Home Blog Page 4

মাধবদীর জমিদার সতী প্রসন্ন গুপ্ত’র রহস্যজনক করুণ মৃত্যুর ঘটনা

মাধবদী বাজারের একদম ভেতরে, মাধবদী কলেজের পাশে পুরোনো আমলের স্থাপত্যঘেরা কয়েকটা ঘর— এটা মাধবদীর জমিদার বাড়ি। লোকজনের কাছে ‘বাবুর বাড়ি’ নামে পরিচিত। বছর চার-পাঁচেক আগেও দুইদিকের প্রবেশপথে গেট ছিলো, জমিদারের নির্মিত। কিন্তু দুটো গেটই কী এক অজানা কারণে ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই জমিদারই মূলত মাধবদী বাজার হাট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজকে মাধবদীর যে তাঁতশিল্পে শনৈ শনৈ উন্নতি, তাতে জমিদারের প্রভূত ভূমিকা রয়েছে। শুধু তাই নয়, মাধবদী হাইস্কুল, স্কুল-মার্কেটসহ ব্রহ্মপুত্র-পারের বিশাল এলাকা জমিদারদের দানকৃত ও ফেলে যাওয়া সম্পত্তি।

মাধবদী বাবুর বাড়ি | ছবি : আদিব হোসেন

বর্তমানে জমিদার বাড়িটি মাধবদী কলেজের শিক্ষকদের কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভেতরে প্রবেশ করলে অনুভব করা যায় তিরিশের দশকের স্থাপত্যশৈলীর গুণ। এই বাড়ির সর্বশেষ মালিক ছিলেন জমিদারদের শেষ বংশধর শৈলেন্দ্রকুমার গুপ্তরায়। পূর্ববর্তী জমিদার সতী প্রসন্ন গুপ্তরায়ের ছেলে। বাবার নামেই তিনি ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মাধবদী সতী প্রসন্ন উচ্চ বিদ্যালয়।

জমিদার সতী প্রসন্ন গুপ্তের করুণ রহস্যজনক মৃত্যুর খবর বলতেই এই ভূমিকা শোনানো। তার আগে জমিদার বাড়ি সম্বন্ধে দুয়েক লাইন জানানো দরকার। জমিদার বাড়ি বা পরে বাবুর বাড়ির আগে নাম ছিলো মুন্সিবাড়ি। শেষ জমিদারের চার পুরুষ আগে এই বাড়ির মালিক মুন্সিয়ানা করে অনেক টাকাপয়সা করেছিলেন বলে তার নাম হয়ে যায় মুন্সি, আর বাড়ির নাম মুন্সিবাড়ি। তিনি জমিদারি শুরু করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর চার ছেলে জমিদারির মালিক হন। সবাই বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু প্রত্যেকেই নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। এরমধ্যে তৃতীয়জন এক পুত্রসন্তান দত্তক নিয়েছিলেন। এই দত্তক পুত্রই পরে এই জমিদারির হাল ধরেন। তার নাম সতী প্রসন্ন গুপ্ত।

সময়টা ১৯১৪/১৫ সালের। মাধবদী গ্রাম নেহাৎ একটা অজ পাড়াগাঁ। গ্রামের মাঝখানে ব্রহ্মপুত্রের শাখা বয়ে চলেছে। সবাই এটাকে খাল বলে। তবে ভরা বর্ষায় যৌবন উছলে পড়ে। গ্রামটা মুসলমান অধ্যুষিত হলেও হিন্দুরাই মূলত প্রভাব বিস্তার করেছিলো। গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরগুলি হিন্দুদের। গ্রামের উঠতি জমিদার হিন্দুধর্মাবলম্বী। জমিদার বাড়ির জ্ঞাতিসম্পর্কীয় রায়বাড়িও অবস্থাসম্পন্ন।

জমিদার সতী প্রসন্ন গুপ্ত ছিলেন সাদাসিধে সরল প্রকৃতির লোক। দত্তক হিসেবে তার এই বাড়ির সঙ্গে যোগ। লেখাপড়ায় সুবিধে করতে না পারলেও জমিদারির উপযুক্ত জ্ঞানবুদ্ধি তার ছিলো। দেখতে সুপুরুষ ছিলেন। পিতা বৃদ্ধ জমিদার পোষ্যপুত্র, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি পরিবেষ্টিত হয়ে স্বর্গগত হলেন। নবীন জমিদারের বয়স তখন সাইত্রিশ-আটত্রিশ মাত্র। পূর্ণ বয়সে বিবাহ করেছিলেন নারায়ণগঞ্জের এক মেয়েকে। ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্যে জমিদার গৃহিণীকে নারায়ণগঞ্জে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হতো। বাড়িতে একা জমিদার সতী বাবু আমলা-কর্মচারীসহ বিষয়সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নিয়ে।

সতী প্রসন্ন গুপ্ত রহস্যজনক করুণ মৃত্যু
জমিদারের প্রসাদপুষ্ট চাটুকারের দল সবসময় তাকে ঘিরে থাকতো। গান-বাজনা, হাসি-হুল্লোড় বাড়িতে লেগেই থাকতো। খালি বাড়ি। সুযোগ বুঝে কিছু দুষ্টুলোক এই আসরের মধ্যে ঢুকে গেলো। তাদের দৃষ্টি গেলো জমিদারের টাকা-পয়সার দিকে। অন্তরঙ্গ বন্ধুর মুখোশ পড়ে তারা জমিদারকে সম্মোহিত করে ফেললো। এরা ছিলো তার দিবারাত্রির সঙ্গী। আমোদ-প্রমোদের নানা উপকরণ তারা সরবরাহ করতো। জমিদার বাবু তাদের হাতে নিজেকে প্রায় সমর্পণ করে দিলেন। একদিন জমিদার বাবু ভাত খাওয়ার পর একটা পান খেলেন, তারপর অজ্ঞান হয়ে গেলেন। বহুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলো অনেক জল ঢালার পর। কিন্তু সেই থেকে শুরু। পান খাওয়ার ফলে মুখের ভেতর ঘামাচির মতো ছোটো ছোটো কী যেনো দেখতে পাওয়া গেলো। তার কিছুদিন পর বড়ো বড়ো গরম হাঁড়ির মাধ্যমে জমিদার বাবুর হাত-পা-পিঠসহ সমস্ত শরীর সেঁক দেয়ার চিকিৎসা চলতে লাগলো। প্রতিবেশিরা এসে দেখেন, দরোজা-জানালা বন্ধ করে সম্পূর্ণ গুমোট, বদ্ধ পরিবেশে জমিদারের উপর গরম বড়ো বড়ো হাঁড়ির সেঁক দেয়া চলছে। আর জমিদার বাবু চিৎকার করতে করতে ঘরের এপাশ থেকে ওপাশে দৌঁড়াচ্ছেন। কখনো কখনো বলছেন, “ওকে বলো, আমি আর টাকা দিতে পারবো না। ও শুধু টাকা চায়।” বলতে বলতে চিকিৎসকের দিকে ইঙ্গিত করছিলেন।

চিকিৎসকের পরামর্শ ছিলো জমিদার গিন্নিকে যেনো তার এই রোগের সংবাদ জানানো না হয়, কিন্তু অবিলম্বে জমিদার গিন্নি এ-সম্পর্কে জেনে দ্রুত ছেলেমেয়ে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ হতে রওনা দিলেন। এসে জমিদারের অবস্থা দেখে তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। তিনি এই চিকিৎসক বিদায় করলেন। জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তাকে এই সকল বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতা করেন পাশের রায়বাড়ির বড়োকর্তা। তিনি না থাকলে একা মহিলার পক্ষে সবকিছু সামাল দেয়া কঠিন হতো। তবে সবচে’ বড়ো কথা হলো, কিছু স্বার্থান্বেষী লোভী মানুষের কারণে, চিকিৎসকের সহযোগিতায় যে-আসুরিক অপচিকিৎসা দিনের পর দিন জমিদার বাবুর উপর চলেছে, তাতে তিনি ততোদিনে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন। পরিবারের সকল চেষ্টা, সেবা ইত্যাদির পরও ভালো হননি। প্রায় দুই বছর এই নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা থেকে জমিদারবাবু নিজেই নিজেকে মুক্তি দেন।

একদিন সকালবেলা বাড়ির কর্ত্রী অনেক ডাকাডাকি করেও সাড়াশব্দ পাচ্ছিলেন না। চাকররাও সারাদিন ডাকাডাকি করলো। কোনো সাড়া নেই। অবশেষে ডাকা হলো রায়বাড়ির কর্তাকে। তাকে জমিদারবাবু সমীহ করতেন। তার ডাক অগ্রাহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু তিনিও ব্যর্থ হলেন। পরে তিনি চাকরকে হুকুম দিলেন বাড়ির পেছন দিয়ে যেভাবেই হোক দরোজার ছিটকিনি খোলার ব্যবস্থা করতে। তাই করা হলো। দরোজা ভেঙে অবশেষে দেখা গেলো, জমিদারবাবু ফাঁস লাগিয়ে শূন্যে ঝুলছেন। মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সের টগবগে জমিদারের এই করুণ মৃত্যু দেখে সবাই বেদনায় মুষড়ে পড়লো। জমিদার বাবুর দুই সন্তান তখনো নাবালক।

গ্রামের সেই লোভী, বন্ধুর বেশে ষড়যন্ত্রকারীগণ উল্টো মামলা করলেন জমিদার গিন্নির বিরুদ্ধে। বলতে লাগলেন, তার বউই তাকে বিষ খাইয়ে ঝুলিয়ে এখন আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করছেন। পুলিশে বাড়ি গিজগিজ করছে। দুইদিন পর শবদাহের অনুমতি মিললো।

আদালতে মামলা চললো অনেকদিন। রায়বাড়ির বুড়োকর্তা সাক্ষ্য দিলেন। শেষপর্যন্ত তার সাক্ষ্যতেই জমিদার গিন্নি ছাড়া পেলেন স্বামী হত্যার কলঙ্ক থেকে। কিন্তু তাতেও বিপদ গেলো না। যতোদিন ছেলেরা সাবালক না হচ্ছে, ততোদিন ছেলেদের পক্ষে মা-ই জমিদারি কোর্ট অব ওয়ার্ডসে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হচ্ছিলো না। পরে রায়বাড়ির দুইকর্তা মিলে এক লক্ষ টাকা জামিনে আসন্ন কোর্ট অব ওয়ার্ডসের হাত থেকে জমিদারি রক্ষা করলেন। একা জমিদার গিন্নি দুই নাবালক সন্তান নিয়ে কতোগুলো অর্থলিপ্সু, ক্ষমাহীন চোখের সামনে দিন-রাত অতিবাহিত করেছেন।

শেষকথা
মাধবদীর জমিদার শৈলেন্দ্র গুপ্তরায় ১৯৪৬ সালে ব্রহ্মপুত্রের ওপারে বাবার নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন— ‘মাধবদী সতী প্রসন্ন উচ্চ বিদ্যালয়’। এর অনেক আগে থেকেই অবশ্য অন্য জায়গায় জমিদার গিন্নির তত্ত্বাবধানে একটা স্কুল চলেছিলো ‘মাধবদী এম ই স্কুল’ নামে। ওটাই ১৯৪৬ সালে স্থানান্তরিত হয় এবং পরের বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।

মাঝখানে ব্রহ্মপুত্রের জল অনেক গড়িয়েছে। নাবালক পুত্রেরা একসময় বড়ো হয়েছে, জমিদার হয়েছে, শান-শওকত বেড়েছে। মাধবদী হাট প্রতিষ্ঠা হয়েছে। জমিদারের বাড়িতে বড়ো বড়ো দেউরিসহ বিল্ডিং উঠেছে। আর জমিদার শৈলেন্দ্র গুপ্তরায় সাধারণ প্রজাদের এবং মুসলমান প্রজাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ছাতা হাতে চলার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। সে অন্য প্রসঙ্গ। এসব গল্প অন্য আরেকদিন করা যাবে।

দ্রষ্টব্য
রায়বাড়ির পুত্রবধূ প্রিয়বালা গুপ্তা তার শেষবয়সে আত্মজীবনী লেখেন ‘স্মৃতিমঞ্জুষা’ নামে। আত্মজীবনীটি তার পুত্র রঞ্জন গুপ্ত’র সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয় কলকাতার দে’জ পাবলিশার্স থেকে। পরবর্তীতে মাধবদীর ভাই গিরিশচন্দ্র সেন গণপাঠাগার বইটির পুনর্মুদ্রণ করে। এই লেখায় জমিদার সতী প্রসন্ন গুপ্ত’র মৃত্যুর ঘটনার বিভিন্ন তথ্য নেয়া হয়েছে উক্ত বই থেকেই।

নরসিংদীর বি বি টকিজে সিনেমা দেখার স্মৃতি এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পাঁচালী


১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনি বি বি টকিজ সিনেমা হলটি পুড়িয়ে ফেলে। পরবর্তীতে হলটির কোনো ছবি বা চিত্র পাওয়া যায়নি। তাই এই নিবন্ধের লেখক ও প্রত্যক্ষদর্শী অধ্যাপক গোলাম মোস্তাফা মিয়ার বর্ণনা অনুযায়ী বি বি টকিজের এই চিত্রটি এঁকেছেন চিত্রশিল্পী শেখ নাহিদ হাসান

সিনেমা একটি আধুনিক শিল্প মাধ্যম। সিনেমা শুধু শিল্প এবং বিনোদনের মধ্যেই থাকেনি। বাণিজ্যিক শিল্প (ইন্ডাস্ট্রি) হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে পৃথিবীব্যাপী। সিনেমা শিল্পের শুরুর সময়ে তাকালে দেখবো, এই শিল্পটির সাথে দর্শকদের যুক্ত হতে গেলে সিনেমা হলে যেতে হতো। বড়ো হলরুম ছাড়া সিনেমা প্রদর্শন করা যেতো না। এই শিল্প প্রদর্শনীর জন্যে সিনেমা হলও গড়ে তুলতে হয়েছে সিনেমা নির্মাণের সাথে সাথে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে বর্তমানে অবশ্য হলে না গিয়েও বাড়িতে বসে নানা প্রযুক্তিগত মাধ্যমে সিনেমা দেখা যায়।

আমার জীবনের প্রথম সিনেমা দেখা ১৯৬০-এর দিকে। তা-ও নির্দিষ্ট কোনো সিনেমা হলে নয়। একটি গুদাম ঘরে। তখন আমি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। বাবার কর্মস্থল তৎকালীন মুন্সিগঞ্জ মহকুমার লৌহজংয়ে অবস্থান করছিলাম আমরা। পড়ছি লৌহজং হাইস্কুলে। যতোটুকু মনে পড়ছে, সিনেমাটির নাম ছিলো ‘আসিয়া’ (১৯৬০)। ছবিটি প্রদর্শিত হবার পূর্বে তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাশাসক আইয়ুব খানের কার্যক্রমের কিছু তথ্যচিত্র দেখানো হয়েছিলো, তা-ও মনে পড়ছে। পর্দায় জীবনের প্রথম সবাক এইসব দৃশ্য দেখার অনুভূতিগুলি এখনো মনে আছে।

বাবা লৌহজং থেকে নারায়ণগঞ্জ মহকুমার রূপগঞ্জে বদলি হলেন। অফিস ছিলো কাঞ্চন। ভর্তি হয়েছিলাম কাঞ্চন বি সি ইনস্টিটিউশনে। রূপগঞ্জ থাকাকালীন সময়ে নরসিংদীতে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে আসার সুবাদে বেশ কয়েকবার সিনেমা দেখা হয়। সিনেমা হলে বসে সিনেমা দেখা সেই প্রথম— ১৯৬৩-৬৪ সালের দিকে। একটি উর্দু ছবি দিয়ে প্রথম হলে বসে সিনেমা দেখা। ছবিটির নাম এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। যে-হলে বসে প্রথম সিনেমা দেখেছি, তার নাম ‘বি বি টকিজ’। নরসিংদী রেলস্টেশন রোড সংলগ্ন বৌয়াকুড় এলাকায়। নরসিংদীর প্রথম সিনেমা হল। যতোটুকু তথ্য জানা আছে, হলের জায়গাটি আমাদের নরসিংদীর ষাট-সত্তর দশকের ছাত্রলীগ নেতা, মুক্তিযোদ্ধা এবং পরবর্তীতে জাতীয় সংসদের সদস্য মেজর (অব.) শামসুল হুদা বাচ্চুর বাবা সৈয়দ আলী মাস্টার সাহেবের। এই জায়গা ভাড়া নিয়ে সিনেমাপ্রেমী বিশ্বম্ভর সাহা (বিশু বাবু) সিনেমা হল গড়ে তোলেন। সময়টা ১৯৫৫-৫৬ সালের দিকে। ঐতিহ্যপূর্ণ এই হলটি সিনেমাপ্রেমিকদের বিনোদনের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠেছিলো। যতোদূর মনে পড়ছে, ‘বি বি টকিজ’-এর পূর্ণরূপ হলো ‘বিশু বাবু টকিজ’। মতান্তরে ‘বৌয়াকুড় বিশুবাবু টকিজ’। বিশু বাবুর অনুপস্থিতিতে তাঁর ছেলে মন্টু সাহা হলটি চালিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে নানা প্রতিরোধ পেরিয়ে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ পাক হানাদার বাহিনি নরসিংদী দখলে নিয়ে নেয় এবং নরসিংদী শহরে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনে তাদের স্থায়ী প্রধান ক্যাম্প স্থাপন করে। নরসিংদী দখলের পর শুরুতেই নরসিংদীতে যে-ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি বাহিনি, তার মধ্যে অন্যতম ছিলো— বি বি টকিজকে সম্পূর্ণরূপে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া।

এই হলটির সাথে আমার স্কুলজীবনের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বাবা রূপগঞ্জ থেকে নরসিংদী থানায় কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে বদলি হয়ে আসেন ১৯৬৫-র শেষদিকে। বদলির পূর্বে বাবা নরসিংদীর ব্রাহ্মন্দীতে জায়গা কিনে একটি বাড়ি করেছিলেন স্থায়ীভাবে থাকার জন্যে। আমি ব্রাহ্মন্দী কে কে এম উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হই। নতুন স্কুলে অনেক বন্ধু জুটে যায়। তাদের সাথে মিশে বি বি টকিজে নিয়মিত সিনেমা দেখার পর্ব শুরু হয়। স্কুল এবং কলেজজীবন পর্যন্ত সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার একটা প্রচণ্ড নেশা তৈরি হয়ে যায়। শৈশব-কৈশোরে আমাদের হাতে কোনো নগদ টাকা থাকতো না। সময়টা এমনই ছিলো যে, যা প্রয়োজন, সব অভিভাবকেরাই কিনে দিতেন। নগদ টাকা আমাদের হাতে দিতেন না। কিন্তু সিনেমার নেশা যখন এসে গেলো, তখন তা দমিয়ে রাখা গেলো না। প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন ছবি আসতো। বাধ্য হয়েই বাবার পকেট থেকে বা টাকা রাখার রক্ষিত স্থান থেকে বাবা-মাকে না বলে, লুকিয়ে টাকা নিয়ে সিনেমা দেখতাম। এজন্যে বাবা-মা’র অনেক গালি, মার খেতে হয়েছে। কিন্তু সিনেমা দেখা বন্ধ হয়নি।

তখন বি বি টকিজে পাকিস্তানি উর্দু ছবিই বেশি চলতো। একসময় ভারতীয় ছবিও আসতো। ১৯৬৫-র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর ভারতীয় সিনেমা আসা বন্ধ হয়ে যায়। বি বি টকিজ হলের মডেল পুরাতন হলেও প্রজেক্টর এবং সামনের বড়ো পর্দার মান বেশ ভালো ছিলো। সাউন্ড সিস্টেমও খারাপ ছিলো না। হলের ভেতরের আসন ব্যবস্থাপনায় সম্মুখভাগে পর্দার কাছাকাছি ছিলো সম্মুখ আসন (ফ্রন্ট স্টল), তার পেছনে মধ্যম আসন (মিডল স্টল), তার পেছনে পশ্চাৎ আসন (রিয়ার স্টল)। হলের পেছনভাগে দ্বিতীয় তলায় প্রথম শ্রেণি (ফার্স্ট ক্লাস) এবং বেলকনি। ফ্রন্ট স্টলের ভাড়া কম ছিলো বলে সেখানে বসেই বেশি ছবি দেখেছি। মনে পড়ছে, হল এলাকায় বিচরণ, টিকেট কাটা এবং হলে প্রবেশের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হতো। লুকিয়ে প্রবেশ করতাম। পরিচিত বড়োজনরা কেউ দেখে ফেললো কিনা, স্যারেরা কেউ দেখে ফেললো কিনা— তাহলে তো বাবা-মা’র মার খেতে হবে। অনেক সময় টিকেট কাটতেও বেশ সমস্যা হয়ে পড়তো। ফ্রন্ট স্টলের ক্ষেত্রে নিম্ন পেশাজীবী শ্রেণির দর্শকদের জন্যে ভীড় ঠেলে টিকেট কাটা যেতো না। তখন বাধ্য হয়ে ব্ল্যাকারদের কাছ থেকে বেশি টাকায় টিকেট কিনতে হতো। আবার কখনো দেখা গেলো ‘হাউজফুল’— সামনে প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে দিতো। মন খারাপ করে চলে আসা ছাড়া আর উপায় কী! সিনেমা দেখার নেশা ধরিয়ে দিতো, যখন ব্যান্ডপার্টি নিয়ে নতুন ছবির পোস্টার সম্বলিত বড়ো বড়ো প্ল্যাকার্ডসহ এলাকায় মাইকিং করতো। মনে পড়ছে, বৌয়াকুড়ের কৃষ্ণকান্ত বর্মণ বেশ দক্ষতার সাথে রসিয়ে রসিয়ে বি বি টকিজে নতুন ছবি আসলে প্রতি সপ্তাহে তার প্রচারণা চালাতো। পোস্টারে নায়ক-নায়িকার ছবি এবং তাদের অ্যাকশান দৃশ্য দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারতাম না। এখনো চোখে ভাসছে, ‘খাইবার পাস’ ছবির পোস্টারে পাকিস্তানি নায়িকা নীলু’র এক পা পাহাড়ের একপাড়ে, অন্য পা আরেক পাড়ে। মাঝখানে খাইবার পাস। সে এক অন্যরকম দৃশ্য। তখন উর্দু ছবিতে নায়িকা হিসেবে নীলু, রাণী, জেবা এবং নায়ক ওয়াহিদ মুরাদ, মোহাম্মদ আলী, সুধীর, সন্তোষ, আলাউদ্দিন প্রমুখদের বেশি দেখা যেতো।

বি বি টকিজে চলতো তিনটি শো— ০৩ টা থেকে বিকেলের প্রদর্শনী (ম্যাটিনি শো), ০৬ টা থেকে সন্ধ্যার প্রদর্শনী (ইভিনিং শো) এবং ০৯ টা থেকে রাতের প্রদর্শনী (নাইট শো)। সাপ্তাহিক ছুটির দিন রবিবার থাকতো সকালের প্রদর্শনী (মর্নিং শো)। মর্নিং শো-এ চলতো ইংরেজি ছবি। কোনোকিছুই দেখা বাকি থাকতো না। সম্ভবত এসব দুষ্টুমির কারণেই বাবা দশম শ্রেণিতে ওঠার পর এসএসসি পরীক্ষার ফল ভালো করার বিবেচনায় শিবপুর হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন।

বি বি টকিজে ষাটের দশকে বাংলা সিনেমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছবি আমি দেখেছি। কয়েকটি ছবির নাম উল্লেখ না করে পারছি না। সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’, জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ ও ‘জীবন থেকে নেয়া’সহ অনেক ছবি সে-সময় বি বি টকিজে প্রদর্শিত হয়েছে। ১৯৬৪ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ ছবির মাধ্যমে দেশের অন্যতম চলচ্চিত্র অভিনেত্রী কবরী’র অভিনয়জীবন শুরু। ‘বেহুলা’ (১৯৬৬) জহির রায়হানের লোককাহিনিনির্ভর ব্যবসা সফল ছবি। এই ছবিতে নায়করাজ রাজ্জাক প্রথম নায়ক হিসেবে অভিষিক্ত হন। ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে জহির রায়হান নির্মাণ করেন ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০)। ছবিটিকে প্রায় নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো, কিন্তু গণদাবিতে পাকিস্তান সরকার এটিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ছবিটিতে রাজনৈতিক আন্দোলন এবং সেই সময়কার ঢাকার রাজপথে কৃষকদের সবচাইতে বড়ো সমাবেশের ফুটেজ ব্যবহার করেন জহির রায়হান। সেই সমাবেশে আমরাও অংশ নিয়েছিলাম নরসিংদীর রায়পুরার কৃষকদের সাথে।

নরসিংদী শহরে ০৪ টি সিনেমা হল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। প্রথম সিনেমা হল বি বি টকিজ-সহ মিতালী, সুরভী এবং সংগীতা। চারটি হলই আজ মাটির সাথে মিশে গেছে। বি বি টকিজ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি দ্বারা ভস্মিভূত হয়েছে। এখন সেখানে বড়ো শপিংমল গড়ে ওঠেছে। মিতালী নরসিংদী পৌরসভার পশ্চিমপাশে দৃষ্টিনন্দন ও সবার চোখে পড়ার মতো জায়গায় একটি আধুনিক সিনেমা হল ছিলো। আজ সেখানে হল ভেঙে নদী বাংলা কনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে নরসিংদীর সবচে’ বড়ো শপিংমল ও আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে। সুরভী ছিলো সাটিরপাড়ায়, সংগীতা ঘোড়াদিয়া যাবার পথে। এগুলোও ভেঙে দিয়ে নতুন মার্কেট তৈরি করা হয়েছে।

বৌয়াকুড়ে অবস্থিত বর্তমান ইনডেক্স প্লাজার সামনে বি বি টকিজের জায়গাটি এখনো খালি পড়ে আছে

ঢাকার বিখ্যাত সিনেমা হল বলাকা, মধুমিতা, অভিসার, গুলিস্তান। প্রত্যেকটি হলে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে (১৯৭০-৭৫) অনেক ছবি দেখেছি। গুলিস্তানের অস্তিত্ব আজ বিলীন। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকার পুরাতন হল ‘পিকচার হাউজ’— পরবর্তী নাম ‘মুকুল’ (আজাদ), ১৯২৯। সেখানে প্রথম নির্বাক ছবি ‘দ্য লাস্ট কিস’ প্রদর্শিত হয়েছিলো। পরের প্রেক্ষাগৃহ সদরঘাটের ‘সিনেমা প্যালেস’— পরবর্তী নাম ‘মতিমহল-রূপমহল’। এই হলে দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ প্রদর্শিত হয়েছিলো। বংশালে ‘মানসী’, ইসলামপুরে ছিলো ‘লায়ন’। ঢাকার আরেকটি উল্লেখযোগ্য হল ছিলো ‘তাজমহল’। বাংলাদেশের বৃহত্তম সিনেমা হল যশোর জেলা সদরের ‘মনিহার’, যার আসনসংখ্যা প্রায় ১,২০০ (একহাজার দুইশত)। কিন্তু বর্তমানে দেশের সব সিনেমা হল ঝুঁকির মুখে। অনেকগুলো বিলুপ্ত। সিনেমা হলের সংখ্যা ১,২০০ থেকে এখন ১০০-র নিচে নেমে এসেছে।

চলচ্চিত্র শিল্পের একটি বৃহৎ এবং শক্তিশালী আধুনিক মাধ্যম হলেও বাংলাদেশে বিগত সত্তর বছরেও এটি পূর্ণাঙ্গ বিকশিত হতে পারেনি। তারপরও ১৯৫৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (এফডিসি)। এ-সময়েই জহির রায়হান, ফতেহ লোহানী, সালাউদ্দিন, সাদেক খান, সুভাষ দত্তের মতো প্রগতিশীল কয়েকজন চলচ্চিত্র চিন্তক ও নির্মাতার আবির্ভাব ঘটে। তাঁদের নির্মিত চলচ্চিত্রের বিষয় ছিলো জীবন-সমাজ-রাষ্ট্র। সামন্তবাদী অত্যাচার, সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকট, পুঁজিবাদের আগ্রাসন এবং সর্বোপরি ভঙ্গুর মূল্যবোধের বিপরীতে ঘুরে দাঁড়ানো। কিন্তু ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র আদর্শের বদলে বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে ওঠে। চলচ্চিত্রে চলে আসে অশালীন, চটুল সংলাপ, অশ্লীল দৃশ্য নির্মাণ, অবাস্তব কাহিনিচিত্র। পূর্ব পাকিস্তানি সময়ের উর্দু ছবির দাপটে তা লক্ষ্য করা যায়।

এতোসব বাধা-প্রতিকূলতার পরও স্বাধীনতার পরপর নতুন অঙ্গীকার নিয়ে সুস্থ চলচ্চিত্র চিন্তক, চলচ্চিত্র সাংবাদিক আলমগীর কবীর নির্মাণ করলেন ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘সূর্যকন্যা’, ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘রূপালী সৈকতে’। এছাড়া কবীর আনোয়ারের ‘সুপ্রভাত’; সুভাষ দত্তের ‘বসুন্ধরা’, ‘ডুমুরের ফুল’; আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’; আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘সারেং বউ’; মসিউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলীর ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’র মতো ভালো ছবিগুলো নির্মিত হয় তখন।

সীমিত হলেও চলচ্চিত্রের এই সুস্থ ধারার উত্তরাধিকার তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদ, হুমায়ূন আহমেদ, আবু সাইয়িদ, মোরশেদুল ইসলাম, গিয়াসউদ্দিন সেলিম, অমিতাভ রেজা, তৌকীর আহমেদ, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী-সহ আরো অনেক নবীন চলচ্চিত্র নির্মাতা, যাদের কাছ থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আশার আলো পাচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, অনেক উঁচুমাপের নির্মাতা তারেক মাসুদকে অকালে হারাতে হয়েছে।

নরসিংদীর প্রথম সিনেমা হল বি বি টকিজে সিনেমা দেখার উত্তাল স্মৃতি এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এই পাঁচালী যখন লিখছি, তখন বাংলাদেশের নবীন নির্মাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ-এর ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবিটি ২০২১ সালের ৭৪ তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের ‘আঁ সার্তে রিগা’ পর্বে প্রদর্শিত হয়েছে এবং ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। এটি আমাদের জন্যে আশার কথা। এই আশা নিয়ে আমরা দেখতে চাই, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সুস্থ ধারায় ফিরে আসবে, সিনেপ্লেক্সসহ সিনেমা হল গড়ে ওঠবে আবার। নতুনভাবে চলচ্চিত্র শিল্পটি হবে সমৃদ্ধ।


গোলাম মোস্তাফা মিয়া
সাবেক অধ্যক্ষ, নরসিংদী সরকারি কলেজ

গিরিশচন্দ্র ও নরসিংদীর নারীশিক্ষা

‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি’ বলে বহুল ব্যবহৃত একটি প্রবাদ বাক্য রয়েছে। নরসিংদীর ঐতিহাসিক উপাদান খুঁজতে গিয়ে আমার জীবনে তেমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। সাটিরপাড়ার প্রজাহিতৈষী জমিদার, শিক্ষাব্রতী ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিত্ব ললিতমোহন রায় বিএবিএল সম্পর্কে উপাত্ত খুঁজতে গিয়ে জানতে পারি, তিনি ছিলেন নেতাজী সুভাষ বোসের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং স্বদেশী স্টিমার কোম্পানি ও সুগার মিলের মালিক। কলকাতা যাদবপুরস্থ বেঙ্গল ল্যাম্পস কারখানা বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অনুরোধে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি।

জমিদার ললিতমোহন রায় নরসিংদীর সাটিরপাড়ায় ব্রিটিশ আমলে একটি স্বদেশী সুগার মিল প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিটিশদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। মিলটি বেশিদিন না টিকলেও দেশপ্রেমের বিশেষ নিদর্শন বহন করেছিলো চিনি কলটি। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে পরিত্যক্ত সেই মিলের জায়গায় তিনি গড়ে তোলেন নারীশিক্ষার জন্যে একটি গার্লস স্কুল এবং তাঁর মা কমলকামিনী দেবীর নামে এর নামকরণ করেন ‘কমলকামিনী গার্লস স্কুল’। তখন নরসিংদী শহরে মেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষার জন্যে কোনো স্কুল কিংবা ইনস্টিটিউট ছিলো না। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি সাটিরপাড়ায় ‘কালী কুমার ইনস্টিটিউশন’ নামে একটি বালক বিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন। স্কুলটির খ্যাতি তখন ভারতবর্ষব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিলো। সেই আশা নিয়ে তিনি কমলকামিনী গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেও এর একযুগ পরই দেশভাগের হট্টগোল শুরু হয়। গার্লস স্কুলের সিংহভাগ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছিলো হিন্দু সম্প্রদায়ের। দেশভাগের কারণে তারা প্রায় সবাই ভারতের বিভিন্ন স্থানে (পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বিহার) চলে গেলে স্কুলটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতাও উঠে যায়। সঙ্গত কারণে স্কুলটি অনেকদিন বন্ধ থাকে। পরবর্তীতে সেখানে গার্লস স্কুলটি চালু হলেও রহস্যজনক কারণে কমলকামিনী নামটি পরিবর্তন করে সেখানে নরসিংদী বালিকা বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড ওঠে। এই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কাদের কারণে বাস্তবায়িত হয়েছিলো, তা আজো জানা যায় না।

সাটিরপাড়ার জমিদার ললিতমোহন রায়

একইভাবে আরেকটি গার্লস স্কুল মাধবদীতে নিঃশেষিত করা হয়েছিলো। সেখানকার শিক্ষানুরাগী নারী প্রিয়বালা গুপ্তা বস্ত্রশিল্পের পীঠস্থানটিকে শিক্ষায় আলোকিত করার জন্যে একটি গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মূলত পিছিয়ে পড়া নারী সমাজকে শিক্ষিত করে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে তিনি শিক্ষার পাশাপাশি আরো অনেক সামাজিক কাজ হাতে নেন। তাঁর স্মৃতিচারণামূলক ‘স্মৃতিমঞ্জুষা’ গ্রন্থে এ-সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ আছে। গ্রামের মানুষদের বিশেষ করে মেয়েদের স্বাবলম্বী করে তোলার জন্যে তাঁর কোনো বিকল্প ছিলো না। তাদেরকে অক্ষরজ্ঞান দেয়ার পাশাপাশি সেলাই শিক্ষা, কুশি কাটা ও বোনাসহ অন্যান্য হাতের কাজ শেখাতেন। এমনকি সাহিত্যচর্চার জন্যে হাতে লেখা পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। ‘কিশলয়’ নামে পত্রিকার তিনটি সংখ্যাও প্রকাশিত হয়েছিলো। এতে প্রিয়বালা গুপ্তার কয়েকটি শিশুতোষ কবিতা প্রকাশ পেয়েছিলো। তাঁর বড়ো ছেলে অজিত গুপ্ত পত্রিকাটি হাতে লিখতেন। অলঙ্করণ করেছিলেন রানু পাকড়াশী। এতে নিয়মিত লিখতেন বিপ্লবী সতীশচন্দ্র পাকড়াশী, অজিত গুপ্ত, হিরণবালা রায়, সাধনচন্দ্র তপাদার ও প্রিয়বালা গুপ্তা।

১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে প্রিয়বালা গুপ্তা তাঁর জীবনের বড়ো স্বপ্ন ‘মাধবদী শিশুশিক্ষা বিদ্যানিকেতন’ নিজবাড়িতে শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দাগ তখনো মুছে যায়নি। দুবেলা স্কুল বসতো। সকাল ০৭ টা থেকে ০৯ টা পর্যন্ত শিশু ও প্রথম শ্রেণি, অন্য শ্রেণিগুলো সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ০৪ টা পর্যন্ত চলতো। মাঝে একঘণ্টা খাবার বিরতি ছিলো। প্রথমদিকে তিনি একা শিক্ষকতা করলেও পরে পাড়ার দুয়েকজন শিক্ষিত ছেলে সাহায্য করতো। পরবর্তীতে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে রঞ্জন গুপ্ত ও ঢাকা সেন্ট গ্রেগরির ছাত্র সাধন তপাদার ও শংকর তপাদার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

প্রিয়বালা গুপ্তা

তারপর ছাত্রী সংগ্রহের জন্যে তিনি বাড়ি বাড়ি যেতে শুরু করেন। নিজের মেয়ে আরতি গুপ্তা ও কাশীপুরের শৈলবালা সাহাকে দিয়ে শুরু করেন ‘মাধবদী শিশুশিক্ষা বিদ্যানিকেতন’। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ কি এপ্রিলে ভর্তি হন কাশীপুরের স্বদেশী মালাদার, মাধবদীর সতী পাকড়াশী ও ননী পাকড়াশী। এভাবে ০৫ জন মেয়ে দিয়ে স্কুলটি শুরু হলেও পরবর্তীতে ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে শিশু শ্রেণির স্কুলটি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত খোলা হয়। ০৫ জন শিক্ষার্থী বেড়ে দাঁড়ায় ১৫০ জনে। মাধবদী ছাড়াও কোতয়ালীরচর, আটপাইকা, কাশীপুর, আলগী, নওপাড়া, বিরামপুর, আনন্দী, শেখেরচর ও ভগীরথপুর থেকে ছাত্রীরা দলে দলে এসে সেই স্কুলে ভর্তি হয়। তখন হিন্দুপ্রধান মাধবদী এলাকায় মুসলমান নারীশিক্ষা ছিলো না বললেই চলে। কিন্তু প্রিয়বালার স্কুলে মুসলমান শিক্ষার্থীরাও ভর্তি হতে শুরু করে। প্রথমদিকে কলুপাড়ার সুলতান মিঞা তার এক মেয়ে ও এক ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করতে আসেন। মেয়েদের স্কুল বিধায় সেখানে ছেলে ভর্তির নিয়ম ছিলো না। কিন্তু সুলতান মিঞার পীড়াপীড়ির কারণে শিশু ছেলেকে সেখানে ভর্তি নিয়েছিলেন। এরপর নওপাড়ার ভূঁইয়া বাড়ির খালেদা আখতার ১০ বছর বয়সে সেখানে ভর্তি হয়। খালেদা সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করে ঢাকা ইডেন কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন। পরে স্বামীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া চলে যান। সেখান থেকে তিনি প্রিয়বালা গুপ্তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। কিন্তু দেশভাগ ও অব্যাহত দাঙ্গার কারণে প্রিয়বালা গুপ্তা ও তাঁর পরিবারের পরিবেশ প্রতিকূলে চলে যেতে শুরু করে। বিশেষ করে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ভয়াবহ দাঙ্গার আঁচ লাগে মাধবদী অঞ্চলে। নিজের প্রিয় জন্মভূমি, স্বামীর বাড়ি, স্কুল আর সাধারণ মানুষের গভীর ভালোবাসা ছেড়ে তাঁকে সীমান্ত পার হতেই হলো। দুই ছেলে, দুই মেয়েকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নৈহাটিতে পা রাখলেন তিনি। এই নৈহাটিতে জন্ম সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজে শিক্ষক হিসেবে চাকুরি পান ছেলে রঞ্জন গুপ্ত। ছেলের সঙ্গে তিনি সিউড়ী চলে যান। সেখান থেকে আর তাঁর ফেরা হয়নি। পেছনে পড়ে থাকে স্বপ্নের স্কুল, টুল-বেঞ্চ আর প্রিয় শিক্ষার্থীরা। সুখের খবর এই যে, মাধবদীর বর্তমান প্রজন্মের উদ্যোগী দুই তরুণ শাহীনুর মিয়া এবং সুমন ইউসুফ প্রিয়বালা গুপ্তার স্কুলটি পুনর্জীবিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যে নরসিংদী জেলা প্রশাসন স্কুলের জন্যে জমিও বরাদ্দ করেছে।

উল্লেখ্য, মাধবদীতে প্রিয়বালা গুপ্তা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গার্লস স্কুলের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সেখানে আরেকটি স্বল্পায়ু গার্লস স্কুলের সন্ধান পাওয়া যায়। মাধবদীর খ্যাতনামা আইনজীবী প্রকাশ পাকড়াশীর ছেলে বেনু পাকড়াশী সেটি গড়ে তুলেছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। গ্রামে এসেই মুষ্টিভিক্ষার মাধ্যমে একটি অবৈতনিক গার্লস স্কুল খোলেন এবং দুজন শিক্ষক নিয়োগ দেন। দেড় বছরের মাথায় তা বন্ধ হয়ে যায়। পড়ে থাকে ব্ল্যাকবোর্ড আর বেঞ্চ। শেষদিকে এর সঙ্গে যুক্ত হন প্রিয়বালা গুপ্তা। তিনি চেষ্টা করেন স্কুলটি বাঁচাতে। কিন্তু এলাকার মানুষের অসহযোগিতায় তা সম্ভব হয়নি।

হিসাব করলে প্রিয়বালা গুপ্তার স্কুলটি জেলার তৃতীয় প্রাচীন গার্লস স্কুল। দ্বিতীয়টি ছিলো জমিদার, বিপ্লবী ও শিক্ষানুরাগী ললিতমোহন রায়ের প্রতিষ্ঠিত কমলকামিনী গার্লস স্কুল। তাহলে সবচে’ প্রাচীন গার্লস স্কুল কোনটি? এর খোঁজ করতে গিয়ে একটি বিস্মৃত ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। যা নরসিংদীর নারীশিক্ষার ইতিহাসে মাইলফলক। একইসাথে শিক্ষার ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে হবে। প্রাচীন গার্লস স্কুলটির সঙ্গে ভাই গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৪-১৯১০) ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কোরানের প্রথম বঙ্গানুবাদকারী (টিকা টিপ্পনীসহ) ও ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারক হিসেবে তিনি আজীবন নারীশিক্ষা, বিধবা বিবাহ ও কুসংস্কার রোধে কাজ করে গেছেন। তা থেকে জন্মভূমি পাঁচদোনাকেও বাদ দেননি। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন, ৪০ বছরেরও অধিক সময় গার্লস স্কুলটি চলেছিলো। পরবর্তীতে নানা বাধা-বিপত্তির কারণে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয়ভাবে অনুসন্ধান করে এবং নানা ঐতিহাসিক বইপত্তর ঘেঁটেও গিরিশচন্দ্র সেনের প্রতিষ্ঠিত সেই গার্লস স্কুলের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়নি। তারা কেনো নরসিংদীর প্রথম গার্লস স্কুলটির ইতিহাস লেখা থেকে বিমুখ ছিলেন, সেটাও একধরনের রহস্য। জেলার ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ ‘ঘোড়াশাল কাহিনী’, ‘পূর্ববঙ্গে মহেশ্বরদী’, ‘মহেশ্বরদী পরগণার ঐতিহাসিক প্রবন্ধাবলী’, ‘নরসিংদীর গুণীজন’ কিংবা ‘নরসিংদীর কবি-সাহিত্যিক’সহ কোথাও স্কুলটির কোনো বিবরণ নেই। গিরিশচন্দ্র সেন ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীতে এর উল্লেখ না করলে স্কুলটির কথা চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যেতো। গিরিশচন্দ্র সেনের বংশধর হিসেবে পরিচিত রনজিৎ কুমার সেন তাঁর ‘মাওলানা ভাই গিরিশচন্দ্র সেন’ বইয়ে গার্লস স্কুলটির কথা উল্লেখ করলেও সে-সম্পর্কে আর কোনো তথ্য উল্লেখ করতে পারেননি। তেমনি এডভোকেট মুখলেছুর রহমান চৌধুরীর লেখা ‘ভাই গিরিশচন্দ্র সেন পরিচিতি’ গ্রন্থেও স্কুলটি সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই।

১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত গিরিশচন্দ্রের আত্মজীবনীতে উল্লেখ করা হয়, “চল্লিশ বৎসরেরও অধিককাল হইতে পাঁচদোনার বালিকা বিদ্যালয়ের কার্য্য চলিতেছে।” এই হিসাবে দেখা যায়, ১৮৬৯ কিংবা ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা ফরাশগঞ্জের এক বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ইডেন ফিমেল স্কুলেরও আগে অজপাড়াগাঁ পাঁচদোনায় গিরিশচন্দ্র মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্কুলটি যাতে ভালোভাবে চলে, সেজন্যে তিনি কলকাতা থেকে বই-পুস্তক ও খেলার সামগ্রী পাঠাতেন। স্কুলটি সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত হয়েছিলো। অনেক মেয়ে বৃত্তি পেয়েছিলো। এখান থেকে লেখাপড়া শিখে অনেকে স্বামী বা বাবার ঘরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন, অনেকে উচ্চশিক্ষাও গ্রহণ করেছিলেন। রক্ষণশীল মহলের শত বাধা সত্ত্বেও গিরিশচন্দ্র স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আত্মজীবনীতে তিনি লেখেন, “বাল্যকাল হইতে স্ত্রী শিক্ষা বিষয়ে আমার বিশেষ উৎসাহ ও অনুরাগ। স্বদেশে গৃহে অবস্থানকালে প্রত্যেক পরিবারের বধূদিগের দুঃখ দুরবস্থা ও তাঁহাদের প্রতি শ্বাশুড়ী, ননদ প্রভৃতির অত্যাচার দর্শন করিয়া আমার মন অতিশয় ব্যথিত হইয়াছে। এইরূপ নিপীড়ন ও নির্য্যাতনের ভিতর থাকিয়া তাঁহাদের মনোবৃত্তি সকল স্ফুর্ত্তি পাইতেছিল না, জ্ঞান পিপাসা কিছুই চরিতার্থ হইতে ছিল না। ভদ্র সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যাগণও বধূরূপে দাসীর ন্যায় নিজ দায়িত্বে খাটিয়া গলদঘর্ম্ম হন, প্রায় কাহারও হইতে আদরযত্ন লাভ করেন না। কাজে একটু ত্রুটি হইলে গঞ্জনা ভোগ করেন, তাঁহাদিগকে নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করিতে হয়, তাঁহাদের মুখ ফুটিয়া কথা কহিবার স্বাধীনতাটুকু নাই। এ সকল দেখিয়া আমি মনে ক্লেশ পাইতাম, ভাবিতাম লেখাপড়া না শিখিলে, আত্মোন্নতি না হইলে, ইঁহাদের অবস্থার উন্নতি, স্বাধীন চিন্তা, মানসিক স্ফুর্ত্তি হওয়া অসম্ভব। লেখাপড়া শিক্ষার দ্বার উম্মুক্ত করিতে হইবে, ইহা ভাবিয়া আমি পাঁচদোনা গ্রামে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে সমদ্যোগী হই।”

গিরিশচন্দ্র সেন

গিরিশচন্দ্র সেনের জীবনে ময়মনসিংহ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। সেখানে তিনি পড়াশোনা করেন। কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন। সেখানেই তাঁর সঙ্গে ব্রাহ্ম সমাজের নেতা কেশবচন্দ্র সেনের পরিচয় হয়েছিলো। সেখানে তাঁর অন্যতম কীর্তি হলো একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। তিনি মুড়াপাড়ার জমিদার ও ময়মনসিংহের কালেক্টর অফিসের খাজাঞ্চি রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় তাঁর (রামচন্দ্রের) বাড়িতে একটি গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সে-স্কুলে শহরের অনেক ভদ্র পরিবার ও রামচন্দ্রের দু’কন্যা পড়াশোনা শুরু করেন। শিক্ষকতার বিনিময়ে গিরিশচন্দ্র কোনো অর্থ গ্রহণ করতেন না। কালেক্টর রেনাল্ড সাহেবের স্ত্রী দু’বার উক্ত স্কুল পরিদর্শন করেন এবং ছাত্রীদের জন্যে সেলাই কল ও খেলার সামগ্রী উপহার দেন। গিরিশচন্দ্র ময়মনসিংহ ছেড়ে চলে যাবার পর স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে পরবর্তীতে সেখানে সরকারি সহযোগিতায় ব্রাহ্ম সমাজের উদ্যোগে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যা এখনো সুনামের সঙ্গে টিকে আছে। যার শুরু হয়েছিলো ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই স্কুল পরিদর্শন করেছিলেন।

গিরিশচন্দ্র সেন মৃত্যুর আগে একটি উইল বা শেষ ইচ্ছাপত্র রেজিস্ট্রি করে যান কালীগঞ্জ সাব রেজিস্ট্রি অফিসে। সেই উইলে তিনি পাঁচদোনা ও তার আশেপাশের গ্রামগুলোর উন্নয়ন ও নারীশিক্ষার জন্যে অর্থ বরাদ্দ করে যান। তিনি তাঁর আয়কৃত অর্থ থেকে শতকরা ৭৫ টাকা জন্মভূমি পাঁচদোনা গ্রামের দুঃখিনী, বিধবা, নিরাশ্রয় বালক-বালিকা, দরিদ্র বৃদ্ধ, নিরুপায় রোগী এবং নিঃসম্বল ছাত্র ও ছাত্রীদের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বিদ্যাশিক্ষার জন্যে দান করেন। তিনি নারী জাগরণের জন্যে দীর্ঘদিন ‘মহিলা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সে-পত্রিকায় বেগম রোকেয়া নিয়মিত লিখতেন। বেগম রোকেয়াকে গিরিশচন্দ্র স্নেহ করে ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন। দুজন দুই ধর্মের হলেও তাঁদের সম্পর্ক প্রকৃতই ছিলো মা ও ছেলের।


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

শামসুর রাহমানের শেকড়ের টান

বাংলাদেশের অন্যতম কবি এবং এ-কালের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও অভিনন্দিত কবি শামসুর রাহমান। রবীন্দ্র-উত্তর তিরিশ পরবর্তী কাব্যজগত বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে অনন্য এক আন্দোলন। রবীন্দ্র-প্রভাব মুক্ত হয়ে শুরু হয় বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র পথচলা। এই ধারাবাহিকতায় জীবনানন্দ দাশের পরই পঞ্চাশের দশকে আধুনিকতার নতুন মাত্রা নিয়ে আবির্ভূত হন শামসুর রাহমান।

চল্লিশ দশকের শেষ পর্যায়ে এবং পঞ্চাশের দশকে তাঁর সদর্প আবির্ভাব হলেও পরবর্তী কয়েক দশকে কবি নানা মাত্রায়, ভাব-আঙ্গিকের বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিজেকে জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন আধুনিক কবি হিসেবে। কবিতার আলোচনায়, কবিদের আসরে তাঁর অবস্থান হয়ে যায় প্রথম সারিতে। কিন্তু এই কবি সম্পর্কে তাঁর শেকড়ের স্থানের মানুষদের একটি ভিন্ন অভিযোগ শুনতে পাওয়া যায়। তাদের বক্তব্য, “এতো জনপ্রিয় কবি, এতো প্রতিষ্ঠিত কবি, তাঁর শেকড়ের সাথে সম্বন্ধ নেই।”

তাঁর শেকড় নরসিংদী জেলার পাড়াতলী গ্রাম, কিন্তু নরসিংদীর সাথে কবির সম্পর্ক নেই, ‘কবি নরসিংদী আসেন না’ ইত্যাদি— বিভিন্ন সভার আলোচনা, নানা আড্ডার আলাপচারিতায় এসব কথা শুনে আমার মনে গভীর জিজ্ঞাসা তৈরি হয়। আসলে এইসব অভিযোগ কি সত্যি? কবি তাঁর শেকড়ের সাথে সম্বন্ধ রাখেন না? নাকি আমরাই কবির সাথে সম্বন্ধ তৈরি করিনি, কবিকে জানতে-বুঝতে চেষ্টা করিনি? কবির সৃষ্টিকর্মের সাথে আমাদের সম্বন্ধ তৈরি হয়নি? আমার ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের গবেষণায় এবং কবির কবিতা পাঠের মাধ্যমে আমার বোধ সৃষ্টি হয়— কবির সম্পর্কে এসব অভিযোগ সত্য নয়। বরং আমরাই তাঁর সৃষ্টিকর্মের অধ্যয়ন না করে, তাঁর জীবনাচরণের তথ্য না জেনে কবিকে অভিযুক্ত করে ফেলেছি। আমার ধারণা হয়েছে, কবি আমাদেরই লোক এবং একজন কালজয়ী শিল্পী হিসেবে কবি সারাদেশের ও পৃথিবীর মানুষের। এসব ভাবনা নিয়ে যখন তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে এবং আমিও কবিকে বেশি করে জানার চেষ্টা করছি, তখন আমি নরসিংদী কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপনার কাজে রত। কবির প্রতি এসব অভিযোগ-অনুযোগের কারণে আমার কষ্ট হতো এবং কবির শেকড়ের সাথে আমারো একটু যোগসূত্র ছিলো। সেই তাগিদে আমি কবিকে আরো বেশি করে জানার চেষ্টা করি। কবির শেকড় নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার পাড়াতলী গ্রাম। মেঘনা নদীর তীরলগ্ন পাড়াতলী তাঁর পৈতৃক নিবাস, তাঁর মূল ঠিকানা। যদিও জন্ম নিয়েছিলেন পুরান ঢাকার মাহুতটুলীতে ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর, নানার বাড়িতে। আমার গর্ব, আমার অহঙ্কার, আমার বাড়িও পাড়াতলী ইউনিয়নের মধ্যনগর গ্রামে।

কলেজের অধ্যাপনাকালে আমি শ্রেণিকক্ষের পাঠদান প্রক্রিয়ার বাইরেও কলেজের সকল সহপাঠক্রমিক কাজে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলাম অধ্যক্ষ মহোদয়ের তাগিদে। এবং নিজেরও ভালোলাগার তাগিদ ছিলো এসব কাজে যুক্ত হওয়ার মধ্যে। ১৯৭৮-৭৯ শিক্ষাবর্ষের জামান-নাসির পরিষদের ছাত্র সংসদের আমি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক। কলেজে তখন ছাত্র সংসদের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিভাগের মাধ্যমে সপ্তাহব্যাপী সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা এবং সাহিত্য উৎসব হতো। ছাত্র সংসদের সভায় আমি প্রস্তাব করলাম— এবার সাহিত্য উৎসবের সমাপনী এবং পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কবি শামসুর রাহমানকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানাতে চাই। প্রস্তাব সানন্দে এবং সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো। যথারীতি কবির সাথে আমরা যোগাযোগ করলাম এবং কবিও আগ্রহভরে অনুষ্ঠানে আসার সম্মতি দিলেন। বর্ণাঢ্য আয়োজনে কবিকে আমরা বরণ করলাম। সুন্দর অনুষ্ঠান হলো। কবি অনেক কথা বললেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করলেন। অনুষ্ঠান শেষে খাবার টেবিলে এবং কবির বিশ্রামের মুহূর্তগুলোতে আমি নানা আলোচনার সুযোগ নিলাম। সাহস করে বলেই ফেললাম—

“কবি, আপনার সম্পর্কে নরসিংদীবাসীর অনেকেরই অনুযোগ, আপনি নরসিংদীর সাথে সম্পর্ক রাখছেন না।”
কবি হেসে বললেন, “কেনো এই অনুযোগ? নরসিংদী তো আমার শেকড়। আমার অনেক কবিতায় আমার গ্রাম, আমার পূর্বপুরুষ, আমার মেঘনা-বিধৌত চরাঞ্চল, নরসিংদীর মাটি ও আমার নানা সুখ-দুঃখের স্মৃতির বিবরণ রয়েছে। আমার অনেক কবিতার জন্ম নরসিংদীর পাড়াতলী গাঁয়ের মাটিতে বসে।”
এবং কবি উল্টো অনুযোগ করলেন, “নরসিংদীর মানুষ তো আমাকে ডাকে না সভা-অনুষ্ঠানে, আমি তো নিয়মিত পাড়াতলী আসি, সময় কাটাই প্রকৃতির কোলে। আজ আপনারা ডেকেছেন, আমি এসেছি। আমাকে ডেকে কেউ পায়নি, এমন অভিযোগ তো করা যাবে না।”
আমি লজ্জিত হলাম। বললাম, “কবি, আপনি ঠিক বলেছেন, ব্যর্থতা আমাদের। আমরা আপনাকে জানার চেষ্টা করি না। আপনার কবিতা পড়ি না। আপনাকে কাছে পাওয়ার সুযোগ নিই না।”

এ-প্রসঙ্গে কবির বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘হৃদপদ্মে জ্যোৎস্না দোলে’র একটি কবিতা ‘পাড়াতলী গাঁয়ে যাই’র উল্লেখ না করে পারছি না। এই কবিতায় কবি তাঁর উৎস এবং শেকড়ের কথা বলেছেন অকপটে, কবিতার শিল্প আঙ্গিকে—

পাড়াতলী গাঁয়ে যাই
পাড়াতলী একটি গাঁয়ের নাম,
…পাড়াতলী আমাদের আদি বাসস্থান
বহুযুগ ধরে কল্লোলিত মেঘনা নদীর তীরে। এখানেই
ছিলেন আমার পিতা, পিতামহ, মাতামহ আর
প্রবীণ প্রপিতামহ আর বহু গুরুজন।
পাড়াতলী গাঁয়ে কখনো কখনো যাই গাঢ় আকর্ষণে
নিজের উৎসের আর পিতার নির্মিত
দালানে প্রবেশ করি কিছু স্মৃতির সুঘ্রাণ নিতে। দালানের
পাশেই পুরানো মসজিদ, মসজিদটির পাশে
কী নিঝুম গোরস্থান, যেখানে আমার পিতা, পিতামহ আর
মাতা গভীর, গভীরতম ঘুমে অচেতন এবং আমার প্রিয়
সন্তানও সেখানে আছে মাটির নিচে ঘুমপাড়ানিয়া
গানে মগ্ন দুনিয়ার মাঠের খেলার মায়া ভুলে।
*  *  *
মেঘনা নদীর ডাকে, আমার উৎসের
গভীর গভীর টানে মাঝে মাঝে আমি পাড়াতলী গাঁয়ে যাই।

তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘ভাঙ্গাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুঁকছে’র উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘তট ভাঙ্গার জেদ’, যার মধ্যেও রয়েছে শেকড়ের কথা এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কবি কবিতায় বলেছেন—

বলতে ভালো লাগে, আমার পূর্বপুরুষগণ
মেঘনা নদীর তীরবর্তী পাড়াতলী গাঁয়ের
বাসিন্দা ছিলেন। তাঁদের ছোটবড় কুঁড়ে ঘর
এখন নিশ্চিহ্ন, কিন্তু পুকুর আর পাকা মসজিদটি
আজ অব্দি রয়ে গেছে সগৌরবে। আমার
পিতার সৃষ্ট একটি দালান আর ইশকুল এখনও
দাঁড়ানো মাথা উঁচু করে।
*  *  *
দাদাজান, নানাজান, আব্বা আর বড় চাচা, আমার
এক সন্তানের এবং আরও কারও কবর রয়েছে সেখানে।
রাত্তিরে নিষ্প্রদীপ সেই উদাস কবরস্থানে জোনাকিরা ছড়ায়
আলো আর ঝিঁঝিঁ পোকা একটানা সুর হয়ে ঝরে চৌদিকে।

পূর্বপুরুষদের কদমি পুকুর আত্মজকে আমার
গিলেছে সেই কবে। এক ভরদুপুরে। আজও স্বগ্রামে
গেলে অতীত এবং বর্তমানের প্রতি নির্বিকার পুকুরটির কিনারে
গিয়ে বসি। গাছ গাছালি ঘেরা এই
জলাশয় সাক্ষী এখানে একাত্তরে হিংস্রতার তাড়া-খাওয়া
সন্ত্রস্ত হরিণের মতো জন্মশহর থেকে ছুটে এখানেই
নিয়েছিলাম ঠাঁই। এই পুকুর আমাকে দেখলেই, মনে হয়,
হাসে বাঁকা হাসি; তবু দিয়েছে যুগল কবিতা উপহার।
*  *  *
শহর লালিত পালিত এই আমার সত্তায় পাড়াতলী গাঁয়ের
পূর্বপুরুষদের শোণিতধারা প্রবাহমান
মেঘনার স্রোতের মতো। বুঝি তাই সমাজের বহুমুখী
নিপীড়ন, নির্দয় শাসকদের সন্ত্রাস আজ
ভেতর মেঘনার উত্তাল তরঙ্গমালা হয়ে জেগে ওঠে প্রতিবাদ
এগিয়ে চলার তেজ, প্রতিক্রিয়ার অনড় তট ভাঙ্গার জেদ।

এই কবিতায় কবি বলেছেন, ‘তবু দিয়েছে যুগল কবিতা উপহার’। এই যুগল কবিতা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকালীন কবির অসাধারণ সৃষ্টি এবং ব্যাপক জনপ্রিয় দুটি কবিতা— ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’। ১৯৭২ সালে প্রাকাশিত ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থের মুক্তিযুদ্ধের যুগল কবিতা। এ নিয়েও কবিকে প্রশ্ন করেছি—

“এ দুটি রচনা সম্পর্কে কিছু বলুন”।
কবি বলেছেন, “কবিতা লিখেছি ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে। আমার বিশ্বাস ছিলো, স্বাধীনতা আসবেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় একদিন গ্রামের বাড়িতে পুকুরপাড়ে বসেছিলাম। পুকুরে অনেকে গোসল করতে আসতো। কয়েকজন ছোটো ছেলেমেয়ে গোসল করছিলো সে-সময়। তাদের ঝাপাঝাপি, অবাধ সাঁতার আমার মনে এক ঝিলিক দিয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে কবিতার লাইন মনে এলো আমার। দ্রুত আমার চাচাত ভাইয়ের কাছ থেকে পেন্সিল আর কাগজ নিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করলাম, পাছে যদি লাইনগুলো হারিয়ে যায়। খুব অল্প সময়ে কবিতা দুটি লিখেছিলাম।”

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মহাকাব্যের বিশালতা ও ব্যাপকতা এবং বিস্তৃতি নিয়ে পাড়াতলী গাঁয়ে বসে লেখা কবিতা দুটি কবির জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে অন্যতম এবং ইতিহাসের দলিল। পাড়াতলী গাঁয়ে কবির পারিবারিক পুকুরে ডুবে তাঁর অকালে প্রয়াত সন্তানের একটি ছবিকে নিয়ে লিখিত কালজয়ী ও শিল্পউত্তীর্ণ কবিতা ‘একটি ফটোগ্রাফ’। কবিতাটি ‘এক ফোঁটা কেমন অনল’ কাব্যের অন্তর্গত এবং এককালে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

কবি শামসুর রাহমানের সৃষ্টিকর্মের এসব তথ্যই প্রমাণ দিচ্ছে, কবির শিকড়সম্বন্ধ কতো গভীর। কবি নিজেও বলেছেন, “নরসিংদীর সঙ্গে আমার একটি গভীর আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। এই জেলার রায়পুরা থানার পাড়াতলী গ্রামে আমার পূর্বপুরুষদের পবিত্র জন্মস্থান। তাই পাড়াতলী তথা নরসিংদীর স্মৃতি আমাকে আনন্দ দেয়, আমার সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতিগুলিকে আন্দোলিত করে।”

১৯৬০ সালে প্রকাশিত ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ নামে প্রথম কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে একজন রোমান্টিক কবি হিসেবে শামসুর রাহমানের সদর্প যাত্রা শুরু। কিন্তু কবি পরবর্তীতে দেশ, কাল, রাজনীতি, সমাজ সচেতন হয়ে ওঠেছেন। হয়ে ওঠেছেন জীবন সচেতন কবি এবং তাঁর কবিতার বিষয় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ভাষা আন্দোলন, বাংলা ভাষা ও বর্ণমালার প্রতি গভীর ভালোবাসা, গণ-আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধ, নানা সংগ্রামী চেতনা এবং স্বদেশ-মানবপ্রেম। কবি তাঁর কবিতায় স্বপ্ন দেখেছেন, আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, আবার স্বপ্ন ভঙ্গের আর্তিও প্রকাশ করেছেন। সব মিলিয়ে ভাব-আঙ্গিকে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের শিল্পধারার সমন্বয় করে কবি হয়ে ওঠেছেন কালজয়ী শিল্পী। অতিক্রম করেছেন অঞ্চল ও দেশকে। যথার্থ অর্থে যিনি কবি, তিনি যেখানেই জন্ম নেন না কেনো, তিনি তাঁর শিল্পকর্মের সফলতা দিয়ে কালজয়ী হয়ে যান। হয়ে যান অঞ্চলকে অতিক্রম করে দেশের, দেশকে অতিক্রম করে পৃথিবীর।
শামসুর রাহমান সেই কবি।


গোলাম মোস্তাফা মিয়া
সাবেক অধ্যক্ষ, নরসিংদী সরকারি কলেজ

ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশন

‘পথের পাঁচালী’খ্যাত লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নরসিংদীর একটি টালিঘরে কয়েকদিন বসবাস করেছিলেন। টালির ঘরটি ছিলো স্থানীয় সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশন (হাইস্কুল)-এর একটি ছাত্রাবাস। ছাত্রাবাসের একটি অংশে শিক্ষকরাও বাস করতেন। তিনি যখন নরসিংদীতে আসেন, তখন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্যেই তিনি তৎকালীন ঢাকা জেলার অজপাড়াগাঁ নরসিংদীতে এসেছিলেন। নরসিংদী তখন একটি পুলিশ ফাঁড়ির অধীনস্থ ছোটো একটি গঞ্জ। মেঘনা নদীতীরের জনপদটির জমিদার ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা, শিক্ষাব্রতী ও আইনজীবী ললিতমোহন রায় বিএবিএল। তিনিই তাঁর পিতা জমিদার কালী নারায়ণ রায়ের নামের স্কুলটি ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন।

বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) কি শুধুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্যে নরসিংদী এসেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিভূতিভূষণের অকথিত একটি অধ্যায়ের সন্ধান পাওয়া যায়। সেটা হলো, তিনি ছিলেন ভারতীয় গোরক্ষিণী সভার প্রচারক। যার জন্যে তাঁকে বাংলা, ত্রিপুরা ও বার্মার বিভিন্ন এলাকা ভ্রমণ করতে হয়েছিলো। সেই ভ্রমণের অংশ হিসেবে তিনি নরসিংদী এসেছিলেন। একই সঙ্গে বন্ধুর আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন। মূলত গোসম্পদ রক্ষা এবং রোগগ্রস্ত ও দুর্বল গরুদের রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করার জন্যে গোরক্ষিণী সভা কাজ করতো। যার সভাপতি ছিলেন গিরিধারী লাল। সেই গোরক্ষার আদর্শ বুকে ধারণ করেই বর্তমানে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার ভারতকে বিতর্কের মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন।

অবশ্যই বিভূতিভূষণ গোরক্ষার প্রচারকাজে বেশিদিন সময় দেননি। এরপর তিনি খেলাৎচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে গৃহশিক্ষক, সচিব এবং তার ভাগলপুর জমিদার এস্টেটের সহ-ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকুরি করেন। কিছুদিন ধর্মতলাস্থ খেলাৎচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর যোগ দেন গোপালনগর স্কুলে। আমৃত্যু সেখানেই শিক্ষকতা করেছেন। লেখালেখি করেছেন দুহাতে। জন্ম দিয়েছেন পথের পাঁচালী (১৯২৮), অপরাজিত (১৯৩১), মেঘমাল্লার (১৯৩১), মৌরীফুল (১৯৩২), যাত্রাবদল (১৯৩৪), চাঁদের পাহাড় (১৯৩৭), কিন্নরদল (১৯৩৮), আরণ্যক (১৯৩৯), আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৪০), ইছামতী (১৯৫০) ও অশনি সংকেত (১৯৫৯) প্রভৃতি কালজয়ী গ্রন্থ। তাঁর লেখা উপন্যাস নিয়ে বেশকিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। জগদ্বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালী, অপরাজিত ও অশনি সংকেত চলচ্চিত্র নির্মাণ করে বিভূতিভূষণকে অন্যতম উচ্চতায় নিয়ে যান।

ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) | ছবিসূত্র : ইন্টারনেট

বিভূতিভূষণ যখন গোরক্ষিণী সভার প্রচারক হিসেবে কাজ করেন, তখন ভারতবর্ষের অনেক খ্যাতনামা লোক এর ব্যাপক সমালোচনা করেন। শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে মানুষের, বিশেষ করে মুসলমানদের খাবার পথে বাঁধা দেয়ার এই প্রচেষ্টায় ধর্মীয় বিভেদও সৃষ্টি হয়। স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ এতে ভীষণ রকম বিরক্ত হয়েছিলেন। একবার গোরক্ষিণী সভার সম্পাদক এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। স্বামীজী তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের সভার উদ্দেশ্য কী?” সম্পাদক জবাব দেন, “আমরা স্থানে স্থানে পিজরাপোল স্থাপন করছি। দুর্বল, রুগ্ন, জরাগ্রস্ত গোমাতাদের সেখানে রেখে পালন করি। তাছাড়া কসাইদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করি।” স্বামীজী বলেন, “উদ্দেশ্য সৎ সন্দেহ নেই। কিন্তু মধ্য ভারতে শুনেছি নাকি প্রায় ৯ লক্ষ লোক মারা গেছে অনাহারে। এই দুর্ভিক্ষ নিবারণে কতো টাকা সাহায্য করেছেন আপনারা?” সম্পাদক জবাব দেন, “দুর্ভিক্ষে সাহায্য আমরা করি না। গোমাতা রক্ষা করাই আমাদের পরম ধর্ম।” স্বামীজীর প্রশ্ন, “আর মানুষ মরে গেলে তার মুখে একমুঠো অন্ন দেওয়া বুঝি আপনাদের ধর্ম নয়?” সম্পাদকের জবাব, “মানুষ মরছে নিজের কর্মফলে, নিজের পাপে, নিজের…” স্বামীজী আবারো বলেন, “আর গোমাতারা? তারা যে কসাইদের হাতে পড়েন, সে-ও তো তাদের কর্মফলে। তবে আর তাদের বাঁচাবার কী দরকার?” সম্পাদক জবাব দেন, “তা আপনি যা বলেছেন তা সত্য, তবে শাস্ত্রে আছে, গাভী আমাদের মাতা।” স্বামীজী সবশেষে বলেন, “হ্যাঁ, গাভী যে আপনাদের মাতা, তা বুঝতে পারছি আমি, নইলে এমনসব ছেলে জন্মাবে কেনো?”

এমনসব প্রতিক্রিয়ার কারণে বোধহয় সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ গোরক্ষিণী সভার প্রচারক হিসেবে কাজ করতে সক্ষম হননি। তবে তিনি শুধুমাত্র চাকুরির খাতিরে এই ধরনের বিতর্কিত কাজে নিজেকে জড়িয়েছিলেন। তিনি পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলা ভ্রমণ শেষে বার্মার আরাকান অঞ্চলের মংডুতে পৌঁছান। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের শারদীয় পূজার কিছু আগে তিনি প্রচারকের চাকুরি নিয়েছিলেন। প্রখ্যাত মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী কেশোরাম পোদ্দারের অনুরোধে মাসিক ৫০ টাকা বেতনে তিনি চাকুরিটি নিয়েছিলেন। মংডু থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকা জেলার কিছু এলাকা ভ্রমণ শেষে তিনি কলকাতায় ফিরে যান। সেখানে গিয়েই তিনি গোরক্ষিণী সভার প্রচারক পদ থেকে ইস্তফা দেন। তখন তিনি থাকতেন ৪১ নম্বর মির্জাপুর স্ট্রিট (বর্তমানে সূর্যসেন স্ট্রিট)-এর মেস বাড়িতে।

১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুলাই বিভূতিভূষণ হরিনাভি স্কুলের মাস্টারি ছেড়ে নতুন করে চাকুরির খোঁজে কলকাতায় চলে আসেন। মেসে থেকেই চাকুরির খোঁজে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতেন। ঠিক সেই সময়ই প্রচারকের চাকুরিটা পেয়ে যান। কলকাতা শিয়ালদাহ রেলস্টেশন থেকে তিনি ট্রেনে কুষ্টিয়ার পথে পা রাখেন। এরপর একে একে কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল, ঢাকা, নোয়াখালী, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম ও বার্মা ভ্রমণ করেন। এসব স্থান থেকে তিনি গোরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়াদি প্রতিবেদন হিসেবে কলকাতায় সমিতি অফিসে পাঠাতেন। বিভূতিভূষণ তাঁর ভ্রমণ কাহিনি ‘অভিযাত্রিক’ গ্রন্থে তার উল্লেখ করলেও গোরক্ষা সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো উল্লেখ করেননি। হয়তোবা তিনি ইচ্ছা করেই তা চেপে গিয়েছিলেন। কোনো গবেষকও সেসব প্রতিবেদন খুঁজে বের করার প্রয়োজন বোধ করেননি। যে-কারণে একটি মূল্যবান উপাদান থেকে বাঙালি পাঠক সমাজ এখনো পর্যন্ত বঞ্চিত রয়েছেন।

তবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকা জেলার নরসিংদী জনপদে যে-ভ্রমণ করেছিলেন, তাঁর সুন্দর বিবরণ রয়েছে। ‘অভিযাত্রিক’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, গোরক্ষিণী সভার প্রচারকের কাজের পাশাপাশি তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে দেখার জন্যে সেখানে যান। একসঙ্গে সেখানকার গোসম্পদের খোঁজ নেয়া, কী পরিমাণ গরু পালন হয় কিংবা কসাইয়ের ছুরির নিচে কতোটি গোমাতার জীবন বিসর্জন দেয়া হচ্ছে, সেসব তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রতিবেদন আকারে কলকাতায় রিপোর্ট দেয়ার জন্যে তিনি মেঘনা তীরবর্তী এলাকাসমূহ ঘুরে দেখেন। সাটিরপাড়া মহল্লার গোচারণ ভূমি পায়ে হেঁটে অবলোকন করেন।

১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুলাইয়ের পর মাস্টারি ছেড়ে দিয়ে বিভূতিভূষণ গোরক্ষিণী সভার প্রচারক হিসেবে পূর্ববঙ্গে যে-ভ্রমণ করেছিলেন, তা একই বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিলো। সেটা তাঁর ‘অভিযাত্রিক’ বইয়েই উল্লেখ রয়েছে। সেখানে তিনি নরসিংদী ভ্রমণ সম্পর্কে নিজমুখে বলেন, “শীতলক্ষ্যা নদীর পুল পার হয়ে আবার ট্রেন এসে থামলো ঘোড়াশাল স্টেশন। ঘোড়াশাল থেকে ঢাকা জেলায় এখান থেকে কিছুদূরে নরসিংদি (নরসিংদী) গ্রামের হাই স্কুলে আমার এক বন্ধু হেডমাস্টার, অনেকদিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি, বিদেশ ভ্রমণের সময় পরিচিত বন্ধুজনের দেখাসাক্ষাৎ বড় আনন্দদান করে, সেজন্য ঠিক করেছিলাম ঢাকা যাবার পথে বন্ধুটির ওখানে একবার…।”

‘অভিযাত্রিক’ বইয়ে বিভূতিভূষণ নরসিংদী যাবার যে-বিবরণ দিয়েছেন, তাতে যৎসামান্য তথ্যগত ভুল রয়েছে। তিনি আখাউড়া দিয়ে ত্রিপুরা রাজ্য ভ্রমণ শেষে ট্রেনে নরসিংদী পৌঁছেছিলেন। যদি তাই হয়, তাহলে শীতলক্ষ্যা নদী ঘোড়াশালের আগে নয় যে, শীতলক্ষ্যা পেরিয়ে ঘোড়াশাল আসতে হবে। এখানে আরেকটি প্রশ্ন, তখন কি নরসিংদীতে কোনো রেলস্টেশন ছিলো না, যার কারণে তিনি ঘোড়াশাল স্টেশনে নেমে নরসিংদী এসেছিলেন। আবার তাঁর বর্ণনায় এসেছে ঘোড়াশাল থেকে নরসিংদী গ্রামের অবস্থান কিছুদূর। প্রকৃতপক্ষে ঘোড়াশাল থেকে নরসিংদীর দূরত্ব কিছুদূর নয়, কমপক্ষে ৬/৭ মাইল। তাই আমি মনে করি, বিভূতিভূষণ আসলে নরসিংদী রেলস্টেশনে নেমে সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশনে গিয়েছিলেন। স্টেশন থেকে স্কুলের দূরত্ব কিছুদূর।

আসলে তিনি নরসিংদী রেলস্টেশন আর ঘোড়াশাল রেলস্টেশন গুলিয়ে ফেলেছিলেন। কারণ, তিনি সেখানে গিয়েছিলেন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে। আর সেই ভ্রমণ কাহিনি তিনি ‘অভিযাত্রিক’ বইয়ে প্রকাশ করেছিলেন ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ২২ মার্চ। এর আগে তিনি পূর্ববঙ্গে ভ্রমণ কাহিনিটি কোনো পত্র-পত্রিকা কিংবা সাময়িকীতে প্রকাশ করেননি। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্সের অন্যতম কর্ণধার ও বিশিষ্ট লেখক গজেন্দ্রকুমার মিত্রের অনুরোধে তিনি ভ্রমণ কাহিনিটি লিখেছিলেন। তিনি তখন যে-ডায়েরি লিখেছিলেন, তার অবলম্বনেই ‘অভিযাত্রিক’ লেখেন। তিনি চোখের দেখা আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে সে-ডায়েরি রচনা করেছিলেন। তিনি মূলত নরসিংদী ভ্রমণ শেষে ট্রেনে ঢাকায় গিয়েছিলেন। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে স্টিমারে গোয়ালন্দ যান। গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনযোগে কলকাতার শিয়ালদা গিয়ে পৌঁছেন। তাই আমার ধারণা, তখন তার ডায়েরিতে ঘোড়াশাল রেলস্টেশন এবং শীতলক্ষ্যা নদীর উল্লেখ করেছিলেন। ‘অভিযাত্রিক’-এর পাণ্ডুলিপি করার সময় তথ্যের কিছুটা হেরফের হয়েছে। যা তাঁর সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত বিষয় ছিলো।

বিভূতিভূষণ নরসিংদীতে যখন যান, তখন জনপদটি অজপাড়াগাঁ। প্রশাসনিক কাঠামো বলতে সেখানে মেঘনা নদীর তীরে একটি কোতঘর (রাজস্ব কেন্দ্র) ও একটি ছোটো পুলিশ ফাঁড়ি ছিলো। মেঘনা ও হাড়িধোয়া নদীর সঙ্গমস্থল ঘেঁষে একটি ছোটো হাট বসতো, যা ‘কৃষ্ণগঞ্জ বাজার’ হিসেবে পরিচিত ছিলো। স্থানীয় জমিদার ললিতমোহন রায় বিএবিএল তাঁর দাদা কৃষ্ণচন্দ্র পাল (রায়)-এর নামে বাজারটি গড়ে তুলেছিলেন। পুলিশ ফাঁড়িটিও তাঁর উদ্যোগে গড়ে ওঠে। তবে অন্যান্য কাঠামো ছিলো গ্রামীণ, কাচা ঘরবাড়ি, মেঠোপথ। কৃষি এবং মৎস্য শিকার করে অধিকাংশ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতো। বিভূতিভূষণের বিবরণে সেই গ্রামীণ আবহ ফুটে ওঠেছে। তাঁর বর্ণনায় পাওয়া যায়, “অজপাড়াগাঁয়ের স্কুল। পূর্ববঙ্গের একটি ক্ষুদ্র গ্রাম স্কুলের শিক্ষক যাদের সকলেরই বাড়ি এখানে, হেডমাস্টার আর হেডপণ্ডিত এই দুজন মাত্র বিদেশী। আমার বন্ধু ছাত্রজীবনে পড়াশুনায় ভালো ছিলেন, খুব স্মার্ট, ভালো ক্রিকেট খেলোয়াড়, চেহেরাও খুব সুন্দর। এহেন স্টাইলবাজ, সুপুরুষ, ইংরেজিতে উঁচু সেকেন্ড ক্লাশ পাওয়া ছেলে মাত্র ষাট টাকা মাইনেতে এই সূদূর ঢাকা জেলার এক পাড়াগাঁয়ে এসে আজ তিন বছর পড়ে আছে। চাকুরির বাজার এমনি বটে।”

ইংরেজিতে এমএ করা মেধাবী বন্ধুর এই চাকুরি নিয়ে বিভূতিভূষণ হতাশা প্রকাশ করলেও নরসিংদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে বেশ প্রশংসা করেন, “এখানে আর কিছু না হোক প্রাকৃতিক দৃশ্য হিসাবে জায়গাটা ভাল। গ্রামের বাইরে দিগন্ত-বিস্তীর্ণ মাঠ মেঘনার তীর ছুঁয়েচে, তারই মাঝে মাঝে ছোট বেত ঝোপ, মাঝে মাঝে বুনো শটির গাছ। এদিকে একটা ছোট খাল। স্কুলের বাড়িটি এই ছোট খালের ধারে, বড় বড় ঘাসের বলের আড়ালে, নিকটে লোকালয় আছে বটে কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে হয় অস্ট্রেলিয়ায় বা দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মধ্যে এসে পড়েছি কোন মায়া বলে।”

বিভূতিভূষণ স্কুলের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, “স্কুল বাড়ির পাশে বোর্ডিং। তিন চারটি বড় বড় ঘর, সেগুলির মেঝে হয়নি এখনও, সুতরাং মাটির সঙ্গে প্রায় সমতল, অত্যন্ত নিচু ভিতরে ওপর বাড়িটা গাঁথা। আমার বন্ধুর কথামতো একটি ছেলে আমার সঙ্গে করে এনে বোর্ডিংয়ের একটা ঘরে বসিয়ে রেখে গেল। আমার বন্ধুটি এই ঘরে থাকেন। একটা কাঠের তক্তপোশ, তার ওপর আধমালা একটা বিছানা, আর তার ওপর খানকতক বই বিছানো। অন্যদিকে কতকগুলো চায়ের পেয়ালা, একটা স্টোভ, দুটি টিনের তোরঙ্গ, একজোড়া পুরোনো জুতো ইত্যাদি। হেডমাস্টারের জন্য বোর্ডিংয়ের এই ঘরটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বুঝলাম।”

বিভূতিভূষণের বন্ধুটির নাম কী? তিনি বন্ধুর স্বভাব-চরিত্র নিয়ে অনেক কথা বলেছেন, “কলকাতার পটুয়াটোলার মেসে থাকার সময় বন্ধুটি যে চালবাজি করতো, সাটিরপাড়া স্কুলেও সে চালবাজি অব্যাহত রেখেছে। শিক্ষকদের অবজ্ঞা করা, তাদেরকে কথায় কথায় ছোট করা এমন কি ওদের দিয়ে চা বানানো ও রান্নাবান্নার কাজ পর্যন্ত করিয়ে নিচ্ছেন। অথচ তিনি প্রচার করছেন, শিক্ষকরা অযোগ্য বলেই তাকে তোষামোদ করেন। অযথা তাদের থাকার ঘরে এসে নানা ফুটফরমাইশ খাটে।”

বিভূতিভূষণ সেই প্রধান শিক্ষকের নাম উল্লেখ না করলেও আমার গবেষণা ও অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, সেই হেডমাস্টারের নাম দীনেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এমএ। তিনি তিন বছর উক্ত স্কুলে ছিলেন। তিনি ছিলেন স্কুলের ষষ্ঠ হেড মাস্টার। করুণাময় গুহ বিএবিটি চলে যাওয়ার পর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ললিতমোহন রায় সংবাদপত্রে হেডমাস্টার চেয়ে বিজ্ঞাপন দিলে দীনেশচন্দ্র চাকুরির আবেদন করে উত্তীর্ণ হন। তিনি আসার আগে সাটিরপাড়া স্কুলের উপর অনেক ঝড়-তুফান যায়। একটি স্বার্থান্বেষী মহল ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে পুকুরের পূর্ব-পশ্চিম পাশে অবস্থিত স্কুলের টিনের চৌচালা দুটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। তখনকার প্রধান শিক্ষক করুণাময় গুহ ও প্রতিষ্ঠাতা ললিতমোহন রায়ের চেষ্টায় সেখানে স্থাপনা পুনর্নির্মিত হয়। স্কুলে হেডমাস্টারের তালিকা বোর্ডে করুণাময়ের পর জে এল লাহিড়ীর নাম রয়েছে। কিন্তু তিনি ছিলেন এমএবিটি। পরের জন ছিলেন সিম্পল এমএ। বিভুতিভূষণের বন্ধুও এমএ পাস ছিলেন। তাই আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যখন নরসিংদী আসেন, তখন সেখানকার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন দীনেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সাটিরপাড়া স্কুল ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে বিটি পাস করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি পেয়ে বিলেত চলে যান উচ্চশিক্ষার জন্যে। বিলেত থেকে এসে তিনি ভারত সরকারের শিক্ষা বিভাগে উচ্চতর পদে যোগ দিয়েছিলেন। এসব তথ্য বিভূতিভূষণের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়।

বিভূতিভূষণের নরসিংদীর স্মৃতিতে কিছু চমকপ্রদ বিষয় জানা যায়। তিনি সাটিরপাড়া গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলেন। স্কুলের ড্রয়িং মাস্টার হরনাথের সঙ্গে তার ভাব হয়ে গিয়েছিলো। এমনকি তাঁর বাড়িতে পর্যন্ত বেড়াতে গিয়েছিলেন। এমন সাদাসিদে মাটির মতো শিক্ষকের প্রেমে পড়ে তিনি সাটিরপাড়া স্কুলে শিক্ষকতার পেশা নেয়ার অভিমতও প্রকাশ করেছিলেন। ড্রয়িং মাস্টারের ভাইঝি মঞ্জুর সঙ্গে অনেক কথা বলেছেন। তার হাতে বানানো পান খেয়েছেন। তারপর হরনাথের স্ত্রীর হাতের চা-নাস্তা খেলেন, যা খেয়ে বিভূতিভূষণ ভীষণ প্রশংসা করেন।

নরসিংদী বেড়ানোর সময় বিভূতিভূষণ সাটিরপাড়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক, সহকারি শিক্ষকদের দেয়া একটি ভোজ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সে-উপলক্ষে এক এলাহি কাণ্ড ঘটেছিলো, যা তিনি অনেকদিন মনে রেখেছিলেন। স্কুলের হলে রান্নাবান্নার মহাকাণ্ড চলছে। সবই বিভূতিভূষণের সম্মানে হচ্ছে। বড়ো ডেকে পোলাও চড়েছে। প্রকাণ্ড বড়ো দুটি মাছ কোটা হচ্ছে। আরো দুয়েক ডেক পোলাও রাঁধবার মাল-মশলা ডালায় সাজানো রয়েছে। শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারী সবাই এসবের দেখভাল নিয়ে ব্যস্ত। কেউ তদারকি নিয়ে ব্যস্ত। কোথায় খাওয়ার পাতা সাজানো হবে, সব ঠিকঠাক করছেন। হেডমাস্টার আর বিভূতিভূষণকে মাঝখানে বসিয়ে সবাই খেতে লাগলেন। একই সঙ্গে চলছে নানান গল্প। একজন শিক্ষক বললেন, “আমাদের দেশ আপনার কেমন লাগলো?” বিভূতিভূষণ জবাব দিলেন, “বড় ভালো লেগেছে। পূর্ববঙ্গের লোকের প্রাণ আছে।”

এভাবে কয়েকটি দিন কেটে গেলো। তবে নরসিংদী ভ্রমণে তাঁর সবচে’ ভালো লাগার জিনিস ছিলো চাঁদনী রাতে মেঘনা নদীর অপূর্ব দৃশ্য অবলোকন, যা তিনি স্মৃতিকথায় লিখেছেন। এক সন্ধ্যায় বন্ধু হেডমাস্টারকে নিয়ে স্কুল থেকে সিকি মাইল পূর্বদিকে মেঘনার পাড়ে বেড়াতে গেলেন। জ্যোৎস্না রাতে মেঘনার তরঙ্গভঙ্গ দেখার লোভ সামলাতে পারলেন না বিভূতিভূষণ। তিনি ভ্রমণ কাহিনিতে বললেন, “বন্ধুকে নিয়ে আমরা গেলুম মেঘনার ধারে। ওপারে কি একটা গ্রাম, এপারে দিগন্ত-বিস্তীর্ণ প্রান্তর, মাঝে মাঝে বাঁশবন, বনঝোপ। নোয়াখালী জেলার মেঘনা যতখানি চওড়া দেখেছি, এখানে নদী তার চেয়ে ছোট। তবুও আমার মনে হলো জলরাশির এমন শোভা দেখেছিলুম শুধু কক্সবাজারের ও মংডুর সমুদ্রতীরে। সন্দ্বীপের তালাবন-শ্যাম-উপকূল-শোভা সেই এক সন্ধ্যায় স্টিমারের ডেক থেকে প্রত্যক্ষ করে মনে যে আনন্দ পেয়েছিলুম, আজও যেন সেই ধরনের আনন্দই আবার ফিরে এল মনে।”

বিভূতিভূষণ নরসিংদীর যে-মেঘনা অবলোকন করেছিলেন, সেটা বর্তমানে নেই। স্কুল থেকে সিকি মাইল দূরত্বের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, সেখানে এখন অসংখ্য ঘরবাড়ি, মিল-কারখানা, জুট মিল। তিনি যখন মেঘনার পাড়ে গিয়েছিলেন, তখন নদীর তীর ঘেঁষে শুধুমাত্র রামদাস বাউলের আখড়া ছিলো। আখড়াটি অনেক পুরোনো। ধারণা করা হয়, প্রায় ৪০০ বছর আগে রামদাস বাউল সেখানে অবস্থান করেছিলেন। তাঁর বংশধররা পরম্পরায় মেঘনা নদীর তীরে বসবাস করছেন। তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এলাকাটি বাউলপাড়া হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে সেখানে বাৎসরিক বাউল মেলা হয়ে আসছে। মেঘনার তীরে সে-মেলায় দেশ-বিদেশ থেকে বাউল সম্প্রদায়ের লোকজন অংশগ্রহণ করে থাকে। মেলা ছাড়াও আশ্রমধামে বাউলসঙ্গীত পরিবেশন হয়। রামদাস বাউল অসংখ্য গান রচনা করেছেন।

স্বল্প সময়ে বাংলা সাহিত্যের শক্তিশালী লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নরসিংদী ভ্রমণে এসে এখানকার মানুষের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। সুন্দর পরিবেশ তাঁর মনে গেঁথে যায়। যা তাঁর ভ্রমণ কাহিনিতে ফুটে ওঠেছে। তিনি স্কুলে শিক্ষকতা সূত্রে নরসিংদী থেকে যাবারও আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু নরসিংদীপ্রেমী এই সাহিত্যিকের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই স্থানীয়ভাবে। সাটিরপাড়া স্কুলের বোর্ডিংয়ে বিভূতিভূষণ বসবাস করলেও তার কোনো ডকুমেন্ট স্কুলে নেই। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেও এই সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বিভূতিভূষণ যে স্কুলে এসেছিলেন, সেটাও তাদের জানা নেই। তাই স্কুলের টালির ঘরের সামনে এই মহান সাহিত্যিকের একটি স্ট্যাচু নির্মাণ করা হলে বর্তমান প্রজন্ম ইতিহাসটা অন্তত জানতে পারবে।


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

ভারতের অন্ধকার দূর করেছিলেন নরসিংদীর যে-দুজন ইঞ্জিনিয়ার

সুরেন রায় আর কিরণ রায় নরসিংদীর সাটিরপাড়া জমিদার বাড়ির সন্তান। জমিদারি এস্টেট দেখাশোনা বাদ দিয়ে তাঁরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান সুদূর জার্মানিতে। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরলেন এবং যোগ দিলেন কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু তাঁদের মাথায় খেলা করছিলো অন্য এক বৃহৎ পরিকল্পনা। শিক্ষকতার পাশাপাশি স্বদেশি চিন্তাধারায় কীভাবে ভারতবর্ষের শিল্প-কারখানায় অবদান রাখা যায়, তা নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা শুরু করলেন।

ইলেকট্রিক্যাল বিদ্যায় মেধার পরিচয় দিলেও তখন ভারতবর্ষে যন্ত্রপাতি ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি উৎপাদনের সহজ সুযোগ ছিলো না। তাই তাঁরা জার্মানিতে পড়ালেখা শেষ করে সেখানকার বিদ্যুৎ খাত এবং সরঞ্জাম তৈরির কারখানাগুলো ঘুরে-ফিরে দেখেন। এরপর দুই ভাই সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা দেশে ফিরে বৈদ্যুতিক বাতি তৈরি করবেন। সেইসাথে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল জার্মানি থেকে কীভাবে আমদানি করা যায়, সেসব নিয়ম-কানুন জেনে আসেন।

ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সুরেন ও কিরণ নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে চিন্তা-ভাবনা করতেন। কিন্তু তাঁদের আরেক ভাই হেমেন রায় ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত ও দক্ষ প্রশাসক। একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করা এবং সেখানে সুষ্ঠু উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ বিষয়ে হেমেন ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী। সুরেন-কিরণ-হেমেনের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত, বিদ্যোৎসাহী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী। দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুরে যখন ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তখন পূর্ববঙ্গের অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ ও জমিদারদের সঙ্গে নরসিংদীর সাটিরপাড়ার জমিদাররাও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। যে-কারণে সেই পরিবারের দুই সন্তান জার্মানি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে এসে সরকারি কোনো উচ্চ পদে যোগদান না করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকুরি গ্রহণ করেন।

তৎকালীন ঢাকা জেলার শহরতলী নরসিংদীর ‘রায় জমিদার’ পরিবারের মেধাবী দুই ইঞ্জিনিয়ার কেনো বৈদ্যুতিক বাতি তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিলেন? এর নেপথ্য কারণ কী ছিলো? এই বিষয়ে জমিদার পরিবারের ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, মূলত দেশপ্রেমের বোধ থেকে কারখানাটি গড়ে তোলা হয়েছিলো। সে-সময় ভারতবর্ষে স্বদেশিদের কোনো বাতি তৈরির কারখানা ছিলো না। পুরো ভারতবর্ষে আলো বিতরণের ক্ষেত্রে একচেটিয়া বাজার ছিলো ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে নেদারল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত ফিলিপস ইলেকট্রনিক্স কোম্পানির হাতে। তারা ভারতের বিভিন্ন শহরে আলোর জন্যে বাতি সরবরাহ করতো। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে কলকাতার চৌরঙ্গীতে রাস্তার দুধারে প্রথম বিজলি বাতি লাগানো হয়েছিলো। ১৯৩০-৪১ খ্রিস্টাব্দে ফিলিপস ইলেকট্রনিক্স কোম্পানি (ইন্ডিয়া) ৩২ নম্বর চৌরঙ্গী রোডে ৭৫ জন কর্মচারী নিয়ে প্রথম অফিস প্রতিষ্ঠা করে। এর পর থেকেই ল্যাম্পের বাজার ওদের হাতে চলে যায়।

ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে তখন সিংহভাগ কলকারখানার মালিক ছিলো বিদেশিরাই। বড়ো বড়ো পদ দখল করে আছে ব্রিটিশ আইসিএস অফিসাররা। এমতাবস্থায় বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায় দেশীয় মালিকানায় স্বদেশি কলকারখানা গড়ে তোলার আন্দোলন করে যাচ্ছেন। সাটিরপাড়ার জমিদার ললিতমোহন রায় ছিলেন তাঁর পরিচিত। নেতাজী সুভাষ বোসের সঙ্গে ললিতমোহন কংগ্রেস করতেন। বিপ্লবী আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাই প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তাঁকে একটি ইলেকট্রিক ল্যাম্প কারখানা স্থাপনের জন্যে অনুরোধ করেন।

সাটিরপাড়ার জমিদার ললিতমোহন রায়

ললিতমোহন রায়ের বাড়ির দুই ছেলে সুরেন ও কিরণ এই বিষয়ে জার্মানি থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে এসেছেন। তাই বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অনুরোধ ফেলতে পারলেন না তিনি। তাঁদের (সুরেন ও কিরণের) সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করে কলকাতার কসবা এলাকায় প্রথম কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ফিলিপস প্রতিষ্ঠার ঠিক পরপর ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের দিকে ‘বেঙ্গল ল্যাম্পস’-এর কারখানা চালু হয়। এই নামটি নেয়া হয় প্রফুল্ল চন্দ্রের ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস’ থেকে।

কলকাতায় বেঙ্গল ল্যাম্পসের কারখানা

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বেঙ্গল ল্যাম্পসকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রথমদিকে তারা টাংস্টেন ফিলামেন্ট বাল্ব তৈরি করতো। সেই সময় ফিলিপসের তৈরি সোডিয়াম-মার্কারির জোরালো আলো বাঙালির অন্দরমহলে অনেকটা বেমানান ছিলো। তাছাড়া স্বদেশি যুগে ‘বেঙ্গল’ শব্দটি সবার পছন্দ হলো। ফলে ফিলিপস শব্দটির জায়গায় বেঙ্গল শব্দটি জুতসই হয়ে ওঠে। বাজারে তরতর করে বেঙ্গল ল্যাম্পসের উৎপাদিত বাতির চাহিদা বেড়ে যায। নরসিংদীর সাটিরপাড়ার রায় জমিদার বাড়ির ইঞ্জিনিয়ারদের তৈরি ল্যাম্পের আলো বাঙালির ঘরে ঘরে জ্বলতে থাকে। কারখানা বড়ো হতে থাকে। প্রচুর বেকার লোকের কর্মসংস্থান ঘটে। এই প্রথম কোনো স্বদেশি কারখানার কাছে বিদেশি খ্যাতনামা ফিলিপস কোম্পানির পরাজয় হলো। আর বেঙ্গল ল্যাম্পসও ভারতবর্ষের প্রথম বাতি উৎপাদনকারী কারখানার তকমা অর্জন করে।

তৎকালীন কাগজে বেঙ্গল ল্যাম্পের বিজ্ঞাপন

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা অর্জনের পর বেঙ্গল ল্যাম্পস অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। তাদের বাতির চাহিদা এতোটাই বেড়ে যায় যে, কসবার কারখানার উৎপাদন দিয়ে সেই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছিলো না। তাই ‘বাঙালদের রাজধানী’ বা উদ্বাস্তুদের বস্তি অধ্যুষিত যাদবপুর এলাকায় বেঙ্গল ল্যাম্পসের বড়ো কারখানা গড়ে তোলা হয়। কসবা ও যাদবপুরের কারখানায় ওভারটাইম শুরু হয়। পরবর্তীতে বাংলার আলো পৌঁছে যায় সুদূর ব্যাঙ্গালোরেও। বেঙ্গল ল্যাম্পসের সোডিয়াম আর মার্কারি বাতি বাজার দখল করে নেয়। ১৯৬০-এর দশকে বেঙ্গল ল্যাম্প সর্বভারতীয় সবচে’ জনপ্রিয় বৈদ্যুতিক বাতিতে পরিণত হয়।

কিন্তু এরইমধ্যে বড়ো ভাই সুরেনের সঙ্গে সেজো ভাই কিরণের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বাঙালি সেন্টিমেন্টের কাছে রক্তের সম্পর্ক হেরে যায়। ফলে বেঙ্গল ল্যাম্পসে ভাঙন দেখা দেয়। নতুন কারখানা গড়ে ওঠে বেহালায়। বেঙ্গল ল্যাম্পের পাশাপাশি বাজারে আসে কিরণ ল্যাম্প। এই দ্বন্দ্বে বাঙালির নিজস্ব আলো কমতে থাকে। শেষাবধি এর হাল ধরেন সাটিরপাড়ার জমিদার বংশের শেষ উত্তরসুরী তপন কুমার রায় ও তাপস কুমার রায়। তখন কলকাতায় বামফ্রন্ট সরকারের মহাদাপট। বেঙ্গল ল্যাম্পসের মালিকেরা স্বদেশি আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন। তাঁদের দেশপ্রেম ছিলো প্রশ্নাতীত। যার কারণে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এগিয়ে আসেন। নানাভাবে কারখানাটি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্যে তিনি চেষ্টা-তদবীর করেন।

গত শতকের আট দশকের মাঝামাঝি সময় জ্যোতি বসুর একমাত্র ছেলে চন্দন বসু পড়াশোনা শেষ করার পর কোথায় চাকুরি করবেন, তা নিয়ে অনেকটা দ্বিধায় পড়েন। ঠিক তখনই তপন কুমার রায় এগিয়ে আসেন। চন্দন বসুকে বেঙ্গল ল্যাম্পসে চাকুরি দেন। একজন মুখ্যমন্ত্রীর ছেলে হয়ে কোথায় বড়ো বড়ো ব্যবসা-বাণিজ্য করবেন, মিল-কারখানা প্রতিষ্ঠা করবেন, সেখানে তিনি নাকি একটি কারখানায় চাকুরি করছেন। এ নিয়ে তখন রাজনৈতিক মহলে কাথাবার্তাও উঠেছিলো।

স্বাধীনতার প্রতীক স্বদেশি কারখানাটি রুগ্ন হয়ে ওঠলে তা দাঁড় করানোর জন্যে বামফ্রন্ট সরকার অনেক চেষ্টা করেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেঙ্গল ল্যাম্পসের বাতির ব্যবহার বৃদ্ধি করারও উদ্যোগ নেয়া হয়। রাজ্যের পূর্ত দপ্তর তাদের ল্যাম্প কিনতো। একপর্যায়ে তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্ত্তী ফাইলে নোট দেন, “জ্যোতি বসুর নির্দেশেই তাঁর পুত্রের চাকুরিস্থল বেঙ্গল ল্যাম্পসকে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো।” নোটটি প্রকাশ্যে আসার পর তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। যার ফলশ্রুতিতে পূর্তমন্ত্রীকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিলো। পরে পূর্তমন্ত্রী যতীনবাবু তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন, “জ্যোতিবাবু বললেন, বাঙালি কনসার্ন (বেঙ্গল ল্যাম্প) বলছে যখন, আপনি দেখুন ওদের কিছু অর্ডার বাড়িয়ে দেওয়া যায় কিনা। তবে ফাইলে এ ব্যাপারটার কোনও নোট রাখবেন না। যা আমাদের বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে।” মুখ্যমন্ত্রী বলার পরও পূর্তমন্ত্রী কেনো ফাইলে নোট দিয়েছিলেন? সেটা তিনি করেছিলেন এক আমলার পরামর্শে। তার নাম মোস্তাক মোর্শেদ (পূর্তসচিব)। তিনি মনে করেছিলেন, বেঙ্গল ল্যাম্পসকে বাড়তি বরাদ্দ দেয়ার বিষয়টি নিয়মবিরুদ্ধ। মূলত আমলার পরামর্শ শুনেই যতীনবাবু মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন। তবে জ্যোতি বসু তাঁর ছেলে চাকুরি করেন বলে নয়, মূলত একটি স্বদেশি কোম্পানিকে বাঁচানোর জন্যেই চেষ্টা করেছিলেন। এর খেসারত দিতে হয়েছিলো পূর্তসচিব মোস্তাক মোর্শেদকে। ঘটনার পর তাকে সচিবালয় থেকে সরিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ একটি বদলি করা হয়েছিলো।

১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুলাই বেঙ্গল ল্যাম্পসের কারখানা লে অফ ঘোষণা করা হয়। এরপর কারখানাটি খোলার জন্যে বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। ৪৮০ জন শ্রমিক যুগের পর যুগ অপেক্ষা করেও চাকুরি পাননি। দীর্ঘ ৪২ বছরে অনেক শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে কোনো ফল না পাওয়া গেলেও কারখানা ও শ্রমিক কলোনির কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি আত্মসাতের জন্যে বিভিন্ন চক্র সক্রিয় রয়েছে। জাল দলিল ও ভুয়া ওয়ারিশ সাজিয়ে সম্পত্তি হস্তান্তরের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। তপন কুমার রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র মেয়ে বিদেশে থাকার কারণে সম্পত্তি নিয়ে জালিয়াতিটা আরো বেশি হচ্ছে।


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

দত্তেরগাঁও কাচারির ইতিহাস-ঐতিহ্য

‘কাচারি’ শব্দটি একসময় আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত ছিলো। ‘কাচারি’ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একসময় কাচারি ছিলো অভিজাত জমিদারদের ছোটোখাটো বৈঠকখানা। জমিদার এস্টেটের যাবতীয় জমির খাজনা কাচারি বসিয়ে আদায় করা হতো। জমিদারগণ খাজনা আদায়কে জোরদার করার জন্যে মাঝে-মধ্যে কাচারিতে আসতেন। বলতে গেলে জমিদারিত্বের সময় কাচারিই ছিলো তাদের প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। জমিদারগণ বড়ো বড়ো শহরে থেকে বিলাসী জীবনযাপন করতো। আর ঐ-বিলাসিতার রসদের যোগান দেয়া হতো কাচারির মাধ্যমে লব্ধ নিরীহ প্রজা সাধারণের পরিশ্রমের রক্তমিশ্রিত অর্থ দিয়ে। কোনো কোনো এলাকায়, কোনো শৌখিন জমিদার হয়তো অট্টালিকা ও প্রাসাদোপম কিছু বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু খুব কম জমিদার‌ই সেসব বাড়িতে থেকেছেন। সেসব বাড়ির কিছু অবশিষ্টাংশ এখনো দেখতে পাওয়া যায়, যা নিয়ে আমরা কাব্য করি, দেখতে যাই, পুলকিত হ‌ই। বাংলাদেশে এখনো অনেক নামকরা জমিদার বাড়ির ইট-সুরকির ভগ্নাংশ বিদ্যমান আছে। প্রজাহিতৈষী জমিদার একেবারেই ছিলো না, তা-ও নয়। তবে সংখায় কম।

আমার আলোচ্য বিষয় দত্তেরগাঁও কাচারি। এই কাচারিও একসময় জমিদারদের সুবিধার্থেই চালু হয়েছিলো। কবে, কখন দত্তেরগাঁও কাচারি চালু হয়েছিলো, এখন তা আর কেউ বলতে পারে না। অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে কাচারিটি সর্বশেষ খাজনা আদায় করে দিতো পুরাতন ঢাকায় বসবাসকারী জমিদার বাবু রশিক মোহন চক্রবর্তী ও বাবু মোহনী মোহন চক্রবর্তীকে। তারা ছিলেন সহোদর ভাই। সম্ভবত তাদের বাবা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে উচ্চমূল্য পরিশোধ করে বেনিয়া ইংরেজদের নিকট থেকে এ-জমিদারির পত্তন এনেছিলেন। কিন্তু তাদের ভ্রাতৃ-কলহের কারণে জমিদারি দুইভাগে ভাগ হয়ে দুইটি কাচারি সৃষ্টি করেছিলো। বড়ো কাচারি ও ছোটো কাচারি। খুব সম্ভবত, বড়ো ভাইয়ের বড়ো কাচারি এবং ছোটো ভাইয়ের ছোটো কাচারি। এখনো বড়ো কাচারি ও ছোটো কাচারি মানুষের মুখে মুখে রয়েছে।

দত্তেরগাঁও কাচারি নরসিংদীর শিবপুর উপজেলায় অবস্থিত। শিবপুর সদর হতে প্রায় ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে। দেশের অনেক কাচারিই আজ আগের অবস্থানে নেই। কিন্তু দত্তেরগাঁও কাচারিটির নামডাক অনেক বেশি। সেই জমিদার, জমিদারিত্ব ও পাইক-পেয়াদা না থাকলেও দত্তেরগাঁও কাচারি এলাকার মানুষের কাছে খুবই পরিচিত। দত্তেরগাঁও একটি বৃহত্তর গ্রাম, যার কেন্দ্রবিন্দু কাচারি। এখানে একটি ঐতিহ্যবাহী উচ্চ বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইউনিয়ন পরিষদের সুন্দর কমপ্লেক্স, দুই-তিনটি হাসপাতাল, বাজার, খেলার মাঠ, আগের পুকুর, কেন্দ্রীয় মসজিদ, ঈদগাহসহ অনেককিছু রয়েছে। তাছাড়া শিবপুর হতে পলাশ ও চরসিন্দুরগামী রাস্তার কেন্দ্রস্থলে হ‌ওয়ায় গুরুত্ব অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কাচারির দক্ষিণে বিশাল মাঠ (বন্দ) থাকায় কাচারির পরিবেশ বেশ মনোরম। এলাকার মানুষের মিলনমেলা এটি। এখানে এসে প্রত্যেকের মন আত্মতৃপ্তিতে ভরে ওঠে। গরমের দিনে শরীর জুড়ায়। গ্রামের মানুষের প্রতিদিন এই কাচারিতে না আসতে পারলে যেনো ভালোই লাগে না।

তখনকার দিনে কাচারিতে বহুমুখী কর্মকাণ্ড হতো। এখানে যাতায়ত ছিলো জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনির। লাঠিয়ালদের বড়ো বড়ো লম্বা গোঁফ থাকতো, যা দেখে সাধারণ মানুষ অতি সহজে ভয় পেতো। পাইক-পেয়াদা, নাজিম, গোমস্তার অভাব পড়তো না। এদের লালন করা হতো শুধুই সাধারণ প্রজাদের ভয় দেখানোর জন্যে, খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্যে। জমিদাররা স্থানীয়ভাবে চোর-বাটপারও পালন করতো, যাদের ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করা হতো। লাঠিয়াল বাহিনি লাঠিখেলা দেখাতো। উদেশ্য ছিলো, লাঠি খেলার অভিনব কৌশল দেখে মানুষ ভয় পেয়ে আগে আগেই যেনো খাজনাপাতি দিয়ে দেয়। চৈত্র-বৈশাখ মাসে পুণ্য নামের অনুষ্ঠান করা হতো। এ-সমস্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা নিজেদের পুণ্য হাসিল করতো। প্রজাদের গুড়, মুড়ি ও বাতাসা খাইয়ে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা হতো।

জমিদারদের জমিদারি দেখাশোনা করতো নায়েবরা। বিশেষ করে, সঠিকভাবে খাজনা আদায় করাই ছিলো নায়েবদের প্রধান কাজ। জমিদারের মনোরঞ্জন করে চলতে হতো তাদের। কোনো নায়েবের খাজনা আদায় সন্তোষজনক না হলে নিমিষেই জমিদাররা নায়েব পরিবর্তন করে ফেলতো। আবার নায়েবগণ‌ই ছিলেন জমিদারির নিম্নস্তরের প্রশাসক। তখনকার নায়েব পদটি উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ছিলো। নায়েব থেকে এ-দেশে ন‌ওয়াব উপাধি এসেছে বলেই জানা যায়। যতোটুকু জানা যায়, মুঘল আমলে এই নায়েব পদের সৃষ্টি। সেই আমলে সুবাহের প্রতিনিধি হিসেবে নায়েবগণ‌ই সবকিছুর দেখাশোনা করতেন। অনেক নায়েব ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন ছিলেন এবং জনগণ তাদের বিশ্বাসও করতেন। তারা সাধারণ প্রজাদের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হতেন। স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে প্রজা সাধারণের সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করাসহ খাজনাপাতি কমিয়ে দেয়া অথবা মওকুফের চেষ্টা করতেন। আবার এমনও নায়েব ছিলো, যারা প্রজাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করতো। যেকোনো প্রকারে খাজনা আদায় করে জমিদারদের খুশি রাখতো। জোর করে প্রজাদের গরু-ছাগলসহ অন্যান্য দ্রব্যাদি নিয়ে এসে সস্তা দামে বিক্রি করে খাজনা মিটাতো। অত্যাচার আর নির্যাতনে মানুষকে অশান্তিতে রাখতো। আমরা নাটক-সিনেমায় এখনো অত্যাচারী অনেক নায়েব দেখি। তারা কীভাবে জমিদারদের খুশি করে, তা-ও দেখি। বর্তমান সময়েও অনেক ভূমি অফিসে নায়েব রূপের পদ আছে, যাদের কীর্তি-কলাপের কথা আমরা প্রায়‌ই শুনি। তাদের অনেকে পুরাতন দিনের নিষ্ঠুর নায়েবদের প্রতিরূপ। সরকার সাধারণ মানুষের ভূমি রক্ষার্থে যুগোপযুগী আইন প্রণয়নের চেষ্টা করছে, যেটি খুব‌ই আশাপ্রদ খবর। সেই সময় দত্তেরগাঁও কাচারিতে নায়েবরূপে কাজ করে অনেকেই সুপরিচিতি অর্জন করেছিলেন। তাদের অনেকের নাম এখনো মানুষের মুখে মুখে। কাচারির শেষদিকে এমন সুনাম অর্জনকারী কয়েকজন নায়েবগণের মধ্যে প্রথমেই আসে মরহুম আবদুল গফুর খানের নাম। অন্যান্য সুপরিচিত নায়েবের মধ্যে প্রয়াত রাম মোহন দত্ত, মরহুম অলফু খান, মরহুম জাফর আলী ভূঁইয়া, মরহুম আলমাছ খান, মরহুম তোফাচান, মরহুম আমীন‌উদ্দীন খান ও মরহুম রাইজ‌উদ্দীন খানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৬ সালের পর জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের ফলে জমিদারসহ সবাই এসব কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েন।

দত্তেরগাঁও কাচারির ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমে অনেককিছুই বলা হয়েছে। আসলে একসময় সারাদেশে কাচারিগুলো ছিলো খুব‌ই তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমান সময়ে তা আর নে‌ই। কিন্তু আমাদের দত্তেরগাঁও কাচারির নামডাক মনে হয় আগের চেয়েও বেশি। বড়ো কাচারির একটি পুকুর ব্যতিত এ-কাচারির স্থাপনা থেকে শুরু করে কোনোকিছুই অবশিষ্ট নেই। কিন্তু বর্তমান আধুনিক অবকাঠামোয় আমাদের কাচারি অপরূপ রূপে সজ্জিত। এই কাচারির জন্যে এলাকার সকল মানুষের মন ব্যাকুল হয়ে থাকে। কাচারির মাঠে ফুটবল খেলা নিয়ে অনেকেই স্মৃতিচারণ করেন। অনেকে খুঁজে বেড়ায় কাচারির, শৈশবের বন্ধুদের, খেলার সাথীদের অম্লমধুর স্মৃতি। বিদেশ-বিভূঁইয়ে থেকেও অনেকে স্বজনদের সাথে আলাপচারিতার ফাঁকে কাচারি প্রসঙ্গে কথা বলেন। সময়ের বিবর্তনে সবকিছুই শেষ হয়ে যায়, পরিবর্তন আসে। তবে আমাদের দত্তেরগাঁও কাচারির কথা মানুষের হৃদয় ও মন থেকে মুছে যাওয়া খুব‌ই কঠিন হবে।


নূরুদ্দীন দরজী
সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার

বিপ্লবীদের আত্মগোপনের অভয়কেন্দ্র ‘রায়পুরা’

বিপ্লবী ইলা মিত্র ও তাঁর স্বামী রমেন মিত্র

তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী, নাচোলের রাণীখ্যাত ইলা মিত্রের স্বামী কমরেড রমেন মিত্র দীর্ঘদিন নরসিংদীর রায়পুরায় আত্মগোপনে ছিলেন। তেভাগা আন্দোলনের জনক হাজী মোহাম্মদ দানেশ হলেও এই আন্দোলন সংগঠনের পেছনে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন রমেন মিত্রের স্ত্রী ইলা মিত্র। ইলা মিত্র ও তাঁর স্বামী রমেন মিত্র কমিউনিস্ট পার্টি থেকে নির্দেশ পেয়ে দিনাজপুর, রংপুর ও পাবনার বর্গাচাষিদের সংগঠিত করতে থাকেন। এ-আন্দোলনের এক পর্যায়ে উত্তেজিত বর্গাচাষিরা পিটিয়ে পাঁচ পুলিশ হত্যা করলে সরকার সেনাবাহিনি তলব করলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়।

তখন তেভাগা আন্দোলনের অনেক নেতাকর্মী গা ঢাকা দেন। রমেন মিত্র হুলিয়া মাথায় নিয়ে চলে আসেন নরসিংদীর রায়পুরায়। এসে আত্মগোপন করেন রায়পুরার হাসিমপুরের রমানন্দ সূত্রধরের বাড়িতে। রায়পুরায় আত্মগোপনে থেকেও রমেন মিত্র গোপনে সংগঠনের কাজ চালাতে থাকেন। রমেন মিত্রের সাথে পরিচিত হন তরুণ আব্দুস সাত্তার, হরিপদ কর্মকার ও ফজলুল হক খোন্দকার। আব্দুস সাত্তার মেম্বারের বাড়িও হাসিমপুর গ্রামে। তিনিই রায়পুরা আর কে আর এম উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র ফজলুল হক খোন্দকারকে রমানন্দ সূত্রধরের বাড়িতে নিয়ে যান রমেন মিত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে। রমেন মিত্র জমিদারের সন্তান, নিজেও ছোটোখাটো জমিদার, তবু তার কথাবার্তা শুনে তরুণ খোন্দকার খুব উজ্জীবিত হন। পরে অবশ্য কৃষকনেতা হাতেম আলী খানের কাছ থেকেও ফজলুল হক খোন্দকার বাম রাজনীতির দীক্ষা পান। ঐ-সময় খোন্দকার নবম শ্রেণির ছাত্র হলেও বয়সের দিক থেকে তখন তিনি বিশ বছরের যুবক। কারণ তিনি প্রায় দশ বছর কওমি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে রায়পুরা আর কে আর এম স্কুলে এসে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। মাদরাসার পড়ালেখা ছাড়ার কারণ হিসাবে তিনি পরবর্তীতে মন্তব্য  করেছিলেন, মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা একমুখী, ক্রটিপূর্ণ ও গতানুগতিক।

ব্রিটিশ শাসনের শেষদিকে রায়পুরার পিরিজকান্দির সৃষ্টিধর খলিফার বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন নিষিদ্ধ বিপ্লবী সংগঠন ‘যুগান্তর’-এর সদস্য বিপ্লবী মধু ব্যানার্জি। সৃষ্টিধর খলিফারও রমানন্দ সূত্রধরের বাড়িতে যাতায়াত ছিলো। পলাশের বিজয় চ্যাটার্জি প্রায়ই রায়পুরায় এসে গোপন সভা করতেন। এসব গোপন সভা বসতো রমানন্দ সূত্রধরের বাড়িতে, কমরেড অজয় রায়ের স্ত্রী জয়ন্তী রায়ের বাড়িতে (কমরেড আকাশ পালের বোন), শ্রীরামপুরে কমরেড ফটিক রায় চৌধুরীর বাড়িতে, রহিমাবাদের রমেন ডাক্তারের বাড়িতে। রমানন্দ সূত্রধরের পূর্বপুরুষ ভীম সূত্রধরের মধ্যেও বিপ্লবী রক্তধারা প্রবাহিত ছিলো। তারই পৌত্র রমানন্দ সূত্রধর দাদার বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গোপনে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ঝাণ্ডা ধরে রেখেছিলেন।

১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা ঘোষণা করলে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা আরো টালমাটাল হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার ছয়দফাকে পাকিস্তান ভেঙে ফেলার ষড়যন্ত্র মনে করলে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। ইতিহাসে এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। সেই সময় থেকে সারা বাংলায় বিভিন্ন নেতাদের বিরুদ্ধে হুলিয়াসহ ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। এই সময়ে অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী অনেক দিন আত্মগোপনে থাকেন ভাটের চরের কমরেড শামসুল হক সাহেবের বাড়িতে এবং হাসিমপুরে রমানন্দ সূত্রধরের বাড়িতে। ষাটের দশকে অনেক বাম নেতা রায়পুরায় আত্মগোপনে ছিলেন। এদের মধ্যে কৃষকনেতা জিতেন ঘোষ, অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী, কমরেড সুচিত চক্রবর্তী, কমরেড নেপাল নাগ, রবি নিয়োগীসহ অনেকে।

রমানন্দের স্ত্রী রেণুবালা একজন করিৎকর্মা মহিলা ছিলেন। বিশেষ করে অতিথি-বেড়াল আপ্যায়নে তার জুরি মেলা ভার। এই সাহসী নারী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গুপ্তচরের কাজ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর আদান-প্রদানে নিঃশঙ্কচিত্তে সহযোগিতা করেছেন। রমেন মিত্র নরসিংদীর রায়পুরায় দ্বিতীয়বার আত্মগোপনে এসেও রমানন্দ সূত্রধরের বাড়িতেই থেকেছিলেন। তার কারণ হয়তো একটিই, রমানন্দের স্ত্রীর নির্ভেজাল আতিথেয়তা।


মহসিন খোন্দকার
সাধারণ সম্পাদক, প্রগতি লেখক সংঘ, নরসিংদী

স্বশিক্ষিত প্রত্নবিদ ও লোকসাহিত্যের নিভৃতচারী সাধক মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান

নিভৃতচারী, আত্মপ্রচারবিমুখ, সত্যনিষ্ঠ, আদর্শবান, স্বশিক্ষিত ও সাদাসিধে একজন মানুষের নাম মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান। বাবা মোহাম্মদ হানীফ পাঠান সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং প্রত্নতত্ত্বের একজন বিরল প্রতিভাসম্পন্ন সাধক ছিলেন। ছিলেন শিক্ষা, সমাজসেবা সাময়িকপত্রের সম্পাদক, লোকসাহিত্য-সংস্কৃতির গবেষক। কথিত আছে, এই পাঠান পরিবার সুদূর আফগানিস্তান থেকে ষোড়শ শতকে ভারতে আসে এবং তাদের বংশধররা ভাগ্যান্বেষণে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বটেশ্বর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। বটেশ্বর বর্তমান বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার একটি বিখ্যাত গ্রাম। বটেশ্বরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম উয়ারী। উয়ারীবটেশ্বর খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থান এবং এখন দেশ-বিদেশখ্যাত। এই উয়ারী-বটেশ্বরকে দেশ-বিদেশখ্যাত করা এবং বর্তমান প্রত্নআলোচনা-প্রত্নগবেষণার জন্যে যিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন, তিনি হানীফ পাঠান। তাঁরই সুযোগ্য সন্তান মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান।

মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠানও বাবার আদর্শ ধারণ করে গ্রামের মানুষের জীবন আলোকিত করার জন্যে শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করেন। বাবা বাঙালি জাতির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শিকড় অনুসন্ধান করেছেন, লোকসাহিত্য-লোকশিল্প সংগ্রহে ব্রতী হয়েছিলেন। চর্চা করেছিলেন লোকসাহিত্যের। হাবিবুল্লাহ পাঠানও বাবার উত্তরাধিকার হিসেবে প্রত্ননির্দশন সংগ্রহ, প্রত্নগবেষণা এবং লোকসাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় ব্রতী হন। ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন : উয়ারী বটেশ্বর’ গ্রন্থের প্রসঙ্গকথায় হাবিবুল্লা পাঠান উল্লেখ করেন :

বাংলাদেশের প্রত্নক্ষেত্র সমূহের মধ্যে উয়ারী বটেশ্বর প্রাচীনতম। অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক সম্ভাবনা অদ্যাবধি সুধীজনদের অজ্ঞাত থেকে যেতো যদি শ্রদ্ধেয় পিতা মোহাম্মদ হানীফ পাঠান সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত না করতেন। ১৩৪০ (১৯৩৩) সালের পৌষ মাসে উয়ারী গ্রামে মাটি খননকালে আকস্মিকভাবে আবিষ্কৃত হয় অনেক ছাপাংকিত রৌপ্যমুদ্রা। এগুলোর অধিকাংশ শ্রমিকেরা বেনের কাছে বিক্রয় করে ফেলে। স্বল্প সংখ্যক মুদ্রা আব্বাজানের হস্তগত হয়। তিনি এগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করেপ্রাচীন মুদ্রা প্রাপ্তিশীর্ষক ছোট্ট সংবাদ সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে ছাপেন। এরপর থেকে স্থানের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল বেড়ে যায়। ছেলেবেলা তিনি এখানকার মাটিতে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা মূল্যবান পাথরের গুটিকা কুড়াতেন। দীর্ঘদিন তিনি মুদ্রা গুটিকাগুলো সযত্নে রক্ষা করেন।

১৯৫৫ সালে আমি যখন অধুনালুপ্ত বাজনাব সবুজ পল্লী হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন তিনি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। পিতাপুত্র একসঙ্গে স্কুলে যেতে উয়ারী গ্রাম অতিক্রমকালে তাঁকে প্রায়ই দেখতাম নিবদ্ধ দৃষ্টিতে পথে পথে কি খুঁজছেন। এভাবেই তিনি মূল্যবান পাথরের গুটিকা খুঁজে পেতেন। পিতার অনুসন্ধান তৎপরতায় আমার বালক মনের উৎসুক্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। যেদিন আমি বড়ো আকৃতির সুদৃশ্য দুটো গুটিকা খুঁজে পাই সেদিন আমার আনন্দ দেখে কে? তিনি প্রায়ই এখানকার প্রাপ্ত নিদর্শন কিংবদন্তী খ্যাত অসম রাজার গড়ের কাহিনী বলতেন। এমনি করে আমিও পিতার অনুসরণে নানা নিদর্শন সংগ্রহে তৎপর হয়ে উঠি। ১৯৫৫ সালের জানুয়ারীর প্রথম দিকে বটেশ্বর গ্রামে মাটিখননকালে কয়েকটি ত্রিকোণাকার লৌহকুঠার শ্রমিকরা পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে গেলে আমি সেগুলো কুড়িয়ে নিই। এগুলো আব্বাজানকে দেখালে তিনি স্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত হন এবং একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। প্রবন্ধটি দৈনিক আজাদ এর রবিবাসরীয় সংখ্যায় (৩০ জানুয়ারী ১৯৫৫) ‘পূর্ব পাকিস্তানে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতাশিরোনামে মুদ্রিত হয়। তিনি কিছু নিদর্শন সংগ্রহ করে প্রবন্ধটি লিখে যেন অলক্ষ্যে একটা গুরুদায়িত্ব আমার স্কন্ধে তুলে দেন। সে সময় থেকে শুরু করে অদ্যাবধি অঞ্চলের ঝোপে জঙ্গলে, খনিতস্থানে, চষাভূমিতে, পথেঘাটে অনেকটা নেশাগ্রস্তের মতো নানা নিদর্শন সংগ্রহে ব্যাপৃত থাকি।

এভাবেই প্রথমত বাবা মোহাম্মদ হানীফ পাঠান এবং পরবর্তীতে সন্তান মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠানের প্রকাশিত নানা লেখা, গ্রন্থ, জাদুঘরে নানা প্রত্ননিদর্শন জমা, প্রত্নগবেষকদের কাছে ধর্না— এসবের মাধ্যমে সকলের দৃষ্টিগোচরে আসে উয়ারী-বটেশ্বর। শুরু হয় প্রত্নতত্ত্ববিদদের পরিদর্শন, প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ এবং গবেষণা। শেষে ২০০০ সাল থেকে শুরু হয় প্রত্নখনন কাজ, যার নেতৃত্ব দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। এখনো পর্যন্ত অনেক দফায় খনন কাজের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ননিদর্শন পাওয়া গেছে। উয়ারী-বটেশ্বর এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল মিলিয়ে এই পর্যন্ত ৫০ টি প্রত্নস্থান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাথর, হাতিয়ার, মুদ্রা, পাথরের গুটি, পুঁতি, নানা ব্যবহার্য সামগ্রী, মৃৎপাত্র, গর্ত-বসতি, রাস্তা, দুর্গ-নগরী এবং প্রাচীনতম মহাজনপদ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসকে নতুন করে জানার ও লেখার পথ উন্মুক্ত করেছে।

এসব নিদর্শন আবিষ্কার, গবেষণাকর্ম, খনন-ইতিহাসসহ নানা প্রসঙ্গ নিয়ে সুফি মোস্তাফিজুর রহমান এবং মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠানের যৌথ প্রচেষ্টায় ‘উয়ারী-বটেশ্বর : শেকড়ের সন্ধানে’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১২ সালে, যা প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার ও আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার লাভ করে।

বাংলাদেশের শেকড়ের সন্ধান, বিশেষ করে উয়ারী-বটেশ্বরের প্রাচীন ইতিহাস অনুসন্ধানে তাঁর বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা, ইতিহাসখ্যাত দুটি গ্রন্থ (প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন : উয়ারী বটেশ্বর, ১৯৮৯ এবং উয়ারী-বটেশ্বর : শেকড়ের সন্ধানে, ২০১২) রচনা এবং প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ, জাদুঘরে সংরক্ষণ, প্রত্নগবেষণা ও খননকালে তাঁর সহায়তার সকল কর্মের জন্যে এই স্বশিক্ষিত বরেণ্য প্রত্নবিদকে ইতিহাস এবং ভবিষ্যত প্রজন্ম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

শিক্ষকতার পাশাপাশি মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ ও গবেষণা নিয়েই কর্মজীবন শেষ করেননি। তাঁর জীবনের আরেকটি বড়ো কাজ হচ্ছে বাবার মতো লোকসাহিত্যের সংগ্রহ ও গবেষণা। লোকসাহিত্য নিরক্ষর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর লোকমনের সৃজনশীল ফসল। লোকসাহিত্য অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষজনের বাণী সাধনা নয়। লোকসাহিত্য সাধারণ জনমানবের সুখ-দুঃখের বাস্তব অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, যার গভীর সম্বন্ধ বৃহত্তর জনমানবের শেকড়ের সাথে। সেদিক থেকে লোকসাহিত্যের গুরুত্ব অনেক। লোকসাহিত্যের অনেক শাখা। লোককাহিনি, লোককথা, ছড়া, রূপকথা, গীত, গীতিকা, প্রবাদ-প্রবচন, ধাঁধা ইত্যাদি। লোকসাহিত্যের এসব শাখার নিদর্শন সংগ্রহ এবং গবেষণা করেছেন হাবিবুল্লা পাঠান। তাঁর অধিকাংশ গবেষণা গ্রন্থই লোকসাহিত্য-সংস্কৃতিভিত্তিক। হাবিবুল্লা পাঠানের লোকসাহিত্য-নির্ভর প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা দেখলেই তা উপলদ্ধি করা যায় :

বাংলাদেশের লোককাহিনী, ১ম খণ্ড
(নরসিংদীর লোককাহিনী সংগ্রহ), ১৯৯৬

বাংলাদেশের লোককাহিনী, ২য় খণ্ড
(নেত্রকোণার লোককাহিনী সংগ্রহ), ১৯৯৭

বাংলাদেশের লোককাহিনী, ৩য় খণ্ড
(ব্রাক্ষণবাড়িয়ার লোককাহিনী সংগ্রহ), ১৯৯৮

নরসিংদীর কবি-সাহিত্যিক, ১৯৯৬

নরসিংদীর লৌকিক খেলাধুলা, ১৯৯৮

নরসিংদী-গাজীপুরের লোকঐতিহ্য
বিবাহ ও মেয়েলী ছড়াগীত, ২০০০

বাংলাদেশের ভাটকবি ও কবিতা, ২০১২

বাংলা প্রবাদে লোককাহিনী, ২০১২

নরসিংদীর স্থাননাম উৎস ও বৈশিষ্ট্য সন্ধান, ২০১৬

নরসিংদীর লোককবি, ২০১৮

প্রত্যেকটি গ্রন্থেই তাঁর কাজের সযত্ন স্বাক্ষর রয়েছে। দেরিতে হলেও লোকসাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার ২০২০’ পেয়েছেন। তাঁর এই সম্মানে আমরা নরসিংদীবাসী গর্বিত হয়েছি।

বাংলা লোকসাহিত্যের নানা নিদর্শন সংগ্রহ এবং সম্পাদনা খুব সহজ কাজ নয়। এক্ষেত্রেও হাবিবুল্লা পাঠানের যোগ্যতার স্বাক্ষর সুস্পষ্ট। বাংলাদেশের লোককাহিনী ৩ খণ্ডে প্রকাশিত গ্রন্থের প্রত্যেকটিতে তাঁর সম্পাদনাকর্ম, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকথা এবং কাহিনীগুলোর সযত্ন বিন্যাস লোকসাহিত্যের পাঠক-গবেষকদের মুগ্ধ করেছে। প্রথম খণ্ডে নরসিংদী অঞ্চলের, দ্বিতীয় খণ্ডে নেত্রকোণার এবং তৃতীয় খণ্ডে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা অঞ্চলের সংগৃহীত লোককাহিনী সন্নিবেশিত হয়েছে।

হাবিবুল্লা পাঠানের বাবা হানীফ পাঠান লোকসাহিত্যের অন্যতম শাখা বাংলা প্রবাদ সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও সম্পাদনায় অসাধারণ কাজ করেছেন, যা বিভিন্ন খণ্ডে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে এবং বাংলা লোকসাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠানও বাংলা প্রবাদ সংগ্রহপূর্বক তার সাথে প্রবাদের উৎস অনুসন্ধান এবং প্রতিটি প্রবাদের সাথে লোককাহিনী যুক্ত করে অসাধারণ গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। তাঁর একটি বিশেষ গবেষণামূলক কাজ বাংলাদেশের ভাটকবিতা সংগ্রহ, সংকলন ও সম্পাদনা। ‘নরসিংদীর স্থাননাম উৎস ও বৈশিষ্ট্য সন্ধান’ গবেষণা গ্রন্থটিও তাঁর পরিশ্রমী কাজের আরেকটি বড়ো স্বাক্ষর।

ব্যক্তিগত জীবনে হাবিবুল্লা পাঠান একজন সাদাসিধে ও সরল মানুষ। সাধারণ তাঁর জীবনযাপন। কিন্তু ব্যক্তিত্ব, বাচনভঙ্গি, জ্ঞান-প্রজ্ঞা-মননে সবাইকে মুগ্ধ করেন। কোনো ক্ষেত্রেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি ছিলো না। সকল ক্ষেত্রে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত এই মানুষটি অনেক উঁচু মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন।

স্বশিক্ষাই তো প্রকৃত শিক্ষা। স্বশিক্ষার মাধ্যমেই তো প্রকৃত মানুষ হওয়া যায়, যা পরিশেষে সুশিক্ষায় রূপ লাভ করে। কল্যাণকর ও সৃষ্টিশীল সুশিক্ষাই শ্রেষ্ঠ শিক্ষা। এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষাকে ধারণ করেই হাবিবুল্লা পাঠান সারাজীবন শিক্ষকতা করেছেন। প্রত্নগবেষণা এবং লোকসাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা করেছেন। অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হয়েছেন। জ্ঞানের শক্তিকে ধারণ করে দূর করেছেন সকল অন্ধকার। ইতিহাসের সত্য, সভ্যতার সত্য, জীবনের সত্যকে অনুসন্ধান করেছেন।

প্রকৃত অর্থে, সত্য এবং সুন্দরের প্রকাশই মানবধর্ম। সত্যই আলো, অসত্যই অন্ধকার। হাবিবুল্লা পাঠান ইতিহাসের, সভ্যতার এবং লোকজীবনের প্রকৃত সত্য এবং কল্যাণকে ধারণ করে বড়ো মাপের মানুষ হিসেবে সকলের মাঝে স্থান করে নিয়েছেন। নিভৃত পল্লীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেও হাবিবুল্লা পাঠান নীরব সাধনায় প্রত্নতত্ত্ব ও লোকসাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা এবং গবেষণা করে যে-ফসল রচনা করেছেন, সময়-ইতিহাস-ভবিষ্যত তাঁকে মর্যাদার সাথে বাঁচিয়ে রাখবে।


গোলাম মোস্তাফা মিয়া
সাবেক অধ্যক্ষ, নরসিংদী সরকারি কলেজ

শেখেরচর-বাবুরহাটের আদ্যোপান্ত

হোটেল এক্সের ছাদ থেকে তোলা বাবুরহাট বাজারের ছবি (প্যানোরোমা মুডে)

শেখেরচর-বাবুরহাট। সমগ্র বাংলাদেশের প্রধান বস্ত্রশিল্পকেন্দ্র। সারাদেশ হতে পাইকারি ব্যবসায়ীরা এই হাটে তাদের কাপড় কেনা-বেচা করে। পাবনা-সিরাজগঞ্জ বস্ত্রশিল্পের আরো দুটি কেন্দ্র, কিন্তু শেখেরচর হাটের মতো এতো বিশাল নয়।

শেখেরচর-বাবুরহাটের একাংশ

ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের একদম লাগোয়া পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে নরসিংদী জেলার শীলমান্দী ইউনিয়নে এটি অবস্থিত। এর আয়তন প্রায় ০.১৪ বর্গ কিলোমিটার। তবে আয়তন প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মানুষের চাহিদা বাড়ছে, আর এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশাই হচ্ছে তাঁতবস্ত্র উৎপাদন ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা। তাই প্রায় সবাই এ-ধরনের পেশায় আত্মনিয়োগ করছে। ফলে এই হাটের আয়তন দিন দিন বেড়েই চলেছে। শেখেরচর বাজার বণিক সমিতির দেয়া তথ্য অনুযায়ী এই হাটে স্থায়ী দোকানের সংখ্যা প্রায় তিন হাজারের মতো এবং প্রতি সপ্তাহে এখানে দুশো থেকে আড়াইশো কোটি টাকার লেনদেন হয়। বর্তমানে এই হাটের ব্যবসায়ীদের হাট-কর্তৃপক্ষকে কোনো প্রকার খাজনা দিতে হয় না। তারা সরাসরি সরকারি কোষাগারে রাজস্ব জমা দেন।

(ছবিতে) শেখেরচরবাবুরহাটের মানচিত্র
বহু জায়গায় খোঁজ-খবর ও দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরও শেখেরচর-বাবুরহাটের পুরোনো বা নতুন কোনো মানচিত্র পাওয়া যায়নি। সবশেষে গুগল ম্যাপ, জুম আর্থ এবং বাবুরহাটে সরেজমিন পরিদর্শনের ভিত্তিতে এই মানচিত্রটি তৈরি করা হয়েছে। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলে রাখি, ক্রমশ বাড়তে থাকা এই হাটের সীমানা নির্দেশে একেবারে নিখুঁত মাপ নেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে কিছুটা ভুল-ত্রুটির সম্ভাবনা থেকেই যায়।

সেই প্রাচীন তাম্রযুগ থেকেই এ-অঞ্চল বস্ত্রশিল্পের জন্যে প্রসিদ্ধ ছিলো। আদি মসলিনের সূতিকাগার ছিলো ঢাকা-সোনারগাঁ ও মহেশ্বরদী পরগণার গোটা অঞ্চল। বর্তমান নরসিংদী জেলা মহেশ্বরদী পরগণার অন্তর্ভুক্ত একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিলো।

মাধবদীর ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একসময় আড়ং বসতো। আনন্দী গ্রামের সন্নিকটে ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আড়ং নামের কাপড়ের এই হাট জমজমাট ছিলো। মাধবদী-শেখেরচর তাঁতশিল্পকেন্দ্র হওয়ার নেপথ্যে এই আড়ং নামের হাটের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। এই কাপড়ের হাট ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও এ-অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে হাট চলতে থাকে। কেননা, এ-অঞ্চলে সুতা থেকে কাপড় উৎপাদন প্রায় প্রতিটি গ্রামেই বিদ্যমান ছিলো। এসবের ফলাফলস্বরূপ গত শতকের তিরিশের দশকের প্রথমেই যখন মাধবদীর জমিদারদের দ্বারা সুতা-কাপড়ের হাট প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন একটা স্থায়ী রূপ পায়, যা অদ্যাবধি চলছে।

মাধবদী হাটে জমিদারদের সঙ্গে পাইকারদের খাজনাকেন্দ্রিক জটিলতায় যখন শেখেরচর বাজারের উৎপত্তি ঘটে, তখন থেকেই ধীরে ধীরে মাধবদী হাট ‘সুতার হাট’, আর শেখেরচর বাজার ‘কাপড়ের হাট’ হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করে।

শেখেরচর-বাবুরহাটে পাইকাররা শুরুতে নদীপথে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন করতো। পরবর্তীতে পঞ্চাশের দশকে মমিন মটর কোম্পানি নরসিংদী-তারাব সড়ক ও তাদের পরিবহন ব্যবসা শুরু করে। পাশাপাশি নরসিংদী-মাধবদী-নারায়ণগঞ্জ রুটে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলে পাইকাররা সড়ক ও রেলপথেও যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন করতে শুরু করে। নদী-সড়ক-রেলপথ একসাথে চালু থাকার কারণে বাবুরহাটের ব্যবসায়ের পরিধি হু হু করে বাড়তে থাকে। পরর্তীতে অবশ্য রেলপথটি বন্ধ হয়ে যায়।

মাধবদী আর শেখেরচর— এই দুই সুতা-কাপড়ের গুরুত্বপূর্ণ বাজারকে কেন্দ্র করে পঞ্চাশের দশক থেকেই গোটা অঞ্চলে সুতা থেকে কাপড় বুননের দেশি নানান যন্ত্রপাতি থেকে বিদেশি যন্ত্রপাতি আমদানি হতে শুরু করে এবং তা দ্বারা উন্নত মসৃণ কাপড় তৈরি শুরু হয়। এই মেশিনের বিপ্লব একদিনে হয়নি। ধীরে ধীরে নানান বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক ও গতিশীল বস্ত্র উৎপাদনে প্রবেশ করেছে এ-অঞ্চলের তাঁতীরা।

জাপানি তাঁতকল আমদানি করে মাধবদীর আলগী গ্রামের স্কুলশিক্ষক হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রথমে তাঁতে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন, এ-প্রসঙ্গে তাঁকে স্মরণ করা যাক। এরপর থেকে আজ অবধি নানা ধরনের চায়না-জাপানি-কোরিয়ান আধুনিক-উত্তরাধুনিক যন্ত্রপাতি দ্বারা বস্ত্র উৎপাদনের যে-ইতিহাস, তা এই গোটা অঞ্চলকে সুতা ও বস্ত্র উৎপাদনের এক মহাজোনে পরিণত করেছে।

শেখেরচর হাট সপ্তাহে তিনদিন বসে। এখন বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়ে শনিবার শেষ হয়। বৃহস্পতিবার ভোর হতেই সারাদেশ থেকে কাপড়ের পাইকাররা আসতে শুরু করে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা হাটে জনসমাগমের যে-বিস্তার শুরু হয়, তা অভাবনীয়। ভ্যান, রিকশা, নসিমন, ট্রাক, পিকআপ ইত্যাদি যানের এক মহাযুদ্ধ চলে দিনমান। এখানে গলির সংখ্যা কতো, এটা কেউ বলতে পারে না। একেক গলিতে একেক ধরনের বস্ত্র। নানা জাতের বস্ত্র, যা এই হাটে নিত্য কেনা-বেচা হয়, সেসবের নাম জানা যাক। শাড়ি, লুঙি, গামছা, থ্রি-পিছ, শার্টিং, বেডশিট, পর্দা, মশারি, ছাপা কাপড় (ভয়েল, পপলিন, টিসি, টরে, মার্কিন, লালসালু, ক্যানভাস, টুইল, পলিয়েস্টার ইত্যাদি)-সহ আরো বহু ধরনের কাপড় এখানে সহজেই আপনি পেয়ে যাবেন।

১৯৩৬ সালে এই শেখেরচর-বাবুরহাট প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে এই ৮৬ বছর ধরে চলা কাপড়ের হাটটি এই অঞ্চলের অর্থনীতির সার্বিক গতি পরিবর্তন করার সাথে সাথে জাতীয়ভাবেও প্রভূত ভূমিকা রেখেছে। এই হাট দুই কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত মাধবদীর সুতার হাটের অর্থনীতির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। মাধবদীতে সুতা কেনা-বেচা হয়, আগেই বলেছি। কটন, পলিয়েস্টার, টিসি, ডেনিমসহ যাবতীয় সুতার আইটেমের পাইকারি ও খুচরা বাজার এটা। এই সুতার বাজারের সাথে সরাসরি কানেক্টেড নারায়ণগঞ্জের মতো সর্ববৃহৎ সুতার বাজার। সারাদেশে সুতা উৎপাদনকারী কারখানা, অর্থাৎ স্পিনিং মিলগুলো আবার যুক্ত নারায়ণগঞ্জ ও মাধবদীর সাথে।

আসেন, এই বাজারগুলোর পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করি। মাধবদী বাজার থেকে নানা ধরনের সুতা কিনে বস্ত্র উৎপাদনকারী মেশিনঅলারা প্রথমে যে-কাপড় তৈরি করে, তা হলো ‘গ্রে কাপড়’। এটা মোটাদাগে শাদা রঙের হয়। এই কাপড় বিক্রি হয় মাধবদী হাটে। প্রধানত সপ্তাহে একদিন। মঙ্গলবার। এই মঙ্গলবারের গ্রে কাপড়ের বেচা-কেনার উপর নির্ভর করে সারা সপ্তাহের সুতার দর নির্ধারণ ও সুতা বিক্রির পরিমাণ। এই দর নির্ধারণ করে প্রধানত নারায়ণগঞ্জের বড়ো বড়ো সুতা ব্যবসায়ীরা (মাধবদীর বড়ো সুতার ব্যবসায়ীরাও কেউ কেউ যুক্ত থাকেন)। নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীদের সুতার সাপ্তাহিক লেনদেনের দিন হচ্ছে বুধবার। তারা বুধবার মাধবদী মোকাম করেন। তারপর মঙ্গলবারের গ্রে কাপড়ের বেচা-কেনার গতিপ্রকৃতি অবলোকন করে বৃহস্পতিবার পরের সপ্তাহের সুতার দর নির্ধারণ করেন।

এদিকে মাধবদীর ব্যবসায়ীদের গ্রে কাপড় ইতোমধ্যে নানা প্রক্রিয়া (সাইজিং, ডাইং, ক্যালেন্ডারিং ইত্যাদি)-র মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার শেখেরচরের হাটে ওঠে। এখানে বলে রাখা অতীব জরুরি যে, সপ্তাহের তিনদিন শেখেরচরের এই ছাপা কাপড়ের হাটের ভালো-খারাপের সাথে মাধবদী-নারায়ণগঞ্জের সুতার দর নির্ধারণ সরাসরি সম্পর্কিত। সুতা ব্যবসায়ীদের প্রথমেই চোখ থাকে, শেখেরচরের হাট কেমন গেলো এই সপ্তাহে! অর্থাৎ উপরের এই সাইকেল একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মাধবদী-নারায়ণগঞ্জের সমস্ত প্রক্রিয়ার সফল পরিসমাপ্তি ঘটে শেখেরচর হাটে এসে।

বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ ফ্যাশন হাউজগুলো বাবুরহাটের কাপড় দিয়েই তাদের সিংহভাগ চাহিদা পূরণ করে। ‘আড়ং’ নামের অত্যন্ত জনপ্রিয় ও স্বনামধন্য ফ্যাশন হাউজটি টিকেই আছে শেখেরচর-বাবুরহাটের সরবরাহকৃত কাপড় দ্বারা। শেখেরচরে প্রায় শতাধিক টেক্সটাইল আড়ংয়ে কাপড় সরবরাহ করে তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে। গত ২০ বছর ধরেই এটা চলছে এবং ক্রমশ এ-ধরনের টেক্সটাইল মিলের সংখ্যা শেখেরচর ও আশেপাশের এলাকায় বেড়েই চলেছে। আড়ংয়ে মাল দেয়াই তাদের প্রধান বাণিজ্যধরন। ফ্যাশন হাউজ ‘আড়ং’ প্রতিবছর শেখেরচরের ব্যবসায়ীদের নিয়ে বড়োসড়ো মিলনমেলার আয়োজন করে থাকে।

আবার চলে আসি শেখেরচর বাজারের ভেতরে। এই বাজারটিকে উপর থেকে দেখলে খুব ছোট্টো একটি বাজার বলেই মনে হয়। শেখেরচরের হাইরাইজ বিল্ডিং হোটেল এক্সের উপরে উঠে দেখেছি, বিল্ডিং আর টিনশেডের ব্যাপক বিস্তার, তবে আয়তন খুব বড়ো নয়। কিন্তু আসল ব্যাপারটা ঘটে বাজারের একদম ভেতরে প্রবেশ করলে। ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে থেকে হাটের ভেতর যেতে তিনটি প্রবেশমুখ রয়েছে। একটি মাজার বাসস্ট্যান্ড, আরেকটি মধ্য বাসস্ট্যান্ড এবং অন্যটি হলো মূল বাসস্ট্যান্ড (সেই ঐতিহাসিক বাঁকমোড়া নামক স্থান, যেখানে বাজারের গোড়াপত্তন হয়েছিলো)। যেদিক দিয়েই আপনি প্রবেশ করেন না কেনো, ভেতরে ঢোকামাত্রই গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাবেন। ঢাকা শহরের বায়ান্নো বাজার তিপান্নো গলির কথা শুনেছেন নিশ্চয়, কিন্তু এই আপাত ছোট্টো একটা বাজারে যে কয়টি গলি, তা বাজারে অবস্থানকারী দোকানিরাও ঠাহর করতে পারেন না। একেক আইটেমের নামে অবশ্য গলি বা পট্টি রয়েছে। যেমন : লুঙ্গি পট্টি, মশারি পট্টি, গামছা পট্টি, লট পট্টি ইত্যাদি।

শেখেরচর বাজারের আশেপাশের এলাকার লোকজন এই বাজারকে ধারণ করে গত ৮৬ বছরে প্রভূত উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে। তবে এই উন্নতি কেবল অর্থনৈতিক। পাশাপাশি শিক্ষা ও সংস্কৃতির তেমন কোনো উন্নয়ন ঘটেনি।

শেখেরচর-বাবুরহাটের বাজার এখন কেমন যাচ্ছে? অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা কেমন? আমরা অনেক ব্যবসায়ীর সাথে আলাপ করে জেনেছি, ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ ‘সুতার বাজার’। সুতা থেকে ছাপা কাপড় হয়ে শেখেরচরে আসতে যেসব প্রক্রিয়া রয়েছে, সুতার উচ্চ দামের কারণে সেসব ধাপেও খরচ দ্বিগুণ-তিনগুণ ধরতে হচ্ছে। গত এক বছর যাবত সুতার বাজার ভয়াবহ রকমের অস্থিতিশীল। বিশ্ববাজার বা তুলার দাম বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে মাধবদী-নারায়ণগঞ্জের বড়ো বড়ো সুতা ব্যবসায়ীরা সুতার দাম প্রতি সপ্তাহেই আকাশচুম্বী করে রাখে। সরকার এ-বিষয়ে কোনো মনিটরিং করে না। যার ভয়াবহ প্রভাব গোটা বস্ত্রশিল্পকে একটা নাজুক অবস্থায় ফেলে রাখছে।

প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার খ্যাত ‘শেখেরচর-বাবুরহাট’ তার দীর্ঘ ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতায় আপন মহিমায় সারা বাংলাদেশের তাঁতবস্ত্রের যোগান অব্যাহত রেখেছে। এটা শেখেরচর-মাধবদী তথা নরসিংদীর গৌরব।

গত শতকের প্রথমদিকে নরসিংদীর প্রজাঅন্তপ্রাণ জমিদার ললিতমোহন রায় তার দাদার নামে হাড়িধোয়া নদীর পাড়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘কৃষ্ণগঞ্জ’ বাজার। সবধরনের মনোহারি দ্রব্যের পাশাপাশি বাজারটিতে সুতা-কাপড়েরও ছোট্টো একটি বাজার গড়ে ওঠেছিলো। দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা কাপড়ের পসরা সাজিয়ে বসতো। কিন্তু বাজারের খাজনা বৃদ্ধির ধুয়া তুলে পাইকাররা এখানেই প্রথম অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং একজোট হয়ে মাধবদীর জমিদারের কাছে যায় তাদের কাপড়ের হাটের জায়গা দেয়ার জন্যে। জমিদার তাদের জায়গা দেয় এবং ধীরে ধীরে হাট জমজমাট হতে শুরু করে। আর তখনই একই বিপত্তি বাধে। আবার খাজনাকেন্দ্রিক জটিলতা। আবার বিদ্রোহ, অসন্তোষ। পাইকাররা আবার দুই কিলোমিটার উত্তরে তালুকদার হলধর সাহার কাছে হাটের জায়গার আবেদন করে এবং নতুন আরেকটি হাটের সৃষ্টি হয় ‘শেখেরচর-বাবুরহাট’।

মূলত পাইকারদের এই ক্রমশ অসন্তুষ্টির ফলাফলস্বরূপ মহেশ্বরদী পরগণার এই অঞ্চলে সুতা-কাপড়ের এক অভাবনীয় বাজার গড়ে ওঠে, যা এখন বাংলাদেশের প্রধান বস্ত্রবাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।

শেখেরচর-বাবুরহাটের এই বস্ত্রকেন্দ্র তার স্বমহিমায় টিকে থাকুক, এটাই প্রত্যাশা সবার।


আলোকচিত্র : শহিদুল্লাহ পিয়াস