭৮৪-এ বিভক্ত ছিলো। উক্ত তালুকের চার আনা ১০ গণ্ডার মালিক ছিলেন এই মরিয়ম বিবি। উপর্যুক্ত পরগণায় বিভিন্ন তালুক নিয়ে গঠিত ছিলো মরিয়ম বিবির জমিদারি।

কে এই জমিদার মরিয়ম বেগম
মরিয়ম বেগমের পিতার নাম জানা না গেলেও তার এক ভাইয়ের নাম ছিলো ইয়াদ ওয়ারেছ। তিনি মীর গোলাম হোসেনের পিতা ছিলেন। মরিয়ম বেগমের স্বামীর নাম সৈয়দ আলী মেহেন্দী খাঁ বাহাদুর, মেয়ের নাম খায়রুন নেছা ওরফে নতে বেগম এবং খায়রুন নেছার স্বামীর নাম মীর গোলাম হোসেন। খায়রুন নেছার কন্যার নাম মরিয়ম নেছা বেগম। উল্লেখ্য যে, এখানে দুইজন মরিয়মের নাম পাওয়া যায়, যার একজন হলেন জমিদার মরিয়ম বেগম এবং অপরজন জমিদার মরিয়ম বেগমের মেয়ের ঘরের নাতনি মরিয়ম নেছা বেগম। মরিয়ম নেছা বেগমের নিজ বসতির ঠিকানা ওয়াকফ ও মীর গোলাম হোসেন কর্তৃক মির্জা মোহাম্মদের নিকট বিক্রিত দলিলে নিম্নোক্তভাবে উল্লেখ করা হইয়াছে :

“ঢাকা জেলার সদর পুলিশ স্টেশন মহালে চাঁদখার পোল স্থিত মৃত মরিয়ম নেছা বেগমের নিজ বসতি ভাদ্রাসন বাড়িময় নিষ্কর ভূমি তাহার চৌহদ্দি পশ্চিমে সড়ক দক্ষিণে কুচা রাস্তা উত্তরে মহালে আলি নকিছ ডেউরী স্থিত লাখেরাজ জমি পূর্বে মৃত ফজলে মিরনের জমিন।”

সহোদর ভ্রাতার পুত্র ও কন্যা খায়রুন নেছার স্বামী জনাব মীর গোলাম হোসেনকে মোতাওয়াল্লী নিযুক্ত করেন এবং উল্লিখিত ওয়াকফকৃত সম্পত্তির নিকট উপস্বত্ব হইতে সুবিধাপ্রাপ্ত হিসেবে তার ঘনিষ্ট আত্মীয় কতিপয় ব্যক্তিদিগের পুত্র, পৌত্রাদি ও ওয়ারিশানক্রমে মাসিক ৭৮ টাকা হিসেবে বার্ষিক ৯৩৬ টাকা এবং অপর কয়েক আশ্রিত ব্যক্তিকে তাদের জীবদ্দশা পর্যন্ত মাসিক ৫ টাকা হিসেবে বার্ষিক ৬০ টাকাসহ মোট ৯৯৬ টাকা খোরপোষ দেওয়ার নিয়ম অবধারিত করেন। ঐ-সম্পত্তির নিট লাভ হতে যা উদ্বৃত্ত হবে, তা দ্বারা ওয়াকফকারীর (মরিয়ম বেগম) বসতবাড়ি স্থিত ইমামবাড়া (শিয়া মুসলিমদের প্রধান এবাদতখানা হোসেনী দালান)-এর খরচ হবে মর্মে শর্তে উল্লেখ করেন। কিন্তু বঙ্গাব্দ ১২৭৪ সনের মাঘ মাসে মরিয়ম বেগমের মৃত্যু হওয়ার পর ৯৯৫৪ নং তালুক ঢাকা কালেক্টরির অফিস কর্তৃক বণ্টন হয়ে কথিত একরভুক্ত চার আনা ১০ গণ্ডা অংশের বাবদ স্বতন্ত্র একটি ছাহাম হয়ে ১৩১৭৩ নং তৌজি সৃষ্টি হয়েছে, যাতে আমীরগঞ্জ ও করিমগঞ্জের গ্রাম ও চকের জমিগুলিও উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। উক্ত সৃজিত মহাল বা তালুকের বার্ষিক ৫৯৮ টাকা সদর জমা ধার্য এক মহাল সৃষ্টি হয়েছে। এটি ছাড়া এই তালুকে ১৫৭৮৩ ও ১৫৭৮৪ নং আরো দুইটি ভিন্ন মহাল বা তৌজি সৃষ্টি হয়। মরিয়ম বেগমের মৃত্যুর ওয়াকফের মোতাওয়াল্লী জনাব মীর গোলাম হোসেন বাংলা ১৩০৮ সনের ২১শে অগ্রহায়ণ ১৯০১ সালের ৭ই ডিসেম্বর তারিখে সম্পাদিত ৩৩ ফর্দে এক সাফকাবলা ওয়াকফ দলিলে উল্লেখিত মরিয়ম বেগমের জমিদারি ও খলিলুর রহমানের তালুকের তার স্বত্ব (মীর গোলাম হোসেনের), মরিয়ম বেগমের কন্যা খায়রুন নেছার হেবায় প্রাপ্ত সম্পত্তি, ফরাজে ও লাখেরাজ ভূমি ও পত্তনী মালিকানা মির্জা মোহাম্মদ, পিতা : মির্জা কাজিম ও মির্জা মোহাম্মদের আপন বোন জনাবা বনি বেগমের (মীর গোলাম হোসেনের ভাগনি) নিকট বিক্রয় করে নিস্বত্ববান হন। তখন ভূমি রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯০৮ প্রণীত হয় নাই বিধায় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন মোতাবেক দলিল লেখক শ্রী জজ্ঞেশ্বর দত্ত সাং হাল ঢাকা কবিরাজের গল্লি, স্টেশন সদর, ঢাকা ও আপন সাকিন বা স্থায়ী ঠিকানা : টিন কোর্ট স্টেশন শ্রীনগর ৩৬০৪ নং (মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর) এবং দলিলটি দুই টাকা মাত্র স্ট্যাম্পে প্রহলদ চন্দ্র ধর বেন্ডার কাঃ আদালতে জিলা : ঢাকা মির গোলাম হোসেনের সহি-স্বাক্ষরে ৩৩ ফর্দের আঠারো পাতার সাফকাবলা দলিল সংগঠিত হয়। আমার নিকট উক্ত দলিলের একটি ছায়ালিপি রক্ষিত আছে, যার চৌম্বক অংশ পরবর্তী পর্বে তুলে ধরা হবে।


আমির হোসেন
গবেষক, আয়কর পরিদর্শক

আমীরগঞ্জের ইতিহাস | পর্ব ১

0

কিশোর ও তারুণ্যকালীন সাহিত্য পাঠের হিরণ্ময় দিনগুলিতে কখন যে হৃদয়ের মণিকোঠায় ইতিহাস-ঐতিহ্যও স্থান করে নিয়েছে, তা সত্যিই ভাবনার বিষয়। প্রাথমিক স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে সুলতানী ও মুঘল আমল সম্পর্কিত পাঠচর্চায় ঈসা খাঁ ও তাঁর মিত্র বারো ভূঁইয়া, চাঁদ রায়, কেদার রায়, মজলিস কুতুব ও গাজীপুরের ফজল গাজীর (পাহ্ লাওয়ান গাজীর বংশধর) নাম শুনেছি। মুঘলদের সেনাপতি মান সিংহের সাথে ঈসা খাঁ’র মল্লযুদ্ধের ছবি ও মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁ ও নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ’র ছবি পাঠ্যপুস্তকে দেখেছি। ১৯৮২ সালে ব্রাহ্মন্দী স্কুল থেকে সোনারগাঁয়ে শিক্ষা সফরে গিয়ে লোকশিল্প জাদুঘর ও ঈসা খাঁ’র আমলের পুরোনো জীর্ণ দালানকোঠা, পানাম নগর ও পুকুর-পরিখা পরিদর্শন করে জমিদার ও রাজা-বাদশাহদের ইতিহাস জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠি।

গ্রামের মুরুব্বিদের আড্ডা ও মজলিস থেকেও অনেক পুরোনো ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হয়েছি। বয়োবৃদ্ধদের মুখনিঃসৃত ঐতিহাসিক শ্রুতি, বংশপরম্পরায় চলে আসা কিংবদন্তী ও লোককাহিনিগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ইতিহাসের ভিত্তি ও কাঠামো এভাবে সংরক্ষিত হয়ে ইতিহাসবিদের চুলচেরা বিশ্লেষণ ও প্রামাণিক মানদণ্ডে ইতিহাস গ্রন্থিত হয়েছে। আমার গ্রামের মধ্যাংশে এরকম আড্ডা দুই জায়গায় ও দক্ষিণাংশে একটি আড্ডা বা মজলিস বসতো। সেখানে বেশি আলোচিত হতো বিগত ও চলমান রাজনীতি, পুরোনো দিনের দুর্ভিক্ষ, পুঁথিপাঠ, মাছধরা, গরুদৌড় ও গ্রাম্য কিংবদন্তী। মুচন্দালীর মুখে প্রথম শুনি, এই গাঁয়ের পূর্বনাম ছিলো ‘ঐছার চর’, যা পরবর্তী সময়ে আমীরগঞ্জ নাম ধারণ করে। যখন এখানে বসতিও গড়ে ওঠেনি, সে-কালে এখানে জাল্লাদের জালে প্রচুর ইছা (চিংড়ি) ধরা পড়তো। লোকমুখে প্রথমে ‘ইছার চর’ হিসেবে পরিচিত ছিলো এবং ইছা নামের অপভ্রংশ ‘ঐছার চর’ নাম ধারণ করে। পরবর্তীতে আমি ঢাকার জাতীয় আর্কাইভে এ-গ্রামের থাকবাস্ত জরিপের (পরগণা ম্যাপ, যা ১৮৫৬ সালে প্রণীত হয়) পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করলে ‘ঐছার চর’ নামের অস্তিত্ব খুঁজে পাই। কিন্তু পরে জানতে পারি, তা ছিলো নীলক্ষ্যার ঐছার চর। আমার গ্রামের আদি নাম ‘ঐছার চর’ কি না, তার প্রামাণিক তথ্য উদ্ধারের চেষ্টা এখনো চালিয়ে যাচ্ছি।

সুলতানী আমলে আমাদের আমীরগঞ্জ জনপদ মেঘনা ও আড়িয়াল খাঁ’র পানির নিচে ছিলো। তখন এ-জনপদের কোনো অস্তিত্বও ছিলো না। তবে এ-জনপদের মাইল দুয়েক উত্তরে পুরান কুঠির বাজার সন্নিহিত আড়িয়াল খাঁ’র উত্তর ও পশ্চিম অংশে (লাল বা গৈরিক মাটির অঞ্চল) মানব বসতি ছিলো। কারণ, সোনাইমুড়ি পাহাড়, যা এ-জনপদ থেকে মাইল তিনেক উত্তরে, তার পাদদেশের এক গ্রামে গভীর নলকূপ স্থাপনকালে কয়েকশো ফুট নিচ থেকে ধানের ছরা উঠে আসলে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ মনে করেন, দুই হাজার বছর পূর্বের এই গৈরিক ভূমিতে মানব বসতি ছিলো। কেননা, আমীরগঞ্জ থেকে প্রায় ১০ মিটার উঁচু গৈরিক এই ভূমি মধুপুর গড়ের বহিরাংশ।

বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের প্রাক্কালে পূর্ব বাংলায় মুসলিমদের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। পূর্বে এই এলাকায় মুণ্ডা, সাওতাল ও রাজবংশীদের বসবাস ছিলো। আশরাফপুরের সুলতানী আমলের মসজিদটি মুসলিম অস্তিত্ব বহন করে বটে।

দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক (১৩২০-১৩২৫)-এর সময় থেকে ইতিহাসের পাতায় সোনারগাঁয়ের নাম পাওয়া যায়। গিয়াসের পুত্র সুলতান মুহম¥দ তুঘলক (১৩২৫-১৩৫১)-এর সময় সোনারগাঁয়ের শাসনকর্তা ছিলেন বাহরাম খান (১৩২৮-১৩৩৮)। ১৩৩৮ সালের বাহরাম খানের মৃত্যুর পর তাঁর সিলাহদার (বর্ম-রক্ষক) ফখরউদ্দীন মুবারক শাহ শাসন ক্ষমতা দখল করে সোনারগাঁকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন। সুলতান ফখরউদ্দীন মুবারক শাহের আমলের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতার বাংলা সফর। তিনি সম্ভবত ১৩৪৬ সালে তাঁর রাজধানী সফর করেন। বাংলা ভ্রমণকালে ইবনে বতুতার বিবরণীতে রায়পুরা, নবীনগর ও নরসিংদী সদরের চর এলাকার গ্রামগুলোর নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও নান্দনিকতার চিহ্ন পাওয়া যায়। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘নিহালা’ থেকে জানা যায়, তিনি সোনারগাঁয়ের স্বাধীন সুলতান ফখরউদ্দীন মুবারক শাহের সময় ১৩৪৬ সালের জুলাই মাসে চাটগাঁও (চট্টগ্রাম) দিয়ে বঙ্গে প্রবেশ করে একমাসে কামরূপ ভ্রমণ করে সিলেটে হযরত শাহজালালের সাথে সাক্ষাত করেন এবং তিনদিন তাঁর আতিথেয়তা গ্রহণ করেন।

সিলেট থেকে সোনারগাঁ আসার পথে তিনি সুরমা নদী দিয়ে এসে এ-জনপদের অতি নিকটে মেঘনা নদী দিয়েই পনেরো দিনে সোনারগাঁ আসেন। তিনি মেঘনা নদীর দু’পাড়ের প্রাকৃতিক শোভায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। দিগন্ত বিস্তৃত শস্য ¶েত্র, নদীপথের বাঁকে বাঁকে গ্রাম ও কিছুদূর পরপর হাট-বাজার, চারিদিকে সবুজের সমারোহ দেখে তাঁর বিবরণীতে উল্লেখ করে মন্তব্য করেন, তিনি যেন বাগানের মধ্য দিয়ে চলেছেন। তিনি যখন সুরমা নদী পেরিয়ে আসছিলেন, তখন তাঁর অভিব্যক্তি এমন হয়েছিলো যে, মিশরের নীল নদের তীরভূমির স্মৃতিকথাই তাঁকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলো।

আমীরগঞ্জের মনুষ্যবসতি, ভূমিচাষ, জমিদার, তালুকদার, পত্তনীদার ও ভূমধ্যধিকারীর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
মুঘলদের পূর্ব বাংলা জয়ের পর সীমান্ত অঞ্চলের জেলাগুলোর ন্যায় ঢাকা জেলাও (সোনারগাঁ) বহিঃআক্রমণের শিকার হয়েছিলো। মুঘল যুগের প্রথমদিকে এ-জনপদে সবেমাত্র নদী ও জলাশয়ের উঁচু পাড়গুলোতে মনুষ্যবসতি গড়ে ওঠতে থাকে। বর্তমান রায়পুরা থানার আমীরগঞ্জ ইউনিয়নসহ পশ্চিমাঞ্চলীয়  আটটি ইউনিয়নের অধিবাসীগণ ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার করে ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার উদীয়মান চর ও উঁচু ভূমিতে নিজেদের আবাসস্থল নির্মাণ করে। তারা নিকটের ও দূরের জমিতে ধান, আখ, তিল, সরিষা ও বিভিন্ন সবজির চাষাবাদ করতো। নতুন শাসক মুঘলরা এসে বহিঃআক্রমণ থেকে বিজিত অঞ্চল রক্ষা ও রাজস্ব বৃদ্ধির জন্যে এ-জনপদের কতোগুলো মহাল (বর্তমান নরসিংদী জেলার মেঘনার উদীয়মান চরসমূহ, যেমন : জোয়ার হাসনাবাদ মৌজার হাইরমারা, দড়িহাইরমারা, চরমধূয়া, মধ্য মৌজার বিরগাঁও, আমীরাবাদ, লক্ষ্মীপুরা, গাজিপুরা, মরিয়মনগর, হাইরমারা, দড়িহাইরমারা, ফতেপুর, বীরকান্দি, আদিয়াবাদ, রহিমাবাদ, হাসনাবাদ) মুঘলদের সেনা ও উচ্চ রাজকর্মচারীর নিকট বন্দোবস্ত দেন।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ইংরেজ আমলে এ-জনপদের ভূমি বন্দোবস্ত (১৭৬৫-১৮৫৭)
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন এ-দেশীয় রাজবল্লভ, উমিচাঁদ, ঘসেটি বেগম, মীরজাফরসহ অনেকে লর্ড ক্লাইভের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পলাশীর প্রান্তরে দেশপ্রেমিক সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটায়। ফলে সুবিধাবাদী মুসলিম ও ষড়যন্ত্রপিয়াসী বর্ণহিন্দুদের জয়জয়কার হয়। মুঘল আমল থেকেই চতুর বর্ণহিন্দুগণ মুসলিমদের সহযোগী হিসেবে অভিনয় করে মুর্শিদাবাদের রাজকর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পেতে থাকে। ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৎকালীন মুঘল বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের নিকট থেকে বাংলা, বিহার ও ওড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে। পূর্বের মুঘল যুগে দেওয়ান ও সুবেদার মুর্শিদকুলি খাঁ তাঁর মালজামিনী রাজস্বনীতিতে বাংলায় ভূমি রাজস্ব আহরণে এক নবপ্রথার আনয়ন করেন। অধিক রাজস্বের আশায় তিনি অনেক সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের জমিদারি কেড়ে নিয়ে অমুসলিম হিন্দুদের নামে জমি বন্দোবস্ত দিতে থাকেন, যারা পূর্বে মুর্শিদাবাদে তাঁর সেরেস্তায় গোমস্তা পেশায় কর্মরত ছিলেন। এমন দুজন জমিদার ছিলেন ভাওয়াল জমিদার ও মুক্তাগাছার জমিদার। তাঁদের পূর্বের মুসলিম জমিদার ছিলেন গাজীরা ও ভাটির রাজা ঈসা খাঁ’র বংশধরদের বাইশ পরগণা। পরবর্তীতে লর্ড কর্নওয়ালিশ ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিধিতে ভাওয়াল রাজা ও মুক্তাগাছার জমিদারি পাকাপোক্ত করেন।

কোম্পানি আমল (১৭৬৫-১৮৫৭)
এ-সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দুটি ইতিহাস গ্রন্থ জেমস টেলরের ‘কোম্পানি আমলে ঢাকা’ ও উইলিয়াম উইলসন হান্টারের ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’। গ্রন্থ দুটি থেকে অবহিত হওয়া যায়, নবাব সিরাজের পরাজয়ের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের নিকট থেকে ২৫,০০,০০০ + ৫৫,০০,০০০ টাকায় বাংলা, বিহার ও ওড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে। শর্ত মোতাবেক, সম্রাট পাবেন ২৫,০০,০০০ টাকা এবং সুবে বাংলার নায়েব নিজামতের জন্যে খরচ হিসেবে পাবেন ৫৫,০০,০০০ টাকা। দেওয়ান রেজা খান কোম্পানির হয়ে দেওয়ানী পদ লাভ করেন। বাদশাহী লাখেরাজ বিধি ১৭৯৩ এবং অ-বাদশাহী লাখেরাজ ১৭৯৩ জারি করে কোম্পানি মুসলিম জায়গীরদার ও ধর্মীয় হিতকর কাজের নিমিত্তে প্রাপ্ত ভূমি (মুঘল সম্রাট কর্তৃক প্রদত্ত লাখেরাজ ভূমি) বন্দোবস্তকে নিয়ন্ত্রণ ও ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত করে দেয়। ফলে জরিপে দেখা যায় যে, পূর্ব বাংলায় শুধুমাত্র দুজন শরীফ মুসলিম ছাড়া কোনো মুসলিম জমিদার ছিলো না, তাঁরা ব্যতিত সকলেই হিন্দু জমিদার ছিলেন।

এখানে উল্লেখ্য যে, ভাওয়াল পরগণার জমিদার ছিলেন ফজল গাজী। তিনি পবিত্র হজ্বব্রত পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় গমনকালে তাঁর জমিদারি সূর্যাস্ত আইনে নিলামে উঠলে ভাওয়াল রাজার পূর্বপুরুষ মুর্শিদাবাদের রাজস্ব কর্মচারী থাকাকালে দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁ’র নিকট থেকে জমিদারি বন্দোবস্ত নিয়ে নেন। ঠিক তেমনই মুক্তাগাছার জমিদারের পূর্বপুরুষও মুর্শিদাবাদের রাজস্ব কর্মচারী থাকাকালে ঈসা খাঁ’র ২২ পরগণার আলাপ সিংসহ দুটি পরগণার জমিদারি ক্রয় করেন। নতুন হিন্দু জমিদারদের মধ্যে কয়েকজন পূর্বের মুসলিম জমিদারদের নায়েব ছাড়া সিংহভাগই ছিলো সুদী ব্যবসায়ী ও রাজকর্মচারী, যাদের জমিদারি পরিচালনায় কোনো অভিজ্ঞতাই ছিলো না।

কোম্পানি প্রথম পাঁচশালা ইজারা নীতিতে প্রথম বছরই বিহার থেকে রাজস্ব প্রাপ্ত হয় ৫০,০০,০০০ টাকা। কোম্পানি প্রথমে দেওয়ানী কাজে দ্বৈত নীতিতে দেশীয় অমাত্য রেজা খানকে নিয়োগ দেন। রেজা খানের কর্মচারীদের রাজস্ব ফাঁকি ও তছরুপের কারণে কোম্পানি অধিক মুনাফার আশায় এক বছরব্যাপী ইজারা দিতে থাকে। কিন্তু প্রাপ্তি কম হওয়ায় ইংল্যান্ড থেকে কোম্পানির হাল ধরতে আসেন ওয়ারেন হেস্টিংস। দ্বৈত শাসনের অবসান করে ১৭৭২ সালে রেজা খানকে বরখাস্ত করেন এবং দশশালা নীতিতে ভূমি বন্দোবস্ত দেন। তারপর লর্ড কর্নওয়ালিশ এসে দশশালা বন্দোবস্তকে ১৭৯৩ সালের বিধিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে ঘোষণা করে জমিদারদের জমির চিরস্থায়ী মালিক করে দেন।

পরগণা (তপ্পা রণ ভাওয়াল)
আমাদের এলাকায় প্রচলিত আছে যে, রায়পুরার ভূমি ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের আগপর্যন্ত ময়মনসিংহ কালেক্টরিতে ছিলো। কথাটি যে কতো অসত্য, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রতিককালে কেদারনাথ রচিত ‘ময়মনসিংহের বিবরণ’ নামক একটি পিডিএফ পুস্তক থেকে। উক্ত বিবরণ থেকে জানতে পারি, রায়পুরার প্রায় সমগ্র অঞ্চল পূর্বে ময়মনসিংহ কালেক্টরিতে ছিলো ঠিকই, তবে তা একটি তপ্পার অধীনে রণ ভাওয়াল পরগণার অন্তর্ভুক্ত হয়। আমাদের আমীরগঞ্জ, হাসনাবাদ মহালটি ঈসা খাঁ’র সময় মনুষ্যবসতির উপযোগী ছিলো না। মুঘলদের শেষ পর্যায়ে এখানে বসতি গড়ে ওঠে। বিবরণীতে উল্লেখ আছে : ভাওয়ালের উত্তর অংশের জমিদারী ভাওয়াল পরগণার অন্তর্ভুক্ত থাকিয়া আকবর শাহের সময়ে ভাওয়াল বাজু নামে পরিচিত ছিল। রাজস্ব-সচিব টোডরমল এই সমস্ত মহালের রাজস্ব ১৯,৩৫,১৬০ দাম বা ৪৮,৩৭৯/- নির্ধারণ করেন। ষোড়শ শতাব্দীতে ভাওয়াল পরগণায় বঙ্গীয় দ্বাদশ ভৌমিকের অন্যতম ভৌমিক ফজল গাজীর আবির্ভাব হয়। গাজী বংশ ইহার পূর্ব হইতে ভাওয়ালে আধিপত্য করতে ছিলেন। ডাঃ ওয়াইজ লিখিয়াছেন, খৃস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে পালওয়ান শাহের পুত্র কায়েম খাঁ দিল্লীর সুলতান হইতে ভাওয়াল পরগণার আধিপত্য গ্রহণ করিয়া লক্ষ্যা নদীর তীরে স্বীয় আবাসস্থল নির্ধারিত করেন। অতঃপর আকবর শাহের সময় ইহার বংশধর ফজল গাজী অপর একাদশ ভূমধ্যধিকারীর সহিত জোট বেঁধে সম্রাটের বিরুদ্ধাচারণ করিয়া স্বীয় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ঈসা খাঁ এই দ্বাদশ ভৌমিকের নেতা ছিলেন। ঈসা খাঁ আকবর শাহের বশ্যতা স্বীকার করিলে দ্বাদশ ভৌমিকের ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে যায়। অতঃপর তিনি (ঈসা খাঁ) ভাওয়াল পরগণার উত্তর অংশ (রণ ভাওয়াল) সম্রাট আকবর শাহীর নিকট থেকে নিজ বাইশ পরগণার সঙ্গে বন্দোবস্ত করিয়া আনেন। এই উত্তর অংশেই পূর্বে আকবর সেনাপতি রাজা মানসিংহের সহিত এগার সিন্ধুতে ঈসা খাঁর যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধ বা রণস্থল হইতে ভাওয়াল পরগণার এই অংশের নাম হয় রণ ভাওয়াল। ক্রমে ঈসা খাঁর বংশধরগণ রণ ভাওয়ালকে আলাপ সিংহের অন্তর্ভুক্ত করিয়া নিজ নিজ বিভাগ ক্রিয়া সম্পাদন করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের নবাবী আমলের কাগজপত্রে (নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর ১৭২৭ সন পর্যন্ত) রণ ভাওয়ালকে অন্তর্ভুক্ত তপ্পা বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। ঈসা খাঁর বংশের পর এই তপ্পা ঢাকার মোগলদিগের হস্তগত হয়, মোগলরা রণ ভাওয়ালের তালুকগুলোকে তাদের অনুগত মোগল ও ইরানীদের নিকট নওয়ারা তালুক হিসাবে বন্দোবস্ত দেন এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর পর্যন্ত, তাহাদিগের হস্তেই পরিচালিত হয়। ১৭৮৭ সনে এই তপ্পার (জমিদারী) ছয় আনা অংশ মহম্মদ করিম, ছয় আনা অংশ হোসেন আলী ও অবশিষ্ট চার আনা অংশ মহম্মদ আলীর নামে লিখিত ছিল। ইতিপূর্বে এই মহাল হইতে কয়েকটি বড় বড় তালুক বাহির হইয়া যাওয়ায়, মালিক গণের পক্ষে রাজস্ব চালাইয়া জমিদারী রক্ষা করা কঠিন হইয়া উঠে। অতঃপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর জমিদারীর অংশ রাজস্ব বাকীর জন্য নীলাম হইয়া যায় এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রাজস্ব বোর্ডের ১৭৯৪ সনের ২৬ শে ফেব্রুয়ারীর চিঠি অনুসারে ৩৪ টি তালুকসহ এই পরগণার (তপ্পা রণ ভাওয়াল) অংশ ঢাকা জেলার তৌজিতে পরিবর্তিত হয়। অতঃপর ইহার বাকী অংশ ত্রিপুরার কালেক্টরীর ভুক্ত হইয়া গিয়াছে। বর্তমান সময়ে ময়মনসিংহ জেলায় রণ ভাওয়ালের জমিদারীর কোন অংশ নাই। এই পরগণার মোট জমি ২,০৩,৫৪০ একর, পরিমাণ ফল ৩১৮.০৩ বর্গমাইল, ও গ্রাম সংখ্যা ২৭৯ টি।

বর্তমান সিএস পর্চায় আমীরগঞ্জ ইউনিয়নসহ রায়পুরা থানার পশ্চিমাঞ্চল এই তপ্পা রণ ভাওয়াল পরগণার অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাওয়া যায়। আবার রণ ভাওয়ালের কিয়দংশ বরদাখাত (যা পূর্বে বরদাখাল নামে অবহিত ছিলো) পরগণা হয়ে ত্রিপুরা জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে আবার ঢাকা কালেক্টরির তৌজিভুক্ত হয়। সর্বশেষ সিএস পর্চায় হাসনাবাদ, হাসনাবাদ বাজার, করিমগঞ্জ, আমীরগঞ্জ ও নলবাটা তালুকটি খারেজি তালুক হিসেবে খলিলুর রহমানের নামে রেকর্ডভুক্ত, যা ১৭৯৪ সালে ঢাকা কালেক্টরির তৌজিভুক্ত হয়। উল্লেখ্য, খলিলুর রহমানের তালুকটি ছিলো একটি স্বাধীন তালুক, যা মুঘল আমলে বন্দোবস্ত নেয়া। একে হুজুরী তালুক নামে ডাকা হতো। হুজুরী তালুকদারগণ জমিদারকে খাজনা না দিয়ে সরাসরি সরকার বাহাদুরকে খাজনা দিতেন এবং বংশানুক্রমে ভূমির মালিকানার অধিকারী ছিলেন। নওয়ারা তালুকের অন্য দুটি তালুক আমরা খুঁজে পাইÑ রহিমাবাদ ও মির্জানগরের মির্জা মুহাম্মদের খারেজি তালুক অন্যটি বালুয়াকান্দি ও আব্দুল্লাপুরের মীর আলী বা আমীর উদ্দিন হায়দার জমিদারের তালুক। মীরগণ ছিলেন মুঘল নৌ-অধ্যক্ষ। মীরদের অধীনে অনেক নৌ-সৈন্য থাকতো। পরবর্তী মুঘল সুবেদারদের অসম রাজ্য, কামরূপ ও ত্রিপুরা অভিযানে এখানকার নৌ-সেনাগণ অংশগ্রহণ করেন।

ভূমি বন্দোবস্তপ্রাপ্ত তালুকদার ও জায়গীরদারগণ সকলেই শরীফ মুসলিম ও মুঘলদের অমাত্য/ওমরাহ ছিলেন এবং তারা ইরান ও মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে ভাগ্যান্বেষণে মুঘল দরবারে চাকুরির সুবাদে আসেন। খলিলুর রহমানের তালুকের হাসনাবাদ বাজারস্থ তিনটি সিএস পর্চা (যার খতিয়ান নং যথাক্রমে ৩৭৫, ৩৭৬, ৩৭৭ এবং প্রত্যেকটির উপরে স্বত্বের কলামে লেখা আছে ‘ভারত সম্রাট’) থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি মুঘল আমলের জায়গীরদার। এসব তালুক ১৮০২ সালের পূর্বের ছিলো এবং এরপর আর কোনো স্বাধীন তালুকের সৃষ্টি হয়নি। কারণ, এরপর থেকে ব্রিটিশ শাসকগণ এই স্বাধীন ও হুজুরী তালুকগুলো নানা অজুহাতে বাদশাহী ও অ-বাদশাহী লাখেরাজ বিধি ১৭৯৩ জারি করে অধিগ্রহণ করে অন্যদের বরাদ্দ দিয়ে দেন। এতে শরীফ মুসলমানগণসহ মধ্যবিত্ত পরিবারে ধস নেমে আসে। পরবর্তীতে আমাদের আমীরগঞ্জ জনপদটি এই রণ ভাওয়াল হিং-এর একটি তপ্পার অন্তর্ভুক্ত হয়।


আমির হোসেন
গবেষক, আয়কর পরিদর্শক

সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্র বিনিময়

সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য (পঞ্চতীর্থ) একাধারে একজন পণ্ডিত, ইতিহাসকার, নাট্যকার, ভাষাবিদ। গ্রামের ছাত্রটোলের পণ্ডিত ছিলেন। বাস করতেন গ্রামেই। বিশ শতকের যে-সময়ে তাঁর বিচরণ, সে-সময়ে ইতোমধ্যে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য আধুনিক যুগ অতিবাহিত করছিলো।

জন্মেছেন ১২৯৮ বঙ্গাব্দে, খ্রিস্টসন অনুসারে ঊনিশ শতকের শেষার্ধে, তৎকালীন মহেশ্বরদী পরগণার অজপাড়াগাঁ আলগিতে। বর্তমানে এটা নরসিংদী জেলার মাধবদী পৌরসভায় পড়েছে। এই গ্রামেই তাঁর বসবাস ও পণ্ডিতি করেছেন মৃত্যু অবধি। অবশ্য তাঁর মৃত্যু ঘটেছিলো ঢাকায়, ১৩৬১ বঙ্গাব্দে।

স্ত্রী ও কন্যার সাথে সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থ, সময়কাল ১৯২৯/৩০

‘পূর্ব্ববঙ্গে মহেশ্বরদী’ তাঁর বহুল পঠিত নন্দিত ইতিহাস-গ্রন্থ। এই গ্রন্থের সাথে সমকালীন পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন শেকড় সন্ধানী লেখক হিসেবে খ্যাত সরকার আবুল কালাম (মৃত্যু : ৩০ আগস্ট ২০২১)। সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থের কোনো গ্রন্থেরই তেমন খোঁজ-খবর পাওয়া যায় না। অবশেষে এই অঞ্চলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক নানা উপাদানসমৃদ্ধ এই ইতিহাস গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায় দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক শাহাদাত হোসেন মন্টুর কল্যাণে, যা পরে সরকার আবুল কালাম সম্পাদনা করেছেন সমকালীন পাঠকদের জন্যে। সেই সাথে এই গ্রন্থের কল্যাণে তাঁর আরো ২৬ টি গ্রন্থের নামের সন্ধান পাওয়া যায়। একনজরে তাঁর গ্রন্থরাজির দিকে চোখ বুলানো যাক :

১. বেদশতক (চারি বেদের একশত শ্রেষ্ঠ মন্ত্রের তাৎপর্য);
২. আদর্শ হিন্দু বিবাহ;
৩. বঙ্গ-গৌরব হোসেন শাহ (পঞ্চাঙ্ক নাটক);
৪. ভক্তের ভগবান (ছেলেদের নাটক);
৫. আত্মদান (ছেলেদের নাটক);
৬. দক্ষিণা (ছেলেদের নাটক);
৭. ছাত্র জীবনে শক্তি সঞ্চয়;
৮. ব্রাহ্মণ ও হিন্দু;
৯. গৃহস্থের শ্রীকৃষ্ণ সাধন;
১০. বিশ্ব-বীণা (বাংলা কবিতা);
১১. বিশ্ব-বীণা (সংস্কৃতে আবৃত্তি);
১২. যুগের মশাল জ্বালল যারা (কবিতা);
১৩. বরযাত্রী বা কন্যাদায়;
১৪. গোধন;
১৫. সমাজ;
১৬. ব্রাহ্মণ;
১৭. তীর্থরাজ;
১৮. প্রাচীনযুগে সমরবিজ্ঞান;
১৯. বানান সমস্যা সমাধান;
২০. ভ্রমণে সাহিত্য;
২১. সংহিতা যুগের সভ্যতা;
২২. ছেলেদের গল্প;
২৩. বড়দের গল্প;
২৪. অনার্য্য বিজয় (পঞ্চাঙ্ক নাটক);
২৫. বিবিধ প্রবন্ধ ও
২৬. পূর্ববঙ্গে মহেশ্বরদী।

‘পূর্ব্ববঙ্গে মহেশ্বরদী’ একটি আকর গ্রন্থ। ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টালে গন্ধ পাওয়া যায় সে-সময়কার মাটির ঘরের মাটির মানুষদের। ডোয়াই, গারুতি, খালোমালোদের জীবনাচার ও সংগ্রামী জীবন। খুঁজে পাওয়া যায় আমাদের পূর্বপুরুষদের যাপিত জীবনচিত্র, লোকাচার, ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-আচরণের। মনে হয় সুরেন্দ্রমোহনের চেতনায় ঐতিহাসিক সত্যের চেয়ে মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে চলমান জীবন। সেই সময়ের বাস্তবতায় জীবন ছিলো নদীকেন্দ্রিক। যে-এলাকায় সুরেন্দ্রমোহনের বসবাস, সেই এলাকার পূর্বদিকে বহমান মেঘনা, যা মেঘনাদ বা মেঘন নামে পরিচিত ছিলো। পশ্চিমদিকে শীতলক্ষ্যা আর প্রায় মধ্যভাগ দিয়ে বয়ে গিয়েছে এক সময়ের খরস্রোতা ও ভয়ঙ্কর নদ ব্রহ্মপুত্র। তার শাখা হাড়িধোয়া, আড়িয়াল খাঁ। আজকের ব্রহ্মপুত্র দেখে সেই চিত্র কল্পনা করা কঠিন।

প্রফেসর মনিরুজ্জামান ‘মহেশ্বরদীর ইতিহাস’ সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেন, “আঞ্চলিক ইতিহাস রাজনৈতিক ইতিহাস অপেক্ষা ভিন্ন এবং সে কথা রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার প্রমুখের ঐতিহ্য ভাঙতে গিয়ে নীহাররঞ্জন রায় তাঁর প্রথম জীবনে ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ লিখে প্রমাণও করেন। তারপর থেকে ইতিহাস রচনার ধারাকে যাঁরা এগিয়ে নিয়ে এসেছেন সেই সোনার গাঁ, বিক্রমপুর, ময়মনসিং ভাওয়াল প্রভৃতি পরগণার ইতিহাসকারদের কথা এ গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। অধ্যাপক সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থের অবদানও তাঁদেরই তুল্য। এদের হাতে ইতিহাস রচনার যে আদর্শ গড়ে ওঠে তা জেলা গেজেটিয়ার ও বিভিন্ন ভৌগোলিক ও স্থানিক পরিচিতিমূলক গ্রন্থেও অনুসৃত হতে দেখা যায়।”

সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থ ভাষাবিদ ও ব্যাকরণবিদ হিসেবে কতোটা পণ্ডিত ছিলেন, তৎকালীন তাঁর নিজের সময়ের সাহিত্য-ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে কতোটা প্রাজ্ঞ ছিলেন, তা আমরা সম্প্রতি আবিষ্কার করেছি  বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাঁর পত্রবিনিময়ের দুর্লভ তথ্যাবলি ও পত্রপাঠ করার মাধ্যমে।

গত শতকের তিরিশের দশকে এই পত্র বিনিময় ঘটেছিলো। তার মধ্যে দুটি পত্র নিয়ে কথা বলাই আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয়।

আমরা এই পত্র বিনিময়ের তথ্যটি পাই সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থের নাতি সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কল্যাণে। সুরেন্দ্রমোহনের তিন পুত্রের মধ্যে মধ্যম পুত্র হলেন সুখেন্দ্র ভট্টাচার্য। তিনি একজন প্রথিতযশা লেখক ও প্রাবন্ধিক ছিলেন। মূলত তিনি তাঁর সম্পাদিত এক গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুরেন্দ্রমোহনের পত্র বিনিময়ের আলাপ তোলেন এবং দুটি পত্র উক্ত গ্রন্থে ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। আর সেই সাথে ইতিহাসের এক দুর্লভ ঝাঁপি খুলে দেন।

এই পত্র বিনিময়ের মহৎ কর্ম ঘটেছিলো ১৯৩৬ সালে। সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থ রবীন্দ্রনাথকে প্রথমে এই পত্র লেখেন রবীন্দ্রনাথের বিশেষ গ্রন্থ পাঠপূর্বক ভাষা ও বানান সংক্রান্ত প্রমাদের জন্যে।  রবীন্দ্রনাথ সেই পত্রের উত্তরও দেন। আমরা রবীন্দ্রনাথের পাঠানো উত্তরসম্বলিত দুটি পত্রই পেয়েছি কেবল।

সুরেন্দ্রমোহনকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের পত্র (পাতা ১ ও ২)

সুরেন্দ্রমোহন রবীন্দ্রনাথকে মহাকাব্য রচনার কথা বলেছিলেন সম্ভবত। রবীন্দ্রনাথ তার উত্তরে লেখেন, “…মহাকাব্য রচনা আমার আয়ত্তের অতীত, সেই কারণেই সহজেই তাহাতে আমার প্রবৃত্তি হয় নাই। মহাকাব্য সম্বন্ধে আমার অশ্রদ্ধা নাই, অক্ষমতা আছে।”

রবীন্দ্রনাথের এই স্বীকারোক্তি মহাকাব্য সম্বন্ধে তাঁকে জানা-বোঝার ক্ষেত্রে মূল্যবান মন্তব্যের দলিল হয়ে রইলো।

দ্বিতীয় পত্রে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় শব্দের বানানগত ভুল, সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ এমনকি কবিতার পঙক্তি বিভ্রম নিয়েও আলাপ তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ প্রত্যেকটি বিষয়ের যথাযথ জবাব দিয়েছেন। আমরা অবশ্য রবীন্দ্রনাথের পত্র দেখিয়াই সুরেন্দ্রমোহনের পত্রের বিষয় উপলব্ধি করে কথা বলছি।

সুরেন্দ্রমোহনকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের পত্র

সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থ একজন বহুভাষাবিদ পণ্ডিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যে তা সম্যক বুঝেছিলেন, তা তাঁর প্রত্যুত্তর দেখেই বোঝা যায়।

দুটি মূল্যবান পত্রেরই সন তারিখ উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ।  এই হিসেবে সময়কাল সম্পর্কে ধারণা করে সুরেন্দ্রমোহন ও রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে গবেষকেরা প্রভূত উপকৃত হবেন, সন্দেহ নেই।

পত্রদুটির সাথে খামও উক্ত সস্পাদিত গ্রন্থে ছেপেছেন সুখেন্দ্র ভট্টাচার্য। আমরা খামের উপরে দেখতে পাই ‘আলগি, পো. মাধবদী’। রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে লিখিত ‘মাধবদী’ অবশ্যই মাধবদীবাসীর জন্যে বিরাট পুলকের বিষয় হতে পারে।

সুরেন্দ্রমোহনকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের পত্রের খাম

রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের এমন এক মহীরুহ যার সঙ্গে সমকালীন কবি-লেখক-পাঠক-গুণগ্রাহী সবার সাহিত্য সংশ্লিষ্ট বহুমাত্রিক যোগাযোগ ঘটেছিলো চিঠিপত্র আদান-প্রদানকে কেন্দ্র করে। আমরা রবীন্দ্রজীবনী এবং সমকালীন ও পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের কবি-লেখকদের জীবনী ও চিঠিপত্র সংকলন থেকে এসব তথ্য জানতে পারি। একদম অজপাড়াগাঁর লেখক-পাঠকদের পত্রের জবাবও রবীন্দ্রনাথ সমান গুরুত্ব সহকারে প্রদান করতে কুণ্ঠা বোধ করেননি।

আমাদের সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থ এমন একজন ভাষাবিদ পণ্ডিত লেখক ছিলেন যে, বিশেষত রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’য় ছাপা হয়ে যাওয়া কবিতার পঙক্তি বিভ্রম নিয়েও যিনি আলাপ তুলতে পারেন। তাঁর পত্রের জবাব রবীন্দ্রনাথ সম্মান ও গুরুত্বের সাথে দেবেন, এটাই কাঙ্ক্ষিত।

এই ঐতিহাসিক গুরুত্ববাহী পত্র বিনিময়ে গবেষকদের জন্যে নানা উপাদান তো রয়েছেই, নরসিংদীবাসী তথা মাধবদীবাসীর জন্যেও রয়েছে প্রভূত মর্যাদা ও ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকার বিরল অর্জন।