Home Blog

শিল্পী ফণী দাস স্মরণে : তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম

0

ফণী দাস শুভ্র ও সুন্দরের এক মহান রূপকার। নরসিংদীর শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চায় আজ যেই সুকুমার জগত তৈরি হয়েছে, তার রূপকারদের মধ্যে ফণী দাস অন্যতম। নরসিংদী চারুভাস্কর্য শিল্পে তিনি রেখেছেন বিরল অবদান। তাঁর ছবি আঁকার বিশাল জগত জুড়ে ছিলো বাংলাদেশ, প্রকৃতি ও মুক্তিযুদ্ধ। তিনি ছবি আঁকতেন তেলরঙ, জলরঙ, পেন্সিল ও কালি-কলমে। তাঁর কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন শিল্পকলা পদক, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন পদক, নবধারা কণ্ঠশীলন পদক, নরসিংদী পৌরসভা কর্তৃক সম্মাননা পদক, বৈশাখী একাডেমি কর্তৃক সম্মাননা পদক, যুগান্তর-স্বজন সমাবেশ পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত একাত্ম ছিলেন শিল্পের সাধনায়।

ফণী ভূষণ দাসের জন্ম ১৩ জানুয়ারি ১৯৫৩, নরসিংদী জেলা সদরের টেকপাড়া (পূর্ব দত্তপাড়া) গ্রামে। তাঁর বাবার নাম গোবিন্দ চন্দ্র দাস, মায়ের নাম প্রেমদা দাস, স্ত্রীর নাম রুমা দাস, ছেলে মাইকেল দাস রনি, মেয়ে নীলা দাস সুইটি। তিনি নরসিংদী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে এসএসসি এবং নরসিংদী কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে এইচএসসি পাশ করেন। তিনি ঢাকা আর্ট কলেজ (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) থেকে ১৯৭৬ সালে বিএফএ স্নাতক এবং পরে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিল্পী কামরুল হাসান, শিল্পী রফিকুন নবী, স্থপতি শামীম শিকদারের মতো শিক্ষকের প্রিয় ছাত্র ছিলেন। এছাড়া তিনি কলকাতা আর্ট কলেজের কয়েকজন বিখ্যাত শিক্ষকের কাছ থেকে চারু ও ভাস্কর্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

শিবপুরের ইটাখোলায় শহীদ মিনারের কাছে নিহত পুলিশ সদস্যদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ, তাঁতশিল্প নগরী মাধবদীতে তাঁতশিল্পের উপর তাঁত ও মাকু দিয়ে ম্যানচেস্টার চত্বর নির্মাণ করেন। তাছাড়া নরসিংদী ও নরসিংদীর বাইরে ৩০-৩৫ টি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ফণী দাসের ভাস্কর্যের কারণে নরসিংদী পৌরসভা বাংলাদেশে নান্দনিক ভাস্কর্যের শহর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

ফণী দাস ছিলেন আমাদের সময়ের বর্ণাঢ্য, উজ্জ্বল, বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব। কালের স্বাক্ষী হয়ে নানাভাবে দেখেছেন জীবন ও কর্মকে। অলোকিত ও শাণিত করার চেষ্টা করেছেন চারপাশের সবাইকে। গত ১৪ এপ্রিল ২০২৪ (রবিবার), ১৪৩১ বঙ্গাব্দের প্রথম দিনে আমাদের কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। ফণী দাসের পুরো জীবন ছিলো সংগ্রামমুখর। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে অনেক সংগ্রাম করে লেখাপড়া করেছেন। লেখাপড়ার খরচ জোগাতে লেখাপড়ার পাশাপাশি টিউশনি করেছেন। ছবি এঁকেও কিছু আয়-রোজগার করেছেন। লেখাপড়া শেষ করে পরিবারের হাল ধরতে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি সুদীর্ঘকাল ইউ-এম-সি আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে ২০১০ সালে অবসর গ্রহণ করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি নরসিংদী শিল্পকলা একাডেমিতে তবলার প্রশিক্ষক হিসেবে চাকুরি করেন। তাঁর পুরো পরিবারই শিল্পী পরিবার। তিনি নিজে ভালো গান গাইতে পারতেন, লিখতে পারতেন, সুর করতে পারতেন। তাঁর ছোটো দুই বোন— শিপালী, দিপালী ও স্ত্রী রুমা দাস বাংলাদেশ রেডিও ও টিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী। স্বাধীনতার পর নরসিংদীতে এমন একটা সময় ছিলো, যখন ফণী দাসের পরিবার ছাড়া কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই হতো না। তাঁর একমাত্র ছেলে রনি মাধবদী গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের ইংরেজির শিক্ষক। একমাত্র মেয়ে আমেরিকার নাগরিক। গত বছরের জুন মাসে তাঁর বাবা-মাকে আমেরিকা নিয়ে যাবার কথা ছিলো। তাঁদের ভিসাও হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তার আগেই তিনি স্থায়ী ভিসা নিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।

ফণী দা’ আমার খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন, কাছের মানুষ ছিলেন, আত্মার মানুষ ছিলেন। বয়সে আমার থেকে অনেক বড়ো হলেও আমরা মিশেছি বন্ধুর মতো। গান, কবিতা, নাটক, দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে আমরা আলাপ করতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান নিয়ে তাঁর মধ্যে অনেক হতাশা ছিলো। তারপরও বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদী ছিলেন। ফণী দা’ ছিলেন রাজনীতি সচেতন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রগতিশীল মানুষ। এতো বড়ো একজন শিল্পী, কিন্তু তাঁর মধ্যে কোনো অহঙ্কার ছিলো না। চলাফেরা করতেন অতি সাধারণ মানুষের মতো। সমাজের সব মানুষের সাথে মিশতেন।

ফণী দা’র সাথে আমার পরিচয় ও চলাফেরা প্রায় দীর্ঘ ৩৫-৪০ বছর যাবত। প্রথম পরিচয়ের পর থেকে তাঁকে যেমন দেখেছি, মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত তেমনই দেখেছি। তিনি ছিলেন চিরতরুণ। ছোটোখাটো গড়নের মানুষ, সব সময় পরিষ্কার-পরিপাটি জামা-কাপড় পড়তেন, ক্লিনশেভ হয়ে থাকতেন। তিনি ছিলেন মৃদুভাষী, আস্তে আস্তে কথা বলতেন, খুব কম কথা বলতেন। সব সময় তাঁর মুখে হাসি লেগে থাকতো। পান-সিগারেটের প্রতি তাঁর আসক্তি ছিলো না। কিন্তু চা পান করতেন ঘন ঘন। এমনও হয়েছে, কাজের চাপে শুধু চা পান করে সারাদিন কাটিয়ে দিয়েছেন। ফণী দা’কে যখন প্রশ্ন করতাম, আচ্ছা দাদা, সেই ছোটোবেলায় আপনাকে যেমন দেখেছি, এখনো তেমনই আছেন কেমন করে? ফণী দা’ মুচকি মুচকি হাসতেন, কোনো উত্তর দিতেন না। আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আমার ভালোবাসা তুমি’ এবং দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনকে নিয়ে লেখা ‘তোমার মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দিয়েছে’। কাব্যগ্রন্থ দুটির কবিতার সাথে মিল রেখে কবিতার মধ্যে চমৎকার ইলাস্ট্রেশন করে দিয়েছেন। তাঁর এই ইলাস্ট্রেশনের কারণে বই দুইটি অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। নরসিংদীর সবচাইতে প্রাচীন সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘স্বরলিপি’ শিল্পীগোষ্ঠীর তিনি আমৃত্যু সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর সভাপতি ছিলেন অভিনেতা খালেকুজ্জামান ও সাবেক সচিব মুক্তিযোদ্ধা সামসুজ্জামান ভাই। স্বরলিপির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা হাবিব ভাই, আমিরুল ভাই, আসাদুজ্জামান খোকন, সরকার সগীর আহম্মেদ, বিদ্যুৎ ভৌমিক, শ্রীধাম কর্মকার, টিপু সুলতান, রতন ধর, সন্তোষ দা’, দিলীপ দা’, রুমা দাস, শিপালী, দিপালী, আকলিমা আক্তার, চিত্রা বিশ্বাস প্রমুখ। এই সংগঠনের নানা কর্মকাণ্ডে ফণী দা’র সাথে আমি জড়িত ছিলাম। তিনি অঙ্গীকার একাডেমি নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা গান গাওয়া শিখতো, ছবি আঁকা শিখতো, তবলা বাজানো শিখতো। নরসিংদীতে ফণী দা’ কিছু অসাধারণ শিল্পকর্ম নির্মাণ করেছেন, যা আজো নরসিংদীর ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঐতিহ্যবাহী সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশনের শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে ফণী দা’ রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে কর্কশিট, বাঁশ, কাঠ দিয়ে নানা রকম কারুকার্যময় শিল্পকর্ম করে একটা শতবর্ষী নান্দনিক মঞ্চ তৈরি করে নরসিংদীর মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু এই মঞ্চ দেখার জন্যে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভীড় করতেন। শতবর্ষী অনুষ্ঠানে তিনি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার ললিতমোহন রায়ের একটা ছেঁড়া, পুরাতন সাদা-কালো ছবি থেকে অসাধারণ সুন্দর একটি ছবি আঁকেন, যা এখন নরসিংদীর ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। সাটিরপাড়া স্কুলের সামনের দেয়ালে তিনি কিছু দৃষ্টিনন্দন টেরাকোটা শিল্পকর্মের কাজ করেছেন। তার মধ্যে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, জাতীয় পাখি দোয়েল, জাতীয় ফুল শাপলা, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ললিতমোহন রায়ের ছবি ইত্যাদি অন্যতম।

বিশ-তিরিশ বছর আগে বাংলাদেশের মুদ্রণশিল্প তেমন আধুনিক ছিলো না। নির্বাচন এলে শিল্পীরা কাপড়ে লিখে ছবি এঁকে ব্যানার বানাতেন। ফণী দা’কে দেখতাম কী চমৎকার করে হারিকেনের ভেতর প্রার্থীর ছবি রেখে মোমবাতির আলোয় প্রার্থীর ছবি এঁকে বড়ো বড়ো তোরণ নির্মাণ করতেন। মানুষ ভীড় করে এসব তোরণ ও ছবি দেখতো।

নরসিংদী সরকারি কলেজের শহীদ মিনারের সাথে ফণী দাসের ইতিহাসও জড়িয়ে আছে। প্রতি বছর একুশ এলেই প্রণব স্যার, মোহাম্মদ আলী স্যার, মোস্তাফা স্যার ফণী দাসকে কলেজে ডেকে আনতেন। তিনি কাপড়ের ক্যানভাসে ভাষা আন্দোলনের নানা রকম ছবি এঁকে, পোস্টার লিখে চারপাশ নান্দনিকভাবে সাজিয়ে তুলতেন। তাঁর ক্যানভাসে আঁকা ছবি, দেয়ালচিত্র, দেয়ালে লেখা কবিতার লাইন, আল্পনা দেখতে ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ মানুষেরা ভীড় করতো। নরসিংদী কলেজের শহীদ মিনার ছিলো তখন নরসিংদীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে নরসিংদী শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্লাব, অফিস-আদালত থেকে হাজার হাজার মানুষ এখানে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করতে আসতেন। একুশের প্রথম প্রহর থেকে সকাল পর্যন্ত আবৃত্তি, নাটক, গানসহ নানা রকম আয়োজন থাকতো। বিশেষ করে, ফণী দাসের শিল্পকর্মের কারণে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একুশের এক অনন্য আবহ তৈরি হতো।

নরসিংদীর বিখ্যাত চারুশিল্পী ফণী দাস নরসিংদীর প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের কল্যাণে পরিচিত হয়ে ওঠেন ভাস্কর হিসেবে। লোকমান হোসেন ফণী দাসকে দিয়ে নরসিংদী পৌরসভার সামনে তিন রাস্তার মোড়ে প্রথম ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ’ নির্মাণ করান। এই কাজের ঠিকাদার ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মনিরুজ্জামান ভাইয়ের প্রতিষ্ঠান। স্তম্ভটি উদ্বোধনের সময় উদ্বোধনী ফলকে প্রতিষ্ঠানের নাম ছিলো, কিন্তু শিল্পী হিসেবে ফণী দাসের নাম ছিলো না। এতে ফণী দাস খুব মনোকষ্টে ছিলেন। কিছুদিন পর আমি, ফণী দা’, রুমা বৌদি মেয়র লোকমান হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে অনুরোধ করি ভাস্কর্যের নামফলকে শিল্পীর নাম সংযোজন করতে। আমরা মেয়রকে বোঝাতে সক্ষম হই যে, কিছুদিন পর হয়তো ফণী দাস থাকবেন না, মেয়র লোকমান হোসেন থাকবেন না, কিন্তু এই ভাস্কর্য থাকবে। ভাস্কর্যে ফণী দাসের নাম থাকলে তা পরবর্তী প্রজন্ম জানবে এবং এই ভাস্কর্যের মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন। লোকমান হোসেন পরে ভাস্কর্যের নিচে আরেকটা নামফলক তৈরি করে ভাস্কর্য শিল্পী হিসেবে ফণী দাসের নাম সংযুক্ত করে দেন। এরপরে আর ফণী দাসকে এসব নিয়ে ভাবতে হয়নি। লোকমান হোসেন ফণী দাসকে দিয়ে একে একে শিক্ষা চত্বর, গোলাপ চত্বর, শাপলা চত্বর, রজনীগন্ধা চত্বর, ফোয়ারা চত্বর নির্মাণ করান। লোকমান হোসেনের মৃত্যুর পর তাঁর ছোটো ভাই মেয়র কামরুজ্জামানও ফণী দাসকে দিয়ে দোয়েল চত্বর, লোকমান হোসেনের সমাধি সৌধ নির্মাণ করান। শিবপুরের ইটাখোলায় শহীদ মিনারের কাছে নিহত পুলিশ সদস্যদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ, তাঁতশিল্প নগরী মাধবদীতে তাঁতশিল্পের উপর তাঁত ও মাকু দিয়ে ম্যানচেস্টার চত্বর নির্মাণ করেন। তাছাড়া নরসিংদী ও নরসিংদীর বাইরে ৩০-৩৫ টি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ফণী দাসের ভাস্কর্যের কারণে নরসিংদী পৌরসভা বাংলাদেশে নান্দনিক ভাস্কর্যের শহর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

১১ আগস্ট ২০১০ সালে স্থাপিত ভাস্কর্য ‘শিক্ষা চত্বর’
১৬ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে মাধবদীতে নির্মিত ‘ম্যানচেস্টার চত্বর’

তিনি ২০১০ সালে বাংলাভিশন টেলিভিশনে ‘আমার আমি’ অনুষ্ঠানে এবং ২০১৩ সালে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনে ‘ভোরের সকাল’ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অংশ নেন।

আমি ফণী দা’র সাথে সুদীর্ঘ ১২ বছর নরসিংদী পৌরসভার আয়োজনে অমর একুশে বইমেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছি। আমাদের সাথে বিচারক হিসেবে আরো ছিলেন কণ্ঠশিল্পী নাজির উদ্দিন আহম্মেদ ভাই। ফণী দা’ তাঁর দায়িত্বের প্রতি অত্যন্ত সচেতন ও নিষ্ঠাবান ছিলেন। প্রতিদিনই অনুষ্ঠান শুরুর আগে খাতা, কলম ও ডায়রি নিয়ে হাজির থাকতেন। অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাচ, গান, আবৃত্তি ও নাটকের সবকিছু ডায়রিতে নোট করে রাখতেন। নিরপেক্ষ বিচার করতেন। কারো অন্যায় অনুরোধ ও দাবির কাছে আপোষ করেননি।

ফণী দাস একজন স্বপ্নবাজ মানুষ ছিলেন। তাঁর অনেক স্বপ্নের কথা আমার সাথে শেয়ার করতেন। নতুন কোনো গান লিখলে সুর করে আমাকে শোনাতেন। খুব সুন্দর কণ্ঠ ছিলো তাঁর। উচ্চারণও ছিলো নিখুঁত। যেকোনো বিষয়ে তৎক্ষণাৎ গান লিখতে পারতেন। তাঁর একটি বড়ো স্বপ্ন ছিলো নিজের আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবি দিয়ে একটি প্রদর্শনী করার। ইতোমধ্যে অনেক ছবিও এঁকেছিলেন। আমাকে কিছু আঁকা ছবি দেখিয়েছেনও। তবলার প্রতি তাঁর একটা অন্য রকম আবেগ ছিলো। এ-আবেগ থেকে তবলার উপর একটা বই লেখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি। তাঁর লেখা গান নিয়ে তিনি একটি একক গানের অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিলেন। এক জীবনে মানুষ অনেক স্বপ্ন দেখে, তার বেশিরভাগই মানুষের অপূর্ণ থেকে যায়। ফণী দা’র দেখা স্বপ্ন তিনি পূরণ করতে না পারলেও আমাদের চোখে সেই স্বপ্ন তিনি এঁকে দিয়ে গেছেন। জানি না, এই স্বপ্নবাজ মানুষটি অদেখা ভুবনে কেমন আছেন। প্রার্থনা করি, যেখানে থাকুন, ভালো থাকুন, পরম করুণাময়ের করুণাধারায় সিক্ত থাকুন।


শাহ্ আলম
কবি ও নাট্যকার

প্রথিতযশা হোমিও চিকিৎসক ডা. চান মোহন মালাকার

0

নরসিংদী রেলস্টেশন সংলগ্ন খালপাড় থেকে ভেলানগর যাওয়ার রাস্তায় ব্রাহ্মন্দী গার্লস হাই স্কুল এন্ড কলেজের সামনেই মালাকার মোড়। মোড় ঘেঁষেই একতলা ভবনের উপরে সাইনবোর্ড ঝুলে আছে— ‘মালাকার হোমিও হল’। সকাল নয়টা বাজতেই রোগীদের ভীড় জমে ওঠে। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ— প্রায় সব বয়সী রোগীরাই এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। তবে বেশি সংখ্যক নারী ও শিশুরাই এখানে সেবা নিতে আসেন।

তৎসময়ে বসন্ত রোগের খুব প্রাদুর্ভাব দেখা দিতো। শীতের শেষে বসন্তের শুরুতে খুব প্রকট আকার ধারণ করতো, চারপাশে হু হু করে ছড়িয়ে পড়তো জলবসন্তের জীবাণু। নিম্ন শ্রেণির পেশাজীবীর মানুষ তখন অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে পারতেন না। তখনই ডা. চান মোহন মালাকার এই গরীব-অসহায়দের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতেন।

কালের পরিক্রমায় বদলে গেছে অনেক কিছুই। আজকের এই শহরের বুক চিরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট বিরাট সব বিল্ডিং, মার্কেট, শপিংমল, পরিবর্তিত হয়েছে রাস্তাঘাট। একটা সময় এসবের কিছুই ছিলো না, বলছি চল্লিশের দশকের কথা। এখানেই একটি টিনের ঘরে নিজ বাড়িতেই ডা. চান মোহন মালাকার শুরু করেছিলেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা। তাঁর জন্ম ২৮ অগ্রহায়ণ ১৩২৬ বঙ্গাব্দ। তিনি একজন ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান ছিলেন। তিনি সাটিরপাড়া কালী কুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন (বর্তমানে সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশন স্কুল এন্ড কলেজ)। তিনি যখন ক্লাশ নাইনে পড়তেন, তখন থেকেই হাতেখড়ি। ব্রাহ্মন্দীর তৎকালীন জমিদার জিতেন্দ্র কিশোর মৌলিকের পরিবার সেবামূলকভাবে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা প্রদান করতেন। গরীব-অসহায়দের সেখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হতো। তিনি সেখান থেকেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় হাতেখড়ি নেন। পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তান আমলে হোমিওপ্যাথিতে এইচএমবি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি নিজ বাড়িতেই এই চিকিৎসা শুরু করেন। তৎসময়ে বসন্ত রোগের খুব প্রাদুর্ভাব দেখা দিতো। শীতের শেষে বসন্তের শুরুতে খুব প্রকট আকার ধারণ করতো, চারপাশে হু হু করে ছড়িয়ে পড়তো জলবসন্তের জীবাণু। নিম্ন শ্রেণির পেশাজীবীর মানুষ তখন অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে পারতেন না। তখনই ডা. চান মোহন মালাকার এই গরীব-অসহায়দের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতেন। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে রোগীরা পায়ে হেঁটে, নৌকায় করে গ্রাম থেকে কাদামাটি পেরিয়ে এখানে আসতেন চিকিৎসার জন্যে। বেশিরভাগই নারী ও শিশু আসতো। শিশুরাই জলবসন্তে আক্রান্ত হতো বেশি। মায়েরা তাদের সন্তান নিয়ে সেই দূরের গ্রাম থেকে নদী পেরিয়ে পায়ে হেঁটে সন্তানের চিকিৎসার জন্যে এখানে আসতেন। তিনি কখনোই কারো কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিতেন না। যার যেমন সাধ্য ছিলো, তেমনই দিতেন। এছাড়াও তিনি যে-সকল মুমূর্ষু রোগীরা আসতে পারতো না, তাদেরকে বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতেন। এভাবেই মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে ডা. চান মোহন মালাকারের নাম। পুরো নরসিংদী জুড়েই ছড়িয়ে পড়ে তাঁর চিকিৎসা খ্যাতি। রোগীরা তাঁকে মালাকার ডাক্তার বলেই চিনতেন। দূর-দূরান্ত থেকে রোগীরা এসে মালাকার ডাক্তারের চেম্বার বা বাড়ির খোঁজ করতো। এভাবে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হতে থাকে মালাকার মোড়। অসংখ্য গুণের অধিকারী মহান হৃদয়ের এই মানুষটি ১৭ আশ্বিন ১৪০১ বঙ্গাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

ডা. চান মোহন মালাকারের ছয় সন্তান। তিন ছেলে এবং তিন মেয়ে। ছোটো ছেলে ডা. সঞ্জয় কুমার মালাকার। তিনিই এখন বাবার এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। তিনি জানান, “আমার বাবা ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় নিয়োজিত হোন। তখন কোনো দোকান ছিলো না, ফার্মেসির নাম ছিলো না, সাইনবোর্ড ছিলো না, বাড়িতে বসেই বাবা চিকিৎসাকার্য চালাতেন। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে রোগীরা আসতেন। তারপর সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছুর বদল হয়েছে। আইন কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। তখন ফার্মেসির নাম ও সাইনবোর্ড লাগানো হলো। আমি হোমিওপ্যাথিতে ডিএইচএমএস ডিগ্রি অর্জন করেছি। এখন আমাদের এখানে প্রতিদিনই ৭০-৮০ জন রোগী আসে।”

এছাড়াও কথা হয়েছে নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী স্যারের সঙ্গে। তিনি বলেন, “বাবু চান মোহন মালাকার একজন খ্যাতিসম্পন্ন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ও নিভৃতচারী সমাজসেবক ছিলেন। ডা. চান মোহন মালাকার দেশভাগ হওয়ার আগে থেকেই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করেন। তাঁর বড়ো ছেলে নারায়ণ মালাকার আমার বন্ধু ছিলো। আমরা একসাথে ব্রাহ্মন্দী বয়েজ স্কুলে পড়তাম। সেই সুবাদে তাঁদের বাসায় যাতায়াত ছিলো, তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তখন আমারও কোনো সমস্যা হলে তাঁর কাছ থেকে ঔষধ নিতাম। সকলের সাথেই খুব আন্তরিকতা ও নমনীয়তা বজায় রাখতেন। তাঁদের পুরো পরিবারটিই অসাম্প্রদায়িক ছিলো।”

নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তাফা মিয়া বলেন, “তৎকালীন সময়ে যে-ক’জন লোক সমাজে নেতৃত্ব দিতেন, তিনি তাদের মধ্যে একজন ছিলেন। তিনি সব সময়ই সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখতেন। তিনি সবথেকে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হিসেবে। তিনি নারীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে খুব সচেতন ছিলেন। তৎসময়ে নারীদের শিক্ষার খুব বেশি সুযোগ ছিলো না। তিনি সেটা উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি ব্রাহ্মন্দী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (এখন যেটা পরিবর্তিত হয়ে ব্রাহ্মন্দী গার্লস হাই স্কুল এন্ড কলেজ)-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। তৎকালীন চিনিশপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব জাহাদ আলী চেয়ারম্যান, ডা. চান মোহন মালাকার, সমসের ইঞ্জিনিয়ার, মধু ভূঁইয়া প্রমুখ সম্মিলিত চেষ্টায় এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।”

নরসিংদীতে বিলুপ্তির পথে পাট চাষ

0

ফাল্গুনের মাঝামাঝি (মার্চের প্রথম সপ্তাহ) থেকে পুরো চৈত্র মাস (এপ্রিলের মাঝামাঝি) পর্যন্ত চলে পাটের বীজ বপন। এই সময়টা ব্যস্ততার মধ্যেই কাটে কৃষকের। বীজ বপনের পর শুরু হয় পাটের চারার যত্ন, নিড়ানি দিয়ে ঘাস উপড়ে ফেলে চারা পাতলাকরণ করা হয়। কৃষকের হাতের ছোঁয়ায় পরম যত্নে বেড়ে ওঠে পাটের চারা। বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে যতোদূর চোখ যায়, পুরো গ্রীষ্মের মাঠ জুড়ে সবুজের সমারোহ, বাতাসে হেলেদুলে নেচে বেড়ায় পাট গাছ, এ যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার্থিব দৃশ্যপট। বর্ষার পানিতে আরো ফুলে-ফেঁপে ওঠে পাটের গাছ। চার মাস প্রতীক্ষার পর আষাঢ়ের পানিতে গাছ কেটে জাগ দিয়ে পচিয়ে কৃষক সংগ্রহ করেন পাট। সেই পাট রোদে শুকিয়ে কৃষকেরা ঘরে তুলে নেন। এ-সময় পাট বিক্রি করে বাড়তি আয় করেন কৃষক, যা দিয়ে পুরো বর্ষাটা কাটিয়ে আবার মাঠের ব্যস্ততায় ফিরে আসেন। এরকম চিত্রের দেখাই মিলতো এক যুগ আগের নরসিংদীর অধিকাংশ গ্রামে।

কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে সেসব সোনালি দিন। এখন আর বিস্তর ফসলের মাঠ জুড়ে দেখা মেলে না পাট ক্ষেতের। প্রতিনিয়ত পাট চাষে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন কৃষকেরা। বর্ষায় পর্যাপ্ত পানির অভাব, ভালো বীজের ঘাটতি, জমি চাষে খরচ বৃদ্ধি, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, বীজ ও সারের চড়া দামÑ সব মিলিয়ে পাট চাষে গুণতে হয় বাড়তি খরচ।

কোনোরকমে খরচ উঠিয়ে, লাকড়ি হিসেবে পাটকাঠিই প্রাপ্য মুনাফা। কখনো কখনো পাটের ফলন কম হলে গুণতে হয় লোকসান। এসব কারণেই কৃষকেরা এখন পাট চাষে আগ্রহী না। প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে পাটের আবাদ।

রায়পুরা উপজেলার চর মধুয়ার কৃষক মোস্তফা মিয়া (৪৮) জানান, পাট চাষে এখন অনেক খরচ, পরিশ্রম বেশি, সেই অনুপাতে লাভ হয় না। তাই এখন শুধু লাকড়ির জন্যে অল্প পরিমাণ পাট চাষ করেন।

শিবপুর উপজেলার জাঙ্গালিয়ার কৃষক নূরু মিয়া (৫৯) জানান, আগে তিনি চার-পাঁচ বিঘা জমি পাট চাষ করতেন। এখন বর্ষায় তেমন পানি না হওয়ায় পাটের জাগ দিতে সমস্যা হয়। তাছাড়া ভালো বীজ পাওয়া যায় না, বেপারিরা পাটের দাম কম দেয়। পাট চাষ করে এখন আর লাভবান হওয়া যায় না। সেজন্যে এখন পাটচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

বিঘা প্রতি প্রায় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয় পাট চাষে। বিঘা প্রতি পাটের ফলন হয় ৫ থেকে ৬ মণ। বিপরীতে বাজারে পাটের দাম কম, ন্যায্য দামে পাট বিক্রি হয় না। বেপারির কাছে অল্প দামে বিক্রি করতে হচ্ছে পাট। গড়ে মণপ্রতি ১,৫০০ থেকে ২,০০০ টাকা পাওয়া যায়।

নরসিংদী সদরের নজরপুরের কৃষক সুলমান মিয়া (৫১) বলেন, “পাট চাষে এখন অনেক খরচ। আগে পাটের মণ বিক্রি করতাম আটশো থেকে এক হাজার টাকা, তখন শ্রমিকের মজুরি ছিলো দেড়শো-দুইশো। আর এখন পাটের মণ দেড়-দুই হাজার, শ্রমিকের মজুরি ছয়-সাতশো। সব মিলায়া খরচ অনেক বেশি, বিক্রি করে লাভ আসে না।”

কোনোরকমে খরচ উঠিয়ে, লাকড়ি হিসেবে পাটকাঠিই প্রাপ্য মুনাফা। কখনো কখনো পাটের ফলন কম হলে গুণতে হয় লোকসান। এসব কারণেই কৃষকেরা এখন পাট চাষে আগ্রহী না। প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে পাটের আবাদ।

নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নরসিংদীতে পাট চাষ হয় ৪,৪১৪ হেক্টর জমিতে। পরবর্তীতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৩,০৪৩ হেক্টর জমিতে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এর পরিমাণ আরো কমে আবাদী জমির পরিমাণ হয় ২,৬৮৫ হেক্টর। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২,৮৭০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করা হয়। ২০১৩ সালের আগের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এক দশকেই পাটের চাষ কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। আনুমানিক দুই দশকে প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে পাট চাষ।

এ-বিষয়ে কথা হয় নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক সালাউদ্দিন টিপুর সাথে। তিনি বলেন, “পাটের জীবনকাল একটু বেশি, একশো বিশ থেকে একশো তিরিশ দিন। পাট চাষে কৃষকের নিরুৎসাহিত হওয়ার অন্যতম কারণ পাটের দাম, পাটের দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় কৃষকরা পাট চাষ করে লাভবান হচ্ছেন না। সেজন্য আমরা চেষ্টা করছি যে, সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে ধান ও গম ক্রয়ের সাথে যদি পাটও ক্রয় করে, তাহলে কৃষকরা পাটের বাজারমূল্য ভালো পাবে। এছাড়াও নরসিংদীতে যেসব পাটকল আছে, সেখানে আমরা যোগাযোগ করছি, তারা যেন কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি পাট ক্রয় করে। এই প্রক্রিয়াটা হয়ে গেলে কৃষকের আর বেপারির কাছে কম দামে পাট বিক্রি করতে হবে না। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, পাটের উন্নতমানের ভালো বীজ কৃষকরা সংগ্রহ করতে পারছেন না, ফলে পাটের ফলন কম হচ্ছে। সেজন্য আমরা কৃষকদের ট্রেনিং দিচ্ছি, উন্নতমানের বীজ দিয়ে পাট চাষে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছি।”

নরসিংদীতে বিলাতি ধনিয়া চাষ : সম্ভাবনার নতুন পথ

0

নরসিংদী শাক-সবজি উৎপাদনসহ বিভিন্ন কৃষিজাত ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখানকার সবজি পুরো দেশব্যপী বিপণন করা হয়। বিশেষ করে, শিবপুর, বেলাব ও রায়পুরা উপজেলায় প্রচুর সবজি উৎপাদিত হয়।

বিলাতি ধনিয়া বা বাংলা ধনিয়া, যার বৈজ্ঞানিক নাম Petroselinum Crispum। এটি একটি মশলা জাতীয় ফসল। চাসনি পাতা হিসেবেও এর পরিচিতি আছে। এর পাতা সবুজ, লম্বাকৃতির, চারপাশে করাতের দাঁতের মতো খাঁজ কাটা। প্রখর সুগন্ধিযুক্ত, পুষ্টিগুণসম্পন্ন ও উন্নত ভেষজগুণে সমৃদ্ধ। নরসিংদী জেলার বেলাব, শিবপুর ও রায়পুরা উপজেলার ছায়াযুক্ত পতিত জমিতে বিলাতি ধনিয়ার চাষাবাদ হয়ে থাকে। বিশেষ করে, বেলাব-শিবপুর উপজেলার উয়ারী, বটেশ্বর, উজলাবো, রাঙ্গারটেক, জয়নগরসহ বেশকিছু এলাকায় কৃষকেরা বাণিজ্যিকভাবে এর চাষাবাদ শুরু করেছেন। এই এলাকার মাটি খুবই উর্বর, রসালো, পানি নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা আছে এবং ছায়াযুক্ত পরিবেশ থাকায় এখানে বিলাতি ধনিয়ার ভালো চাষাবাদ হয়। পুরো এলাকা জুড়েই রয়েছে বিভিন্ন ফলের গাছ— আম, কাঁঠাল, লটকন ও বিভিন্ন রকমের গাছপালা। এতো এতো গাছপালা থাকার ফলে জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ছায়া পড়ে। এসবকিছু মিলিয়ে এখানকার ভূমি এই ফসল উৎপাদনের জন্যে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে।

কৃষকেরা প্রথমে তিন-চারবার ভালো করে জমি চষে, মাটি ভেঙে ঝুরঝুরে করে, জমিতে পরিমাণমতো গোবর ও রাসায়নিক সার দিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে নেয়। তারপর জমিতে সেচের পানি দিয়ে মাটি রসালো করে বীজ বোনে। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস (মধ্য কার্তিক থেকে মধ্য ফাল্গুন) পর্যন্ত বীজ বোনা হয়। চারা গজানোর পর নিয়মিত নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে জমিতে সেচ প্রদান করা হয়, নির্দিষ্ট সময় পর পর ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করা হয়। চারা গজানোর ৪৫ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা হয়। গাছের নিচের দিকের বড়ো পাতাগুলো তুলে ডুবো পানিতে ধুয়ে আঁটি বেঁধে বিক্রির জন্যে প্রস্তুত করা হয়। প্রতিদিন বিকেলে কৃষকেরা পাতা তুলতে ব্যস্ত সময় পার করে। বিকেলে পাতা তুলে সন্ধ্যার মধ্যেই সমস্ত কাজ শেষ করে প্রস্তুতকৃত পাতা বিক্রি করে পরদিন সকালে। এভাবে পাতা তুললে দীর্ঘমেয়াদে নিয়মিত পাতা তোলা যায়।

আমার স্বামী চৌদ্দ গণ্ডা (একুশ শতক) জমিতে ধইন্যা লাগাইছেন। আমি প্রতিদিন বিকেলে পাতা তুলে ধুয়ে আঁটি বেঁধে দেই। অনেক পরিশ্রম লাগে। খরচ হইছে পঞ্চাশ হাজার টাকার বেশি। আশা করি, পাঁচ লাখ টাকার মতো বিক্রি করতে পারবো।

কৃষক লতিফ মিয়া (৫৫) বলেন, “বিলাতি ধনে চাষ করতে অনেক খাটুনি লাগে। নিয়মিত নিড়ানি দিতে হয়, জমিতে আগাছা হলে ফলন কম হয়।” তিনি আরো বলেন, “করতে পারলে লাভ আছে। খরচ কম, লাভ বেশি। গায়ে-গতরে খাটতে হয় বেশি। একবার লাগাইলে সারা বছর পাতা তোলা যায়।”

বটেশ্বরের কৃষক কফিল উদ্দীন খান (৪৮) জানান, “তিনি পাঁচ গণ্ডা (আট শতাংশ) জমি চাষ করেছেন। এখানে প্রায় বিশ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তিনি এখনো পর্যন্ত চল্লিশ হাজার টাকার পাতা বিক্রি করেছেন। পুরো সিজনে প্রায় দুই লাখ  টাকা বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন।”

প্রতি শতক জমি চাষাবাদ করতে ২,০০০-২,৫০০ টাকা খরচ হয়। আর পাতা সংগ্রহ করা যায় প্রায় ১৮০-২৫০ কেজি। প্রতি কেজি পাতা গড়ে ১০০-১২০ টাকা করে পাইকারি বিক্রি হয়। স্থানীয় বটেশ্বর বাজারে প্রতিদিন সকাল এগারোটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত হাট বসে। এখানে কৃষকের কাছ থেকে পাইকাররা পাতা কিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা ও বিভাগে আড়তদার এবং খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে। এছাড়াও মরজাল, বারৈচা ও শিবপুর বাজারে নিয়মিত কেনাবেচা হয়। বর্ষার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পূর্ণ উদ্যমে চলে এই কাজ। টানা দুই থেকে তিন মাস কৃষকেরা পাতা সংগ্রহ করতে পারেন। এছাড়াও বয়স্ক চারা থেকে বীজ সংগ্রহ করে সেই বীজ বিক্রি করেও আয় করা যায় বাড়তি টাকা।

কৃষক ফুলমতি (৫২) জানান, “আমার স্বামী চৌদ্দ গণ্ডা (একুশ শতক) জমিতে ধইন্যা লাগাইছেন। আমি প্রতিদিন বিকেলে পাতা তুলে ধুয়ে আঁটি বেঁধে দেই। অনেক পরিশ্রম লাগে। খরচ হইছে পঞ্চাশ হাজার টাকার বেশি। আশা করি, পাঁচ লাখ টাকার মতো বিক্রি করতে পারবো।”

এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে গাছপালা আছে। মাটির পুষ্টিগুণ খুবই ভালো, পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়, মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বেশি, পানি নিষ্কাশনের সুবিধা ভালো। অনেক গাছপালা, বাগান থাকার জন্যে পর্যাপ্ত ছায়া পাওয়া যায়। বিলাতি ধনে সরাসরি রোদে পড়লে পাতার কাঁটা শক্ত হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়। সেজন্যে আলাদা করে ছাউনির ব্যবস্থা করা লাগে। কিন্তু আমাদের এই অঞ্চলে এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। মাটির পুষ্টিগুণ ভালো হওয়ায় সার বেশি লাগে না। ফলে খরচ অনেকাংশে কমে যায় এবং উৎপাদন ভালো হয়। এই ফসল চাষে কৃষকের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অন্যান্য ফসল চাষে কৃষকদের বাড়তি রাসায়নিক সার ও মজুরির খরচ গুণতে হয়। বাড়ির আঙিনায়, বাগানের মধ্যে খালি জমি ইত্যাদি স্থানেই চাষ করা হয়। ফলে পরিবারের সকলে একসাথে হাত লাগিয়ে কাজ করতে পারে। কৃষকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বিলাতি ধনিয়া চাষে বিঘা প্রতি আনুমানিক খরচ ষাট থেকে সত্তর হাজার টাকা। আর ফসল সংগ্রহ করে বিক্রি করে আয় হবে আনুমানিক সাত থেকে আট লাখ টাকা। কৃষকের আরেকটু সচেতনতা ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সুনজর পড়লে আশা করা যায়, অন্যসব সবজির মতো এটিও হতে পারে একটি প্রধান অর্থকরী ফসল এবং এতে তৈরি হবে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার।

সাংবাদিকতার অগ্রদূত হাবিবুল্লাহ বাহার : প্রয়াণের ৩০ বছর

0

‘নরসিংদীর খবর’ ছিলো সাজানো-গোছানো এবং নিয়মিত প্রকাশনা। যার ফলে পত্রিকাটিকে নরসিংদীতে আধুনিক পত্রিকার পথিকৃৎ বলা হয়। অবশ্য হাবিবুল্লাহ বাহারের যোগ্যতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার গুণেই পত্রিকাটি সহজে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু বেশিদিন তিনি ‘নরসিংদী খবর’ পত্রিকাটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারেননি। মাত্র পাঁচ বছর পত্রিকাটির সম্পাদনায় যুক্ত থাকতে পেরেছিলেন। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে ১৯৯৫ সালের ২১ অক্টোবর তিনি পরলোকগমন করেন।

প্রবীণ সাংবাদিক হাবিবুল্লাহ বাহার (১৯৪৪-১৯৯৫) নরসিংদী অঞ্চলের সাংবাদিকতায় নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন। সেই জাগরণের মূল সূত্র ছিলো ‘সাপ্তাহিক নরসিংদীর খবর’ পত্রিকা। এর প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে স্থানীয় সাংবাদিকতার খোলনলচে পাল্টে দিয়েছিলেন তিনি। একসময় শহরের দু-চারজন মানুষ সাংবাদিকতা করতেন। কিন্তু ১৯৯০ সালে ‘নরসিংদীর খবর’ প্রকাশের মাধ্যমে সাংবাদিকতার ধারণাকে জেলা শহর থেকে থানা কিংবা ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন হাবিবুল্লাহ বাহার। প্রতিটি স্থানে সাংবাদিক কিংবা সংবাদের সোর্স নিয়োগ দিয়ে সংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের জগতে তিনি ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন। স্থানীয়ভাবে ‘নরসিংদীর খবর’ পত্রিকার আগেও কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিলো। সেগুলো ছিলো অনিয়মিত। কিন্তু ‘নরসিংদীর খবর’ ছিলো সাজানো-গোছানো এবং নিয়মিত প্রকাশনা। যার ফলে পত্রিকাটিকে নরসিংদীতে আধুনিক পত্রিকার পথিকৃৎ বলা হয়। অবশ্য হাবিবুল্লাহ বাহারের যোগ্যতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার গুণেই পত্রিকাটি সহজে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু বেশিদিন তিনি ‘নরসিংদী খবর’ পত্রিকাটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারেননি। মাত্র পাঁচ বছর পত্রিকাটির সম্পাদনায় যুক্ত থাকতে পেরেছিলেন। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে ১৯৯৫ সালের ২১ অক্টোবর তিনি পরলোকগমন করেন।

হাবিবুল্লাহ বাহার (১৯৪৪-১৯৯৫)

তাঁর মৃত্যুর পর অনেকেই ভেবেছিলো, হয়তো পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাবে। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক হলেও তারা তখনো শিশু। স্ত্রী সেতারা বেগম সরকারি চাকুরিতে থাকায় পত্রিকাটি চালানোর মতো সময় পাবেন কি না, সেটা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু এ-ধারণাকে অমূলক প্রমাণ করেছিলেন সেতারা বেগম। তিনি নরসিংদীর খবর পত্রিকাটিকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। সফলও হন। এখনো পর্যন্ত নরসিংদীর খবর জেলার একটি জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য পত্রিকার আসন দখল করে আছে।

হাবিবুল্লাহ বাহারের সঙ্গে আমার ছোটো একটি স্মৃতি রয়েছে। আমি তখন ঢাকায় জনপ্রিয় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে চাকুরি করি। একদিন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসে ভেলানগরস্থ ‘নরসিংদীর খবর’ পত্রিকার কার্যালয়ে যাই। সাংবাদিকতা ও লেখালেখি নিয়ে তাঁর সঙ্গে অনেক কথাবার্তা বলি। আপাদমস্তক একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন তিনি। সাম্যবাদের জন্যে আমৃত্যু রাজনীতি করে গেছেন। চলাফেরাও করতেন সাধারণ মানুষের মতো। তিনি আমাকে নরসিংদীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে প্রবন্ধ লেখার অনুরোধ করেন। আমি ঢাকা ফিরে প্রখ্যাত কবিয়াল হরিচরণ আচার্য্যকে নিয়ে একটি দীর্ঘ লেখা পাঠাই, যা হাবিবুল্লাহ বাহার অত্যন্ত যত্ন করে ছেপেছিলেন। পরে এই লেখাটি ত্রিপুরার আগরতলাস্থ ‘কবিগুণাকর হরিচরণ গবেষণাগার’ থেকে প্রকাশিত বইয়ে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছিলো।

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম মোস্তাফা মিয়া বলেন, “হাবিবুল্লাহ বাহার সাংবাদিক হিসেবে যতোটা না জনপ্রিয় ছিলেন, তার চেয়ে বেশি খ্যাতিমান ছিলেন ‘নরসিংদীর খবর’ প্রকাশ করে। পত্রিকাটি নরসিংদীর সাংবাদিকতার চরিত্র পাল্টে দিয়েছিলো। অনেক ভালো ভালো সাংবাদিকের জন্ম দিয়েছিলো পত্রিকাটি। এর নেপথ্য কারিগর ছিলেন কর্মযোগী হাবিবুল্লাহ বাহার।”

কথা প্রসঙ্গে গোলাম মোস্তাফা মিয়া আরো জানান, “একসময় নরসিংদীর সাংবাদিকতা ঝিমিয়ে পড়েছিলো। সেই ঝিমিয়ে পড়াদের মধ্যে হাবিবুল্লাহ বাহারও ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে একটি পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে সাংবাদিক সমাজকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। তিনি অকালে মারা না গেলে আরো অবদান রাখতে পারতেন। পরবর্তীতে নরসিংদীর খবরের হাল ধরেছিলেন তাঁর সুযোগ্য স্ত্রী সেতারা বেগম। এখনো তিনি পত্রিকাটি এগিয়ে নেয়ার জন্যে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন।”

হাবিবুল্লাহ বাহার অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ছিলেন। তিনি মুখে যা বলতেন, যতো কষ্টই হোক, তা-ই করতেন। তিনি নিজে সম-সাময়িক বিষয়ের উপর সম্পাদকীয় লিখতেন। কখনো কপি করতেন না। এখনো পর্যন্ত হাবিবুল্লাহ বাহারের নীতি-রীতিই ধারণ করে আছে পত্রিকাটি।

হাবিবুল্লাহ বাহারের সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়েছিলো ঐতিহ্যবাহী ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার মাধ্যমে। তিনি প্রথমদিকে ‘সংবাদ’-এর ছাপাখানায় ছোটো একটি চাকরি নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সাংবাদিকতা আর লেখালেখির পোকা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। সহকর্মী ও ‘সংবাদ’-এর বর্ষীয়ান সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে থাকেন। এক পর্যায়ে জন্মস্থান নরসিংদীতে ফিরে আসেন। দৈনিক সংবাদের নরসিংদী সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। জেলার সর্বত্র সংবাদ সংগ্রহের জন্যে দাপিয়ে বেড়াতে থাকেন।

কর্মবীর ছিলেন তিনি। শুধু সংবাদ পত্রিকার সংবাদদাতার করিডোরে সীমাবদ্ধ থাকতে চাননি। জেলা প্রেস ক্লাবকে নতুন করে গড়ে তোলা এবং সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭২ সালে গড়ে ওঠা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বাবু ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর ও বাবু নিবারণ রায়। একই সাথে তাঁরা প্রথম সভাপতি ও প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দীর্ঘ ২২ বছর (১৯৭২-১৯৯৪) একাধারে নিবারণ রায় সাধারণ সম্পাদক থাকলেও ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর (১৯৭২-১৯৭৪) এবং স্বপন কুমার সাহা (১৯৭৪-১৯৭৫)-এর পর সভাপতি হন হাবিবুল্লাহ বাহার। দুই মেয়াদে (১৯৭৫-১৯৭৯ ও ১৯৮০-১৯৯২) প্রায় ১৬ বছর তিনি নরসিংদী প্রেস ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

সাংবাদিকতা ছাড়া হাবিবুল্লাহ বাহার ‘ন্যাপ (মোজাফফর)’ রাজনৈতিক দলের নিষ্ঠাবান নেতা ছিলেন। নরসিংদীর গৌরবময় কৃষক আন্দোলনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিলো। খেটে খাওয়া কৃষক-শ্রমিকদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যে তিনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। নরসিংদী সরকারি কলেজে পড়াশোনার সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

তাঁর জন্ম পলাশ থানার গয়েশপুর গ্রামে হলেও তিনি ভেলানগরস্থ নানার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতেন। পরবর্তীতে সেখানেই স্থায়ী হন। সেখানেই গড়ে তোলেন নরসিংদীর খবর পত্রিকার কার্যালয়। লেখক-সাংবাদিকদের মিলনমেলায় পরিণত হয় স্থানটি। প্রবীণ শিক্ষক ও সাংবাদিক হলধর সাহা জানান, নরসিংদীর খবর পত্রিকার শুরুতে এর সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। তাঁর মতো আরো অনেক সাংবাদিক, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যমণি ছিলেন হাবিবুল্লাহ বাহার। ব্যক্তিত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে অনেক মানুষের প্রিয় ছিলেন তিনি। নরসিংদীর খবর প্রকাশ করে তিনি নরসিংদীর সাংবাদিকতায় জোয়ার সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি পত্রিকা প্রকাশ না করলে হয়তো স্থানীয় সাংবাদিকতা অনেকটা পিছিয়েই থাকতো।

নরসিংদীর খবর পত্রিকায় কাজ করেছেন এমন একাধিক সাংবাদিক জানান, হাবিবুল্লাহ বাহার অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ছিলেন। তিনি মুখে যা বলতেন, যতো কষ্টই হোক, তা-ই করতেন। তিনি নিজে সম-সাময়িক বিষয়ের উপর সম্পাদকীয় লিখতেন। কখনো কপি করতেন না। এখনো পর্যন্ত হাবিবুল্লাহ বাহারের নীতি-রীতিই ধারণ করে আছে পত্রিকাটি। বর্তমান সম্পাদক অধ্যাপক সেতারা বেগমও প্রাক্তন সম্পাদকের নীতি অনুসরণ করে নিজ হাতে সম্পাদকীয় লিখে যাচ্ছেন। যে-কারণে নরসিংদীর খবর পত্রিকাটি স্থানীয়ভাবে তার সূচনালগ্ন থেকে এখনো পর্যন্ত প্রথম সারিতে রয়েছে। পত্রিকাটি পাঠকেরা পকেটের পয়সা খরচ করে কেনেন এবং পড়েন।
আজ নরসিংদীর খবর পত্রিকাটি যে-শক্ত খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেটার ভিত রচনা করে গেছেন হাবিবুল্লাহ বাহার। কঠোর পরিশ্রমী এই মানুষটি নানা পেশা, নানা অভিজ্ঞতা থেকে যে-জ্ঞান আহরণ করেছিলেন, সেসব সাংবাদিকতায় কাজে লাগিয়ে গেছেন। কখনো কো-অপারেটিভ, কখনো এনজিও কর্মী, কখনো সরকারি কলেজের কর্মকর্তা হিসেবে কিংবা ছাপাখানার কর্মী হিসেবে কাজ করে নিজের জীবন মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করে গেছেন।

প্রখ্যাত সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান সরদার তাঁর লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইয়ে হাবিবুল্লাহ বাহার ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে কিছু তথ্য উল্লেখ করেছেন। ১৯৭১ সালে শাহজাহান সরদার তাঁর মনোহরদীর বাড়ি থেকে ত্রিপুরায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে যাবার আগে হাবিবুল্লাহ বাহারের ভেলানগরস্থ বাসায় রাত্রিযাপন করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রখ্যাত ন্যাপ নেতা কামাল হায়দার ও নারায়ণগঞ্জ বারের আইনজীবী ওয়াজউদ্দিন। পরের দিন নরসিংদী থেকে লঞ্চে নবীনগর হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তাঁরা ত্রিপুরা গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। হাবিবুল্লাহ বাহারের পরিবার সম্পর্কে শাহজাহান সরদার উল্লেখ করেন, “গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে শিবপুর পৌঁছি দু’ঘণ্টায়। সেখান থেকে বাসে নরসিংদীর ভেলানগর। কামাল হায়দারও এখানে এলেন। বড় ভাই ন্যাপ নেতা, ছোট ভাই ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। এখানে আরো একজন এলেন, নারায়ণগঞ্জ বারের উকিল ও আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট ওয়াজউদ্দিন। রাতে তাঁদের বাসায় থাকি, হাবিবুল্লাহ বাহার ও শহীদুল্লাহ বাহারের বাবা বেঁচে নেই। বৃদ্ধ মা ও ছোট বোন, মা ও ছোট বোন শুধু বাসায়। ২৫ এপ্রিল সকালে দুই ভাই মা ও বোনের কাছ থেকে বিদায় নেন।”

রাজনৈতিক জীবনে হাবিবুল্লাহ বাহার ছিলেন সর্বহারা কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির ত্রাণকর্তা। ক্ষণস্থায়ী জীবনে বহু কালজয়ী কর্মের সঙ্গে জড়িয়ে অমর হয়ে আছেন তিনি। কিন্তু স্থানীয়ভাবে বড়ো অবহেলিত এই মানুষটি। তাঁর কোনো স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি নরসিংদী শহরের কোথাও। প্রবীণ সাংবাদিক, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও নরসিংদীর কোনো সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন তাঁকে স্মরণ করেন না। কিন্তু তাঁকে স্মরণ করা, তাঁর কর্ম ও জীবনকে জনসম্মুখে তুলে আনা প্রাজ্ঞ ও সচেতন মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হওয়া উচিত ছিলো।


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

স্থানীয় সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর

0

স্বাধীনতার পরপর নরসিংদী ঢাকা জেলার একটি ছোটো থানা শহর। সাংবাদিকদের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিককে নিয়ে ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর গড়ে তোলেন নরসিংদী প্রেস ক্লাব। সবাই মিলে প্রধান সাংবাদিক হিসেবে তাঁকেই সভাপতি নির্বাচিত করেন।

একজন নির্লোভ ও মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ ছিলেন ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর (১৯২৫-১৯৮৩)। এসব বিশেষণের প্রভাব পড়েছিলো তাঁর কর্মজীবনে— সাংবাদিকতায়। দিনের পর দিন অভুক্ত থেকেও মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিরসনে তিনি আপোষহীন কলমযোদ্ধা ছিলেন। পকেটে টাকা নেই, পেটে ভাত নেই— এমন দারিদ্র্য তাঁর পেশায় পিছুটান আনতে পারেনি। ঢাকার নিকটবর্তী নরসিংদী জনপদে ঘুরে ঘুরে মানুষের দুঃখ-কষ্ট আর সমস্যা খুঁজে বেরিয়েছেন আমৃত্যু। সেসব সংবাদপত্রে প্রকাশ করে সমাধানের পথ সুগম করে গেছেন।

নরসিংদীর এমন কোনো গ্রাম কিংবা দুর্গম এলাকা ছিলো না, যেখানকার মানুষ ঈশ্বর চন্দ্রের নাম জানতেন না। তবে তিনি ‘ঈশ্বর বাবু’ নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। গায়ে হাফ-হাতা তিন পকেটঅলা শার্ট আর লুঙি, পায়ে চটি চাপিয়ে ভোরবেলা বাসা থেকে বের হতেন। পকেটে কলম আর নোটবুক ছিলো সর্বদা তাঁর সঙ্গী। মানুষের সব সমস্যা নিজের মাথায় নিয়ে ঘুরতেন। কীভাবে রিপোর্ট লিখলে মানুষ সেটা থেকে মুক্তি পাবে, সেই চিন্তা-ভাবনায় মগ্ন থাকতেন। কখনো নিজের সমস্যার কথা ভাবেননি। কখনো প্রচণ্ড ক্ষিধেয় কাহিল হয়ে পকেটের কোণ হাতড়ে খুচরো পয়সা পেলেও তা দিয়ে ভাত কিংবা রুটি খাওয়া সম্ভব ছিলো না। অগত্যা সামান্য মুড়ি কিনে ক্ষুধা নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। এভাবে জীবন ধারণ করতে গিয়ে সংসার-ধর্ম করার কথা তাঁর মনেই আসেনি। অকৃতদার জীবন বেছে নিয়েছিলেন নির্বিঘ্নে সাংবাদিকতা পেশা চালিয়ে যাবার জন্যে।

পাকিস্তান আমলে ঈশ্বর বাবু যখন সাংবাদিকতা শুরু করেন, তখন নরসিংদী ছিলো ঢাকা জেলাধীন নারায়ণগঞ্জ মহকুমার একটি মফস্বল থানা শহর। এর পার্শ্ববর্তী থানাগুলো, যেমন : শিবপুর, রায়পুরা, মনোহরদী, পলাশ ও বেলাব অবশ্য তেমন উন্নত ছিলো না। এসব এলাকার লোকজন কেনাকাটা কিংবা চিকিৎসা নিতে নরসিংদী থানা শহরে আসতেন। পরবর্তীতে নরসিংদী হয়ে ওঠে এসব থানার কেন্দ্রস্থল। এর ধারাবাহিকতায় থানা শহরটি প্রথমে মহকুমা, পরে জেলা শহরে পরিণত হয়। নৌকাঘাটা শিবপুর থানাধীন লালমাটির সভ্যতা ঘেরা একটি গ্রামের নাম। সেই গ্রামের সূত্রধর পরিবারে ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন ঈশ্বর বাবু। তাঁর বাবার নাম শ্যামাচরণ সূত্রধর। বাল্যকাল সে-গ্রামেই কাটে। বাবা কাঠের কাজ (আসবাবপত্র, গৃহনির্মাণ ও নৌকা বানানো) করে জীবিকা  নির্বাহ করতেন। কিন্তু ছেলেকে তিনি সূত্রধর বা মিস্ত্রি বানাতে চাননি। এভাবে এইচএসসি পাশ করার পর আর উচ্চশিক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে। পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। কিন্তু তখন তাঁর মাথায় কাজ করছিলো অন্য এক চিন্তা। মওলানা ভাসানী, মাওলানা আকরম খাঁ, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সন্তোষ গুপ্ত প্রমুখের বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনে আকৃষ্ট হন ঈশ্বর বাবু। বিশেষ করে, মানিক মিয়ার আপোষহীন ও সাহসী সাংবাদিকতা তাঁর মনে গেঁথে যায়। তাই তিনি মাস্টারি ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতা পেশা গ্রহণে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু গ্রামে থেকে এ-ধরনের সাংবাদিকতা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়েই নরসিংদী চলে আসেন। এখানে নেই তাঁর আশ্রয়, নেই কোনো আত্মীয়-স্বজন। অনেকটা ভবঘুরে জীবন বেছে নেন। পেটে ভাত না থাকলেও চোখে-মুখে সাংবাদিক হওয়ার দীপ্ত আলোর রশ্নি ভাসতে থাকে। সফলও হন। তখন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ দেশের সবচে’ জনপ্রিয় পত্রিকা এবং সেটির ভূমিকা ছিলো দুঃসাহসিক। এর সঙ্গেই যুক্ত হলেন ঈশ্বর বাবু। নরসিংদীর সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এভাবে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত  ইত্তেফাকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু ঠুনকো একটি ঘটনায় ইত্তেফাকের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য দেখা দেয়। ছেড়ে দেন প্রিয় ইত্তেফাক। এরপর সংযোগ ঘটে সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘বাসস’-এর সঙ্গে। ১৯৮৩ সালের ১৬ অক্টোবর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাসসের সঙ্গে ছিলেন তিনি।

বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনে মহকুমা প্রশাসক, মন্ত্রী, সচিব কিংবা ডিসি-এসপিদের সান্নিধ্যে জীবন কাটালেও ব্যক্তিগত জীবন ছিলো অত্যন্ত সাদামাটা এবং দারিদ্র্যে নিমজ্জিত। এরপরও পকেটে দু-চারশো টাকা থাকলে রাজা হয়ে যেতেন। আশেপাশের মানুষজন কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের যত্ন করে খাওয়াতেন। পকেট খালি থাকলেও চুপ করে বসে থাকতেন। না খেয়ে থাকলেও কিছু বলতেন না। তখন একমুঠো মুড়ি কিংবা চিড়া খেয়ে জীবনধারণ করতেন।

ঈশ্বর বাবুর ঘনিষ্ঠ শিষ্য নিবারণ রায় জানান, অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন ঈশ্বর বাবু। কোনো চাহিদা ছিলো না। টাকা থাকলে খেতেন, না থাকলে উপোস থাকতেন। বসবাস করতেন নরসিংদী শহরের পশ্চিম কান্দাপাড়াস্থ বিধুভূষণ দাসের এক ছাপড়াঘরে। ভাড়া ২০-২৫ টাকা মাত্র। চিরকুমার এ-মানুষটির ঘর-সংসার ছিলো না সত্যি, কিন্তু তিনি পুরো নরসিংদীবাসীকে নিজের সংসার মনে করতেন। অসহায়-গরীব মানুষকে নিজের সন্তানতুল্য মনে করতেন। কখনো তিনি সম্পদের পেছনে ছোটেননি। নিজের এক টুকরো জমি বরাদ্দের জন্যে ডিসি-এসপিকে অনুরোধ করেননি।

বর্ষীয়ান সাংবাদিক নিবারণ বাবু আরো জানান, “১৯৭৪ সালে তিনি ইত্তেফাক ছেড়ে দিলেও তিনি আমাকে সে-পত্রিকার সাংবাদিক হিসাবে নিয়োগ দিতে অনেক চেষ্টা করেন। সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে অনুরোধ করেন, আমাকে নরসিংদী প্রতিনিধি করার জন্য। তাঁর কাছ থেকে হাতে-কলমে সাংবাদিকতা শিখি। এমন সৎ সাংবাদিক আমি জীবনে দেখিনি। অনেক সময় উপোস থেকে আমাদের বাসায় যেতেন। কখনো মুখ ফুটে কিছু বলতেন না। আমার মা অনেক সময় তাঁকে জোর করে খাওয়াতেন। তিনি সাংবাদিকতার জন্য  জীবন বিলিয়ে গেছেন। কিন্তু নিজে কোনো কিছু প্রত্যাশা করেননি। দুঃখজনক বিষয় হলো, নরসিংদীর মানুষ তথা সাংবাদিক সমাজ এ-মহান ব্যক্তিটিকে ভুলে গেছে।”

নরসিংদী প্রেস ক্লাব সূত্রে জানা গেছে, উক্ত প্রেস ক্লাবের জন্ম ১৯৭২ সালে। স্বাধীনতার পরপর নরসিংদী ঢাকা জেলার একটি ছোটো থানা শহর। সাংবাদিকদের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিককে নিয়ে ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর গড়ে তোলেন নরসিংদী প্রেস ক্লাব। সবাই মিলে প্রধান সাংবাদিক হিসেবে তাঁকেই সভাপতি নির্বাচিত করেন। সাধারণ সম্পাদক হন বাবু নিবারণ রায়। এভাবে পথচলা শুরু হয় নরসিংদী প্রেস ক্লাবের। এরপর উক্ত প্রেস ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এবং দূতাবাস কর্মকর্তা স্বপন কুমার সাহা, ‘নরসিংদীর খবর’-এর সম্পাদক হাবিবুল্লাহ বাহারের মতো বরেণ্য সাংবাদিকরা। তাছাড়া উক্ত প্রেস ক্লাবের সঙ্গে জড়িত অনেকেই পরবর্তী জীবনে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। বর্তমানে নরসিংদী প্রেস ক্লাব সাংবাদিকদেরকে বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়ে যাচ্ছে। নিজস্ব বহুতল ভবনে বসে সাংবাদিকেরা পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি আড্ডা ও পরামর্শ করছেন। অথচ এর গোড়াপত্তন করে গেছেন ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর।

ঈশ্বর বাবুর শেষ জীবনটা ছিলো সবচে’ মর্মান্তিক। অর্থকষ্টে সঠিক চিকিৎসা পর্যন্ত করতে পারনেনি। আত্মীয়-পরিজনবিহীন অবস্থায় ডায়বেটিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কঠোর নিয়ম-নীতি আর ব্যয়বহুল ঔষধের অভাবে মধ্যবয়সেই ঝরে পড়েছিলেন তিনি। শরীরে আঘাতজনিত কারণে তিনি গ্যাংগ্রিনে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ডায়বেটিস থাকায় সেটা সহজে সেরে ওঠছিলো না। একপর্যায়ে সে-আঘাত ভয়াবহ রূপ ধারণ করে অর্থের অভাবে। শিষ্য নিবারণ বাবু স্বউদ্যোগে গুরুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেন। কিন্তু অবস্থাটা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো যে, সেখান থেকে তাঁর অবস্থা ভালোর দিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৩ সালের ১৬ অক্টোবর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে মৃত্যুবরণ করেন। তখন তাঁর জন্যে চোখের পানি ফেলার মতো একজন সহকর্মী কিংবা আত্মীয়ও ছিলো না। সে-সময় লাশ গ্রহণ এবং সৎকারের লোক খুঁজে পাচ্ছিলো না মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ। অবশেষে নিবারণ বাবু এবং তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা’র প্রচেষ্টায় একটি ট্রাকে করে প্রবীণ সাংবাদিক ঈশ্বর বাবুর লাশ নরসিংদীতে আনা হয়। এবার বিপত্তি বাধলো হিন্দু ধর্ম অনুসারে তাঁর মুখাগ্নি নিয়ে। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী, একজন নিকটাত্মীয় কিংবা সন্তানকে এ-দায়িত্ব পালন করতে হয়। কিন্তু সেখানে এমন কেউ ছিলেন না। এগিয়ে এসে শিষ্য নিবারণ রায় গুরু ঈশ্বর বাবুকে মেঘনা নদীতীরবর্তী শ্মশানে নিয়ে সৎকার করলেন। মুখাগ্নি করলেন নিজ হাতে। এভাবে একজন সাংবাদিকের ট্র্যাজেডিপূর্ণ ইতিহাসের জন্ম হলো নরসিংদীতে।

তিনি যখন মারা যান, তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে তাঁর লাশ গ্রহণের জন্যে কোনো আত্মীয়-স্বজন পাওয়া যায়নি। শিষ্যদের প্রচেষ্টায় তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিলো। এরপর হঠাৎ করে এই অকৃতদার মানুষটির আত্মীয়-স্বজনের আবির্ভাব ঘটে। মূলত তারা ঈশ্বর বাবুর ব্যাংক-ব্যালেন্সের খোঁজ করতে এসেছিলেন।

এই ত্যাগী ও বড়ো সাংবাদিককে নিয়ে ছোটো একটি স্মৃতি রয়েছে আমার। আমি তখন জন্মস্থান দিলারপুরের ছঘরিয়া পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি, তৃতীয় শ্রেণিতে। সে-সময় এক প্রচণ্ড ঝড়ে স্কুলগৃহটি উড়ে যায়। ফলে খোলামাঠে ক্লাশ করতে হতো আমাদের। এর মধ্যে একদিন হেডমাস্টার স্যার ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বললেন, আগামীকাল সবাই ভালো কাপড়-চোপড় পরে আসবে। আমরা ধরে নিই, আগামীকাল হয়তো স্কুল পরিদর্শক আসবেন। কিন্তু পরদিন দেখা গেলো, একজন সাংবাদিক কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে হাজির হলেন। খোলা মাঠে ক্লাশ নেয়ার দৃশ্য ধারণ করে সাংবাদিক সাহেব চলে গেলেন। পরদিন দেখলাম, ইত্তেফাক পত্রিকায় সেই ছবিসহ একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে। সংবাদের শুরুতে ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর নামটি রয়েছে। হেডস্যার পত্রিকা বগলদাবা করে স্কুলে হাজির। এর কিছুদিন পর জানতে পারলাম, সংবাদটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই স্কুলগৃহের নির্মাণকাজ শুরু হয়ে যায়। কাঁচা ঘর পাকা ভবনে রূপ নেয়। ঘটনাটি আমার মনে বেশ দাগ কাটে। তাৎক্ষণিকভাবে সাংবাদিক ঈশ্বর বাবুকে আমার কাছে সংবাদের জাদুকর মনে হয়েছিলো। একটিমাত্র সংবাদে উড়ে যাওয়া স্কুলগৃহ পাকা দালানে পরিণত হয়েছে। তাঁর এই কীর্তিতে আমার মনে একটি প্রশ্ন উঠেছিলো, সাংবাদিকেরা আসলে কি মানুষ, না অন্য গ্রহের জীব? ঈশ্বর বাবুর এই জাদুকরী কাণ্ডের প্রভাব পরবর্তীতে আমার পেশাগত জীবনের উপর পড়ে। সাংবাদিক হওয়ার সুপ্ত বাসনা মনে অঙ্কুরিত হতে থাকে। ভিন্ন এক নায়কের আসন লাভ করেন ঈশ্বর বাবু।

এ-নায়কের আর্থিক অবস্থা জানতে পারি আরো অনেক পরে। আমি তখন একটি জাতীয় দৈনিকের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত। ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে নরসিংদী প্রেস ক্লাবে আড্ডাচ্ছলে ঈশ্বর বাবু সম্পর্কে খোঁজ-খবর করি। ইত্তেফাকের সাংবাদিক নিবারণ বাবু ছাড়া অন্যান্য সাংবাদিকেরা তাঁর সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য জানেন না। তাঁর ঘনিষ্ঠ অনেক সাংবাদিক মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেকে বয়োবৃদ্ধ অবস্থায় আছেন। তাই তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের বিস্তারিত উপাত্ত জানা সম্ভব হয়নি। টুকরো টুকরো স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে ঈশ্বর বাবুর মর্মান্তিক এক কাহিনি জানা গেলো। তিনি যখন মারা যান, তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে তাঁর লাশ গ্রহণের জন্যে কোনো আত্মীয়-স্বজন পাওয়া যায়নি। শিষ্যদের প্রচেষ্টায় তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিলো। এরপর হঠাৎ করে এই অকৃতদার মানুষটির আত্মীয়-স্বজনের আবির্ভাব ঘটে। মূলত তারা ঈশ্বর বাবুর ব্যাংক-ব্যালেন্সের খোঁজ করতে এসেছিলেন। নরসিংদীতে কোনো সহায়-সম্পত্তি কেনা আছে কি না, তা-ও জানতে চেষ্টা করেন। কিন্তু অনেক অনুসন্ধান করেও নগদ অর্থ কিংবা জমি-জমার কোনো হদিস করতে পারেননি। সোনালী ব্যাংকে একটি একাউন্টের সন্ধান পেলেও সেখানে কানাকড়িও সঞ্চিত ছিলো না। বাড়ি-ঘরের খোঁজ করে জানতে পারেন, তিনি বড়ো সাংবাদিক হয়েও ছোটো একটি ভাড়া করা খুঁপড়ি ঘরে থেকেছেন। ঈশ্বর বাবুর টাকা-পয়সা আর সম্পত্তির অনুসন্ধান করতে এসে তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের বরং কিছু গাঁটের পয়সা খরচ হলো।

নরসিংদী প্রেস ক্লাব, বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা ও জেলা প্রশাসকের দপ্তরে খোঁজ করে প্রয়াত সাংবাদিক ঈশ্বর বাবুর কোনো স্মৃতিচিহ্ন পাওয়া যায়নি। এমনকি তাঁর প্রতিষ্ঠিত নরসিংদী প্রেস ক্লাবেও কোনো স্মৃতি সংরক্ষিত নেই। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে প্রেস ক্লাবে ছবি টাঙানোর রেওয়াজ থাকলেও সেটা বাস্তবায়িত হয়নি। ক্লাবের একাধিক সদস্য জানান, ঈশ্বর বাবুর ছবি রাখতে কারো আপত্তি নেই। কিন্তু তাঁর ছবি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে তাঁর এবং প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নিবারণ রায়— দুজনের ছবিই প্রেস ক্লাবে সংরক্ষণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মাখন দাস বলেন, “ঈশ্বর বাবু আমাদের অনুকরণীয় ছিলেন। তিনি নিঃস্বার্থভাবে লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে সাংবাদিকতা করে গেছেন। মৃত্যুর সময় তাঁর নিজের এক টুকরো জমিও ছিলো না। ব্যাংকে এক পয়সাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই এই মহৎ সাংবাদিকের স্মৃতি রক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সভায় আলোচনা হয়েছে। অচিরেই ক্লাবের পক্ষ থেকে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হবে। সেখানে প্রয়াত সব সাংবাদিকদের ছবিসহ জীবনী অন্তর্ভুক্ত থাকবে।”

নরসিংদীর ইতিহাস এবং নরসিংদীর গুণীজন সম্পর্কিত বেশ কিছু বই-পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। সেখানেও ঈশ্বর বাবু বেশ অবহেলিত। কোনো কোনো গ্রন্থে তাঁর নাম পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়নি। কোনো বইয়ের পাতায় বেশ দীনতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে দু-চার লাইন ব্যয় করা হয়েছে। এর মধ্যে শফিকুল আসগরের ‘নরসিংদীর ইতিহাস’ গ্রন্থে সাড়ে পাঁচ লাইনের বিবরণ দেয়া হলেও এতে কিছু তথ্যবিভ্রাট রয়েছে। তিনি ১৯৮৩ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে মৃত্যুবরণ করলেও সে-বইয়ে তাঁর মৃত্যুর সাল ১৯৮৫ সাল উল্লেখ করা হয়। মৃত্যুস্থান নরসিংদী শহর বলা হয়। তবে সরকার আবুল কালামের লেখা ‘নরসিংদীর গুণীজন’ বইয়ে ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধরের একটি স্কেচ দেয়া হয়েছে। জানতে পারি, কোনো-এক পত্রিকায় ছাপা হওয়া ঈশ্বর বাবুর অস্পষ্ট একটি ছবি থেকে স্কেচটি করানো হয়েছিলো। বইটিতে ঈশ্বর বাবুকে যথার্থ চারণ সাংবাদিক হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, “নরসিংদী যখন থানা, সাংবাদিক শব্দটিও বোধহয় সে সময় সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত ছিলো না, সে সময় তিনি সাদা হাফশার্ট আর লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়াতেন সংবাদের নেশায়। …চিরকুমার এ-চারণ সাংবাদিক দীর্ঘরোগ ভোগ করে চরম অবহেলা আর অবজ্ঞায় জীবনের শেষ সময় অতিবাহিত করেন।”

নরসিংদীর সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক গোলাম মোস্তাফা মিয়া ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর সম্পর্কে বলেন, “একজন খাঁটি চারণ সাংবাদিক বলতে যা বোঝায়, সেটা ছিলেন ঈশ্বর বাবু। তিনি হয়তো মোনাজাত উদ্দিনের মতো এতো ব্যাপকতা এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেননি, কিন্তু নরসিংদী জেলার প্রতিটি অঞ্চলে তিনি বিচরণ করেছিলেন। সংবাদপত্রের পাতায় সমস্যা, দুর্নীতি, অনিয়ম ও দেশের কথা তুলে ধরেছিলেন। তাই এক অর্থে তাঁকে নরসিংদীর মোনজাত উদ্দিন বলা যায়।”

এই মানুষটি সারাজীবন নিঃস্বার্থভাবে সাংবাদিকতা করে গেছেন। সাংবাদিকতা যে একটি উপাসনাতুল্য কর্মকাণ্ড, সেটা ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধরের জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়।


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

শিবপুরের বিভিন্ন স্থান-নামের উৎস সন্ধান | পর্ব ৪

বাড়ৈআলগী
সেই আমলে এলাকায় জায়গা জমির জরিপ চলছিলো। কিন্তু সঠিক তথ্য না পাওয়ায় জমি রেকর্ডভুক্ত করতে সমস্যা হচ্ছিলো। এলাকার মুরুব্বিরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অনেক মুরুব্বি অতীতের বর্ণনা দিতে পারতেন। তাদের মধ্যে ‘বাড়ৈ’ নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন। আবার আলগা থেকে হয়েছে ‘আলগী’। মুরুব্বি বাড়ৈ সাহেবের নামের সাথে ‘আলগী’ যোগ হয়ে হয়েছে ‘বাড়ৈআলগী’। অর্থাৎ তাদের এলাকাটি অন্যান্য এলাকা থেকে দূরবর্তী স্থানে স্বতন্ত্র বা আলগা ছিলো বলেই গ্রামের নাম বাড়ৈআলগী। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর এখানে ‘বাড়ৈআলগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একসময় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মরহুম আবদুল মান্নান বিদ্যালয়ের উন্নয়নে সচেষ্ট ছিলেন।

তেলিয়া
এই এলাকায় ব্যাপক হারে হিন্দু লোকের বসবাস ছিলো। কারো একজন হিন্দু ভদ্রলোকের নাম ছিলো তৈলচন্দ্র ওরফে তেলাচন্দ্র। আর এই নাম হতেই হয়েছে তেলিয়া। এছাড়া একসময় এলাকাটিতে প্রচুর তৈলবীজ উৎপাদন হতো। ওই বীজ থেকে উৎপাদিত তেলে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য এলাকায়ও সরবরাহ করা যেতো। সবচেয়ে উল্লেখ্য যে, এ-গ্রামে অনেক বড়ো একটি বটগাছ ছিলো। বটবৃক্ষটি দীর্ঘ বছর ধরে এলাকাসহ পথিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। ইতিহাসের সাক্ষী গাছটি এখন আর আগের মতো না থাকলেও এর ধ্বংসাবশেষ পথযাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ওই বটগাছের কারণে স্বর্গগত তৈলচন্দ্রের তেলিয়া গ্রাম শিবপুর ও নরসিংদীতে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছে।

ঝাউয়াকান্দী
গ্রামের নাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া না গেলেও এলাকাবাসী মনে করে, একসময় এখানে অনেক অনেক ঝাউ গাছ জন্মাতো। ঝাউ গাছ একপ্রকার সূচাগ্র ও রমণীয় সুন্দর বৃক্ষ বিশেষ। গাছের শাখা-প্রশাখা দেখতে খুবই সুন্দর। সারিবদ্ধ ঝাউগাছ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। আর এ-সমস্ত ঝাউগাছের কারণেই গ্রামের নাম ঝাউয়াকান্দী হয়েছে। এ গ্রামে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ঝাউয়াকান্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। ১৯২৩ সালে মোলভী সুবেদ আলী পণ্ডিত ও মরহুম খিদির বক্স এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সুবেদ আলী সাহেব নিজেই জমি দিয়েছিলেন। দক্ষিণমুখী বিদ্যালয়ের বর্তমান অবকাঠামোগত অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মনোহরদীর গোতাশিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব ওসমান গণি মাস্টার, জনাব নাসির উদ্দীন মোল্লা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। দুইটি গ্রামের নামে সমৃদ্ধ তেলিয়া ঝাউয়াকান্দী উচ্চ বিদ্যালয় ইতোমধ্যে এলাকার শিক্ষায় বিশেষ অবদান রেখে চলেছে।


লেখক : সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার

শিবপুরের বিভিন্ন স্থান-নামের উৎস সন্ধান | পর্ব ৩

ভরতেরকান্দী
যতোটুকু জানা যায়, বর্তমান ভরতেরকান্দী এলাকায় একসময় ভরত নামে একজন হিন্দু ছিলেন। তিনি পেশায় কুমোর ছিলেন। হাড়ি-পাতিল তৈরির কুমোর শুধু নয়, দেখতেও নাকি ছিলেন রাজকুমারের মতো। অতিশয় সুন্দর ভরত বাবু আচার-আচরণে এলাকার সকলের প্রিয়ভাজন ছিলেন। এলাকায় যথেষ্ঠ প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিলো তার। গুণমুগ্ধতার কারণে একটি সময়ে এসে এলাকা তথা গ্রামের নাম রাখার প্রয়োজনে সবাই মিলে ভরত বাবুর নাম অনুসারে গ্রামের নাম রাখেন ভরতকান্দী। ওই ভরতকান্দী পরবর্তীতে হয়ে যায় ভরতেরকান্দী। ভরতেরকান্দীতে একটি বাজার আছে। নাম পেত্নির বাজার। আগের দিনে রাতের বেলায়, বিশেষ করে গভীর অন্ধকার রাতে এ-বাজারে অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটতো, যা ভূত-পেত্নিরা ঘটাতো মনে করে বাজারের নাম রাখা হয়েছিলো পেত্নির বাজার। গ্রামের ভরতেরকান্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৩৯ সালে। বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিত্ব মরহুম আবদুর রাজ্জাক মোল্লা সাহেবের দানকৃত জমির উপর। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন মরহুম হাফিজ উদ্দিন সরকার, মো. তমিজ উদ্দিন প্রধান, আবদুল ওয়াহাব মোল্লা, দানিছ মোল্লা এবং জমিদাতা আবদুর রাজ্জাক মোল্লা। বিদ্যালয়ের কীর্তিমান ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. একেএম রাশিদুল আলম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

কুমরাদী
এই গ্রাম নিয়ে আধ্যাত্মিক ও মজার ঘটনা রয়েছে। একসময় গ্রামটিতে একজন অসুস্থ মহিলা ছিলেন। তার নাম ছিলো ‘রাদী’। তার অসুস্থতা এমন মারাত্মক পর্যায়ে গিয়েছিলো যে, কোনোপ্রকার চিকিৎসায় আরোগ্য লাভ হচ্ছিলো না। অনেক কিছুর পর একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তির চিকিৎসায় মহিলা সুস্থ হয়ে ওঠেন। জানা যায়, রাদীকে চিকিৎসা দেয়ার পর বুজুর্গ ব্যক্তিটি উচ্চস্বরে বলেছিলেন, “কুমরাদী বা উঠো রাদী।” ‘কুমরা’ শব্দের একটি অর্থ গড়াগড়ি খাওয়া। অসুস্থ সেই মহিলা দীর্ঘদিন ধরে বিছানায় গড়াগড়ি করছিলেন। বুজুর্গ হুজুর বলেছিলেন, কুমরাদী বা গড়াগড়ি থেকে উঠো। হুজুরের সেদিনের সেই কথার পর আর তাকে গড়াগড়ি করতে হয়নি এবং সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। সেই ‘কুমরাদী’ বলা থেকেই পরবর্তীতে গ্রামের নাম হয়ে যায় কুমরাদী। অন্য একটি সূত্র থেকে জানা যায়, কুম্ভরাণী নামে সে-এলাকায় একজন জমিদার ছিলেন এবং তার নাম থেকেই প্রথমে কুম্ভরাণী ও পরে কুমরাদী নামটি এসেছে। এলাকায় আরো জনশ্রুতি আছে যে, এখানে একসময় গভীর জঙ্গল ছিলো। ওই গহীন জঙ্গলে শাহ মনসুর আলী (র.) নামে একজন দরবেশ বসবাস করতেন। তখনকার সময়ে অতি দ্রুত দরবেশের নাম ও সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো। নামধাম শুনে বর্তমান কুমিল্লার স্থানীয় এক নিঃসন্তান রাজা তার রাণীসমেত সন্তান লাভের আশায় আমাদের নরসিংদীর কুমরাদীতে দরবেশের আস্তানায় হাজির হন। দরবেশের সাথে সাক্ষাত করে তার মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সন্তান লাভের প্রার্থনা করেন। দরবেশ সন্তান লাভের জন্যে ঔষধ-পথ্যাদি দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সাথে কিছু শর্ত যুক্ত করে দেন। শর্তে বলা হয়েছিল যে, যদি তারা কন্যা সন্তান লাভ করে, তবে সেই কন্যাকে দরবেশের সাথে বিয়ে দিতে হবে। দিগ্বিদিক চিন্তা না করে রাজা-রাণী দরবেশের শর্তে রাজি হয়ে যান। দরবেশ আল্লাহর নিকট তাদের সন্তান লাভের প্রার্থনা করলে মহান রাব্বুল আলামিন তাতে সাড়া দেন। তাদের ঘরে আলো ঝলমলে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। সেই কন্যা শাহজাদীর নাম রাখা হয় রাদী। শাহজাদী ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকেন। একসময় রাজ্যের ভবিষ্যত শাহজাদী বিবাহযোগ্যা হন। অন্যদিকে মেয়ের বিয়ের শর্তের কথা রাজার মনে থাকলেও রাণী তা বেমালুম ভুলে যান। তাকে বিষয়টি অবগত করানো হলে তিনি আগের শর্ত মানতে রাজি হননি। তড়িঘড়ি করে অন্য কোনো রাজ্যের রাজপুত্রের সাথে রাণী শাহজাদীর সম্বন্ধ ঠিক করে ফেলেন। রাজ্যময় বিয়ের সানাই বেজে ওঠে। জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন চলে। সমস্ত প্রজাদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা হয়। কিন্তু এর মাঝে হঠাৎ শাহজাদী মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক কান্নাকাটি, বড়ো বড়ো বৈদ্য দিয়ে চিকিৎসা করানো হলেও শাহজাদী সুস্থ হননি। শর্ত ভঙ্গের কারণে রাজা খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন। অনন্যোপায় হয়ে রাজা পূর্বের প্রতিশ্রুতি অনুসারে মেয়েকে নিয়ে কুমরাদীতে দরবেশের আস্তানায় চলে আসতে বাধ্য হন। কিন্তু দুঃখজনক যে, দরবেশ তখন আস্তানার বাইরে ছিলেন। কোনো উপায় করতে না পেরে রাজা মেয়েকে আস্তানায় রেখে চলে যান। তার অনেক পরে দরবেশ ফিরে এসে এহেন অবস্থা দেখে সহজেই ঘটনা বুঝে ফেলেন। তিনি মেয়েটিকে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলে ওঠেন, “কুম, কুম”, যার অর্থ রাদী উঠো। সহসা শাহজাদী জ্ঞান ফিরে পান। এ-ঘটনা পুরো এলাকায় জানাজানি হয়ে যায়। এভাবে গ্রামের নাম হয় কুমরাদী। অনেকের মতে, কুমরাদীতে বর্তমানে যেই ভগ্নদশার দরগাহ রয়েছে, তা সেই আধ্যাত্মিক দরবেশেরই। এখনো প্রতিদিন অনেক মানুষ তা দেখতে আসেন। দরগাহ বা মাজার সংলগ্ন একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে পরবর্তীতে, সাথে এতিমখানা। কুমরাদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে, ব্রিটিশ আমলে। মাওলানা আবদুল আজিজ এর প্রতিষ্ঠাতা। তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন পুটিয়া ইউনিয়নের এককালের প্রখ্যাত চেয়ারম্যান আবদুর জব্বার মাস্টার, যিনি আততায়ীর হাতে নিহত হন। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আরো সহযোগিতা করেছেন মরহুম আলাউদ্দিন শিকদার, মো. শামসু ভূঁইয়া ও মো. আবুল হাশেম। প্রায় ১০৪ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি বিভিন্ন উত্থান-পতনের মধ্যেও স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক ছাত্র-ছাত্রী এ-বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মাওলানা আবদুল আজিজ সাহেবের পুত্র ব্যারিস্টার আবু তাহের আবদুল্লাহ। এই গ্রামেই রয়েছে দেশ বিখ্যাত ও একসময়ের আন্তর্জাতিক মানের কুমরাদী দারুল উলুম মাদরাসা।

কুমরাদী গ্রাম ও শিবপুরে মাদরাসা শিক্ষার কথা
মাদরাসা শিক্ষা সর্বপ্রথম চালু হয়েছিলো মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর মাদরাসা স্থাপনের মাধ্যমে। তিনি মদিনায় হিজরতের পর মসজিদে নববীর পাশে ‘সুফফা আবাসিক’ ও ‘দারুল কুববাহ’ নামে দুইটি মাদরাসা স্থাপন করেছিলেন বলে ইতিহাস রয়েছে। এছাড়াও তিনি মসজিদভিত্তিক মাদরাসা চালু করেছিলেন। খলিফাগণের মধ্যে হযরত ওমর (রা.) সিরিয়ায় এবং হযরত আলী (রা.) বুশরা ও কুফায় মাদরাসা শিক্ষা চালু করেছিলেন। উমাইয়া ও আব্বাসীয় আমলেও মাদরাসা শিক্ষা বিস্তৃত হয়েছিলো। কোথাও কোথাও মাদরাসাভিত্তিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাও চালু হয়েছিলো।

বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা প্রথম আরম্ভ হয়েছিলো সুলতানি আমলে। ১২৭৮ সালে সোনারগাঁয়ে একটি মাদরাসা স্থাপিত হয়, যেটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম মাদরাসাগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৭৮০ সালে কলকাতায় আলিয়া মাদরাসা স্থাপিত হয়। ১৮৯৯ সালে চট্টগ্রামে ‘দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদরাসা হওয়ার পর এদেশে কওমী মাদরাসার প্রচলন শুরু হয়। তারও আগে ঢাকায় হাজী মহসিন ট্রাস্টের উদ্যোগে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও চালুর এমন ধারাবাহিকতায় নরসিংদীর শিবপুরে ‘কুমরাদী দারুল উলুম মাদরাসা’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে। এই মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবদুল আজিজ। এই মাদরাসা হতে বহু ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে জগতখ্যাতি অর্জন করেছেন। আজিজ সাহেব মাদরাসার পাশাপাশি স্বতন্ত্র এতিমখানাও তৈরি করেছিলেন। বহু এতিম এখানে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার সুযোগ পেয়ে লেখাপড়া করে তাদের জীবনের পথ খুঁজে নিতে পেরেছে। এখানে এতিম মেয়েদের পড়াশোনার পর তারা বয়োপ্রাপ্ত হলে এতিমখানার তত্ত্বাবধানে উপযুক্ত পাত্রের কাছে তাদের বিবাহের ব্যবস্থা করে দেয়া হতো। শুধু তা-ই নয়, নবদম্পতির ভবিষত উন্নয়নের জন্যে আর্থিক সহযোগিতারও ব্যবস্থা করে দেয়া হতো।


লেখক : সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার

শিবপুরের বিভিন্ন স্থান-নামের উৎস সন্ধান | পর্ব ২

পুটিয়া
শিবপুরের গ্রাম ও গ্রামীণ সভ্যতার আলোচনায় এবার চলে এসেছি পুটিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ও ইতিহাস-ঐতিহ্য বিষয়ে। এ-ইউনিয়নে বহু গ্রাম রয়েছে এবং পুটিয়া গ্রামের নামেই পুটিয়া ইউনিয়ন হয়েছে। পুটিয়া নামটি কোথা থেকে বা কীভাবে এলো জানতে ইউনিয়নের প্রাক্তন একজন চেয়ারম্যানের সাথে আলোচনা হয়। শ্রদ্ধেয় চেয়ারম্যান এবং এলাকার অন্যান্যদের থেকে জানা যায়, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ব্রিটিশ শাসনামল ছিলো তখন। বেনিয়া ব্রিটিশদের নানাবিধ অত্যাচার-নির্যাতনে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেছিলো। এলাকায় যারা ইংরেজদের প্রতিনিধিত্ব করতো, তারা মানুষকে মানুষই মনে করতো না। অসহনীয় নির্যাতনের মধ্যে থেকে ইংরেজদের কথামতো চলতে হতো। তাদের বাধ্যগত না থাকলে সাধারণ মানুষের উপর স্টিম রোলার চলতো প্রতিনিয়ত। এমনিভাবে অত্যাচারিত হতে হতে আর মার খেতে খেতে এলাকার কয়েকজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি ফন্দি করলেন, মরলে মরবো, সাধারণ মানুষের উপর যে-ইংরেজ কর্তা এমন অত্যাচার করছে, তাকে কৌশলে পেটাতে হবে। একদিন সাদরে সেই ইংরেজ কর্তাকে দাওয়াত দিয়ে এনে এমন পিটুনি দিলো যে, সেই নরাধম ইংরেজ এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলো এবং আর কোনোদিন এলাকায় ফিরে আসেনি। তারপর যে-ই আসতো, একই কৌশলে পিটুনি দেয়া হতো। পিটুনির ধরন দেখে ইংরেজদের অনেকে ভয় পেয়ে আর এই এলাকায় আসতো না। এলাকা হয়ে যায় ইংরেজ-শূন্য। মানুষজন ইংরেজ তাড়ানোর সেই পিটুনির কৌশল দেখে খুব আনন্দ পেয়েছিলো। লোকজন একসাথে বসে হাসাহাসি করতো। ধীরে ধীরে পিটুনি বা কঠিন মার দেয়ার জায়গাকে ‘পিটাইয়া’ বলতে আরম্ভ করলো। ‘পিটাইয়া’ বলতে বলতে কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে এখনকার বিখ্যাত ‘পুটিয়া’, যে-পুটিয়া সারা বাংলাদেশের মানুষের নিকট এক নামে পরিচিত। নরসিংদী সদর সংলগ্ন এই ইউনিয়নের দক্ষিণ প্রান্তের মানুষজনের নিত্যদিনের চলাফেরা নরসিংদী শহরের সাথে। এ-ইউনিয়নের বুক চিরে চলে গেছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। পুটিয়া বাংলাদেশের অনত্যম বৃহৎ গরুর হাট। প্রতি শনিবার হাটের বিশালতা দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। দেশের দূর-দূরান্তের মানুষ এই হাটে আসেন পছন্দমতো গরু ক্রয় করতে।
পুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় : গ্রামটিতে সর্বাগ্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ঐতিহ্যবাহী পুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার সাল ১৯২০। তারও আগে এই জায়গায় টোল ও মক্তব ছিলো। পৃথিবী ছিলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে। তারপরও ১৯১৯ সালে শিক্ষা সংস্কারের আওতায় পৌর এলাকা ও গ্রামাঞ্চলের বিশেষ বিশেষ জায়গায় ইউনিয়ন কেন্দ্রিক প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক করার সামান্য চিন্তা থেকে বর্তমানের পুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এলাকার অনেক ছাত্র-ছাত্রী এখানে পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। পরবর্তীতে পুটিয়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা অনেক এগিয়েছে। মাদরাসা শিক্ষায়ও পুটিয়া অনেক এগিয়ে।

সৈয়দনগর
নাম থেকেই বোঝা যায়, এলাকায় সৈয়দ বংশের লোকজনের বসবাস ছিলো। সেই ‘সৈয়দ’ উপাধি থেকেই গ্রামের নামকরণ হয়েছে। তারও আগে এই গ্রামকে ‘সৈকারচর’ বলে মানুষ চিনতো। সম্ভবত গ্রামে সৈয়দদের বসবাস শুরু হলে তাদের উপাধি থেকে ‘সৈয়দনগর’ নামটি এসেছে। গ্রামটি খুবই পরিচিত এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে অবস্থিত হওয়ায় ব্যাপক পরিচিত। গ্রামের মানুষ শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বেশ অগ্রসর। সৈয়দনগরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি মাদরাসা রয়েছে।
সৈয়দনগর দড়িপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় : ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি প্রথমদিকে নৈশ বিদ্যালয় ছিলো। বিদ্যালয়ের জন্যে জমি দিয়েছেন মরহুম সাফিজ উদ্দিন, ডা. আ. ওহাব, মো. সামসুদ্দিন ও মো. আ. মান্নান মোল্লা। উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন মো. জামাল উদ্দিন, মো. ফজলুর রহমান, তমিজ উদ্দিন মাস্টার, মফিজ উদ্দিন ও রমিজ উদ্দিন। উল্লেখযোগ্য শিক্ষকগণের মধ্যে ছিলেন জনাব মো. জামাল উদ্দিন, জনাব মো. ফজলুর রহমান, জনাব আবু সাঈদ এবং জনাব আ. হান্নান মোল্লা। তাঁদের হাতে এলাকার বহু ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

মুন্সেফেরচর
এলাকাটিতে একসময় খুবই খরস্রোতা নদী ছিলো। ইংরেজদের স্বার্থে এলাকার ভূমি জরিপ করা একান্তভাবে দরকার হয়ে পড়ে। কিন্তু নদীতে পানি ও কোথাও বিচ্ছিন্ন চর থাকায় জরিপ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। তবু জরিপ করতে হবে বিধায় তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের স্থানীয় প্রতিনিধি জরিপের জন্যে একজন উচ্চপদস্থ মুন্সেফ পাঠান। উক্ত মুন্সেফ এলাকায় দীর্ঘদিন অবস্থান করে কঠিন জরিপ করতে চেষ্টা করেন। আশেপাশের এলাকা ও গ্রামের মানুষজন মুন্সেফকে জমি সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য দিতেন। মুন্সেফ সাহেবও জনগণের সাথে ভালো ব্যবহার করতেন, সম্মান দিতেন। এলাকাবাসীও তাকে সম্মান দিতে ভুল করেনি। সেই মুন্সেফ সাহেবের সম্মানার্থে তারা গ্রামের নাম রাখে মুন্সেফেরচর।
মুন্সেফেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় : ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ শাসনকালে মুন্সেফেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। শিক্ষায় অনুরাগী মরহুম আক্রাম আলী গাজী জমি দিয়েছেন। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে এখন বিদ্যালয়টি একটি ভালো অবস্থানে আছে। পুরোনো কৃতিত্বপূর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় মরহুম মো. আবদুস ছালাম খন্দকার, দুই দুইবার পুটিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. সালাহ উদ্দিন গাজী, চট্রগ্রাম মেরিন একাডেমির ইঞ্জিনিয়ার মো. মাসুদ মিয়া। নিবেদিতপ্রাণ ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ছিলেন জনাব আমিনুল ইসলাম, জনাব নাজমুল কবির আনোয়ার, জনাব জিন্নত আলী গাজী, জনাব মনির উদ্দিন গাজী এবং জনাব মো. কামাল গাজী।


লেখক : সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার

শিবপুরের বিভিন্ন স্থান-নামের উৎস সন্ধান | পর্ব ১

মানিকদী
শিবপুরের দুলালপুর ইউনিয়নের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ‘মানিকদী’ বহুল পরিচিত ও শিক্ষায় অগ্রসরমান একটি গ্রাম। ব্রিটিশ আমলের আগে থেকেই এ-গ্রামের মানুষ শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে অনেক এগিয়ে ছিলো। শিক্ষার হার বেশি থাকায় চাকরি-বাকরিতেও তারা অগ্রগামী ছিলো। এ-গ্রামের নামকরণ প্রসঙ্গে জানা যায়, এলাকাটি ছিলো হিন্দুপ্রধান। তৎসময়ে হিন্দুদের মধ্যে কোনো-এক সদ্বংশীয় প্রভাব ও প্রতিপত্তিশালী স্বর্গীয় মানিক বাবুর নামানুসারে গ্রামের নাম রাখা হয়েছিলো ‘মানিকদী’। গ্রামের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ। সুপ্রিম কোর্টের একসময়ের যশস্বী এডভোকেট মরহুম মোজাফ্ফর আহমেদ এবং তাঁর ছেলে স্বনামধন্য বিচারপতি মরহুম মাসুক আহমদ মানিকদীরই কৃতী সন্তান। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব অন্তিম চন্দ্র সেনের কাছ থেকে জানা যায়, মানিকদী গ্রামটি একসময় নদীতে ডুবে ছিলো। এখানে ক্রমাগত চর পড়ে। চরে উর্বর ফসল ফলতো। এমন ফসল ফলার কারণে অন্যান্য এলাকার মানুষদের এই এলাকা আকর্ষণ করতো ও টেনে নিয়ে আসতো। সেই উর্বর ফসলের কারণে মানুষজন বলতো ‘এখানে মানিক ফলে’। আর এভাবেই গ্রামটি পেয়ে যায় ‘মানিকদী’ নাম। এ-গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মানিকদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৯ সালেরও পূর্বে। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্বর্গীয় সুরেন্দ্র চন্দ্র দাশ। সুরেন্দ্র বাবু এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকও ছিলেন। প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন আবদুল কুদ্দুস পণ্ডিত। জমিদাতা ছিলেন মরহুম সেকান্দর আলী। বিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোক্তার হোসেন, জেলা রেজিস্ট্রার মাহমুদুর রহমান রিপন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাহমিনা বেগম, জেলা কৃষি অফিসার বাদল চন্দ্র ঘোষ এবং জীবন বীমা করপোরেশনের পরিচালক সুধাংশু চন্দ্র ঘোষ।

ভিটিচিনাদী
বিখ্যাত, সুপরিচিত এবং দৃষ্টিনন্দন চিনাদী বিলের পূর্বপাড়ে চিনাদী বিলের সৌন্দর্য, সম্পদ ও মৎস্য আহরণের সুবিধা পেয়ে এখানে ব্যাপক হারে মানুষের বসবাস আরম্ভ হয়েছিলো। বসবাসের জন্যে বিলের পাড়ে বাড়ি বানানোর প্রয়োজন হয়। বাড়ি বানানোর আগে ভিটি তৈরি করতে হতো। জোরেশোরে মানুষের মধ্যে ভিটি তৈরি শুরু হয়েছিলো। ভিটি তৈরির ধুমধাম থেকেই গ্রামের নাম হয়ে যায় ‘ভিটিচিনাদী’। গ্রামটি এখনো হিন্দু অধ্যুষিত এবং প্রায় ষাট ভাগ হিন্দুদের বসবাস রয়েছে। গ্রামের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিটিচিনাদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৯৬৯ সালে। স্থানীয় নিরীহ মৎস্যজীবী মানুষের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুলালপুর তথা শিবপুরের কিংবদন্তীতুল্য চেয়ারম্যান মরহুম মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ। শিক্ষানুরাগী এই চেয়ারম্যান বিদ্যালয়ের জন্যে জমিরও ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন মরহুম রইস উদ্দিন ভূঁইয়া। প্রখ্যাত ভেটেরিনারি ডাক্তার বদর উদ্দীন এ-বিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র ছিলেন।

গড়বাড়ি
শিবপুরের বর্তমান গড়বাড়ি এলাকা একসময় সুপ্রসিদ্ধ ভাওয়াল রাজার এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। এলাকায় দুটি মৌজা ছিলো, যার একটি ‘গুদ্দ মহেশ্বরদী’ এবং অপরটি ‘নগর মহেশ্বরদী’। এই দুটি নামের মৌজা এখনো চালু রয়েছে। কিন্তু একসময় গড়বাড়ি এলাকা নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়। অর্থাৎ এলাকা মৌজাভুক্ত করতে সমস্যায় পড়তে হয়। কোন এলাকা কোন মৌজার অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তা নিয়েই ছিলো বিভ্রান্তি। এই পরিস্থিতিতে এলাকার জন্যে একটি গড় হিসেব করার পরামর্শ পাওয়া যায়। পরামর্শ মোতাবেক গড় করা থেকেই গ্রামের নাম হয়েছে ‘গড়বাড়ি’। গড়বাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন অভিজ্ঞ ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের সাথে আলোচনা করে একই অভিমত পাওয়া যায়। গড়টি করার পরামর্শ এসেছিলো ভাওয়াল রাজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে। অর্থাৎ গড় করে সমীকরণের মাধ্যমে মৌজাভুক্ত করা হয়েছিলো এলাকাটিকে। এলাকায় সুপরিচিত নাজির বাড়ির শিক্ষক জনাব আবদুল বাছেদ নাজিরের নিকট থেকে জানা যায় গড়বাড়ির বিভিন্ন ঐতিহ্যের কথা। ভাওয়াল রাজের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়বাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় ১৯৩৯ সালে। প্রথমদিকে বিদ্যালয় ভবন ছিলো স্থানীয় ঠাকুর বাড়িতে। প্রথম জমিও দিয়েছিলেন ঠাকুর বাড়ির কেউ একজন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, প্রতিষ্ঠার সময় বিদ্যালয়ের নাম ছিলো ‘গুদ্দ মহেশ্বরদী ফ্রি মডেল স্কুল’। পাশাপাশি ক্যাম্পাসে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর গড়ে ওঠেছে এম এ রশিদ উচ্চ বিদ্যালয়। উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও জমিদাতা মোহাম্মদ আবদুর রশিদ স্বয়ং। এ-দুটি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল অর্জন করে যারা জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিপ্লব নাজির।

সাতপাইকা
সাতপাইকা অঞ্চলটি একসময় হিন্দু অধ্যুষিত ছিলো। হিন্দুদের একটি সুপরিচিত বাড়ি ছিলো ঠাকুর বাড়ি। মজার বিষয় হলো, এলাকায় কোনো জমিদার বা জমিদারি ছিলো না। কিন্তু এখানে পাইকদের বসবাস ছিলো। জানা যায়, অন্যান্য সব এলাকার জমিদারদের পাইকেরা বর্তমান সাতপাইকা এলাকায় বাড়িঘর নির্মাণ করে বসবাস করতো। ওই সমস্ত পাইকদের মধ্যে সাতজন ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী ও নামিদামি। আর সেই পাইকদের মধ্যে প্রভাবশালী সাতজন পাইকের কারণে গ্রামের নাম হয়ে যায় ‘সাতপাইক’, যার বর্তমান নাম ‘সাতপাইকা’। সেই গ্রামের এক সাহসী ব্যক্তির নাম ছিলো গোপাল গুপ্ত। গোপাল গুপ্ত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় যোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ স্পাইদের বিশেষ তৎপরতার কারণে দুভার্গ্যবশত গোপাল গুপ্ত এলাকা ছেড়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। সাতপাইকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি মোটামুটি পুরাতন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৩০ সালে। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জহর উদ্দীন প্রধান ও জাব্বার প্রধান। প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন স্বর্গীয় ঈশ্বর চন্দ্র দাশ। জমি দিয়েছিলেন জহর উদ্দীন প্রধান ও জাব্বার প্রধান। সাতপাইকা স্কুলের স্বনামধন্য ছাত্র ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মিয়ার উদ্দীন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মিয়ার উদ্দীন ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে শিবপুরের পুটিয়া রণাঙ্গনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। মিয়ার উদ্দীনের ভাই এবং বাংলাদেশ গ্লাস ও সিরামিকসের প্রিন্সিপাল মুসলেউদ্দীনও সাতপাইকা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। সচিব আবু বকর সিদ্দিক এ-স্কুলেরই ছাত্র। সাতপাইকা গ্রামের অভিজ্ঞ মুরুব্বি সাবেক ব্যাংক ম্যানেজার তাইজদ্দিন সাহেবের কাছ থেকে গ্রাম ও স্কুল সংক্রান্ত অনেক তথ্য পাওয়া গেছে।


লেখক : সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার