Home Blog

নরসিংদীতে প্রচুর সাংবাদিক, আন্দোলন চলাকালীন আমি ৪-৫ জনকেও মাঠে পাই নাই : রাকিবুল ইসলাম

0

রাকিবুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি ‘এখন’ টেলিভিশনের রিপোর্টার এবং ‘বাংলা ট্রিবিউন’-এর নরসিংদী জেলা প্রতিনিধি। নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেছেন। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সক্রিয়ভাবে মাঠে থেকে সংবাদ সংগ্রহের কাজ করেছেন। সেই আন্দোলন ও সাংবাদিকতা বিষয়ে তার সাথে আলাপ হয় গত ১৮ জুন ২০২৫ (বুধবার)। সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেছেন সম্পাদক সুমন ইউসুফ।

গত বছর জুলাইয়ে যে-অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হিসেবে আমরা এটিকে অভিহিত করি। নরসিংদীতে সাংবাদিক হিসেবে আপনি মাঠে তৎপর ছিলেন। আপনি কী দেখেছেন? কী জেনেছেন? নরসিংদীতে কীভাবে শুরু হলো এবং কারা ছিলো?

রাকিবুল ইসলাম : নরসিংদীতে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায় কোটা বিরোধী শিক্ষার্থীরা, যারা চাকরি প্রত্যাশী বা বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা দিচ্ছিলো। এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীন নেতাকর্মীদের বাধায় যারা যেতে পারেনি, তারাই মূলত কাজগুলো শুরু করেছিলো। শুরুর দিকে নরসিংদী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিলো বেশি। তারপর একেবারে স্কুল ও বেসরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরাও এই আন্দোলনে যোগ দেয়। যখন মোটামুটি শুরুটা হয়ে গেছে, ভালো একটা জমায়েত নিয়ে শিক্ষার্থীরা জেলখানার মোড় অবরোধ করে, তখন পুলিশ লাঠিচার্জ করে, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। তখন এই অবস্থা দেখে স্থানীয় জনতাও এখানে যোগ দিতে শুরু করে। ১৮ জুলাই যখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনির গুলিতে প্রথম তাহমিদ শহীদ হলো, তখন পুরো নরসিংদীব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো এবং আন্দোলনের তীব্রতা আরো বেড়ে গেলো। তার ঠিক পরদিনই ১৯ জুলাই বিক্ষোভকারীরা নরসিংদী জেলা কারাগারের গেট ভাঙচুর ও কারাগারে আগুন লাগিয়ে দেয়। সেদিন এই ঘটনার সময় আমি নরসিংদী পাবলিক লাইব্রেরির এখানে ছিলাম, পুলিশ সেখানে ব্যারিকেড দেয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই রাস্তা দিয়ে চলাচল নিষেধ করে দেয়, তাদেরকে এখানে আটকে দেয়া হয়। আন্দোলনকারীরা উপজেলার মোড় থেকে আবাসিক এরিয়ার ভিতর দিয়ে বিভিন্ন গলির রাস্তা দিয়ে জেলখানার মোড়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। সেদিন শিক্ষার্থীদের সাথে অনেক গার্ডিয়ানও আন্দোলনে যোগ দেয়। অনেক মেয়েরা তাদের ব্যাগের ভেতরে রুটি বেলার বেলন নিয়ে আসে। এখানে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ছিলো।

কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানার ছিলো?

রাকিবুল ইসলাম : না। রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে কোনো আন্দোলনকারী আমি দেখি নাই। তবে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত এরকম অনেককেই দেখেছি, তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলন করেছে।

১৯ জুলাই জেলখানায় হামলা করা হয়েছে। কারা হামলা করেছে বলে আপনার মনে হয়?

রাকিবুল ইসলাম : জেলখানায় যেদিন হামলা হয়েছে সেদিন আমি আমার এসাইনমেন্টের কাজে আশেপাশেই ছিলাম। এর মধ্যে খবর পেলাম জেলখানা ভাঙা হয়েছে। সেখানে আমার দুজন বন্ধু ছিলো, আমি তাদেরকে কল দেই। তারা আমাকে বলে যে, এদিকে আইসেন না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন আসা যাবে না? তারা বলে যে, অবস্থা ভয়াবহ, সাংবাদিকদের জন্যও জায়গাটা সেইফ না। পরে আমি ভেলানগর বাজারের এখানে আমার বাইক রেখে, আমার ক্যামেরাম্যানকে দাঁড় করিয়ে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি গেলাম। দেখলাম, জেলখানায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। তো অনেকের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে এখানে প্রথমে যারা হিট করেছে, তারা কেউ এখানকার স্থানীয় শিক্ষার্থী না।

তাহলে কারা করলো?

রাকিবুল ইসলাম : কারা করেছে, এটা এখনো স্পষ্ট না। তাদেরকে কেউ চিনে না, তাদের সম্পর্কে কেউ জানে না। জেলখানার সামনে আইডিকার্ড পরিহিত কোনো শিক্ষার্থী আমি দেখি নাই।

১৯ জুলাইয়ের পর থেকে একেবারে ৩-৪ আগস্ট পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য ছিলো জেলখানার মোড়। ঐ-সময় কারা সেখানে ছিলো বা কোন শ্রেণির মানুষ এই তৎপরতায় বেশি সরব ছিলো? কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পার্টির লোকজন কি ছিলো?

রাকিবুল ইসলাম : আমি একটু বিস্তারিত বলি, ১৯ জুলাই জেলখানা ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডের পরদিন সকালে আমি ও আমার আরেকজন সহকর্মী পিয়াল ভাই সেখানে গিয়ে দেখি, তখনো আগুন জ্বলতেছে। আমরা মূল গেটের সাথের দেয়াল টপকে সেখানে প্রবেশ করি। আমরা সাংবাদিক পরিচয় হাইড করে যাই। ভিতরে গিয়ে দেখি অনেক লোকজন হাঁটাহাঁটি করছে। সেখানে উপস্থিত কেউ শিক্ষার্থী ছিলো না, তারা হচ্ছে কয়েদি। অনেক কয়েদি জেলখানা ভাঙচুরের সময় পালিয়ে গেছে, যাদের সাজার বয়স কম, দুই-তিন মাস, তারা পালিয়ে যায়নি। কারণ হচ্ছে, তাদেরকে যদি নতুন করে এরেস্ট করে, তখন যদি সাজার মেয়াদ বাড়ে, এই ভয়ে। এজন্যে তারা জেলার খুঁজতেছে। তারা কী করবে, থাকবে নাকি চলে যাবে? এরকম কনফিউশানে তারা সেখানে হাঁটাচলা-ছোটাছুটি করছিলো। এই অবস্থায় জামাত-শিবির বলেন বা আওয়ামী বিরোধী যে-দলের কথাই বলেন, তাদেরকে মার্ক করার মতো কোনো নেতা বা কর্মী আমি দেখি নাই। আগস্টের ১, ২, ৩ তারিখ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সমাগম ছিলো। সেই সাথে আওয়ামী বিরোধী যেসব দল ছিলো, তাদেরও অংশগ্রহণ ছিলো।

আন্দোলন বিমুখ করতে সরকারি দলের যে-তৎপরতা ছিলো, সেখানে কারা ছিলো এবং কী রকম প্রতিরোধ তারা করেছে?

রাকিবুল ইসলাম : এখানে পুলিশ ছিলো অগ্রগামী। তারা শুরুতে ডিফেন্সিভ থাকলেও পরবর্তীতে আন্দোলনকারীদের সাথে খুব বাজে আচরণ শুরু করে, রাস্তাঘাটে এবং যেসব জায়গায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, সেসব জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে ফোন চেক করা শুরু করে। এই প্রক্রিয়ায় তাদেরকে সহযোগিতা করেছে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা, স্পেসিফিকলি যদি বলি, ছাত্রলীগের অনেক নেতারা পুলিশের সাথে থেকে এই কাজে সহযোগিতা করেছে। আমার যেটা মনে হয়, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সাথে মিলে পরামর্শ করেই পুলিশ এই তৎপরতা চালিয়েছে। আন্দোলনকারীদের ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে, পুলিশ সেখানে চুপ করে ছিলো।

এই অভ্যুত্থানে পুরো নরসিংদী জেলায় কতোজন শহীদ হয়েছেন?

রাকিবুল ইসলাম : স্পেসিফিক কোনো তথ্য নাই।

জেলা প্রশাসক ১৯ জন বলেছেন। তাদের প্রত্যেকের নাম-ঠিকানা আছে?

রাকিবুল ইসলাম : হ্যাঁ, জেলা প্রশাসকের নিকট নাম-ঠিকানাসহ পুরো তালিকা আছে। সেখানে আহতদের তিনটা গ্রেডে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এবং আহত ও নিহতের পরিবারকে প্রণোদনাও দিয়েছে।

কী পরিমাণ সাংবাদিক সেই সময় তৎপর ছিলো?

রাকিবুল ইসলাম : সাংবাদিকের কথা যদি বলি, নরসিংদীতে প্রচুর সাংবাদিক। জেলা প্রেসক্লাবের সদস্যই প্রায় ৭০ জন। এর মধ্যে ৩০-৩৫ জন এক্টিভ। তো আন্দোলন চলাকালীন আমি চার-পাঁচজনকেও মাঠে পাই নাই। আমিসহ তিন-চারজন মাঠে দৌড়াইছি। তখন পরিস্থিতি অনেক ভয়ের ছিলো, গুলি খাওয়া, আহত হওয়ার ভয় ছিলো। আবার রাজনৈতিক অনেক ব্যাপার ছিলো, শিক্ষার্থীরা অনেক সাংবাদিককে ইগনোর করছিলো, ভুয়া বলে সরিয়ে দিচ্ছিলো। আবার অনেক সাংবাদিককে দেখেছি পুলিশের ও তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের দালালি করতে। দালালি করতে বলতে, আমার কাছে একজন সাংবাদিক কিছু শিক্ষার্থীর ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, এরা কারা? মূলত ব্যাপারটা হচ্ছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনি তার কাছে এদের পরিচয় জানতে চাইছে। তো সে আমাকে বেশ কয়েকটা ছবি ফরোয়ার্ড করলো এবং তাদের বেশ কিছু তথ্য জানতে চাইলো। এর মধ্যে আমি সবাইকে চিনি না, দুয়েকজনকে চিনেছি। কিন্তু সঙ্গত কারণে আমি কোনো তথ্য দিইনি।

তিনি কোন পত্রিকার বা কোন টেলিভিশনের?

রাকিবুল ইসলাম : তিনি একটা টেলিভিশনের সংবাদকর্মী। আমি তার নাম প্রকাশ করতে পারছি না। আমার বাসা নরসিংদী সরকারি কলেজের পাশে, শিক্ষার্থীদের সাথে আমার পরিচয় আছে। সেই হিসেবে কয়েকজন সাংবাদিক আমার কাছে তাদের তথ্য জানার জন্যে বিভিন্ন সময় তাদের ছবি পাঠাতো।

তারা কি জাতীয় লেভেলের প্রমিনেন্ট সাংবাদিক? নাম বলা যাবে কি? তারা কি আপনার সিনিয়র?

রাকিবুল ইসলাম : হ্যাঁ, তারা আমার সিনিয়র এবং জাতীয় লেভেলের। আমি তাদের নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। এই সংখ্যাটা কিন্তু বেশি না, দুই-তিনজন। একটা বিষয় আমাকে খুব অবাক করেছে যে, আমরা এতো সাংবাদিক, একটা মানববন্ধন হলে বা একটা রাজনৈতিক প্রোগ্রাম হলে আমরা এতোগুলা সাংবাদিক যাই। কিন্তু আন্দোলনের সময় মাঠে এতো সাংবাদিক পাইনি, চার-পাঁচজন সাংবাদিকই মাঠে ছিলো এবং কয়েকজন ক্যামেরাম্যানকে দেখেছি।

তারা যায় নাই কেন? তারা যদি নির্ধারিত জাতীয় পত্রিকা বা মিডিয়ার কর্মী হয়ে থাকে, তাদের কি এই আন্দোলন কভার করার কথা না? কর্তৃপক্ষ কি তাদের কাছে চায় নাই?

রাকিবুল ইসলাম : কর্তৃপক্ষ চাইছে। ওই যে বললাম, কেউ হচ্ছে ক্যামেরাপার্সন বা হেল্পিং হ্যান্ড পাঠাইছে। এরকম একজন আরেকজনের কাছ থেকে একটা ফুটেজ শেয়ার নিয়েছে। মূলত আমি যেটা আশা করেছিলাম যে, আট-দশজন সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত থাকবে, ওই সময় দৌড়াদৌড়ি-গোলাগুলি পরিস্থিতিটা স্বচক্ষে দেখবে। আমি আসলে এরকম ব্যাপারটা পাই নাই।

অনেককেই তো পান নাই। যাদেরকে পেয়েছেন, তাদের নাম কি বলা যায়?

রাকিবুল ইসলাম : তখন আমি ছিলাম, আশিকুর রহমান পিয়াল (সময় টিভি), আইয়ূব ভাই (যমুনা টিভি), বাংলাভিশনের লক্ষ্মণ দা’ ছিলো, ডিবিসি নিউজের তোফায়েল আহমেদ স্বপন ভাই, ডেইলি স্টারের জাহিদুল ইসলাম ভাই ছিলেন আর মাছরাঙা টেলিভিশনের বদরুল ভাই (বর্তমানে স্টার নিউজে কর্মরত) যতোটা সম্ভব, ছিলেন। এছাড়া আর নিবেদিতপ্রাণ কাউকে খুব একটা পাই নাই। এর বাইরে যাদেরকে পেয়েছিলাম, তাদের মধ্যে আবার অনেকে দালালি করেছে।

আপনি বলছেন, তাদের মধ্যেও আবার কয়েকজন দালালি করেছে। আবার তাদের সাথে কথা বললে ব্যাপারটা এমন হবে কি না যে, আপনিও দালালি করেছেন?

রাকিবুল ইসলাম : এমন হলে আমার কিছু করার নাই। কারণ হচ্ছে, আমি আমার জায়গা থেকে কাজ করার চেষ্টা করেছি।

আপনার অফিস আপনাকে কী নির্দেশনা দিয়েছিলো?

রাকিবুল ইসলাম : অফিস আমাকে যা ঘটছে, সরাসরি সেটাই কভার করে পাঠানোর কথা বলেছে।

কোনো পক্ষে না। জাস্ট ঘটনা কী ঘটতেছে, সেটাই?

রাকিবুল ইসলাম : হ্যাঁ, কোনো পক্ষে না। যখন নেট ছিলো না, শাটডাউন চলছে। আমি টেলিভিশনে খবর দেখতে পারছি না। তখনো আমি আমার মতো করে অফিসে নিউজ পাঠাইছি। আমি জেলখানা ভাঙার নিউজের কথাটাই বলি। ওই নিউজটাও আমি দেখতে পারি নাই। কিন্তু আমি তখনো অফিসে নিউজ পাঠাইছি। অফিস আমাদেরকে অনেক সাপোর্ট দিছে, কোনো বাধা ছিলো না।

পাঁচ আগস্ট আমাদের দেশে গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে। এরপরে আমাদের বাংলাদেশ ভিন্ন একটা প্রেক্ষাপটে চলে গেছে। এই সময়টাতে সাংবাদিকতার নতুন রূপরেখা স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে তৈরি হইছে। নতুন চিন্তা, নৈতিক স্খলন এবং পুনর্জাগরণ নানান দিক দিয়েই নতুনভাবে সংগঠিত হয়েছে। পাঁচ আগস্টের পরে স্থানীয় সাংবাদিকদের অবস্থা কী?

রাকিবুল ইসলাম : পাঁচ আগস্টের পরে নরসিংদীতে মোটামুটি সবাই ট্রাই করছে। সত্যি বলতে, সবাই চেষ্টা করেছে ভালো কাজ করার। অনেকেই হাফ ছেড়ে বাঁচছে যে, আইসিটি এক্টের নানাবিধ সমস্যা ছিলো, তো এইটা থেকে অনেকে বেঁচে যাবে বা বেঁচে গেছে, এই ধরনের চিন্তা-ভাবনা করে অনেকে টুকটাক নিউজ করেছে। বাট একটা জিনিস খেয়াল করলাম, ওই যে বললাম, আন্দোলনের সময় পাঁচজনকেও পাই নাই, পাঁচ আগস্টের পরে অন্তত পঞ্চাশজন হবে যে, তারা বলতেছে, এই করছে সেই করছে। এবং বৈষম্য বিরোধী সাংবাদিক ফোরাম টাইপের প্রচার-প্রচারণাও আমি ফেসবুকে দেখলাম। এখন তারা কারা? তাদেরকে আন্দোলনের সময় তো আমি দেখি নাই। হয় তারা এমন জায়গায় ছিলো, যেখানে আমি ছিলাম না বা যেখানে আমি ছিলাম, সেখানে তারা ছিলো না। এখন মূল ঘটনাই তো ছিলো নরসিংদী জেলখানার মোড়ে। এইটা ছিলো নরসিংদীর আন্দোলনের কেন্দ্র। সেখানে তো আমি ছিলাম। তারা কই ছিলো? কোথায় থেকে সাংবাদিকতা করেছে, আমি জানি না।

আপনি যে হাফ ছেড়ে বাঁচার কথা বললেন, এখানে দুইটা দিক আছে। একটা হচ্ছে, আমি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে পারি নাই উপরের চাপের কারণে বা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে। আপনি অনেক লম্বা একটা লিস্টের ইঙ্গিত দিলেন যে, তারা পুরোনো রেজিমের দালালি করেছে। পাঁচ আগস্টের পরে ওই দালালগুলো হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। আরেকটা হচ্ছে যে, এখন আবার নতুন করে পল্টি নেয়া। কোনটা হচ্ছে?

রাকিবুল ইসলাম : না! যারা সাংবাদিকতা করতে চায়, তারা হাফ ছেড়ে বাঁচছে। এর মানে তো এই না যে, আপনি আন্দোলনের সময় থাকতে পারেন নাই, কারণ তখন অনেক ভয় ছিলো, নানাবিধ কারণ ছিলো, এখন আপনি পাঁচ আগস্টের পরে আইসা বৈষম্য বিরোধী সাংবাদিক ফোরাম করবেন। এগুলোর তো দরকার নাই। ডেইলি স্টারের সাংবাদিক জাহিদ ভাই, তিনি তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর হাতে মাইর খাইছেন, বাংলাভিশনের লক্ষ্মণ দা’রে ঘুষি দিছে, আমারে কাঠ নিয়ে মারতে আসছে, অন্য আরেকজন এসে সেই আঘাত ফিরাইছে। এই যে, এরকম ঘটনা আমাদের যাদের সাথে হইছে, আমরা তো এতো লাফালাফি করছি না। তারা কেন লাফালাফি করছে, যারা তখন ছিলো না, যাদের দেখি নাই? সুতরাং তাদের কোনো উদ্দেশ্য আছে। আগে যেরকম দালালি করেছে, হইতে পারে, এবারও দালালি বা নিজেকে জাহির করতে চাইছে।

প্রায় এক বছর হয়ে গেছে। এক বছরে অনেক কিছু প্রকাশ হয়ে যাওয়ার কথা এবং হয়েছেও। তো ওই সাংবাদিকেরা খোলস পাল্টে নতুন কারো দালালি করতেছে, এরকম?

রাকিবুল ইসলাম : হ্যাঁ, এরকমই করতেছে।

স্পষ্ট করে বলছেন?

রাকিবুল ইসলাম : হ্যাঁ, একদম। যেহেতু আমরা সাংবাদিকতা করি, আওয়ামী লীগ বলেন, বিএনপি বলেন, জামাত বলেন, যেকোনো দলের নেতাকর্মীদের সাথে আমরা বসতে পারি, কথা বলতে পারি। একটা ভালো সম্পর্ক বা হাই-হ্যালোর সম্পর্ক থাকতেই পারে। এই জায়গা থেকে বের হয়েও আমি দেখেছি, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক যাদের ছিলো, এখন তারাই আবার খোলস পাল্টে আওয়ামী বিরোধী যেসব রাজনৈতিক দল আছে, তাদের সাথে মেশার ট্রাই করছে এবং মিশে যাচ্ছে।

নরসিংদীতে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিক কয়জন আছে বা কী রকম আছে বলে আপনার মনে হয়? যেকোনো দলই আসুক, আমি আমার পক্ষ থেকে একদম নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করে যাবো, এরকম? নাকি কর্তৃপক্ষ এসব ব্যপারে চাপ দেয় না?

রাকিবুল ইসলাম : কর্তৃপক্ষ চাপ দিলে দালাল সোজা হইতে বাধ্য। যেমন ধরেন, আমি দালালি করি, তো আমার কর্তৃপক্ষ যদি বলে আমাকে স্ট্রেট কাজ করতে, সেহেতু চাকরি বাঁচাতে হলে স্ট্রেট কাজ করতে হবে। কর্তৃপক্ষ যদি চাপ দেয়, তাহলে এই সংকট অনেকটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। আর বস্তুনিষ্ঠতার যে-সংজ্ঞা, এটা একেকজন একেকভাবে দেখে। আমার কাছে মনে হয়, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা পরে আসবে, আগে আসবে হচ্ছে যে, একটা নিউজ, একটা স্টোরি বা এইটা নিয়ে একটু চিন্তা করা, নিজস্ব গবেষণা করা, এইটাই আমাদের মাঝে নাই। এই অভাবটা আমাদের সবার আছে। আপনি যেটা বলছেন যে, আমি কোনো পক্ষ নিলাম না, জাস্ট ঘটনা যা, সেটাই বললাম। এরকম সাংবাদিক নরসিংদীতে দশ-বারোজন আছে। কিন্তু তারা হয়তো কাজ করে না, আলসেমি করে, তাদের আর্থিক সঙ্কট আছে, আবার অনেকে আছে, যাদের শুধু সাংবাদিকতা করে চলে না, আশেপাশে বিজ্ঞাপন নেয়ার ট্রাই করে। এখন আমি আপনার কাছ থেকে বিজ্ঞাপন নিলে তো আপনার বিরুদ্ধে ঠাসঠাস দুয়েকটা কথা বলতে পারি না। এরকম কিছু জায়গায় একটু ছাড় দিতে হয়। তখনই প্রকৃত সাংবাদিকতা মার খায়।

এই যে এতো দলাদলি, ‘নরসিংদী প্রেস ক্লাব’ আছে, এরপর আবার আলাদা করে একটা ‘নরসিংদী জেলা প্রেস ক্লাব’ আছে, আবার এর বাইরে আপনারা নতুন নতুন নামে করছেন ‘এক্টিভ জার্নালিস্ট’। এগুলোর কারণটা কী?

রাকিবুল ইসলাম : এখানে হচ্ছে কমিউনিকেশন গ্যাপ, নিজেদের মধ্যে কমিউনিকেশন গ্যাপ থাকার ফলেই এরকমটা হচ্ছে। আর নরসিংদী প্রেস ক্লাব এবং জেলা প্রেস ক্লাব এখন একই। নরসিংদী জেলা প্রেস ক্লাবের এখন আর কোনো এক্টিভিটি নাই। আর ‘এক্টিভ জার্নালিস্ট’ যেটা আছে, এটা হচ্ছে একটা মেসেঞ্জার গ্রুপ। এইটা কোনো সংগঠন বা ফেসবুক পেইজ বা গ্রুপ না। আমরা এখানে যারা সাংবাদিকতা করি, আমাদের প্রতিটা টেলিভিশনের বা সংবাদ মাধ্যমের যেহেতু আলাদা করে এতো বেশি লোকবল বা প্রটোকল নাই, সেজন্যে আমরা পুরো জেলার খবরগুলো পাওয়ার জন্যে নিজেদের এই গ্রুপে এড করে রাখি, কোনো একটা ঘটনা ঘটলে সেটা দ্রুত জানানোর জন্যে। তারপর আমরা সেটা নিয়ে নিউজ করি বা যার যার কাজ করি।

পাঁচই আগস্টের এক বছর চলে গেছে। এখন আপনারা যারা সাংবাদিকতা করছেন, আপনারা কি সঠিক খবর পৌঁছাচ্ছেন? আপনার এবং অনেকের ভাষ্যমতেই, আগে একটা স্বৈরতান্ত্রিক চাপ ছিলো। ওই চাপটা এখন থাকার কথা না।

রাকিবুল ইসলাম : অফিস যে আমাদের চাপ দিতো, ব্যাপারটা এমন না, আমরাই একটা মেন্টাল প্রেশারে থাকতাম।

এই মেন্টাল প্রেশার কি এখন আছে?

রাকিবুল ইসলাম : না। এখন নাই। ব্যক্তিগতভাবে আমার নাই। তবে অনেকের মেন্টাল প্রেশার আছে। আমার মেন্টাল প্রেশার কেন নাই? কারণ হচ্ছে, যেহেতু আমি কারো কাছে যাই না, ব্যক্তিগতভাবে কারো সাথে আর্থিক কোনো লেনদেন করি না। সেহেতু আমার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নাই।

এখন তো দেখা যায় যে, অনেক সাংবাদিক বিএনপির দিকে ঝুঁকে গেছে, তাদের নেতৃবৃন্দের দালালি করার চেষ্টা করতেছে বা করছে। এরকম পরিস্থিতিতে সাংবাদিকতা কেমন হচ্ছে?

রাকিবুল ইসলাম : এখন আওয়ামী বিরোধী যে-শক্তিগুলো আছে, তাদের সাথে যারা হাত মেলাচ্ছে, তারা ভালো করে সাংবাদিকতা করতে পারছে না।

সাংবাদিক সত্তার বাইরেও আপনি একজন নাগরিক। একজন নাগরিক হিসেবে আপনার অনেক প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির জায়গা আছে। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পরে আসলে আমরা কী পাইছি? সামনে আরো কিছু পাওয়ার আশা আছে কি না? এই এক বছরে সংক্ষেপে আপনার এনালাইসিসটা কী?

রাকিবুল ইসলাম : আগস্টের পাঁচ তারিখ বিকেলে আমার কাছে মনে হইছে, হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে হইছে যে, খুব দ্রুত হানাহানি-সংঘাত কমে যাবে। কিন্তু যেটা প্রত্যাশা ছিলো, তার সাথে প্রাপ্তির মিল নাই। প্রত্যাশা করেছিলাম, চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক কারবারি— এগুলো থাকবে না। কিন্তু এগুলো কমে নাই। চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ এখনো হচ্ছে। কিন্তু আমরা আসলে সাধারণ মানুষ হিসেবে যেটা প্রত্যাশা করেছি সেটা পাই নাই। আমি আসলে নির্বাচন হবে, অমুক দল তমুক দল ক্ষমতায় আসবে— এগুলো বুঝি না। আমি একজন সাংবাদিক হিসেবে, মানুষ হিসেবে বুঝি যে, আমি স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করবো, খাবো-দাবো, ঘুমাবো, আমার কাজটা করবো। রাষ্ট্র আমাকে নিরাপত্তা দেবে। এটাই আমি চাই। কিন্তু এখনো সেটা পাইনি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে বিএনপি : মনজুর এলাহী

0

মনজুর এলাহী। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), নরসিংদী জেলা। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, নরসিংদী সদর। তিনি বিশিষ্ট শিল্পপতি হিসেবেও পরিচিত। গত ১২ জুন ২০২৫ (বৃহস্পতিবার) তার এই সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেন সম্পাদক সুমন ইউসুফ।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এদেশের জনগণ আশা করেছে, বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির বন্দোবস্ত শুরু হবে। পুরোনো সব ধরনের ব্যবস্থা দূর হবে। তো জনগণের বিরাট একটা অংশের প্রতিনিধিত্বশীল দল হিসেবে বিএনপি বা আপনাদের পরিকল্পনা কী? আপনারা কীভাবে গড়ে তুলতে চান এই দেশকে?

মনজুর এলাহী : ধন্যবাদ আপনাকে সময়োপযোগী একটা প্রশ্ন করার জন্যে। সবচে’ বড়ো কথা হলো, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। এই দলের জন্মই হয়েছে এই দেশের মাটি ও মানুষের জন্যে কিছু করার জন্যে, এদেশের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে, এদেশের মানুষের ভোটাধিকার অর্জনের জন্যে, প্রতিটি নাগরিক যেন স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারে, নাগরিক অধিকার যেন ঠিকমতো পায়। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করাই হলো বিএনপির প্রথম এবং প্রধান কাজ। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী জনগণের চাহিদা।

সেই জায়গা থেকে জনগণের যে-চাহিদা, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র দ্বি-দলীয় বৃত্তের বাইরে গিয়ে মানুষ নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা খুঁজতেছিলো। এই অবস্থায় আপনাদের…

মনজুর এলাহী : এই জায়গায় একটা কথা বলে রাখি। এরকম একটা গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন আরেকটি রাজনৈতিক দল হবে, এটা কিন্তু মানুষের প্রত্যাশা ছিলো না। এতে মানুষ আরো আশাহত হয়েছে। কেন আশাহত হয়েছে? কারণ, বাঙালি বীরের জাতি। ১৯৪৭ সালে ছাত্র-যুবকেরা আন্দোলন-সংগ্রাম করে ইংরেজ শাসন থেকে মুক্ত করেছে আমাদের। তারপর ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ’৯০-এর গণ-আন্দোলনে ছাত্ররাই আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, জীবন দিয়েছে। তারা আবার স্ব স্ব জায়গায় চলে গিয়েছে। কেননা, তাদের ক্ষমতায় আসীন হবার ইচ্ছে ছিলো না। তারা দেশকে ভালোবেসে এসেছে, আবার ফিরে গিয়েছে। কিন্তু ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর মানে এবারই প্রথম এরকম ঘটনা ঘটলো। ছাত্ররা দল তৈরি করলো। রাষ্ট্রক্ষমতার স্বাদ পেতে চাইলো। আরেকটি বিষয়, এটা কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ছিলো। কিন্তু তারা ‘জনতা’ শব্দটি বাদ দিয়ে কেবল তারাই এই অভ্যুত্থান করেছে বলে ভাবতে লাগলো। ধরুন, একটা গাছ কাটতে কুড়ালের কোপ লাগে দশটা। আজকে সতোরো বছর ধরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র হাজার হাজার নেতাকর্মী খুন হয়েছে, গুম হয়েছে, মামলা খেয়েছে, জেল খেটেছে, বাড়ি-ব্যবসা-স্বজন হারা হয়েছে, দেশছাড়া হয়েছে স্বৈরাচারের আত্যাচার-নির্যাতনে। তো গত সতোরো বছরে আমরা নয়টা কোপ সেই স্বৈরাচারের গাছের গোড়ায় দিয়েছি। জুলাইয়ের এক মাসের আন্দোলনে দশ নম্বর কোপটা দেয়া হয়েছে। গাছটা পড়ে গেলো। তো এখন আপনি বলতে পারেন না যে, এই গাছ কাটার একমাত্র অবদান আপনার, আর কারো কোনো অবদান নেই। এটা ঠিক না।

মূলত আমার প্রশ্নটা ছিলো, বিএনপি’র পক্ষ থেকে আপনারা কীভাবে দেশ গঠনের কাজটা করতে চান? মানে আপনাদের পরিকল্পনাটা কী?

মনজুর এলাহী : সংস্কারের আলাপটা কিন্তু সরকার এখন বলছে। কিন্তু আমাদের নেতা জনাব তারেক রহমান কিন্তু ২০২২ সালেই এই ৩১ দফা প্রণয়ন করেছেন। এই ৩১ দফার পরে আপনি আর এমন কোনো বিষয় খুঁজে পাবেন না, যেখানে সংস্কারের প্রয়োজন আছে। তাহলে ভাবুন, যখন সংস্কারের কথা কেউ উচ্চারণও করেনি, তখনই আমাদের দল, আমাদের নেতা সংস্কারের আলাপ তুলেছিলেন। জনাব তারেক রহমান প্রস্তাব করেছেন যে, বাংলাদেশে একই ব্যক্তি পরপর দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। অথচ এখন থেকে উনার বয়স বিবেচনা করলে পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মতো বয়স উনার হয়তো আছে। সেই জায়গা থেকে উনি এই প্রস্তাব করেছেন। এমন নিঃস্বার্থ সংস্কারপ্রস্তাব আর হতে পারে না। আপনি যদি ৩১ দফা পড়েন, তাহলে এই প্রশ্ন আর আমাকে করার প্রয়োজন নেই।

সামনে তো নির্বাচন। মোটামুটি একটা সময় নির্ধারিত হয়েছে। কিছুটা এদিক-সেদিক হতে পারে। ভোটের জন্যে আপনারা জনগণের কাছে যাবেন। তাদের কাছে ভোট চাইবেন। তো জনগণের জন্যে আপনাদের কাজ কীরকম ছিলো, যেটার উপর ভিত্তি করে আপনারা ভোট চাইবেন? নাকি আপনারা ভাবছেন যে, আওয়ামী লীগ যেহেতু নাই, সুতরাং আপনারাই ক্ষমতার ভাগিদার?

মনজুর এলাহী : এটা নিন্দুকেরা বলে। বিএনপি এখনো পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলো চারবার, তখন কি আওয়ামী লীগ ছিলো না? আওয়ামী লীগের সাথে লড়াই করেই বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় চারবার এসেছে। আমরা তো কখনোই চাই নাই আওয়ামী লীগ ধ্বংস হয়ে যাক, তারা দেশ থেকে পালিয়ে যাক। তারা থাকলে তাদের সাথেও কম্পিটিশন করেই আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা করতাম। ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার দল বিএনপি না। জনগণের জন্যে এমন কোনো কাজ নাই, যেটা বিএনপি করে নাই। সমাজ সংস্কার বলেন, রাষ্ট্র সংস্কার বলেন, অবকাঠামো উন্নয়ন বলেন, সবকিছুতেই বিএনপির কাজ আছে। এভাবে বললে লিস্ট অনেক লম্বা হয়ে যাবে। সংক্ষেপে যদি বলি, এ-ধরনের কাজ করেছে বলেই জনগণ ভোট দিয়ে চারবার বিএনপিকে ক্ষমতায় এনেছে।

আপনাকে একটা বিষয়ে বলতে চাই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যদি বলি, তাহলে জনগণ আগের মতো চিন্তা করছে না। এই জায়গা থেকে বিএনপি যদি জনগণের নিকট সেবা পৌঁছে দেয়ার কাজটা করতে না পারে, তাহলে তো জনগণ আবারো মুখ ফিরিয়ে নেবে। এই ব্যাপারগুলো আপনাদের নজরে আছে কি না, জানতে চাই।

মনজুর এলাহী : আপনি খেয়াল করে দেখেন, পাঁচ তারিখের পরে তিনদিন কিন্তু সরকার ছিলো না। এটা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। সেই তিনদিনসহ পরবর্তী প্রায় দেড় থেকে দুই মাস সরকার গঠন হলেও ট্রাফিক ব্যবস্থা থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলার যে-অবনতি হয়েছিলো, তখন আমাদের দলের লোকেরা কিন্তু দিনে-রাতে জনগণের নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা করেছে। কেউ যেন কোনো সুযোগ নিতে না পারে, সেজন্যে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। এই কৃতিত্বটুকুও কিন্তু আপনারা দিচ্ছেন না আমাদের।

অনেকের মুখে একটা কথা চালু আছে যে, পুরোনো ফ্যাসিবাদ পালিয়ে গেছে, নতুন ফ্যাসিবাদ আবার আসতে চলেছে। এই ব্যাপারটাকে আপনারা কীভাবে ডিল করতে চান?

মনজুর এলাহী : এরকম কথা যদি চালু থাকে, তাহলে আমি বলবো ভালো। আর আমরা কিন্তু পেছনের দরোজা দিয়ে ক্ষমতায় বসতে চাচ্ছি না। আবার নির্বাচন হলে আমরাই নিশ্চিত ক্ষমতায় বসবো, এটাও বলছি না। এর আগেও কিন্তু তিনবার বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে। এবং তিন মাসের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার নজিরও আছে। বর্তমান সরকার দশ মাস অতিবাহিত হতে চললেও এখনো পর্যন্ত নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিতে পারছে না। আওয়ামী লীগ আগে বলতো, উন্নয়ন উন্নয়ন উন্নয়ন, পরে নির্বাচন। আর বর্তমান সরকার বলছে, সংস্কার সংস্কার সংস্কার, পরে নির্বাচন। তো আমরা যদি এরকমই খারাপ হই, তাহলে নির্বাচনের মাধ্যমেই তা প্রমাণ হয়ে যাবে। তখনই দেখা যাবে, জনগণ আমাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে নাকি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে মব জাস্টিস চলছে মারাত্মকভাবে। তাছাড়া গত দশ মাসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনির যে-নিস্পৃহ অবস্থান, বর্তমান সরকারেরও এসব ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেই বলে মনে হচ্ছে, আবার একটা বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে আপনারাও সরকারের নিকট জোরালো দাবি জানাচ্ছেন না কেন?

মনজুর এলাহী : এ-ব্যাপারে আপনার সাথে কম-বেশি আমিও একমত। এর মধ্যে আপনি দেখেন, গত পনেরো বছরে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ করে নাই, এমন কারো সরকারি চাকরি হয়েছে বলে দেখানো যাবে না। তো পাঁচ আগস্টের পরে মিনিমাম বিশ পার্সেন্ট অফিসার হয় স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছে অথবা পালিয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের নব্বই ভাগ লোকই আওয়ামী মনস্ক। যারা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে বা পালিয়ে গেছে, তাদের বাইরে যারা এখনো চাকরিতে আছে, তারা নিজেরাই চাচ্ছে না দেশ স্থিতিশীল থাকুক। শেখ হাসিনা বাইরে থেকে কীসের ভিত্তিতে বলে ফেলে যে, টুপ করে ঢুকে যাবে? যাই হোক, তাদের কবল থেকে আমরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসবো। আর মব জাস্টিস বর্তমান দেশের প্রেক্ষাপটে বন্ধ করা খুব কঠিন। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক সরকার না থাকলে জনমনে স্থিতিশীলতা আসে না। তাছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও স্থিতিশীলতা আসে না, বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। যেমন বিনিয়োগ সম্মেলন হলো, রেজাল্ট কিন্তু জিরো। আর ইউনুস সাহেব নানা দেশ ঘুরে যা নিয়ে আসছেন, সেগুলো কিন্তু বিনিয়োগ না। এর অন্যতম কারণ হলো, কোনো ইনভেস্টরই স্থিতিশীল সরকার না থাকলে ইনভেস্ট করবে না। এবং এসব কারণেই আমরা বারবার নির্বাচনের কথা বলছি।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলো। এই ব্যাপারে আপনাদের অবস্থান কী এখন?

মনজুর এলাহী : আওয়ামী লীগ বড়ো একটি রাজনৈতিক দল, আমাদের প্রতিপক্ষ একটা দল। এখন আমরা যদি বলি, তাদের নিষিদ্ধ চাই, তাহলে আপনারাই আবার বলবেন, আমরা ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চাইছি। বিএনপি’র চরিত্র কিন্তু এটা না। এখন দায়িত্বে তো আমরা নেই। বর্তমান সরকার তাদের বিচার-বিবেচনায় তাদের নিষিদ্ধ করেছে। এর কোনো দায়-দায়িত্ব আমরা নেবো না।

বিগত সরকার নানাভাবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে বিভাজিত করেছে। বর্তমান সময়েও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা ধরনের বিতর্কিত বক্তব্য-অবস্থান দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আপনাদের দলীয় অবস্থান কী?

মনজুর এলাহী : আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী না, তারা চাপা মারে। বরং যেই স্বপ্ন, সাধ, আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো, তার ধারে-কাছেও নেই আওয়ামী লীগ। গণতন্ত্র বলেন, বাকস্বাধীনতা বলেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলেন, ভোটাধিকার বলেন, এই সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলো আওয়ামী লীগ।

পাঁচ আগস্টের পর থেকেই জনগণের মুখে মুখে একটা কথা ছড়িয়ে পড়েছে যে, আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপি নরসিংদীসহ সারা দেশে ব্যাপকভাবে চাঁদাবাজিতে অংশ নিয়েছে। তারপর মামলা-বাণিজ্য করেছে। আবার পদবাণিজ্যের অভিযোগও আছে। এই ব্যাপারে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আপনার বক্তব্য কী?

মনজুর এলাহী : এগুলো অপপ্রচার। মুখরোচক গল্প। তারপরও যদি কারো বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির এরকম অভিযোগের প্রমাণ আপনি দিতে পারেন, তাহলে অবশ্যই আমরা দলীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। আর যোগ্যদেরই বিএনপি পদ দিয়ে থাকে। তখন যারা পদ পায় না, তারা পদবাণিজ্যের এসব গল্প ছড়িয়ে থাকে। ইতোমধ্যে সারা দেশে আমাদের হাজারের উপর নেতাকর্মী বহিষ্কৃত হয়েছে। সুতরাং আমাদের দলীয় অবস্থান এসবের বিরুদ্ধে। মূলত আমাদের দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে আমাদের প্রতিপক্ষ ভাইয়েরাই এসব ছড়াচ্ছে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, প্রেক্ষাপট : নরসিংদী

0

ষোড়শ শতকের দিকে ইউরোপে বাড়ির কাছে মানুষের বর্জ্য সংগ্রহের জন্যে সেসপিট এবং সেসপুল গর্ত করার সংখ্যা বেড়ে যায়। জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে রাস্তার নিচেও মানুষের মল-মূত্র যাওয়ার জন্যে নালা-খাল ইত্যাদি খনন করা হয়। এসব বর্জ্য পদার্থ বৃষ্টির পানিতে বয়ে যাওয়ার মতো ছিলো না। সেসপুলগুলো তখন বিভিন্ন ট্রেডম্যান দ্বারা পরিষ্কার করানো হতো। এরা প্রতিরাতে আসতো এবং এক ধরনের লিকুইড নিক্ষেপ করে কঠিন মল বের করে নিয়ে আসতো। আর এই কঠিন বর্জ্য বাজারে বিক্রি করতো নাইটসয়েল নামে সার উৎপাদনের জন্যে। তারা ঊনিশ শতকের দিকে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীদের সহযোগিতায় ম্যানহোল ব্যবস্থার উদ্ভাবন করেন, যা এখনো পর্যন্ত বিদ্যমান। কিন্তু সংকট ক্রমেই বাড়তে থাকে। ম্যানহোলের মধ্যে ময়লা আটকে শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। অনেক সময় ম্যানহোলে পড়ে গিয়ে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হয়।

দূষণ একটি অপবিত্র কাজ
দূষণের মধ্য দিয়ে পরিবেশ হত্যা একটি অপবিত্র কাজ হিসেবে বিবেচিত। ময়লার ভাগাড় থেকে আগত দুর্গন্ধ যেমন মানুষের দৈনন্দিন চলাচলে ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করছে, তেমনি গণস্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। জনগণের সেবার নাম করে চেয়ার অলঙ্কৃত করা কথিত ডায়নামিক কর্তৃপক্ষ ‘গোলেমালে যাক কয়দিন’ সিস্টেমে শহরের মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছেন। ময়লার ভাগাড়ে প্রতিদিন টনের টন আবর্জনা জমা হচ্ছে। তবে যেভাবে হওয়ার কথা, ঠিক সেভাবে নয়, পুরোটাই অব্যবস্থাপনায়। জনজীবনে চরম ভোগান্তি সৃষ্টি করছে শহরের এসব ময়লা। উন্নত দেশে যেভাবে ময়লা ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেছে, উন্নত বলে তারা পেরেছে, ‘আমরা তাদের মতো নই’ বলে কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব সেরে স্বর্গীয় সুখ লাভ করতে চায়। তাদের ধারণা, সব অটোমেটিক চলবে। এবং নিজেরা পকেট ভারি করার ধান্দায় এসব দায়িত্ব পালন না করে অন্যদিকে মনোযোগ দেন। মেয়র পদটা কেবলই একটা অর্থ কামানোর ম্যাগনেটিক গেট। একটা ‘এ’ গ্রেডের পৌরসভার যে-পরিমাণ লোকবল থাকা প্রয়োজন, সেটা কর্তৃপক্ষের অজানা থাকার কথা নয়। জানা মতে, নরসিংদী পৌরসভার যথেষ্ট ফান্ড রয়েছে। কিন্তু এদিকে মনোযোগ দিয়ে কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট সময় নষ্ট করতে রাজি নন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।

নরসিংদী ও মাধবদী শহর এবং মধ্যবর্তী গ্রামসমূহের বিপুল সংখ্যক মানুষের যোগাযোগের অন্যতম প্রধান সড়ক নরসিংদী-মদনগঞ্জ রুটের দুই পাশে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল বর্জ্যের ভাগাড়

শহরের লোকসংখ্যা
তথ্য মতে, নরসিংদী শহরের লোকসংখ্যা প্রায় তিন লাখ। এখানে রয়েছে অসংখ্য স্কুল-কলেজ এবং অফিস। স্থানীয় এবং ভাড়াটে মিলিয়ে উল্লেখিত জনসংখ্যা প্রতিদিন বিশাল পরিমাণ বর্জ্য উৎপন্ন করছে। এসব বর্জ্য বিশাল বর্জ্যের পাহাড় সৃষ্টি করছে। তারপর আছে ভ্রমণকারী হিসেবে অস্থায়ী লোকসংখ্যা, যেটা হিসেবের বাইরে। অন্যদিকে, সদর উপজেলার মাধবদী পৌরসভার জনসংখ্যার হিসাব তথ্যের অভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যাচ্ছে না। তবে আনুমানিক লাখের উপর হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, শহরটিতে অসংখ্য কারখানা আছে, যেখানে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করছে।

বর্জ্য আসার স্থানসমূহ
নরসিংদী শহরটির বর্তমান অবস্থা খুব বেশি দিনের নয়। ক্রমবর্ধমান জনবসতি প্রতিনিয়ত ময়লার ওজন বৃদ্ধি করে চলেছে। এসব ময়লার উৎস বিভিন্ন জায়গা। মূলত সাতটি জায়গাকে ময়লার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জায়গাগুলো হচ্ছে : ১. বাসা-বাড়ি (৭০%), ২. বাজার (১০%), ৩. মেডিক্যাল (৫%), ৪. শিল্প কারখানা (৫%), ৫. যানবাহন (৩%), ৬. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (৩%) ও ৭. অনুষ্ঠান (৪%)। মূলত কোন স্থান থেকে কী পরিমাণ বর্জ্য আসে, তা বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী শতকরা হিসাবে দেখানো হয়েছে।

বর্জ্য ফেলার স্থানসমূহ
বাসা-বাড়ি, মেডিক্যাল, শিল্প কারখানা, বাজার, যানবাহন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অনুষ্ঠানস্থল থেকে উৎপাদিত বিশাল পরিমাণ ময়লা ফেলা হয় মূলত তিন ধরনের জায়গায় : ১. নদীর ধারে (বড়ো বাজার, শেখেরচর), ২. বড়ো রাস্তার ধারে (নরসিংদী-মদনগঞ্জ রাস্তা) ও ৩. খাল বা কোনো নালা-নর্দমায় (মাধবদী)।

নদীতে বা নদীর ধারে ময়লা ফেলা হলে সেটা আবার নদীর পানিকে দূষিত করে থাকে। অনেকে এই পানি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে। গোসল করার কারণেও অসংখ্য মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, যেটি এখনো কোনো গবেষণার মুখ দেখেনি। অন্যদিকে ময়লার এই দূষিত পানি পান করে অনেক পশু-পাখি আক্রান্ত হচ্ছে, যা ইকোসিস্টেমে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

বর্জ্যের ধরন
বিভিন্ন কারণে পরিবেশে নানা রকমের বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এসব বর্জ্য পদার্থকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় : ১. কঠিন, ২. তরল ও ৩. গ্যাসীয়।

বিষক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে আবার একে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে : ১. বিষাক্ত বর্জ্য ও ২. বিষহীন বর্জ্য।

বিষাক্ত বর্জ্য
বিষাক্ত বর্জ্য কঠিন, তরল ও বায়বীয় হয়ে থাকে। যন্ত্রশিল্প, নির্মাণশিল্প, মোটরের নষ্ট পার্টস ও হাসপাতাল থেকে আসা বর্জ্যই বিষাক্ত বর্জ্য। এসব বর্জ্য মানুষ ও প্রাণীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। এগুলো পরিবেশের জন্যে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির ইঙ্গিত দেয়। তাই এসব বর্জ্য পদার্থকে বিপদজনক বর্জ্য পদার্থ বলা হয়।

বিষহীন বর্জ্য
অফিস, রেস্টুরেন্ট, স্কুল-কলেজের বর্জ্য, পরিত্যক্ত খাবার, ফলের খোসা, পচা শাক-সবজি, ছেঁড়া কাগজ, ছেঁড়া কাপড় ইত্যাদি বিষহীন বর্জ্য হিসেবে বিবেচিত। এগুলোকে সঠিকভাবে বিয়োজিত করলে পরিবেশের উপর অনেক কম ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে।

লোকসংখ্যাপ্রতি বর্জ্যের পরিমাণ
নরসিংদী শহরে প্রায় ৩ লাখ লোকের বাস। এখানে মাথাপিছু দৈনিক ৫০০ গ্রাম বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এসব উৎপাদিত বর্জ্যের মধ্যে ৬.৭১ শতাংশ আবার মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে সেই হিসেবে ৩.৫ টন কঠিন বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এগুলোর ৭০ শতাংশ বাসা-বাড়ি থেকে আসে। আর ১০.৪২ বর্গকিলোমিটার শহরটি থেকে প্রায় ৪০ টন বর্জ্য আসে। সংগৃহীত বর্জ্যের ৬৮ শতাংশের বেশি চলে যায় ল্যান্ডফিলে। ৪ শতাংশের মতো বর্জ্য রিসাইক্লিং হচ্ছে। বাকি সব নদী বা খাল-বিল বা অনির্দিষ্ট স্থানে ফেলে পরিবেশ দূষণ করছে। (বিবিএসের জরিপ)

বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যয়
দেশের প্রতিটি স্থানীয় সরকার মোট ব্যয়ের ৮ শতাংশ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় খরচ করে। এতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বছরে মাথাপিছু গড় ব্যয় হয় ৫২০-৫৩০ টাকার মতো। বিবিএস জরিপ অনুযায়ী নরসিংদী পৌরসভার হিসেব করলে দেখা যায়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় তদারকির হার ৬০ শতাংশের কম। ২০২২ সালের বিবিএস প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিটি শহুরে নাগরিকের পেছনে ৫৫৮ টাকা ব্যয় হয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্যে। এটি ২০২৫ সালে এসে ৬০০ টাকার কিছু বেশি দাঁড়িয়েছে। এটা অপ্রতুল। এটা বাড়িয়ে জনবল সংকট কমিয়ে শহরবাসীকে স্বস্তি দিতে হবে।

অস্থায়ী কর্মী ও দক্ষ লোকবল
বিবিএস জরিপ অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে ২০ হাজার ১০৫ জন স্থায়ী কর্মী বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, যা এই খাতে মোট কর্মীর ৩৮ শতাংশ। সিটি কর্পোরেশনগুলোতে এই হার ৫০ শতাংশের মতো, আর পৌরসভায় ৩০ শতাংশেরও কম। জরিপ অনুযায়ী, এসব খাতে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। নরসিংদী পৌরসভার ময়লা বিষয়ক প্রধান কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, নরসিংদীতে ২০০ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী রয়েছে। এছাড়া বাজারগুলোতে অস্থায়ী কর্মীও চোখে পড়ে। কিন্তু এই সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় 3R
সমন্বিত ও সম্পূর্ণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে 3R নীতি প্রয়োগ করা হয়। তিনটি R হলো :

১. Reduce (কমানো);
২. Reuse (পুনর্ব্যবহার) ও
৩. Recycle (পুনর্চক্রীকরণ)।

অর্থাৎ নীতিগুলোতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্যদ্রব্য না ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। তারপর পণ্যের পুনরায় ব্যবহার এবং পণ্যের পুনর্চক্রীকরণের উপর বিশেষজ্ঞগণ মত দিয়েছেন। এটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি কার্যকরী দিক।

বর্জ্যের সম্ভাবনাময় অর্থনীতি
বর্জ্য নিয়ে দুটো প্রচলিত কথা হলো ‘আজকের বর্জ্য আগামীকালের সম্পদ’ এবং ‘আবর্জনাই নগদ অর্থ’। নরওয়ে, সুইডেন, আমেরিকা কিংবা জার্মানি বর্জ্য পদার্থকে সম্পদে পরিণত করছে। আবর্জনা থেকে এখন তৈরি হচ্ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সার এবং বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান তৈজসপত্র। নরসিংদীকে একটি A গ্রেডের শহর ধরে নিলে ও মোট জনসংখ্যা যদি ৩ লাখ ধরা হয় এবং বিবিএসের হিসেব অনুযায়ী জনপ্রতি ৫০০ গ্রাম আবর্জনা যদি দিনে উৎপাদিত হয়, তাহলে দিনে ১৫০ টন এবং মাসে ৪ হাজার ৫০০ টনের বেশি ময়লা উৎপাদিত হচ্ছে। এই বিপুল আবর্জনা ব্যবহার করে জেলায় বিশাল পরিমাণ সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের চাহিদা এবং প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্রের চাহিদা মেটানো সম্ভব। পৌরসভার যদি যথেষ্ট অর্থ না থাকে, ঋণ নিয়ে এই প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। আমরা ইতোমধ্যে যশোর পৌর কর্তৃপক্ষকে ৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখেছি, যারা দুই বছরের মধ্যে লাভের মুখ দেখেছে। প্রকল্পের প্লান্ট থেকে উৎপাদিত সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বাজারমূল্য থেকে কম দামে তারা বিক্রি করছে। দিনে ৩০ থেকে ৪০ টন বর্জ্য পদার্থ ব্যবহার করে এসব সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদন করছে। এদিকে হিসেব করলে দেখা যায়, নরসিংদীতে বিরাট পরিমাণের বর্জ্য পদার্থ নষ্ট করে পরিবেশ ও জনজীবনের ক্ষতি সাধন অর্থাৎ সম্পদ নষ্ট করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, যশোরের প্রকল্পটি দেশের প্রথম পাইলট প্রকল্প।

বর্জ্যের স্তূপ স্থাপন
১৯৯১ সালে Environment Protection Agency ল্যান্ডফিল সাইটের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নীতিমালা প্রদান করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, একটি ল্যান্ডফিল সাইটের ৩০ মিটার দূরত্বের মধ্যে কোনো খাবার পানির নলকূপ থাকা যাবে না এবং ৬৫ মিটার দূরত্বের মধ্যে কোনো ঘর-বাড়ি, স্কুল-কলেজ ও পার্ক থাকা যাবে না। এছাড়াও রাস্তার পাশে ময়লার ভাগাড় রাখা যাবে না। ময়লার স্তূপ স্থাপন করার জন্যে অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে ময়লা রাখার স্থান পাকা করা। কিন্তু যেখানে ময়লা ফেলা হয়, সেখানে দেশের কোথাও পাকা করা হয়েছে বলে দেখা যায় না। কারণ বিশাল পরিমাণ বর্জ্য পদার্থ থেকে প্রচুর তরল রস বেরিয়ে আসে, যেগুলো পানির স্তরে মিশে মিঠা পানির ক্ষতি করছে। এছাড়াও এই তরল রস খোলা জায়গায় ফেলার কারণে ফসলি জমিতে গিয়ে পড়ছে। ফলে ফসল ও জমিÑ উভয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নরসিংদীর শালিধা এবং মাধবদীর ফায়ার সার্ভিস এলাকায় প্রায় অর্ধ কিলোমিটার করে যে-পাহাড় পরিমাণ ময়লার ভাগাড় সৃষ্টি করা হয়েছে, এতে বিশাল পরিমাণ জমি ক্ষতির শিকার হচ্ছে। অন্যদিকে, দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজে যারা নরসিংদী থেকে মদনগঞ্জ রাস্তাটি ব্যবহার করেন, তাদের সংখ্যা আনুমানিক ৩০ থেকে ৩৫ হাজারের বেশি। রাস্তার পাশে থাকা ময়লার দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়। চালকেরা এই ভোগান্তির শিকার প্রতিদিনই হচ্ছেন। অনেক সময় যানজট সৃষ্টি হতে দেখা যায় এই ময়লার ভাগাড়ের ঠিক মাঝখানে।

প্লাস্টিক পণ্য
বিগত কয়েক বছরে নতুন বর্জ্য হিসেবে প্লাস্টিক বর্জ্য বেড়েই চলেছে। মূল বর্জ্যের ১০ শতাংশ এখন প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে বিবেচিত। তার মানে ৪ হাজার ৫০০ টন বর্জ্যের মধ্যে ১০ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য। এগুলো রিসাইক্লিং না করার ফলে পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। এসব প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশে মিশে জনজীবনে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করছে। এসব বর্জ্যের মধ্যে ৩৯ শতাংশ ভাগাড়ে ফেলা হচ্ছে, তার ৩৬ শতাংশ মাত্র রিসাইক্লিং হচ্ছে।

মাইক্রোপ্লাস্টিক
প্লাস্টিকের ব্যাগ, সিন্থেটিক পোশাক, প্লাস্টিকের কার্পেট, থালা-বাসন, বোতল, টায়ার, খেলনা, বাসায় ব্যবহৃত প্লাস্টিক জাতীয় পণ্যদ্রব্য, প্যাকেটজাত দ্রব্য এবং প্লাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য ব্যবহারের পর ফেলে দেয়া হয়। সেগুলো ফেলা হয় ময়লার ডাম্পিং গ্রাউন্ডে। ফেলে দেয়া ময়লা যখন দীর্ঘ সময় ধরে রোদে পড়ে থাকে, তখন রৌদ্রতাপ ও অণুজীব এবং পরিবেশের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফলে এসব প্লাস্টিক ভেঙে তৈরি হয় বিভিন্ন আকৃতির প্লাস্টিক, যা আবারো পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান ও সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে ক্ষয় হয়ে পরিণত হয় ছোটো ছোটো প্লাস্টিক কণায়। এগুলোকেই বলা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক। মাইক্রোপ্লাস্টিক মূলত চার ধরনের হয় : ১. অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা (ন্যানোপ্লাস্টিক, ১-১০০০ ন্যানোমিটার), ২. ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা (মাইক্রোপ্লাস্টিক ১- ১০০০ মাইক্রোমিটার), ৩. মাঝারি আকারের প্লাস্টিক কণা (১-১০ মিলিমিটারের বেশি) ও ৪. বড়ো প্লাস্টিক কণা (১ সেন্টিমিটারের বেশি)।

এসব প্লাস্টিক মাটিতে ফেলা হলে ৪০০ বছরেও নষ্ট হয় না। বরং প্রতিনিয়ত গলে গলে বাতাসের সাথে মিশে বছরের পর বছর ধরে পরিবেশের ক্ষতি করে। তাই বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাস্তুতন্ত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিক সূর্যতাপে গলে বাতাসের সাথে মিশে প্রাণীর খাবারে পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে, সেখানে মানুষও বাদ পড়ছে না। ভয়ের কারণ হচ্ছে, ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ফিল্টার করার পরও খাবার পানি থেকে এসব প্লাস্টিক কণা আলাদা করা যায় না। তাহলে ময়লার স্তূপে থাকা এসব প্লাস্টিক অবশ্যই উদ্বেগের কারণ। কেননা এসব প্লাস্টিক মানুষের লালা, রক্তে ও মলে ঢুকে যাচ্ছে। তারপর এগুলো ফুসফুস হয়ে রক্তের মাধ্যমে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে এবং ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগের কারণ হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৫ সালে ঢাকায় মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিলো ৩ কেজি। সেটা ২০২৫ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২৫ কেজির কাছাকাছি। নরসিংদী ঢাকার খুব কাছের একটি শহর। এখানে জীবনযাত্রার মান ঢাকার কাছাকাছি। সেই হিসেবে আমরা বলতে পারি, শহরে থাকা প্রায় তিন লাখ মানুষের জনপ্রতি ব্যবহৃত প্লাস্টিক অন্তত ২০ কেজির কম হবে না।

গরীব-ধনীর তুলনামূলক বর্জ্য উৎপাদন
গড়ে একজন মানুষ বছরে ১৮০ কেজি বর্জ্য উৎপাদন করে। শহরে যেহেতু তুলনামূলক আর্থিকভাবে মোটামুটি স্বাবলম্বীরাই বসবাস করে, সেই হিসেবে গরীবের তুলনায় ধনীরাই বেশি বর্জ্য উৎপাদন করে থাকে। আনুমানিক ধরে নিলে তুলনাটি হতে পারে ৭৫ : ২৫ অনুপাতে। অর্থাৎ নরসিংদী পৌরসভার ৩ লাখ মানুষের মধ্যে ৭৫ হাজার মানুষই বেশি বর্জ্য উৎপাদন করছে।

বায়োমাইনিং
ময়লার দুর্গন্ধে নগরবাসী অতিষ্ঠ। এটা থেকে মুক্তির জন্যে পৌরকর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করছে না। নরসিংদীর শালিধা, মাধবদীর ফায়ার সার্ভিস এলাকা, শেখেরচর বাজার, মাধবদী শহরের নদীর পাড় এবং ভেলানগর ঢাকা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ময়লার দুর্গন্ধে নগরের বাসিন্দারা অতিষ্ঠ। অথচ পৌর কর্তৃপক্ষ চাইলেই এটার একটা চমৎকার সমাধান করতে পারে। সেটি হচ্ছে বায়োমাইনিং পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ময়লার উপর গজিয়ে তোলা হয় সবুজ গাছ। সবুজায়নের মাধ্যমে ময়লার ভাগাড়কে বাগানে পরিণত করা সম্ভব। এই পদ্ধতিটি কলকাতা পৌর কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছে এবং যথাযথ ফলও পাচ্ছে তারা। নরসিংদী শহরের শালিধা অঞ্চলে বিশাল ভাগাড়ের পাড় দিয়ে যাওয়ার সময় প্রথম ভাগাড়টিতে চোখ বুলালেই দেখা যাবে এর প্রমাণ। সেখানে প্রাকৃতিক উপায়েই গাছ জন্মাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ চাইলেই অল্প খরচে এই উদ্যোগটি গ্রহণ করতে পারে।

পচনশীল ও অপচনশীল দ্রব্য পৃথকীকরণ
দুর্গন্ধে নাকাল শহরবাসী। এটার পেছনে অব্যবস্থাপনাকেই মূলত দায়ী করা যায়। কর্তৃপক্ষ যদি পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের নির্দেশ দেয় যে, তারা যখন বাসা-বাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করবে, তখন তারা ময়লাকে দুটি ভাগে সংগ্রহ করবে। ভাগ দুটি হচ্ছে পচনশীল দ্রব্য এবং অপচনশীল দ্রব্য। পাশাপাশি পৌরকর্তৃপক্ষ সারা শহরে মাইকিং করে শহরবাসীকে অনুরোধও করতে পারে যে, তারা যখন দ্রব্য ব্যবহার করবে, তখন যেন ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট দুটি ভাগে ভাগ করে রাখেন। তখন পরিচ্ছন্নতা কর্মীদেরও পচনশীল ও অপচনশীল দ্রব্য পৃথক করতে বেগ পেতে হবে না। তারপর ডাম্পিং গ্রাউন্ডে যখন ময়লা ফেলা হবে, তখন প্রথমে অপচনশীল, তারপর কিছুটা দূরত্বে পচনশীল ময়লা ফেলা হবে। এতে দুর্গন্ধ অনেকটা কমে আসবে। এখানে সচেতনতার পাশাপাশি সদিচ্ছার প্রয়োজন। গরম বাড়ার সাথে সাথেই পচনশীল দ্রব্যের দুর্গন্ধ চারদিকে দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। কর্তৃপক্ষ যেন তাদের দক্ষতা ব্যবহার করে দুর্ভোগ কমিয়ে আনে, সেটার জন্যে নগরবাসীদেরও ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

শালিধা এলাকায় নরসিংদী-মদনগঞ্জ রুটে বিশাল বর্জ্যের ভাগাড়

হাসপাতালের বর্জ্য আলাদাকরণ
হাসপাতালের বর্জ্যে বিভিন্ন ধরনের রোগ-জীবাণু থাকে। এগুলো থেকে বড়ো একটা অংশ রোগ ছড়িয়ে থাকে। শহরে লোকসংখ্যা বেশি থাকায় নরসিংদী সদরেই শুধু বিশের অধিক সরকারি ও প্রাইভেট হাসপাতাল গড়ে ওঠেছে। প্রাইভেট হাসপাতালগুলো ছোটো এবং তুলনামূলক পরিচ্ছন্ন থাকলেও সরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থা নাজুক। প্রতিদিন এগুলো থেকেও ভালো পরিমাণে বর্জ্য আসছে এসব ভাগাড়ে। তাই পৌরকর্তৃপক্ষ এসব হাসপাতালের বর্জ্য পদার্থের জন্যে আলাদা ডাম্পিং গ্রাউন্ড তৈরি করতে পারে, যেটা হবে লোকালয় থেকে দূরবর্তী স্থানে। এতে দুর্গন্ধ ও জীবাণু— দুটি থেকেই বাঁচা যাবে।

পলিথিন
ময়লার ভাগাড়ে তাকালেই দেখা যায় পলিথিনের বিশাল সমাহার। পলিথিন মাটির সাথে মেশে না। যেহেতু পরিবেশের জন্যে এটা মারাত্মক ক্ষতিকর, সেহেতু এটা নিয়ে পৌরকর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে। নরসিংদী এবং মাধবদী শহরে প্রতিদিন গড়ে পরিবারপ্রতি ৪ টি করে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। আর এসব ব্যাগ একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেয়া হয়। সেই হিসেবে শুধু শহরেই তিন লাখ মানুষের গড় পলিথিনের ব্যবহার দিনে ২ লাখ ৭৫ হাজার পিস। সংখ্যাটা মাসে দাঁড়ায় ৮২ লাখ ৫০ হাজারে। এসব পলিথিন নানা উপায়ে ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফলে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। তাহলে কী পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ছে এবং বিভিন্ন উপায়ে আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে, তা ভেবে দেখা দরকার।

ই-বর্জ্য
নতুন বর্জ্য হিসেবে প্রতিদিন ই-বর্জ্যের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। নরসিংদী ঘনবসতি শহর বিধায় এখানে প্রচুর পরিমাণে ই-বর্জ্যের সৃষ্টি হচ্ছে। শহরে ব্যবহৃত ই-বর্জ্যের মাত্র ৩ শতাংশ পুনর্প্রক্রিয়াকরণ হচ্ছে। বাকি ৯৭ শতাংশই জায়গা করে নিচ্ছে ময়লার ভাগাড়ে। শহরে এই হার বছরে ২১ শতাংশ করে বেড়েই চলেছে। ই-বর্জ্য নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক জোট গ্লোবাল ই-ওয়েস্ট স্ট্যাটিসটিকস পার্টনারশিপের এক জরিপ বলছে, বিশ্বে প্রতিবছর ই-বর্জ্য ২১ শতাংশ হারে বাড়ছে। বর্তমানে নরসিংদী শহরেও ই-বর্জ্যের সুনামি দেখা যাচ্ছে। এগুলোতে সিসা, টিন, সিলিকন, দস্তা, পারদ, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম ও নাইট্রাস অক্সাইড নামক রাসায়নিক পদার্থ থাকে। এসব পদার্থ মাটি ও পানিকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে এবং এসব দূষিত রাসায়নিক পদার্থ বিভিন্নভাবে মানুষের দেহে প্রবেশ করছে। বিশেষ করে, গর্ভবতী মা ও শিশু এটার শিকার হচ্ছে বেশি। অথচ সঠিক ব্যবস্থাপনা হলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বহুগুণে কমে যেতো। পাশাপাশি পৌরকর্তৃপক্ষ লাভজনক উপায়ে ব্যবসা করে পৌরসভার তহবিলও বাড়াতে পারতো।

পৌর পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের স্বাস্থ্য
নরসিংদী পৌরসভার ময়লা বিষয়ক প্রধান কর্মকর্তা মো. ইয়াসিন মিয়ার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, শহরে মোট ২০০ পরিচ্ছন্নতা কর্মী রয়েছে। তারা প্রতিদিন বাসা-বাড়ি থেকে আবর্জনা সংগ্রহ করছেন কোনোরকম প্রটেকশন ব্যবহার না করেই। এতে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। পৌরকর্তৃপক্ষের উচিত নির্দিষ্ট সময় অন্তর তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা এবং আবর্জনা সংগ্রহের জন্যে প্রয়োজনীয় প্রটেকশন ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা। কারণ ময়লা থেকে বের হওয়া বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ সরাসরি তাদের শরীরে প্রবেশ করছে। ফলে চোখ জ্বলা, ফুসফুসে সমস্যা দেখা দেয়াসহ নানাবিধ সমস্যায় তারা ভুগতে থাকে। তারা যদি অসুস্থ থাকে, তাহলে পুরো শহর আবর্জনার স্তূপে পরিণত হবে। তাই তাদের সুস্থ রাখার জন্যে কর্তৃপক্ষের উচিত, নির্দিষ্ট সময় অন্তর তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা।

মাছ ও মুরগির বর্জ্য
শহরের বাজারগুলোতে অনেকগুলো ফার্মের মুরগির দোকান গড়ে ওঠেছে। সব মিলিয়ে একশোর কম হবে না। এসব বাজার থেকে বিষ্ঠা সংগ্রহ করে সরাসরি ময়লার ভাগাড়ে ফেলা হয়। ফলে দুর্গন্ধ আরো বেড়ে যায়। সেই সাথে আছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও। মৎস্য থেকেও প্রচুর বর্জ্য পদার্থ আসে, যেগুলো দুর্গন্ধ ছড়াতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এগুলো অন্যান্য বর্জ্যের সাথে মিশে ব্যাপকভাবে ইকোলজি হত্যা করছে। তাই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিক নিয়মে করতে হবে। ক্যাটাগরি অনুযায়ী বর্জ্য অপসারণ আলাদাভাবে করতে হবে।

নরসিংদী শহরের শিক্ষা চত্বরের নিকটবর্তী ডাম্পিং স্টেশনের বর্জ্য প্রায়শই ছড়িয়ে পড়ে রাস্তায়

পোশাকের বর্জ্য এবং ক্ষতিকর ফাইবার
প্রকাশিত অ্যালগালিটা ২০১২ নিবন্ধ অনুসারে, একটি পলিস্টার পোশাক থেকে প্রতিবার ওয়াশিং বিমুক্ত করার পর ফাইবার বের হয় ১৯০০-র বেশি। পরীক্ষায় আরো দেখা যায়, প্রতি লিটার বর্জ্যপানিতে নিষ্কৃত মাইক্রোফাইবারের সংখ্যা ১০০-র বেশি। এসব রঙ করা কাপড় ব্যবহারের পর যখন ফেলে দেয়া হয়, তখন ময়লার স্তূপে আরেকটি সংখ্যা যুক্ত রড, যার পরিমাণ নেহায়েত কম নয়। শহরে যদি ৩ লাখ লোক থাকে, তাহলে এসব রঙ মিশ্রিত কাপড় যায় কোথায়? সূর্যের তাপে কাপড় থেকে বের হয়ে আসা রঙ প্রাকৃতিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি করছে। কারণ কাপড় উৎপাদনে প্লাস্টিকের যথেষ্ট ব্যবহার হয়ে থাকে। তাই এসব রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথ উপায়ে করতে হবে। নয়তো নরসিংদীর শালিধা এবং মাধবদীর ফায়ার সার্ভিস এলাকায় ময়লার ভাগাড়ে আবর্জনার পরিমাণ হবে আকাশচুম্বী।

ময়লা থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস
বর্তমান বিশ্বে একটা বড়ো আশঙ্কার কারণ হচ্ছে গ্রিন হাউস গ্যাস। পচা আবর্জনা অর্থাৎ মূলত পচা খাবার থেকে ১০ শতাংশ গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসৃত হচ্ছে। তাহলে শহরে দৈনিক যে-পরিমাণ বর্জ্য হচ্ছে, তার অর্ধেকই পচনশীল দ্রব্য। সেই হিসেবে ৪ হাজার টনেরও বেশি বর্জ্য মাসে পচছে। এবার এটা থেকে যে-পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসৃত হচ্ছে, সেটা বড়ো উদ্বেগের কারণ। এই উদ্বেগ শুধু নগরবাসীর জন্যে নয়, সারা দেশের জন্যেই। এসব আবর্জনার কারণে মশার উপদ্রব বেড়ে চলেছে। মূলত তাপ বাড়ার সাথে সাথে এই ঘটনাটি ঘটতে থাকে। শহরের মানুষের উপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলছে এই গ্যাস। কর্তৃপক্ষ যদি এটার সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে জনদুর্ভোগ আরো প্রকট থেকে প্রকটতর হবে।

বর্জ্য পোড়ানোর ধোঁয়া এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি
নরসিংদী শহরের শালিধা এবং মাধবদী পৌরসভার ফায়ার সার্ভিস এলাকায় বর্জ্যের বিশাল স্তূপ চোখে পড়ে। প্রতিদিনই দেখা যায়, বর্জ্যগুলোতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলছে। মূলত দুর্গন্ধ থেকে রক্ষা পেতেই কর্তৃপক্ষ এই কাজ করছে তাদের অজ্ঞতা থেকে। কিন্তু কী পরিমাণ ক্ষতি যে হচ্ছে, সেটার ইয়ত্তা নেই। আবর্জনা পোড়ানোর ফলে নির্গত হয় পার্টিকলস, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, হাউড্রোজেন ক্লোরাইড, বেনজিন, পলিক্লোরিনেটেড বাইফেনালস, আর্সেনিক, মার্কুরি ও ফার্নাস।

তাছাড়া ময়লা পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়ার কারণে যানবাহন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। প্রায়শই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে।

যে কেউ এসব রিপোর্ট দেখলে আঁতকে না উঠে পারবেন না। অথচ এসব ব্যাপারে পৌরসভা কর্তৃপক্ষের জ্ঞান শূন্যের কোটায়, এই কথা অবিশ্বাস হয় না। তাদের কাছে এসবের কোনো তথ্যই পাওয়া যাবে না। তারা মূলত প্রাইমারি থেকে ফাইনাল ডিসপোজাল পর্যন্ত ময়লা ফেলে দায়িত্ব শেষ বলে মনে করেন। কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা না করলে তাদের ঘুম ভাঙবে না। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার দিকে এগিয়ে যাওয়া। সেটা নরসিংদী কিংবা মাধবদীর পৌরকর্তৃপক্ষের বেলায় দেখা যায় না।

ভেলানগর ব্রিজের পাশে স্তূপীকৃত বর্জ্য গড়িয়ে পড়ছে হাড়িধোয়া নদীতে

টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কিছু সুপারিশ
সঠিকভাবে এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্যে কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হতে হবে। নগরবাসীর শান্তির জন্যে কর্তৃপক্ষকে সময়োপযোগী কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে শহরে কোনো জঞ্জাল থাকবে বলে মনে হয় না। একটি পরিচ্ছন্ন শহর গড়ে তুলতে কর্তৃপক্ষ নিচের সুপারিশগুলো ভেবে দেখতে পারে। সুপারিশগুলো হচ্ছে :

১. বর্জ্য পদার্থের ক্ষতিকর দিক নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি।
২. বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার লক্ষ্যে বর্জ্য উৎপাদনের উৎসস্থলে শ্রেণি অনুযায়ী পৃথক ডাস্টবিনে ফেলার ব্যবস্থা করা।
৩. বর্জ্য পদার্থের পুনরাবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লাভজনক পণ্যে রূপান্তরিত করা।
৪. আবর্জনাগারের কাছাকাছি বায়োগ্যাস প্রজেক্ট স্থাপন করা, যাতে পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি জ্বালানি খাতে ভূমিকা রাখা যায়।
৫. নগরে জোনভিত্তিক ছোটো আকারের পতিত স্থানে ডাম্পিং জোন গড়ে তোলা।
৬. সড়কে জ্যাম হ্রাস ও দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশ থেকে সাধারণ নগরবাসীকে বাঁচাতে দিনের পরিবর্তে রাতের বেলায় বর্জ্যের গাড়িতে বর্জ্য অপসারণ।
৭. সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্যে শহরের অভিজ্ঞ মানুষদের নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ নেয়া।
৮. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রিনক্লাব গড়ে তুলতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে ছোটো ছোটো কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এ-ব্যাপারে সচেতন হতে পারে।
৯. আবর্জনার উপর বায়োমাইনিং পদ্ধতিতে সবুজায়ন।
১০. পরিবেশ বিষয়ক সংগঠনগুলোর পরামর্শ গ্রহণ।

সুতরাং একটি পরিচ্ছন্ন শহর গড়ে তুলতে হলে বিশেষজ্ঞ টিমের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে এবং তাদের দেখানো পথেই হাঁটতে হবে। নয়তো শহরের দুর্গন্ধ আগের অবস্থায়ই থেকে যাবে। যেখানে ডাস্টবিন রয়েছে, সেখানে পর্যাপ্ত কীটনাশক এবং সুগন্ধি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিতে হবে। প্রতি সপ্তাহে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে। কর্তৃপক্ষ চাইলে এলাকায় এলাকায় ময়লা শোষণ করে এমন ডাস্টবিন ব্যবহার করতে পারে। এলাকার মোড়ে মোড়ে ময়লা ফেলে যেভাবে পরিবেশ ও জনজীবনের ক্ষতি করা হচ্ছে, সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মোড়ে মোড়ে ফেলা আবর্জনা বড়ো গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে রাস্তার পরিবেশ নষ্ট হওয়াসহ মারাত্মক দুর্গন্ধ ছড়ায়। তাই অতি দ্রুত কীভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে নগরবাসীকে অস্বস্তি থেকে মুক্তি এবং একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেয়া যায়, সেদিকে কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে।


বালাক রাসেল
সম্পাদক, dheki24.com

নরসিংদীতে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন

0

নরসিংদী জেলা কৃষক আন্দোলনের তীর্থভূমি। এখানে ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে অনেক বড়ো বড়ো কৃষক আন্দোলন হয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন জাতীয় এবং স্থানীয় নেতারা। তবে নরসিংদীতে সর্বপ্রথম কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলো কমিউনিস্ট পার্টি। তারপর ভাসানী ন্যাপ ও মোজাফ্ফর ন্যাপের কৃষক সংগঠনগুলো শক্ত অবস্থান তৈরি করে। তাদের কৃষক আন্দোলনের ফলে নরসিংদীতে অনেক কিংবদন্তীতুল্য কৃষকনেতার জন্ম হয়। এতো বিপুল পরিমাণ কৃষকনেতা অন্যত্র দেখা যায় না। একই সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ে সবচে’ বেশি কৃষক সম্মেলন হয়েছে নরসিংদী জেলায়। মূলত আন্দোলনকারী কৃষকনেতাদের মূল্যায়নের জন্যেই এখানে কেন্দ্রীয় সম্মেলন বেশি হয়েছে, যা ইতিহাসে স্থান করে আছে।

নরসিংদী জেলার সবচেয়ে আলোচিত কৃষক আন্দোলন ও দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছিলো রায়পুরা থানার রহিমাবাবদ ও আদিয়াবাদ গ্রামে। ব্রিটিশ আমলে অনুষ্ঠিত এ-ঘটনার পর জেলার বিভিন্ন স্থানে শক্তিশালী কৃষক সমিতি, কৃষক সভা কিংবা কৃষক সংগঠন গড়ে ওঠে। আন্দামান ফেরত বিপ্লবী সতীশ পাকড়াশী, জিতেন ঘোষ, হাতেম আলী খান, বিপ্লবী রহমান মাস্টার, কমরেড আবদুল হাই, শামসুল হক ভূঁইয়া ওরফে মাহতাব মাস্টার, ফয়েজ মাস্টার, অন্নদা পাল, তারা মাস্টার ও ফজলুল হক খোন্দকারের নেতৃত্বে কৃষকেরা সংগঠিত হয়ে নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, যার সাথে দেশের বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো সরাসরি জড়িত ছিলো। তাঁদের মধ্যে আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন অন্যতম। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৬৪ সালে রায়পুরা বাজারে (শ্রীরামপুর বাজার) কৃষক সম্মেলন হয়েছিলো। দুইদিনব্যাপী এ-সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন হাতেম আলী খান। প্রধান অতিথি ছিলেন মওলানা ভাসানী।

১৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় কৃষক সমিতির প্রতিনিধি সম্মেলন। এতে মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ থেকে ৫০ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে একটি জেলা কমিটি গঠন করা হয়। সভাপতি নির্বাচিত হন জিতেন ঘোষ। কার্যকরী সভাপতি নির্বাচিত হন কাজী জহিরুল হক। সহ-সভাপতি হন ফিরোজ আল মোজাহিদ। দ্বিতীয় সহ-সভাপতি আবদুল খালেক। তৃতীয় সহ-সভাপতি মানিক মিয়া। সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক। সহ-সম্পাদক আবদুল হাই ও হানিফ খান। সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, দপ্তর সম্পাদক নজরুল ইসলাম ও কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন ব্রজেন্দ্রনাথ সাহা। সদস্য হিসেবে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের নাম পাওয়া যায় না।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করে জানা যায়, রায়পুরা কৃষক সমিতির নেতৃবৃন্দ এই সম্মেলন সফল করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। শ্রীরামপুর বাজারটি ছিলো রায়পুরা থানার একটি বৃহৎ ও প্রাচীন হাট। দূর-দূরান্ত থেকে কৃষকেরা উক্ত হাটে এসে বেচাকেনা করতেন। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য ও হাট ইজারাদারদের খাজনা কমানোর জন্যে স্থানীয় কৃষকনেতারা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছিলেন। তাই ১৯৬৪ সালের কৃষক সম্মেলন তাদের কাছে উৎসব হিসেবে দেখা দেয়। জাতীয় কৃষকনেতাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে উক্ত হাটে কয়েকটি তোরণ সাজানো হয়েছিলো। এর মধ্যে প্রধান সড়কের প্রবেশপথে বড়ো করে একটি তোরণ নির্মাণ করে সেটার নামকরণ করা হয়েছিলো ‘বিপ্লবী রহমান মাস্টার তোরণ’।

প্রতিনিধি সম্মেলনের পরদিন, ১৬ এপ্রিল ১৯৬৪, শ্রীরামপুর বাজারে বিশাল জনসভা হয়। জনসভার মূল আকর্ষণ ছিলো মওলানা ভাসানীর ভাষণ। ভাষণে তিনি কালিশিয়ায় পুলিশী নির্যাতন ও নিত্য পণ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ করে বলেন, “আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, হাইকোর্টের ব্যারিস্টার, উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত কারো ভোটের অধিকার নেই। ভোটের অধিকার আছে কেবল মুষ্টিমেয় কতিপয় বুনিয়াদী গণতন্ত্রীর। জনগণ কখনোই অধিকারহীন অবস্থা মেনে নিবে না। সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানের জনগণ নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।”

তিনি আরো বলেন, “কায়দে আজম ও বড়লাট হওয়ার পর স্বীয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ পরিত্যাগ করে সবার প্রতি সমব্যবহারের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছিলেন। অথচ আজকে গভর্নর এবং অন্যান্য সরকারি কর্মচারীদের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার জন্য এমন অধিকার এবং উৎসাহ দান করা হচ্ছে, ব্রিটিশ আমলেও এর নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না।”

পাক-ভারত যুদ্ধ বিরতির পর ১৯৬৫ সালে রায়পুরার (বর্তমানে বেলাব উপজেলাধীন) আমলাব গ্রামে একটি কৃষক সমাবেশ হয়েছিলো। মূলত বেলাব বাজারে ইজারাদার বিরোধী আন্দোলনে সফলতা অর্জনের ঘটনার পরই আমলাব ইউনিয়নে এ-সভা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বাংলাদেশ কৃষক সমিতি উক্ত সভার শুরুতে তাদের জয়ের কথা সগর্বে ঘোষণা করে। আব্দুল হাসিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বেলাব বাজারে অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের চেষ্টা না করার ঘোষণা দেয়া হয়। ইজারাদার চেয়ারম্যান নিজ মুখে তা ঘোষণা দিয়ে কৃষক সমিতিতে যোগদান করেন। তিনি কৃষক সমিতির ৯ দফা মেনে নেন।

৯ দফার উল্লেখযোগ্য দফা
ক. ইউনিয়নের যেকোনো কাজ করার পূর্বে ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্য ছাড়াও প্রতি গ্রাম থেকে অন্তত তিনজন করে কৃষককর্মী নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
খ. কোনো সরকারি সাহায্য পাওয়া গেলেই জনগণকে তা অবহিত করতে হবে এবং উক্ত সাহায্য বণ্টনের ব্যাপারে ওয়ার্ডের মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্য ছাড়াও তিনজন কৃষককর্মীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
গ. যারা গরীব ও দিনমজুর, তাদের সবরকম খাজনা ও ট্যাক্স বাতিল করতে হবে।
ঘ. প্রতি বছর শেষে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনসভা করে বছরের সবরকম উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কার্যবিবরণী পেশ করবেন।

এখানে উল্লেখ্য, মৌলিক গণতন্ত্রী ছিলো মার্শাল আইয়ুব খানের প্রবর্তিত গ্রাম সংগঠন, গ্রাম সরকার বা গ্রাম পঞ্চায়েত ধরনের। দেশের অধিকাংশ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা মৌলিক গণতন্ত্রী ছিলেন।

আমলাব কৃষক সভায় পাকিস্তানের উপর ভারতীয় হামলার নিন্দা করা হয়। রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি করা হয় সমাবেশে। সমাবেশে জাতিসংঘ, মেন্টো ও সিয়াটো বর্জনের ডাক দেয়া হয়। বেলাব হাট ইজারাদার বিরোধী আন্দোলন নিয়ে ১৯৬৬ সালে ‘জনতা’ পত্রিকা একটি প্রতিবেদন পেশ করে। প্রতিবেদনটি নিম্নরূপ :

“রায়পুরার বেলাব বাজারের জনসাধারণ কিছুকাল ধরে হরতাল করে আসছিলেন ইজারাদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। ইজারাদারদের অত্যাচার, কৃষক জনসাধারণের খাজনা, ট্যাক্স, কৃষি ধান, কৃষি দ্রব্যের মূল্য, হাট বাজারে খাজনা তোলা প্রভৃতি বহুবিধ সমস্যার সমাধানের দাবীতে এ এলাকায় জনসাধারণ সুদীর্ঘ দেড়মাস যাবৎ হরতাল পালন করেন। এ সময় ধরে বেলাব হাট বন্ধ ছিল। এ ব্যাপারে কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাতেম আলী খান একটি বিবৃতি দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত হাট কর্তৃপক্ষ কৃষক সমিতির ন্যায্য দাবী মেনে নিয়েছিল। বাজার কমিটি এবং সাধারণ কৃষকদের পক্ষ থেকে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়। উক্ত লিখিত চুক্তিতে বলা হয়, অতঃপর বেলাব বাজারের ইজারাদাররা প্রত্যেক ভিন্ন ভিন্ন মহলের জন্য সরকার নির্ধারিত খাজনার চার্ট বোর্ড আকারে বাজারের গলিতে গলিতে টাঙিয়ে দেবে এবং ছাপা রশিদ দিয়ে খাজনা আদায় করবে। গৃহস্থের কাঁচামাল বিক্রয়ের উপর তোলা বা খাজনা ধরা হবে না। বাজারে যে কোন জিনিসের দালালী বাজার কমিটির নির্ধারিত হারে প্রচলিত থাকবে। বাজারের উপর থেকে যেকোন ধরনের চাঁদা বাজার কমিটি ব্যতিত আদায় করা যাবে না। যেকোন মহলের টাকা প্রতি এক আনা হারে খাজনা ধার্য্য ছিল, তার হার কমানোর জন্য বাজার কমিটি সরকারের প্রতি আবেদন জানাবে।”

এ-ধরনের চুক্তি তখন নজিরবিহীন ঘটনা। শুধুমাত্র কৃষকনেতা ও কৃষকদের জোরালো আন্দোলনেই সম্ভব হয়েছিলো। ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায়, ১৯৬৬ সালের ৩০ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক বর্ধিত সভা আহ্বান করে। হাজী মোহাম্মদ দানেশের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়, পরবর্তী ২৯ ও ৩০ মার্চ রায়পুরা থানার অন্তর্গত শিবপুরে (প্রকৃতপক্ষে স্থানটির নাম জংলী শিবপুর বাজার) প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। উক্ত বাজারটি কৃষিপণ্য তথা সবজির বাজার হিসেবে বিখ্যাত। সপ্তাহে শত শত ট্রাক সবজি বেচাকেনা হয়।

হাতেম আলী খান

কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে ১২ ও ১৩ এপ্রিল কৃষক সমিতির পঞ্চম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সমিতির সাধারণ সম্পাদক তার প্রতিবেদনে দেশের কৃষি ও কৃষকের সমস্যার সার্বিক দিক তুলে ধরে বলেন, “১৯৫১ সালের জমিদারী দখল আইনে জমিদারদের জন্য প্রচুর খেসারতের ব্যবস্থা করে এবং পরিবার প্রতি ১০০ বিঘা পর্যন্ত খাস জমি জমিদার জোতদার শ্রেণীর হাতে রাখার সুযোগ দিয়ে বাকি উদ্বৃত্ত জমি সরকারি দখলে আনার ব্যবস্থা করা হয়। তাছাড়া ঐ আইনে লুপ্ত প্রায় নানকার প্রথার অবসান করা হয় এবং ঠানুয়া খাজনার বদলে টাকার খাজনা চালু করার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে সবচেয়ে ব্যাপক যে সামন্তবাদী শোষণ প্রথা বর্গপ্রথা, তার আসান বা বর্গাচাষীর সামান্যতম তেভাগার দাবীও ঐ আইনে স্বীকৃত হয়নি।”

প্রতিবেদনে বলা হয়, “এ আইন কার্যকরী করার ক্ষেত্রেও তদানীন্তন মুসলিম লীগ সরকার টালবাহানা করেন। ১৯৫৫ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময় এবং পরবর্তীকালে ১৯৫৭-৫৮ সালে তা কার্যকরী করার ব্যবস্থা শুরু হয়। কিন্তু ঐ সময়ে পূর্ব পাকিস্তান জোতদার শ্রেণী বাধা প্রদানের ফলে তা সম্পূর্ণভাবে কার্যকরী করা যায়নি।”

সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে আরো বলা হয়, “আমাদের নিজস্ব কোন জমি নেই। যারা পরের জমিতে প্রজা হিসাবে চাষাবাদ করে, তাদের মধ্যে শতকরা ১৪ জনের জমির খাজনাই বা বর্গাজমির পরিমাণ আধা একরেরও কম। শতকরা ৬১ জনের জমির পরিমাণ ২.৫ একরের কম এবং শতকরা ৮৯ জনের জমির পরিমাণ ৫ একরের কম।”

প্রতিবেদনে বলা হয়, “জমিদারী আমলে ছোট ছোট খালবিল, জলমহাল ও নদী বন্দোবস্ত দেওয়া হতো না। সাধারণ মানুষ এগুলো ব্যবহার করতো। বর্তমানে এসব জমি সরকারের হাতে যাওয়ার পর তা সাধারণ মানুষের পরিবর্তে ইজারাদারদের কাছে বন্দোবস্ত দেওয়া হচ্ছে। সরকার হাটবাজারগুলো একইভাবে বন্দোবস্ত দেওয়ায় সাধারণ মানুষ ইজারাদার কর্তৃক শোষণ নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।”

জংলী শিবপুর বাজারে অনুষ্ঠিত কৃষক সমাবেশে সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, “বিগত কালের মধ্যে কৃষক সমিতির নেতৃত্বে যেসব আন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে আমলাব ইউনিয়ন কৃষক আন্দোলন ও বেলাব হাট ইজারাদার বিরোধী আন্দোলন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। উপরোক্ত দু’টি আন্দোলনেই রায়পুরা থানার কৃষক সমিতির নেতৃত্বে দলমত নির্বিশেষে সব কৃষককে এবং স্থানীয় এ রকম বিরাট সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল। এরূপ বিরাট সাফল্যের ফলেই সমগ্র এলাকা জুড়ে কৃষক সমিতির প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সাংগঠনিক শক্তিও বৃদ্ধি পেয়েছে।”

সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সাংগঠনিক শক্তির বিবরণ দিতে গিয়ে ১৬ টি জেলার সদস্য সংখ্যা তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে ময়মনসিংহ ৩০০০, বগুড়া ২০০, দিনাজপুর ২০০০, রংপুর ৫০০০, রাজশাহী ২০০০, খুলনা ৩০০০, যশোর ৩০০০, কুষ্টিয়া ২০০, বরিশাল ১০০০, ফরিদপুর ৩০০, ঢাকা ১০০০০, কুমিল্লা ১০০০, নোয়াখালী ২০০০, চট্টগ্রাম ২০০০, পাবনা ৬০০০ ও সিলেট ১০০০০।

পঞ্চম বার্ষিক সম্মেলনে ৪৫ সদস্য বিশিষ্ট কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিটি নিম্নরূপ :

সভাপতি
আবদুল হামিদ খান ভাসানী

সহ-সভাপতি
হাজী মোহাম্মদ দানেশ
মুন্সী মোদাচ্ছের আলী
অমূল্য লাহিড়ী
আলী সরদার খান
আলতাব আলী

সাধারণ সম্পাদক
হাতেম আলী খান

সহ-সাধারণ সম্পাদক
আবদুল হক
শামসুল হক

কোষাধ্যক্ষ
আহমেদুল কবীর মনু মিয়া

সাংগঠনিক সম্পাদক
জিতেন ঘোষ

জিতেন ঘোষ

জংলী শিবপুর হাটে অনুষ্ঠিত কৃষক সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, সেখানে কৃষক সমিতির ঘোষণাপত্রের চতুর্থ পৃষ্ঠার শেষ অনুচ্ছেদের পরিবর্তে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করা হয় :

“পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি হবে দলমত, সম্প্রদায়, ধর্ম, স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে পূর্ব পাকিস্তানের সব কৃষক শ্রেণীর একটি গণপ্রতিষ্ঠান। পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকদের এ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হবে এ প্রদেশের ভূমি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সামন্তবাদী শোষণ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ অবসান করে খোদ চাষীর হাতে জমি প্রদান এবং কৃষকদের উপর থেকে সাম্রাজ্যবাদী, ধনবাদী ও অন্যান্য সর্বপ্রকার শোষণের অবসান করে দেশে একটি গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সঠিক মুক্তি সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সম্ভবপর বলে কৃষক সমিতি মনে করে। উপরোক্ত উদ্দেশ্যগুলো হাসিল করার জন্য এ প্রতিষ্ঠান সব কৃষককে সংগঠিত করবে এবং শান্তিপূর্ণ প্রথায় আন্দোলন ও কর্ম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে।”

জংলী শিবপুর হাটে অনুষ্ঠিত পঞ্চম বার্ষিক সম্মেলন ছিলো তৎসময়ের সবচেয়ে বৃহৎ কৃষক সমাবেশ। স্থানীয় বাড়িঘর ছাড়াও হাজার হাজার অস্থায়ী শামিয়ানা ও তাবু তৈরি করে আগত অতিথি এবং কৃষকদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। তাদের খাওয়া-দাওয়ার জন্যে স্থানীয় কৃষকেরা স্বতস্ফূর্তভাবে ক্ষেতের শাক-সবজি ও চাল-ডাল প্রদান করেছিলেন।

সে-সময় কৃষক আন্দোলনে একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। ১৯৬৭ সালের ৫ মার্চ ঢাকা জেলা কৃষক সমিতির উদ্যোগে ঢাকায় এক বিশাল সমাবেশের ডাক দেয়। উক্ত সমাবেশে যোগ দেয়ার জন্যে নরসিংদী জেলায় রায়পুরা, বেলাব, শিবপুর, মনোহরদী, সদর থানা থেকে প্রায় এক লক্ষ কৃষকের বিরাট মিছিল ঢাকার দিকে রওনা দেয়। ৪ মার্চ রাতে মিছিলটি নরসিংদী-ঢাকা সড়কের বাবুরহাটের কাছে আসলে পুলিশ সেই মিছিলে এলোপাতাড়ি হামলা চালায়। লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস দিয়ে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে শত শত কৃষক আহত হয়। এ-ঘটনার পর কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাতেম আলী খান এক বিবৃতিতে বলেন, “পুলিশী হামলার নিন্দা করার ভাষা নেই। বর্তমানে দেশের মেহনতি মানুষ দুর্ভিক্ষাবস্থার সম্মুখীন। দেশের মানুষের উপর স্বৈরাচারী শাসনের অকথ্য জুলুম নেমে এসেছে।”

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন আসে। অনেকে ধারণা করেছিলেন, হয়তো দেশে সর্বদলীয় সরকার গঠিত হবে। কিন্তু বাস্তবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার গঠিত হয়। তখন কৃষক সমিতি অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলো। তখন কৃষকনেতারা নতুন করে কৃষক সমিতি গঠনের উপর গুরুত্ব দেন। সমিতি পুনর্গঠনের জন্যে কৃষকনেতা জিতেন ঘোষ, হাতেম আলী খান, ফজলুল হক খোন্দকার, শামসুল হক, অমূল্য লাহিড়ী, নূরুল ইসলাম, মহিউদ্দিন আহমেদ, আলতাব আলী, আজিজুল ইসলাম, আবদুস সামাদ, এবাদাত উল্লাহ, সুনীল রায়, নূর রহমান, মিয়া সিরাজুল হক ও মতিয়া চৌধুরী প্রমুখ এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ কৃষক সমিতির জাতীয় সম্মেলন আহ্বানের ঘোষণা করেন।

‘একতা’ পত্রিকা এ-সম্মেলন নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, “১৯৭২ সালের ২০, ২১ ও ২২ মার্চ তিনদিনব্যাপী সম্মেলন হবে রায়পুরা থানার বেলাব বাজারে। তখন বেলাব উপজেলা হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে এটাই প্রথম কৃষক সম্মেলন। এ সম্মেলন কৃষক সমাজের মধ্যে নতুন উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। এর মাধ্যমে এ সম্মেলনের জাতীয় রূপ ফুটে ওঠেছে। সারাদেশ থেকে ১০০০ প্রতিনিধি ও কাউন্সিলর এ সম্মেলনে অংশ নেবে। সম্মেলন উপলক্ষে কৃষক র‌্যালী, প্রচারের লিফলেট বিতরণ করা হবে। লক্ষাধিক কৃষক বেলাব সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মান প্রভৃতি সমাজতান্ত্রিক দেশের প্রতিনিধিদেরকে এ সম্মেলনে যোগদান করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।”

‘ঢাকা জেলার কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯৪৫ সালে নেত্রকোণায় নিখিল ভারত কৃষক সম্মেলনের পর সর্ববৃহৎ কৃষক সমাবেশ ছিলো বেলাব বাজারে। ১৯৭২ সালের ২০ মার্চ রাজশাহী বাদে দেশের প্রতিটি জেলার কাউন্সিলর ও ডেলিগেট যোগদান করেন। ভারত থেকে ভবানী সেনের নেতৃত্বে ৫ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দল বেলাব বাজারে উপস্থিত হন। পূর্ব জার্মান কৃষক দলের সভাপতি অনিস্ট উলফের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সেখানে আসেন।

সম্মেলনের শুরুতে হাতেম আলী খান, মণি সিংহ ও আবদুস সাত্তারকে নিয়ে সম্মেলন পরিচালনার জন্যে একটি সভাপতিমণ্ডলী গঠিত হয়। সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে কৃষক ও কৃষক সংগঠনের অবস্থা সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। বক্তারা সেই প্রতিবেদনের উপর আলোচনা করেন। ২১ মার্চ দুপুরে প্রতিনিধি সম্মেলন শেষ হয়। তখন গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিটি হলো :

সভাপতি
কমরেড মণি সিংহ

সহ-সভাপতি
আবদুস সাত্তার
জিতেন ঘোষ
কাজী মাওলানা মহতাব খান
নলিনী দাস
আলতাব আলী

সম্পাদক
হাতেম আলী খান

সহ-সম্পাদক
ফজলুল হক খোন্দকার
নূরু রহমান

সাংগঠনিক সম্পাদক
আবদুল মোমেন

প্রচার সম্পাদক
শহীদুল্লাহ বাহার

দপ্তর সম্পাদক
শফিকুর রহমান মিলন

কোষাধ্যক্ষ
ডা. মনীন্দ্রনাথ গোস্বামী

সদস্যবৃন্দ
আবদুস সালাম
খোকা রায়
পীর

হাবিবুর রহমান, মতিয়া চৌধুরী, জ্ঞান চক্রবর্ত্তী, নূরুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার, শামসুল হক, গুরুদাস তালুকদার, অমূল্য লাহিড়ী, আবদুল হাই, আজিজুর রহমান, মোকলেছুর রহমান, ডা. রবিউল হক, মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম, ডা. আব্দুল মালেক, আমিনুল ইসলাম বাদশা, মীর শহীদ মণ্ডল, আবদুল লতিফ, জিতেন দত্ত, সয়ের উদ্দিন, মো. মুসা, ধীরেন দাস, সাহেব উল্লাহ, মির্জা আবদুল হাই, আবদুস সামাদ, আবুল হাফেজ, তারা মিয়া, আবুল হাশেম, সন্তোষ ব্যানার্জী, আবদুস সবুর ও মোসলেম উদ্দিন।

বেলাব সম্মেলনে বিশাল জনসভা হয় ২২ মার্চ। বিভিন্ন স্থান থেকে মিছিলসহ প্রায় লক্ষাধিক কৃষক হাজির হয় সেখানে। পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে মঞ্চ, শামিয়ানা ও তাবু নির্মাণ করে সম্মেলনটি হয়েছিলো। সম্মেলনের একনিষ্ঠ কর্মী কৃষকনেতা বাবর আলী মাস্টার মৃত্যুর আগে আমাকে জানান, এ সম্মেলন বেলাবতে উৎসবে পরিণত হয়েছিলো। বাংলাদেশে এতো কৃষকের সমাবেশ আর হয়েছে কি না, তা জানা নেই। সম্মেলনটি সফল করার জন্যে কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিলো।

সম্মেলনে কৃষকের ভাগ্যোন্নয়ন, আর্থিক উন্নতি ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিলো। প্রস্তাবগুলো নিম্নরূপ :

১. একমাত্র কৃষকেরা জমির মালিক হবে। এ-নীতির ভিত্তিতে জমির মালিকানা নির্ধারণ করতে হবে।
২. মাথাপিছু ৫ বিঘা ও পরিবারপিছু ৫০ বিঘার বেশি জমি কেউ রাখতে পারবে না। এ-নিয়ম কার্যকর করার জন্যে আইন প্রণয়ন করতে হবে।
৩. জমির উচ্চসীমা নির্ধারণ করার ফলে যে-জমি পাওয়া যাবে, তা গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে বণ্টন করতে হবে।
৪. সরকারি খাসজমি গরীব ও ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে।
৫. জমি বণ্টনের পর কৃষকেরা যাতে সেই জমি চাষাবাদ করতে পারে, সে-ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে।
৬. কৃষকদের সমবায় প্রথায় চাষাবাদ করতে উৎসাহিত করতে হবে।
৭. বর্গাজমি থেকে বর্গাচাষিদের উচ্ছেদ বন্ধ করতে হবে। সেলামি আদায় বন্ধ করতে হবে।
৮. বর্গাচাষের সাধারণ নিয়ম হিসেবে আধির বদলে বর্গাচাষিকে দুই-তৃতীয়াংশ দেয়ার আইন করতে হবে। যদি জমির মালিক চাষের সমস্ত খরচ যথা হাল, বলদ, সার, বীজের খরচ বহন করে, তাহলে মালিক অর্ধেক পাবে।
৯. ক্ষেতমজুরদের বাঁচার মতো মজুরি দিতে হবে।
১০. তাদের কর্মসংস্থানের জন্যে গ্রামাঞ্চলে কল-কারখানা স্থাপন করতে হবে। ক্ষেতমজুরদের কাজের সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে। টেস্ট রিলিফের ব্যবস্থা করতে হবে।
১১. কর্মসংস্থানের কোনো স্থায়ী ব্যবস্থার পূর্বে ক্ষেতমজুরদের বেকার ভাতা দিতে হবে। সংশোধিত রেশনিংয়ের মাধ্যমে তাদের খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
১২. হাট ইজারা, জল ইজারা ও ঘাট ইজারা প্রথা বাতিল করতে হবে।

উক্ত সম্মেলনে জলমহাল বন্দোবস্ত নিয়ে বিশেষ প্রস্তাবনা গৃহীত হয়। তাছাড়া কৃষক সমিতি নিয়ে ভাসানী ন্যাপের নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করে বলা হয়, অতীতে মওলানা ভাসানী কৃষক আন্দোলন নিয়ে ব্যাপক কর্মসূচি দিতেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর সেটা দেখা যায় না। একই সঙ্গে আবদুল হকের মতো কৃষকনেতারা ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে চলে যাওয়ায় কৃষক আন্দোলনে অনেকটা ভাটা পড়ে। তাই এর অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্যে বেলাব সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। নরসিংদী জেলার মধ্যে প্রাদেশিক, ঢাকা জেলা ও থানাভিত্তিক অনেক কৃষক সমাবেশ বা সম্মেলন হয়েছে। এর কোনোটা তিনদিন, কোনোটা দুইদিন, আবার কোনোটা একদিনব্যাপী হয়েছে। এর মধ্যে রায়পুরার শ্রীরামপুর বাজার, রায়পুরার জংলী শিবপুর বাজার, বেলাবর আমলাব ইউনিয়ন এবং বেলাব বাজার সম্মেলন অন্যতম। বিভিন্ন কৃষকনেতা, রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং স্থানীয় সূত্র থেকে জানা যায়, এসব বড়ো বড়ো সম্মেলন ও সমাবেশ ছাড়াও নরসিংদীর কয়েকটি এলাকায় কিছু কৃষক সমাবেশ হয়েছিলো। তবে এসব সমাবেশের বিবরণ কিংবা তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। গবেষকেরাও এর বিবরণ লিখেননি। এ-বিষয়ে রায়পুরা-বেলাবর প্রধান কৃষকনেতা আবদুল খালেক মাস্টার (৮০) জানান, বার্ধক্যজনিত কারণে দিনক্ষণ ভুলে গেলেও স্মরণ হচ্ছে, ষাটের দশকে শিবপুরের নোয়াদিয়া গ্রামে কৃষক সমাবেশ হয়েছিলো। তৎসময় নোয়াদিয়া, খৈশাখালী ও পুটিয়া এলাকায় সফিউদ্দিন ওরফে সফি কেরানীর নেতৃত্বে শক্তিশালী কৃষক সমিতি গড়ে ওঠেছিলো। ১৯৬৪ সালে স্থানীয় দাঙ্গা ও পুটিয়া বাজারে ইজারাদার বিরোধী আন্দোলন সফল হওয়ায় সেখানে একটি কৃষক সমাবেশ হয়েছিলো। কিন্তু এ-সমাবেশ সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানা নেই। একইভাবে শিবপুর সমাবেশের কথা জানা গেলেও এর নির্দিষ্ট কোনো তথ্য-উপাত্ত কোথাও পাওয়া যায় না। তবে ১৯৬৮ সালে হাতিরদিয়ার হাট হরতাল আন্দোলন করতে গিয়ে ৪ জন শহীদ হওয়ায় সেখানে এক প্রতিবাদ সমাবেশে মওলানা ভাসানী বক্তব্য রেখেছিলেন।

১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে নরসিংদী শহরে কৃষক সমিতির দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন হয়। ১৮, ১৯ ও ২০ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় দ্বি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে সর্বত্র সাংগঠনিক তৎপরতা চালানো হয়। সম্মেলনকে সফল করার জন্যে থানা পর্যায়ে সভা-সমিতির সদস্যরা তৎপর হয়ে ওঠে। কিংবদন্তীতুল্য নেতা মণি সিংহ নরসিংদী মহকুমার বিভিন্ন স্থানে ভাষণ দিতে থাকেন। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে কৃষক সমিতি প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালাতে পারেনি, যার কারণে সমিতি অনেকটা নির্জীব হয়ে পড়েছিলো। তাই নেতৃবৃন্দ নরসিংদীতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনকে বেশ গুরুত্ব দেয়। সমিতির ভবিষ্যত এ-সম্মেলনের উপর নির্ভর করবে, এই মনোভাব নিয়ে তারা কাজ করতে থাকেন। ১৮ মে সম্মেলন শুরু হয় জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে। উত্তোলন করেন সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম। অপরদিকে সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করেন কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক খোন্দকার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ, মোহাম্মদ ফরহাদ, আওয়ামী লীগ নেত্রী বেগম সাজেদা চৌধুরী, চৌধুরী হারুনুর রশীদ, কৃষক লীগ নেতা রহমত আলী, ছাত্র ইউনিয়নের কাজী আকরাম হোসেন ও সম্মেলন অভ্যর্থনা উপ-পরিষদের আহ্বায়ক এম ইউ ভূঁইয়া।

সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি আবদুস সালাম। ৫ বছর পর অনুষ্ঠিত এই জাতীয় সম্মেলনে দুই শতাধিক প্রতিনিধি যোগদান করেন। সভায় বলা হয়, দেশ আজ চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছে। দেশের প্রায় ৭৮ লক্ষ মানুষ ঘরবাড়িহীন ছিন্নমূল, ৭০ লক্ষ লোক শিক্ষিত ও আধাশিক্ষিত বেকার। ১৯৭২ সালে যেখানে দেশে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ছিলো শতকরা ৩৭ জন, আজ সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৫ জনে। কৃষকদের শুধু সার, বীজ ও কীটনাশক ঔষধ সমস্যা নিয়ে লড়াই করলে চলবে না। সাথে সাথে পুরোনো রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে আমূল পরিবর্তনের পক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

সম্মেলনে মোহাম্মদ ফরহাদ বলেন, “বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার আট বছর পার হওয়ার পর আজো লাখ লাখ মানুষ অর্ধাহারে-অনাহারে ভুগছে। বর্তমান সরকার ধনিক শ্রেণীর সরকার। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে বিলাসদ্রব্য আমদানী করছে। অথচ কৃষি ব্যবস্থার উন্নতির জন্য কোন পর্যবেক্ষণ নেই সরকারের।”

বেগম সাজেদা চৌধুরী বলেন, “বঙ্গবন্ধু দেশের কৃষক সমাজকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। ২৫ বিঘা জমির খাজনা মওকুফ করেন এবং দেশের অগ্রগতির লক্ষ্যে জাতীয়করণ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কুচক্রীমহল বঙ্গবন্ধুর সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে দেয়নি।”

মতিয়া চৌধুরী বলেন, “দেশের দুর্ভিক্ষ শুধু আপতকালীন সমস্যা নয়। আধপেটা অনাহারী দিন যাপন করছে বছরের পর বছর এদেশের বেশিরভাগ কৃষক। আওয়ামী লীগ দলীয় জোতদার প্রতিনিধিদের চাপে বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭৪ সালে পরিবারের সংজ্ঞা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন, যার ফলে ১০০ বিঘা সিলিং-এর কার্যকারিতা ভণ্ডুল হয়ে যায়।”

তিনদিনব্যাপী এ-সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হলে তার উপর ৪০ জন আলোচনা করেন। তাছাড়া তারা গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। নেয়া হয় কিছু প্রস্তাব। শেষদিন ছিলো বিশাল সমাবেশ। সেই জনসমুদ্রে প্রস্তাবগুলো পাঠ করা হয়, গৃহীত প্রস্তাবগুলো হলো :

১. দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, পাবনা, জামালপুরসহ অন্যান্য দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজমান জেলাগুলোকে দুর্ভিক্ষ এলাকা ঘোষণা করা। দুর্ভিক্ষ এলাকায় অবিলম্বে সরকারি কর্মসূচি (কাজের বিনিময়ে খাদ্য), টেস্ট রিলিফ ও রিলিফের ব্যবস্থা করা। যেখানে কাজ দেওয়া সম্ভব নয়, সেখানে অবিলম্বে সরকার থেকে বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ করা এবং লঙ্গরখানা খোলা।
২. বাজারে চাল, গমের দাম যাতে বৃদ্ধি পেতে না পারে, তার জন্য সরকার থেকে মার্কেটিং অপারেশনের ব্যবস্থা করা।
৩. চালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি প্রতিরোধ করার জন্য মজুদ বিরোধী অভিযান পরিচালনা করা।
৪. গ্রামাঞ্চলে গরীব, ভূমিহীন ও ক্ষেতমজুরদের সন্তানদের নিয়মিত রেশন ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করা। শহরের ধনীদের রেশন বন্ধ করে দিয়ে গ্রাম ও শহরের গরীবদের পূর্ণ রেশন দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
৫. গরীবরা যাতে পরবর্তী ফসল করতে পারে, তার জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিঋণ, সার, বীজ ইত্যাদি সরকারের কাছ থেকে সরবরাহ করা। যাদের হাল নেই, তাদের হালের গরু ক্রয়ের জন্য সরকার থেকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য প্রদান করা।
৬. গরীব কৃষকদের যাতে অভাবের তাড়নায় জমি বা হালের গরু বিক্রি করতে না হয়, তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্য বা সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা।
৭. পরিবার প্রতি জমির সিলিং ১০০ বিঘার স্থলে দু’ফসলা জমি ৫০ বিঘা, এক ফসলা জমি ৭৫ বিঘা ধার্য্য করা। উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন ও গরীব কৃষকদের কাছে বিনামূল্যে বিতরণ করা।
৮. চরের জমি বিনামূল্যে স্থানীয় ভূমিহীন ও গরীব কৃষকদের মধ্যে সমবায়ে যোগদানের শর্তে বিলি-বণ্টন করা। উক্ত সমবায় সংস্থাকে সরকারিভাবে সর্বপ্রকার সাহায্য প্রদান করা।
৯. যেসব খাসজমি ধনীদের দখলে রয়েছে, তা ভূমিহীন ও গরীব কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে বন্দোবস্ত দেওয়া।

২০ মে সম্মেলনের শেষদিন নরসিংদী কলেজ মাঠে হাজার হাজার কৃষক, দিনমজুর, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ সমবেত হন। উক্ত জনসভায় সভাপতিত্ব করেন সফিউদ্দিন আহমেদ। বক্তব্য রাখেন প্রখ্যাত কমিউনিস্ট ও কৃষকনেতা মণি সিংহ, আবদুস সালাম, ফজলুল হক খোন্দকার, জিতেন দত্ত, গুরুদাস তালুকদার, অনিমা সিংহ, মতিয়া চৌধুরী, আবদুস সাত্তার ও নূহ-উল-আলম লেনিন। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে আবদুস সালাম ও ফজলুল হক খোন্দকার। তারপর তারা একটি যৌথ বিবৃতি দেন। ১৮-২৪ জুলাই কৃষকদের দাবি সপ্তাহ ঘোষণা দিয়ে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বলেন, “সরকারের এই ভ্রান্ত কৃষিনীতির কারণে দেশে খাদ্যসহ সার্বিক অর্থনীতি চরম সংকটে নিপতিত। সার, কীটনাশক, তেল-সাবানের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় পাম্প ও গভীর নলকূপের ভাড়া বহুগুণ বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে পাটসহ অন্যান্য অর্থকরী ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে কৃষকরা সবসময় বঞ্চিত হচ্ছে। রংপুরসহ দেশের কয়েকটি জেলায় দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে। এক মুঠো খাবারের আশায় তারা শহরে ভীড় জমাচ্ছে। তাদের দুর্দশার অন্ত নেই। এমতাবস্থায় কৃষককূলকে রক্ষার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। সংগঠনের কর্মী ও সমর্থকদের সমবেতভাবে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের লক্ষ্যে দাবি সপ্তাহকে সফল করার আহ্বান জানানো হলো।”

২৫ জুলাই কৃষক সমিতির নতুন কমিটির পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেই সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

১৯৭২ সালে নরসিংদীর শিবপুরে একটি ঐতিহাসিক কৃষক সম্মেলন হয়েছিলো। তৎকালীন কৃষকনেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে সেই কৃষক সম্মেলনে মওলানা ভাসানী দু’দিন দুটি জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন। সেখানে লক্ষাধিক কৃষক-জনতা উপস্থিত হয়েছিলেন। শুধু শিবপুর নয়, আশেপাশে জয়দেবপুর, মনোহরদী, রায়পুরা, ভৈরব, বেলাব, কিশোরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, রূপগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে দল বেঁধে কৃষক-জনতা সেখানে হাজির হয়েছিলো। সেটা স্মরণকালে বৃহৎ একটি কৃষক সম্মেলন ছিলো।

এই কৃষক আন্দোলনকে সফল করার জন্যে কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিলো। মওলানা ভাসানীর ‘হক কথা’ পত্রিকায় উক্ত সম্মেলন নিয়ে একাধিক সংবাদও প্রকাশ পায়। ১৯৭২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের সন্তোষে এক জরুরি সভায় মওলানা ভাসানীর আহ্বানে কৃষকনেতারা মিলিত হন। উক্ত সভায় শিবপুরে কৃষক সমিতির কমিটিগুলো পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যার প্রেক্ষিতে শিবপুরের কৃষকনেতারা শিবপুর থানা, ইউনিয়ন, এমনকি গ্রাম সমিতি পর্যন্ত পুনর্গঠন করেন। বাংলাদেশের আর কোথাও কৃষক সমিতির এতো ব্যাপক তৎপরতার ঘটনা জানা যায়নি।

২৯ ফেব্রুয়ারি চক্রধা ইউনিয়ন কৃষক সমিতির কর্মীরা শিবপুর বাজারে মিলিত হন। এতে সভাপতিত্ব করেন সামসুদ্দিন আহমদ। সভায় বক্তৃতা করেন কৃষকনেতা আবুল হারিছ রিকাবদার, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকার সভাপতি আবদুল মান্নান খান, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদ সদস্য তোফাজ্জল হোসেন প্রমুখ। সভায় এমদাদ হোসেন ভূঞাকে সভাপতি ও নায়েব আলী ফকিরকে সাধারণ সম্পাদক করে চক্রধা ইউনিয়ন কৃষক সমিতি গঠন করা হয়।

১ মার্চ ধানুয়া স্কুল মাঠে এক সভায় নূরুদ্দীন ভূঞাকে সভাপতি ও আবদুল বাতেনকে সাধারণ সম্পাদক করে মাছিমপুর ইউনিয়ন কমিটি গঠন করা হয়। সেখানে কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, আবুল হারিছ রিকাবদার, তোফাজ্জল হোসেন বক্তব্য রাখেন। ৬ মার্চ গঠিত হয় বাঘাব ইউনিয়ন কমিটি। সভাপতি নির্বাচিত হন ভিকচান ভূঁইয়া ও সাধারণ সম্পাদক হন আবদুল বাতেন গাজী। ৪ মার্চ গঠিত হয় দুলালপুর ইউনিয়ন কমিটি, সিরাজউদ্দিন আহমেদ সভাপতি ও নাসির উদ্দিনকে সাধারণ সম্পাদক করে। ৫ মার্চ হিজলিয়া গ্রামে এক কৃষকসভায় সিরাজ মিঞাকে সভাপতি ও ডা. মো. শফিউদ্দিনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। একই দিনে সকালে যোশর বাজারে আবদুর রহমানকে সভাপতি ও সিরাজুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি করা হয়।

এসব সভায় ১১ টি প্রস্তাবনা আনা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কৃষকদের ঋণ মওকুফ, মহাজনী ইজারাদারী ও সুদখুরী প্রথা বাতিল, শিবপুর ও যোশরে মরা নদী খনন, নরসিংদী থেকে চালাকচর, শিবপুর থেকে লাখপুর, চরসিন্দুর, যোশর ও বেলাব রাস্তাসহ অন্যান্য রাস্তা সংস্কার, শিক্ষকদের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ৯ মাস বকেয়া বেতন প্রদান, শহীদ আসাদ কলেজের সরকারি অনুদান বৃদ্ধি, চাল-ডাল-তেল-কাপড় প্রভৃতির উর্ধ্বমূল্য রোধ প্রভৃতি। উক্ত প্রস্তাবনাগুলোতে কেন্দ্রীয় কৃষকনেতা হিসেবে আবদুল মান্নান ভূঁইয়া স্বাক্ষর করেন।

২৯ ও ৩০ এপ্রিল স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম কৃষক সম্মেলন হয় শিবপুরে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মওলানা ভাসানী। দুইদিনব্যাপী সম্মেলনে তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দেন, একমাত্র বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রই নিপীড়িত-অত্যাচারিত কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। উক্ত সম্মেলনে ভারতের দুজন বিখ্যাত কৃষকনেতা অংশগ্রহণ করেছিলেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা মোজাফ্ফর আহমেদের একটি বাণী সম্মেলনে পাঠ করা হয়। তাছাড়া ভিয়েতনামের কৃষক মুক্তি কমিটি ও আফ্রো-এশীয় সোলিডারিটি সংস্থার কর্মকর্তারা উক্ত কৃষক সম্মেলনে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়ে সংহতি প্রকাশ করেন। শিবপুরের ঐতিহাসিক কৃষক সম্মেলনের পর মওলানা ভাসানীর ‘হক কথা’ পত্রিকায় ‘শিবপুর থেকে টঙ্গী’ শিরোনামে চার সংখ্যায় ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিলো। ১৯৭২ সালের ৩০ এপ্রিল প্রদত্ত ভাষণে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ডলার, রুবল, রুপেয়া দিয়ে বাঙলার মানুষকে চেনা যাবে না। ধর্ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই দেশে হিন্দু হলে, বৌদ্ধ হলে, খ্রিস্টান হলে তার ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা সরকারকে বহন করতে হবে। মানুষের নৈতিক উন্নতির জন্য, স্পিরিচুয়াল ডেভেলাপমেন্টের জন্য, আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য যে সমস্ত শিক্ষা অপরিহার্য, তার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে সরকারকে।

অবসরপ্রাপ্ত থানা শিক্ষা অফিসার ও বিশিষ্ট লেখক নূরুদ্দীন দরজী জানান, শিবপুর সম্মেলনের স্থানটি ছিলো শহীদ আসাদ কলেজ সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠ। অতীতে মাঠটি শিবপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছিলো। বর্তমানে ঈদগাহ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাংলাদেশ কৃষক সমিতি ‘শিবপুর সম্মেলন’ নিয়ে একটি বুকলেট প্রকাশ করেছিলো, যেখানে উক্ত সম্মেলনকে ‘পূর্বাঞ্চল সম্মেলন’ বলা হয়েছে। সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে বুকলেটে নাম ছাপা হয়েছে আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার। আহ্বায়ক হিসেবে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা ছাপা আকারে ২৯ ও ৩০ এপ্রিল সম্মেলনস্থলে বিলি করা হয়েছিলো।


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

পারুলিয়া মসজিদ : নরসিংদীর ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সম্প্রীতির শিকড়

0

নরসিংদী একটি প্রাচীন জনপদ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ভূ-ভাগে প্রথম জনবসতি হয় পাথরের যুগে। চার-পাঁচ সহস্র খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এ-এলাকায়ই নিজেদের উদ্ভাবিত লোহার কুড়াল দিয়ে বন-জঙ্গল কেটে কৃষির সূত্রপাত করেন। এ-লোহার উৎস ও ব্যবহার সংক্রান্ত কিঞ্চিৎ বর্ণনা নিচে লেখা আছে। উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কারের ফলে অনেক কিছুই এখন প্রমাণিত হচ্ছে। অনেক আগে থেকেই নরসিংদী শিল্পসমৃদ্ধ বাণিজ্য এলাকা। অনুমান করা যায় যে, নরসিংদী ছিলো তীরবর্তী অভ্যন্তরীণ ব্যস্ততম নদী বন্দর। আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও এ-বন্দরের গুরুত্ব অপরিসীম। তার কারণ এ-বন্দরের সাথে বাংলাদেশের বড়ো বড়ো শহরগুলোর যোগাযোগ ছিলো অত্যন্ত নিবিড়। প্রাচীন সমতটের রাজধানী রোহিতাগিরি (ময়নামতি) থেকে গোমতী ও ডাকাতিয়া নদীর স্রোত বেয়ে বণিকেরা আসতো বর্তমান বেলাব থানার উয়ারী-বটেশ্বর বন্দরে। সেখানে তারা বিভিন্ন পণ্য বেচা-কেনা করে আড়িয়াল খাঁ’র স্রোত ধরে চলে আসতো মেঘনার তীরে, নরসিংদী বন্দরে। নরসিংদী থেকে নদীপথে দক্ষিণে ২০ মাইল দূরে সোনারগাঁ, আর সেখান থেকে ভাটিয়াল স্রোত ধরে বণিকেরা যেতো বাকলা, চন্দ্রদ্বীপ ও সামন্দর বন্দরে। এ-বন্দর থেকে রপ্তানি হতো কার্পাস তুলা, মিহি চাল ও বিভিন্ন শস্য সামগ্রী। পরিবর্তে এখানে আমদানি করা হতো সম্ভার থেকে উৎকৃষ্ট মৃৎপাত্র, ময়নামতির মোটা শাড়ি, পুতির মালা ও কাঠের খড়ম। গোমতী (রংপুরের অন্তর্গত) ও ধামরাই থেকে তামা ও পিতলের তৈজসপত্র আর পুণ্ড্রনগর থেকে পোড়ামাটির বিগ্রহ। খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতকে বাণিজ্য উপলক্ষে ব্রহ্মপুত্র ও শীতলক্ষ্যার তীরে আরবীয়দের জাহাজ নোঙর করতো। আরবীয়রা এ-অঞ্চল হতে লাক্ষ্যা নির্মিত দ্রব্যাদি, মসলিন ও আখের গুড় ইউরোপীয় দেশসমূহে নিয়ে যেতো। শাতিল-লাকমা থেকে শীতলক্ষ্যা নামকরণ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কেননা সেকালে এ-জনপদ লাক্ষ্যা শিল্পের জন্যে প্রসিদ্ধ ছিলো।

প্রাচীনকালে এ-বন্দরের বিস্তৃতি ছিলো নদী তীরের উত্তর-দক্ষিণে প্রায় দেড়মাইলের মতো। এই বন্দরের প্রায় আড়াই মাইল পশ্চিম দিকে দক্ষিণমুখী প্রবাহিত হতো প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র নদ। পূর্ব দিক দিয়ে বন্দরের কূল ঘেঁষে উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত হতো বিশাল মেঘনা। রেনেলের তথ্য থেকে জানা যায়, সোনারগাঁয়ের সাত মাইল দূরে (উত্তর) নলদী থেকে নরসিংদী পর্যন্ত নদীটি (মেঘনা) সুপ্রশস্ত খরস্রোতা এবং দ্বীপবহুল। অনেক স্থানেই এর পরিসর আড়াই মাইলের বেশি। ব্রহ্মপুত্র থেকে উদ্ভূত হাড়িধোয়া নামক একটি শাখা নদী বন্দরের উত্তর দিক হতে প্রবাহিত হয়ে বন্দরের পূর্ব দিকে মেঘনার সাথে সংযুক্ত ছিলো। হাড়িধোয়া ও মেঘনার এ-সংযুক্তি এখনো বিদ্যমান। নরসিংদী শহরের পূর্ব প্রান্ত (বর্তমান থানারঘাট) থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার মাঝিয়ারা গ্রাম পর্যন্ত প্রায় সাত-আট মাইল বিস্তৃত ছিলো বিশাল মেঘনা নদী। প্রাচীনকালের ভূ-প্রকৃতির এই রূপ নরসিংদী শহরের আশেপাশের মরা নদী, খাল, বিল, জলাশয় ও পূর্ব দিকে চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ নিম্নভূমির দিকে তাকালে অতি সহজেই অনুমান করা যায়।

ইলিয়াছ শাহী বংশের পর হাবশী শাসনের যুগে বাংলাদেশে অনেক ছোটো-বড়ো জমিদারের উৎপত্তি হয়। হাবশী শাসনের শেষ পর্যায়ে সোনারগাঁ ভূখণ্ডের উত্তর-পশ্চিম শীতলক্ষ্যার তীরে ‘ধনপদ সিংহ’ নামে এক ব্যক্তি জমিদারি প্রতিষ্ঠা করে রাজা খেতাব গ্রহণ করেন। রাজা ধনপদ সিংহের পুত্র নরসিংহ জমিদারির সীমা বৃদ্ধি করেন। রাজা নরসিংহ শীতলক্ষ্যা নদীর তিন মাইল পূর্বে প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে নগর নরসিংহপুর নামে আবাসিক স্থান নির্মাণ করেন এবং প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে নগর প্রতিষ্ঠা করেন। মুঘল ভারতের সুবে বাংলার অন্যতম ছিলো ‘মহেশ্বরদী’ পরগণা। বর্তমান নরসিংদী জেলার সমগ্র অঞ্চলই ছিলো মহেশ্বরদী পরগণার অন্তর্ভুক্ত। এই পরগণার উত্তরে প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র, দক্ষিণে সোনারগাঁ আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদী ও ভাওয়াল পরগণা। পূর্ব দিকে মেঘনা নদী ও বরদাখাৎ পরগণা। এই পরগণার সদর দপ্তর ছিলো নগর মহেশ্বরদী। এই মহেশ্বরদী পরগণার ঠিক কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পারুলিয়া গ্রাম। পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ ও পরগণার সদর দপ্তর মহেশ্বরদীর সঙ্গে এ-গ্রামের যাতায়াত ও যোগাযোগ ছিলো অত্যন্ত সুগ্রথিত। স্থলপথে রাজধানী সোনারগাঁ থেকে একটি প্রশস্ত কাঁচা রাস্তা উত্তরমুখী সাতগাঁয়ের উপর দিয়ে পাঁচদোনা হয়ে পারুলিয়াকে সংযুক্ত করতো। প্রাচীন এ-রাস্তাটি পারুলিয়া থেকে উত্তরমুখী অগ্রসর হয়ে শিবপুর ছুঁয়ে নগর মহেশ্বরদীর উপর দিয়ে পরগণার শেষ উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছেছে। এখনো রাস্তাটি আছে। ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত পারুলিয়া ছিলো মহেশ্বরদী পরগণার সবচেয়ে বড়ো রাজস্ব আদায় কেন্দ্র ও প্রশাসনিক কাচারি। এখানে পরগণা প্রশাসকের একজন প্রতিনিধি বাস করতেন, যার উপাধি ছিলো নায়েব-ই-দেওয়ান। কোনো কোনো ঐতিহাসিক ‘নরসিংদী’ নামকরণের উৎস মনে করেন রাজা নরসিংহকে। কেউ মনে করেন খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর গুপ্ত বংশীয় রাজা নরসিংহ গুপ্তকে।

‘নরসিংদী’ নামকরণের কয়েকটি উৎস
‘পূর্ববঙ্গে মহেশ্বরদী’ গ্রন্থের মাধ্যমে জানা যায়, কোনো কোনো প্রাচীন মানচিত্রে নরসিংদীর নাম ‘নরসিংগড়’ লেখা হতো। শশীভূষণ মুখোপাধ্যায় প্রণীত স্কুলপাঠ্য বাঙ্গালা প্রেসিডেন্সির ম্যাপে এরূপ লেখা রয়েছে। যদিও এ-অঞ্চলের অনেকের ধারণা, এখানকার লোকজন সিংহের ন্যায় পরাক্রমশালী বলে নাম হয়েছে নরসিংহদী। নরসিংহ অর্থ পুরুষ সিংহ বা সিংহ পুরুষ। আবার কারো মতে, বিষ্ণুর নরসিংহ অবতার রূপ একটা মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেন রাজারা শহরের কোনো একটি মন্দিরে। সেই থেকে এ-জায়গার নাম হয়েছে নরসিংহদী। প্রথমে নরসিংহডিহি। সংস্কৃত ভাষায় ‘ডিহি’ মানে ডাঙা। আবার ডিহি বলা হয় কতিপয় গ্রাম বা মৌজার সমষ্টিকে। অর্থাৎ নরসিংহদী বলতে মনে করা হয় যেসব গ্রাম বা মৌজায় সিংহের মতো পুরুষ বাস করে। নরসিংদী মূলত একটি উঁচু স্থল এলাকা। এজন্যে নরসিংদীতে বহু এলাকার নামের শেষে ‘দী’ যুক্ত আছে। এক পর্যায়ে ‘ডিহি’ থেকে ‘দী’ হয়ে গেছে।

জাতীয় অধ্যাপক ও দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ একজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি নরসিংহ পাল নামের কথা বলেছেন। নরসিংদী নামকরণের পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। ইংরেজ কোম্পানির দেওয়ান ও গৌড়ীয় ব্রাহ্মণ ভিখনলাল ঠাকুর আঠারো শতকে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে বাস করতেন। তখন এলাকাটি ভিখনলাল ঠাকুরের বাজার নামে পরিচিত ছিলো। লোকশ্রুতি অনুযায়ী, এক সন্ন্যাসী একবার তাঁর বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। উক্ত সন্ন্যাসী ভিখনলালের আপ্যায়নে সন্তুষ্ট হয়ে ৪ টি লক্ষ্মী নারায়ণ, দুটি নরসিংহ শিলা এবং একটি দক্ষিণমুখী শঙ্খ দান করেন। ভিখনলাল ঠাকুর দুটি লক্ষ্মী নারায়ণ মূর্তি প্রতিষ্ঠার ফলে এলাকার নামকরণ ভিখনলাল ঠাকুরের বাজারের পরিবর্তে লক্ষ্মীবাজার হয়। আরেকটি নারায়ণ শিলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ গ্রামে। নারায়ণগঞ্জ নামের উৎপত্তি উক্ত নারায়ণ মূর্তি প্রতিষ্ঠার কারণেই। বাকি লক্ষ্মী নারায়ণ, নরসিংহ শিলাগুলো ইদ্রাকপুর, পঞ্চমীঘাট ও বিক্রমপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো বলে জানা যায়। এর মধ্যে লক্ষ্মী নারায়ণ শিলা ও শঙ্খ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস পরিষ্কারভাবে জানা গেলেও নরসিংহ মূর্তি দুটি কোথায়, কখন স্থাপিত হয়েছিলো, সেটা আজো সঠিকভাবে জানা যায়নি। সেক্ষেত্রে নরসিংহ মূর্তিটি নরসিংদীতে স্থাপিত হয়েছিলো এবং তা থেকেই নরসিংহ নামের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়।

আবার নগর নরসিংহপুর থেকেও নরসিংদী নামের উৎপত্তির সূত্র খোঁজেন কেউ কেউ। নগর নরসিংহপুরের পাশেই নরসিংহের চর নামে একটি গ্রাম রয়েছে। সুরেন্দ্র মোহন পঞ্চতীর্থের মতে, এ-এলাকায় নরসিংহ ভট্টাচার্য্য নামে একজন বসতি স্থাপন করেন। তার নাম অনুসারে হয়েছে নরসিংহের চর। নগর নরসিংহপুরের পাশে বেশ কয়েকটি চর সংযুক্ত গ্রাম রয়েছে। যেমন : ঢালুয়ারচর, সরকারচর, মাঝেরচর, বাড়ারচর, চরনগরদী। এছাড়া কাছাকাছি বেশ কিছু বিল এখনো রয়েছে। যেমন : সিংহের বিল, পৌদঘুরি বিল, শালধোয়ার বিল, কুড়াইতলী বিল ও বিভিন্ন জলাশয়।

সুরেন্দ্র মোহন পঞ্চতীর্থ নরসিংদীকে ‘নরসিংহগড়দী’ হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন। যেমন : চরনগরদী গ্রামকে বলা হয়েছে চন্দ্রগড়দী বলে। জিনারদীর প্রাচীন নাম দীনার দ্বীপ ছিলো বলেও তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। একসময় চন্দ্রগড়দীর নামও চন্দ্রগড় দ্বীপ ছিলো। পলাশ ও শিবপুরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া হাড়িধোয়া তালতলী বাজারের উত্তর কোণায় এবং নরসিংদী সদর উপজেলার রাজাদী-চিনিশপুর প্রান্তে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সাথে পলাশের চরনগরদী ও কালীবাজারের পাশে সংযুক্ত হয়। এ থেকে সহজেই প্রমাণিত হয়, এখানে একসময় নদী কেন্দ্রিক জীবনধারা ছিলো।

জনৈক ঐতিহাসিক লিখেছেন, রাজা নরসিংহের পুত্র রাজা ভগীরথ সিংহ, তাঁর পুত্র রাজা শ্রীধর সিংহ, তাঁর পুত্র রাজা কালিদাস সিংহ। তিনি হোসেনশাহী বংশের শাসনের শেষের দিকে স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সোলেমান খাঁ নাম গ্রহণ করেন এবং সোনারগাঁ অঞ্চলে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলাম শাহ সুরের সেনাপতি তাজ খান কররানীর সাথে যুদ্ধে তিনি নিহত হন। সোলেমান খাঁ’র দুই পুত্র ঈশা খাঁ ও ইসমাইল খাঁ।

অবশ্য ঈশা খাঁ’র পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে জানা যায়, “মুঘল যুগে ভারতের যুক্ত প্রদেশের বিভিন্ন জায়গাকে বায়সওয়ালা বলা হতো। ২২ টি পরগণার দু’হাজার বর্গমাইল এলাকা নিয়ে বায়সওয়ালা রাজ্যটির অবস্থান ছিল। এই বায়স রাজপুত বংশের রাজা ধনপদ সিংহ ছিল দিল্লীর সম্রাটের মিত্র রাজা। ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা ধনপদ সিংহের অধঃস্তন পুরুষ রাজা ভগীরথ সিংহের সাথে ঐ বংশের কালিদাস সিংহ সুলতান মাহমুদ শাহের রাজধানী গৌড়ে আসেন। তারা গৌড় তথা বাংলায় তীর্থ ভ্রমণ শেষে ভাগ্যান্বেষণে সুলতান মাহমুদ শাহের দরবারে হাজির হন। সুলতান কালিদাস সিংহকে সরকারের রাজস্ব বিভাগে চাকুরী দেন। নিজ যোগ্যতা আর পরিশ্রমের ফলে রাজস্ব উজিরের পদে অধিষ্ঠিত হন। কথিত আছে, কালিদাস ব্রাহ্মণদেরকে স্বর্ণ হস্তি দান করেন এবং ‘গজদানী’ উপাধি প্রাপ্ত হন। পরে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সোলায়মান খাঁ নাম ধারণ করেন। তিনি সৈয়দ বংশের শেষ শাসক সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের কন্যাকে বিয়ে করেন। শেরশাহের কাছে এই বংশের পতনের পর সোলায়মান খাঁ পূর্বে ময়মনসিংহ, ঢাকা জেলা, পশ্চিমে সিলেট ও ত্রিপুরা জেলার অংশ নিয়ে ভাটি অঞ্চলের রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন এবং সিংহাসনচ্যুত রাজপরিবারের অভিজাত ব্যক্তিদের সহযোগিতায় আফগান শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনিই এই বংশের প্রথম ব্যক্তি, যিনি অযোধ্যা থেকে বাংলায় এসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।”

ঈশা খাঁর পুত্র দেওয়ান মুসা খাঁ, তাঁর পুত্র দেওয়ান মাসুম খাঁ, তাঁর পুত্র দেওয়ান মনোয়ার খাঁ। দেওয়ান মনোয়ার খাঁর পাঁচ পুত্র ছিলো। তাঁদের একজন দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.)। মনোয়ার খাঁ’র জীবদ্দশায়ই তিনি মহেশ্বরদী পরগণার দেওয়ান নিযুক্ত হন এবং মহেশ্বরদীতে নিজের আবাসিক এলাকা গড়ে তুলে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। বর্তমান নরসিংদী জেলার শিবপুর থানার অন্তর্গত নগর মহেশ্বরদী গ্রামের শেষ প্রান্তে ‘গড়বাড়ী’ নামক স্থানটি ছিলো দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.)-এর আবাসিক এলাকা। এ-এলাকার চারপাশ ছিলো গভীর পরিখা ও উচ্চ মাটির প্রাচীরের বেষ্টনী দ্বারা সুরক্ষিত। এজন্যে স্থানটির নামকরণ হয় গড়বাড়ী। অবশ্য এই গড়বাড়ী নিয়ে মতবিরোধ আছে প্রচুর।

কেউ কেউ অনুমান করেন, এই গড়বাড়ী অনেক প্রাচীনকালে তৈরি। অবশ্য পক্ষে যুক্তি আছে যথেষ্ট। তবে গড়বাড়ী স্থানটি প্রাচীন হলেও পরবর্তী সময় দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.) এ-সুরক্ষিত স্থানেই নিজের আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছিলেন। গড়বাড়ী বেষ্টনী প্রাচীরের বাইরে একটি বৃহৎ জলাশয়, জলাশয়ের উত্তর তীরে একটি উচ্চ স্থানের নাম কারখানার ভিটা। এ-ভিটার মাটির নিচে রয়েছে অসংখ্য স্তূপীকৃত ইট। ভিটার বর্তমান মালিক সম্প্রতি মাটি খননের সময় উদ্ধার করেন কয়েকটি লৌহনির্মিত তলোয়ার ও বর্শাফলক। অনুমান করা হয় যে, কারখানার ভিটা ছিলো জমিদার ঈশা খাঁ ও তাঁর বংশধরদের একটি অস্ত্র তৈরির কারখানা। মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহৃত হাতিয়ারপত্রগুলো এই কারখানায় তৈরি হতো। এ-ধারণা অমূলক নয়, কারণ প্রাচীন গ্রন্থ ‘আইন-ই-আকবরী’তে আবুল ফজল লিখেছেন, ঢাকা থেকে উত্তর-পূর্ব কোণে ৩০ মাইল দূরে কোনো-এক স্থানে লোহা পাওয়া যায়। সে-স্থান থেকে সংগৃহিত লোহা দিয়ে বাংলায় নিয়োজিত মুঘল সৈন্যবাহিনির জন্যে হাতিয়ার তৈরি হতো। মহেশ্বরদী থেকে অনুমানিক দশ-পনেরো মাইল উত্তর-পশ্চিমে কাপাসিয়া থানার অন্তর্গত লোহাদী থেকে সংগৃহিত লোহাই ব্যবহার করা হতো কারখানায় হাতিয়ার তৈরির জন্যে। তিনদিকে ব্রহ্মপুত্র ও একদিকে খরস্রোতা শীতলক্ষ্যা নদী বেষ্টিত এবং বনারণ্যে ঢাকা নগর মহেশ্বরদী ছিলো বিদেশি শত্রুর জন্যে প্রাকৃতিকভাবেই দুর্ভেদ্য। নিরাপত্তাজনিত কারণেই এরকম সুরক্ষিত স্থান নির্ধারণ করা হতো অস্ত্র কারখানা তৈরির জন্যে। দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.)-এর পূর্বপুরুষগণ কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়িতে [কোনো বর্ণনায় ‘হযরতনগর’ আছে। তবে কিশোরগঞ্জে ঈশা খাঁ’র বংশবদ হযরতনগর রয়েছে। যার সাথে আত্মীয়তার সূত্রে সম্পর্ক রয়েছে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর প্রধান সেনাপতি সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরউদ্দীন (রহ.)-এর বংশবদদের] স্থায়ীভাবে বাস করলেও একমাত্র প্রশাসনিক সুবিধার জন্যেই তিনি মহেশ্বরদীতে বসবাস করতেন।

দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.)-এর স্ত্রী ছিলেন জনৈক নাসেরের কন্যা জয়নব বিবি। (আরেকটি বর্ণনামতে, ১৭১৭ সালে মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হন ও তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা বিবি জয়নবকে ঈশা খাঁ’র পঞ্চম অধস্তন পুরুষ দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.)-এর সাথে বিবাহ দেন এবং উপহার স্বরূপ মহেশ্বরদী পরগণার দেওয়ানী প্রদান করেন।) জয়নব বিবি অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ পরহেজগার মহিলা ছিলেন। দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.) সুফিদের সংস্পর্শে আসেন। ধীরে ধীরে আধ্যাত্মিকতায় নিমগ্ন হন ও এলমে মারেফাত অর্জন করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু এবং দয়ালু ও নীতিবান মুসলমান।

এদিকে অল্প সময়ে নরসিংহপুর (পারুলিয়া) এলাকায় তাঁর ভক্তবৃন্দ ও গুণগ্রাহীও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাঁদের অনুরোধে ভ্রাতুষ্পুুত্রের নিকট মহেশ্বরদী পরগণার দায়িত্বভার অর্পণ করে নিজে সস্ত্রীক পারুলিয়ার কাচারি বাড়িতে বাস করতে থাকেন। তাঁরা নৌকাযোগে এখানে এসেছিলেন। তাঁর নামানুসারে একসময় এটি ‘শরীফপুর’ হিসেবেও খ্যাত ছিলো। তখন এখানে পালতোলা নৌকা চলতো, যা দিয়ে মানুষ নদী পার হতো। স্থানটি শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্রের সাথে সংযোগ রক্ষা করতো। লোকজন প্রচণ্ড স্রোত পেরিয়ে এই নদ পার হতে পারলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলতো, “পার হইল/ পার হইলাম।” ‘পার হইল’ থেকে ‘পারৈল’, অতঃপর ‘পারুলিয়া’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। আরেকটি মত হলো, এককালে এখানে অসংখ্য পারুল গাছ ও পারুলের দ্বীপ ছিলো। তদানুসারে নাম হলো পারুলের দ্বীপ-পারুদিয়া-পারুলদ্যা-পারুল্যা-পারুলিয়া। সময়ের বিবর্তনে এলাকাটি ‘পারুলিয়া’ নামে খ্যাত হয়। আবার দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.)-এর মোজেজা এবং ইসলাম প্রসারের ভূমিকায় তাঁর নামের আগে আউলিয়া যুক্ত হয়। যার ফলে ‘পীর+আউলিয়া’ থেকে ‘পারুলিয়া’ নামটি অনন্য মর্যাদা পেয়েছে। পারুলিয়ার পাশেই একটি বাজার রয়েছে ‘সাধুর বাজার’ নামে। পূর্বকাল থেকেই এলাকাটি পীর-ফকির- দরবেশ-বাউল-সাধকদের উর্বর বিচরণভূমি ছিলো।

ঐতিহাসিক পারুলিয়া মসজিদ
দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.) ও জয়নব বিবি ১১২৬ হিজরি (জাতীয় তথ্য বাতায়ন), ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে (বিভিন্ন বর্ণনায় ১১২৮ হিজরি, ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দ, ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দ দেয়া আছে, যা অন্য হিসাবগুলোর সাথে মিলে না) মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন স্বরূপ তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদ নির্মাণে জয়নব বিবির বিশেষ ভূমিকা ছিলো বলে জানা যায়। ইরান, বাগদাদ ও ইয়েমেন থেকে কারিগর এনে মসজিদের নির্মাণ ও কারুকাজ করা হয়। এই মসজিদের সবুজ গম্বুজ দেখে মদিনার মসজিদে নববী এবং অলৌকিক মাহাত্ম্যের মসজিদে বনি হারামের কথা স্মরণ করেন অনেকে। ভারি ও মজবুত পাথরের খিলানের উপর তৈরি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট ৬০ ফুট দৈর্ঘ্যরে এ-মসজিদ মুঘল স্থাপত্যশৈলীর এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন। মসজিদটির অভ্যন্তরের দৈর্ঘ্য ১৮.২৯ মিটার, প্রস্থ ৫.১৮ মিটার এবং মসজিদের দেয়ালের পুরুত্ব ১.৫২ মিটার। দুটি ধনুক আকৃতির সমান্তরাল পথের মাধ্যমে মসজিদের অভ্যন্তরকে বর্গাকারভাবে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ভাগের উপরেই একটি করে গম্বুজ রয়েছে। প্রতিটি গম্বুজে নকশা ও অলঙ্কার খোদাই করা আছে। ব্যতিক্রম হিসেবে মসজিদের চারকোণায় অষ্টভুজ টাওয়ার রয়েছে, যেগুলোর প্রতিটির উচ্চতা কার্ণিশ পর্যন্ত। মসজিদটির মোট পাঁচটি ধনুক আকৃতির ফটকের মধ্যে পূর্ব দিকের দেয়ালে তিনটি, উত্তর ও দক্ষিণ দিকের দেয়ালে একটি ফটক রয়েছে।

মসজিদের ভেতরের অংশ

মসজিদের মাঝখানের ফটকটি অন্যান্য ফটকের চেয়ে বড়ো। মসজিদের মূল ফটকের বাইরের দিকটির উপরিভাগ অর্ধগম্বুজ আকৃতির ছাদের নিচে অবস্থিত, যেটি একটি আয়তাকার কাঠামোর উপর নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদের পশ্চিম দিকের দেয়ালে পূর্ব দিকের ফটকগুলো বরাবর তিনটি মিহরাব অবস্থিত। সবক’টি মিহরাব এবং ধনুক আকৃতির ফটকগুলো অলঙ্কারখচিত আয়তাকার কাঠামোর উপর নির্মাণ করা হয়েছে। মিহরাব এবং ফটকের উভয় দিকেই ধনুক আকৃতির কোটর রয়েছে। ফটকগুলোর বাইরের অংশে বর্গাকার এবং আয়তাকার নকশা রয়েছে। মসজিদের সামনে বর্গাকার আঙিনাটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রাচীরের পূর্ব দিকে একটি চমৎকার ফটক রয়েছে। মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে অবস্থিত দুটি পুকুর মসজিদ অঙ্গনকে ঠাণ্ডা রাখার পাশাপাশি মসজিদের সৌন্দর্য বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে।

পারুলিয়া মসজিদের সৌন্দর্য ও কারুকার্য আজো নরসিংদী তথা দেশের যেকোনো মসজিদ থেকে অনন্য। মূল প্রবেশ দরজার উপরিভাগে স্থাপিত পাথরের শিলালিপিতে ফারসি ভাষায় কবিতার ছন্দে লিপিবদ্ধ আছে মসজিদটির নির্মাণ ইতিহাস। স্মৃতিফলকে লেখা আছে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” কর্দে জয়নব বিনতে নাছের জজায়ে দেওয়ান শরীফ ও নির্মাণ সময়। ১৮৯৭ (কোনো বর্ণনায় ১৯০৪) সালের ভূমিকম্পে মসজিদটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৮৯ সালে এবং ২০১২ সালে মসজিদটি পুনরায় সংস্কার করা হয়।

১১২৮ হিজরিতে দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.) ইন্তেকাল করেন। তার একবছর পর ১১২৯ হিজরিতে জয়নব বিবিও ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.)-এর পাশে জয়নব বিবিকেও সমাহিত করা হয়। বর্তমানে স্থানটি দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.) ও জয়নব বিবির যুগল মাজার হিসেবে পরিচিত।

দেওয়ান শরীফ খাঁ ও জয়নব বিবির সমাধি এবং মাজার

প্রায় বিশ বিঘা জমির উপর মসজিদ ও মাজার অবস্থিত। একসময় তাঁদের ঘোড়া ছিলো। চারটি পুকুর এখনো রয়েছে। কাচারিঘর, রান্নাঘরসহ অন্য স্থাপনার তেমন কোনো অস্তিত্ব নেই। হুজরাখানার উত্তর দিকে নায়েব সাহেবের কাচারি ও বাসভবনের ধ্বংসাবশেষ আজকাল দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এখানে একসময় ছিলো সুরম্য অট্টালিকা। মাজারের পশ্চিম দিকে একটি প্রবেশ তোরণ ও সুরম্য দেয়ালের কিছু অংশ এবং একটি অতীব মূল্যবান কালো পাথর এখনো রয়েছে। কিছু স্বার্থান্বেষী লোক বাসভবনের ধ্বংসাবশেষ থেকে ইট-পাথর তুলে নিয়ে নিজেদের কাজে ব্যবহার করেছে আর আবাসিক এলাকাটি পরিণত করেছে ধানের জমিতে।

এই নিষ্কর জমির উত্তরাধিকারীদের মধ্যে স্বত্ব নিয়ে নরসিংদী জজ কোর্টে একটি মামলা রুজু হয়। বংশতালিকায় নরসিংহের নাম দেখে স্বভাবতই ধারণা করেন যে, রাজা নরসিংহের নাম থেকেই নরসিংহদী তথা নরসিংদী নামের উৎপত্তি হয়ে থাকবে। যদিও নরসিংদীর প্রাচীন নাম নিয়ে আজো ধোঁয়াশা কাটেনি। সেহেতু নরসিংদী নামের উৎপত্তি ও প্রকৃত ইতিহাস হয়তো এখনো অজানাই রয়ে গেছে।

আরেকটি মজার বিষয় আছে ঘোড়াশাল কেন্দ্রিক। দিল্লীর সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে সেই এলাকার টেকপাড়ায় শেখ গোলাম মোহাম্মদ নামে এক ক্ষমতাধর বিচক্ষণ ব্যক্তি বাস করতেন। দিল্লীর রাজদরবারেও তাঁর নাম সুপরিচিত ছিলো। ঐ-সময় দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.) শরীফপুরের জমিদার হয়েও স্বাধীন নরপতি ছিলেন। কর পাওয়া ব্যতিত জমিদারির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মুঘল সম্রাটের হস্তক্ষেপ করার তেমন নজির ছিলো না।

এখানকার এক ধুরন্ধর প্রজা দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.)-এর বিরুদ্ধে দিল্লীর রাজদরবারে এক গুরুতর অভিযোগ দায়ের করেন। সেই অভিযোগের বিচারকে কেন্দ্র করে জমিদার দেওয়ান শরীফ খান (রহ.)-এর সাথে দিল্লীর রাজদরবারের চরম বিরোধ দেখা দেয়। দিল্লীর সম্রাটের লিখিত ফরমানে শেখ মোহাম্মদ উক্ত বিবাদ নিষ্পত্তি করে দিল্লীর সম্রাটের সাথে দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.)-এর সন্ধি করে দেন। শেখ গোলাম মোহাম্মদের এ-কর্মতৎপরতা ও বিচক্ষণতায় সম্রাট আওরঙ্গজেব ও দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.) উভয়ই অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন। এ-কাজের পুরস্কার স্বরূপ সম্রাট আওরঙ্গজেব শেখ গোলাম মোহাম্মদকে একটি তেজি ঘোড়া ও মূল্যবান শাল উপহার দেন।

জমিদার দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.)-ও স্বীয় পালিত কন্যা চাঁদ বিবিকে শেখ গোলাম মোহাম্মদের দ্বিতীয় পুত্র শেখ গোলাম নবীর সহিত বিবাহ দেন। বিবাহের উপহার স্বরূপ চরপাড়া, টেকপাড়া, টেংগরপাড়া, বিনাটি, করতেতৈল, রাজাব ও চামরাব নামে ক্ষুদ্র পল্লীগুলো প্রদান করেন। সম্রাট প্রদত্ত ঘোড়া ও শাল দেখার জন্যে দলে দলে লোকজন শেখ গোলাম মোহাম্মদের বাড়িতে আসতো। আগন্তুকগণকে ‘কোথায় যাও’ প্রশ্ন করা হলে তারা বলতো, ঘোড়া এবং শাল দেখতে যাই। সেই থেকে শেখ গোলাম মোহাম্মদের বাসগ্রাম ও বিবাহের উপহার স্বরূপ প্রাপ্ত ক্ষুদ্র গ্রামগুলোর সমষ্টিই ‘ঘোড়াশাল’ নামে পরিচিত হতে থাকে এবং তাঁর পুত্র গোলাম নবীর সময় এলাকাটি ‘ঘোড়াশাল’ নামে অভিহিত হয়।

ঘোড়াশাল দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত অঞ্চল। এ-এলাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বসবাস। দেওয়ান শরীফ খাঁ (রহ.) জিনারদী তথা সেই এলাকার সবচেয়ে প্রাচীন জিনারদী কালী মন্দিরটি ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে ত্রিভূজ আকৃতির অনন্য নকশায় নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। সম্ভবত পারুলিয়া মসজিদ ও জিনারদী কালী মন্দিরের নির্মাণ একই সময়ে শুরু হয়েছিলো। তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নে পালনের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তিনি। তারই ধারাবাহিকতায় আজ অবধি অঞ্চলটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল নিদর্শন বজায় রেখে চলছে।

পারুলিয়া মসজিদ সম্পর্কে বহু মিথ প্রচলিত আছে। বলা হয়, মসজিদটি গায়েবিভাবে নির্মিত। লোকেদের বিশ্বাস, তখনকার সময় এই এলাকায় কোনো বিয়ে-শাদিসহ কোনো অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্যে যাবতীয় হাড়ি-পাতিল-বাসন- কোসন মসজিদের লাগোয়া পুকুর থেকে গায়েবিভাবে পাওয়া যেতো। ব্যবহারের পর আবার পুকুরে রেখে দিতে হতো। একবার এক মহিলা লবণের কৌটা চুলের বেণীতে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তিনদিন পর্যন্ত এটা ফেরত না দেয়ায় স্বপ্নে কঠোর পরিণতির বার্তা দেয়া হয়। এরপর তা ফেরত দিলে সেই যে গায়েবি জিনিসপত্র পানিতে মিশে যায়, তারপর থেকে কখনো আর অনুষ্ঠানের সামগ্রী এখানে পাওয়া যায় না। তাছাড়া এখানে একটি বিশেষ বৃক্ষ (বাঞ্জা/বাঞ্ছা) গাছ ছিলো, যার পাতা-ছাল খেলে মানুষের রোগ-বালাইসহ মনোবাঞ্ছা পূরণ হতো। যুগে যুগে এগুলো মানুষের মুখে মুখে জনশ্রুতি হয়ে আছে।

সম্ভবত নরসিংদী জেলা তথা সমগ্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বয়স্ক কাঠাল গাছগুলোর একটি মাজারের পাশে এখনো রয়েছে। পাশের পুকুরে একসময় বিরল প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতো। এখানে সব ধর্মের-বর্ণের মানুষ আসেন। প্রতি বছর ১৭ ফাল্গুন থেকে তিনদিনব্যাপী বাৎসরিক উরস মাহফিল হয়। কোনো-এক কারণে এ-বছর উরস মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়নি। তাছাড়া প্রতি বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক মাহফিল হয়। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে বহু ভক্ত ও দর্শনার্থী এখানে আসেন। এখানে আসাও খুব সহজ। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভেলানগর ও পাঁচদোনা এবং ঘোড়াশাল থেকে সিএনজি দিয়ে সহজেই এখানে আসা যায়। ট্রেনেও নরসিংদী কিংবা ঘোড়াশাল স্টেশন থেকে আসা যায় সহজেই।

আজো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐতিহ্যের অনন্য নিদর্শন হিসেবে পারুলিয়া মসজিদ ও মাজারটি কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাধ্যমে ঐতিহাসিক পারুলিয়া মসজিদ সংরক্ষণ, পুকুর সংস্কার, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ উন্নয়ন ও দৃষ্টিনন্দন করতে রাষ্ট্রের পরিকল্পিত ভূমিকা প্রয়োজন।


তথ্যসূত্র
১. নরসিংদীর নামকরণ নিয়ে বিতর্ক, আপেল মাহমুদ;
২. নরসিংদীর ইতিহাস-এতিহ্য, আব্দুর রশীদ;
৩. নবম পরশ নরসিংদী জেলা নির্দেশিকা, এম. এ. আসাদ ভূঞা সম্পাদিত;
৪. সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরউদ্দীন (রহ.), এস. এম. ইলিয়াছ;
৫. জাতীয় তথ্য বাতায়ন;
৬. উইকিপিডিয়া;
৭. ‘বিবিসি’সহ বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল;
৮. ঘোড়াশাল ভাস্কর্য;
৯. মাজারের প্রবীণ ভক্তবৃন্দ ও দর্শনার্থীর বক্তব্য।


মো. জাকারিয়া
কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক
গবেষণা কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা অফিস, নরসিংদী

আতাউর রহমান ভূঁইয়া : নীতিনিষ্ঠ এক রাজনীতিক ও শিক্ষকের ছবি

১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাস। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি এবং শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত নরসিংদীর ছাত্র-জনতা যখন উত্তেজিত, ঠিক সেই সময় মনোহরদী থানার হাতিরদিয়াতে একটি জনসভায় যোগ দেয়ার জন্যে রওনা হন মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবদুস সবুর খান, ওয়াহিদুজ্জামান এবং নারায়ণগঞ্জের ডিসি আ. ছাত্তার। তারা গাড়িযোগে নরসিংদীর বৌয়াকুড়ে বর্তমান ইনডেক্স প্লাজার সামনে পৌঁছালে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার একটি মিছিল তাদের গতি রোধ করে এবং তাদের গাড়ি ভাঙচুর করে। এরপর সারা নরসিংদীতে আইয়ুব খানের ফটো ভাঙা হয় একের পর এক। মন্ত্রীদের গাড়ি ভাঙচুরের পরপরই সারা নরসিংদী পুলিশে ছেয়ে যায়। এই ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন যে-কয়েকজন ছাত্রনেতা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন আতাউর রহমান ভূঁইয়া।

সেদিন নেতৃত্বে থাকা ছাত্ররা গ্রেফতার এড়িয়ে পালিয়ে গেলেও আতাউর রহমান ভূঁইয়া ও শামসুল হক ভূঁইয়াকে কলেজ থেকে ফোর্স টিসি দেয়া হয় এবং রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, নাজমুল হোসেন বাদল, শামসুল হুদা বাচ্চু ও আলী আকবরসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এর প্রতিবাদে পরবর্তী টানা সাতদিন কলেজে কোনো ছাত্র আসেনি। নরসিংদীর তৎকালীন জিন্নাহ পার্কে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী মঞ্চ) রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত মিটিং চলে। কাজী জাফরসহ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতারাও সেই মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। এই জনমত ও ছাত্র আন্দোলনের মুখে কলেজ প্রশাসন ১৫-১৬ দিন পর তাঁদের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।

নরসিংদী কলেজে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা ছিলো আতাউর রহমান ভূঁইয়ার সাহসিকতার আরেকটি নমুনা। কলেজ প্রশাসনের সাথে সম্পৃক্ত তৎকালীন প্রতিক্রিয়াশীল কুচক্রী মহলের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে কলেজ চত্বরে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন কর্তৃক স্থাপিত কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর উঠিয়ে উক্ত স্থানে ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিস্মারক শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করা হয় তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে।

প্রসঙ্গত, আতাউর রহমান ভূঁইয়া যখন নরসিংদী কলেজে পড়তেন, তখন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক ও পণ্ডিত দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। নানা কারণে তিনি অধ্যক্ষ মহোদয়ের প্রিয়পাত্রে পরিণত হন। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ আতাউর রহমানকে তাঁর সাথে শিক্ষক কোয়ার্টারের (তখন টিনের ঘর ছিলো, বর্তমানে কলেজ মাঠের পশ্চিমপাশে অবস্থিত) বারান্দার ঘরে থাকতে বলেন। আতাউর রহমানও রাজি হয়ে যান এবং থাকা শুরু করেন। সেই রুমে বসেই তিনি ’৬২-র শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের প্রতিবাদে উক্ত আন্দোলনের কর্মপরিকল্পনা করতে থাকেন। অধ্যক্ষ জনাব আজরফ তা কোনোভাবেই টের পাননি। তবে ঘটনার পর প্রশাসনের চাপেই তিনি দুজনকে ফোর্স টিসি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠনের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈরী আচরণ প্রকাশ পেতে থাকে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এই বিমাতাসুলভ আচরণের প্রথম বিরোধী অবস্থান। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের বিজয় বাঙালির নেতৃত্বের শক্ত খুঁটি স্থাপন করে দেয়। পঞ্চাশের দশকের এই দুটি আন্দোলন বাঙালির চেতনা জাগ্রত করেছিলো। তখন থেকেই বাংলাদেশের জনগণ চিন্তা-মননে, প্রথা-প্রতিষ্ঠানে এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে সজাগ হয়ে ওঠতে থাকে। ঠিক সেই সময়ই বেড়ে ওঠা আতাউর রহমান ভূঁইয়ার।

শাসকের তোষণের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা ও জনগণের দাবি আদায়ে রাজপথে তাণ্ডব চালানো এই রাজনীতিক ১৯৪০ সালের ১ ডিসেম্বর নরসিংদী জেলাধীন শিবপুর উপজেলার বৈলাব গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আবদুস সোবহান ভূঁইয়া এবং মা মেরী আক্তার। আতাউর রহমান ভূঁইয়া ১৯৫৬ সালে গাজীপুরের জয়দেবপুরের রাণী বিলাসমনি হাই স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন এবং জগন্নাথ কলেজে আইএ ক্লাশে ভর্তি হন। সেখানেই তাঁর রাজনীতির শুরু। গণ-মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়নের মিটিং-মিছিলে তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে তদানীন্তন পাকিস্তানের আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে। সরকারবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় তিনি গ্রেফতার হবার আশঙ্কায় পড়েন। সেই কারণে জগন্নাথ কলেজ পরিত্যাগ করে চলে আসেন নরসিংদী। ১৯৬০ সালে তিনি পুনরায় আইএ ক্লাশে ভর্তি হন নরসিংদী কলেজে। তখন কলেজের পরিবেশ আজকের মতো ছিলো না। উত্তরপাশের ভবনটাই শুধুমাত্র ছিলো। আর বর্তমান ছাত্রাবাসটি ছিলো টিনের।

নরসিংদী কলেজে ভর্তি হয়েই আবুল হাশিম মিয়ার সংস্পর্শে এসে তিনি ছাত্র ইউনিয়নকে সংগঠিত করার কাজে নেমে পড়েন। এর পূর্বে নরসিংদী কলেজের ছাত্ররাজনীতি এতোটা সুশৃঙ্খলভাবে চালিত হচ্ছিলো না। আতাউর রহমান ভূঁইয়া ছাত্র ইউনিয়নকে সুগঠিত করলে এবং পাশাপাশি ছাত্রলীগও সক্রিয়ভাবে মাঠে নামলে কলেজের ছাত্ররাজনীতি একটি আদর্শভিত্তিক অবস্থানে চলে আসে। তৎসময়ে আতাউর রহমানসহ অন্যান্য ছাত্রনেতারা মুসলিম লীগ ও ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের নজর এড়াতে মেঘনা পাড়ি দিয়ে করিমপুরে গিয়ে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা-পরিকল্পনা করতেন।

নরসিংদী কলেজে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা ছিলো আতাউর রহমান ভূঁইয়ার সাহসিকতার আরেকটি নমুনা। কলেজ প্রশাসনের সাথে সম্পৃক্ত তৎকালীন প্রতিক্রিয়াশীল কুচক্রী মহলের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে কলেজ চত্বরে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন কর্তৃক স্থাপিত কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর উঠিয়ে উক্ত স্থানে ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিস্মারক শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করা হয় তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। তখন ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হোসেন বাদল ও শামসুল হক ভূঁইয়া ছিলেন এই কাজে আতাউর রহমান ভূঁইয়ার অন্যতম সহযোগী। তখনকার মুসলিম লীগের জাঁদরেল নেতা রহমান ভূঁইয়া, তোফাজ্জল মৌলভী’র বিরুদ্ধে গিয়ে কলেজে শহীদ মিনার স্থাপন মোটেও সহজ কাজ ছিলো না। এসব কাজ করতে গিয়ে তিনি পাকিস্তানপন্থী দলগুলোর স্থানীয় নেতাকর্মী ও প্রশাসনের বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন।

এসব বাধা তাঁকে মোটেও দমাতে পারেনি। বরং ফুঁসিয়ে দিয়েছে বহুগুণে। রাজনৈতিক তৎপরতার ফলস্বরূপ ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, নরসিংদী জেলা শাখা’র সভাপতির দায়িত্ব পান আতাউর রহমান ভূঁইয়া। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট। এই রিপোর্টে ২ বছরের ডিগ্রি কোর্সকে ৩ বছরে রূপান্তরিত করাসহ পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা সংকোচনের প্রস্তাব করা হয়। কাজেই এই রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্ররা শিক্ষা দিবস পালন উপলক্ষে প্রদেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়। নরসিংদীর প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই হরতাল পুরোপুরিভাবে পালিত হয়। এ-দিন ঢাকায় ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে তিনজন নিহত হলে নরসিংদীতেও তার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ধর্মঘট পালিত হয়। ইতোমধ্যেই আইয়ুব খান নিজের ক্ষমতার পথ নিষ্কণ্টক করতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ আবুল মনসুর আহমদ, মনসুর আলী ও শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ করলে অন্যান্য স্থানের মতো নরসিংদীতেও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এসব আন্দোলনের সময় নরসিংদীর দত্তপাড়া ঈদগাহ ময়দানে এক জনসভা হয়। এতে আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী বক্তৃতা করেন। এ-সময়ের আন্দোলনে নেতৃত্বে ছিলেন আতাউর রহমান ভূঁইয়া, জানে আলম ভূঁইয়া, রিয়াজ উদ্দিন, সাখাওয়াত হোসেন মিয়া ওরফে ইয়ার মোহাম্মদ, শামসুল হক ভূঁইয়া, হাবিবুল্লাহ বাহার, নারায়ণচন্দ্র সাহা, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, আবদুল মান্নান খান, ফজলুর রহমান ফটিক মাস্টার, আপেল মাহমুদ, আলী আকবর, নাজমুল হোসেন বাদল প্রমুখ ছাত্রনেতা। মন্ত্রীদের গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়ে আতাউর রহমান ভূঁইয়া পালিয়ে চলে যান রায়পুরার শ্রীনিধিতে। সেখানে বন্ধু হুমায়ূনের বাড়িতে ৮-১০ দিন আত্মগোপনে থাকার পর সেখান থেকেও পালিয়ে যান।

১৯৬২ সালেই তিনি নরসিংদী কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। পাশ করার পর নরসিংদী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মোতাহের হোসেন ও ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা কাজী জাফরও এ-ব্যাপারে সহায়তা করেন। কিন্তু এখানকার রাজনৈতিক অবস্থা ও মানুষের উন্নয়নের জন্যে নরসিংদীর স্থানীয় প্রগতিশীল রাজনীতিকরা তাঁকে নরসিংদী কলেজেই পড়াশোনার নির্দেশ দেন। তিনিও রাজি হয়ে যান এবং নরসিংদী কলেজেই বিএ পাশকোর্সে ভর্তি হন। সেই সময়ই ১৯৬৫ সালে আইয়ুব খানের বিপক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা ফাতেমা জিন্নাহ’র পক্ষে নরসিংদী স্টেশনে হাজার হাজার মানুষের সামনে বক্তৃতা দিয়ে আলোচিত হন।

১৯৬৫ সালে তিনি বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড ডিগ্রি লাভ করেন।

তারপর আতাউর রহমান ভূঁইয়া আদর্শিক কারণে ও আবুল হাশিম মিয়া, জিতেন ঘোষ, জ্ঞান চক্রবর্তীসহ রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশ মোতাবেক মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। ব্রাহ্মন্দী স্কুলসহ বিভিন্ন বিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকার পর ১৯৬৬ সালে নরসিংদী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। এই পাইলট স্কুলে শিক্ষকতা করার সময়ই তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এ যোগদান করেন।

প্রসঙ্গত, ১৯৬৭ সালে ন্যাপ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পিকিংপন্থী মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এবং মস্কোপন্থী আবদুল ওয়ালীর নেতৃত্বে ন্যাপের দুইটি ধারা গঠিত হয়। ওয়ালী ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তান অংশের সভাপতি নির্বাচিত হন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। তখন থেকেই এ-অঞ্চলে মস্কোপন্থী এই দলটি ‘ন্যাপ (মোজাফফর)’ নামে পরিচিতি পেতে থাকে। পরবর্তীতে সচেতন ছাত্র ও প্রগতিশীল রাজনীতিকদের মধ্যে ন্যাপ (ভাসানী) ও ন্যাপ (মোজাফফর) জনপ্রিয় হতে থাকে। আতাউর রহমান ভূঁইয়া বৈষম্যহীন ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ন্যাপ (মোজাফফর)-কে বেছে নেন।

শিক্ষক থাকা অবস্থায়ই তিনি ’৬৬-র ছয়দফা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান আন্দোলনে নরসিংদীতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও ছিলো তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ। ৪ এপ্রিল নরসিংদী বাজারে পাকবাহিনির বোম্বিংয়ের পর তিনি নরসিংদী ছেড়ে চলে যান। শিবপুরে তাঁর গ্রামের বাড়িতে কিছুদিন আশ্রয়গ্রহণের পর বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে থাকেন এবং স্থানীয়ভাবে হাবিবুল্লাহ বাহারের নেতৃত্বে ট্রেনিং গ্রহণ করেন। ট্রেনিংয়ের প্রধান অস্ত্র ছিলো থ্রি নট থ্রি রাইফেল, এলএমজি, স্টেনগান ও হ্যান্ড গ্রেনেড। হাবিবুল্লাহ বাহারের এই বাহিনির অন্যান্য সদস্যের মধ্যে আবুল হাশিম মিয়া, তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র শহীদুল্লাহ বাহার, নূরুল ইসলাম গেন্দু, আজিজ আহমেদ খান, বি এ রশিদ, আলী আহমেদ, রফিকুল ইসলাম, মজিবর রহমান, সামছুল হক ভূঞা, বদরুজ্জামান বদু ভূঞা, গাজী শাহাবুদ্দিন, যূথিকা চ্যাটার্জী, কার্তিক চ্যাটার্জী, গোলাম মোস্তাফা মিয়া প্রমুখও ছিলেন।

এখানে আরেকটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। যুদ্ধকালীন নরসিংদী কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন আগরতলা মামলার আসামী কমান্ডার আবদুর রউফ। তাঁকে এই কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেবার পেছনেও রয়েছে আতাউর রহমান ভূঁইয়ার বিশেষ অবদান। এ-প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “তখন আমি অভিভাবক প্রতিনিধি হিসেবে কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য ছিলাম। আরো ছিলেন রফিক খন্দকার, আদম আলী মাস্টার। আমরা ছিলাম প্রগতির পক্ষে। বাকিরা প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষে। তৎকালীন এসডিও’র সাথে প্রায় ঝগড়া করেই আমরা রউফ সাহেবকে কলেজের দায়িত্বে আনার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করি। মিটিংয়ে এসডিও আমাদের প্রশ্ন করেছিলো, একজন ষড়যন্ত্র মামলার আসামিকে কেন আমরা কলেজের দায়িত্বে আনতে চাই? তখন আমরা বলি যে, আগরতলা মামলার আসামি বলেই আমরা তাঁকে এই কলেজের অধ্যক্ষ করতে চাই।”

স্বাধীন দেশে আবারো আতাউর রহমান ভূঁইয়া শিক্ষকতায় ফেরেন। প্রায় ১৯ বছর পাইলট স্কুলে শিক্ষকতার পর ১৯৮৩ সালে তিনি নরসিংদী উচ্চ বালিকা বিদ্যানিকেতনের প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং বিদ্যালয়টিকে একটি মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপ দেন। উক্ত প্রতিষ্ঠানে তিনি ছিলেন প্রায় ৬ বছর। এর মধ্যে ১৯৮০-৮১ শিক্ষাবর্ষে তিনি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও তিনি ন্যাপের পক্ষ থেকে সরাসরি অংশ নেন। এ-সময় সামরিক শক্তির নানা প্রলোভনেও তিনি তাঁর আদর্শ থেকে একচুলও নড়েননি। বরং ন্যায়নিষ্ঠ রাজনীতিক ও শিক্ষকের ভূমিকায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।

পরবর্তীতে চিনিশপুর ইউনিয়নের তখনকার চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিন ভূঁইয়ার অনুরোধে তিনি নরসিংদীর ঘোড়াদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এই স্কুলটিকেও তিনি যথারীতি শূন্য থেকে টেনে তোলেন। তাঁর সময়েই মূলত ঘোড়াদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় উন্নতির শিখরে আরোহণ করে। ২০০০ সালে অবসর গ্রহণের কথা থাকলেও তাঁর স্বীয় দক্ষতা ও বিচক্ষণতার কারণে বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদ তাঁর চাকুরির মেয়াদ ক্রমান্বয়ে ৫ (২+২+১) বছর বাড়িয়ে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। চাকুরির বর্ধিত সময়সীমা উত্তীর্ণ হবার পরও একান্তই বিদ্যালয়ের প্রয়োজনে আরো ২ বছর তিনি রেক্টর হিসেবে উক্ত বিদ্যালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। সবশেষে তিনি ২০০৭ সালে ঘোড়াদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় এবং শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসরগ্রহণ করেন।

দীর্ঘ এই শিক্ষকজীবনে তিনি বহু ছাত্রের জীবন গড়ে দিয়েছেন। সবচে’ পরিলক্ষিত যে-বিষয়টি, সেটি হলো তিনি শুধুমাত্র একটি বিদ্যালয়ে পাঠদান ও প্রশাসনিক কাজেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি, তার সাথে উক্ত এলাকার সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনেও ভূমিকা রেখেছেন। আর এ-কারণেই রাজনীতি ও দলীয় পরিচয়ের বাইরেও তিনি নিজের আরেকটি পরিচয় স্বতন্ত্রভাবে দাঁড় করাতে পেরেছেন এবং তা বেশ সাফল্যের সাথে। তাছাড়া শিক্ষক আন্দোলনের সাথেও ছিলো তাঁর সংযোগ। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, নরসিংদী জেলা শাখা’র সভাপতি ছিলেন দীর্ঘদিন।

আতাউর রহমান ভূঁইয়া ছাত্ররাজনীতিতে তুখোড় সময় পার করার পর নিজেকে একজন আদর্শ ও প্রগতিশীল শিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলার দিকেই মনোযোগ দিয়েছেন বেশি।  বৈষম্যমুক্ত-শোষণহীন ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের আন্দোলনে এখনো ভূমিকা পালনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর ভূমিকা অব্যাহত রয়েছে। এসব সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘নবধারা কণ্ঠশীলন অ্যাওয়ার্ড ২০১৪’ লাভ করেন।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ঐক্য ন্যাপের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন মানুষের মুখে এখনো শোনা যায়, আতাউর রহমান ভূঁইয়া যখন মাইক নিয়ে নরসিংদী বাজারে বের হতেন, তখন সকল দোকানদার-ব্যবসায়ীরা দোকানের দরোজায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন শুধুমাত্র তাঁর যৌক্তিক ও দাপুটে কণ্ঠস্বর শোনার জন্যে।

তাঁর সময়ের বহু রাজনীতিক যেখানে আদর্শ, ব্যক্তিত্ব এবং গণমানুষের মুক্তির স্বপ্ন বিকিয়ে দিয়ে ভোগ-দখলের রাজনীতির পালে মিশে গেছেন, সেখানে একজন আতাউর রহমান ভূঁইয়া মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের আদর্শ, ব্যক্তিত্ব, স্বপ্ন, সত্তাকে ভাঁজ হয়ে যাওয়া চামড়ার নিচে বয়ে বেড়িয়েছেন। আর এ-কারণেই তিনি সবসময় প্রাসঙ্গিক।

আগামীর প্রজন্ম তাঁকে যদি না চেনে, না জানে, তাহলে সত্যিকার অর্থেই আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেলবো নরসিংদীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের বাঁক-বদলের আলোকরেখা।

আতাউর রহমান ভূঁইয়া দুই পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা সুলতানা প্রায় ৪৪ বছর ব্রাহ্মন্দী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। বর্তমানে তিনি প্রয়াত। আতাউর রহমান ভূঁইয়া ২০২৪ সালের ২১ মে মৃত্যুবরণ করেন।


তথ্যসূত্র
১. নরসিংদী জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন;
২. ‘নবধারা কণ্ঠশীলন অ্যাওয়ার্ড ২০১৪ ও কৃতি শিক্ষার্থী সংবধর্না’ স্মরণিকা;
৩. ব্রহ্মপুত্র, ডিসেম্বর ২০২২ সংখ্যা এবং
৪. আতাউর রহমান ভূঁইয়ার সাক্ষাতকার।

আবদুল্লাহ আল মামুনের সাক্ষাতকার

0

আবদুল্লাহ আল মামুন। নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি’র সাবেক সভাপতি। বর্তমানে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশন (BTMA)-এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি নরসিংদীর স্বনামধন্য একজন শিল্প-উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত। গত ২৭ এপ্রিল ২০২৫ (রবিবার) তার সাথে বিস্তারিত কথা হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের সাম্প্রতিক হালচাল নিয়ে। সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেছেন সম্পাদক সুমন ইউসুফ।

আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য আসলে কীরকম চলতেছে এখন? নরসিংদীসহ সারা বাংলাদেশের? প্রশ্নটি করার কারণ হলো, সরকার পরিবর্তন হলো প্রায় নয় মাস হয়ে গেছে। বিগত সরকারের একধরনের পলিসি ছিলো, বর্তমান সরকার পলিসি পরিবর্তন করেছে কি না, করলে সেটা কীরকম? আপনার কী মনে হয়?

আবদুল্লাহ আল মামুন : দেখেন, বর্তমানে যে-ব্যবসায়িক পরিবেশ-প্রতিবেশ বিদ্যমান, এখানে ব্যাকরণগত যে-ব্যবসা হওয়া উচিত, সেটা হচ্ছে না। এখন ব্যবসায়ীরা আসলে ম্যানেজ করছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে যার যার ব্যবসাটা আমরা ম্যানেজ করছি। সেখানে নানা ধরনের অসঙ্গতি আছে। যেমন ধরেন, ব্যাংকিং সেক্টর, সেখানে ঋণের প্রাপ্যতা নিয়ে ব্যাপক সংকট আছে, ডলারের একটা সংকট আছে। তাছাড়া গ্যাসের একটা সংকট আছে, ইলেকট্রিসিটির সংকট আছে, শ্রমবাজারে সংকট আছে। আবার আন্তর্জাতিক বিশ্বে নানা ধরনের কনফ্লিক্ট আছে। তাই আমার মনে হয়, বাংলাদেশ একটা পরিবর্তিত পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে এটাকে সংজ্ঞায়িত করা একটু ডিফিকাল্ট হয়ে যাবে। তবে একটা বিষয় বলতে হবে যে, বিগত রেজিমের যে-অব্যবস্থাপনা ছিলো, অর্থনৈতিক সেক্টরে সেগুলোর রি-কনস্ট্রাকশনের একটা চেষ্টা চলছে। আমার মনে হয় যে, এই ধারাবাহিকতা যদি কিছুদিন চলে, তাহলে একটা স্থিতিশীল অবস্থায় আসবে ব্যবসা-বাণিজ্য, যেখান থেকে আমরা আসলে পরিকল্পনা করতে পারবো। এখনো আমরা বাংলাদেশের ইকোনোমিক গ্রোথের প্ল্যান করতে পারছি না। এখন আমরা সাসটেইন করছি, একটা জায়গায় যাবো বলে আশা করছি, সেখানে পৌঁছালেই আমরা প্ল্যান করতে পারবো। আশা করছি, এই বছরের শেষে আমরা এমন একটা জায়গায় পৌঁছে যাবো, যেখান থেকে আমরা গন্তব্য ঠিক করতে পারবো।

তাহলে আপনি মনে করছেন, বর্তমান সরকার আমাদের এমন একটা আশা বা সাফল্য দেখাচ্ছে?

আবদুল্লাহ আল মামুন : ইয়েস, আমরা আশান্বিত। কেননা, কিছু কিছু সেক্টরে চুরি বন্ধ হয়েছে। এটা একটা বড়ো প্রাপ্তি আমাদের। আপনি জানেন যে, একধরনের লুটপাট চলছিলো ব্যাংকিং সেক্টরে। এটা বন্ধ হয়েছে এবং এটা যদি স্থায়ী হয়, তাহলে আমাদের সম্পদ-সঞ্চিতি বাড়বে। সেখান থেকে আমাদের প্রান্তিক জনগণের কাছে আমাদের পুঁজি পৌঁছে যাবে বলে আমরা মনে করি। এটা সর্বজনবিদিত যে, বিগত সরকার উন্নয়নের নামে নানা ধরনের দুর্নীতির সাথে জড়িত হয়ে গিয়েছিলো। এবং এটি একটি-দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে না, জাতিগতভাবে সারা দেশের সকল পর্যায়ের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিলো। সবাই কোনো-না-কোনোভাবে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলো। এই জিনিসটা কাটঅফ হয়েছে। আশা করছি, আগামী দিনে একটা অবস্থান তৈরি হবে, যেখান থেকে আমরা নতুন করে শুরু করতে পারবো।

আগামীতে আবার নতুন দল বা গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসীন হবে, তখন কি এসব রক্ষা করা সম্ভব হবে? নাকি বর্তমান উপদেষ্টা সরকারকেই একটা পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের দিকে ধাবিত হতে হবে?

আবদুল্লাহ আল মামুন : এটা একটা আপেক্ষিক বিষয়। আগামী দিনে নতুন একটা সরকার আসবে, কারা আসবে, তারা ধরে রাখতে পারবে কি না, সেটা এই মুহূর্তে প্রেডিক্ট করাটা বড়ো কঠিন। তবে একটি কথা বলতে চাই, প্রত্যেকটা উন্নত দেশকে এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই কিন্তু যেতে হয়েছে। ইউএসএ, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান— যারাই উন্নত হয়েছে, তারা একদিনে সেই জায়গায় যায় নাই। তাদেরও কিন্তু আমাদের মতো এই টার্মোয়েল পার হয়েই যেতে হয়েছে। যুগের পর যুগ যুদ্ধ হয়েছে। তো এই ধরনের যুদ্ধ-বিগ্রহ-বিচ্যুতি পার করেই কিন্তু একটা দেশকে এগিয়ে যেতে হয়। আমার মনে হয়, রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেই সময়টা পার করছে। এসব রি-কনস্ট্রাকশনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটি দেশে রূপান্তরিত হবে।

আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতের একটা বৃহৎ সম্পর্ক ছিলো। এখন বর্তমান সরকার এবং জনগণের ভারতের প্রতি যে-বৈরী মনোভাব জন্মেছে, পাশাপাশি সরকারের পাকিস্তানের প্রতি একধরনের প্রীতি জন্মেছে, পাকিস্তানের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন ধারা উন্মুক্ত হচ্ছে, পণ্য আমদানি-রপ্তানির এই স্থানবদলের নিরিখে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন?

আবদুল্লাহ আল মামুন : ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন। আমি দেখেছি, যারাই এই প্রশ্নটি করে এবং যারা উত্তর দেয়, তারা একধরনের ইমোশন থেকে ব্যাপারটিকে ডিল করে। আমার স্টেটমেন্টটা একটু ভিন্ন। পৃথিবীর যেসব বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো আছে, ম্যাক্সিমামের সাথে তার প্রতিবেশি দেশের বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। যেমন রাশিয়া, রাশিয়ার বেশিরভাগ প্রতিবেশি দেশের সাথে তার সম্পর্ক ভালো না। আমেরকিার মতো সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশের সাথেও তার প্রতিবেশি দেশের বৈরী সম্পর্ক। এমকি চীনেরও তার প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট আছে। ইটস অ্যা ভেরি কমন ফেনোমেনা ইন গ্লোবাল ওয়ার্ল্ড। এটা চলবেই। সুতরাং প্রতিবেশি দেশের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন-অবনয়ন মেনে নিয়েই এগোতে হবে। আরেকটা বিষয়, ভারত একটা বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ভালো ছিলো। কিন্তু দেখতে হবে, সেই সম্পর্কের ফলে বেনিফিশিয়ারি কে ছিলো, এই বেনিফিশিয়ারি স্টেটমেন্টও আমাদের দেখা উচিত। সেই সাথে দেখতে হবে, ভারতের আশেপাশে অন্যান্য যেসব রাষ্ট্র রয়েছে, তারা কি ভারতের কাছ থেকে অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সুবিধা পেয়েছে? এই মূল্যায়ন করলে কিন্তু আমরা একটা ভিন্ন চিত্র দেখতে পাবো। এসব বিষয়ও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হলো, মূলত আমরা ভারতের ক্রেতা। আমরা মাত্র ১.৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করি ভারতে, আর ভারত ১২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে আমাদের দেশে। ফলে তাদের বেশি লয়াল থাকা উচিত আমাদের কাছে। তাদের এটা নিয়ে চিন্তা করার কথা। এটা স্বাভাবিক সেন্স থেকে বলা। তো এটা হচ্ছিলো না। এবং যেহেতু আমরা ক্রেতা, সেহেতু আমাদের জন্যে বিকল্প বের করা খুব কষ্টসাধ্য হবে না। তাছাড়া বর্তমান সরকার একটা রি-অ্যাক্টিভ ইনিশিয়েটিভ নিয়েছে, যেটা হলো আমাদের পরিত্যক্ত পোর্টগুলো চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা আমাদের বাণিজ্যের জন্যে নতুন দ্বার উন্মোচন করবে।

কিছুদিন আগে আমাদের এখানে বিনিয়োগ নিয়ে একটা বড়ো ধরনের সম্মেলন হয়েছে। আমাদের বর্তমান সরকার এটাকে অনেক প্রাধান্য দিচ্ছে। এই ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

আবদুল্লাহ আল মামুন : এটা একটা রেগুলার ইভেন্ট। এটা বিশেষ কোনো ইভেন্ট না। বাংলাদেশে এ-ধরনের ইভেন্ট বিগত দিনে আরো বহু হয়েছে। এর থেকে বড়ো পরিসরেও হয়েছে। বড়ো কথা হলো, এখনো আমরা বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে আলাদা করে উপস্থাপন করতে পারিনি। আমাদের যে-ইকোনোমিক সেক্টর, সোশ্যাল সিকিউরিটি, বিজনেস ইনডেক্স— এসবে আমরা খুব বেশি উন্নতি করতে পারিনি। আমরা যে মানুষকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি আমাদের দেশে ইনভেস্ট করতে, আমরা কি প্রস্তুত? আমার কি সেই আয়োজনটা আছে? সুতরাং আমি মনে করি, এই বিষয়টাকে এতো গুরুত্ব দিয়ে দেখার কিছু নেই, আবার গুরুত্বহীন করে দেখারও কিছু নেই। কিন্তু এতো এতো বিশৃঙ্খলার মধ্যে যে ইন্টেরিম গভর্নমেন্ট এই ধারাবাহিকতাটা রক্ষা করেছে, সেজন্যে আমি তাদের বিশেষ ধন্যবাদ জানাতে চাই।

আপনি বিটিএমএ-র বর্তমান পরিচালক, আগে সহ-সভাপতি ছিলেন। অর্থাৎ টেক্সটাইল সংক্রান্ত কর্মতৎপরতার ভেতর আছেন। কিন্তু গত প্রায় দেড় দশক ধরে সুতার বাজার অস্থিরতার ভেতর আছে। আমাদের নরসিংদী, মাধবদী, শেখেরচর, নারায়ণগঞ্জ এই গোটা জোনটাই একদম সুতার উপর নির্ভরশীল। সুতা ছাড়া এখানকার সবই অচল। কিন্তু এই সংকটের আসলে নিরসন হচ্ছে না কেন? বড়ো ধরনের সিন্ডিকেট কি জড়িত? সরকার এখানে নজর দেয় না কেন?

আবদুল্লাহ আল মামুন : দেখেন, এটার জন্যে একটু মূলে যাওয়া দরকার। সুতা উৎপাদনের যে-প্রক্রিয়া, অর্থাৎ সুতার ফ্যাক্টরি করতে একটা লার্জ এমাউন্টের ইভেস্টমেন্ট প্রয়োজন। ফলে বিগত দুই যুগ আগেও আমাদের উদ্যোক্তাদের সেই সক্ষমতা ছিলো না। এমনকি ব্যাংকেরও ছিলো না। তারও আগে আমাদের দেশে তিন-চারটা পাকিস্তানি ফ্যাক্টরি ছিলো। মূলত আমাদের আমদানি করতে হতো। তবে আশার কথা হলো এই, গত দুই দশকে আমাদের স্থানীয় বাজারে বেশ কিছু সুতার মিল স্থাপিত হয়েছে। ফলে সুতার প্রাপ্যতা থেকে শুরু করে মূল্য নির্ধারণ পর্যন্ত আগের অব্যবস্থাপনাটা কমে এসেছে। আমি বলবো না যে, নাই হয়ে গেছে সংকট। আপনি তো শুধু সুতার কথাটা বললেন, বাংলাদেশে এমন কোনো কমোডিটি আছে, চাল-ডাল-তেল-পেঁয়াজ-নুন-কেরোসিন-পেট্রোল-ডিজেল, যেখানে অস্থিরতা নাই? সেই সাথে সুতাও কিন্তু আমাদের একটা কমোডিটি। আমাদের যাপিত জীবনে বস্ত্র নিত্য-নৈমিত্তিক একটা অনুষঙ্গ। ফলে এখানেও অস্থিরতা আছে। আমি মনে করি, আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অস্থিরতা অনেকটা কমে গেছে। আশা করছি, আগামী দিনে বাংলাদেশের যদি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ঠিক হয়, তাহলে এসব আরো সহনীয় মাত্রায় চলে আসবে। আপনি খেয়াল করেন, গত তিন বছরে গ্যাসের দাম তিনশো গুণ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু আমাদের উৎপাদিত দ্রব্যের দাম কিন্তু আমরা এতোটা বাড়াতে পারিনি। বিগত সরকারের আমলে চিনি, সয়াবিন তেলসহ এরকম আরো কিছু পণ্যে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো হতো। সেক্ষেত্রে দেখা যেতো, দুয়েকটা বড়ো কোম্পানি সেসব পণ্য আমদানির সাথে জড়িত ছিলো। সকল পণ্যের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব নয়। আরেকটা বিষয়, আগে যেটা হতো, তিন-চারজন উৎপাদক বা আমদানিকারক মিলে সিন্ডিকেট করতে পারতো, কেননা কেবলমাত্র সেই তিনজন বা চারজনই সুতার উৎপাদক বা আমদানিকারক ছিলো। এখন আর সেটা সম্ভব নয়। সারা দেশে কমপক্ষে পাঁচ হাজারের উপর সাপ্লায়ার আছে, দেড় হাজারের বেশি সুতার মিল রয়েছে। সুতরাং দেড় হাজার মিল মালিক একসাথে সিন্ডিকেট করবে, এটা সম্ভব না।

তাহলে কারা মূল্য বৃদ্ধি করছে?

আবদুল্লাহ আল মামুন : আমি এবং আপনি ক্রেতা-বিক্রেতা, আমরা মূল্য নির্ধারণ করি না। অর্থনীতির ভাষায়, চাহিদা এবং যোগানের ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারিত হয়।

আপনি থিওরিটিক্যালি একদম  সরলভাবে বিষয়টাকে ডিল করলেন। কিন্তু এখানে একটা বিরাট নৈরাজ্য চলছে। আপনি জানেন, টেক্সটাইল শিল্পের বহু লোক ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হইছে। সুতার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, সকালে যেই রেটটা ছিলো, বিকেলেই হয়তো পাঁচ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে, এরকম সময়ও গিয়েছে। পরেরদিন আবার হয়তো দশ টাকা বেড়ে গেছে। এখনো এমন হচ্ছে। এটা একধরনের নৈরাজ্য বলে আমি মনে করি। এই ব্যাপারগুলো প্রপারলি ডিল হচ্ছে না কেন?

আবদুল্লাহ আল মামুন : আমি কিন্তু আগেই বলেছি যে, সুতার বাজারের অস্থিরতা কমে নাই। আপনি যদি স্ট্যাটিস্টিক্স দেখেন, দেখবেন, গত পাঁচ বছরে সুতার দাম, ধরেন ১০০ টাকার সুতার দাম ১০% রেঞ্জে ৯০ টাকা থেকে ১১০ টাকার মধ্যে উঠা-নামা করেছে। আরেকটা বিষয় মানতে হবে, সুতার বাজার নির্ভর করে তুলার বাজারের উপরে। তুলা কিন্তু আমাদের এখানে উৎপাদিত হয় না। ফলে তুলা আমদানি করে উৎপাদন খরচ এবং শ্রমমজুরি দিয়ে মিল মালিকদের তেমন কিছু করার থাকে না। আমি সরাসরি সুতা উৎপাদনের সাথে যুক্ত না থাকলেও তাদের গল্পগুলো জানি। আবার ব্যাংকের ইন্টারেস্ট রেট ৯% থেকে বেড়ে ১৫% হয়েছে। সুতার বাজারের অস্থিরতা অবশ্যই কমানো দরকার। তবে সবগুলো বিষয় মাথায় নিয়ে সেটা করতে হবে। আমি প্রস্তাব করেছিলাম, সুতার গায়ে যেন দাম লেখা থাকে, ফ্যাক্টরির নাম, উৎপাদন তারিখ দেয়া থাকে— এভাবে সবার কথা বিবেচনায় রেখে ব্যবস্থাটা করা উচিত। আমার শেষ কথা হলো, বিগত দিনের তুলনায় এখন অস্থিরতা অনেক কমেছে। সেটা আরো কমানো যাবে। এক্ষেত্রে কিছু বিধিমালা প্রণয়ন এবং তার সরাসরি প্রয়োগ ঘটাতে হবে।

আচ্ছা, শেষ প্রশ্নে যেতে চাই। সেটা হলো, নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিতে তিন মেয়াদে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন আপনি। আপনি নরসিংদী চেম্বারের একজন একনিষ্ঠ শুভাকাঙ্ক্ষী এবং দক্ষ সংগঠক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তো এবার চেম্বারের পরিচালনা পরিষদের যে-বডি গঠিত হলো, সেখানে স্মরণকালের সবচে’ বেশি রাজনৈতিক প্রভাব দেখা গেছে বলে সকলেই মনে করছেন। সেই সাথে চতুর্দিকে একটা নির্বাচনী আমেজ ছিলো। আপনিও নির্বাচনী তৎপরতার ভেতর ছিলেন বলেই জানতাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়নি। সব কিছু মিলিয়ে চেম্বার কি নরসিংদীর ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যে ইতিবাচক জায়গায় দাঁড়াতে পারলো? আপনার পর্যবেক্ষণ কী এই বিষয়ে?

আবদুল্লাহ আল মামুন : এই বিষয়ে আমার বক্তব্য দেয়াটা একটু বিব্রতকর। একটা বিষয় আপনি জানেন যে, আমি নরসিংদী চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট ছিলাম আরো প্রায় ছয়-সাত বছর আগে। আবার আমি টেক্সটাইল এসোসিয়েশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলাম, এখন ডিরেক্টর হিসেবে আছি। সেই বাস্তবতায়, সেখান থেকে ফিরে এসে নরসিংদী চেম্বারের দায়িত্ব নেয়ার সুযোগ আমার ছিলো না। এবং আমার ইচ্ছাও ছিলো না। কিন্তু নরসিংদীর সাধারণ ব্যবসায়ী এবং ব্যক্তিগতভাবে অনেকে আমাকে চেম্বারের দায়িত্ব নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারা চাইছিলো, বর্তমান পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমি যেন ইন্টেরিম হিসেবে হলেও দায়িত্বটা নিই। ফলে আলোচনাটা ছিলো। এটা নিয়ে আমি খুব দোদুল্যমান ছিলাম। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। কিন্তু এসবের ভেতর দিয়ে যেটা ঘটে গেলো, সেটা আমিও দেখেছি, আপনারাও দেখেছেন। তাই এই বিষয়ে এর বেশি বলাটাকে আমি আমার জন্যে বিব্রতকর মনে করছি। তবে আমি মনে করি, নরসিংদী বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের তীর্থস্থান। সুতরাং এখানে যারাই চেম্বার অব কমার্সের দায়িত্ব নেবে, তাদের আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। পাশাপাশি তাদের একটা সাকসেস স্টোরি থাকতে হবে, ব্যবসায়িক এবং ব্যক্তিগত জীবনে। দ্যান তারা একটা এসোসিয়েশনকে সাকসেসফুল করতে পারবে।

এটা কি আছে তাদের?

আবদুল্লাহ আল মামুন : সেটা আপনারা বিবেচনা করবেন, নরসিংদীর ব্যবসায়ীরা বিবেচনা করবে। সবচে’ বড়ো বিষয় হলো, ব্যবসায়ীদের যারা নেতা, তাদের সর্বপ্রথম ক্রাইটেরিয়াই তো তাদের ভালো ব্যবসায়ী হতে হবে। তারা সাকসেসফুল বিজনেসম্যান কি না, এটাও তো দেখার বিষয়। আমি মনে করি, আমি যদি আমার ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক জীবনে সফল হতে না পারি, আমার কোনো ব্যবসায়িক পরিকল্পনা যদি সফল না হয়, আমার যদি কোনো ভিশন না থাকে, তাহলে আমি সারা জেলার ব্যবসায়ীদের দায়িত্ব নেবো কীভাবে?

মাধবদীর জমিদার সতী প্রসন্ন গুপ্ত’র রহস্যজনক করুণ মৃত্যুর ঘটনা

মাধবদী বাজারের একদম ভেতরে, মাধবদী কলেজের পাশে পুরোনো আমলের স্থাপত্যঘেরা কয়েকটা ঘর— এটা মাধবদীর জমিদার বাড়ি। লোকজনের কাছে ‘বাবুর বাড়ি’ নামে পরিচিত। বছর চার-পাঁচেক আগেও দুইদিকের প্রবেশপথে গেট ছিলো, জমিদারের নির্মিত। কিন্তু দুটো গেটই কী এক অজানা কারণে ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই জমিদারই মূলত মাধবদী বাজার হাট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজকে মাধবদীর যে তাঁতশিল্পে শনৈ শনৈ উন্নতি, তাতে জমিদারের প্রভূত ভূমিকা রয়েছে। শুধু তাই নয়, মাধবদী হাইস্কুল, স্কুল-মার্কেটসহ ব্রহ্মপুত্র-পারের বিশাল এলাকা জমিদারদের দানকৃত ও ফেলে যাওয়া সম্পত্তি।

মাধবদী বাবুর বাড়ি | ছবি : আদিব হোসেন

বর্তমানে জমিদার বাড়িটি মাধবদী কলেজের শিক্ষকদের কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভেতরে প্রবেশ করলে অনুভব করা যায় তিরিশের দশকের স্থাপত্যশৈলীর গুণ। এই বাড়ির সর্বশেষ মালিক ছিলেন জমিদারদের শেষ বংশধর শৈলেন্দ্রকুমার গুপ্তরায়। পূর্ববর্তী জমিদার সতী প্রসন্ন গুপ্তরায়ের ছেলে। বাবার নামেই তিনি ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মাধবদী সতী প্রসন্ন উচ্চ বিদ্যালয়।

জমিদার সতী প্রসন্ন গুপ্তের করুণ রহস্যজনক মৃত্যুর খবর বলতেই এই ভূমিকা শোনানো। তার আগে জমিদার বাড়ি সম্বন্ধে দুয়েক লাইন জানানো দরকার। জমিদার বাড়ি বা পরে বাবুর বাড়ির আগে নাম ছিলো মুন্সিবাড়ি। শেষ জমিদারের চার পুরুষ আগে এই বাড়ির মালিক মুন্সিয়ানা করে অনেক টাকাপয়সা করেছিলেন বলে তার নাম হয়ে যায় মুন্সি, আর বাড়ির নাম মুন্সিবাড়ি। তিনি জমিদারি শুরু করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর চার ছেলে জমিদারির মালিক হন। সবাই বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু প্রত্যেকেই নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। এরমধ্যে তৃতীয়জন এক পুত্রসন্তান দত্তক নিয়েছিলেন। এই দত্তক পুত্রই পরে এই জমিদারির হাল ধরেন। তার নাম সতী প্রসন্ন গুপ্ত।

সময়টা ১৯১৪/১৫ সালের। মাধবদী গ্রাম নেহাৎ একটা অজ পাড়াগাঁ। গ্রামের মাঝখানে ব্রহ্মপুত্রের শাখা বয়ে চলেছে। সবাই এটাকে খাল বলে। তবে ভরা বর্ষায় যৌবন উছলে পড়ে। গ্রামটা মুসলমান অধ্যুষিত হলেও হিন্দুরাই মূলত প্রভাব বিস্তার করেছিলো। গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরগুলি হিন্দুদের। গ্রামের উঠতি জমিদার হিন্দুধর্মাবলম্বী। জমিদার বাড়ির জ্ঞাতিসম্পর্কীয় রায়বাড়িও অবস্থাসম্পন্ন।

জমিদার সতী প্রসন্ন গুপ্ত ছিলেন সাদাসিধে সরল প্রকৃতির লোক। দত্তক হিসেবে তার এই বাড়ির সঙ্গে যোগ। লেখাপড়ায় সুবিধে করতে না পারলেও জমিদারির উপযুক্ত জ্ঞানবুদ্ধি তার ছিলো। দেখতে সুপুরুষ ছিলেন। পিতা বৃদ্ধ জমিদার পোষ্যপুত্র, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি পরিবেষ্টিত হয়ে স্বর্গগত হলেন। নবীন জমিদারের বয়স তখন সাইত্রিশ-আটত্রিশ মাত্র। পূর্ণ বয়সে বিবাহ করেছিলেন নারায়ণগঞ্জের এক মেয়েকে। ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্যে জমিদার গৃহিণীকে নারায়ণগঞ্জে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হতো। বাড়িতে একা জমিদার সতী বাবু আমলা-কর্মচারীসহ বিষয়সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নিয়ে।

সতী প্রসন্ন গুপ্ত রহস্যজনক করুণ মৃত্যু
জমিদারের প্রসাদপুষ্ট চাটুকারের দল সবসময় তাকে ঘিরে থাকতো। গান-বাজনা, হাসি-হুল্লোড় বাড়িতে লেগেই থাকতো। খালি বাড়ি। সুযোগ বুঝে কিছু দুষ্টুলোক এই আসরের মধ্যে ঢুকে গেলো। তাদের দৃষ্টি গেলো জমিদারের টাকা-পয়সার দিকে। অন্তরঙ্গ বন্ধুর মুখোশ পড়ে তারা জমিদারকে সম্মোহিত করে ফেললো। এরা ছিলো তার দিবারাত্রির সঙ্গী। আমোদ-প্রমোদের নানা উপকরণ তারা সরবরাহ করতো। জমিদার বাবু তাদের হাতে নিজেকে প্রায় সমর্পণ করে দিলেন। একদিন জমিদার বাবু ভাত খাওয়ার পর একটা পান খেলেন, তারপর অজ্ঞান হয়ে গেলেন। বহুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলো অনেক জল ঢালার পর। কিন্তু সেই থেকে শুরু। পান খাওয়ার ফলে মুখের ভেতর ঘামাচির মতো ছোটো ছোটো কী যেনো দেখতে পাওয়া গেলো। তার কিছুদিন পর বড়ো বড়ো গরম হাঁড়ির মাধ্যমে জমিদার বাবুর হাত-পা-পিঠসহ সমস্ত শরীর সেঁক দেয়ার চিকিৎসা চলতে লাগলো। প্রতিবেশিরা এসে দেখেন, দরোজা-জানালা বন্ধ করে সম্পূর্ণ গুমোট, বদ্ধ পরিবেশে জমিদারের উপর গরম বড়ো বড়ো হাঁড়ির সেঁক দেয়া চলছে। আর জমিদার বাবু চিৎকার করতে করতে ঘরের এপাশ থেকে ওপাশে দৌঁড়াচ্ছেন। কখনো কখনো বলছেন, “ওকে বলো, আমি আর টাকা দিতে পারবো না। ও শুধু টাকা চায়।” বলতে বলতে চিকিৎসকের দিকে ইঙ্গিত করছিলেন।

চিকিৎসকের পরামর্শ ছিলো জমিদার গিন্নিকে যেনো তার এই রোগের সংবাদ জানানো না হয়, কিন্তু অবিলম্বে জমিদার গিন্নি এ-সম্পর্কে জেনে দ্রুত ছেলেমেয়ে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ হতে রওনা দিলেন। এসে জমিদারের অবস্থা দেখে তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। তিনি এই চিকিৎসক বিদায় করলেন। জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তাকে এই সকল বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতা করেন পাশের রায়বাড়ির বড়োকর্তা। তিনি না থাকলে একা মহিলার পক্ষে সবকিছু সামাল দেয়া কঠিন হতো। তবে সবচে’ বড়ো কথা হলো, কিছু স্বার্থান্বেষী লোভী মানুষের কারণে, চিকিৎসকের সহযোগিতায় যে-আসুরিক অপচিকিৎসা দিনের পর দিন জমিদার বাবুর উপর চলেছে, তাতে তিনি ততোদিনে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন। পরিবারের সকল চেষ্টা, সেবা ইত্যাদির পরও ভালো হননি। প্রায় দুই বছর এই নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা থেকে জমিদারবাবু নিজেই নিজেকে মুক্তি দেন।

একদিন সকালবেলা বাড়ির কর্ত্রী অনেক ডাকাডাকি করেও সাড়াশব্দ পাচ্ছিলেন না। চাকররাও সারাদিন ডাকাডাকি করলো। কোনো সাড়া নেই। অবশেষে ডাকা হলো রায়বাড়ির কর্তাকে। তাকে জমিদারবাবু সমীহ করতেন। তার ডাক অগ্রাহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু তিনিও ব্যর্থ হলেন। পরে তিনি চাকরকে হুকুম দিলেন বাড়ির পেছন দিয়ে যেভাবেই হোক দরোজার ছিটকিনি খোলার ব্যবস্থা করতে। তাই করা হলো। দরোজা ভেঙে অবশেষে দেখা গেলো, জমিদারবাবু ফাঁস লাগিয়ে শূন্যে ঝুলছেন। মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সের টগবগে জমিদারের এই করুণ মৃত্যু দেখে সবাই বেদনায় মুষড়ে পড়লো। জমিদার বাবুর দুই সন্তান তখনো নাবালক।

গ্রামের সেই লোভী, বন্ধুর বেশে ষড়যন্ত্রকারীগণ উল্টো মামলা করলেন জমিদার গিন্নির বিরুদ্ধে। বলতে লাগলেন, তার বউই তাকে বিষ খাইয়ে ঝুলিয়ে এখন আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করছেন। পুলিশে বাড়ি গিজগিজ করছে। দুইদিন পর শবদাহের অনুমতি মিললো।

আদালতে মামলা চললো অনেকদিন। রায়বাড়ির বুড়োকর্তা সাক্ষ্য দিলেন। শেষপর্যন্ত তার সাক্ষ্যতেই জমিদার গিন্নি ছাড়া পেলেন স্বামী হত্যার কলঙ্ক থেকে। কিন্তু তাতেও বিপদ গেলো না। যতোদিন ছেলেরা সাবালক না হচ্ছে, ততোদিন ছেলেদের পক্ষে মা-ই জমিদারি কোর্ট অব ওয়ার্ডসে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হচ্ছিলো না। পরে রায়বাড়ির দুইকর্তা মিলে এক লক্ষ টাকা জামিনে আসন্ন কোর্ট অব ওয়ার্ডসের হাত থেকে জমিদারি রক্ষা করলেন। একা জমিদার গিন্নি দুই নাবালক সন্তান নিয়ে কতোগুলো অর্থলিপ্সু, ক্ষমাহীন চোখের সামনে দিন-রাত অতিবাহিত করেছেন।

শেষকথা
মাধবদীর জমিদার শৈলেন্দ্র গুপ্তরায় ১৯৪৬ সালে ব্রহ্মপুত্রের ওপারে বাবার নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন— ‘মাধবদী সতী প্রসন্ন উচ্চ বিদ্যালয়’। এর অনেক আগে থেকেই অবশ্য অন্য জায়গায় জমিদার গিন্নির তত্ত্বাবধানে একটা স্কুল চলেছিলো ‘মাধবদী এম ই স্কুল’ নামে। ওটাই ১৯৪৬ সালে স্থানান্তরিত হয় এবং পরের বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।

মাঝখানে ব্রহ্মপুত্রের জল অনেক গড়িয়েছে। নাবালক পুত্রেরা একসময় বড়ো হয়েছে, জমিদার হয়েছে, শান-শওকত বেড়েছে। মাধবদী হাট প্রতিষ্ঠা হয়েছে। জমিদারের বাড়িতে বড়ো বড়ো দেউরিসহ বিল্ডিং উঠেছে। আর জমিদার শৈলেন্দ্র গুপ্তরায় সাধারণ প্রজাদের এবং মুসলমান প্রজাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ছাতা হাতে চলার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। সে অন্য প্রসঙ্গ। এসব গল্প অন্য আরেকদিন করা যাবে।

দ্রষ্টব্য
রায়বাড়ির পুত্রবধূ প্রিয়বালা গুপ্তা তার শেষবয়সে আত্মজীবনী লেখেন ‘স্মৃতিমঞ্জুষা’ নামে। আত্মজীবনীটি তার পুত্র রঞ্জন গুপ্ত’র সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয় কলকাতার দে’জ পাবলিশার্স থেকে। পরবর্তীতে মাধবদীর ভাই গিরিশচন্দ্র সেন গণপাঠাগার বইটির পুনর্মুদ্রণ করে। এই লেখায় জমিদার সতী প্রসন্ন গুপ্ত’র মৃত্যুর ঘটনার বিভিন্ন তথ্য নেয়া হয়েছে উক্ত বই থেকেই।

নরসিংদীর বি বি টকিজে সিনেমা দেখার স্মৃতি এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পাঁচালী


১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনি বি বি টকিজ সিনেমা হলটি পুড়িয়ে ফেলে। পরবর্তীতে হলটির কোনো ছবি বা চিত্র পাওয়া যায়নি। তাই এই নিবন্ধের লেখক ও প্রত্যক্ষদর্শী অধ্যাপক গোলাম মোস্তাফা মিয়ার বর্ণনা অনুযায়ী বি বি টকিজের এই চিত্রটি এঁকেছেন চিত্রশিল্পী শেখ নাহিদ হাসান

সিনেমা একটি আধুনিক শিল্প মাধ্যম। সিনেমা শুধু শিল্প এবং বিনোদনের মধ্যেই থাকেনি। বাণিজ্যিক শিল্প (ইন্ডাস্ট্রি) হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে পৃথিবীব্যাপী। সিনেমা শিল্পের শুরুর সময়ে তাকালে দেখবো, এই শিল্পটির সাথে দর্শকদের যুক্ত হতে গেলে সিনেমা হলে যেতে হতো। বড়ো হলরুম ছাড়া সিনেমা প্রদর্শন করা যেতো না। এই শিল্প প্রদর্শনীর জন্যে সিনেমা হলও গড়ে তুলতে হয়েছে সিনেমা নির্মাণের সাথে সাথে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে বর্তমানে অবশ্য হলে না গিয়েও বাড়িতে বসে নানা প্রযুক্তিগত মাধ্যমে সিনেমা দেখা যায়।

আমার জীবনের প্রথম সিনেমা দেখা ১৯৬০-এর দিকে। তা-ও নির্দিষ্ট কোনো সিনেমা হলে নয়। একটি গুদাম ঘরে। তখন আমি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। বাবার কর্মস্থল তৎকালীন মুন্সিগঞ্জ মহকুমার লৌহজংয়ে অবস্থান করছিলাম আমরা। পড়ছি লৌহজং হাইস্কুলে। যতোটুকু মনে পড়ছে, সিনেমাটির নাম ছিলো ‘আসিয়া’ (১৯৬০)। ছবিটি প্রদর্শিত হবার পূর্বে তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাশাসক আইয়ুব খানের কার্যক্রমের কিছু তথ্যচিত্র দেখানো হয়েছিলো, তা-ও মনে পড়ছে। পর্দায় জীবনের প্রথম সবাক এইসব দৃশ্য দেখার অনুভূতিগুলি এখনো মনে আছে।

বাবা লৌহজং থেকে নারায়ণগঞ্জ মহকুমার রূপগঞ্জে বদলি হলেন। অফিস ছিলো কাঞ্চন। ভর্তি হয়েছিলাম কাঞ্চন বি সি ইনস্টিটিউশনে। রূপগঞ্জ থাকাকালীন সময়ে নরসিংদীতে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে আসার সুবাদে বেশ কয়েকবার সিনেমা দেখা হয়। সিনেমা হলে বসে সিনেমা দেখা সেই প্রথম— ১৯৬৩-৬৪ সালের দিকে। একটি উর্দু ছবি দিয়ে প্রথম হলে বসে সিনেমা দেখা। ছবিটির নাম এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। যে-হলে বসে প্রথম সিনেমা দেখেছি, তার নাম ‘বি বি টকিজ’। নরসিংদী রেলস্টেশন রোড সংলগ্ন বৌয়াকুড় এলাকায়। নরসিংদীর প্রথম সিনেমা হল। যতোটুকু তথ্য জানা আছে, হলের জায়গাটি আমাদের নরসিংদীর ষাট-সত্তর দশকের ছাত্রলীগ নেতা, মুক্তিযোদ্ধা এবং পরবর্তীতে জাতীয় সংসদের সদস্য মেজর (অব.) শামসুল হুদা বাচ্চুর বাবা সৈয়দ আলী মাস্টার সাহেবের। এই জায়গা ভাড়া নিয়ে সিনেমাপ্রেমী বিশ্বম্ভর সাহা (বিশু বাবু) সিনেমা হল গড়ে তোলেন। সময়টা ১৯৫৫-৫৬ সালের দিকে। ঐতিহ্যপূর্ণ এই হলটি সিনেমাপ্রেমিকদের বিনোদনের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠেছিলো। যতোদূর মনে পড়ছে, ‘বি বি টকিজ’-এর পূর্ণরূপ হলো ‘বিশু বাবু টকিজ’। মতান্তরে ‘বৌয়াকুড় বিশুবাবু টকিজ’। বিশু বাবুর অনুপস্থিতিতে তাঁর ছেলে মন্টু সাহা হলটি চালিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে নানা প্রতিরোধ পেরিয়ে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ পাক হানাদার বাহিনি নরসিংদী দখলে নিয়ে নেয় এবং নরসিংদী শহরে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনে তাদের স্থায়ী প্রধান ক্যাম্প স্থাপন করে। নরসিংদী দখলের পর শুরুতেই নরসিংদীতে যে-ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি বাহিনি, তার মধ্যে অন্যতম ছিলো— বি বি টকিজকে সম্পূর্ণরূপে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া।

এই হলটির সাথে আমার স্কুলজীবনের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বাবা রূপগঞ্জ থেকে নরসিংদী থানায় কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে বদলি হয়ে আসেন ১৯৬৫-র শেষদিকে। বদলির পূর্বে বাবা নরসিংদীর ব্রাহ্মন্দীতে জায়গা কিনে একটি বাড়ি করেছিলেন স্থায়ীভাবে থাকার জন্যে। আমি ব্রাহ্মন্দী কে কে এম উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হই। নতুন স্কুলে অনেক বন্ধু জুটে যায়। তাদের সাথে মিশে বি বি টকিজে নিয়মিত সিনেমা দেখার পর্ব শুরু হয়। স্কুল এবং কলেজজীবন পর্যন্ত সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার একটা প্রচণ্ড নেশা তৈরি হয়ে যায়। শৈশব-কৈশোরে আমাদের হাতে কোনো নগদ টাকা থাকতো না। সময়টা এমনই ছিলো যে, যা প্রয়োজন, সব অভিভাবকেরাই কিনে দিতেন। নগদ টাকা আমাদের হাতে দিতেন না। কিন্তু সিনেমার নেশা যখন এসে গেলো, তখন তা দমিয়ে রাখা গেলো না। প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন ছবি আসতো। বাধ্য হয়েই বাবার পকেট থেকে বা টাকা রাখার রক্ষিত স্থান থেকে বাবা-মাকে না বলে, লুকিয়ে টাকা নিয়ে সিনেমা দেখতাম। এজন্যে বাবা-মা’র অনেক গালি, মার খেতে হয়েছে। কিন্তু সিনেমা দেখা বন্ধ হয়নি।

তখন বি বি টকিজে পাকিস্তানি উর্দু ছবিই বেশি চলতো। একসময় ভারতীয় ছবিও আসতো। ১৯৬৫-র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর ভারতীয় সিনেমা আসা বন্ধ হয়ে যায়। বি বি টকিজ হলের মডেল পুরাতন হলেও প্রজেক্টর এবং সামনের বড়ো পর্দার মান বেশ ভালো ছিলো। সাউন্ড সিস্টেমও খারাপ ছিলো না। হলের ভেতরের আসন ব্যবস্থাপনায় সম্মুখভাগে পর্দার কাছাকাছি ছিলো সম্মুখ আসন (ফ্রন্ট স্টল), তার পেছনে মধ্যম আসন (মিডল স্টল), তার পেছনে পশ্চাৎ আসন (রিয়ার স্টল)। হলের পেছনভাগে দ্বিতীয় তলায় প্রথম শ্রেণি (ফার্স্ট ক্লাস) এবং বেলকনি। ফ্রন্ট স্টলের ভাড়া কম ছিলো বলে সেখানে বসেই বেশি ছবি দেখেছি। মনে পড়ছে, হল এলাকায় বিচরণ, টিকেট কাটা এবং হলে প্রবেশের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হতো। লুকিয়ে প্রবেশ করতাম। পরিচিত বড়োজনরা কেউ দেখে ফেললো কিনা, স্যারেরা কেউ দেখে ফেললো কিনা— তাহলে তো বাবা-মা’র মার খেতে হবে। অনেক সময় টিকেট কাটতেও বেশ সমস্যা হয়ে পড়তো। ফ্রন্ট স্টলের ক্ষেত্রে নিম্ন পেশাজীবী শ্রেণির দর্শকদের জন্যে ভীড় ঠেলে টিকেট কাটা যেতো না। তখন বাধ্য হয়ে ব্ল্যাকারদের কাছ থেকে বেশি টাকায় টিকেট কিনতে হতো। আবার কখনো দেখা গেলো ‘হাউজফুল’— সামনে প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে দিতো। মন খারাপ করে চলে আসা ছাড়া আর উপায় কী! সিনেমা দেখার নেশা ধরিয়ে দিতো, যখন ব্যান্ডপার্টি নিয়ে নতুন ছবির পোস্টার সম্বলিত বড়ো বড়ো প্ল্যাকার্ডসহ এলাকায় মাইকিং করতো। মনে পড়ছে, বৌয়াকুড়ের কৃষ্ণকান্ত বর্মণ বেশ দক্ষতার সাথে রসিয়ে রসিয়ে বি বি টকিজে নতুন ছবি আসলে প্রতি সপ্তাহে তার প্রচারণা চালাতো। পোস্টারে নায়ক-নায়িকার ছবি এবং তাদের অ্যাকশান দৃশ্য দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারতাম না। এখনো চোখে ভাসছে, ‘খাইবার পাস’ ছবির পোস্টারে পাকিস্তানি নায়িকা নীলু’র এক পা পাহাড়ের একপাড়ে, অন্য পা আরেক পাড়ে। মাঝখানে খাইবার পাস। সে এক অন্যরকম দৃশ্য। তখন উর্দু ছবিতে নায়িকা হিসেবে নীলু, রাণী, জেবা এবং নায়ক ওয়াহিদ মুরাদ, মোহাম্মদ আলী, সুধীর, সন্তোষ, আলাউদ্দিন প্রমুখদের বেশি দেখা যেতো।

বি বি টকিজে চলতো তিনটি শো— ০৩ টা থেকে বিকেলের প্রদর্শনী (ম্যাটিনি শো), ০৬ টা থেকে সন্ধ্যার প্রদর্শনী (ইভিনিং শো) এবং ০৯ টা থেকে রাতের প্রদর্শনী (নাইট শো)। সাপ্তাহিক ছুটির দিন রবিবার থাকতো সকালের প্রদর্শনী (মর্নিং শো)। মর্নিং শো-এ চলতো ইংরেজি ছবি। কোনোকিছুই দেখা বাকি থাকতো না। সম্ভবত এসব দুষ্টুমির কারণেই বাবা দশম শ্রেণিতে ওঠার পর এসএসসি পরীক্ষার ফল ভালো করার বিবেচনায় শিবপুর হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন।

বি বি টকিজে ষাটের দশকে বাংলা সিনেমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছবি আমি দেখেছি। কয়েকটি ছবির নাম উল্লেখ না করে পারছি না। সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’, জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ ও ‘জীবন থেকে নেয়া’সহ অনেক ছবি সে-সময় বি বি টকিজে প্রদর্শিত হয়েছে। ১৯৬৪ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ ছবির মাধ্যমে দেশের অন্যতম চলচ্চিত্র অভিনেত্রী কবরী’র অভিনয়জীবন শুরু। ‘বেহুলা’ (১৯৬৬) জহির রায়হানের লোককাহিনিনির্ভর ব্যবসা সফল ছবি। এই ছবিতে নায়করাজ রাজ্জাক প্রথম নায়ক হিসেবে অভিষিক্ত হন। ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে জহির রায়হান নির্মাণ করেন ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০)। ছবিটিকে প্রায় নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো, কিন্তু গণদাবিতে পাকিস্তান সরকার এটিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ছবিটিতে রাজনৈতিক আন্দোলন এবং সেই সময়কার ঢাকার রাজপথে কৃষকদের সবচাইতে বড়ো সমাবেশের ফুটেজ ব্যবহার করেন জহির রায়হান। সেই সমাবেশে আমরাও অংশ নিয়েছিলাম নরসিংদীর রায়পুরার কৃষকদের সাথে।

নরসিংদী শহরে ০৪ টি সিনেমা হল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। প্রথম সিনেমা হল বি বি টকিজ-সহ মিতালী, সুরভী এবং সংগীতা। চারটি হলই আজ মাটির সাথে মিশে গেছে। বি বি টকিজ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি দ্বারা ভস্মিভূত হয়েছে। এখন সেখানে বড়ো শপিংমল গড়ে ওঠেছে। মিতালী নরসিংদী পৌরসভার পশ্চিমপাশে দৃষ্টিনন্দন ও সবার চোখে পড়ার মতো জায়গায় একটি আধুনিক সিনেমা হল ছিলো। আজ সেখানে হল ভেঙে নদী বাংলা কনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে নরসিংদীর সবচে’ বড়ো শপিংমল ও আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে। সুরভী ছিলো সাটিরপাড়ায়, সংগীতা ঘোড়াদিয়া যাবার পথে। এগুলোও ভেঙে দিয়ে নতুন মার্কেট তৈরি করা হয়েছে।

বৌয়াকুড়ে অবস্থিত বর্তমান ইনডেক্স প্লাজার সামনে বি বি টকিজের জায়গাটি এখনো খালি পড়ে আছে

ঢাকার বিখ্যাত সিনেমা হল বলাকা, মধুমিতা, অভিসার, গুলিস্তান। প্রত্যেকটি হলে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে (১৯৭০-৭৫) অনেক ছবি দেখেছি। গুলিস্তানের অস্তিত্ব আজ বিলীন। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকার পুরাতন হল ‘পিকচার হাউজ’— পরবর্তী নাম ‘মুকুল’ (আজাদ), ১৯২৯। সেখানে প্রথম নির্বাক ছবি ‘দ্য লাস্ট কিস’ প্রদর্শিত হয়েছিলো। পরের প্রেক্ষাগৃহ সদরঘাটের ‘সিনেমা প্যালেস’— পরবর্তী নাম ‘মতিমহল-রূপমহল’। এই হলে দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ প্রদর্শিত হয়েছিলো। বংশালে ‘মানসী’, ইসলামপুরে ছিলো ‘লায়ন’। ঢাকার আরেকটি উল্লেখযোগ্য হল ছিলো ‘তাজমহল’। বাংলাদেশের বৃহত্তম সিনেমা হল যশোর জেলা সদরের ‘মনিহার’, যার আসনসংখ্যা প্রায় ১,২০০ (একহাজার দুইশত)। কিন্তু বর্তমানে দেশের সব সিনেমা হল ঝুঁকির মুখে। অনেকগুলো বিলুপ্ত। সিনেমা হলের সংখ্যা ১,২০০ থেকে এখন ১০০-র নিচে নেমে এসেছে।

চলচ্চিত্র শিল্পের একটি বৃহৎ এবং শক্তিশালী আধুনিক মাধ্যম হলেও বাংলাদেশে বিগত সত্তর বছরেও এটি পূর্ণাঙ্গ বিকশিত হতে পারেনি। তারপরও ১৯৫৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (এফডিসি)। এ-সময়েই জহির রায়হান, ফতেহ লোহানী, সালাউদ্দিন, সাদেক খান, সুভাষ দত্তের মতো প্রগতিশীল কয়েকজন চলচ্চিত্র চিন্তক ও নির্মাতার আবির্ভাব ঘটে। তাঁদের নির্মিত চলচ্চিত্রের বিষয় ছিলো জীবন-সমাজ-রাষ্ট্র। সামন্তবাদী অত্যাচার, সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকট, পুঁজিবাদের আগ্রাসন এবং সর্বোপরি ভঙ্গুর মূল্যবোধের বিপরীতে ঘুরে দাঁড়ানো। কিন্তু ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র আদর্শের বদলে বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে ওঠে। চলচ্চিত্রে চলে আসে অশালীন, চটুল সংলাপ, অশ্লীল দৃশ্য নির্মাণ, অবাস্তব কাহিনিচিত্র। পূর্ব পাকিস্তানি সময়ের উর্দু ছবির দাপটে তা লক্ষ্য করা যায়।

এতোসব বাধা-প্রতিকূলতার পরও স্বাধীনতার পরপর নতুন অঙ্গীকার নিয়ে সুস্থ চলচ্চিত্র চিন্তক, চলচ্চিত্র সাংবাদিক আলমগীর কবীর নির্মাণ করলেন ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘সূর্যকন্যা’, ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘রূপালী সৈকতে’। এছাড়া কবীর আনোয়ারের ‘সুপ্রভাত’; সুভাষ দত্তের ‘বসুন্ধরা’, ‘ডুমুরের ফুল’; আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’; আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘সারেং বউ’; মসিউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলীর ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’র মতো ভালো ছবিগুলো নির্মিত হয় তখন।

সীমিত হলেও চলচ্চিত্রের এই সুস্থ ধারার উত্তরাধিকার তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদ, হুমায়ূন আহমেদ, আবু সাইয়িদ, মোরশেদুল ইসলাম, গিয়াসউদ্দিন সেলিম, অমিতাভ রেজা, তৌকীর আহমেদ, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী-সহ আরো অনেক নবীন চলচ্চিত্র নির্মাতা, যাদের কাছ থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আশার আলো পাচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, অনেক উঁচুমাপের নির্মাতা তারেক মাসুদকে অকালে হারাতে হয়েছে।

নরসিংদীর প্রথম সিনেমা হল বি বি টকিজে সিনেমা দেখার উত্তাল স্মৃতি এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এই পাঁচালী যখন লিখছি, তখন বাংলাদেশের নবীন নির্মাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ-এর ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবিটি ২০২১ সালের ৭৪ তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের ‘আঁ সার্তে রিগা’ পর্বে প্রদর্শিত হয়েছে এবং ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। এটি আমাদের জন্যে আশার কথা। এই আশা নিয়ে আমরা দেখতে চাই, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সুস্থ ধারায় ফিরে আসবে, সিনেপ্লেক্সসহ সিনেমা হল গড়ে ওঠবে আবার। নতুনভাবে চলচ্চিত্র শিল্পটি হবে সমৃদ্ধ।


গোলাম মোস্তাফা মিয়া
সাবেক অধ্যক্ষ, নরসিংদী সরকারি কলেজ

গিরিশচন্দ্র ও নরসিংদীর নারীশিক্ষা

‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি’ বলে বহুল ব্যবহৃত একটি প্রবাদ বাক্য রয়েছে। নরসিংদীর ঐতিহাসিক উপাদান খুঁজতে গিয়ে আমার জীবনে তেমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। সাটিরপাড়ার প্রজাহিতৈষী জমিদার, শিক্ষাব্রতী ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিত্ব ললিতমোহন রায় বিএবিএল সম্পর্কে উপাত্ত খুঁজতে গিয়ে জানতে পারি, তিনি ছিলেন নেতাজী সুভাষ বোসের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং স্বদেশী স্টিমার কোম্পানি ও সুগার মিলের মালিক। কলকাতা যাদবপুরস্থ বেঙ্গল ল্যাম্পস কারখানা বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অনুরোধে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি।

জমিদার ললিতমোহন রায় নরসিংদীর সাটিরপাড়ায় ব্রিটিশ আমলে একটি স্বদেশী সুগার মিল প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিটিশদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। মিলটি বেশিদিন না টিকলেও দেশপ্রেমের বিশেষ নিদর্শন বহন করেছিলো চিনি কলটি। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে পরিত্যক্ত সেই মিলের জায়গায় তিনি গড়ে তোলেন নারীশিক্ষার জন্যে একটি গার্লস স্কুল এবং তাঁর মা কমলকামিনী দেবীর নামে এর নামকরণ করেন ‘কমলকামিনী গার্লস স্কুল’। তখন নরসিংদী শহরে মেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষার জন্যে কোনো স্কুল কিংবা ইনস্টিটিউট ছিলো না। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি সাটিরপাড়ায় ‘কালী কুমার ইনস্টিটিউশন’ নামে একটি বালক বিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন। স্কুলটির খ্যাতি তখন ভারতবর্ষব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিলো। সেই আশা নিয়ে তিনি কমলকামিনী গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেও এর একযুগ পরই দেশভাগের হট্টগোল শুরু হয়। গার্লস স্কুলের সিংহভাগ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছিলো হিন্দু সম্প্রদায়ের। দেশভাগের কারণে তারা প্রায় সবাই ভারতের বিভিন্ন স্থানে (পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বিহার) চলে গেলে স্কুলটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতাও উঠে যায়। সঙ্গত কারণে স্কুলটি অনেকদিন বন্ধ থাকে। পরবর্তীতে সেখানে গার্লস স্কুলটি চালু হলেও রহস্যজনক কারণে কমলকামিনী নামটি পরিবর্তন করে সেখানে নরসিংদী বালিকা বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড ওঠে। এই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কাদের কারণে বাস্তবায়িত হয়েছিলো, তা আজো জানা যায় না।

সাটিরপাড়ার জমিদার ললিতমোহন রায়

একইভাবে আরেকটি গার্লস স্কুল মাধবদীতে নিঃশেষিত করা হয়েছিলো। সেখানকার শিক্ষানুরাগী নারী প্রিয়বালা গুপ্তা বস্ত্রশিল্পের পীঠস্থানটিকে শিক্ষায় আলোকিত করার জন্যে একটি গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মূলত পিছিয়ে পড়া নারী সমাজকে শিক্ষিত করে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে তিনি শিক্ষার পাশাপাশি আরো অনেক সামাজিক কাজ হাতে নেন। তাঁর স্মৃতিচারণামূলক ‘স্মৃতিমঞ্জুষা’ গ্রন্থে এ-সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ আছে। গ্রামের মানুষদের বিশেষ করে মেয়েদের স্বাবলম্বী করে তোলার জন্যে তাঁর কোনো বিকল্প ছিলো না। তাদেরকে অক্ষরজ্ঞান দেয়ার পাশাপাশি সেলাই শিক্ষা, কুশি কাটা ও বোনাসহ অন্যান্য হাতের কাজ শেখাতেন। এমনকি সাহিত্যচর্চার জন্যে হাতে লেখা পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। ‘কিশলয়’ নামে পত্রিকার তিনটি সংখ্যাও প্রকাশিত হয়েছিলো। এতে প্রিয়বালা গুপ্তার কয়েকটি শিশুতোষ কবিতা প্রকাশ পেয়েছিলো। তাঁর বড়ো ছেলে অজিত গুপ্ত পত্রিকাটি হাতে লিখতেন। অলঙ্করণ করেছিলেন রানু পাকড়াশী। এতে নিয়মিত লিখতেন বিপ্লবী সতীশচন্দ্র পাকড়াশী, অজিত গুপ্ত, হিরণবালা রায়, সাধনচন্দ্র তপাদার ও প্রিয়বালা গুপ্তা।

১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে প্রিয়বালা গুপ্তা তাঁর জীবনের বড়ো স্বপ্ন ‘মাধবদী শিশুশিক্ষা বিদ্যানিকেতন’ নিজবাড়িতে শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দাগ তখনো মুছে যায়নি। দুবেলা স্কুল বসতো। সকাল ০৭ টা থেকে ০৯ টা পর্যন্ত শিশু ও প্রথম শ্রেণি, অন্য শ্রেণিগুলো সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ০৪ টা পর্যন্ত চলতো। মাঝে একঘণ্টা খাবার বিরতি ছিলো। প্রথমদিকে তিনি একা শিক্ষকতা করলেও পরে পাড়ার দুয়েকজন শিক্ষিত ছেলে সাহায্য করতো। পরবর্তীতে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে রঞ্জন গুপ্ত ও ঢাকা সেন্ট গ্রেগরির ছাত্র সাধন তপাদার ও শংকর তপাদার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

প্রিয়বালা গুপ্তা

তারপর ছাত্রী সংগ্রহের জন্যে তিনি বাড়ি বাড়ি যেতে শুরু করেন। নিজের মেয়ে আরতি গুপ্তা ও কাশীপুরের শৈলবালা সাহাকে দিয়ে শুরু করেন ‘মাধবদী শিশুশিক্ষা বিদ্যানিকেতন’। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ কি এপ্রিলে ভর্তি হন কাশীপুরের স্বদেশী মালাদার, মাধবদীর সতী পাকড়াশী ও ননী পাকড়াশী। এভাবে ০৫ জন মেয়ে দিয়ে স্কুলটি শুরু হলেও পরবর্তীতে ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে শিশু শ্রেণির স্কুলটি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত খোলা হয়। ০৫ জন শিক্ষার্থী বেড়ে দাঁড়ায় ১৫০ জনে। মাধবদী ছাড়াও কোতয়ালীরচর, আটপাইকা, কাশীপুর, আলগী, নওপাড়া, বিরামপুর, আনন্দী, শেখেরচর ও ভগীরথপুর থেকে ছাত্রীরা দলে দলে এসে সেই স্কুলে ভর্তি হয়। তখন হিন্দুপ্রধান মাধবদী এলাকায় মুসলমান নারীশিক্ষা ছিলো না বললেই চলে। কিন্তু প্রিয়বালার স্কুলে মুসলমান শিক্ষার্থীরাও ভর্তি হতে শুরু করে। প্রথমদিকে কলুপাড়ার সুলতান মিঞা তার এক মেয়ে ও এক ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করতে আসেন। মেয়েদের স্কুল বিধায় সেখানে ছেলে ভর্তির নিয়ম ছিলো না। কিন্তু সুলতান মিঞার পীড়াপীড়ির কারণে শিশু ছেলেকে সেখানে ভর্তি নিয়েছিলেন। এরপর নওপাড়ার ভূঁইয়া বাড়ির খালেদা আখতার ১০ বছর বয়সে সেখানে ভর্তি হয়। খালেদা সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করে ঢাকা ইডেন কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন। পরে স্বামীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া চলে যান। সেখান থেকে তিনি প্রিয়বালা গুপ্তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। কিন্তু দেশভাগ ও অব্যাহত দাঙ্গার কারণে প্রিয়বালা গুপ্তা ও তাঁর পরিবারের পরিবেশ প্রতিকূলে চলে যেতে শুরু করে। বিশেষ করে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ভয়াবহ দাঙ্গার আঁচ লাগে মাধবদী অঞ্চলে। নিজের প্রিয় জন্মভূমি, স্বামীর বাড়ি, স্কুল আর সাধারণ মানুষের গভীর ভালোবাসা ছেড়ে তাঁকে সীমান্ত পার হতেই হলো। দুই ছেলে, দুই মেয়েকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নৈহাটিতে পা রাখলেন তিনি। এই নৈহাটিতে জন্ম সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজে শিক্ষক হিসেবে চাকুরি পান ছেলে রঞ্জন গুপ্ত। ছেলের সঙ্গে তিনি সিউড়ী চলে যান। সেখান থেকে আর তাঁর ফেরা হয়নি। পেছনে পড়ে থাকে স্বপ্নের স্কুল, টুল-বেঞ্চ আর প্রিয় শিক্ষার্থীরা। সুখের খবর এই যে, মাধবদীর বর্তমান প্রজন্মের উদ্যোগী দুই তরুণ শাহীনুর মিয়া এবং সুমন ইউসুফ প্রিয়বালা গুপ্তার স্কুলটি পুনর্জীবিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যে নরসিংদী জেলা প্রশাসন স্কুলের জন্যে জমিও বরাদ্দ করেছে।

উল্লেখ্য, মাধবদীতে প্রিয়বালা গুপ্তা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গার্লস স্কুলের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সেখানে আরেকটি স্বল্পায়ু গার্লস স্কুলের সন্ধান পাওয়া যায়। মাধবদীর খ্যাতনামা আইনজীবী প্রকাশ পাকড়াশীর ছেলে বেনু পাকড়াশী সেটি গড়ে তুলেছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। গ্রামে এসেই মুষ্টিভিক্ষার মাধ্যমে একটি অবৈতনিক গার্লস স্কুল খোলেন এবং দুজন শিক্ষক নিয়োগ দেন। দেড় বছরের মাথায় তা বন্ধ হয়ে যায়। পড়ে থাকে ব্ল্যাকবোর্ড আর বেঞ্চ। শেষদিকে এর সঙ্গে যুক্ত হন প্রিয়বালা গুপ্তা। তিনি চেষ্টা করেন স্কুলটি বাঁচাতে। কিন্তু এলাকার মানুষের অসহযোগিতায় তা সম্ভব হয়নি।

হিসাব করলে প্রিয়বালা গুপ্তার স্কুলটি জেলার তৃতীয় প্রাচীন গার্লস স্কুল। দ্বিতীয়টি ছিলো জমিদার, বিপ্লবী ও শিক্ষানুরাগী ললিতমোহন রায়ের প্রতিষ্ঠিত কমলকামিনী গার্লস স্কুল। তাহলে সবচে’ প্রাচীন গার্লস স্কুল কোনটি? এর খোঁজ করতে গিয়ে একটি বিস্মৃত ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। যা নরসিংদীর নারীশিক্ষার ইতিহাসে মাইলফলক। একইসাথে শিক্ষার ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে হবে। প্রাচীন গার্লস স্কুলটির সঙ্গে ভাই গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৪-১৯১০) ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কোরানের প্রথম বঙ্গানুবাদকারী (টিকা টিপ্পনীসহ) ও ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারক হিসেবে তিনি আজীবন নারীশিক্ষা, বিধবা বিবাহ ও কুসংস্কার রোধে কাজ করে গেছেন। তা থেকে জন্মভূমি পাঁচদোনাকেও বাদ দেননি। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন, ৪০ বছরেরও অধিক সময় গার্লস স্কুলটি চলেছিলো। পরবর্তীতে নানা বাধা-বিপত্তির কারণে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয়ভাবে অনুসন্ধান করে এবং নানা ঐতিহাসিক বইপত্তর ঘেঁটেও গিরিশচন্দ্র সেনের প্রতিষ্ঠিত সেই গার্লস স্কুলের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়নি। তারা কেনো নরসিংদীর প্রথম গার্লস স্কুলটির ইতিহাস লেখা থেকে বিমুখ ছিলেন, সেটাও একধরনের রহস্য। জেলার ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ ‘ঘোড়াশাল কাহিনী’, ‘পূর্ববঙ্গে মহেশ্বরদী’, ‘মহেশ্বরদী পরগণার ঐতিহাসিক প্রবন্ধাবলী’, ‘নরসিংদীর গুণীজন’ কিংবা ‘নরসিংদীর কবি-সাহিত্যিক’সহ কোথাও স্কুলটির কোনো বিবরণ নেই। গিরিশচন্দ্র সেন ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীতে এর উল্লেখ না করলে স্কুলটির কথা চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যেতো। গিরিশচন্দ্র সেনের বংশধর হিসেবে পরিচিত রনজিৎ কুমার সেন তাঁর ‘মাওলানা ভাই গিরিশচন্দ্র সেন’ বইয়ে গার্লস স্কুলটির কথা উল্লেখ করলেও সে-সম্পর্কে আর কোনো তথ্য উল্লেখ করতে পারেননি। তেমনি এডভোকেট মুখলেছুর রহমান চৌধুরীর লেখা ‘ভাই গিরিশচন্দ্র সেন পরিচিতি’ গ্রন্থেও স্কুলটি সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই।

১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত গিরিশচন্দ্রের আত্মজীবনীতে উল্লেখ করা হয়, “চল্লিশ বৎসরেরও অধিককাল হইতে পাঁচদোনার বালিকা বিদ্যালয়ের কার্য্য চলিতেছে।” এই হিসাবে দেখা যায়, ১৮৬৯ কিংবা ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা ফরাশগঞ্জের এক বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ইডেন ফিমেল স্কুলেরও আগে অজপাড়াগাঁ পাঁচদোনায় গিরিশচন্দ্র মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্কুলটি যাতে ভালোভাবে চলে, সেজন্যে তিনি কলকাতা থেকে বই-পুস্তক ও খেলার সামগ্রী পাঠাতেন। স্কুলটি সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত হয়েছিলো। অনেক মেয়ে বৃত্তি পেয়েছিলো। এখান থেকে লেখাপড়া শিখে অনেকে স্বামী বা বাবার ঘরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন, অনেকে উচ্চশিক্ষাও গ্রহণ করেছিলেন। রক্ষণশীল মহলের শত বাধা সত্ত্বেও গিরিশচন্দ্র স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আত্মজীবনীতে তিনি লেখেন, “বাল্যকাল হইতে স্ত্রী শিক্ষা বিষয়ে আমার বিশেষ উৎসাহ ও অনুরাগ। স্বদেশে গৃহে অবস্থানকালে প্রত্যেক পরিবারের বধূদিগের দুঃখ দুরবস্থা ও তাঁহাদের প্রতি শ্বাশুড়ী, ননদ প্রভৃতির অত্যাচার দর্শন করিয়া আমার মন অতিশয় ব্যথিত হইয়াছে। এইরূপ নিপীড়ন ও নির্য্যাতনের ভিতর থাকিয়া তাঁহাদের মনোবৃত্তি সকল স্ফুর্ত্তি পাইতেছিল না, জ্ঞান পিপাসা কিছুই চরিতার্থ হইতে ছিল না। ভদ্র সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যাগণও বধূরূপে দাসীর ন্যায় নিজ দায়িত্বে খাটিয়া গলদঘর্ম্ম হন, প্রায় কাহারও হইতে আদরযত্ন লাভ করেন না। কাজে একটু ত্রুটি হইলে গঞ্জনা ভোগ করেন, তাঁহাদিগকে নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করিতে হয়, তাঁহাদের মুখ ফুটিয়া কথা কহিবার স্বাধীনতাটুকু নাই। এ সকল দেখিয়া আমি মনে ক্লেশ পাইতাম, ভাবিতাম লেখাপড়া না শিখিলে, আত্মোন্নতি না হইলে, ইঁহাদের অবস্থার উন্নতি, স্বাধীন চিন্তা, মানসিক স্ফুর্ত্তি হওয়া অসম্ভব। লেখাপড়া শিক্ষার দ্বার উম্মুক্ত করিতে হইবে, ইহা ভাবিয়া আমি পাঁচদোনা গ্রামে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে সমদ্যোগী হই।”

গিরিশচন্দ্র সেন

গিরিশচন্দ্র সেনের জীবনে ময়মনসিংহ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। সেখানে তিনি পড়াশোনা করেন। কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন। সেখানেই তাঁর সঙ্গে ব্রাহ্ম সমাজের নেতা কেশবচন্দ্র সেনের পরিচয় হয়েছিলো। সেখানে তাঁর অন্যতম কীর্তি হলো একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। তিনি মুড়াপাড়ার জমিদার ও ময়মনসিংহের কালেক্টর অফিসের খাজাঞ্চি রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় তাঁর (রামচন্দ্রের) বাড়িতে একটি গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সে-স্কুলে শহরের অনেক ভদ্র পরিবার ও রামচন্দ্রের দু’কন্যা পড়াশোনা শুরু করেন। শিক্ষকতার বিনিময়ে গিরিশচন্দ্র কোনো অর্থ গ্রহণ করতেন না। কালেক্টর রেনাল্ড সাহেবের স্ত্রী দু’বার উক্ত স্কুল পরিদর্শন করেন এবং ছাত্রীদের জন্যে সেলাই কল ও খেলার সামগ্রী উপহার দেন। গিরিশচন্দ্র ময়মনসিংহ ছেড়ে চলে যাবার পর স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে পরবর্তীতে সেখানে সরকারি সহযোগিতায় ব্রাহ্ম সমাজের উদ্যোগে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যা এখনো সুনামের সঙ্গে টিকে আছে। যার শুরু হয়েছিলো ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই স্কুল পরিদর্শন করেছিলেন।

গিরিশচন্দ্র সেন মৃত্যুর আগে একটি উইল বা শেষ ইচ্ছাপত্র রেজিস্ট্রি করে যান কালীগঞ্জ সাব রেজিস্ট্রি অফিসে। সেই উইলে তিনি পাঁচদোনা ও তার আশেপাশের গ্রামগুলোর উন্নয়ন ও নারীশিক্ষার জন্যে অর্থ বরাদ্দ করে যান। তিনি তাঁর আয়কৃত অর্থ থেকে শতকরা ৭৫ টাকা জন্মভূমি পাঁচদোনা গ্রামের দুঃখিনী, বিধবা, নিরাশ্রয় বালক-বালিকা, দরিদ্র বৃদ্ধ, নিরুপায় রোগী এবং নিঃসম্বল ছাত্র ও ছাত্রীদের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বিদ্যাশিক্ষার জন্যে দান করেন। তিনি নারী জাগরণের জন্যে দীর্ঘদিন ‘মহিলা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সে-পত্রিকায় বেগম রোকেয়া নিয়মিত লিখতেন। বেগম রোকেয়াকে গিরিশচন্দ্র স্নেহ করে ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন। দুজন দুই ধর্মের হলেও তাঁদের সম্পর্ক প্রকৃতই ছিলো মা ও ছেলের।


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক