Home Blog Page 7

নরসিংদীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুঃখের জারি এবং প্রাসঙ্গিক কথা

যেকথা নানাভাবে বলা হয়েছে
এই শতাব্দীর গোড়া থেকে কিংবা আরো আগে থেকেই পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয়ে আসছিলো, ‘নরসিংদীতে বিশ্ববিদ্যালয় চাই’। বর্তমান শতকের গোড়ায় সংসদে দেশে ১২ টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা প্রস্তাবিত হলে তার মধ্যে একটি নরসিংদীতে হবে— এই প্রত্যাশা করা হয়েছিলো। তদুপরি ঢাকার অদূরে পূর্বাচলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস করার প্রস্তাব উঠলে অগত্যা সেটিও যাতে নরসিংদীতে করা হয়, সে-দাবিও রাখা হয় এবং তজ্জন্যে নরসিংদীর অদূরে বিশ্ববিদ্যালয় করার উপযোগী একটি পতিত জমিদার বাড়ি ও তার খাসজমি (পতিত)-র কথাও উল্লেখ করে দেখানো হয় (দ্রষ্টব্য : নরসিংদী জেলা কর্তৃপক্ষের নিকট সরকারি নজরে আনার জন্যে উক্ত বিষয়ক পেশকৃত পত্র, তারিখ— ১২.১১.২০০৮)। পরবৎসর পুনরায় এ-ব্যাপারে ‘নরসিংদী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন পরিষদ’-এর পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সাথে সাক্ষাত করে তাঁর বরাবরও আবেদন করা হয় এবং তাতেও বিস্তৃত করে বলা হয় যে, “প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার খ্যাত মাধবদী (বাবুরহাট) বাজার সংলগ্ন ঐতিহাসিক বালাপুর জমিদার বাড়িটি ও তৎসংলগ্ন প্রায় ২ (দুই) হাজার বিঘা খাসজমি অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে প্রায় তিন শতাব্দী ধরে। এখানে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের সকল প্রকার অবকাঠামো বিদ্যমান। এই ঐতিহাসিক বাড়িটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় ক্যাম্পাস নির্মাণের সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান; এখানে তা করা হলে ভূমি ক্রয় করার জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হবে না। বরং তা সাশ্রয় হবে। অপরদিকে অন্যভাবে জমি অধিকৃত করতে গেলে বহু মূল্যবান আবাদী জমির ও কৃষকের ঘরবাড়ির ক্ষতি সাধন অবশ্যম্ভাবী।” (আবেদনের তারিখ : ১৯.০১.২০০৯)

আবেদন প্রয়াসের ধারা
বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি যেমন রাজনৈতিক দাবি, তেমনি যথাকর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনারও বিষয়। কিন্তু প্রথম থেকেই আমরা যারা এই দাবি নিয়ে লেখালেখি করছি বা দাবিটা তুলতে বা দেশবাসীকে বোঝাতে চেষ্টা করছি, তারা কেউ সক্রিয় রাজনীতিক নই। পেশাগতভাবে আমাদের কেউ শিক্ষক, কেউ চিকিৎসক, কেউ ছাত্র, কেউ ব্যবসায়ী এবং অনেকে হয়তো চাকুরিজীবী হয়েও লেখক মাত্র। একটা সাধারণ চিন্তা, দেশপ্রীতি ও দায়িত্ববোধ থেকে অনুভূত কিছু অসুবিধার কারণেই আমরা প্রথমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একত্র হই ’৮০-র দশকের দিকে। তারপর থেকেই বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জনের সাথে দেখা করে, করণীয় বিষয়ে সকলের বুদ্ধি, পরামর্শ ও উপদেশমতো উপযুক্ত স্থানে যথাপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপস্থিত করতে থাকি এবং পত্র-পত্রিকায়ও নরসিংদীর মতো স্থানের ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক গুরুত্বের কথা এবং বিশেষভাবে এখানকার ছাত্রদের সমস্যার কথা উল্লেখ করে নরসিংদীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্যে আবেদন জানাতে উদ্যোগী হই। এভাবেই আমরা আমাদের নতুন জেলার দরিদ্র ছাত্র ও অভিভাবকদের দুঃখ ও কষ্টগুলি সকলের গোচর করার বা জানাবার উদ্দেশ্যে অদ্যাবধি চেষ্টা করে আসছি।

এসব ছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংদীর ছাত্রদের নিয়ে আমরা বিভিন্ন সভা-সম্মেলনে এর প্রয়োজনীয়তার কথা বহু শতবার আলোচনা করেছি। নরসিংদীতেও এ নিয়ে সংবাদ-সম্মেলন করেছি একাধিকবার। এসব সংবাদ বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় পত্র-পত্রিকায় এবং প্রচারিত পত্রে ও পোস্টারে হয়তো অনেকেই লক্ষ্য করে থাকতে পারেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নরসিংদী ছাত্র সমিতি
’৮০-র দশক থেকে এই চিন্তাটা বিশেষভাবে কাজ করলেও নবসৃষ্ট নরসিংদী জেলার শিক্ষার্থীদের সমস্যার প্রতিকার ও দৃষ্টিপাত ঘটাতে এই আবেদনটিকে শেষে একটা আন্দোলনের পর্যায়ে গ্রহণ করার উদ্যোগ নেয়া শুরু হয়। এর পেছনে যেসব বাস্তব কারণ ছিলো, সেগুলো হলো : ১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া বেশ দুরূহ হয়ে ওঠছিলো; ২. ঢাকায় থাকা-খাওয়ার খরচ সাধারণ ছাত্রদের জন্যে আর্থিক ও সার্বিক ব্যবস্থার দিক থেকে ছিলো বহুগুণ কষ্টের বা দুর্বহ বিশেষ এবং ৩. একইভাবে কষ্টের মাত্রা বেড়ে ওঠছিলো ঢাকার বাইরে (চট্টগ্রাম) যারা যেতে বাধ্য হচ্ছিলো, তাদের।

১৯৭৭ সালে আমি পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরলেও সেই সময় নরসিংদী থানা প্রথম মহকুমায় উন্নীত হয়েছিলো বলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংদীর ছাত্রদের শিক্ষাকষ্ট দূর করার বিষয়ে কিছু করার জন্যে ব্যক্তিগতভাবে আমার মধ্যে একটা চিন্তা কাজ করতে থাকে। এর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে CURDP বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্পের শিক্ষা পরিচালক হিসেবে এবং নরসিংদীতে আমার নিজ গ্রামেও বেশ কিছু সামাজিক কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। এসব কারণে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নরসিংদী ছাত্র সমিতি’ গড়ে ওঠলে তার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আমি নরসিংদী থেকে আগত ছাত্রদের সমস্যাগুলি নিয়ে কাজ করার কথা ভাবি। তার মধ্যে অন্যতম তাদের চট্টগ্রাম আসা, থাকা ও ভর্তির বিষয়গুলি নিশ্চিত করা। ক্রমে তার সাথে যুক্ত হয় নরসিংদীতে চিটাগাং মেইল ট্রেনের স্টপেজ করার দাবিও, যাতে ছাত্রদের চিটাগাং আসা-যাওয়ার কষ্টটা লাঘব হয়। এসবের সমাধান দুঃসাধ্য না হলেও যথেষ্ট ব্যয়বহুল, কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ ছিলো। শেষে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তাটাই প্রধান হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে নরসিংদী জেলায় পরিণত হয় (১৯৮৪ সালে) এবং আমাদের আশা-স্বপ্নও বৃদ্ধি পায়। পরে বিশেষত অনুষদের ডিন থাকাকালেও নরসিংদীর ছাত্রদের কষ্টটাকে আরো কাছ থেকে ও স্পষ্ট করে বুঝতে সক্ষম হই। এবং বিষয়টি নিয়ে আরো নানা জনের সঙ্গে মিলে বৃহত্তর পরিসরে কাজের বাস্তবায়নে এগিয়ে আসি।

বাস্তব পরিস্থিতির কারণেই এইভাবে অচিরে আমাকে উপদেষ্টা করে ডাক্তার হাসান এবং শ্রীক্ষণরঞ্জন রায় ‘নরসিংদী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন পরিষদ’ গঠন করে এবং নরসিংদীতে প্রেস কনফারেন্স আহ্বান করে।

এছাড়াও এই পরিষদ বার্ষিক সম্মেলন করে স্বাক্ষরতা গ্রহণসহ রক্তদান, চক্ষুশিবির, দন্তপরীক্ষা ও সেবা প্রভৃতি নানা সামাজিক কার্যক্রম নিয়মিত পরিচালনা করতে থাকে। উদ্দেশ্য ছিলো আমাদের দাবিটিকে সাধারণের মধ্যে ছড়ানো ও তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এসব অনুষ্ঠানে নরসিংদী জেলার বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে যেমন নরসিংদীর শিক্ষাদাবি উপস্থাপন করা হয়েছে, তেমনি অভ্যাগত সকলেই আমাদের দাবির স্বপক্ষে বা অনুকূলে মন্তব্য প্রকাশ ও উপদেশ প্রদানসহ সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতিও প্রদান করেছেন।

এভাবে পর্যায়ক্রমে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সচিবালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, নরসিংদীর জনপ্রতিনিধিদের দপ্তর এবং সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রীবর্গের কার্যালয় তো বটেই, সংশ্লিষ্ট আরো নানা জনের সাথেও দেখা-সাক্ষাত করে ও প্রত্যেকের কাছে আমাদের লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করে এবং প্রয়োজনীয় স্মারক পেশ করে নরসিংদীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা যথাসাধ্য বোঝাবার চেষ্টা করেছি। এ-ব্যাপারে সকলের আন্তরিক সহযোগিতার আশ্বাসে বিগত প্রায় ২৫ বছর ধরে আমরা আমাদের এই প্রয়াস-প্রচেষ্টা অব্যাহতভাবে চালিয়ে আসছি।

আবেদনসমূহে উল্লেখিত বক্তব্য
আমাদের বক্তব্যের মধ্যে আমরা সব সময় এই কথাটাই বলতে চেয়েছি যে, নরসিংদী তার সমৃদ্ধ ইতিহাস সত্ত্বেও শিক্ষাগত দিক থেকে একটি অবহেলিত জনপদ। অনেক আন্দোলন করে এবং স্থানীয় সিনেমা হল, রেলস্টেশন এবং বাজারের তোলা তুলে স্থানীয় নেতৃত্বের সহযোগ-সহায়তায় স্বাধীনতার আগে নরসিংদী কলেজটি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় এবং অনতিকালে সরকারিকরণসহ তার আরো উন্নতি করাও সম্ভব হয়। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, এখনো পর্যন্ত এখানকার শিক্ষার পরিস্থিতি এবং চাহিদার বিষয়টি নিয়ে কেউ বিশদভাবে বিবেচনা করে করণীয় কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। উচ্চশিক্ষার জন্যে এখানকার ছেলেমেয়েরা কতোটা কষ্ট করছে, সেটি সবার অগোচরেই থেকে যাচ্ছে। লক্ষ্য করলে সহজেই বোঝা যায়, পূর্বে কিশোরগঞ্জ এবং পূর্ব-দক্ষিণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পশ্চিমে রেলপথে টঙ্গী পর্যন্ত প্রায় তিন জেলা এবং কোরানের প্রথম অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন এবং বাংলা ও আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি জগতের পুরোধা সত্যজিৎ রায়-অতুলপ্রসাদ প্রমুখের মামাবাড়ি-ফুপার বাড়ির এলাকা পাঁচদোনা-রূপগঞ্জ-সোনারগাঁ এলাকা ধরে নিয়ে মেঘনার এপাড়-ওপাড়ব্যাপী ব্রাহ্মণবাড়িয়া- কুমিল্লা-নারায়ণগঞ্জের বহিঃপ্রান্তভাগজুড়ে তথা নরসিংদী সংলগ্ন এক সুবিশাল এলাকার মধ্যে অতীতেও কখনো উচ্চশিক্ষার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি, এখনো তেমনি তার কোনো ব্যত্যয় ঘটছে না। বর্ণিত এই এলাকার মধ্যস্থান হচ্ছে নরসিংদী। নরসিংদীর স্থানগত গুরুত্ব একাধিক কারণে। এটি একটি প্রাচীন সভ্যতার পীঠস্থান, মসলিনের জন্মভূমি এবং আমধ্যযুগ বিখ্যাত পাটকেন্দ্র ও বাণিজ্যিক এলাকা। মধ্যযুগের কবি গৌরবনরসিং ওঝা এবং পশ্চিমবঙ্গে অভিবাসিত কৃত্তিবাস ও ভারতচন্দ্রের উত্তর বংশধারার চিহ্ন জিনারদীর পুরাণ-অনুবাদক কবি ষষ্ঠীবর শর্মা ও তৎপুত্র গঙ্গাদাসের কথাও এখানে আমরা স্মরণ করতে পারি। নরসিংদীর বাউল মেলাও এর আরেকটি ঐতিহ্যিক স্মারক।

ঢাকা শহরের পরেই প্রশাসনিক, ঐতিহাসিক এবং সংস্কৃতিগত গুরুত্বে নরসিংদীর অবস্থান। অথচ শিক্ষা-দীক্ষার দিক থেকে এলাকাটি অনেক পেছনে। শুধু কয়েকটি স্কুল-কলেজের বাতাবরণ দিয়ে শিক্ষানগরী বা শিক্ষাএলাকা সৃষ্টি হয় না। ঢাকায় ভর্তি হতে না পেরে এখানকার ছাত্ররা যে-অমানুষিক কষ্ট স্বীকার করে চট্টগ্রামে বা সিলেটে ভর্তি হতে যায় এবং সেখানে যাতায়াত ও থাকার ব্যবস্থা করতে গিয়ে যে-অমানুষিক, শারীরিক ও আর্থিক কষ্ট মেনে নিতে বাধ্য হয়, সেই অবর্ণনীয়তা কি তাতে স্পষ্ট হয়? এসব কথা বহু বহুবার যথাকর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছাবার চেষ্টা আমরা করেছি, সে-কথা আগে বলা হয়েছে। এক কথা বারবার বলা হলে তা যে কর্ণকুহরের মধু হয়ে ওঠে, অন্তত আমাদের সে-অভিজ্ঞতা হয়নি। নরসিংদীর ভাগ্য যে-তিমিরে ছিলো, সেই তিমিরেই আছে আজো।

সংবাদপত্রে নরসিংদী বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মূল বক্তব্য
পত্রিকার মাধ্যমে জোর লেখালেখি শুরু হয় এই শতাব্দী বা সহস্রাব্দ থেকে। তাতে যাঁরা দাবি করছিলেন, তাঁরা সকলেই যে নরসিংদীর, তা নয়। কেউ কেউ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের, কেউবা আরো দূরের। ঢাকার ফরিদাবাদ থেকে এক মহিলা (বা ছাত্রী)-ও লিখেছেন, যা আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। অবশ্য অধিকাংশ লেখাই প্রকাশিত হয়েছে চট্টগ্রামের (আজাদী : ২১ সেপ্টেম্বর ২০০৬, ২১ নভেম্বর ২০০৬, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১, ২৬ জুলাই ও ৯ সেপ্টেম্বর ২০১২; সুপ্রভাত বাংলাদেশ : ২০ সেপটেম্বর ২০০৬; ২১ আগস্ট ২০০৮, ৭ এপ্রিল ২০১১, পূর্বকোণ : ৩০ এপ্রিল ২০১৩; দৈনিক কর্ণফুলী : ১ সেপ্টেম্বর ২০০৬ ও ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৬; ডেসটিনি : ২৪ মে ২০০৮; চট্টগ্রাম মঞ্চ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৬ প্রভৃতি) এবং ঢাকার (দৈনিক প্রথম আলো : ৮ আগস্ট ২০০৬, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৬, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১১; আজকের কাগজ : ১৮ অক্টোবর ২০০৬; দিনকাল : ২৪ জানুয়ারি ২০০৭; যায়যায়দিন : ২৮ অক্টোবর ২০০৮; ভোরের কাগজ : ২৮ জানুয়ারি ২০১১; দৈনিক জনতা : ১০ অক্টোবর ২০০৬, ১০ মার্চ ২০১১; খবর : ১১ ফাল্গুন ১৪১৭; দৈনিক রূপালী : ৩০ আশ্বিন ১৪১৩; নয়াদিগন্ত : ১৫ জুলাই ২০০৬, ১০ অক্টোবর ২০০৬; মানবজমিন : ৭ অক্টোবর ২০০৬; আমাদের সময় : ৭ অক্টোবর ২০০৬; দৈনিক আল আমীন : ১১ নভেম্বর ২০০৮ প্রভৃতি) পত্রিকাগুলিতে। এসব কাগজে ফিচার-নিবন্ধ আকারে বা দাবিপত্র আকারেও অনেকে লেখেন। নরসিংদীর স্থানীয় কাগজও এ-বিষয়ে পিছিয়ে ছিলো না। তাদের মধ্যে অন্যতম সাপ্তাহিক নরসিংদীর বার্তা, নরসিংদীর কণ্ঠ, নরসিংদীর খবর, নরসিংদীর চোখের আলো, খোঁজ-খবর ও মাটির পুতুল। এছাড়া নরসিংদীর আদিয়াবাদের গবেষণা-প্রতিষ্ঠান ‘আদিয়াবাদ সাহিত্য-ভবন ও ভাষাতত্ত্ব-কেন্দ্র’র মুখপত্র তথা নরসিংদীর তথ্যপত্র ‘নিসর্গ-বার্তা’র একাধিক সংখ্যায় এ-বিষয়ে তথ্য দেয়ার চেষ্টা আছে।

এসব চিঠিপত্র, আবেদন, প্রতিবেদন ও দাবিনামা, যা উল্লিখিত পত্র-পত্রিকাগুলিতে প্রকাশিত হয়েছে এবং অব্যাহতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে, সেসবে এই বন্দর বা বাণিজ্যকেন্দ্রের পশ্চাদ্ভূমি (হিন্টারল্যান্ড)-এর বিবরণ এবং তার গুরুত্বের কথাও উঠে এসেছে যথামূল্যায়নসহ। তাতে উল্লেখিত হয়েছে যে, নরসিংদী আবহমানকাল থেকেই যেমন ধান-পাট-কলা-আখ-কাঁঠাল এবং মেঘনার জলশস্য-সমৃদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়-কেন্দ্র, তেমনি বাংলাদেশের অন্যতম ঐতিহাসিক ‘সাইট’ উয়ারী-বটেশ্বরের পশ্চাদ্ভূমি ও প্রাচীন চীন-উপনিবেশ গ্রাম চিনিশপুর ও মাধবদী-বাবুরহাটের নব্য বস্ত্রশিল্পের অতীত রুমাই শহর (রোম), ইতালি ও মিশর-বাইজেন্টাইন নন্দিত মসলিনের ইতিহাস-হারা হতভাগ্য অঞ্চলও। এই প্রাচীন ইতিহাস ও পটভূমি নিয়ে নরসিংদীর মতো স্থান শুধু নতুন জেলা (১৯৮৪ সালে) হওয়ার কারণে আজ তার কোনো দাবির প্রতিই দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন বোধ করছে না কেউ। তাছাড়া প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো, ঢাকার শহরতলীরূপে গড়ে ওঠা এই নরসিংদীর বেলায় শিক্ষা ক্ষেত্রে অন্ধকার যেন আরো বিশেষভাবে তার জন্মগত অধিকার ও অর্জন হয়ে ওঠেছে। পত্রিকা কেন, গিল্টি মারা মহাহ্রস্ব কর্ণকুহরের প্রান্তে বসে যদি সারা নরসিংদীবাসী আকাশ কাঁপানো কোনো মহাক্রন্দসী ভেঁপু বাজাতে শুরু করেন, তাহলেও এই অনন্তকালের মহান কুম্ভকর্ণ মহাশয়েরা মহানিদ্রা ভঙ্গ করে জেগে ওঠবেন, এমন ভরসা আছে কি?

‘নরসিংদী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’-এর প্রস্তাবনা কোনো কলুষিত বোধ ও বুদ্ধির উত্তরাধিকারজাত প্রপঞ্চ নয়, বরং প্রকৃত চাহিদার লক্ষ্যে বিকৃতির প্রতিবাদ। বস্তুত নব সৃজনী চিন্তার একটি ধারা প্রতিষ্ঠারই স্বপ্ন নিয়ে এই আন্দোলন শুরু। গলির ধার করা আলো নয়, আবার ঢাকার তলীও নয়, একটা নিজস্বতা নিয়েই যেন শুরু হয় তার চলা। হোক তা স্থানিকতার মূল্যেই। সেই মূল্যেই ধন্য হবে নরসিংদী।

বিশ্বায়নের প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয় : ‘কি ঘর বানাইলি হাসন শূন্যের মাঝার
আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু তা কার জন্যে? এককালে ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানের প্রবেশদ্বারে লেখা থাকতো ‘ডগস এন্ড ইন্ডিয়ান্স আর নট এলাউড’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও এখন সাধারণের জন্যে নয়। উপরতলার মানুষের জন্যে। সাধারণের জন্যে উপরে উঠার কোনো পথ নেই সেখানে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সিঁড়ি নেই’ উপরে উঠার। আধ্যাত্মিকভাবে না, এলিসের আশ্চর্য দেশের মতো বাস্তব এক শূন্যে ঝুলে আছে এই অনুগমনাগমন পথের শিক্ষা-ইমারতটি। কিছু লোকের জন্যে তাই এখন গলির নিয়ম, মানে গলিতে গলিতে অন্য ব্যবস্থা। যাকে বলেছি ‘গলিলিও’ ধারা। এক শ্রেণির ছাত্র এই বিকল্প মেনে নিয়েছে। তারই ফল যত্রতত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচুর্য।

বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির দিক থেকে বাংলাদেশের যে-রেকর্ডই সৃষ্টি হোক, আমাদের এখন দাঁড়াবার জায়গা চাই, আশ্রয়ের ঘর চাই। শিক্ষার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য দেশের অনুকরণ এখন আর বড়ো আবশ্যক নেই। নিজের মতোন করে নিজেদের ঘর বানানো কঠিন নয়। পশ্চিম দেশে এখন আমাদের হাতই যোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছে। সেখানে পূর্বদেশীয় পণ্ডিতদের অবস্থান লক্ষ্য করলেই তা বোঝা যায়। শুধু তা-ই নয়, এই বিশ্বায়নের দিনে বহু পূর্বদেশ, যেমন জাপান, চীন, ভারত (বিশেষত দক্ষিণ ভারত) যে এখন অনেকটাই এগিয়ে গেছে, এটাও আমাদের কাছে আদর্শযোগ্য। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, পাশ্চাত্য শিক্ষা যদি কেন্দ্র হয়, মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির স্থানিক শিক্ষা তার থেকে স্বাধীন না হোক, সিন্দাবাদের বুড়োর মতো অন্তত তাদের ঘাড়ে আর চেপে নেই সেই কেন্দ্রীয় ধারাটা। এখন যেকোনো দেশেরই কেন্দ্র আর প্রান্ত নিয়ে এই তুলনাটা করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির একসময় সুনাম ছিলো, আন্তর্জাতিক মানের দিক থেকে তা যা-ই হোক না কেন। কিন্তু আজকের যুগশিক্ষা এবং যুগের দাবির বিষয়টি বিশ্বায়নের ডামাডোলে অনেক কিছুর সাথেই মিশে যাচ্ছে। এটা আমাদের বুঝে নিতে হবে। আমরা কোথায় আছি বা ছিলাম, কোথায় চলেছি? আসলে মূল বিষয়টি কী? এই ‘যুগের দাবি’ কার স্বার্থে, কে করে? তার প্রকারই বা কী? তার উপযোগিতা কোথায় এবং কীসে? সে কি কেন্দ্রগত শিক্ষায় না বহুকেন্দ্রিক শিক্ষায়, প্রধান শিক্ষাকেন্দ্রে না শত উপ-শিক্ষাকেন্দ্রে, একতম বিশ্ববিদ্যালয়ে না বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে (ভ্যাট-দ্বন্দ্বসহ)? এরকম বহু প্রশ্নের মুখোমুখী আজ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা। ভাষানীতির মতোই এ-দেশের শিক্ষানীতিও অস্পষ্ট। এই সমস্যা যতোই দিন যাচ্ছে, ততোই অমীমাংসিতভাবে সেই বাদুরঝোলা-ই ঝুলছে। আজ গলিতে গলিতে গড়ে ওঠা নানাবিধ ‘গলিলিও’ মহাশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির অবস্থা দেখে আল মাহমুদের কবিতার কথাই মনে পড়ে যায়। তাতে আছে, ‘জ্ঞানের প্রকোষ্ঠে দেখো ঝুলে আছে বিষণ্ন বাদুর’ কিংবা ‘বানরের চেঁচানিতে ভরে যায় সেগুনের শাখা’। দুটো উপমাই বিদ্যাশিক্ষা বা জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে করুণ চিত্রের দ্যোতক। কে না জানে, মাটির সাথে যোগহীনতায় কোনো কাজের জিনিস জন্মে না। তখন সবই শূন্যে ঝুলে থাকে। অন্যভাবে এই কথাটাই রবীন্দ্রনাথও উল্লিখিত সেই প্রবন্ধেই বলেছেন তাঁর ‘সিঁড়ি-হারা শিক্ষাবিধান’ তত্ত্ব উপস্থিত করে। অনেক মাল-মশলা দিয়ে দোতালা বা বহুতলা বানিয়ে যদি উপরে উঠার সিঁড়ি না থাকে, তবে ঊর্ধ্বপথযাত্রায় সকল প্রয়াসই ব্যর্থ হয়। সিঁড়িহীন বাড়ির প্ল্যানটাকে তাই তিনি এভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, “নিচের তলাটা উপরের তলাকে নিঃস্বার্থ ধৈর্যে শিরোধার্য করে নিয়েছে, তার ভার বহন করেছে কিন্তু সুযোগ গ্রহণ করেনি, দাম জুগিয়েছে, মাল আদায় করে নি।” আমাদের দুঃখটাই যেন তিনি তুলে ধরেছেন এভাবে, “অভ্রভেদী বাড়িটাই আমাদের অভ্যস্ত, তার গৌরবে আমরা অভিভূত, তার বুকের কাছটাতে উপর নিচে সম্বন্ধ স্থাপনের যে সিঁড়ির নিয়মটা ভদ্র নিয়ম সেটাতে আমাদের অভ্যাস হয় নি।” আমরা ঢাকার শিক্ষায় অভ্যস্ত। সেই ঢাকা শুধু নরসিংদী কেন, বাংলাদেশের যেকোনো স্থান থেকে কতোই-বা দূরে। কিন্তু ওই অক্সফোর্ডনামী দালানটা এবং এখন দেখাদেখি গলাগলি করা ‘গলিলিও’ উচ্চশিক্ষার অন্য বাড়িগুলোও যারা নিজেরাই স্বনামে বরহক অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, স্ট্যামফোর্ড ইত্যাদি নানা বসনে কতোই না অভ্রভেদী এবং তারও বেশি সোপানহীন। সেখানে উঠার সাধ্য কী!

আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আন্তর্জাতিক নানা নাম নিয়ে, যতোই আরো উপরে উঠছে, ততোই মাটি থেকে সরে যাচ্ছে। তার সিঁড়ি হয়ে ওঠছে অদৃশ্য এবং দূরের (মফস্বলের) ও গরীব ঘরের ছেলেমেয়েদের এবং ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রদের ছাড়া অন্যদের পক্ষে তার কাছে পৌঁছানো হয়ে ওঠছে দুরূহ। দেশে আজ মেধাবী ছাত্ররা দুর্লক্ষ্য নয়, জিপিএ ফাইভেরও অভাব নেই, কিন্তু সেই জ্ঞানান্বেষী বা অভীপ্সুদের ক’জন উপরতলায় অর্থাৎ ঢাকায় ভর্তি হতে পারছে? উচ্চশিক্ষার নামে তারা কোথায় পড়ছে ছিটকে, কে জানে? অন্যদিকে শিক্ষার ব্যবসায় এবং ব্যবসায়ের প্রতিযোগিতায় ডিগ্রির কাগজ বা সনদ এবং জ্ঞানের পার্থক্য ঘুচে গিয়ে সমতা এসে গেছে এই ফাঁকে। ডিগ্রি নয়, এখন শুধু কাগজ হলেই চলে। প্রকৃত শিক্ষা আজ কাগুজেশিক্ষা বা সনদধন্য শিক্ষারূপে এভাবেই প্রমোশন নিয়ে ছিক্কাতে উঠেছে নির্বিবাদে। যাদের অর্থবিত্ত আছে, তাদের উপরে উঠার সিঁড়ির প্রয়োজন নেই। আর অন্যদের তা নাগালের বাইরে। তাকে হাতের কাছে পাবার সুযোগ কই? মেধাশূন্য শিক্ষা এবং শিক্ষাশূন্য মেধার প্রতিযোগিতায় ছাত্র এবং অভিভাবক উভয়ের লক্ষ্য এবং লভ্য বিষয় এখন একটাই, সেই কাগুজেবিদ্যা তথা সনদ। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে আশু মুক্তি আবশ্যক। কেন্দ্রীয় শিক্ষাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যতিত এশিয়ার অন্যান্য দেশ আজ সেই শিক্ষার পথেই চলেছে। আমরা আরজ আলী মাতুব্বরের স্বশিক্ষার আশায় বা আর ডি বর্মণের বাঙালির ‘এক তারাটা’ বাজাবার স্বপ্ন নিয়ে আনন্দে আছি। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তার জন্যে পথ চাই, সিঁড়ি চাই, সাধনা চাই আর চাই সহযোগিতা। কে করবে সহযোগিতা? কে কাকে বোঝাবে শিক্ষার দারিদ্র্য কী ভীষণ অভিশাপ!

হ্যাঁ, আপন শিক্ষায় যারা শিক্ষিত, তাদের বলা হয় স্বশিক্ষিত। তাদের মূল্য প্রাতিষ্ঠানিক তথা পরশিক্ষায় নয়। এই অর্থে ‘শিক্ষা’র মূল্য কী? কিছুই নয়। কথিত উন্নয়নের সিঁড়িও নয়, মাপকাঠিও নয় এবং দারিদ্র্যমোচনের উপায় তো নয়ই। শিক্ষা, উন্নয়ন, দারিদ্র্য এই শব্দগুলিকে আগে পরস্পর সংশ্লিষ্ট মনে করা হতো। ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে।’ কিন্তু দেখা গেছে, সে বড়ো মিথ্যা, কারণ শিক্ষাদাতা স্বয়ং শিক্ষকদেরই দারিদ্র্য ঘোচেনি কোনোদিন। অন্যদিকে জমি-জমা বেচে অশিক্ষিতরাও যারা ‘উন্নতি’ করতে চেয়েছে বিদেশে গিয়ে, তারাও উন্নয়ন বা সৌভাগ্য অর্জন দূরে থাক, বরং নিঃস্ব হয়েই ফিরেছে অনেকে। অতএব এই শব্দগুলি এখন দ্ব্যর্থবোধক কিংবা অতি-তাৎপর্যক। অর্থনীতির লোকেরা আজ স্বীকার করছে যে, কেবল আর্থিক দারিদ্র্যই দারিদ্র্য নয়, আসলে তা একটা দেশের প্রকৃত অভাবকে চিহ্নিত করে না। বাস্তবে ‘অভাব’ অনেক কিছুকেই বোঝায়। অভাব দূর না হলে দারিদ্র্যমোচন হবে না। অভাব সৃষ্টি হয় এবং অদূরীকর হয়, যখন মানুষ আপনাতে হয় নিঃস্ব, নিজস্বতা যখন শূন্য হয়ে ওঠে, অর্জনে হীন হয়। আপনার বলে তার আর কিছুই থাকে না। সেই দারিদ্র্য অমোচনীয়। মধ্যম আয়ে উন্নীত বাংলাদেশ আজ সেই অর্থে বড়োই দরিদ্র। আমরা তা আরো লক্ষ্য করবো নরসিংদীর শিক্ষাচিত্রে। মেঘনার তীরে একটি প্রযুক্তিধর্মী জ্ঞানকেন্দ্র স্থাপনের ব্যর্থতায় সে কী নিদারুণ দরিদ্র! ঘোষিত ডিজিটাল শিক্ষার দেশে ‘গলিলিও’ শিক্ষালয়ে প্রান্তরের বিমুক্ত শিক্ষা, উদার শিক্ষা ও গন্তব্যগামী স্বাধীন শিক্ষার অভাব আজ সকলেই অনুভব করছে। অন্য ব্যাপারে ঘাটতি বাজেট বা লোন করে তা পূরণ করা যায়, কিন্তু শিক্ষার এই দারিদ্র্যমোচনের সে-দাবি পূরণ হবে কবে, আর কে-ইবা করবে তা?

আঞ্চলিক উন্নয়নএকটি শূন্যতা পূরণ অঙ্গীকার
৮ম জাতীয় পে-স্কেল ঘোষিত হলে সকলেই এবার স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে যে, দেশের চলমান অগ্রগতিই যথেষ্ট নয়, মানুষ আপনার স্বাধীনতায় হয় শক্তিমান ও সবল। এই স্বাধীনতাটুকু তাঁর ক্ষেত্রগত অর্জন। আপন ক্ষেত্র থেকে তাকে তুলে নিলে অপর স্থানে সে অকৃষ্ট, অসৃজ ও নিষ্ফলা হয়। কেননা সৃজনতা বা সৃজনশীলতাই তার আদ্যশক্তি ও স্বকীয়তার পরিচয়। তার ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে তাতেই। ব্যক্তিত্বহীন মানুষ নির্বীর্য এবং অস্তিত্বশূন্য।

আজ দিনের বদল হয়েছে, বিশ্ব কাছে চলে এসেছে। কিন্তু বিশ্বায়নে মানুষের মুক্তি ঘটেনি। দারিদ্র্য-মুক্তি একটা লক্ষ্য হতে পারতো, হয়নি। তাই ‘দারিদ্র্য’র সংজ্ঞা পাল্টানো প্রয়োজন, সেই সাথে দারিদ্র্য মোচনের উপায় বা প্রক্রিয়াও। দারিদ্র্য কোথায় এবং কতোদূর, তার সীমা, তার বিচার বা পুনর্বিচার হয়নি। ‘গরিবী হটাও’ কেবল আর্থিক বা অর্থনৈতিক দারিদ্র্য মোচনে সীমিত থাকায় বিপন্ন মানুষ বিপন্নতর পরিস্থিতিতে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে। আদিকাল থেকেই মানুষ গরীব থেকেও জীবনকে গুটিয়ে নিয়ে বেঁচে রয়েছে এবং সংগ্রাম করে আজো এগিয়ে চলেছে। (সাধারণভাবে যে-কারণে বলা হয়, মানুষ না খেয়ে মরে না, খেয়েই মরে— জ্ঞানের অভাবে।) সুতরাং সংগ্রামের হাতিয়ার অর্থ (money) নয়, আত্মশক্তি বা বাঁচতে শেখায়, যার অর্থ বাঁচার জন্যে উপযোগী শিক্ষা, তথ্য এবং জ্ঞান চাই। বিপন্ন ভাষা বা Endangered Language এবং সেই সব ভাষাভাষীর মতোই বিপন্ন জাতি বা গোষ্ঠীরাও (যেমন আমাদের দেশের প্রাচীন রবিদাস, ঋষি, চামার, মুর্দাফরাস, কামার, কুমার, গাইন, নাগারচি, সুইপার, বাইদ্যা, বারুই, বেহারা, চৌদালি, বাওয়ালি প্রভৃতি বহু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী) আজ বিলীন বা বিলীয়মান অবস্থায় উপনীত। তাদের বলা হচ্ছে ‘হারিয়ে যাওয়া দরিদ্র গোষ্ঠী’ বা সমাজ। সব সমাজ বা গোষ্ঠীরই বেঁচে থাকার মূলে থাকে কিছু সংগ্রামী চেতনা ও জ্ঞান। যারা হারিয়ে যায়, তারা তাদের সেই টেকনোলজি ও যাপিত জীবনের প্রকরণও হারিয়ে ফেলে। জাতি শুধু অনুকরণ করেই উন্নত হয় না। তার অন্তর্গত তপস্যাও তার মূলে কাজ করে। তাকে ইতালীয় নৃ-সাংস্কৃতিক বিচারে বলে ‘সাবস্ট্র্যাটাম’-সম্পদ। (বিজ্ঞানী দীপংকর চট্টোপাধ্যায় যাকে প্রকারান্তরে বুঝিয়েছেন ‘সাবেক সংস্কৃতি’ বলেও) সেটা যেমন প্রকাশ-সত্যের বা ভাষার, তেমনি জ্ঞানার্জন-ক্ষমতার। ফার্দিনান্দ দ্য স্যসুর থেকে নোয়াম চমস্কি পর্যন্ত সকল ঐতিহাসিক ও রূপান্তরশীল তাত্ত্বিকেরাই তা প্রমাণ করেছেন। উত্তর আধুনিক জ্ঞানবাদীরাও তার থেকে বাদ যাননি।

সেই অবতলবস্তুর শক্তি ও প্রেরণাই গোষ্ঠী বা জাতির ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য এনে দেয়। তার আইডেন্টিটিকে সবল করে। তার পারঙ্গমতার প্রকৃতিকে বুঝতে সহায়তা করে। আজ ছোট্টো সিঙ্গাপুরে যা সম্ভব হয়েছে, মালয়েশিয়ায় যা সহজ এবং স্বাভাবিকভাবে টিংকু আব্দুর রহমান থেকে তাঁর উত্তরাধিকারদের হাতে, বিশেষত মাহাথির মোহাম্মদের স্বপ্নের ঘাটে ঘটে যেতে পারলো, বাংলাদেশে আরো কয়েক যুগেও তা আমরা দেখবো কি না সন্দেহ। বিশ্বায়ন থেকে উদারবাদী বিশ্বায়নে পৃথিবীর নানা কেন্দ্রে (তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও) যেসব পরিবর্তন ঘটছে, তার প্রভাবে স্বপ্রাবল্যে আজ মধ্যপ্রাচ্য থেকে পূর্ব এশিয়া বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিও শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্য-বাসস্থান-যোগাযোগসহ কোথায় না আদর্শতুল্য? কিন্তু সেই তেজ, শক্তি, বীর্য ও সৃজনশীলতা আমাদের মতো হবু (expecting) মধ্যম আয়ের দেশে কোথায়? আমাদের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে জাতিমূলের কোনো শক্তিই কি কাজ করেছে বা করছে? কেন নয়? আমরা তাদের আগে স্বাধীন হয়েও কেন এখনো দাসত্বই করছি, এখনো করে চলেছি উপনিবেশী লিগেসি অনুসরণ, এখনো অমানবিক ধর্মের অস্ত্রোপসনাকেই মনে করছি আমাদের শক্তি? আমাদের মধ্যে কোনো পরিবর্তনই কাজ করেনি, এ কেমন দুর্ভাগ্য আমাদের!

আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয় : প্রসঙ্গ নরসিংদী বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
এবার আবার শুরুতে ফিরে যাওয়া যাক। আমরা শুরু করেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি নিয়ে। সেখান থেকে আবারো বলি, ‘আর কত খাণ্ডব পোড়াতে হবে’, আর কতোবার বলতে হবে এ-কথা, কতোবার বোঝাতে হবে যে, বস্তুসম্পদে এবং কারুজ্ঞানে আমরা একসময় পিছিয়ে ছিলাম না, কিন্তু আজ আমরা শিক্ষা-দারিদ্র্যে জগত-ভিখারি। এ-দারিদ্র্য মোচনের জন্যে পাশ্চাত্য ঋণ-বিলাসে ভুগতে চাই না। দারিদ্র্য মোচনের মূল চাবিকাঠি শুধু অর্থঋণ নয়, সে-কথা প্রমাণিত হয়ে গেছে। তাই আর পরঅনুকরণ নয়, নিজের শক্তিতে দাঁড়াতে চাই। প্রযুক্তিজ্ঞান ব্যতিত আজকের পৃথিবীতে তা সম্ভব নয়। শিক্ষার দারিদ্র্য থেকে মুক্তি চাই। নরসিংদী বড়ো দরিদ্র। তার খাদ্যের অভাব নেই, তার মৃত্তিকাশস্য, জলশস্য সবই পরিপূর্ণভাবে আছে, আছে বস্ত্রও। কিন্তু দারিদ্র্যের শেষ নেই। এককথায় আমাদের মনে পড়বে যুক্ত বাংলায় হক সাহেবের মন্ত্রীত্বের কালে দেশে খাদ্যের অভাব ছিলো না, কিন্তু জয়নুলের তুলি এবং ‘অন্নদাতা’র কৃষাণ চন্দরদের কলম বলছে, তখন রাজধানীতে দুর্ভিক্ষ ছিলো। এ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সাইট আছে বাংলাদেশে। নরসিংদীতেই এর প্রথম দাবি উঠেছিলো প্রতিষ্ঠার। আজো জানি না, তা হবে কি হবে না। আমাদের দাবির ভিত্তি একটি বিশেষ শিক্ষাদর্শন। কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্থক্য থাকবে, সাধারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তা হবে পৃথক, এর প্রতিষ্ঠা হবে আধুনিক চিন্তা ও দারিদ্র্যমোচন-সম্ভব জ্ঞানের ভিত্তিতে এবং স্থানীয় পরিবেশের মধ্যেই থাকবে তার সাধনার মৌল উপাদান। নরসিংদী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তার আপন উপলব্ধ ও পরীক্ষিত জ্ঞানেই ফিরিয়ে আনবে তার ঋদ্ধ অতীত ও লোকবিশ্রুত ঐতিহ্য।


. মনিরুজ্জামান
ভাষাবিজ্ঞানী, প্রাবন্ধিক
সাবেক অধ্যাপক ও ডিন, কলা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলা একাডেমি ও একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক

প্রিয়বালা গুপ্তা : নারী জাগরণ ও সমাজ সংস্কারে ব্রতী এক মহীয়সীর জীবনপাঠ

0

প্রিয়বালা গুপ্তা একজন সমাজহিতৈষী। তিনি সমাজ সংস্কারে ব্রতী ছিলেন জীবদ্দশা জুড়ে। একটা বদ্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়ানোর কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। বিশেষত, নারীশিক্ষার প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব ছিলো মারাত্মক।

প্রিয়বালা গুপ্তা যে-সময় ও সমাজে ছিলেন, সেই সমাজে ছেলেদের শিক্ষার ব্যবস্থাও এতোটা সহজসাধ্য ছিলো না। চার-পাঁচ মাইলের মধ্যে বালকদের একেকটা স্কুল গড়ে ওঠছিলো তখন, কিন্তু মেয়েদের শিক্ষার কোনো ব্যবস্থাই ছিলো না। আবার সময় ও সমাজ ছিলো ভয়ানক প্রতিকূল। নিজে তেমন পড়াশোনা করতে পারেননি। কিন্তু দুর্নিবার তৃষ্ণা ছিলো তাঁর পড়ালেখার।

প্রিয়বালা গুপ্তা (১৮৯৯-১৯৭৩)

জন্ম বেড়ে ওঠা
প্রিয়বালা গুপ্তা জন্মেছেন ১৮৯৯ সালে, ভাগলপুরে। পৈতৃক বাড়ি পাঁচদোনায়। বাবা ইন্দুভূষণ সেন ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের ভ্রাতুষ্পুত্র। সরকারি চাকরিসূত্রে নানান জায়গায় ঘুরেছেন। শৈশবের প্রিয়বালাও পিতার কর্মস্থলগুলিতে তাঁর পড়াশোনা চালিয়েছেন। তাঁর অনুভূতির ডালপালা বিস্তৃত হয়েছিলো সেসব অঞ্চলে। ভাগলপুর, কটক, কোন্নগড়, কলকাতা, রাঁচি ইত্যাদি নানা স্থানে বাস করেছেন পিতার কর্মসূত্রে। পড়াশোনায় এতোটাই মেধাবী ছিলেন যে, স্কুল-কর্তৃপক্ষ তাঁকে সম্পূর্ণ  অবৈতনিকভাবে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করার সুযোগ দিয়েছিলো। কিন্তু পিতা ১০ বছরের পর আর তাঁকে পড়াশোনা করানোর ইচ্ছে পোষণ করেননি। বাড়িতে বসিয়ে পাত্রস্থ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রিয়বালার ঐকান্তিক ইচ্ছে ছিলো পড়াশোনা করে অনেকদূর যাবার। অবশেষে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মাধবদীর সম্ভ্রান্ত বনেদি রায় পরিবারে বিয়ে করে বালিকাবধূ হয়ে প্রবেশ করেন প্রিয়বালা।

শ্বশুরবাড়ি মাধবদীতে
মাধবদী গ্রাম তখন অন্ধকারাচ্ছন্ন এক অজপাড়াগাঁ। বধূ হয়ে এ-গ্রামে এসেই তিনি দেখেন, এখানে পড়াশোনার কোনো বালাই নেই। তবে স্বামী যতীন্দ্রমোহন গুপ্ত ঢাকা কলেজ পড়ুয়া শিক্ষিত ভদ্রলোক ছিলেন। তাঁর শ্বশুর তারিণী গুপ্ত রায় ও বড়ো শ্বশুর কাশীকান্ত গুপ্ত রায় মাধবদী গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। এই গ্রামের গোড়াপত্তন করেছিলো এই পরিবারটি। আঠারো শতকের মাঝামাঝি যশোর থেকে নানা জায়গায় বসতি স্থাপন করে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত রায় এইখানে এসে তিনঘর জ্ঞাতি সঙ্গে নিয়ে ব্রহ্মপুত্র খালের পশ্চিম পাড়ে বসতি স্থাপন করেন। এককালে জায়গাটা যে নদীগর্ভ থেকে চর হিসেবে জেগে ওঠেছিলো, তার প্রমাণ হিসেবে বাড়ির ভিত কাটার সময় কিছু ভাঙা নৌকার খোল, বৈঠা, মাস্তুলের পচা অংশ, ভাঙা ঝিনুক ইত্যাদি নাকি উঠে এসেছিলো জল-কাদার সঙ্গে।

প্রিয়বালা গুপ্তা যখন এ-বাড়িতে বউ হয়ে আসেন, তখন রায়বাড়িটি পড়তির দিকে। একসময় বিশাল জমিদারি ছিলো। তাদের তিন জ্ঞাতির এক জ্ঞাতি প্রচুর মুন্সিয়ানা, টাকা-পয়সা কামিয়ে জমিদারি স্থাপন করেছে। বাড়িটাও মুন্সি বাড়ি এবং পরে জমিদার বাড়ি বা বাবুর বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলো।

মূলত মাধবদী ছোটো একটা গ্রাম ছিলো। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরই প্রাধান্য ছিলো। আশেপাশের গ্রামগুলো ছিলো বিরামপুর, নওপাড়া, কাশীপুর, কোতোয়ালির চর ইত্যাদি। এবং গ্রামগুলো মুসলমান অধ্যুষিত ছিলো। মাধবদীসহ আশেপাশের সব অঞ্চলই একটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকারে ঢেকে ছিলো।

কাব্যচর্চা, মনের জানালায় দূর দেখা
রায়বাড়িতে তাঁর মনের কথা বলার বা শোনার কেউ নেই। বিশাল একান্নবর্তী পরিবারে কাজ করার লোকের অভাব নেই। একা একা সংবেদনশীল এই নারী মাঝে মাঝে ভাবতেন, হয়তো তিনি পাগল হয়ে যাবেন। তবে তিনি শেষপর্যন্ত পাগল হয়ে যাননি। বাঁচার জন্যে, আত্মরক্ষার প্রয়োজনে তিনি নিজের মনের গভীরে সৃষ্টি করলেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক জগত— তাঁর কাব্যচর্চা, লেখাপড়া, ভাবনা-চিন্তার জগত। সেখানে বাইরের কারো প্রবেশাধিকার নেই। অবশ্য কাব্যচর্চার অভ্যাস তাঁর বিয়ের আগেও ছিলো। সাত-আট বছর বয়সে বাবার উৎসাহে অক্ষর মিলিয়ে কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। ‘ভ্রাতৃদ্বিতীয়া’ নামে তাঁর একটা কবিতা সে-কালের ‘মহিলা’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো। কবি দেবেন্দ্রনাথ সেন খুশি হয়ে একটা প্রশংসাপত্র পাঠিয়েছিলেন। মাঝে অনেকদিন বন্ধ ছিলো। এখন আবার তাঁর চর্চা শুরু হলো। সারাদিন ও রাত নয়টা পর্যন্ত সংসারের কাজ করতেন, তারপর নিজের ঘরে এসে ঢুকে যেতেন নিজের জগতে। কামিনী রায়, গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, মানকুমারী বসুর কিছু কবিতার বই তাঁর নিজের কাছে ছিলো। বারবার সেগুলো পড়তে লাগলেন। এই কবিতা পড়া ও লেখা তাঁর অভ্যাসে পরিণত হলো এখন। অভ্যাস এবং আনন্দের উৎস— দুটোই। না পাওয়ার যন্ত্রণাকে ভুলে থাকার, নিজের আনন্দে বুঁদ হয়ে থাকার এর চেয়ে বড়ো উপায় আর নেই।

রবিবারের আসর মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠার বীজ
গ্রামের অশিক্ষিত কূলবধূরা আসতো তাঁর কাছে। স্বামী বিদেশে চাকুরি করে, তাদের কাছে চিঠি পাঠায়, কিন্তু তারা চিঠি পড়তে ও লিখতে পারতো না। প্রিয়বালা তা তাদের পড়ে শোনাতেন। কিন্তু অন্যের চিঠি পড়তে তাঁর বিব্রতবোধ হতো। প্রিয়বালা এসব অশিক্ষিত মেয়েদের পড়াশোনার কথা বলতেন। কিন্তু তাদের পড়াশোনার সুযোগ কই! প্রায়ই গ্রামের নানা বয়সী মহিলারা আসতো, অনেক কিছু জানতে চাইতো। প্রিয়বালা ঠিক করলেন, তাদের সবাইকে নিয়ে বসবেন। কথা বলবেন। সুখ-দুঃখের গল্প শুনবেন তাদের। ঠিক হলো, প্রতি রবিবার তারা বসবেন দুপুরবেলা, ঘরকন্নার কাজ সমাপ্ত করে।

গ্রামের বউ-শাশুড়িদের বাড়িতে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করতেন, “দিনরাত সংসারের কাজ করতে করতে, ভাবতে ভাবতে একঘেয়েমি এসে যায় না? তার চেয়ে বরং মাঝে মাঝে সবাই মিলে বসে একটু হাসি-ঠাট্টা, গল্পগুজব করলে মন্দ কি? দেশের ও দশের কত কথা আমাদের অজানা, কত বইতে ছড়িয়ে আছে কত সুন্দর সুন্দর গল্প আর কাহিনি। জানতে ইচ্ছা করে না আপনাদের?”

তারপর প্রতি রবিবার দুপুরের খাওয়া সেরে মেয়েদের বৈঠক বসতো। গল্পচ্ছলে প্রিয়বালা নিজেদের থানার কথা, জেলার কথা, বাংলা ও ভারতবর্ষের কথা বলতেন, ছেলেদের ভূ-চিত্রাবলির বই এনে দেখাতেন, কোনটা আমাদের দেশ, কোথায় নিজেদের জেলা ও থানার অবস্থান। কোনোদিন বিজ্ঞান প্রসঙ্গে বলতেন পৃথিবীর জন্মের কথা, মানুষ সৃষ্টির রহস্য। মহিলারা মন্ত্রমুগ্ধ। একটা আশ্চর্য আলোকোজ্জ্বল অজ্ঞাত জগতের জানালা যেন ঈষৎ ফাঁক হচ্ছিলো তাদের চোখের সামনে। রবিবারের আসর জমে গেলো। এভাবে শিখতে আর শেখানোর ইচ্ছায় মেয়েদের পড়াশোনার একটা গোপন ইচ্ছে পুষতে লাগলেন। মেয়েদের বিদ্যালয় করার মনোবাসনা জাগ্রত হচ্ছিলো তাঁর।

স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকায়
এর মধ্যে পঞ্চাশের মন্বন্তর এসে গেলো। সারা বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলো। মাধবদী গ্রামেও এর ভয়াবহ থাবা বিস্তার লাভ করলো। চারদিকে লঙ্গরখানা খোলা হলো। লঙ্গরখানাগুলোতে গ্রামের লোক ঝাঁপিয়ে পড়লো।

‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ নামে একটা সংগঠন সক্রিয় ছিলো এ-সময়। এই সমিতির নরসিংদী থানার সম্পাদক হিরণবালা রায়। মাধবদী গ্রামের দুই মাইল উত্তরে আটপাইকা গ্রাম। আটপাইকার অনুশীলন পার্টির কর্মী সতীন্দ্র রায়, মনীন্দ্র রায়। বিশাল জায়গা-জমি নিয়ে তালুকদারি তাদের। কিন্তু এই দুই ভাই মানুষের জন্যে রাজনীতি করেন। কৃষক আন্দোলন করেন। পরে তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন। তাঁদের বিধবা বোন হিরণবালা দেবী মহিলা সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এই দুর্ভিক্ষের দিনে রিলিফ বিতরণের কাজ শুরু করলেন। তিনি এসে ধরেন প্রিয়বালা গুপ্তাকে। প্রিয়বালার পরিচয় তিনি আগেই পেয়েছিলেন। মাধবদীতে তাঁরা দুধ বিতরণের কাজ শুরু করেন। আর এই দুধ বিতরণের সেন্টার খোলার আহ্বান জানালেন প্রিয়বালাকে, তাঁর বাড়িতে। কিছুটা সংকোচ থাকলেও প্রথমে, পরে একজন নিবেদিতপ্রাণ স্বেচ্ছাসেবী হয়ে গ্রামে ছোটো ছোটো বাচ্চাদের দুধ বিতরণ শুরু করলেন তিনি। গরীব মায়েদের ভিড়ে উঠোন ভরে যেতো। কাজটা ভালো লেগেছিলো প্রিয়বালার। এই প্রথম বাইরের সঙ্গে জনসংযোগ, সমাজসেবা। পরে স্কুল করার সময় এই সংযোগ কাজে লেগেছিলো। শুধু দুগ্ধ বিতরণ নয়, পরে এই সমিতির পক্ষ থেকে প্রিয়বালা নিয়মিত কম্বলও বিতরণ করতেন।

স্বপ্ন সফল, মাধবদী শিশু সদন বিদ্যানিকেতনের যাত্রা
১৯৪৪ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা চারদিকে। যুদ্ধ,  মন্বন্তর এবং পূর্ব ও পরবর্তী ঘটনাবলি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনা সঞ্চারে যথেষ্ট সহায়তা করেছিলো। এদিকে প্রিয়বালা গুপ্তা চিন্তিত তাঁর সন্তানদের নিয়ে। তাঁর আট সন্তানের মধ্যে ছেলেরা ইতোমধ্যে পড়াশোনার ভেতর দিয়েই যাচ্ছে। ছোটো দুই মেয়েকে নিয়ে পড়লেন পড়াশোনা-সংক্রান্ত দুশ্চিন্তায়। মেয়েদের কোনো পড়াশোনার স্কুল নেই। এমন সময় অভাবনীয় সুযোগ এসে গেলো। পাশের গ্রাম কাশীপুর থেকে এক ব্যবসায়ী পরিবারের গৃহিণী বাড়িতে বেড়াতে এলেন। এ-কথা সে-কথার পর বললেন, প্রিয়বালা যদি বাড়িতে একটা স্কুল খোলেন, তাহলে তিনি তার মেয়েকে এখানে দেবেন। নিজে নিরক্ষর, তার বড়ো ইচ্ছে, ছোটো মেয়ে শৈল কিছু লেখাপড়া শিখুক। সময় পাল্টেছে, বিয়ে দেয়ার আগে মেয়েদের কিছুটা লেখাপড়া জানা থাকা দরকার। প্রিয়বালার কাছে এটি ছিলো তাঁর দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন পূরণের এক অযাচিত সুযোগ। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন।

তিনি উঠে-পড়ে লেগে গেলেন স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজে। স্কুলের জন্যে ছাত্রী চাই। সুতরাং গ্রামের মহিলাদের বাড়িতে ডেকে শৈল’র মায়ের প্রস্তাব ও নিজের সমস্ত পরিকল্পনার কথা খুলে বললেন। এখানে বলে রাখা ভালো, মাধবদী এবং আশেপাশের অঞ্চলে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা, আলোড়ন-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সমাজের একাংশের ভেতর কিছুটা অন্তত চেতনার সঞ্চার হয়েছিলো। শিক্ষার, বিশেষত, স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা তারা ভাবতে শুরু করেছিলো। তাছাড়া প্রিয়বালার সৎ প্রয়াসের কথা জানতো তারা। ফলে সবাই মোটামুটি রাজি হয়ে গেলো। স্কুলে মেয়ে পাঠাবে তারা।

এবার প্রথমেই চাই ঘর। বলা মাত্রই রায়পরিবারের কর্তা স্বামী যতীন্দ্রমোহন রায় তাঁর বৈঠকখানা ছেড়ে দিলেন। মাধবদী হাই স্কুলের হেডমাস্টার শচীনন্দন সাহা তিনটি মেরামতযোগ্য বেঞ্চ দিলেন। এইভাবে মাত্র দুটি মেয়ে— নিজের কন্যা আরতি ও কাশীপুরের শৈল সাহাকে নিয়ে শুরু হলো মাধবদী অঞ্চলে মেয়েদের পড়াশোনার দ্বার উন্মুক্ত করা প্রতিষ্ঠান ‘মাধবদী শিশু সদন বিদ্যানিকেতন’।

দুই-চারদিনের মধ্যে ভর্তি হলো কাশীপুরের স্বদেশী মালাকার এবং মাধবদীর সতী পাকড়াশী ও ননী পাকড়াশী। সময়টা সম্ভবত ১৯৪৪ সালের মার্চ কি এপ্রিল। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত খোলার প্রস্তাব থাকলেও যাত্রা শুরু হলো শিশু শ্রেণি ও প্রথম শ্রেণি দিয়ে, ওই পাঁচ মেয়েকে নিয়ে। পরের বছর থেকে ছাত্রীসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর একটি করে নতুন শ্রেণির সংযোজন হতো। এইভাবে একে একে প্রস্তাবিত চারটি শ্রেণিই খুলে যায়। স্কুলটা তৈরি হয়েছিলো কেবল মেয়েদের জন্যে। কিন্তু দ্বিতীয় বছর থেকে অভিভাবকেরা মেয়ের সঙ্গে তাদের ছেলেটিকেও এনে ভর্তি করতে চায়। এটি মেয়েদের স্কুল, ছেলেরা যাক তাদের পাঠশালায়। তা যতোই বলুন, যতোই বোঝান, ওরা কিছুতেই কানে তুলতে চায় না। তারা শুনেছেন, এখানে খুব ভালো পড়াশোনা হয়। শেষকালে বাচ্চা ছেলেটাই জুড়ে দেয় তারস্বরে কান্না। বাধ্য হয়ে তাই ছেলেদেরও প্রবেশাধিকার দিতে হয়। কিন্তু ছেলেরা পড়তে পারতো চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। পাশ করে তারা পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হতো মাধবদী স্কুলে। অবশ্যই ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে। চতুর্থ শ্রেণির প্রথম বার্ষিক পরীক্ষার আগেই কান্নাকাটি শুরু হয় মেয়েদের, “এবার আমরা কোথায় যাব দিদিমণি। আমাদের পড়া যে বন্ধ হবে।” লেখাপড়ার মজা তারা পেয়েছে, সহজে তা ছাড়তে চায় না। শেষে মেয়েদের মায়েরাও এসে পীড়াপীড়ি করতে থাকে। এইভাবে স্কুলে চালু হয় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। পাঁচটি মেয়ে নিয়ে শুরু হয়েছিলো, সংখ্যাটি দেড়শো ছাড়িয়ে যায়। স্কুলঘর ভর্তি হয়ে বারান্দা ভরে, তারপর ছেলেমেয়ের ঢল নেমে উঠোনে আসে। বসার জায়গা নেই, ছোটো ছোটো বাচ্চাদের কেউ হোগলা চাটাইয়ের একটি ছেঁড়া খণ্ড নিয়ে আসে, কেউ-বা এক টুকরো চট এনে তাতেই বসে পড়ে। ছেলেমেয়েদের আগ্রহ ও উপচে-পড়া আনন্দ দেখে প্রিয়বালার চোখে জল এসে যেতো। বলতেন, “আমি এদের মনের কথা খুব বুঝতে পারি। কোনদিন পড়াশোনার সুযোগ পায়নি ত! সামান্য একটু পেয়েছে, তাতেই দ্যাখ, বন্যার মত সব ছুটে এসেছে এখানে।”

মাধবদী ছাড়া ছাত্রীরা প্রধানত এসেছিলো আটপাইকা, কোতোয়ালির চর, কাশীপুর, আলগী, নওপাড়া, বিরামপুর, ভগীরথপুর, শেখেরচর ও আনন্দী থেকে। স্কুল থেকে এসব গ্রামের দূরত্ব এক থেকে দেড় মাইলের মধ্যে। উত্তর ও দক্ষিণের গ্রামগুলোর সঙ্গে মাধবদীর সড়কপথে যোগাযোগ ছিলো না। অধিকাংশেরই আলপথ একমাত্র ভরসা, বর্ষায় যেখানে হাঁটু পরিমাণ জল-কাদা। উচ্চ-মধ্যবর্গের হিন্দু ছাত্রীরা ছিলো বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। বৈশ্য সাহারা আর্থিক দিক থেকে উন্নত হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে ছিলো পশ্চাদপদ। এদের একটি অংশের মধ্যে মায়েদের বিশেষ উৎসাহে তাদের মেয়েরা স্কুলে ভর্তি হয়। প্রথম ‘পঞ্চকন্যা’র মধ্যে একজন ছিলো বৈশ্যকন্যা, অপরজন ছিলো পিছিয়ে থাকা মালাকার পরিবারের। অচ্ছুৎ ও হতদরিদ্র ঋষিদের কথা দূরে থাকুক, কোনো কৈবর্ত মেয়ে স্কুলে আসেনি। পাকিস্তান জন্মের আগে-পরে মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চাঞ্চল্য ও চেতনা বিশেষভাবে আত্মপ্রকাশ করে। মুসলিম লীগের প্রভাবে সাম্প্রদায়িকতা এর মূল সুর হলেও শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, সীমাবদ্ধভাবে যদিও, ঘুমভাঙা নবজাগরণের কিছু লক্ষণ দেখা গিয়েছিলো তাদের মধ্যে। মাধবদী একটি নির্ভেজাল হিন্দু গ্রাম, কিন্তু সংলগ্ন গ্রামগুলোতে মুসলমানদেরই সংখ্যাধিক্য। অথচ স্কুলের স্বর্ণযুগে পড়ুয়াদের তালিকায় তাদের সংখ্যা ছিলো মাত্র ১০ (১৫০ জনের ভেতর); ৬ টি ছেলে, ৪ টি মেয়ে। তারা এসেছিলো মুসলিম সমাজের দুই বিপরীত মেরু থেকে। মেয়েদের শিক্ষা সম্পর্কে এদের অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো বিস্ময়করভাবে ভিন্ন। পুরোপুরি মুসলিম গ্রাম কলুপাড়া থেকে একদিন সুলতান মিঞা তার ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে এলো স্কুলে ভর্তি করানোর জন্যে। মেয়েটির বয়স ১০, ছেলেটির ৬। প্রিয়বালা মেয়েটিকে শিশু শ্রেণিতে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করে নেন, আর ছেলেটি সম্পর্কে বলেন, এখানে হবে না। কারণ এটি মেয়েদের স্কুল। অন্যদিকে খালেদা আখতার খানম এসেছিলো মিশ্র-গ্রাম নওপাড়ার ভূঁইয়াবাড়ি নামে খ্যাত এক অবস্থাপন্ন আশরাফ পরিবার থেকে। বাবা ডাক্তার, কাকা বা জ্যাঠা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, প্রচুর জায়গা-জমি, ছেলেরা মাধবদী হাই স্কুলে উঁচু ক্লাশের ছাত্র, নবযুগের আলোয় কিছুটা আলোকিত। একদিন খালেদার এক দাদা বোনকে সঙ্গে করে এনে স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে যায়। মেয়েটির বয়স প্রায় দশ। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সূর্যের আলো দেখার অধিকার থেকে অনেক আগেই বঞ্চিত হবার কথা। শোনা যায়, বাবা এবং বাড়ির বয়স্ক পুরুষদের প্রবল আপত্তি ছিলো খালেদার স্কুলে ভর্তি হবার ব্যাপারে। একমাত্র মা ও দাদাদের আগ্রহে সে স্কুলে আসতে পেরেছে। আসা বেশ অসুবিধাজনক, সত্যি। প্রায় এক-দেড় মাইল দূরত্ব, ধান-পাট-আখ ক্ষেতের আলপথ পেরিয়ে আসতে হয় বাবুরহাটের ভেতর দিয়ে। বাড়ির বড়োদের আপত্তি, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশিদের নিন্দার রসনাকে অগ্রাহ্য করে খালেদা সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত এখানে পড়েছিলো। বাবা ছেলেদের কলেজে পড়াশোনার জন্যে ঢাকায় বাসা ভাড়া করে দেন। খালেদাও সেখানে চলে যায়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাশ করে ঢাকা ইডেন গার্লস স্কুলে শিক্ষকতা করেছিলেন তিনি।

রেডিওতে গীতিনাট্য রচনা সাহিত্যভারতী উপাধি লাভ
১৯৪৭ সালে বিশ্বভারতী লোকশিক্ষা সংসদের একটি কেন্দ্র স্থাপিত হয় মাধবদী গ্রামে। স্কুল-কলেজের কোনো ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা না থাকা প্রিয়বালাকে পীড়া দিতো। তাই পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সে সেই কেন্দ্রের অধীনে যথাক্রমে আদ্য, মধ্য ও অন্ত পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে তিনি ‘সাহিত্যভারতী’ উপাধি পান। তার আগে ১৯৪২ সালে সাধন তপাদারের উদ্যোগে ও অনুপ্রেরণায় প্রিয়বালা ঢাকা রেডিওতে ‘শকুন্তলা’ নামে একটি গীতিনাট্য পাঠান। গীতিনাট্যটি যথারীতি গৃহীত ও সম্প্রচারিত হয়। তার পরের বছর সম্প্রচারিত হয় ‘শবরীর প্রতীক্ষা’ ও ‘উর্মিলা’ নামে আরো দুটি গীতিনাট্য।

শিশু প্রসূতি পরিচর্যা এবং ধাত্রীবিদ্যায় পারদর্শিতা
আজকে এই আধুনিক চিকিৎসাযুগে এসে এটা কল্পনা করা খুবই কঠিন যে, তখনকার শিশু জন্ম দেয়া, বাচ্চা ও মায়ের পরিচর্যা কতোটা ভয়াবহ কঠিন ছিলো! আঁতুড়ঘর মানেই নোংরা কিছু। আর প্রসূতি হলো মূর্তিময়ী অশুচি। একটা নতুন প্রাণকে পৃথিবীর আলো দেখাতে গিয়ে প্রাণ এবং প্রাণদাত্রী উভয়ের যেখানে জীবনের আশঙ্কা, সেখানে গোটা প্রক্রিয়ার দায়িত্বে থাকতো অক্ষর-পরিচয়হীন, অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন পোশাক ও আচার-আচরণের কোনো স্ত্রীলোক, যার স্বাস্থ্যবিধি ও চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। যুগ-যুগান্তের এটাই রীতি, এটাই বদ্ধমূল সংস্কার। এই রীতি মানতে গিয়ে কতো নবজাতক ও মায়ের প্রাণ যে বিপন্ন হয়েছে, তার ইয়ত্তা নাই।

প্রিয়বালা গুপ্তা নিজের জীবন দিয়ে এগুলো উপলব্ধি করেছিলেন। তাই সম্ভ্রান্ত পরিবারের গৃহিণী হয়েও তখনকার সমাজের অভিজাতদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আত্মনিয়োগ করেছিলেন প্রসূতি পরিচর্যায়। আর তাই ধাত্রীবিদ্যায় পড়াশোনা করে নিয়মিত জাতপাতহীন মনোভাব নিয়ে সমাজের এই মহৎ কাজে শামিল হয়েছিলেন। তারপর সমাজ খুব ধীরে ধীরে অনুধাবন করতে শিখেছে এই অশুচির মর্যাদা ও প্রিয়বালাকে।

সঙ্গীত রচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সাহিত্য পত্রিকা
প্রিয়বালা গুপ্তা তখনকার মাধবদীর বদ্ধ অন্ধ সমাজে শুধু স্কুল খুলেই ক্ষান্ত হননি। ছাত্রীদের মনোগঠন নির্মাণ করতে, মনের অফুরান আবেগকে প্রকাশের ও বিকাশের ব্যবস্থাও করেছিলেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। আজো এটা ভাবা কঠিন যে, মাধবদীতে তখন রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী পালিত হতো। ২৫শে বৈশাখ ঘটা করে পালিত হতো প্রিয়বালার বাড়িতে ও স্কুলে। নিয়মিত নাচ-গানের আসর বসতো। কবিতা আবৃত্তি ও মূকাভিনয় হতো। শুধু তাই নয়, ‘কিশলয়’ নামে হাতে লেখা একটা সাহিত্য পত্রিকাও বের হতো। তিন বছরে তিনটি সংখ্যা বেরিয়েছিলো সেই পত্রিকার। পত্রিকায় লিখতেন সতীশ পাকড়াশী, হিরণবালা রায়, প্রিয়বালা গুপ্তা, অজিত গুপ্ত রায়, সাধন তপাদার প্রমুখ। স্বাধীনতা আন্দোলন, স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, বাচ্চাদের উপযোগী ছড়া, শিকার কাহিনি ইত্যাদি নিয়ে লেখা হতো সেই কাগজে।

প্রিয়বালা গুপ্তার আরো একটি গুপ্ত প্রতিভা ছিলো। তিনি গান লিখতেন। এই অঞ্চলের যারা সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন, তারা তাঁর কাছে আসতেন গান লিখে দেয়ার জন্যে। এমনকি বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা বিয়ে-শাদি হলেই গান লিখে দেয়ার জন্যে তাঁর ডাক পড়তো।

স্বদেশীদের সঙ্গে যোগাযোগ
মাধবদী গ্রামের বিখ্যাত সর্বভারতীয় বিপ্লবী সতীশ পাকড়াশীর সঙ্গে তিনি নিয়মিত পত্র বিনিময় করতেন প্রিয়বালা গুপ্তা। সমাজের নানামুখী সংস্কারে প্রিয়বালা তাঁর পরামর্শ চাইতেন। একবার সতীশ পাকড়াশী জেল থেকে মুক্তি পেয়ে মাধবদী এসেছিলেন। তখন দেখা হলে প্রিয়বালা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি আমাকে পথ দেখিয়ে দিন, কীভাবে কাজ করলে আমি সাফল্য অর্জন করতে পারব।” জবাবে সতীশ তিক্তভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, “এ-গ্রাম যেদিন আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাবে এবং সে ছাই যাঁর দ্বারা নিশ্চিহ্ন হয়ে নতুন গ্রামের গোড়াপত্তন হবে, তাঁর হাতেই হবে এ-গ্রামের নবজীবনের প্রাণপ্রতিষ্ঠা।”

সতীশ পাকড়াশীর রাজনৈতিক অনুসারী ছিলেন আটপাইকার সতীন্দ্র রায়, মনীন্দ্র রায়, হিরণবালা রায়— তাদের সাথে নানা কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন প্রিয়বালা গুপ্তাও।

স্বাধীনতা, দেশভাগ আর ছিন্নমূল জীবনের পথে
১৯৪৭, ১৫ আগস্ট। ধর্মের ভিত্তিতে দুটি দেশের জন্মলাভের মধ্য দিয়ে যে-স্বাধীনতা পাওয়া হলো, তাতে জীবন হয়ে পড়লো প্রত্যেক মানুষের জন্যে অনিশ্চিত। বাড়লো অনিরাপত্তা। ধর্মীয় জোশে মানুষ প্রতিবেশির রক্ত আর মাংস খাওয়া শুরু করলো। প্রিয়বালা গুপ্তার মতো মহীয়সী সমাজ সংস্কারক হয়ে গেলো এক নিমিষেই শত্রু।

দেশভাগ হবার পরপরই মাধবদী অঞ্চলে মৃদুভাবে দেশত্যাগ শুরু হয়ে গেলো। পরে জোরালোভাবে। চলে গেলো নিজের দেশ, সম্পত্তি, সাজানো বাগান ছেড়ে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত এক অন্ধকারে।

প্রিয়বালা গুপ্তা কখনো যেতে চাননি এই মাটি ছেড়ে কোথাও। যানওনি। পড়াশোনার জন্যে পুত্র-কন্যাদের তিনি ওপারে পাঠিয়ে নিজে স্বামী ও এক পুত্রকে নিয়ে এখানেই থাকেন। ১৯৫৪ সালে স্বামী মারা গেলেন। প্রিয়বালা গুপ্তা মাধবদীর মানুষের ভালোবাসায় ধন্য হয়ে জীবনের অনেক গ্লানি বহন করে মাধবদী বালিকা বিদ্যালয়ের দিদিমণি হয়ে রয়ে গেলেন। কিন্তু ওপারে ছেলেমেয়েদের দেখতে ক’দিনের জন্যে বেড়াতে গিয়ে আর ফিরে আসা হলো না তাঁর প্রিয় স্কুল আর মাধবদী গ্রামে। স্কুলের ছাত্রীরা বারবার চিঠি লিখে অনুরোধ জানাতো ফিরে আসার জন্যে। কিন্তু পাসপোর্ট জটিলতা আর পুত্র-কন্যাদের বহুমুখী জটিল সমস্যার সমাধান করতে আর ফেরা হলো না। পশ্চিমবঙ্গের সিঁউরিতে পুত্রের বাসস্থানে থেকে গেলেন। সেখানেই হাঁপানি আর শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে সমাজ সংস্কারক ও মহীয়সী প্রিয়বালা গুপ্তা ১৯৭৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

মৃত্যুর পূর্বে ১৯৬৩ সাল থেকে তিনি তাঁর আত্মজীবনী লিখতে শুরু করলেন। ‘স্মৃতিমঞ্জুষা’ নামের এই আত্মজৈবনিক গ্রন্থ কেবল তাঁর জীবনীই ছিলো না, মাধবদী ও তার আশেপাশের মানুষ-সমাজ-পরিবেশ ইত্যাদি বহুমুখী বিষয়ে ইতিহাসের আঁকর হয়ে রইলো এই গ্রন্থ। এই গ্রন্থ প্রিয়বালার মৃত্যুর অনেক পরে তাঁর পুত্র রঞ্জন গুপ্ত’র সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।

সহায়তা
১. স্মৃতিমঞ্জুষা, প্রিয়বালা গুপ্তা;
২. আলোর অভিমুখে : প্রিয়বালা গুপ্তার জীবন ও সময়, রঞ্জন গুপ্ত।

নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী ‘হিমকবরী কেশ তৈল’

0

নানা কারণে নরসিংদীর যশ-খ্যাতি-সুনাম দেশব্যাপী ব্যাপ্ত। প্রাচীনকাল থেকে মসলিন, মিহি সুতি কাপড়, জামদানি, শাড়ি-লুঙ্গি, চাদর-গামছা প্রভৃতি বস্ত্র উৎপাদন ও বিপণন ক্ষেত্র হিসেবে নরসিংদী অঞ্চল খ্যাতির শীর্ষে ছিলো। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করে মৌর্য, গুপ্ত, সেন, পাল, সুলতানী ও মুঘল আমলে প্রাচীন নৌ-বন্দর উয়ারী-বটেশ্বর, বেলাব, মরজাল, পারুলিয়া, আনন্দী ও নরসিংদী বাজার ছিলো পণ্যদ্রব্য বেচাকেনা আর ক্রেতা-বিক্রেতা-ব্যবসায়ী-বণিকদের আনাগোনায় মুখরিত। ব্রিটিশ আমলের শেষদিকে উক্ত অঞ্চল ছিলো হস্তচালিত তাঁত, কুমারদের মাটির তৈজসপত্র, কৃষিপণ্যের মধ্যে নানা তরকারি, ফলমূলের মধ্যে, বিশেষ করে, অমৃতসাগর কলার একচ্ছত্র উৎপাদনস্থল। এর মধ্যে আয়ুর্বেদ পণ্য হিসেবে ‘হিমকবরী কেশ তৈল’ নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী পণ্যের পরিধি বৃদ্ধি করেছে। ব্রিটিশ আমলের শেষদিক থেকে শুরু করে আজ অবধি সারা বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে সমান জনপ্রিয় এই তৈল। মাথা ঠাণ্ডা রাখা, চুল কালো করা, খুশকি মুক্ত রাখা এবং বায়ুরোগের মহৌষধ হিসেবে ‘হিমকবরী’ বাংলার ঘরে ঘরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

জানা যায়, হিমকবরী তৈলের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মধুসূদন সাহা। তিনি সর্বত্র এম. সাহা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। একজন খ্যাতিমান আয়ুর্বেদশাস্ত্রী কবিরাজ হিসেবে সফল ফর্মুলায় তৈলটি তৈরি করে বাজারজাত করার সাথে সাথে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এতে তাঁর সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কালী কুমার হাই স্কুল থেকে এম. সাহা ১৯৩৭ সালে মেট্রিকুলেশন পাশ করে কলকাতা আয়ুর্বেদ কলেজে ভর্তি হন। অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে কবিরাজী পরীক্ষায় পাশ করে তিনি জন্মভূমি নরসিংদীতে চলে আসেন। তখন ঢাকা শহর ছিলো পূর্ববঙ্গবাসীর ভাগ্য বদলের একমাত্র অবলম্বন। সঙ্গত কারণে সবার প্রত্যাশা ছিলো, এম. সাহা ঢাকা শহরেই আয়ুর্বেদ প্রতিষ্ঠান দিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন। কিন্তু তিনি সেই প্রত্যাশা পায়ে ঠেলে নরসিংদীতে চলে আসেন এবং প্রতিষ্ঠা করেন আয়ুর্বেদ রিসার্চ সোসাইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তবে এম. সাহা তাঁর আয়ুর্বেদ ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন চর্মের ছত্রাকনাশক ক্রিম ‘পদ্ম মলম’ দিয়ে। উক্ত মলমটি এতোই কার্যকর ছিলো যে, তা দ্বিতীয়বার ব্যবহারের প্রয়োজন হতো না। খোসপাঁচড়া, দাউদ-একজিমা, ছুলি-ঘা যেকোনো রোগের অব্যর্থ ঔষধ ছিলো পদ্ম মলম।

এম. সাহার প্রতিভা ছিলো ব্যতিক্রমধর্মী। পদ্ম মলমের পাশাপাশি তিনি লেমন জাতীয় একটি কোল্ড ড্রিংকসের ফর্মুলা তৈরি করেন এবং তা উৎপাদন করে বাজারজাতও করেন। তৎসময়ে নরসিংদীর মতো একটি থানা সদরে এ-ধরনের আধুনিক পানীয়  উৎপাদন ও বাজারজাত করা ছিলো অকল্পনীয় ব্যাপার। এজন্যে তিনি কলকাতা থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করে নরসিংদীতে কারখানা নির্মাণ করেছিলেন। কোল্ড ড্রিংকসের কাঁচামাল, কেমিক্যাল প্রভৃতি কলকাতা থেকে আনা হতো। পদ্ম মলমের মতো কোল্ড ড্রিংকসটিও জনপ্রিয়তা পায়। গ্রাম-গঞ্জের মানুষের কাছে এম. সাহার কোল্ড ড্রিংকস ছিলো স্বপ্নের পানীয়। এরপর উৎপাদন শুরু করেন ‘কান্তা কেশ তৈল’ আর ‘হিমকবরী কেশ তৈল’। এম. সাহার নিজস্ব ফর্মুলা আর অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রতিটি পণ্যই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়।

এম. সাহার পিতার নাম ছিলো শশীমোহন সাহা। তিনি ছিলেন উক্ত আয়ুর্বেদ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। তাঁর অপর ভাই ছিলেন মিহির লাল সাহা, চুনি লাল সাহা ও যদু লাল সাহা। তারা সবাই কারখানা ও ব্যবসা পরিচালনা করতেন যৌথ উদ্যোগে। বর্তমানে নরসিংদীর সদর রোডস্থ প্রধান ডাকঘরের পাশে ‘হিমকবরী হাউস’ই হলো তাদের আদি বাড়ি, কারখানা ও বিক্রয় কেন্দ্র। তাদের আরেকটি বাড়ি ছিলো ডাক্তার হেমেন্দ্র সাহার মোড়স্থ মসজিদের সম্মুখে। অভিরাম মণ্ডল বাড়িটি এম. সাহার কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন।

জানা যায়, ভ্রাতৃ কলহের কারণে পাক আমলে তাদের আয়ুর্বেদ ব্যবসাটি দু’ভাগ হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠাতা এম. সাহা পদ্ম মলম, কান্তা কেশ তৈল ও লেমন কোল্ড ড্রিংকস নিজের কাছে রেখে শুধুমাত্র হিমকবরী কেশ তৈলটি তিন ভাইকে ভাগ করে দেন। কিন্তু শেষাবধি শুধুমাত্র হিমকবরী তৈলের খ্যাতিই বজায় থাকে।

এম. সাহা একজন ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিভাবান লোক হলেও তাঁর চিন্তাধারা ছিলো একটু অস্থির ধরনের। কোনো-একটা চিন্তাধারায় তিনি বেশি সময় নিবদ্ধ থাকতে পারেননি। তাছাড়া তিনি আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে সফল হলেও মার্কেটিং সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন। ফলে তাঁর উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণের ব্যর্থতার কারণে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। অপরদিকে হিমকবরী তৈলের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বিতে গিয়ে পৌঁছে। অপর তিন ভাইয়ের একটি গুণ ছিলো, তারা হিমকবরীর বদৌলতে প্রচুর অর্থ-যশ অর্জন করলেও আর দ্বিতীয় কোনো পণ্য উৎপাদনের কথা ভাবেননি। এর মধ্যে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন এম. সাহা পরিবারটি ভারতে চলে যান। যুদ্ধ শেষে অন্যরা ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার পরিকল্পনা করলেও যদু লাল সাহা নরসিংদীতে ফিরে আসেন। প্রোপ্রাইটর হিসেবে তিনি হিমকবরী কেশ তৈলের বাজার ধরে রাখেন। পরবর্তীতে তৈলের লেবেলে নিজেকে স্বত্বাধিকারী হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতা, অসাধু ব্যবসায়ীদের দাপটের মুখে তিনি ব্যবসাটা আগের মতো ধরে রাখতে পারেননি। ধর্মীয় উন্মাদনা আর সাম্প্রদায়িকতার হুঙ্কারের কারণে হতাশাগ্রস্ত যদু লাল সাহা সপরিবারে ২০০৩ সালে জোট সরকারের আমলে নীরবে-নিঃশব্দে প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে ভারতের বিরাটীতে পরবাসী হন। অবশ্য হিমকবরীর প্রতিষ্ঠাতা এম. সাহা অনেক আগেই সপরিবারে ভারতবাসী হয়েছিলেন।

এম. সাহার খ্যাতির নক্ষত্র মাটিতে পতিত হলেও তাঁর ছেলে  ডা. মাখন লাল সাহা গোল্ড মেডেল নিয়ে এমবিবিএস পাশ করে বর্তমানে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কৃতী সার্জন। তিনি ১৯৬৮ সালে সাটিরপাড়া কালী কুমার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে পাশ করেই কলকাতা প্রবাসী হয়েছিলেন। এই প্রতিভাবান হিন্দুদের দেশত্যাগ সত্যি মর্মান্তিক। এতে একদিকে এদেশে মেধাশূন্যতা দেখা দিচ্ছে, অপরদিকে আমাদের মানবিকতা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। একশ্রেণির মানুষের মানসিক, সামাজিক, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শারীরিক নিপীড়নের কারণে আরেক শ্রেণির মানুষ তার পিতৃভূমি ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

যদু লাল সাহা সপরিবারে দেশত্যাগ করার আগে হিমকবরী হাউস, বসতবাড়ি, তৈল উৎপাদনের ফর্মুলা, লাইসেন্স তথা গুডউইল সবকিছু নরসিংদীর স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ও সমাজসেবী সরোজ কুমার সাহার কাছে বিক্রি করে গেছেন। মালিকানা পরিবর্তিত হলেও ‘হিমকবরী’ এখনো উৎপাদিত হচ্ছে সীমিত পরিসরে। দিনাজপুর, রংপুর ও সিলেট অঞ্চলে বর্তমানে বাজারজাত করা হচ্ছে একসময়ের বাজার কাঁপানো এই তৈল।

কৃতজ্ঞতা
সাটিরপাড়া কালী কুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক প্রয়াত সত্যেন্দ্রনাথ মোদক


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

কাজীকে দেখে এলাম

0
তামারা ফিলিপসের ‘বিনিথ ম্যাজিক’

কাজী, গোলাপের চাষ করতে চেয়েছিলো। সে গোলাপ ভালোবাসে। গোলাপের গন্ধ

চাপিলা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়ার সময় তার প্রথম স্মরণ হয় লাল রঙের কথা। আর একখণ্ড পপলার কাঠের কথা। সে ভাত মাখাচ্ছিলো আর ভাবছিলো গতকাল বৃষ্টি হয়েছে কিনা। বৃষ্টি হলে দুলালি পায়ে নূপুর পড়তো। দুলালি কি কাল নূপুর পড়েছিলো? দুলালি কি কখনো নুপূর পড়তো? সে মনে করতে পারলো, দুলালির বুনি ছিলো বেশ বড়ো। আর চোখগুলোও!

কালবোশেখের ছেনালি শব্দ আসছে কানে। কাজী খাবার শেষে একটা সিগারেট ধরালো। শীত শীত করছে আর মনে পড়ছে দুলালির উদোম গতর। কাজী হঠাৎ চোখ বন্ধ করলো। চোখ বন্ধ করলে তার আবার স্মরণ হয় লাল রঙের কথা। গোলাপের কথা।

একটা গোলাপের ছবি আঁকবো। কাজী ভাবলো।
একটা টকটকে লাল গোলাপের ছবি আঁকবো। আবার ভাবলো কাজী।

তিনদিন আগে শুরু হওয়া মাসের তৃতীয় দিনে এসে কাজী প্রথম তার ক্যানভাসে আঁচড় টানলো। আঁচড় টানলো টকটকে লাল রঙের। এরপর একদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো যখন, তখন কাজী আমাদের গোলাপের গল্প বলেছিলো। সে গল্প বলেছিলো ইসমাইল ভাইয়ের বৃদ্ধ এবং কালো ধোঁয়ায় জঙ ধরে ওঠা অতীত দিনের একটা চায়ের দোকানে বসে।

সে বললো, “দুলালির যোনিতে কিড়া ধরেছে। কিড়াগুলো সেখানে কিলবিল করছে। তাকে ডাক্তার দেখানো উচিত
কাজী চায়ে চুমুক দেয়। চায়ের জলে লেবুপাতা ভাসছে। আমরা লেবুপাতার গন্ধ পেলাম। আমরা গন্ধ পেলাম দুলালির কিড়ায় ধরে ওঠা যোনির।
হ্যাঁ, দুলালির যোনিতে কিড়ায় ধরেছে”, কাজী বললো।
কিড়াগুলি সেখানে কিলবিল করছে”, আবার বললো কাজী।

পুরোনো দিনের ঘুমের মতো দেখতে এই চায়ের দোকানটায় আমরা ছিলাম তিনজন। আমি, আমার বন্ধু আর কাজী। আমি সিগারেট টানছিলাম। আমি চাইছিলাম না আমার সিগারেট থেকে কাজীকে ভাগ দিই। কাজী আবার চায়ে চুমুক দেয়। চায়ের জলে লেবুপাতা ভাসছে। আমি তাকিয়ে থেকে দেখি, কাজীর হাতে লাল রঙ লেগে আছে। আর এই লাল রঙের জায়গাটায় আটকে আছে একটা শাদা রঙের কিড়া। আমার মনে হলো কিড়াটির কোনো মাথা নেই।
হুঁ, কিড়াটির কোনো মাথা নেই”, আমার বন্ধু বললো।

আমি আমার বন্ধুর দিকে তাকাই, তাকে আমার কৈ মাছের মতো মনে হয়। তাকে মনে হয় মাটিতে আটকে পড়া একটা কৈ মাছের মতো!
তোকে একটা কৈ মাছের মতো লাগছে”, আমি বলি।
তোকে একটা মৃত কৈ মাছের মতো লাগছে”, আবার আমি বলি।

এরপর অনেকদিন আমরা আমাদের চোখ বন্ধ করে রাখি অথবা আমরা আর এরমধ্যে কাজীকে দেখতে পাইনি। সে ছিলো অদৃশ্য এবং আমরা ভাবলাম, সে এমনই। তখন, আবার অতীত দিনের মতোই ইহুদী আর মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেলো। আর যুদ্ধ লাগলো সেই একই পুরোনো এবং পবিত্র আর মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের জায়গা জেরুজালেমে। যদিও ইহুদীরা ছিলো আজীবন নির্যাতিত এবং কখনো নিজেদের একটা দেশ না পাওয়া জাতি। তবুও আমরা দেখলাম, তারা কেমন শক্তিশালী আর বেজন্মা একটা জাতি হয়ে ওঠলো!

আমি আর আমার বন্ধু, যাকে আমার মৃত কৈ মাছের মতো মনে হয়, আমরা আলাপ শুরু করি এই যুদ্ধ নিয়ে। আমরা আলাপ করি টাওয়াদীর গলির মোড়ে রবীন্দ্রনাথের চায়ের দোকানে বসে। রবীন্দ্রনাথ কখনো দুধ চা বিক্রি করেন না। কারণ হিসেবে তিনি আমাদের বলেন, তাঁর কোনো প্রেমিকা নেই। আমরা কেবল তাঁর দোকানে রঙ চা খাই। এবং মাঝেমধ্যেই মুসলমান আর ইহুদীদের যুদ্ধ নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলি।
গাজায় আজ একটা শিশু মারা গেছে”, আমার বন্ধু বললো, যাকে আমার মৃত কৈ মাছের মতো মনে হয়।
শালা ইহুদীদের পাছা ফাটিয়ে দেয়া উচিত”, আবার আমার বন্ধু বললো, বলা বাহুল্য, যাকে আমার মৃত কৈ মাছের মতোই মনে হয়।

আমি তার কথার পিঠে কোনো কথার পেরেক ঠুকি না। আমি টিভিতে নিচের দিকে যমুনার জলের মতো বয়ে যাওয়া সংবাদ পড়তে থাকি। যেখানে বলছে এবং দেখাচ্ছেও, গুলিস্তানে এক কথা বলা কুকুর পাওয়া গেছে। সাংবাদিকের দল এই কথা বলা কুকুরের দিকে মাউথপিস বাড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কুকুরটি গলা খাঁকারি দিয়ে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। সে জনগণের সেবা করতে চায়। সে জনগণকে সাথে নিয়ে উন্নয়নের বিপ্লব করতে চায়। সে সবার ঘরে সমপরিমাণ মাংসের হাড়ের জোগান পৌঁছে দিতে চায় এবং এক্ষেত্রে সে বদ্ধপরিকর।

শালারা সবসময় কুকুরের দিকেই মাইক বাড়ায়”, আমার বন্ধু বললো।
কথা বলা কুকুরের দিকেই”, আবার আমার বন্ধু বললো।
তখন একটা প্রজাপতি এসে ঢুকলো চায়ের দোকানটায়। আর এর পেছন পেছন আমরা দেখলাম কাজীকে। কাজী আমাদের সামনে এসে, যেনো আমরা দেখতে পাইনি এমন করে জাদুকরের মতো শূন্য থেকে এক ছবি এনে বের করলো। আমরা ছবিটির দিকে তাকালাম, এরপর তাকালাম কাজীর দিকে, তারপর আবার ছবিটির দিকে। আমরা বিশ্বাস করতে চাইছিলাম যে, ছবিটা কাজীই এঁকেছে।
তখন কাজী বললো, “ছবিটা আমি এঁকেছি।

শালা শুয়োরপুত্র করলো কী!
ছবি এতোটাই নিখুঁত যে, মনে হচ্ছে গোলাপের পাপড়ি থেকে কিড়াগুলো হয়তো এখনই জোরবাতাসে উড়ে যাবে।
তুমি এটা কেমন করে আঁকলে”, আমার বন্ধু জানতে চাইলো।
এই গোলাপ আর এই কিড়াগুলো”, আবার আমার বন্ধু জানতে চাইলো।
আমি খেয়াল করলাম, কিড়াগুলোর কোনো মাথা নেই।
হুঁ, কিড়াগুলোর কোনো মাথা নেই”, কাজী বললো।
আমি আমার ছবিগুলো নিয়ে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করবো”, আবার বললো কাজী।
তখন কাজী ঠিক করে কলেজের পুকুরপাড়ের রাস্তার দুপাশে যেগাছেরা রয়েছে, তাতেই দড়ি দিয়ে টাঙিয়ে সে এই আয়োজনটা করবে। পরদিন কাজী তার ছবিগুলো নিয়ে পুকুরপাড়ের রাস্তায় চলে এলে সে দেখে যে, এখানে কোনো গাছ নেই।
এখানে তো গাছ ছিলো”, কাজীর মনে হয়।
এখানে কি কোনোদিন গাছ ছিলো”, আবার মনে হয় কাজীর।
কাজী চারপাশে তাকিয়ে কী যেনো হাতড়ায়। তার চোখ তখন পৃথিবীর চোখ বলে মনে হয় না আমাদের। আমরা তাকিয়ে দেখি, সে তার ছবিগুলো নিয়ে হাঁটতে শুরু করে দেয়। সে হাঁটতে থাকে। আমরা এটা আমাদের জন্মের সময় পাওয়া চোখ দিয়ে দেখি। পরদিন মুর্দা দেখার মতো খবরের কাগজে পড়ি, কাজী হাঁটছে। এইদিন বিকেলে আমরা টিভিতে দেখতে পাই, কাজী হাঁটছে। তখন আমরা আরো দেখি যে, সে একা নয়, তার সাথে আরো অনেকেই হাঁটছে।
কাজী হাঁটছে’, এই আলোচনা আমরা এক সপ্তাহ ধরে করি।

এরপর আমরা যখন ভুলে যাবো বলে ঠিক করলাম অথবা যেসময়ের পর ভুলে ফেলাটাই উচিত, সেই সময় আবার একটা প্রজাপতিকে দেখি চায়ের দোকানে এসে ঢুকতে। আর সেইসাথে আমাদের মনে পড়ে কাজীর কথা। আমরা জেনেছিলাম, কাজী কোনোএক পাহাড়ি এলাকায় গিয়েছিলো।
চল্ আমরা পাহাড়ে যাই”, আমার বন্ধু বললো।
কাজী যেপাহাড়টায় গেছে, তাতে”, আবার আমার বন্ধু বললো।

এরপর আমরা সেই পাহাড়টায় যাই। সেখানে আমরা সেই পাহাড়জুড়ে একধরনের গাছ দেখি।
এইগুলা কী গাছ”, আমি জিজ্ঞেস করি।
এটা কোন জাতের গোলাপ গাছ”, আবার জিজ্ঞেস করি আমি।
পুরো পাহাড়জুড়ে একই ধরনের আর পুরোনো দিনের গল্প বলে এমন গাছ; যা আমাদের বলে, এরা আসলে মানুষ বা এরা আসলে কাজী। আর এরা এখন প্রত্যেকেই গাছ। কেবলই গাছ। আর প্রত্যেক গাছেই ধরে আছে গোলাপ ফুল, যার পাপড়িগুলো কিড়ায় খাওয়া।

বৃক্ষরোপণ বন্ধ করুন দয়া করে

পৃথিবী পুড়ে যাচ্ছে, তাপমাত্রা সকল রেকর্ড ভেঙে নতুন উচ্চতায় স্থাপিত হচ্ছে। এবারের গরম হয়তো মানুষকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে তার চারপাশের প্রকৃতি নিয়ে। কিংবা হয়তো বরাবরের মতোই অন্তত আমাদের দেশের প্রবণতা অনুযায়ী সমস্ত দায়-দায়িত্ব সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। কিন্তু স্বস্তি কি আদৌ আসবে? প্রকৃতিকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে না দিলে প্রকৃতি তার যথাযথ শোধ নিবে, এর বাইরে যাওয়ার কোনো পথ মানুষের প্রজ্ঞা-প্রযুক্তি এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি। তাই নিজেদের বাঁচার স্বার্থেই প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে।

প্রতি বর্ষায় বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃক্ষ রোপিত হচ্ছে, তবু কেনো আমরা এর বিশেষ কোনো সুফল পাচ্ছি না? আমাদের বৃক্ষরোপণ পদ্ধতিই কিংবা বৃক্ষ বিষয়ক প্রাথমিক জ্ঞানের অভাবই আমাদের সুফল বঞ্চিত করছে। আমরা জানি, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার প্রাথমিক একটি উদ্যোগ হলো বৃক্ষরোপণ। আসলে কি তাই? বৃক্ষরোপণ কি আমাদের প্রকৃতিকে রক্ষা করতে পারে? পরিসংখ্যানবিদগণ হয়তো অনেক রকম পরিসংখ্যান দেবেন। যেমন, একটি দেশের ভূমির শতকরা অন্তত পঁচিশ ভাগ বনভূমি থাকা দরকার। বাংলাদেশে এর এক তৃতীয়াংশও নেই। এখন আমরা যদি সবার সম্মিলিত উদ্যোগে পঁচিশ শতাংশ বনাঞ্চল আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরে তৈরি করে ফেলতে পারি, তাহলে কি আমাদের পরিবেশ ভালো হয়ে যাবে?

আমাদের বৃক্ষরোপণ বিষয়ক ধারণায় কিছু মৌলিক গলদ আছে। তাই প্রথমত আমাদের পক্ষে পঁচিশ শতাংশ বনাঞ্চল পুনর্নির্মাণ সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, যদি আমরা পঁচিশ শতাংশ বনাঞ্চল নির্মাণ করতেও পারি, সেই বনই আমাদের মানুষ থেকে পশু বানিয়ে ছাড়বে। সুফল অনেক দূরের ব্যাপার, বনবৃদ্ধির কুফলই আমরা সামলাতে পারবো না। এর প্রধান কারণ আমরা সাদামাটাভাবে জেনেছি যে, বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা করা যায়। আমাদের দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি শ্লোগান হলো ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’। পরিতাপের বিষয় হলো, আমরা গাছ লাগিয়েই পরিবেশকে একেবারে খাদের কিনারায় নিয়ে এসেছি।

আমরা বলতে চাই, আপনারা দয়া করে গাছ লাগানো বন্ধ করুন। যদি দেশের মানুষের কল্যাণ কামনা করেন, যদি আপনার পরিবেশ নিয়ে কিছুটা মায়া-মমতা থাকে, তাহলে গাছ লাগানো বন্ধ করুন। কারণ, আপনারা গত আশির দশক থেকে এখন পর্যন্ত গাছ লাগিয়ে বাংলাদেশের পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান ও মননশীলতার যে-বিপুল পরিমাণ ক্ষতি সাধন করেছেন, তা স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে আরো অন্তত বিশ বছর লেগে যাবে। আর যদি ক্রমাগত গাছ লাগাতে থাকেন, তাহলে এই দেশটার অন্তত প্রাকৃতিক কোনো ভবিষ্যত নেই, একথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়।

আমরা গাছ লাগানোর নামে বাংলাদেশের বাস্তুসংস্থান, পরিবেশ-প্রতিবেশ, পুষ্টি, বৃক্ষ-অর্থনীতি, প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক, পাখি-পতঙ্গসহ জমির ফসল, পুকুরের মাছ, পশুখাদ্যের শৃঙ্খলা, সবকিছুতেই একটি বড়ো বিপর্যয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি। কারণ, আমরা ব্যাপকহারে লাগিয়েছি মেহগনি, ইউক্যালিপ্টাস, রেইনট্রি, একাশিয়া, শিশু ইত্যাদি। এসব গাছ আমাদের পরিবেশের জন‌্যে মারাত্মক ক্ষতিকর। দ্রুত বর্ধনশীল, লাভজনক, অল্প আয়াস ও অল্প জায়গায় বেশি রোপণযোগ্য ইত্যাদি বিবিধ বিভ্রান্তিকর প্রচারণা এবং প্ররোচনায় আমরা এসব বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে আমাদের পরিবেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছি। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অতি উর্বর মাটিকে আমরা ইউক্যালিপ্টাসের মাধ্যমে মুড়িয়ে দিয়েছি। ইউক্যালিপ্টাস অতিমাত্রায় পানি শোষণকারী একটি গাছ, যেটি কোনো কোনো এলাকার মরুকরণের জন‌্যে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। এর পাতা, এর গঠন পাখি-পতঙ্গ, মানুষ-প্রাণিকুল কারো জন‌্যেই বিশেষ কিছু রাখে না আমাদের পরিবেশে। ফুল-ফল তো নেই-ই, আছে কাঠ, তা-ও আবার নিম্ন মানের। অথচ উত্তরাঞ্চল আমাদের আম-জাম-লিচুসহ সকল ফলের প্রধান যোগানদাতা। উত্তরাঞ্চলের মাটিকে অনুর্বর করে দেয়ার যে-ষড়যন্ত্র, সেটি এখনো চলমান আছে। দেশের অধিকাংশ সরকারি নার্সারিতে ব্যাপকহারে উৎপাদিত হচ্ছে এসব ক্ষতিকর গাছের চারা, যা স্বল্পমূল্যে অথবা বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে বিভিন্ন বৃক্ষরোপণ অভিযানে পরিবেশ বাঁচানোর নামে! আমাদের পরিবেশবিদগণ, পরিবেশ রক্ষাকারীগণ মহাউৎসাহে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশ ধ্বংসে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন ক্রমাগত।

উত্তরাঞ্চলকে ধ্বংস করা হচ্ছে ইউক্যালিপ্টাস রোপণের মাধ্যমে, আর মধ্যাঞ্চলে ব্যাপকভাবে রোপিত হচ্ছে রাক্ষুসে বৃক্ষ রেইনট্রি। রেইনট্রি অন্তত দশ থেকে পনেরোটি দেশীয় প্রজাতির জায়গা দখল করে সগর্বে বিস্তার করে তার ডালপালা। নিম্ন মানের কাঠসহ ক্ষতিকর পাতা ঝরানোর মাধ্যমে রেইনট্রি ক্রমাগত কমিয়ে দিচ্ছে আমাদের ফসল ও মাছের উৎপাদন। আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টি সহজেই আমরা অনুধাবন করতে পারি না। কারণ, আমরা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন‌্যে অতিরিক্ত সার-কীটনাশক প্রয়োগ করে উৎপাদন ঠিক রাখছি, পাশাপাশি মাছের জন‌্যেও লাগছে অতিরিক্ত খাবার। পশুখাদ্য, মানুষের পুষ্টি চাহিদা আর পাখির খাবার বা বাসস্থানের বালাই নেই। সার-কীটনাশকে ফসল ও বিভিন্ন বর্জ্যে মাছ ও মুরগী পালনের মাধ্যমে নিজেদের জন‌্যে তৈরি করছি বিষাক্ত খাবার। আমাদের দেশে ইতোমধ্যেই ক্যান্সার প্রায় মহামারি আকার ধারণ করেছে এসব বিষাক্ত খাবারের প্রতিক্রিয়ায়। অথচ রেইনট্রির বদলে দেশীয় ফলের গাছ পুরো চিত্রটাই উল্টে দিতে পারে। কিন্তু সেটি সম্ভব হচ্ছে না, কারণ, আমরা অগ্রপশ্চাদ বিবেচনা না করেই বৃক্ষরোপণ করে পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করছি।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে মেহগনির। প্রায় প্রত্যেক সরকারি-বেসরকারি নার্সারিতে কোটি কোটি মেহগনির চারা রোপিত হবার অপেক্ষায় থাকে প্রতিবছর। যদিও এই গাছগুলো সারাদেশেই সহজলভ্য, কিন্তু অঞ্চলভেদে কোনো কোনো প্রজাতির রাজত্ব লক্ষ্য করা যায়। মেহগনির বিষাক্ত ফল ও পাতা আমাদের পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান ব্যাপকভাবে ধ্বংসের জন‌্যে প্রধানত দায়ী। আমরা সরলমনে বৃক্ষরোপণের উৎসাহে, পরিবেশের প্রতি ভালোবাসায় এই বৃক্ষগুলো রোপণ করলেও এসব প্রজাতির বৃক্ষ রোপণের পরামর্শদাতারা আমাদের মতোই সরলমনে এদেরকে এই উর্বর ভূমিতে পুনর্বাসিত করেনি। তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশই এসব প্রজাতি নির্বাচন। বাংলাদেশ বন বিভাগের নার্সারিগুলো সাধারণত ফলের চারা উৎপাদন করে না (স্বল্প পরিমাণে ব্যতিক্রম আছে)। বন বিভাগের জনপ্রিয় ধারণাগুলোর একটি হলো সামাজিক বনায়ন। আমাদের বক্তব্য হলো, সমাজকে বন বানিয়ে দয়া করে আমাদের পশু বানাবেন না। বন বনেই থাকুক, সমাজের বন হয়ে ওঠা আর সমাজের মানুষের পশু হয়ে ওঠার মধ‌্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। আমরা বৃক্ষকে যখন শুধুই টাকা উপার্জনের উৎস হিসেবে বিবেচনা করতে শিখি, তখন আমাদের মনুষ্যত্বকে ছাপিয়ে পশুত্বই জোরালো হয়ে ওঠে। বৃক্ষ কেবলি টাকার উৎস নয়, প্রকৃতি শুধুই আমাদের স্বার্থ পূরণের উপায় নয়। কিন্তু যখনই একান্ত ব্যক্তিগত বিবেচনায় একটি কাঠের গাছ লাগানো হয়, মানুষ পশুত্বের দিকে একধাপ এগিয়ে যায়। কেননা, সেখানে ঐ-ব্যক্তির স্বার্থের বাইরে সমাজে বসবাসকারী অন্য কারো জন‌্যে আর কিছুই থাকে না। ফলের গাছে যেমন মানুষ-পশু-পাখি সবার জন‌্যে অল্প পরিমাণে হলেও খাদ্য-আশ্রয়-বাসস্থানের ব্যবস্থা থাকে, কাঠের গাছের চরিত্র এর বিপরীত। মানুষকে পশু বানানোর একটি সুদূরপ্রসারী প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে সামাজিক বনায়ন এবং সর্বত্র কাঠের গাছ রোপণের মাধ্যমে।

আমাদের অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনাহীন বৃক্ষপ্রেম পরিবেশ বিপর্যয়ের জন‌্যে প্রধানত দায়ী। সরকারি মহল থেকে এর সরাসরি উৎসাহ যোগানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষ ভালো বিবেচনায় এসব প্ররোচনায় একপ্রকার ফাঁদেই পা দিচ্ছে বলা যায়। সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে আমরা কথা বলে জেনেছি, তাদেরও বিশেষ কোনো ভাবনা নেই এসব বিষয়ে। অনেকটাই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলছে আমাদের পরিবেশ সুরক্ষার আন্দোলন। প্রতিটি বৃক্ষের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য আছে, যার সাথে সংশ্লিষ্ট বাস্তুসংস্থানের সম্পর্ককে বিবেচনায় না নিলে উপকারের বদলে সেটি ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে এর ভয়াবহ প্রভাব আমরা নানাভাবেই দেখতে পাই। প্রতিবছর ঝড়ের কবলে পড়ে হাজার হাজার পাখি মারা যাচ্ছে। কারণ, এসব বৃক্ষ পাখির আশ্রয় হিসেবে উপযোগী নয়। আমাদের সাতচল্লিশ (৪৭) শতাংশ মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। কারণ, মূল খাবারের সাথে দেশীয় ফলের যোগান পর্যাপ্ত নয়। দেশে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার বিদেশি ফল আমদানির মাধ্যমে দেশের একটি বিরাট আকারের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত পশুখাদ্যের অভাবও পূরণ করতে হচ্ছে আমদানির মাধ্যমে। নিজেদের গাছের ফল আত্মীয়-প্রতিবেশিকে দেয়ার মাধ্যমে যে-হৃদ্যতার সংস্কৃতি ছিলো, তা-ও বিলুপ্তির পথে শুধুমাত্র কাঠের গাছ রোপণের ব্যাপকতার কারণে। এভাবে মেহগনি-ইউক্যালিপ্টাস-রেইনট্রি-শিশু-একাশিয়া রোপণের মাধ্যমে শুধু পরিবেশ নয়, আমরা সারা দেশের বাস্তু-ভবিষ্যত, অর্থ-পুষ্টি, মনন-মায়া সমস্ত কিছু ধ্বংসের আয়োজনে অতি উৎসাহের সাথে অংশগ্রহণ করে চলেছি। তাই আবারো বলছি, আপনারা দয়া করে বৃক্ষরোপণ বন্ধ করুন। নিজ হাতে পরিবেশ-প্রকৃতির, মানুষের, দেশের ক্ষতি করবেন না।


দ্রাবিড় সৈকত
সহকারি অধ‌্যাপক, চারুকলা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ‌্যালয়

চিরচেনা দুর্জন আলী

লোকসংগীতের দেশ আমাদের এই জন্মভূমি। গাজীর পট এদের মধ্যে অন্যতম। আর এই গাজীর পটের অন্যতম বাদক ও গায়েন আমাদের নরসিংদীর হাজীপুর গ্রামের দুর্জন আলী। একজন নরসিংদীবাসী হিসেবে তিনি আমাদের করেছেন সম্মানিত। কিন্তু আমরা কয়জনইবা তাঁর সম্পর্কে জানি? ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি নীরবে চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। আজো অনেককিছুই মনে পড়ে তাঁকে নিয়ে।

উপন্যাসের মতো হাড়িধোয়া নদীর তীরে হাজীপুর গ্রাম। প্রধান সড়ক বলতে মাটির উপর ইটের বুনন। বাড়িগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলাশয় আর খোলা মাঠ দ্বারা আবৃত। রাস্তার ধারে ধারে নাম না জানা হরেক রকমের ছোটো ছোটো গাছপালা। গ্রীষ্মকালের রোদে চারদিকে যখন অস্বস্তি আর ক্লান্তির ছাপ, তখন সবার কাছে এক প্রশান্তির নাম ছিলো দুর্জন আলী ও তাঁর গাজীর পট। দুর্জন আলী ছিলেন এমনি একজন, যিনি মানুষের মাঝে আনন্দ বিলাতেন গাজীর পটের মাধ্যমে। যখনই কোনো বাড়িতে তাঁর আগমন ঘটতো, ঘরের গৃহিণীরা জমায়েত হতো বাড়ির উঠোনে। আর বাড়ির ছেলেমেয়েরা ছুটে আসতো মাঠ থেকে, রাস্তা থেকে। সেসব দুরন্ত ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমিও ছিলাম। এতোটাই আকর্ষণীয় ছিলো তাঁর পরিবেশনা যে, ছেলেমেয়েরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতো তাঁর গীত। কেউ কেউ চেষ্টা করতো তাঁর গাওয়া কয়েকটা লাইন মুখস্থ করে নিতে। এ যেনো ছিলো ছেলেমেয়েদের মনের আনন্দ। বিনিময়ে দুর্জন আলী পেতো প্রতিঘর থেকে একমুঠো করে চাল।

দুর্জন আলী ছিলেন একাকি মানুষ। অবিবাহিত হওয়ায় তাঁর ভাই কোনাই মিয়া, ভ্রাতুষ্পুত্র ও তাদের সন্ততিরাই ছিলো তাঁর আপনজন। তাদের ঘিরেই ছিলো তাঁর সংসার। সারা বছরের উপার্জনের জন্যে কখনো মজুরি খাটতেন, কখনোবা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাতা মেরামতের কাজ করতেন। করতেন কাঠমিস্ত্রীর কাজও। মৃত্যুর আগে তাঁর বয়স হয়েছিলো প্রায় চুরানব্বই (৯৪), কিন্তু ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। শেষ বয়সেও তাঁকে দেখতাম ফুটপাতে বসে ছাতা মেরামতের কাজ করছেন। সমগ্র জীবন কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করতে হয়েছে তাঁকে। অথচ এই দুর্জন আলীই ১৯৯৯ সালে ব্রিটেনে ‘বাংলাদেশ উৎসব’-এ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ২০১৫ সালে ‘ব্রহ্মপুত্র’ পত্রিকার জন্যে তাঁর সাক্ষাতকার নিতে গিয়ে ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের নামাঙ্কিত সার্টিফিকেট দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার।

সময়ের সাথে সাথে দুর্জন আলীর বয়স বাড়ে, বয়স বাড়ে হাজীপুরেরও। শেষ সময়ে তাঁকে দেখতাম বাজারের চায়ের স্টলে। একাকি। তাঁর পরনে থাকতো জীর্ণ কাপড়। অবশেষে ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি সবার অলক্ষ্যে নীরবে চলে গেলেন গাজীর পটের শেষ সূর্য দুর্জন আলী।

দুর্জন আলীর প্রসঙ্গ এলেই আরো বহু স্মৃতি মনের গোপন কুঠুরি থেকে জেগে ওঠে। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে ‘ব্রহ্মপুত্র | নরসিংদী জেলার মুখপত্র’ দুর্জন আলীকে প্রচ্ছদকাহিনি করে সংখ্যা প্রকাশ করে। সেই সংখ্যায়ও লিখেছিলাম আমার শৈশবের নির্মল আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ দুর্জন আলীকে নিয়ে। ‘একজন প্রকৃত শিল্পীর সান্নিধ্যে’ শিরোনামের সেই লেখাটি আবারো পাঠকের সামনে নিয়ে আসা খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলেই মনে করি।

________________________
একজন প্রকৃত শিল্পীর সান্নিধ্যে
ব্রহ্মপুত্র, প্রথম বর্ষ একাদশ সংখ্যা (০১ আগস্ট ২০১৫) থেকে

গাজীর পটের অন্যতম কুশীলব নরসিংদীর গায়েন দুর্জন আলীর বাড়ি হাজীপুর গ্রামের যে-পাড়ায়, সেখানে গিয়ে মন আর যেতে চাইছিলো না। মূল এলাকা থেকে যেনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ; নোংরা জল আর থিকথিকে কাদায় পূর্ণ বাড়িতে যাবার মূল রাস্তা। ‘মূল রাস্তা’ বলে আসলে কিছু নেইও। ঢাকা শহরের বস্তির চেয়েও ঘনবসতিপূর্ণ কয়েকটি টিনের চৌচালা ঘরের কোন দিক দিয়ে যাওয়া যাবে, তা ঠাহর করতে লেগে গেলো আধা ঘণ্টা। তারপর আছে প্রায় হাঁটুসমান নোংরা পানি পেরোনোর ধকল। তবু যাওয়া হলো। আমরা তিনজন। আমাদের পথ দেখিয়ে চলেছেন এলাকার প্রবীণ, মহৎ, আন্তরিকতাপূর্ণ একজন মানুষ। নাম নিরঞ্জন বাবু।

দুর্জন আলী বাড়ি নেই। অগত্যা ঘরে বসে অপেক্ষা করতে হলো। অপেক্ষা করতে করতে কথা হচ্ছিলো তাঁর ভাতিজার বউয়ের সাথে। তিনি আমাদের আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। ঘরের পুরো অংশে দরিদ্রতার ছাপ সুস্পষ্ট। কিন্তু এই মহিলার হাসি ও কথায় কোনো দরিদ্রতার চিহ্ন ছিলো না।

গেয়ে শোনাচ্ছেন দুর্জন আলী

…অবশেষে দুর্জন আলী এলেন। আমাদের চক্ষু সার্থক হলো। খর্বাকৃতির হালকা-পাতলা গড়নের এক বৃদ্ধ। তবে চেহারায় মনীষীদের ছাপ। এক দেখায়ই ভালো লাগলো। দুর্জন আলী যে-ঘরটাতে থাকেন, সেটা কতোটা করুণাঘন, না দেখলে বোঝার উপায় নেই। কিন্তু মুখে তাঁর পরম তৃপ্তির হাসি। আমাদের দেখে খুব খুশি। কিছুটা গেয়ে শোনালেন। ইংল্যান্ড ভ্রমণের বর্ণনা দিতে দিতে সার্টিফিকেট খোঁজাখুঁজি করছেন আর বলে চলেছেন তাঁর প্রাজ্ঞতাপূর্ণ কথাবার্তা। কথোপকথনের এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “গাজীর গান কেনো গান! কী আছে এই গানে!” বললেন, “এটা গাইলে সুখ আসে মনে। জ্ঞান পাওয়া যায়।” এরচে’ বড়ো মহৎ কথা আর কী হতে পারে! নিজের মতো এই যে আত্মসুখ লাভ, এরচে’ মহৎ শিল্পী আর কে হতে পারে!

আমরা জিজ্ঞেস করি তার বর্তমান দুরবস্থা নিয়ে, কিন্তু এই বৃদ্ধ-তরুণ মহান শিল্পী এসব কথার ধারে-কাছেও গেলেন না। তিনি কেবল তার গাজী-কালু, পট ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে উৎসাহী। আর তাঁর মুখে লেগে আছে পরিতৃপ্তির হাসি।

দুর্জন আলীর জীর্ণ কুটির

 

তাঁর ভাতিজা ফজল মিয়া এলেন। তিনি বের করলেন শম্ভু আচার্য’র আঁকা পটচিত্র এবং শোনাতে লাগলেন আমাদের, চিত্র ধরে ধরে কাহিনি-গান। আমাদের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বারবার আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে দিতে লাগলো। ফজল মিয়া গ্রামে ঘুরে ঘুরে ভাঙা ছাতা ঠিকঠাক করেন। ফজল মিয়া যখন গান শুরু করেন, তখন দুর্জন আলী নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি, তিনিও শুরু করলেন ভাতিজার সঙ্গে। শরীরে এখন আর আগের শক্তি নেই, বোঝা যায়। কিন্তু মনের এক অদম্য অফুরন্ত শক্তির বলে এখনো তারুণ্য ধরে রেখেছেন প্রায় শতবর্ষী এক মহান গায়েন দুর্জন আলী।

আমরা ফিরে আসছি আবার সেই নোংরা কাদাপানি পেরিয়ে। কিছুটা এসে পেছন ফিরে দেখি দুর্জন আলী হাঁটুকাদা পেরিয়ে আমাদের পেছন পেছন আসছেন। উদ্দেশ্য, আমাদের দোকানে বসিয়ে চা-বিস্কিট খাওয়াবেন। আমরা ভাবি, ৬০/৭০ বৎসর ধরে এই অঞ্চলে এক ঐতিহ্য ধরে রাখা এই জীবন্ত কিংবদন্তীকে সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা তথাকথিত শিক্ষিত-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা কী দিয়েছি? একটা ভালোমতো থাকার ঘর নেই, চরম দীন-দরিদ্র অখ্যাত এক পাড়ায় বসে বসে হৃদয়ের ভেতর এই পরম সৌন্দর্য কীভাবে ধরে রাখেন এই বৃদ্ধ? তিনি এখনো কেবল দিতে চান। প্রাপ্তির খেদহীন এই শিল্পীর কাছে শেখার আছে অনেক কিছু।

বাউল ধর্ম ও নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী বাউল মেলা

0

সূর্য উঠার পর থেকেই মেঘনার পার ঘেষে পুঞ্জিভূত হতে থাকে মানুষের সারি। গন্তব্য বাউল বাড়ির ঘাট। যদিও বাঁধানো ঘাট বলতে তেমন কিছু নেই, তবে নির্দেশক আছে। বাড়ির দখিনের ফটক বরাবর চলছে পুণ্যস্নান। স্নান শেষে পুণ্যার্থীরা একে একে প্রবেশ করতে থাকে বাড়ির ভেতরের দিকে। দ্বিতল ভবনটি পার হয়ে গেলেই মূল আখড়াবাড়ি। সামনের দিকে ঘিয়ের প্রদীপ, মোম, ধূপবাতির দোকান। একদম উত্তরের আরাধনা কক্ষের সামনের প্রাচীরে পুণ্যার্থীরা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিচ্ছেন, দরোজার সামনে ছিটিয়ে দিচ্ছেন বাতাসা। ধূপের গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে আসে। উলুধ্বনি, প্রার্থনা চলছে। আরাধনা কক্ষের ভেতর যজ্ঞের আগুন জ্বালানোর জন্যে ঘি ঢালা হচ্ছে। সার্বিক নির্দেশনার দায়িত্ব পিন্টু বাউলের হাতে, তিনি এই আখড়া বাড়ির সেবায়েত।

আখড়াবাড়ির ঠিক মাঝখানটাতে বৈঠকের ছাউনি। দেশ দেশের বাইরের নানা প্রান্ত থেকে আসা বাউল পুণ্যার্থীরা সর্পিল হয়ে বসেছেন। থেমে থেমে চলছে গান, গানের ফাঁকে ভাববর্ণনা। সব মিলিয়ে নরসিংদীর মতো একটা কর্মব্যস্ত মফস্বলের ভেতর এক ভিন্নরকম দৃশ্য। বাড়ির প্রাচীরের ঠিক বাইরেই বিশাল এলাকা জুড়ে মনোহর পসরা। মুখরোচক খাবারের দোকান, জুয়েলারিকসমেটিকস, খেলনার দোকান, ক্রোকারিজ, মাটি কাঠের তৈজসপত্রসব মিলিয়ে এলাহি ব্যাপার। ড্যাবের ঢোল, জিলাপি, পিস্তল, কাঠের ঘোড়াএক লহমায় শৈশবে ফিরে যাওয়া যায়।

বলছিলাম নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী বাউল মেলার কথা। প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমার তিথিতে বাউল ঠাকুরের স্মরণে এই মেলার আয়োজন করা হয়। মূলত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বাউল পুণ্যার্থীদের মিলন উৎসব। বলা হয়ে থাকে, এই মাঘী পূর্ণিমার তিথিতে বাউল ঠাকুর দেহ ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু ঠিকঠাক তাঁর সময়কাল, নাম, পরিচয় এখন আর কিছুই জানা যায় না। তিনিবাউল ঠাকুরনামেই পরিচিত। অবশ্য কোনো লিপিবদ্ধ তথ্যাদি বা ঐতিহাসিক প্রমাণ না থাকার কারণ বাউল ঠাকুরেরই কিছু শর্ত। তিনি লিপিবদ্ধ করাকে জড়গুরুত্বহীন কাজ বলে মনে করতেন। যদি শিক্ষা সাধনাকে নিজের অন্তরাত্মায় ধারণ করা না যায়, তাহলে পুঁথিগত সকল ব্যাপারই অর্থহীন। ঠাকুরের সহস্রাধিক ভাবসঙ্গীত রয়েছে, যা সেই পাঁচ শতাধিক বছর ধরে শুধু মৌখিকভাবে অনুশীলন উচ্চারিত হয়ে আসছে এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের মুখে।

এই উৎসবেরই একজন পুণ্যার্থী শংকরলাল পোদ্দারের কাছে আমরা জানতে চেয়েছিলাম এখানকার বাউল মেলা বাউল ঠাকুরের আগমনের ইতিহাস। তার ভাষ্য এই যে, “বাউল ঠাকুরের দেহ যেস্থানে সমাহিত করা হয়েছে (উত্তরের আরাধনা কক্ষের অভ্যন্তরে), সেখানে একটি ফলক রয়েছে। ফলকে ৯৩৪ বাংলা সনের উল্লেখ রয়েছে। তবে বাউল ঠাকুরের ইতিহাস জানার চেবেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো তাঁর দর্শন শিক্ষাকে ধারণ করতে পারা, তাই নিয়ে বোঝাপড়ার খুব একটা প্রয়োজন নেই। বাউল ঠাকুরের দর্শনভাবের বোঝাপড়া, তাঁর শিক্ষাকে ধারণ করাটাই মূলকথা।সেই জায়গা থেকে এই আখড়াবাড়ি বরাবরই প্রচারবিমুখ। কোনোরকম প্রচারণা ছাড়াই প্রতি বছর ঠাকুরের তিরোধান দিবসে হাজার হাজার পুণ্যার্থী এখানে অংশগ্রহণ করেন, আত্মশুদ্ধি লাভের জন্যে প্রার্থনা করেন। নরসিংদীর বাউলপাড়ার এই বাউল মেলাটি ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে, তা বহু খোঁজখবর করেও জানা যায়নি।

এসব বিষয়আশয় নিয়ে কথা হলো একজন প্রবীণ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের সাথে, যিনি পরলোকগত মণীন্দ্র বাউলের সাথে দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন। মণীন্দ্র বাউলও পেশায় খুব জনপ্রিয় একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ছিলেন এবং দীর্ঘ সময় এই আখড়াবাড়ির সেবায়েত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর সাহচর্যে থাকায় বাউলবাড়িতে দীর্ঘ সময়ের আসাযাওয়ায় অনেক অভ্যন্তরীণ তথ্য জানা থাকার কথা। যদিও তিনি সাক্ষাতকার এবং নাম প্রকাশে অনীহা প্রকাশ করেছেন। তবে আলাপচারিতায় কিছু তথ্য উঠে আসে। তার ভাষ্য অনুসারে, বাউল ঠাকুরের সময়কালটি ভারতবর্ষে মুঘল শাসনামলের, সম্রাট আকবরের সময়ের। আকবরের রাষ্ট্রনীতির সাথে বিরোধের জেরে বাউল ঠাকুর স্বেচ্ছায় নির্বাসন নেন এবং এখানে এসে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োজিত হন। বোধিলাভের পর তাঁর দর্শন প্রচার শুরু করেন। এর আগে তিনি ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু এখানে এসে বাউল ধর্ম প্রচারের সময়রামদাস বাউলনাম ধারণ করেন। তাঁর কোনো সন্তান ছিলো না। এমনকি পূর্ব জীবনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এখন যারা বাউলবাড়ির সদস্য, তারা সময় আখড়াবাড়িতে নিযুক্ত খাদেমদেরই উত্তরসুরী। উন্মুক্ত কোনো নথি না থাকলেও বাউল বাড়িতে কিছু গোপনীয় নথি থাকার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত।

এই প্রবীণ চিকিৎসকের তথ্যের একটা বড়ো ঐতিহাসিক দুর্বলতা এই যে, খুব বেশি কিছু জানা না গেলেও এর আগে আখড়াবাড়ির সেবায়েত যারা ছিলেন, ব্রিটিশ শাসনামল থেকে তাদের নামের তালিকাটি পাওয়া যায়। সেই সূত্রে ব্রিটিশ শাসনামলে (কোনোএক পর্যায়ে) এই আখড়াবাড়ির সেবায়েত ছিলেন স্বর্গীয় নদীরাম বাউল। পরবর্তীতে তাঁর নাতি মণীন্দ্র চন্দ্র বাউল বর্তমানে তাঁর ছেলে সাধন চন্দ্র বাউল, মৃদুল বাউল মিন্টু, শীর্ষেন্দু বাউল পিন্টু, মলয় বাউল রিন্টু এবং প্রাণেশ কুমার বাউল ঝন্টু। প্রাণেশ কুমার বাউল ঝন্টুর মৃত্যুর পর মৃদুল বাউল মিন্টু এবং বছর শীর্ষেন্দু বাউল পিন্টু সেবায়েত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এখন নদীরাম বাউল, যার তথ্য ব্রিটিশ শাসনামলে প্রথম সেবায়েত হিসেবে উল্লেখ করা হয়, তাঁর আরেক নাম রামদাস বাউল। এই জায়গায় এসে বাউল ঠাকুরের নাম সংক্রান্ত যেদাবি প্রবীণ চিকিৎসক করেছিলেন, তা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। আবার সম্ভব যে, একই নামের পুনরাবৃত্তি হয়েছে এবং বাউলদের মধ্যে ধরনের নাম ধারণের ঝোঁক এর আগেও দেখা গিয়েছে।

যাই হোক, এখানকার আগত পুণ্যার্থী, সেবায়েত সকলেই বাউল ধর্মের শিক্ষা, বাউল ঠাকুরের প্রতি ভক্তি ইত্যাদি প্রধান বিষয়বস্তু প্রচার ধারণ করার পক্ষপাতী। বিষয়ে কথা হলো এই বাড়িরই বধূ মীনাক্ষি বাউলের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় বাউল ঠাকুরের ভাবের বিষয়টি পুরো ধরা পড়ে।

প্রতিষ্ঠিত মত অনুসারে, বাউলদের উদ্ভব বিকাশের সাথে অঞ্চলে ইসলামের প্রসারের সংযোগ রয়েছে। ইসলামের বিস্তারের সময় এই অঞ্চলে পারস্যের সুফিধারার আগমন ঘটে। যখন সুফিমত অঞ্চলে প্রবেশ করে, তখন এখানকার স্থানিক আধ্যাত্মিকতা সাধনপদ্ধতির সাথে মিথস্ক্রিয়ায় একটি লোকধর্মের রূপ লাভ করে। এবং যেহেতু এই অঞ্চলের মানুষ এর আগেই বৌদ্ধ সহজিয়াদের তন্ত্র আধ্যাত্মিক যোগ সাধনার সাথে পরিচিত ছিলো, তাই খুব সহজেই সুফিমতের সাথে স্থানীয় মানুষের সংযোগ স্থাপন সহজতর হয়। সামাজিক জাতবৈষম্যবিরোধীদেহাত্মবাদী দর্শন, তার সাথে সাংখ্য, তন্ত্র যোগ সাধনার সংযোগে বাউল ধর্মমত অঞ্চলের মানুষের মনে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়। সুফিবাদের সংস্পর্শে এসে বাউল, বৈষ্ণব ভাববাদ লোকায়ত ধারার বিস্তার ঘটে। বাউলদের বিস্তারের প্রাথমিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন হচ্ছেন আউল চাঁদ মাধব বিবি। তাঁদের প্রয়াসেই বাউলধারার প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে লালন সাঁই এই ধারায় গুরুত্বপূর্ণ অর্ন্তভুক্তি সাধন করেন।

তবে কি নরসিংদীর বাউল ঠাকুর তাঁদেরই চিন্তার উত্তরসুরী? এই জায়গাটিতে এসে আমাদের একটু থামতে হয়। কারণ, বাউল ঠাকুরের সাথে মাধব বিবি বা আউল চাঁদের যেসংযোগ, তারচেঅধিকতর সংশ্লিষ্টতা শ্রী চৈতন্য দেবের সাথে।

ব্রাহ্মণ্যশৈব বৌদ্ধ তান্ত্রিক সহজিয়ার সমবায়ে গড়ে ওঠেছে একটি মিশ্র মত। এর আধুনিক নাম নাথপন্থা।অমৃতকুণ্ডসম্ভবত এদেরই শাস্ত্র চর্যাগ্রন্থ। এটি গোরক্ষপন্থীর রচনা বলে অনুমিত হয়।
বামাচার নয়, কায়াসাধন তথা দেহতাত্ত্বিক সাধনই তাদের লক্ষ্য।হঠযোগের মাধ্যমেই সাধনা চলে। একসময় এই নাথপন্থা সহজিয়া মতের প্রাদুর্ভাব ছিলো বাঙলায়, চর্যাগীতি নাথসাহিত্য তার প্রমাণ। এই দুই সম্প্রদায়ের লোক পরে ইসলাম বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়।
             : ভূমিকা, বাঙলার সূফী সাহিত্য, . আহমদ শরীফ

আহমদ শরীফের এই মতকে আমলে নিলে ধরে নিতে হয় যে, বৈষ্ণববাদের উত্থানের পেছনে সুফিধারার কন্ট্রিবিউশন ছিলো। এই বৈষ্ণব ভাবধারার অন্যতম সংস্কারক হচ্ছেন শ্রী চৈতন্য। তিনি রূপক প্রেমভক্তিসাধনার সমন্বয়ে সনাতন ধর্মের নতুন এক চাঞ্চল্যকর ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন, যা জনমনে ব্যাপক বিস্তার প্রাধান্য লাভ করে। জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে নদীয়ায় এবং পরবর্তী সন্ন্যাসজীবনে ভারতের তীর্থস্থানগুলোতে ভ্রমণের পর দক্ষিণ ভারতের পুরীতে গিয়ে উপস্থিত হন।

পুরীতে অবস্থানকালে তাঁর কাছে অগণিত ভক্ত সমবেত হতেন। চৈতন্য দেবের মৃত্যু নিয়ে রয়েছে বড়ো এক রহস্য, অনেক কথাউপকথা। তবে কৃষ্ণদাস কবিরাজ কর্তৃক রচিতচৈতন্যচরিতামৃতঅনুসারে, চৈতন্য মহাপ্রভু একদিন বিকেলে পুরী জগন্নাথ মন্দিরের একটি উপমন্দির টোটা গোপীনাথ মন্দিরে প্রবেশ করেন। প্রবেশের পরপরই মন্দিরের দ্বার বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে আর কোনোদিন চৈতন্য মহাপ্রভুর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। দাবি করা হয় যে, মহাপ্রভু সেখানেই জগন্নাথ দেবের সাথে লীন হয়েছেন, তাঁর অন্তর্ধান ঘটেছে। এখন, বাউল ঠাকুরের আখড়াবাড়ির দাবি, শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুইবাউল ঠাকুর টোটা গোপীনাথ মন্দিরে অন্তর্ধানের পর তিনি এখানে বাউল ঠাকুর রূপে আবির্ভূত হন।

এখানকার বাউলেরা মূলত সনাতন ধর্মের অনুশাসনগুলোই অনুসরণ করেন। তবে ঈশ্বর সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তার জায়গাটিতে তাঁরা অদ্বৈতবাদী, সর্বেশ্বরবাদী। যেহেতু সবকিছুই ঈশ্বরের সৃষ্টি, তাই প্রতিটি প্রাণের মধ্যেই ঈশ্বর আছেন বলে তাঁদের বিশ্বাস। জীবনাচরণের ব্যাপারে তাঁরা খুব সচেতন। খাবারদাবারের ব্যাপারে বেশকিছু বাছবিচার রয়েছে। একদানা খাবারও যেন নষ্ট না হয়, তা কঠোরভাবে নির্দেশিত। মাংস না খেলেও মাছ (যেহেতু জলজাত, তাই) খান। দেহ মনের উপর খাবারের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে বলে বিশ্বাস করেন তাঁরা।

বাউল ঠাকুরের দর্শনও মূলত সাংখ্যতন্ত্রযোগ সাধনার উপরই প্রতিষ্ঠিত। মানবদেহের যেচালিকাশক্তি, সেখানেই পরমাত্মার অবস্থান, সেখানেই ঈশ্বর বিরাজমান। আর মানুষের মনই হচ্ছে জীবাত্মা। জাগতিক জীবনের মোহে পড়ে পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার ব্যাপক ব্যবধান তৈরি হয়। তখনই মানুষ রিপুর বশবর্তী হয়। অপরাধে লিপ্ত হয়। তাই জাগতিক যতো অসামঞ্জস্যতা, যতো ধরনের বিশৃঙ্খলা রয়েছে, বাউল ঠাকুর তাঁর সমাধান খুঁজেছেন দেহের অভ্যন্তরে। নিজের মধ্যেকার যেই কামক্রোধহিংসালোভ, তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেই কেবল জীবাত্মা পরমাত্মার মিলন ঘটানো সম্ভব। সম্ভব প্রকৃত অর্থেমানুষ’- উন্নীত হওয়া। আর এজন্যেই প্রয়োজন দেহসাধনা। জগতের সবকিছুর প্রতিরূপ মানুষের নিজের মধ্যেই রয়েছে। এখানেই দেশকালপাত্র, এখানেই মন্দিরকাবা। একটি গানের কথা অনেকটা এমন

এই দেহভাণ্ডে আছে, ব্রহ্মাণ্ডে নাই,
দেহের বিচার করতে হইলো, নইলে মানুষ হারাই
(দেহের উপযুক্ত সাধনা করতে না পারলে মনুষ্যজন্ম হারাতে হবে, দেহ সাধনা না করলে তো আর দেহের প্রয়োজন নাই। পরবর্তী জন্মে চুরাশি লক্ষ প্রজাতির কোনো একটিতে জন্মলাভ করতে হবে।)

ঠাকুরের সহস্রাধিক ভাবসঙ্গীত মূলত দেহ সাধনার মাধ্যমে নিজের অন্তরাত্মাকে পবিত্র বিশুদ্ধ করার প্রয়াসেই রচিত। বাড়ির সদস্যরা প্রতি বুধবার সন্ধ্যায় বৈঠকে পর্যায়ক্রমে সেগুলো পাঠ আলোচনা করেন। উন্মুক্ত বৈঠক হওয়ায় পুণ্যার্থীরাও যুক্ত হতে পারেন।

ধর্মমতে নারীকে খুব পবিত্র এবং অপেক্ষাকৃত শ্রেষ্ঠতম হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়। বলা হয়ে থাকে, নারীই সৃষ্টির মূল। মাতৃগর্ভকে বিশেষ প্রতীকী অর্থেও ব্যবহার করা হয়। নারী পুরুষ দুজনের মধ্যেই ছয়টি রিপু তথা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ মাৎসর্য বিদ্যমান। তবে নারী আরো অতিরিক্ত তিনটি রিপুর অধিকারী : মায়া, জঠর (গর্ভ) ধৈর্য। বাউলমতে, পুরুষের জন্যে ঈশ্বরের আরাধনা আরো কঠিন এই কারণেই যে, তাকে ছয়টি রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং নারী যে অতিরিক্ত রিপুর অধিকারী, তা পুরুষকে মনে ধারণ করতে হয়, আয়ত্ত করতে হয়। কারণ, মাতৃমনন ছাড়া ঈশ্বরের সাধনা সম্ভব নয়, নিজের দেহের ভেতরে অন্তর্দৃষ্টি রাখা সম্ভব নয়। এই কারণেই বাউলদের মধ্যে নারীর মতো করে দীর্ঘ চুল রাখার একটি প্রচলন রয়েছে।

খুব চমৎকার নিয়মানুবর্তিতা শৃঙ্খলার মধ্যে জীবনযাপন করেন তাঁরা। জীবনযাপনে রয়েছে চিহ্ন প্রতীকের ব্যবহার। তন্ত্র যোগ সাধনা যাপনের বড়ো একটা স্থান দখল করে আছে। এমনকি, যদি যজ্ঞের আগুনের কথাই ধরিসাধারণ ব্রাহ্মণের যজ্ঞে দেখা যায়, মাটির উপর উঁচু করে কাঠ অন্যান্য রসদে আগুন জ্বালানো হয়। কিন্তু বাউল ঠাকুরের তিরোধান উৎসবের মহাযজ্ঞে আগুনের জায়গা তৈরি করা হয়েছে মাটি খুঁড়ে, ভেতরের দিকে। এই যজ্ঞের আগুনের জন্যে সচেতনভাবে মাটি খুঁড়ে তৈরি যেগর্ত, তা সম্পূর্ণই মাতৃগর্ভের প্রতীক। এইরূপ অসংখ্য প্রতীকের ব্যবহার রয়েছে পুরো আখড়াবাড়ি তাঁদের জীবনযাপন জুড়ে।

বাউল ঠাকুর তাঁর ধর্মমত ইতিহাসের এক অনালোচিত অধ্যায়। এই ব্যাপারে বাইরের জগতের জানাশোনা খুব সামান্যই। অবশ্য আগেই বলেছি, এর একটি বড়ো কারণ হচ্ছে লিখিত কোনো দালিলিক নথি না থাকা বা না রাখা। তবে যাই হোক, সার্বিক বিচারে ইতিহাসের একটি দুর্গম সময়ে, যখন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জাতবৈষম্য তুঙ্গে, তখন বাউল ঠাকুর সমতা, অসাম্প্রদায়িকতা জাতবৈষম্যহীন সমাজের শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন, যা এখনো প্রাসঙ্গিক।

নরসিংদীর লোকউৎসব ও লোকমেলা

ওরস
নরসিংদী জেলাধীন নরসিংদী সদর উপজেলার কাবুল শা’ (রা.)-এর মাজার, বেলাব উপজেলার আমলাব বাজারে হজরত শাহ আলী শাহ (রা.)-এর মাজার, ভাটেরচর দক্ষিণপাড়া ভূঁইয়া শাহ বাড়ির দরবার শরীফ মাজার, শিবপুর উপজেলার কুমরাদী গ্রামের শাহ মনসুরের মাজারে বছরের বিভিন্ন সময় ওরস অনুষ্ঠিত হয়। ওরস উপলক্ষে স্থানীয়সহ বিভিন্ন এলাকার মানুষের সমাগম হয়।

হযরত মাওলানা কাবুল শা’ (রা.)-এর মাজারের ওরস
প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের ১২ তারিখে কাবুল শা’ মাজারে ওরস অনুষ্ঠিত হয়। দেড়শো বছর আগে নরসিংদী পৌরসভার তরোয়ায় হযরত মাওলানা কাবুল শা’ (রা.)-এর মাজারের এই স্থানটি জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিলো। জঙ্গলের ভেতর এই রওজা অর্থাৎ মাজার পাওয়া যায়। আজ থেকে ১৭ বছর আগে এই মাজারের ভবনের পিলার তৈরি করার সময় মাটির নিচে ইটের দেয়াল পাওয়া যায়।

হযরত মাওলানা কাবুল শা (রা.)-এর মাজারের খাদেম মো. হারুন-অর-রশীদ খান বলেন, “আমার দাদা হাজী সামাদ খান বিয়াল্লিশ বছর এই মাজারের খাদেমগিরি করেন। এরপর আমার বাবা মেহের খান পঁচিশ বছর এবং আমি আটত্রিশ বছর যাবত এই মাজারের খাদেমগিরি করছি। প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মাজারে মিলাদ মাহফিল এবং জিকির হয়। প্রতিদিন মানত পূর্ণ হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১২-১৪ জন তোবারক নিয়ে আসেন। তোবারক খিচুড়ি-বিরিয়ানি আসে। দোয়া পড়ে তোবারক প্রথমে পশুপাখির জন্য মাজারের উঠানের এক কোণায় দেয়া হয়। এরপর মাজারে আগত ভক্তদের মধ্যে তোবারক বিতরণ করা হয়।”

কথিত আছে, মাজার আবিষ্কারের সময় থেকে দুটি পাথর ছিলো। পাথর দুটো চারকোণা আকৃতির। মাজারের পাশে পূর্ব দিকের চাকলার দীঘিতে পাথর দুটো নামতো। আবার দীঘি থেকে উপরে উঠে আসতো। পাথরের মাঝখানটা একটু ঢালু। মানুষ অজু করার জন্যে পাথরের ঢালু অংশে হাত দিলে পানি উঠতো। কেউ একজন একটি পাথরের এক কোণা ভেঙে ফেলে। দ্বিতীয় পাথরটি চাকলার দীঘিতে নেমে যায়। পাথরটি আর উপরে উঠে আসেনি। যে-পাথরটি নামেনি, সেটিতে পঞ্চাশ বছর যাবত আর পানি উঠে না।

মানুষ মূলত বিভিন্ন মানত নিয়ে এখানে আসে। বিভিন্ন এলাকার মানতকারীরা বৃহস্পতিবার হরদম মিষ্টান্ন, খিচুড়ি, বিরিয়ানির তবারক কাবুল শা’ (রা.)-এর মাজারে এনে দেয়। মানতকারীরা দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তবারক নিয়ে আসে। মাজার প্রাঙ্গণে প্রতিদিনই বিকালে প্লাস্টিকের কাগজ বিছিয়ে মারফতি-ফকিরি গানের আসর বসে। শ্রোতারা গায়কদের চারপাশ ঘিরে বসে-দাঁড়িয়ে আসর উপভোগ করেন। গায়কদের মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে মোরা গায়, অন্যরা ঘোসায় টান দেয়।

হজরত শাহ আলী শাহ (রা.)-এর মাজারের ওরস
হজরত শাহ আলী শাহ (রা.)-এর মাজারে বছরে একদিন ওরস করা হয়। তবে সময় নির্ধারিত নেই। জানা যায়, ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাগদাদ থেকে ৩৬০ জনের মধ্যে তিনজন আউলিয়া নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার আমলাব বাজারে এসে আস্তানা গাড়েন। এই তিনজন আউলিয়ার মধ্যে হজরত শাহ আলী শাহ (রা.), ওয়ালি শাহ এবং আরেকজন আউলিয়া (নাম জানা যায়নি) ছিলেন। তাঁদের এখানে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁদের সমাধিস্থলেই এ-মাজার গড়ে ওঠে।

সব বয়সি নারী-পুরুষ যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী মানত করেন। প্রতিদিনই সকাল-সন্ধ্যা মোমবাতি জ্বালিয়ে ভক্তরা যার যার বাসনা মানত করেন। মানত পূর্ণ হলে গরু, ছাগল, মুরগি দিয়ে তৈরি খিচুড়ি, বিরিয়ানি, সিন্নি দেয়। সন্ধ্যা ৭ টার পর মাজারের ফটক বন্ধ করে দেয়া হয়।

ভাটেরচর দক্ষিণপাড়া শাহ বাড়ির দরবার শরীফের ওরস
বেলাব উপজেলার ভাটেরচর গ্রামের দক্ষিণপাড়ায় শাহ বাড়ির দরবার শরীফে প্রতিবছর চৈত্র মাসের ২০ তারিখ ওরস অনুষ্ঠিত হয়। এই গ্রামের শাহ মোহাম্মদ শাহ সুফী আবু তালেব হোসেন চিশতিয়া এবং শাহ সুফী পীরে কামেল আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া চিশতিয়া— পিতা-পুত্র দুজনেই পীর ছিলেন। শাহ সুফী পীরে কামেল আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া চিশতিয়া ভৈরবের জগন্নাথপুরের পীর শাহ করিম শাহ সুফী আব্দুল করিম চিশতিয়ার মুরিদ হন। শাহ সুফী পীরে কামেল আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া চিশতিয়ার ছেলে শাহ মোহাম্মদ আবু কায়সার চিশতিয়া ১৯৯৩ সালে সিলেটের শায়েস্তাগঞ্জের ১২০ আউলিয়ার দরবারের মতুয়ালির শাহ সুফী শফিকুল হাসান চিশতিয়ার মুরিদ হন।

১৯৯০ সাল থেকে প্রতিবছর চৈত্র মাসের ২০ তারিখ (৩ এপ্রিল) ভাটেরচর দক্ষিণপাড়ার শাহ বাড়ি দরবার শরীফ মাজারে ওরস উদযাপিত হয়। দুইদিন ধরে সারা দিন-রাত ওরস চলে।

নরসিংদীর বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের রহিমাকান্দির শফিকের দল, ভাটেরচরের নওয়াব মিয়ার দল, মীর কাশেমের দল, সোহরাব হোসেনের দল, লক্ষ্মীপুরের আবু জাহেরের দল ওরসে বাউল গান, ফকিরি, মারফতি, নবীতত্তত্বের গান পরিবেশন করেন।

হাসান পাগলার মাজারের ওরস
ময়মনসিংহের নান্দাইল থেকে হাসান পাগলা সিলেটের পীর সিদ্দিক আলী মাওলানার সাথে নরসিংদীর বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের ভাটেরচর গ্রামে আসেন। পীর সিদ্দিক আলী হাসান ফকিরকে এ-গ্রামের বাসিন্দা গোলাপ মিয়ার কাছে রেখে যান। এখানে তিনি ফকিরি গান-বাজনা আর জিকির করতেন, মসজিদে আজান দিতেন। এলাকার মানুষের কাছে তিনি আধ্যাত্মিক ব্যক্তি হিসেবে সুপরিচিত হন। কারো কোনো রোগ-বালাই হলে তারা তার কাছে যেতেন। তিনি ফুঁ দিয়ে দিলে রোগমুক্তি ঘটতো। পঞ্চাশ বছর তিনি এই এলাকায় আউলিয়ার কাজ করেন। ১৯৯২ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। ভাটেরচর গ্রামেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। তার সমাধিস্থানে গড়ে ওঠে মাজার, যেখানে প্রতি বছর ওরস হয়।

পার্বণ
পার্বণ নিয়ে বাংলাদেশে একটি কথার প্রচলন রয়েছে। হিন্দুদের ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’। এখানে তেরো শব্দটি তেরো সংখ্যা অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। তেরো শব্দটি এখানে বহু অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রকৃত অর্থে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ সারা বছর জুড়ে অনেক ব্রত পার্বণের অনুষ্ঠান করে থাকে। এমন অনেক লৌকিক দেব-দেবীর পূজা বছরের নির্দিষ্ট দিন ছাড়াও প্রতি মাস এবং সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে করা হয়। মঙ্গলচণ্ডী পূজা সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার, লক্ষ্মী পূজা সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার এবং শনি পূজা সপ্তাহের প্রতি শনিবার বাড়ির উঠোনে বা বারান্দায় তুলসি গাছের তলায় করা হয়। নরসিংদী জেলায়ও এসব পূজার প্রচলন রয়েছে।

পদ্মপুরাণ
লোকায়ত দেবী পদ্মা বা মনসা বিষয়ক আখ্যানের পরিবেশনা ‘পদ্মপুরাণ’। সাধারণত বাংলা বছরের শ্রাবণ সংক্রান্তি অর্থাৎ শ্রাবণ মাস জুড়ে এই পুরাণ নরসিংদী অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে পরিবেশিত হয়ে থাকে। এ-ধরনের আখ্যান পরিবেশনার জন্যে সাধারণত বাড়ির উঠোন, ঘর, চতুর্দিকে খোলা নাটমন্দির অথবা মন্দির প্রাঙ্গণের খোলা স্থানে এ-গান পরিবেশন করা হয়। শ্রাবণ মাস জুড়ে বেলা তিনটার পর পদ্মপুরাণ পরিবেশন করা হয়। একটি জলচৌকির উপর পদ্মপুরাণ রাখা হয়। শ্রাবণ মাসের প্রতিদিন গানের সুরে একজন নারী পদ্মপুরাণ পরিবেশন করেন। তাকে ঘিরে বসে এলাকার অন্য নারী অর্থাৎ গৃহিণীরা। পদ্মপুরাণের সামনে একটি থালায় চিনি, বাতাসা আর একটি গ্লাসে জল রাখা হয়। অনেকে ফল-মিষ্টিও দিয়ে থাকে। আগরবাতি জ্বালানো হয়। যিনি ইচ্ছা করেন, তার ঘরেও পদ্মপুরাণ পড়া হয়। এভাবে কয়েক ঘর ঘুরেও পদ্মপুরাণ শেষ করা হয়। যারা এই আখ্যান শোনেন, তাদের সবার হাতে ফুল, দূর্বা থাকে।

বেলাব উপজেলার জাংগুয়া গ্রামে মনসা পূজার দিন পদ্মপুরাণের আখ্যান শেষ করা হয় না। মনসা মূর্তি অথবা অষ্টনাগ বিসর্জনের দিন পদ্মপুরাণের আখ্যান শেষ করা হয়।

মনসা পূজা
সর্পের দেবী মনসা। শ্রাবণ সংক্রান্তিতে শ্রী শ্রী মনসা দেবী ও অষ্টনাগ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পহেলা শ্রাবণ পদ্মপুরাণ পাঠ শুরু হয়, শেষ হয় পহেলা ভাদ্রে। মন্দির অথবা যে-বাড়িতে পদ্মপুরাণের আখ্যান পরিবেশন করা হয়, সেই বাড়িতে মনসা মূর্তি অথবা নাগ দিয়ে মনসা পূজা করা হয়।

নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলায় মনসা মূর্তি দিয়ে পূজা করা হয়। শাপলা ফুলের মালা গেঁথে মনসা মূর্তির গলায় পরিয়ে দেয়া হয়।

বেলাব উপজেলার জংগুয়া গ্রামের দেবনাথ সম্প্রদায় মনসার মূর্তি দিয়ে পূজা করে। পোড়ামাটির ঘটে সিঁদুরের ফোঁটা দেয়া পাঁচ পাতাবিশিষ্ট আম্রপল্লব রাখা হয়। ঘটের গায়ে পাঁচ ফোঁটা সিঁদুর দেয়া হয়। ঘটের উপর ফুল, বেলপাতা, ধান, দূর্বা, আস্ত নারকেল এবং গামছা রাখা হয়। নরসিংদী উপজেলার বৌয়াকুড় গ্রামে জেলে সম্প্রদায়ের লোকেরা মনসা মূর্তি দিয়ে পূজা করে।

বিশ্বকর্মা পূজা
শিল্পের প্রতিষ্ঠাতা দেবতা বিশ্বকর্মা। নরসিংদী জেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের কুমার-কামার, বণিক, তাঁতী, স্বর্ণকার শ্রেণির নর-নারীরা এই পূজা উদযাপন করে থাকেন। শিবপুর উপজেলার নর-নারীরা এই পূজা উদযাপন করে থাকেন বেশি। পঞ্জিকা মতে, বিশ্বকর্মা পূজা ষড়শীতি সংক্রান্তি অর্থাৎ ৩১ ভাদ্র অনুষ্ঠিত হয়। সমৃদ্ধির জন্যে এই পূজা করা হয়। এ-পূজা মূলত তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থানে করা হয়। সেখানে মাটির তৈরি এক থেকে দেড় ইঞ্চি লম্বা বিশ্বকর্মার মূর্তি অথবা বিশ্বকর্মার ছবি স্থাপন করা হয়। অবস্থাপন্ন বণিক, মৃৎশিল্পী এবং কর্মকাররা মূর্তি নিয়ে বিশ্বকর্মা পূজা করে থাকে। পূজার সময় ঢাক, ঢোল, কাঁসর, ঘণ্টা বাজানো হয়। নরসিংদী সদর উপজেলার বৌয়াকুড়ে বিশ্বকর্মা পূজা ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্রেই অনুষ্ঠিত হয়।

লক্ষ্মী পূজা
ধনের দেবী লক্ষ্মী। আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা অর্থাৎ পঞ্চমী তিথিতে লক্ষ্মী পূজা হয়। একে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজাও বলা হয়। দেবী দূর্গার বিসর্জনের পঞ্চম দিনে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। যদিও সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার এই পূজা প্রায় প্রত্যেক হিন্দু বাড়িতে করা হয়। নরসিংদী অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আশ্বিন মাসের পঞ্চমী তিথিতে লক্ষ্মী মূর্তি দিয়ে পূজার প্রচলন রয়েছে।

বেলাব উপজেলার জংগুয়া গ্রামে দেবনাথ সম্প্রদায়ের লোকেরা লক্ষ্মী পূজায় দুটি ডোল যাবার দেয়। ডোল যাবার দুটি কলাপাতার উপর বসানো হয়। একটিতে ধান, দ্বিতীয়টিতে সিদ্ধ চাল দেয়া হয়। এ-সম্প্রদায়ের লোকেরা লক্ষ্মীর মূর্তি নিয়ে পূজা করে। তবে পূজায় আল্পনা করে না।

শিবপুর উপজেলার যোশর গ্রামের পাল সম্প্রদায়ের মধ্যে মূর্তি নিয়েই লক্ষ্মী পূজা করার প্রচলন রয়েছে।

শিবপুর উপজেলার কামরাব গ্রামের পাল সম্প্রদায়ের মধ্যে চালের গুঁড়া নিয়ে তৈরি চষির নাড়ু লক্ষ্মী দেবীকে নিবেদন করার চল রয়েছে, যা নরসিংদী অঞ্চলের অন্য কোথাও দেখা যায় না।

নরসিংদী সদর উপজেলার বৌয়াকুড় গ্রামের খালপাড়া জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে লক্ষ্মী পূজায় সেওইর নাড়ু দেয়া হয়। ভাত চালন দিয়ে ডলে রোদে শুকিয়ে বালু অথবা তেল দিয়ে ভাজা হয়। ভাজা সেওই গুড়ে পাক দিয়ে নাড়ু তৈরি করা হয়।

কার্তিক পূজা
কার্তিক শস্য দেবতাদের মধ্যে সর্বপ্রধান। ৩০ কার্তিক কার্তিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। কার্তিক মাসের শেষদিন ফসল তোলার মৌসুমের আগে করা হয় বলে এই দেবতার নাম কার্তিক। এই প্রতিমা দেব সেনাপতি কার্তিকের মতোই দেখতে। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ নারীরা আনুষ্ঠানিকভাবে এই ব্রত বা পূজা করে থাকে। মাটির মূর্তি দিয়ে কার্তিক পূজা করা হয়। মূর্তির উপর নতুন গামছা রাখা হয়। ব্রতিনী কার্তিকের মূর্তির সামনে তিনটি বড়ো ঘট স্থাপন করে থাকে। প্রতিটি ঘটের গায়ের মাঝখানে পাঁচটি সিঁদুরের ফোঁটা দেয়া হয়। প্রথম ঘটে পুরান চাল, দ্বিতীয় ঘটে আতপ চাল এবং তৃতীয় ঘটে জলপাই, তেঁতুল, মূলা, বেগুন, আলু, বিভিন্ন সবজি দিয়ে পূর্ণ করা হয়। একধরনের কাঁটা গাছ কার্তিকের প্রতিমার পেছনে মাটির মধ্যে পোঁতা হয়।

নবান্ন
অগ্রহায়ণ মাসে জমিতে ধান পাকলে নতুন ধানের চাল দিয়ে পিঠা ও মিষ্টান্ন রান্না করা হয়। জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে ছেলে বা মেয়েশিশুকে কাঁচি দিয়ে জমিতে পাঠানো হয়। জমিতে পাঠানোর আগে শিশুটিকে স্নান করানো হয়। কারো সাথে কথা না বলে শিশু ধানের পাঁচটি হিজা কেটে মাথায় করে বাড়িতে নিয়ে আসে। এই পর্যন্ত সে কথা বলবে না। একটি পোড়ামাটির ঘটে জল ভরে জলচৌকির উপর বসানো হয়। এই ঘটে ধানের হিজা ডুবিয়ে রাখা হয়। ধানের হিজায় পাঁচটি সিঁদুরের ফোঁটা দেয়া হয়। এভাবে এটি ঘরে রাখা হয়। চালের গুঁড়া জলে গুলিয়ে জলচৌকির সামনে আল্পনা করা হয়। জলচৌকির সামনে থেকে আঁকতে আঁকতে ঘরের দোর পর্যন্ত এসে শেষ করা হয়।

জমি থেকে প্রথম যে-ধান ঘরে তোলা হয়, তা আতপ চাল করা হয়। এই চাল থেকে কিছু চালের গুঁড়া কুটে পাঁচটি চিতল পিঠা বানানো হয়। দুধ দিয়ে নতুন চালের মিষ্টান্ন রান্না করা হয়। পরে এই পিঠা-মিষ্টান্ন পরিবারের সদস্য এবং প্রতিবেশিদের খেতে দেয়া হয়।

বেলাব উপজেলার যুগি সম্প্রদায়ের মধ্যে অগ্রহায়ণ মাসে প্রথম যে-ধান ঘরে উঠে, তা নবান্নের জন্যে আলাদা করে রাখে। রোববার অথবা বৃহস্পতিবার উপবাস করে ঐ-ধানের চালের গুঁড়ি দিয়ে দুপুরবেলা চিতল পিঠা এবং চাল দিয়ে মিষ্টান্ন রান্না করা হয়। চালের গুঁড়ি জলে গুলিয়ে ঘর ও উঠোনে ফুল, কলসি, ধানছড়া, পানগাছ ইত্যাদি আল্পনা আঁকা হয়। ঘরের মতুম পালার সামনে আল্পনা আঁকা হয়। এখানে একটি থালায় পাঁচটি চিতল পিঠা ও মিষ্টান্ন দিয়ে লক্ষ্মী দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়।

মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরাও অগ্রহায়ণ মাসে প্রথম যে-ধান ঘরে তোলে, তা দিয়ে নবান্ন উৎসব করে।

শারদীয় দুর্গোৎসব
হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় অনুষ্ঠান দুর্গা পূজা। শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে মায়ের আগমন। মায়ের আগমনে নরসিংদী শহরে বাগবিতান, সেবা সংঘ, বিজয়া সংসদ, যুব সংঘ, সাটিরপাড়া মহামায়া সংঘ, নরসিংদী ক্রীড়াচক্র, নোয়াদিয়া আদ্যাশক্তি মন্দির, ব্রাহ্মন্দী ও শিক্ষা চত্বর মন্দিরে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। নরসিংদীর সবচেয়ে বড়ো মণ্ডপ বাগবিতান ক্লাব। এখানে অষ্টমীর দিন তিথি অনুযায়ী কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বারো বছরের নিচে মেয়েশিশুকে মা দুর্গা সাজিয়ে কুমারী পূজা করা হয়।

নরসিংদীর রায়পুরার পশ্চিমপাড়া, বটতলাহাটি, তাত্তাকান্দা, হাশিমপুর, কড়িতলা, পিরিচকান্দি, রহিমাবাদ, আমীরগঞ্জ ইত্যাদি এলাকায় দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মণ্ডপগুলোতে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে ভক্তদের মাঝে খিচুড়ি, লাবড়া, ফল-ফলাদির প্রসাদ বিতরণের পাশাপাশি সন্ধ্যায় আরতি নাচেরও আয়োজন করা হয়।

শিবপুরে নৌকাঘাটা, জয়নগর, কামরাব, আজকিতলা, যোশর ইত্যাদি এলাকায় দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মণ্ডপগুলোতে সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত দুপুরে ভক্তদের মাঝে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। সন্ধ্যায় এলাকার হিন্দু যুবকরা আরতি নাচে অংশ নেয়। মনোহরদীর রামপুরের মিঠাগড়, সিদ্ধেশ্বরী বাড়ি, পশ্চিমপাড়ায় দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। খিদিরপুর, সরিতপুরেও পূজা হয়। প্রত্যেক মণ্ডপে কাপড় এবং আলোকসজ্জা করা হয়। সন্ধ্যায় এসব মণ্ডপে আরতি নাচের প্রতিযোগিতা করা হয়।

বেলাব’র বিশটি পূজা মণ্ডপে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বেলাব মন্দির, বেলাব সুতারপাড়া মন্দির, নারায়ণপুর, গোবিন্দপুর, চর উজিলাব সুতারবাড়ি, কাশিমনগর, বিন্নাবাইদ ইত্যাদি মন্দিরে পূজা হয়।

ঈদ উৎসব
ঈদ নরসিংদীর মুসলমান সম্প্রদায়ের একটি বড়ো ধর্মীয় উৎসব। ঈদের নামাজের ইমামতি করেন মসজিদের ইমাম। নামাজ শেষে ঈদগাহ ময়দানে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। এতে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

রায়পুরা উপজেলার তাত্তাকান্দা জামে মসজিদের ঈদগাহ ময়দানে ঈদের বৃহত্তম জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া রায়পুরা থানার হাফেজিয়া মাদরাসা প্রাঙ্গণ, শ্রীরামপুর মদিনা মসজিদ, কুলাতলী গ্রামের ঈদগাহ মাঠ, চরাঞ্চলের ফকিরাচর মাদরাসা মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। রায়পুরা উপজেলার ২৪ টি ইউনিয়নের প্রত্যেকটিতে চার থেকে পাঁচটি ঈদগাহ ময়দানে ঈদের জামাত হয়।

শিবপুর উপজেলার জয়নগর বিলপাড় ঈদগাহ ময়দান, জয়নগর ধনাইয়া ঈদগাহ মাঠ, যোশর কামারটেক ঈদগাহ মাঠ, কামরাব জয়নগর ঈদগাহ মাঠ, সুজাতপুর ঈদগাহ মাঠ, আজকিতলা ঈদগাহ মাঠ, দরিপুরা ঈদগাহ মাঠ, শিবপুর ঈদগাহ মাঠ, চৌঘরিয়া ঈদগাহ মাঠ, খরিয়া ঈদগাহ মাঠে মুসল্লিরা ঈদের নামাজ আদায় করেন।

পীরপুর ঈদগাহ মাঠ মনোহরদীর খিদিরপুর ইউনিয়নে সবচেয়ে বড়ো ঈদগাহ মাঠ। এছাড়াও পূর্ব রামপুর ঈদগাহ মাঠ, পশ্চিম রামপুর ঈদগাহ মাঠ, চরসাগরদি ঈদগাহ মাঠ, চর আহমদপুর ঈদগাহ মাঠ, খিদিরপুরের দরগা ঈদগাহ মাঠে ঈদের দিন নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা।

নরসিংদী সদরে গাবতলী জামিয়া কাশেমিয়া মাদরাসা ঈদগাহ ময়দান, নরসিংদী পৌর ঈদগাহ ময়দান, দত্তপাড়া ঈদগাহ ময়দান, ট্রেজারি মাঠ, মাধবদী পৌর ঈদগাহ ময়দান ইত্যাদি ঈদগাহ ময়দানে নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।

লোকমেলা
লোকমেলা গ্রামবাংলার মানুষের আনন্দ বিনোদনের জন্যেই শুধু নয়, এটি লোকউৎসবও বটে। সমাজকে ঐক্যবদ্ধ ও সংহত রাখতে মেলার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এর সাথে জড়িত থাকে লোকসমাজের নানা ধরনের প্রথা, বিশ্বাস-সংস্কার আর উৎসব। লোকসংস্কৃতি এবং লোকশিল্পও লোকমেলার একটি অংশ।

নরসিংদী সদর উপজেলার বাউল ঠাকুরের আখড়াবাড়ির দক্ষিণে মেঘনা নদীর পাড়ে মাঘী পূর্ণিমার আগে অথবা পরের বুধবার বাউল ঠাকুরের মেলা বসে। নরসিংদী সদর উপজেলার তরোয়া পৌরসভায় হযরত মাওলানা কাবুল শা’ (রা)-এর মাজারে ১২ ফাল্গুন কাবুল শা’ মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

বাউল ঠাকুরের মেলা
নরসিংদী সদর উপজেলার বাউলপাড়ায় শ্রী শ্রী বাউল ঠাকুরের আখড়াধামে বাংলা ৯৪০ সাল থেকে বাউল ঠাকুরের মেলা শুরু হয়। বাউল ঠাকুরের আখড়াবাড়ির দক্ষিণে মেঘনা নদীর পাড়ে এই মেলা বসে। প্রতিবছর মাঘী পূর্ণিমার আগে অথবা পরের বুধবার এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাউল ঠাকুর মাঘী পূর্ণিমার এই দিনে যজ্ঞ করতেন। এর স্থায়ীত্বকাল কমপক্ষে দশদিন। দেশ-বিদেশের বাউল ঠাকুরের মতাবলম্বী বাউলশিল্পীরা এই মেলায় অংশ নেয়। আখড়াবাড়ির ঠাকুরের মন্দিরের সামনে আটচালায় বাউলশিল্পীদের আসর বসে। বাউল ঠাকুরের শিষ্যরা এই মেলায় আসেন। শিষ্য ও সেবায়েতগণ যৌথভাবে মেলায় আগত বাউলদের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করেন। বুধবার দুপুরবেলা বাউল ঠাকুরের মহাপ্রসাদ মেলায় আগত ভক্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়। বাউল ঠাকুরের শিষ্যরা মেলায় বাউল ঠাকুরের গান, কীর্তন বেহালা, করতাল, খোল, সারিন্দা, একতারা, মন্দিরা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে পরিবেশন করে। বাউল ঠাকুরের রচিত গান লিখিত নয়, মুখে মুখে শিষ্যরা আত্মস্থ করেছেন।

প্রায় একশত বছর তিনি এখানে অবস্থান করেন এবং এখানে সমাধিস্থ হন। তিনি একাই এখানে আসেন। বাউল ঠাকুরের শিষ্যরা বিক্রমপুর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। নরসিংদী সদরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বেশিরভাগই ঠাকুরের মত পোষণ করেন।

কাবুল শামেলা
তরোয়ার হযরত মাওলানা কাবুল শা’ (রা.)-এর মাজারে ১২ ফাল্গুন মেলা বসে। মাজারের প্রাচীরের সীমানা ঘেঁষে মেলা বসে। সাতদিন ধরে এই মেলা চলে।

১৩৫৯ সালে কাবুল শা’ মাজারে কাবুল শা’ মেলা শুরু হয়। এই নিয়ে জনশ্রুতি রয়েছে। এ-প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা কাবুল শা’ (রা.)-এর মাজারের খাদেম মো. হারুন-অর-রশীদ খান বলেন, “হাজী আব্দুল সামাদ খানের মেজো ছেলে সালামত খান স্বপ্নে নির্দেশ পান, ফাল্গুন মাসের ১২ তারিখে কাবুল শা’ মাজারে মিলাদ মাহফিল তোবারক জিকির সামা করার। একে ঘিরেই এখানে দুইদিনব্যাপী মেলা বসতো। এই মেলায় ফকির পাগল, সালে মজনু সবাই সমবেত হতেন। দুইদিন থেকে মেলার মেয়াদ বেড়ে বর্তমানে সাত দিন হয়েছে।”

কালীবাড়ি মেলা
নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার রায়পুরা সদরে পশ্চিমপাড়া গ্রামের কালী মন্দিরের সামনে কাকন নদীর পাড়ে ফাল্গুন মাসে দোল পূর্ণিমার বারো দিন পর কালীবাড়ি মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একদিন এই মেলা বসে।

তাত্তাকান্দা অষ্টমী মেলা
রায়পুরা উপজেলার তাত্তাকান্দা গ্রামের আর কে আর এম উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে কাকন নদীর পাড়ে অষ্টমী তিথিতে ২৬ চৈত্র তাত্তাকান্দা অষ্টমী মেলা বসে। এই মেলা দু’দিনব্যাপী চলে।

গাছতলা মেলা
রায়পুরা উপজেলার বটতলাহাটি গ্রামের বটগাছতলায় পহেলা বৈশাখে গাছতলা মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলার সময়কাল একদিন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই মেলা। পহেলা বৈশাখের দিন সকালবেলা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা বটগাছতলায় পূজা দেয়। বাইশ বছর ধরে এই মেলা চলছে।


সহায়ক গ্রন্থ
বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি : নরসিংদী, বাংলা একাডেমি

মাতৃভূমি ও মানুষের জন্যে আমার যা করণীয়, সেগুলো না করে তো আমি চলে গেছি : হরিপদ দত্ত

0

হরিপদ দত্ত। সমকালীন বাংলা কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখক। বর্তমানে তিনি পশ্চিবঙ্গের নদীয়া জেলায় বসবাস করেন। সম্প্রতি তিনি অল্প কয়েকদিনের জন্যে নিজ মাতৃভূমি বাংলাদেশে আসেন। জুন ২০২৩ (শুক্রবার) তাঁর এই সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়। সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন শহিদুল হক সুমন সুমন ইউসুফ।

আপনি দেশে আসার পর থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সাক্ষাতকার দিয়েছেন। সবাই একটা প্রশ্ন আপনাকে করেছে। আমিও আমাদের পাঠকদের জন্যে প্রশ্নটি পুনরায় করতে চাই। সেটি হলো, আপনি দেশ ছেড়েছেন কেন?

হরিপদ দত্ত : আসলে বাংলাদেশের অন্য আটদশজন হিন্দু যেসব কারণে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়, আমি কিন্তু সেসব কারণের শিকার নই। আমাদের যেএলাকা, সেটি ছিলো একদম কৃষিপ্রধান। তারা কৃষিকাজ ছাড়া আর কিছুই পারে না। সেখানে ইউরিয়া সারকারখানা প্রায় সব কৃষিজমি নিয়ে নেয়। ফলে সেখানকার মানুষজন উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। পুরো একটা গ্রাম ভেঙে যায়। সময়টা ছিলো খুব খারাপ। ১৯৬৪৬৫। দাঙ্গা হলো। ভারতপাকিস্তান যুদ্ধ হলো। এরকম পরিস্থিতিতে একটা বিরাট দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতর পড়লো সংখ্যালঘুরা। অনেকে অনেক জায়গায় চলে গেলো। আমাদের কিন্তু সেরকম যাওয়ার বিষয় ছিলো না। কৃষিজমি হারিয়ে ভূমিহীন অবস্থায় আমার পরিবার ভারতে চলে যায়। তবে আমি যাইনি। কিন্তু শেকড়ছেঁড়া একটা মানুষের যা হয়, একটা দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেলাম। এই অবস্থায় আমার স্ত্রীসন্তানদের কোথায় রাখবো, এই চিন্তা করতে করতে তাদেরকেও পাঠিয়ে দিলাম। আমি রয়ে গেলাম বাংলাদেশেই। তারপর ২০১২ সালে এসে আমি দেশ ছাড়ি। আমি জানতাম না যে, আমার কিডনির সমস্যা হয়ে গেছে। আসলে অসুস্থতার জন্যেই আমাকে ভারতে যেতে হয়, বাধ্য হয়ে, পরিবারের কাছে। তবে চিরতরে যাবার জন্যে নয়, চিকিৎসা করে সুস্থ হয়ে ফিরে আসবো বলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু অসুস্থতা বেড়েই চললো। নিউমোনিয়া পর্যন্ত হয়েছিলো। আবার পাসপোর্টের জটিলতায় পড়লাম। প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তাই আর আসতে পারিনি। তাছাড়া আমার কোনো সম্পত্তি নেই। না বাংলাদেশে, না ভারতে। সেই যে সারকারখানা আমাদের ভূমিহীন করলো, সেই থেকে এখনো ভূমিহীনই রয়ে গেলাম। আমার বাবাকাকার শত শত বিঘা জমি ছিলো, সব সারকারখানা দখল করে নিলো। তো এরকম পরিস্থিতিতে আমার সন্তানেরাও আমাকে ছাড়তে চাইলো না। তারা সেখানে শিক্ষকতা করে। এখন প্রকৃতপক্ষে তাদের উপরেই আমি নির্ভরশীল।

সেখানকার কোনো পত্রপত্রিকায় লেখা দেন? বা কোথাও ছাপা হয়েছে এখনো পর্যন্ত?

হরিপদ দত্ত : না না। এটা আমি আগেও বলেছি, ভারতের কোনো পত্রিকায় লেখার জন্যে তো আমার জন্ম হয়নি। আমার জন্ম হয়েছে খানেপুর গ্রামে, শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে, এই বাংলার মাটিতে। আমার এই ঋণটা তো শোধ করতে হবে। আমার চলে যাওয়াটা ছিলো একধরনের বিট্রেয়ারের কাজ, বিশ্বাসঘাতকের কাজ। আমার মাতৃভূমি মানুষের জন্যে আমার যা করণীয়, সেগুলো না করে তো আমি চলে গেছি। বাংলাদেশের মাটি, মানুষ, জনতাআমাকে তাড়িয়ে তো দেয়নি তারা। আমি নিজে তা স্বীকার করি। কিন্তু ক্ষমা চাই না। ক্ষমা কী আর! এর ফল তো আমাকে ভোগ করতে হচ্ছে। আমি বুঝতে পেরেছি। বছরেরই ১৮ ফেব্রুয়ারি আমি বর্ডার ক্রস করে বাংলাদেশে ঢুকতে পারিনি। এর অন্যতম কারণ হলো, বিশ্বাসঘাতকদের তার মাতৃভূমি দ্বিতীয়বার জায়গা দেয় না। আর এই কারণেই আমি এবারের বইমেলায় দেশে আসতে পারিনি। যদিও এগুলো আবেগতাড়িত কথা বলে উড়িয়ে দিতে পারে অনেকে, তবুও আমি এটিই মনে করি।

যাই হোক, নরসিংদীভিত্তিক আপনার যেলেখালেখি, আপনারদ্রাবিড় গ্রাম’, ‘শীতলক্ষ্যা’, ‘জাতিস্মরের জন্মজন্মান্তরইত্যাদি উপন্যাসে আমরা খানেপুর গ্রামের ভাঙনের ইতিহাস উপন্যাসের আদলে পাই। কিন্তু আমরা সারকারখানা কর্তৃক খানেপুর গ্রাম ধ্বংস হবার প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাই।

হরিপদ দত্ত : আগেও একবার মাসুদ রানাকে আমি বলেছি, না জেনে, না পড়ে এগুলো জিজ্ঞেস করা উচিত না। আমার আত্মজীবনীউলুখাগড়া ছাপা হয়েছে। তাছাড়া অনেক উপন্যাসেও এসবের ছাপ আছে। আর অনেক কথা এভাবে বলা যায় না। কেউ বলে না। আমার ঘরসংসার আছে, নানা সমস্যা আছে। রবীন্দ্রনাথ আর কাদম্বরীর সম্পর্কের কথা কি তিনি স্বীকার করেছেন কখনো?

আচ্ছা, তাহলে ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। এখন আপনি পশ্চিমবঙ্গে আছেন। সেখানে দিন কীভাবে পার করছেন?

হরিপদ দত্ত : ঘুরেফিরে কাটাই আরকি। ভাবলাম, বয়স হয়েছে, ধর্মকর্ম করা দরকার। এটা করোনা শুরু হওয়ার দুই বছর আগের কথা। মনে হলো, আমার সৃষ্টির জন্যে পুণ্য অর্জন দরকার আছে। আমি পা বাড়ালামপ্রথম যে তীর্থস্থানে গেলাম, তার নাম শান্তিপুর। মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের বাড়ি, প্রথম মুসলমান লেখকের হাতে রচিত উপন্যাসজোহরা লেখক। ওটাই আমার ধর্মস্থান। তীর্থ মানে আমার কাছে গয়াকাশীবৃন্দাবন নয়, লেখকের জন্য লেখকের সৃষ্টির জায়গা তার পুণ্যভূমি, এটা আমি মনে করি। ওটাই আমার ধর্মস্থান। এরপরে গেলাম চৈতন্য দেবের আন্দোলনের স্থানে, নদীয়া। গেলাম কৃত্তিবাস ওঝার ওখানে। কৃত্তিবাস ওঝার জন্মস্থানে। একটা বটগাছ আছে। বটগাছের সঙ্গে একটা সাইনবোর্ড লাগানো। লেখাএই বটবৃক্ষের নিচে বসিয়া মহাকবি কৃত্তিবাস রামায়ণ রচনা করিয়াছিলেন নিচে সংস্কৃতেও লেখা আছে। দেখলাম, গাছের ওখানে একটা ফুটা আছে। ওখানকার কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করলাম, ফুটা কেন? সে বললো, ভেতরের গাছটাই মূল গাছ। যেটা দেখতে পাচ্ছেন, সেটার বয়স বড়জোড় ৭০ বছর হবে। মূল গাছটাই ভেতরে। উপরেরটা নবীন গাছ। বটগাছ তো একজন আর একজনকে জড়িয়ে থাকে। এভাবেই তারা হাজার বছর টিকে থাকে। ওখানে একটা লাইব্রেরিও আছে। যদিও তেমন কিছু নেই, কিন্তু যেটা অবাক করলো, তা হলো, অনেকগুলো কবর ওখানে। কবরগুলো চৈতন্য দেবের শিষ্যের। হুসেন শাহ, হরিদাস, বলবান হরিদাসের। ভেতরের দিকে আরো আছে, যেতে পারলাম না। ঘন জঙ্গল হয়ে গেছে। এটা সাহিত্যের জায়গা। সেই বটবৃক্ষের উপরে একটি বেদি বাঁধানো আছে। সেই বেদির উপর বসে ভাবলাম, এখানেও হয়তো লেখা থাকতে পারতো, ‘এই বটবৃক্ষের তলায় বসিয়া হরিপদ দত্ত জন্ম জন্মান্তর উপন্যাস রচনা করিয়াছিলেন (অট্টহাস্যে) এমন যদি হতো, খুব ভালো হতো। কবি জয়দেবের তীর্থ বীরভূম; সেখানে ভোজপুরি ভাষা। যেটা রাধাকৃষ্ণের প্রেমের মূল জায়গা। ওখানে একটা ভাঙা মন্দিরের মতো আছে। এই জায়গাগুলো আমার কাছে তীর্থস্থানের মতো। এই জায়গাগুলোতে গেলে প্রেরণা পাওয়া যায়। সাহিত্যের প্রেরণা পাওয়া যায়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়েরহাসুলী বাঁকের উপকথাআমার অত্যন্ত প্রিয় উপন্যাস। বীরভূম, যেখানের কথা এই মহাকাব্যিক উপন্যাসে বলা হয়েছে। জঙ্গল এলাকা। বাঙালি, সাঁওতাল, কাহার পাশাপাশি দীর্ঘ বছর বসবাস করে। আর বাঁকটা হলো অনেকটা কল্পনা। কোপাই নদীটা শান্তিনিকেতন যাবার পথে দেখা যায়। আমি যখন গেলাম, তখন শীতকাল। পানি তেমন নেই। হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম নদীর চরার ওপাড়ে একটা বটগাছ আর তার সঙ্গে লাগোয়া একটা দহ। গভীর দহ, দূর থেকে দেখা যায়। হেঁটে ওদিকে যাওয়া নিষেধ, চোরাবালি আছে। উপন্যাসে কালো বউ, নাম নয়ান, যে পরকীয়া করে ধরা পড়ে, পরে একটা জায়গায় বটগাছের কাছে সাপ তাকে ছোবল মারে, পরে দহের মধ্যে পড়ে মারা যায়। হেঁটে ওই দহের কাছে যাবার পর মনে হলো, এটা সেই জায়গা। তারাশঙ্করের বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। ওখানে বটগাছ আছে অনেক। দহও অনেক আছে। হয়তো ওটা নয়, ওটার মতো। কবির কল্পনা যখন মানুষকে স্পর্শ করে, তখন এমন হয়। আমার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের একটা অংশ চুঁচুড়ার দিকে থাকে। এই স্টেশন দিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বহুবার গিয়েছেন। তাঁর বাবা ব্রিটিশ সরকারের চাকুরি করতেন। ওয়ালীউল্লাহ্ থাকতেন উনার সঙ্গে। ওই পথে কলকাতা আসতেনযেতেন।একটি তুলসী গাছের কাহিনিগল্পে যেচরিত্রগুলো পাওয়া যায়, ওই যে গৃহকর্ত্রী, দেশভাগের পর ট্রেনে করে চলে গেলেন; কোথায় গেলেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ জানেন না। কিন্তু যখন সন্ধ্যায় তুলসী গাছের কথা বললেন, এখানে যে লিলুয়া, বৈদ্যবাটি, সেখানে গিয়ে ঠিক একটা বাড়ি দেখে আমার বারবার গল্পটির কথা মনে হতে লাগলো। আমি সেই বৈদ্যবাটি স্টেশনে নেমে গেলাম। দেখি কী হয়। মুশকিল হলো ওসব জায়গায় মিশতে গেলে একটা ভাষা লাগে। জোর করে হলেও উত্তরবঙ্গীয় ভাষায় বলবার চেষ্টা করলাম। একজনকে বললাম, ওই পাশে যাবার পথ কোনটা? তখন সে বললো, আপনি কেন যাবেন? আমি বললাম, ওই যে বাড়ির উঠান, ওখানে একটু যাবো। উঠানে একটা শাড়ি আড়াআড়ি করে মেলে দেয়া। মনে হলো একটা গৃহস্থ বাড়ি। ঠিক গল্পে যেমন আছে। কোনো রকম ঢুকেই যাচ্ছিলাম, পেছন থেকে একজন ডাক দিলো, কেন যাবেন, কী কাজ, কোথা থেকে এসেছেন? বললাম, পাশের গ্রামে আমার আত্মীয় থাকেন। এখানে একটু বেড়াচ্ছি। যাই হোক, নানা প্রশ্ন। আর তর্ক করলাম না। কিন্তু দেখো, ওয়ালীউল্লাহ্ গল্পটা লিখেছেন ১৯৪৮ সালে, কিন্তু আমি এখন তাড়িত হচ্ছি। সাহিত্য কীভাবে মানুষকে আকর্ষণ করে, কীভাবে বিভ্রান্ত করে, আমিই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
আরেকটা বিষয় বলি। তোমরা কি মনে করো, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্কে যথাযোগ্য মূল্যায়ন বা মর্যাদা দিয়েছে বাংলাদেশের পাঠকলেখকবুদ্ধিজীবীরা? দেয় নাই। কারণ, উনাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিলে এখন যারা লাফালাফি করে, তারা পায়ের নিচে চলে যাবে। তাঁর সমতুল্য লেখক বাংলা সাহিত্যে বিরল। পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে বলেছিলেন, “পড়ো, পড়ো, শিখো, কীভাবে একজন ওয়ালীউল্লাহ্চাঁদের অমাবস্যাউপন্যাসে উপমাচিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। শিখো হরিপদ, শিখো। শিখবে, লিখবে।
ওয়ালীউল্লাহ্ নকলটা করলো কিছু আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তাঁর ধারাবর্ণনার নদীর কুয়াশা, কুয়াশা উপরে উঠতেছে। ওয়ালীউল্লাহ্ লেখলো ভেড়া, ইলিয়াস ভাবলো, কেউ পড়ে নাই এসব, সে লিখলো বাছুর।

আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছে নাই আপনার?

হরিপদ দত্ত :উলুখাগড়া ছাপা হয়েছে তো আত্মজীবনী।

ঢাকা কেন্দ্রিক যেসাহিত্যচর্চা এবং কলকাতা কেন্দ্রিক যেসাহিত্যচর্চা, এক্ষেত্রে ঢাকার অবস্থান কীরূপ?

হরিপদ দত্ত : একটা সত্য কথা বলি। ঢাকা কেন্দ্রিক মানে হলো মুসলিম সমাজ, পারিবারিক জীবনএসব, আর মুসলমানরা শিক্ষাগ্রহণ শুরু করেছে হিন্দুদের অনেক পরে। আর বাংলা ভাষার চর্চা ঠিক ওইভাবে মুসলিম সমাজে ছিলো না। এর ফলে যেগ্যাপটা তৈরি হয়েছে, পরবর্তীকালে ধরো ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলে একটা বিরাট চেঞ্জ আসছে। ফলে সাহিত্যেও একটা চেঞ্জ আসলো। দেখো, এই সময় স্রোতের মতো কবিতা লেখা হয়েছে। নির্মলেন্দু গুণহাবিবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার বই ট্রেনে ট্রেনে বিক্রি হতো। নাটকথিয়েটারের জোয়ার বইলো। কিন্তু যেই না স্বাধীনতার সূর্য আস্তে আস্তে মেঘে ঢাকতে শুরু করলো, স্বাধীনতা মানুষের আশা পূরণ করতে পারলো না, ঠিক শিল্পসাহিত্যেরও একই অবস্থা হলো। কোথায় গেলো এসব? যৌনতার দিকে চলে গেলো। সেগুলোর বিশাল বাজার তৈরি হলো। তারপর আরো পরে ইলেকট্রনিক ডিভাইস এলো। ছেলেমেয়েরা বইপড়া থেকে দূরে চলে যেতে থাকলো। তবে আমি মনে করি না যে, মোবাইল বা আধুনিকতার কারণেই তারা বই থেকে দূরে সরে গেছে। ইংল্যান্ডআমেরিকার চেয়ে উন্নত কি বাংলাদেশ নাকি? লক্ষ লক্ষ কপি উপন্যাসের বই বিক্রি হয় আমেরিকায়, ইংল্যান্ডে, ইউরোপে। ওখানেও তো মিডিয়ামের ছড়াছড়ি। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ভেতর বসবাস করে আমেরিকান ছেলেমেয়েরা। তারপরও তারা বই কিনে, বই পড়ে। যাই হোক, ঢাকার ব্যাপারটা হলো, এখানে সাহিত্যের চর্চাটাই কম হইছে। তবে হবে। আসলে অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্যবাদী একটা আগ্রাসন ছিলো, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ব্রাহ্মণ্যবাদী কালচারটা অনেকটা বঙ্কিমচন্দ্র বহন করতো। সেই যুগটা চলে গেছে।
স্বাধীনতা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে আমাদের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু আমরা পারিনি সত্যিকার অর্থে। বিশ্বমানের কোনো উপন্যাস, গল্প, সাহিত্য আমরা উৎপাদন করতে পারিনি। এটা স্বীকার করতে হবে।

এর কারণটা কী? কেন পারিনি? আমাদের ঘাটতি কোন জায়গায়?

হরিপদ দত্ত : ঘাটতিটা হলো, আমাদের চর্চার অভাব আছে।

আমরা কি বৈশ্বিক চেতনা ধারণ করতে পারি নাই?

হরিপদ দত্ত : না না। বৈশ্বিক চেতনা আছে। থাকবে না কেন? অনেক ক্ষেত্রেই আছে। কিন্তু সাহিত্যিক যেচেতনা, এটা তো কেউ জন্মসূত্রে পায় না। এটা পড়াশোনার মাধ্যমে হয়। সেই সুযোগগুলো এখানে নেই। এখানে বিশ্বমানের কোনো পাঠাগার নেই। নেই কিন্তু। সেধরনের প্রকাশনা সংস্থাও নেই এখানে। আমি এক প্রকাশককে বলেছিলাম একবার, ভাই, তুমি মনে কিছু করো না, তুমি আনন্দ পাবলিশার্সে গিয়ে ট্রেনিং নাও, কীভাবে বইয়ে বিনিয়োগ করে এটার বিলিবণ্টন করে আয় করতে হয়, এটা বুঝতে হবে তোমাকে। তুমি যদি বাংলাবাজারে বইসা দুইটা বই বিক্রি কইরা অই পয়সা দিয়া এক সের চাল কিনে মোহাম্মদপুর চলে যাও, তাহলে তোমাকে দিয়ে বইয়ের ব্যবসা হবে না, তুমি যোগ্য নও প্রকাশক হবার। পরে সে রাগ করেছিলো।
মুশকিলটা হলো, আমাদের এখানে খাটনি আছে, শক্তি কম। স্বীকার করতে হবে। তারপর কী বলবো, আত্মমর্যাদা নাই আমাদের মধ্যে। এক কবিকে একবার আমি ফোনে বলেছিলাম, ‘দেশপত্রিকায় তোমার একটা কবিতা ছাপা হলো, ‘আনন্দবাজারপত্রিকায় ছাপা হলো, এতে লেজ নাড়ানোর কিছু নাই। তুমি কি জানো, পূজা সংখ্যার পত্রিকা কীভাবে ছাপা হয়? এমন ঘটনা মাঝেমধ্যে ঘটে যে, বাংলাদেশের লেখককবিদের লেখাদেশপত্রিকায় যেগুলো থাকে, বাংলাদেশের জন্যে আলাদা ছাপা হয়। সেগুলো বাংলাদেশে চলে আসে। কলকাতায় যেপত্রিকা চলে, সেখানে বাংলাদেশের লেখকদের লেখা থাকে না। আমি তাকে বললাম, তুমি এই লেজুড়বৃত্তি করো না। নিজের দেশ, ঐতিহ্য, ধর্মসবকিছু বিসর্জন দিয়ো না। কারণ, এটা একটা মার্কেট। তোমার একটা কবিতা ছাপা হলে তুমি লেজ নাড়তে নাড়তে গদগদ করতে করতে আরো দশটা পাঠক তৈরি করবা তাদের। কোথায় ময়মনসিংহে বসে তুমি পশ্চিমবঙ্গে আমাকে টাকা খরচ করে ফোন করে বললে, দাদা, দেশ পত্রিকার এই সংখ্যা কি আপনার ঘরে এসেছে? আমি তো লিখেছি। আমিও কলকাতার ভাষায় বললাম, আমি পড়েছি বৎস্য, খুব ভালো লিখেছো। এতো গদগদ কেন? বাজার তৈরি করছে তারা। তারা বেনিয়া, এটা মনে রাখতে হবে।

এবার আমাদের করণীয়টা বলেন। ঢাকার সাহিত্যচর্চার জন্যে কী পড়া দরকার, কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে পড়া দরকার?

হরিপদ দত্ত : দেখো, আমি কখনোই বলবো না যে, তুমি কমিউনিস্ট লেখকদের বই পড়ো, মানিকের বই শুধু পড়ো। এটা আমি কখনোই বলবো না। আগে বলতাম। প্রত্যেকে পড়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন। যা ভালো লাগে, সেটাই পড়বে। তবে তোমাদের শেষ একটা কথা বলে রাখি, তোমরা তৈরি হয়ে থাকো। দিন আসতেছে কিন্তু। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা কেন্দ্রিক গদ্য আর বাংলাদেশের ঢাকা কেন্দ্রিক গদ্য কিন্তু একটা অনিবার্য সংঘাতের কাছাকাছি চলে আসছে। আমিও চাচ্ছি, দ্রুত সংঘাতটা লাগুক। লাগলে সুবিধা কী, স্বাধীন বাংলাদেশের একেবারে নিজস্ব একটা গদ্যরীতি তৈরি হবে। আরেকটা জিনিস হিসেব করে দেখবা যে, সারা বিশ্বে আটাশ কোটির মতো বাঙালি আছে। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বিহারের একটা অংশ, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে কিছু আছেএদের মধ্যে ধর্মীয়ভাবে হিন্দুমুসলমানের সংখ্যা কতো? হিন্দু মাত্র নয় কোটি। তাহলে বাকি ঊনিশ কোটিই তো নেতৃত্ব দেবে। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আবার স্বাধীন দেশ কোনটাপশ্চিমবঙ্গ না বাংলাদেশ? সুতরাং তোমাদের দায়িত্ব বাংলা সাহিত্যের নেতৃত্ব নেয়া, লেজুড়বৃত্তি করা নয়।

পঞ্চাশ বছরেও এটা হলো না কেন?

হরিপদ দত্ত : হলো না, যে লেজুড়বৃত্তি।

কলকাতার লেখকদের সাথে আপনার কোনো যোগাযোগ নেই?

হরিপদ দত্ত : না। যোগাযোগ আমি করিই না। আমার সব লেখা আমি বাংলাদেশেই পাঠিয়ে দেই। জন্মঋণ শোধ করতে করতেই আমার জীবন চলে যাবে।

একাত্তরের যুদ্ধের সময় আপনি কোথায় ছিলেন?

হরিপদ দত্ত : তখন আমি একটা বাম দলের সাথে যুক্ত ছিলাম। আমি চীনপন্থীদের সাথে ছিলাম। মেননদের সাথে ছিলাম। তাছাড়া আন্ডারগ্রাউন্ডের সাথে, সর্বহারার সাথেও যোগাযোগ ছিলো। টিপু বিশ্বাস, ভাষা মতিন, বদরুদ্দীন উমর

বদরুদ্দীন উমর ভাইয়ের জন্যে আমার খুব কষ্ট লাগে। এতো বিশাল পণ্ডিত, উনাকে কে বললো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কমিউনিস্ট রাজনীতি করতে?

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেশেই থাকার চিন্তা করছেন কি? বা বাংলাদেশে ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা আছে কি?

হরিপদ দত্ত : আমি তো পরনির্ভরশীল এখন। আমার ছেলেরাই আমাকে খাওয়ায়পরায়। আর ওখানে আমাকে কেউ চেনে না তো। আমি নিরিবিলি স্টেশনে বসে থাকি, একা। আর ওখানে বসলে আমার মাতৃভূমির কথা মনে পড়ে খুব।

ভাই গিরিশচন্দ্র সেন : কোরআনের অনুবাদ নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক


ভাই গিরিশচন্দ্র সেন। জন্ম মহেশ্বরদী পরগণার পাঁচদোনায়। ১৮৩৪ সালে। একজন ক্ষণজন্মা মানুষ। অত্যন্ত মেধাবী, কিন্তু আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া করেননি খুব বেশি। বাড়িতে পারিবারিক শিক্ষাগুরুর কাছে বাংলা ও মৌলভীর কাছে ফারসি শেখা। তারপর ঢাকার পোগোজ স্কুলে কিছুকাল পড়েছিলেন। ভালো লাগেনি একটানা পাঁচ ঘণ্টা ক্লাশরুমে বসে থাকা। তাই স্কুল ছেড়েছিলেন। তারপর ভাইয়ের আশ্রয়ে ময়মনসিংহে সংস্কৃত পাঠশালায়, হার্ডিঞ্জ স্কুলে। অতঃপর হার্ডিঞ্জ থেকে শিক্ষক প্রশিক্ষণে পাশ করে ঐ-স্কুলেই শিক্ষকতা। লেখাপড়ার আনুষ্ঠানিক দৌড় এতোটুকুই। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক অধ্যয়নে পুরো জীবন কেটেছে তাঁর। আর তাতেই ব্যুৎপত্তি ঘটেছে বাংলা, ইংরেজি, ফারসি, সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু ও আরবি ভাষায়। সার্থকতা এসেছে লেখালেখি আর সাংবাদিকতায়।

আমাদের বাড়ির কাছের এই মানুষটি সম্পর্কে জানি সেই ছোটোকাল থেকেই। জানি কোরআনের বাংলা অনুবাদক হিসেবে। কোরআন সপ্তম শতাব্দীর প্রথম ভাগের আরব দেশের ঐশী ধর্মগ্রন্থ। আরবি ভাষায় লেখা। এর বাণী প্রচার করে ইসলাম ধর্ম ব্যাপ্তি পেয়েছে দেশে দেশে। এই বাংলা মুল্লুকেও। সেই থেকে এখানকার মুসলমানদের ঘরে ঘরে রয়েছে পবিত্র এই ধর্মগ্রন্থ, আরবি কোরআন। অধিকাংশই পড়তে জানেন। কিন্তু ক’জনে এর অর্থ বোঝেন?

আরবি থেকে বাংলায় সম্পূর্ণ কোরআন অনুবাদের মাধ্যমে এর অর্থ বোঝার মহতি কাজটি করলেন পাঁচদোনার এই মানুষটি। এখন থেকে ১৪২ বছর আগে। আর এই কাজটি করতে ৪২ বছর বয়সে তিনি আরবি শিখতে যান তখনকার ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার অন্যতম কেন্দ্র লখনৌ’তে। লখনৌর প্রবীণ আলেম মৌলভী এহসান আলীর কাছে আরবি ভাষা ও ব্যাকরণ শেখেন এক বছর। তাঁর কাছে ফারসি সাহিত্যও পড়াশোনা করেন তিনি। ফিরে এসে কলকাতা ও ঢাকার নলগোলায় আরো দুইজনের কাছে আরবিতে অধিকতর তালিম নেন। তারপর অনুবাদের কাজে হাত দেন।

অনুবাদের কাজ শুরু করেন ময়মনসিংহে। ১৮৮১ সালে শুরু করে শেষ করেন ১৮৮৬ সালে। প্রথম খণ্ড শেরপুরের চারুচন্দ্র প্রেস থেকে ছাপেন। এর একটি কপি পাঠান কলকাতায়, পত্রিকায় প্রকাশের জন্যে। শর্ত দেন, প্রকাশকালে থাকবে না অনুবাদকের নাম। এভাবেই প্রথম প্রকাশ। পরে অনূদিত খণ্ডগুলো একে একে পাঠালেন কলকাতার বিধানযন্ত্র প্রেসে। এখানেই প্রথম অখণ্ড অনুবাদ প্রকাশিত হয় তাঁর নাম উহ্য রেখে। এক হাজার কপি বাঁধাই হয়ে বাজারে যায়। দ্রুতই তা নিঃশেষ হয়। ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় সংস্করণ, প্রচ্ছদে অনুবাদকের নাম উল্লেখ করে। প্রকাশক ও মুদ্রক দেবযন্ত্রের মালিক গিরিশচন্দ্র চক্রবর্তী। এই সংস্করণ শেষ হওয়ার পর সংশোধিত আকারে, টীকা যুক্ত হয়ে তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় কলকাতার মঙ্গলগঞ্জ মিশন প্রেস থেকে। তাঁর জীবদ্দশায় এটিই শেষ সংস্করণ। ১৯১০ সালে তিনি মারা যান। এরপর অনবরত এর নতুন নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়ে আসছে কলকাতা ও ঢাকায়, ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশনী থেকে।

প্রথমবার যখন তাঁর অনুবাদখণ্ড প্রকাশিত হয়, তখন এক ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়। এমনটা হয়েছিলো মুসলমান সমাজে, তেমন বিশ্বাসবোধ থেকে যে, “আরবিই কোরানের একমাত্র ভাষা, এর কোনো ভাষান্তর হতে পারে না।” তবে বাঙালি মুসলমান সমাজের বিদগ্ধজন এই ভাষান্তরকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যথার্থ অনুবাদ হয়েছে। বলেছিলেন, আগেই এর ভাষান্তর হয়েছে ফারসি ও উর্দুতে। কাজেই বাংলায় হলো, তাতে দোষ কী? তখন অবশ্য অনুবাদকের নাম ছিলো না, প্রচ্ছদে। পরে যখন নামসহ প্রকাশ পেলো, তখন আরেক ধরনের প্রতিক্রিয়া হলো। একজন অমুসলমানের অনুবাদে কোরআন, এ যেন অকল্পনীয় কারো কারো কাছে। এক ক্রুদ্ধ মুসলমান বললেন, “কাফেরের হাতে হয়েছে এই পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ। তাকে পাইলে আমি শিরশ্ছেদ করবো।” কিন্তু লেখাপড়া জানা আলেম সমাজ, বিদ্বানেরা এই কাজের অকৃপণ প্রশংসা করেন। অনুবাদককে উদ্দেশ্য করে প্রশংসাপত্র আসতে থাকে। পত্রিকায় লেখেন বেশ অনেকে। কলকাতার তিন মৌলভী ইংরেজিতে লেখা এক চিঠিতে বলেন, “আমরা কয়জন অত্যন্ত সতর্কতা ও মনোযোগ দিয়ে আপনার অনুবাদ পড়েছি। মূল কোরআনের সাথে তা তুলনা করে দেখেছি। আমরা অবাক হয়েছি কিভাবে আপনি এমন যথার্থ অনুবাদ করতে সক্ষম হলেন।” এমন প্রশংসাসূচক পত্র ও মতামত পাওয়া গেলো তৎকালীন অনেকের কাছ থেকেই। ঢাকা থেকে মৌলভী আলিমুদ্দিন আহমদ ফারসিতে লেখা পত্রে তাঁর অনুবাদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। আবু আল মজফফর আবদুল্লা নামের আরেকজন লেখেন, “আপনি যে টীকা বর্ণনা করেছেন তা আমার ক্ষুদ্র বিদ্যা-বুদ্ধিতে পর্যন্ত বুঝতে পেরেছি।” যশোরের মৌলভী আফতাব উদ্দীন লেখেন, “বাংলা অনুবাদটি অতি উৎকৃষ্ট ও প্রাঞ্জল। এতে বাঙালি জাতির গৌরব বাড়বে।” এমন প্রশংসার বর্ণনা তাঁর জীবনকালকে ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৩৬ সালে প্রখ্যাত মুসলমান মনীষী মওলানা আকরম খাঁ লেখেন :

“তিন কোটি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা। তাদের মধ্যে কোনো মনীষী কোরানের অনুবাদ প্রকাশের কল্পনা করেনি ১৮৭৬ সাল অবধি। আরবি ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত মুসলমানের অভাব ছিল না তাদের মধ্যে। এই গুরুদায়িত্বভার সর্বপ্রথম বহন করলেন বাংলার এক হিন্দু (প্রকৃত পক্ষে তিনি ছিলেন নিরাকার একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম, হিন্দু নন) সন্তান ভাই গিরিশচন্দ্র সেন। তাঁর এই অসাধারণ সাধনা ও অনুপম সিদ্ধি জগতের অষ্টম আশ্চর্য বলে উল্লেখ করা যেতে পারে।”

ভাই গিরিশচন্দ্র সেন বাঙালি মুসলমান সমাজ কর্তৃক তাঁর সকল প্রশংসার জবাব দিয়েছেন অতি বিনয়ের সাথে। লিখেছেন :

“এ তো ঈশ্বরের লীলা। সাধারণ মানুষের অগম্য এই নিগূঢ় জ্ঞান আমি তাদের জন্য প্রকাশ করতে পারবো, এমনটা আমি পূর্বে চিন্তা করতে পারিনি। অনেকটা মনের আবেগে আমি এই কাজের উদ্যোগী হয়ে লখনৌ যাই।”

প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে চাই, কোরআন অনুবাদে তাঁর নাম ছড়িয়েছে, এ-কথা সত্য। কিন্তু এটাই তাঁর একমাত্র সৃষ্টিকর্ম নয়। তিনি অনবরত লিখেছেন আজীবন। নিজের আত্মজীবনীসহ তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৭৭ টির মতো। তিনিই প্রথম হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী লিখেছেন বাংলায়। তিনি বই লিখেছেন ইসলামের মনীষীদের নিয়ে। অনুবাদ করেছেন বিখ্যাত আরবি গ্রন্থ ‘মেস্কাতোল মসাবিহ’। এর নাম দিয়েছেন ‘হাদিস পূর্ব্ব বিভাগ’। এরপর হাদিসের অপর খণ্ড ‘হাদিস উত্তর বিভাগ’। বিচিত্র তাঁর লেখার ভুবন। লিখেছেন ভ্রমণ কাহিনি, ইতিহাস ও ধর্মবিষয়ক বই ‘বর্ম্মাদেশ ও বর্ম্মাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম’।


ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের সকল কীর্তি এখন সুদূর অতীতের ঘটনা। কোরআন অনুবাদের বিষয়টিও তাই। কিন্তু সেই অতীত আবার সামনে এসেছে কিছু মানুষের অপলাপের ফলে। প্রায় দেড়শো বছর পর প্রতিষ্ঠিত সত্যকে ঘিরে নতুন তথ্য হাজির করছেন কিছু লোক। কোনো গবেষণায় নয়, কোনো প্রকাশনায় নয়, এমনকি কোনো বিতর্ক সভায়ও নয়। তারা এটা করছেন ‘সোস্যাল মিডিয়া’ বলে কথিত অবারিত এক মাধ্যমে, ফেসবুক-সহ অন্যত্র। এ এক বিচিত্র জগত। বিশাল এর পর্দা, নিমিষে তা ছড়িয়ে যায় আঙুলের এক চাপে। তারপর ‘লাইক’ আর ‘শেয়ার’-এর কসরত। কোনো বাছ-বিচারের বালাই নেই, সত্য-অসত্যের যাচাই নেই। হুমড়ি খেয়ে পড়ছে একদল মানুষ, ছুটছে বেদম, বলছে, বাহ্, চমৎকার তো, মারহাবা মারহাবা!

আমি দেখছি, ফেসবুকের সেই ‘ফেসলেস’ কতিপয় মানুষ লিখছেন, “গিরিশচন্দ্র সেন কোরআনের অনুবাদক নন, প্রকাশক।” লিখছেন, “এতদিনে সত্যটা প্রকাশ পেল কোরআনের বাংলা অনুবাদক নিয়ে।” লিখছেন, “হিন্দু গিরিশচন্দ্র নয়, কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক মুসলমান…।” আমি অবাক হই। এমন যেসব লিংকের দেখা পাই, সবিনয়ে দুই কথা লিখি, সম্বিৎ ফেরাতে চাই। কিন্তু না, তাতে কি ফেরেন তারা? ক’দিন পরপর একই পোস্ট দিতে থাকেন। সেই গোয়েবলসের কৌশলের মতো। একটা মিথ্যাকে বারবার প্রচার করলে অনেক মানুষ একেই সত্য বলে ভাববে। এমনটাই আমি এখন দেখছি। আমার পরিচিতজনদের মধ্যেও কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয়ে আমাকে প্রশ্ন করেন, আসলেই কি তা?

ফেসবুকের তেমন একটি অপলাপ নমুনা হিসেবে তুলে ধরছি এখানে। শিরোনাম ‘একটি ভুলের নিরসন : গিরিশচন্দ্র সেন বাংলা ভাষায় কোরআন শরীফের অনুবাদক নন’। লেখাটি এখানে সংক্ষেপে উদ্ধৃত করছি :

“সর্বপ্রথম অনুবাদ করেন মাওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়া। তারপর মৌলভী নাইমুদ্দীন। গিরিশচন্দ্র হচ্ছেন প্রকাশক। সুতরাং কুরআন শরীফের প্রথম বাংলা অনুবাদক গিরিশ চন্দ্র নন। আরবি জানেন না, আরবি ব্যাকরণ জানেন না, এমন ব্যক্তি কুরআন অনুবাদ করেছেন— এমন প্রচার মূর্খতা।”

এই প্রচারে ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের কীর্তিকে শুধু অস্বীকারই করা হয়নি, তাঁকে তঞ্চকতার দায়ে অভিযুক্তও করা হয়েছে। আর এই পোস্টের নিচে বলা হচ্ছে, যতো পরিমাণে সম্ভব পোস্টটি শেয়ার করুন, অন্যকে জানার সুযোগ করে দিন। আহ্বানটি এমন যেন শেয়ার করে সাচ্চা মুসলমানিত্বের দায়িত্ব সারলেন।


অনুবাদ তো ভাষান্তর। এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায়। কোরআনের এমন ভাষান্তর বাংলায় সার্থকভাবে করেছেন ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। বহুকাল এই সত্য নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। এখন যাঁদের নাম উল্লেখ করে প্রচার শুরু, তাঁদের বিষয়ে একটু আলোকপাত করতে চাই।

আমীরুদ্দীন বসুনিয়া রংপুরের মানুষ। তিনি পুঁথি সাহিত্যের ভাষায় কোরআনের শেষ পারা ভাবানুবাদ করেছিলেন। কোরআনের শেষ পারাটি হচ্ছে ছোটো আকারের বেশ কয়েকটি সুরার সমষ্টি। এর অনেকগুলো নামাজি মুসলমানদের মুখস্থ থাকে। তিনি তেমন সুরাগুলোর তর্জমা পুঁথির ছন্দে লিখেছিলেন। ঐ-সময় এই অংশ নিয়ে তিনি ছাড়াও পুঁথির ভাষায় লেখেন জনৈক আকবর আলী। উল্লেখ্য যে, এই কাজে এই দুজনই প্রথম নন। তারও বহু আগে কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর কোরআনের একটি সুরায় বর্ণিত কাহিনি অবলম্বনে ‘ইউসুফ জুলেখা’ কাব্য লেখেন। পরবর্তীকালের কবি কাজী নজরুল ইসলামও কোরআনের প্রথম সুরা ‘ফাতিহা’ ও শেষদিকের সুরা ‘এখলাস’-এর অনুবাদ করেন কবিতার মতো করে। প্রশ্ন করা যেতে পারে, এসবকেই কোরআনের অনুবাদ বলা যাবে কি? পুঁথির ভাষায় কিংবা কবিতার ছন্দে সামান্য অংশবিশেষ লিখেই কি কোরআনের অনুবাদক হওয়া সম্ভব? তাঁদেরকে কি সম্পূর্ণ কোরআনের অনুবাদক বলা যায়?

জবাব হচ্ছে, না, তা বলা যায় না। হয়তো খণ্ডিতভাবে এমন অনুবাদ বা ভাবানুবাদ করে থাকবেন আরো অনেক ধর্মপ্রাণ। হয়তো-বা কোনো ইসলাম বিরোধীও। তাদের কেউ কোনোভাবেই সম্পূর্ণ কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক বলে বিবেচিত হতে পারেন না। যেটুকু কাজ তাঁরা করেছেন, সেটুকুর স্বীকৃতি ও মর্যাদা তাঁরা নিঃসন্দেহে পেতে পারেন। কিন্তু যা করেননি, তার কৃতিত্ব কী করে পাবেন?

টাঙ্গাইলের মানুষ মৌলভী নইমুদ্দীনকে এই কৃতিত্ব যারা দিতে চান, তারা সন তারিখের ভুল তথ্য দিচ্ছেন। এছাড়া তথ্য তল্লাশিতে বেরিয়ে এসেছে যে, তিনি কয়েক পারা মাত্র অনুবাদ করতে পেরেছিলেন, সম্পূর্ণটা নয়। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্রগণ আরো কয়েক পারা অনুবাদ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এর বেশি নয়। মৌলভী নইমুদ্দীন আর গিরিশচন্দ্র সেন সম-সাময়িক। অথচ প্রচারকেরা দাবি করছেন, গিরিশচন্দ্র সেনের জন্মের আগেই তিনি অনুবাদ সম্পন্ন করেছেন। টাঙ্গাইলের মানুষ হিসেবে ‘বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার, টাঙ্গাইল’-এ মৌলভী নইমুদ্দীন সম্পর্কে যে-বিবরণ ছাপা হয়েছে, তাতে তাঁর এই অনুবাদের সময়কাল ১৮৯২ থেকে ১৯০৮ সাল মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই হিসেবে তিনি ভাই গিরিশচন্দ্র সেন কর্তৃক প্রথম খণ্ডের অনুবাদ প্রকাশের অন্তত ১১ বছর পর এই কাজটি করেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া যায়।


কোরআনের বাংলা অনুবাদ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে অনেকেই গবেষণা করেছেন, অনেকেই বই লিখেছেন। এপার-ওপার উভয় বাংলায়। বই লিখেছেন ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়েও। আমি নিজেও একটি বই লিখেছি তাঁকে নিয়ে। আমার এই যৎকিঞ্চিত জ্ঞানের কথা বাদ দিলেও বহু জ্ঞানী-গুণীর উদাহরণ টানা যায় এক্ষেত্রে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক অমলেন্দু দে, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল অদুদ, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান, অধ্যাপক অমিত দে, মোফাখখার হুসেইন, ড. সফিউদ্দিন আহমদ ও কবি আবদুল কাদিরসহ বিশিষ্টজনের লেখায় ও গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ভাই গিরিশচন্দ্র সেনই বাংলা গদ্যে পবিত্র কোরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদক।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মুজীবুর রহমানের পিএইচডি থিসিসের বিষয়বস্তু ছিলো ‘বাংলা ভাষায় কোরআন চর্চা’। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-কোরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সাবেক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল অদুদেরও পিইচডি থিসিস ‘বাংলা ভাষায় কোরআন চর্চা’। মোফাখখার হুসেইন রচিত গবেষণা গ্রন্থ ‘পবিত্র কুরআন প্রচারের ইতিহাস ও বঙ্গানুবাদের শতবর্ষ’। অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদের গবেষণা সমৃদ্ধ বইয়ের শিরোনামই হচ্ছে ‘কোরানের প্রথম অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন’। এর প্রতিটিতেই একই সত্য প্রতিষ্ঠিত যে, প্রথম সম্পূর্ণ কোরআনের বাংলা অনুবাদক আর কেউ নন, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন।


কোরআন এক মহাগ্রন্থ। ঐশ্বরিক গ্রন্থ। কোরআন বলছে, এর বাণী গোটা মানবজাতির উদ্দেশ্যে, মানবজাতির পথ প্রদর্শনের জন্যে। কোরআন যাঁর মাধ্যমে নাজিল হয়েছে, সেই রসুল মোহাম্মদ (সা.) বিদায় হজ্জের ভাষণে এর বাণী ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান রেখেছেন। স্বয়ং আল্লাহতায়ালা ও রসুল (সা.)-এর যখন এমন ঘোষণা, তখন কোরআনের অনুবাদক ব্রাহ্ম নাকি হিন্দু, এমন সংকীর্ণ চিন্তা আদৌ শোভা পায় কি? না, মোটেই নয়। ভিন্ন ভিন্ন ভাষার মানুষের বোঝার জন্যে অনুবাদ একটি অপরিহার্য বিষয়। বাংলাভাষীদের জন্যে ভাই গিরিশচন্দ্র সেন এই কাজটি করেছেন প্রথম। কিন্তু তাতেই কি শেষ? না, তা-ও নয়। পরবর্তীকালে আরো অনেকেই বাংলায় অনুবাদ করেছেন। এখনো অনেকে করছেন। ভবিষ্যতেও হয়তো করবেন। কিন্তু প্রথমে যিনি অনেক প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে এই দুরূহ কাজটি করলেন, তাঁকে সেই স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা কেন কারো কারো, তা বোধগম্য নয়। অমুসলিমের দ্বারা এই মহৎকর্ম, সে-কারণেই কি? এমনটা হলে তা সত্যিই দুঃখজনক, মুসলমানদের জন্যেও লজ্জাজনক। যাঁদের নাম উল্লেখ করে, যাঁদেরকে এই কৃতিত্বের মুকুট পরাতে এই কসরত, তাঁরা নিজেরাও পরলোকে থেকে লজ্জায় কুণ্ঠিত হবেন নিশ্চয়ই। তাঁরা কেউ জীবদ্দশায় এমনটা কখনো দাবি করেননি। তাঁদের অনূদিত গ্রন্থ এ-দেশের কোনো প্রাচীন লাইব্রেরি বা আর্কাইভে আছে, তেমনটাও জানা নেই। অথচ ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের অনূদিত প্রথম খণ্ড সেই কালেই ক্যাটালগিং হয়ে আছে বেঙ্গল লাইব্রেরিতে। ক্যাটালগ নম্বর ৭৬৫৯-৬০। ১৮৮২ সালের ঐ-লাইব্রেরির ত্রৈমাসিক বিবরণীতে ইংরজিতে লেখা আছে, “এই বইটি আরবি থেকে বাংলায় অনূদিত কোরআনের প্রথম খণ্ড। অনুবাদক আশা করছেন ১২ খণ্ডে তিনি এর অনুবাদ শেষ করতে সক্ষম হবেন।”

আরো উল্লেখ করতে চাই, ভাই গিরিশচন্দ্র সেনই কোরআনের একমাত্র অমুসলিম অনুবাদক নন। আরো অনেক অমুসলিম এর অনুবাদ করেছেন গ্রিক, ল্যাটিন, চীনা, রুশ, চেক ও ইংরেজিসহ পৃথিবীর নানা ভাষায়। এতে করে ঐসব ভাষাভাষী মানুষ কোরানের বাণী পড়ার ও বোঝার সুযোগ পেয়েছে। আর বাংলায় ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের অনুবাদেই প্রথম কোরআন পাঠ হয়েছে বাংলা ভাষাভাষী অসংখ্য মানুষের। এ কি কম কথা! এজন্যে মুসলমানদের গর্বিত হওয়া উচিত।

কোরআন অনুবাদই নিঃসন্দেহে তাঁকে ব্যাপক পরিচিতি দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন এর চেয়ে ঢের বড়ো মাপের কিছু। সাদা মনের মানুষ। বাংলা গদ্যরীতিতে নিজস্ব স্টাইল তৈরি করা সুসাহিত্যিক, একান্ত নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিক, সংবাদপত্রের সম্পাদক, নারী শিক্ষার অগ্রদূত। তাঁর দ্বারা পাঁচদোনায় প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়টি ছিলো এই অঞ্চলে নারী শিক্ষার প্রথম দীপশিখা। তাঁর জীবনকালব্যাপী চল্লিশ বছর আলো জ্বালিয়েছে এই বিদ্যালয়। ময়মনসিংহের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়টিও তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ বিদ্যালয়ে তিনি বিনা বেতনে শিক্ষকতাও করেন। জীবন সায়াহ্নে তিনি তাঁর পৈতৃক সহায়-সম্পত্তি পাঁচদোনার মানুষের কল্যাণে ব্যয়ের জন্যে উইল করে দিয়ে যান।


আগস্ট মাসের ১৫ তারিখ এই মহতী মানুষটির মৃত্যু দিবস। আমি তাঁকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। তাঁর অমর কীর্তি বিরোধী সকল অপলাপ, অপপ্রচার বন্ধ হোক। সত্য চিরভাস্বর হয়ে থাকুক। এমনটাই প্রত্যাশা আমার।


সিরাজ উদ্দিন সাথী
প্রাবন্ধিক, গবেষক ও ‘ভাই গিরিশচন্দ্র সেন : জীবন ও তৎকালীন সমাজ’ গ্রন্থের রচয়িতা