Home Blog Page 5

কাজীকে দেখে এলাম

0
তামারা ফিলিপসের ‘বিনিথ ম্যাজিক’

কাজী, গোলাপের চাষ করতে চেয়েছিলো। সে গোলাপ ভালোবাসে। গোলাপের গন্ধ

চাপিলা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়ার সময় তার প্রথম স্মরণ হয় লাল রঙের কথা। আর একখণ্ড পপলার কাঠের কথা। সে ভাত মাখাচ্ছিলো আর ভাবছিলো গতকাল বৃষ্টি হয়েছে কিনা। বৃষ্টি হলে দুলালি পায়ে নূপুর পড়তো। দুলালি কি কাল নূপুর পড়েছিলো? দুলালি কি কখনো নুপূর পড়তো? সে মনে করতে পারলো, দুলালির বুনি ছিলো বেশ বড়ো। আর চোখগুলোও!

কালবোশেখের ছেনালি শব্দ আসছে কানে। কাজী খাবার শেষে একটা সিগারেট ধরালো। শীত শীত করছে আর মনে পড়ছে দুলালির উদোম গতর। কাজী হঠাৎ চোখ বন্ধ করলো। চোখ বন্ধ করলে তার আবার স্মরণ হয় লাল রঙের কথা। গোলাপের কথা।

একটা গোলাপের ছবি আঁকবো। কাজী ভাবলো।
একটা টকটকে লাল গোলাপের ছবি আঁকবো। আবার ভাবলো কাজী।

তিনদিন আগে শুরু হওয়া মাসের তৃতীয় দিনে এসে কাজী প্রথম তার ক্যানভাসে আঁচড় টানলো। আঁচড় টানলো টকটকে লাল রঙের। এরপর একদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো যখন, তখন কাজী আমাদের গোলাপের গল্প বলেছিলো। সে গল্প বলেছিলো ইসমাইল ভাইয়ের বৃদ্ধ এবং কালো ধোঁয়ায় জঙ ধরে ওঠা অতীত দিনের একটা চায়ের দোকানে বসে।

সে বললো, “দুলালির যোনিতে কিড়া ধরেছে। কিড়াগুলো সেখানে কিলবিল করছে। তাকে ডাক্তার দেখানো উচিত
কাজী চায়ে চুমুক দেয়। চায়ের জলে লেবুপাতা ভাসছে। আমরা লেবুপাতার গন্ধ পেলাম। আমরা গন্ধ পেলাম দুলালির কিড়ায় ধরে ওঠা যোনির।
হ্যাঁ, দুলালির যোনিতে কিড়ায় ধরেছে”, কাজী বললো।
কিড়াগুলি সেখানে কিলবিল করছে”, আবার বললো কাজী।

পুরোনো দিনের ঘুমের মতো দেখতে এই চায়ের দোকানটায় আমরা ছিলাম তিনজন। আমি, আমার বন্ধু আর কাজী। আমি সিগারেট টানছিলাম। আমি চাইছিলাম না আমার সিগারেট থেকে কাজীকে ভাগ দিই। কাজী আবার চায়ে চুমুক দেয়। চায়ের জলে লেবুপাতা ভাসছে। আমি তাকিয়ে থেকে দেখি, কাজীর হাতে লাল রঙ লেগে আছে। আর এই লাল রঙের জায়গাটায় আটকে আছে একটা শাদা রঙের কিড়া। আমার মনে হলো কিড়াটির কোনো মাথা নেই।
হুঁ, কিড়াটির কোনো মাথা নেই”, আমার বন্ধু বললো।

আমি আমার বন্ধুর দিকে তাকাই, তাকে আমার কৈ মাছের মতো মনে হয়। তাকে মনে হয় মাটিতে আটকে পড়া একটা কৈ মাছের মতো!
তোকে একটা কৈ মাছের মতো লাগছে”, আমি বলি।
তোকে একটা মৃত কৈ মাছের মতো লাগছে”, আবার আমি বলি।

এরপর অনেকদিন আমরা আমাদের চোখ বন্ধ করে রাখি অথবা আমরা আর এরমধ্যে কাজীকে দেখতে পাইনি। সে ছিলো অদৃশ্য এবং আমরা ভাবলাম, সে এমনই। তখন, আবার অতীত দিনের মতোই ইহুদী আর মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেলো। আর যুদ্ধ লাগলো সেই একই পুরোনো এবং পবিত্র আর মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের জায়গা জেরুজালেমে। যদিও ইহুদীরা ছিলো আজীবন নির্যাতিত এবং কখনো নিজেদের একটা দেশ না পাওয়া জাতি। তবুও আমরা দেখলাম, তারা কেমন শক্তিশালী আর বেজন্মা একটা জাতি হয়ে ওঠলো!

আমি আর আমার বন্ধু, যাকে আমার মৃত কৈ মাছের মতো মনে হয়, আমরা আলাপ শুরু করি এই যুদ্ধ নিয়ে। আমরা আলাপ করি টাওয়াদীর গলির মোড়ে রবীন্দ্রনাথের চায়ের দোকানে বসে। রবীন্দ্রনাথ কখনো দুধ চা বিক্রি করেন না। কারণ হিসেবে তিনি আমাদের বলেন, তাঁর কোনো প্রেমিকা নেই। আমরা কেবল তাঁর দোকানে রঙ চা খাই। এবং মাঝেমধ্যেই মুসলমান আর ইহুদীদের যুদ্ধ নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলি।
গাজায় আজ একটা শিশু মারা গেছে”, আমার বন্ধু বললো, যাকে আমার মৃত কৈ মাছের মতো মনে হয়।
শালা ইহুদীদের পাছা ফাটিয়ে দেয়া উচিত”, আবার আমার বন্ধু বললো, বলা বাহুল্য, যাকে আমার মৃত কৈ মাছের মতোই মনে হয়।

আমি তার কথার পিঠে কোনো কথার পেরেক ঠুকি না। আমি টিভিতে নিচের দিকে যমুনার জলের মতো বয়ে যাওয়া সংবাদ পড়তে থাকি। যেখানে বলছে এবং দেখাচ্ছেও, গুলিস্তানে এক কথা বলা কুকুর পাওয়া গেছে। সাংবাদিকের দল এই কথা বলা কুকুরের দিকে মাউথপিস বাড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কুকুরটি গলা খাঁকারি দিয়ে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। সে জনগণের সেবা করতে চায়। সে জনগণকে সাথে নিয়ে উন্নয়নের বিপ্লব করতে চায়। সে সবার ঘরে সমপরিমাণ মাংসের হাড়ের জোগান পৌঁছে দিতে চায় এবং এক্ষেত্রে সে বদ্ধপরিকর।

শালারা সবসময় কুকুরের দিকেই মাইক বাড়ায়”, আমার বন্ধু বললো।
কথা বলা কুকুরের দিকেই”, আবার আমার বন্ধু বললো।
তখন একটা প্রজাপতি এসে ঢুকলো চায়ের দোকানটায়। আর এর পেছন পেছন আমরা দেখলাম কাজীকে। কাজী আমাদের সামনে এসে, যেনো আমরা দেখতে পাইনি এমন করে জাদুকরের মতো শূন্য থেকে এক ছবি এনে বের করলো। আমরা ছবিটির দিকে তাকালাম, এরপর তাকালাম কাজীর দিকে, তারপর আবার ছবিটির দিকে। আমরা বিশ্বাস করতে চাইছিলাম যে, ছবিটা কাজীই এঁকেছে।
তখন কাজী বললো, “ছবিটা আমি এঁকেছি।

শালা শুয়োরপুত্র করলো কী!
ছবি এতোটাই নিখুঁত যে, মনে হচ্ছে গোলাপের পাপড়ি থেকে কিড়াগুলো হয়তো এখনই জোরবাতাসে উড়ে যাবে।
তুমি এটা কেমন করে আঁকলে”, আমার বন্ধু জানতে চাইলো।
এই গোলাপ আর এই কিড়াগুলো”, আবার আমার বন্ধু জানতে চাইলো।
আমি খেয়াল করলাম, কিড়াগুলোর কোনো মাথা নেই।
হুঁ, কিড়াগুলোর কোনো মাথা নেই”, কাজী বললো।
আমি আমার ছবিগুলো নিয়ে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করবো”, আবার বললো কাজী।
তখন কাজী ঠিক করে কলেজের পুকুরপাড়ের রাস্তার দুপাশে যেগাছেরা রয়েছে, তাতেই দড়ি দিয়ে টাঙিয়ে সে এই আয়োজনটা করবে। পরদিন কাজী তার ছবিগুলো নিয়ে পুকুরপাড়ের রাস্তায় চলে এলে সে দেখে যে, এখানে কোনো গাছ নেই।
এখানে তো গাছ ছিলো”, কাজীর মনে হয়।
এখানে কি কোনোদিন গাছ ছিলো”, আবার মনে হয় কাজীর।
কাজী চারপাশে তাকিয়ে কী যেনো হাতড়ায়। তার চোখ তখন পৃথিবীর চোখ বলে মনে হয় না আমাদের। আমরা তাকিয়ে দেখি, সে তার ছবিগুলো নিয়ে হাঁটতে শুরু করে দেয়। সে হাঁটতে থাকে। আমরা এটা আমাদের জন্মের সময় পাওয়া চোখ দিয়ে দেখি। পরদিন মুর্দা দেখার মতো খবরের কাগজে পড়ি, কাজী হাঁটছে। এইদিন বিকেলে আমরা টিভিতে দেখতে পাই, কাজী হাঁটছে। তখন আমরা আরো দেখি যে, সে একা নয়, তার সাথে আরো অনেকেই হাঁটছে।
কাজী হাঁটছে’, এই আলোচনা আমরা এক সপ্তাহ ধরে করি।

এরপর আমরা যখন ভুলে যাবো বলে ঠিক করলাম অথবা যেসময়ের পর ভুলে ফেলাটাই উচিত, সেই সময় আবার একটা প্রজাপতিকে দেখি চায়ের দোকানে এসে ঢুকতে। আর সেইসাথে আমাদের মনে পড়ে কাজীর কথা। আমরা জেনেছিলাম, কাজী কোনোএক পাহাড়ি এলাকায় গিয়েছিলো।
চল্ আমরা পাহাড়ে যাই”, আমার বন্ধু বললো।
কাজী যেপাহাড়টায় গেছে, তাতে”, আবার আমার বন্ধু বললো।

এরপর আমরা সেই পাহাড়টায় যাই। সেখানে আমরা সেই পাহাড়জুড়ে একধরনের গাছ দেখি।
এইগুলা কী গাছ”, আমি জিজ্ঞেস করি।
এটা কোন জাতের গোলাপ গাছ”, আবার জিজ্ঞেস করি আমি।
পুরো পাহাড়জুড়ে একই ধরনের আর পুরোনো দিনের গল্প বলে এমন গাছ; যা আমাদের বলে, এরা আসলে মানুষ বা এরা আসলে কাজী। আর এরা এখন প্রত্যেকেই গাছ। কেবলই গাছ। আর প্রত্যেক গাছেই ধরে আছে গোলাপ ফুল, যার পাপড়িগুলো কিড়ায় খাওয়া।

বৃক্ষরোপণ বন্ধ করুন দয়া করে

পৃথিবী পুড়ে যাচ্ছে, তাপমাত্রা সকল রেকর্ড ভেঙে নতুন উচ্চতায় স্থাপিত হচ্ছে। এবারের গরম হয়তো মানুষকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে তার চারপাশের প্রকৃতি নিয়ে। কিংবা হয়তো বরাবরের মতোই অন্তত আমাদের দেশের প্রবণতা অনুযায়ী সমস্ত দায়-দায়িত্ব সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। কিন্তু স্বস্তি কি আদৌ আসবে? প্রকৃতিকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে না দিলে প্রকৃতি তার যথাযথ শোধ নিবে, এর বাইরে যাওয়ার কোনো পথ মানুষের প্রজ্ঞা-প্রযুক্তি এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি। তাই নিজেদের বাঁচার স্বার্থেই প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে।

প্রতি বর্ষায় বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃক্ষ রোপিত হচ্ছে, তবু কেনো আমরা এর বিশেষ কোনো সুফল পাচ্ছি না? আমাদের বৃক্ষরোপণ পদ্ধতিই কিংবা বৃক্ষ বিষয়ক প্রাথমিক জ্ঞানের অভাবই আমাদের সুফল বঞ্চিত করছে। আমরা জানি, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার প্রাথমিক একটি উদ্যোগ হলো বৃক্ষরোপণ। আসলে কি তাই? বৃক্ষরোপণ কি আমাদের প্রকৃতিকে রক্ষা করতে পারে? পরিসংখ্যানবিদগণ হয়তো অনেক রকম পরিসংখ্যান দেবেন। যেমন, একটি দেশের ভূমির শতকরা অন্তত পঁচিশ ভাগ বনভূমি থাকা দরকার। বাংলাদেশে এর এক তৃতীয়াংশও নেই। এখন আমরা যদি সবার সম্মিলিত উদ্যোগে পঁচিশ শতাংশ বনাঞ্চল আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরে তৈরি করে ফেলতে পারি, তাহলে কি আমাদের পরিবেশ ভালো হয়ে যাবে?

আমাদের বৃক্ষরোপণ বিষয়ক ধারণায় কিছু মৌলিক গলদ আছে। তাই প্রথমত আমাদের পক্ষে পঁচিশ শতাংশ বনাঞ্চল পুনর্নির্মাণ সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, যদি আমরা পঁচিশ শতাংশ বনাঞ্চল নির্মাণ করতেও পারি, সেই বনই আমাদের মানুষ থেকে পশু বানিয়ে ছাড়বে। সুফল অনেক দূরের ব্যাপার, বনবৃদ্ধির কুফলই আমরা সামলাতে পারবো না। এর প্রধান কারণ আমরা সাদামাটাভাবে জেনেছি যে, বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা করা যায়। আমাদের দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি শ্লোগান হলো ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’। পরিতাপের বিষয় হলো, আমরা গাছ লাগিয়েই পরিবেশকে একেবারে খাদের কিনারায় নিয়ে এসেছি।

আমরা বলতে চাই, আপনারা দয়া করে গাছ লাগানো বন্ধ করুন। যদি দেশের মানুষের কল্যাণ কামনা করেন, যদি আপনার পরিবেশ নিয়ে কিছুটা মায়া-মমতা থাকে, তাহলে গাছ লাগানো বন্ধ করুন। কারণ, আপনারা গত আশির দশক থেকে এখন পর্যন্ত গাছ লাগিয়ে বাংলাদেশের পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান ও মননশীলতার যে-বিপুল পরিমাণ ক্ষতি সাধন করেছেন, তা স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে আরো অন্তত বিশ বছর লেগে যাবে। আর যদি ক্রমাগত গাছ লাগাতে থাকেন, তাহলে এই দেশটার অন্তত প্রাকৃতিক কোনো ভবিষ্যত নেই, একথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়।

আমরা গাছ লাগানোর নামে বাংলাদেশের বাস্তুসংস্থান, পরিবেশ-প্রতিবেশ, পুষ্টি, বৃক্ষ-অর্থনীতি, প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক, পাখি-পতঙ্গসহ জমির ফসল, পুকুরের মাছ, পশুখাদ্যের শৃঙ্খলা, সবকিছুতেই একটি বড়ো বিপর্যয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি। কারণ, আমরা ব্যাপকহারে লাগিয়েছি মেহগনি, ইউক্যালিপ্টাস, রেইনট্রি, একাশিয়া, শিশু ইত্যাদি। এসব গাছ আমাদের পরিবেশের জন‌্যে মারাত্মক ক্ষতিকর। দ্রুত বর্ধনশীল, লাভজনক, অল্প আয়াস ও অল্প জায়গায় বেশি রোপণযোগ্য ইত্যাদি বিবিধ বিভ্রান্তিকর প্রচারণা এবং প্ররোচনায় আমরা এসব বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে আমাদের পরিবেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছি। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অতি উর্বর মাটিকে আমরা ইউক্যালিপ্টাসের মাধ্যমে মুড়িয়ে দিয়েছি। ইউক্যালিপ্টাস অতিমাত্রায় পানি শোষণকারী একটি গাছ, যেটি কোনো কোনো এলাকার মরুকরণের জন‌্যে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। এর পাতা, এর গঠন পাখি-পতঙ্গ, মানুষ-প্রাণিকুল কারো জন‌্যেই বিশেষ কিছু রাখে না আমাদের পরিবেশে। ফুল-ফল তো নেই-ই, আছে কাঠ, তা-ও আবার নিম্ন মানের। অথচ উত্তরাঞ্চল আমাদের আম-জাম-লিচুসহ সকল ফলের প্রধান যোগানদাতা। উত্তরাঞ্চলের মাটিকে অনুর্বর করে দেয়ার যে-ষড়যন্ত্র, সেটি এখনো চলমান আছে। দেশের অধিকাংশ সরকারি নার্সারিতে ব্যাপকহারে উৎপাদিত হচ্ছে এসব ক্ষতিকর গাছের চারা, যা স্বল্পমূল্যে অথবা বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে বিভিন্ন বৃক্ষরোপণ অভিযানে পরিবেশ বাঁচানোর নামে! আমাদের পরিবেশবিদগণ, পরিবেশ রক্ষাকারীগণ মহাউৎসাহে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশ ধ্বংসে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন ক্রমাগত।

উত্তরাঞ্চলকে ধ্বংস করা হচ্ছে ইউক্যালিপ্টাস রোপণের মাধ্যমে, আর মধ্যাঞ্চলে ব্যাপকভাবে রোপিত হচ্ছে রাক্ষুসে বৃক্ষ রেইনট্রি। রেইনট্রি অন্তত দশ থেকে পনেরোটি দেশীয় প্রজাতির জায়গা দখল করে সগর্বে বিস্তার করে তার ডালপালা। নিম্ন মানের কাঠসহ ক্ষতিকর পাতা ঝরানোর মাধ্যমে রেইনট্রি ক্রমাগত কমিয়ে দিচ্ছে আমাদের ফসল ও মাছের উৎপাদন। আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টি সহজেই আমরা অনুধাবন করতে পারি না। কারণ, আমরা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন‌্যে অতিরিক্ত সার-কীটনাশক প্রয়োগ করে উৎপাদন ঠিক রাখছি, পাশাপাশি মাছের জন‌্যেও লাগছে অতিরিক্ত খাবার। পশুখাদ্য, মানুষের পুষ্টি চাহিদা আর পাখির খাবার বা বাসস্থানের বালাই নেই। সার-কীটনাশকে ফসল ও বিভিন্ন বর্জ্যে মাছ ও মুরগী পালনের মাধ্যমে নিজেদের জন‌্যে তৈরি করছি বিষাক্ত খাবার। আমাদের দেশে ইতোমধ্যেই ক্যান্সার প্রায় মহামারি আকার ধারণ করেছে এসব বিষাক্ত খাবারের প্রতিক্রিয়ায়। অথচ রেইনট্রির বদলে দেশীয় ফলের গাছ পুরো চিত্রটাই উল্টে দিতে পারে। কিন্তু সেটি সম্ভব হচ্ছে না, কারণ, আমরা অগ্রপশ্চাদ বিবেচনা না করেই বৃক্ষরোপণ করে পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করছি।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে মেহগনির। প্রায় প্রত্যেক সরকারি-বেসরকারি নার্সারিতে কোটি কোটি মেহগনির চারা রোপিত হবার অপেক্ষায় থাকে প্রতিবছর। যদিও এই গাছগুলো সারাদেশেই সহজলভ্য, কিন্তু অঞ্চলভেদে কোনো কোনো প্রজাতির রাজত্ব লক্ষ্য করা যায়। মেহগনির বিষাক্ত ফল ও পাতা আমাদের পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান ব্যাপকভাবে ধ্বংসের জন‌্যে প্রধানত দায়ী। আমরা সরলমনে বৃক্ষরোপণের উৎসাহে, পরিবেশের প্রতি ভালোবাসায় এই বৃক্ষগুলো রোপণ করলেও এসব প্রজাতির বৃক্ষ রোপণের পরামর্শদাতারা আমাদের মতোই সরলমনে এদেরকে এই উর্বর ভূমিতে পুনর্বাসিত করেনি। তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশই এসব প্রজাতি নির্বাচন। বাংলাদেশ বন বিভাগের নার্সারিগুলো সাধারণত ফলের চারা উৎপাদন করে না (স্বল্প পরিমাণে ব্যতিক্রম আছে)। বন বিভাগের জনপ্রিয় ধারণাগুলোর একটি হলো সামাজিক বনায়ন। আমাদের বক্তব্য হলো, সমাজকে বন বানিয়ে দয়া করে আমাদের পশু বানাবেন না। বন বনেই থাকুক, সমাজের বন হয়ে ওঠা আর সমাজের মানুষের পশু হয়ে ওঠার মধ‌্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। আমরা বৃক্ষকে যখন শুধুই টাকা উপার্জনের উৎস হিসেবে বিবেচনা করতে শিখি, তখন আমাদের মনুষ্যত্বকে ছাপিয়ে পশুত্বই জোরালো হয়ে ওঠে। বৃক্ষ কেবলি টাকার উৎস নয়, প্রকৃতি শুধুই আমাদের স্বার্থ পূরণের উপায় নয়। কিন্তু যখনই একান্ত ব্যক্তিগত বিবেচনায় একটি কাঠের গাছ লাগানো হয়, মানুষ পশুত্বের দিকে একধাপ এগিয়ে যায়। কেননা, সেখানে ঐ-ব্যক্তির স্বার্থের বাইরে সমাজে বসবাসকারী অন্য কারো জন‌্যে আর কিছুই থাকে না। ফলের গাছে যেমন মানুষ-পশু-পাখি সবার জন‌্যে অল্প পরিমাণে হলেও খাদ্য-আশ্রয়-বাসস্থানের ব্যবস্থা থাকে, কাঠের গাছের চরিত্র এর বিপরীত। মানুষকে পশু বানানোর একটি সুদূরপ্রসারী প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে সামাজিক বনায়ন এবং সর্বত্র কাঠের গাছ রোপণের মাধ্যমে।

আমাদের অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনাহীন বৃক্ষপ্রেম পরিবেশ বিপর্যয়ের জন‌্যে প্রধানত দায়ী। সরকারি মহল থেকে এর সরাসরি উৎসাহ যোগানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষ ভালো বিবেচনায় এসব প্ররোচনায় একপ্রকার ফাঁদেই পা দিচ্ছে বলা যায়। সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে আমরা কথা বলে জেনেছি, তাদেরও বিশেষ কোনো ভাবনা নেই এসব বিষয়ে। অনেকটাই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলছে আমাদের পরিবেশ সুরক্ষার আন্দোলন। প্রতিটি বৃক্ষের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য আছে, যার সাথে সংশ্লিষ্ট বাস্তুসংস্থানের সম্পর্ককে বিবেচনায় না নিলে উপকারের বদলে সেটি ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে এর ভয়াবহ প্রভাব আমরা নানাভাবেই দেখতে পাই। প্রতিবছর ঝড়ের কবলে পড়ে হাজার হাজার পাখি মারা যাচ্ছে। কারণ, এসব বৃক্ষ পাখির আশ্রয় হিসেবে উপযোগী নয়। আমাদের সাতচল্লিশ (৪৭) শতাংশ মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। কারণ, মূল খাবারের সাথে দেশীয় ফলের যোগান পর্যাপ্ত নয়। দেশে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার বিদেশি ফল আমদানির মাধ্যমে দেশের একটি বিরাট আকারের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত পশুখাদ্যের অভাবও পূরণ করতে হচ্ছে আমদানির মাধ্যমে। নিজেদের গাছের ফল আত্মীয়-প্রতিবেশিকে দেয়ার মাধ্যমে যে-হৃদ্যতার সংস্কৃতি ছিলো, তা-ও বিলুপ্তির পথে শুধুমাত্র কাঠের গাছ রোপণের ব্যাপকতার কারণে। এভাবে মেহগনি-ইউক্যালিপ্টাস-রেইনট্রি-শিশু-একাশিয়া রোপণের মাধ্যমে শুধু পরিবেশ নয়, আমরা সারা দেশের বাস্তু-ভবিষ্যত, অর্থ-পুষ্টি, মনন-মায়া সমস্ত কিছু ধ্বংসের আয়োজনে অতি উৎসাহের সাথে অংশগ্রহণ করে চলেছি। তাই আবারো বলছি, আপনারা দয়া করে বৃক্ষরোপণ বন্ধ করুন। নিজ হাতে পরিবেশ-প্রকৃতির, মানুষের, দেশের ক্ষতি করবেন না।


দ্রাবিড় সৈকত
সহকারি অধ‌্যাপক, চারুকলা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ‌্যালয়

চিরচেনা দুর্জন আলী

লোকসংগীতের দেশ আমাদের এই জন্মভূমি। গাজীর পট এদের মধ্যে অন্যতম। আর এই গাজীর পটের অন্যতম বাদক ও গায়েন আমাদের নরসিংদীর হাজীপুর গ্রামের দুর্জন আলী। একজন নরসিংদীবাসী হিসেবে তিনি আমাদের করেছেন সম্মানিত। কিন্তু আমরা কয়জনইবা তাঁর সম্পর্কে জানি? ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি নীরবে চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। আজো অনেককিছুই মনে পড়ে তাঁকে নিয়ে।

উপন্যাসের মতো হাড়িধোয়া নদীর তীরে হাজীপুর গ্রাম। প্রধান সড়ক বলতে মাটির উপর ইটের বুনন। বাড়িগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলাশয় আর খোলা মাঠ দ্বারা আবৃত। রাস্তার ধারে ধারে নাম না জানা হরেক রকমের ছোটো ছোটো গাছপালা। গ্রীষ্মকালের রোদে চারদিকে যখন অস্বস্তি আর ক্লান্তির ছাপ, তখন সবার কাছে এক প্রশান্তির নাম ছিলো দুর্জন আলী ও তাঁর গাজীর পট। দুর্জন আলী ছিলেন এমনি একজন, যিনি মানুষের মাঝে আনন্দ বিলাতেন গাজীর পটের মাধ্যমে। যখনই কোনো বাড়িতে তাঁর আগমন ঘটতো, ঘরের গৃহিণীরা জমায়েত হতো বাড়ির উঠোনে। আর বাড়ির ছেলেমেয়েরা ছুটে আসতো মাঠ থেকে, রাস্তা থেকে। সেসব দুরন্ত ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমিও ছিলাম। এতোটাই আকর্ষণীয় ছিলো তাঁর পরিবেশনা যে, ছেলেমেয়েরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতো তাঁর গীত। কেউ কেউ চেষ্টা করতো তাঁর গাওয়া কয়েকটা লাইন মুখস্থ করে নিতে। এ যেনো ছিলো ছেলেমেয়েদের মনের আনন্দ। বিনিময়ে দুর্জন আলী পেতো প্রতিঘর থেকে একমুঠো করে চাল।

দুর্জন আলী ছিলেন একাকি মানুষ। অবিবাহিত হওয়ায় তাঁর ভাই কোনাই মিয়া, ভ্রাতুষ্পুত্র ও তাদের সন্ততিরাই ছিলো তাঁর আপনজন। তাদের ঘিরেই ছিলো তাঁর সংসার। সারা বছরের উপার্জনের জন্যে কখনো মজুরি খাটতেন, কখনোবা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাতা মেরামতের কাজ করতেন। করতেন কাঠমিস্ত্রীর কাজও। মৃত্যুর আগে তাঁর বয়স হয়েছিলো প্রায় চুরানব্বই (৯৪), কিন্তু ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। শেষ বয়সেও তাঁকে দেখতাম ফুটপাতে বসে ছাতা মেরামতের কাজ করছেন। সমগ্র জীবন কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করতে হয়েছে তাঁকে। অথচ এই দুর্জন আলীই ১৯৯৯ সালে ব্রিটেনে ‘বাংলাদেশ উৎসব’-এ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ২০১৫ সালে ‘ব্রহ্মপুত্র’ পত্রিকার জন্যে তাঁর সাক্ষাতকার নিতে গিয়ে ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের নামাঙ্কিত সার্টিফিকেট দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার।

সময়ের সাথে সাথে দুর্জন আলীর বয়স বাড়ে, বয়স বাড়ে হাজীপুরেরও। শেষ সময়ে তাঁকে দেখতাম বাজারের চায়ের স্টলে। একাকি। তাঁর পরনে থাকতো জীর্ণ কাপড়। অবশেষে ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি সবার অলক্ষ্যে নীরবে চলে গেলেন গাজীর পটের শেষ সূর্য দুর্জন আলী।

দুর্জন আলীর প্রসঙ্গ এলেই আরো বহু স্মৃতি মনের গোপন কুঠুরি থেকে জেগে ওঠে। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে ‘ব্রহ্মপুত্র | নরসিংদী জেলার মুখপত্র’ দুর্জন আলীকে প্রচ্ছদকাহিনি করে সংখ্যা প্রকাশ করে। সেই সংখ্যায়ও লিখেছিলাম আমার শৈশবের নির্মল আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ দুর্জন আলীকে নিয়ে। ‘একজন প্রকৃত শিল্পীর সান্নিধ্যে’ শিরোনামের সেই লেখাটি আবারো পাঠকের সামনে নিয়ে আসা খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলেই মনে করি।

________________________
একজন প্রকৃত শিল্পীর সান্নিধ্যে
ব্রহ্মপুত্র, প্রথম বর্ষ একাদশ সংখ্যা (০১ আগস্ট ২০১৫) থেকে

গাজীর পটের অন্যতম কুশীলব নরসিংদীর গায়েন দুর্জন আলীর বাড়ি হাজীপুর গ্রামের যে-পাড়ায়, সেখানে গিয়ে মন আর যেতে চাইছিলো না। মূল এলাকা থেকে যেনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ; নোংরা জল আর থিকথিকে কাদায় পূর্ণ বাড়িতে যাবার মূল রাস্তা। ‘মূল রাস্তা’ বলে আসলে কিছু নেইও। ঢাকা শহরের বস্তির চেয়েও ঘনবসতিপূর্ণ কয়েকটি টিনের চৌচালা ঘরের কোন দিক দিয়ে যাওয়া যাবে, তা ঠাহর করতে লেগে গেলো আধা ঘণ্টা। তারপর আছে প্রায় হাঁটুসমান নোংরা পানি পেরোনোর ধকল। তবু যাওয়া হলো। আমরা তিনজন। আমাদের পথ দেখিয়ে চলেছেন এলাকার প্রবীণ, মহৎ, আন্তরিকতাপূর্ণ একজন মানুষ। নাম নিরঞ্জন বাবু।

দুর্জন আলী বাড়ি নেই। অগত্যা ঘরে বসে অপেক্ষা করতে হলো। অপেক্ষা করতে করতে কথা হচ্ছিলো তাঁর ভাতিজার বউয়ের সাথে। তিনি আমাদের আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। ঘরের পুরো অংশে দরিদ্রতার ছাপ সুস্পষ্ট। কিন্তু এই মহিলার হাসি ও কথায় কোনো দরিদ্রতার চিহ্ন ছিলো না।

গেয়ে শোনাচ্ছেন দুর্জন আলী

…অবশেষে দুর্জন আলী এলেন। আমাদের চক্ষু সার্থক হলো। খর্বাকৃতির হালকা-পাতলা গড়নের এক বৃদ্ধ। তবে চেহারায় মনীষীদের ছাপ। এক দেখায়ই ভালো লাগলো। দুর্জন আলী যে-ঘরটাতে থাকেন, সেটা কতোটা করুণাঘন, না দেখলে বোঝার উপায় নেই। কিন্তু মুখে তাঁর পরম তৃপ্তির হাসি। আমাদের দেখে খুব খুশি। কিছুটা গেয়ে শোনালেন। ইংল্যান্ড ভ্রমণের বর্ণনা দিতে দিতে সার্টিফিকেট খোঁজাখুঁজি করছেন আর বলে চলেছেন তাঁর প্রাজ্ঞতাপূর্ণ কথাবার্তা। কথোপকথনের এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “গাজীর গান কেনো গান! কী আছে এই গানে!” বললেন, “এটা গাইলে সুখ আসে মনে। জ্ঞান পাওয়া যায়।” এরচে’ বড়ো মহৎ কথা আর কী হতে পারে! নিজের মতো এই যে আত্মসুখ লাভ, এরচে’ মহৎ শিল্পী আর কে হতে পারে!

আমরা জিজ্ঞেস করি তার বর্তমান দুরবস্থা নিয়ে, কিন্তু এই বৃদ্ধ-তরুণ মহান শিল্পী এসব কথার ধারে-কাছেও গেলেন না। তিনি কেবল তার গাজী-কালু, পট ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে উৎসাহী। আর তাঁর মুখে লেগে আছে পরিতৃপ্তির হাসি।

দুর্জন আলীর জীর্ণ কুটির

 

তাঁর ভাতিজা ফজল মিয়া এলেন। তিনি বের করলেন শম্ভু আচার্য’র আঁকা পটচিত্র এবং শোনাতে লাগলেন আমাদের, চিত্র ধরে ধরে কাহিনি-গান। আমাদের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বারবার আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে দিতে লাগলো। ফজল মিয়া গ্রামে ঘুরে ঘুরে ভাঙা ছাতা ঠিকঠাক করেন। ফজল মিয়া যখন গান শুরু করেন, তখন দুর্জন আলী নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি, তিনিও শুরু করলেন ভাতিজার সঙ্গে। শরীরে এখন আর আগের শক্তি নেই, বোঝা যায়। কিন্তু মনের এক অদম্য অফুরন্ত শক্তির বলে এখনো তারুণ্য ধরে রেখেছেন প্রায় শতবর্ষী এক মহান গায়েন দুর্জন আলী।

আমরা ফিরে আসছি আবার সেই নোংরা কাদাপানি পেরিয়ে। কিছুটা এসে পেছন ফিরে দেখি দুর্জন আলী হাঁটুকাদা পেরিয়ে আমাদের পেছন পেছন আসছেন। উদ্দেশ্য, আমাদের দোকানে বসিয়ে চা-বিস্কিট খাওয়াবেন। আমরা ভাবি, ৬০/৭০ বৎসর ধরে এই অঞ্চলে এক ঐতিহ্য ধরে রাখা এই জীবন্ত কিংবদন্তীকে সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা তথাকথিত শিক্ষিত-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা কী দিয়েছি? একটা ভালোমতো থাকার ঘর নেই, চরম দীন-দরিদ্র অখ্যাত এক পাড়ায় বসে বসে হৃদয়ের ভেতর এই পরম সৌন্দর্য কীভাবে ধরে রাখেন এই বৃদ্ধ? তিনি এখনো কেবল দিতে চান। প্রাপ্তির খেদহীন এই শিল্পীর কাছে শেখার আছে অনেক কিছু।

বাউল ধর্ম ও নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী বাউল মেলা

0

সূর্য উঠার পর থেকেই মেঘনার পার ঘেষে পুঞ্জিভূত হতে থাকে মানুষের সারি। গন্তব্য বাউল বাড়ির ঘাট। যদিও বাঁধানো ঘাট বলতে তেমন কিছু নেই, তবে নির্দেশক আছে। বাড়ির দখিনের ফটক বরাবর চলছে পুণ্যস্নান। স্নান শেষে পুণ্যার্থীরা একে একে প্রবেশ করতে থাকে বাড়ির ভেতরের দিকে। দ্বিতল ভবনটি পার হয়ে গেলেই মূল আখড়াবাড়ি। সামনের দিকে ঘিয়ের প্রদীপ, মোম, ধূপবাতির দোকান। একদম উত্তরের আরাধনা কক্ষের সামনের প্রাচীরে পুণ্যার্থীরা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিচ্ছেন, দরোজার সামনে ছিটিয়ে দিচ্ছেন বাতাসা। ধূপের গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে আসে। উলুধ্বনি, প্রার্থনা চলছে। আরাধনা কক্ষের ভেতর যজ্ঞের আগুন জ্বালানোর জন্যে ঘি ঢালা হচ্ছে। সার্বিক নির্দেশনার দায়িত্ব পিন্টু বাউলের হাতে, তিনি এই আখড়া বাড়ির সেবায়েত।

আখড়াবাড়ির ঠিক মাঝখানটাতে বৈঠকের ছাউনি। দেশ দেশের বাইরের নানা প্রান্ত থেকে আসা বাউল পুণ্যার্থীরা সর্পিল হয়ে বসেছেন। থেমে থেমে চলছে গান, গানের ফাঁকে ভাববর্ণনা। সব মিলিয়ে নরসিংদীর মতো একটা কর্মব্যস্ত মফস্বলের ভেতর এক ভিন্নরকম দৃশ্য। বাড়ির প্রাচীরের ঠিক বাইরেই বিশাল এলাকা জুড়ে মনোহর পসরা। মুখরোচক খাবারের দোকান, জুয়েলারিকসমেটিকস, খেলনার দোকান, ক্রোকারিজ, মাটি কাঠের তৈজসপত্রসব মিলিয়ে এলাহি ব্যাপার। ড্যাবের ঢোল, জিলাপি, পিস্তল, কাঠের ঘোড়াএক লহমায় শৈশবে ফিরে যাওয়া যায়।

বলছিলাম নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী বাউল মেলার কথা। প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমার তিথিতে বাউল ঠাকুরের স্মরণে এই মেলার আয়োজন করা হয়। মূলত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বাউল পুণ্যার্থীদের মিলন উৎসব। বলা হয়ে থাকে, এই মাঘী পূর্ণিমার তিথিতে বাউল ঠাকুর দেহ ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু ঠিকঠাক তাঁর সময়কাল, নাম, পরিচয় এখন আর কিছুই জানা যায় না। তিনিবাউল ঠাকুরনামেই পরিচিত। অবশ্য কোনো লিপিবদ্ধ তথ্যাদি বা ঐতিহাসিক প্রমাণ না থাকার কারণ বাউল ঠাকুরেরই কিছু শর্ত। তিনি লিপিবদ্ধ করাকে জড়গুরুত্বহীন কাজ বলে মনে করতেন। যদি শিক্ষা সাধনাকে নিজের অন্তরাত্মায় ধারণ করা না যায়, তাহলে পুঁথিগত সকল ব্যাপারই অর্থহীন। ঠাকুরের সহস্রাধিক ভাবসঙ্গীত রয়েছে, যা সেই পাঁচ শতাধিক বছর ধরে শুধু মৌখিকভাবে অনুশীলন উচ্চারিত হয়ে আসছে এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের মুখে।

এই উৎসবেরই একজন পুণ্যার্থী শংকরলাল পোদ্দারের কাছে আমরা জানতে চেয়েছিলাম এখানকার বাউল মেলা বাউল ঠাকুরের আগমনের ইতিহাস। তার ভাষ্য এই যে, “বাউল ঠাকুরের দেহ যেস্থানে সমাহিত করা হয়েছে (উত্তরের আরাধনা কক্ষের অভ্যন্তরে), সেখানে একটি ফলক রয়েছে। ফলকে ৯৩৪ বাংলা সনের উল্লেখ রয়েছে। তবে বাউল ঠাকুরের ইতিহাস জানার চেবেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো তাঁর দর্শন শিক্ষাকে ধারণ করতে পারা, তাই নিয়ে বোঝাপড়ার খুব একটা প্রয়োজন নেই। বাউল ঠাকুরের দর্শনভাবের বোঝাপড়া, তাঁর শিক্ষাকে ধারণ করাটাই মূলকথা।সেই জায়গা থেকে এই আখড়াবাড়ি বরাবরই প্রচারবিমুখ। কোনোরকম প্রচারণা ছাড়াই প্রতি বছর ঠাকুরের তিরোধান দিবসে হাজার হাজার পুণ্যার্থী এখানে অংশগ্রহণ করেন, আত্মশুদ্ধি লাভের জন্যে প্রার্থনা করেন। নরসিংদীর বাউলপাড়ার এই বাউল মেলাটি ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে, তা বহু খোঁজখবর করেও জানা যায়নি।

এসব বিষয়আশয় নিয়ে কথা হলো একজন প্রবীণ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের সাথে, যিনি পরলোকগত মণীন্দ্র বাউলের সাথে দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন। মণীন্দ্র বাউলও পেশায় খুব জনপ্রিয় একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ছিলেন এবং দীর্ঘ সময় এই আখড়াবাড়ির সেবায়েত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর সাহচর্যে থাকায় বাউলবাড়িতে দীর্ঘ সময়ের আসাযাওয়ায় অনেক অভ্যন্তরীণ তথ্য জানা থাকার কথা। যদিও তিনি সাক্ষাতকার এবং নাম প্রকাশে অনীহা প্রকাশ করেছেন। তবে আলাপচারিতায় কিছু তথ্য উঠে আসে। তার ভাষ্য অনুসারে, বাউল ঠাকুরের সময়কালটি ভারতবর্ষে মুঘল শাসনামলের, সম্রাট আকবরের সময়ের। আকবরের রাষ্ট্রনীতির সাথে বিরোধের জেরে বাউল ঠাকুর স্বেচ্ছায় নির্বাসন নেন এবং এখানে এসে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োজিত হন। বোধিলাভের পর তাঁর দর্শন প্রচার শুরু করেন। এর আগে তিনি ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু এখানে এসে বাউল ধর্ম প্রচারের সময়রামদাস বাউলনাম ধারণ করেন। তাঁর কোনো সন্তান ছিলো না। এমনকি পূর্ব জীবনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এখন যারা বাউলবাড়ির সদস্য, তারা সময় আখড়াবাড়িতে নিযুক্ত খাদেমদেরই উত্তরসুরী। উন্মুক্ত কোনো নথি না থাকলেও বাউল বাড়িতে কিছু গোপনীয় নথি থাকার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত।

এই প্রবীণ চিকিৎসকের তথ্যের একটা বড়ো ঐতিহাসিক দুর্বলতা এই যে, খুব বেশি কিছু জানা না গেলেও এর আগে আখড়াবাড়ির সেবায়েত যারা ছিলেন, ব্রিটিশ শাসনামল থেকে তাদের নামের তালিকাটি পাওয়া যায়। সেই সূত্রে ব্রিটিশ শাসনামলে (কোনোএক পর্যায়ে) এই আখড়াবাড়ির সেবায়েত ছিলেন স্বর্গীয় নদীরাম বাউল। পরবর্তীতে তাঁর নাতি মণীন্দ্র চন্দ্র বাউল বর্তমানে তাঁর ছেলে সাধন চন্দ্র বাউল, মৃদুল বাউল মিন্টু, শীর্ষেন্দু বাউল পিন্টু, মলয় বাউল রিন্টু এবং প্রাণেশ কুমার বাউল ঝন্টু। প্রাণেশ কুমার বাউল ঝন্টুর মৃত্যুর পর মৃদুল বাউল মিন্টু এবং বছর শীর্ষেন্দু বাউল পিন্টু সেবায়েত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এখন নদীরাম বাউল, যার তথ্য ব্রিটিশ শাসনামলে প্রথম সেবায়েত হিসেবে উল্লেখ করা হয়, তাঁর আরেক নাম রামদাস বাউল। এই জায়গায় এসে বাউল ঠাকুরের নাম সংক্রান্ত যেদাবি প্রবীণ চিকিৎসক করেছিলেন, তা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। আবার সম্ভব যে, একই নামের পুনরাবৃত্তি হয়েছে এবং বাউলদের মধ্যে ধরনের নাম ধারণের ঝোঁক এর আগেও দেখা গিয়েছে।

যাই হোক, এখানকার আগত পুণ্যার্থী, সেবায়েত সকলেই বাউল ধর্মের শিক্ষা, বাউল ঠাকুরের প্রতি ভক্তি ইত্যাদি প্রধান বিষয়বস্তু প্রচার ধারণ করার পক্ষপাতী। বিষয়ে কথা হলো এই বাড়িরই বধূ মীনাক্ষি বাউলের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় বাউল ঠাকুরের ভাবের বিষয়টি পুরো ধরা পড়ে।

প্রতিষ্ঠিত মত অনুসারে, বাউলদের উদ্ভব বিকাশের সাথে অঞ্চলে ইসলামের প্রসারের সংযোগ রয়েছে। ইসলামের বিস্তারের সময় এই অঞ্চলে পারস্যের সুফিধারার আগমন ঘটে। যখন সুফিমত অঞ্চলে প্রবেশ করে, তখন এখানকার স্থানিক আধ্যাত্মিকতা সাধনপদ্ধতির সাথে মিথস্ক্রিয়ায় একটি লোকধর্মের রূপ লাভ করে। এবং যেহেতু এই অঞ্চলের মানুষ এর আগেই বৌদ্ধ সহজিয়াদের তন্ত্র আধ্যাত্মিক যোগ সাধনার সাথে পরিচিত ছিলো, তাই খুব সহজেই সুফিমতের সাথে স্থানীয় মানুষের সংযোগ স্থাপন সহজতর হয়। সামাজিক জাতবৈষম্যবিরোধীদেহাত্মবাদী দর্শন, তার সাথে সাংখ্য, তন্ত্র যোগ সাধনার সংযোগে বাউল ধর্মমত অঞ্চলের মানুষের মনে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়। সুফিবাদের সংস্পর্শে এসে বাউল, বৈষ্ণব ভাববাদ লোকায়ত ধারার বিস্তার ঘটে। বাউলদের বিস্তারের প্রাথমিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন হচ্ছেন আউল চাঁদ মাধব বিবি। তাঁদের প্রয়াসেই বাউলধারার প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে লালন সাঁই এই ধারায় গুরুত্বপূর্ণ অর্ন্তভুক্তি সাধন করেন।

তবে কি নরসিংদীর বাউল ঠাকুর তাঁদেরই চিন্তার উত্তরসুরী? এই জায়গাটিতে এসে আমাদের একটু থামতে হয়। কারণ, বাউল ঠাকুরের সাথে মাধব বিবি বা আউল চাঁদের যেসংযোগ, তারচেঅধিকতর সংশ্লিষ্টতা শ্রী চৈতন্য দেবের সাথে।

ব্রাহ্মণ্যশৈব বৌদ্ধ তান্ত্রিক সহজিয়ার সমবায়ে গড়ে ওঠেছে একটি মিশ্র মত। এর আধুনিক নাম নাথপন্থা।অমৃতকুণ্ডসম্ভবত এদেরই শাস্ত্র চর্যাগ্রন্থ। এটি গোরক্ষপন্থীর রচনা বলে অনুমিত হয়।
বামাচার নয়, কায়াসাধন তথা দেহতাত্ত্বিক সাধনই তাদের লক্ষ্য।হঠযোগের মাধ্যমেই সাধনা চলে। একসময় এই নাথপন্থা সহজিয়া মতের প্রাদুর্ভাব ছিলো বাঙলায়, চর্যাগীতি নাথসাহিত্য তার প্রমাণ। এই দুই সম্প্রদায়ের লোক পরে ইসলাম বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়।
             : ভূমিকা, বাঙলার সূফী সাহিত্য, . আহমদ শরীফ

আহমদ শরীফের এই মতকে আমলে নিলে ধরে নিতে হয় যে, বৈষ্ণববাদের উত্থানের পেছনে সুফিধারার কন্ট্রিবিউশন ছিলো। এই বৈষ্ণব ভাবধারার অন্যতম সংস্কারক হচ্ছেন শ্রী চৈতন্য। তিনি রূপক প্রেমভক্তিসাধনার সমন্বয়ে সনাতন ধর্মের নতুন এক চাঞ্চল্যকর ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন, যা জনমনে ব্যাপক বিস্তার প্রাধান্য লাভ করে। জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে নদীয়ায় এবং পরবর্তী সন্ন্যাসজীবনে ভারতের তীর্থস্থানগুলোতে ভ্রমণের পর দক্ষিণ ভারতের পুরীতে গিয়ে উপস্থিত হন।

পুরীতে অবস্থানকালে তাঁর কাছে অগণিত ভক্ত সমবেত হতেন। চৈতন্য দেবের মৃত্যু নিয়ে রয়েছে বড়ো এক রহস্য, অনেক কথাউপকথা। তবে কৃষ্ণদাস কবিরাজ কর্তৃক রচিতচৈতন্যচরিতামৃতঅনুসারে, চৈতন্য মহাপ্রভু একদিন বিকেলে পুরী জগন্নাথ মন্দিরের একটি উপমন্দির টোটা গোপীনাথ মন্দিরে প্রবেশ করেন। প্রবেশের পরপরই মন্দিরের দ্বার বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে আর কোনোদিন চৈতন্য মহাপ্রভুর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। দাবি করা হয় যে, মহাপ্রভু সেখানেই জগন্নাথ দেবের সাথে লীন হয়েছেন, তাঁর অন্তর্ধান ঘটেছে। এখন, বাউল ঠাকুরের আখড়াবাড়ির দাবি, শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুইবাউল ঠাকুর টোটা গোপীনাথ মন্দিরে অন্তর্ধানের পর তিনি এখানে বাউল ঠাকুর রূপে আবির্ভূত হন।

এখানকার বাউলেরা মূলত সনাতন ধর্মের অনুশাসনগুলোই অনুসরণ করেন। তবে ঈশ্বর সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তার জায়গাটিতে তাঁরা অদ্বৈতবাদী, সর্বেশ্বরবাদী। যেহেতু সবকিছুই ঈশ্বরের সৃষ্টি, তাই প্রতিটি প্রাণের মধ্যেই ঈশ্বর আছেন বলে তাঁদের বিশ্বাস। জীবনাচরণের ব্যাপারে তাঁরা খুব সচেতন। খাবারদাবারের ব্যাপারে বেশকিছু বাছবিচার রয়েছে। একদানা খাবারও যেন নষ্ট না হয়, তা কঠোরভাবে নির্দেশিত। মাংস না খেলেও মাছ (যেহেতু জলজাত, তাই) খান। দেহ মনের উপর খাবারের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে বলে বিশ্বাস করেন তাঁরা।

বাউল ঠাকুরের দর্শনও মূলত সাংখ্যতন্ত্রযোগ সাধনার উপরই প্রতিষ্ঠিত। মানবদেহের যেচালিকাশক্তি, সেখানেই পরমাত্মার অবস্থান, সেখানেই ঈশ্বর বিরাজমান। আর মানুষের মনই হচ্ছে জীবাত্মা। জাগতিক জীবনের মোহে পড়ে পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার ব্যাপক ব্যবধান তৈরি হয়। তখনই মানুষ রিপুর বশবর্তী হয়। অপরাধে লিপ্ত হয়। তাই জাগতিক যতো অসামঞ্জস্যতা, যতো ধরনের বিশৃঙ্খলা রয়েছে, বাউল ঠাকুর তাঁর সমাধান খুঁজেছেন দেহের অভ্যন্তরে। নিজের মধ্যেকার যেই কামক্রোধহিংসালোভ, তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেই কেবল জীবাত্মা পরমাত্মার মিলন ঘটানো সম্ভব। সম্ভব প্রকৃত অর্থেমানুষ’- উন্নীত হওয়া। আর এজন্যেই প্রয়োজন দেহসাধনা। জগতের সবকিছুর প্রতিরূপ মানুষের নিজের মধ্যেই রয়েছে। এখানেই দেশকালপাত্র, এখানেই মন্দিরকাবা। একটি গানের কথা অনেকটা এমন

এই দেহভাণ্ডে আছে, ব্রহ্মাণ্ডে নাই,
দেহের বিচার করতে হইলো, নইলে মানুষ হারাই
(দেহের উপযুক্ত সাধনা করতে না পারলে মনুষ্যজন্ম হারাতে হবে, দেহ সাধনা না করলে তো আর দেহের প্রয়োজন নাই। পরবর্তী জন্মে চুরাশি লক্ষ প্রজাতির কোনো একটিতে জন্মলাভ করতে হবে।)

ঠাকুরের সহস্রাধিক ভাবসঙ্গীত মূলত দেহ সাধনার মাধ্যমে নিজের অন্তরাত্মাকে পবিত্র বিশুদ্ধ করার প্রয়াসেই রচিত। বাড়ির সদস্যরা প্রতি বুধবার সন্ধ্যায় বৈঠকে পর্যায়ক্রমে সেগুলো পাঠ আলোচনা করেন। উন্মুক্ত বৈঠক হওয়ায় পুণ্যার্থীরাও যুক্ত হতে পারেন।

ধর্মমতে নারীকে খুব পবিত্র এবং অপেক্ষাকৃত শ্রেষ্ঠতম হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়। বলা হয়ে থাকে, নারীই সৃষ্টির মূল। মাতৃগর্ভকে বিশেষ প্রতীকী অর্থেও ব্যবহার করা হয়। নারী পুরুষ দুজনের মধ্যেই ছয়টি রিপু তথা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ মাৎসর্য বিদ্যমান। তবে নারী আরো অতিরিক্ত তিনটি রিপুর অধিকারী : মায়া, জঠর (গর্ভ) ধৈর্য। বাউলমতে, পুরুষের জন্যে ঈশ্বরের আরাধনা আরো কঠিন এই কারণেই যে, তাকে ছয়টি রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং নারী যে অতিরিক্ত রিপুর অধিকারী, তা পুরুষকে মনে ধারণ করতে হয়, আয়ত্ত করতে হয়। কারণ, মাতৃমনন ছাড়া ঈশ্বরের সাধনা সম্ভব নয়, নিজের দেহের ভেতরে অন্তর্দৃষ্টি রাখা সম্ভব নয়। এই কারণেই বাউলদের মধ্যে নারীর মতো করে দীর্ঘ চুল রাখার একটি প্রচলন রয়েছে।

খুব চমৎকার নিয়মানুবর্তিতা শৃঙ্খলার মধ্যে জীবনযাপন করেন তাঁরা। জীবনযাপনে রয়েছে চিহ্ন প্রতীকের ব্যবহার। তন্ত্র যোগ সাধনা যাপনের বড়ো একটা স্থান দখল করে আছে। এমনকি, যদি যজ্ঞের আগুনের কথাই ধরিসাধারণ ব্রাহ্মণের যজ্ঞে দেখা যায়, মাটির উপর উঁচু করে কাঠ অন্যান্য রসদে আগুন জ্বালানো হয়। কিন্তু বাউল ঠাকুরের তিরোধান উৎসবের মহাযজ্ঞে আগুনের জায়গা তৈরি করা হয়েছে মাটি খুঁড়ে, ভেতরের দিকে। এই যজ্ঞের আগুনের জন্যে সচেতনভাবে মাটি খুঁড়ে তৈরি যেগর্ত, তা সম্পূর্ণই মাতৃগর্ভের প্রতীক। এইরূপ অসংখ্য প্রতীকের ব্যবহার রয়েছে পুরো আখড়াবাড়ি তাঁদের জীবনযাপন জুড়ে।

বাউল ঠাকুর তাঁর ধর্মমত ইতিহাসের এক অনালোচিত অধ্যায়। এই ব্যাপারে বাইরের জগতের জানাশোনা খুব সামান্যই। অবশ্য আগেই বলেছি, এর একটি বড়ো কারণ হচ্ছে লিখিত কোনো দালিলিক নথি না থাকা বা না রাখা। তবে যাই হোক, সার্বিক বিচারে ইতিহাসের একটি দুর্গম সময়ে, যখন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জাতবৈষম্য তুঙ্গে, তখন বাউল ঠাকুর সমতা, অসাম্প্রদায়িকতা জাতবৈষম্যহীন সমাজের শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন, যা এখনো প্রাসঙ্গিক।

নরসিংদীর লোকউৎসব ও লোকমেলা

ওরস
নরসিংদী জেলাধীন নরসিংদী সদর উপজেলার কাবুল শা’ (রা.)-এর মাজার, বেলাব উপজেলার আমলাব বাজারে হজরত শাহ আলী শাহ (রা.)-এর মাজার, ভাটেরচর দক্ষিণপাড়া ভূঁইয়া শাহ বাড়ির দরবার শরীফ মাজার, শিবপুর উপজেলার কুমরাদী গ্রামের শাহ মনসুরের মাজারে বছরের বিভিন্ন সময় ওরস অনুষ্ঠিত হয়। ওরস উপলক্ষে স্থানীয়সহ বিভিন্ন এলাকার মানুষের সমাগম হয়।

হযরত মাওলানা কাবুল শা’ (রা.)-এর মাজারের ওরস
প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের ১২ তারিখে কাবুল শা’ মাজারে ওরস অনুষ্ঠিত হয়। দেড়শো বছর আগে নরসিংদী পৌরসভার তরোয়ায় হযরত মাওলানা কাবুল শা’ (রা.)-এর মাজারের এই স্থানটি জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিলো। জঙ্গলের ভেতর এই রওজা অর্থাৎ মাজার পাওয়া যায়। আজ থেকে ১৭ বছর আগে এই মাজারের ভবনের পিলার তৈরি করার সময় মাটির নিচে ইটের দেয়াল পাওয়া যায়।

হযরত মাওলানা কাবুল শা (রা.)-এর মাজারের খাদেম মো. হারুন-অর-রশীদ খান বলেন, “আমার দাদা হাজী সামাদ খান বিয়াল্লিশ বছর এই মাজারের খাদেমগিরি করেন। এরপর আমার বাবা মেহের খান পঁচিশ বছর এবং আমি আটত্রিশ বছর যাবত এই মাজারের খাদেমগিরি করছি। প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মাজারে মিলাদ মাহফিল এবং জিকির হয়। প্রতিদিন মানত পূর্ণ হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১২-১৪ জন তোবারক নিয়ে আসেন। তোবারক খিচুড়ি-বিরিয়ানি আসে। দোয়া পড়ে তোবারক প্রথমে পশুপাখির জন্য মাজারের উঠানের এক কোণায় দেয়া হয়। এরপর মাজারে আগত ভক্তদের মধ্যে তোবারক বিতরণ করা হয়।”

কথিত আছে, মাজার আবিষ্কারের সময় থেকে দুটি পাথর ছিলো। পাথর দুটো চারকোণা আকৃতির। মাজারের পাশে পূর্ব দিকের চাকলার দীঘিতে পাথর দুটো নামতো। আবার দীঘি থেকে উপরে উঠে আসতো। পাথরের মাঝখানটা একটু ঢালু। মানুষ অজু করার জন্যে পাথরের ঢালু অংশে হাত দিলে পানি উঠতো। কেউ একজন একটি পাথরের এক কোণা ভেঙে ফেলে। দ্বিতীয় পাথরটি চাকলার দীঘিতে নেমে যায়। পাথরটি আর উপরে উঠে আসেনি। যে-পাথরটি নামেনি, সেটিতে পঞ্চাশ বছর যাবত আর পানি উঠে না।

মানুষ মূলত বিভিন্ন মানত নিয়ে এখানে আসে। বিভিন্ন এলাকার মানতকারীরা বৃহস্পতিবার হরদম মিষ্টান্ন, খিচুড়ি, বিরিয়ানির তবারক কাবুল শা’ (রা.)-এর মাজারে এনে দেয়। মানতকারীরা দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তবারক নিয়ে আসে। মাজার প্রাঙ্গণে প্রতিদিনই বিকালে প্লাস্টিকের কাগজ বিছিয়ে মারফতি-ফকিরি গানের আসর বসে। শ্রোতারা গায়কদের চারপাশ ঘিরে বসে-দাঁড়িয়ে আসর উপভোগ করেন। গায়কদের মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে মোরা গায়, অন্যরা ঘোসায় টান দেয়।

হজরত শাহ আলী শাহ (রা.)-এর মাজারের ওরস
হজরত শাহ আলী শাহ (রা.)-এর মাজারে বছরে একদিন ওরস করা হয়। তবে সময় নির্ধারিত নেই। জানা যায়, ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাগদাদ থেকে ৩৬০ জনের মধ্যে তিনজন আউলিয়া নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার আমলাব বাজারে এসে আস্তানা গাড়েন। এই তিনজন আউলিয়ার মধ্যে হজরত শাহ আলী শাহ (রা.), ওয়ালি শাহ এবং আরেকজন আউলিয়া (নাম জানা যায়নি) ছিলেন। তাঁদের এখানে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁদের সমাধিস্থলেই এ-মাজার গড়ে ওঠে।

সব বয়সি নারী-পুরুষ যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী মানত করেন। প্রতিদিনই সকাল-সন্ধ্যা মোমবাতি জ্বালিয়ে ভক্তরা যার যার বাসনা মানত করেন। মানত পূর্ণ হলে গরু, ছাগল, মুরগি দিয়ে তৈরি খিচুড়ি, বিরিয়ানি, সিন্নি দেয়। সন্ধ্যা ৭ টার পর মাজারের ফটক বন্ধ করে দেয়া হয়।

ভাটেরচর দক্ষিণপাড়া শাহ বাড়ির দরবার শরীফের ওরস
বেলাব উপজেলার ভাটেরচর গ্রামের দক্ষিণপাড়ায় শাহ বাড়ির দরবার শরীফে প্রতিবছর চৈত্র মাসের ২০ তারিখ ওরস অনুষ্ঠিত হয়। এই গ্রামের শাহ মোহাম্মদ শাহ সুফী আবু তালেব হোসেন চিশতিয়া এবং শাহ সুফী পীরে কামেল আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া চিশতিয়া— পিতা-পুত্র দুজনেই পীর ছিলেন। শাহ সুফী পীরে কামেল আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া চিশতিয়া ভৈরবের জগন্নাথপুরের পীর শাহ করিম শাহ সুফী আব্দুল করিম চিশতিয়ার মুরিদ হন। শাহ সুফী পীরে কামেল আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া চিশতিয়ার ছেলে শাহ মোহাম্মদ আবু কায়সার চিশতিয়া ১৯৯৩ সালে সিলেটের শায়েস্তাগঞ্জের ১২০ আউলিয়ার দরবারের মতুয়ালির শাহ সুফী শফিকুল হাসান চিশতিয়ার মুরিদ হন।

১৯৯০ সাল থেকে প্রতিবছর চৈত্র মাসের ২০ তারিখ (৩ এপ্রিল) ভাটেরচর দক্ষিণপাড়ার শাহ বাড়ি দরবার শরীফ মাজারে ওরস উদযাপিত হয়। দুইদিন ধরে সারা দিন-রাত ওরস চলে।

নরসিংদীর বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের রহিমাকান্দির শফিকের দল, ভাটেরচরের নওয়াব মিয়ার দল, মীর কাশেমের দল, সোহরাব হোসেনের দল, লক্ষ্মীপুরের আবু জাহেরের দল ওরসে বাউল গান, ফকিরি, মারফতি, নবীতত্তত্বের গান পরিবেশন করেন।

হাসান পাগলার মাজারের ওরস
ময়মনসিংহের নান্দাইল থেকে হাসান পাগলা সিলেটের পীর সিদ্দিক আলী মাওলানার সাথে নরসিংদীর বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের ভাটেরচর গ্রামে আসেন। পীর সিদ্দিক আলী হাসান ফকিরকে এ-গ্রামের বাসিন্দা গোলাপ মিয়ার কাছে রেখে যান। এখানে তিনি ফকিরি গান-বাজনা আর জিকির করতেন, মসজিদে আজান দিতেন। এলাকার মানুষের কাছে তিনি আধ্যাত্মিক ব্যক্তি হিসেবে সুপরিচিত হন। কারো কোনো রোগ-বালাই হলে তারা তার কাছে যেতেন। তিনি ফুঁ দিয়ে দিলে রোগমুক্তি ঘটতো। পঞ্চাশ বছর তিনি এই এলাকায় আউলিয়ার কাজ করেন। ১৯৯২ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। ভাটেরচর গ্রামেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। তার সমাধিস্থানে গড়ে ওঠে মাজার, যেখানে প্রতি বছর ওরস হয়।

পার্বণ
পার্বণ নিয়ে বাংলাদেশে একটি কথার প্রচলন রয়েছে। হিন্দুদের ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’। এখানে তেরো শব্দটি তেরো সংখ্যা অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। তেরো শব্দটি এখানে বহু অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রকৃত অর্থে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ সারা বছর জুড়ে অনেক ব্রত পার্বণের অনুষ্ঠান করে থাকে। এমন অনেক লৌকিক দেব-দেবীর পূজা বছরের নির্দিষ্ট দিন ছাড়াও প্রতি মাস এবং সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে করা হয়। মঙ্গলচণ্ডী পূজা সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার, লক্ষ্মী পূজা সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার এবং শনি পূজা সপ্তাহের প্রতি শনিবার বাড়ির উঠোনে বা বারান্দায় তুলসি গাছের তলায় করা হয়। নরসিংদী জেলায়ও এসব পূজার প্রচলন রয়েছে।

পদ্মপুরাণ
লোকায়ত দেবী পদ্মা বা মনসা বিষয়ক আখ্যানের পরিবেশনা ‘পদ্মপুরাণ’। সাধারণত বাংলা বছরের শ্রাবণ সংক্রান্তি অর্থাৎ শ্রাবণ মাস জুড়ে এই পুরাণ নরসিংদী অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে পরিবেশিত হয়ে থাকে। এ-ধরনের আখ্যান পরিবেশনার জন্যে সাধারণত বাড়ির উঠোন, ঘর, চতুর্দিকে খোলা নাটমন্দির অথবা মন্দির প্রাঙ্গণের খোলা স্থানে এ-গান পরিবেশন করা হয়। শ্রাবণ মাস জুড়ে বেলা তিনটার পর পদ্মপুরাণ পরিবেশন করা হয়। একটি জলচৌকির উপর পদ্মপুরাণ রাখা হয়। শ্রাবণ মাসের প্রতিদিন গানের সুরে একজন নারী পদ্মপুরাণ পরিবেশন করেন। তাকে ঘিরে বসে এলাকার অন্য নারী অর্থাৎ গৃহিণীরা। পদ্মপুরাণের সামনে একটি থালায় চিনি, বাতাসা আর একটি গ্লাসে জল রাখা হয়। অনেকে ফল-মিষ্টিও দিয়ে থাকে। আগরবাতি জ্বালানো হয়। যিনি ইচ্ছা করেন, তার ঘরেও পদ্মপুরাণ পড়া হয়। এভাবে কয়েক ঘর ঘুরেও পদ্মপুরাণ শেষ করা হয়। যারা এই আখ্যান শোনেন, তাদের সবার হাতে ফুল, দূর্বা থাকে।

বেলাব উপজেলার জাংগুয়া গ্রামে মনসা পূজার দিন পদ্মপুরাণের আখ্যান শেষ করা হয় না। মনসা মূর্তি অথবা অষ্টনাগ বিসর্জনের দিন পদ্মপুরাণের আখ্যান শেষ করা হয়।

মনসা পূজা
সর্পের দেবী মনসা। শ্রাবণ সংক্রান্তিতে শ্রী শ্রী মনসা দেবী ও অষ্টনাগ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পহেলা শ্রাবণ পদ্মপুরাণ পাঠ শুরু হয়, শেষ হয় পহেলা ভাদ্রে। মন্দির অথবা যে-বাড়িতে পদ্মপুরাণের আখ্যান পরিবেশন করা হয়, সেই বাড়িতে মনসা মূর্তি অথবা নাগ দিয়ে মনসা পূজা করা হয়।

নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলায় মনসা মূর্তি দিয়ে পূজা করা হয়। শাপলা ফুলের মালা গেঁথে মনসা মূর্তির গলায় পরিয়ে দেয়া হয়।

বেলাব উপজেলার জংগুয়া গ্রামের দেবনাথ সম্প্রদায় মনসার মূর্তি দিয়ে পূজা করে। পোড়ামাটির ঘটে সিঁদুরের ফোঁটা দেয়া পাঁচ পাতাবিশিষ্ট আম্রপল্লব রাখা হয়। ঘটের গায়ে পাঁচ ফোঁটা সিঁদুর দেয়া হয়। ঘটের উপর ফুল, বেলপাতা, ধান, দূর্বা, আস্ত নারকেল এবং গামছা রাখা হয়। নরসিংদী উপজেলার বৌয়াকুড় গ্রামে জেলে সম্প্রদায়ের লোকেরা মনসা মূর্তি দিয়ে পূজা করে।

বিশ্বকর্মা পূজা
শিল্পের প্রতিষ্ঠাতা দেবতা বিশ্বকর্মা। নরসিংদী জেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের কুমার-কামার, বণিক, তাঁতী, স্বর্ণকার শ্রেণির নর-নারীরা এই পূজা উদযাপন করে থাকেন। শিবপুর উপজেলার নর-নারীরা এই পূজা উদযাপন করে থাকেন বেশি। পঞ্জিকা মতে, বিশ্বকর্মা পূজা ষড়শীতি সংক্রান্তি অর্থাৎ ৩১ ভাদ্র অনুষ্ঠিত হয়। সমৃদ্ধির জন্যে এই পূজা করা হয়। এ-পূজা মূলত তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থানে করা হয়। সেখানে মাটির তৈরি এক থেকে দেড় ইঞ্চি লম্বা বিশ্বকর্মার মূর্তি অথবা বিশ্বকর্মার ছবি স্থাপন করা হয়। অবস্থাপন্ন বণিক, মৃৎশিল্পী এবং কর্মকাররা মূর্তি নিয়ে বিশ্বকর্মা পূজা করে থাকে। পূজার সময় ঢাক, ঢোল, কাঁসর, ঘণ্টা বাজানো হয়। নরসিংদী সদর উপজেলার বৌয়াকুড়ে বিশ্বকর্মা পূজা ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্রেই অনুষ্ঠিত হয়।

লক্ষ্মী পূজা
ধনের দেবী লক্ষ্মী। আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা অর্থাৎ পঞ্চমী তিথিতে লক্ষ্মী পূজা হয়। একে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজাও বলা হয়। দেবী দূর্গার বিসর্জনের পঞ্চম দিনে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। যদিও সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার এই পূজা প্রায় প্রত্যেক হিন্দু বাড়িতে করা হয়। নরসিংদী অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আশ্বিন মাসের পঞ্চমী তিথিতে লক্ষ্মী মূর্তি দিয়ে পূজার প্রচলন রয়েছে।

বেলাব উপজেলার জংগুয়া গ্রামে দেবনাথ সম্প্রদায়ের লোকেরা লক্ষ্মী পূজায় দুটি ডোল যাবার দেয়। ডোল যাবার দুটি কলাপাতার উপর বসানো হয়। একটিতে ধান, দ্বিতীয়টিতে সিদ্ধ চাল দেয়া হয়। এ-সম্প্রদায়ের লোকেরা লক্ষ্মীর মূর্তি নিয়ে পূজা করে। তবে পূজায় আল্পনা করে না।

শিবপুর উপজেলার যোশর গ্রামের পাল সম্প্রদায়ের মধ্যে মূর্তি নিয়েই লক্ষ্মী পূজা করার প্রচলন রয়েছে।

শিবপুর উপজেলার কামরাব গ্রামের পাল সম্প্রদায়ের মধ্যে চালের গুঁড়া নিয়ে তৈরি চষির নাড়ু লক্ষ্মী দেবীকে নিবেদন করার চল রয়েছে, যা নরসিংদী অঞ্চলের অন্য কোথাও দেখা যায় না।

নরসিংদী সদর উপজেলার বৌয়াকুড় গ্রামের খালপাড়া জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে লক্ষ্মী পূজায় সেওইর নাড়ু দেয়া হয়। ভাত চালন দিয়ে ডলে রোদে শুকিয়ে বালু অথবা তেল দিয়ে ভাজা হয়। ভাজা সেওই গুড়ে পাক দিয়ে নাড়ু তৈরি করা হয়।

কার্তিক পূজা
কার্তিক শস্য দেবতাদের মধ্যে সর্বপ্রধান। ৩০ কার্তিক কার্তিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। কার্তিক মাসের শেষদিন ফসল তোলার মৌসুমের আগে করা হয় বলে এই দেবতার নাম কার্তিক। এই প্রতিমা দেব সেনাপতি কার্তিকের মতোই দেখতে। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ নারীরা আনুষ্ঠানিকভাবে এই ব্রত বা পূজা করে থাকে। মাটির মূর্তি দিয়ে কার্তিক পূজা করা হয়। মূর্তির উপর নতুন গামছা রাখা হয়। ব্রতিনী কার্তিকের মূর্তির সামনে তিনটি বড়ো ঘট স্থাপন করে থাকে। প্রতিটি ঘটের গায়ের মাঝখানে পাঁচটি সিঁদুরের ফোঁটা দেয়া হয়। প্রথম ঘটে পুরান চাল, দ্বিতীয় ঘটে আতপ চাল এবং তৃতীয় ঘটে জলপাই, তেঁতুল, মূলা, বেগুন, আলু, বিভিন্ন সবজি দিয়ে পূর্ণ করা হয়। একধরনের কাঁটা গাছ কার্তিকের প্রতিমার পেছনে মাটির মধ্যে পোঁতা হয়।

নবান্ন
অগ্রহায়ণ মাসে জমিতে ধান পাকলে নতুন ধানের চাল দিয়ে পিঠা ও মিষ্টান্ন রান্না করা হয়। জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে ছেলে বা মেয়েশিশুকে কাঁচি দিয়ে জমিতে পাঠানো হয়। জমিতে পাঠানোর আগে শিশুটিকে স্নান করানো হয়। কারো সাথে কথা না বলে শিশু ধানের পাঁচটি হিজা কেটে মাথায় করে বাড়িতে নিয়ে আসে। এই পর্যন্ত সে কথা বলবে না। একটি পোড়ামাটির ঘটে জল ভরে জলচৌকির উপর বসানো হয়। এই ঘটে ধানের হিজা ডুবিয়ে রাখা হয়। ধানের হিজায় পাঁচটি সিঁদুরের ফোঁটা দেয়া হয়। এভাবে এটি ঘরে রাখা হয়। চালের গুঁড়া জলে গুলিয়ে জলচৌকির সামনে আল্পনা করা হয়। জলচৌকির সামনে থেকে আঁকতে আঁকতে ঘরের দোর পর্যন্ত এসে শেষ করা হয়।

জমি থেকে প্রথম যে-ধান ঘরে তোলা হয়, তা আতপ চাল করা হয়। এই চাল থেকে কিছু চালের গুঁড়া কুটে পাঁচটি চিতল পিঠা বানানো হয়। দুধ দিয়ে নতুন চালের মিষ্টান্ন রান্না করা হয়। পরে এই পিঠা-মিষ্টান্ন পরিবারের সদস্য এবং প্রতিবেশিদের খেতে দেয়া হয়।

বেলাব উপজেলার যুগি সম্প্রদায়ের মধ্যে অগ্রহায়ণ মাসে প্রথম যে-ধান ঘরে উঠে, তা নবান্নের জন্যে আলাদা করে রাখে। রোববার অথবা বৃহস্পতিবার উপবাস করে ঐ-ধানের চালের গুঁড়ি দিয়ে দুপুরবেলা চিতল পিঠা এবং চাল দিয়ে মিষ্টান্ন রান্না করা হয়। চালের গুঁড়ি জলে গুলিয়ে ঘর ও উঠোনে ফুল, কলসি, ধানছড়া, পানগাছ ইত্যাদি আল্পনা আঁকা হয়। ঘরের মতুম পালার সামনে আল্পনা আঁকা হয়। এখানে একটি থালায় পাঁচটি চিতল পিঠা ও মিষ্টান্ন দিয়ে লক্ষ্মী দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়।

মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরাও অগ্রহায়ণ মাসে প্রথম যে-ধান ঘরে তোলে, তা দিয়ে নবান্ন উৎসব করে।

শারদীয় দুর্গোৎসব
হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় অনুষ্ঠান দুর্গা পূজা। শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে মায়ের আগমন। মায়ের আগমনে নরসিংদী শহরে বাগবিতান, সেবা সংঘ, বিজয়া সংসদ, যুব সংঘ, সাটিরপাড়া মহামায়া সংঘ, নরসিংদী ক্রীড়াচক্র, নোয়াদিয়া আদ্যাশক্তি মন্দির, ব্রাহ্মন্দী ও শিক্ষা চত্বর মন্দিরে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। নরসিংদীর সবচেয়ে বড়ো মণ্ডপ বাগবিতান ক্লাব। এখানে অষ্টমীর দিন তিথি অনুযায়ী কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বারো বছরের নিচে মেয়েশিশুকে মা দুর্গা সাজিয়ে কুমারী পূজা করা হয়।

নরসিংদীর রায়পুরার পশ্চিমপাড়া, বটতলাহাটি, তাত্তাকান্দা, হাশিমপুর, কড়িতলা, পিরিচকান্দি, রহিমাবাদ, আমীরগঞ্জ ইত্যাদি এলাকায় দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মণ্ডপগুলোতে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে ভক্তদের মাঝে খিচুড়ি, লাবড়া, ফল-ফলাদির প্রসাদ বিতরণের পাশাপাশি সন্ধ্যায় আরতি নাচেরও আয়োজন করা হয়।

শিবপুরে নৌকাঘাটা, জয়নগর, কামরাব, আজকিতলা, যোশর ইত্যাদি এলাকায় দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মণ্ডপগুলোতে সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত দুপুরে ভক্তদের মাঝে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। সন্ধ্যায় এলাকার হিন্দু যুবকরা আরতি নাচে অংশ নেয়। মনোহরদীর রামপুরের মিঠাগড়, সিদ্ধেশ্বরী বাড়ি, পশ্চিমপাড়ায় দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। খিদিরপুর, সরিতপুরেও পূজা হয়। প্রত্যেক মণ্ডপে কাপড় এবং আলোকসজ্জা করা হয়। সন্ধ্যায় এসব মণ্ডপে আরতি নাচের প্রতিযোগিতা করা হয়।

বেলাব’র বিশটি পূজা মণ্ডপে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বেলাব মন্দির, বেলাব সুতারপাড়া মন্দির, নারায়ণপুর, গোবিন্দপুর, চর উজিলাব সুতারবাড়ি, কাশিমনগর, বিন্নাবাইদ ইত্যাদি মন্দিরে পূজা হয়।

ঈদ উৎসব
ঈদ নরসিংদীর মুসলমান সম্প্রদায়ের একটি বড়ো ধর্মীয় উৎসব। ঈদের নামাজের ইমামতি করেন মসজিদের ইমাম। নামাজ শেষে ঈদগাহ ময়দানে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। এতে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

রায়পুরা উপজেলার তাত্তাকান্দা জামে মসজিদের ঈদগাহ ময়দানে ঈদের বৃহত্তম জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া রায়পুরা থানার হাফেজিয়া মাদরাসা প্রাঙ্গণ, শ্রীরামপুর মদিনা মসজিদ, কুলাতলী গ্রামের ঈদগাহ মাঠ, চরাঞ্চলের ফকিরাচর মাদরাসা মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। রায়পুরা উপজেলার ২৪ টি ইউনিয়নের প্রত্যেকটিতে চার থেকে পাঁচটি ঈদগাহ ময়দানে ঈদের জামাত হয়।

শিবপুর উপজেলার জয়নগর বিলপাড় ঈদগাহ ময়দান, জয়নগর ধনাইয়া ঈদগাহ মাঠ, যোশর কামারটেক ঈদগাহ মাঠ, কামরাব জয়নগর ঈদগাহ মাঠ, সুজাতপুর ঈদগাহ মাঠ, আজকিতলা ঈদগাহ মাঠ, দরিপুরা ঈদগাহ মাঠ, শিবপুর ঈদগাহ মাঠ, চৌঘরিয়া ঈদগাহ মাঠ, খরিয়া ঈদগাহ মাঠে মুসল্লিরা ঈদের নামাজ আদায় করেন।

পীরপুর ঈদগাহ মাঠ মনোহরদীর খিদিরপুর ইউনিয়নে সবচেয়ে বড়ো ঈদগাহ মাঠ। এছাড়াও পূর্ব রামপুর ঈদগাহ মাঠ, পশ্চিম রামপুর ঈদগাহ মাঠ, চরসাগরদি ঈদগাহ মাঠ, চর আহমদপুর ঈদগাহ মাঠ, খিদিরপুরের দরগা ঈদগাহ মাঠে ঈদের দিন নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা।

নরসিংদী সদরে গাবতলী জামিয়া কাশেমিয়া মাদরাসা ঈদগাহ ময়দান, নরসিংদী পৌর ঈদগাহ ময়দান, দত্তপাড়া ঈদগাহ ময়দান, ট্রেজারি মাঠ, মাধবদী পৌর ঈদগাহ ময়দান ইত্যাদি ঈদগাহ ময়দানে নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।

লোকমেলা
লোকমেলা গ্রামবাংলার মানুষের আনন্দ বিনোদনের জন্যেই শুধু নয়, এটি লোকউৎসবও বটে। সমাজকে ঐক্যবদ্ধ ও সংহত রাখতে মেলার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এর সাথে জড়িত থাকে লোকসমাজের নানা ধরনের প্রথা, বিশ্বাস-সংস্কার আর উৎসব। লোকসংস্কৃতি এবং লোকশিল্পও লোকমেলার একটি অংশ।

নরসিংদী সদর উপজেলার বাউল ঠাকুরের আখড়াবাড়ির দক্ষিণে মেঘনা নদীর পাড়ে মাঘী পূর্ণিমার আগে অথবা পরের বুধবার বাউল ঠাকুরের মেলা বসে। নরসিংদী সদর উপজেলার তরোয়া পৌরসভায় হযরত মাওলানা কাবুল শা’ (রা)-এর মাজারে ১২ ফাল্গুন কাবুল শা’ মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

বাউল ঠাকুরের মেলা
নরসিংদী সদর উপজেলার বাউলপাড়ায় শ্রী শ্রী বাউল ঠাকুরের আখড়াধামে বাংলা ৯৪০ সাল থেকে বাউল ঠাকুরের মেলা শুরু হয়। বাউল ঠাকুরের আখড়াবাড়ির দক্ষিণে মেঘনা নদীর পাড়ে এই মেলা বসে। প্রতিবছর মাঘী পূর্ণিমার আগে অথবা পরের বুধবার এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাউল ঠাকুর মাঘী পূর্ণিমার এই দিনে যজ্ঞ করতেন। এর স্থায়ীত্বকাল কমপক্ষে দশদিন। দেশ-বিদেশের বাউল ঠাকুরের মতাবলম্বী বাউলশিল্পীরা এই মেলায় অংশ নেয়। আখড়াবাড়ির ঠাকুরের মন্দিরের সামনে আটচালায় বাউলশিল্পীদের আসর বসে। বাউল ঠাকুরের শিষ্যরা এই মেলায় আসেন। শিষ্য ও সেবায়েতগণ যৌথভাবে মেলায় আগত বাউলদের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করেন। বুধবার দুপুরবেলা বাউল ঠাকুরের মহাপ্রসাদ মেলায় আগত ভক্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়। বাউল ঠাকুরের শিষ্যরা মেলায় বাউল ঠাকুরের গান, কীর্তন বেহালা, করতাল, খোল, সারিন্দা, একতারা, মন্দিরা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে পরিবেশন করে। বাউল ঠাকুরের রচিত গান লিখিত নয়, মুখে মুখে শিষ্যরা আত্মস্থ করেছেন।

প্রায় একশত বছর তিনি এখানে অবস্থান করেন এবং এখানে সমাধিস্থ হন। তিনি একাই এখানে আসেন। বাউল ঠাকুরের শিষ্যরা বিক্রমপুর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। নরসিংদী সদরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বেশিরভাগই ঠাকুরের মত পোষণ করেন।

কাবুল শামেলা
তরোয়ার হযরত মাওলানা কাবুল শা’ (রা.)-এর মাজারে ১২ ফাল্গুন মেলা বসে। মাজারের প্রাচীরের সীমানা ঘেঁষে মেলা বসে। সাতদিন ধরে এই মেলা চলে।

১৩৫৯ সালে কাবুল শা’ মাজারে কাবুল শা’ মেলা শুরু হয়। এই নিয়ে জনশ্রুতি রয়েছে। এ-প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা কাবুল শা’ (রা.)-এর মাজারের খাদেম মো. হারুন-অর-রশীদ খান বলেন, “হাজী আব্দুল সামাদ খানের মেজো ছেলে সালামত খান স্বপ্নে নির্দেশ পান, ফাল্গুন মাসের ১২ তারিখে কাবুল শা’ মাজারে মিলাদ মাহফিল তোবারক জিকির সামা করার। একে ঘিরেই এখানে দুইদিনব্যাপী মেলা বসতো। এই মেলায় ফকির পাগল, সালে মজনু সবাই সমবেত হতেন। দুইদিন থেকে মেলার মেয়াদ বেড়ে বর্তমানে সাত দিন হয়েছে।”

কালীবাড়ি মেলা
নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার রায়পুরা সদরে পশ্চিমপাড়া গ্রামের কালী মন্দিরের সামনে কাকন নদীর পাড়ে ফাল্গুন মাসে দোল পূর্ণিমার বারো দিন পর কালীবাড়ি মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একদিন এই মেলা বসে।

তাত্তাকান্দা অষ্টমী মেলা
রায়পুরা উপজেলার তাত্তাকান্দা গ্রামের আর কে আর এম উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে কাকন নদীর পাড়ে অষ্টমী তিথিতে ২৬ চৈত্র তাত্তাকান্দা অষ্টমী মেলা বসে। এই মেলা দু’দিনব্যাপী চলে।

গাছতলা মেলা
রায়পুরা উপজেলার বটতলাহাটি গ্রামের বটগাছতলায় পহেলা বৈশাখে গাছতলা মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলার সময়কাল একদিন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই মেলা। পহেলা বৈশাখের দিন সকালবেলা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা বটগাছতলায় পূজা দেয়। বাইশ বছর ধরে এই মেলা চলছে।


সহায়ক গ্রন্থ
বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি : নরসিংদী, বাংলা একাডেমি

মাতৃভূমি ও মানুষের জন্যে আমার যা করণীয়, সেগুলো না করে তো আমি চলে গেছি : হরিপদ দত্ত

0

হরিপদ দত্ত। সমকালীন বাংলা কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখক। বর্তমানে তিনি পশ্চিবঙ্গের নদীয়া জেলায় বসবাস করেন। সম্প্রতি তিনি অল্প কয়েকদিনের জন্যে নিজ মাতৃভূমি বাংলাদেশে আসেন। জুন ২০২৩ (শুক্রবার) তাঁর এই সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়। সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন শহিদুল হক সুমন সুমন ইউসুফ।

আপনি দেশে আসার পর থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সাক্ষাতকার দিয়েছেন। সবাই একটা প্রশ্ন আপনাকে করেছে। আমিও আমাদের পাঠকদের জন্যে প্রশ্নটি পুনরায় করতে চাই। সেটি হলো, আপনি দেশ ছেড়েছেন কেন?

হরিপদ দত্ত : আসলে বাংলাদেশের অন্য আটদশজন হিন্দু যেসব কারণে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়, আমি কিন্তু সেসব কারণের শিকার নই। আমাদের যেএলাকা, সেটি ছিলো একদম কৃষিপ্রধান। তারা কৃষিকাজ ছাড়া আর কিছুই পারে না। সেখানে ইউরিয়া সারকারখানা প্রায় সব কৃষিজমি নিয়ে নেয়। ফলে সেখানকার মানুষজন উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। পুরো একটা গ্রাম ভেঙে যায়। সময়টা ছিলো খুব খারাপ। ১৯৬৪৬৫। দাঙ্গা হলো। ভারতপাকিস্তান যুদ্ধ হলো। এরকম পরিস্থিতিতে একটা বিরাট দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতর পড়লো সংখ্যালঘুরা। অনেকে অনেক জায়গায় চলে গেলো। আমাদের কিন্তু সেরকম যাওয়ার বিষয় ছিলো না। কৃষিজমি হারিয়ে ভূমিহীন অবস্থায় আমার পরিবার ভারতে চলে যায়। তবে আমি যাইনি। কিন্তু শেকড়ছেঁড়া একটা মানুষের যা হয়, একটা দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেলাম। এই অবস্থায় আমার স্ত্রীসন্তানদের কোথায় রাখবো, এই চিন্তা করতে করতে তাদেরকেও পাঠিয়ে দিলাম। আমি রয়ে গেলাম বাংলাদেশেই। তারপর ২০১২ সালে এসে আমি দেশ ছাড়ি। আমি জানতাম না যে, আমার কিডনির সমস্যা হয়ে গেছে। আসলে অসুস্থতার জন্যেই আমাকে ভারতে যেতে হয়, বাধ্য হয়ে, পরিবারের কাছে। তবে চিরতরে যাবার জন্যে নয়, চিকিৎসা করে সুস্থ হয়ে ফিরে আসবো বলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু অসুস্থতা বেড়েই চললো। নিউমোনিয়া পর্যন্ত হয়েছিলো। আবার পাসপোর্টের জটিলতায় পড়লাম। প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তাই আর আসতে পারিনি। তাছাড়া আমার কোনো সম্পত্তি নেই। না বাংলাদেশে, না ভারতে। সেই যে সারকারখানা আমাদের ভূমিহীন করলো, সেই থেকে এখনো ভূমিহীনই রয়ে গেলাম। আমার বাবাকাকার শত শত বিঘা জমি ছিলো, সব সারকারখানা দখল করে নিলো। তো এরকম পরিস্থিতিতে আমার সন্তানেরাও আমাকে ছাড়তে চাইলো না। তারা সেখানে শিক্ষকতা করে। এখন প্রকৃতপক্ষে তাদের উপরেই আমি নির্ভরশীল।

সেখানকার কোনো পত্রপত্রিকায় লেখা দেন? বা কোথাও ছাপা হয়েছে এখনো পর্যন্ত?

হরিপদ দত্ত : না না। এটা আমি আগেও বলেছি, ভারতের কোনো পত্রিকায় লেখার জন্যে তো আমার জন্ম হয়নি। আমার জন্ম হয়েছে খানেপুর গ্রামে, শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে, এই বাংলার মাটিতে। আমার এই ঋণটা তো শোধ করতে হবে। আমার চলে যাওয়াটা ছিলো একধরনের বিট্রেয়ারের কাজ, বিশ্বাসঘাতকের কাজ। আমার মাতৃভূমি মানুষের জন্যে আমার যা করণীয়, সেগুলো না করে তো আমি চলে গেছি। বাংলাদেশের মাটি, মানুষ, জনতাআমাকে তাড়িয়ে তো দেয়নি তারা। আমি নিজে তা স্বীকার করি। কিন্তু ক্ষমা চাই না। ক্ষমা কী আর! এর ফল তো আমাকে ভোগ করতে হচ্ছে। আমি বুঝতে পেরেছি। বছরেরই ১৮ ফেব্রুয়ারি আমি বর্ডার ক্রস করে বাংলাদেশে ঢুকতে পারিনি। এর অন্যতম কারণ হলো, বিশ্বাসঘাতকদের তার মাতৃভূমি দ্বিতীয়বার জায়গা দেয় না। আর এই কারণেই আমি এবারের বইমেলায় দেশে আসতে পারিনি। যদিও এগুলো আবেগতাড়িত কথা বলে উড়িয়ে দিতে পারে অনেকে, তবুও আমি এটিই মনে করি।

যাই হোক, নরসিংদীভিত্তিক আপনার যেলেখালেখি, আপনারদ্রাবিড় গ্রাম’, ‘শীতলক্ষ্যা’, ‘জাতিস্মরের জন্মজন্মান্তরইত্যাদি উপন্যাসে আমরা খানেপুর গ্রামের ভাঙনের ইতিহাস উপন্যাসের আদলে পাই। কিন্তু আমরা সারকারখানা কর্তৃক খানেপুর গ্রাম ধ্বংস হবার প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাই।

হরিপদ দত্ত : আগেও একবার মাসুদ রানাকে আমি বলেছি, না জেনে, না পড়ে এগুলো জিজ্ঞেস করা উচিত না। আমার আত্মজীবনীউলুখাগড়া ছাপা হয়েছে। তাছাড়া অনেক উপন্যাসেও এসবের ছাপ আছে। আর অনেক কথা এভাবে বলা যায় না। কেউ বলে না। আমার ঘরসংসার আছে, নানা সমস্যা আছে। রবীন্দ্রনাথ আর কাদম্বরীর সম্পর্কের কথা কি তিনি স্বীকার করেছেন কখনো?

আচ্ছা, তাহলে ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। এখন আপনি পশ্চিমবঙ্গে আছেন। সেখানে দিন কীভাবে পার করছেন?

হরিপদ দত্ত : ঘুরেফিরে কাটাই আরকি। ভাবলাম, বয়স হয়েছে, ধর্মকর্ম করা দরকার। এটা করোনা শুরু হওয়ার দুই বছর আগের কথা। মনে হলো, আমার সৃষ্টির জন্যে পুণ্য অর্জন দরকার আছে। আমি পা বাড়ালামপ্রথম যে তীর্থস্থানে গেলাম, তার নাম শান্তিপুর। মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের বাড়ি, প্রথম মুসলমান লেখকের হাতে রচিত উপন্যাসজোহরা লেখক। ওটাই আমার ধর্মস্থান। তীর্থ মানে আমার কাছে গয়াকাশীবৃন্দাবন নয়, লেখকের জন্য লেখকের সৃষ্টির জায়গা তার পুণ্যভূমি, এটা আমি মনে করি। ওটাই আমার ধর্মস্থান। এরপরে গেলাম চৈতন্য দেবের আন্দোলনের স্থানে, নদীয়া। গেলাম কৃত্তিবাস ওঝার ওখানে। কৃত্তিবাস ওঝার জন্মস্থানে। একটা বটগাছ আছে। বটগাছের সঙ্গে একটা সাইনবোর্ড লাগানো। লেখাএই বটবৃক্ষের নিচে বসিয়া মহাকবি কৃত্তিবাস রামায়ণ রচনা করিয়াছিলেন নিচে সংস্কৃতেও লেখা আছে। দেখলাম, গাছের ওখানে একটা ফুটা আছে। ওখানকার কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করলাম, ফুটা কেন? সে বললো, ভেতরের গাছটাই মূল গাছ। যেটা দেখতে পাচ্ছেন, সেটার বয়স বড়জোড় ৭০ বছর হবে। মূল গাছটাই ভেতরে। উপরেরটা নবীন গাছ। বটগাছ তো একজন আর একজনকে জড়িয়ে থাকে। এভাবেই তারা হাজার বছর টিকে থাকে। ওখানে একটা লাইব্রেরিও আছে। যদিও তেমন কিছু নেই, কিন্তু যেটা অবাক করলো, তা হলো, অনেকগুলো কবর ওখানে। কবরগুলো চৈতন্য দেবের শিষ্যের। হুসেন শাহ, হরিদাস, বলবান হরিদাসের। ভেতরের দিকে আরো আছে, যেতে পারলাম না। ঘন জঙ্গল হয়ে গেছে। এটা সাহিত্যের জায়গা। সেই বটবৃক্ষের উপরে একটি বেদি বাঁধানো আছে। সেই বেদির উপর বসে ভাবলাম, এখানেও হয়তো লেখা থাকতে পারতো, ‘এই বটবৃক্ষের তলায় বসিয়া হরিপদ দত্ত জন্ম জন্মান্তর উপন্যাস রচনা করিয়াছিলেন (অট্টহাস্যে) এমন যদি হতো, খুব ভালো হতো। কবি জয়দেবের তীর্থ বীরভূম; সেখানে ভোজপুরি ভাষা। যেটা রাধাকৃষ্ণের প্রেমের মূল জায়গা। ওখানে একটা ভাঙা মন্দিরের মতো আছে। এই জায়গাগুলো আমার কাছে তীর্থস্থানের মতো। এই জায়গাগুলোতে গেলে প্রেরণা পাওয়া যায়। সাহিত্যের প্রেরণা পাওয়া যায়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়েরহাসুলী বাঁকের উপকথাআমার অত্যন্ত প্রিয় উপন্যাস। বীরভূম, যেখানের কথা এই মহাকাব্যিক উপন্যাসে বলা হয়েছে। জঙ্গল এলাকা। বাঙালি, সাঁওতাল, কাহার পাশাপাশি দীর্ঘ বছর বসবাস করে। আর বাঁকটা হলো অনেকটা কল্পনা। কোপাই নদীটা শান্তিনিকেতন যাবার পথে দেখা যায়। আমি যখন গেলাম, তখন শীতকাল। পানি তেমন নেই। হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম নদীর চরার ওপাড়ে একটা বটগাছ আর তার সঙ্গে লাগোয়া একটা দহ। গভীর দহ, দূর থেকে দেখা যায়। হেঁটে ওদিকে যাওয়া নিষেধ, চোরাবালি আছে। উপন্যাসে কালো বউ, নাম নয়ান, যে পরকীয়া করে ধরা পড়ে, পরে একটা জায়গায় বটগাছের কাছে সাপ তাকে ছোবল মারে, পরে দহের মধ্যে পড়ে মারা যায়। হেঁটে ওই দহের কাছে যাবার পর মনে হলো, এটা সেই জায়গা। তারাশঙ্করের বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। ওখানে বটগাছ আছে অনেক। দহও অনেক আছে। হয়তো ওটা নয়, ওটার মতো। কবির কল্পনা যখন মানুষকে স্পর্শ করে, তখন এমন হয়। আমার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের একটা অংশ চুঁচুড়ার দিকে থাকে। এই স্টেশন দিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বহুবার গিয়েছেন। তাঁর বাবা ব্রিটিশ সরকারের চাকুরি করতেন। ওয়ালীউল্লাহ্ থাকতেন উনার সঙ্গে। ওই পথে কলকাতা আসতেনযেতেন।একটি তুলসী গাছের কাহিনিগল্পে যেচরিত্রগুলো পাওয়া যায়, ওই যে গৃহকর্ত্রী, দেশভাগের পর ট্রেনে করে চলে গেলেন; কোথায় গেলেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ জানেন না। কিন্তু যখন সন্ধ্যায় তুলসী গাছের কথা বললেন, এখানে যে লিলুয়া, বৈদ্যবাটি, সেখানে গিয়ে ঠিক একটা বাড়ি দেখে আমার বারবার গল্পটির কথা মনে হতে লাগলো। আমি সেই বৈদ্যবাটি স্টেশনে নেমে গেলাম। দেখি কী হয়। মুশকিল হলো ওসব জায়গায় মিশতে গেলে একটা ভাষা লাগে। জোর করে হলেও উত্তরবঙ্গীয় ভাষায় বলবার চেষ্টা করলাম। একজনকে বললাম, ওই পাশে যাবার পথ কোনটা? তখন সে বললো, আপনি কেন যাবেন? আমি বললাম, ওই যে বাড়ির উঠান, ওখানে একটু যাবো। উঠানে একটা শাড়ি আড়াআড়ি করে মেলে দেয়া। মনে হলো একটা গৃহস্থ বাড়ি। ঠিক গল্পে যেমন আছে। কোনো রকম ঢুকেই যাচ্ছিলাম, পেছন থেকে একজন ডাক দিলো, কেন যাবেন, কী কাজ, কোথা থেকে এসেছেন? বললাম, পাশের গ্রামে আমার আত্মীয় থাকেন। এখানে একটু বেড়াচ্ছি। যাই হোক, নানা প্রশ্ন। আর তর্ক করলাম না। কিন্তু দেখো, ওয়ালীউল্লাহ্ গল্পটা লিখেছেন ১৯৪৮ সালে, কিন্তু আমি এখন তাড়িত হচ্ছি। সাহিত্য কীভাবে মানুষকে আকর্ষণ করে, কীভাবে বিভ্রান্ত করে, আমিই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
আরেকটা বিষয় বলি। তোমরা কি মনে করো, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্কে যথাযোগ্য মূল্যায়ন বা মর্যাদা দিয়েছে বাংলাদেশের পাঠকলেখকবুদ্ধিজীবীরা? দেয় নাই। কারণ, উনাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিলে এখন যারা লাফালাফি করে, তারা পায়ের নিচে চলে যাবে। তাঁর সমতুল্য লেখক বাংলা সাহিত্যে বিরল। পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে বলেছিলেন, “পড়ো, পড়ো, শিখো, কীভাবে একজন ওয়ালীউল্লাহ্চাঁদের অমাবস্যাউপন্যাসে উপমাচিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। শিখো হরিপদ, শিখো। শিখবে, লিখবে।
ওয়ালীউল্লাহ্ নকলটা করলো কিছু আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তাঁর ধারাবর্ণনার নদীর কুয়াশা, কুয়াশা উপরে উঠতেছে। ওয়ালীউল্লাহ্ লেখলো ভেড়া, ইলিয়াস ভাবলো, কেউ পড়ে নাই এসব, সে লিখলো বাছুর।

আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছে নাই আপনার?

হরিপদ দত্ত :উলুখাগড়া ছাপা হয়েছে তো আত্মজীবনী।

ঢাকা কেন্দ্রিক যেসাহিত্যচর্চা এবং কলকাতা কেন্দ্রিক যেসাহিত্যচর্চা, এক্ষেত্রে ঢাকার অবস্থান কীরূপ?

হরিপদ দত্ত : একটা সত্য কথা বলি। ঢাকা কেন্দ্রিক মানে হলো মুসলিম সমাজ, পারিবারিক জীবনএসব, আর মুসলমানরা শিক্ষাগ্রহণ শুরু করেছে হিন্দুদের অনেক পরে। আর বাংলা ভাষার চর্চা ঠিক ওইভাবে মুসলিম সমাজে ছিলো না। এর ফলে যেগ্যাপটা তৈরি হয়েছে, পরবর্তীকালে ধরো ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলে একটা বিরাট চেঞ্জ আসছে। ফলে সাহিত্যেও একটা চেঞ্জ আসলো। দেখো, এই সময় স্রোতের মতো কবিতা লেখা হয়েছে। নির্মলেন্দু গুণহাবিবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার বই ট্রেনে ট্রেনে বিক্রি হতো। নাটকথিয়েটারের জোয়ার বইলো। কিন্তু যেই না স্বাধীনতার সূর্য আস্তে আস্তে মেঘে ঢাকতে শুরু করলো, স্বাধীনতা মানুষের আশা পূরণ করতে পারলো না, ঠিক শিল্পসাহিত্যেরও একই অবস্থা হলো। কোথায় গেলো এসব? যৌনতার দিকে চলে গেলো। সেগুলোর বিশাল বাজার তৈরি হলো। তারপর আরো পরে ইলেকট্রনিক ডিভাইস এলো। ছেলেমেয়েরা বইপড়া থেকে দূরে চলে যেতে থাকলো। তবে আমি মনে করি না যে, মোবাইল বা আধুনিকতার কারণেই তারা বই থেকে দূরে সরে গেছে। ইংল্যান্ডআমেরিকার চেয়ে উন্নত কি বাংলাদেশ নাকি? লক্ষ লক্ষ কপি উপন্যাসের বই বিক্রি হয় আমেরিকায়, ইংল্যান্ডে, ইউরোপে। ওখানেও তো মিডিয়ামের ছড়াছড়ি। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ভেতর বসবাস করে আমেরিকান ছেলেমেয়েরা। তারপরও তারা বই কিনে, বই পড়ে। যাই হোক, ঢাকার ব্যাপারটা হলো, এখানে সাহিত্যের চর্চাটাই কম হইছে। তবে হবে। আসলে অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্যবাদী একটা আগ্রাসন ছিলো, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ব্রাহ্মণ্যবাদী কালচারটা অনেকটা বঙ্কিমচন্দ্র বহন করতো। সেই যুগটা চলে গেছে।
স্বাধীনতা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে আমাদের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু আমরা পারিনি সত্যিকার অর্থে। বিশ্বমানের কোনো উপন্যাস, গল্প, সাহিত্য আমরা উৎপাদন করতে পারিনি। এটা স্বীকার করতে হবে।

এর কারণটা কী? কেন পারিনি? আমাদের ঘাটতি কোন জায়গায়?

হরিপদ দত্ত : ঘাটতিটা হলো, আমাদের চর্চার অভাব আছে।

আমরা কি বৈশ্বিক চেতনা ধারণ করতে পারি নাই?

হরিপদ দত্ত : না না। বৈশ্বিক চেতনা আছে। থাকবে না কেন? অনেক ক্ষেত্রেই আছে। কিন্তু সাহিত্যিক যেচেতনা, এটা তো কেউ জন্মসূত্রে পায় না। এটা পড়াশোনার মাধ্যমে হয়। সেই সুযোগগুলো এখানে নেই। এখানে বিশ্বমানের কোনো পাঠাগার নেই। নেই কিন্তু। সেধরনের প্রকাশনা সংস্থাও নেই এখানে। আমি এক প্রকাশককে বলেছিলাম একবার, ভাই, তুমি মনে কিছু করো না, তুমি আনন্দ পাবলিশার্সে গিয়ে ট্রেনিং নাও, কীভাবে বইয়ে বিনিয়োগ করে এটার বিলিবণ্টন করে আয় করতে হয়, এটা বুঝতে হবে তোমাকে। তুমি যদি বাংলাবাজারে বইসা দুইটা বই বিক্রি কইরা অই পয়সা দিয়া এক সের চাল কিনে মোহাম্মদপুর চলে যাও, তাহলে তোমাকে দিয়ে বইয়ের ব্যবসা হবে না, তুমি যোগ্য নও প্রকাশক হবার। পরে সে রাগ করেছিলো।
মুশকিলটা হলো, আমাদের এখানে খাটনি আছে, শক্তি কম। স্বীকার করতে হবে। তারপর কী বলবো, আত্মমর্যাদা নাই আমাদের মধ্যে। এক কবিকে একবার আমি ফোনে বলেছিলাম, ‘দেশপত্রিকায় তোমার একটা কবিতা ছাপা হলো, ‘আনন্দবাজারপত্রিকায় ছাপা হলো, এতে লেজ নাড়ানোর কিছু নাই। তুমি কি জানো, পূজা সংখ্যার পত্রিকা কীভাবে ছাপা হয়? এমন ঘটনা মাঝেমধ্যে ঘটে যে, বাংলাদেশের লেখককবিদের লেখাদেশপত্রিকায় যেগুলো থাকে, বাংলাদেশের জন্যে আলাদা ছাপা হয়। সেগুলো বাংলাদেশে চলে আসে। কলকাতায় যেপত্রিকা চলে, সেখানে বাংলাদেশের লেখকদের লেখা থাকে না। আমি তাকে বললাম, তুমি এই লেজুড়বৃত্তি করো না। নিজের দেশ, ঐতিহ্য, ধর্মসবকিছু বিসর্জন দিয়ো না। কারণ, এটা একটা মার্কেট। তোমার একটা কবিতা ছাপা হলে তুমি লেজ নাড়তে নাড়তে গদগদ করতে করতে আরো দশটা পাঠক তৈরি করবা তাদের। কোথায় ময়মনসিংহে বসে তুমি পশ্চিমবঙ্গে আমাকে টাকা খরচ করে ফোন করে বললে, দাদা, দেশ পত্রিকার এই সংখ্যা কি আপনার ঘরে এসেছে? আমি তো লিখেছি। আমিও কলকাতার ভাষায় বললাম, আমি পড়েছি বৎস্য, খুব ভালো লিখেছো। এতো গদগদ কেন? বাজার তৈরি করছে তারা। তারা বেনিয়া, এটা মনে রাখতে হবে।

এবার আমাদের করণীয়টা বলেন। ঢাকার সাহিত্যচর্চার জন্যে কী পড়া দরকার, কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে পড়া দরকার?

হরিপদ দত্ত : দেখো, আমি কখনোই বলবো না যে, তুমি কমিউনিস্ট লেখকদের বই পড়ো, মানিকের বই শুধু পড়ো। এটা আমি কখনোই বলবো না। আগে বলতাম। প্রত্যেকে পড়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন। যা ভালো লাগে, সেটাই পড়বে। তবে তোমাদের শেষ একটা কথা বলে রাখি, তোমরা তৈরি হয়ে থাকো। দিন আসতেছে কিন্তু। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা কেন্দ্রিক গদ্য আর বাংলাদেশের ঢাকা কেন্দ্রিক গদ্য কিন্তু একটা অনিবার্য সংঘাতের কাছাকাছি চলে আসছে। আমিও চাচ্ছি, দ্রুত সংঘাতটা লাগুক। লাগলে সুবিধা কী, স্বাধীন বাংলাদেশের একেবারে নিজস্ব একটা গদ্যরীতি তৈরি হবে। আরেকটা জিনিস হিসেব করে দেখবা যে, সারা বিশ্বে আটাশ কোটির মতো বাঙালি আছে। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বিহারের একটা অংশ, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে কিছু আছেএদের মধ্যে ধর্মীয়ভাবে হিন্দুমুসলমানের সংখ্যা কতো? হিন্দু মাত্র নয় কোটি। তাহলে বাকি ঊনিশ কোটিই তো নেতৃত্ব দেবে। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আবার স্বাধীন দেশ কোনটাপশ্চিমবঙ্গ না বাংলাদেশ? সুতরাং তোমাদের দায়িত্ব বাংলা সাহিত্যের নেতৃত্ব নেয়া, লেজুড়বৃত্তি করা নয়।

পঞ্চাশ বছরেও এটা হলো না কেন?

হরিপদ দত্ত : হলো না, যে লেজুড়বৃত্তি।

কলকাতার লেখকদের সাথে আপনার কোনো যোগাযোগ নেই?

হরিপদ দত্ত : না। যোগাযোগ আমি করিই না। আমার সব লেখা আমি বাংলাদেশেই পাঠিয়ে দেই। জন্মঋণ শোধ করতে করতেই আমার জীবন চলে যাবে।

একাত্তরের যুদ্ধের সময় আপনি কোথায় ছিলেন?

হরিপদ দত্ত : তখন আমি একটা বাম দলের সাথে যুক্ত ছিলাম। আমি চীনপন্থীদের সাথে ছিলাম। মেননদের সাথে ছিলাম। তাছাড়া আন্ডারগ্রাউন্ডের সাথে, সর্বহারার সাথেও যোগাযোগ ছিলো। টিপু বিশ্বাস, ভাষা মতিন, বদরুদ্দীন উমর

বদরুদ্দীন উমর ভাইয়ের জন্যে আমার খুব কষ্ট লাগে। এতো বিশাল পণ্ডিত, উনাকে কে বললো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কমিউনিস্ট রাজনীতি করতে?

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেশেই থাকার চিন্তা করছেন কি? বা বাংলাদেশে ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা আছে কি?

হরিপদ দত্ত : আমি তো পরনির্ভরশীল এখন। আমার ছেলেরাই আমাকে খাওয়ায়পরায়। আর ওখানে আমাকে কেউ চেনে না তো। আমি নিরিবিলি স্টেশনে বসে থাকি, একা। আর ওখানে বসলে আমার মাতৃভূমির কথা মনে পড়ে খুব।

ভাই গিরিশচন্দ্র সেন : কোরআনের অনুবাদ নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক


ভাই গিরিশচন্দ্র সেন। জন্ম মহেশ্বরদী পরগণার পাঁচদোনায়। ১৮৩৪ সালে। একজন ক্ষণজন্মা মানুষ। অত্যন্ত মেধাবী, কিন্তু আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া করেননি খুব বেশি। বাড়িতে পারিবারিক শিক্ষাগুরুর কাছে বাংলা ও মৌলভীর কাছে ফারসি শেখা। তারপর ঢাকার পোগোজ স্কুলে কিছুকাল পড়েছিলেন। ভালো লাগেনি একটানা পাঁচ ঘণ্টা ক্লাশরুমে বসে থাকা। তাই স্কুল ছেড়েছিলেন। তারপর ভাইয়ের আশ্রয়ে ময়মনসিংহে সংস্কৃত পাঠশালায়, হার্ডিঞ্জ স্কুলে। অতঃপর হার্ডিঞ্জ থেকে শিক্ষক প্রশিক্ষণে পাশ করে ঐ-স্কুলেই শিক্ষকতা। লেখাপড়ার আনুষ্ঠানিক দৌড় এতোটুকুই। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক অধ্যয়নে পুরো জীবন কেটেছে তাঁর। আর তাতেই ব্যুৎপত্তি ঘটেছে বাংলা, ইংরেজি, ফারসি, সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু ও আরবি ভাষায়। সার্থকতা এসেছে লেখালেখি আর সাংবাদিকতায়।

আমাদের বাড়ির কাছের এই মানুষটি সম্পর্কে জানি সেই ছোটোকাল থেকেই। জানি কোরআনের বাংলা অনুবাদক হিসেবে। কোরআন সপ্তম শতাব্দীর প্রথম ভাগের আরব দেশের ঐশী ধর্মগ্রন্থ। আরবি ভাষায় লেখা। এর বাণী প্রচার করে ইসলাম ধর্ম ব্যাপ্তি পেয়েছে দেশে দেশে। এই বাংলা মুল্লুকেও। সেই থেকে এখানকার মুসলমানদের ঘরে ঘরে রয়েছে পবিত্র এই ধর্মগ্রন্থ, আরবি কোরআন। অধিকাংশই পড়তে জানেন। কিন্তু ক’জনে এর অর্থ বোঝেন?

আরবি থেকে বাংলায় সম্পূর্ণ কোরআন অনুবাদের মাধ্যমে এর অর্থ বোঝার মহতি কাজটি করলেন পাঁচদোনার এই মানুষটি। এখন থেকে ১৪২ বছর আগে। আর এই কাজটি করতে ৪২ বছর বয়সে তিনি আরবি শিখতে যান তখনকার ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার অন্যতম কেন্দ্র লখনৌ’তে। লখনৌর প্রবীণ আলেম মৌলভী এহসান আলীর কাছে আরবি ভাষা ও ব্যাকরণ শেখেন এক বছর। তাঁর কাছে ফারসি সাহিত্যও পড়াশোনা করেন তিনি। ফিরে এসে কলকাতা ও ঢাকার নলগোলায় আরো দুইজনের কাছে আরবিতে অধিকতর তালিম নেন। তারপর অনুবাদের কাজে হাত দেন।

অনুবাদের কাজ শুরু করেন ময়মনসিংহে। ১৮৮১ সালে শুরু করে শেষ করেন ১৮৮৬ সালে। প্রথম খণ্ড শেরপুরের চারুচন্দ্র প্রেস থেকে ছাপেন। এর একটি কপি পাঠান কলকাতায়, পত্রিকায় প্রকাশের জন্যে। শর্ত দেন, প্রকাশকালে থাকবে না অনুবাদকের নাম। এভাবেই প্রথম প্রকাশ। পরে অনূদিত খণ্ডগুলো একে একে পাঠালেন কলকাতার বিধানযন্ত্র প্রেসে। এখানেই প্রথম অখণ্ড অনুবাদ প্রকাশিত হয় তাঁর নাম উহ্য রেখে। এক হাজার কপি বাঁধাই হয়ে বাজারে যায়। দ্রুতই তা নিঃশেষ হয়। ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় সংস্করণ, প্রচ্ছদে অনুবাদকের নাম উল্লেখ করে। প্রকাশক ও মুদ্রক দেবযন্ত্রের মালিক গিরিশচন্দ্র চক্রবর্তী। এই সংস্করণ শেষ হওয়ার পর সংশোধিত আকারে, টীকা যুক্ত হয়ে তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় কলকাতার মঙ্গলগঞ্জ মিশন প্রেস থেকে। তাঁর জীবদ্দশায় এটিই শেষ সংস্করণ। ১৯১০ সালে তিনি মারা যান। এরপর অনবরত এর নতুন নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়ে আসছে কলকাতা ও ঢাকায়, ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশনী থেকে।

প্রথমবার যখন তাঁর অনুবাদখণ্ড প্রকাশিত হয়, তখন এক ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়। এমনটা হয়েছিলো মুসলমান সমাজে, তেমন বিশ্বাসবোধ থেকে যে, “আরবিই কোরানের একমাত্র ভাষা, এর কোনো ভাষান্তর হতে পারে না।” তবে বাঙালি মুসলমান সমাজের বিদগ্ধজন এই ভাষান্তরকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যথার্থ অনুবাদ হয়েছে। বলেছিলেন, আগেই এর ভাষান্তর হয়েছে ফারসি ও উর্দুতে। কাজেই বাংলায় হলো, তাতে দোষ কী? তখন অবশ্য অনুবাদকের নাম ছিলো না, প্রচ্ছদে। পরে যখন নামসহ প্রকাশ পেলো, তখন আরেক ধরনের প্রতিক্রিয়া হলো। একজন অমুসলমানের অনুবাদে কোরআন, এ যেন অকল্পনীয় কারো কারো কাছে। এক ক্রুদ্ধ মুসলমান বললেন, “কাফেরের হাতে হয়েছে এই পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ। তাকে পাইলে আমি শিরশ্ছেদ করবো।” কিন্তু লেখাপড়া জানা আলেম সমাজ, বিদ্বানেরা এই কাজের অকৃপণ প্রশংসা করেন। অনুবাদককে উদ্দেশ্য করে প্রশংসাপত্র আসতে থাকে। পত্রিকায় লেখেন বেশ অনেকে। কলকাতার তিন মৌলভী ইংরেজিতে লেখা এক চিঠিতে বলেন, “আমরা কয়জন অত্যন্ত সতর্কতা ও মনোযোগ দিয়ে আপনার অনুবাদ পড়েছি। মূল কোরআনের সাথে তা তুলনা করে দেখেছি। আমরা অবাক হয়েছি কিভাবে আপনি এমন যথার্থ অনুবাদ করতে সক্ষম হলেন।” এমন প্রশংসাসূচক পত্র ও মতামত পাওয়া গেলো তৎকালীন অনেকের কাছ থেকেই। ঢাকা থেকে মৌলভী আলিমুদ্দিন আহমদ ফারসিতে লেখা পত্রে তাঁর অনুবাদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। আবু আল মজফফর আবদুল্লা নামের আরেকজন লেখেন, “আপনি যে টীকা বর্ণনা করেছেন তা আমার ক্ষুদ্র বিদ্যা-বুদ্ধিতে পর্যন্ত বুঝতে পেরেছি।” যশোরের মৌলভী আফতাব উদ্দীন লেখেন, “বাংলা অনুবাদটি অতি উৎকৃষ্ট ও প্রাঞ্জল। এতে বাঙালি জাতির গৌরব বাড়বে।” এমন প্রশংসার বর্ণনা তাঁর জীবনকালকে ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৩৬ সালে প্রখ্যাত মুসলমান মনীষী মওলানা আকরম খাঁ লেখেন :

“তিন কোটি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা। তাদের মধ্যে কোনো মনীষী কোরানের অনুবাদ প্রকাশের কল্পনা করেনি ১৮৭৬ সাল অবধি। আরবি ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত মুসলমানের অভাব ছিল না তাদের মধ্যে। এই গুরুদায়িত্বভার সর্বপ্রথম বহন করলেন বাংলার এক হিন্দু (প্রকৃত পক্ষে তিনি ছিলেন নিরাকার একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম, হিন্দু নন) সন্তান ভাই গিরিশচন্দ্র সেন। তাঁর এই অসাধারণ সাধনা ও অনুপম সিদ্ধি জগতের অষ্টম আশ্চর্য বলে উল্লেখ করা যেতে পারে।”

ভাই গিরিশচন্দ্র সেন বাঙালি মুসলমান সমাজ কর্তৃক তাঁর সকল প্রশংসার জবাব দিয়েছেন অতি বিনয়ের সাথে। লিখেছেন :

“এ তো ঈশ্বরের লীলা। সাধারণ মানুষের অগম্য এই নিগূঢ় জ্ঞান আমি তাদের জন্য প্রকাশ করতে পারবো, এমনটা আমি পূর্বে চিন্তা করতে পারিনি। অনেকটা মনের আবেগে আমি এই কাজের উদ্যোগী হয়ে লখনৌ যাই।”

প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে চাই, কোরআন অনুবাদে তাঁর নাম ছড়িয়েছে, এ-কথা সত্য। কিন্তু এটাই তাঁর একমাত্র সৃষ্টিকর্ম নয়। তিনি অনবরত লিখেছেন আজীবন। নিজের আত্মজীবনীসহ তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৭৭ টির মতো। তিনিই প্রথম হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী লিখেছেন বাংলায়। তিনি বই লিখেছেন ইসলামের মনীষীদের নিয়ে। অনুবাদ করেছেন বিখ্যাত আরবি গ্রন্থ ‘মেস্কাতোল মসাবিহ’। এর নাম দিয়েছেন ‘হাদিস পূর্ব্ব বিভাগ’। এরপর হাদিসের অপর খণ্ড ‘হাদিস উত্তর বিভাগ’। বিচিত্র তাঁর লেখার ভুবন। লিখেছেন ভ্রমণ কাহিনি, ইতিহাস ও ধর্মবিষয়ক বই ‘বর্ম্মাদেশ ও বর্ম্মাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম’।


ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের সকল কীর্তি এখন সুদূর অতীতের ঘটনা। কোরআন অনুবাদের বিষয়টিও তাই। কিন্তু সেই অতীত আবার সামনে এসেছে কিছু মানুষের অপলাপের ফলে। প্রায় দেড়শো বছর পর প্রতিষ্ঠিত সত্যকে ঘিরে নতুন তথ্য হাজির করছেন কিছু লোক। কোনো গবেষণায় নয়, কোনো প্রকাশনায় নয়, এমনকি কোনো বিতর্ক সভায়ও নয়। তারা এটা করছেন ‘সোস্যাল মিডিয়া’ বলে কথিত অবারিত এক মাধ্যমে, ফেসবুক-সহ অন্যত্র। এ এক বিচিত্র জগত। বিশাল এর পর্দা, নিমিষে তা ছড়িয়ে যায় আঙুলের এক চাপে। তারপর ‘লাইক’ আর ‘শেয়ার’-এর কসরত। কোনো বাছ-বিচারের বালাই নেই, সত্য-অসত্যের যাচাই নেই। হুমড়ি খেয়ে পড়ছে একদল মানুষ, ছুটছে বেদম, বলছে, বাহ্, চমৎকার তো, মারহাবা মারহাবা!

আমি দেখছি, ফেসবুকের সেই ‘ফেসলেস’ কতিপয় মানুষ লিখছেন, “গিরিশচন্দ্র সেন কোরআনের অনুবাদক নন, প্রকাশক।” লিখছেন, “এতদিনে সত্যটা প্রকাশ পেল কোরআনের বাংলা অনুবাদক নিয়ে।” লিখছেন, “হিন্দু গিরিশচন্দ্র নয়, কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক মুসলমান…।” আমি অবাক হই। এমন যেসব লিংকের দেখা পাই, সবিনয়ে দুই কথা লিখি, সম্বিৎ ফেরাতে চাই। কিন্তু না, তাতে কি ফেরেন তারা? ক’দিন পরপর একই পোস্ট দিতে থাকেন। সেই গোয়েবলসের কৌশলের মতো। একটা মিথ্যাকে বারবার প্রচার করলে অনেক মানুষ একেই সত্য বলে ভাববে। এমনটাই আমি এখন দেখছি। আমার পরিচিতজনদের মধ্যেও কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয়ে আমাকে প্রশ্ন করেন, আসলেই কি তা?

ফেসবুকের তেমন একটি অপলাপ নমুনা হিসেবে তুলে ধরছি এখানে। শিরোনাম ‘একটি ভুলের নিরসন : গিরিশচন্দ্র সেন বাংলা ভাষায় কোরআন শরীফের অনুবাদক নন’। লেখাটি এখানে সংক্ষেপে উদ্ধৃত করছি :

“সর্বপ্রথম অনুবাদ করেন মাওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়া। তারপর মৌলভী নাইমুদ্দীন। গিরিশচন্দ্র হচ্ছেন প্রকাশক। সুতরাং কুরআন শরীফের প্রথম বাংলা অনুবাদক গিরিশ চন্দ্র নন। আরবি জানেন না, আরবি ব্যাকরণ জানেন না, এমন ব্যক্তি কুরআন অনুবাদ করেছেন— এমন প্রচার মূর্খতা।”

এই প্রচারে ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের কীর্তিকে শুধু অস্বীকারই করা হয়নি, তাঁকে তঞ্চকতার দায়ে অভিযুক্তও করা হয়েছে। আর এই পোস্টের নিচে বলা হচ্ছে, যতো পরিমাণে সম্ভব পোস্টটি শেয়ার করুন, অন্যকে জানার সুযোগ করে দিন। আহ্বানটি এমন যেন শেয়ার করে সাচ্চা মুসলমানিত্বের দায়িত্ব সারলেন।


অনুবাদ তো ভাষান্তর। এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায়। কোরআনের এমন ভাষান্তর বাংলায় সার্থকভাবে করেছেন ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। বহুকাল এই সত্য নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। এখন যাঁদের নাম উল্লেখ করে প্রচার শুরু, তাঁদের বিষয়ে একটু আলোকপাত করতে চাই।

আমীরুদ্দীন বসুনিয়া রংপুরের মানুষ। তিনি পুঁথি সাহিত্যের ভাষায় কোরআনের শেষ পারা ভাবানুবাদ করেছিলেন। কোরআনের শেষ পারাটি হচ্ছে ছোটো আকারের বেশ কয়েকটি সুরার সমষ্টি। এর অনেকগুলো নামাজি মুসলমানদের মুখস্থ থাকে। তিনি তেমন সুরাগুলোর তর্জমা পুঁথির ছন্দে লিখেছিলেন। ঐ-সময় এই অংশ নিয়ে তিনি ছাড়াও পুঁথির ভাষায় লেখেন জনৈক আকবর আলী। উল্লেখ্য যে, এই কাজে এই দুজনই প্রথম নন। তারও বহু আগে কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর কোরআনের একটি সুরায় বর্ণিত কাহিনি অবলম্বনে ‘ইউসুফ জুলেখা’ কাব্য লেখেন। পরবর্তীকালের কবি কাজী নজরুল ইসলামও কোরআনের প্রথম সুরা ‘ফাতিহা’ ও শেষদিকের সুরা ‘এখলাস’-এর অনুবাদ করেন কবিতার মতো করে। প্রশ্ন করা যেতে পারে, এসবকেই কোরআনের অনুবাদ বলা যাবে কি? পুঁথির ভাষায় কিংবা কবিতার ছন্দে সামান্য অংশবিশেষ লিখেই কি কোরআনের অনুবাদক হওয়া সম্ভব? তাঁদেরকে কি সম্পূর্ণ কোরআনের অনুবাদক বলা যায়?

জবাব হচ্ছে, না, তা বলা যায় না। হয়তো খণ্ডিতভাবে এমন অনুবাদ বা ভাবানুবাদ করে থাকবেন আরো অনেক ধর্মপ্রাণ। হয়তো-বা কোনো ইসলাম বিরোধীও। তাদের কেউ কোনোভাবেই সম্পূর্ণ কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক বলে বিবেচিত হতে পারেন না। যেটুকু কাজ তাঁরা করেছেন, সেটুকুর স্বীকৃতি ও মর্যাদা তাঁরা নিঃসন্দেহে পেতে পারেন। কিন্তু যা করেননি, তার কৃতিত্ব কী করে পাবেন?

টাঙ্গাইলের মানুষ মৌলভী নইমুদ্দীনকে এই কৃতিত্ব যারা দিতে চান, তারা সন তারিখের ভুল তথ্য দিচ্ছেন। এছাড়া তথ্য তল্লাশিতে বেরিয়ে এসেছে যে, তিনি কয়েক পারা মাত্র অনুবাদ করতে পেরেছিলেন, সম্পূর্ণটা নয়। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্রগণ আরো কয়েক পারা অনুবাদ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এর বেশি নয়। মৌলভী নইমুদ্দীন আর গিরিশচন্দ্র সেন সম-সাময়িক। অথচ প্রচারকেরা দাবি করছেন, গিরিশচন্দ্র সেনের জন্মের আগেই তিনি অনুবাদ সম্পন্ন করেছেন। টাঙ্গাইলের মানুষ হিসেবে ‘বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার, টাঙ্গাইল’-এ মৌলভী নইমুদ্দীন সম্পর্কে যে-বিবরণ ছাপা হয়েছে, তাতে তাঁর এই অনুবাদের সময়কাল ১৮৯২ থেকে ১৯০৮ সাল মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই হিসেবে তিনি ভাই গিরিশচন্দ্র সেন কর্তৃক প্রথম খণ্ডের অনুবাদ প্রকাশের অন্তত ১১ বছর পর এই কাজটি করেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া যায়।


কোরআনের বাংলা অনুবাদ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে অনেকেই গবেষণা করেছেন, অনেকেই বই লিখেছেন। এপার-ওপার উভয় বাংলায়। বই লিখেছেন ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়েও। আমি নিজেও একটি বই লিখেছি তাঁকে নিয়ে। আমার এই যৎকিঞ্চিত জ্ঞানের কথা বাদ দিলেও বহু জ্ঞানী-গুণীর উদাহরণ টানা যায় এক্ষেত্রে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক অমলেন্দু দে, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল অদুদ, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান, অধ্যাপক অমিত দে, মোফাখখার হুসেইন, ড. সফিউদ্দিন আহমদ ও কবি আবদুল কাদিরসহ বিশিষ্টজনের লেখায় ও গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ভাই গিরিশচন্দ্র সেনই বাংলা গদ্যে পবিত্র কোরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদক।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মুজীবুর রহমানের পিএইচডি থিসিসের বিষয়বস্তু ছিলো ‘বাংলা ভাষায় কোরআন চর্চা’। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-কোরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সাবেক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল অদুদেরও পিইচডি থিসিস ‘বাংলা ভাষায় কোরআন চর্চা’। মোফাখখার হুসেইন রচিত গবেষণা গ্রন্থ ‘পবিত্র কুরআন প্রচারের ইতিহাস ও বঙ্গানুবাদের শতবর্ষ’। অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদের গবেষণা সমৃদ্ধ বইয়ের শিরোনামই হচ্ছে ‘কোরানের প্রথম অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন’। এর প্রতিটিতেই একই সত্য প্রতিষ্ঠিত যে, প্রথম সম্পূর্ণ কোরআনের বাংলা অনুবাদক আর কেউ নন, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন।


কোরআন এক মহাগ্রন্থ। ঐশ্বরিক গ্রন্থ। কোরআন বলছে, এর বাণী গোটা মানবজাতির উদ্দেশ্যে, মানবজাতির পথ প্রদর্শনের জন্যে। কোরআন যাঁর মাধ্যমে নাজিল হয়েছে, সেই রসুল মোহাম্মদ (সা.) বিদায় হজ্জের ভাষণে এর বাণী ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান রেখেছেন। স্বয়ং আল্লাহতায়ালা ও রসুল (সা.)-এর যখন এমন ঘোষণা, তখন কোরআনের অনুবাদক ব্রাহ্ম নাকি হিন্দু, এমন সংকীর্ণ চিন্তা আদৌ শোভা পায় কি? না, মোটেই নয়। ভিন্ন ভিন্ন ভাষার মানুষের বোঝার জন্যে অনুবাদ একটি অপরিহার্য বিষয়। বাংলাভাষীদের জন্যে ভাই গিরিশচন্দ্র সেন এই কাজটি করেছেন প্রথম। কিন্তু তাতেই কি শেষ? না, তা-ও নয়। পরবর্তীকালে আরো অনেকেই বাংলায় অনুবাদ করেছেন। এখনো অনেকে করছেন। ভবিষ্যতেও হয়তো করবেন। কিন্তু প্রথমে যিনি অনেক প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে এই দুরূহ কাজটি করলেন, তাঁকে সেই স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা কেন কারো কারো, তা বোধগম্য নয়। অমুসলিমের দ্বারা এই মহৎকর্ম, সে-কারণেই কি? এমনটা হলে তা সত্যিই দুঃখজনক, মুসলমানদের জন্যেও লজ্জাজনক। যাঁদের নাম উল্লেখ করে, যাঁদেরকে এই কৃতিত্বের মুকুট পরাতে এই কসরত, তাঁরা নিজেরাও পরলোকে থেকে লজ্জায় কুণ্ঠিত হবেন নিশ্চয়ই। তাঁরা কেউ জীবদ্দশায় এমনটা কখনো দাবি করেননি। তাঁদের অনূদিত গ্রন্থ এ-দেশের কোনো প্রাচীন লাইব্রেরি বা আর্কাইভে আছে, তেমনটাও জানা নেই। অথচ ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের অনূদিত প্রথম খণ্ড সেই কালেই ক্যাটালগিং হয়ে আছে বেঙ্গল লাইব্রেরিতে। ক্যাটালগ নম্বর ৭৬৫৯-৬০। ১৮৮২ সালের ঐ-লাইব্রেরির ত্রৈমাসিক বিবরণীতে ইংরজিতে লেখা আছে, “এই বইটি আরবি থেকে বাংলায় অনূদিত কোরআনের প্রথম খণ্ড। অনুবাদক আশা করছেন ১২ খণ্ডে তিনি এর অনুবাদ শেষ করতে সক্ষম হবেন।”

আরো উল্লেখ করতে চাই, ভাই গিরিশচন্দ্র সেনই কোরআনের একমাত্র অমুসলিম অনুবাদক নন। আরো অনেক অমুসলিম এর অনুবাদ করেছেন গ্রিক, ল্যাটিন, চীনা, রুশ, চেক ও ইংরেজিসহ পৃথিবীর নানা ভাষায়। এতে করে ঐসব ভাষাভাষী মানুষ কোরানের বাণী পড়ার ও বোঝার সুযোগ পেয়েছে। আর বাংলায় ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের অনুবাদেই প্রথম কোরআন পাঠ হয়েছে বাংলা ভাষাভাষী অসংখ্য মানুষের। এ কি কম কথা! এজন্যে মুসলমানদের গর্বিত হওয়া উচিত।

কোরআন অনুবাদই নিঃসন্দেহে তাঁকে ব্যাপক পরিচিতি দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন এর চেয়ে ঢের বড়ো মাপের কিছু। সাদা মনের মানুষ। বাংলা গদ্যরীতিতে নিজস্ব স্টাইল তৈরি করা সুসাহিত্যিক, একান্ত নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিক, সংবাদপত্রের সম্পাদক, নারী শিক্ষার অগ্রদূত। তাঁর দ্বারা পাঁচদোনায় প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়টি ছিলো এই অঞ্চলে নারী শিক্ষার প্রথম দীপশিখা। তাঁর জীবনকালব্যাপী চল্লিশ বছর আলো জ্বালিয়েছে এই বিদ্যালয়। ময়মনসিংহের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়টিও তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ বিদ্যালয়ে তিনি বিনা বেতনে শিক্ষকতাও করেন। জীবন সায়াহ্নে তিনি তাঁর পৈতৃক সহায়-সম্পত্তি পাঁচদোনার মানুষের কল্যাণে ব্যয়ের জন্যে উইল করে দিয়ে যান।


আগস্ট মাসের ১৫ তারিখ এই মহতী মানুষটির মৃত্যু দিবস। আমি তাঁকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। তাঁর অমর কীর্তি বিরোধী সকল অপলাপ, অপপ্রচার বন্ধ হোক। সত্য চিরভাস্বর হয়ে থাকুক। এমনটাই প্রত্যাশা আমার।


সিরাজ উদ্দিন সাথী
প্রাবন্ধিক, গবেষক ও ‘ভাই গিরিশচন্দ্র সেন : জীবন ও তৎকালীন সমাজ’ গ্রন্থের রচয়িতা

মো. জালাল উদ্দিন : বিরলপ্রজ এক নাট্যকার

আমরা দেখি, শেক্সপিয়রীয় নাটকে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে অতিপ্রাকৃত উপাদান ও অনুষঙ্গ। গ্রিক নাটকে দেব-দেবীর প্রভাব ও পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্য বা নিয়তি পরিলক্ষিত হয় প্রবলভাবে। জর্জ বানার্ড ’শ-র নাটকে দেখি যুদ্ধ, রাজনীতি ও ধর্মদ্বন্দ্বের প্রবল প্রভাব, তবে আইরিশ এই নাট্যকার নরওয়েজিয়ান নাট্যকার হেনরিক ইবসেন দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন। আমেরিকার নাট্যকার ইউজিন তাঁর নাটকে তুলে ধরেছেন মোহ ও নৈরাশ্য কাটিয়ে ওঠার সংগ্রাম, আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের সংগ্রাম। স্যামুয়েল বাকেটের নাটকে দেখি হাস্যরস, মানসিক উৎকণ্ঠা, মনোজাগতিক সংকট। আর আধুনিক নাটকের জনক নরওয়েজিয়ান নাট্যকার হেনরিক ইবসেন। তিনি তাঁর নাটকে তুলে ধরেছেন বাস্তববাদ, সামাজিক মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও বিচার।

তবে এই উপমহাদেশে নাটকের চেয়ে অনেক পুরোনো সাহিত্যকর্ম হলো বিভিন্ন পালা। বিশেষ করে মিথ নির্ভর পালাগুলো অত্যন্ত প্রাচীন। অষ্টম ও নবম শতকে এ-দেশে পালাগান ও পালার অভিনয় বেশ প্রচলিত ছিলো। শ্রী চৈতন্যদেবের আর্বিভাবের আগে রাঢ়, বঙ্গ, সমতট, গৌড়, পুণ্ড্র, চন্দ্রদ্বীপ, হরিকেল, শ্রীহট্টসহ সমগ্র ভূ-খণ্ডে পালাগান ও কাহিনিকাব্যের অভিনয় প্রচলিত ছিলো। ধর্মীয় বা কোনো উৎসবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার যে-রীতি, সেখান থেকেই যাত্রা শব্দটি এসেছে। এ-দেশে প্রাচীনকালে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি অভিনয় করে দেখানো হতো। সেখান থেকেই যাত্রার উৎপত্তি।

এই উপমহাদেশে নাটক বলি, যাত্রা বলি বা চলচ্চিত্র বলি, এসবের অগ্রপথিক ছিলেন হীরালাল সেন (১৮৬৬-১৯১৭)। মানিকগঞ্জে জন্ম নেয়া এই বিরল নাট্যপ্রতিভা কলকাতায় ঊনিশ শতকের শেষদিকে নাটক ও চলচ্চিত্রের গোড়াপত্তন করেছিলেন। তিনি প্রথমে মিথনির্ভর পালা তৈরি করেন। তিনিই প্রথম এই উপমহাদেশে বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণ করেছিলেন।

ঊনবিংশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে যাত্রায় দেশপ্রেমমূলক কাহিনি শুরু হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা রেখেছেন মুকুন্দ দাস। তিনি নাটক ও যাত্রার মাধ্যমে দেশপ্রেম ও ব্রিটিশ বিরোধী চেতনা তুলে ধরেন। পরে আমরা দেখেছি, কৃষ্ণকমল গোস্বামী, মনোমোহন বসু, নফরউদ্দিন, মীর মশাররফ হোসেন রূপকথাভিত্তিক অনেক পালা রচনা করেছেন। সত্তর দশক থেকে নব্বইয়ের দশকে গ্রামে-গঞ্জে অনেক পালাশিল্পী বহু পালা করেছেন এবং তারা সফলভাবে এসব পালা মঞ্চস্থ করে দর্শকমহলে বেশ সাড়াও ফেলেছিলেন। তাদের মধ্যে চট্টগ্রামের অমলেন্দু বিশ্বাস, মানিকগঞ্জের ধানেশ্বরের আব্দুল করিম, নরসিংদীর মো. জালাল উদ্দিন, হীরেন্দ্র কৃষ্ণ দাস, সন্তোষ শীল, অনুপ ভৌমিক, মুন্সিগঞ্জের রফিকুল, পটুয়াখালীর সেকান্দর মাস্টার, খুলনার ডুমুরিয়ার এম এ মজিদ, ময়মনসিংহের নান্দাইলের কফিল উদ্দিন ও মানিকগঞ্জের ডা. আবেদ আলী অন্যতম। তাদের সম-সাময়িক অনেক আধুনিক নাট্যকার মঞ্চনাটক ও থিয়েটার আন্দোলন করে সারা দেশে খুব সাড়া ফেলেছেন। তাদের মধ্যে নাট্যকার সেলিম আল দীন, মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, মামুনুর রশীদ ও সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ অন্যতম। তাদের নাটকে উঠে এসেছে শ্রেণি-সংগ্রাম, ভুখা-নাঙ্গা মানুষের আকুতি ও রাষ্ট্রীয় শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস। তবে তাদের নাটকের ভাষা,    প্রকাশভঙ্গি ও আবহ বোঝার সাধ্য গ্রামের সাধারণ জনগণের কমই ছিলো। গ্রামের শ্রমজীবী মানুষ, সহজ-সরল মানুষের বিনোদন হলো অনেক আওয়াজে, অনেক আলোতে, অনেক দর্শকের সামনে মঞ্চায়িত যাত্রাপালা, বাউল গান, কীর্তন ও জারি-সারি গান।

বাংলাদেশের যাত্রাশিল্প নিয়ে কথা বলতে গেলে নরসিংদীর মো. জালাল উদ্দিনের কথা বলতে হয়। তিনি এক বিরলপ্রজ নাট্যকার, যাত্রাপালা রচয়িতা ও নাট্য নির্দেশক। মো. জালাল উদ্দিনের জন্ম ১৯৩৯ সালের ১২ জানুয়ারি, নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার হাইরমারা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম হাজী নায়েব আলী ও মাতার নাম জামিলা খাতুন। পিতা হাজী নায়েব আলী ছিলেন পরহেজগার, সচ্ছল ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। মো. জালাল উদ্দিন ছাত্রাবস্থায় নাটক লিখে হাত পাকান। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনো বিশ-বাইশ বছরের ছেলেকে গ্রামের মানুষের অভিযোগে ত্যাজ্য করতে চেয়েছিলেন পিতা হাজী নায়েব আলী। গ্রামের মানুষ তখন বলছিলো, “আপনি নামাজ পড়েন, হজ্ব করেছেন, ইমানদার লোক, অথচ আপনার ছেলেটা নাটক করে বেড়ায়, এটা কেমন কথা?”

মানুষের এসব অভিযোগে পিতা অতিষ্ঠ হয়ে একদিন খুব চুপিসারে পুত্রের নাটকের রিহার্সেল দেখলেন। নাটকের নাম ছিলো ‘গাঁয়ের বুকে’। পিতা হাজী নায়েব আলী খুব মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলেন, নাটকটিতে বা যাত্রাপালাটিতে খারাপ কিছু করা হচ্ছে না, বরং নাটকে তুলে ধরা হয়েছে তৎকালীন সামাজিক অবিচার-অনাচার, কুসংস্কার ও নানা অসঙ্গতি। সেই থেকে এক অদৃশ্য পারিবারিক সনদ যেন পেয়ে যান নাট্যকার মো. জালাল উদ্দিন। মো. জালাল উদ্দিনের শৈশব গ্রামীণ গন্ধ ও বাতাস মাখা, দুরন্তপনায় ঠাসা। জন্ম হাইরমারা গ্রামে হলেও তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়েছে চরসুবুদ্ধি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, তারপর পড়ালেখা করেন চরসুবুদ্ধি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তিনি কিছুদিন পড়াশোনা করেছেন কিশোরগঞ্জের কটিয়াদির  আচমিতা উচ্চ বিদ্যালয়ে, খালার বাসায় থেকে। তারপর মেট্রিকুলেশন পাশ করার পর ভর্তি হন নরসিংদী সরকারি কলেজে। নরসিংদী কলেজে পড়ার সময় তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের নাট্য ও প্রমোদ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ঐ-সময় কলেজ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম নাটক ‘অপ্রত্যাশিত’। সেই থেকেই নাট্যজগতে তাঁর শুভযাত্রা। তারপর তিনি রচনা করেন সমাজ সংস্কারমূলক নাটক ‘গাঁয়ের বুকে’, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক ‘দুই ভাই’, ‘রক্তরাঙা বাংলাদেশ’ ইত্যাদি। এমনকি সত্যজিৎ রায়ের মতো নারী বিবর্জিত নাটকও রচনা করেছেন তিনি।

নাট্যজগতে কাজ করতে গিয়ে জীবনের চড়াই-উৎরাইয়ে তিনি একসময় যাত্রাশিল্পের সঙ্গে যুক্ত হন এবং বেশ কিছু যাত্রাপালা রচনা করেন। তাঁর রচিত যাত্রাপালাগুলোর মধ্যে ‘ভিখারীর ছেলে’ খুবই জনপ্রিয় পালা, যার মুদ্রণ সংখ্যা আট লক্ষেরও বেশি। এই যাত্রাপালাটি বাংলাদেশের বাইরে আসাম ও কলকাতায়ও মঞ্চস্থ হয়েছিলো। তাঁর রচিত নাটক ও যাত্রাপালার মধ্যে ‘গাঁয়ের বুকে’, ‘ভিখারীর মেয়ে’, ‘ভিখারীর ছেলে’, ‘দুই ভাই’, ‘রাজরক্ত’, ‘রাজ্যহারা’, ‘মালির ছেলে’, ‘রক্তরাঙা বাংলাদেশ’, ‘কিছু খেতে দাও’, ‘মাঝির মেয়ে’, ‘কুসুম তারা’, ‘প্রীতিবন্ধন’, ‘রঙিলা একটি মেয়ের নাম’, ‘ডাকাত’, ‘লুণ্ঠিত দেবমন্দির’ ও ‘অনেক আঁধার’ অন্যতম। তিনি যাত্রাপালা পরিষদের সভাপতিও ছিলেন।

তিনি নরসিংদী গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের অগ্রপথিক। তিনি নরসিংদী গ্রুপ থিয়েটারের গোড়াপত্তন করেছিলেন। নরসিংদীর প্রথমদিকের গ্রুপ থিয়েটার সংগঠন ‘তরঙ্গ নাট্যগোষ্ঠী’, ‘কল্লোল নাট্য সংস্থা’ ও ‘সাম্প্রতিক নাট্যগোষ্ঠী’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি।

বিশাল সংসারের (৮ ছেলে, ৫ মেয়ে) চাকা সচল রাখতে ছুটেছেন দিগ্বিদিক। কিছুদিন কাজ করেছেন চলচ্চিত্র সাংবাদিক হিসেবে। জনপ্রিয় চলচ্চিত্র পরিচালক ইবনে মিজানের সহকারী হয়ে কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে। নাট্য নির্দেশনা ও যাত্রাপালা পরিচালনার পাশাপাশি ‘মঞ্চরূপা’ নামে একটি দোকান ছিলো তাঁর, যেখান থেকে তিনি মঞ্চনাটক ও যাত্রাপালার সরঞ্জামাদি ভাড়া দিতেন। নাটক ও যাত্রাপালা নির্দেশনা ও পরিচালনা করে কিছু অর্থ পেতেন আর নাটক ও যাত্রাপালার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভাড়া দিয়ে কিছু আয় করতেন। তাই এই নাট্যকারের সংসার জীবন তেমন সচ্ছল ছিলো না। তবে তাঁর ছেলেমেয়েরা কেউ সঙ্গীতশিল্পী, কেউ অভিনেত্রী, কেউ তালযন্ত্রী, কেউ সাউন্ড ডিরেক্টর হওয়ায় তারা সংসারের কিছুটা আর্থিক দুরবস্থা দূর করেছেন। তাই তাঁর পরিবারকে বলা যায় একটি আদর্শ সংস্কৃতি ঋদ্ধ পরিবার।

মো. জালাল উদ্দিন শেষ বয়সে বেশ কিছু সমাজহিতৈষী কাজ করেছেন। প্রায় একক প্রচেষ্টায় নিজ এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেছেন চরসুবুদ্ধি জুনিয়র স্কুল। নির্মাণ করেছেন দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। এলাকায় শিক্ষা বিস্তারে ও আর্ত মানবতার সেবায় হাত প্রসারিত করেছেন বারবার। তাঁর কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এসবের মধ্যে নরসিংদী মুক্তধারা নাট্য সম্প্রদায় সম্মাননা ১৯৯৫, অধ্যাপক শাহ হালীমুযযামান সম্মাননা ২০১২, বেলাব কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ গুণীজন সম্মাননা ২০১২, যাত্রাপালা সম্রাট ব্রজেন্দ্র কুমার দে স্মৃতি পদক ২০১৩, নরসিংদী শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক নাট্যাঙ্গন সম্মাননা ২০১৫, নরসিংদী ব্যান্ড মিউজিক এসোসিয়েশন সম্মাননা ২০০৯, নরসিংদী নীলাম্বরী ললিতকলা একাডেমি সম্মাননা ২০১৪, রায়পুরা চরসুবুদ্ধি ইউনিয়ন পরিষদ সম্মাননা ২০১৫ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আরো পেয়েছেন নরসিংদী জেলা গ্রুপ থিয়েটার সম্মাননা ও স্বরলিপি শিল্পীগোষ্ঠী সম্মাননা।

তিনি বহুবার ঢাকা শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক মঞ্চায়নে নরসিংদীর প্রতিনিধিত্ব করে পুরস্কৃত হয়েছেন। তাঁর অনেক নাটক সারা দেশে মঞ্চস্থ করার জন্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সেন্সরবোর্ড অনুমতি দিয়েছে। তাঁর বড়ো ছেলে শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া লিটন জানান, “বাবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই, দলিল, পাণ্ডুলিপি ভর্তি একটি ট্রাংক চুরি হয়ে যাওয়াতে আমাদের পরিবারের বিশেষ ক্ষতি হয়ে গেছে।”

মহান নাট্যকার ও যাত্রাশিল্পী মো. জালাল উদ্দিন নরসিংদী তথা সারা বাংলাদেশের গর্ব। তিনি ২০১৯ সালের ২২ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।


মহসিন খোন্দকার
কবি ও ছড়াকার

মহেশ্বরদী প্রতিভা : ইতিহাসবিদ-শিক্ষাবিদ ত্রৈলোক্যনাথ ভট্টাচার্য

0

পবিত্র কোরআন শরীফ সর্বপ্রথম বঙ্গানুবাদ (তরজমাসহ) করার কারণে ভাই গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৫-১৯১০) ও তাঁর জন্মস্থান পাঁচদোনা গ্রামটি একই সঙ্গে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।  যারা গিরিশচন্দ্রের নাম জানেন, তারা পাঁচদোনার নামও জানেন। কিন্তু এই গ্রামের সবচে’ প্রাচীন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন রাজা দর্পনারায়ণ রায়। তিনি মুর্শিদাবাদে নবাব আলীবর্দী খানের সময়ে দেওয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। নবাব কর্তৃক ‘রাজা’ উপাধিপ্রাপ্ত হয়ে পাঁচদোনা এলাকায় জমিদারির বন্দোবস্ত পেয়েছিলেন। তাঁরই বংশধর ছিলেন ভাই গিরিশচন্দ্র সেন।

সেই একই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলার আরেক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসবিদ ত্রৈলোক্য চন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য (১৮৬০-১৯০০)। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অসংখ্য ইতিহাসাশ্রিত প্রবন্ধ লিখে অমর হয়ে আছেন। বিশেষ করে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক লেখালেখিতে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন।

‘সাহিত্য’, ‘আরতি’, ‘নব্যভারত’, ‘সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা’, ‘মর্নিং পোস্ট’ প্রভৃতি খ্যাতনামা পত্রিকায় লেখালেখি  করেছেন আমৃত্যু। একই সঙ্গে বৃটিশ প্রশাসনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকুরি করেছেন। এর আগে বিএল পাশ করে আইন পেশায়ও জড়িয়েছিলেন। ছিলেন বরিশালের বিখ্যাত ব্রজমোহন স্কুলের হেডমাস্টার।

সাহিত্য ও ইতিহাস চর্চায় ছিলেন নিবেদিত। কলকাতার ‘নব্যভারত’ পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক দেবী প্রসন্ন রায়, ‘সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা’র ক্ষেত্রপাল চক্রবর্তী, ‘আরতি’র সম্পাদক সারদাচরণ ঘোষ প্রমুখের সঙ্গে ত্রৈলোক্যনাথ ভট্টাচার্যের গভীর সম্পর্ক ছিলো। ‘আরতি’ পত্রিকাটি ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত হতো। অপরদিকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা’য় তাঁর সঙ্গে লেখালেখি করতেন অচ্যুতচরণ চৌধুরী, অমূল্যচরণ ঘোষ, চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, দীনেশ ভট্টাচার্য, নগেন্দ্র নাথ বসু, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দীনেশ চন্দ্র সেন প্রমুখ।

‘আরতি’ ছিলো ময়মনসিংহের কেদারনাথ মজুমদারের প্রতিষ্ঠিত মাসিক সাহিত্য পত্রিকা। তিনি ‘সৌরভ’ পত্রিকা প্রকাশ করে খ্যাতিমান হয়েছিলেন। সৌরভ ছিলো তাঁর ছেলের নাম। আর আরতি ছিলো মেয়ের নাম। দুজনেরই অকালমৃত্যু হয়েছিলো। সন্তানের মৃত্যুশোক ভুলে থাকার চেষ্টা করেছিলেন পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে। তৎকালীন সময় বাংলা ভাষার সব বিখ্যাত লেখকেরা তাঁর ‘সৌরভ’ ও ‘আরতি’ পত্রিকায় লেখালেখি করেছিলেন।

বর্তমান প্রজন্মের কাছে ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক ত্রৈলোক্যনাথ ভট্টাচার্য প্রায় বিস্মৃত হয়ে গেছেন। নিজ দেশ তো বটেই, এমনকি জন্মভূমি নরসিংদীর পাঁচদোনায় পর্যন্ত তিনি অবহেলিত। ১২৪ বছর আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর ১০ বছর পর গিরিশচন্দ্র সেন মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু গিরিশ সেনকে নিয়ে আলোচনা থাকলেও ত্রৈলোক্যনাথকে সবাই ভুলে যান। তাই এই বিস্মৃত ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদকে জানার জন্যে আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। আশা করি আমার পথ ধরে গবেষক-লেখকেরা এগিয়ে এসে লেখক ও মনীষী ত্রৈলোক্যনাথ ভট্টাচার্যকে নিয়ে লেখালেখি করবেন।

তাঁর জন্ম ২১ জ্যৈষ্ঠ ১২৬৭ বঙ্গাব্দ (১৮৬০), ঢাকা জেলার মহেশ্বরদী পরগণার পাঁচদোনা গ্রামে। পিতা ব্রজনাথ ভট্টাচার্য, মাতা ব্রহ্মময়ী দেবী। সাত বছর বয়সে পিতৃহীন ত্রৈলোক্যনাথ ভীষণ দারিদ্র্যের মধ্যেও পড়াশোনা করে পাঁচদোনা মধ্য-বাংলা স্কুল থেকে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় পাশ করেন (১৮৭১)। বৃত্তি পেয়ে কোনো চতুষ্পাঠীতে ভর্তি হওয়ার বদলে তিনি ইংরেজি পড়তে চাওয়ায় তাঁর মা জিনিসপত্র বিক্রি ও ধার করে তাঁকে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে পাঠান। সেখান থেকে প্রথম শ্রেণিতে এন্ট্রান্স ও ঢাকা কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে এফএ পাশ করে তিনি কলকাতায় জেনারেল এসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনে (এখন স্কটিশচার্চ কলেজ) বিএ পড়েন। এখানে গিলক্রাইস্ট বৃত্তি পরীক্ষায় সংস্কৃত প্রশ্নের উত্তর বাংলা অক্ষরে লেখার জন্যে তা বাতিল হয়। প্রথমবার তিনি বিএ পাশ করতে পারেননি।

ইতোমধ্যে কুমিল্লায় মহারাজার স্কুলে হেডমাস্টার পদে আবেদন করেন এবং নিযুক্ত হন। এখান থেকে দ্বিতীয়বার বিএ পরীক্ষা দেন, কিন্তু অকৃতকার্য হন। কিছুদিন পর ময়মনসিংহ জেলার সুসং দুর্গাপুর স্কুলে হেডমাস্টার হয়ে আসেন। কিন্তু তাঁর বিএ পাশ করার জেদ অটুট ছিলো। বন্ধুকে বলতেন, “বি-এ পাশ না করিয়া বাঁচিয়া থাকা বিড়ম্বনা।” এরপর ঢাকা রূপরঘু স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদ নেন। এখান থেকে তৃতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাশ করেন।

তাঁর সংস্কৃতের খাতা দেখে পরীক্ষক মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন তাঁকে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে বৃত্তি নিয়ে এমএ পড়বার আমন্ত্রণ জানান। সেখান থেকেই সংস্কৃত সাহিত্যে এমএ (১৮৮৫) পাশ করে ত্রৈলোক্যনাথ বরিশাল ব্রজমোহন ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দেন। সঙ্গে সঙ্গে বিএল পরীক্ষার জন্যেও তৈরি হন। বিএল (১৮৮৬) পাশ করে ওকালতি শুরু করেন ঢাকায়। প্রায় দুই বছর পর আবগারি বিভাগের সাব ডেপুটি কালেক্টর হয়ে ছাপরা যান (১৮৮৯)। তিন বছর পর সে-কাজে বিরক্ত হয়ে বদলির আবেদন করে গয়া জেলার নোয়াদায় খাসমহালের কাজে যোগ দেন। পরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে উন্নীত হয়ে গয়া সদরে আসেন। পরের বছর গয়ায় প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। ফলে ত্রৈলোক্যনাথকে মজফ্ফরপুরে বদলি করা হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। মজফ্ফরপুর পৌঁছাবার পরের দিন, ১ অগ্রহায়ণ ১৩০৭ (১৯০০) জ্ঞানেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে প্লেগেই তাঁর মৃত্যু হয়।

অর্থাভাব ও অস্থির কর্মজীবনেও ত্রৈলোক্যনাথ ইতিহাস ও সাহিত্যের চর্চা করে গিয়েছেন সারা জীবন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিলো প্রত্নতত্ত্ব। এ-বিষয়ে ‘নব্যভারত’, ‘সাহিত্য’, ‘আরতি’ ‘সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা’ এবং কলকাতার ইংরেজি দৈনিক ‘মর্নিং পোস্ট’ প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে ‘নেপালের পুরাতত্ত্ব’ লিখে বিশেষ তৃপ্তি পান। ‘সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম ভাগ’ (১৮৮৮), ‘বিদ্যাপতি ও অন্যান্য বৈষ্ণবকবিগণের জীবনী’, ‘ঐতিহাসিক প্রবন্ধমালা, প্রথম ভাগ’ (১৮৯৬), ‘পাঠমালা’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বহু প্রাচীন সংস্কৃত বই এবং ভারত-ইতিহাস বিষয়ে অনেক বই ও পত্রিকায় সমৃদ্ধ একটি ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারও তিনি উত্তরকালের জন্যে রেখে যান।

নিচে তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধ ও নিবন্ধের তালিকা দেয়া হলো :

বঙ্গে সংস্কৃত-চর্চ্চা। নব্যভারত। কার্তিক ১২৯৩, পৃষ্ঠা ৩১১-৩২২; পৌষ ১২৯৩, পৃষ্ঠা ৪০৬-৪২৯; বৈশাখ ১২৯৪, পৃষ্ঠা ৪০-৪৩; আষাঢ় ১২৯৪, পৃষ্ঠা ১৪৩-১৪৫; শ্রাবণ ১২৯৪, পৃষ্ঠা ১৫৫-১৬২; অগ্রহায়ণ ১২৯৪, পৃষ্ঠা ৪০৩-৪১২; পৌষ ১২৯৪, পৃষ্ঠা ৪৬২-৪৬৯; ফাল্গুন ১২৯৪, পৃষ্ঠা ৫৭৪-৫৭৮; চৈত্র ১২৯৪, পৃষ্ঠা ৬২৮-৬৩৯; জ্যৈষ্ঠ ১২৯৫, পৃষ্ঠা ৬৬-৭২; আশ্বিন ১২৯৫, পৃষ্ঠা ৩১৭-৩২৯; শ্রাবণ ১২৯৬, পৃষ্ঠা ১৬৯-১৭৯; আশ্বিন ১২৯৬, পৃষ্ঠা ৩৩৫-৩৫১।

বাসবদত্তাকার সুবন্ধু। নব্যভারত। অগ্রহায়ণ ১২৯৩, পৃষ্ঠা ৩৫৭-৩৫৯।

আর্য্যদিগের ধর্মশাস্ত্র। নব্যভারত। ফাল্গুন ১২৯৩, পৃষ্ঠা ৫০১-৫০৬; চৈত্র ১২৯৩, পৃষ্ঠা ৫২৯-৫৩৭।

বৈদিক সাহিত্য। নব্যভারত। ভাদ্র ১২৯৪, পৃষ্ঠা ২৩৯-২৫৩; বৈশাখ ১২৯৮, পৃষ্ঠা ৪৩-৫২।

ঢাকার পুরাতন কাহিনী। নব্যভারত। জ্যৈষ্ঠ ১২৯৭, পৃষ্ঠা ৬৩-৭৬।

গৌড়েশ্বর পালরাজগণ। ভাদ্র ১২৯৭, পৃষ্ঠা ২৬২-২৭০; আশ্বিন-কার্তিক ১২৯৭, পৃষ্ঠা ৩১৬-৩২৪।

রাজা আদিশূর। চৈত্র ১২৯৭, পৃষ্ঠা ৬২৫-৬৩৬।

সেনরাজগণ। আশ্বিন ১২৯৮, পৃষ্ঠা ২৯১-৩১১; অগ্রহায়ণ ১২৯৮, পৃষ্ঠা ৪২৩-৪৩০; পৌষ ১২৯৮, পৃষ্ঠা ৫০১-৫০৩; মাঘ ১২৯৮, পৃষ্ঠা ৫০৯-৫২০; চৈত্র ১২৯৮, পৃষ্ঠা ৬৩৭-৬৪৩; শ্রাবণ ১২৯৯, পৃষ্ঠা ১৯৭-২০২; আশ্বিন ১২৯৯, পৃষ্ঠা ২৯৫-২৯৯; অগ্রহায়ণ ১২৯৯, পৃষ্ঠা ৪০৫-৪১১; পৌষ ১২৯৯, পৃষ্ঠা ৪৮৭-৪৯১।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট লিঙ্কনের বাল্য-জীবনী। নব্যভারত। পৌষ ১২৯৭, পৃষ্ঠা ৫০৫-৫১৪।

ভারতবর্ষ ও ইউরোপের বাণিজ্য। সাহিত্য। পৌষ ১২৯৯, পৃষ্ঠা ৫২৫-৫৩৩।

ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য। সাহিত্য। মাঘ ১২৯৯, পৃষ্ঠা ৬০৮-৬১৫।

কলিকাতায় ইংরাজী চর্চ্চা। নব্যভারত। ফাল্গুন ১৩০০, পৃষ্ঠা ৫৬৯-৫৭৭।

মগধের পুরাতত্ত্ব। নব্যভারত। কার্তিক ১৩০১, পৃষ্ঠা ৩৫৬-৩৬৭; মাঘ ১৩০১, পৃষ্ঠা ৫১০-৫২৩।

নেপালের পুরাতত্ত্ব। নব্যভারত। চৈত্র ১৩০১, পৃষ্ঠা ৬২৪-৬৩১; বৈশাখ ১৩০২, পৃষ্ঠা ৩০-৩৬; আষাঢ় ১৩০২, পৃষ্ঠা ১১৫-১২১; অগ্রহায়ণ ১৩০২, পৃষ্ঠা ৪০৭-৪১৪; মাঘ ১৩০২, পৃষ্ঠা ৫০৬-৫১১; ফাল্গুন ১৩০২, পৃষ্ঠা ৬০০-৬০৫; চৈত্র ১৩০২, পৃষ্ঠা ৬২৫-৬৩৩; আষাঢ় ১৩০৩, পৃষ্ঠা ১২২-১২৬; শ্রাবণ ১৩০৩, পৃষ্ঠা ১৬১-১৬৫; পৌষ ১৩০৩, পৃষ্ঠা ৪৪৯-৪৫২; জ্যৈষ্ঠ ১৩০৪, পৃষ্ঠা ৯৭-১০৩; আষাঢ় ১৩০৪, পৃষ্ঠা ১৫৬-১৬৪।

ভট্টোজী দীক্ষিত। নব্যভারত। শ্রাবণ ১৩০২, পৃষ্ঠা ১৮৪-১৯১।


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক।

আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেলের সাক্ষাতকার

0

জনাব আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল, আপনি সুবিধাবঞ্চিত শিশু বা পথশিশুদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ‘পথকলি’ নামে। যতোদূর জানি, ২০১১ সালে প্রথম শুরু করেছেন। শুরুর গল্পটা জানতে চাই।

আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : আমি আসলে শিক্ষাজীবন থেকেই বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম। আমি স্কাউট করতাম। তখন আমরা প্রতিবারই শীতবস্ত্র বিতরণ করতাম। রেলস্টেশন, লঞ্চঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায়। ২০১১ সালে আমরা বটতলা পার হয়ে আল্লাহু চত্বরের দিকে গিয়েছিলাম শীতবস্ত্র বিতরণ করতে। সেখানে একটা মাদরাসা আছে, তার পাশে কয়েকটা টঙ দোকান আছে। সেখানে কিছু মানুষ জড়ো করে আমরা কাজ করছিলাম। হঠাৎ দেখি, একটা টঙের নিচে কিছু একটা নড়াচড়া করছে। রাত তখন প্রায় একটা বাজে। ভাবলাম কুকুর-টুকুর হবে হয়তো। কিন্তু টর্চ মেরে দেখি একটা বাচ্চা। শীতে একদম কাঁপতেছে, কান্না করতেছে। বের করে বাবা-মা’র কথা জিজ্ঞেস করলাম। বলতেছে, বাবা আরেক বিয়ে করে চলে গেছে, মা’রও বিয়ে হয়ে গেছে টঙ্গি। বাচ্চাটা সেখানেই বিভিন্ন হোটেলে পানি আনার কাজ করে দিনের বেলা। রাতে থাকার জায়গা নাই। তো বিষয়টা আমার খুব খারাপ লাগলো। ওর গায়ে একটা কম্বল জড়িয়ে দিলাম। তারপর সরকারি কলেজে দেখলাম আরো কিছু বাচ্চা পাঁচ টাকা-দশ টাকার জন্যে মানুষের হাতে-পায়ে ধরতেছে, আবার কেউ টাকা না দিলে তাদের সাথে খারাপ ব্যবহারও করছে। তো সব মিলিয়ে আমার মনে হলো, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর, এসব বাচ্চাদের নিয়ে কিছু কাজ করা যায়। তখন আমি নরসিংদী সরকারি কলেজের মূল ভবনের সামনের মাঠে একদিন এরকম আট-দশটা বাচ্চাকে নিয়ে বসি। তাদের সাথে কথাবার্তা বলি। তাদের বলি যে, প্রতিদিন আমরা বসবো। তারা তো আর এমনিতেই আসবে না। তাদের জন্যে চিপস-চকলেট নিয়ে যেতাম। এভাবে তারা আরো বাড়তে লাগলো। প্রথমদিকে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম, তারা যেন মানুষের কাছে এভাবে টাকা না চায়, মারামারি না করে। দেখলাম কাজ হচ্ছে। পরবর্তীতে ভাবলাম, পড়াশোনার দিকে তাদের নিয়ে যাই। প্রথম বসার প্রায় একবছর পর তাদের আমি অক্ষরজ্ঞান দেয়া শুরু করি। তখন পৌরপার্ক ছিলো না। কলেজের মূল ভবনের মাঠের বিভিন্ন জায়গায় তাদের নিয়ে বসতাম। পরে একটা সময় (২০১৫-১৬ হবে) কলেজে বহিরাগতদের প্রবেশে অনেকটা রেস্ট্রিকশন জারি হলে তাদের নিয়ে পার্কের দিকে চলে আসি।

তাদেরকে কী কী পড়ানো হতো?

আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : পার্কে আসার পর থেকে একজন হুজুর রাখি তাদের আরবি পড়ানোর জন্যে। পাশাপাশি আমি বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি পড়াতাম। সপ্তাহে তিনদিন বসতাম। শুক্র-শনি আমি পড়াতাম, আর একদিন হুজুর পড়াতো। সবাই ছিলো একদম বাচ্চা, ৫-১০ বছর বয়স। ফলে একেবারে প্রাথমিক অক্ষরজ্ঞান শিখানো হতো। এখনো এভাবেই চলছে। সেখান থেকে যাদেরকে উৎসাহী মনে হয়, তাদেরকে আশেপাশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি করিয়ে দিই। সেক্ষেত্রে ব্যাগ-ইউনিফর্মের খরচ আমরা বহন করি।

এই হারটা আসলে কেমন? মানে কেমন সংখ্যক শিশু আপনার এখান থেকে সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হচ্ছে প্রতি বছর?

আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : আমার এখানে শিশুর সংখ্যা প্রায় ৬৪। নিয়মিত আসে ৪০ জনের মতো। আবার খাবার বা কাপড় দেয়ার সময় সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ৮০-৯০ জনে। এদের মধ্য থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে ৪-৫ জনকে বিভিন্ন সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে পারি।

নানা সময়ে আমরা দেখেছি যে, নরসিংদীর সংস্কৃতিকর্মী থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত আপনার এই কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হয়েছেন, শিশুদের সাথে বসেছেন। তো তাদের কাছ থেকে কীরকম সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন?

আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : আচ্ছা, একটা বিষয় আমি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে রাখি। আমি যখন বাচ্চাদের নিয়ে বিশেষ কোনো ইভেন্ট করি, সেটা খাবার বা পোশাক যা-ই হোকÑ অনেক অতিথি থাকে তখন। এবং অতিথিদের নিয়ে আসার মূল কারণ হলো, বাচ্চাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাই যে, দেখো, উনারা পড়াশোনা করেছেন বলেই আজকে এমন এমন ভালো জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তোমরাও পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। মূলত তাদের উদ্বুদ্ধ করাই ছিলো আমার উদ্দেশ্য। আর আমার এখানে যে-অতিথিদের আমি নিয়ে এসেছি, তাদের কাছ থেকে আমি কোনো আর্থিক সহায়তা কখনোই নিইনি। তারপরও উৎসাহী অনেকে সহযোগিতা করতে চাইলে আমি তাদের বলি, আপনি একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করে দেন বা কাপড় কিনে দেন। তখন তারা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বাচ্চাদের খাবার বা কাপড় দিয়ে যান। সরাসরি আর্থিক কোনো সহায়তা আমি আজ পর্যন্ত কখনোই গ্রহণ করিনি। আমি নিজের বেতনের একটা নির্দিষ্ট অংশ বাচ্চাদের জন্যে জমিয়ে রাখি। সেখান থেকেই তাদের সমস্ত খরচ বহন করি।

দীর্ঘ সময় এই কাজ করতে গিয়ে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন কি?

আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : প্রথমদিকে বন্ধু-বান্ধবরা নানাভাবে নিরুৎসাহিত করতো। কারণ, এসব বাচ্চারা একটু নোংরাই থাকে, জামা-কাপড় ঠিক থাকে না, হাতে-পায়ে-চুলে ময়লা থাকে। এসব কারণে অনেকে তাদের সঙ্গ দেয়াটা পছন্দ করতো না। অনেকে বলতো, এগুলো নিজের প্রচারের জন্যে করে, কাজের কাজ কিছুই নাই। আবার অনেকে বলতো, টাকা-পয়সা হাতানোর জন্যে করে, ডোনেশন নিয়ে করে ইত্যাদি। তো একটা সময় পরে এসব মন্তব্য আর গায়ে মাখি না। নিজের জায়গায় সৎ থাকলে এগুলো কাজে প্রভাব ফেলে না।

আপনি তো একজন ব্যাংকার। পেশাগত জায়গায় আপনি অনেক ব্যস্তই থাকেন বলা যায়। সারা সপ্তাহের ব্যস্ততা শেষে ছুটির দিনগুলোতে আপনি ‘পথকলি’ নিয়ে মেতে থাকেন…

আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : আমি বলি, একটা সময় থাকে, মানুষ অনেক কষ্টের পরেও সেই সময়টায় আনন্দ পায় বা প্রশান্তি পায়, ‘পথকলি’ আমার জন্যে এরকমই। প্রাইভেট ব্যাংকে কাজ করার কারণে সারা সপ্তাহের যে-স্ট্রেস আমার মধ্যে জমা হয়, বাচ্চাগুলোর কাছে আসলে সেগুলো দূর হয়ে যায়। তাদের সাথে সময় কাটাতে আমি প্রশান্তি অনুভব করি। আমি বরং আরো উৎসাহিত হই।

আচ্ছা, ভিন্ন একটা প্রসঙ্গে কথা বলি। সুবিধাবঞ্চিত বা পথশিশুদের সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসার দায়িত্বটা তো ছিলো রাষ্ট্রের। কিন্তু করতে হচ্ছে আপনাকে বা আপনার মতো অনেকেই করে। এই ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : এটা সম্পূর্ণ সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে করি আমি। আমার যতোটুকু ক্ষমতা আছে, সেটুকু দিয়েই আমি চেষ্টা করছি। আমি মনে করি যে, প্রত্যেকের দায়বদ্ধতা রয়েছে সমাজের প্রতি। আমাদের রাষ্ট্র আসলে সবদিকে নজর রাখতে পারছে না। এই কারণেই নাগরিকদের কিছু কাজ করতে হয়। আমাদের নারী ও শিশু মন্ত্রণালয় আছে, সমাজসেবা অধিদপ্তর আছে। তারা যদি এসব শিশুদের সঠিক পরিচর্যার ভেতর দিয়ে নিতে পারতো, তাহলে তাদের অবস্থা এমন থাকতো না। আমরা যদি নরসিংদীর ‘বাঁধনহারা’র দিকে তাকাই, তারা কতো চমৎকার সব কাজ করছে। ছোটো ছোটো বাচ্চারা ‘যশোর রোড’-এর মতো নাটক মঞ্চস্থ করে ফেলছে। তার মানে হলো, এই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের যদি সঠিক পরিচর্যা করা যায়, তাহলে দৃশ্যপট একদম পাল্টে যাবে। আমি দেখলাম, এই বাচ্চাগুলোই মানুষের হাতে-পায়ে ধরছে, টাকা চাচ্ছে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, মারামারি করছে, মানুষের ধমক খাচ্ছে। সেই জায়গা থেকেই আমার মনে হলো, তাদের মধ্যে বোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করি, তাদের আত্মনির্ভরশীল করার চেষ্টা করি। ভাবনা ছিলো, তারা যাতে ভিক্ষাবৃত্তির দিকে না যায়, মাদকের দিকে না যায়। তো আমি আমার মতো করে তাদের নিয়ে কাজ করতে চেষ্টা করছি।

নানা সময়ে আপনার কাছ থেকে জানতে পেরেছি, আপনি বাচ্চাদের জন্যে স্থায়ী একটা ব্যবস্থা করতে চান। এই ব্যাপারে বাস্তব কোনো পদক্ষেপ কি গ্রহণ করেছেন?

আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : হ্যাঁ, এটা করার জন্যে কিছু পদক্ষেপ আমি নিয়েছি। আমাদের সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক যিনি আছেন এখানে, উনার সাথে কথা বলেছি, আমার এখানে যারা আছে, তাদের একটা প্রাথমিক তালিকাও জমা দিয়েছি। তাছাড়া তাদের মাসিক সভা হয় জেলা প্রশাসকের সাথে। সেখানেও আমি বিষয়টা উপস্থাপন করেছি।

এক্ষেত্রে স্থানীয় কোনো শিল্পপতি বা প্রশাসনের কারো কাছ থেকে কোনো আশ্বাস বা প্রতিশ্রুতি কি পেয়েছেন?

আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : আমাদের সাবেক একজন জেলা প্রশাসক, সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন, একবার তার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে নরসিংদী সরকারি কলেজের মঠে তিনি বাচ্চাদের সাথে ঘাসের উপরে বসেছিলেন। তাদের সাথে কথা বলেছেন, আদর করেছেন। তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, তাদের জন্যে একটা স্থায়ী ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন।

তিনি চলে যাবার পর যারা দায়িত্বে এসেছেন, তাদের সাথে আপনি কোনো যোগাযোগ বা এই বিষয়ের অগ্রগতি নিয়ে কোনো আলোচনা করেছেন কি?

আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : পরবর্তীতে জেলা প্রশাসক বদিউল আলমও আমাদের এখানে এসেছেন, বাচ্চাদের সাথে সময় কাটিয়েছেন। উনিও বলেছিলেন, বাচ্চাদের একটা ব্যবস্থা করবেন। এ-ব্যাপারে জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তার সাথে কথাও বলেছিলেন। কিন্তু বিষয়টা আর সামনে আগায় নাই। এছাড়া বাংলাদেশ বিটিএম-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আমাদের বড়ো ভাই আব্দুল্লাহ আল মামুনও আমাকে আশ্বস্ত করেছেন যে, যখন আমরা এই কাজে হাত দেবো, উনি আমাদের পাশে থাকবেন।

আরেকটা বিষয়, আপনি ‘পথকলি’ নিয়ে পত্র-পত্রিকা থেকে শুরু করে টিভি মিডিয়ায় পর্যন্ত একটা প্রচারের আলোয় আছেন, নানা সময়ে আমরা এগুলো দেখেছি। এসবের ফলে নরসিংদীর বাইরে থেকে কোনো ধরনের সহায়তার জন্যে যোগাযোগ করে কি কেউ?

আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : হ্যাঁ, মাছরাঙা টেলিভিশনের ‘রাঙা সকাল’ অনুষ্ঠানে যাওয়ার পর এক ভদ্রলোক আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন, অর্থ সহায়তা দিতে চেয়েছেন। কিন্তু আমি নিইনি। কারণ, এভাবে সাহায্য-সহযোগিতা নেয়ার ব্যাপারটা সুবিধাবঞ্চিত ও পথশিশুদের একটা ব্যবসায় পরিণত করে ফেলে। অনেকে কিছু টাকা ডোনেশন দিয়ে বিশাল কৃতিত্ব নিতে চায়। ফলে মানুষের মধ্যে একধরনের সন্দেহ তৈরি হয়। মনে করে, পথশিশুদের আড়ালে বুঝি এসবই চলে। তাই আমি এ-ধরনের আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করি না।