Home Blog Page 6

পথকলি : সুবিধাবঞ্চিত ও পথশিশুদের আনন্দের বিদ্যালয়

0

নরসিংদী রেলস্টেশন ও নরসিংদী সরকারি কলেজের মাঝখানে বেশ কয়েক বছর আগে গড়ে তোলা হয়েছে ‘নরসিংদী পৌর উদ্যান’। উন্মুক্ত এই উদ্যান সাজানো হয়েছে নানা ধরনের গাছ ও বাচ্চাদের খেলাধুলার বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে। পাশাপাশি রয়েছে সুদৃশ্য বেঞ্চও। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নানা বয়স ও পেশার মানুষের আড্ডামুখর উপস্থিতি লেগেই থাকে এখানে। সারা দিনই বাচ্চারা মত্ত থাকে খেলাধুলায়। ইদানিং আবার বিভিন্ন ধরনের মেলা বসতে শুরু করেছে এখানে। ফলে সর্বদাই জনমানুষের সমাগমে গিজিগিজ করে উদ্যানটি। কিন্তু এই চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে যায় সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার। শুক্রবার সকাল থেকে দল বেঁধে আসতে শুরু করে রেলস্টেশন এবং আশেপাশের বস্তির সুবিধাবঞ্চিত ও পথশিশুরা। কেউ খালি গায়ে, কেউ ছেঁড়া জামা-প্যান্ট গায়ে চাপিয়ে।

উদ্যানের সবুজ ঘাসে বা শুকনো মাটিতে প্লাস্টিকের টুল পেতে বসেই সকালের হালকা নাশতা সেরে ফেলে সবাই। তারপর শুরু হয় মূল কাজ। কোনো-এক মহৎ কদমগাছের নিচে বোর্ড আর মার্কার হাতে দাঁড়িয়ে পড়েন শিক্ষক। বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করে জীবনের গভীরে প্রবেশ করতে চান গল্পের ছলে। বাচ্চাদের চোখে-মুখে যেন স্বপ্নের বীজ বুনে দেন। বাচ্চারাও তাদের করুণ বাস্তবতা থেকে ডুব দেয় আনন্দ আর স্বপ্নিল জীবনের ভেতর। দুপুরের খাবারও উদ্যানেই ব্যবস্থা করা থাকে। খাওয়া-দাওয়ার পর নির্দিষ্ট সময় বিরতি এবং তারপর আবার পাঠকার্যক্রমে ফিরে আসে তারা। পাঠের ভেতর কাটিয়ে দেয় সারা বিকেল। দিনভর আনন্দ আর অর্জিত অক্ষরজ্ঞান পকেটে পুরে সন্ধ্যার আগমুহূর্তে তারা ফিরে যায় নিজ নিজ গন্তব্যে। পরদিন শনিবার, আবার সকাল থেকে শুরু, সন্ধ্যা পর্যন্ত রুটিনওয়ার্ক, শিশুদের কলরবে মুখরিত উদ্যানের পরিমণ্ডল। শুক্র-শনিবার ছাড়াও সপ্তাহে আরো একদিন বিকেলবেলা চলে পাঠদান কার্যক্রম। পাঠকার্যক্রমের মূল অংশে থাকে বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি ও ধর্মশিক্ষার মতো বিষয়।

উদ্যানের সবুজে চলছে পাঠকার্যক্রম

নরসিংদী শহরের পরিচিত এসব দৃশ্যে পথশিশুদের মধ্যে প্রতিনিয়ত দেখা যায় একজনকে। তিনি আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল। ব্যাংকার আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল ১৪ বছর ধরে মেতে আছেন এই সুবিধাবঞ্চিত ও পথশিশুদের নিয়ে। তার এই আয়োজনের নাম দিয়েছেন ‘পথকলি’। নিজের খরচে, নিজের প্রত্যক্ষ শ্রমে শিশুদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে কিছুটা হলেও ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার, বাচ্চাদের খাতা-কলম, শিক্ষকদের সম্মানীসহ সব খরচ বহন করছেন একা। নিজের বেতনের একটা নির্দিষ্ট অংশ তিনি জমিয়ে রাখেন ‘পথকলি’র জন্যে। তবে কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে বাচ্চাদের কিছু দিতে চাইলে তা-ও তিনি গ্রহণ করেন। তবে সরাসরি অর্থ গ্রহণ করেন না কখনোই। খাবার অথবা কাপড় অথবা খাতা-কলম চাইলেই কিনে দিতে পারেন আগ্রহী কেউ। বেশিরভাগ সময় তিনি নিজেই বাচ্চাদের পড়িয়ে থাকেন। তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত ও পথশিশুদের অক্ষরজ্ঞান দেয়া। পাশাপাশি তারা যেন নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানতে পারে। অন্যান্য স্বাভাবিক বাচ্চার চেয়ে নিজেদের দুর্বল না ভাবে। একদিন তারা যেন সমাজের বোঝা না হয়।

দুপুরের খাবার

তাছাড়া একজন হুজুরও রেখেছেন বাচ্চাদের জন্যে, যিনি সপ্তাহে একদিন বাচ্চাদের ধর্মশিক্ষা দিয়ে থাকেন। আরবি হরফ থেকে শুরু করে নামাজ, রোজা ও বিভিন্ন দোয়া শিখিয়ে থাকেন তিনি।

২০১১ সালে ৮ জন পথশিশু নিয়ে যাত্রা করে ‘পথকলি’, নরসিংদী সরকারি কলেজ মাঠে। পরবর্তীতে কলেজের নানা জটিলতার কারণে পৌর উদ্যানে স্থানান্তর করেন কার্যক্রম। বর্তমানে ‘পথকলি’র শিশুর সংখ্যা প্রায় ৬৪। তবে ৪০ থেকে ৪৫ জন নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। এদের কারো কারো মা-বাবা নেই, কারো মা-বাবা থাকলেও তারা উদ্বাস্তুর মতো পথে ঘুরে বেড়ায়, কারো পরিবারের অবস্থা সংকটাপন্ন। কেউ আবার স্টেশনেই রাত কাটায়। বেশিরভাগই ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী। অক্ষরজ্ঞান আয়ত্তে এলে তাদের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়ে থাকে। তখন তাদের ব্যাগ-ইউনিফর্ম থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক খরচও বহন করা হয় ‘পথকলি’র পক্ষ থেকে। সময়ের পরিক্রমায় বহু শিশু এখান থেকে বের হয়ে শহরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। আবার অনেকে বিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে কাজকর্মে ঢুকে পড়েছে।

ইয়াসিন, কালো, সুজন, রুমা, শান্তারাও একদিন বিদ্যালয়ে পা রাখবে, সমাজের অন্য সব শিশুর মতো করে পৃথিবীটাকে দেখবেÑ এমনটাই প্রত্যাশা আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেলের। ‘পথকলি’ নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনাও রয়েছে তার। শিশুদের জন্যে স্থায়ী একটি ব্যবস্থা করতে চান তিনি। খাওয়া-দাওয়া আর কাপড়-চোপড়ের জন্যে যাতে তাদের জীবন থেমে না থাকে, এমন একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়তে চান তিনি, যেন তিনি না থাকলেও তাদের সমস্যা না হয়। এই লক্ষ্যে কাজও করছেন বলে জানান তিনি।

আবদুল্লাহ আল মামুন রাসেলের এই কর্মযজ্ঞের সবচে’ চমৎকার দৃশ্যটি ধরা পড়ে প্রতি ঈদের আগে, বৈশাখে। নতুন কাপড় কিনে দেওয়া হয় সবাইকে। নতুন কাপড়ের রঙ, মাঠের সবুজ ঘাস আর শিশুদের হাসিমুখ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। পুরো স্টেশন এরিয়ার সুবিধাবঞ্চিত ও পথশিশুরা আনন্দে মেতে ওঠে। তাছাড়া প্রতি বছর শীতবস্ত্রও বিতরণ করা হয়। নতুন কাপড় পেয়ে বাচ্চাদের মুখে যে-হাসি ফুটে ওঠে, তা দেখতে কার না ভালো লাগে?

ঈদে নতুন কাপড় বিতরণ
শীতবস্ত্র বিতরণ

নরসিংদীর শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং প্রশাসনের বহু গুণী ব্যক্তিত্ব নানা সময়ে ‘পথকলি’র বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। পাশে থেকে তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা যুগিয়েছেন।

নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী জানান, “পথশিশুদের নিয়ে রাসেলের যে-কার্যক্রম, সেটা খুবই দরকারি। ঈদ, পূজা-পার্বণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়

বাচ্চাদেরকে কাপড়, খাবার দেয়া হয়। ফলে তাদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি হয়। আমিও অনেকবার সেসব আয়োজনে গিয়েছি। রাসেলসহ আরো যারা এসব কার্যক্রমের সাথে আছে, তাদের জন্যে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শুভকামনা।”

নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তাফা মিয়া বলেন, “আমাদের সমাজে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সুবিধাবঞ্চিত ও পথশিশু রয়েছে। তারা একটা সময় সমাজের বোঝা হিসেবে পরিগণিত হয়। তাই তাদের নিয়ে কাজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব শিশুদের মূলস্রোতে নিয়ে আসার দায়িত্ব রাষ্ট্রের হলেও রাষ্ট্র তা ঠিকমতো করতে পারছে না বলেই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব নেয়া উচিত। সেই জায়গা থেকে রাসেলের এই উদ্যোগ এবং ধারাবাহিক কার্যক্রম প্রশংসার যোগ্য। তবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে আরো টেকসই এবং স্থায়ী সাংগঠনিক তৎপরতা তার কাছ থেকে আশা করি আমরা।”

নরসিংদী ইনডিপেনডেন্ট কলেজের অধ্যক্ষ ড. মশিউর রহমান মৃধার মতে, “একটি ভালো কাজ মানুষকে পরিতৃপ্ত করে, আনন্দ দেয়। এক্ষেত্রে রাসেলের আয়-উপার্জন খুব বেশি নয়, কিন্তু কেবলমাত্র মারাত্মক ইচ্ছাশক্তির দ্বারাই সে প্রায় ৬০-৭০ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে, যাদের কেউ দেখভাল করে না, যারা পথে ঘুরে বেড়ায়, তাদের নিয়ে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। আমি মনে করি, এই মুহূর্তে নরসিংদীতে যে-কয়েকটি ভালো কাজ চলমান আছে, তার মধ্যে একটি হলো রাসেলের পথশিশুদের নিয়ে এই কার্যক্রম।”

নরসিংদী পরিবেশ আন্দোলনের সভাপতি মইনুল ইসলাম মিরু জানান, “ইদানিং আমি লক্ষ্য করেছি যে, সকল কাজের ভীড়ে রাসেল ‘পথকলি’কে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। তার একটা ইচ্ছা আছে যে, এসব সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে সে স্থায়ী একটা ব্যবস্থা করতে চায়। এটা করতে পারলে দারুণ একটা ব্যাপার ঘটবে। এখান থেকে শত ফুল না ফুটুক, অন্তত দুই-চারটা ফুল ফুটলেও আমি এটাকে সার্থক বলে মনে করি। পাশাপাশি আমি এই মহতী উদ্যোগের সাথে সব সময়ই আছি।”

‘পথকলি’র অনেক শিশু-কিশোর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনের আশেপাশে। অনেকে বিভিন্ন সরকারি বিদ্যালয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকে ছিটকে পড়েছে। নানা কাজকর্মে যুক্ত হয়ে গেছে। আমরা ঘুরে ঘুরে তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি। তাদের অনুভূতি জানতে চেয়েছি। সেরকমই কয়েকজনের অনুভূতি তুলে ধরতে চাই পাঠকদের কাছে।

ফাতেমা আক্তার

আমি টু-তে পড়ি। ব্রাহ্মন্দী সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। রাসেল ভাইয়ের স্কুল থেকে আমি অ-আ, এক-দুই, এ-বি-সি-ডি, আলিফ-বা শিখছি। ওইখানে যাইতে আমাদের অনেক ভালো লাগে। প্রতি শুক্রবার আর শনিবার যাইতাম। রাসেল ভাইয়ের স্কুলে আমি আগে যাইতাম। মেলার জন্যে এখন বন্ধ।

ইসরাত জাহান তিথি

আমি এখন ক্লাশ ওয়ানে পড়ি। আমার আব্বু ডেকোরেটরে কাজ করে, মা-ও কাজ করে। রাসেল ভাইয়ের স্কুলে আমি সব সময় যাই। অনেক ভালো লাগে যাইতে। অ-আ, ক-খ পড়ায় আমাদের। তারপরে হুজুর আছে একজন, উনি আমাদের আলিফ-বা পড়ায়। আবার রাসেল ভাই আমাদের খাওয়ায়, কাপড় দেয়। গল্পও শোনায়। আমার মনে চায়, সারাদিন ওইখানেই থাকি।

মিলি আক্তার কুলসুম

আমার আব্বা রাজমিস্ত্রির কাজ করে। আমি ফাইভ পর্যন্ত পড়ছি। এখন স্কুলে যাই না। আমি প্রায় এক বছরের মতো রাসেল ভাইয়ের স্কুলে গেছি। ওইখান থেকে আমি অনেক কিছু শিখছি। আবার খাবার, তারপরে কাপড়ও দিতো মাঝে-মধ্যে। ঈদে জামা দিতো, বৈশাখেও জামা দিতো, শীতের সময় কম্বল-সোয়েটারও দিতো। রোজার সময় ইফতারও করাইতো।

রমজান

রাসেল ভাই যহন প্রথম শুরু করে স্কুল, সরকারি কলেজে, তহন আমি যাইতাম। কতো কিছু শিখাইছে রাসেল ভাই। অ-আ থেকে শুরু কইরা অঙ্ক পর্যন্ত শিখাইছে। আমি সরকারি স্কুলেও ভর্তি হইছিলাম। কিন্তু পরে আর পড়ালেখা করি নাই। এখন ব্যবসা করি, আনারসের। আগের সময়গুলো অনেক মনে পড়ে, অনেক। রাসেল ভাইয়ের লগে অনেক সময় আছিলাম। আমার দোকানে আরেকটা ছেলে কাজ করে, হ্যায়ও রাসেল ভাইয়ের স্কুলে যাইতো। আর ওইখান থেকে যা শিখছি, সেইগুলো এহন আমার কাজে লাগতাছে। ব্যবসায়ও কাজে লাগতাছে। মাঝে-মধ্যে মনে হয়, ভুল করছি পড়ালেখা না কইরা। রাসেল ভাই অনেক বুঝাইতো, কিন্তু পড়ালেখা ছাইড়া দিছি। পড়ালেখা করলে ভালো জায়গায় থাকতাম। যাক, সেইটা তো আর হইলো না। রাসেল ভাইয়ের লাইগ্যা অনেক দোয়া করি।

রহিমাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয় যেন আমার স্মৃতির ঘোলাটে আয়না

প্রত্যেক মানুষের জীবনেই প্রাথমিক শিক্ষা একটি স্মৃতিময় কাল। শৈশব কালের এই শিক্ষা বাকি জীবনের বিভিন্ন স্তরে মধুর স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। শিক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা জীবনব্যাপী হয়ে থাকে। কিন্তু ক্ষুদ্র পরিসরের প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের ছোটো ছোটো ঘটনাগুলো পরবর্তী জীবনে অনেক বড়ো হয়ে দেখা দেয়। জীবনের বাঁকে সুতোর গুটির মতো ঘটনাগুলো যেন জীবন্ত লুকিয়ে থাকে। জীবন সায়াহ্নে এসে মানুষ সকল কিছু ফেলে শৈশবে ফিরে যেতে চায়। বর্তমান রহিমাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্মৃতি-কাতরতা আমার জীবনব্যাপী প্রবাহমান। অনেক দিন হয়ে গেলেও মনে হচ্ছে, এখনো বুঝি আমি রহিমাবাদ স্কুলের ছাত্র। মাত্র দুই বছর পড়েছি সেই স্কুলে, অথচ মনে হয় হাজার বছর। আমার প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে খানিকটা ঘটনাবহুল কাহিনি আছে। ডবল প্রমোশন নিয়ে নিয়ে আমি প্রাইমারি স্কুলের পাঠগ্রহণ সমাপ্ত করেছি মাত্র আড়াই বছরে। কারণ, একটু বিলম্বে আমাকে স্কুলে ভর্তি হতে হয়েছিলো। ছোটো থাকতেই মাকে হারিয়েছি আর বাবাকে তো দেখিই নাই। আমার বয়স যখন এক-দেড় বছর, তখন বাবা মারা যান। শুনেছি, ছেলে হিসেবে বাবা আমাকে খুবই আদর করতেন। কিন্তু বাবার কথা একটুও মনে পড়ে না। তাঁর চেহারা বা কোনো অবয়ব আমার বিন্দুমাত্র স্মরণে নেই। ছোটোবেলা খুব চঞ্চল প্রকৃতির ও ডানপিটে স্বভাবের ছিলাম আমি। ঘুরে বেড়াতাম আর খেলাধুলার প্রতি ঝোঁক ছিলো বেশি। স্কুলে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া করার কথা কখনো ভাবিনি।

পরম শ্রদ্ধেয় রুসুন পণ্ডিতের কথা
আমাদের গাঁয়ের স্কুলে একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ছিলেন আবদুল মাজেদ খান স্যার, যার ডাকনাম ছিলো রুসুন পণ্ডিত। একদিন  স্যার স্কুলে যাওয়ার পথে আমাকে লিচু গাছের উঁচু ডালে বসে আছি দেখে রাগ করলেন। স্কুলে যাই না কেন জিজ্ঞেস করে বললেন, “যদি স্কুলে না যাস, তবে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে।” স্যারের কথা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়ি। তাছাড়া পুলিশকে খুব ভয় করতাম। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম, স্কুলে ভর্তি হবো। ভয়ে ভয়ে স্যারকেও বললাম, “স্কুলে যাবো স্যার।” স্যার খুব খুশি হলেন। বললেন, “আর দেরি নয়, আগামীকাল থেকে চলে আসবি।” তখন ছিলো ১৯৬৪ সালের মাঝামাঝি সময়। আমার জন্ম ১৯৫৬ সালে। তখন আমার বয়স আট বছরের চেয়েও বেশি।

স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু
১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি, সম্ভবত জুলাই মাসে, প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হই আমাদের দত্তেরগাঁও মডেল প্রাইমারি স্কুলে। হঠাৎ ভর্তি ও স্যারদের উৎসাহ পেয়ে ব্যাপকভাবে পড়াশোনা শুরু করি। কিন্তু বিড়ম্বনার বিষয় ছিলো যে, আমার সমবয়সী প্রায় সবাই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তো। আমার প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির বিষয়টিকে অনেকে তুচ্ছজ্ঞান করে তাচ্ছিল্যের সাথে দেখছে মনে হতো। কেউ কেউ টিপ্পনি দিয়ে নতুন নাম করে খোঁচা দিয়ে কথা বলতো। এই অবস্থায় মাত্র ছয় মাস পড়াশোনা করে বার্ষিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। কিন্তু মাথায় এক আজগুবি বুদ্ধি তাড়া করলো। এক ক্লাশ বাদ দিয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হতে হবে। স্যারদের সাথে আলাপ করলাম ও সাহস করে ইংরেজি ‘ডবল প্রমোশন’ কথাটি ব্যবহার করে বলে ফেললাম, “আমাকে ডবল প্রমোশন দিতে হবে।” স্যারেরা তো এ-কথা শুনে তেলে-বেগুনে জ্ঝলে ওঠলেন। স্কুলের কিংবদন্তীতুল্য শিক্ষক ছিলেন মরহুম ফাইজউদ্দিন পণ্ডিত। তিনি বাংলা-ইংরেজির সংমিশ্রণে অনেক কথা শুনিয়ে দিলেন। নানা কথা বলে বলে হাসি-ঠাট্টায় বিভিন্ন উক্তি করলেন। পড়ে গেলাম মহা সমস্যায়। হেডস্যারসহ কোনো স্যারই আমার প্রস্তাবে রাজি হলেন না। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমাকে অনেক পরামর্শ দিলেন। কিন্তু আমার রোগ সারলো না। অনন্যোপায় হয়ে রুসুন ও ফাইজউদ্দিন পণ্ডিতের স্কুলের মায়া ত্যাগ করলাম। মনের অদম্য বাসনা নিয়ে একদিন বাড়ি থেকে চলে গেলাম দূরের আদিয়াবাদ গ্রামে। ভর্তি হলাম পার্শ্ববর্তী রহিমাবাদ স্কুলে, তৃতীয় শ্রেণিতে, কোনোরকম বাধা ছাড়াই। টিসি আনার বিষয়টি খুব কড়াকড়ি করা হয়নি তখনো। তাছাড়া আমাকে গায়ে-গতরে বড়সড়ই দেখাতো।

যেভাবে রহিমাবাদ স্কুলে ভর্তি হওয়া সহজ হয়েছিলো
আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় একজন মৌলভী থাকতেন আদিয়াবাদ দক্ষিণপাড়ায়। মক্তবে আরবি পড়াতেন ছেলেমেয়েদের। তিনি প্রথমেই আমার লজিং থাকার ব্যবস্থা করলেন এক বাড়িতে। তখন লজিংয়ের প্রচলন ছিলো বেশি। থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে বাড়ির দুইজন ছেলেমেয়েকে পড়াতে হবে। তারা তখন পড়তো প্রথম শ্রেণিতে, আর আগের বছরই আমি প্রথম শ্রেণি পাশ করেছি! মৌলভী সাহেব লজিং দিয়েছেন, সম্ভবত এই কারণে বাড়ির মালিক তেমন কিছু বলতে পারেননি।

তখন ছিলো পাকিস্তান আমল। পাক-ভারত যুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিলো। প্রতিদিন যুদ্ধের খবরাদি শুনতাম, যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা হতো নিজেদের মধ্যে। এরই মাঝে পড়াশোনা করে আমি ভালোভাবে চতুর্থ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হই। পাশ করার পর আমাকে পেয়ে বসে সেই পুরোনো রোগে, অর্থাৎ ডবল প্রমোশনের রোগ। আমার কথা শুনে স্যারেরা আশ্চর্য হলেন। ডর-ভয় রেখে সাহস নিয়ে এতোদিন পর আগের বছরের ডবল প্রমোশনের কথা স্যারদের বললাম। তাঁরা দত্তেরগাঁও স্কুলের মতো তেমন কিছু না বললেও আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন। আমি ছিলাম সিদ্ধান্তে অটল। এবার পঞ্চম শ্রেণিতে পড়বোই। আর তাহলেই সমবয়সী যাদের পেছনে ছিলাম, তাদের সমান হয়ে যাবো। তখন রহিমাবাদ স্কুলে হোগলাকান্দীর একজন সহজ-সরল স্যার ছিলেন। নামটি ভুলে গেছি বলে দুঃখ লাগছে। তিনি অনেক বুঝিয়েও আমাকে রাজি করাতে না পেরে বললেন, “তুই যদি সাতদিনের মধ্যে চতুর্থ শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের সবকিছু পড়ে শোনাতে পারিস, তবে তোকে ডবল প্রমোশন দিতে চেষ্টা করবো।” যেই কথা, সেই কাজ। নাছোড়বান্দা হয়ে স্যারের নির্দেশমতো চতুর্থ শ্রেণির ইংরেজি বই পড়তে শুরু করলাম। নিজে নিজেই এবং প্রয়োজনে অন্যদের কিছু সহযোগিতা নিয়েও পড়েছি। ভুলভ্রান্তি কিছু ছিলো কি না, জানি না। তবে সাতদিনের মধ্যে পড়া শেষ করে ফেললাম এবং স্যারের সামনে গিয়ে হাজির হলাম। শ্রদ্ধেয় স্যার সেদিন আমার মুখের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। কোনো পাঠই জিজ্ঞেস করলেন না। স্যারের নীরব সম্মতি পেয়ে পঞ্চম শ্রেণির বন্ধুদের সাথে গিয়ে বসতে লাগলাম। নিজেকে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ভেবে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলাম। সেদিন স্যার একবার শুধু বলেছিলেন, “আমাদের কথা শুনলি না তো, দুর্বল হয়ে উপরে উঠে যে-ভুল করলি, তার ফল ভোগ করবি জীবনভর।” স্যারের সে-কথা আমার সারা জীবন মনে আছে। তখন থেকে আজ অবধি যদি কোথাও পড়াশোনা বা অন্য কোনো বিষয়ে হোঁচট খেয়েছি, স্যারের মূল্যবান কথা আমার বারবার মনে পড়েছে, আমাকে তাড়িত করেছে। তবে দয়াময়ের কৃপায় খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয়নি।

রহিমাবাদ স্কুল ও কিছু কথা
নরসিংদী জেলার রায়পুরা বাংলাদেশের একটি অন্যতম বৃহৎ উপজেলা, যা তৎসময়ে ছিলো আরো বৃহৎÑ রায়পুরা থানা। এই উপজেলার অনেকটা পশ্চিম প্রান্তে আড়িয়াল খাঁ নদঘেঁষা রহিমাবাদ স্কুল। খোলামেলা পরিবেশে দক্ষিণমুখী ও দৃষ্টিনন্দন স্কুল এটি। জবরদস্ত ব্রিটিশ শাসনের সময় ১৯০৬ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো। সময়টি ছিলো বঙ্গভঙ্গের ডামাডোলে উত্তেজনাপূর্ণ। তখন বাংলার গর্ভনর ছিলেন স্যার এন্ড্রু ফ্রেজার। স্বর্গীয় লালমোহন সাহার উদ্যোগে এবং তাঁর জ্ঞাতি কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষানুরাগীদের সহায়তায় রহিমাবাদ একটি পূর্ণাঙ্গ বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো। দীর্ঘ ১১৯ বছরে আলোকদ্যুতিবাহী বিদ্যালয়টি এলাকার মানুষকে  শিক্ষার আলোয় অনেক এগিয়ে নিয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বহু বিপ্লবী রহিমাবাদ থেকে তৈরি হয়েছিলো বলেও শুনেছি। এ-বিদ্যালয়ের সুনাম দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে। বর্তমান প্রধান শিক্ষক জনাব নাজিম উদ্দীন মহোদয়ের সাথে কথা বলে অনেক ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারি।

তৎসময়ের স্কুলগৃহ, ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকমণ্ডলী
দক্ষিণমুখী উত্তর ভিটেতে স্কুলগৃহটি ছিলো নড়বড়ে অবস্থায়, দোচালা টিনের ঘর। উত্তর ও পশ্চিমদিকে খানিকটা বেড়া থাকলেও বাকি দুইদিক খোলামেলা ছিলো। দুয়েকটি পার্টিশন মাঝে-মধ্যে দেয়া হতো। পাটের বস্তা/ছালা দিয়ে শ্রেণির পৃথকীকরণ করার চেষ্টাও করা হতো। এক শ্রেণি হতে অন্য শ্রেণির জন্যে বেঞ্চ টানাটানি করতাম আমরা। প্রতিদিন ক্লাশ শুরুর পূর্বে স্যারদের তত্ত্বাবধানে সম্পূর্ণ বিদ্যালয়গৃহ ও আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালিত হতো। আমাদের হেডস্যার আসতেন গৌরীপুর থেকে। আমরা বলতাম গৌরীপুরের স্যার। হেডস্যারের নাম জিজ্ঞাসা করবো এমন বুকের পাটা কারো ছিলো না। এজন্যে হোগলাকান্দীর স্যার ও গৌরীপুরের স্যারের নাম মনে করতে পারছি না। অন্যান্যদের মধ্যে ইয়াকুব আলী স্যার, কুতুবুদ্দিন স্যার ও অদুদ স্যারের কথা বেশ মনে আছে। তাঁদের আদর-শাসনের স্মৃতিগুলো আজো অমলিন। সহপাঠী বন্ধুদের নামগুলো ভুলে গেছি। অজিত চন্দ্র, নরেন্দ্র চন্দ্র, মোশাররফ, মজিদের চেহারা দৃষ্টির সীমায় এখনো কিছুটা হাজির হয়। অল্প সংখ্যক মেয়েরাও আমাদের সহপাঠী ছিলো, যাদের নাম মোটেও মনে করতে পারছি না।

তখন আমাদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিলো একমাত্র রেডিও। তবে স্কুল পর্যায়ে বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো থেকে আমরা প্রচুর আনন্দ পেয়েছি। স্কুলের সহপাঠী ও বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, গানে, আবৃত্তিতে অংশগ্রহণের সুন্দর ব্যবস্থা ছিলো। আমাদের রহিমাবাদ বিদ্যালয়ের চতুর্দিকে পাখিডাকা সুর, সবুজ শ্যামল প্রান্তর, সুবিন্যস্ত ফসলের মাঠ, সুন্দর ও সুউচ্চ গাছপালা, অরণ্য, নদী, খাল-বিল, বর্ষার দিনে ডিঙি ও পালতোলা  নৌকা দেখে দেখে কতো যে ভালো লাগতো। বিশেষ করে, আড়িয়াল খাঁ নদের তীরে তীরে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ ছিলো অত্যন্ত মধুময়। রহিমাবাদ বাজারে একটি মিষ্টির দোকানের টসটসে রসগোল্লার কথা আজো ভুলতে পারি না। আড়িয়াল খাঁ নদের সারি সারি নৌকার কোনোটিতে চড়ে মাঝে-মধ্যে চলে যেতাম হাসনাবাদ বাজারে। ফিরে আসার পথে নৌকায় বসে গরম জিলাপি খাওয়ার কথা মনে হলে আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই সময়ে। তখনকার নরম নরম কাবলি বুট খাওয়ার কথা মনে হলে বিস্মিত হয়ে পড়ি। আরো যে কতো কথা, কতো গল্প, কতো স্মৃতি।

অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পর একদিন আমার প্রিয় স্কুলটিতে উপস্থিত হয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে খুঁজতে থাকি হারিয়ে ফেলা সেই জীবন, শ্রদ্ধেয় স্যার আর বন্ধুদের। এখন পাকা দালান ঠাঁই পেয়েছে নড়বড়ে টিনের ঘরের জায়গায়। আছে পর্যাপ্ত বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল ও সুসজ্জিত আসবাবপত্র। নেই শুধু সেই দিন, সেই হাসি, সেই প্রাণ, সেই সব কণ্ঠ, উচ্ছ্বাস, আনন্দ, ছন্দোবদ্ধ সুর, গল্প, কবিতা আর গান। আমার স্যারেরা সে-সময় মাসিক ৩০-৪০ টাকা বেতনের জন্যে চাতক পাখির মতো পোস্ট অফিসের পিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। বারবার মনে হচ্ছিলো স্যারদের কথা। তাই মনের তাগিদ থেকে নিজের পরিচালনায় বর্তমান শিক্ষকমণ্ডলীকে নিয়ে পরবাসী স্যারদের জন্যে যৎসামান্য দোয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম মাত্র। এরই মাঝে সহসাই ছুটির ঘণ্টা বেজে ওঠে, ফিরে আসতে বাধ্য হই আপন ঠিকানায়। হয়তো আর দেখা হবে না বন্ধুদের সাথে। তবে হ্যাঁ, যতোদিন বেঁচে আছি, শৈশবস্মৃতিতে জড়ানো প্রিয় রহিমাবাদ স্কুল থাকবে আমার কাছে অমলিন ও অক্ষয়।


নূরুদ্দীন দরজী
সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার

সারোয়ার তুষারের সাথে আলাপচারিতা

0

সারোয়ার তুষার। লেখক ও কলামিস্ট। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। তারই পথ ধরে নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছেন ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নামে। এই সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক তিনি। নরসিংদীর ঘোড়াশালের কৃতি সন্তান সারোয়ার তুষার সম্প্রতি নরসিংদী এসেছিলেন, এক অনুষ্ঠানে। তারই এক ফাঁকে ‘গঙ্গাঋদ্ধি’র পক্ষ থেকে তাঁর সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয় গত ৪ জানুয়ারি ২০২৫ (শনিবার)। সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন সম্পাদক সুমন ইউসুফ। সঙ্গে ছিলেন নাজমুল আলম সোহাগ।


সুমন ইউসুফ : জনাব সারোয়ার তুষারকে গঙ্গাঋদ্ধি’র পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাদের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্যে। আমি প্রথমেই বুঝে নিতে চাই, এই যে জুলাইয়ের আন্দোলন, এটা বিপ্লব নাকি অভ্যুত্থান?

সারোয়ার তুষার : আচ্ছা, বিপ্লব না অভ্যুত্থান, এই তর্কটা আমার কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। আমরা যখন বলি যে, এটা বিপ্লব না, তখন আমাদের মাথায় থাকে চীন বিপ্লব বা রুশ বিপ্লব অথবা ইরানী বিপ্লব। সেগুলোর সাথে তুলনা করে আমরা বলি, এটা বিপ্লব না। কারণ, এখানে সেরকম কোনো ভ্যানগার্ড পার্টি নাই বা কোনো-একটা পার্টির আন্ডারে এটা হয় নাই। কিন্তু, আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা হচ্ছে, এটাকে পুরোপুরি বিপ্লব বলা না গেলেও আমরা এখনো পর্যন্ত একটা বিপ্লবী প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। আপনি দেখবেন যে, রাষ্ট্র সংস্কার, সংবিধান পুনর্গঠনের কথা বলা হচ্ছে। রাষ্ট্র সংস্কার করতে হবে, সংবিধান বদলাতে হবে, আগস্টের তিন তারিখে ফ্যাসিবাদের বিলোপ এবং আর যেন কেউ স্বৈরাচারী হয়ে ওঠতে না পারে— অভ্যুত্থানের আগেও এই কথাগুলো বলা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, আমরা ফ্যাসিবাদ থেকে গণতন্ত্রের দিকে যাচ্ছি। আমাদের কিন্তু অনেকেরই ধারণা, আমরা একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ছিলাম। তারপর শেখ হাসিনা এসে এটাকে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় রূপ দিয়েছে। কিন্তু এই ঘটনা সত্যি নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মের পর থেকে কখনোই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়নি। আমাদের এখানে নির্বাচন ছিলো। ‘নির্বাচন’ আর ‘গণতন্ত্র’ এক জিনিস না। রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক না হয়, তাহলে নির্বাচন গণতন্ত্র আনতে পারে না। আমাদের সাংবিধানিকভাবেই একটা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিলো। যেহেতু আওয়ামী লীগের একটা সাংস্কৃতিক ন্যারেটিভ ছিলো, যার মাধ্যমে শেখ হাসিনা সেটাকে ফ্যাসিবাদে পরিণত করতে পেরেছে। বিপ্লব বলতে আমাদের মাথায় শুধু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কাজ করে। কিন্তু ফরাসি বিপ্লব কিংবা মার্কিন বিপ্লব, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিপ্লব— এগুলো কিন্তু আসলে গণতান্ত্রিক বিপ্লব।

সুমন ইউসুফ : এগুলো বাদ দিয়ে আমি যদি বলি, বিপ্লবের কমন সিম্পটম বলতে সাধারণ মানুষ বোঝে যে, সমাজটা আগে তৈরি হতে হবে। সমাজটা গঠনমূলকভাবে তৈরি হওয়ার পরে বিপ্লব হয় বা বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। এদিক থেকে…

সারোয়ার তুষার : সেটাই বললাম, আমরা এখনো একটা বিপ্লবী প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি, পুরোটা আমরা এখনো সারতে পারছি না। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতান্ত্রিক করার চেষ্টা চলছে এবং তারপর কালচারের দিক থেকে করতে হবে, মানে সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ করতে হবে। সামাজিকভাবে এমনকি ধর্মীয় পুনর্গঠন, ধর্মের বিভিন্ন বিষয়, ধর্মের বিভিন্ন ইন্টারপ্রিটেশন কীভাবে আমরা ইনকর্পোরেট করবো— এটাকে এক্সক্লোড করতে অনেক সমস্যা হয়। এসব দিক থেকে আমি মনে করি, আমরা একটা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি, যেটা শুরু হয়ে গেছে পাঁচ আগস্টের মধ্য দিয়ে। এখনো আমাদের সেটা শেষ হয় নাই। ফলে পাঁচ আগস্ট বিপ্লব হয়েছে কি হয় নাই, তারচে’ বড়ো কথা এই যে, গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়েছে পাঁচ আগস্ট ফ্যাসিজমের উৎখাতের মধ্য দিয়ে। এখন ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ করতে পারলেই আমরা বিপ্লবকে পূর্ণাঙ্গ করতে পারবো বা সফল করতে পারবো। যদি আমরা সেটা না করতে পারি, তাহলে ব্যবস্থাটা আবার টিকে থাকবে। আমার একটা তর্ক ছিলো। আপনি বলতেছেন বিপ্লব নাকি অভ্যুত্থান? আমি তো দেখতেছি, এটাকে পলিটিক্যাল পার্টিগুলো একটা রেজিমের পরিবর্তন হিসেবে দেখতেছে, মানে শুধু ক্ষমতার হাতবদল। তাদের গণঅভ্যুত্থানের আইডিয়াই নাই। গণঅভ্যুত্থান কিন্তু স্ট্যাটাসের দিক থেকে বিপ্লবের চে’ কম কিছু না। বিপ্লব একটা নীরব প্রক্রিয়া। এখন দুনিয়ার যেসব জায়গায় বিপ্লব হইছে, আমরা যেগুলোকে বিপ্লব বলতে চাই, সেগুলো ছিলো মূলত রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। রাশিয়ায়, চীনে, ইরানে আপনি এমনটা দেখবেন। কিন্তু ইউরোপে বিপ্লবটা এক-দুইদিনে হয় নাই, তিনশো-চারশো বছর ধরে হয়েছে। আবার ধরেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র। এই উপমহাদেশে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম একটা সিগনিফিক্যান্সের ব্যাপার। এটা হইছে কিন্তু বুদ্ধিভিত্তিক কর্মকাণ্ডগুলোর ফলে আমাদের যে স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়েছে, এজন্যেই বাংলাদেশ হইছে। অনেকে মনে করেন যে, পাকিস্তান আন্দোলন, নানা ঘাত-প্রতিঘাত কতোগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আসলে কিন্তু ব্যাপারটা সেরকম না। আমাদের সমাজের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা বা সুর সবসময়ই আছে। এটা পুরোপুরি বামপন্থী স্টাইলে হতে হবে, এমন না। এমনটা হয় না সব সময়। বাংলাদেশের অস্তিত্বের গুরুত্বটা কী! এই চেতনাটা সব সময় আছে এবং এটা আছে বলেই কিন্তু যখন এখানে ফ্যাসিজম দাঁড়ায়, তখন এই ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে সমাজে শক্তি তৈরি হয়। সেটা যেভাবেই হোক। যেমন, এবার কিছু ছাত্র নেতৃত্ব দিলো। এটা কিন্তু হতে পেরেছে সমাজে বিপ্লবী একটা মনোভাব আছে বলেই।

সুমন ইউসুফ : মোটামুটি বোঝা গেছে ব্যাপারটা। আপনারা দ্বি-দলীয় বৃত্তের বাইরে নতুন একটা রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ  করার চিন্তা-ভাবনা করতেছেন এবং কর্মতৎপরতায় আপনারা এগিয়েও যাচ্ছেন। বিভিন্ন জেলা ও থানায় কমিটি দিচ্ছেন এবং কেন্দ্রীয়ভাবে বিভিন্ন কর্মতৎপরতা আছে। এটা খুবই দরকার বলে জনগণ মনে করে। কারণ গণমানুষের গত তিপ্পান্নো বছরের একটি আকাঙ্ক্ষার জায়গা ছিলো যে, দ্বি-দলীয় শাসন ব্যবস্থার বাইরে সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা তাদের দরকার। আপনারা এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই নেমেছেন বলে আমরা মনে করছি। আপনাদের আদর্শ এবং উদ্দেশ্য কী? গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার রূপ কীরকম হবে? এসবকিছু নিয়ে আপনাদের লড়াইটা কোন জায়গায়?

সারোয়ার তুষার : এখানে বাংলাদেশের যে-রাজনৈতিক দলগুলো, শুধু বাংলাদেশ না, উপমহাদেশে যেসব রাজনৈতিক দল আছে, তাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, তাদের কোনো রাষ্ট্রপ্রকল্প নাই। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের একটা থিসিস আছে, যেটা বই আকারে বের হয়েছে। সেখানে তিনি একটা কথা বলেছেন, ভারতীয় উপমহাদেশে কোনো রাজনৈতিক দল নাই। অথচ তখন কংগ্রেস ছিলো, মুসলিম লীগ ছিলো। তিনি এগুলোকে রাজনৈতিক দল বলতে চাচ্ছেন না। কেন? কারণ, এদের কোনো রাষ্ট্রপ্রকল্প নাই। এরা মূলত কিছু দেন-দরবার করে। আর হাল আমলে আমাদের বাংলাদেশ হওয়ার পরে, রাজনৈতিক দলগুলো শুধু নির্বাচন বোঝে, আর কিছু বুঝতে চায় না। যেমন ধরেন, এখনো দ্রুত নির্বাচনের জন্যে প্রেশার ক্রিয়েট করা হচ্ছে। এটা কিন্তু সমাজে অস্থিরতা তৈরি করছে। এই সমস্ত বিষয় নিয়ে আমাদের একটা মূল্যায়ন আছে এবং আমাদের একটা উপলব্ধি আছে। সেখান থেকে আমরা মনে করি, আমাদের এমন একটা রাজনৈতিক দল হতে হবে, যে আসলে প্রথমত বাংলাদেশে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রকল্প হাজির করবে— এই হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রকল্প, জনগণের সাথে রাষ্ট্রের এই সম্পর্ক। এই যে বিষয়টা, এটা কিন্তু আপনি আমাদের এখানে দেখবেন না। এখানে রাজনৈতিক দলের যে-আইডিয়াটা থাকে, সেটা হলো, আপনি যদি আমার লোক হোন, আমি ক্ষমতায় গেলে আপনি এই এই সুবিধা পাবেন, আর অন্য সবাই সেটা পাবে না। এই কনসেপ্টকে চরম জায়গায় নিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ধরেন, আপনি একটা দল করেন এবং আপনার দল ক্ষমতায় নাই, কিন্তু আপনি সমাজে নিরাপদে আছেন এবং আপনার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পারছেন। এই যে আইডিয়া, এটা দরকার। এই কনসেপ্টকেই আমরা বলছি ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’। বাংলাদেশপন্থী সকল শক্তি, তাদের যার যার রাজনীতি থাকবে। কিন্তু কতোগুলো বিষয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে রাজনীতি করবো না। যেমন অভ্যুত্থান হলো। অভ্যুথানের পরে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটেছে। এই ফ্যাসিবাদ আমরা ফিরে আসতে দেবো না। এজন্যেই বলা হচ্ছে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ। জাতীয় নাগরিক কমিটি থেকে আমরা চাচ্ছি, বিভিন্ন মতের মানুষ এখানে আসছে এবং তারা যার যার রাজনীতি ছেড়েই আসছে। এটাকে আমরা বলছি যে, পোস্ট ইডিওলজিক্যাল বা ভাবাদর্শিক-উত্তর সময়। মানে  হচ্ছে, তেরো সালের আগে পরে বাংলাদেশে বাইনারি রাজনীতি ছিলো। শাহবাগ বনাম শাপলা, ধর্ম বনাম প্রগতি, বিজ্ঞান বনাম মৌলবাদ— এরকম। আমরা যে-রাজনীতি করতে চাই, অর্থাৎ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হয়ে ওঠা, একটা পলিটিক্যাল কমিউনিটি হয়ে ওঠার যে-রাজনীতি, এর জন্যে এটা অনেক ক্ষতিকর। কিন্তু বিভাজন ছিলো মূলত একটাই, সেটা হলো ফ্যাসিজম বনাম জনগণ। এখানে আর কোনো বিভক্তির দরকার নাই। এই জনগণের পক্ষের কোনো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাইনি, যেটাকে অনেকে বলে গণরাজনৈতিক ধারা কিংবা আপনি অন্য কোনো ভাষায়ও বলতে পারেন। এখানে জনগণের সব সময়ই একটা আলাদা এজেন্ডা আছে। এটা কিন্তু সব সময় উপেক্ষিত। এই যে এখন যেমন বলা হচ্ছে, নির্বাচন দিয়ে দিলে যারা ক্ষমতায় আসবে, তারা জনগণের চাওয়া পূরণ করে ফেলবে। ব্যাপারটা এরকম না। জনগণের চাওয়া যে আলাদা, এটার প্রমাণ আমি আপনাকে ভুরি ভুরি দিতে পারবো। একটা উদাহরণ দিই, গত জানুয়ারির আগে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে আন্দোলন করলো বিরোধী দল। কিন্তু আপনি খেয়াল করে দেখেন, বাংলাদেশের জনগণ সেই আন্দোলনে সাড়া দেয় নাই। এখন বাংলাদেশের জনগণ কি ভোট দিতে চায় না? ডেফিনেটলি ভোট দিতে চায়। বাংলাদেশের জনগণ যে সাত জানুয়ারির নির্বাচনকে গ্রহণ করে নাই, তার প্রমাণ হচ্ছে যে, পাঁচ শতাংশ মানুষও ভোট দিতে যায়নি। যদি বিশ শতাংশও ভোট দিতে যাইতো, তাহলে আওয়ামী লীগ সেটাকে বিরাট সাকসেসফুল নির্বাচন দেখাইতো। কিন্তু লাখ লাখ মানুষ জুলাই মাসে রাস্তায় নামলো। মাত্র ছয় মাসের মধ্যে। ঘটনাটা কী প্রমাণ করলো? প্রমাণ করলো যে, মানুষ ভোটাধিকার চায়। কিন্তু ভোটের দাবিতে তারা রাস্তায় জীবন দিবে না। আপনি একটা রাজনৈতিক দল। আপনি ভোটের অধিকারে রাস্তায় আন্দোলন করছেন। আপনি যদি সেটা আদায় করতে পারেন আপনার শক্তি দিয়ে, তাহলে মানুষ গিয়ে ভোট দিয়ে আসবে। কিন্তু এর জন্যে জীবন দিবে না। মানুষ জীবন দিবে কীসের জন্যে? মানুষ জীবন দিয়েছে জুলাই মাসে। দেখেন, পুলিশ বলছে, স্যার, একটা গুলি করি একটা মরে, আরো দশটা সামনে আসে। অথচ ঢাকা শহরের কোথাও একসাথে দশ লাখ লোক জড়ো হয় নাই তিন তারিখের আগে। শেখ হাসিনাকে শেষ পর্যন্ত পালাতে হলো এবং রাজনৈতিক দলগুলো কিন্তু ২৬ জুলাই পর্যন্ত বলেছে যে, তাদের এই আন্দোলনের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নাই। তাদের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করেছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু আন্দোলন হইছে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে। এই যে জনগণের একটা আলাদা চাওয়া সব সময়ই ছিলো। জনগণ দেখেন কতো রেডিক্যাল। চল্লিশের দশকেও পাকিস্তান আন্দোলনের সময় কিংবা আপনি তার সামনে একটা এজেন্ডা ঠিক করলে তারা তা আদায় করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। যেমন আপনি ছয় দফা ঠিক করেছেন, জনগণ দেশ স্বাধীন করেছে। আপনি বলেছেন যে, ভারতের মধ্যে আমাদের মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি হতে হবে, যেহেতু আমরা মাইনরিটি, আমাকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে, তারা পাকিস্তান আন্দোলন করে ফেলেছে। রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি, সেনাবাহিনি— এরকম যতোগুলো পক্ষ আছে, তার মধ্যে জনগণ সব থেকে অগ্রসর পক্ষ। সে যেকোনো পরিবর্তনের জন্যে সব সময় মুখিয়ে থাকে। আবার দেখেন যে, পরিচিত রাজনৈতিক দল ডাকলো, সে আসলো না। কিন্তু অপরিচিত ছাত্ররা ডাকলো, সে রাস্তায় নেমে পড়লো। এই পার্থক্যটা থেকে বোঝা যায় যে, জনগণের একটা আলাদা এজেন্ডা আছে। এই এজেন্ডা কেউ কখনো রাজনীতিতে পিক করে নাই। আমরা সেই চেষ্টা করতেছি। সেটা হচ্ছে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ। ভাষাটা নতুন, আইডিয়াটা নতুন। এটা অনেকের বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো এটা মানতে পারছে না। এটার মানে কী? সংস্কার কেন করতে হবে? নির্বাচন দিয়ে দিলেই তো হয়ে যায়। কিন্তু আমরা মনে করি, যেসব কারণে বাংলাদেশে বারবার অভ্যুত্থান করতে হয়, সেগুলোই তো নিরসন হয়নি। অভ্যুত্থান তো আমরা এবারই প্রথম করলাম না। আন্দোলন আমরা এবারই প্রথম করলাম না। কিন্তু আমরা যদি নূর হোসেনের সাথে জাস্টিস করতাম, তাহলে তো আবু সাঈদকে জীবন দিতে হতো না। নূর হোসেন তো চাইছিলেন, গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক। স্বৈরাচার কিন্তু নিপাত গেছে। তো জনগণের এই চাওয়া ছাত্র-তরুণদের পক্ষেই পূরণ করা সম্ভব বলে আমরা মনে করছি। আমাদের সমাজে ছাত্ররা হচ্ছে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ভ্যানগার্ড। এখন তরুণদের রেডিক্যাল পরিবর্তন মানেই হচ্ছে জনগণের বৃহত্তর পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা। আপনি বলতে পারেন, এর মধ্যে শ্রমিক এজেন্ডা কোথায়, এর মধ্যে কৃষক এজেন্ডা কোথায়? এখন এগুলো পরিষ্কারভাবে নাই। কিন্তু আস্তে আস্তে আসবে।

সুমন ইউসুফ : জনগণের যেই এজেন্ডার কথা আপনি বললেন, এটা আপনাদের নাগরিক কমিটিতে কীভাবে রূপায়িত করবেন? পরিকল্পনা কী?

সারোয়ার তুষার : প্রাথমিক পরিকল্পনা হচ্ছে এই পরিবর্তনের জন্যে জনগণকে সংগঠিত করা। আমি যে-কথাগুলো বললাম, এগুলো আপনাদের কারোরই বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না। কারণ আপনারা সবাই বোঝেন যে, এই পরিবর্তনগুলো বাকি আছে। এই পরিবর্তনগুলো লাগবে আমাদের। এখন জাতীয় নাগরিক কমিটি প্লাটফর্মে আমরা এটাকে গোছাচ্ছি। পরবর্তীতে আমাদের যখন দলটা হবে, সেখানে কর্মসূচির মধ্যে এই বিষয়গুলো থাকবে। শ্রমিকের বা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার চাওয়া। কোন কোন বিষয়গুলো তাদের আটকে রাখছে, সেগুলো নিরসন করার মাধ্যমে আমরা চাই একটা বড়সড় পরিবর্তন। আমাদের রোডম্যাপটা হচ্ছে, সামনে যে-নির্বাচন হবে, সেটা হতে হবে গণপরিষদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। কারণ, আমরা মনে করি, এই সংবিধান প্রাসঙ্গিক না। নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে একটা রাষ্ট্র নির্মাণ করতে হবে। সেই রাষ্ট্রের অধীনে সংসদ নির্বাচন হবে।

নাজমুল আলম সোহাগ : গণপরিষদ নির্বাচনকে অনেকে বলতেছে সংবিধান সভার নির্বাচন।

সারোয়ার তুষার : একই কথা।

সুমন ইউসুফ : আপনারা কি আগামী মানে সামনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন?

সারোয়ার তুষার : আমরা মনে করি, সামনের নির্বাচনটা হওয়া উচিত গণপরিষদ নির্বাচন মানে সংসদ নির্বাচন। গণপরিষদ নির্বাচন হচ্ছে ঐ সংবিধান প্রণয়নের প্রশ্নে। তো সেটার জন্যে অবশ্যই আমরা প্রস্তুতি নিতেছি। আমাদের সেই প্রস্তুতি আছে। ড. ইউনুস যেটা বলেছেন, ’২৬-এর জুনে কিংবা ’২৫-এর ডিসেম্বরের মধ্যে। কিন্তু বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো এই সময়টা দিতে চায় না। একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার কাজ হচ্ছে সংস্কার করা, সে দুই বছরের কম সময় থাকবে, এই ইঙ্গিত দেয়ার পরও তাকে আপনি কতো রকমের ডিস্টার্ব করতেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত যা-ই ঘটুক, আমরা নির্বাচনে অংশ নিবো। তবে আমরা মনে করি, এই বছরের রাজনীতি হবে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিতে।

নাজমুল আলম সোহাগ : আপনারা তো গণতন্ত্রের কথা খুব বলছেন। আপনারা নাগরিক কমিটিতে যে-সিদ্ধান্তগুলো নেন, অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, নাগরিক কমিটি নাকি ক্লাবের মতো আচরণ করছে। এ-ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?

সারোয়ার তুষার : না! এগুলো ঠিক কথা না। আমাদের পরিষ্কার একটা অর্গানোগ্রাম আছে।

সুমন ইউসুফ : আপনার দলের যে-আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মপরিকল্পনার কথা বললেন, সবকিছুর বিপরীতে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল এবং সমাজে বিদ্যমান স্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে লড়াই করে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছাতে পারবেন? অলরেডি আপনাদের বিরুদ্ধে একটা কথা প্রচলিত যে, আপনারা কিংস পার্টি। এক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থান কী?

সারোয়ার তুষার : কিংস পার্টি কথাটা যদি সত্যি হয়, তাহলে তো আপনার আগের প্রশ্নটা ঠিক না যে, আমরা পারবো কি না? কিংস পার্টি পারবে না কেন? আপনার প্রশ্নটা হতে পারতো যে, এতো বড়ো কায়েমি স্বার্থবাদী রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে আপনারা কি পারবেন? যদি আমরা কিংস পার্টি হই, তাহলে তো এটা খুব সহজেই হওয়ার কথা, যেহেতু আমাদের কাছে সরকারের সকল ক্ষমতা আছে। সারা দেশে আমরা যখন সাধারণ কর্মীসভা করছি, সেখানেও হামলার শিকার হচ্ছি। বরিশালে এই ঘটনা ঘটেছে। আমরা এখনো পর্যন্ত সেই অর্থে রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠিনি। শুধু প্রস্তুতিমূলক কাজ করছি। এটাই অনেকের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠছে। কিংস পার্টির যে-তর্কটা, সেটা একেবারেই আমাদের উদ্যম নষ্ট করার জন্যে করছে। আমাদেরকে হীনমন্যতায় ভোগানোর জন্যে করছে। আমি মনে করি, কিংস পার্টি হওয়ার মতো কোনো শর্ত এখন বাংলাদেশে নাই।

সুমন ইউসুফ : জনগণের মধ্যে বেশি প্রতিভাত যে, ছাত্ররা আন্দোলন করেছে, ছাত্ররা ইউনুস সাহেবকে বসাইছে এবং আপনারা ঐ-লিগ্যাসি ধারণ করছেন। কিংস পার্টির আলাপটা ওখান থেকেই উঠে আসে।

সারোয়ার তুষার : প্রথম কথা হচ্ছে, কিংস পার্টি করানোর মতো শর্ত এই সরকারের নাই। অবশ্য শুরু থেকে এই সরকার ছাত্রদের সরকারই ছিলো। উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রেও ছাত্রদের ভূমিকা ছিলো। প্রথমদিকে জনগণও যেভাবে ছাত্রদের সাথে ছিলো, পরবর্তীতে জনগণ যার যার কাজে ফেরত গেছে। ছাত্ররা যে আবার রাজনীতি করবে, জনগণের তো এই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা নাই। এখন আবার জনগণকে একত্রিত করার চেষ্টা চলছে এবং ছাত্ররা যখনই প্রোক্লেমেশনের কথা বলেছে, তখন জনগণ সাড়া দিতে শুরু করেছে। সেদিন আমাদের জমায়েতে ছিলো প্রায় এক লাখ মানুষ। সেদিন যদি আমরা প্রোক্লেমেশন জারি করতাম, তাহলে সেই জমায়েতটা চার-পাঁচ লাখ হয়ে যেতো। আমাদের দাবি সরকার গ্রহণ করেছে, অর্থাৎ আমাদের একপ্রকার থামিয়ে দেয়া হলো। ছাত্ররা কিংস পার্টি করতেছে, এটা একেবারেই সত্যি না। আমার একটা হাইপোথিসিস এরকম, যখন বাংলাদেশে একটা সরকার গঠিত হয়, সেখানে বিরোধী একটা দল থাকে। কিন্তু এই সরকার তো সেভাবে হয়নি। এই সরকারের তো কোনো বিরোধী দল নাই। ফলে এখানে ক্ষমতার দুটি পক্ষ আমরা দেখতে পাই। একদিকে জনগণ, জনক্ষমতা! আরেকটা হচ্ছে স্টাবলিশমেন্টের ক্ষমতা। এটা সব সময়ই আগানো-পিছানো আছে। স্টাবলিশমেন্ট একটু আগায়, জনগণ একটু পিছায়। আবার জনগণ একটু আগায়, স্টাবলিশমেন্ট একটু পিছায়। এই যে প্রোক্লেমেশন, এটা দিতে পারলে জনগণের মধ্যে ঐতিহাসিক মৈত্রী তৈরি হতো। আবার কিন্তু জনক্ষমতাটা আগায়া যেতো। এই যে সংবিধান বাতিল করতে চাওয়া, এটাও কিন্তু এর সাথে সম্পর্কিত। ফলে আমি বলবো যে, ছাত্ররা আসলে সরকারের মধ্যে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে।

নাজমুল আলম সোহাগ : আপনার কাছে জানতে চাই যে, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটা ফ্যাসিবাদ সরালেন, আরেকটা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের আকাঙ্ক্ষার যে-জায়গা, মাজার ভাঙা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগ ও সংগীত বিভাগ বন্ধ করে দিতে হবে, এইটা মোকাবেলা বা মীমাংসা করার জন্যে নাগরিক কমিটির পলিসি কীরকম?

সারোয়ার তুষার : আমরা বলছি যে, আমরা যেকোনো ধরনের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। ফ্যাসিবাদ মানে হচ্ছে একটা জাতিবাদের উৎকট প্রকাশ। জাতিবাদটা শুধু সেক্যুলার জাতিবাদ হয় না। এটা ধর্মীয় জাতিবাদও হয়। ধর্মীয় জাতিবাদটাও আধুনিক জিনিস। অনেকে মনে করে, এটা হচ্ছে প্রাক আধুনিক আর সেক্যুলার জাতিবাদ হচ্ছে আধুনিক। আসলে দুটোই আধুনিক। ইসলামের কথা যদি বলেন, ইসলামে কোনো রাষ্ট্রধারণা নাই। ইসলামকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের ধারণা তো মডার্ন ধারণা। এটা আমাদের সমাজে আছে, এটা সত্য। আগস্টের পাঁচ তারিখের পরে কিছু বিশৃঙ্খলাও তৈরি হয়েছে। মাজার ভাঙার কোনো দরকার ছিলো না। ধর্মে এটা ঠিক নাকি বেঠিক, এই বিষয়ের বাইরে যদি আমরা যাই, ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার দিক থেকে যদি দেখি, আমাদের সিরিয়াস বদনাম হইছে। ইন্ডিয়া সিরিয়াসলি প্রোপাগান্ডা করতে পারছে। যারা এই কাজ করেছে, তারা আমাদের জন্যে সিরিয়াস ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি যারা, যেমন আলেম-ওলামারা এটা নিয়ে শক্ত কিছু বলে না যে, এটা করা যাবে না। তাদেরকে এই দায় নিতে হবে। অন্যান্য যা কিছু হচ্ছে, যেমন মোরাল পুলিশিং, এটা করা যাবে না, ওইটা করা যাবে না— এগুলো কিছু হচ্ছে। যেহেতু একটা অ্যানার্কিক পরিস্থিতি বিরাজ করতেছে। তো আমি মনে করি, এই বিষয়গুলো সামনে করতে পারবে না। কারণ আপনি সংগ্রাম করছেন আর এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষের একটা ঐতিহাসিক চৈতন্যের বা ঐতিহাসিক স্পিরিট তৈরি হয়। মানুষ এটা থেকে পেছনে যেতে পারে না। যেমন, এবার আপনি রাজাকার বলেছেন, মানুষ ক্ষেপে গেছে। তো সামনে যখন আপনি বারবার বলবেন তুমি শাহবাগী, তুমি নাস্তিক, এগুলো মানুষের পছন্দ হবে না। এগুলোর সমাধান একদিনে হবে না। আস্তে আস্তে হবে। ফলে এখন যারা এই ধরনের কাজ করতেছে, তারা মনে করতেছে সফল হবে। আল্টিমেটলি তারা সফল হবে না। কারণ, ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব বা ব্যক্তির মর্যাদার ব্যাপারে সমাজে একটা কনশাসনেস তৈরি হয়েছে যে, আপনি কাউকে অপমান করতে পারবেন না, কাউকে ট্যাগ দিতে পারবেন না। কতোগুলো জিনিস আমরা অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছি। আপনি কাউকে কোনো ট্যাগিং দিতে পারেন না। আপনি শিবির ট্যাগ দিয়ে কাউকে মারতে পারবেন না, আবার শাহবাগী ট্যাগ দিয়েও কাউকে মারতে পারবেন না।

সুমন ইউসুফ : এই সরকার ক্ষমতায় আসার অলরেডি পাঁচ মাস হয়ে গেছে। এখন আমরা দেখতেছি, মোহভঙ্গ ঘটছে অনেকের। সমাজের মানুষের মোহভঙ্গ হচ্ছে। এবং সরকার সুশাসন ও সেবাপ্রদানের জায়গায় কোনো সফলতা দেখাতে পারছে না। এই ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

সারোয়ার তুষার : হ্যাঁ, মোহভঙ্গ আছে বা থাকতে পারে। তাহলে আপনার আলাপটা হবে যে, আমাদের এই পরিস্থিতিটা পার হওয়ার জন্যে বা সংস্কার করার জন্যে আমাকে আরো শক্তপোক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু আপনি যদি বলেন, সংস্কার বাদ দেন, ইলেকশন দেন। তাহলে তো সবই বেহাল হবে। অথচ, বিএনপি কিন্তু গণমানুষের দিকে থাকতে পারতো, বৈপ্লবিক একটা অবস্থান নিতে পারতো। কিন্তু বিএনপি এটা করতে চাইছে না কেন? কারণ, তারা আসলে কোনো পরিবর্তন করতে চায় না। এরই সাথে আরো অন্যান্য ভূ-রাজনৈতিক বিষয়-আশয় আছে, ইন্ডিয়ার সিগনাল আছে।

নাজমুল আলম সোহাগ : ইন্ডিয়ার সিগনালটা কী? এটা ক্লিয়ার করেন।

সারোয়ার তুষার : আমি মনে করি, ইন্ডিয়ার প্রথম ভাবনা ছিলো, আওয়ামী লীগকে তারা রিইনস্টল করতে পারবে। সেটার সম্ভাবনা আপাতত নাই। এখন তারা বিএনপি’র মাধ্যমে ইন্ডিয়ার ব্লকটাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। ইন্ডিয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ খুব দ্রুত কামব্যাক করতে পারবে। এখন বিএনপি বলতেছে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা যাবে না, আওয়ামী লীগকে ভোটে অংশ নিতে দেন। কতো বিপজ্জনক কথা! জনগণ আগস্টের পাঁচ তারিখে যে-রায় দিয়েছে, সেটার তাহলে কী করবেন? অলরেডি আওয়ামী লীগকে জনতা পরাজিত করেছে। আবার কেন ভোট দিয়ে তাকে পরাজিত করতে হবে?

সুমন ইউসুফ : এই বিষয়ে একটা সাদা পর্যবেক্ষণও আছে। সেটা হচ্ছে, আপনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেবেন না কেন? তারা ফ্যাসিবাদী হলে বা অপরাধী হলে তাদের বিচার হবে। বিচারের তো কোনো লক্ষণ দেখি না। আপনারা ইনক্লুসিভ বা সমন্বিতকরণের কথাবার্তা বলছেন, সবাইকে নিয়েই তো এগিয়ে যাবেন। তাহলে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না কেন?

সারোয়ার তুষার : কারণ, নাৎসিবাদের পতনের পরে জার্মানির কী অবস্থা হবে, এটার জন্যে আপনি হিটলারের পরামর্শ নেন নাই। আওয়ামী লীগ যতোগুলো গণহত্যা করেছে, এই  জুলাইয়ের গণহত্যা, শাপলার হত্যাকাণ্ড, পিলখানা হত্যাকাণ্ড, এছাড়াও বিগত সময়ে যতো গুম-খুন হয়েছে, এগুলোর তো আলাদা বিচারের ব্যবস্থা আছেই। এগুলো বাদেও বিগত তিনটা নির্বাচন যে আপনি হাইজ্যাক করলেন, মানুষকে আপনি ভোট দিতে দিলেন না, জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিলেন, এগুলো তো ফৌজদারি অপরাধ। এখানে তো আওয়ামী লীগ দল হিসেবে অংশগ্রহণ করেছে। তো দল হিসেবে তাকে শাস্তি দিবেন না? তাকে তো বিচারের আওতায় আনতে হবে। এগুলো না করে যখন কেউ নির্বাচনের কথা বলে, তখন মনে হবে যে, আওয়ামী লীগকে আপনি শুধু একটা বিরোধী দল হিসেবে ট্রিট করতেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ এখন ডেমোক্রেটিক ফ্রেমওয়ার্কে নাই। এখন সে ডেমোক্রেটিক ফ্রেমওয়ার্কে আসতে পারবে কি না, সেটা নির্ভর করবে এই বিচারের রায়ের উপর। এই আওয়ামী লীগের সেন্ট্রাল কমিটি পুরোপুরি ডিজেবল করতে হবে। কারণ এটা ক্রিমিনাল সিন্ডিকেট। তারা যতোগুলো স্থানীয় নির্বাচন করেছে, এগুলো ডিসমেন্টাল করতে হবে। তারপর আপনি আওয়ামী লীগকে বলেন, দল গুছিয়ে আসতে।

সুমন ইউসুফ : আপনার অনেক লেখায় বা পত্রিকার বিভিন্ন কলামে দেখেছি, বা আপনাদের কথাবার্তায়ও একটা বিষয় জারি রেখেছেন, ’২৪ এবং ’৭১— দুইটা ঘটনাকে একিভূত করার যে-চেষ্টা আপনাদের, এটার তাৎপর্য কী?

সারোয়ার তুষার : আমরা জারি রাখছি বলতে, আমাদের বোঝাপড়া হচ্ছে, গত ৬০-৭০ বছরের মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো অর্জন আমাদের ‘মুক্তিযুদ্ধ’। আমরা এটাকে ধারণ করি এবং নিজেদেরকে এর উত্তরাধিকার মনে করি। কিন্তু আওয়ামী লীগ এটাকে দলীয়করণ করেছে। তারা মুক্তযুদ্ধের নামে সকল কর্মকাণ্ড করেছে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী। আমরা দেখেছি যে, জনগণ এবং মুক্তিযুদ্ধের মাঝখানে আওয়ামী লীগ একটা দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তো এখন জনগণের মালিকানা বা জনগণের অর্জনটাকে স্বীকার করতে গেলে ’২৪ একটা সুযোগ হয়ে এসেছে। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আপনি আবার বলতে পারছেন যে, ’৭১ ছিলো জনগণের একটা অর্জন। এই যে আমরা এতোক্ষণ রাষ্ট্রপ্রকল্পের কথা বললাম, এটা কিন্তু ’৭১-এর আকাঙ্ক্ষারই রাষ্ট্রপ্রকল্প। সেটা হয় নাই। আওয়ামী লীগ সেটা হতে দেয় নাই। কারণ ’৭১-এর আকাঙ্ক্ষার মধ্যে তো কোনো ভোটবিহীন সরকার থাকতে পারে না। আমরা বলছি যে, ’২৪ মানে ’৭১-এ ফেরার একটা রাস্তা তৈরি হইছে। এতোদিন আওয়ামী লীগ এটার প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড়িয়েছিলো। এজন্যে আমরা বলছি যে, ’৭১ আর ’২৪ একটা লিগ্যাসির মধ্যে আছে। ’২৪ আর ’৭১ এক জিনিস না। ’২৪ হচ্ছে ’৭১-এর ধারাবাহিকতা। আমাদের তো মুক্তির সংগ্রাম চলছে। ১৯৭১ সালে যে-কারণে এতো মানুষ জীবন দিলো। যে-ধরনের রাষ্ট্রপ্রকল্প জনগণ চেয়েছিলো, সেটা তো তারা পায়নি। তো ’২৪-এ এসে আবার সেই সুযোগ এসেছে।

সুমন ইউসুফ : কিন্তু সেটা ’৭১-এর বিরোধী শক্তিকে সাথে নিয়ে কীভাবে সম্ভব?

সারোয়ার তুষার : ’৭১-এর বিরোধী শক্তি কাকে সাথে নিছি?

সুমন ইউসুফ : যেমন জামায়াতে ইসলাম। আপনাদের নানা কথাবার্তায় তো তাদেরকে ছাড় দেন। তাদের বিষয়ে তো আপনাদের কোনো কংক্রিট বিরোধী অবস্থান নাই।

সারোয়ার তুষার : জামায়াতে ইসলামের ’৭১-এর ভূমিকা নিয়ে তাদেরকে দলগতভাবে ক্ষমা চাইতে হবে— এটাই আমাদের অবস্থান। যেহেতু আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও আমরা এ-কথা বলি। কিন্তু এটাও ঠিক যে, জামায়াতে ইসলামের ক্ষেত্রে আপনি একটা মিস ফায়ার করেছেন, ২০১৩ সালে, ইন দ্য নেম অব যুদ্ধাপরাধীর বিচার।

সুমন ইউসুফ : যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়া যা-ই ঘটুক না কেন, আমি বলছি তাদের রাজনৈতিক যে-স্ট্যান্ড ছিলো ১৯৭১ সালে, সেটার কথা। তারা বাংলাদেশ কনসেপ্টেরই বিরোধী ছিলো। এখন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দলটা বাংলাদেশ কনসেপ্টের বিরোধী, তাহলে তারা কীভাবে এই দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায়?

সারোয়ার তুষার : তাদের অবশ্যই এই নামে রাজনীতি করা উচিত না। কারণ, এই দল ১৯৭১-এ বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলো। তাদের পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। আমাদের অবস্থান হচ্ছে, ১৯৭১-এর ব্যাপারে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া যাবে না। ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানে তাদের দলের অনেক লোকজন ছিলো। এখন একটা সুযোগ এসেছে তাদের। ’৭১-এর যে-ভুল, সেটা যদি প্রকাশ্যে তারা স্বীকার করে, তাহলে কিন্তু সমাজে আবার নরমালাইজড হতে পারে। কিন্তু তারা তাদের ভুল স্বীকার করতেছে না। এজন্যে সমাজে তাদের উপর এই চাপটা জারি রাখতে হবে। কিন্তু আমরা তাদের সাথে আছি বা তাদেরকে নিয়ে আছি বা তাদের ব্যাপারে নমনীয় আছি, এরকম কোনো কিছু নাই। তাদেরকে নিয়ে আওয়ামী লীগের যে-রাজনীতি, আমরা আবার সেই ট্র্যাপেও পড়তে চাই না।

সুমন ইউসুফ : মানুষের মধ্যে এটা প্রচারিত আছে যে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটিতে ইসলামী ছাত্র শিবিরের অনেক কর্মী আছে এবং জামায়াতে ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতা আছে।

সারোয়ার তুষার : ছাত্র শিবির করতো এমন লোক আমাদের সংগঠনে আছে, এটা আমরা কখনোই অস্বীকার করিনি। মানে সাবেক শিবির। সে তো তার রাজনীতি ছেড়ে দিয়েই এসেছে। আমাদের এখানে বাম সংগঠনের কর্মীও আছে। আবার আমাদের মতো মধ্যমপন্থীরাও আছে। এটা একটা মিশ্র অবস্থান। আরো বেশ কিছু গুঞ্জন আছে, যেগুলো বিএনপি প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে যে, নাগরিক কমিটি জামায়াতে ইসলামের সাথে মিলে গেছে।

সুমন ইউসুফ : আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিব— দুটি বিষয় ’৭১-এর সাথে জড়িত। কোনোভাবেই মুছে ফেলার বিষয় না। আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে অপশাসন কায়েম করেছে, ফ্যাসিজম চালু করেছে। আবার এর পতনও ঘটেছে। কিন্তু ঐতিহাসিক কারণে আমরা ’৭১ থেকে আওয়ামী লীগকে বা শেখ মুজিবকে বাদ দিবো কেন? বি-আওয়ামীকরণ বিষয়টা যে আপনি বলেছেন আপনার এক লেখায়, এই বিষয়টার সাথে বোঝাপড়া কীরকমভাবে হবে?

সারোয়ার তুষার : আওয়ামী লীগকে বাদ দেয়ার কথা হয় নাই। আমার কথা ছিলো, মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের দলীয় ইতিহাস লেখা সম্ভব কি না। আমার অবস্থান হচ্ছে, সম্ভব না। তারা যে-ইতিহাসটা আপনাকে গত পনেরো বছর গেলাইছে, সেখানে তার দলের অন্য কেউ আছে? তাজউদ্দীন সাহেব, মওলানা ভাসানী, সিরাজুল আলম খান— তারা কি আছে?

সুমন ইউসুফ : কোথায় নাই? আপনি মাধ্যমটা চিহ্নিত করছেন কোনটা?

সারোয়ার তুষার : তাদের গল্পের যে-আউটলুক, সেখানে পুরোটাই শেখ মুজিব। অন্য কেউ তো নাই।

সুমন ইউসুফ : শেখ মুজিব তো কেন্দ্রেই ছিলো। আপনি ১৯৭১ সালের কথা ধরলে মওলানা ভাসানীসহ অন্যান্যরা নিজেরা সাইড হয়ে শেখ মুজিবকে উপরে রেখেছে। শেখ মুজিব তো শুধু আওয়ামী লীগের বিষয় না। বাকি যাদের কথা বললেন, তারা তো নিজের জায়গায়ই ছিলো এবং আছে। কোন মাধ্যমগুলোতে তাদের বিতাড়িত করে শেখ মুজিব উপরে আছে?

সারোয়ার তুষার : গত পনেরো বছর কী ইতিহাস চর্চা করানো হয়েছে আমাদের? ইতিহাসের কোন বয়ানটা তৈরি করা হয়েছে? এমনকি শেখ মুজিবকে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের নেতা হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছে। আপনারা তো বদরুদ্দীন উমর পড়েছেন ভালো করে। উনি তো এগুলোর মীমাংসা করেছেন অনেক আগে যে, এগুলো সত্যি না। আর ’৭১-এর ক্ষেত্রে শেখ মুজিব তো জানতেন না, দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে। তার নামে একটা ঘটনা ঘটছে, এটা সত্যি। কিন্তু উনি তো পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র কায়েম করার জন্যে গণপরিষদ চাইছেন। আমি তো সেখানে খারাপ কিছু দেখছি না। কারণ উনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে আমাদের জন্যে তো সেটা খারাপ কিছু না। কিন্তু উনি তো দেশ স্বাধীন করতে চান নাই। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। পরে উনি নতুন দেশে এসে প্রধানমন্ত্রী হইছেন।

সুমন ইউসুফ : ১৯৭১-এর এক দশক আগে থেকে সকল আন্দোলন-সংগ্রামে এবং নানা ধরনের বৈষম্য বিরোধিতায় সবাই শেখ মুজিবকে সামনে রাখছে। তাদের কথা হচ্ছে, সে আমাদের প্রতিনিধি। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রতিনিধি হচ্ছে শেখ মুজিব। মওলানা ভাসানীসহ সবাই এই কথা বলেছে। তো শেখ মুজিব যদি স্বাধীনতা না চায়, তাহলে তো কেউই চায় নাই।

সারোয়ার তুষার : কেউ চায় নাই— কথাটা সত্য না। বাংলাদেশের ছাত্র-তরুণ, এমনকি আওয়ামী লীগের ভেতর যারা তরুণ, তারা চাইছে। তারা শেখ মুজিবকে পোস্টার হিসেবে বা আইকন হিসেবে দাঁড় করাইছে। সাতই মার্চের ভাষণে তাকে জোর করে স্বাধীনতার কথা বলাইছে। এই ইতিহাসগুলো তো এখন এভেইলেবল। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, আমি যে বি-আওয়ামীকরণের কথা বলি, সেখানে আমি বলতে চেয়েছি যে, ইতিহাসে আওয়ামী লীগের একচেটিয়াকরণ করা হইছে। এখান থেকে বের হয়ে আপনাকে প্রকৃত ইতিহাস লিখতে হবে। সেখানে আওয়ামী লীগ যতোটুকু আছে, ততোটুকু বলতে হবে। কিন্তু আপনাকে তো এই কথাটাও বলতে হবে, ছয় মার্চে শেখ মুজিব পাকিস্তানের কনস্যুলেট জেনারেলের কাছে বলেছেন যে, আমার দলের মিলিট্যান্ট বা জঙ্গি, যারা একটু বেশি উগ্র বা রেডিক্যাল, তারা আমাকে স্বাধীনতার ঘোষণা করার জন্যে চাপ প্রয়োগ করছে, আপনারা আমাকে গ্রেফতার করুন। এগুলো তো মহিউদ্দিন আহমেদ সাহেবের বইপত্র পড়লেই পাবেন। এগুলো বহুল চর্চিত ব্যাপার। ফলে আওয়ামী লীগ আদৌ মুক্তিযুদ্ধ চাইছে কি না, ভারতে আওয়ামী লীগ কী করেছে, এগুলো তো এখন আর কোনো গোপন কথা না। এগুলো এখন সকল মেইনস্ট্রিম বইয়ের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। সেক্টর কমান্ডারদের বইপত্রে পাওয়া যাচ্ছে। আপনি যখন যথাযথভাবে আলোচনা করবেন ইতিহাস নিয়ে, তখন এইসব বিষয়গুলো বেরিয়ে আসবে।

সুমন ইউসুফ : আপনি যে-কথাগুলো বলছেন, এগুলো তো একটা ইতিহাস সার্ভ করার পার্শ্ব আলাপ।

সারোয়ার তুষার : আপনি এগুলোকে পার্শ্ব আলাপ বলতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়ে যখন আলাপ করবো, আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র কায়েমের জন্যে ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত ছিলো, যুদ্ধের কোনো পরিকল্পনা তাদের ছিলো না। দেশ যখন স্বাধীন হইছে, আওয়ামী লীগ সামনে ছিলো। অন্যদেরকে সে সামনে আসতে দেয় নাই। অন্য বামপন্থী দলগুলো দেশের ভেতর থেকেই স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করেছে। এই বিষয়গুলো কিন্তু আমরা সামনে আনতে পারি নাই। এটা না আনতে পারার কারণেই আপনাদের এখন মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগকে বাদ দেয়া হচ্ছে। পুরো ইতিহাসটাকে সামনে আনেন, মানুষকে চর্চা করতে দেন। দেখেন, আওয়ামী লীগ কোথায় দাঁড়ায়। আওয়ামী লীগের প্রবাসী সরকারের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে কমিটেড ছিলো এক থেকে দুজন লোক। তার মধ্যে একজন তাজউদ্দীন আহমদ। সেই তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের সাথে ৭ দফায় এমন চুক্তি করেছে, প্রায় দেশ বিক্রি করে দেয়ার মতোন। আওয়ামী লীগ দলটাকে আপনার বুঝতে হবে। এইটা পেটি বুর্জোয়া বা লুম্পেনদের দল। ইতিহাসকে এমনভাবে আইরনি করা হয়েছে যে, রুমি, আজাদদের মতো রেডিক্যাল বামপন্থীরাও শেখ মুজিবকে ক্রিটিক্যালি সমর্থন দিতে বাধ্য হইছে। আমাদের এই ইতিহাস নিয়ে কোনো সমস্যা নাই। মুশকিল হচ্ছে, আপনি ইতিহাসকে যেভাবে একচেটিয়া দলীয়করণ করছেন। ’৭২ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে সমাজে তুমুল ক্ষোভ আছে। ইতিহাসে এগুলো যুক্ত করতে হবে। তাহলে ইতিহাসটা অবমুক্ত হবে। তখন আপনি ইতিহাসের সত্য বয়ান সামনে আনতে পারবেন।

সুমন ইউসুফ : কিন্তু পাঁচজন লোকের মধ্য থেকে শেখ মুজিবকে আউট করে ফেললেন, সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী-যোগেন মণ্ডল— উনাদের রাখলেন। তাহলে এই ব্যবস্থাটা কি নতুন করে আওয়ামী লীগের ধারাবাহিকতা হচ্ছে না?

সারোয়ার তুষার : নাহ্। এই দায় আওয়ামী লীগের। আজকে যে মুজিব বাদ পড়তেছে, কারণ, আওয়ামী লীগ যেভাবে শেখ মুজিবকে ব্যবহার করেছে, তাতে মুজিবীয় একটা কাল্ট তৈরি হইছে। আপনি যখন আবার ইতিহাসের আট-দশজন ক্যারেক্টারের মধ্যে মুজিবও ছিলো, এভাবে বসাতে পারবেন, তখন ইতিহাসটা স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসবে।

সুমন ইউসুফ : আপনি শেখ মুজিবকে বাদ দিলে তো ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে।

সারোয়ার তুষার : বাদ দেয়া হচ্ছে না তো। ওই পাঁচজনের মধ্যে নাই।

সুমন ইউসুফ : ওই পাঁচজনের মধ্যে শেখ মুজিব থাকবে না কেন?

সারোয়ার তুষার : সে যে মুজিববাদ আকারে সমাজের মধ্যে বা আওয়ামী লীগের মধ্যে আছে, এখন সেটার সমালোচনা হচ্ছে। তার যে দেবায়ন ঘটেছে, মানে দেবতারূপ নিয়েছে, সেটার সমালোচনা হলে শেখ মুজিব স্বাভাবিক ইতিহাসের ক্যারেক্টার হিসেবে হাজির হবে। এইটুকু আগে হইতে দেন।

সুমন ইউসুফ : এইটা তো ব্যাপক গ্রে স্ট্যান্ড।

সারোয়ার তুষার : না। আমার কাছে সেরকম মনে হয় না। শেখ মুজিবকে অযথাই দেবতা বানানো হয়েছে। গত ১৫ বছর তাকে কাল্ট করে দুঃশাসন হয়েছে।

সুমন ইউসুফ : এখন তাকে যথাযথ জায়গায় নেয়া দরকার। যথাযথ জায়গায় নেয়ার জন্যে আপনাদের স্ট্যান্ড হলো, তাকে বাদ দিতে হবে?

সারোয়ার তুষার : এখনো রক্তের দাগ শুকায়নি। আপনি এখনি তাকে আনা শুরু করবেন, যখন আওয়ামী লীগ নাই। তাহলে ব্যাপারটা ঠিক হয় না। আগে ইতিহাসের এই বিষয়গুলো মীমাংসা করতে হবে। তখন উনি অটোমেটিক্যালি ইতিহাসে ফেরত আসবেন।

সুমন ইউসুফ : আচ্ছা, অন্য প্রসঙ্গে যাই। বাংলাদেশের মিডিয়া কি এখন স্বাধীন? আপনি কী মনে করেন?

সারোয়ার তুষার : মিডিয়া সব সময়ই তার স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত। এক্ষেত্রে তার পলিটিক্যাল ইকোনমি মাথায় রাখা ইম্পর্ট্যান্ট, আগে যারা তাকে ফাইন্যান্স করতো, এখনো তারাই করে। তাদের সব সময়ই একটা এজেন্ডা থাকে। এখন তো সরকারের দিক থেকে তাদেরকে কোনো চাপ দিয়ে রাখা হয় নাই। কিন্তু তার ক্যারেক্টার সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। সে ওইটার সাপেক্ষেই এখনকার কিছু কিছু পরিস্থিতি তুলে ধরে।

সুমন ইউসুফ : ভয় কাজ করে তাদের মধ্যে। তারা তো এখনো বাতাবি লেবু, কয়েকটা চ্যানেল বা পত্রিকা বাদ দিয়ে। বেশিরভাগই তো আগের মতোই আছে। এখন আপনি বলতে পারেন যে, সরকার থেকে তো কল দিয়ে তাকে বলেনি, আপনি এই নিউজটা করবেন না। কিন্তু অটো একটা সেন্সর কাজ করে। এটা তো ভয় থেকে।

সারোয়ার তুষার : না। এটা তারা তাদের স্বার্থ থেকে করে। সে তার স্বার্থ অনুযায়ী রঙ বদলাচ্ছে কেবল। মিডিয়ার অর্থ সংস্থান কোথা থেকে হচ্ছে— এটা যতোক্ষণ পর্যন্ত ফয়সালা না হবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত আমরা যে-ধরনের মিডিয়া চাই, তেমনটা পাবো না। আমরা শুধুমাত্র সরকারের দিকে তাক করি। কারা টাকা দিচ্ছে? কেন দিচ্ছে? একটা বিজনেস হাউজ কেন মিডিয়া পাবে? এই বিষয়গুলোর ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত আমরা যে-ধরনের ভূমিকা মিডিয়ার কাছে চাই, সেটা পাবো না।

সুমন ইউসুফ : আপনারা যে-জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন, এই জাতীয় ঐক্য কীভাবে হবে এখন এই অবস্থায়? একটা ন্যারেটিভে কি ঐক্য হওয়া সম্ভব?

সারোয়ার তুষার : কতোগুলো বিষয় আপনাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। নিজেদের মধ্যে অনেক রাজনীতি থাকবে। একটা পোস্ট পলিটিক্যাল পজিশন থেকে পলিটিক্যাল জার্নিটা শুরু হবে। আপনি কতোগুলো বিষয় নিয়ে রাজনীতি করবেন না। অনেক বয়ান থাকবে। অনেকের অনেক এম্বিশন থাকবে। কিন্তু ন্যূনতম কতোগুলো ঐক্য থাকবে। এটা এখন প্রক্রিয়াধীন আছে। এখনই, চার-পাঁচ মাসে এর ফয়সালা করতে পারবো না। আমরা এখন নাজুক সিচুয়েশনে আছি, ক্ষমতার কাড়াকাড়ি আছে। আমাদের আরেকটু সামনে আগাতে হবে। জাতীয় ঐক্যটা হচ্ছে এরকম, বিজেপি আর কংগ্রেস কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নে একমত হয়ে যায়। আমাদেরকে সেরকম কিছু করতে হবে। মানে বিএনপি আমাদেরকে পরাজিত করতে চাইবে। আমরা বিএনপিকে পরাজিত করতে চাইবো। এখানে কোনো দোষ  নাই। আবার এর মধ্যে আছে আওয়ামী লীগের প্রশ্ন, বিচারের প্রশ্ন— এগুলো করতে হবে। এগুলো না করে কেউ যখন বলে যে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসুক, তখন এটা ভুল হয়ে যায়। আমাদের মিনিমাম একটা জায়গায় আসতে হবে যে, এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা  নিজেদের মধ্যে রাজনীতি করবো না। আমরা মনে করি, এটা আস্তে আস্তে সম্ভব হবে। কারণ, আলোচনাগুলো জারি আছে। আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা একটা জায়গায় যেতে পারবো।

সুন্দর আলী গান্ধী : স্থানীয় ইতিহাসে অনুচ্চারিত এক স্বদেশি চরিত্র

0

প্রায় ১৪০ বছরের প্রাচীন রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেস (প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ডিসেম্বর)। ভারতবর্ষের অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও ঘাত-প্রতিঘাতের সাক্ষী হয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দলটি এখনো সগর্বে টিকে আছে। দেশভাগের আগে স্বাধীনতার মূল নেতৃত্ব দিয়ে দলটি ইতিহাসে অমর অধ্যায় রচনা করেছে। দলটি সৃষ্টি করেছে অসংখ্য কীর্তিমান রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, যারা যুগ যুগ ধরে দেশকে সমৃদ্ধ ও বিনির্মাণ করে গেছেন। তেমন একজন নিবেদিতপ্রাণ কংগ্রেস নেতা ছিলেন ঢাকার পূর্বাঞ্চল হিসেবে খ্যাত নরসিংদীর সুন্দর আলী মিঞা (১৮৮২-১৯৪৭)। রাজনৈতিক জীবনে অহিংস, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক গুণের অধিকারী হওয়ায় এবং মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক মতাদর্শের একনিষ্ঠ অনুসারী হওয়ায় তৎকালীন গণমানুষের কাছ থেকে ‘গান্ধী’ খেতাব পেয়েছিলেন। এই কারণে তিনি সুন্দর আলী গান্ধী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন।

মহাত্মা গান্ধীর ডাকে বিদেশি পণ্য বর্জন আন্দোলনে ঢাকা পূর্বাঞ্চলে সুন্দর আলী গান্ধীর নেতৃত্ব ছিলো আশা জাগানিয়া। তিনি মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসু, অনুশীলন সমিতির নেতা মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, সতীশচন্দ্র পাকড়াশী, কৃষক নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, সাটিরপাড়ার জমিদার কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয় নেতা ললিতমোহন রায় প্রমুখের পরামর্শ ও সহযোগিতায় তাঁতশিল্পের পীঠস্থান নরসিংদী- নারায়ণগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ-গাজীপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় কংগ্রেসের রাজনীতি ছড়িয়ে দেন। তিনি স্থানীয় মুসলমান ও হিন্দুদের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন, যার কারণে তিনি ‘গান্ধী’ খেতাবের পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমানদের মিলনের অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন ও বিদেশি পণ্য বর্জনের ডাক দিলে তিনি দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বস্ত্রশিল্প অধ্যুষিত মাধবদী, শেখেরচর, নরসিংদী, হাসনাবাদ প্রভৃতি এলাকায় তাঁতিদের সংগঠিত করে দেশি তাঁত গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। তখন মাধবদী-শেখেরচরে অনেক বিলেতি তাঁতের আবির্ভাব হয়েছিলো। বাজারে বিলেতি কাপড়ের চাহিদা ছিলো বেশ। তাই সাধারণ মানুষদের কাছে দেশি কাপড় ও দেশি খটখটি তাঁতযন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্যে প্রচারণা, পথসভা ও জনসভা করার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। মাধবদী, বাবুরহাট, শেখেরচর, হাসনাবাদ ও নরসিংদী শহরে তিনি ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে লিফলেট ও হ্যান্ডবিল বিলি করে দেশি পণ্য ব্যবহার ও বিলেতি পণ্য পরিহারের জন্যে অনেক প্রচারণা চালান।

নরসিংদী ও শেখেরচরের একাধিক প্রবীণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তখন দেশের সর্ববৃহৎ কাপড়ের হাট ছিলো মাধবদীতে, যা মাধবদীর জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গণে বসতো। সেই হাটের ক্রেতা-বিক্রেতাদের জমিদারকে উচ্চহারে খাজনা দিতে হতো। প্রতিবছর জমিদারি খাজনা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তারা বাবুরহাটের কাপড় ব্যবসায়ীদের খাজনা বৃদ্ধি করতেন। অনেক সময় জমিদারের পাইক-বরকন্দাজরা খারাপ ব্যবহার করতো। এতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। ফলে বাবুরহাট নিয়ে এলাকায় দুই পক্ষের কোন্দল শুরু হয়। প্রভাবশালী, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও তালুকদার শ্রেণি মাধবদীর জমিদারদের পক্ষে অবস্থান নেয়। তখন এলাকার সাধারণ তাঁতি ও খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে অবস্থান নেন কংগ্রেস নেতা সুন্দর আলী গান্ধী, করিমপুরের সেকান্দর আলী মাস্টার ও জিনারদীর বিজয় চ্যাটার্জী প্রমুখ। সেই সময় তাঁদের পরামর্শদাতা হিসেবে আধ্যাত্মিক পীর ইমামউদ্দিন এগিয়ে আসেন। তিনি ছিলেন সুন্দর আলী গান্ধীর পীর। তিনি পরামর্শ দেন, যেহেতু কাপড় ব্যবসায়ী ও তাঁতিদের সিংহভাগই মুসলমান, তাই তাদের হিন্দু জমিদারদের অধীনে হাট করার দরকার নেই। তাদের জন্যে আলাদা একটা কাপড়ের হাট বসালে ভালো হয়। কথাটি সুন্দর আলী গান্ধীর মনে ধরে। তাই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি সেখানে কংগ্রেসের শ্রমিক ফ্রন্ট গড়ে তোলার জন্যে প্রথমে একটি তাঁতি শ্রমিক সমিতি গড়ে তোলেন। এই সমিতি তখন বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। সিদ্ধান্ত হয়, মাধবদীর অদূরে শেখেরচর প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী বাঁকমোড়া নামক স্থানে অস্থায়ী ভিত্তিতে একটি কাপড়ের হাট বসানো হবে। এবং উক্ত হাটে কোনো তাঁতি ও ব্যবসায়ীদের খাজনা দিতে হবে না। বিনা খরচে ব্যবসা করার লোভে তখন অনেক তাঁতি-ব্যবসায়ী মাধবদী বাবুর বাড়ির পরিবর্তে শেখেরচর বাঁকমোড়ায় ভিড় করতে থাকেন। খুব সহজে খোলা মাঠে জমে ওঠে কাপড়ের হাট। তখন উৎসাহী কিছু মানুষ হাটটির নামকরণ করেন সুন্দর আলী গান্ধীর পীর ইমামউদ্দিনের নামানুসারে— ‘ইমামগঞ্জ বাজার’। তবে সেটা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। এক পর্যায়ে কাপড়ের হাটটি শেখেরচর হাট হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে দূর-দূরান্তের লোকজন শেখেরচর হাটকে বাবুরহাট হিসেবেই আখ্যায়িত করে থাকে। বর্তমানে কাপড়ের হাটটি দেশের বৃহৎ হিসেবে প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। হাটটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে স্থানীয় তালুকদার হলধর সাহা ও বালাপুরের জমিদার কালীমোহন সাহা সহযোগিতা করেন।

সুন্দর আলী গান্ধী সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিক, মজুর, তাঁতি ও জেলে শ্রেণির স্বার্থ দেখে গেছেন আমৃত্যু। তাদের জন্যে তিনি অনেক জনহিতকর কাজ করে এখনো অমর হয়ে আছেন। কংগ্রেসের রাজনীতি করতে গিয়ে তাঁকে প্রায় জমিদার শ্রেণির বিরুদ্ধাচারণ করতে হতো। কারণ জমিদার শ্রেণি ছিলো ব্রিটিশদের দোসর এবং স্বাধীনতা বিরোধী। ব্রিটিশদেরকে এদেশে বহাল রাখতে পারলে তাদের জমিদারি টিকিয়ে রেখে প্রজাদের শোষণ করা যাবে। অপরদিকে কংগ্রেসের নেতা হিসেবে সুন্দর আলী গান্ধীর চিরকামনা ছিলো দেশের স্বাধীনতা। ব্রিটিশরাজকে এদেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া ছাড়া দেশের মানুষের কোনো মুক্তি নেই। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন সাটিরপাড়ার জমিদার ললিতমোহন রায় বিএবিএল। তিনি জমিদার হলেও নিজে ছিলেন অনুশীলন সমিতির পৃষ্ঠপোষক। বিপ্লবীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। নিজে ছিলেন নেতাজী সুভাষ বসুর ঘনিষ্ঠ সহচর। সঙ্গত কারণে তিনি সুন্দর আলী গান্ধীর প্রতি সমর্থন দিয়ে গেছেন। তাছাড়া ললিতমোহনের আইনপেশা ও রাজনীতি বিস্তৃত ছিলো ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও কলকাতা পর্যন্ত। তাই নরসিংদী অঞ্চলের কংগ্রেস রাজনীতি তিনি সুন্দর আলী গান্ধী, সেকান্দর আলী মাস্টার ও বিজয় চ্যাটার্জী প্রমুখের মতো নেতাদের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। শিক্ষাব্রতী ও সমাজ সংস্কারক ললিতমোহন স্থানীয় রাজনীতিতে নাক গলাতেন না। জমিদার হয়েও তিনি গণমানুষের কাতারে নেমে এসেছিলেন। জাতপাত রেওয়াজ ভাঙার জন্যে তিনি জমিদার হয়েও নরসিংদী বাজারের মেথরদের জমিদার বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে একই থালায় খাবার খেতেন। তাঁর মতো সুন্দর আলী গান্ধীও সাধারণ মানুষের কাতারে দাঁড়িয়েছিলেন। এসব খেটে খাওয়া মানুষজনই সুন্দর আলী মিঞাকে সম্মানজনক খেতাব দিয়েছিলেন ‘গান্ধী’ হিসেবে।

তাঁর কিছু অমর কীর্তি এখনো নরসিংদীবাসীর অন্তরে চিরজাগ্রত রয়েছে। তিনি এলাকাবাসীর ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের জন্যে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যার সূচনা হয়েছিলো ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে, মাইনর স্কুল হিসেবে। খাতাপত্রে ‘নরসিংদী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়’ হিসেবে থাকলেও মানুষের মুখে মুখে স্কুলটির নাম ‘গান্ধী স্কুল’ নামে পরিচিত। মেঘনা নদীর তীরবর্তী স্কুলটি অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্ম দিয়েছে। প্রায় ৫ একর জমি দান করেছিলেন স্কুলের জন্যে। একসময় সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নরসিংদী পাইলট স্কুল চলতো। অনেক গরীব ছাত্র নরসিংদী শহরের বিভিন্ন বাড়িতে লজিং থেকে উক্ত স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। উক্ত স্কুল ছাড়াও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় তাঁর নেতৃত্বে নরসিংদী শহরে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে একটি জাতীয় কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, যার অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়েছিলেন ড. সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত। উক্ত জাতীয় কলেজে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন প্রখ্যাত বিপ্লবী সতীশ পাকড়াশী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বাংলায় এক মহাদুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।

মূলত যুদ্ধের কারণে খাদ্যশস্যের পরিবহনে বাধা সৃষ্টি হলে মজুতদারি ব্যবসা বৃদ্ধি পায়। তখন সুন্দর আলী গান্ধী নরসিংদী বাজারে অনেক চাল-ডালের আড়ত অনাহারী মানুষের জন্যে খুলে দিয়েছিলেন। তিনি ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিবর্গের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্য সংগ্রহ করে অনাহারী মানুষের মুখে তুলে দিয়েছিলেন। বেশকিছু লঙ্গরখানা খুলে মানুষের জন্যে খাবার নিশ্চিত করেছিলেন। সে-সময় অনাহারে অনেক মানুষ মরে বাংলার পথে-ঘাটে পড়ে থাকতো। কিন্তু তাঁর সময়োপযুক্ত পদক্ষেপের কারণে নরসিংদীবাসী দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলো। তাঁর এই মানবিক অবদানের কথা এলাকাবাসীর মুখে মুখে ছড়িয়ে গিয়েছে।

কংগ্রেস রাজনীতির সক্রিয় নেতা হওয়ায় সর্বভারতীয় অনেক নেতা সুন্দর আলী গান্ধীকে পছন্দ করতেন। এঁদের কেউ কেউ তাঁর বাড়িতে এসে আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন। সেখানে রাত্রিযাপনের পর অতিথিরা মেঘনা নদীতে নৈশবিহার করতেন। কেউ কেউ বৈকালিক ভ্রমণও করতেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, ডা. রাজেন্দ্র প্রসাদ, মওলানা আজাদ, ড. আচার্য কৃপালানী, এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ বিভিন্ন সময়ে নরসিংদী এসেছেন। তাঁদের সভা করার জন্যে তিনি মেঘনার তীরবর্তী স্থানে একটি বড়ো ময়দান তৈরি করেছিলেন। পরবর্তীতে সেখানেই নরসিংদীর বড়ো বড়ো রাজনৈতিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধুর মতো খ্যাতিমান নেতারা সেই ময়দানে জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। এটি স্থানীয়ভাবে ‘গান্ধী মাঠ’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। মাঠের পাশে একটি কবরস্থান, পাবলিক টয়লেট এবং একটি বড়ো পাকা মসজিদ স্থাপন করেন সুন্দর আলী গান্ধী। মসজিদটি মুঘল আমলের স্থাপত্যশৈলীতে নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে এসব স্থাপনা দর্শনার্থীদের কাছে আকষর্ণীয় হয়ে ওঠেছে।

সুন্দর আলী গান্ধী মনে-প্রাণে একজন নরসিংদীপ্রেমী ছিলেন। জন্মস্থানের প্রতি তাঁর অপার ভালোবাসা প্রতিটি কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি নরসিংদীকে একটি মহকুমা শহর হিসেবে গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই বছর এক সরকারি সফরে নরসিংদী এসেছিলেন বাংলার ছোটোলাট। তিনি স্টিমারযোগে কলকাতা থেকে প্রথমে ঢাকায়, পরে মেঘনা নদী ধরে নরসিংদী এসে গান্ধী মাঠের ঘাটে নোঙর করেন। পরে সুন্দর আলী গান্ধীর আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। তখন ছোটোলাটের সম্মানে নরসিংদীতে এক সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছিলো। সেই সভায় তিনি ছোটোলাটের কাছে নরসিংদী থানাকে মহকুমায় রূপান্তর করার দাবি জানান। সে-দাবি মেনেছিলেনও ছোটোলাট। কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তীব্রতর হওয়ায় এবং ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশভাগের কারণে তাঁর সেই দাবি বাস্তবে রূপদান করতে পারেননি। তাঁর স্বপ্নের সেই নরসিংদী মহকুমা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে, যা জেলা হিসেবে রূপান্তরিত হয় ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে। দুঃখজনক বিষয় হলো, ব্রিটিশ বিতাড়নের জন্যে তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। কিন্তু সেই স্বাধীনতা তিনি দেখে যেতে পারেননি। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশভাগের কয়েক মাস পূর্বে ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বাংলার এক অভিজাত ও ধনাঢ্য পরিবারে সুন্দর আলী গান্ধীর জন্ম ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুল, মসজিদ, ঈদগাহের পাশের কবরস্থানে তিনি সমাহিত হন। তাঁর পূর্বপুরুষের বাস ছিলো ঐতিহাসিক সোনারগাঁও। সুলতানদের রাজধানী মোগড়াপাড়ায় বসবাস করার সময় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়। দেশি সেনা হিসেবে আবরার খাঁ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সঙ্গত কারণে তিনি বিচারের সম্মুখীন হন। সেই বিচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে তিনি মোগড়াপাড়া থেকে পালিয়ে নরসিংদীর দুর্গম চরাঞ্চল নবীপুরের জঙ্গলে আশ্রয় নেন। ধীরে ধীরে নবীপুরে জনবসতি গড়ে ওঠতে থাকে। সেখানে আবরার খাঁ ও তাঁর দুই পুত্র হাজী কলিম খাঁ ও হাজী কেরামত আলী পাটের ব্যবসা শুরু করেন। ইতোমধ্যে মেঘনা ও হাড়িধোয়া নদীর তীরবর্তী থানা রোড ও হাজীপুরে ব্রিটিশ, গ্রিক ও আরমেনীয় পাট ব্যবসায়ীদের অনেক গোডাউন গড়ে ওঠেছে। স্থানীয়ভাবে তারা পাট কিনে নৌ-যোগে কলকাতায় রপ্তানি করতেন। তাদের গোডাউনে পাট সরবরাহ করে পিতা-পুত্রদ্বয় আর্থিকভাবে বেশ উন্নতি করেন। এক পর্যায়ে তাঁরা মেঘনা নদীর তীরবর্তী দত্তপাড়ায় বসতি স্থাপন করে পাটের আড়তদারি শুরু করেন। হাজী কলিম ছিলেন নিঃসন্তান। হাজী কেরামত আলীর চার সন্তানের মধ্যে সুন্দর আলী গান্ধী ছিলেন তৃতীয়। প্রথম ছিলেন হাফিজ উদ্দিন বেপারী, দ্বিতীয় হলেন আবদুল হামিদ বেপারী ও সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন বেলায়েত হোসেন মাস্টার। তাঁদের বাবা ও চাচা শুধু পাটের ব্যবসাই নয়, বিভিন্ন তৈজসপত্র ও খাদ্যশস্য নৌকাযোগে কলকাতা থেকে নরসিংদী বাজারে এনে বিক্রি করে অনেক টাকা-পয়সা আয় করেছিলেন। তখনকার সময় নরসিংদী বাজারে হিন্দু সাহা উপাধিধারী ব্যবসায়ীদের একচ্ছত্র রাজত্ব ছিলো। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাজী কলিম ও কেরামত আলী ব্যবসায় প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। তাঁদের উত্তরসুরীদের কেউ কেউ নামের শেষে বেপারী লিখতে শুরু করেন। সেই সূত্রে তাঁদের বসতিস্থল দত্তপাড়াকে কেউ কেউ বেপারীপাড়া হিসেবে অভিহিত করতেন। শুধু হাজী কলিম ও কেরামত আলীই নয়, তাঁদের মতো আরো কিছু পরিবার দত্তপাড়ায় বসতি স্থাপন শুরু করলে পুরো মহল্লাটি বেপারীপাড়া হয়ে ওঠে। বেপারীপাড়ার পাশে কয়েকটি তেল্লী পরিবার বাস করতো। তারা তৈল পেশার কাজ করতেন।

ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায়, সুন্দর আলী গান্ধীর ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ বাংলার তৎকালীন রাজধানী গৌড় থেকে ষোড়শ শতাব্দীতে প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁও বসতি স্থাপন করেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আবরার খাঁ সোনারগাঁও থেকে চরের দেলোয়ারপুর মৌজায় নবীপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন। তখন পুরো এলাকায় নীল চাষের ব্যাপক প্রচলন। কৃষকদেরকে জোরপূর্বক নীল চাষ করতে বাধ্য করতো নীলকররা। তেমন কয়েকটি নীলকুঠি ছিলো মেঘনার তীরবর্তী ভঙ্গারচর, মাহমুদাবাদ (নারায়ণপুর) ও শীতলক্ষ্যার তীরের ডাঙ্গা এলাকায়। রাসায়নিক রঙ আবিষ্কার হলে নীলের চাষাবাদ লোপ পায়। তখন সোনালি আঁশ হয়ে ওঠে পাট। পাটের ব্যাপক উৎপাদন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সুন্দর আলী গান্ধীর পরিবারেরও উত্থান শুরু হয়।

তাঁদের পরিবারের সবচেয়ে খ্যাতিমান পুরুষ ছিলেন সুন্দর আলী গান্ধী। তবে একাডেমিক শিক্ষার চেয়ে তিনি স্বশিক্ষা আর বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতায় একজন মহান মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। মক্তব শেষ করে পিতার ব্যবসায় নিয়োজিত থেকে তিনি কংগ্রেস রাজনীতিতে একজন সাচ্চা মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। বাবা হাজী কেরামত আলী ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত পণ্ডিত মানুষ। ফারসি, উর্দু, আরবি, বাংলা ও সংস্কৃতে তিনি পারদর্শী ছিলেন। তিনি যখন ব্যবসায়ের কাজে কলকাতা-করাচি যেতেন, তখন অনর্গল ফারসি, উর্দু ও হিন্দি ভাষায় কথা বলতেন। কোনো আরবের সঙ্গে সাক্ষাত হলে আরবি ভাষায় কথা বলতেন। বাবার এসব গুণ প্রসারিত হয়েছিলো সুন্দর আলী গান্ধীর মধ্যে। তিনি পিতার ব্যবসা সামলেও রাজনীতিতে ব্যস্ত সময় পার করতেন। পরিণত বয়সে তিনি দত্তপাড়া নিবাসী লালমোহন ভূঁইয়ার কন্যা মির্জা বানু বিবিকে বিয়ে করেন। মির্জা বানু ছিলেন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল লতিফ ভূঁইয়ার বোন।

সুন্দর আলী গান্ধীর সর্বকনিষ্ঠ ভাই বেলায়েত হোসেন মাস্টার ছিলেন একাডেমিকভাবে উচ্চশিক্ষিত মানুষ। মাত্র ৩ বছর বয়সে মাতৃহীন হলে ২০ বছর বয়সী সুন্দর আলী ভাইয়ের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। বেলায়েত হোসেনের জন্ম ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর। তিনি সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউট থেকে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। তখন তিনি ঐতিহাসিক বেকার হোস্টেলে থাকতেন। তিনি সরকারি কোনো চাকুরি গ্রহণ না করে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ব্যবসায় মনোযোগ দেন এবং বিশেষ উন্নতি সাধন করেন।

পিতার মতো তিনিও সমাজসেবা, কুসংস্কার নিরোধ, অসাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড, নরসিংদীর উন্নয়ন ও শিক্ষানুরাগী হিসেবে অমরত্ব লাভ করেন। তাঁর অসংখ্য অমর কীর্তির মধ্যে নরসিংদী সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠা ছিলো অন্যতম। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ এপ্রিল এক ঐতিহাসিক সভায় নারায়ণগঞ্জের এসডিও এস এইচ কোরাইশী কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্যে যে ১৪ জনের কমিটি গঠন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে বেলায়েত হোসেন মাস্টার, স্থানীয় জমিদার ও কলেজের জমিদাতা জিতেন্দ্র কিশোর মৌলিক, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মৌলভী তোফাজ্জল হোসেন, আফছার উদ্দিন সরকার প্রমুখ ছিলেন অন্যতম। তাছাড়া বেলায়েত হোসেন মাস্টার নরসিংদী কলেজের সহ-সভাপতি, নরসিংদী বালিকা বিদ্যালয়ের সভাপতি, নরসিংদী পাট ও চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি, ঋণ ও শালিসী বোর্ডের সদস্য, জুড়ি বোর্ডের মেম্বার, নরসিংদী ফায়ার ব্রিগেডের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। শেখেরচর কাপড়ের হাট প্রতিষ্ঠায় সুন্দর আলী গান্ধীর সহযোগী, নরসিংদী সদর হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন ও কুটির শিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এলাকার উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। বেলায়েত হোসেন মাস্টার অত্যন্ত সুদর্শন ও রুচিশীল ব্যক্তি ছিলেন। দিনে দুইবার দাঁড়ি কামাতেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানে অন্তঃপ্রাণ ছিলেন। কলকাতা থেকে অনেক বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা এনে পড়তেন। তাঁর ঠিকানায় নিয়মিত আসতো আনন্দবাজার, দি স্টেটসম্যান, সওগাত, মোহাম্মদী, চতুরঙ্গ, ভারতবর্ষ ও মানসী পত্রিকা। তিনি অত্যন্ত চমৎকার ইংরেজি লিখতে ও বলতে পারতেন। তাঁর আরেকটি অনন্য কীর্তি ছিলো নরসিংদী দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করা। পুুরান লঞ্চঘােেট ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বামাসুন্দরী দাস্যা তাঁর প্রয়াত স্বামী কার্তিক চন্দ্র সাহার স্মৃতি রক্ষার্থে ১,০০০ টাকা ব্যয় করে হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করলে তার সভাপতি ও পরিচালনার ভার পড়ে বেলায়েত হোসেন মাস্টারের উপর। তাঁর এক ছেলে শাহাদাৎ হোসেন মন্টু বাবার মতো বই ও পত্র-পত্রিকা পড়ুয়া মানুষ। জ্যাঠা সুন্দর আলী গান্ধী ও বাবা বেলায়েত হোসেন মাস্টারের পথ ধরে তিনিও ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক উন্নতি করেছেন। তিনি পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ ও একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা-ইন-এডুকেশন ডিগ্রি গ্রহণ করেন। কোনো চাকুরিবৃত্তি গ্রহণ না করে তিনিও পারিবারিক ঐতিহ্যে ব্যবসায় নিয়োজিত হন। তিনি ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স ইনভেস্টমেন্ট এন্ড কমার্স ব্যাংকের অন্যতম উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন গান্ধী স্কুলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। কবি ইকবালের ‘দ্য রিকনস্ট্রাকশন অব রিলিজিয়াস থট ইন ইসলাম’, স্যার এডউইন আর্নল্ডের ‘পার্লস অব দ্য ফেইথ অর ইসলামস রোজারি’ ও স্যার থমাস কার্লাইলের ‘মোহাম্মদ দ্য হিরো এজ প্রফেট’ বঙ্গানুবাদ করে খ্যাতি অর্জন করেন। আমেরিকা, জার্মানি, ইংল্যান্ড, ইতালি, উজবেকিস্তান, রোমানিয়া, গ্রিস, বুলগেরিয়াসহ অসংখ্য দেশ ভ্রমণ করেছেন। তিনি বিদেশ থেকে দামি পারফিউম, স্যুট-প্যান্টের পরিবর্তে লাগেজ ভর্তি করে ইংরেজি ভাষার দুষ্প্রাপ্য ও মহামূল্যবান বই-পুস্তক নিয়ে আসতেন।

সুন্দর আলী গান্ধীর পুত্রদের মধ্যে সবচেয়ে তেজস্বী পুরুষ ছিলেন মিঞা আবদুল মজিদ। দ্বিতীয় পুত্র মিঞা আবদুল অহিদ, তৃতীয় পুত্র আবদুস শহীদ ও চতুর্থ পুত্র মিঞা রেজাই করিম খসরু। তারা ব্যবসায়ী হিসেবে নরসিংদীতে খ্যাতিমান হয়েছেন। আবদুস শহীদ নরসিংদী পৌরসভার কাউন্সিলর হিসেবে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। মিঞা রেজাই করিম নরসিংদী পাট শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি, নরসিংদী পাট আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ঈদগাহ কমিটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে পিতার আদর্শ উজ্জীবিত রেখেছিলেন। জমিদার ললিতমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত কমল কামিনী গার্লস স্কুলটি দেশভাগের পূর্বকালে বন্ধ হয়ে যায়। এতে নরসিংদীর নারীশিক্ষায় প্রচণ্ড ছেদ পড়ে। এটা গান্ধী পরিবারের বিদ্যোৎসাহী সদস্যদের বেশ মর্মপীড়া দেয়। তাঁদের পক্ষ হয়ে মিঞা আবদুল মজিদ গার্লস স্কুলটি পুনর্জীবিত করার উদ্যোগ নেন। তিনি চাচা বেলায়েত হোসেন মাস্টারকে স্কুলের সভাপতি করেন। তাঁদের উদ্যোগে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করা হয়। কর্মজীবীদের উৎসাহ দেয়ার জন্যে সকাল ছয়টা থেকে দশটা পর্যন্ত প্রাতঃকালীন ব্যবস্থা চালু করেন। উক্ত স্কুলটি পরবর্তীতে কমল কামিনী গার্লস স্কুলের পরিবর্তে সাটিরপাড়া বালিকা বিদ্যালয় হিসেবে নামকরণ করা হয়। বর্তমানে স্কুলটি সাটিরপাড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

সুন্দর আলী গান্ধীর পুরো পরিবার একটি অসাম্প্রদায়িক পরিবার ছিলো। নরসিংদীর রামদাস বাউলের আখড়া তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে যুগ যুগ ধরে। প্রতিবছর সেখানে যে-বাউলমেলা হয়, তাতে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন বেলায়েত হোসেন মাস্টার। তিনি সেখানে বাউল সঙ্গীতের সঙ্গে এসরাজ সংগত করতেন। সুন্দর আলী গান্ধী ছিলেন বাউল আখড়ার একজন ভক্ত। জ্যাঠা সুন্দর আলী গান্ধী সম্পর্কে ভাতিজা শাহাদাৎ হোসেন মন্টু জানান, “সুন্দর আলী গান্ধী ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের চেহারার সঙ্গে কোকড়ানো চুল, খাড়া নাসিকা, প্রশস্ত ললাট ও জ্যোতির্ময় চোখ দেখে যেকোনো মানুষ আকর্ষিত হতেন। খদ্দরের পাঞ্জাবি, নিমা ও লুঙ্গি পরতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। স্বদেশি পোশাক পরে মানুষদের উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি মনে-প্রাণে ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী, দেশপ্রেমিক ও মাতৃভূমির প্রতি শ্রদ্ধাশীল।” কিন্তু অবাক কাণ্ড হলো, এই মহান রাজনীতিক ও আধুনিক নরসিংদীর বিনির্মাণকারীর কোনো মূল্যায়ন নরসিংদীবাসী করেনি। তিনি দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, সমাজ গঠন ও রাজনীতিতে বিরল উদাহরণ হলেও স্থানীয়ভাবে তাঁর কোনো স্মৃতি গড়ে তোলা হয়নি। তাঁর নামে কোনো রাস্তা, মিলনায়তন কিংবা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়নি। তাই নরসিংদী পুরান বাসস্ট্যান্ড থেকে পুরান থানার ঘাট পর্যন্ত রাস্তাটির নাম যদি ‘সুন্দর আলী গান্ধী সড়ক’ করা হয়, তাহলে এই মহর্ষি মানুষটির প্রতি সামান্য হলেও সম্মান জানানো সম্ভব হবে। নরসিংদী পৌরসভা এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

শিবপুরের নলুয়া বিল

বাংলাদেশ খাল, বিল আর নদীর দেশ। নদীর তীর, খালের ধার ও বিলের পাড় বাঙালিদের ঠিকানা। নরসিংদীর শিবপুরে রয়েছে এমন একটি সুপরিচিত বিল। নলুয়া বিল। অনেকে বলেন নল্লা বিল। শিবপুরের মানুষ অথচ নলুয়া বিল চেনেন না, এমনটি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শিবপুর সদর ঘেঁষা উত্তরের এই বিলের পূর্ব পাশের গ্রামের নাম পূবেরগাঁও। ’৭১-এর বীর মুক্তিযোদ্ধা বেদন মৃধা এই পূবেরগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন। এ-বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্যে পূবেরগাঁওয়ের মানুষ গর্ব বোধ করেন। বিলের  উত্তরে ঐ দেখা যায় মজলিশপুর গ্রাম। পশ্চিমে বসবাস করেন ধানুয়া, সৈয়দেরগাঁও এবং আবদুলখানা গ্রামের অধিবাসীরা। নলুয়া বিল এসব গ্রামের মানুষজনের নিত্যসঙ্গী, চলার সাথী। বিল হতে বাহিত নির্মল বাতাসে গ্রামবাসীগণ নিঃশ্বাস ফেলেন। সুন্দর পরিবেশ আর মৃদুমন্দ বাতাস এনে দেয় তাঁদের অফুরন্ত প্রাণোচ্ছল সজীবতা।

শিবপুর উপজেলায় এমন আরো অনেক বিল রয়েছে। বিখ্যাত চিনাদী বিল, গড়িয়া, দোপাথর, রমরমা, মলাডাঙ্গা, আতরকাঠি ও খাজ্জা বিলসহ পাহাড়ি অঞ্চলে ছোটো-বড়ো অনেক খরস্রোতা বিল এখনো কালের সাক্ষী হয়ে আছে। তবে নলুয়া বিলটি যেন সমধিক পরিচিত। এ-বিলের ধার বেয়ে চলে গেছে শিবপুর-চরসিন্দুর, শিবপুর-লাখপুরের অতি পুরাতন বৃহৎ পাকা রাস্তা। নলুয়া কলাগাছিয়া নদীর সাথে সংযোগ রক্ষা করে আছে সেই অতীতকাল থেকেই। বর্ষার সময় কলাগাছিয়া নদীতে নতুন পানি এলে নলুয়া প্রাণ ফিরে পায়।  বিলের পশ্চিম পাড়ে এককালের হিন্দু তীর্থস্থানের মতো আঙ্গুলখোলা বাজার ছিলো। প্রতিবছর সেই বাজারে অনেক বড়ো বৈশাখী মেলা বসতো। খোলামেলা সুন্দর পরিবেশে তখনকার মেলার দিনে বিলপাড়ের মানুষেরা আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠতো। বিলের বড়ো-ছোটো নানা জাতের প্রচুর মাছকে কেন্দ্র করে আবদুলখানা গ্রামে মৎস্যজীবী পরিবার গড়ে ওঠেছিলো। বংশ পরম্পরায় এখনো এ-গ্রামে মৎস্য ব্যবসার সাথে জড়িত অনেক মানুষ। সেই সময় ছোটো ছোটো নৌকা ও জাল দিয়ে ট্রলিং পদ্ধতিতে মাছ ধরা হতো। রাতের বেলা মাছ ধরতে গিয়ে জেলেরা তাদের নিজস্ব স্টাইলে ভিন্ন ধরনের হাকডাক করতো। গেয়ে ওঠতো মাছকে ভয় দেখানো সঙ্গীত। দিনের বেলাও বিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে ছোটো ছেলেমেয়েসহ অনেকে মাছ ধরার দৃশ্য দেখে দেখে মুগ্ধ হতো। বিলপাড়ের বাসিন্দা মনু বর্মণের কাছ থেকে জানা যায়, তাঁর দাদা একবার প্রায় ২৫ কেজি ওজনের বিশাল একটি রুইমাছ এই বিল থেকে ধরেছিলেন। মনু তাঁর পূর্বপুরুষদের নলুয়া থেকে বড়ো বড়ো মাছ ধরার অনেক ঘটনা শুনেছেন। একসময় বিলে প্রচুর বোয়াল মাছও ছিলো। বৃষ্টির মৌসুমে রাতে অনেক বোয়াল মাছ ধানের জমিতে উঠে আসতো।

প্রতিবছর একাধিকবার মধুর মাছ ধরার পলো উৎসব হতো। চতুর্দিক হতে শত সহস্র মাছ শিকারি পলোসহ বিভিন্ন ধরনের জাল নিয়ে উচ্চস্বরে হাকডাক করতে করতে বিলে নামতো। মানুষজন সেই পলো বাওয়া থেকে প্রচুর মাছ নিয়ে আনন্দ ফুর্তিতে বাড়ি ফিরতো, মা-বোনেরা মাছ দেখে খুশি হতেন। কিন্তু বড়োই পরিতাপের বিষয় যে, এখন সেসব দিন যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। নেই আগের মাছ, শোনা যায় না জেলেদের হই-হুল্লোড়, কলকল নৌকা চলার শব্দ। নেই লগি-বৈঠার ঠনঠন আওয়াজ। জেলের ডাকে জেলেনি আর জেগে ওঠে না। নামে না আর পলো। হয় না মাছ ধরার উৎসব। সাজ সাজ রব যায় না দেখা। বাংলার অনেক বিলের সাথে নলুয়া বিলও নিজস্ব যৌবন হারিয়ে এখন মৃতপ্রায়। আগের মতো পানি আর আসে না। জোয়ারের সময় ঢেউ আর খেলে না। ছেলেমেয়ের দল শাপলা শালুক কুড়ানোর ছলে আর নাইতে যেতে পারে না। খাল-বিল-নদীর সেই দিনের রূপ  হারিয়ে এখন প্রকৃতিতে দেখা দিয়েছে নেতিবাচক প্রভাব। প্রায় সময়ই বিল থাকে পানিশূন্য। বর্ষায় কিছু জোয়ার আর কিছু বৃষ্টির পানি এলে মাথা তুলে দাঁড়াতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। আর শুকনো মৌসুমে বলতে গেলে বিলের অনেকাংশ হাহাকার করে। মাছসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ছে দিনের পর দিন। বিলপাড়ের মানুষ ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস। অনেকে আবার বিলপাড়ে নতুন বাড়িঘরও তৈরি করেছে।

নলুয়া এখন দৈর্ঘ্যে এক কিলোমিটারের মতো। উত্তরদিকের অনেকটাই শুকিয়ে ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে। উত্তরদিকে শুকিয়ে যাওয়া ফসলি জমির বড়ো অংশের  এখন নাম হয়েছে ‘রসুনিয়া’ বিল। অনেকে বলেন, ‘রউন্না’ বিল। হয়তো কোনো কৃষক বিলের উত্তরে জেগে ওঠা জমিতে রসুন চাষ করেছিলেন। সেখান থেকেই এই নাম। এখনো নলুয়া বিলের যে-সামান্য পরিধি রয়েছে, তার মধ্যখানে সারা বছরই কম-বেশি মাছ পাওয়া যায়। আরেক মৎস্য ব্যবসায়ী স্বপন চন্দ্র থেকে জানা যায়, এখনো প্রায় ৩০ টি মৎস্যজীবী পরিবার এ-বিল থেকেই তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করে বেঁচে আছে। প্রতিবছর বর্ষায় একটু-আধটু পানি এলে তুলনামূলক বেশি মাছ পেলে অনেকের দিন ভালো কাটে। অনেকে দেশের বিভিন্ন বাজার থেকে মাছ নিয়ে এসে এলাকাবাসীর মাছের চাহিদা পূরণ করে ও পুষ্টির যোগান দেয়।

বিলের পশ্চিম পাশে আমার মামার বাড়িতে শৈশবকালে কতো গিয়েছি। মামাতো-ফুফাতো ভাই-বোনেরা একসাথে দল বেঁধে নলুয়ার বর্ষার নতুন পানিতে মহানন্দে গোসল করেছি। সাঁতার কেটেছি, দূর থেকে দৌড়ে এসে লাফিয়ে পানিতে পড়েছি। কখনো শাপলা কুড়িয়ে নানির হাতে দিয়েছি। ছোটো ছোটো মাছ ধরার অনেক স্মৃতি মনে এসে দোল খায়। আবার কি আসবে ফিরে, সেইসব দিন, জেগে ওঠবে চিরায়ত বাংলার হারানো রূপ?


নূরুদ্দীন দরজী
সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার

আবদুল মান্নান ভূঁইয়া : কৃষক আন্দোলন বেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি

0

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রির কথাগুলো ইদানিং অনেকের মুখে মুখে ফিরছে। সেটার সোল এজেন্ট হয়ে ওঠেছিলো আওয়ামী লীগ। এজেন্ট হওয়ার কারণ, তারা মনে করে, তারাই দেশ স্বাধীন করেছে এবং এর সকল সুফল তারাই ভোগ করবে। তবে এ-কথা ঠিক, একাত্তরে দেশ স্বাধীন হয়েছিলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। যাদের অধীনে স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন দল, মত ও গোষ্ঠীর লোকজন অংশগ্রহণ করেছিলেন। এমন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, যাদের দলীয়, সাংস্কৃতিক কিংবা গোষ্ঠীগত পরিচয় ছিলো না। আমার আত্মীয় নইমুদ্দিন ভূঁইয়া একজন কৃষক ছিলেন। তিনি স্বাধীনতার জন্যে লাঙল ফেলে রেখে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। এমন দল-গোষ্ঠীহীন লাখ লাখ নইমুদ্দিনকে আওয়ামী লীগ অস্বীকার করে এককভাবে নিজের কৃতিত্ব ফলাতে চেয়েছে।

তেমনি আওয়ামী ঘরানার বাইরে দেশের বড়ো একটা জনগোষ্ঠী নিঃস্বার্থভাবে স্বাধীনতার জন্যে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। যাদের রাজনৈতিক পরিচয় আওয়ামী লীগের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলো না। দেশের  বামপন্থী  রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন অনেক দল জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো। এদের সবচেয়ে বড়ো একটা ঘাঁটি ছিলো তৎকালীন ঢাকা জেলার পূর্বাঞ্চল হিসেবে খ্যাত নরসিংদী অঞ্চলে। যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ন্যাপ (ভাসানী)-র খ্যাতিমান নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া (১৯৪৩-২০১০)। তাঁর অধীনে শত শত বামপন্থী নেতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এই বামপন্থী মুক্তিবাহিনিটি স্থানীয়ভাবে ‘মান্নান ভূঁইয়া বাহিনি’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিলো। কিন্তু প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ হিসেবে মান্নান ভূঁইয়া নিজের মুখে কখনো ‘মান্নান ভূঁইয়া বাহিনি’ কথাটি উচ্চারণ করেননি। তিনি বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের সমান কৃতিত্বের অধিকারী মনে করতেন। মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সরাসরি রাজনৈতিক সহচর ছিলেন তিনি। জীবনের  বড়ো একটা অংশ কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। শিবপুর কৃষক সম্মেলন, হাতিরদিয়া বাজার হাট-হরতাল সফল করে জাতীয় রাজনীতিতে পরিচিতি লাভ করেন। মান্নান ভূঁইয়া  ছাড়াও শিবপুরের আসাদুজ্জামান আসাদ ভাসানী সমর্থক ও স্থানীয় কৃষক নেতা। মান্নান-আসাদের নেতৃত্বে শিবপুর, মনোহরদী, বেলাব ও রায়পুরায় ব্যাপক কৃষক আন্দোলন চলতে থাকে। তাঁদের সভা-সম্মেলনে ভাসানী সভাপতিত্ব করে জ্বালাময়ী বক্তব্য রেখেছিলেন। এই আসাদুজ্জামান আসাদ ঊনসত্তরে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে অভ্যুত্থানকে সফলতার পথে নিয়ে গিয়েছিলেন। শহীদ আসাদের মৃত্যুর পর মূলত স্থানীয় কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মান্নান ভূঁইয়া। ২০১০ সালের ২৭ জুলাই ফুসফুসে ক্যান্সার হয়ে মৃত্যু হলে রাজনীতির একটা অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটে। ধীর-স্থির ও গম্ভীর চিন্তা-চেতনা পোষণকারী এই রাজনৈতিক নেতার মৃত্যুতে দেশের রাজনীতিতে যে-শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা এখনো পূরণ হয়নি। বিশেষ করে, নরসিংদীর শিবপুরের মানুষ তাঁর অভাব হারে হারে টের পাচ্ছেন।

শিবপুর-মনোহরদীর বিভিন্ন এলাকায় তথ্য সংগ্রহ করতে  গিয়ে অবাক হয়েছি। ছাত্র জীবন থেকেই মান্নান ভূঁইয়া প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনায় পরিপক্বতা অর্জন করেছিলেন। মাছিমপুর গ্রামে এক সাধারণ কৃষক পরিবারে ১৯৪৩ সালের ১ মার্চ জন্ম নেয়া এ-রাজনৈতিক নেতাকে জাতীয় পর্যায়ে আসতে কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা করতে হয়েছে। গ্রামের প্রাইমারি স্কুল, শিবপুর স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে নরসিংদী কলেজে পড়াশোনা করেছেন তিনি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পাশাপাশি এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। পিতা আবদুল হাই ভূঁইয়া আপাদমস্তক একজন কৃষক ছিলেন। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও রাজনৈতিক প্রবল স্রোতে এ-পেশা ভেসে যায়। রাজনীতি তাঁর অস্থি-মজ্জায় বাসা বেঁধেছিলো। যার কারণে ছাত্র জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন।

নরসিংদী কলেজে পড়ার সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ছাত্র সংসদের সমাজ সেবা সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠক হিসেবে তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে জাতীয় রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৪-৬৫ সালে তিনি ডাকসু’র কার্যনিবার্হী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপ করতেন।

ছাত্র জীবন শেষে মান্নান ভূঁইয়া মূলত মওলানা ভাসানীর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ন্যাপে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ন্যাপের রাজনীতিতে থাকার সময় তিনি বেশিরভাগ সময় কৃষক সমিতির হয়ে গ্রামাঞ্চলের অবহেলিত কৃষকদের পক্ষে কাজ করেছেন। শিবপুর, মনোহরদী ও নরসিংদী সদরে অনেক বড়ো বড়ো কৃষক আন্দোলন করেছেন তিনি। কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বেশ কয়েক বছর তিনি বরেণ্য কৃষক নেতা জিতেন ঘোষ, হাতেম আলী খান, অন্নদা পাল ও সরদার ফজলুল করিম প্রমুখের সঙ্গে কাজ করেন।

তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অনেক উত্থান-পতন আর ঘাত-প্রতিঘাত থাকলেও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে। শিবপুর রণাঙ্গনকে তিনি শত্রুমুক্ত রেখেছিলেন। ভারতের কোনো সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়াই তিনি স্থানীয় এবং ঢাকার বেশকিছু বামপন্থী নেতাকর্মীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, যা ছিলো মুক্তিযুদ্ধের অনন্য নজির। নরসিংদী জেলার উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা হিসেবে খ্যাত সেই শিবপুর, বেলাব, মনোহরদী এবং রায়পুরার অংশবিশেষ ছিলো হাজার হাজার বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের বিচরণ ক্ষেত্র। কমিউনিস্ট, ন্যাপ ও সর্বহারা পার্টির নেতাকর্মীরা বেশ কিছু প্রশিক্ষণ ক্যাম্প, আশ্রয় শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রহ কেন্দ্র খুলে পুরো এলাকাটিকে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস মুক্তাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। প্রখ্যাত  বামপন্থী নেতা ও লেখক হায়দার আকবর খান রনো, হায়দার আনোয়ার খান জুনো ও রাশেদ খান মেনন, চলচ্চিত্রকার  জহির রায়হান তাঁর দলবলসহ শিবপুরের রণাঙ্গনে এসেছিলেন। একাধিক বামপন্থী নেতা সেই রণাঙ্গন নিয়ে বই কিংবা প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁরা সবাই মান্নান ভূঁইয়ার কমান্ডে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। ভারতের সাহায্য ছাড়া যে-কয়েকটি দল দেশের ভিতরে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো, তার মধ্যে মান্নান ভূঁইয়ার গ্রুপ ছিলো সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। বরিশাল পেয়ারা বাগান এলাকায় আরেকটি দল কোনো রকম সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাহায্য ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো। সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন কমরেড সিরাজ শিকদার।

‘শিবপুর মুক্তিযুদ্ধের এক সশস্ত্র ঘাঁটি’ শীর্ষক প্রবন্ধে হায়দার আনোয়ার  খান জুনো বলেন, “একাত্তরের বেশ আগে থেকেই শিবপুর বামপন্থীদের একটা শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলো। মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে সেখানে  জঙ্গি কৃষক সংগঠন গড়ে ওঠেছিলো। শিবপুরে বামপন্থী ছাত্র ইউনিয়নও খুব শক্তিশালী ছিলো। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে শিবপুর যথেষ্ট অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ঊনসত্তরের শহীদ আসাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায়ই শিবপুরে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন।”

পঁচিশে মার্চ পাক হানাদার বাহিনি নিরীহ মানুষের উপর হামলা চালালে মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে সে-হামলার প্রতিরোধ প্রস্তুতি নেয়া হয়। এপ্রিলের প্রথমদিকে পাঁচদোনায় ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে পাকিস্তানি মিলিটারির যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে ফেলে যাওয়া কিছু অস্ত্র এবং শিবপুর থানা লুট করে কিছু রাইফেল পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে সেসব অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়। মান্নান ভূঁইয়ার নির্দেশ পেয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার মজনু মৃধা ও হারিস মোল্লা প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পান। তদারকিতে ছিলেন ঝিনুক খান, কালা মিয়া, আবদুল আলী মৃধা, তোফাজ্জল হোসেন, মান্নান খান ও আওলাদ হোসেন প্রমুখ। শিবপুর থানা সদরে পাকিস্তানি আর্মির ক্যাম্প থাকায় বিপ্লবী মুক্তিযোদ্ধারা শিবপুর পাহাড়ি এলাকায় গোপনে সংগঠিত হয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করেন।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বয়ান থেকে জানা যায়, শিবপুর, মনোহরদী, বেলাব ও রায়পুরা এলাকায় কয়েকটি দলে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো। তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় আলাদা হলেও সবাই মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন। যুদ্ধের ৯ মাস বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনির ছোটো ছোটো কিছু যুদ্ধ হয়েছিলো। তবে  উল্লেখযোগ্য যুদ্ধটি হয় ১৩ আগস্ট পুটিয়া বাজারে। নরসিংদীর টি এন্ড টি ভবনে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনির মূল ঘাঁটির সাথে শিবপুর এলাকার যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল ছিলো পুটিয়া ব্রিজ। মূলত এই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়ার জন্যেই পুটিয়া ব্রিজটি বিস্ফোরণে ধ্বংস করে মুক্তিযোদ্ধারা অপেক্ষা করতে থাকেন। তখনো পাক আর্মিরা সেখানে পৌঁছেনি। অনেকক্ষণ পর পাকবাহিনির বড়ো একটা দল সেখানে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে তরুণ যোদ্ধা ফজলু নিহত হন। তিনি শিবপুরের প্রথম শহীদ।

হায়দার আনোয়ার খান জুনোর লেখা ‘একাত্তরের রণাঙ্গন : শিবপুর’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেন। শিবপুরে বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সারাদেশে আলোচিত হয়েছিলো। শিবপুরে কোনো রাজাকার ছিলো না। দলমত নির্বিশেষে মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে সবাই যুদ্ধ করেছিলো। যদিও তারা অন্যান্য এলাকায়ও যুদ্ধ করেছেন। পুরো শিবপুরকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছিলো দীর্ঘ ৯ মাস পর। যুদ্ধ চলাকালীন শিবপুর এলাকায় কোনো ডাকাতি, ছিনতাই, চুরির ঘটনা ঘটেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কেউ জোরপূর্বক খাদ্য সামগ্রী ও নগদ তহবিল সংগ্রহ করেননি। ক্যাম্পগুলোতে মুক্তিযোদ্ধারা খাওয়া-দাওয়ার খুব কষ্ট করতেন। দলনেতা মান্নান ভূঁইয়া এসব কঠোর হস্তে দমন করে নিদের্শনা দিয়েছিলেন, “কোন ক্যাম্পের জন্য আলাদা ভাবে কিছু সংগ্রহ করা যাবে না। কেন্দ্রীয়ভাবে দেওয়া চাল, ডাল, তেল, নুনে চলতে হবে।” তাঁর  কঠোর মনোভাবের কারণেই এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়নি। গ্রাম্য কোন্দল, মারামারিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ছোটোখাটো বিষয় মুক্তিযোদ্ধারাই মীমাংসা করতেন। বড়ো কোনো সমস্যা দেখা দিলে দলনেতা মান্নান ভূঁইয়া সমাধান করে দিতেন।

মান্নান ভূঁইয়া বাহিনির আরেকটি যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিলো চন্দনদিয়ায়। সেখানে হাবিলদার মজনু মৃধার দলের উপর পাকবাহিনি অর্তকিত হামলা চালায়। এই হামলায় মজনু মৃধা, আব্দুল আলী মৃধা, আমজাদ হোসেন, মানিক মিয়া, ইদ্রিস আলী, নজরুল ইসলামসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা হামলা মোকাবেলা করতে থাকেন। সেখানে বিভিন্ন পর্যায়ে তীব্র যুদ্ধ হয়। এতে পাকিস্তানি বাহিনির ৭ জন মারা গেলেও মান্নান ভূঁইয়া বাহিনির অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। মানিক ও ইদ্রিস শহীদ হন। আমজাদের পায়ে গুলি লাগে। নজরুল রাইফেলসহ পাকবাহিনির হাতে আটক হন।

মান্নান ভূঁইয়া বাহিনির এই সামান্য ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া হয়েছিলো ভরতেরকান্দি অভিযানের সময়। নরসিংদী থেকে শিবপুর ও মনোহরদীর সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা অক্ষত রাখার জন্যে সেখানকার সেতুটি পাকবাহিনি সার্বক্ষণিক পাহারা দিতো। তাই একে ধ্বংস করে হানাদার বাহিনির নির্বিঘ্ন যাতায়াত বিঘ্ন করার জন্যে মান্নান ভূঁইয়ার নির্দেশে হাবিলদার মজনু মৃধার নেতৃত্বে একটি চৌকষ দল বাছাই করা হয়। তাঁদের হাতে তুলে দেয়া হয় দুটি এলএমজি, দুটি স্টেনগান, একটি এসএমজি, কয়েকটি রাইফেল এবং কয়েকটি হ্যান্ড গ্রেনেড ও গোলাবারুদ। নির্দেশ দেয়া হয় ভরতেরকান্দি ব্রিজটি উড়িয়ে দিতে। ব্রিজটি পাকিস্তানি বাহিনির কঠোর নজরদারিতে ছিলো। দু’পাশে ছিলো বাংকার। গোয়েন্দা তথ্যে জানা যায়, ভোর ৬ টার দিকে পাহারারত পাকসেনারা বাংকার থেকে বেরিয়ে এসে হাঁটাহাঁটি করে। এই সময় বাংকারের দু’দিক থেকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করা হয়। প্রথম আক্রমণেই চারজন পাকিস্তানি ধরাশায়ী হয়। এরপর পাকিস্তানিরা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। পরে সেখানে ছয়টি মৃতদেহ পড়ে থাকে। বাংকার থেকে তিনটি চায়নিজ রাইফেল ও চার বাক্স গুলি উদ্ধার করা হয়। এরপর মান্নান বাহিনি বিস্ফোরকের সাহায্যে  ব্রিজটি ধ্বংস করে দেয়।

ভরতেরকান্দি ব্রিজ ধ্বংসের অপারেশনে একটি মর্মান্তিক হৃদয়স্পর্শী ঘটনার অবতাড়না হয়। হাবিলদার মজনু মৃধা ও হায়দার আনোয়ার খান জুনো সেখান থেকে ফিরে আসার সময় একজন পাক আর্মিকে সেখানে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেন। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বাঁচার আশা না থাকলেও তাকে ধরাধরি করে পাশের একটি স্কুলঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন পাক আর্মি তাঁদের হাতে একটি পোস্টকার্ড তুলে দিয়ে বললো, “আমি জানি, আর বেশিক্ষণ বাঁচবো না। আমার একটা অনুরোধ, আমার বিবির কাছে এই পোস্টকার্ডটা পোস্ট করে দিও। আমার বিবি জানুক, আমি বেঁচে আছি।”

১২ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা নরসিংদীকে মুক্ত করেন। পরবর্তীতে টি এন্ড টি অফিসে অবস্থিত পাক আর্মির অফিসটি দখল করে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়। টি এন্ড টি অফিসের ভেতর থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। থরে থরে  সাজানো রকেট লঞ্চার আর দুটি মর্টার, অনেক গোলাবারুদ আর গ্রেনেড। কিছুক্ষণ পর ভারতীয় বাহিনির হেলিকপ্টার নরসিংদীতে নামলো। অফিসারসহ ভারতীয় বাহিনির সদস্যরা টি এন্ড টি ভবনের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ তাঁদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়। শিবপুরে মান্নান ভূঁইয়া বাহিনিতে প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলো বলে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রবীণ রাশেদ খান মেনন সূত্রে জানা গেছে। তিনি এক চিঠিতে তাঁদেরকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন।  চিঠির একাংশে উল্লেখ করেন, “মুক্তিযুদ্ধকালীন সর্ব সময় বর্তমান নরসিংদী জেলার শিবপুরে আমরা প্রধান কেন্দ্রস্থল করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘাঁটি স্থাপন করি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সাথে যুুদ্ধ করে শিবপুর অঞ্চলকে যুদ্ধের নয় মাস পুরোপুরিভাবে মুক্তি রাখে।” মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে রাশেদ খান মেননসহ আরো অনেক বামপন্থী জাতীয় বীর দেশমাতৃকার টানে জীবন উৎসর্গ করার জন্যে প্রত্যয় গ্রহণ করেছিলেন।

বর্ষীয়ান বামপন্থী নেতা হায়দার আকবর খান রনো তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “২৭ মার্চ সকালে কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন, আমি, বিখ্যাত  চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের গাড়িতে করে ঢাকা ত্যাগ করি। শক্তিশালী কৃষক ঘাঁটিতে পৌঁছাই। গাড়িটি চালিয়ে নিয়ে যায় বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আনোয়ার খান জুনো। উল্লেখ্য, জহির রায়হান কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি তার গাড়িটি মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহারের জন্য আমাদের দান করেন। শিবপুরে আমরা হেডকোয়ার্টার করি। একই সঙ্গে বিভিন্ন কৃষক এলাকায় সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করার নিদের্শ দেই। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির অধীনের ১৪ টি মুক্ত আধামুক্ত এলাকা বা ঘাঁটি অঞ্চল গঠিত হয়েছিল। প্রায় ৩০ হাজার সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা আমাদের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের ভেতর থেকেই। ১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৬ খণ্ডে প্রকাশিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও দলিলপত্রে এই সংখ্যাটি উল্লেখ আছে। ১৪ টি ঘাঁটি এলাকায়  মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা শতাধিক।”

হায়দার আকবর রনোর স্মৃতিচারণ থেকে আরো জানা যায়, সমন্বয় কমিটির অধীনস্থ ঘাঁটিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ঘাঁটি ছিলো শিবপুর, মনোহরদী, পলাশ, রায়পুরা ও নরসিংদীর কিয়দাংশ নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ এলাকা। সেখানে আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে গঠিত  হয়েছিলো একধরনের পাল্টা প্রশাসন। শিবপুরের যুদ্ধে সরাসরি সামরিক কমান্ডার ছিলেন হাবিলদার মজনু মৃধা, হায়দার আনোয়ার খান জুনো ও মান্নান খান। মে মাসেই শিবপুরের অন্তর্ভুক্ত পুটিয়ার যুদ্ধে প্রথম শহীদ হন ১৪ বছরের কিশোর মানিক। কাজী সিরাজ এক লেখায় দাবি করেছেন, মান্নান ভূঁইয়া ছিলেন শিবপুর, মনোহরদী, বেলাব ও রায়পুরা অঞ্চলের প্রকৃত সেনাপতি। তিনি তখন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির অন্যতম নেতা। এই সংগঠনের প্রধান নেতা ছিলেন কাজী জাফর আহমেদ। অন্য কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, মোস্তফা জামাল হায়দার প্রমুখ।  সেই সংগঠনের ১৪ টি ঘাঁটির মধ্যে শিবপুর ঘাঁটিটি ছিলো হেডকোয়ার্টার, যার সেনাপতি ছিলেন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। তিনি ২৫ মার্চ বিকেলে শিবপুরে জনসভা করে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়ার কণ্ঠস্বর শোনার আগেই মান্নান ভূঁইয়া শিবপুরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে যোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন। এক্ষেত্রে বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের ভরসার স্থল ছিলো শিবপুর, ভারত নয়। দেশে থেকে প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধ করার জন্যে মান্নান ভূঁইয়া সবাইকে উৎসাহিত করতেন।

তখন বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের বাইরে যুদ্ধরত বেশ কয়েকটি গ্রুপ ছিলো। তার মধ্যে আওয়ামী লীগের গ্রুপটি ছিলো বৃহৎ। তাছাড়া পাঁচদোনার ন্যাভাল সিরাজের গ্রুপটি বিশেষভাবে আলোচিত ছিলো। তবে ন্যাভাল সিরাজ (বীর প্রতীক) খালেদ মোশাররফ ও মেজর হায়দার দ্বারা প্রভাবিত ছিলো বলে  তিনি বামপন্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। যুদ্ধ জয়ের পর তিনি ন্যাপ (ভাসানী)-র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয় নোংরা রাজনীতির শিকার হয়ে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে নৃশংসভাবে খুন হন। শুধু ন্যাভাল সিরাজই নয়, যুদ্ধকালীন মান্নান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধেও নানা ষড়যন্ত্র ও মিথ্যা প্রচারণা হয়েছিলো। ভিন্ন মতাবলম্বী মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ রটিয়ে বেড়ায়, মান্না ভূঁইয়ার নেতৃত্বে নকশালরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা করছে। এই গুজবের কারণে মান্নান ভূঁইয়াকে হত্যারও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন কেউ কেউ। এই বিষয়ে হায়দার আনোয়ার খান জুনো তাঁর এক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “সেপ্টেম্বরের শেষের দিকেই বিএলএফ এর একটি দল শিবপুরে আসে মুক্তিবাহিনী বা এফএফ থেকে, এরা ছিল একটু ভিন্ন। মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিতেন বাঙালী সেনারা। কিন্তু বিএলএফ সদস্যরা প্রত্যক্ষভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। বিএলএফ এর ঐ দলের সঙ্গে ভারী অস্ত্রশস্ত্রও ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মান্নান  ভূঁইয়াকে হত্যা করা। কিন্তু শিবপুরে এসে এবং কার্যক্রম দেখে তারা বুঝতে পারে, মান্নান ভূঁইয়াকে হত্যা করলে তারা কেউ অক্ষত অবস্থায় শিবপুর থেকে ফিরে যেতে পারবে না।”

হায়দার আনোয়ার খান জুনো ছিলেন শিবপুর মান্নান ভূঁইয়া বাহিনির সেকেন্ড ইন কমান্ড। তিনি তাঁর বইয়ে মান্নান ভূঁইয়া বাহিনির সদস্যদের একটি তালিকা দিয়েছেন এইভাবে : ন্যাভাল সিরাজ, মজনু মৃধা, মান্নান খান, ঝিনুক, আমজাদ, মিলন, ফজলু, বেনু, আফতাব, তোফাজ্জল হোসেন, তোফাজ্জল ভূঁইয়া, ইয়াসিন, ইদ্রিস, মানিক, মজিবুর রহমান, কফিল উদ্দিন, শাহ জাহান, শাহাবুদ্দিন, মিন্টু, সোলেমান, সিরাজ, হাবিবুর রহমান, সেন্ট আওলাদ, সাউদ ও ইকবাল প্রমুখ। তাঁদের  সঙ্গে ঢাকার বাসিন্দা শেখ কাদের ও কুমিল্লার সন্তান কাজী গোফরানও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধকালীন সার্বক্ষণিক শিবপুরে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মান্নান ভূঁইয়া। তাঁকে অনুপ্রেরণা ও পরামর্শ দিতে সে-সময় শিবপুরে গেছেন কাজী জাফর আহমেদ রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, জহির রায়হান, মোস্তফা জামাল হায়দার, লুৎফুন্নেসা বিউটি, মাহবুবা রশিদা চপল, শাহরিয়ার আখতার বুলু শিবপুরের হেডকোয়ার্টারের অন্তর্ভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে শহীদ হন ফজলু, ইদ্রিস, মানিক মিয়ার উদ্দিন, সাদেক ও ইব্রাহিম।

স্বাধীনতার পর আবদুল মান্নান ভূঁইয়া দেশ গঠনে মন দেন। সেজন্যে তিনি প্রথমে কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা ভাবতে থাকেন। যারা মানুষের মুখে আহার যোগান, তাদের মুখেই খাদ্য জুটছে না। সঙ্গত কারণে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। কৃষক সমিতি প্রতিষ্ঠা করে এর শাখা সারা দেশে ছড়িয়ে দেন। তিনি দীর্ঘদিন মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭৭ সালের দিকে ন্যাপ ভাসানী ও কৃষক সমিতি থেকে বেরিয়ে এসে কিংবদন্তীতুল্য কৃষক-শ্রমিক নেতা কাজী জাফর আহমদের ইউপিপিতে যোগদান করেন। তবে মান্নান ভূঁইয়ার রাজনৈতিক জীবনের ইউটার্ন হয়ে থাকবে ১৯৭২ সালে শিবপুরে অনুষ্ঠিত কৃষক সম্মেলনটি। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক সক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছিলো সেই কৃষক সম্মেলনের মাধ্যমে, যা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে নরসিংদী এলাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ময়মনসিংহ এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। সম্মেলনটি সফল করার জন্যে বেশ কয়েকটি প্রস্তুতি সভা হয়, যাতে প্রতিদিন দেড়-দুই হাজার কৃষক উপস্থিত থাকতেন। ১৯৭২ সালে ২৯ ও ৩০ এপ্রিল দুইদিনব্যাপী সেই সম্মেলনে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিলো। সেখানে লাখ লাখ কৃষক উপস্থিত হয়েছিলো বলে সংবাদপত্রে লেখা হয়। ২৯ এপ্রিল মওলানা ভাসানী দীর্ঘক্ষণ বক্তব্য রেখেছিলেন, যা ‘তোমরা প্রস্তুত হও’ শিরোনামে বুকলেট হিসেবে ছাপা হয়। সেখানে ভাসানী বলেন, “বাংলার কৃষক! তোমরা প্রস্তুত হও, দুনিয়ার নিপীড়িত মানুষ, দুনিয়ার মজলুম মানুষ, দুনিয়ার নির্যাতিত মানুষ, শোষিত মানুষকে তোমরা মুক্ত কর। আমরা মুক্ত করবোই করব। শুধু বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য আমরা কৃষক সমিতি গঠন  করিনি। শুধু বাংলাদেশের কৃষকদের মুক্তির জন্য কৃষক সমিতি গঠিত হয়নি। শুধু বাংলার মানুষের জন্য বাংলার কৃষক সমিতি  গঠন করা হয়নি। দুনিয়ার কৃষক, দুনিয়ার মজলুম মানুষের জন্য বাংলার কৃষক সমিতি গঠন করা হয়েছে।”

শিবপুরের কৃষক সম্মেলনে ভাষণ দিচ্ছেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, ১৯৭২

 

৩০ এপ্রিল ঐতিহাসিক কৃষক সম্মেলনে লাখ লাখ কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের উদ্দেশ্যে মওলানা ভাসানী বলেন, “আজ আমাদের সর্বপ্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে, মা বোনের ইজ্জত দিয়ে যে স্বাধীনতা আপনারা অর্জন করেছেন, সে স্বাধীনতা ঠিকভাবে রক্ষার জন্য গোটা বাংলাদেশের মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-যুবক, কামার-কুমার, জেলে-তাতী, পিয়ন, আর্দালী সর্বস্তরের নিপীড়িত মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়াজ তুলুন, আগামী ১৬ মে তারিখে আওয়ামী লীগ সরকার যে শাসনতন্ত্র আপনাদের সামনে পেশ করবে, আপনাদের জন্য তৈরি করে পাঠাবে, এই সভা থেকে আমি জানিয়ে দিচ্ছি, শেখ মুজিবুর রহমান, গণতন্ত্রের নিয়মে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, যারা সংখ্যায় বেশি, তারাই দেশ শাসন করবে, তারাই দেশ পরিচালনা করবে। এই দেশের  কৃষক-মজুরের সংখ্যা শতকরা ৯৫ ভাগ। তারাই এদেশের শাসক হতে পারে।” শিবপুরের কৃষক সম্মেলনে প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। তিনি মওলানা ভাসানীর পর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছিলেন। তাঁর বক্তব্যের একটি ছাপা বুকলেট সম্মেলনস্থলে বিতরণ করা হয়েছিলো। বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, “স্বাধীনতার অগ্রনায়ক মজলুম জনতার নির্ভীক সেনানী, কৃষকের নয়নমণি মওলানা ভাসানী নব্বই বছর বয়সেও এতো দূরে, শিবপুরে এসে আজিকার এই সম্মেলনের সভাপতির আসন গ্রহণ করে আমাদেরকে গৌরবান্বিত করে তুলেছেন। এ গৌরব শুধু আমাদের সংগঠনেরই নয়, এ গৌরব সমগ্র শিবপুরবাসীর। তিনি তাঁর সারা জীবনের অভিজ্ঞতা ও প্রখর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বর্তমান পর্যায়ের কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তারই ভিত্তিতে এই সম্মেলন রচনা করবে আগামী দিনের কাজের ধারা। বাংলাদেশের মহান নেতা মওলানা ভাসানীকে আমরা জানাই বিপ্লবী অভিনন্দন। শিবপুরবাসী তাঁকে জানায় তাদের প্রাণঢালা ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।”


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

পাগল দ্বিজদাস, তাঁর উত্তরসুরী ও কবিগানের পরম্পরা

0

লোকসঙ্গীতের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার ভাটির দেশ নিয়ে আমার দীর্ঘদিনের একটা কৌতূহল ছিলো। সেই কৌতূহলটা যে এখন আমার মিটে গেছে, তেমন নয়। তবে একটা প্রশ্নের জবাব আমি পেয়েছি সেখানকার লোকসঙ্গীতের কয়েকজন কিংবদন্তীর জবানবন্দী থেকে। ভাটির দেশ খ্যাত সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জের কিয়দংশ ঘিরে এতো সমৃদ্ধ কবি-মালজোড়া গান, বাউল, জারি-সারি, ভাটিয়ালি ও বিচ্ছেদ গানের উর্বরভূমি কীভাবে গড়ে ওঠলো? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি অবিভক্ত বাংলার লোকসঙ্গীতের কিংবদন্তী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের (১৯১২-১৯৮৭) লেখা ‘উজান গাঙ বাইয়া’ গ্রন্থটি সংগ্রহ করি। বইটি পড়ে জানতে পারি, তাঁর সঙ্গীতের মূল অনুপ্রেরণা হলেন পাগল দ্বিজদাস ও তাঁর শিষ্য হরিচরণ আচার্য্য। তাঁদের কবিগান শুনে ছেলেবেলায় তিনি মাতোয়ারা হয়ে ওঠেছিলেন। তাঁদের গানে বুঁদ হওয়ার পথ থেকে আমৃত্যু ফিরতে পারেননি।

তাঁর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, খুব ছোটোবেলায় পূজা ছিলো তাঁর আনন্দের অন্যতম সঙ্গী। সে-সময় তাঁদের জমিদার বাড়ির নাটমন্দিরে পাগল দ্বিজদাস আর হরিচরণ আচার্য্যরে কবিগান ছিলো অন্যতম আকর্ষণ। কবিয়ালরা পানসি নৌকায় চড়ে পূজার সময় তাঁদের বাড়িতে এসে গান গাইতেন। দোহারা-নট্ট সহকারে তারা যখন বাড়িতে আসতেন, তখন পুরো হবিগঞ্জ জুড়ে হৈচৈ পড়ে যেতো। হাজার হাজার মানুষ কবিগান শুনতে আসতেন। এদের শিডিউল ঠিক রাখার জন্যে পূর্ব থেকেই জমিদার হরকুমার বিশ্বাস বায়না করে রাখতেন।

কবিয়াল দ্বিজদাস ছিলেন একজন তাত্ত্বিক ব্যক্তি। তিনি গান গাওয়ার চেয়ে কবিগান রচনা, কবির জবাব, টপ্পা প্রভৃতি রচনায় ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। প্রচ্ছন্ন কবি হিসেবে গানের আসরে তিনি অনেক টপ্পা, গান মুখে মুখে রচনা করে দিতেন। তিনি যার পক্ষে থাকতেন, সেই কবিয়াল গানের আসর মাত করতে পারতেন। যার কারণে অবিভক্ত বাংলায় তাঁর কদর ছিলো সবচেয়ে বেশি। অনেক কবিয়াল দিনের পর দিন তাঁর কাছে বসে থাকতেন গান কিংবা টপ্পা লিখে নেয়ার জন্যে। বাস্তবে দেখা গেছে, যে-কবিয়াল যতো বেশি দ্বিজদাসের কাছ থেকে টপ্পা ও গান লিখিয়ে নিতে পারতেন, তিনি গানের আসর ততো মাত করতে পারতেন। এর জলজ্যান্ত উদাহরণ হলেন অবিভক্ত বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিয়াল হরিচরণ আচার্য্য কবিগুণাকর (১৮৬১-১৯৪১)। তিনি নিজে একজন প্রতিভাবান ও দক্ষ কবিয়াল ছিলেন। এর সঙ্গে গানের গুরু দ্বিজদাসের লেখা গান, জবাব ও টপ্পা যোগ করে তিনি প্রতিটি আসর মাতিয়ে তুলতেন। ডাকছড়া গেয়ে দর্শক শ্রোতাদের মন জয় করে নিতেন।

পাগল দ্বিজদাস নিয়ে বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম (১৯১৬-২০০৯) চমৎকার একটা মূল্যায়ন করেছেন। সিলেটের খ্যাতনামা সাংবাদিক ও লোকগবেষক সুমন কুমার দাশ ভাটির লোকসঙ্গীত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছেন। এই সংক্রান্ত তাঁর অনেকগুলো গবেষণা গ্রন্থ রয়েছে। দ্বিজদাসের গান নিয়েও তাঁর গবেষণা রয়েছে। সেখানে তিনি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, শাহ আবদুল করিম পাগল দ্বিজদাসের গানের অত্যন্ত অনুরক্ত ছিলেন। তাঁর সঙ্গীত জীবনে দ্বিজদাসের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর গান গেয়ে আসর জমাতেন। ভাটির দেশের বিভিন্ন স্থানে পাগল দ্বিজদাসের অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী সঙ্গীতের প্রভাব ছিলো প্রকট। তাঁর লেখা গান ছিলো দর্শক-শ্রোতাদের কাছে লোভনীয়। ভাটির দেশে কোথাও তাঁর গান হলে নানা স্থান থেকে সেখানে হাজার হাজার দর্শক হাজির হতেন। সেটা আর কোনো কবিয়াল বা শিল্পীর ক্ষেত্রে ঘটেনি। শাহ আবদুল করিম গান রচনার আগে, শিল্পী জীবনের প্রথমদিকে, দ্বিজদাসের গান গেয়ে গ্রাম্য আসর থেকে শুরু করে সারস্বত সমাজ মাত করেছিলেন। শাহ করিমের উত্থানের পেছনে দ্বিজদাসের গান যে জাদুর মতো কাজ করেছিলো, সেটা করিম বিভিন্ন আলোচনা, বিতর্ক কিংবা সাক্ষাতকারে নির্মোহভাবে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

ভাটির দেশের আরেক কালজয়ী সঙ্গীতজ্ঞ দূরবীন শাহ (১৯২০-১৯৭৭) ছিলেন পাগল দ্বিজদাসের গানের অনুরক্ত। তিনিও শাহ করিমের মতো বিভিন্ন আসরে দ্বিজদাসের গান গাইতেন। তাঁর গান গাইতে গাইতেই দূরবীন শাহ একসময় বাউল সাধক হয়ে ওঠেন। দূরবীনের ছেলে আলম শাহ সুমন কুমার দাশের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, তাঁর বাবা পাগল দ্বিজদাসের অনুসারী ছিলেন। দ্বিজদাসের গান তাঁর নমস্য ছিলো। তাঁর গানের খাতায় নিজ হাতে দ্বিজদাসের কিছু গান লিখে রেখেছিলেন। তিনি পাগল দ্বিজদাসকে গানের মুর্শিদ হিসেবে গণ্য করতেন।

মালজোড়া গানের জন্ম ভাটির দেশ নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন বাউল ও লোকসঙ্গীত শিল্পীদের মাধ্যমে। শুধু সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলেই নয়, নেত্রকোণা-কিশোরগঞ্জ এলাকায় মালজোড়া গানের যে-প্রভাব-প্রতিপত্তি, সেখানেও পাগল দ্বিজদাসের প্রভাব প্রকট ছিলো। সেখানকার কিংবদন্তীতুল্য বাউল রশিদ উদ্দিন (১৮৮৯-১৯৬৪), উকিল মুন্সি (১৮৮৫-১৯৭৮) ও জালাল খাঁ (১৮৯৪-১৯৭২) প্রমুখ ছিলেন পাগল দ্বিজদাসের গুণমুগ্ধ। একসময় নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জের আনাচে-কানাচে শিল্পীরা পাগল দ্বিজদাসের গান গাইতেন। অনেক শিল্পী-গীতিকার তাঁর গানে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেই ঘরানায় অনেক গান লিখেছেন। নেত্রকোণার বাউল সুনীল কর্মকার আর সালাম সরকাররা এখনো দ্বিজদাসের গানকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন। সেখানকার অত্যন্ত গুণীজন উকিল মুন্সি, রশিদ উদ্দিন আর জালাল খাঁর অসংখ্য কালজয়ী গান থাকার পরও পাগল দ্বিজদাসের গানের মূল্য আকাশচুম্বি। অনেক নবীন শিল্পীর গানের খাতা নিরীক্ষা করলে দু-চারটা দ্বিজদাসের গান পাওয়া যাবে। বাউল, কবিগান, মুর্শিদী ও ভাটিয়ালি গানের তাত্ত্বিক পুরুষ হিসেবে তাঁরা দ্বিজদাসের গানকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়ে থাকেন। পাগল দ্বিজদাসের পারিবারিক নাম শ্রী বৈকুণ্ঠনাথ চক্রবর্তী (১২৫২-১৩৪২ বঙ্গাব্দ)। পাগল দ্বিজদাস তার কবিনাম। এই নামের ভনিতায়ই তিনি গান রচনা করতেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, বৈকুণ্ঠনাথ চক্রবর্তী শিবপুরস্থ যোশর পাদরী এস্টেটের নায়েব হিসেবে চাকুরি করতেন। এই পাদরী এস্টেটটি ছিলো নাগরী খ্রিস্টানপল্লী পর্তুগীজ জমিদারির একটি অংশ। তিনি সেই জমিদারির একজন নায়েব হয়ে কৃষকের পক্ষে গান লিখতেন।

দ্বিজদাসের জন্মস্থান পারুলিয়া গ্রাম ছিলো প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী একটি সমৃদ্ধ গ্রাম। অনেক ভাবুক, সাধক, পণ্ডিত ও ইংরেজি শিক্ষিত লোকের বাস ছিলো সেখানে। প্রাচীনকালে টোল-চতুষ্পাঠীর জন্যে পারুলিয়ার নাম বিক্রমপুর, নদীয়া, কমলাকান্ত (কুমিল্লা), বোয়ালিয়া (রাজশাহী) প্রভৃতি স্থানের সঙ্গে তুলনীয় ছিলো। তেমন টোল-চতুষ্পাঠীতেই পাগল দ্বিজদাস প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেন। ছোটোবেলা থেকেই তিনি ভাবুক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। একাডেমিক শিক্ষা বাদ দিয়ে তিনি প্রকৃতি, স্রষ্টা, সৃষ্টি রহস্য, রূপবৈশিষ্ট্য, সমাজ-সংস্কৃতি, জন্ম-মৃত্যু, রোগ-শোক ও মনুষ্য জগতের বিচিত্র ঘটনাবলি নিয়ে ভাবতে থাকেন। একপর্যায়ে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োজিত হয়ে ইহলোক-পরলোক নিয়ে গভীর ভাবনায় নিয়োজিত হন। এটাকে পূর্ণাঙ্গতা দিতে তিনি বাড়ির পাশে উঁচু ঢিবিতে গড়ে তোলেন ‘শক্তিমঠ’ নামে একটি আধ্যাত্মিক সাধনা কেন্দ্র। তা একসময় সারা ভারতবর্ষের খ্যাতিমান কেন্দ্রে পরিণত হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে সাধক, বাউল, আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব, ধার্মিক, পণ্ডিত প্রমুখরা সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেন। তাঁদের সাধন-ভজন ও থাকা-খাওয়ার জন্যে তিনি বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে দেন। আশ্রমের আদলে মাটির ঘর আর গাছ-গাছালি আবৃত ‘শক্তিমঠ’ ভাবুকদের কাছে ‘শান্তিনিকেতন’ হয়ে ওঠে। পারুলিয়ার চক্রবর্তী বংশ সে-সময় ধনে-মানে বেশ সম্পদশালী। তাই দ্বিজদাস শক্তিমঠের খরচ যোগাতেন তালুকদার তহবিল থেকে। দেশি-বিদেশি অনেক আধ্যাত্মিক সাধক, সাধু-সন্ন্যাসী শক্তিমঠে অবস্থান করে সাধন-ভজন করতেন। যেখানে ধর্মীয় শাস্ত্র, অঙ্ক, জ্যোতিষশাস্ত্র, সংস্কৃত শ্লোক, স্রষ্টা, সৃষ্টিতত্ত্ব ও জীবন-মৃত্যুর রহস্য বিষয়ক শিক্ষা দেয়া হতো। সেখানেই পাগল দ্বিজদাস আধ্যাত্মিক জ্ঞানচক্ষু লাভ করেন। সাধনার মাধ্যমে সৃষ্টি-স্রষ্টার রহস্য, জন্ম-মৃত্যুতত্ত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনার খোরাক পান। একই সঙ্গে সঙ্গীত রচনা শুরু করেন। সঙ্গী হিসেবে পান শ্রী জ্ঞানানন্দ গোস্বামী নামে আরেক পণ্ডিতকে। তিনি পারুলিয়া তথা নরসিংদী এলাকার মানুষ ছিলেন না। পণ্ডিতের ভিটা নামে খ্যাত চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে তিনি পাগল দ্বিজদাসের ডাকে সাড়া দিয়ে পারুলিয়ায় চলে এসেছিলেন। তাঁকে স্থানীয়ভাবে দ্বিজদাসের দক্ষিণহস্ত হিসেবে গণ্য করা হতো।

জ্ঞানানন্দ গোস্বামী প্রথমে শক্তিমঠের কর্মাধ্যক্ষ হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে শক্তিমঠের পাশাপাশি সেখানে ‘শ্রীকৃষ্ণ পাঠশালা’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন দ্বিজদাস। তাঁকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেন জ্ঞানানন্দ গোস্বামী। সঠিকভাবে শক্তিমঠ ও শ্রীকৃষ্ণ পাঠশালা প্রতিষ্ঠার সময়কাল জানা না গেলেও পাঠশালাটি ইংরেজি স্কুল হিসেবে ঘোষিত হয় ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে। বর্তমানে শ্রীকৃষ্ণ পাঠশালা নামটি পুরোনো দলিল-দস্তাবেজ ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। উঁচু টিলার উপর শ্রীকৃষ্ণ পাঠশালার জায়গায় সাইবোর্ড উঠেছে পারুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের। একই সঙ্গে শক্তিমঠটি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। পারুলিয়ার অনেক শিক্ষিত ও গুণীজনের সঙ্গে কথা বলে এই ধ্বংসযজ্ঞের কারণ জানতে পারিনি। এমনকি পাগল দ্বিজদাসের বাড়িঘর কীভাবে প্রভাবশালী মহলের কব্জায় চলে গেছে, সে-বিষয়ে মুখ খোলার কাউকে পাওয়া যায়নি। এতোকিছুর পরও পাগল দ্বিজদাসকে দুনিয়া থেকে একেবারে মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। উত্তরসুরীদের মাধ্যমে তাঁর গান, পদ, ছড়া, মালসী ও ডাক বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে। অনেকের হৃদয়ে রাখা আছে দ্বিজদাসের গান। সেখান থেকে তা বের করে এনে আর ধ্বংস করা যাবে না। পাগল দ্বিজদাস ছিলেন একজন যুক্তিবাদী, বস্তুবাদী মানবিক মানুষ। তাঁর গানের মাধ্যমে সেটাই প্রমাণিত হয়। সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব বিষয়ক অনেক গান রচনা করে তিনি বিষয়টিকে এক রহস্যময় বিষয় করে তুলেছেন। যুক্তিবাদকে তিনি বুকে ধারণ করে অসংখ্য গান লিখেছেন। যার সিংহভাগই হারিয়ে গেছে। যা অক্ষত আছে, সেটা টিকিয়ে রাখার কৃতিত্ব হলো শক্তিমঠের কর্মাধ্যক্ষ জ্ঞানানন্দ গোস্বামীর। তিনি প্রথমবার দ্বিজদাসের গানগুলো সংকলনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে। ‘শক্তিমঠ গ্রন্থমালা-১’ নামে তিনি প্রথমবার ১৭৫ টি গান সংকলন করেন সেই বইয়ে। বইয়ের আখ্যাপত্রে উল্লেখ করা হয় :

পাগল
দ্বিজদাসের গান।

শ্রীযুত বৈকুণ্ঠনাথ চক্রবর্ত্তী
বিরচিত

প্রথম সংস্করণ

প্রকাশক—
ব্রহ্মচারী শ্যামানন্দ।
পো. : পারুলিয়া, ঢাকা।
১৩৩২।

সর্ব্বস্বত্ব সুরক্ষিত       মূল্য— পাঁচ সিকা।

Printed by Gopal Chandra De
at The Hena Press, Lakshmibazar,
Dacca.

পাগল দ্বিজদাসের গান’ বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন জ্ঞানানন্দ। আসলে এই নামটি শক্তিমঠের কর্মাধ্যক্ষ জ্ঞানানন্দ গোস্বামী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি সংক্ষেপে নাম লিখতেন জ্ঞানানন্দ। ভূমিকায় তিনি লিখেন :

আমি কবি অথবা গায়ক নহি। সুতরাং গানের ভাল-মন্দ বিচার করিবার অধিকার আমার নাই। তবে কবি অথবা গায়েকরা যে গান রচনা করেন, তাহা শুধু তাঁদের নিজেদের জন্য নহে, আমাদের সকলের। এই ভরসাতেই সাধারণ জ্ঞানের দিক দিয়া আজ দ্বিজদাসের গান সম্বন্ধে দু’ একটি কথা বলিব।
প্রথমেই বলিয়া রাখি, পারুলিয়ার স্বনামধন্য শ্রীযুত বৈকুণ্ঠনাথ চক্রবর্তী মহাশয় নিজেকে দ্বিজদাস পরিচয় দিয়া এই গানগুলি রচনা করেন। মহা-পাগলেরাই এমন করিয়া নিজের নামের আকাঙ্ক্ষাকে কাজের পশ্চাতে লুকাইয়া রাখিতে চাহে। তাই প্রকাশক দ্বিজদাসকে পাগল খেতাব দিয়াছেন। পৃথিবীর মহাপ্রাণ ব্যক্তিদের আর এক নাম পাগল।
‘দ্বিজ-দাসের গান’ বাঙ্গলার পূর্ব্ব প্রান্তে বহু পূর্ব হইতে প্রচলিত। বাউল সম্প্রদায়ের অনেকেই এই গান গাহিয়া দেশ দেশান্তরে ভিক্ষা সংগ্রহ করে। অধিকাংশ গানের বর্ণিত ঘটনা সমূহ কবি বৈকুণ্ঠনাথের নিজের জীবনের উপর দিয়া ঝড়ের ন্যায় বহিয়া গিয়াছে বলিয়াই গানগুলি এমন করিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। ঘটনার স্রোতের সহিত কবি আপনাকে ভাসাইয়া দিতে পারিয়াছিলেন বলিয়াই আজ ঐ গানে উন্মাদনা আসে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনুভূতির তরঙ্গ-সঙ্গে নিজে নৃত্য করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়াই আজ ঐ গান মর্ম স্পর্শ করে। সমাজ, ধর্ম ও দেশের আকুলতায় কবি নিজে ব্যাকুল হইয়া গাহিয়াছিলেন বলিয়াই আজ ঐ গানে চোখে জল আসে, ঘন ঘন রোমাঞ্চ হয়, পলকে পলকে পুলক জন্মে। এক কথায় বৈকুণ্ঠনাথের গান তাঁর কর্ম ও অনুভূতির উলঙ্গ বিকাশ। বৈকুণ্ঠনাথ চিরকাল খেয়ালে চলিয়াছেন। তাই যখন যাহা সত্য বলিয়া বুঝিয়াছেন, জন-মতের অপেক্ষা না করিয়াও তাহা নির্ভয়ে প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁর প্রাণের ও গানের এই সারল্যে আমি মুগ্ধ। তাঁর ধর্মমত মহান, উদার। নিদর্শনÑ ‘হরি কি কালী বলা ভুল’। সমাজ-মত সঙ্কীর্ণতা-রহিত। পরোপকার তাঁর দৈনিক ব্রত। তাঁর গানে বাঙ্গালার তথা বাঙ্গালীর খাঁটি প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যায়।
‘দ্বিজ-দাস’ বৈকুণ্ঠনাথ আজও জীবিত। বয়স প্রায় আশীর কাছাকাছি। অদ্যাপি চশমার প্রয়োজন হয় না। শিশুকালে মাতৃ-হীন, পিতার দুলাল ছিলেন। তথাপি তাঁকে জীবন সংগ্রামে বুঝিতে হইয়াছিল যে, ‘মানুষ মনীব ভয়ানক জীব’। সংসারে তাঁর দুই গৃহিণী, আজও সমভাবে বর্ত্তমান। আত্মজ পুত্র নাই, দত্ত্ক গ্রহণে পিন্ড রক্ষার বন্দোবস্ত করিয়াছেন। সংসারকে হাড়ে হাড়ে চিনিবার মতন সকল সুযোগই তাঁর ছিল। তাই তিনি বুঝিয়াছেন ‘ধনী আর রমণী জীবন্তে খায় প্রাণ’। বৈকুণ্ঠনাথ জীবনে অনেক উপার্জন করিয়াছেন, ব্যয়ও যথেষ্ট করিতেন। তাঁর অন্নে অনেক গরীব পরিবার প্রতিপালিত হয়।
‘পারুলিয়া শক্তিমঠ’ তাঁর শেষ জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। মঠের অধিকাংশ ভূমি বৈকুণ্ঠনাথের দান।
বৈকুণ্ঠনাথ দ্বিজের সেবায় আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। তাই তিনি স্বেচ্ছায় ‘দ্বিজ-দাস’ নামে আত্ম-পরিচয় দিয়াছেন।
কবি বা গায়কের রচিত গানের বইয়ের ভূমিকায় রচয়িতার সংক্ষিপ্ত জীবন-কথা আনুষঙ্গিক না হইলেও নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক নহে। বিশেষত: আত্ম-গোপন পটু ‘দ্বিজ-দাস’ বৈকুণ্ঠনাথ যে আজ নিজের রচিত গীতি-মাল্যে ভূষিত হইয়া হাতে হাতে ধরা পড়িলেন, ইহাতেই আমার আনন্দ।
নানা কারণে বইখানা অত্যন্ত ক্ষিপ্রতা সহকারে প্রকাশিত হয়। ফলত: অনেক স্থলে গ্রাম্যতা-দুষ্ট শব্দগুলির পরিবর্তন ঘটিয়া উঠে নাই। স্থানে স্থানে মুদ্রাকর-প্রমাদও রহিয়া গিয়াছে। তথাপি প্রার্থনা করি, ‘পাগল দ্বিজদাসের গান’ বাঙ্গালার প্রতি পল্লী বাট মাতাইয়া তুলুক, রাজপথ মুখরিত করুক, ঘরে ঘরে বিরাজিত হোক।

‘শক্তিমঠ’।                   ইতি—
তারিখ— মহাকাল।         শ্রীনারায়ণে—
তিথি— মহামায়া।           জ্ঞানানন্দ

১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার সালমা বুক ডিপো থেকে ‘পাগল দ্বিজদাসের গান’ বইটির একটি সস্তা সংস্করণ বের করা হয়। এতে প্রথম সংস্করণের ৩৩ টি গান বাদ দেয়া হয়। তবে এই সস্তা সংস্করণে নতুন করে ৪ টি গান সংযুক্ত করা হয়। এসব অসঙ্গতি কিছুই সালমা বুক ডিপোর সংস্করণে বলা হয়নি। ১২ টাকা মূল্যের নিউজপ্রিন্টের ছাপা বইটিতে দ্বিজদাস সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। তবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ২০১২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘বাউল-ফকির উৎসব কমিটি’ কর্তৃক ‘পাগল দ্বিজদাসের গান’ বইটি ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে পারুলিয়া শক্তিমঠ থেকে প্রকাশিত বইয়ের অনুরূপ। প্রথম সংস্করণের দাঁড়ি-কমা পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের বইয়ে অনুসরণ করা হয়েছে। এই বইয়ের ভূমিকা থেকে জানা যায়, পাগল দ্বিজদাসের পৌত্রী ছিলেন শ্রী লক্ষ্মী চক্রবর্তী। তারই ছেলে গৌতম চক্রবর্তী প্রথম সংস্করণটি বাউল-ফকির উৎসব কমিটির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। লক্ষ্মী চক্রবর্তী বইটি পেয়েছিলেন তাঁর কাকিমা মায়া চক্রবর্তীর কাছ থেকে। এতে বোঝা যায়, পাগল দ্বিজদাসের বংশধররা পারুলিয়া ছেড়ে ভারতের কোচবিহার গিয়ে বসতি স্থাপন করার সময় সর্বস্ব হারালেও পূর্বপুরুষদের মেধার সৃষ্টি স্বরচিত বইটি যক্ষের ধনের মতো বুকে লালন করেছিলেন। যার কারণে একশত বছরের পুরোনো সেই মহামূল্যবান দলিলটি নতুন করে প্রকাশিত হয়েছে। সেই মহামূল্যবান দলিলের ভূমিকায় পার্থ মজুমদার উল্লেখ করেন, “নরসিংদী তার বাউলদের জন্য বিখ্যাত। পাগল দ্বিজদাস সেখানকারই লোক আর তাঁর গান বহুকাল ধরে বাউলদের মুখে মুখে ফিরছে। তিনি কখনো আসরে গান গাইতে যেতেন না। জমিদারী সেরেস্তার কর্মাধ্যক্ষ হিসাবে কাজ সামলাতেন আর পদ রচনা করতেন। সেই পদ বাউলদের মুখে মুখে সারা বাঙলায় ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে উল্লেখ্য, পাগল দ্বিজদাস তাঁর সাংসারিক জীবনে দুটি বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু তাঁর ঔরসজাত কোনো সন্তান ছিলো না। তিনি একজন পুত্রসন্তান দত্তক নিয়েছিলেন। ধারণা করা যায়, লক্ষ্মী চক্রবর্তী তারই মেয়ে।

পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত বইয়ের সংস্করণে একটি চিঠি ছাপা হয়, যা লিখেছিলেন আইনসভার সদস্য ও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রায়বাহাদুর গিরিশচন্দ্র নাগ। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগের বাবা। তিনি ম্যাজিস্ট্রেসি জীবনের উপর ভিত্তি করে লিখেছিলেন ‘ডেপুটি জীবন’ গ্রন্থটি। তিনি পাগল দ্বিজদাসের গান শোনার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। যার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তিনি দ্বিজদাসকে চিঠিটি দিয়েছিলেন। যা তাঁর পালকপুত্রের বংশধরদের কাছে সংরক্ষিত ছিলো। চিঠিটি নিম্নে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি।

শ্রীচরণকমলেষু—
আজ একটি বিষয় আপনাকে লিখিতে ইচ্ছা হইল। আপনাকে অযথা তোষামোদ করিবার অভিপ্রায়ে নয়, আপনার গুণাবলীর কথা মনে হওয়াতেই লিখিতেছি।
কয়েক মাস পূর্বে আমি ‘ঢাকা শক্তি ঔষধালয়ের’ অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত মথুরা মোহন চক্রবর্তী মহাশয়ের স্বামীবাগের কারখানায় বাৎসরিক উৎসবে নিমন্ত্রিত হইয়া তথায় গিয়াছিলাম। সেখানে বাউল সঙ্গীত হইতেছিল। একদল বাউল গায়ক বড় মনোহর দেহতত্ত্ব বিষয়ক অতি উৎকৃষ্ট গান শুনাইয়াছিল। ঢাকার অনেক গণ্যমান্য লোক তথায় উপস্থিত ছিলেন। গানগুলি অতি মনোহর বোধ হওয়ায় আমি জিজ্ঞাসা করিলাম গানগুলি কার রচিত? তখন তাহারা বলিল, অধিকাংশ গান আপনার রচিত। আপনাকে আমি একজন দক্ষ জমিদারের কর্মকুশল কার্য্যাধ্যক্ষ বলিয়া জানতাম; কিন্তু গানগুলি শুনিয়া বুঝিলামÑ আপনি একজন ভাবুক, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক কবি। আপনার প্রতি আমার ভক্তি বর্ধিত হইল। আমি উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলীকে আপনার পরিচয় দিলাম। তাঁহারাও একবাক্যে আপনার প্রশংসা করিলেন। দেহতত্ত্ব, বৃন্দাবনলীলা, অদ্বৈত ও দ্বৈতবাদ, সাকার নিরাকার প্রভৃতি মীমাংসা অতি মনোমুগ্ধকর ভাষাতে আপনার গানে করিয়াছেন। ভাষা যেমন সরল তেমন মধুর। আপনি আমাদের দেশে গোপন থাকিয়া এমন সুন্দর কবিত্ব প্রকাশ করিয়াছেন, ইহা দেখিয়া আমি বড় আহ্লাদিত হইলাম। আপনি এ সব গান কোন গ্রন্থাকারে প্রকাশ করিয়াছেন কি না, জানি না। না করিয়া থাকিলে সত্বর প্রকাশ করা উচিত। সাহিত্য জগতে উহা অত্যন্ত আদৃত হইবে। যদি কোন বই থাকে, তাহা হইলে আমি একখানা বই পাইতে লালায়িত। আমার মনের প্রকৃত ভাব লিখিলাম। আপনাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে নয়। ইতি—

10E, Qieemswau Raosoma
Delhi
2nd, March, 1924

সেবক
(স্বাক্ষর) শ্রীগিরিশ চন্দ্র নাগ।

প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ, লোকগবেষক ও ইতিহাসবিদ মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান তাঁর ‘নরসিংদীর লোককবি’ গ্রন্থে পাগল দ্বিজদাস সম্পর্কে কিছু অভূতপূর্ব তথ্য উপস্থাপন করেন। সেই তথ্যমতে, পাগল দ্বিজদাস টাঙ্গাইলের আটিয়া পরগণার জমিদার এস্টেটের নায়েব হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেখানকার জমিদার ছিলেন অত্যাচারী ও অযোগ্য। খাজনা আদায়ের জন্য প্রজাদের উপর নির্যাতন চালাতেন। যার কারণে তিনি সেখানে বেশিদিন চাকুরি করেননি। সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে তাই তিনি গান বাঁধলেন :

ইস্তফা করি নায়েবগিরি, আমি চাই না এ চাকুরি আর।
নাহি বুঝ ভালো-মন্দ তুমি নিজে অন্ধ জমিদার।।
১ নম্বর আটিয়া পরগণা, কেহ আটিয়া ওঠেনা।
আমার আগে কত জনা পালিয়েছে পদ্মাপার।

আটিয়া জমিদারের নায়েবের চাকুরি ছেড়ে এসে তিনি যোশর পর্তুগীজ জমিদারি এস্টেটের নায়েব হিসেবে যোগদান করেন। নায়েবের কাজ করলেও প্রজা নিপীড়ন কখনো সমর্থন করেননি। কাজকর্মে করিৎকর্মা ছিলেন বলে খ্রিস্টান পাদরীরা তাঁকে তেমন ঘাটাতেন না। অপরদিকে দ্বিজদাস স্বাধীনচেতা হিসেবে কবিগান নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তবে অনেক সময় কৌশলে প্রজাদের খ্রিস্টান জমিদারদের হাত থেকে রক্ষাও করতেন।

তেমন একটি ঘটনা নিম্নে বর্ণিত হলো। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে কালীগঞ্জের নাগরী-ধর্মপল্লীর পর্তুগীজ জমিদার হাতিতে চড়ে যোশর কাচারিতে আসতেন। মূলত খাজনা আদায়ের তদারকি করার জন্যেই আসা। বাকি খাজনা আদায় করার জন্যে জমিদারি এস্টেটের বিভিন্ন গ্রামে সফর করতেন পাইক বরকন্দাজসহ। একবার খাজনা অনাদায়ের কারণে পাদরী জমিদার ছুটাবন্দ গ্রামে ছুটলেন। হাতির গলায় ঘণ্টা বেজে চলেছে। এই আওয়াজে অনেক প্রজা ভয়ে গ্রাম ছেড়ে গেলেন। কিছু প্রজা সঙ সেজে অদ্ভুত পোশাক পরে হাতির গায়ে ঢিল ছুঁড়তে লাগলেন। এতে জমিদার রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠলেন। পাইক-পেয়াদারা প্রজাদের উপর লাঠিচার্জ করার প্রস্তুতি নিলো। ঠিক তখনই নায়েব বৈকুণ্ঠনাথ চক্রবর্তী তথা পাগল দ্বিজদাস বুদ্ধি খাটিয়ে বললেন, জমিদার মহাশয়, এরা আসলে পাগল, তাই এমন ব্যবহার করছে। এদের বেশভূষা দেখেন না কেমন বিশ্রী। পাগলের সঙ্গে কি বিবাদ করা সাজে? পাদরী জমিদার নায়েব দ্বিজদাসের কথা শুনে শান্ত হলেন। বললেন, সত্যিই এরা বদ্ধ পাগল। পাগলের আবার খাজনা কীসের? চলো সবাই কাচারিতে ফিরে যাই। এভাবে দ্বিজদাস তাঁর মানবিক গুণ ও বুদ্ধি দিয়ে ছুটাবন্দ গ্রামের অসহায় প্রজাদের রক্ষা করেছিলেন।

কবিগানের আসরে মুকুটহীন সম্রাট ছিলেন পাগল দ্বিজদাস। কণ্ঠে গান না তুলেও অসংখ্য গান, টপ্পা, ছড়া রচনা করে কবিয়ালদের মাথার তাজ হয়ে বেঁচে ছিলেন। তাঁর শিবলিঙ্গের টপ্পা, অগ্নিদেব ঘরজামাইয়ের টপ্পা, বসুমতির টপ্পা একসময় সারাদেশ মাতিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেগুলো হারিয়ে গেছে। তিনি কবিগানের আসরে ছুটে যেতেন। কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই কবিদের প্রশ্ন ও উত্তর বাতলে দিতেন। ছড়া, টপ্পা, গান রচনা করে দিতেন। একবার শিবপুর এলাকার নৌকাঘাটা গ্রামে হিন্দুপাড়ায় হরিচরণ আচার্য্য ও আলগীর পঞ্চানন আচার্য্যরে কবিগান হয়। পাগল দ্বিজদাস তখন অদূরবর্তী যোশর কাচারিতে ছিলেন। তিনি নৌকাঘাটা গ্রামে উপস্থিত হলেন। তিনি সন্তানতুল্য শিষ্য হরিচরণ আচার্য্য কবি গুণাকরকে সেখানে গান, ছড়া, টপ্পা প্রভৃতি যোগান দেওয়ায় সেই আসরে পঞ্চানন আচার্য্যরে পরাজয় ঘটেছিলো।

শিষ্য হরিচরণ আচার্য্যকে অবিভক্ত বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিয়াল হিসেবে গড়ে তোলার নেপথ্য কারিগর ছিলেন গুরু পাগল দ্বিজদাস। তেমন আরো অনেক কবিগানের আসরে তিনি ছুটে গেছেন শিষ্যের মাথায় আশীর্বাদের হাত রাখার জন্যে। হরিচরণ আচার্য্যও গুরু দ্বিজদাসকে পিতৃতুল্য জ্ঞান করতেন। হরিচরণ ‘বঙ্গের কবির লড়াই’ বইটি গুরু পাগল দ্বিজদাসকে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন, “আপনি দেশবিশ্রুতে পরম রসজ্ঞ কবি। আপনার ছদ্ম নামের ‘দ্বিজদাসের গান’ কাব্যজগতের অমূল্য সম্পদ। আপনার মর্ম্মস্পর্শী রচনা কৌশল অতুলনীয়। আপনি আমাকে পুত্রাধিক স্নেহ করেন। কবিগান আপনার চিরপ্রিয়-কাব্য-সাহিত্যে আমার যা কিছু সুকৃতি তাহা আপনারই প্রতিভা প্রভাবের ফল।”

কবিগানের মুসলমানকরণই মালজোড়া গান। ভাটির দেশের মুসলিম কবিয়ালরা মালজোড়া গানের প্রবর্তক। এর মধ্যে নেত্রকোণার রশিদ উদ্দিনকে কেউ কেউ মালজোড়া গানের পথিকৃৎ বলে থাকেন। যা পরবর্তীতে বাউল গান হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। এলাকাভেদে বাউল গান কোথাও শরীয়তি-মারফতি, কোথাও বিচার গান, কোথাও পালাগান আবার কোথাও বয়াতি গান হিসেবে পরিচিত। ঢোল, হারমোনিয়াম, দোতারা, বেহালা, সারিন্দা, মন্দিরা, বাঁশি সহযোগে সারারাত পক্ষ-প্রতিপক্ষ গান গেয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেন। এতে দোহারের উপস্থিতিও থাকে। ভাটির দেশ ছাড়াও কবিগান বা মালজোড়া গানের একটি বড়ো ঘরানা রয়েছে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর দক্ষিণপাশে, বামনসুর গ্রামে। যা দেওয়ান ঘরানা হিসেবে পরিচিত। শত শত বাউল শিল্পী এই ঘরানার অধীনে গান গেয়ে আসর মাত করে যাচ্ছেন। বামনসুর গ্রামের দেওয়ান ঘরানার আদিপুরুষ হলেন আলফু দেওয়ান। তিনি একজন আধ্যাত্মিক সাধক এবং লোক- সঙ্গীতের খ্যাতিমান শিল্পী। তাঁর দুই সন্তান মালেক দেওয়ান ও খালেক দেওয়ান প্রায় ৩ হাজার বাউল, মুর্শিদী, বিচ্ছেদ, ভাটিয়ালি প্রভৃতি গান লিখে এবং মঞ্চে পরিবেশন করে সুনাম অর্জন করেছেন। তাঁদের তৃতীয় পুরুষ আরিফ দেওয়ান, মাখন দেওয়ানসহ আরো অনেকে বাউল গানে খ্যাতি অর্জন করেছেন। এদের মধ্যে খালেক দেওয়ান ও তাঁর শিষ্য মাতাল কবি রাজ্জাক দেওয়ান বাউল বা আধ্যাত্মিক গানকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তাঁদের লেখা ও সুর দেওয়া অনেক গান এখন বাংলার সর্বত্র গাওয়া হয়। এমনকি পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের গান নিয়মিত গাওয়া হয়। মাতাল রাজ্জাক এবং তাঁর গুরু খালেক দেওয়ান ছিলেন পাগল দ্বিজদাসের অনুরক্ত। তাঁরা প্রথম জীবনে পালাগান বা বাউল গানে দ্বিজদাসের অসংখ্য গান গেয়ে আসর মাত করেছিলেন। তাঁদের গানের খাতায় দ্বিজদাসের অনেক গান লিপিবদ্ধ থাকতো। তাছাড়া তাঁদের লেখা গানে দ্বিজদাসের গানের অনেক প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। তাঁরা মনে করতেন, দ্বিজদাসের মতো সহসী, অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী সঙ্গীতজ্ঞ বাংলায় বিরল।

লেখাটি শেষ করবো একটি ঘটনা দিয়ে। বামনসুরের খালেক দেওয়ান তখন ভারবর্ষব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন। কলকাতা এইচএমভি থেকেও তাঁর গানের রেকর্ড বের হয়েছে। গ্রাম বাংলার বিয়েতে খালেক দেওয়ানের গান রেকর্ডে না বাজালে সেই বিয়ে ভেঙে যেতো। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই খালেক দেওয়ানের কাছে গান শেখার জন্যে ভিড় করতে থাকতেন। তেমন দুজন ছাত্র ছিলেন অন্ধ গায়ক শামসু দেওয়ান ও পাগল বাচ্চু। দুজনেই পরবর্তীতে বাংলায় বাউল গানের আসর মাত করে সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হন। এই পাগল বাচ্চু পরে বাংলায় ‘পাগল’ পদবী দিয়ে নতুন ঘরানার সৃষ্টি করেন। তাঁর ছোটো ভাই মনির হোসেনও ‘পাগল মনির’ নাম ধারণ করে বাউল-বিচ্ছেদ গানে নাম করেন। তাঁরও অনেক শিষ্য-সাগরেদ গানের আসরে গুরুর নাম-যশ বজায় রাখছেন। তবে এই ‘পাগল’ উপাধিটা গায়ক বাচ্চু পেলেন কোথায়? এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে আবার খালেক দেওয়ানের কাছে ফিরে যেতে হবে। তিনি যখন অসংখ্য শিষ্যকে বাউল, মারফতি গান শেখাতেন, তাঁদের মধ্যে বাচ্চুকে তাঁর আলাদা প্রতিভার মনে হয়েছে। ভবিষ্যতে সে যোগ্য শিষ্য হয়ে ওঠতে পারবে বলে ‘পাগল’ সম্বোধন করতেন তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু পাগল দ্বিজদাসকে স্মরণ করে। গুরুর ভবিষ্যতবাণী প্রমাণ করেছিলেন পাগল বাচ্চু।


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

পাগল দ্বিজদাসের গান

0

বৈকুণ্ঠনাথ চক্রবর্তী। মাতৃহারা; পিতার আদরের দুলাল। দুই বিবাহ করেছিলেন। নিঃসন্তান। পালক পুত্র ছিলো। ছিলেন রাজকর্মচারী। জমিদারের সেরেস্তাদার। কালীগঞ্জ-আড়িখোলা খ্রিস্টান মিশন, নরসিংদীর শিবপুরের যোশর কাচারি বাড়ি, দেওয়ান শরীফ খাঁ-জয়নব বিবির নগর নরসিংহপুর— এসব জায়গায় তাঁর কর্ম ও সম্পর্ক ছিলো বলে জনশ্রুতি। জ্ঞানানন্দ গোস্বামী, যিনি মাস্টার দা’ সূর্যসেনের সাথী। তিনি একবার এসেছিলেন বৈকুণ্ঠনাথের কাছে। দুজনে মিলে গড়ে তুলেছিলেন শিক্ষালয় ‘শ্রীকৃষ্ণের পাঠশালা’, ‘শক্তিমঠ’, দেবালয় ও চিকিৎসালয়।

বৈকুণ্ঠনাথের আড়ালে থাকার স্বভাব ছিলো। তাঁর উপার্জন যথেষ্ট ছিলো। মানুষের পাশে দাঁড়াতেন সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে। ছিলেন রাজকর্মচারী। আসা-যাওয়ার পথে গান লিখতেন। জ্ঞানানন্দ গোস্বামীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ‘শক্তিমঠ’ থেকে প্রকাশ করা হয়েছিলো ‘পাগল দ্বিজদাসের গান’। সংরক্ষণের অভাবে অনেক গান হারিয়ে গেছে। তাঁর আত্মীয়-স্বজনের অধিকাংশই ভারতে চলে গেছেন। তাঁরা গানগুলো সাথে করে নিয়ে গেছেন বলে মনে করা হয়। পৈতৃক ভিটা জন্মস্থান পারুলিয়ায় তাঁর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। চিকিৎসালয় নেই। শক্তিমঠ নেই। তবে পাঠশালাটি আছে নবরূপে। অত্র এলাকার আলোকবর্তিকা ঐতিহ্যবাহী ‘পারুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে।

দ্বিজদাস ও জ্ঞানানন্দ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘শ্রীকৃষ্ণ পাঠশালা’, যা বর্তমানে ‘পারুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে পরিচিত

বৈকুণ্ঠনাথ চক্রবর্তী সম্পর্কে যতোটুকু জানা যায়, ততোই ধোঁয়াশা বাড়ে। তাঁর সম্পর্কে প্রকৃত সত্য ও বিস্তারিত জানা একান্ত প্রয়োজন। যার স্মৃতিচিহ্নসহ সব মুছে গেছে। এমন একজন মহামানবকে কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে এই সমাজ, এই রাষ্ট্রের কি কোনো দায়িত্ব নেই?

বৈকুণ্ঠ গান লিখতেন ‘দ্বিজদাস’ ছদ্মনামে। নিদারুণ জীবন বাস্তবতা ও স্পষ্টভাষ্যে। গানের কথায় গভীর জীবনবোধ নিরপেক্ষ বাস্তবতার আলোকে তাঁকে বস্তুবাদী বলে থাকেন অনেকে। এ-কথার সত্যতা কতোটা? জানতে হলে ডুব দিতে হবে দ্বিজদাসের গানের ভুবনে। তাঁর গানের কথায় যেমন সত্যতা আছে, আবার আছে ভাবনার উদ্রেককারী অনেক উপসর্গ। বরাক নদীর জল যেখান থেকে বাংলায় প্রবাহিত হয়, দ্বিজদাসের জন্মস্থান থেকে সে-পর্যন্ত তাঁর গানের ব্যপক প্রভাব। গ্রামীণ জনপদে ও পদাবলির আসরে তাঁর গান প্রাণে শিহরণ জাগায়। নাগরিক সমাজেও তিনি সমাদৃত। হালের জনপ্রিয় বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম, দূরবীন শাহ প্রমুখ তাঁর গানে গভীরভাবে প্রভাবিত। প্রখ্যাত বাউল সাধক সুনীল কর্মকারসহ বর্তমানের প্রায় সব বাউল শিল্পীর মুখেই ভাসে দ্বিজদাসের গান। হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখেছেন তাঁর গান নিয়ে। কবিয়াল হরিচরণ আচার্য্য সরাসরি দ্বিজদাসের দীক্ষায় ধন্য হয়েছেন। জ্ঞানানন্দ গোস্বামী বামপন্থী ছিলেন। দ্বিজদাসের বাড়ি পারুলিয়া এলাকার অনেকেই বামপন্থী স্বদেশী আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। তাঁর গানের কথাকে বামপন্থীরা একান্ত আপন বলেই মনে করেন। সেই সাথে তাঁকে বস্তুবাদী বলে থাকেন অনেকে। তাঁর বিখ্যাত গান :

কেহ শোনো বা না-শোনো, মানো বা না-মানো,
তাতে আমার নাই কোনো লাভ-লোকসান।

শুনে যারে ওরে পাগল দ্বিজদাসের গান।

 

দ্বিজদাসের ভাবনায় সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে অমীমাংসিত সাবলীল উচ্চারণ আছে এ-গানে। এক পর্যায়ে অকপট উচ্চারণ :

কেহ বলে আছ তুমি, কেহ বলে নাই,
আমি বলি থাকো থাকো না থাকলে নাই।
…মানতে মানতে শাস্ত্র— পাই না অন্ন বস্ত্র,
লোটা বটি অস্ত্র ক্রমে তিরোধান
শুনে যারে ওরে পাগল দ্বিজদাসের গান।।

এ-কথার উপর ভিত্তি করেই তাঁকে বস্তুবাদী বলাটা যৌক্তিক হবে? নিজ ধর্ম চেতনায় অন্তিম পর্ব শ্মশানের কথা বহুবার এসেছে তাঁর কথায় :

তরুলতা কন্যার সাথে বিয়া হবে বিধি মতে
সমন ঠাকুর ঘটক তাতে, রাজ ঝোটক সম্মেলন
কর হে বিয়ার আয়োজন।

তাঁর গানের প্রতিটি কথাই গভীর চিন্তার উদ্রেক ও সাধনার পথ উন্মোচিত করে।

আমি বিনে তোমার কিসের বড়াই
আবার
পঞ্চত্বের কালে, পঞ্চে পঞ্চ মিলে
পাঁচ গেলে, পাছে রলো না রলো না।

দর্শনে স্পর্শনে শ্রবণে কি ঘ্রাণে
কিছুতেই না হয় ঠিকানা।

এ-গানগুলো প্রতিটি ভাবুক হৃদয়ে ভাবনার খোরাক জোগায়। তাঁর গানে মানুষ ও গুরু ভজনার কথাও এসেছে সহজ সারল্যে।

মানুষে মানুষ বিরাজে খুঁজে নেওয়া বড় দায়
মানিক চিনে, দুই এক জনে, শ্রীমহাজনের কৃপায়।

সংসারের যাতনা ও পারিপার্শ্বিক প্রভাব দ্বিজদাসকে তিক্ত স্বাদ দিয়েছিলো ষোলোআনা। গানে যার যথার্থ প্রমাণ রয়েছে অনেকটা অংশজুড়েই :

সংসারের সংসারী, মাইনা নাই চাকরী
এ ঝকমারি করে দেখেছি
এবার হলো যা হবার, বাকি নাই রে আর
সকাল সকাল গেলে বাঁচি।

এই জীবন-সংসারের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণাও প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কথায়। মৃত্যু-শ্মশান-অন্তিম যাত্রাÑ এসবে আচ্ছন্নতা প্রকাশ পায় :

এই যে সংসার সকলই অসাড়

পবনের যেদিন গতি রুদ্ধ হবে
ভুজঙ্গ গিয়া গুরুকে দংশিবে
পতঙ্গ সেই দিন মাতঙ্গে নাশিবে
সিংহের হবে শিয়ালের ভয়
একদিন নিরাকার হবে জলে জলাময়।

লালনের গান আর দ্বিজদাসের গানের মৌলিক পার্থক্য হলো, লালন যেখানে ভাববাদী, দ্বিজদাস সেখানে যুক্তিবাদী। লালনের গানে সাধন-ভজনের সাথে কর্মপরিণতি ও মুক্তির বাসনায় করুণ মিনতি আছে। আর দ্বিজদাসের আছে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর নিঃসঙ্কোচ অভিপ্রায়। দ্বিজদাস বলেছেন :

আমি তোমার অধীন, হই চিরদিন, তোমার প্রত্যাশী
আনিয়াছ, আসিয়াছি, যেতে বললে তৈয়ার আছি
নাচাইতেছ, নাচিতেছি, বসতে বললে বসি
তুমি করাও আমি করি, না করাইলে কি আর পারি
কাঁদাও যখন কেঁদে মরি, হাসাইলে হাসি
আমি কিসে দোষী দয়াল আমি কিসে দোষী।

তাঁর জন্মস্থান নরসিংদী-পলাশ-পারুলিয়ায় পূর্ব থেকেই বাউল-ফকিরদের পদচারণা ছিলো। ছিলো কবিগানের চারণভূমি। নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষের মিলে-মিশে বাস। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁরা একসাথেই থাকে। স্বাভাবিকভাবেই তা দ্বিজদাসকেও প্রভাবিত করেছে। এক জায়গায় লিখেছেন :

রাম রহিম না জুদা ভাবো আসল ঠিক রাখিও ভাই।

ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে দ্বিজদাস গভীর জ্ঞান রাখতেন, যা তাঁর গানের কথায় বিভিন্ন জায়গায় এসেছে।

এক বিনে দুজন নাই।

আবার মৃত্যু নিয়ে তাঁর কতো চমৎকার অভিলাষ :

যে জন জানে, মরণ কি বিষয়
মধুরেণ সমাপণ, তার মরণ মধুমেয়।

জন্মান্তরবাদ, সমাজ-সংসার, যুক্তি, কামতত্ত্ব, মানুষ ভজন, শ্যামাসঙ্গীত, দেশাত্ববোধক প্রভৃতি বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যময় গানের ঝাপি নিয়ে বাংলা সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করে গেছেন দ্বিজদাস। অথচ আজ কোথাও তাঁর স্মৃতিচিহ্নটুকু পর্যন্ত নেই। এর ফলে একদিকে তাঁর মহামূল্যবান সৃষ্টিগুলো যেমন হারিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে হচ্ছে বিকৃত ব্যবহার। তাঁর সৃষ্টি-সঙ্গীত ও সামাজিক অবদানগুলো সংরক্ষণ করে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে রাষ্ট্র উদ্যোগী হবে, এটাই প্রত্যাশা। শেষ কথা, দ্বিজদাসের স্বপ্নের ভাষায় আশাবাদী উচ্চারণ :

সময়ে ফুল ফুটবে সত্য
গোড়ায় জল ঢাল নিত্য।


মো. জাকারিয়া
কবি ও গবেষক।

আমীরগঞ্জের ইতিহাস | পর্ব ৩

0

ফরাজে ও লাখেরাজ ভূমি ও পত্তনী মালিকানা ১৪৭ টাকা মূল্যে বিক্রয়ের সাফ কবলা হইয়াছে বির্দ্দরী মির্জা মোহাম্মদ, পিতা- মৃত মির্জা মোহাম্মদ কাজেম, সাকিন- চান্দখার পোল ও শ্রীমতি বনী বেগম, পতি- শ্রী মৌলভী মকরেম আলী, সাকিন- বড় কাটারা, থানা- সদর, জাতি- মোসলমান, পেশা- তালুকদারী, জেলা- ঢাকা স্থানে লিখিতং, শ্রী মীর গোলাম হোসেন, পিতা- মৃত ইয়াদ ওয়ারেছ আলী, জাতি- মোসলমান, পেশা- জমিদারী, সাকিন- গের্দ্দ হুসনি দালান, ঢাকা সদর, জেলা- ঢাকা কোট মৌজাস্থিত লাখেরাজ জমি ও পত্তনী ও মিরাশি জমি ও ওয়ার্কফ ইষ্টাটের মোল হেবা ও হাবেলী ঘর তৎতহতি জমিন ইসাদি বিক্রয় সাফ কবলা পত্র মিদং কার্যাঞ্চে আমি আমার কন্যা মৃত মরিয়ম নেছা বেগমের ওয়ারিশপ্রাপ্ত নিম্ন তফসিলের লিখিত চৌহদ্দি ভুক্ত ষোল আনি বিত্তের দুই আনা অংশ অন্যের নিরাপত্তে মালিক দখলকার আছি ঐ বিষাদির দুই আনা হিস্যা আমি আপন অধিকার মতে উচিত মূল্য মবলক ১৪৭ টাকাতে সাফ বিক্রয় করার উদ্যত হইলে, তোমরা উক্ত মৃত বেগমের পুত্র ও কন্যা ও আমার দৌহিত্র দৌহিত্রি বিধায় এবং মৃত বেগমের বক্রি দুই আনা অংশের মালিক তোমরা যথায় আমা হইতে ঐ দুই আনা অংশের খরিদ করার উদ্যত হওয়ায় আমি আমার প্রাপ্য দুই আনা অংশের মধ্যে এক আনা অংশ তুমি মির্জা মোহাম্মদ নিকট মং ৭৩ টাকা আট আনা মূল্যে ও এক আনা অংশ তুমি শ্রী মতি বনি বেগম নিকট মং ৭৩ টাকা আট আনা মূল্যে একুনে উভয়ের নিকট মং ১৪৭ একশত সাত চল্লিশ টাকা নগদ দস্ত বদস্ত বেবাক বুঝিয়া পাইয়া আপন ইচ্ছায় ও সৎজ্ঞানের রাজি রগবতে বহাল তবিয়তে সাফ বিক্রয় করিয়া লিখিয়া দিতেছি ও অঙ্গিকার করিতেছি যে, নিম্নের তপসিলের লিখিত বিষাদির আমার প্রাপ্ত দুই আনা অংশ কাত তোমরা উপরোক্ত অংশানুসারে আপন ২ পুত্র ওয়ারিশ ও স্থলবর্তি গণক্রমে অংশানুসারে সদর খাজনা ও মিউনিসিপালিটি টেকস মতে আদায় করিয়া আমার নাম খরিজে আপন ২ নাম অংশ মতে রেজিষ্ট্রারী করিয়া প্রজা উঠাইয়া কি বানাইয়া রাস্তা বাগান বানাইয়া হাবেলী ইসাদি ভাংগিয়া কি উক্ত নাল করিয়া প্রজাগণ হইতে কর কবুলিয়ত লইয়া দিঘি পুস্কনি খনন করিয়া দান বিক্রয় সর্ব প্রকার কন্যধিকারী হইয়া পরম সুখে ভোগ বিনিত্তগ দান বিক্রয় দখল তছরূপ করিতে রহেন। নিম্ন লিখিত বিষাদির আমার ওয়ারিশ প্রাপ্ত উক্ত দুই আনা অংশে আমি ও আমার পুত্র পৌত্রাদি ওয়ারিশ ও স্থবর্ত্তি গণ ও ভাবি উত্তরাধিকারীগণের সর্ব প্রকার দাবী দাওয়া সম্পূর্নরূপে রহিল না ও রহিলেক না, করিলে অগ্রাহ্য হইবেক। আর প্রকাশ থাকে যে, নিম্নের লিখিত ২/৩/৪/৫ নং সম্পত্তি ভিন্ন অন্য কোনো সম্পত্তি কেহর নিকট দায়বদ্ধ নাই। তপছিলের লিখিত ২/৩/৪/৫ নং সম্পত্তি দায়বদ্ধ থাকা ও বক্রি সম্পত্তি নির্দায় অবস্থায় থাকা এবং তপছিলের লিখিত সমস্ত সম্পত্তি কেহর নিকট কোন বয়, হেবা ও দান বিক্রয় মিরাশ পত্তনী কি দর পত্তনি কি কম জমায় ইজারা ইসাদি করি নাই ও দেই নাই তাহা তোমাদের নিকট প্রকাশ করায় তোমরা আমার আত্মীয় বিধায় আমার কথা বিশ্বাস করিয়া বিনা অনুসন্ধানে ও বিনা যাচাইতে খরিদ করিলা যদি খরিদের পর আমার উল্লেখিত কোন কার্য প্রকাশ পায় তাহাতে তোমাদের অনিষ্ট ঘটে তাহা হইলে আমি আইনানুসারে ফৌজদারিতে দণ্ডনিয় হইব, এতদ্বার্থে মূল্যের সমস্ত টাকা অংশানুসারে তোমাদের স্থানে নগদ দস্ত বদস্তে বুঝিয়া পাইয়া আপন ইচ্ছায় দলিলের সমস্ত মর্মর্থ ভাল মত পাঠ করিয়া ও বুঝিয়া শুনিয়া অত্র সাফ কবলা লিখিয়া দিলাম। ইতি সন ১৩০৮ সন ২১ শে অগ্রাহায়ন তপছিল সম্পত্তি ১/১২৬৯ সালের ১৪ ভাদ্রের লিখিত মৃতে ছৈয়দ আলী মেহেন্দী খা বাহাদুরের স্ত্রী মৃত মরিয়ম বেগম সাহেবার ওয়ার্কফ নামার লিখিত জেলা ঢাকার কালেক্টরীর তৌজি ভূক্ত ৯৯৬৫ নং জমিদারী তপে রন ভাওয়াল হিঃ। চার আনা ১৫ গন্ডা মরিয়ম বেগম ও আমিনদ্দিন হায়দর ও ৬৪৪৭ নং ডেয়ারা বন্দবস্ত ভূমি চরকান্দা ও পাবনীরা ও রায়পুরা পোলিশ স্টেশন ও সাব রেজিষ্টারের অধীন জোয়ার হাসনাবাদ তাহার চার আনা নয় গন্ডা ও ৯৯৫৪ নং তালুকের হিঃ চার আনা ১৫ গন্ডা অংশ স্থাবর তাহার মোতাউল্ল আমি গোলাম হোসেন ঐ মোতাউল্ল ইষ্টেটের হইতে মৃত মরিয়ম নেছা বেগম বার্ষিক ৬০ টাকা মালিকানা পাওয়ার অধিকারী ছিল। ঐ ৬০ টাকা মালিকানা ষোল আনা বয়সে মৃত মরিয়ম নেছা বেগমের ওয়ারিশ সূত্রে দুই আনা অংশ আমি অত্র সিকিউরিটি ঐ দুই আনা অংশের রাখা ৭ টাকা ৫ আনা বার্ষিক মালিকান বিক্রি করিলাম (১২৯৮ সালের ১৯ পৌষের লিখিত পত্তনী কবুলত পাট্টা আবু আহাম্মদ আবদুল বাছেদ লকনগ মোতউল্লির পক্ষে উনছ খান, পিতা মৃত মৌলভী আলীমুদ্দিন আহম্মদ নিকট প্রাপ্ত ৯৯৬৫ নং জমিদারী তপে রনভাওয়াল হিঃ চার আনা ১৫ গন্ডা জমিদারী বনামে আমিরদ্দিন হায়দর ও মরিয়ম বেগম সদর জমা ১৭১৯ টাকা ছয় আনা ৮ পাই জেলা ঢাকার রায়পুরার পুলিশ ষ্টেশন ও সাব রেজিষ্টারের অধিন পোক্তার চর মধুয়া মধ্যে মৌজা বিরগাও ও আলিয়াবাদ ও লক্ষীপুরা ও মরিয়ম নগর ও গাজীপুরা গং পোক্তার হাসনাবাদ মধ্যে মৌজা ফতেপুর, দরি হাইর খারা ও বির হাইর খারা ও জেলা ত্রিপুরার অধিন দাউদকান্দি থানা ও সাব রেজিষ্টারের অধীন পোক্তার মৃজার চর ও মৌজা আমিরাবাদ ও ভিটিগাও বাঘাকান্দি ও গোদাকান্দি মৌজা রায়পুর ও সিন্দি ও মুরাদনগর পোলিশ ষ্টেশন ও সাব রেজিষ্টারের অধীন মৌজে খোয়ার চর ও জেলা ফরিদপুরের অধিন পালঙ্গের থানা সাব রেজিষ্টারের অধীন মৌজে পাইকতলি ও শখিপুরা ৯৯৫৪ নং তালুক খলিলের রহমান সদর পক্ষে ২১০ টাকা ৭ আনা ২ পাই যে নিযুক্ত আছে উক্ত তালুকের ভুমি জেলা ঢাকার রায়পুরার পোলিশ ষ্টেশন ও সাব রেজিষ্টারের অধিন পোক্তার হাসনাবাদ মধ্যে মৌজে নলবাটা ও আমির গঞ্জ ও করিম গঞ্জ ও আগানগর ও হাসনাবাদ মৌজে পূর্ব পারা ও পশ্চিম পারা ও বিঃ পূর্ব পারা ও মির কান্দি ও নেবুর কান্দি ও আট কান্দি ও হাট হাসনাবাদ উক্ত জমিদারী (৯৯৬৫ নং তালুক) ও তালুকের (৯৯৫৪ খারেজী তালুক খলিলুর রহমান) সোলা আনার সে হিঃ ৭ আনা ৮ গন্ডা মৃত মরিয়ম নেছা বেগমের মৃত মাতা খায়রুন নেছা ওরফে নতে বেগমের ওয়ারিশি মতে ও মৃত মরিয়ম নেছা বেগমের পিতা মির গোলাম হোসেনের হেবা সূত্রে ২ আনা ৮ গন্ডা একুনে ১০ আনা অংশ জাহা উক্ত সন তারিখের পত্তনী কবুলত পাট্টা অনুসারে সদর খাজনা ও পথবর পাবলিক ওয়ার্ক ছেদ ও ডাক টেকস ইসাদি বাদে জমিদারীর বার্ষিক পত্তনী খাজনা ১০০ টাকা তালুকের বার্ষিক পত্তনী খাজনা ৪৪ টাকা একজাই মং ১৪৪ টাকা মালিকানা খাজনা উক্ত আবু আহাম্মদ আবদুল বাছেদ নিকট পাত্তা ন্যায় উক্ত মালিকানা খাজনার টাকার মধ্যে ষোল আনা রকমের ২ আনা অংশে বার্ষিক মং ১৮ টাকা পাত্তা জায় তাহা…

এমতাবস্থায় ৯,৯৬৫ নং জমিদারি ঢাকা কালেক্টরিতে প্রায় ১৪ বছর অংশীদারদের যথাযথ স্বত্ব বণ্টনাধীনে থাকে তদোপলক্ষে মীর গোলাম হোসেন সাহেব এর কতোক অংশ (সম্ভবত শুধু খলিলুর রহমানের তালুক থেকে সৃষ্ট ১৩,১৭৩ নং মহালটি) বাংলা ১৩১২ সনের ২৯ শ্রাবণ তারিখে ওয়াকফনামাভুক্ত সম্পত্তি দাউদকান্দি থানার কাশীপুর গ্রাম নিবাসী পোকন চন্দ্র কর্মকারের পুত্র রাজচন্দ্র কর্মকারের নামে পত্তনী বিলি করেন, যা আইনত বে-আইনি ও অগ্রহণযোগ্য। কারণ, গোলাম হোসেন মরিয়ম বেগমের ওয়াকফ সম্পত্তির তার প্রাপ্য সমুদয় স্বত্ব ইতোপূর্বে বাংলা ১৩০৮ সনের ২১ অগ্রহায়ণ তারিখে বিক্রি করে দিয়েছেন। তদানুসারে রাজচন্দ্র কর্মকার ও তাহার ভ্রাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্র ঐ-সকল সম্পত্তি দখল করতে থাকে। প্রায় চার বছর পর রাজচন্দ্র কর্মকার উক্ত পত্তনপ্রাপ্ত ১৩,১৭৩ নং মহালের তালুকদারির স্বত্বের আট আনা অংশ ঢাকার ১৩ নং বেচারাম দেউরী নিবাসী মৌলভী আলীমুদ্দিনের নিকট বাংলা ১৩১৬ সনের ২২ মাঘ তারিখে বিক্রি করে দেন। উল্লেখ্য যে, এই মৌলভী আলীমুদ্দিনের জন্মস্থান হাসনাবাদ গ্রামে, তার পিতার নাম মৌলভী জমির উদ্দিন। তিনি ঢাকার নবাব বাড়িতে মুন্সির চাকরি করতেন এবং বগুড়ার নবাব বাড়ির নবাব কন্যাকে ছলচাতুরির মাধ্যমে বিবাহ করেন। তিনি আটকান্দির কুঠিবাড়ি মসজিদ নির্মাণ করেন। উল্লেখ্য যে, আমার গ্রাম আমীরগঞ্জ ও করিমগঞ্জের ১৩,১৭৩ নং তৌজি বা মহালের সেটেলমেন্ট জরিপের সিএস পর্চায় পত্তনী তালুকদারের নাম রাজচন্দ্র কর্মকার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। রাজচন্দ্র কর্মকারের ৪৬৮ নং তালুকের অংশ আট আনা এবং মৌলভী আলীমুদ্দিনের ৪৬৯ নং তালুকের অংশ আট আনা ও রাজচন্দ্র কর্মকার আবার তার তালুক নং ৪৬৮-র আট আনার খাজনা আদায় করে দেয়ার শর্তে অর্ধেক অর্থাৎ চার আনা আমীরগঞ্জ নিবাসী সদর উদ্দিন বেপারী গংদের নিকট দরপত্তন দেন। অর্থাৎ সদর উদ্দিন গং রাজচন্দ্রের অবশিষ্ট পত্তনী তালুকের খাজনা আদায় বাবদ ৪৬৮-ক নামীয় তালুকের একটি মধ্যস্বত্ব লাভ করেন।

এদিকে মির্জা মোহাম্মদ, মরিয়ম বেগমের মৃত্যুর প্রায় ৩৩ বছর পর মরিয়ম বেগম পাবলিক ওয়াকফ এস্টেটের মালিকানা ও দখল পুনরুদ্ধার নেয়ার নিমিত্তে অপেক্ষমান থাকেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা কালেক্টরিতে ওয়াকফ এস্টেটের বেনিফিশিয়ারি ও মোতয়াল্লী হিসেবে নিজের আইনগত ভিত্তি ও মালিকানার অধিকার অর্জনের অপেক্ষমান থাকাবস্থায় বৃটিশ সরকার কর্তৃক ১৯১৩ সালে ভারতীয় মুসলমান ওয়াকফ ভেনিডেটিং আইন গঠিত হয় এবং ১৯৩৪ সালের বঙ্গীয় ওয়াকফ আইন জারি হয়। কিন্তু ইতোমধ্যে কোনো-এক সময়ে মির্জা মোহাম্মদের মৃত্যু হয়। মির্জা মোহাম্মদের মৃত্যুর পর তার পুত্র মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ ঢাকা কালেক্টরির তৌজিভুক্ত ৯,৯৫৪ নং মহালের ষোলো আনা (চার আনা ১০ গণ্ডা) ও ৯,৯৬৫ নং মহালের (তিন আনা ১০ গণ্ডা)-সহ অন্যান্য মহালকে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করার জন্যে ১৪ঃয ঈডঘ কলিকাতা হাইকোর্টে এক আর্জি দায়ের করেন। ফলে কলকাতা হাইকোর্ট ‘মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেট’কে পাবলিক ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে বৈধ প্রমাণ করেন। তারপর তিনি কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিংয়ে অবস্থিত বঙ্গীয় ওয়াকফ প্রশাসকের কার্যালয়ে ১৯৩৪ সালের বঙ্গীয় ওয়াকফ আইনের ৪৪ ধারা মোতাবেক মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেটকে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার লক্ষ্যে বঙ্গীয় ওয়াকফ কমিশনার সাহেব বাহাদুর বরাবর প্রয়োজনীয় দালিলিক প্রমাণাদিসহ দরখাস্ত দাখিল করেন। ফলে মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেটকে বঙ্গদেশীয় মহামান্য ওয়াকফ বোর্ড ও কমিশনার কর্তৃক উক্ত এস্টেট ওয়াকফ আইনের ৪৬ (ক) ধারার বিধান মোতাবেক ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে মীমাংসিত হইয়া ওয়াকফ বোর্ডে রক্ষিত রেজিস্ট্রারিতে ৪,৭২১ নং ওয়াকফ এস্টেট হিসেবে ইনরোলড হয়। পরবর্তীতে মির্জা মোহাম¥দ আশরাফ ২২ নভেম্বর ১৯৩৭ তারিখে সেন্ট্রাল কোর্ট, ২ চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ে অবস্থিত ওয়াকফ বোর্ডের কমিশনার বরাবর কমিশনার কর্তৃক পূর্বে প্রেরিত পত্র, যার স্মারক নং সি/৮২৫১, তারিখ ১০ নভেম্বর ১৯৩৭-এর জবাবে মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেটের তার মালিকানার স্বপক্ষে ঢাকা কালেক্টরির ৯,৯৫৪ ও ৯,৯৬৫ নং তৌজিভুক্ত তালুকদার ও কবুলিয়ত প্রজাদের দুটি পৃথক তালিকাসহ দালিলিক প্রমাণাদি দাখিল করে তাকে উক্ত ওয়াকফ স্টেটের দখলদারের ক্ষমতা প্রদান ও মোতওয়াল্লী হিসেবে গ্রহণ করার জন্যে আবেদন করেন। আবেদনে তিনি ৯,৯৫৪ নং মহালের চার আনা ১০ গণ্ডা (ষোলো আনা) ও ৯,৯৬৫ নং মহালের তিন আনা ১০ গণ্ডা (ষোলো আনা) শেয়ার দাবি করে নির্দিষ্ট প্রজাদের নিকট থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে তার নামে দুটি মহালের নাম জারি করতে এবং ঢাকা কালেক্টরির ‘ডি’ রেজিস্ট্রার সংশোধন করতে ঢাকা কালেক্টরকে আদেশ প্রদান করার জন্যে অনুরোধ করেন। মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে মরিয়ম বেগমের ওয়াকফ সম্পত্তির মূল্য উল্লেখ করেছেন তৎকালীন সময়ের ২,০৫,০০০ টাকা। উপর্যুক্ত বিষয়ের প্রামাণিক দলিলাদির ছায়ালিপি এই নিবন্ধের লেখকের নিকট রক্ষিত আছে।

অবশেষে মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ তার আবেদনের প্রেক্ষিতে মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেটের ৯,৯৫৪ ও ৯,৯৬৫ নং তৌজিভুক্ত তালুকের মোট দশ আনার স্বত্ববান ও মোতয়াল্লী হিসেবে ওয়াকফ আইনের ৪০ ধারার বিধান মোতাবেক বেঙ্গল ওয়াকফ বোর্ডের কমিশনার কর্তৃক গণ্য হন।

অতঃপর মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ সম্পূর্ণ ওয়াকফ এস্টেটের মোতয়াল্লীভাবে দখল করে ঢাকা দ্বিতীয় সাব-জজ আদালতের ১৯৪০ সালের ২১ নং দেওয়ানী মোকদ্দমা স্থাপনে ডিক্রি লাভ করেন এবং ঢাকা কালেক্টরিতে ওয়াকফকৃত উপর্যুক্ত মহাল (৯,৯৫৪ এর ১৩,১৭৩, ১৫,৭৮৩ ও ১৫,৭৮৪ এবং ৯,৯৬৫ নং মহাল) ও অন্যান্য মহালসমূহের নামজারিক্রমে মোতওয়াল্লীভাবে মালিক ও দখলকার হিসেবে ঢাকা কালেক্টরিতে রক্ষিত ‘ডি’ রেজিস্ট্রার সংশোধন হয়ে মির্জা মোহাম্মদ আশরাফের নাম লিপিবদ্ধ হয়। উক্ত দ্বিতীয় সাব-জজ আদালতের উক্ত মামলার রায় ও ডিক্রি দ্বারা মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেটের ওয়াকফ প্রভৃতির বিরুদ্ধে যেসব হস্তান্তর বা অষরবহধঃরড়হ হয়েছে, উক্ত সমুদয় হস্তান্তরই আইনত পণ্ড, ভুয়া, তঞ্চকী ও যোগসাজসী বলে সাব্যস্ত হয়েছে এবং উক্ত ডিক্রিবলে উপর্যুক্ত ওয়াকফ মহালান্তর্গত যে সমুদয় পত্তনী, সিকিমী পত্তনী, দত্ত পত্তনী বা অন্য প্রকার স্থায়ী মধ্যস্বত্বের লিপি সেটেলমেন্ট জরিপী (সিএস) রেকর্ডে প্রকাশ পায়, তা সমুদয়ই পণ্ড, ভুয়া, বে-আইনি, তঞ্চকী ও যোগসাজসী। অতঃপর তিনি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ঢাকার কোর্ট বরাবর বিবাদী রাজচন্দ্র কর্মকারের বিরুদ্ধে একটি মিস কেইস (নং ৬৪) দাখিল করেন, পূর্বের বে-আইনিভাবে নামজারি বাতিল ও মরিয়ম বেগমের ওয়াকফ এস্টেটের মোতওয়াল্লী হিসেবে তার ব্যক্তিগত বার্ষিক আর্থিক ভিত্তি নির্ধারণের জন্যে। বার্ষিক আর্থিক ভিত্তি নির্ধারণের পর মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ রাজচন্দ্র কর্মকার, আলীমুদ্দিন মৌলভী ও অন্যান্য ভূমধ্যধিকারীর নিকট অদ্যাবধি ১ নং তফসিলের তার আইনত প্রাপ্ত জোতের ষোলো আনার অর্থ এবং ২ নং তফসিলের সমুদয় পথকরসহ বকেয়া কর পরিশোধের জন্যে তাগাদাপত্র প্রেরণ করেন। কিন্তু বিবাদীগণ উক্ত টাকা পরিশোধ করেন নাই। ফলত পরবর্তীতে মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ উপর্যুক্ত বে-আইনি হস্তান্তরের জন্যে দাতা মীর গোলাম হোসেন ও হস্তান্তর গ্রহীতা পত্তনী তালুকদার রাজচন্দ্র কর্মকার, ভূমধ্যধিকারীর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চাহিয়া ঢাকা মুন্সেফ আদালতে এক নালিশী মামলা দায়ের করেন। এদিকে আমীরগঞ্জ, করিমগঞ্জ ও নলবাটায় রাজচন্দ্র কর্মকার থেকে চার আনা দরপত্তনধারী সদর উদ্দিন বেপারীগণ খাজনা আদায়ের চেষ্টা করলে আমীরগঞ্জ নিবাসী আফসার উদ্দিন মৌলভী, ছৈযুদ্দিন মৌলভী, সুরুজ খা এবং করিমগঞ্জের কাবিল মৃধা, পিতা : আলাবক্স মৃধা, ওয়াকফ সম্পত্তিতে বে-আইনিভাবে পত্তন পাওয়া জমিতে খাজনাদি পরিশোধে অস্বীকার করেন এবং সদর উদ্দিন বেপারী গংদের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ মুন্সেফ আদালতে নালিশী মামলা দায়ের করেন, যা এই প্রতিবেদক খাঁ বাড়ির রুকুন উদ্দিন খাঁ’র মুখে ও অন্যান্য বয়স্কদের মুখে শুনেছেন।

প্রাপ্ত উপর্যুক্ত কার্যাদি সমাধান্তে পূর্ব বাংলায় কৃষক প্রজা পার্টি আনিত জমিদারি উচ্ছেদ তথা রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এসে যাওয়ায় মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ জমিদার সাহেব মরিয়ম বেগমের জমিদারি ও খলিলুর রহমানের খারেজী তালুকের নিজ স্বত্ব ও মোতয়াল্লী হিসেবে বেশি সুবিধা করতে পারেননি। খাজনা আদায়ের রশিদ প্রমাণে দেখা যায়, এ-জনপদে মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ ২৪ আষাঢ় ১৩৬৫ বঙ্গাব্দ তারিখ পর্যন্ত কর্মচারীসহ নিজে খাজনাদি আদায় করতে পেরেছিলেন। অবশেষে মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ ১৯৮১ সনের ১৭ জুলাই ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন (মৃত্যুসনদ মোতাবেক)। মৃত্যুকালে তিনি পাঁচ ছেলে ও দুই কন্যা রেখে যান। প্রথম পুত্রের  নাম মির্জা খোরজো আয়ায, দ্বিতীয় পুত্রের নাম মির্জা খুসরু, তৃতীয় পুত্রের নাম মির্জা খোরুম, চতুর্থ পুত্রের নাম মির্জা দিলশাদ ও পঞ্চম পুত্রের নাম মির্জা নেহাল। কন্যাগণ হলেন নাজমা ও নিজাকাত। পুত্রদের মধ্যে দুজন জীবিত আছেন। একজন ইরানে বসবাস করেন এবং বাংলাদেশে মির্জা নেহাল সাহেব সপরিবারে বসবাস করছেন। জাতীয় পরিচয়পত্রে মির্জা নেহাল সাহেবের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে ১ নং ইটাওয়ালা ঘাট, ইসলামবাগ পশ্চিম, লালবাগ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা। এনআইডি নং ২৩৫৯১৪০০২৩। বর্তমানে তিনিই বাপ-দাদাদের হারানো জমিদারির প্রামাণি, দলিল-দস্তাবেদ সংরক্ষণ করছেন, যদি কখনো হারানো জমিদারি পুনরুদ্ধার বা ক্ষতিপূরণ আদায়ে প্রামাণ্য দলিল-দস্তাবেজের প্রয়োজন হয়।

উপর্যুক্ত আলোচনা, বিভিন্ন প্রামাণিক দলিল-দস্তাবেজ, তৎকালীন ভূমি বন্দোবস্ত, একসালা, দশসালা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন ও ওয়াকফ আল আওলাদ আইন পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, আমার আমীরগঞ্জ গ্রাম বা এ-জনপদে স্থানীয় কোনো ভূস্বামী জমিদার বা তালুকদার শ্রেণির কেউ ছিলো না। দাউদকান্দির রাজচন্দ্র কর্মকার এই জনপদের খলিলুর রহমান নামীয় খারেজী তালুকের কিয়দাংশ (যা মরিয়ম বেগমের জমিদারি ও পরে মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেট হিসেবে গণ্য ছিলো) অবৈধভাবে মীর গোলাম হোসেন থেকে পত্তন নিয়েছেলেন। তবে একসময়ের হাসনাবাদ নিবাসী আটকান্দি মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মৌলভী আলীমুদ্দিন এবং তার সুযোগ্য পুত্র মৌলভী আবু আহম্মদ বাছেতের মির্জানগর, আটকান্দি, বীরকান্দি, আব্দুল্লাপুরসহ ঢাকার কেরানীগঞ্জের মতো দূর জনপদে কয়েকটি বৈধ তালুক ছিলো, যা তিনি ইংরেজ নীলকর ও মুঘল ঘরানার জমিদার থেকে পত্তন নিয়েছিলেন। আলীমুদ্দিন মৌলভী তার পত্নী (বগুড়ার নবাবের মেয়ে) বিয়োগের পর আমীরগঞ্জ ও করিমগঞ্জের ১৩,১৭৩ নং মহালের তার আট আনার অংশ ওয়াকফ করে দেওয়ায় উক্ত গ্রামদ্বয়ের রায়তদের কোনো খাজনা পরিশোধ করতে হয় নাই। অনেকেই আমীরগঞ্জের সদু বেপারী গংদের দৃষ্টিনন্দন দ্বিতল কোঠাবাড়ি ও একতলা বৈঠকখানা দর্শন করে সদু বেপারী গংদের জমিদার মনে করে বিভ্রান্ত হন। মূলত তারা ছিলেন হলুদ, গুড়, পাটের বেপারী ও রেলওয়ে জমির ইজারাদার এবং  অবৈধ ও বে-আইনিভাবে প্রাপ্ত পত্তনী তালুকদার রাজচন্দ্র কর্মকারের অবশিষ্ট আট আনা পত্তনী তালুকের চার আনার মধ্যস্বত্বাধিকারী, যা তারা রাজচন্দ্র কর্মকারের পক্ষে খাজনা আদায় করার শর্তে প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তবে মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ মরিয়ম বেগমের জমিদারির আইনগত মোতওয়াল্লী হলে এবং আমীরগঞ্জ ও করিমগঞ্জের রায়তগণ সদু বেপারী গংদের খাজনা দিতে আপত্তি জানালে সদু বেপারী গং এই মধ্যস্বত্বের কোনো ফায়দা নিতে পারেন নাই। রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ পাশ হয়ে গেলে ১৯৫৭ সাল থেকে ভূমির মালিকানা হয়ে যায় রাষ্ট্রের। তখন থেকে বঙ্গীয় কৃষক ও রায়তগণ জমিদার ও তালুকদারদের পরিবর্তে রাষ্ট্রকে খাজনা দিতে শুরু করেন। (সমাপ্ত)


আমির হোসেন
গবেষক, আয়কর পরিদর্শক

আমীরগঞ্জের ইতিহাস | পর্ব ২

0

রাণী ভিক্টোরিয়ার আমলে ভূমি বন্দোবস্ত (১৮৫৭-১৯৪৭)
পরবর্তীকালে খলিলুর রহমান তালুকের অংশীদারদের উত্তরাধিকার বা বেনেফিশিয়ারগণ হাসনাবাদ মৌজায় আমীরগঞ্জ বা হাসনাবাদ বাজারের মূল অংশ তিনজন ভূমধ্যধিকারীর নিকট কবুলত পাট্টা দেন। পূর্বোক্ত হাসনাবাদ বাজারস্থ তিনটি  সিএস পর্চার খতিয়ান নং যথাক্রমে ৩৭৫, ৩৭৬, ৩৭৭।  সিএস পর্চার ক্রমানুসারে এই তিনটি ভূমধ্যধিকারীগণ হলেন (খতিয়ানের ক্রমানুযায়ী) আমীরগঞ্জের সোনা উল্লাহ ভূঁইয়া (পিতা : কোবাদ ভূঁইয়া), রহিমাবাদের হরচন্দ্র সাহা (পিতা : কিশোর সাহা) ও আমীরগঞ্জের সদর উদ্দিন বেপারী (পিতা : আছান উল্লাহ বেপারী)। খলিলুর রহমান তালুকের পশ্চিম অংশ, আড়িয়াল খাঁ নদের তীরঘেঁষা বর্তমান আমীরগঞ্জ ও বৃহত্তম করিমগঞ্জ, ১৩১৭৩ নং মহালটিকে রাজচন্দ্র কর্মকারের নিকট পত্তনী তালুক হিসেবে পত্তন দেয়া হয়। বর্তমানে উক্ত গ্রামদ্বয়ের সিএস পর্চা তার সাক্ষ্য বহন করছে। উল্লেখ্য, উপর্যুক্ত খলিলুর রহমানের খারেজী তালুকটি বিস্তৃত ছিলো আমীরগঞ্জের পূর্ব ও পশ্চিম চক করিমগঞ্জ, নলবাটা, আগানগর, হাসনাবাদ পূর্বপাড়া, পশ্চিমপাড়া, মীরকান্দি (বীরকান্দি), নেবুরকান্দি, আটকান্দি ও হাসনাবাদ বাজার পর্যন্ত। পরে আমার এক অনুসন্ধানে তার সঠিক ইতিহাস বের হয়ে আসে, যার বিস্তারিত বিবরণ সামনে পর্যায়ক্রমে আসবে। এ-সকল গ্রাম ছিলো খলিলুর রহমান তালুকের ৪ আনা ১০ গণ্ডার অংশ, যা জমিদার মরিয়ম বেগমের অংশ। অবশিষ্ট অংশ ছিলো অন্যান্য শরিকগণের। এখানে উল্লেখ্য যে, মৃত মরিয়ম বেগমের ১৩১৭৩ নং মহালের রায়ত ছিলেন পুটিয়ার রাম কুমার নাথ (ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছেÑ থানা : রায়পুরা, জেলা : নরসিংদী) নরসিংদী সদর উপজেলাধীন বীরপুরের রামারুদ্দিন, মুলকজান, রাধা গোবিন্দ সাহা ও হরি গোবিন্দ সাহা। বর্তমান এ-নিবন্ধ লেখার (১১ এপ্রিল ২০২২) খানিক পূর্বে আমার অগ্রজ জাকির ভাই (দলিল লেখক)-এর কল্যাণে আমাদের গ্রামের এক কৃষক পরিবার কর্তৃক জমিদারদের জমির খাজনা প্রদানের প্রমাণপত্র (প্রজার অংশ) দাখিলা আমার হস্তগত হয়। ২৪ আষাঢ় ১৩৬৫ বঙ্গাব্দ তারিখে আদায়কৃত ১৩৬০-৬১ বাংলা সনের খাজনার লিখিত দাখিলা পাঠে দেখা যায়, জিলা ঢাকা কালেক্টরির তৌজিভুক্ত ১৩১৭৩ নং মহাল, ১০ ওয়াকফ এস্টেট, থানা : রায়পুরা, ৩৭২ নং মৌজা হাসনাবাদ প্রকাশ রণভাওয়াল হিং ১, ষোল আনা মালিক দখলকার মোতোয়াল্লী মৌলভী মির্জ্জা মোহাম্মদ আশ্রাফ জমিদার সাহেব, সাকিন : ২৫ নং বড় কাটারা, থানা : লালবাগ, ঢাকা। উক্ত দাখিলায় মরিয়ম বেগম জমিদারির নিচে ব্র্যাকেটবন্দী খারিজা তালুকদার খলিলুর রহমানের নাম উল্লেখ আছে, প্রজার নাম ছমির খা (পিতা : মৃত আমির খাঁ, গ্রাম : আমীরগঞ্জ। দাখিলায় যার মাধ্যমে খাজনা প্রদান করা হয়েছে, তার দস্তখতে নাম লিখা আছে রুকুন উদ্দিন খাঁ (পিতা : ছমির খা)। সেই হিসেবে রুকুন উদ্দিন খাঁ’র সাথে দাখিলার সত্যতা নিয়ে আমার সাথে কয়েকবার আলাপচারিতা হয়। তিনি জানান, তিনি নিজে এই স্বাক্ষর দিয়েছেন এবং মির্জা মোহাম্মদ আশ্রাফকে স্বচক্ষে দেখেছেন। এটি পাওয়ার পর আমার এ-জনপদের পূর্বের জমিদার ও তালুকদারদের ধারণা পাল্টে যায় এবং আমি এ-জনপদের ভূমি মালিকানা ইতিহাসের এক তমসাচ্ছন্ন অধ্যায়ে পড়ি। ভাবতে থাকি, কে কার থেকে পত্তনী নিয়েছেন? এই জনপদের সিএস পর্চায় উল্লেখিত রাজচন্দ্র কর্মকার কার থেকে পত্তনী নিয়েছেন?  কারণ, দাখিলা পাঠে জানা যায় যে, এ-জনপদ ঢাকা (২৫ নং বড় কাটারা, থানা : লালবাগ) নিবাসী মুঘল অমাত্যের বংশধর মরিয়ম বেগমের ওয়াকফ এস্টেট এবং এই মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেটের সর্বশেষ মোতয়াল্লী ও মালিক হলেন মির্জা মোহাম্মদ আশ্রাফ। কয়েক বছর পূর্বে আমার চাচাতো ভাই জনাব কাঞ্চনের কাছে স্থানীয় জমিদারদের নাম জানতে চাইলে তিনি ঢাকার লালবাগের এক মির্জা আলীর নাম বলেন, যিনি আমীরগঞ্জে আগমন করতেন মরিয়ম বিবির মাজারের বাতি খরচ নিতে। কাঞ্চন ভাই তার পিতা রমিজ উদ্দিন মুন্সির সাথে বালক বয়সে এই মির্জাকে সিকদার বাড়ি (বর্তমান চুন্নু ও ইকবাল ভাইদের বাড়ি), বড় বাড়ি (সদু বেপারীর বাড়ি) ও খাঁ বাড়িতে দেখতে পেয়েছেন। দাখিলা পাঠের পর প্রাচীন ঢাকার উল্লিখিত ঠিকানায় সফর করার ইচ্ছে জাগে। কিন্তু সরকারি চাকরি ও আমার অসুস্থতা এই সফরের প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। গত ১ এপ্রিল ২০২২ তারিখের কয়েক সপ্তাহ পূর্বে আমি ২৫ নং বড় কাটারা সফর করি এবং জমিদার মির্জা মোহাম্মদ আশ্রাফের খান্দানের সত্যতা পাই এবং তাঁর পুত্র-কন্যাদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করি। আরো জানতে পারি যে, ২৫ নং বড় কাটারা, জমিদার মির্জা মোহাম্মদ আশ্রাফের বসত বাড়িটি ও তার পাশের ভিটি ১৯৮৬ সালে হাজী মোহাম্মদ সেলিম (একসময়ের বিএনপির এমপি, পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের এমপি) কমিশনার থাকাবস্থায় খরিদ করে নিয়েছেন, যা বর্তমানে ৩০ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়। গত ১ এপ্রিল ২০২২ তারিখে বিকাল ৪ ঘটিকায় মরিয়ম বিবি ওয়াকফ এস্টেটের মোতোয়াল্লী মির্জা মোহাম্মদ আশ্রাফের ছেলে মির্জা নেহালের সাথে দেখা হয় এবং তার সাথে মরিয়ম বিবির জমিদারি ও ওয়াকফ এস্টেট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং তিনি মরিয়ম বিবির জমিদারি ও ওয়াকফ এস্টেটের প্রায় সমস্ত দালিলিক প্রমাণাদির ফটোকপি আমাকে দেন। উক্ত প্রমাণাদি প্রাপ্তির পর উক্ত জনপদে জমিদারি ও তালুকদারির ইতিহাস আমাকে নতুন করে লিখতে হচ্ছে। প্রমাণাদি পর্যালোচনা করে অবগত হওয়া যায় যে, আমাদের এই জনপদসহ অন্যান্য স্থানের জমিদার ছিলেন মরিয়ম বেগম, যার ঢাকা কালেক্টরির তৌজি নং ৯৯৬৫ (সদর জমা ছিলো ১৭১৯ টাকা)। তবে রায়পুরার কয়েকটি ইউনিয়নে আমির উদ্দিন হায়দার ও মরিয়ম বেগমের যৌথ জমিদারি ছিলো। গুগলক্রমে বরদাখাত (ত্রিপুরার একটি পরগণার নাম) লিখে সার্চ দিলে একটি ফিচার আসে, সেখানে উপরে লেখা আছে, গভর্নমেন্ট গেজেট ১৮৯৪ সাল ১৩ই মার্চ এবং মরিয়ম বিবি হিং। ১৫ (চার আনা ১৫ গণ্ডা) পরগণা রণভাওয়াল, তৌজি নং ৯৯৬৫ নং জমিদারির অংশ দেখতে পাওয়া যায়। এই মরিয়ম বিবির জমিদারি বিভিন্ন জেলায়, বিভিন্ন পরগণায় তালুক অবস্থান ছিলো। যেমন : সাবেক ত্রিপুরা হালে কুমিল্লার হোমনা, মুরাদনগর ও দাউদকান্দি, সাবেক ফরিদপুর জেলার বেদেরগঞ্জ, সাবেক ত্রিপুরা জেলার হালে নারায়ণগঞ্জ জেলার বৈদ্যের বাজার, বর্তমান নরসিংদীর সাটিরপাড়ার তালুকদারের (সাটিরপাড়া বয়েজ ও গার্লস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ললিতমোহন রায় গং)-এর ঢাকা জিলার কেরানীগঞ্জের ২৭৬ নং তালুক, ঈশানচন্দ্র পাল গংয়ের ২৭৩ নং তালুক, মৌলভী আলীমুদ্দিন আহম্মদের ২৭৪ ও ২৭৭ নং তালুক, মৌলভী আবু আহাম্মদ আবদুল বাছেদের (যিনি মৌলভী আলীমুদ্দিনের পুত্র) ২৭৫ নং তালুক, আছমতন্নেছার ২৭৮ নং তালুকসহ সবই তপ্পা রণভাওয়াল পরগণাস্থিত, যার ভূমির অবস্থান ছিলো ঢাকা কেরানীগঞ্জ থানার ২৭৯ নং কামারঘোপ মৌজাস্থÑ এ-সকল ভূমিই মরিয়ম বিবির জমিদারি থেকে বন্দোবস্ত নেওয়া। জাহাঙ্গীরনগর পরগণার লালবাগ থানার লাখেরাজ এস্টেট, যার একজন মধ্যস্বত্বাধিকারী ছিলেন রায় আনন্দলোচন মিত্র, যা মরিয়ম বিবি ভারত সম্রাট থেকে লাখেরাজ সম্পত্তি হিসেবে বংশ পরস্পরায় মালিক হয়েছিলেন। এ-জনপদের পূর্বোক্ত আরেকজন তালুকদার ছিলেন, যার নাম খলিলুর রহমান। তার তালুকটি খারেজী তালুক ছিলো, যা অন্য কোনো বৃহৎ তালুক থেকে বের হয়ে নতুন মালিকানা সৃষ্টি হওয়াকে বোঝায়। এ-তালুকের অবস্থান ও জোত কবুলতদের বাসস্থান ছিলো বর্তমান রায়পুরা থানার আমীরগঞ্জ (বর্তমানে লেখকের জন্মস্থান) বৃহত্তর করিমগঞ্জ, হাসনাবাদ ও হাসনাবাদ বাজার, নলবাটা, আগানগর, মির্জানগর, আটকান্দি, চরসুবুদ্ধি, হাইরমারা ইউনিয়নসহ বীরকান্দি, মেহেন্নাঘর, আদিয়াবাদ, খাস উল্লাহ, পুটিয়া ও বীরপুরে (নরসিংদী)। খলিলুর রহমান তালুকের ঢাকা কালেক্টরির তৌজি নং ৯৯৫৪ এবং তার  (খারেজী তালুক খলিলুর রহমান), যার সদর জমা ২১০ টাকা। এ-তালুকে হাসনাবাদ মৌজাস্থ আরেকটি ঈশানচন্দ্র পালের ১০৪ নং মধ্যস্বত্ব দেখতে পাই, যার জোতের মালিক ছিলেন সোনা গাজী এবং দখলদার নাম হরিচরণ নাথ (পিতা : মৃত স্বরূপ নাথ)। এই খারেজী তালুকটি বিভিন্ন মহালে যেমন : ১৩১৭৩, ১৫৭৮৩ ও ১৫৭৮৪-এ বিভক্ত ছিলো। উক্ত তালুকের চার আনা ১০ গণ্ডার মালিক ছিলেন এই মরিয়ম বিবি। উপর্যুক্ত পরগণায় বিভিন্ন তালুক নিয়ে গঠিত ছিলো মরিয়ম বিবির জমিদারি।

কে এই জমিদার মরিয়ম বেগম
মরিয়ম বেগমের পিতার নাম জানা না গেলেও তার এক ভাইয়ের নাম ছিলো ইয়াদ ওয়ারেছ। তিনি মীর গোলাম হোসেনের পিতা ছিলেন। মরিয়ম বেগমের স্বামীর নাম সৈয়দ আলী মেহেন্দী খাঁ বাহাদুর, মেয়ের নাম খায়রুন নেছা ওরফে নতে বেগম এবং খায়রুন নেছার স্বামীর নাম মীর গোলাম হোসেন। খায়রুন নেছার কন্যার নাম মরিয়ম নেছা বেগম। উল্লেখ্য যে, এখানে দুইজন মরিয়মের নাম পাওয়া যায়, যার একজন হলেন জমিদার মরিয়ম বেগম এবং অপরজন জমিদার মরিয়ম বেগমের মেয়ের ঘরের নাতনি মরিয়ম নেছা বেগম। মরিয়ম নেছা বেগমের নিজ বসতির ঠিকানা ওয়াকফ ও মীর গোলাম হোসেন কর্তৃক মির্জা মোহাম্মদের নিকট বিক্রিত দলিলে নিম্নোক্তভাবে উল্লেখ করা হইয়াছে :

“ঢাকা জেলার সদর পুলিশ স্টেশন মহালে চাঁদখার পোল স্থিত মৃত মরিয়ম নেছা বেগমের নিজ বসতি ভাদ্রাসন বাড়িময় নিষ্কর ভূমি তাহার চৌহদ্দি পশ্চিমে সড়ক দক্ষিণে কুচা রাস্তা উত্তরে মহালে আলি নকিছ ডেউরী স্থিত লাখেরাজ জমি পূর্বে মৃত ফজলে মিরনের জমিন।”

সহোদর ভ্রাতার পুত্র ও কন্যা খায়রুন নেছার স্বামী জনাব মীর গোলাম হোসেনকে মোতাওয়াল্লী নিযুক্ত করেন এবং উল্লিখিত ওয়াকফকৃত সম্পত্তির নিকট উপস্বত্ব হইতে সুবিধাপ্রাপ্ত হিসেবে তার ঘনিষ্ট আত্মীয় কতিপয় ব্যক্তিদিগের পুত্র, পৌত্রাদি ও ওয়ারিশানক্রমে মাসিক ৭৮ টাকা হিসেবে বার্ষিক ৯৩৬ টাকা এবং অপর কয়েক আশ্রিত ব্যক্তিকে তাদের জীবদ্দশা পর্যন্ত মাসিক ৫ টাকা হিসেবে বার্ষিক ৬০ টাকাসহ মোট ৯৯৬ টাকা খোরপোষ দেওয়ার নিয়ম অবধারিত করেন। ঐ-সম্পত্তির নিট লাভ হতে যা উদ্বৃত্ত হবে, তা দ্বারা ওয়াকফকারীর (মরিয়ম বেগম) বসতবাড়ি স্থিত ইমামবাড়া (শিয়া মুসলিমদের প্রধান এবাদতখানা হোসেনী দালান)-এর খরচ হবে মর্মে শর্তে উল্লেখ করেন। কিন্তু বঙ্গাব্দ ১২৭৪ সনের মাঘ মাসে মরিয়ম বেগমের মৃত্যু হওয়ার পর ৯৯৫৪ নং তালুক ঢাকা কালেক্টরির অফিস কর্তৃক বণ্টন হয়ে কথিত একরভুক্ত চার আনা ১০ গণ্ডা অংশের বাবদ স্বতন্ত্র একটি ছাহাম হয়ে ১৩১৭৩ নং তৌজি সৃষ্টি হয়েছে, যাতে আমীরগঞ্জ ও করিমগঞ্জের গ্রাম ও চকের জমিগুলিও উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। উক্ত সৃজিত মহাল বা তালুকের বার্ষিক ৫৯৮ টাকা সদর জমা ধার্য এক মহাল সৃষ্টি হয়েছে। এটি ছাড়া এই তালুকে ১৫৭৮৩ ও ১৫৭৮৪ নং আরো দুইটি ভিন্ন মহাল বা তৌজি সৃষ্টি হয়। মরিয়ম বেগমের মৃত্যুর ওয়াকফের মোতাওয়াল্লী জনাব মীর গোলাম হোসেন বাংলা ১৩০৮ সনের ২১শে অগ্রহায়ণ ১৯০১ সালের ৭ই ডিসেম্বর তারিখে সম্পাদিত ৩৩ ফর্দে এক সাফকাবলা ওয়াকফ দলিলে উল্লেখিত মরিয়ম বেগমের জমিদারি ও খলিলুর রহমানের তালুকের তার স্বত্ব (মীর গোলাম হোসেনের), মরিয়ম বেগমের কন্যা খায়রুন নেছার হেবায় প্রাপ্ত সম্পত্তি, ফরাজে ও লাখেরাজ ভূমি ও পত্তনী মালিকানা মির্জা মোহাম্মদ, পিতা : মির্জা কাজিম ও মির্জা মোহাম্মদের আপন বোন জনাবা বনি বেগমের (মীর গোলাম হোসেনের ভাগনি) নিকট বিক্রয় করে নিস্বত্ববান হন। তখন ভূমি রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯০৮ প্রণীত হয় নাই বিধায় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন মোতাবেক দলিল লেখক শ্রী জজ্ঞেশ্বর দত্ত সাং হাল ঢাকা কবিরাজের গল্লি, স্টেশন সদর, ঢাকা ও আপন সাকিন বা স্থায়ী ঠিকানা : টিন কোর্ট স্টেশন শ্রীনগর ৩৬০৪ নং (মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর) এবং দলিলটি দুই টাকা মাত্র স্ট্যাম্পে প্রহলদ চন্দ্র ধর বেন্ডার কাঃ আদালতে জিলা : ঢাকা মির গোলাম হোসেনের সহি-স্বাক্ষরে ৩৩ ফর্দের আঠারো পাতার সাফকাবলা দলিল সংগঠিত হয়। আমার নিকট উক্ত দলিলের একটি ছায়ালিপি রক্ষিত আছে, যার চৌম্বক অংশ পরবর্তী পর্বে তুলে ধরা হবে।


আমির হোসেন
গবেষক, আয়কর পরিদর্শক