Home Blog Page 7

আমীরগঞ্জের ইতিহাস | পর্ব ১

0

কিশোর ও তারুণ্যকালীন সাহিত্য পাঠের হিরণ্ময় দিনগুলিতে কখন যে হৃদয়ের মণিকোঠায় ইতিহাস-ঐতিহ্যও স্থান করে নিয়েছে, তা সত্যিই ভাবনার বিষয়। প্রাথমিক স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে সুলতানী ও মুঘল আমল সম্পর্কিত পাঠচর্চায় ঈসা খাঁ ও তাঁর মিত্র বারো ভূঁইয়া, চাঁদ রায়, কেদার রায়, মজলিস কুতুব ও গাজীপুরের ফজল গাজীর (পাহ্ লাওয়ান গাজীর বংশধর) নাম শুনেছি। মুঘলদের সেনাপতি মান সিংহের সাথে ঈসা খাঁ’র মল্লযুদ্ধের ছবি ও মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁ ও নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ’র ছবি পাঠ্যপুস্তকে দেখেছি। ১৯৮২ সালে ব্রাহ্মন্দী স্কুল থেকে সোনারগাঁয়ে শিক্ষা সফরে গিয়ে লোকশিল্প জাদুঘর ও ঈসা খাঁ’র আমলের পুরোনো জীর্ণ দালানকোঠা, পানাম নগর ও পুকুর-পরিখা পরিদর্শন করে জমিদার ও রাজা-বাদশাহদের ইতিহাস জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠি।

গ্রামের মুরুব্বিদের আড্ডা ও মজলিস থেকেও অনেক পুরোনো ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হয়েছি। বয়োবৃদ্ধদের মুখনিঃসৃত ঐতিহাসিক শ্রুতি, বংশপরম্পরায় চলে আসা কিংবদন্তী ও লোককাহিনিগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ইতিহাসের ভিত্তি ও কাঠামো এভাবে সংরক্ষিত হয়ে ইতিহাসবিদের চুলচেরা বিশ্লেষণ ও প্রামাণিক মানদণ্ডে ইতিহাস গ্রন্থিত হয়েছে। আমার গ্রামের মধ্যাংশে এরকম আড্ডা দুই জায়গায় ও দক্ষিণাংশে একটি আড্ডা বা মজলিস বসতো। সেখানে বেশি আলোচিত হতো বিগত ও চলমান রাজনীতি, পুরোনো দিনের দুর্ভিক্ষ, পুঁথিপাঠ, মাছধরা, গরুদৌড় ও গ্রাম্য কিংবদন্তী। মুচন্দালীর মুখে প্রথম শুনি, এই গাঁয়ের পূর্বনাম ছিলো ‘ঐছার চর’, যা পরবর্তী সময়ে আমীরগঞ্জ নাম ধারণ করে। যখন এখানে বসতিও গড়ে ওঠেনি, সে-কালে এখানে জাল্লাদের জালে প্রচুর ইছা (চিংড়ি) ধরা পড়তো। লোকমুখে প্রথমে ‘ইছার চর’ হিসেবে পরিচিত ছিলো এবং ইছা নামের অপভ্রংশ ‘ঐছার চর’ নাম ধারণ করে। পরবর্তীতে আমি ঢাকার জাতীয় আর্কাইভে এ-গ্রামের থাকবাস্ত জরিপের (পরগণা ম্যাপ, যা ১৮৫৬ সালে প্রণীত হয়) পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করলে ‘ঐছার চর’ নামের অস্তিত্ব খুঁজে পাই। কিন্তু পরে জানতে পারি, তা ছিলো নীলক্ষ্যার ঐছার চর। আমার গ্রামের আদি নাম ‘ঐছার চর’ কি না, তার প্রামাণিক তথ্য উদ্ধারের চেষ্টা এখনো চালিয়ে যাচ্ছি।

সুলতানী আমলে আমাদের আমীরগঞ্জ জনপদ মেঘনা ও আড়িয়াল খাঁ’র পানির নিচে ছিলো। তখন এ-জনপদের কোনো অস্তিত্বও ছিলো না। তবে এ-জনপদের মাইল দুয়েক উত্তরে পুরান কুঠির বাজার সন্নিহিত আড়িয়াল খাঁ’র উত্তর ও পশ্চিম অংশে (লাল বা গৈরিক মাটির অঞ্চল) মানব বসতি ছিলো। কারণ, সোনাইমুড়ি পাহাড়, যা এ-জনপদ থেকে মাইল তিনেক উত্তরে, তার পাদদেশের এক গ্রামে গভীর নলকূপ স্থাপনকালে কয়েকশো ফুট নিচ থেকে ধানের ছরা উঠে আসলে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ মনে করেন, দুই হাজার বছর পূর্বের এই গৈরিক ভূমিতে মানব বসতি ছিলো। কেননা, আমীরগঞ্জ থেকে প্রায় ১০ মিটার উঁচু গৈরিক এই ভূমি মধুপুর গড়ের বহিরাংশ।

বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের প্রাক্কালে পূর্ব বাংলায় মুসলিমদের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। পূর্বে এই এলাকায় মুণ্ডা, সাওতাল ও রাজবংশীদের বসবাস ছিলো। আশরাফপুরের সুলতানী আমলের মসজিদটি মুসলিম অস্তিত্ব বহন করে বটে।

দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক (১৩২০-১৩২৫)-এর সময় থেকে ইতিহাসের পাতায় সোনারগাঁয়ের নাম পাওয়া যায়। গিয়াসের পুত্র সুলতান মুহম¥দ তুঘলক (১৩২৫-১৩৫১)-এর সময় সোনারগাঁয়ের শাসনকর্তা ছিলেন বাহরাম খান (১৩২৮-১৩৩৮)। ১৩৩৮ সালের বাহরাম খানের মৃত্যুর পর তাঁর সিলাহদার (বর্ম-রক্ষক) ফখরউদ্দীন মুবারক শাহ শাসন ক্ষমতা দখল করে সোনারগাঁকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন। সুলতান ফখরউদ্দীন মুবারক শাহের আমলের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতার বাংলা সফর। তিনি সম্ভবত ১৩৪৬ সালে তাঁর রাজধানী সফর করেন। বাংলা ভ্রমণকালে ইবনে বতুতার বিবরণীতে রায়পুরা, নবীনগর ও নরসিংদী সদরের চর এলাকার গ্রামগুলোর নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও নান্দনিকতার চিহ্ন পাওয়া যায়। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘নিহালা’ থেকে জানা যায়, তিনি সোনারগাঁয়ের স্বাধীন সুলতান ফখরউদ্দীন মুবারক শাহের সময় ১৩৪৬ সালের জুলাই মাসে চাটগাঁও (চট্টগ্রাম) দিয়ে বঙ্গে প্রবেশ করে একমাসে কামরূপ ভ্রমণ করে সিলেটে হযরত শাহজালালের সাথে সাক্ষাত করেন এবং তিনদিন তাঁর আতিথেয়তা গ্রহণ করেন।

সিলেট থেকে সোনারগাঁ আসার পথে তিনি সুরমা নদী দিয়ে এসে এ-জনপদের অতি নিকটে মেঘনা নদী দিয়েই পনেরো দিনে সোনারগাঁ আসেন। তিনি মেঘনা নদীর দু’পাড়ের প্রাকৃতিক শোভায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। দিগন্ত বিস্তৃত শস্য ¶েত্র, নদীপথের বাঁকে বাঁকে গ্রাম ও কিছুদূর পরপর হাট-বাজার, চারিদিকে সবুজের সমারোহ দেখে তাঁর বিবরণীতে উল্লেখ করে মন্তব্য করেন, তিনি যেন বাগানের মধ্য দিয়ে চলেছেন। তিনি যখন সুরমা নদী পেরিয়ে আসছিলেন, তখন তাঁর অভিব্যক্তি এমন হয়েছিলো যে, মিশরের নীল নদের তীরভূমির স্মৃতিকথাই তাঁকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলো।

আমীরগঞ্জের মনুষ্যবসতি, ভূমিচাষ, জমিদার, তালুকদার, পত্তনীদার ও ভূমধ্যধিকারীর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
মুঘলদের পূর্ব বাংলা জয়ের পর সীমান্ত অঞ্চলের জেলাগুলোর ন্যায় ঢাকা জেলাও (সোনারগাঁ) বহিঃআক্রমণের শিকার হয়েছিলো। মুঘল যুগের প্রথমদিকে এ-জনপদে সবেমাত্র নদী ও জলাশয়ের উঁচু পাড়গুলোতে মনুষ্যবসতি গড়ে ওঠতে থাকে। বর্তমান রায়পুরা থানার আমীরগঞ্জ ইউনিয়নসহ পশ্চিমাঞ্চলীয়  আটটি ইউনিয়নের অধিবাসীগণ ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার করে ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার উদীয়মান চর ও উঁচু ভূমিতে নিজেদের আবাসস্থল নির্মাণ করে। তারা নিকটের ও দূরের জমিতে ধান, আখ, তিল, সরিষা ও বিভিন্ন সবজির চাষাবাদ করতো। নতুন শাসক মুঘলরা এসে বহিঃআক্রমণ থেকে বিজিত অঞ্চল রক্ষা ও রাজস্ব বৃদ্ধির জন্যে এ-জনপদের কতোগুলো মহাল (বর্তমান নরসিংদী জেলার মেঘনার উদীয়মান চরসমূহ, যেমন : জোয়ার হাসনাবাদ মৌজার হাইরমারা, দড়িহাইরমারা, চরমধূয়া, মধ্য মৌজার বিরগাঁও, আমীরাবাদ, লক্ষ্মীপুরা, গাজিপুরা, মরিয়মনগর, হাইরমারা, দড়িহাইরমারা, ফতেপুর, বীরকান্দি, আদিয়াবাদ, রহিমাবাদ, হাসনাবাদ) মুঘলদের সেনা ও উচ্চ রাজকর্মচারীর নিকট বন্দোবস্ত দেন।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ইংরেজ আমলে এ-জনপদের ভূমি বন্দোবস্ত (১৭৬৫-১৮৫৭)
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন এ-দেশীয় রাজবল্লভ, উমিচাঁদ, ঘসেটি বেগম, মীরজাফরসহ অনেকে লর্ড ক্লাইভের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পলাশীর প্রান্তরে দেশপ্রেমিক সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটায়। ফলে সুবিধাবাদী মুসলিম ও ষড়যন্ত্রপিয়াসী বর্ণহিন্দুদের জয়জয়কার হয়। মুঘল আমল থেকেই চতুর বর্ণহিন্দুগণ মুসলিমদের সহযোগী হিসেবে অভিনয় করে মুর্শিদাবাদের রাজকর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পেতে থাকে। ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৎকালীন মুঘল বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের নিকট থেকে বাংলা, বিহার ও ওড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে। পূর্বের মুঘল যুগে দেওয়ান ও সুবেদার মুর্শিদকুলি খাঁ তাঁর মালজামিনী রাজস্বনীতিতে বাংলায় ভূমি রাজস্ব আহরণে এক নবপ্রথার আনয়ন করেন। অধিক রাজস্বের আশায় তিনি অনেক সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের জমিদারি কেড়ে নিয়ে অমুসলিম হিন্দুদের নামে জমি বন্দোবস্ত দিতে থাকেন, যারা পূর্বে মুর্শিদাবাদে তাঁর সেরেস্তায় গোমস্তা পেশায় কর্মরত ছিলেন। এমন দুজন জমিদার ছিলেন ভাওয়াল জমিদার ও মুক্তাগাছার জমিদার। তাঁদের পূর্বের মুসলিম জমিদার ছিলেন গাজীরা ও ভাটির রাজা ঈসা খাঁ’র বংশধরদের বাইশ পরগণা। পরবর্তীতে লর্ড কর্নওয়ালিশ ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিধিতে ভাওয়াল রাজা ও মুক্তাগাছার জমিদারি পাকাপোক্ত করেন।

কোম্পানি আমল (১৭৬৫-১৮৫৭)
এ-সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দুটি ইতিহাস গ্রন্থ জেমস টেলরের ‘কোম্পানি আমলে ঢাকা’ ও উইলিয়াম উইলসন হান্টারের ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’। গ্রন্থ দুটি থেকে অবহিত হওয়া যায়, নবাব সিরাজের পরাজয়ের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের নিকট থেকে ২৫,০০,০০০ + ৫৫,০০,০০০ টাকায় বাংলা, বিহার ও ওড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে। শর্ত মোতাবেক, সম্রাট পাবেন ২৫,০০,০০০ টাকা এবং সুবে বাংলার নায়েব নিজামতের জন্যে খরচ হিসেবে পাবেন ৫৫,০০,০০০ টাকা। দেওয়ান রেজা খান কোম্পানির হয়ে দেওয়ানী পদ লাভ করেন। বাদশাহী লাখেরাজ বিধি ১৭৯৩ এবং অ-বাদশাহী লাখেরাজ ১৭৯৩ জারি করে কোম্পানি মুসলিম জায়গীরদার ও ধর্মীয় হিতকর কাজের নিমিত্তে প্রাপ্ত ভূমি (মুঘল সম্রাট কর্তৃক প্রদত্ত লাখেরাজ ভূমি) বন্দোবস্তকে নিয়ন্ত্রণ ও ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত করে দেয়। ফলে জরিপে দেখা যায় যে, পূর্ব বাংলায় শুধুমাত্র দুজন শরীফ মুসলিম ছাড়া কোনো মুসলিম জমিদার ছিলো না, তাঁরা ব্যতিত সকলেই হিন্দু জমিদার ছিলেন।

এখানে উল্লেখ্য যে, ভাওয়াল পরগণার জমিদার ছিলেন ফজল গাজী। তিনি পবিত্র হজ্বব্রত পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় গমনকালে তাঁর জমিদারি সূর্যাস্ত আইনে নিলামে উঠলে ভাওয়াল রাজার পূর্বপুরুষ মুর্শিদাবাদের রাজস্ব কর্মচারী থাকাকালে দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁ’র নিকট থেকে জমিদারি বন্দোবস্ত নিয়ে নেন। ঠিক তেমনই মুক্তাগাছার জমিদারের পূর্বপুরুষও মুর্শিদাবাদের রাজস্ব কর্মচারী থাকাকালে ঈসা খাঁ’র ২২ পরগণার আলাপ সিংসহ দুটি পরগণার জমিদারি ক্রয় করেন। নতুন হিন্দু জমিদারদের মধ্যে কয়েকজন পূর্বের মুসলিম জমিদারদের নায়েব ছাড়া সিংহভাগই ছিলো সুদী ব্যবসায়ী ও রাজকর্মচারী, যাদের জমিদারি পরিচালনায় কোনো অভিজ্ঞতাই ছিলো না।

কোম্পানি প্রথম পাঁচশালা ইজারা নীতিতে প্রথম বছরই বিহার থেকে রাজস্ব প্রাপ্ত হয় ৫০,০০,০০০ টাকা। কোম্পানি প্রথমে দেওয়ানী কাজে দ্বৈত নীতিতে দেশীয় অমাত্য রেজা খানকে নিয়োগ দেন। রেজা খানের কর্মচারীদের রাজস্ব ফাঁকি ও তছরুপের কারণে কোম্পানি অধিক মুনাফার আশায় এক বছরব্যাপী ইজারা দিতে থাকে। কিন্তু প্রাপ্তি কম হওয়ায় ইংল্যান্ড থেকে কোম্পানির হাল ধরতে আসেন ওয়ারেন হেস্টিংস। দ্বৈত শাসনের অবসান করে ১৭৭২ সালে রেজা খানকে বরখাস্ত করেন এবং দশশালা নীতিতে ভূমি বন্দোবস্ত দেন। তারপর লর্ড কর্নওয়ালিশ এসে দশশালা বন্দোবস্তকে ১৭৯৩ সালের বিধিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে ঘোষণা করে জমিদারদের জমির চিরস্থায়ী মালিক করে দেন।

পরগণা (তপ্পা রণ ভাওয়াল)
আমাদের এলাকায় প্রচলিত আছে যে, রায়পুরার ভূমি ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের আগপর্যন্ত ময়মনসিংহ কালেক্টরিতে ছিলো। কথাটি যে কতো অসত্য, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রতিককালে কেদারনাথ রচিত ‘ময়মনসিংহের বিবরণ’ নামক একটি পিডিএফ পুস্তক থেকে। উক্ত বিবরণ থেকে জানতে পারি, রায়পুরার প্রায় সমগ্র অঞ্চল পূর্বে ময়মনসিংহ কালেক্টরিতে ছিলো ঠিকই, তবে তা একটি তপ্পার অধীনে রণ ভাওয়াল পরগণার অন্তর্ভুক্ত হয়। আমাদের আমীরগঞ্জ, হাসনাবাদ মহালটি ঈসা খাঁ’র সময় মনুষ্যবসতির উপযোগী ছিলো না। মুঘলদের শেষ পর্যায়ে এখানে বসতি গড়ে ওঠে। বিবরণীতে উল্লেখ আছে : ভাওয়ালের উত্তর অংশের জমিদারী ভাওয়াল পরগণার অন্তর্ভুক্ত থাকিয়া আকবর শাহের সময়ে ভাওয়াল বাজু নামে পরিচিত ছিল। রাজস্ব-সচিব টোডরমল এই সমস্ত মহালের রাজস্ব ১৯,৩৫,১৬০ দাম বা ৪৮,৩৭৯/- নির্ধারণ করেন। ষোড়শ শতাব্দীতে ভাওয়াল পরগণায় বঙ্গীয় দ্বাদশ ভৌমিকের অন্যতম ভৌমিক ফজল গাজীর আবির্ভাব হয়। গাজী বংশ ইহার পূর্ব হইতে ভাওয়ালে আধিপত্য করতে ছিলেন। ডাঃ ওয়াইজ লিখিয়াছেন, খৃস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে পালওয়ান শাহের পুত্র কায়েম খাঁ দিল্লীর সুলতান হইতে ভাওয়াল পরগণার আধিপত্য গ্রহণ করিয়া লক্ষ্যা নদীর তীরে স্বীয় আবাসস্থল নির্ধারিত করেন। অতঃপর আকবর শাহের সময় ইহার বংশধর ফজল গাজী অপর একাদশ ভূমধ্যধিকারীর সহিত জোট বেঁধে সম্রাটের বিরুদ্ধাচারণ করিয়া স্বীয় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ঈসা খাঁ এই দ্বাদশ ভৌমিকের নেতা ছিলেন। ঈসা খাঁ আকবর শাহের বশ্যতা স্বীকার করিলে দ্বাদশ ভৌমিকের ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে যায়। অতঃপর তিনি (ঈসা খাঁ) ভাওয়াল পরগণার উত্তর অংশ (রণ ভাওয়াল) সম্রাট আকবর শাহীর নিকট থেকে নিজ বাইশ পরগণার সঙ্গে বন্দোবস্ত করিয়া আনেন। এই উত্তর অংশেই পূর্বে আকবর সেনাপতি রাজা মানসিংহের সহিত এগার সিন্ধুতে ঈসা খাঁর যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধ বা রণস্থল হইতে ভাওয়াল পরগণার এই অংশের নাম হয় রণ ভাওয়াল। ক্রমে ঈসা খাঁর বংশধরগণ রণ ভাওয়ালকে আলাপ সিংহের অন্তর্ভুক্ত করিয়া নিজ নিজ বিভাগ ক্রিয়া সম্পাদন করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের নবাবী আমলের কাগজপত্রে (নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর ১৭২৭ সন পর্যন্ত) রণ ভাওয়ালকে অন্তর্ভুক্ত তপ্পা বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। ঈসা খাঁর বংশের পর এই তপ্পা ঢাকার মোগলদিগের হস্তগত হয়, মোগলরা রণ ভাওয়ালের তালুকগুলোকে তাদের অনুগত মোগল ও ইরানীদের নিকট নওয়ারা তালুক হিসাবে বন্দোবস্ত দেন এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর পর্যন্ত, তাহাদিগের হস্তেই পরিচালিত হয়। ১৭৮৭ সনে এই তপ্পার (জমিদারী) ছয় আনা অংশ মহম্মদ করিম, ছয় আনা অংশ হোসেন আলী ও অবশিষ্ট চার আনা অংশ মহম্মদ আলীর নামে লিখিত ছিল। ইতিপূর্বে এই মহাল হইতে কয়েকটি বড় বড় তালুক বাহির হইয়া যাওয়ায়, মালিক গণের পক্ষে রাজস্ব চালাইয়া জমিদারী রক্ষা করা কঠিন হইয়া উঠে। অতঃপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর জমিদারীর অংশ রাজস্ব বাকীর জন্য নীলাম হইয়া যায় এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রাজস্ব বোর্ডের ১৭৯৪ সনের ২৬ শে ফেব্রুয়ারীর চিঠি অনুসারে ৩৪ টি তালুকসহ এই পরগণার (তপ্পা রণ ভাওয়াল) অংশ ঢাকা জেলার তৌজিতে পরিবর্তিত হয়। অতঃপর ইহার বাকী অংশ ত্রিপুরার কালেক্টরীর ভুক্ত হইয়া গিয়াছে। বর্তমান সময়ে ময়মনসিংহ জেলায় রণ ভাওয়ালের জমিদারীর কোন অংশ নাই। এই পরগণার মোট জমি ২,০৩,৫৪০ একর, পরিমাণ ফল ৩১৮.০৩ বর্গমাইল, ও গ্রাম সংখ্যা ২৭৯ টি।

বর্তমান সিএস পর্চায় আমীরগঞ্জ ইউনিয়নসহ রায়পুরা থানার পশ্চিমাঞ্চল এই তপ্পা রণ ভাওয়াল পরগণার অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাওয়া যায়। আবার রণ ভাওয়ালের কিয়দংশ বরদাখাত (যা পূর্বে বরদাখাল নামে অবহিত ছিলো) পরগণা হয়ে ত্রিপুরা জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে আবার ঢাকা কালেক্টরির তৌজিভুক্ত হয়। সর্বশেষ সিএস পর্চায় হাসনাবাদ, হাসনাবাদ বাজার, করিমগঞ্জ, আমীরগঞ্জ ও নলবাটা তালুকটি খারেজি তালুক হিসেবে খলিলুর রহমানের নামে রেকর্ডভুক্ত, যা ১৭৯৪ সালে ঢাকা কালেক্টরির তৌজিভুক্ত হয়। উল্লেখ্য, খলিলুর রহমানের তালুকটি ছিলো একটি স্বাধীন তালুক, যা মুঘল আমলে বন্দোবস্ত নেয়া। একে হুজুরী তালুক নামে ডাকা হতো। হুজুরী তালুকদারগণ জমিদারকে খাজনা না দিয়ে সরাসরি সরকার বাহাদুরকে খাজনা দিতেন এবং বংশানুক্রমে ভূমির মালিকানার অধিকারী ছিলেন। নওয়ারা তালুকের অন্য দুটি তালুক আমরা খুঁজে পাইÑ রহিমাবাদ ও মির্জানগরের মির্জা মুহাম্মদের খারেজি তালুক অন্যটি বালুয়াকান্দি ও আব্দুল্লাপুরের মীর আলী বা আমীর উদ্দিন হায়দার জমিদারের তালুক। মীরগণ ছিলেন মুঘল নৌ-অধ্যক্ষ। মীরদের অধীনে অনেক নৌ-সৈন্য থাকতো। পরবর্তী মুঘল সুবেদারদের অসম রাজ্য, কামরূপ ও ত্রিপুরা অভিযানে এখানকার নৌ-সেনাগণ অংশগ্রহণ করেন।

ভূমি বন্দোবস্তপ্রাপ্ত তালুকদার ও জায়গীরদারগণ সকলেই শরীফ মুসলিম ও মুঘলদের অমাত্য/ওমরাহ ছিলেন এবং তারা ইরান ও মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে ভাগ্যান্বেষণে মুঘল দরবারে চাকুরির সুবাদে আসেন। খলিলুর রহমানের তালুকের হাসনাবাদ বাজারস্থ তিনটি সিএস পর্চা (যার খতিয়ান নং যথাক্রমে ৩৭৫, ৩৭৬, ৩৭৭ এবং প্রত্যেকটির উপরে স্বত্বের কলামে লেখা আছে ‘ভারত সম্রাট’) থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি মুঘল আমলের জায়গীরদার। এসব তালুক ১৮০২ সালের পূর্বের ছিলো এবং এরপর আর কোনো স্বাধীন তালুকের সৃষ্টি হয়নি। কারণ, এরপর থেকে ব্রিটিশ শাসকগণ এই স্বাধীন ও হুজুরী তালুকগুলো নানা অজুহাতে বাদশাহী ও অ-বাদশাহী লাখেরাজ বিধি ১৭৯৩ জারি করে অধিগ্রহণ করে অন্যদের বরাদ্দ দিয়ে দেন। এতে শরীফ মুসলমানগণসহ মধ্যবিত্ত পরিবারে ধস নেমে আসে। পরবর্তীতে আমাদের আমীরগঞ্জ জনপদটি এই রণ ভাওয়াল হিং-এর একটি তপ্পার অন্তর্ভুক্ত হয়।


আমির হোসেন
গবেষক, আয়কর পরিদর্শক

সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্র বিনিময়

সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য (পঞ্চতীর্থ) একাধারে একজন পণ্ডিত, ইতিহাসকার, নাট্যকার, ভাষাবিদ। গ্রামের ছাত্রটোলের পণ্ডিত ছিলেন। বাস করতেন গ্রামেই। বিশ শতকের যে-সময়ে তাঁর বিচরণ, সে-সময়ে ইতোমধ্যে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য আধুনিক যুগ অতিবাহিত করছিলো।

জন্মেছেন ১২৯৮ বঙ্গাব্দে, খ্রিস্টসন অনুসারে ঊনিশ শতকের শেষার্ধে, তৎকালীন মহেশ্বরদী পরগণার অজপাড়াগাঁ আলগিতে। বর্তমানে এটা নরসিংদী জেলার মাধবদী পৌরসভায় পড়েছে। এই গ্রামেই তাঁর বসবাস ও পণ্ডিতি করেছেন মৃত্যু অবধি। অবশ্য তাঁর মৃত্যু ঘটেছিলো ঢাকায়, ১৩৬১ বঙ্গাব্দে।

স্ত্রী ও কন্যার সাথে সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থ, সময়কাল ১৯২৯/৩০

‘পূর্ব্ববঙ্গে মহেশ্বরদী’ তাঁর বহুল পঠিত নন্দিত ইতিহাস-গ্রন্থ। এই গ্রন্থের সাথে সমকালীন পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন শেকড় সন্ধানী লেখক হিসেবে খ্যাত সরকার আবুল কালাম (মৃত্যু : ৩০ আগস্ট ২০২১)। সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থের কোনো গ্রন্থেরই তেমন খোঁজ-খবর পাওয়া যায় না। অবশেষে এই অঞ্চলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক নানা উপাদানসমৃদ্ধ এই ইতিহাস গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায় দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক শাহাদাত হোসেন মন্টুর কল্যাণে, যা পরে সরকার আবুল কালাম সম্পাদনা করেছেন সমকালীন পাঠকদের জন্যে। সেই সাথে এই গ্রন্থের কল্যাণে তাঁর আরো ২৬ টি গ্রন্থের নামের সন্ধান পাওয়া যায়। একনজরে তাঁর গ্রন্থরাজির দিকে চোখ বুলানো যাক :

১. বেদশতক (চারি বেদের একশত শ্রেষ্ঠ মন্ত্রের তাৎপর্য);
২. আদর্শ হিন্দু বিবাহ;
৩. বঙ্গ-গৌরব হোসেন শাহ (পঞ্চাঙ্ক নাটক);
৪. ভক্তের ভগবান (ছেলেদের নাটক);
৫. আত্মদান (ছেলেদের নাটক);
৬. দক্ষিণা (ছেলেদের নাটক);
৭. ছাত্র জীবনে শক্তি সঞ্চয়;
৮. ব্রাহ্মণ ও হিন্দু;
৯. গৃহস্থের শ্রীকৃষ্ণ সাধন;
১০. বিশ্ব-বীণা (বাংলা কবিতা);
১১. বিশ্ব-বীণা (সংস্কৃতে আবৃত্তি);
১২. যুগের মশাল জ্বালল যারা (কবিতা);
১৩. বরযাত্রী বা কন্যাদায়;
১৪. গোধন;
১৫. সমাজ;
১৬. ব্রাহ্মণ;
১৭. তীর্থরাজ;
১৮. প্রাচীনযুগে সমরবিজ্ঞান;
১৯. বানান সমস্যা সমাধান;
২০. ভ্রমণে সাহিত্য;
২১. সংহিতা যুগের সভ্যতা;
২২. ছেলেদের গল্প;
২৩. বড়দের গল্প;
২৪. অনার্য্য বিজয় (পঞ্চাঙ্ক নাটক);
২৫. বিবিধ প্রবন্ধ ও
২৬. পূর্ববঙ্গে মহেশ্বরদী।

‘পূর্ব্ববঙ্গে মহেশ্বরদী’ একটি আকর গ্রন্থ। ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টালে গন্ধ পাওয়া যায় সে-সময়কার মাটির ঘরের মাটির মানুষদের। ডোয়াই, গারুতি, খালোমালোদের জীবনাচার ও সংগ্রামী জীবন। খুঁজে পাওয়া যায় আমাদের পূর্বপুরুষদের যাপিত জীবনচিত্র, লোকাচার, ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-আচরণের। মনে হয় সুরেন্দ্রমোহনের চেতনায় ঐতিহাসিক সত্যের চেয়ে মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে চলমান জীবন। সেই সময়ের বাস্তবতায় জীবন ছিলো নদীকেন্দ্রিক। যে-এলাকায় সুরেন্দ্রমোহনের বসবাস, সেই এলাকার পূর্বদিকে বহমান মেঘনা, যা মেঘনাদ বা মেঘন নামে পরিচিত ছিলো। পশ্চিমদিকে শীতলক্ষ্যা আর প্রায় মধ্যভাগ দিয়ে বয়ে গিয়েছে এক সময়ের খরস্রোতা ও ভয়ঙ্কর নদ ব্রহ্মপুত্র। তার শাখা হাড়িধোয়া, আড়িয়াল খাঁ। আজকের ব্রহ্মপুত্র দেখে সেই চিত্র কল্পনা করা কঠিন।

প্রফেসর মনিরুজ্জামান ‘মহেশ্বরদীর ইতিহাস’ সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেন, “আঞ্চলিক ইতিহাস রাজনৈতিক ইতিহাস অপেক্ষা ভিন্ন এবং সে কথা রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার প্রমুখের ঐতিহ্য ভাঙতে গিয়ে নীহাররঞ্জন রায় তাঁর প্রথম জীবনে ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ লিখে প্রমাণও করেন। তারপর থেকে ইতিহাস রচনার ধারাকে যাঁরা এগিয়ে নিয়ে এসেছেন সেই সোনার গাঁ, বিক্রমপুর, ময়মনসিং ভাওয়াল প্রভৃতি পরগণার ইতিহাসকারদের কথা এ গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। অধ্যাপক সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থের অবদানও তাঁদেরই তুল্য। এদের হাতে ইতিহাস রচনার যে আদর্শ গড়ে ওঠে তা জেলা গেজেটিয়ার ও বিভিন্ন ভৌগোলিক ও স্থানিক পরিচিতিমূলক গ্রন্থেও অনুসৃত হতে দেখা যায়।”

সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থ ভাষাবিদ ও ব্যাকরণবিদ হিসেবে কতোটা পণ্ডিত ছিলেন, তৎকালীন তাঁর নিজের সময়ের সাহিত্য-ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে কতোটা প্রাজ্ঞ ছিলেন, তা আমরা সম্প্রতি আবিষ্কার করেছি  বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাঁর পত্রবিনিময়ের দুর্লভ তথ্যাবলি ও পত্রপাঠ করার মাধ্যমে।

গত শতকের তিরিশের দশকে এই পত্র বিনিময় ঘটেছিলো। তার মধ্যে দুটি পত্র নিয়ে কথা বলাই আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয়।

আমরা এই পত্র বিনিময়ের তথ্যটি পাই সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থের নাতি সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কল্যাণে। সুরেন্দ্রমোহনের তিন পুত্রের মধ্যে মধ্যম পুত্র হলেন সুখেন্দ্র ভট্টাচার্য। তিনি একজন প্রথিতযশা লেখক ও প্রাবন্ধিক ছিলেন। মূলত তিনি তাঁর সম্পাদিত এক গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুরেন্দ্রমোহনের পত্র বিনিময়ের আলাপ তোলেন এবং দুটি পত্র উক্ত গ্রন্থে ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। আর সেই সাথে ইতিহাসের এক দুর্লভ ঝাঁপি খুলে দেন।

এই পত্র বিনিময়ের মহৎ কর্ম ঘটেছিলো ১৯৩৬ সালে। সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থ রবীন্দ্রনাথকে প্রথমে এই পত্র লেখেন রবীন্দ্রনাথের বিশেষ গ্রন্থ পাঠপূর্বক ভাষা ও বানান সংক্রান্ত প্রমাদের জন্যে।  রবীন্দ্রনাথ সেই পত্রের উত্তরও দেন। আমরা রবীন্দ্রনাথের পাঠানো উত্তরসম্বলিত দুটি পত্রই পেয়েছি কেবল।

সুরেন্দ্রমোহনকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের পত্র (পাতা ১ ও ২)

সুরেন্দ্রমোহন রবীন্দ্রনাথকে মহাকাব্য রচনার কথা বলেছিলেন সম্ভবত। রবীন্দ্রনাথ তার উত্তরে লেখেন, “…মহাকাব্য রচনা আমার আয়ত্তের অতীত, সেই কারণেই সহজেই তাহাতে আমার প্রবৃত্তি হয় নাই। মহাকাব্য সম্বন্ধে আমার অশ্রদ্ধা নাই, অক্ষমতা আছে।”

রবীন্দ্রনাথের এই স্বীকারোক্তি মহাকাব্য সম্বন্ধে তাঁকে জানা-বোঝার ক্ষেত্রে মূল্যবান মন্তব্যের দলিল হয়ে রইলো।

দ্বিতীয় পত্রে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় শব্দের বানানগত ভুল, সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ এমনকি কবিতার পঙক্তি বিভ্রম নিয়েও আলাপ তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ প্রত্যেকটি বিষয়ের যথাযথ জবাব দিয়েছেন। আমরা অবশ্য রবীন্দ্রনাথের পত্র দেখিয়াই সুরেন্দ্রমোহনের পত্রের বিষয় উপলব্ধি করে কথা বলছি।

সুরেন্দ্রমোহনকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের পত্র

সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থ একজন বহুভাষাবিদ পণ্ডিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যে তা সম্যক বুঝেছিলেন, তা তাঁর প্রত্যুত্তর দেখেই বোঝা যায়।

দুটি মূল্যবান পত্রেরই সন তারিখ উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ।  এই হিসেবে সময়কাল সম্পর্কে ধারণা করে সুরেন্দ্রমোহন ও রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে গবেষকেরা প্রভূত উপকৃত হবেন, সন্দেহ নেই।

পত্রদুটির সাথে খামও উক্ত সস্পাদিত গ্রন্থে ছেপেছেন সুখেন্দ্র ভট্টাচার্য। আমরা খামের উপরে দেখতে পাই ‘আলগি, পো. মাধবদী’। রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে লিখিত ‘মাধবদী’ অবশ্যই মাধবদীবাসীর জন্যে বিরাট পুলকের বিষয় হতে পারে।

সুরেন্দ্রমোহনকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের পত্রের খাম

রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের এমন এক মহীরুহ যার সঙ্গে সমকালীন কবি-লেখক-পাঠক-গুণগ্রাহী সবার সাহিত্য সংশ্লিষ্ট বহুমাত্রিক যোগাযোগ ঘটেছিলো চিঠিপত্র আদান-প্রদানকে কেন্দ্র করে। আমরা রবীন্দ্রজীবনী এবং সমকালীন ও পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের কবি-লেখকদের জীবনী ও চিঠিপত্র সংকলন থেকে এসব তথ্য জানতে পারি। একদম অজপাড়াগাঁর লেখক-পাঠকদের পত্রের জবাবও রবীন্দ্রনাথ সমান গুরুত্ব সহকারে প্রদান করতে কুণ্ঠা বোধ করেননি।

আমাদের সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থ এমন একজন ভাষাবিদ পণ্ডিত লেখক ছিলেন যে, বিশেষত রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’য় ছাপা হয়ে যাওয়া কবিতার পঙক্তি বিভ্রম নিয়েও যিনি আলাপ তুলতে পারেন। তাঁর পত্রের জবাব রবীন্দ্রনাথ সম্মান ও গুরুত্বের সাথে দেবেন, এটাই কাঙ্ক্ষিত।

এই ঐতিহাসিক গুরুত্ববাহী পত্র বিনিময়ে গবেষকদের জন্যে নানা উপাদান তো রয়েছেই, নরসিংদীবাসী তথা মাধবদীবাসীর জন্যেও রয়েছে প্রভূত মর্যাদা ও ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকার বিরল অর্জন।