ঐতিহাসিক `বাঁকমোড়া' নামক স্থান (বর্তমান মূল বাসস্ট্যান্ড), যেখানে শেখেরচর হাটের গোড়াপত্তন হয়েছিলো | ছবি : শহিদুল্লাহ পিয়াস
বাংলার তাঁতবস্ত্রশিল্পের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র শেখেরচর-বাবুরহাটের গোড়াপত্তন ঘটে বাংলা ১৩৪৩ সনের ৮ জ্যৈষ্ঠ (১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ)। সারা বাংলাদেশ, এমনকি বাংলাদেশের বাইরে থেকেও কাপড় ব্যবসায়ীগণ এই বাবুরহাটে বস্ত্র বেচা-কেনার জন্যে আসতেন। হাটটি ‘প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার’ বলে খ্যাত ছিলো একসময়।
বর্তমান শেখেরচর থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে মাধবদী গ্রাম। মূলত মাধবদীই ছিলো তাঁতবস্ত্র বেচা-কেনার প্রথম হাট। এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মাধবদীর তৎকালীন জমিদার গোপাল গুপ্ত, বিষাদ গুপ্ত, শৈলেন্দ্র গুপ্ত রায়। পাঁচ-ছয় পুরুষ ধরে তাদের জমিদারি। তিরিশের দশকের কাছাকাছি সময়ে এই মাধবদীর সুতা-কাপড়ের হাট প্রতিষ্ঠিত হয়। নরসিংদীর জমিদার ললিতমোহন রায়ের সাথে খাজনা সংক্রান্ত বিরোধ তৈরি হলে পাইকারগণ মাধবদীর জমিদারের শরণাপন্ন হন এখানে হাট বসানোর জন্যে। এ-সুযোগ মাধবদীর জমিদারগণ লুফে নেন। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে তাদের বিশাল জমি খালি পড়েছিলো। সেখানেই বসানো হলো হাট। এই হাটকে কেন্দ্র করে জমিদারদের শনৈ শনৈ উন্নতি হতে লাগলো। মাধবদীর বাবুদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বলে এই হাটের নামকরণ হয়ে যায় ‘বাবুরহাট’।
কয়েক বছর যেতেই একই বিপত্তি। জমিদারদের নায়েবরা গাইট প্রতি খাজনা (তোহা) দুই পয়সা করে বেশি আদায় করা শুরু করে। এটা মেনে নেয়া কষ্টকর ছিলো পাইকারদের কাছে। তারা বারবার জমিদারের নায়েবের কাছে আবেদন করতে লাগলো তোহা বৃদ্ধি না করতে। কিন্তু জমিদারের নায়েব তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করতেন না। বরং দুর্ব্যবহার করতেন এবং আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা করছিলেন। এমতাবস্থায় কাপড়ের পাইকাররা একজোট হয়ে তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে লাগলেন। একসময় এই অসন্তোষ বিস্ফোরিত হতে হতে তাদের নিয়ে গেলো মাধবদী থেকে দুই কিলোমিটার উত্তরে শেখেরচরের তালুকদার হলধর সাহার কাছে। তারা হলধর বাবু ওরফে কালু বাবুকে বুঝালো শেখেরচরে হাট প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব। হলধর বাবুও এই মহা সুযোগ হাতছাড়া করেননি। শেখেরচরের উত্তরে বাঁকমোড়া (বর্তমান মূল বাসস্ট্যান্ড) নামক স্থানে খোলা আকাশের নিচে কৃষিজমির উপর আরম্ভ হলো শেখেরচর-বাবুরহাট। তখন বাংলা ১৩৪৩ সন।
হলধর সাহা (কালু বাবু) এতো বড়ো হাট প্রতিষ্ঠার জন্যে পর্যাপ্ত পয়সা-কড়ির মালিক ছিলেন না। এজন্যে তিনি সাহায্য নেন বালাপুরের জমিদার কালীমোহন সাহার। হলধর সাহা ও কালীমোহন সাহা বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয় ছিলেন। শেখেরচর (ইমামগঞ্জ) হাটের ১৬ আনা মালিকানার মধ্যে ৪ আনার মালিক ছিলেন বাবু হলধর সাহা (কালু বাবু) এবং ১২ আনার মালিক ছিলেন বালাপুরের কালীমোহন সাহা। পরবর্তীতে তার দুই ছেলে বাবু আশুতোষ সাহা ও বাবু মনোরঞ্জন সাহা মালিকানাপ্রাপ্ত হন।
এই হাটটিও বাবুদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিধায় এটাও পরবর্তীতে বাবুরহাট নামে পরিচিতি পায়। অবশ্য শেখেরচর হাটের প্রথমে নাম ছিলো ‘ইমামগঞ্জের হাট’। এই নামকরণের পেছনে ছিলেন তখনকার নরসিংদীর সিংহপুরুষ গান্ধীবাদী স্বদেশি রাজনীতিবিদ সুন্দর আলী গান্ধী। তিনিও এই হাট প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সুন্দর আলী গান্ধীর পীরের নাম ছিলো ইমাম উদ্দিন। হলধর বাবুরা সুন্দর আলীর পরামর্শ চাইলে তিনি এই হাটের নাম তাঁর পীরের নামে ‘ইমামগঞ্জের হাট’ নামকরণ করেন। প্রথমদিকে জনসাধারণের মুখে মুখে ইমামগঞ্জের হাট, পাবলিকের বাজার, নয়াবাজার ইত্যাদি নামেও পরিচিত ছিলো।
শেখেরচর-ইমামগঞ্জের বাজার প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর থেকে মাধবদীতে বাবুদের হাট স্তিমিত হয়ে যেতে শুরু করে। পাইকাররা মাধবদী হাটে তাদের পসরা সাজায় না। দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই শেখেরচরে আসতে থাকে। আর এই মলিন ক্রেতাশূন্য হাট মাধবদীর বাবুরা মেনে নিতে পারেন না। তারা শেখেরচরের বিরুদ্ধে নানা অপতৎপরতা চালাতে থাকে। স্পষ্টত আশেপাশের আরো অনেক এলাকা দুই ভাগ হয়ে যায়। কেউ কেউ মাধবদীর জমিদারদের পক্ষে; আবার কেউ হলধর বাবুদের পক্ষে। ব্রহ্মপুত্রের উপর স্থাপিত বাঁশের সাঁকো দিয়ে শেখেরচর হাটের মানুষজন হাটে যাওয়া-আসা করতো। মাধবদীর জমিদার গোপালবাবুর লোকেরা বারবার সেই বাঁশের সাঁকো ভেঙে দিতে থাকে। লাঠিয়াল বাহিনি দিয়ে হাটুরেদের হাটে প্রবেশে বাধা দিতে থাকে। মাধবদীর জমিদারেরা সুন্দর আলী গান্ধীর কাছেও যায় অর্থের প্রলোভন দেখাতে, যাতে তিনি এই হাট ভেঙে দেন। কিন্তু কোনো কাজই হয়নি। দাঙ্গা-হাঙ্গামা-সংঘর্ষ ইত্যাদি চলতে চলতে একসময় কলিকাতা হাইকোর্টে মামলা পর্যন্ত গড়ায়। মামলায় শেষ পর্যন্ত মাধবদীর জমিদারেরা হেরে যান।
শেখেরচর হাটের প্রতিষ্ঠাতা হলধর সাহা দূর-দূরান্ত থেকে আসা হাটুরেদের জন্যে নানা জায়গায় টিউবওয়েলের ব্যবস্থা করেন, এমনকি স্থানে স্থানে নিরাপত্তার জন্যে লাঠিয়াল বাহিনিও নিয়োগ করেন।
এই হাট প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নিয়ে ডা. আ. গনি পদ্য রচনা করেন। এই পদ্য স্থানীয় কবিয়ালরা গ্রামে গ্রামে পাঠ করতেন। তেমনি একটি পদ্য পাঠকেরা পড়ে নিতে পারেন। পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতে পারেন ঐতিহ্যবাহী শেখেরচর-বাবুরহাটের গোড়াপত্তনের ইতিহাস এবং তৎসময়ে ঘটে যাওয়া বিচিত্র ঘটনার ভেতর।
মাধবদী হাট ভাঙ্গিয়া শেখেরচরে হাট বসায় গোপাল বাবু দেখে নিরুপায়। গোপালেরা তিন ভাই থাকত কলকাতায় দেশ বিদেশে জমিদারী, মাধবদীতে জন্মবাড়ি বাড়িতে রাখছে ম্যানেজার, সে করতো না সুবিচার যত আছে আমলা ফইড়া, হাটটার খায় লুইটা পুইড়া এইরূপ অত্যাচারে ফকিরের জমা ধরে। বাবুর মা নিষেধ করে এই জমাটা ছাইড়া দিয়া অন্য জমা লও বাড়াইয়া ছয় পয়সা ছিল গাইটের জমা, করে নিল বার আনা জমা যখন বাড়াইল, পাইকারগণে শুনতে পাইল জগন্নাথ মাড়োয়ারী, সে তো গেল বাবুর বাড়ি যাইয়া বলে ম্যানেজারে, জমা ধরেন কম করে, অনেক অনুরোধ করে, কমাইতে নাহি পারে কমাইতে চাইলে পরে, জমা চায় ৫ টাকা করে। ইহা শুনে মাউরার ছাও, কারো সনে করে না রাও সঙ্গে যত পাইকার ছিল, সবারে ডাকিয়া লইল আসল তারা ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব পাড়ে শেখেরচরের কালু বাবু এইবার তো কইরাছে কাবু ৫ কানি ক্ষেত ধান ভাঙ্গিয়া হাটের জায়গা করে দিলরে ১৩৪৩ সনে জ্যৈষ্ঠ মাসের আষ্ট দিনে ইমামগঞ্জের হাট আরম্ভ হইলরে…
কালু সায় কয় কৃষ্ণ সাহারে ডাইকা পুলের জোগাড় কর তাড়াতাড়ি গোপাল বাবু শুনতে পায়, জায়গা দিছে কালু সায় হাট বসাইল কালী সায়। থাকতেন তিনি ঢাকার বাড়ি, চইড়া আইল মটর গাড়ি নামলেন গিয়া ভিতর বাড়ি যাইয়া বলে মায়ের কাছে, মোদের হাট কেন ভাইঙ্গা গেছে মায় ছেলেরে কয় তখন, শোন বাবা রাজনন্দন বাড়িতে রাখছ ম্যানেজার, সে করে না সুবিচার তার কারণে হাট গিয়াছে বললাম বাবা তোমার কাছে। ডাইকা বলে ম্যানেজারেরে, হাট ভাঙ্গছে কী কারণে ম্যানেজার কয় তখন, হাট ভাইঙ্গা দিছে পাইকারগণ তখন বাবু চিন্তা করে। অনেক চিন্তা কইরা সার ডাকাইল পাইকার পাইকারেরা চইলা আইল তানগো কাছে জিজ্ঞাসিল পাইকারগণ কয় তখন শোনেন বাবু রাজনন্দন ৬ পয়সা ছিল গাইটের জমা কইরা নিল বার আনা। অনেক অনুরোধ করি কমাইতে নাহি পারি কমাইতে কইলে পরে জমা চায় ৫ টাকা করে। ইহা শুনে বাঘের ছাও কারো সনে করে না রাও বন্দুক ছিল ভিতর বাড়ি আনে বন্দুক হাতে করে ধরে বন্দুক ম্যানেজার মারিতেরে…
পাইকারগণে বলে তারে মাইরেন না বাবু ম্যানেজারে। পাইকারেরা প্রণাম দিয়া যার যার দেশে যায় চলিয়া গোপাল বাবু গর্জে ওঠে মামলা করল হাইকোর্টেতে লাগিলরে মামলার ঠাঁট বিচার করে বড়লাট হাটের কথা খ্যান্ত পাই হাট তো রইল মামলায় মাধবদী হাট ভাঙ্গিয়া শেখেরচরে হাট বসায় গোপাল বাবু দেখে নিরুপায়।
যাই হোক, মামলা-মোকদ্দমা-শত্রুতা-সংঘাত পেরিয়ে শেখেরচর কাপড়ের হাট স্থিতাবস্থায় উপনীত হয় এবং সারাদেশে ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ এক বাণিজ্যকেন্দ্রে রূপ লাভ করে। নানা চড়াই-উৎড়াই আর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এটি বর্তমান অবস্থায় এসেছে। এই হাটের বিস্তৃতির পেছনে যাঁরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে রইলো অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা।
শিপ্ত। মোস্তাফিজুর রহমান শিপ্ত। পেশায় একজন উদ্যোক্তা এবং ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার। ফটোগ্রাফিটা মাথায় নেশার মতো চেপে বসার শুরুটা ২০১৩ সালের মাঝামাঝি। ছোটোবেলায় বাবা পাখি পুষতেন। তখন থেকেই পাখির প্রতি একটা অনন্য ঝোঁক ছিলো তার। ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফিতে ঢুকে পড়ার মূল রসদটা হয়তো সেটাই ছিলো। আর সেই সুবাদে পশুপাখি ও প্রকৃতির দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের অনেক জেলায়। এই শখের প্রতি অকুণ্ঠ ঝোঁক আর নেশা তাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে বাংলার চেনা-অচেনা চর, খাল-বিল, জঙ্গল আর নানা জলাভূমিতে। একেকটা ছবির জন্যে কতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুর্গম পথে চলা, জলায়-কাঁদায় ঘাপটি মেরে বসে থাকা, কতো আঁচড়, কতো পোকামাকড়ের কামড়, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত একটা ক্লিক সেসব কষ্টকে একদম ম্লান করে দেয়। নতুন নতুন পাখির জীবন বৈচিত্র্য জানার পাশাপাশি তাদের ক্যামেরাবন্দী করার উন্মত্ত আকাঙ্ক্ষা তাকে সাহায্য করেছে প্রায় তিনশো প্রজাতির পাখির ছবি তুলতে। তিনি স্বপ্ন দেখেন, ক্রমে এই সংখ্যাটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে, ছবিতেও উঠে আসবে জীবন ও প্রকৃতির নানা বৈচিত্র্যের রূপকথন। অবশ্য এই স্পৃহা থেকে ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজ কর্মের ছাপ ফেলতে সমর্থ হয়েছেন এই গুণী শিল্পী, জয় করে এনেছেন বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার। বঙ্গবন্ধু ফটোগ্রাফার অফ দ্য ইয়ার ২০১৯, Photocrowd International ২০১৮, D’ Photocafe WNI World Photography Exibition ২০১৭-সহ আরো অসংখ্য সুকীর্তির স্বাক্ষরে পরিপূর্ণ তার সঞ্চয়ের ঝুলি। বিভিন্ন সময়ে The Daily Observer, ইত্তেফাক, প্রথম আলো-সহ বেশ কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায়ও এসেছে তার নাম।
ছবি তোলা এবং ছবির অর্জনগুলোর বেশিরভাগই ছিলো ছাত্রজীবনের। চাকুরিজীবনে প্রবেশের সাথে সাথে শখের জায়গাটা ধরে রাখা ক্রমশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। কিন্তু তার মন তো পড়ে থাকে সেই জলে-জঙ্গলেই। একটা সময় আর মনের সাথে পেরে ওঠতে পারলেন না। চাকুরি ছেড়ে দিলেন আর নিজেকে উন্মোচিত করলেন একজন উদ্যোক্তা হিসেবে। এতে করে শখের কাজেও পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন। বর্তমানে নরসিংদীর ইটাখোলায় প্রায় ১০০ জন প্রতিবন্ধী নিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি বিশ্বমানের কারু এবং হস্তশিল্প কারখানা, যেখানে দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন উপকরণ তৈরির সাথে সাথে অসংখ্য প্রতিবন্ধী আয়-রোজগার করছেন। নিজেদের অচলাবস্থার নির্মম পরিণতি আর অসহনীয় যন্ত্রণা কিছুটা হলেও লাঘব করতে পারছেন।
ফটোগ্রাফি মূলত একধরনের স্মার্ট শখ। এই শখের জায়গাটা পাকা করতে এবং ছবিপ্রেমী আরো অসংখ্য তরুণকে আলোকচিত্রের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে ২০১৯ সালে বেশ কয়েকজন উদ্যমী তরুণ-তরুণী নিয়ে গড়ে তোলেন ‘নরসিংদী ফটোগ্রাফিক সোসাইটি’। ইতোমধ্যে দুটি বেশ বড়োসড়ো চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন তারা সফলভাবেই সমাপ্ত করতে পেরেছে।
এই সবকিছুর পাশাপাশি ছোটো ভাই এবং বন্ধুদের নিয়ে গড়া একটা ইভেন্ট ফটোগ্রাফির প্রতিষ্ঠানও রয়েছে তার। আলাপচারিতায় নিশ্চিত বুঝতে পারি, প্রকৃতপক্ষেই একজন পাখি ও প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ তিনি। বর্তমান প্রকৃতির অস্থিতিশীল অবস্থার দরুন অনেকটা উদ্বিগ্ন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সমগ্র পৃথিবীর বৈশ্বিক উষ্ণতা লাগামহীন বেড়ে চলেছে। এমন যদি চলতে থাকে, তাহলে একদিন দেখা যাবে, প্রকৃতিও তার মুখ ফিরিয়ে নেবে, নষ্ট হয়ে যাবে আমাদের ইকোসিস্টেম। তিনি বলেন, “২০১৩-১৪ সালেও যেসব পাখি এ-দেশে দেখা যেতো, তাদের অনেকগুলোই এখন বিলীন। অনেক প্রজাতি চোখে পড়ে না আর। আবার অনেক প্রজাতির অস্তিত্ব শঙ্কার মুখে। তাই বেশি বেশি পাখিবান্ধব গাছ রোপণ করে পরিবেশের প্রতি আরো যত্নশীল হওয়া খুবই জরুরি।” মোস্তাফিজুর রহমান শিপ্ত এখনো স্বপ্ন দেখেন, এই বাংলা আবারো সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা হয়ে ওঠবে; আর তার পথে-প্রান্তরে, জলে-জঙ্গলে তিনি দাপিয়ে বেড়াবেন বিচিত্র সব পশু-পাখির ছবি তোলার জন্যে।
এবারে দেখে নেয়া যাক মোস্তাফিজুর রহমান শিপ্তর ক্যামেরায় ধারণ করা বিচিত্র কিছু পাখির আলোকচিত্র, যা তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে তুলে এনেছেন।
লাল ঠেঙিউল্টোঠুঁটিবাবুই বাটনতিলা বাজমাছরাঙাউদয়ী ধলা-চোখমৌটুসীলাল মুনিয়াছোটো জিরিয়ার বাচ্চাসবুজ সুইচোরাটিয়া
মোস্তাফিজুর রহমান শিপ্ত
জন্ম | ১১ আগস্ট ১৯৯৫, ঘাগটিয়া, শিবপুর
বসবাস | মুন্সেফেরচর, ইটাখোলা, শিবপুর পেশা | উদ্যোক্তা ও ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার
আমি বসে বসে তাই ভাবি, নদী কোথা হতে এল নাবি। কোথায় পাহাড় সে কোনখানে, তাহার নাম কি কেহই জানে। নদী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘নদী’ কবিতায় নদীর পুরো জন্মকথা বলে দিয়েছেন। নদী কেমন করে পাহাড়ের ঝর্নাধারা থেকে বেরিয়ে এঁকে-বেঁকে সমতলে নামে, তারপর সমতলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে পতিত হয়ে নদীর চলা শেষ হয়, নদীর মৃত্যু ঘটে। নদী হচ্ছে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে প্রবাহিত জলধারা। প্রাকৃতিক নিয়মে পাহাড়ের বরফগলা পানি এবং পাহাড় হতে যে-ঝর্নাধারার সৃষ্টি, সেই ঝর্নার পানির সাথে বৃষ্টির জলধারা মিলে নিচের দিকে গভীর খাতে সর্পিলাকারে প্রবাহিত হয়েই নদীর সৃষ্টি।
নদীকে কেন্দ্র করেই পৃথিবীর আদি সভ্যতার উদ্ভব, বিকাশ ও বিস্তৃতি। বাংলাদেশের সভ্যতা-সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ নদীকে অবলম্বন করেই। বাংলার প্রাচীন সভ্যতার প্রধান কেন্দ্র পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, উয়ারী-বটেশ্বর প্রাচীন নদীর পাড়েই গড়ে ওঠেছিলো। বাংলার সভ্যতার অগ্রযাত্রা, কৃষিনির্ভর জীবন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বন্দর, বাজার-হাট, যোগাযোগ, প্রতিদিনের জীবনযাপন, তার প্রসার ও বিস্তৃতি নদীকে ঘিরেই।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ৫৬ হাজার বর্গমাইল আয়তনের বাংলাদেশ নদীর পলিতে গড়ে ওঠা বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ। নদী বিধৌত বাংলাদেশে ছোটো-বড়ো নদীর সংখ্যা প্রায় তিনশো’র অধিক। সমস্ত দেশটি অসংখ্য নদী, উপনদী, শাখা এবং প্রশাখা নদী দ্বারা মাকড়সার জালের মতো আচ্ছাদিত। বাংলাদেশে প্রধান নদীপ্রবাহ হচ্ছে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। রাজনৈতিকভাবে দেশের একটি শ্লোগান আছে— ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’। বস্তুত, বাংলাদেশের প্রকৃত ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। পদ্মা এবং গঙ্গা নদী একই প্রবাহ। ভারতে এর জন্ম; সেখানে নাম ‘গঙ্গা’, বাংলাদেশে রাজশাহী বিভাগ দিয়ে প্রবেশের পর এই প্রবাহের নাম হয়েছে ‘পদ্মা’। একইভাবে ব্রহ্মপুত্র এবং যমুনাও একই প্রবাহ। ‘ব্রহ্মপুত্র’র খাত পরিবর্তন হয়েই ‘যমুনা’ নাম হয়েছে। মেঘনা এবং সুরমাও একই প্রবাহ। মূলত, বাংলাদেশের অসংখ্য নদী, যেগুলো সুন্দর সুন্দর নাম নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবাহিত হয়েছে, সেগুলো মূলত পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনা-ব্রহ্মপুত্র’র শাখা।
নরসিংদী জেলায় প্রবাহিত নদ-নদী
বাংলাদেশের নদী বাংলাদেশের প্রাণ। তদ্রুপ নরসিংদীর নদীগুলোও নরসিংদীর প্রাণ। নরসিংদীতে নদীর প্রধান প্রবাহ ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা এবং তাদের শাখা নদী শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ, কলাগাছিয়া, হাড়িধোয়া, গঙ্গাজলী, বানার, কয়রা। নরসিংদীর ব্যবসা-বাণিজ্য, নদীবন্দর গড়ে ওঠেছে ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, শীতলক্ষ্যার পাড়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। গঙ্গাজলী এবং কয়রা নদীর পাড়ে গড়ে ওঠেছিলো হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতা ‘উয়ারী-বটেশ্বর’। নদী দুটি আজ মৃত। ব্রহ্মপুত্র’রও একটি প্রধান প্রবাহ আজ মৃত, যা নরসিংদীর পারুলিয়া, চর্ণগরদী, পাঁচদোনা, শেখেরচর (বাবুরহাট), মাধবদী, মহজমপুর, লাঙ্গলবন্দ হয়ে শীতলক্ষ্যায় শেষ হয়েছে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র’র বড়ো প্রবাহটি কিশোরগঞ্জ জেলার সীমারেখা হয়ে মনোহরদী, বেলাব অতিক্রম করে ভৈরবের কাছে মেঘনায় মিলিত হয়েছে।
গঙ্গাজলী ও কয়রা নামক নদী দুটির অস্তিত্ব পুরোনো ও নতুন অনেক মানচিত্র খুঁজেও পাওয়া যায়নি। বেলাব উপজেলার ‘হাড়িসাঙ্গান’ গ্রামে নদী দুটির প্রবাহ এখনো বিদ্যমান। তবে তা খুবই ক্ষীণ ধারায় বহমান।
ব্রহ্মপুত্র
নরসিংদীর উপর দিয়ে প্রবাহিত অন্যতম নদ ব্রহ্মপুত্র। হিন্দুশাস্ত্রমতে, দেবতা ব্রহ্মা’র মানসপুত্ররূপে এর নাম হয়েছে ব্রহ্মপুত্র। ব্রহ্মপুত্র নদ উত্তর হিমালয়ে অবস্থিত কৈলাশ পর্বতশৃঙ্গের হিমবাহের অবিরত জলধারা থেকে উৎপত্তি লাভ করে তিব্বতের মানস সরোবরের সাথে মিলিত হয়ে উঁচু মালভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই প্রবাহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ঘুরে ভারতের অরুণাচল ও আসামে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কুড়িগ্রাম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ব্রহ্মপুত্র’র গতিপথ অতি বিচিত্র। কালের ধারায় বিভিন্ন পথে প্রবাহিত হয়েছে এটি। পুরোনো ব্রহ্মপুত্র’র প্রধান প্রবাহটি জামালপুর জেলার বাহাদুরাবাদ হয়ে শেরপুর জেলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে এসে মধুপুর গড় এলাকার কাছে বংশি ও তুরাগ নামে দুটি শাখা নদীর সৃষ্টি করেছে। মূল প্রবাহ ময়নমনসিংহ জেলায় প্রবেশ করে ময়মনসিংহ শহর ও গফরগাঁ’র পাশ দিয়ে সোজা দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার টোকের কাছে শীতলক্ষ্যা নদীকে শাখা হিসেবে জন্ম দিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর, পাকুন্দিয়া অতিক্রম করে নরসিংদী জেলায় প্রবেশ করে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়। একটি ধারা পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে নরসিংদী জেলার চালাকচর, বড়চাপা, পোড়াদিয়া ও বেলাব এসে আবার দুভাগে ভাগ হয়। ডানের ধারা নরসিংদীর আড়িয়াল খাঁ নামে এবং বামের প্রধান ধারা (পুরোনো ব্রহ্মপুত্র) তার অপরিবর্তিত নামে নরসিংদীর রায়পুরার সীমান্ত সংলগ্ন ভৈরব বাজারের পাশ দিয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। এটিই পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের প্রধান প্রবাহ নামে পরিচিত।
কিন্তু মেজর রেনেল কর্তৃক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ব্রহ্মপুত্র’র মূল প্রবাহের প্রধান স্রোতধারা মনোহরদী উপজেলার সর্ব-উত্তরে আড়ালিয়া নামক স্থানে দক্ষিণ দিক দিয়ে মনোহরদীর হাতিরদিয়া, শিবপুরের লাখপুর, পলাশ উপজেলার চরসিন্দুর, পারুলিয়া, চর্ণগরদী, জিনারদী হয়ে পাঁচদোনা, শীলমান্দী, শেখেরচর (বাবুরহাট), মাধবদী থেকে আড়াইহাজার উপজেলার পশ্চিম প্রান্ত বরাবর প্রবাহিত হয়ে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দের দক্ষিণ দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে শীতলক্ষ্যা-ধলেশ্বরী ও মেঘনা নদীর সঙ্গমস্থল কলাগাছিয়া নামক স্থানে মেঘনার সাথে মিলিত হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান তীর্থস্থান লাঙ্গলবন্দের কাছে নদীটি এখনো সচল। নদীর এই অংশে হিন্দু সমাজের পুণ্যস্নানের পঞ্চমীঘাট রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র’র এই প্রবাহের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে পাঁচদোনা, বানিয়াদী, মাধবদী, আলগী, মহজমপুর এবং মনোহরদীতে পুণ্যস্নানের ঘাট অতীতে থাকলেও এখন নদী শুকিয়ে যাওয়া এবং দূষণের কারণে তা স্নানের অনুপযোগী। এসব এখন ইতিহাস-কিংবদন্তীর অংশ।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ | ছবিটি নরসিংদী সদর উপজেলার শেখেরচর-বাবুরহাট অংশ থেকে তোলা
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র’র এই প্রবাহের অংশে ব্রহ্মপুত্র’র পাড়ের খালি জায়গায় গড়ে ওঠেছে প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার খ্যাত বাংলাদেশের তাঁতবস্ত্রশিল্পের সবচাইতে বড়ো হাট। বস্ত্রশিল্পের সবচেয়ে বড়ো ব্যবসাকেন্দ্র শেখেরচরের বাবুরহাট, যা নরসিংদীকে দেশ ও দেশের বাইরে পরিচিত করেছে। নরসিংদী জেলার ব্র্যান্ডও হয়েছে ‘তাঁত শিল্পের মেলা/ নরসিংদী জেলা’। কথিত আছে, মাধবদীর ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একসময় আড়ং বসতো। আনন্দী গ্রামের সন্নিকটে ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আড়ং নামের কাপড়ের এই হাট জমজমাট ছিলো। মাধবদী-শেখেরচর তাঁতশিল্পকেন্দ্র হওয়ার নেপথ্যে এই আড়ং নামের হাটের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। …শেখেরচর বাবুরহাট ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের একদম লাগোয়া পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে নরসিংদী জেলার শিলমান্দী ইউনিয়নে অবস্থিত।
ব্রহ্মপুত্র নদের এই প্রবাহের ব্রহ্মপুত্রতীরের নরসিংদীর কৃতীসন্তান মাধবদীর পাকড়াশী বংশের অগ্নিযুগের বিপ্লবী সতীশ পাকড়াশী। পাঁচদোনার বাংলা ভাষায় পবিত্র কোরানের প্রথম অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, শিক্ষাবিদ ও সংস্কৃতিসাধক সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য। ভাটপাড়ার নিখিল ভারতের প্রথম আইসিএস স্যার কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত (কে জি গুপ্ত), পারুলিয়ার সাধকপুরুষ ও সঙ্গীতসাধক ও লোকসাহিত্যিক পাগল দ্বিজ দাস।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের যোগাযোগের একটি বড়ো মাধ্যম ছিলো নৌ-পথ। নরসিংদীর মনোহরদী থেকে নারায়ণগঞ্জের কলাগাছিয়া পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র’র এই প্রবাহ অংশে একসময় গয়নার নৌকা চলাচল করতো। এখন এই অংশের নদী মূলত মৃত। অনেক স্থানে নদীর অস্তিত্ব বোঝাও কঠিন। বর্তমান সরকার অন্যান্য নদীর মতো ব্রহ্মপুত্র’র এই অংশ খনন করলেও তা নদীর প্রবাহ তৈরি করার মতো অবস্থা হয়নি। অনেক জায়গায় এটি মৃত খালে পরিণত হয়েছে।
শীতলক্ষ্যা
শীতলক্ষ্যা নদী পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের অন্যতম প্রধান শাখা। ১৭৮০ সালে মেজর জেমস রেনেলের ব্রহ্মপুত্র নদ জরিপ তথ্য থেকে জানা যায়, কিশোরগঞ্জ জেলাধীন ঐতিহাসিক দুর্গশহর এগারসিন্দুরের কাছাকাছি গাজীপুর জেলার টোক নামক স্থানে ব্রহ্মপুত্র নদের একটি শাখা বানার নামে উৎপত্তি হয়ে নরসিংদী জেলার লাখপুরের কাছে শীতলক্ষ্যা নাম ধারণ করেছে। শীতলক্ষ্যা নদীটি নরসিংদী জেলার পশ্চিম সীমান্ত নির্ধারণ করেছে। নদীর পূর্ব তীরে নরসিংদী জেলার মনোহরদী, শিবপুর, পলাশ ও নরসিংদী সদর উপজেলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান গড়ে ওঠেছে। যেমন : মনোহরদী, হাতিরদিয়া, শিমুলিয়া, লাখপুর, চরসিন্দুর, ঘোড়াশাল, ডাঙ্গা বাজার প্রভৃতি নদীবন্দর। পশ্চিম প্রান্তে গাজীপুর জেলার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, ফতুল্লার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীটি নারায়ণগঞ্জ সদর হয়ে বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়ার কাছে ধলেশ্বরী নদীতে পতিত হয়েছে। শীতলক্ষ্যা নদী সর্বমোট ১০৮ কিলোমিটার দীর্ঘ। উৎস থেকে ধলেশ্বরী নদীতে পতিত হওয়া অবধি প্রবাহপথে শীতলক্ষ্যা নদীটি গাজীপুর, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান গড়ে তুলে প্রবাহিত হয়েছে। শীতলক্ষ্যা নদীর উভয় তীর বিস্তীর্ণ জনপদ, লাখ-কোটি মানুষের বসতি।
শান্ত এই নদী সম্পর্কে জনশ্রুতি, শীতল আর লক্ষ্মী— এই দুই বিশেষণেই শীতলক্ষ্যার নামকরণ। শীতলক্ষ্যা নদীর পানি বাংলাদেশের স্বাদু পানির নদ-নদীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ ও নির্মল। একমাত্র এই কারণেই শীতলক্ষ্যার তীরে গড়ে ওঠেছিলো ভুবনখ্যাত প্রাচীন মসলিন বস্ত্রশিল্প।
ইংরেজ আমলের সরকারি নথিপত্রে এই নদীকে তৎকালীন ঢাকা জেলার সুন্দরতম নদী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। শীতলক্ষ্যার পাড় উঁচু, ভরা বর্ষাতেও দুকূল ছাপিয়ে যায় না। নদীভাঙন নেই বললেই চলে। এজন্যেই এই নদীতীরে গ্রাম, বন্দর, ব্যবসাকেন্দ্রের পাশাপাশি উভয় কূলেই এখন ব্যাপক শিল্পায়ন— গড়ে ওঠেছে বহু কল-কারখানা। দেশ বিভাগের আগে শীতলক্ষ্যার পাড়ে বেশ কয়েকটি সোডা ওয়াটার, লেমনেড ইত্যাদি কারখানা গড়ে ওঠেছিলো। বর্তমানে এই নদীর উভয় তীর বাংলাদেশের শিল্প-বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। এরকম বাণিজ্যিক গৌরব বাংলাদেশের খুব কম নদীরই আছে। শীতলক্ষ্যার পাড়েই গড়ে ওঠেছে দেশের সুবৃহৎ নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর। গড়ে ওঠেছিলো আদমজী-সহ অসংখ্য পাটকল। নদীর নরসিংদী প্রান্তে রয়েছে চরসিন্দুর দেশবন্ধু চিনিকল, পলাশে প্রাণ কোম্পানির বিশাল শিল্পকারখানা, দুটি সারকারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র (ওয়াপদা), সিমেন্ট ফ্যাক্টরিসহ অগণিত ছোটো-মাঝারি-বৃহৎ শিল্পকারখানা।
নদীপাড়ের অনেক স্থান হয়ে ওঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। গড়ে ওঠেছে ছোটো-বড়ো রিসোর্ট। নদীর পশ্চিম প্রান্তে কালীগঞ্জের নাগরীতে রয়েছে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের এলাকা। রয়েছে পর্তুগিজ বণিকদের গড়া গির্জা।
একসময় এই শীতলক্ষ্যার নদীপথই ছিলো এই এলাকার সাথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের যোগাযোগের মাধ্যম। চলতো নৌকা-লঞ্চ-স্টিমার। গুরুত্বপূর্ণ এই নদীর ব্যস্ততা বর্তমানে অনেক কমে যাচ্ছে। শিল্পবর্জ্য নদীকে করেছে ব্যাপকভাবে দূষিত।
আড়িয়াল খাঁ
ব্রহ্মপুত্র নদের আরেকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ শাখা এবং সুন্দরতম নদী নরসিংদীর বুকে প্রবাহিত আড়িয়াল খাঁ নদ। আড়িয়াল খাঁ নদ কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী ও কুলিয়ারচর এবং নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার সীমান্ত এলাকায় পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের শাখা হিসেবে উৎপত্তি লাভ করে নরসিংদী জেলার মধ্যে উত্তর-দক্ষিণে এঁকে-বেঁকে প্রবাহিত হয়েছে। আড়িয়াল খাঁ নদ মনোহরদী উপজেলার উত্তর-পূর্ব পাশ দিয়ে বেলাব উপজেলার পোড়াদিয়া, পাটুলি, অন্যদিকে বিন্নাবাইদ হয়ে বেলাব বাজারের কাছে এসে আবার ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহের সাথে যুক্ত হয়ে আমলাব, চর উজিলাব অতিক্রম করে বারৈচার সন্নিকটে জংলী শিবপুর বাজারের নিকট নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলায় প্রবেশ করেছে। রায়পুরা উপজেলায় উত্তর বাখরনগর, চর মরজাল, যোশর বাজার, রাধাগঞ্জ বাজার, কুঠির বাজার হয়ে আদিয়াবাদ শতবর্ষী স্কুলের পাশ দিয়ে রহিমাবাদ, ডৌকারচর, হাসনাবাদ বাজার, আমীরগঞ্জ হয়ে একদিকে রায়পুরার নলবাটা, অন্যদিকে নরসিংদী সদরের হাজীপুর ইউনিয়নের খাসেরচরের কাছে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। মেঘনায় মিলিত হয়ে পশ্চিম দিকে নরসিংদী বাজারের পুরাতন থানার ঘাট পর্যন্ত প্রবাহের ধারা বজায় রেখে হাড়িধোয়া শাখা নদীকে জন্ম দিয়েছে। মেঘনায় মিলনস্থল থেকে নরসিংদী থানার ঘাট পর্যন্ত এলাকায় বর্ষাকালে নদীপ্রবাহের গতিময় ধারার দুটি নদীর পানির আলাদা আলাদা রঙ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়।
আড়িয়াল খাঁ নদের প্রবাহিত জেলা : কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী। প্রবাহিত উপজেলা : কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি, কুলিয়ারচর, নরসিংদী জেলার মনোহরদী, বেলাব, রায়পুরা ও নরসিংদী সদর। দৈর্ঘ্য প্রায় ১৯ কিলোমিটার, গড় প্রশস্ততা ৭৯ মিটার। নদীর প্রকৃতি সর্পিলাকার। নদীটিতে সারাবছরই পানির প্রবাহ থাকে। জুন-সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পানি প্রবাহের মাত্রা বেশি হলেও নদীপাড় নিমজ্জিত হয় না। তবে বর্তমানে নদীর তলদেশঅঞ্চল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীতীরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাচীন বাজার পোড়াদিয়া বাজার, বেলাব বাজার, জংলী শিবপুর বাজার, যোশর বাজার, রাধাগঞ্জ বাজার, কুঠির বাজার, রহিমাবাদ বাজার, হাসনাবাদ বাজার। বেলাব বাজারসহ অন্যান্য বাজারের গুরুত্বপূর্ণ পণ্য সোনালি আঁশ পাটসহ অন্যান্য পণ্য নদীপথে নরসিংদীতে আনা হতো। পাট জমা হতো নরসিংদীর মেঘনা ও আড়িয়াল খাঁ পাড়ের বড়ো বড়ো পাটগুদামে, আদমজী-সহ বড়ো বড়ো পাটকলে পাঠানোর জন্যে। এই নদীর উপর রয়েছে আমীরগঞ্জের ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলসেতু, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সেতু। বর্তমান সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে এই নদীই পণ্য পারাপার এবং নৌ-পথে যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন ছিলো। অধ্যাপক সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের ‘মহেশ্বরদীর ইতিহাস’ গ্রন্থের তথ্য থেকে জানা যায়, আড়িয়াল খাঁ তীরবর্তী মরজাল গ্রাম হইতে মৌর্য যুগের বহুতর রৌপ্যমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়। এর মধ্যে ৯০ টি মুদ্রা ঢাকা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এই স্থানে মৌর্য যুগের মুদ্রার আবিষ্কার হইতে বুঝা যায় যে, কত প্রাচীনকাল হইতে এই অঞ্চলে আর্যসভ্যতার বিস্তার হয়েছে।
আড়িয়াল খাঁ নদীর ঠিক পাড়ে সুন্দর খেলার মাঠসহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আদিয়াবাদ স্কুল, যে-স্কুল তার ঐতিহ্য নিয়ে শতবর্ষ পার করেছে। আর কাছাকাছি নদীপাড়ের রহিমাবাদ ছিলো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং পাকিস্তান পরবর্তী বাম রাজনীতিবিদদের গুরুত্বপূর্ণ আস্তানা।
গঙ্গাজলী ও কয়রা
গঙ্গাজলী ও কয়রা নদী দুটিও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। দুটি নদীই নরসিংদীর প্রাচীন নদী। বর্তমান বেলাব উপজেলায় অবস্থিত প্রাচীন সভ্যতার প্রত্নস্থান এই গঙ্গাজলী, কয়রা, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরেই গড়ে ওঠেছিলো। গঙ্গাজলী ও কয়রা— দুটি নদীই আজ মৃত এবং অস্তিত্বহীন। বেলাব-শিবপুর অঞ্চলে নদী দুটির কিছু মরা খাল এবং ছোটো খালের মতো অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। বেলাব’র হাড়িসাঙ্গান গ্রামে গঙ্গাজলীর একটি প্রবাহ এখনো দেখা যায়। নদীটির উপর একটি সেতুও রয়েছে।
নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার আশরফপুর গ্রামটি গঙ্গাজলী নদীর তীরে অবস্থিত বলে জানা যায়। সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে আশরফপুরে বৌদ্ধবিহার গড়ে ওঠার পেছনে গঙ্গাজলী নদীর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে বলে নরসিংদীর ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক আপেল মাহমুদ সাথী উল্লেখ করেছেন।
গঙ্গাজলী নদী | ছবিটি বেলাব উপজেলার হাড়িসাঙ্গান গ্রামের গঙ্গাজলী বাজার অংশ থেকে তোলাকয়রা নদী | ছবিটি বেলাব উপজেলার হাড়িসাঙ্গান গ্রাম থেকে তোলা
সুফি মোস্তাফিজুর রহমান এবং মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান রচিত নরসিংদীর প্রত্নস্থান বিষয়ক গবেষণাগ্রন্থ ‘উয়ারী-বটেশ্বর : শেকড়ের সন্ধানে’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে : আড়াই হাজার বছর আগে নরসিংদী জেলার উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র নদ উপত্যকায় গড়ে ওঠে এক প্রাচীন জনপদ। …উয়ারী-বটেশ্বর নরসিংদী জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থান। …ইতিমধ্যে উয়ারী-বটেশ্বরের মানববসতি খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ শতকের বলে প্রমাণিত হয়েছে। উয়ারী-বটেশ্বর ছিলো নদীবন্দর, বাণিজ্যকেন্দ্র ও স্বল্পমূল্যবান পাথরের পুঁতি উৎপাদনকেন্দ্র। …পুরাতন ব্রহ্মপুত্রনদ এবং এর শাখা আড়িয়াল খাঁ, পাহাড়িয়া (কলাগাছিয়া), গঙ্গাজলী ও কয়রা এ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। …এখনো উয়ারী গ্রামের উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে প্রাচীন কয়রা নদীর সংকীর্ণ খাত। একসময় হয়তো এই নদীই ছিলো আরও প্রশস্ত। কয়রা নদীর আরও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ মিশেছে আড়িয়াল খাঁ (ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা) নদীর সঙ্গে। এই পুরাতন ব্রহ্মপুত্রই ছিল একদা ব্রহ্মপুত্র নদের মূল স্রোত। ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদের মূল গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যায়, ফলে এটি পরিচিত হতে থাকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ হিসেবে। বর্তমান আড়িয়াল খাঁ ও ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গমস্থল থেকে উয়ারী-বটেশ্বরের দূরত্ব চার কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। …সম্ভবত উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলের অধিবাসীরা পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের (কয়রা, গঙ্গাজলী, পাহাড়িয়া, আড়িয়াল খাঁ শাখাসহ) তীরবর্তী উর্বর উপত্যকা ভূমিতে কৃষিকাজের সেচের জন্য নদ-নদীর পানি ব্যবহার করত। মৎস্য শিকার, যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে নদ-নদীর ব্যবহার ছিল খুবই কার্যকর এবং বিকল্পরহিত। এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও সংস্কৃতিতে, তাদের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে এবং এ অঞ্চলে যে সমৃদ্ধ নগরব্যবস্থার প্রমাণ ইতিমধ্যে উন্মোচিত হয়েছে, তাতে এ অঞ্চলের নদ-নদীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
হাড়িধোয়া
নরসিংদীর একটি ছোটো নদী হাড়িধোয়া। আড়িয়াল খাঁ নদীটি খাসেরচর এবং নলবাটার মধ্য দিয়ে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়ে তার প্রবাহের গতিধারা পশ্চিম দিকে নরসিংদী পুরাতন থানার ঘাট পর্যন্ত এসে এই প্রবাহের নদীকে জন্ম দিয়েছে। নদীটি ছোটো হলেও নরসিংদীর একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। বর্তমানে শিল্পবর্জ্যে নদীটি চরমভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে।
নদীটির নামকরণ সম্পর্কে ইতিহাসবিদ-সাংবাদিক আপেল মাহমুদের বক্তব্য : হাড়িধোয়ার তীরে হাজীপুর ও নরসিংদী বাজারে একসময় কুমার ও পাল সম্প্রদায়ের লোকেরা বিপুল পরিমাণে মাটির জিনিসপত্র তৈরি করতো এবং উক্ত নদীতে সেগুলো ধোয়া-মোছার কাজ করতো। সম্ভবত এ হাড়ি-পাতিল ধোয়ার কাজ থেকে হাড়িধোয়া নামটি এসেছে। বর্তমানেও উক্ত নদীর তীরে অবস্থিত হাজীপুর ব্রিজের পশ্চিম পাশের জায়গাটি পাতিলবাড়ি হিসেবে পরিচিত। এই পাতিলবাড়ি থেকে শহরের হেমেন্দ্র সাহার মোড় পর্যন্ত সড়কের নাম হয়েছে পাতিল বাড়ি রোড।
হাড়িধোয়া নদী | ছবিটি নরসিংদী সদর উপজেলার পুরানপাড়া অংশ থেকে তোলা
নদীটি নরসিংদী বাজার, হাজীপুর, বৌয়াকুড়, আরশীনগর, বীরপুর, পুরানপাড়া, বাদুয়ারচর, পুটিয়া বাজার, ঘোড়াদিয়া, ভরতেরকান্দি, ভেলানগর, চিনিশপুর ও চর্ণগরদী হয়ে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে মিলিত হয়েছে। নদীটির প্রবাহিত জেলা : নরসিংদী। প্রবাহিত উপজেলা : নরসিংদী সদর, শিবপুর ও পলাশ। নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৮ কিলোমিটার। প্রশস্ততা গড়ে ৬১ মিটার। নদীটির গতিপ্রকৃতি সর্পিলাকার। নদীটি দেখতে খুবই সুন্দর, যদিও শিল্পবর্জ্যে দূষিত। তীরবর্তী স্থাপনা : নরসিংদী পৌরসভা ও বাজার, পুটিয়া বাজার, কালী বাজার। এই নদীর উপর দিয়ে পুরানপাড়ায় ঢাকা-নরসিংদী-চট্টগ্রাম রেলসেতু, ভেলানগরে ঢাকা-নরসিংদী-সিলেট মহাসড়কসহ অনেকগুলি সেতু রয়েছে। হাড়িধোয়ার পাড়ে বেশকিছু ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা গড়ে ওঠেছিলো। নদীটির উৎসস্থলের সাথেই নরসিংদী পাতিলবাড়ির সন্নিকটে দেশখ্যাত কবিয়াল ও বৈষ্ণবসাধক কবিগুণাকর হরিচরণ আচার্যের বসতবাড়ি, সমাধি এবং শ্রী শ্রী বিষ্ণুপ্রিয়া আশ্রম গড়ে তোলা হয়েছে। একটু অগ্রসর হলেই বৌয়াকুড় নদীপাড়ে সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য, আধ্যাত্মিক সাধক, গীতিকার সামসুদ্দিন আহমেদ এছাকের সমাধি এবং তাঁর গড়ে তোলা ‘আরশীনগর’। চিনিশপুরের ঐতিহাসিক কালীবাড়ী মন্দির ও আশ্রম, যেখানে একসময় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ছিলো।
নদীপাড়ের বীরপুর-পুরানপাড়ার হাজীপুর অংশে জেলেপাড়া রয়েছে। এই জেলেপাড়ার দিকে তাকালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’-তে বর্ণিত ঘনবসতিপূর্ণ জেলেপাড়ার বর্ণনার কথা স্মরণে আসে।
কলাগাছিয়া/পাহাড়িয়া
পাহাড়িয়া নামের এই নদীটি নরসিংদী জেলাধীন বেলাব-শিবপুর উপজেলার বিলাঞ্চল থেকে উৎপত্তি লাভ করে শিবপুর সদরের শিবপুর বাজারের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শিবপুরের পুরানদিয়া, পালপাড়া, ব্রাহ্মন্দী, খলাপাড়া বাজার, নোয়াদিয়া, জাঙ্গালিয়া হয়ে রায়পুরা উপজেলার ডৌকারচর দিয়ে আমীরগঞ্জের কাছে আড়িয়াল খাঁ নদীতে পতিত হয়েছে।
স্থানীয়ভাবে নদীটি কলাগাইছ্যা (কলাগাছিয়া) নদী নামে সর্বাধিক পরিচিত। নদীর উৎসমুখ বিলাঞ্চল, পতিত হয়েছে আড়িয়াল খাঁ নদীতে। প্রবাহিত হয়েছে নরসিংদী জেলার বেলাব, শিবপুর, রায়পুরা উপজেলার মধ্য দিয়ে। নদীর র্দৈঘ্য প্রায় ২৮ কিলোমিটার, প্রশস্ততা গড়ে ৫৭ মিটার। নদীর গতিপথ সর্পিলাকার। নদীতে সারাবছর পানির প্রবাহ দেখা যায়। তবে বর্ষা মৌসুমে এর প্রবাহমানতা অনেকটা বেড়ে যায়। নদীটি তুলনামূলকভাবে দুষণমুক্ত। শুকনো মৌসুমে নদীর পানিপ্রবাহের দু’পাশের শুকনো জায়গায় ধানের চারা উৎপাদন ও ধানের চাষে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বর্তমানে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। একসময় এই নদীতে লঞ্চ চলতো যাতায়াতের জন্যে। নদীর দুই পাড়ের জনপদে প্রচুর তরি-তরকারি, ফলমূল ও নানা কৃষিপণ্যের প্রচুর ফলনের পেছনে এই নদীর ভূমিকা রয়েছে। সর্পিলাকার এই নদীর গতিপথের দৃশ্য খুবই মনোরম। নরসিংদীর বিশিষ্ট ছড়াকার আবু আসাদ রচিত ‘বর্ষা এলো, বৃষ্টি এলো’ নামে গীতি-নৃত্যনাট্যে এই কলাগাছিয়া নদীর সুন্দর বর্ণনা রয়েছে।
মেঘনা
পৃথিবীর বৃহৎ নদীগুলোর অন্যতম মেঘনা এবং বাংলাদেশে প্রশস্ততায় বৃহত্তম নদী। হিমালয় বলয় বহির্ভূত নদী মেঘনা। আসামের পার্বত্য অঞ্চল থেকে জন্ম নিয়ে ‘বরাক’ নদী আসামের শেরপুরের কাছে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উত্তরের শাখা সুরমা পশ্চিম দিকে ছাতক, সিলেট ও সুনামগঞ্জের উপর দিয়ে ধীর ও সর্পিল গতিতে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করেছে। মেঘনা ভৈরব বাজারের কাছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হয়েছে। তারপর আরো দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে চাঁদপুরের কাছে পদ্মা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। আরো দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে নোয়াখালী ও ভোলা দ্বীপের মধ্য দিয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। সুরমাসহ মেঘনা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৫০ মাইল।
মেঘনা নদী মোট দুটি অংশে বিভক্ত। একটি মেঘনা আপার, অপরটি মেঘনা লোয়ার। উৎস থেকে শুরু করে চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলাধীন ষাটনল পর্যন্ত মেঘনা আপার। নরসিংদী জেলায় প্রবাহিত মেঘনার অংশটি আপার। চাঁদপুর থেকে শুরু করে মেঘনা-পদ্মার মিলিত স্রোত মেঘনা লোয়ার নামে পরিচিত।
মেঘনা পৃথিবীর বড়ো নদীগুলোর মতোই অনেক বেশি বৃষ্টির পানি বহন করে। খাসিয়া-জয়ন্তীয়া পাহাড়, শিলং উপত্যকা ও চেরাপুঞ্জির বৃষ্টির পানি বহন করে আনে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টির বিপুল জলরাশির জন্যে সিলেটে বড়ো বড়ো বিল বা হাওর তৈরি হয়েছে।
চাঁদপুরের কাছে পদ্মা-মেঘনার মিলনস্থলে এবং মেঘনার মোহনার বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যায়। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় মেঘনার নৌ-পথ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মেঘনার কোনো কোনো অংশে, বিশেষ করে ভৈরব-আশুগঞ্জ, নরসিংদী, আড়াইহাজার, দাউদকান্দি অংশের তীরে প্রচুর শিল্পকারখানাও গড়ে ওঠেছে। ভৈরবের রেলওয়ে সেতু, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সেতু, কুমিল্লার দাউদকান্দিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সেতুর যোগাযোগে বিশাল ভূমিকা রয়েছে। মেঘনা নদী নিয়ে দেশ-বিদেশের অনেক কবি-সাহিত্যিক কবিতা-গান রচনা করেছেন। মেঘনার অববাহিকায় রয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত উর্বর ফসলি জমি।
মেঘনা নদী কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবের কাছে এসে ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার সঙ্গমস্থলে নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার রামনগর-গৌরীপুর দিয়ে নরসিংদী জেলায় প্রবেশ করেছে। এখানে মেঘনার দুটি ধারা। মূল ধারাটি পূর্ব-দক্ষিণ পাড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ, নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর উপজেলার সীমান্ত এবং পশ্চিম-দক্ষিণ পাড়ে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চাঁনপুর, পাড়াতলী, বাঁশগাড়ী, মির্জানগর, চরমধুয়া হয়ে নরসিংদী সদর অতিক্রম করে দক্ষিণমুখী হয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অন্য ধারাটিও বিশাল প্রশস্ততায় রায়পুরার মহেষপুর, রায়পুরা সদর, শ্রীনগর, চরসুবুদ্ধি, নীলক্ষ্যা, চর আড়ালিয়া হয়ে নরসিংদী সদর উপজেলার নরসিংদী পৌরসভা এলাকা অতিক্রম করে শিলমান্দী, মহিষাশুড়া, পাইকারচর হয়ে মূল মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে। মাঝখানের চরে নরসিংদী সদর উপজেলার ৪ টি ইউনিয়ন নদীর পলিতে গড়ে ওঠেছে।
মেঘনা নদী | ছবিটি নরসিংদী সদর উপজেলার শেখ হাসিনা সেতুর করিমপুর অংশ থেকে তোলা | ছবিসূত্র : ইন্টারনেট
নরসিংদী জেলার রায়পুরা এবং নরসিংদী সদর উপজেলায় মেঘনা নদী প্রবাহিত হয়েছে। রায়পুরা এবং নরসিংদী সদরে বিশাল চরাঞ্চল গড়ে ওঠেছে মেঘনা নদীর পলিমাটিতে। রায়পুরায় চাঁনপুর, পাড়াতলী, শ্রীনগর, বাঁশগাড়ী, চরমধুয়া, মির্জাচর— এই ৬ টি ইউনিয়নের অসংখ্য গ্রাম মেঘনার দুই প্রবাহের মাঝখানে পলিতে গড়ে ওঠা বিশাল জনপদ। নদীর পশ্চিম প্রান্তের অংশেও মহেষপুর, চরসুবুদ্ধি, নীলক্ষ্যা, চর আড়ালিয়া, নদীর পলিতে গড়া জনপদ। নরসিংদী সদর উপজেলার ৪ টি ইউনিয়ন করিমপুর, নজরপুর, আলোকবালী, চরদিঘলদীর অসংখ্য গ্রামও নদীর মূল দুই প্রবাহের মাঝখানে গড়ে ওঠা চরাঞ্চল। মেঘনার প্রবাহের এই বিশাল চরাঞ্চলে মেঘনা নদীর মূল দুই প্রবাহের পাশাপাশি মেঘনার অসংখ্য শাখাও জালের মতো বিস্তৃত হয়ে আছে। নরসিংদীর মানচিত্রের দিকে তাকালে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। এই চরাঞ্চল নরসিংদীর জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিকে করেছে বৈচিত্র্যময়। এই বৈচিত্র্য নরসিংদীর ভূমিতে বিশেষভাবে দৃষ্টিযোগ্য। নরসিংদী জেলার উত্তর-পূর্ব দিকে লালমাটির পাহাড়, টিলা, ব্রহ্মপুত্র নদের পলিতে গড়া প্রাচীন সমতল ভূমি, বৃক্ষরাজির বনাঞ্চলের বৈচিত্র্যময় এলাকা। সেখানে কয়েক হাজার বছর পূর্বের উয়ারী-বটেশ্বরসহ অনেক প্রত্নস্থান আবিষ্কৃত হয়েছে। দক্ষিণ অংশে মেঘনার নতুন মাটির বিশাল চরাঞ্চল, যে-অঞ্চলের ভাষা, জীবনযাত্রা, প্রাকৃতিক পরিবেশ নরসিংদীকে বৈচিত্র্যমণ্ডিত করেছে।
নদীবেষ্টিত নরসিংদীর চরাঞ্চলের মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষি ও মাছ ধরা। সারা বছরই মাছ ধরার কাজ চলে। শীত মৌসুমে জালের মতো জড়িয়ে থাকা নদীর শাখা-প্রশাখায় প্রচুর মাছের ঘের থেকে বড়ো বড়ো মাছ ধরা হয়। নদীপাড়ের এই জনপদে ধান, পাট, গম, আলু, মরিচ, সরিষা ছাড়াও প্রধান অর্থকরী ফসল উচ্ছে, তরমুজ, বাঙ্গি, খিরা প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। আর রয়েছে গৃহপালিত পশু-পাখি। পানিবেষ্টিত এলাকা হিসেবে প্রচুর হাঁস পালিত হয় এই অঞ্চলে।
অতীতে চরাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের প্রধান বাহন ছিলো নৌকা এবং পায়ে হাঁটা। ঘরে ঘরে ছিলো নৌকা। বর্তমানে রাস্তাঘাট হয়েছে। নরসিংদী সদরের চরাঞ্চলের সাথে যোগাযোগের জন্যে মেঘনা নদীতে শেখ হাসিনা সেতু নির্মিত হয়েছে। এই সেতু মানুষের জীবনযাত্রার ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। নরসিংদীর মেঘনায় এখনো লঞ্চ চলে; নরসিংদী হতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মরিচা, বাঞ্ছারামপুর, সলিমগঞ্জ, নবীনগর রুটে। সিলেট, সুনামগঞ্জ থেকে ভৈরব বাজার-আশুগঞ্জ-নরসিংদী হয়ে মেঘনার নৌ-পথে ভারি-মাঝারি-ছোটো নৌ-যানে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনসহ সারাদেশের সাথে এখনো যোগাযোগ রয়েছে। একসময় নারায়ণগঞ্জ থেকে ভৈরব বাজারের মেঘনার নৌ-পথে স্টিমার চলতো। নরসিংদী অংশে গুরুত্বপূর্ণ ঘাট ছিলো ভঙ্গারচর (বালাপুর জমিদার বাড়ির ঘাট), নরসিংদী সদর ঘাট, হাইরমারা-মনিপুরা বাজার, রায়পুরা।
নরসিংদীর মেঘনা নদীবাহিত চরাঞ্চলের একটি অসুন্দর বিষয়ও যুগ যুগ ধরে বহন করতে হচ্ছে জনপদটিকে। সেটি হলো বংশগত-গোষ্ঠীগত-গ্রামগত বিরোধ ও অন্যান্য তুচ্ছ সমস্যা নিয়ে মারামারি-খুনখারাবি। ঘোষণা দিয়ে লাঠি, পুরকি, বল্লম, রামদা’, বাঁশের চিকন ফলাযুক্ত নানা অস্ত্র নিয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষ ও লড়াই, যা একটানা কয়েকদিনও চলে। সারাদেশের মানুষ এই লড়াইকে ট্যাঁটাযুদ্ধ হিসেবে চেনে।
এই চরাঞ্চলে অনেক গুণীজনেরও জন্ম হয়েছে, যাঁদের শৈশব কেটেছে নদীপাড়ের জীবনযাত্রায়। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম যোদ্ধা শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের নাম, যাঁর পৈতৃক নিবাস ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার মিলনস্থল রায়পুরার রামনগরে। একই গ্রামের সন্তান সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ আলাউদ্দিন আল আজাদ, মুক্তিযোদ্ধা ও আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন। রায়পুরার পাড়াতলী গ্রামের সন্তান ও আমাদের কালের শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি শামসুর রাহমানসহ অনেক গুণী মানুষের জন্ম ও শৈশবস্মৃতি নিয়ে বেড়ে ওঠা এই মেঘনার পাড়। কবি শামসুর রাহমান মেঘনা নদী নিয়ে তাঁর ‘একজন নদীর উদ্দেশে’ কবিতায় অসাধারণ ও আবেগময় অনুভূতি প্রকাশ করেছেন :
মাতামহ, পিতা নব্য জীবিকার টানে গ্রাম বাংলার ছোট পাড়াতলী ছেড়ে, থই থই ধানশোভা, মেঘনার তটভূমি, তরঙ্গে তরঙ্গে রৌদ্র-চাঁদিনীর ব্যালে অনেক পেছনে রেখে ইট পাথরের বেগানা শহরে ডেরা বাঁধলেন। শর্ষেক্ষেতময় প্রজাপতি, ঘুঘু, মেঘনার ঢেউয়ের সঙ্গীত রক্তে দিয়েছে অদম্য কত দোলা। * * * মেঘনা আমার প্রিয়া কেন এমন ব্যাকুল ডাকো বারবার? মেঘনা আমার শৈশবের, যৌবনের কতদিন করেছ হরণ অনায়াসে, আমার ভেতরে জাগিয়েছ কী বিপুল অগণিত ঢেউ, আজও এই আমার নবীন বার্ধক্যের নানান প্রহরে ঝলসে উঠছ তুমি, কখনও কখনও তোমার নিকট যাই, ছুঁই তোমার শরীর গাঢ় অনুরাগে, জানি মৃত্যুর পরেও আমি দেখব তোমাকে ভাবীকালে যুগযুগান্তরে বংশধরদের উৎসুক দৃষ্টিতে।
শেষকথা
জীবন নদীর মতোই গভীর ও বহমান। নরসিংদীর পুরো জনপদকে ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা এবং তাদের শাখা শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ, কলাগাছিয়া, হাড়িধোয়া, গঙ্গাজলী, কয়রা একেবারে মাকড়সার জালের মতো ঘিরে আছে নদীর বহমান ধারায়। এই নদীগুলোই নরসিংদীর প্রাণ, প্রাণের প্রবাহ। অথচ যে-নদীগুলো নরসিংদীর প্রাণ, নরসিংদীর জন-জীবনের প্রাণ, সেই নদীগুলো অনেক জায়গায় আজ মৃত। মানুষ ও প্রকৃতির বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় নদীর মৃত্যুঘণ্টা বাজছে। পয়ঃনালী, ড্রেনের দূষিত পানি, শিল্প ও কল-কারখানার বর্জ্য, লঞ্চ ও নৌ পরিবহনের জ্বালানি তেলের বর্জ্য নদীর পানিকে করেছে দূষিত। পাঁচদোনা-মাধবদীতে মৃত ব্রহ্মপুত্র’র ক্ষীণ প্রবাহে শিল্পবর্জ্য, হাড়িধোয়ার পানি ও মাটির দূষণ, শীতলক্ষ্যা-মেঘনার দূষিত পানি আমাদের নরসিংদীবাসীকে প্রতিনিয়ত কাঁদায়। একদিকে নদীর নাব্যতা কমছে, পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে নদী-পরিবেশ শিকার হচ্ছে দূষণের। নদী, নদীর মাটি, পানির প্রবাহ যেভাবে মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছে, তা থেকে আমরা নদীকে বাঁচাতে চাই। বাঁচাতে চাই নরসিংদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং দীর্ঘকালে গড়ে ওঠা জনপদকে। আর সত্যিকার অর্থেই যদি তা চাই, তাহলে চিন্তা-ভাবনা বা অপেক্ষার এখন আর অবকাশ নেই। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা মাথায় রেখে এখনই কাজে নেমে পড়তে হবে।
তথ্যসূত্র
১. মহেশ্বরদীর ইতিহাস, সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থ;
২. বাংলাদেশের নদ-নদী, মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক;
৩. বাংলাদেশের নদীকোষ, ড. অশোক বিশ্বাস;
৪. বাংলাদেশের নদী, মোকারম হোসেন;
৫. ঢাকার ইতিহাস, যতীন্দ্রমোহন রায়;
৬. উয়ারী-বটেশ্বর : শেকড়ের সন্ধানে, সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ও মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান;
৭. নদী সংখ্যা ১৯৯৯-২০০০, মীজানুর রহমান ত্রৈমাসিক পত্রিকা;
৮. নরসিংদীর নদ-নদীর বিবরণ, আপেল মাহমুদ সাথী।
গোলাম মোস্তাফা মিয়া
সাবেক অধ্যক্ষ, নরসিংদী সরকারি কলেজ
নেতাজির অনুগামী, শুভাকাঙ্ক্ষী আর পৃষ্ঠপোষকের কোনো অভাব ছিলো না পূর্ববঙ্গে। এর মধ্যে একজন ছিলেন নরসিংদীর জমিদার ললিতমোহন রায় বিএবিএল। তিনি ছিলেন নেতাজির ভাইপো ডা. শিশির কুমার বসুর শ্বশুর। অর্থাৎ কৃষ্ণা বসুর নানা। একজন শিল্পপতি, শিক্ষাবিদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে ললিতমোহন ছিলেন ভারতবর্ষব্যাপী পরিচিত। বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামী ছিলেন। তিনি ছিলেন কলকাতা বেঙ্গল ল্যাম্পসের প্রতিষ্ঠাতা। উক্ত ল্যাম্প কারখানা ছিলো ভারতবর্ষের বৈদ্যুতিক বাল্ব উৎপাদনকারী প্রথম প্রতিষ্ঠান।
এলগিন রোডের বসু পরিবার, নরসিংদীর সাটিরপাড়ার রায় জমিদার বাড়ি আর কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর চৌধুরী পরিবার একে অপরের আত্মীয় ছিলো। নরসিংদীর জমিদার ললিতমোহন রায়ের মেয়ে ছায়া দেবীর বিয়ে হয়েছিলো নীরদ সি চৌধুরীর ভাই চারুচন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে। অপরদিকে তাঁদের মেয়ে কৃষ্ণা বসুর সম্বন্ধ হয় সুভাষচন্দ্রের বড়ো ভাই শরৎচন্দ্র বসুর ছেলে ডা. শিশির কুমার বসুর সঙ্গে। তাঁদের সন্তান সুগত বসু, শর্মিলা বসু, ও সুমন্ত্র বসু। কৃষ্ণা বসুর জন্ম তাঁর দাদু (মাতামহ) ললিত রায়ের ঢাকাস্থ লক্ষ্মীবাজারের বাড়িতে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ডিসেম্বর। শিশির বসুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিলো ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর। ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি ৮১ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন।
অনেকে মনে করেন, আত্মীয়তা সূত্রে নেতাজির সঙ্গে ললিতমোহন রায়ের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিলো। কোনো কোনো গবেষক যুক্তি দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, একই আদর্শের রাজনীতির কারণেই সুভাষচন্দ্র তাঁর ভাইপোকে ললিতমোহনের নাতনীকে বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছিলেন। তাছাড়া ডা. শিশির বসুর বাবা শরৎ বসু স্বাধীনতাপ্রেমী ও কংগ্রেস রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ট ছিলেন। ললিতমোহনও একই রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।
তবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র আর ললিতমোহনের রাজনীতি একই সূত্রে গাঁথা ছিলো। দুজনেই কংগ্রেসের রাজনীতি করলেও বিশ্বাস করতেন, সশস্ত্র আন্দোলন ছাড়া এই দেশ থেকে উপনিবেশবাদী ব্রিটিশদের তাড়ানো সম্ভব নয়। আলোচনার টেবিলে বসে চা-নাস্তা খাওয়ার নামে রাজনীতি করলে স্বাধীনতার পথ আরো দীর্ঘায়িত হবে। যার কারণে সশস্ত্র বিপ্লবে জড়িত বিভিন্ন দল— যেমন : অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর পার্টি, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স, সূর্যসেনের দল (ইন্ডিয়ান রিপাবলিক আর্মি) প্রভৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন দুজনেই। নেতাজি তো দেশ ছেড়েছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করার জন্যে।
ললিতমোহন রায় আইনজীবী হিসেবে ঢাকা ও নারায়ণঞ্জ বারের নেতৃত্ব দিলেও তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিলো দেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। সেজন্যে তিনি নিজে স্বদেশি স্টিমার কোম্পানি খুলেছিলেন। এর মূল অফিস ছিলো নারায়ণগঞ্জে। ব্রিটিশ মালিকানাধীন স্টিমার কোম্পানিকে টেক্কা দেবার জন্যেই তিনি সেটা করেছিলেন। স্বদেশি জাহাজে যাত্রী পরিবহনের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে অনেক বিপ্লবীদের চাকুরি দেয়া হয়েছিলো। তাঁরা সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে জাহাজে চলে যেতেন। পুলিশ অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বিপ্লবীদের পেতো না। প্রখ্যাত বিপ্লবী মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ললিতমোহন রায়ের প্রতিষ্ঠিত স্বদেশি স্টিমারে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন।
ললিতমোহন রায় ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পিতা কালী কুমার রায়ের নামে সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশন নামে একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। লেখাপড়ায় স্কুলটি সুনাম অর্জন করে। এরচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের কারণে। উক্ত স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি শরীরচর্চা, লাঠি খেলা ও ছোরা চালনা শেখানো হতো। স্কুলের শিক্ষক মহিমচন্দ্র নন্দী, ছাত্র মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, সতীশচন্দ্র পাকড়াশী প্রমুখ অনুশীলন সমিতির শাখা গড়ে তুলেছিলেন স্কুলে। ফলে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা এসব কর্মকাণ্ডের রিপোর্ট দেয় ঊর্ধ্বতন মহলে। এতে ব্রিটিশ প্রশাসন ক্ষুব্ধ হয়ে সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশনের সরকারি অনুদান বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এসব বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের মূল উৎসাহদাতা ছিলেন জমিদার ও আইনজীবী ললিতমোহন রায়। তিনি স্কুলের যে-আবাসিক ছাত্রাবাস ও শিক্ষক কোয়ার্টার নির্মাণ করেছিলেন, সেখানে বিভিন্ন বিপ্লবীদের লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করতেন। এমনকি তিনি তাঁর জমিদার বাড়ির অনেককে বিপ্লবী দলে যোগদানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তেমন একজন বিপ্লবী সুনীল বরণ রায়, যিনি পরবর্তীতে হুগলির চন্দননগরের গভর্নর হয়েছিলেন। জমিদার ললিতমোহন রায়ের ঘনিষ্ঠ কবিয়াল হরিচরণ আচার্য্য বহু স্বদেশি গান গেয়ে মানুষদের সচেতন করতেন।
অতীতে মহেশ্বরদী পরগণা ছাড়াও ভাওয়াল পরগণার কিছু এলাকায় তাঁর জমিদারি এস্টেট ছিলো। তিনি তাঁর পুরো জমিদারিতে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় শুধুমাত্র মহেশ্বরদী পরগণাতেই পঞ্চাশটি বিপ্লবী আখড়া গড়ে ওঠেছিলো, যেগুলোর নেতৃত্বে ছিলো অনুশীলন সমিতি। বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষা নেবার জন্যে তাঁরা চিনিশপুর কালী মন্দিরকে বেছে নিয়েছিলেন। জঙ্গলাকীর্ণ সেই কালী মন্দিরটি জনমানবহীন থাকতো। এই সুযোগে বিপ্লবীরা সেখানে গিয়ে নিজের রক্তে তিলক এঁকে কালীমূর্তির সামনে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার দীক্ষা গ্রহণ করতেন। বিপ্লবী দল অনুশীলন সমিতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ললিতমোহন রায়ের নাম গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিলো। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হবার পর। ব্রিটিশ সরকারকে উৎখাতের জন্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের অভিযোগ এনে এই মামলা দায়ের হয় ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে।
ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে এই মামলার অন্যতম আসামী মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী তাঁর লেখা ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাকভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, উক্ত মামলার আইনজীবী ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস। তিনি মামলা উপলক্ষে কলকাতা থেকে ঢাকা আসতেন। ব্যারিস্টার দাসের আগমন উপলক্ষে ঢাকায় বিপ্লবীদের শোভাযাত্রা হতো। যখন জেলখানা থেকে বিপ্লবীদের কোর্টে আনা হতো, তখন তাঁদের গাড়ি ঘিরে শত শত বিপ্লবী পদযাত্রা করতো। দুই বছর ধরে চলা মামলাটির মূল তদারককারি ছিলেন সাটিরপাড়ার জমিদার ললিতমোহন রায়।
জমিদারি, স্টিমার ব্যবসা ও আইন পেশার বাইরেও ললিতমোহন রায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে মনোযোগ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করাকে তিনি দেশপ্রেম মনে করতেন। এক্ষেত্রে তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রখ্যাত স্বদেশি নেতা ও বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়। একদিন প্রফুল্লচন্দ্র জমিদার ললিত বাবুকে দেখে বললেন, জমিদারির পাশাপাশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলুন। দেশ শিল্পে সমৃদ্ধ না হলে স্বাধীনতা লাভ করে পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাবে না। কথাটি ললিত বাবুর বেশ মনে ধরলো। তাই তিনি চিন্তা-ভাবনা করে দুই ছেলেকে প্রযুক্তিবিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্যে আমেরিকা ও জার্মানিতে পাঠান। ভারতের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, লেখক ও কংগ্রেস নেতা কৃষ্ণা বসু ‘হারানো ঠিকানা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ললিতমোহন রায় তাঁর মেজো ছেলে সুরেন্দ্রকুমার রায়কে আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পাঠান। কিরণ রায়কে পাঠানো হলো কেমব্রিজের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)-তে। সুরেন রায়কে পাঠানো হলো জার্মানিতে, ইলেকট্রিক প্রযুক্তিতে মাস্টার্স করার জন্যে। সেটা ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। ছেলেরা বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পর ললিতমোহন রায় তাঁদেরকে কলকাতায় একটি ল্যাম্প কোম্পানি খোলার নির্দেশ দিলেন। উক্ত কোম্পানির নামকরণ করেন ‘বেঙ্গল ল্যাম্পস লিমিটেড’। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ল্যাম্প কারখানা স্থাপিত হয়। প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস’ নামের আদলে কোম্পানির নাম রাখা হয়। বেঙ্গল ল্যাম্পস প্রতিষ্ঠার আগে কলকাতার বৈদ্যুতিক বাতির বাজার নিয়ন্ত্রণ করতো নেদারল্যান্ডসভিত্তিক বৈদ্যুতিক বাতির কোম্পানি ‘ফিলিপস’। সেই ফিলিপসকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে যায় স্বদেশি বাল্ব তৈরির কারখানা বেঙ্গল ল্যাম্পস। কলকাতার যাদবপুর, কসবা, বেহালা ছাড়াও ব্যাঙ্গালোরে বেঙ্গল ল্যাম্পসের কারখানা স্থাপিত হয়। বিদেশি কোম্পানিকে পেছনে ফেলে একটি স্বদেশি কোম্পানির এগিয়ে যাবার বিষয়টি সে-সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেছিলো। নরসিংদীর জমিদার ললিতমোহন রায় এবং হেমেন রায় মিলে যে-সাফল্য অর্জন করেন, তা দেখে অনেক বাঙালি ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও বৃহৎ শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার জন্যে এগিয়ে এসেছিলেন।
কৃষ্ণা বসুর বিবরণ থেকে জানা যায়, কিরণ রায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী ছিলেন। পরে বেঙ্গল ল্যাম্পস প্রতিষ্ঠার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন। কিন্তু হিমালয় ভ্রমণ করতে গিয়ে তুষারপাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছিলো। সুরেন রায়ও যাদবপুর কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী এবং পরিচালনা পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সুরেন ও হেমেন রায় বেঙ্গল ল্যাম্পস ফ্যাক্টরির পাশেই সুসজ্জিত বাসভবন নির্মাণ করে বসবাস করতেন।
জানা যায়, দেশভাগ ও অব্যাহত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পূর্ববঙ্গ থেকে হাজার হাজার হিন্দু পরিবার পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তার বড়ো একটি অংশ দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর এলাকায় উদ্ধাস্তু হিসেবে বসবাস করতে থাকে। তাদের জন্যে ভারত সরকার সেখানে বেশকিছু উদ্ধাস্তু কলোনি প্রতিষ্ঠা করে দেয়। তখন বেঙ্গল ল্যাম্পসের পক্ষ থেকে উদ্ধাস্তুদের নানাভাবে সহযোগিতা করা হয়।
এর প্রতিদানও পেয়েছে ললিতমোহন রায়ের আত্মীয়-স্বজনেরা। নাতনি কৃষ্ণা বসু বারবার সংসদ নির্বাচনে জয় লাভ করেছেন যাদবপুর আসন থেকে। তাঁর ছেলে সুগত বসুও একই আসন থেকে জয় লাভ করেন। এর নেপথ্যে বেশকিছু কারণ ছিলো। প্রথম তিনটি কারণ হলো : এক. কৃষ্ণা বসু ও সুগত বসু নেতাজি সুভাষচন্দ্রের পারিবারিক লোক; দুই. দাদু (মাতামহ) ও তাঁর সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল ল্যাম্পসের সুনাম; তিন. যাদবপুর এলাকার সিংহভাগ মানুষ পূর্ববঙ্গের উদ্ধাস্তু, যাদের বড়ো একটি অংশ স্বাধীনতা যুদ্ধে বিপ্লবী দলের সদস্য হিসেবে নেতাজি ও ললিতমোহনকে শ্রদ্ধা করতেন।
কৃষ্ণা বসু প্রথম কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম যাদবপুর কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯৮ ও ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে তৃণমূল কংগ্রেস থেকে একই আসনে সাংসদ হিসেবে জয়লাভ করেন। মায়ের আসন থেকে তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে সুগত বসু ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে সাংসদ হন। তিনি একজন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ। আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তনী পরে আর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আগ্রহ দেখাননি। তারপর কবির সুমন ও মিমি চক্রবর্তী যাদবপুর থেকে সাংসদ হন। নেতাজিকে নিয়ে সুগত বসুর ইংরেজি ভাষায় গবেষণা রয়েছে।
কৃষ্ণা বসু দীর্ঘ ৪০ বছর কলকাতার খ্যাতনামা সিটি কলেজের শিক্ষক ছিলেন। কিছুদিন অধ্যক্ষ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তবে লেখালেখিতে তিনি বেশি সুনাম অর্জন করেছেন। নেতাজি সম্পর্কে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন, যা পাঠকের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। লিখেছেন একাধিক স্মৃতিকথা বিষয়ক গ্রন্থ। গ্রন্থগুলো হলো— ইতিহাসের সন্ধানে, এমিলিয়ে ও সুভাষ : এক অনন্য সম্পর্কের কাহিনি, পার্লামেন্টের অন্দরমহলে, চরণরেখা তব, প্রবন্ধ সংগ্রহ (১৯৫১-২০২০), প্রসঙ্গ সুভাষচন্দ্র, ছোটদের নেতাজি, হারানো ঠিকানা, ১৯৪৭ স্মৃতি-বিস্মৃতি, ভ্রমণ দেশে দেশে, এক নম্বর বাড়ি প্রভৃতি।
লেখালেখির পাশাপাশি কৃষ্ণা বসু নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর প্রধান ছিলেন, যার মাধ্যমে তিনি সুভাষ বসুর রাজনৈতিক আদর্শ ও দেশপ্রেমের ভাবনা-চিন্তাকে প্রসারিত করেছেন। সাংসদ থাকাকালে তিনি পার্লামেন্টরি স্ট্যান্ডিং কমিটি অন এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্সের চেয়ারম্যান, কমিটি অন অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন কমিটির সদস্য ছিলেন। তৃণমূল কংগ্রেসের সবচেয়ে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি সবার কাছ থেকে মাতৃসম সম্মান পেতেন।
লেখালেখির জন্যে কৃষ্ণা বসু প্রতিশ্রুতি পুরস্কার, সোপান পুরস্কার, শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার, উত্তর পথ পুরস্কার, কবি বিষ্ণু দে পুরস্কার, উৎসব পুরস্কার, আল্পনা আচার্য স্মৃতি পুরস্কার ও রাইটার ইন রেসিডেন্স সম্মাননা লাভ করেন। একজন কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও তিনি খ্যাতনামা ছিলেন। নিয়মিত লিখতেন আনন্দবাজার, সংবাদ প্রতিদিনসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকায় কলাম লিখে বেশ সুনাম অর্জন করেন।
আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক
১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি লাভ করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র— বাংলাদেশ। এ-দেশের সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগ, মৃত্যু আর রক্তের বিনিময়ে এটা সম্ভব হয়েছিলো। তবে এই স্বাধীনতা হঠাৎ করে শুরু হয়ে যায়নি। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই ধাপে ধাপে নানান তৎপরতা ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৯৭১ সালে এসে পরিণতি লাভ করে। গোটা দেশের মানুষ নিজেদের এই স্বাধীনতার পথে সম্মিলিতভাবে বিলিয়ে দিয়েছিলো অকুণ্ঠচিত্তে। আর এই বিলিয়ে দেয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবার আত্মলীনপথে অনেক রাজনৈতিক নেতার তৎপরতা প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলো।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলার দামাল সন্তানেরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকায় বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিল বের করে। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। সালাম, বরকত, রফিকের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। এই হত্যার প্রতিবাদে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে গোটা দেশ। নরসিংদী জেলায়ও এই হত্যার খবর পৌঁছামাত্র জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মতো ফুঁসে ওঠে জনতা। নরসিংদী, রায়পুরা, মনোহরদী, শিবপুর, পলাশ ও বেলাব থানার প্রতিটি স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল এবং সমাবেশের মাধ্যমে এ-ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। স্কুল-কলেজ, মিল-কারখানা এমনকি অফিস আদালতেও ধর্মঘট পালিত হয়।
এ-সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো নরসিংদীতে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়োজিত জনসভা। ২১ ফেব্রুয়ারির তিনদিন পর অনুষ্ঠিত এই জনসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। আওয়ামী লীগ নেতা মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে দত্তপাড়া ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত এই জনসভায় প্রচুর লোক সমাগম হয়। মওলানা ভাসানীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং অবিলম্বে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানান। জনগণ প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। এই জনসভা সংগঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া, আফসার উদ্দিন, আ. রাজ্জাক ভূঁইয়া, মতিউর রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। এই জনসভার জের হিসেবে মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করার জন্যে সরকার ঢাকা থেকে নরসিংদীতে প্রায় ২০০ পুলিশ ফোর্স পাঠায়। এই পুলিশ ফোর্স যখন ভাসানীকে গ্রেফতারের জন্যে নরসিংদী রেলস্টেশনে অপেক্ষা করছিলো, তখন স্টেশনের পশ্চিমে অবস্থিত বটতলার ওয়াজ উদ্দিন নামক একজন আওয়ামী লীগ কর্মী পুলিশ দেখে সন্দেহ পোষণ করেন। তিনি তৎক্ষণাৎ দত্তপাড়া থেকে যে-পথে মওলানা ভাসানী নরসিংদী স্টেশনে আসতে পারেন, সেই পথে এগিয়ে যান এবং পথিমধ্যে মওলানা ভাসানীসহ নেতৃবৃন্দকে আসতে দেখে পুলিশের উপস্থিতির খবর দেন। ফলে গ্রেফতার এড়াতে মওলানা ভাসানীকে হিন্দুপাড়ার ভেতর দিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। ৫-৬ দিন সেখানে আত্মগোপনে থাকার পর তাঁকে নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।
১৯৫৩ সালে ঈদগাহ ময়দানে আরো একটি বড়ো জনসভা হয়। এই জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। বিশেষ অতিথি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। নবীনগরের রফিকুল ইসলাম, আলী আহমেদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দও বক্তব্য রাখেন। শেরে বাংলা এ-সভায় সবাইকে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান। এই জনসভার উদ্যোক্তা ছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
ঐতিহাসিক দত্তপাড়া ঈদগাহ ময়দান | ছবি : নূর নিহাদ
১৯৫৩ সালে শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাভিত্তিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রামে যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং ১৯৫৪ সালের ৮ মার্চের সাধারণ নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই নির্বাচনে মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ নেতা সারা বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে ২১ দফার বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে তোলেন। এরই অংশ হিসেবে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, শেখ মুজিব নরসিংদী, শিবপুর, রায়পুরা ও মনোহরদীর হাতিরদিয়ায় গণসংযোগে আসেন এবং জনসভা করেন। তাঁদের গণসংযোগের ফলে সারা নরসিংদীতে গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়। নরসিংদী এলাকার নির্বাচনী প্রচারণায় মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া, আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া, আবুল হাশিম মিয়া, আতাউর রহমান ভূঁইয়া, আ. লতিফ ভূঁইয়া, আফতাব উদ্দিন ভূঁইয়া, কলিম উদ্দিন এডভোকেট, শহীদ উল্লাহ ভূঁইয়া, তোফাজ্জল হোসেন, ছাত্রনেতা গোফরান, জিয়াউল হক, নূর মোহাম্মদ, গৌরাঙ্গ পোদ্দার, নৃপেন্দ্র সাহা, সুরেন্দ্র দাস, তাবু মিয়া ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।
নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয় এবং যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থীরা প্রতিটি আসনে ভোটের বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে ৩ এপ্রিল যুক্তফ্রন্ট সরকার শপথ গ্রহণ করে ক্ষমতাসীন হয়। কিন্তু ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে এবং যুক্তফ্রন্ট সরকারকে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করে কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৩৫ সালে প্রণীত ভারত শাসন আইনের ৯২ (ক) ধারা বলে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে চক্রান্তমূলকভাবে ক্ষমতা কেড়ে নেয় এবং পূর্ব বাংলায় অনির্দিষ্ট কালের জন্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। শেরে বাংলাকে অন্তরীণ, মওলানা ভাসানী বিদেশে থাকায় স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে নিষেধাজ্ঞা এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ শত শত রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয় এবং কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এই নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়, আন্দোলন গড়ে ওঠে। নরসিংদীতেও এই আন্দোলন মারাত্মক রূপ লাভ করে। প্রতিবাদ, মিছিল, মিটিং, বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সমগ্র নরসিংদী। আন্দোলনের প্রচণ্ডতাকে দমনের জন্যে পাকিস্তান সরকার গ্রেফতার করে নরসিংদীর জননেতা আবুল হাশিম মিয়া, শীতল চন্দ্র দে, কার্তিক চন্দ্র সাহা, আবুল ফজল ভূঁইয়া, সুরেশ পোদ্দারসহ আরো কয়েকজন নেতাকে। মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া, হারুন-অর-রশিদ ভূঁইয়া, রহমান ভূঁইয়াসহ আরো কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতারের জন্যে তাঁদের বাড়িতে হানা দিয়ে ব্যর্থ হয়।
১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট। এই রিপোর্টে ২ বছরের ডিগ্রি কোর্সকে ৩ বছরে রূপান্তরিত করাসহ পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা সংকোচনের প্রস্তাব করা হয়। কাজেই এই রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্ররা শিক্ষা দিবস পালন উপলক্ষে প্রদেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়। নরসিংদীর প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই হরতাল পুরোপুরিভাবে পালিত হয়। এ-দিন ঢাকায় ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে তিনজন নিহত হলে নরসিংদীতেও তার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ধর্মঘট পালিত হয়। ইতোমধ্যেই আইয়ুব খান নিজের ক্ষমতার পথ নিষ্কণ্টক করতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ আবুল মনসুর আহমদ, মনসুর আলী ও শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ করলে অন্যান্য স্থানের মতো নরসিংদীতেও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এসব আন্দোলনের সময় নরসিংদীর দত্তপাড়া ঈদগাহ ময়দানে এক জনসভা হয়। এতে আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী বক্তৃতা করেন। এ-সময়ের আন্দোলনে নেতৃত্বে ছিলেন জানে আলম ভূঁইয়া, রিয়াজ উদ্দিন, আতাউর রহমান ভূঁইয়া, সাখাওয়াত হোসেন মিয়া ওরফে ইয়ার মোহাম্মদ, শামসুল হক ভূঁইয়া, হাবিবুল্লাহ বাহার, নারায়ণচন্দ্র সাহা, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, আবদুল মান্নান খান, ফজলুর রহমান ফটিক মাস্টার, আপেল মাহমুদ, আলী আকবর, নাজমুল হোসেন বাদল প্রমুখ ছাত্রনেতা। সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি এবং শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত নরসিংদীর ছাত্র-জনতা যখন উত্তেজিত, ঠিক সেই সময় মনোহরদী থানার হাতিরদিয়াতে একটি জনসভায় যোগ দেয়ার জন্যে রওনা হন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবদুস সবুর খান, ওয়াহিদুজ্জামান এবং নারায়ণগঞ্জের ডিসি আ. ছাত্তার। তারা গাড়িযোগে নরসিংদীর বর্তমান ফায়ার সার্ভিসের সামনে (মতান্তরে বৌয়াকুড়) পৌঁছালে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার একটি মিছিল তাদের গতি রোধ করে এবং তাদের গাড়ি ভাঙচুর করে। এরপর সারা নরসিংদীতে আইয়ুব খানের ফটো ভাঙা হয়। এ-ঘটনার প্রেক্ষিতে ছাত্রনেতা আতাউর রহমান ভূঁইয়া ও শামসুকে কলেজ থেকে ফোর্স টিসি দেয়া হয় এবং রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, নাজমুল হোসেন বাদল, শামসুল হুদা বাচ্চু ও আলী আকবরসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। পরে জনমত ও ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকার তাদের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাঙালির মুক্তিসনদ ‘ছয়দফা’ ঘোষণা করে এবং স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে। এ-সময় বাম আন্দোলন মস্কোপন্থী ও চীনপন্থী নামে দুই ধারায় বিভক্ত হলেও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন অব্যাহত রাখে তারা। ফলে আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে। নরসিংদীতে ছয়দফার পক্ষে মিছিল, মিটিং, শোভাযাত্রা চলতে থাকে। ছয়দফার জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে সরকার দমননীতির আশ্রয় নিয়ে শেখ মুজিবসহ কয়েকজন নেতাকে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে বন্দী করে এবং প্রদেশজুড়ে ধর-পাকড় শুরু করে। এর প্রতিক্রিয়ায় পূর্ব বাংলায় ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং প্রতিবাদে ৭ জুন হরতাল আহ্বান করা হয়। গোটা পূর্ব পাকিস্তানের সাথে নরসিংদীতেও ব্যাপক বিক্ষোভ হয়, সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। হরতালের দিন সরকার নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নেয়। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ধর্মঘটী জনতার উপর পুলিশ গুলি চালালে ১১ জন নিহত ও বহু লোক আহত হয়। শত শত লোককে গ্রেফতার করা হয়। প্রতিবাদে ১৭ থেকে ১৯ জুন সারাদেশে প্রতিবাদ দিবস পালন করা হয়। নরসিংদী জেলার প্রতিটি থানার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানায় মিছিল-সভা-সমাবেশের মাধ্যমে এই প্রতিবাদ দিবসকে সফল করে তোলা হয়। নরসিংদীর নেতৃবৃন্দের নির্দেশে জনতা নরসিংদী থেকে জিনারদী পর্যন্ত রেললাইন তুলে ফেলে। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে নরসিংদীতে রাজনৈতিক উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করে। তাঁদেরকে গ্রেফতারের পরপরই এই ষড়যন্ত্রমূলক মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ অন্যদের মুক্তির দাবিতে গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে। হরতাল, মিছিল, মিটিং, জনসভার মাধ্যমে আন্দোলন চলতে থাকে। নরসিংদীতে ১০ আগস্ট ছাত্র ধর্মঘট, ১৭ সেপ্টেম্বর সরকারি কলেজে কালো পতাকা উত্তোলন ও সভা করা হয়। ১৫ অক্টোবর সরকারি কলেজে আইয়ুব খানের উন্নয়ন দশক উপলক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হলে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্ররা এই সভা বর্জন করে এবং ‘দুর্গতির দশক’ হিসেবে একে আখ্যায়িত করে। ১০ নভেম্বর ন্যাপের উদ্যোগে জিন্নাহ পার্কে জনসভা হয়। ১১ ডিসেম্বর সর্বদলীয় কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৪ ডিসেম্বর হরতাল পালিত হয়। এছাড়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের উদ্যোগে পৃথক কর্মীসভা, শোভাযাত্রা, প্রতিবাদ সভা, জনসভা অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলে। এ-সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার খরচ মেটানোর জন্যে নরসিংদী জেলাবাসীর পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে টাকা প্রেরণ। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নরসিংদীর সর্বস্তরের জনগণের নিকট থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে কালীগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা ময়েজউদ্দীনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অর্থ প্রেরণ করে মামলার ব্যয় মেটানোর কাজে সহায়তা করেন।
১৯৬৮ সালে নরসিংদীর সবচেয়ে আলোড়িত ঘটনা মনোহরদী থানায় সংঘটিত ‘হাট হরতাল’। আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করতে মওলানা ভাসানী ২৯ ডিসেম্বর এসব এলাকায় হাট হরতাল পালনের ডাক দেন। এই হরতাল সফল করার জন্যে শিবপুর ও মনোহরদী এলাকায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল মান্নান খান, তোফাজ্জল হোসেন, ছাত্র ইউনিয়ন ও কৃষকনেতা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, কৃষক সমিতির নেতা তোফাজ্জল হোসেন শাহজাহান, আ. রশিদ তারা মাস্টার, আ. হাই ও সিরাজুল হক। স্থানীয় নেতা তোফাজ্জল হোসেন শাজাহানের নেতৃত্বে প্রথমে হরতালের পক্ষে পিকেটিং শুরু হয়। একটি রিকশায় দাঁড়িয়ে আসাদুজ্জামান বক্তব্য প্রদানকালে সকাল এগারোটায় পুলিশ পিকেটিংরত ছাত্র-জনতার উপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও ধর-পাকড় আরম্ভ করে। ফলে জনতা আরো মারমুখী হয়ে ওঠে। এমন অবস্থায় আবদুল মান্নান খানের নেতৃত্বে শিবপুর হতে বিপুল জনতার এক জঙ্গি মিছিল হাতিরদিয়ার জনতার সাথে মিলিত হয়ে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করে তোলে হাতিরদিয়া বাজার এবং গ্রেফতারকৃতদের ছাড়িয়ে আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। উত্তপ্ত অবস্থায় বিকেলের দিকে পুলিশ বাহিনি জনতার উপর বেপরোয়া গুলি চালায়। পুলিশের নির্মম গুলিবর্ষণে নিহত হয় নোয়াদিয়ার মো. মিয়া চান, সোনামুড়ার মো. হাছেন আলী ও বাসলীকান্দির মো. ছিদ্দিকুর রহমান নামে তিনজন কৃষক। মাথায় মারাত্মক আঘাতে আহত হন মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান এবং চান মিয়া, আক্কাছ আলী, মোতালেব ও কলেজ ছাত্র আ. হাইসহ আরো বেশ কয়েকজন কৃষক-জনতা। গ্রেফতার করা হয় কৃষকনেতা তোফাজ্জল হোসেন শাজাহান, ছাত্রনেতা তোফাজ্জল হোসেন, সেন্টু মোল্লা, মোক্তার হোসেন খান, শরীফ হোসেন এবং মাইকম্যান শাজাহানকে। গ্রেফতারকৃতদেরসহ মোট ১৮ জনকে আসামী করে পরে পুলিশ মামলা দায়ের করে। প্রধান আসামী ছিলেন আসাদের পিতা মৌলভী আবু তাহের। গ্রেফতার এড়িয়ে আসাদুজ্জামান ঢাকায় চলে আসেন এবং প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় ঘটনার বিবরণ দেন। ফলে ৩০ ডিসেম্বরের সংবাদপত্রগুলোতে ঘটনার বিস্তারিত খবর প্রকাশিত হয়। হাতিরদিয়ায় সংঘটিত পুলিশি হত্যা ও নির্যাতনের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সমগ্র নরসিংদী এলাকায় প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সারা এলাকায় বিক্ষোভ চলে ও প্রতিবাদ সভা হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে ২ জানুয়ারি ১৯৬৯ নরসিংদী কলেজে ছাত্র ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা হয়। ৩ জানুযারি কলেজের পুকুরঘাটে নরসিংদী শহরের সমস্ত স্কুল-কলেজের ছাত্রদের জমায়েত ও সভা হয়।
১৯৬৯ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আন্দোলন-সংগ্রামের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যুজ্জ্বল অধ্যায়। এ-সময়ই শুরু হয় তুমুল আন্দোলন এবং শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত বাঙালি তাদের আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে শুরু করে। ৪ জানুয়ারি ডাকসু কার্যালয়ে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (উভয় গ্রুপ) এবং ডাকসুর সমন্বয়ে পূর্ব বাংলার প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে ১১ দফা দাবিনামা পেশ করে। এরই অনুসরণে নরসিংদীতেও ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। এই পরিষদে যারা ছিলেন :
শামসুল হুদা বাচ্চু, ছাত্রলীগ, আহ্বায়ক
নূরুল ইসলাম গেন্দু, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য সচিব
হারাধন চন্দ্র সাহা, ছাত্রলীগ, সদস্য
আবদুল মতিন ভূঁইয়া, ছাত্রলীগ, সদস্য
সুভাষ চন্দ্র সাহা, ছাত্রলীগ, সদস্য
মানিক সাহা, ছাত্রলীগ, সদস্য
আবদুল গফুর, ছাত্রলীগ, সদস্য
ফজলুল কাদের চৌধুরী, ছাত্রলীগ, সদস্য
মো. আলী আকবর (নরসিংদী কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি), ছাত্রলীগ, সদস্য
মো. আবদুল আলী মৃধা, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), সদস্য
শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), সদস্য
মো. বজলুর রহমান, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), সদস্য
তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), সদস্য
নূরুল ইসলাম কাঞ্চন, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), সদস্য
যূথিকা চ্যাটার্জী, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
কার্তিক চ্যাটার্জী, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
রফিকুল ইসলাম, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
আজিজ আহমেদ খান, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
বি এ রশিদ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
মজিবর রহমান, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
মোশাররফ হোসেন, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
১১ দফা দাবির সমর্থনে ছাত্ররা ২০ জানুয়ারি সারা পূর্ব বাংলায় ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ছাত্র ধর্মঘট পালনকালে ঢাকায় এক ছাত্রমিছিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা নরসিংদীর অগ্নিপুরুষ আসাদুজ্জামান (আসাদ) গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। আসাদের হত্যাকাণ্ড ছাত্রসমাজসহ পূর্ব বাংলার সকল শ্রেণির মানুষকে প্রবল আঘাত করে। সারা নরসিংদীতে শোকের ছায়া নেমে আসে। পরদিন নরসিংদী কলেজে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং জানাজার আগে বিরাট জনসভা এবং জানাজা শেষে হাজার হাজার লোকের শোকমিছিল এলাকা প্রদক্ষিণ করে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শিবপুর, মনোহরদী, নরসিংদী, কালীগঞ্জ, রায়পুরা, আড়াইহাজার এলাকায় মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ সভা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। ফলে জনগণ সোচ্চার হয়ে ওঠে, ব্যাপকভাবে আন্দোলনমুখী হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
আসাদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ২২ জানুয়ারি নরসিংদীতে বিরাট মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সমাবেশে ২৪ জানুয়ারি (শুক্রবার) নরসিংদীতে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। ২৪ জানুয়ারি নরসিংদীর সকল অঞ্চলে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, কল-কারখানা, হাট-বাজার সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। নরসিংদী শহরে অভূতপূর্ব মিছিল হয় এবং বিকেলে তৎকালীন ইপিআরটিসি ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ-জনসভায় শোককে শক্তিতে পরিণত করার শপথ নেয়া হয় এবং সংগ্রামকে জীবনের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করার অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়। এই জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতা মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া, মতিউর রহমান ভূঁইয়া, ন্যাপের আবুল হাশিম মিয়া, আতাউর রহমান ভূঁইয়া, ছাত্রনেতা শামসুল হুদা বাচ্চু, আলী আকবর, হারাধন সাহা, আ. আলী মৃধা, আ. মতিন ভূঁইয়া, শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া, তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া, নূরুল ইসলাম গেন্দু, যূথিকা চ্যাটার্জী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সমাবেশে ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি নরসিংদীতে দু’দিনব্যাপী শোক দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি যথাযোগ্য মর্যাদায় শোক দিবস পালন করা হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ-দিন ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী যূথিকা চ্যাটার্জীর নেতৃত্বে নরসিংদীতে অনুষ্ঠিত হয় সরকার বিরোধী এক বিরাট মহিলা মিছিল। স্কুল-কলেজের ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সচেতন মহিলারা এই মিছিলে যোগ দেয়। নরসিংদীতে এটি ছিলো সর্বপ্রথম মহিলা মিছিল। ঘরের গৃহিণীদের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে এই মিছিল অনন্য ভূমিকা পালন করে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ইউ-এম-সি জুট মিলের শ্রমিকদের মিছিল, ২১ তারিখে কলেজ মাঠে এবং ২২ তারিখে মরিচাকান্দিতে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এসব আন্দোলনের ফলে আইয়ুব সরকার পিছু হটতে থাকে। ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিরোধী দলকে আলোচনায় আসার আহ্বান জানায়। সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয় প্রবল আন্দোলনের মুখে। ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। শেখ মুজিবসহ অন্যান্য অভিযুক্তরা মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬৯-এর এই গণ-অভ্যুত্থানে এশিয়ার লৌহমানব খ্যাত আইয়ুবের পতন ঘটে। আইয়ুবের পতন ত্বরান্বিত করার জন্যে এ-সময় নরসিংদীর বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয় আরো অনেক আন্দোলন, সংগ্রাম, জনসভা। এগুলোর মধ্যে ২০ ফেব্রুয়ারি আদিয়াবাদের জনসভা, ২৪ ফেব্রুয়ারি পাঁচদোনার জনসভা, ৪ মার্চ শহরের জিন্নাহ পার্কের জনসভা, ৬ মার্চ জয়নগরের জনসভা, ১১ মার্চ কাঁঠালিয়ার জনসভা অন্যতম। কাঁঠালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। তবুও তিনি আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এরপর ১২ মার্চ ‘ডাক’ (DAC : Democratic Action Committee)-র উদ্যোগে শিবপুরে অনুষ্ঠিত হয় এক বিরাট জনসভা। ১৪ মার্চ কালীগঞ্জের নাগরীতে অনুষ্ঠিত হয় এক ছাত্র-জনসভা। ১৬ মার্চ ঘোড়াশালের সান্তানপাড়ায়ও অনুষ্ঠিত হয় জনসভা। এ-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নরসিংদীসহ সারা দেশের আন্দোলনই আইয়ুবের পতনকে ত্বরান্বিত করে। এরপর ১৯৬৯ এর ২৫ মার্চ দেশে পুনরায় সামরিক শাসন জারি করা হয়। আইয়ুব খান চলে গেলো, ইয়াহিয়া খান এলো নতুন চক্রান্তের ছক নিয়ে। পাকশির শাহপুরে কমিউনিস্টদের আয়োজিত এক কৃষক সম্মেলনে ইতোমধ্যেই শ্লোগান ওঠে— শ্রমিক কৃষক অস্ত্র ধর, পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর।
রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় ১১ দফাকে সমর্থন করে শেখ মুজিবুর রহমান জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের দাবি জানান। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-শ্রমিক সংগঠন ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্যে জনগণের প্রতি আহ্বান জানায়। এরই মধ্যে বিভিন্ন ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠন এমনকি কোনো কোনো রাজনৈতিক দলও স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিত্যাগ করে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবিতে ক্রমে সোচ্চার হয়ে ওঠে। জনগণের কাছে পাকিস্তানি শাসকচক্রের বৈষম্য ও ষড়যন্ত্র পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় সারা দেশের মানুষও সোচ্চার হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলন প্রবল থেকে প্রবলতর হয়। নরসিংদীর বিভিন্ন স্থানে এ-সময় সংঘটিত হয় অনেক জঙ্গি মিছিল-মিটিং। এসব মিছিল-মিটিংয়ে সম্পৃক্ত হয় সর্বস্তরের জনগণ। মূলত, ছাত্রনেতারা এ-আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রমিক সংগঠন এবং সামাজিক সংস্থাসমূহও এ-সময় চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি জিন্নাহ পার্কে অনুষ্ঠিত হয় জনসভা। জানুয়ারির ১৫ তারিখ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর চট্টগ্রাম যাবার পথে নরসিংদী রেলস্টেশনে ছাত্ররা তাকে কালো পতাকা প্রদর্শন করে। ১৭ জানুয়ারি থেকে নরসিংদীতে পালন করা হয় ‘১১ দফা সপ্তাহ’। জনগণকে সচেতন ও সক্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে এ-সপ্তাহের সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। ২৪ জানুয়ারি নরসিংদীতে পালন করা হয় সর্বাত্মক হরতাল। জানুয়ারিতে হাসনাবাদ বাজারে অনুষ্ঠিত হয় এক জনসভা। এতে কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতারা বক্তব্য রাখেন। এই আন্দোলন আস্তে আস্তে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেবে বলে তারা বক্তব্য প্রদান করেন। এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণার জন্যে ৯ মার্চ নরসিংদীর শিক্ষকগণ পালন করেন ধর্মঘট। নরসিংদীর সকল বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ মিছিল করে এই ধর্মঘটে যোগ দেন। মিছিল শেষে ব্রাহ্মন্দী বিদ্যালয়ের মাঠে সভা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষকগণের কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১২ মার্চ মশাল মিছিল বের করা হয় এবং জিন্নাহ পার্কে জনসভার আয়োজন করা হয়। এই জনসভায় ঢাকা থেকে আগত হেনা দাস প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। এ-সময় রায়পুরার নারায়ণপুরে অনুষ্ঠিত হয় এক বিরাট জনসভা। এতে মওলানা ভাসানী প্রধান অতিথি ছিলেন। এ-জনসভায় ভাসানী জনগণের ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে সকলকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান।
২ এপ্রিল নরসিংদীর জন্যে একটি স্মরণীয় দিন। এ-দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নরসিংদীর ঈদগাহ ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বক্তব্য রাখেন। তিনি ৬ দফা দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্যে এবং আগামী নির্বাচনে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের জন্যে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। জনসভার পূর্বে নরসিংদী রেলস্টেশনে তাঁকে ছাত্র-জনতা বিপুল সংবর্ধনা জানায়।
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর ব্যাপক অত্যাচার-নিপীড়ন-হত্যাকাণ্ডে পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে প্রচণ্ড অসন্তোষের সৃষ্টি হয় এবং তার প্রতিবাদে সারা পূর্ব পাকিস্তানের সাথে নরসিংদীর জনগণও ২৬ মে হরতাল পালন করে। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত হয় অসংখ্য সভা-সমাবেশ। নরসিংদীসহ সারা দেশের প্রবল উত্তাল আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে বাধ্য হন। নির্বাচনী জোয়ারে জেগে ওঠে নরসিংদীসহ সারা পূর্ব বাংলার মানুষ। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১ মার্চ বেলা একটার সংবাদে রেডিও মারফত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার সাথে সাথে নরসিংদীর সর্বস্তরের জনগণ প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। নরসিংদী সদর থানাসহ প্রতিটি থানায়ই প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। প্রতিবাদ সভা, মিছিল, বিক্ষোভ প্রদর্শন ও নিন্দা জ্ঞাপন করে অধিবেশন আহ্বানের দাবি জানানো হয়।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ নরসিংদীর জন্যে একটি স্মরণীয় দিন। এ-দিন নরসিংদী শহরের মিতালী সিনেমা হলের সামনে আয়োজন করা হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের সভা। ২ মার্চ সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র সমাবেশ ব্যতিত পূর্ব পাকিস্তানের আর কোথাও তখনো পর্যন্ত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়নি। মিতালী সিনেমা হলের সামনে অনুষ্ঠিত বিরাট জনসভার জনপ্রতিনিধি হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতা জনাব মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে নরসিংদীতে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।
৩ মার্চ ১৯৭১, নরসিংদীর মিতালী সিনেমা হলের সামনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন
৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত ঘোষিত কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুযায়ী নরসিংদীতে প্রতিদিন সকাল ৬ টা থেকে বেলা ২ টা পর্যন্ত পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। নরসিংদী শহরসহ বর্তমান নরসিংদী জেলার প্রতিটি থানার সমস্ত দোকানপাট বন্ধ থাকে। বাস-রিকশা-গাড়িসহ কোনো যানবাহন চলাচল করেনি। নরসিংদী ও পলাশ থানার সকল কল-কারখানার উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকে। এ-সমস্ত কর্মসূচি চলাকালীন মিছিল, পথসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং জনসভার আয়োজন করা হয়। এমনি একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয় নরসিংদী কলেজ মাঠে। ৬ মার্চ অনুষ্ঠিত এই জনসভায় স্থানীয় রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতারা জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন এবং অধিকার আদায়ে যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকার জন্যে সবাইকে আহ্বান জানান। এসব কর্মসূচিতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্দোলন ক্রমশ জঙ্গি রূপ ধারণ করে।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশাল জনসমুদ্রে ভাষণে বলেন, তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। শেখ মুজিবের এই ঘোষণা উত্তাল জনসমুদ্র এবং সারা দেশের মানুষের মতো নরসিংদীর মানুষকেও প্রবলভাবে আন্দোলিত ও উজ্জীবিত করে তোলে। ঢাকায় বসবাসরত নরসিংদীর মানুষজন ছাড়াও নরসিংদী থেকে হাজার হাজার কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা এই জনসভায় যোগদান করে। রেলগাড়ি ছাড়াও শুধুমাত্র নরসিংদী থেকেই ১০০ টি বাসে করে জনগণ এই জনসভায় যোগ দেন।
১৬ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে মুজিব-ভুট্টো-ইয়াহিয়ার সমঝোতার প্রয়াস অব্যাহত থাকলেও জনগণ তখন রাজপথে ‘স্বাধীনতা’র মন্ত্রে আপোসহীন। আর এক্ষেত্রে ছাত্রসমাজের ভূমিকাই ছিলো সবচেয়ে অগ্রগণ্য। এরই মধ্যে ১৯ মার্চ সামরিক বাহিনি জয়দেবপুরে গুলিবর্ষণ করে নিরীহ মানুষকে হত্যা করলে নরসিংদীতে তার প্রতিবাদে মিছিল ও বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয় এবং ছাত্রসভার আয়োজন করা হয়।
এরপর ২৬ মার্চ; ইতিহাসের সেই ভয়াল কালরাত। ইয়াহিয়া-ভুট্টো গং সভ্যতার নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় বাংলার বুকে। শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং অবধারিতভাবে শুরু হয়ে যায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
সার্বিক তথ্য সহায়তা
১. মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন, নরসিংদী জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস;
২. এম আর মাহবুব, নরসিংদীর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও শীতলক্ষ্যা বিধৌত চরসিন্দুর নরসিংদীর একটি সরস জনপদ। সুদীর্ঘকাল থেকেই এখানে রয়েছে সাহসী জনবসতি। এখানকার উর্বর মাটিতে ফলে সমৃদ্ধ ফসল। একসময় ফলতো উন্নত লাল ধান। এখনো জন্মে ধান, পাট, বেগুন, মুলা আর চরাঞ্চলে গোলা আলু, বাঙ্গি, মটরশুঁটির মতো নানা ফসল। এখানকার কলা (বড়ো সাগর কলা) হয় অনেক সুস্বাদু। এখানে রয়েছে নরসিংদী জেলার বিখ্যাত কলার হাট। পশ্চিমে শীতলক্ষ্যার গুজি ও চিংড়ি মাছের সাথে পূর্বের ব্রহ্মপুত্রের শোল, বোয়াল, শিঙ, মাগুরের স্বাদ আর উদরপূর্তিতে কেটে যেতো চরসিন্দুরের মানুষের সুখের জীবন। দুদিকে বয়ে চলা শান্ত নদীর মৃদুমন্দ বাতাসে জুড়িয়ে যায় প্রাণ। শীতলক্ষ্যার পালতোলা নৌকায় ঢেউ দিয়ে চলে যেতো বাবলা-সহ সায়েদ কোম্পানির অন্যান্য লঞ্চগুলো। বাতাসে ভেসে বেড়াতো মাঝিমাল্লার গান। গুটি গুটি, কুটকুটে আওয়াজ তুলে গরুর গাড়ি আখ বোঝাই করে ছুটে চলতো এলাকার একমাত্র দেশবন্ধু সুগার মিলে। বর্ষায় নদী তীরের পল্লীগীতি ও ভাটিয়ালি গানের সুরের প্রতিধ্বনি করে শুকনো মৌসুমে বসতো লোকগীতি ও লোকসংস্কৃতির জমজমাট আসর। কলাপট্টিতে ‘রূপবান’, ‘আলোমতি’, ‘সাগর ভাসা’র করুণ কাহিনির অভিনয় দেখে ভাসতো মানুষ চোখের জলে।
একমাত্র চরসিন্দুর হতে লঞ্চে চড়ে নরসিংদীর উত্তরাঞ্চলের মানুষকে যাতায়াত করতে হতো ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ নরসিংদীর অন্যান্য এলাকায়। আবার অনেকে যাতায়াত করতো কষ্টকর গুণটানা নৌকায়। তখন অন্য কোনো যোগাযোগের ব্যবস্থা তেমন ছিলো না। সারাদিন চলাচলের পরও রাত ১২ টায় একটি লঞ্চ ছেড়ে যেতো ঘোড়াশাল হয়ে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে। সমগ্র মনোহরদী ও শিবপুরের অধিকাংশ মানুষ তাঁদের প্রয়োজনে রাতের ঐ-লঞ্চে কেউ ঘোড়াশাল নেমে ট্রেনে ঢাকা যেতো এবং বেশিরভাগ মানুষ যেতো নারায়ণগঞ্জে। তখন বর্তমান নরসিংদী জেলাটি ছিলো নারায়ণগঞ্জ মহকুমার অধীনে। মামলা-মোকদ্দমা ও অন্যান্য কাজে চরসিন্দুর হয়ে লঞ্চেই যেতে হতো। বর্তমান চরসিন্দুর ব্রিজের খানিকটা পূর্ব-দক্ষিণ কর্নারে ছিলো লঞ্চঘাট। আজো ব্রিজের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে পূর্বদিকে তাকালে ক্ষয়িষ্ণু লঞ্চঘাটের চিহ্ন দেখা যায়। যেন স্মরণ করিয়ে দেয় হারিয়ে যাওয়া দিনের কথা।
শীতলক্ষ্যা নদীতে ছিলো প্রচুর মাছ। আশেপাশের বাজারগুলো শীতলক্ষ্যার স্বাদযুক্ত মাছে ভরে যেতো। নদী সংলগ্ন পূর্বদিকের খাড়িতে ভুলপথে অনেক মাছ এসে রাতজাগা শিকারির হাতে ধরা পড়তো। মাঝে মাঝে ধরা পড়তো গুজি মাছ। আইড় মাছকে এলাকার মানুষ গুজি মাছ বলে। নদী ও খাড়ির মধ্যেকার চর ছিলো খুবই নয়নাভিরাম। ঐ-চরে হেঁটে হেঁটে ভ্রমণ পিপাসুর প্রাণ জুড়িয়ে যেতো। বিভিন্ন পার্বণে, বিশেষ করে ঈদের দিনগুলোতে খুব সকালে সমগ্র এলাকার মানুষ নদীতে মহাউৎসবে গরুকে গোসল করাতো। প্রতি শুক্র ও মঙ্গলবার প্রসিদ্ধ চরসিন্দুর হাট বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের মিলনমেলায় পরিণত হতো। বাজার থেকে কে কতো বড়ো মাছ কিনতে পারবে, চলতো এমন প্রতিযোগিতা। এমনসব সাংস্কৃতিক রূপ ধারণ ও লালন করে প্রাচীনকাল থেকেই চরসিন্দুর একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত জনপদ হিসেবে গড়ে ওঠতে থাকে।
চরসিন্দুর হাই স্কুল
এলাকার শিক্ষা বিস্তারে চরসিন্দুর হাই স্কুলই ছিলো একমাত্র অবলম্বন। শিক্ষায় অনেকটা পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্যে ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বর্তমানের চরসিন্দুর হাই স্কুলটি, যেটি ২০১৮ সালে সরকারিকরণ করা হয়েছে। চরসিন্দুরের মহান ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি মৌলভী ইয়াকুব আলী মিয়ার বদান্যতায় মনোরম ও দক্ষিণমুখী সুন্দর জায়গায় ‘জর্জ ইনস্টিটিউশন’ নামে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন ছিলো ব্রিটিশ আমল। ছিলো সদ্য প্রয়াত রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাবা-দাদাদের প্রতাপ। রাণীর বাবা ছিলেন ষষ্ঠ জর্জ এবং দাদা পঞ্চম জর্জ। তাদের নামে নামকরণ হলে অধিক আনুকূল্য পাওয়া যাবে, সম্ভবত এই আশায় স্কুলটির এমন নামকরণ করা হয়েছিলো।
জর্জ ইন্সটিটিউশন নামে এভাবেই পথচলা শুরু চরসিন্দুর হাই স্কুলের। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পাক-ভারত উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ তাড়ানোর আন্দোলন শুরু হলে স্কুলের নাম পরিবর্তিত হয়ে চরসিন্দুর ইংরেজি হাই স্কুল নাম ধারণ করে। পাঠদান চলছিলো তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্তু। সকল শ্রেণির বই আসতো কলকাতা শিক্ষা বোর্ড থেকে। এই স্কুলের সর্বপ্রথম এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা কেন্দ্র ছিলো নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজ। পরবর্তীতে গাজীপুর-নরসিংদী হয়ে স্বাধীনতার পর কয়েক বছর এ-স্কুলেই এসএসসি কেন্দ্র করা হয়েছিলো।
চরসিন্দুর হাই স্কুলের রয়েছে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ’৭১-এর স্বাধীনতার জন্যে মুক্তিযুদ্ধসহ অনেক আন্দোলনের বীরত্বে গাঁথা চরসিন্দুর হাই স্কুল। ’৭১ সালে স্কুল মাঠ ছিলো মুক্তিযুদ্ধের রিক্রুটিং ক্যাম্প। এখান থেকে দলে দলে লোকজন যেতো ভারতে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ অর্জন করতে। হানাদার বিরোধী সাধারণ মানুষের সম্মুখে যুদ্ধের মহড়া হতো চরসিন্দুরে।
ব্রিটিশ আমল থেকে এখন পর্যন্ত অনেক বিখ্যাত-প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বের পদার্পণে ধন্য স্কুলটি। পদার্পণ করেছেন বাংলার বাঘ খ্যাত শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। এসেছিলেন পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন, স্বাধীনতার পর অনেকের মধ্যে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানসহ বহু গুণীজন। শেরে বাংলার সাথে কিংবদন্তি শিল্পী আব্বাস উদ্দিন ও তাঁর সহযোগী বেদার উদ্দিন আহমেদ এসে গান শুনিয়ে সকলকে দারুণ মুগ্ধ করার কথা জানা যায়। শুরু থেকে বহু জ্ঞানপ্রদীপ শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণের ছায়াতলে থেকে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী তাদের জীবনপ্রদীপ প্রোজ্জ্বলিত করেছেন। করেছেন দেশ ও দেশের মানুষের সেবা। এ-স্কুলের স্বনামধন্য প্রধান শিক্ষকগণের মধ্যে মোক্তার হোসেন খান, ইয়াকুব আলী আওরঙ্গজেব, সৈয়দ ফজলুল হক অন্যতম। প্রথমদিকের শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষকদের মধ্যে স্বর্গীয় অম্বিকাচরণ ঘোষ ও অতীন্দ্র চরণ রক্ষিতের নাম এখনো বিদ্যালয়ের নামফলকে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাছাড়া আবদুল জলিল, আবদুল আউয়াল, নাদিরুজ্জামান ও হীরালাল মণ্ডলসহ অনেকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেক সহকারি শিক্ষক বিভিন্ন যশস্বী কর্মকাণ্ডের জন্যে এখনো মানুষের মুখে মুখে জীবন্ত রূপ হয়ে ফিরে আসেন।
স্কুলের অনেক ছাত্রছাত্রী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। মাননীয় জাতীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপ, আলহাজ্ব কামরুল আশরাফ খান পোটন ও জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহন এ-স্কুলেরই কৃতী ছাত্র। স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে বিচারপতি মুনসুরুল হক, যুগ্ম-সচিব নূরুজ্জামান ভূঁইয়া, মীর মোশারফ হোসেন এবং আরো অনেকে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত। ছাত্র ছিলেন ডা. ফজলুল করিম পাঠান ও ডা. অভিরাম চন্দ্র মণ্ডল, যারা চিকিৎসা ক্ষেত্রে এলাকায় প্রচুর অবদান রেখে কিংবদন্তী হয়ে আছেন।
সভাপতি ও সম্পাদক হিসেবে স্কুল পরিচালনার জন্যে মরহুম নূর উদ্দিন মিয়া, মফিজ উদ্দিন খান, ইয়াকুব আলী মিয়া, আবদুর রশিদ শিকদার ও নাসিরুদ্দিন শিকদার বেনু মিয়ার মতো অনেকে স্কুলটি উন্নত থেকে উন্নততর করেছেন, যার প্রতিফলন এখনো বিদ্যমান।
১৯৬৭ সালে গর্বের স্কুলটির ছাত্র ছিলাম আমি। তার আগের বছর এক দুর্বৃত্ত ছাত্রের ছুরিকাঘাতে নরসিংদী কলেজে ম্যাট্রিক পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রধান শিক্ষক মোক্তার হোসেন স্যার খুন হন। তখনকার টলটলায়মান অবস্থায় শিক্ষক ছিলেন মরহুম বেলায়েত হোসেন স্যার, হীরালাল স্যার, বজলুর রহমান স্যার, হাবিবুর রহমান খান বকুল স্যারসহ আরো অনেকে, যাদের নাম এই মুহূর্তে স্মরণে নেই। তবে খুব মনে আছে ময়মনসিংহ থেকে আসা একজন স্যারের কথা, যার আগমনে স্কুলটি দারুণভাবে প্রাণ ফিরে পায়। পরের বছর আমি এই স্কুল ছেড়ে নিজের গ্রামে নব প্রতিষ্ঠিত দত্তেরগাঁও হাই স্কুলে চলে আসি। স্বল্প সময় চরসিন্দুর স্কুলে পড়াশোনা করলেও তৎসময়ের বহু স্মৃতি অজান্তেই মনে এসে ভিড় করে। হীরালাল স্যার ও বেলায়েত স্যারের স্নেহ-আদরের কথা খুবই মনে পড়ে। তাঁদের অমৃত শিক্ষাসুধা পানে আকণ্ঠ তৃপ্ত ছিলাম। বহু আগে একদিন হীরালাল স্যারের বাড়ি গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করে কদমবুচি করেছিলাম। তিনি তখন অবসরে, বয়সে ভারাক্রান্ত। যতটুকু জানি, ছাত্রছাত্রীদের মাঝে তিনি হয়ে ওঠেছিলেন স্বর্গীয় দেবতাসম। শুনেছি, হীরালাল স্যার মৃত্যুবরণ করলে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে স্যারের মরদেহের খাটিয়ার পেছন পেছন শ্মশান পর্যন্ত ছুটেছিলো। লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিলো।
এই মহাবিশ্ব ও মহাকালের বিশালতার তুলনায় একজন মানুষের যাপিত জীবনের ব্যাপ্তি নেহায়েত নগণ্য। যারা একবার চলে যায়, কোনোদিন আর ফিরে আসে না। তারপরও অনিত্য ও নশ্বর এ-পৃথিবীতে অনেক কিছু অবিনশ্বর হয়ে থাকে মানব মনে, সৃষ্টির আহ্বানে। তেমনি হয়ে থাকবে চরসিন্দুর এবং চরসিন্দুর হাই স্কুল, এই প্রত্যাশা রেখে শেষ করছি।
হিমালয়ের কৈলাশ পর্বতশৃঙ্গ থেকে বয়ে আসা বিপুল জলরাশির স্রোতধারা ব্রহ্মপুত্র। সেই আদিকাল থেকে বহু জনপদ আর বিচিত্র গতিপথ পেরিয়ে মহেশ্বরদীকে অবগাহিত করেছে এই নদ। জনপদকে করেছে সমৃদ্ধ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালের আগে পরগণায় বিভক্ত ছিলো বারো ভূঁইয়ার এই দেশ। বর্তমান নরসিংদী জেলার বৃহৎ অঞ্চল তখন পরিচিত ছিলো মহেশ্বরদী পরগণা হিসেবে। শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড় জুড়ে বিস্তৃত এই জনপদ। এর পশ্চিম পাড়ে ভাওয়াল পরগণা। লক্ষ্যার পাড়ের এই দুই জনপদ— মহেশ্বরদী আর ভাওয়াল, গলাগলি হয়ে, এক হয়ে থেকেছে বহুকাল; ব্রিটিশ, পাকিস্তানি আমল ও বাংলাদেশের প্রথমদিকে বৃহত্তর ঢাকা জেলায়।
এই অঞ্চলটিতে ব্রহ্মপুত্র যে কতো বিশাল নদ ছিলো, এখন আর তা বোঝার উপায় নেই। এই ঊনবিংশ শতাব্দীতেও এখানে এর অস্তিত্ব ছিলো প্রবল প্রতাপে। ছিলো যাতায়াত আর যোগাযোগের প্রধান নদীপথ। মাধবদী আর পাঁচদোনায় ছিলো এর বন্দর। পাঁচদোনার মানুষ ভাই গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৪-১৯১০) তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ পাশ ঘেঁষে প্রবাহিত। এই নদীই এখানকার জীবন। এর জলপথে চলাচল করে মানুষ। দূর কিংবা নিকটবর্তী নগরে। এই পথে পালতোলা কিংবা গুণটানা নৌকা হচ্ছে বাহন। আরো লিখেছেন, পাঁচদোনা থেকে ঐ-রকম নৌকায় চড়ে তিনি ও তাঁর পরিবারের লোকেরা ময়মনসিংহ ও ঢাকা যেতেন। সময় লাগতো অনেক।
ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী শীতলক্ষ্যা। টলটলে মিষ্টি জলের নদী। এর পাড়ের প্রবীণ লোকেরা বলেন, শীতলক্ষ্যাকে সাত পাঁকে প্যাঁচিয়ে বিয়ে করেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। সেই আদিকালে। নদ আর নদীর এই প্যাঁচের মধ্যেই মহেশ্বরদীর অবস্থান। এর প্রভাবে এই অঞ্চলের মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনযাপন গড়ে ওঠেছে ভিন্ন মাত্রা নিয়ে; এই দুই নদ-নদী ও এদের শাখা-প্রশাখাকে ঘিরে।
শীতলক্ষ্যার পাড়ে জন্ম কৃতী সাহিত্যিক হরিপদ দত্তের; ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতে। খাতাপত্রে জন্ম ১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে। সেই হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার ছয় মাস আগে। কিন্তু তিনি বলছেন, পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিলো দুই বছর। সুতরাং তাঁর জন্ম ১৯৪৫ সালে হতে পারে। সেই হিসেবে বর্তমানে তাঁর বয়স ৭৮ বছর।
শীতলক্ষ্যার পাড়ের যে-গ্রামে তাঁর জন্ম, তার নাম খানেপুর। ঐ-গ্রামের অনূঢ়া নৈস্বর্গিক প্রকৃতিতে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা বর্ধিষ্ণু জোতদার পরিবারে। নদীর পাড় জুড়ে বিশাল ভূ-সম্পত্তি, প্রতাপ-প্রতিপত্তিশীল দত্ত পরিবারে। বাবা শরৎ দত্ত ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের চাকুরে; পাকিস্তান হবার পর তাঁর অঞ্চলের ইউনিয়ন বোর্ডের সদস্য। আইয়ুব খানের সময় মৌলিক গণতন্ত্রী (বিডি) মেম্বার। বাবা-মা’র একমাত্র পুত্রসন্তান হিসেবে এবং বনেদি পারিবারিক ঐতিহ্যের সুবাদে তাঁর শৈশব কেটেছে আদরে ও স্বাচ্ছন্দ্যে, পার্শ্ববর্তী নিম্নবর্গের হিন্দু ও মুসলমান সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে মিলেমিশে। পড়াশোনা নদীর ওপাড়ের ভাওয়াল জামালপুর স্কুলে। তারপর ঢাকায়। জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯৬৪-৬৫ সালে আইয়ুব খানের শাসনামলে শিল্পায়ন শুরু হয় শীতলক্ষ্যার পাড় জুড়ে, নদীপথে যোগাযোগের সুবিধার কথা বলে। নদীর পাড়ে অনেকটা দূরে আগে থেকেই ছিলো দেশবন্ধু সুগার মিল, চিত্তরঞ্জন কটন মিল ও পাক জুট মিল। এবার দত্তদের গ্রাম (খানেপুর-কাঁঠালিয়াপাড়া) নির্দিষ্ট হলো সারকারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও ফৌজিদের জুট মিলের জন্যে। হিন্দু জনসংখ্যাপ্রধান এই এলাকার অধিবাসীরা হঠাৎ করেই সরকারি অধিগ্রহণের দ্বারা ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ হলেন। হয়ে পড়লেন উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী। দত্ত পরিবার তাঁদের ভূ-স্বামীর মর্যাদা হারালো। শিল্পায়নের নতুন আর্থ-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে বহুকালের আধিপত্যও হারালো। বাড়ি-ভিটা, জমি হারানোদের শতকরা ৯০ ভাগই ছিলো হিন্দু পরিবার। তারা যা কিছু ক্ষতিপূরণ (পুরো ক্ষতিপূরণ মেলেনি তাদের নানা মারপ্যাঁচে) পেলেন, তা নিয়ে নতুন আবাসের খোঁজে সীমান্ত পাড়ি দিলেন প্রায় সবাই। দত্তবাবুরা গেলেন না। তাদের কেউ কেউ গেলেন অনেকটা দেরিতে, বাংলাদেশ হওয়ার কিছুকাল পরে। কিন্তু হরিপদ দত্ত গেলেন না। তিনি একাই থেকে গেলেন বিদ্রোহী হয়ে। বললেন, জন্মভূমি ছেড়ে যাবো কোথায়?
বাবা শরৎ দত্ত ছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি একান্ত অনুগত একজন। তিনি ১৯৪৭-এ দেশভাগের সময় পাকিস্তানকেই নিজ বাসভূমি মেনে নিয়েছেন। চারপাশের অন্য হিন্দুদের বলেছেন, এটাই আমাদের দেশ। এখানেই আমাদের পূর্বপুরুষের সবকিছু। এই জন্মভূমি ছেড়ে যাবো কোন দুঃখে? জাতপাত-ধর্ম নির্বিশেষে জনপ্রিয় সেই ঋজু মনের জনসেবক ভূ-সম্পত্তি, প্রতিপত্তি হারিয়েও পাকিস্তান ছাড়লেন না। বৃদ্ধ বয়সে বাংলাদেশ আমলে দেশ ছাড়লেন পরিবারের অন্যদের নিয়ে। বলা যায়, অনেকটা বাধ্য হয়েই। বয়োবৃদ্ধ বাবা-মা একমাত্র পুত্রকে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু হরিপদ দত্ত তো যাবেনই না। বিদায় বেলায় তাঁরা তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “সাবধানে থাকিস বাবা। ভালো থাকিস।”
হরিপদ দত্তের মানস সরোবরে ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’। রামায়ণে রাম যেমন ছোটো ভাই লক্ষণকে বলেছিলেন, “হে লক্ষণ, এমনকি এই স্বর্ণময় লঙ্কাও আমাকে আকৃষ্ট করে না। জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেয়।” এই আকুতি অনবরত প্রকাশ পেয়েছে তাঁর লেখায়, কথায় ও মিথস্ক্রিয়ায়। স্বপ্ন দেখেছেন শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন, জাতপাত, ধর্ম আর উঁচু-নিচুর ব্যবধানহীন মাতৃভূমির। সেই স্বপ্ন অনবরত ভেঙে চুরমার হয়েছে। এসবেরই প্রকাশ ঘটেছে তাঁর লেখালেখিতে।
লেখালেখির শুরু হয়েছিলো সেই স্কুলজীবন থেকেই। ঝোঁক ছিলো শিল্প-সাহিত্যের প্রতি। এমনটা প্রবাহমান থেকেছে জীবনভর। জীবিকার জন্যে অনেক পেশার ডালপালায় ভর করেছেন তিনি। শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘকাল। তবে এক জায়গায় নয়, বহু জায়গায়। উচ্চ বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও ফাজিল মাদরাসায়। ঝোঁকের বশে ডলার কামাতে উত্তর আমেরিকার দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় গিয়ে কায়িক শ্রমের জীবন চেখে দেখেছেন। কিন্তু কোনো অবস্থায়ই লেখালেখি ছাড়েননি। অনবরত লিখেছেন। এখনো লিখছেন। তাঁর ভাষায় ‘লেখাকে ভালোবেসে জীবনে বঞ্চিত হয়েছেন অনেক কিছু থেকে’।
১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘কত আঁখি জল’। ছাত্র থাকা অবস্থায়। তারপর থেকে ক্রমাগত অসংখ্য উপন্যাস, গল্পগ্রন্থ, প্রবন্ধ সাহিত্য, শিশু-কিশোর সাহিত্য যেন দুই হাতে লিখে গেছেন। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অসংখ্য বই, বহু প্রকাশনী থেকে। থামেননি একদম। তাঁর লেখার স্টাইল ও গভীরতা অনন্য মাত্রার। অন্য অনেকের চেয়েই ভিন্ন। তাঁর উপন্যাসের পটভূমি ও বিষয়বস্তু গতানুগতিক নয়। অপরূপ বর্ণনাশ্রয়ী, সুদক্ষ শব্দ কারিগরের অবাক করা বিশ্লেষণে ভরপুর। যেমনটা খুব কম লেখকের লেখায়ই দেখা মেলে।
নিঃসন্দেহে তিনি এই কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও শিশু-কিশোর সাহিত্যিক। শিশু-কিশোরদের জন্যে তাঁর লেখা ‘পাখি ও পতঙ্গরা যখন মানুষ ছিল’, ‘মায়ের কাছে ফেরা’ এককথায় অনবদ্য রচনা। উপন্যাস ‘জাতিস্মরের জন্মজন্মান্তর’, ‘চার পৃথিবীর মানুষ’, ‘মোহাজের’, ‘অন্ধকূপে জন্মোৎসব’, ‘চিম্বুক পাহাড়ের জাতক’, ‘দ্রাবিড় গ্রাম’ ইত্যাদি কালজয়ী রচনা।
প্রথম জীবনে সপরিবারে, পুরো গ্রামের আপনজনসহ বাড়ি-ভিটা থেকে উচ্ছেদ হওয়ার দুঃস্বপ্ন তাঁকে পরবর্তী জীবন জুড়ে যেন তাড়া করেছে। স্মৃতিপটে এঁটে থেকেছে। এরই প্রতিবিম্ব দেখা যায় তাঁর ‘শেকড়ছেঁড়া মানুষেরা’ উপন্যাসে। তিনি অন্যত্র লিখছেন, “আমার বাড়ি নেই, কিন্তু টিকে আছে আমার জন্ম গ্রামের অবশেষ অংশ। ওখানে আমি আজ অচেনা আগন্তুক।” আবার কোথাও নিজেকে ভেবেছেন ‘জন্ম উদ্বাস্তু’।
জীবনভর লড়াকু হরিপদ দত্তকেও একসময় হার মানতে হয়েছে। পড়ন্ত জীবন বেলায় তাঁকে মাতৃভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে হয়েছে। তাঁর অভিবাসন বিরোধী বিদ্রোহী মনকে বশ স্বীকার করতে হয়েছে জীবনের কঠিন বাস্তবতার কারণে। যেতে হয়েছে স্বজনদের আতিথেয়তায়। সীমান্তের ওপাড়ে।
নিজের জন্ম-সম্পর্ক নিয়ে অপূর্ব বর্ণনা রয়েছে তাঁর লেখায়। তিনি লিখছেন, “জাতিস্মরের চোখ দিয়ে আমি কল্পনা করতে পারি আমার জন্মগৃহ আর বিছানাকে। অন্ধকারাচ্ছন্ন সদ্য নির্মিত ছনের কাঁচা ক্ষুদ্রাকৃতি গুহাগৃহ। আলো-বাতাস অবরুদ্ধ ঘরের মেঝে সদ্য ফেলা লাল এঁটেল মাটির ফ্লোর। স্যাঁতস্যাঁতে। পাটশোলার বেড়ায় লেপে দেয়া গোবর-মাটির গন্ধ। আমার জন্মরক্ত জীর্ণ কাঁথা চুষে বাঁশের চাটাই ভেদ করে লাল মাটির ফ্লোর বেয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আমার জন্মরক্ত আর জন্মমাটিকে আলাদা করে কার সাধ্য?” কী অকাট্য বন্ধন! উল্লেখ্য, যে-সময় তাঁর জন্ম, সে-সময়টায় হিন্দু পরিবারে সন্তান প্রসব হতো তেমন অশুচি বা আঁতুড় ঘরে, যেমনটা তাঁর লেখায় উঠে এসেছে। যিনি সন্তান জন্ম দিচ্ছেন, সেই নারীকে ‘অশুচি’ গণ্য করে আলাদা ঐ-ঘরে নির্বাসিত করার এই ব্যবস্থাটি এখন আর নেই, আধুনিকতার ছোঁয়ায়।
হরিপদ দত্তের শেকড় গাড়া শীতলক্ষ্যার পাড়ের মহেশ্বরদীর পলাশের সেই খানেপুর গ্রামে, যেই গ্রাম আর আগের নৈস্বর্গিক রূপে নেই; কারখানার বিষাক্ত বাষ্পে নষ্ট পরিবেশ ও প্রতিবেশের এক ভিন্নতর জনপদ এখন। কিন্তু তাঁর স্মৃতিতে-মননে এখনো সেই অনূঢ়া প্রাকৃতিক স্বর্গ, যেখানে মানুষ আর পাখ-পাখালি, শিমুল আর পলাশ ফুলের রক্তিম রঙে নববধূর সাজে সেজে থাকে পুরোটা অঞ্চল। বিলগুলো ভরে থাকে পদ্ম আর শাপলায়। যেখানে শীতলক্ষ্যার জল মানস সরোবরের জলের মতো নির্মল। বয়ে চলে সদা কলকল রবে। দুই পাড়ের মানুষের জন্যে যে-নদীর রয়েছে অকৃপণ মাতৃস্নেহভরা অবদান। কবি বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, “শীতলক্ষ্যা তীরে গিয়েছিনু লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে। …যাব নাক সেথা আর, যদিও লক্ষ্মীপূর্ণিমা রাত ফিরিবে পুনর্বার।” এমন অভিমান করার একশো একটা কারণ থাকলেও হরিপদ দত্ত বারবার এই নদীর কথায় ফিরে এসেছেন। লিখেছেন, “আমি শীতলক্ষ্যার কাছে বারবার ফিরে যাই। এই নদীর জলেই মিশে আছে আমার হাজার বছরের পূর্বপুরুষের চিতাভস্ম।” তিনি লিখেছেন, “শীতলক্ষ্যা আমার জন্ম ঠিকানা।” একসময় একে নিয়ে লিখেছেন অনবদ্য এক উপন্যাস— ‘শীতলক্ষ্যা’।
হরিপদ দত্ত এই জনপদের গণমানুষের জাতীয় আকাঙ্ক্ষার লড়াই-সংগ্রামের জোয়ার-ভাটায় অবগাহন করেছেন। দেখেছেন, কী মহিমান্বিত চরিত্রবলে তাঁর এলাকার মানুষ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। দেখেছেন, কী উচ্চাশা নিয়ে এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন একাত্তরে। তিনি দেখেছেন, তাঁর এলাকায় একজনও রাজাকার হয়নি, মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন অনেকেই। অবশেষে তিনি এমনটাও প্রত্যক্ষ করে ভারাক্রান্ত হয়েছেন যে, মানুষের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তাঁর ভাষায়, “১৯৭১ সালে পৃথক দেশ গড়া হলো। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য তৈরি হলো না। সেভাবে দেশ গড়ে ওঠলো না। চীনে যেমন বিপ্লবের পর মানুষের মধ্যে একটা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এসেছিল, তেমনটা হলো না। ভেতর থেকে পাকিস্তানই রয়ে গেল। ধর্মের প্রশ্নে পাকিস্তান হয়েছিল, গণতন্ত্রের প্রশ্নে বাংলাদেশ হলো। কিন্তু সেই গণতন্ত্রের বাংলাদেশ হলো না।” আক্ষেপ করে বলছেন, “দেশ না, মানুষ ভাগ হয়ে গেল।” তিনি এর ব্যাখ্যায় বলছেন, “শ্রেণি-বৈষম্য, ধন-বৈষম্য, বর্ণপ্রথা আর ধর্মের দৈত্য বিভাজন তৈরি করেছে।” তিনি এ-ও দেখছেন যে, এখানকার শিল্প-সংস্কৃতি এখন ক্রমশ জড়তা আর ভীরুতায় নিমজ্জিত হচ্ছে। শিল্পীদের গ্রাস করছে এসব। জীবন ঘষে আগুন জ্বালাবার শক্তি লোপ পাচ্ছে যেন তাদের।
জীবনভর লড়াকু হরিপদ দত্তকেও একসময় হার মানতে হয়েছে। পড়ন্ত জীবন বেলায় তাঁকে মাতৃভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে হয়েছে। তাঁর অভিবাসন বিরোধী বিদ্রোহী মনকে বশ স্বীকার করতে হয়েছে জীবনের কঠিন বাস্তবতার কারণে। যেতে হয়েছে স্বজনদের আতিথেয়তায়। সীমান্তের ওপাড়ে। প্রায় এক যুগের সেই অভিবাসী জীবন কাটিয়ে এবার তিনি এসেছিলেন শেকড়ের তীব্র টানে। ফিরে গিয়েছিলেন সেই শীতলক্ষ্যার পাড়ে। লোকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, কেন ছেড়ে গেলেন? জবাবে তিনি বলেন, ছেড়েছি স্বজনদের চাপে বাধ্য হয়ে। বয়স ও স্বাস্থ্যগত সীমাবদ্ধতায়। একটি পত্রিকার সাথে সাক্ষাতকারে তিনি এ-কথাও বলেছেন যে, “লেখক হিসেবে দেশ ছাড়া আমার উচিত হয়নি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল দেশ ছেড়ে যাওয়া।”
এখন তিনি পশ্চিম বাংলায় থাকেন স্বজনদের সাথে। তিনি সেখানে নিজেকে উদ্বাস্তু মনে করেন। তাঁর মন পড়ে থাকে এখানে; মাতৃভূমিতে। তাঁর সাহিত্যিক মন পাখির মতো উড়ে বেড়ায় এর প্রান্তরে, গ্রাম-গ্রামান্তরে। তিনি বলেন, “আমার সাহিত্য সাধনা নিবেদিত আমার জন্মভূমির জন্য, জন্মের ঋণমুক্তির জন্য। আমার জন্মের দায় বাংলাদেশের, বিশ্বের অন্য কোনো দেশের জন্য নয়। তাই যা লিখেছি, যা লিখছি ও যা লিখবো, সবই বাংলাদেশের জন্য।”
ভীষণ আত্মপ্রচারবিমুখ ও একান্ত নিভৃতচারী এই সাহিত্যিকের যতোসব সৃষ্টি, সেগুলো ততোটা প্রচার পায়নি, যতোটা পাওয়া উচিত ছিলো। তাঁর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে বোদ্ধামহলে স্বীকৃতি মিলেছে বরাবরই। বাংলাদেশের প্রধান কবি, বাংলাদেশের হৃদয়ের কবি, নরসিংদীর মেঘনা পাড়ের মানুষ শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা ‘তিনজন যুবকের গর্জে ওঠা’ হরিপদ দত্তকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর সৃষ্টিকর্মের স্বীকৃতি দিয়ে। তবে সাধারণত যেভাবে তাঁর পরিচিতি ও খ্যাতি শাখা-প্রশাখা মেলার কথা ছিলো, তেমনটা যথাসময়ে হয়েছে, এই কথা বলা যাবে না। এর আরো বিস্তৃতি-লাভ উচিত ছিলো। তবে তেমনটা না হলেও জাতীয় পর্যায়ে তাঁর স্বীকৃতি মিলেছে বেশ আগেই। বাংলা একাডেমি তাঁকে পুরস্কৃত করেছে দুই দুইবার। প্রথমবার ২০০১ সালে সা’দত আলি আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার দিয়ে। পরে ২০০৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান তিনি।
হরিপদ দত্তের সাহিত্যকর্মের উপর এখন গবেষণা হচ্ছে। পিএইচডি করছেন কেউ কেউ। তরুণ প্রজন্মের কাছে আবেদন সৃষ্টি করছে তাঁর ভিন্নতর সৃজনশীল বিষয়গুলো। এর উপর ভর করে নিশ্চিন্তে বলা যায়, তাঁর সাহিত্যকর্ম কালোত্তীর্ণ হয়ে বাংলা সাহিত্যের ভুবনে বিরাজ করবে উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে। তবে তিনি তো এখনো লিখছেন। তাঁর সেইসব লেখাও ক্রমান্বয়ে যোগ হবে এই গ্যালাক্সিতে। আর এর মাঝেই অমরত্ব পাবেন মহেশ্বরদীর এই কৃতী সাহিত্যিক।
আদিয়াবাদ ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ রায়পুরা উপজেলার একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নৈসর্গিক দৃশ্যের অপরূপ রূপে সুশোভিত স্কুলটি আড়িয়াল খাঁ নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জ্ঞানের মশাল জ্বেলে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে শতবর্ষেরও অধিক সময় ধরে। আদিয়াবাদের সোনালি শিক্ষার বিস্তারে স্কুলটির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে আদিয়াবাদের মুসলিম কৃষকগণ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এদিকে মেধাবী ছাত্র আফসার উদ্দিন (বর্তমান সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু’র পিতা) পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় তাঁর মামা উমেদ আলী মুন্সি ভাগ্নেকে উচ্চ শিক্ষিত করার জন্যে স্থানীয় সচ্ছল কৃষকদের দ্বারস্থ হন। বৃটিশ আমলে তৎকালীন আদিয়াবাদ ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট জহির উদ্দিন মুন্সির প্রত্যক্ষ উদ্যোগে স্কুলটি যাত্রা শুরু করে ১৯১২ সাল হতে। ময়েজ উদ্দিন মোল্লা, মানিক সরকার, রওশন আলী মীর, ইয়াছিন আলী সরকার, জাফর আলী সরকার, হাড়াই প্রধান, কালাই শিকদারসহ আরো অনেকে স্কুল প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন।
প্রাথমিক অবস্থায় বাঁশের খুঁটি ও ছনের ছাউনি দিয়ে মক্তবে পাঠদানের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রথমবারের মতো ১৯১৭ সালে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেই অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে। প্রাথমিক অবস্থায় প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন বাবু শ্রী নলিনী কান্ত ঘোষ। প্রথমদিকে স্কুলের জন্যে ছাত্র-ছাত্রী সংগ্রহ করা হতো আশারামপুর, হাইরমারা, নিলক্ষ্যা, মনিপুর, চরসুবুদ্ধি, হাসনাবাদ, হাঁটুভাঙ্গা, বালুয়াকান্দি, পুটিয়া, সিরাজনগর, রাধাগঞ্জ, খৈনকুট, সৃষ্টিগড়, গোবিন্দপুরসহ আশেপাশের এলাকা হতে। কর্দমাক্ত কাঁচা রাস্তা ধরে স্কুলে আসতো শিক্ষার্থীরা।
১৯৬৫ সালে এলাকাবাসীর প্রচেষ্টায় স্কুলে পাকা দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়। এর দু’বছর পরই ১৯৬৭ সালে এ-প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জয়নাল আবেদিন ভূঁইয়া ও খোরশেদ আলম নামে দু’জন ছাত্র দ্বিতীয় গ্রেডে বৃত্তি লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধের বছরও তিনজন ছাত্র বৃত্তি লাভ করে। ছেষট্টির ছয়দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন জনাব খন্দকার আবু হান্নান। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্কুলটি একবার বন্ধ হয়ে যায় এবং কয়েক মাস পর আবার কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে অর্থাভাবে আবারো বন্ধ হয়ে যায় এবং পুনরায় সক্রিয় হয় সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু’র হস্তক্ষেপে, যিনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্কুলের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
১৯৯৫ সাল হতে কলেজ শাখা চালু করা হয়। তৎকালীন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এ.এস.এইচ.কে সাদেক এই কলেজ পরিদর্শনে এসে স্কুলের পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হন এবং ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত করেন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে জাতীয়করণ করে নেয়।
‘মালঞ্চ’ নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। সম্পাদক ছিলেন বিজ্ঞান শিক্ষক জনাব আবদুল কবির। পরবর্তী বছর ‘কল্পতরু’ নামে আরেকটি ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় তৎকালীন ছাত্র জয়নাল আবেদীনের সম্পাদনায়, যিনি কর্মজীবনে রাজউকের চেয়ারম্যান ছিলেন। কিন্তু ম্যাগাজিন দুটোর কোনো কপির সন্ধান পাওয়া যায়নি। ১৯৭৫ সালে বাংলার শিক্ষক মো. আবদুল হকের সম্পাদনায় ‘সৈকত’ এবং ১৯৯৯ সালে বাংলার শিক্ষক বেলায়েত হোসেনের সম্পাদনায় ‘অন্বেষা’ নামে ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। ২০১৬ সালে বর্তমান অধ্যক্ষ মো. নূর সাখাওয়াত হোসেন মিয়ার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘কলরব’। ২০১৭ সাল হতে কলেজ শাখা থেকে ‘স্মৃতির পাতায়’ ও স্কুল শাখা থেকে ‘বন্ধন’ নামে প্রতিবছর ধারাবাহিক সিরিজ ম্যাগাজিন প্রকাশিত হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটিতে পিঠা উৎসব, বৈশাখী মেলা, বিজ্ঞান মেলা, কৃষি মেলা, শিক্ষা উপকরণ মেলা, সাংস্কৃতিক সপ্তাহ পালন, সাপ্তাহিক সাংস্কৃতিক ক্লাশ, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কুইজ, চিত্রাঙ্কন, বৃক্ষরোপণ, ল্যাংগুয়েজ ক্লাবসহ অন্যান্য কার্যক্রম বিদ্যমান রয়েছে। প্রায় ৬৫ প্রজাতির গাছপালা ও ফুল রয়েছে স্কুলটিতে।
স্কুলের বর্তমান গভর্নিং বডির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন মিসেস কল্পনা রাজিউদ্দিন। সুদীর্ঘ ১৮ বছর ধরে অধ্যক্ষ হিসেবে আছেন মো. নূর সাখাওয়াত হোসেন মিয়া। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে সব মিলিয়ে ৫০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন। স্কুল শাখায় ১,১৫০ জন শিক্ষার্থীর পাশাপাশি কলেজ শাখায় প্রায় ৪০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।
এই প্রতিষ্ঠানটি দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের পদচারণায় ঋদ্ধ হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ও সমরেশ মজুমদার অন্যতম। কবি ও সাংবাদিক আজিজুল হাকিম এই স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন। এই স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক আবু সায়ীদ ছেরাজুদ্দাহার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে (সম্ভবত ১৯৪০ সালে) তাঁকে উদ্দেশ্য করে চার পঙক্তির একটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন, যেটি রবীন্দ্রভবন মহাফেজখানায় সংরক্ষিত আছে। (সূত্র : ড. মনিরুজ্জামান) বিষয়টি এই স্কুলের জন্যে অত্যন্ত গৌরবের।
বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির অকৃত্রিম অনুষঙ্গ ‘গাজীর পট’-এর গায়েন দুর্জন আলী, মৃত্যুবরণ করেন ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি। এ-বছর তাঁর মৃত্যুর ৮ বছর পূর্ণ হলো। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই মহান শিল্পী তাঁর কাজে পূর্ণ সক্রিয় ছিলেন। ছোটোখাটো দোহারা গড়নের এই মানুষটি খুবই বড়ো মনের ছিলেন। পেশা ছিলো বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাতা মেরামত করা। থাকতেন নরসিংদীর হাজীপুরে, এক জীর্ণ কুটিরে। সাথে থাকতেন তাঁর ছোটো ভাই আরেক কিংবদন্তী গায়েন কোনাই মিয়ার পুত্র ফজল মিয়া ও তাঁর পরিবার। জীর্ণাবস্থায়, দরিদ্রাবস্থায় দিনাতিপাত করেও এই শিল্পী মানুষটি তাঁর মনের ভিতরে অফুরান প্রেম ও মানবিকতার রসের ধারা বহমান রেখে চলতেন। ২০১৫ সালে, যখন তাঁর সাথে প্রথম সাক্ষাত ঘটে, তখনই পেয়েছিলাম এই শিল্পীমনের পরিচয়।
লোকশিল্প গবেষক তোফায়েল আহমদ কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামে ‘গাজীর পট’ দেখতে যান। আশুতোষ মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ দাবি করে, দুই বাংলার এই একটি গাজীর পটই অবশিষ্ট আছে। গবেষক তোফায়েল আহমদ এই তথ্য মেনে নিতে পারেননি। দেশে ফিরে খুঁজতে থাকলেন পটচিত্রী আর পট পরিবেশনা সম্প্রদায়। সারাদেশের পটচিত্রের ইতিবৃত্ত খুঁজতে গিয়ে লোকসংস্কৃতি গবেষক তোফায়েল আহমদ এবং তাঁর দলের সঙ্গী সমাজকর্মী হামিদা হোসেন, শিল্পী কালিদাস কর্মকার নরসিংদীর হাজীপুর গ্রামের বেদেপাড়ায় খুঁজে পান পটকুশীলব দুর্জন আলী এবং কোনাই মিয়াকে। এসব ঘটনা সেই সত্তর দশকের। তাঁদের সূত্র থেকেই ১৯৮০ সালে খুঁজে পাওয়া যায় মুন্সিগঞ্জের কমলাঘাটের কাঠপট্টির কালিন্দীপাড়ায় পটচিত্রী সুধীর আচার্য এবং তাঁর ছেলে শম্ভু আচার্যকে। দুর্জন আলীর কাছে যে-পটচিত্রটি দেখতে পেয়েছিলাম, তা শম্ভু আচার্যের আঁকা। বর্তমানে এই চিত্রটি গায়েন ফজল মিয়া ও তাঁর দল ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশে হাতেগোনা যে-ক’জন গাজীর পটশিল্পী ছিলেন, দুর্জন আলী ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অনেকে মনে করেন, তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গাজীর পটের শেষ সূর্যটি অস্তমিত হয়েছে।
দুর্জন আলীর জন্ম ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর ভাই কোনাই মিয়াও ছিলেন পটকুশীলব। দুর্জন আলী এবং কোনাই মিয়ার বাবা আনোয়ার আলী। কয়েক পুরুষ যাবত তাঁরা নরসিংদীর হাড়িধোয়া-মেঘনা নদীর তীরে হাজীপুর গ্রামের বেদেপাড়ায় বসবাসরত। তাঁদের পূর্বপুরুষের আবাসস্থল ছিলো বৃহত্তর কুমিল্লার রামচন্দ্রপুরের দুলালপুর গ্রাম। দুর্জন আলী ও কোনাই মিয়ার ওস্তাদ কুমিল্লার জাফরগঞ্জের আবদুল হামিদ। কোনাই মিয়া অনেক আগেই প্রয়াত হয়েছেন। তাঁদের পূর্বপুরুষ ছিলেন বেদে সম্প্রদায়ের। দুর্জন আলী কখনো ছাতা সেলাইয়ের কাজ করতেন, কখনো সবজি বিক্রি করতেন, কখনো করতেন মুটে-মজুরের কাজ। দুর্জন আলী ছিলেন নিঃসন্তান।
দুর্জন আলীর সৌভাগ্য হয়েছিলো, ১৯৯৯ সালে ব্রিটেনে ‘বাংলাদেশ উৎসব’-এ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে গাজীর পটের গায়েন হিসেবে যোগদান করার।
ফজল মিয়া ও তাঁর দল
দুর্জন আলীর মৃত্যুর সাথে সাথে এ-অঞ্চল থেকে একটা যুগের অবসান হয়ে গিয়েছিলো, এরকম ধারণা ছিলো আমাদের। কিন্তু সম্প্রতি দুর্জন আলীর ভাতিজা ফজল মিয়ার ‘গাজীর পট’ নিয়ে নতুন দল গড়ার কথা জেনে নতুন আশার সঞ্চার হলো। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে নরসিংদী পৌর পার্কে নরসিংদী জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘গাজীর পট আসর’ দেখে পরদিন চলে গেলাম তাঁর বাড়ি হাজীপুরে। নয় বছর পর সেই একই ঘর, একই পরিবেশ দেখে স্মৃতিকাতর হলাম। ফজল মিয়াকে অভিনন্দন জানালাম মহান শিল্পী দুর্জন আলীর এই কীর্তি ধরে রাখার জন্যে।
গাজীর পটের গায়েন ফজল মিয়া
ফজল মিয়ার ছেলে দুটো এখন বড়ো হয়েছে। তবে ততোটা বড়ো নয়। কিশোর বলা যায়। তাদের নিয়েই সে গঠন করেছে তাঁর গাজীর গীতের দল। তাঁর দলের সদস্যরা হলেন : বড়ো ছেলে মো. আবদুল্লাহ, ছোটো ছেলে মো. হাবিবুল্লাহ ও করতাল বাদক মো. আঙ্গুর মিয়া।
ফজল মিয়ার কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা ছিলো, কেন এখনো ধরে রেখেছেন এই শিল্পটি…? তিনি বলেন, “ভালো লাগে, মনে আনন্দ পাই, সেজন্যই এই গান করি।” এই বাক্য শুনে সহসা মনে পড়ে গিয়েছিলো নয় বছর আগের দুর্জন আলীর কাছে শোনা একই অমোঘ বাক্য, “সুখ আসে মনে, জ্ঞান পাওয়া যায়, এই জন্যই গাই।” একজন প্রকৃত শিল্পীর যথাযথ উপলব্ধি!
ফজল মিয়া আরো জানান, “বাপ-দাদারা এই গান কইরা গেছেন। তাঁদের স্মৃতিকে ধইরা রাখতে হইবো। এটা আমাদের সম্পদ। আমি যতোদিন বাঁইচা থাকমু, এই গান করমু। আমার মৃত্যুর পর আমার পোলারা করবো, যদি তারা চায়।”
ফজল মিয়া আলাপে আরো জানান, তিনি তাঁর পুরোনো পেশা ছাতা মেরামতের পাশাপাশি এখন গাজীর গীতকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। এখন নানা স্থান থেকে তাঁর ডাক আসে গান গাওয়ার জন্যে। গত এক-দেড় বছরের মধ্যে তিনি সোনারগাঁ, ময়মনসিংহ, ঢাকা ইত্যাদি জায়গায় গান করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়, শিশু একাডেমি মিলনায়তনে সম্প্রতি গাজীর গীত পরিবেশনের খবর তিনি জানান।
মহান শিল্পী দুর্জন আলীর স্মৃতি জাগরূক রাখতে ফজল মিয়া ও তাঁর দল বাংলাদেশের এই লোকপরম্পরার গীতধারাটিকে আর নরসিংদীর এই স্থানীয় সম্পদকে সবসময়ই ঊর্ধ্বে তুলে ধরবেন, পাশাপাশি আরো অনেকের মাঝে ছড়িয়ে দেবেন, এই প্রত্যাশা রেখেই নরসিংদীর হাজীপুরের পশ্চিমপাড়া তালতলার মাঠের পাশে তাঁর কুটির থেকে আমরা বেরিয়ে আসি।
নরসিংদী অঞ্চলকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে নরসিংদী নগরের রূপকার তৎকালীন সাটিরপাড়ার জমিদারি তালুকদার ললিতমোহন রায় তাঁর বাবার নামে ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউট’ ইংরেজি বিদ্যালয়। ফলে এই অঞ্চলে শিক্ষার যে-দ্বার উন্মোচন হয়েছিলো, তার ঠিক দুই বছর পর রায়পুরায় প্রতিষ্ঠা পায় আরেকটি ইংরেজি বিদ্যালয়, যার নাম ‘রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউট’ (বর্তমান নাম রায়পুরা রাজকিশোর রাধামোহন উচ্চ বিদ্যালয়)। ১৯০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি শুরু থেকেই আলোড়ন তুলেছিলো এন্ট্রান্স পরীক্ষার সাফল্যে। সমসময়ে গড়ে ওঠা সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউট এবং রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউট— বিদ্যালয় দুটি নরসিংদী অঞ্চলে শিক্ষার যে-নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলো এবং এখনো যে-আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে, তা নরসিংদীর ইতিহাস-ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
নরসিংদীর বরেণ্য লেখক ও গবেষকেরা নরসিংদীর ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে বহু তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা গ্রন্থ কিংবা নিবন্ধ লিখেছেন। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এবং আমি অত্যন্ত অবাক হয়েছি এই কারণে যে, সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থের লেখা ‘মহেশ্বরদীর ইতিহাস’সহ ইতিহাসের অন্যান্য গ্রন্থ ও গবেষণায় সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউটের সাথে আরো স্বনামধন্য শতবর্ষী বিদ্যালয়ের নাম-ইতিহাস থাকলেও রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউট সম্পর্কে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। হয়তো সঠিক তথ্যের অভাব কিংবা নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সেটি হয়ে ওঠেনি। কিন্তু রায়পুরার তাত্তাকান্দা গ্রামের ঐতিহ্যবাহী চৌধুরী বাড়ির জমিদার শ্রী রাজকিশোর পাল চৌধুরী এবং হাসিমপুর গ্রামের চৌধুরী বাড়ির জমিদার শ্রী রাধামোহন পাল চৌধুরী দুজনের নামের প্রথম অংশ নিয়ে ‘রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউট’ নামে এ-মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি রায়পুরার কুড়েরপাড় নামক স্থানে প্রতিষ্ঠা করেন। সংক্ষেপে একে ‘আর কে আর এম’ বলা হয়ে থাকে। বিদ্যালয়টির প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী নলিনী ঘোষ। তাঁর বাড়ি ছিলো কলকাতায়। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ।
উল্লেখ্য যে, রায়পুরারই আরেক শতবর্ষী শিক্ষালয় আদিয়াবাদ ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সিনিয়র শিক্ষক আমার নানা মরহুম মৌলভী আমির উদ্দিন আহমেদ নরসিংদী অঞ্চলের সর্বপ্রথম মুসলমান ছাত্র হিসেবে এন্ট্রান্স পাশের গৌরব অর্জন করেছিলেন কলকাতা মাদরাসা থেকে। একটি ডায়েরিতে তাঁর কিছু ছাত্রের মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার রেজাল্ট ও সন-তারিখ লেখা ছিলো। সেখান থেকেই এসব ক্ষেত্রে আমার আগ্রহ তৈরি হয়। তৎসময়কার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছাত্রদের তথ্য, বিদ্যালয়ের ইতিহাস জানার চেষ্টা থেকে আমি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে থাকি। তারই ধারাবাহিকতায় রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউটের এন্ট্রান্স ও মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার ফলাফল বের করি, যা ছিলো খুবই দুঃসাধ্য ও কঠিন একটি কাজ। আর এই কাজে আমি দিক-নির্দেশনা পেয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের অস্টিন পি স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান মানিকের নিকট থেকে, যিনি এসব বিষয়ে বিশদ গবেষণা করছেন।
রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউটের এন্ট্রান্স ও মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তখনকার সময় বিদ্যালয়টি কতোটা স্বনামধন্য ছিলো। এমনকি সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউটের সাথে যেন এক ধরনের অঘোষিত প্রতিযোগিতা ছিলো। এ-পর্যায়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯০৭-১৯০৯ সালের এন্ট্রান্স পরীক্ষা এবং ১৯১০-১৯১৩ ও ১৯১৫-১৯২০ সালের মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউটের সাফল্যের স্বরূপ তুলে ধরবো।
এন্ট্রান্স পরীক্ষা, ১৯০৭
দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : রজনী কান্ত দত্ত (১৯ বছর ১ মাস) এবং তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : অভয়চরণ ভট্টাচার্য (১৯ বছর ৫ মাস)।
এন্ট্রান্স পরীক্ষা, ১৯০৮
দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ৩ জন : কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য (১৯ বছর ৭ মাস), অম্বিকাচরণ (১৬ বছর ৬) ও উপেন্দ্র নারায়ণ কারকুন (১৮ বছর ১ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : দীনেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য (১৭ বছর ৯ মাস)।
এন্ট্রান্স পরীক্ষা, ১৯০৯
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ২ জন : ক্ষিতিশ চন্দ্র ভট্টাচার্য (১৬ বছর ৮ মাস) ও যোগেন্দ্র চন্দ্র নাথ (১৭ বছর ১০ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ২ জন : পূর্ণচন্দ্র দত্ত (১৯ বছর ২ মাস) ও নবদ্বীপ চন্দ্র সাহা (১৬ বছর ১০ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১০
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ১ জন : নরেন্দ্রচন্দ্র দাস (১৭ বছর ১১ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : আলা উদ্দিন ভূঁইয়া (১৮ বছর ৪ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : নাছির উদ্দিন (১৯ বছর ২ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১১
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ২ জন : রাজমোহন দাস (১৬ বছর ৮ মাস) ও গঙ্গাচরণ সাহা (১৮ বছর ২ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : তমিজাদ্দিন (২০ বছর ২ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : অখিল চন্দ্র পাল (১৮ বছর ১০ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১২
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ১ জন : চন্দ্র কিশোর দে (২০ বছর ৮ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ২ জন : নূরাহাদ ভূঁইয়া (১৮ বছর ২ মাস) ও মথুচন্দ্র পাল (২০ বছর)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : আব্দুল গাফফার (২১ বছর ১০ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১৩
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ৬ জন : আব্দুল হাকিম (১৬ বছর ১১ মাস), আব্দুল মজিদ (১৮ বছর), মনমোহন ভট্টাচার্য (১৯ বছর ৯ মাস), নকুল চন্দ্র দাস (১৮ বছর ৮ মাস), ভুপেন্দ্র চন্দ্র কুমার রায় (১৬ বছর ৮ মাস) ও অক্ষয় কুমার রায় (১৬ বছর ৮ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ৬ জন : আব্দুল গাফফার (২১ বছর ২ মাস), আব্দুল গণি (১৭ বছর ৩ মাস), মদন মোহন ভট্টাচার্য (২১), জনাব আলী (১৯ বছর ২ মাস), অধর চন্দ্র পাল (১৮ বছর ১১ মাস) ও পূর্ণ চন্দ্র পাল (১৮ বছর ৪ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১৫
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ১ জন : তায়েব উদ্দিন (১৬ বছর ২ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : শামসুল হক (১৭ বছর ২ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১৬
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ২ জন : রাজেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী (১৭ বছর ৪ মাস) ও হরেন্দ্র লাল পাল (১৭ বছর ৫ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : গঙ্গা চন্দ্র বিশ্বাস (২১ বছর ৫ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১৭
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ২ জন : আহম্মেদ আলী (১৭ বছর ৪ মাস) ও সুরেশ চন্দ্র দাস (১৭ বছর ৫ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ৩ জন : আব্দুর রহমান মিয়া (২৩ বছর ৭ মাস), সুরেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী (১৮ বছর ৯ মাস) ও উপেন্দ্র কিশোর দত্ত (২২ বছর ১১ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ৩ জন : সচীন্দ্র লাল কর্মকার (১৭ বছর ১১ মাস), মোহাম্মদ জনাব আলী (১৬ বছর ৫ মাস) ও যতীন্দ্র কুমার রায় (১৯ বছর ১ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১৮
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ১ জন : মো. ইমদাদুল হক (১৮ বছর ১ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ২ জন : বশির উদ্দিন আহম্মেদ (১৯ বছর ৫ মাস) ও ইন্দ্র মোহন দাস (১৮ বছর ৪ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : মনমোহন সাহা (১৮ বছর ২ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১৯
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ৪ জন : ললিত কুমার দত্ত (২১ বছর ১ মাস), পরেশ চন্দ্র নাগ (১৭ বছর ২ মাস), সোনা মিয়া (১৬ বছর ১১ মাস) ও রজনীকান্ত তালুকদার (১৭ বছর ১০ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ১১ জন : আব্দুল গফুর ভূঁইয়া (২০ বছর ১ মাস), আব্দুর রহমান (১৭ বছর ৩ মাস), আব্দুস সোবহান (১৭ বছর ১১ মাস), হিরেন্দ্র কুমার দাস (২০ বছর ৩ মাস), অশ্বিনী কুমার গোস্বামী (২০ বছর ৪ মাস), জলধর কর্মকার (১৭ বছর), মুহাম্মদ সাহেব আলী (২০ বছর ৫ মাস), সুরেশ চন্দ্র পাল (১৭ বছর ৭ মাস), সুরেন্দ্র কুমার রায় (১৮ বছর ২ মাস), সফিউদ্দিন ভূঁইয়া (২০ বছর ১ মাস) ও ক্ষেত্র মোহন সাহা (২১ বছর ৭ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯২০
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ২ জন : হরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ (১৭ বছর ১০ মাস) ও ভরত চন্দ্র নাথ (১৮ বছর ১ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ৭ জন : আব্দুল আজিজ (১৮ বছর ১১ মাস), আব্দুল ওয়াহেদ (১৮ বছর ১০ মাস), ললিত মোহন দাস (২১ বছর ৫ মাস), অমর চন্দ্র পাল (২০ বছর ৪ মাস), অশ্বিনী কুমার রায় (১৯ বছর ১ মাস), নগেন্দ্র কুমার রায় (১৮ বছর ৪ মাস) ও অনন্ত কুমার শ্যাম (২২ বছর ৩ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ২ জন : মুহাম্মদ নওয়াব আলী (১৭ বছর ২ মাস) ও মনিরউদ্দিন (১৮ বছর ৯ মাস)।
উল্লেখ্য যে, ১৯১০ সালে এই বিদ্যালয় থেকে প্রথম ২ জন মুসলমান ছাত্র মেট্রিকুলেশন পাশ করে। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর এলাকায় ব্যাপক সাড়া পড়ে এবং অতি অল্প সময়ে আশানুরূপ ফলাফলে দ্রুত শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পেতে থাকে। রায়পুরা ছাড়াও দেশের দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্রছাত্রী এসে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কারণে এক পর্যায়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের জন্যে আবাসিক বোর্ডিংয়ের ব্যবস্থা করেন এবং ১৯৬২ সালে স্থান সংকুলান না হওয়ায় কুড়েরপাড় থেকে তাত্তাকান্দায় মেঘনা নদীর শাখা কাঁকন নদীর তীরে পাগলনাথ মন্দিরের পাশে ৩ একর ৮১ শতাংশ জায়গায় গড়ে তোলেন বিদ্যালয়ের বর্তমান ক্যাম্পাস। ১২০ বছরের পুরোনো রায়পুরা রাজকিশোর রাধামোহন উচ্চ বিদ্যালয়টি সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে, এটাই কাম্য।
তথ্যসূত্র
১. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্যালেন্ডার (১৯০৮-১৯২৩) ও
২. কাঁকন, বিদ্যালয়ের এলামনাই এসোসিয়েশন কর্তৃক প্রকাশিত ম্যাগাজিন।
খন্দকার পারভেজ আহম্মদ (পিনু)
আহ্বায়ক, আমরা হাজীপুর ইউনিয়নবাসী