নেতাজির অনুগামী, শুভাকাঙ্ক্ষী আর পৃষ্ঠপোষকের কোনো অভাব ছিলো না পূর্ববঙ্গে। এর মধ্যে একজন ছিলেন নরসিংদীর জমিদার ললিতমোহন রায় বিএবিএল। তিনি ছিলেন নেতাজির ভাইপো ডা. শিশির কুমার বসুর শ্বশুর। অর্থাৎ কৃষ্ণা বসুর নানা। একজন শিল্পপতি, শিক্ষাবিদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে ললিতমোহন ছিলেন ভারতবর্ষব্যাপী পরিচিত। বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামী ছিলেন। তিনি ছিলেন কলকাতা বেঙ্গল ল্যাম্পসের প্রতিষ্ঠাতা। উক্ত ল্যাম্প কারখানা ছিলো ভারতবর্ষের বৈদ্যুতিক বাল্ব উৎপাদনকারী প্রথম প্রতিষ্ঠান।
এলগিন রোডের বসু পরিবার, নরসিংদীর সাটিরপাড়ার রায় জমিদার বাড়ি আর কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর চৌধুরী পরিবার একে অপরের আত্মীয় ছিলো। নরসিংদীর জমিদার ললিতমোহন রায়ের মেয়ে ছায়া দেবীর বিয়ে হয়েছিলো নীরদ সি চৌধুরীর ভাই চারুচন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে। অপরদিকে তাঁদের মেয়ে কৃষ্ণা বসুর সম্বন্ধ হয় সুভাষচন্দ্রের বড়ো ভাই শরৎচন্দ্র বসুর ছেলে ডা. শিশির কুমার বসুর সঙ্গে। তাঁদের সন্তান সুগত বসু, শর্মিলা বসু, ও সুমন্ত্র বসু। কৃষ্ণা বসুর জন্ম তাঁর দাদু (মাতামহ) ললিত রায়ের ঢাকাস্থ লক্ষ্মীবাজারের বাড়িতে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ডিসেম্বর। শিশির বসুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিলো ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর। ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি ৮১ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন।
অনেকে মনে করেন, আত্মীয়তা সূত্রে নেতাজির সঙ্গে ললিতমোহন রায়ের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিলো। কোনো কোনো গবেষক যুক্তি দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, একই আদর্শের রাজনীতির কারণেই সুভাষচন্দ্র তাঁর ভাইপোকে ললিতমোহনের নাতনীকে বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছিলেন। তাছাড়া ডা. শিশির বসুর বাবা শরৎ বসু স্বাধীনতাপ্রেমী ও কংগ্রেস রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ট ছিলেন। ললিতমোহনও একই রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।
তবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র আর ললিতমোহনের রাজনীতি একই সূত্রে গাঁথা ছিলো। দুজনেই কংগ্রেসের রাজনীতি করলেও বিশ্বাস করতেন, সশস্ত্র আন্দোলন ছাড়া এই দেশ থেকে উপনিবেশবাদী ব্রিটিশদের তাড়ানো সম্ভব নয়। আলোচনার টেবিলে বসে চা-নাস্তা খাওয়ার নামে রাজনীতি করলে স্বাধীনতার পথ আরো দীর্ঘায়িত হবে। যার কারণে সশস্ত্র বিপ্লবে জড়িত বিভিন্ন দল— যেমন : অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর পার্টি, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স, সূর্যসেনের দল (ইন্ডিয়ান রিপাবলিক আর্মি) প্রভৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন দুজনেই। নেতাজি তো দেশ ছেড়েছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করার জন্যে।
ললিতমোহন রায় আইনজীবী হিসেবে ঢাকা ও নারায়ণঞ্জ বারের নেতৃত্ব দিলেও তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিলো দেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। সেজন্যে তিনি নিজে স্বদেশি স্টিমার কোম্পানি খুলেছিলেন। এর মূল অফিস ছিলো নারায়ণগঞ্জে। ব্রিটিশ মালিকানাধীন স্টিমার কোম্পানিকে টেক্কা দেবার জন্যেই তিনি সেটা করেছিলেন। স্বদেশি জাহাজে যাত্রী পরিবহনের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে অনেক বিপ্লবীদের চাকুরি দেয়া হয়েছিলো। তাঁরা সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে জাহাজে চলে যেতেন। পুলিশ অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বিপ্লবীদের পেতো না। প্রখ্যাত বিপ্লবী মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ললিতমোহন রায়ের প্রতিষ্ঠিত স্বদেশি স্টিমারে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন।
ললিতমোহন রায় ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পিতা কালী কুমার রায়ের নামে সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশন নামে একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। লেখাপড়ায় স্কুলটি সুনাম অর্জন করে। এরচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের কারণে। উক্ত স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি শরীরচর্চা, লাঠি খেলা ও ছোরা চালনা শেখানো হতো। স্কুলের শিক্ষক মহিমচন্দ্র নন্দী, ছাত্র মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, সতীশচন্দ্র পাকড়াশী প্রমুখ অনুশীলন সমিতির শাখা গড়ে তুলেছিলেন স্কুলে। ফলে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা এসব কর্মকাণ্ডের রিপোর্ট দেয় ঊর্ধ্বতন মহলে। এতে ব্রিটিশ প্রশাসন ক্ষুব্ধ হয়ে সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশনের সরকারি অনুদান বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এসব বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের মূল উৎসাহদাতা ছিলেন জমিদার ও আইনজীবী ললিতমোহন রায়। তিনি স্কুলের যে-আবাসিক ছাত্রাবাস ও শিক্ষক কোয়ার্টার নির্মাণ করেছিলেন, সেখানে বিভিন্ন বিপ্লবীদের লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করতেন। এমনকি তিনি তাঁর জমিদার বাড়ির অনেককে বিপ্লবী দলে যোগদানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তেমন একজন বিপ্লবী সুনীল বরণ রায়, যিনি পরবর্তীতে হুগলির চন্দননগরের গভর্নর হয়েছিলেন। জমিদার ললিতমোহন রায়ের ঘনিষ্ঠ কবিয়াল হরিচরণ আচার্য্য বহু স্বদেশি গান গেয়ে মানুষদের সচেতন করতেন।
অতীতে মহেশ্বরদী পরগণা ছাড়াও ভাওয়াল পরগণার কিছু এলাকায় তাঁর জমিদারি এস্টেট ছিলো। তিনি তাঁর পুরো জমিদারিতে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় শুধুমাত্র মহেশ্বরদী পরগণাতেই পঞ্চাশটি বিপ্লবী আখড়া গড়ে ওঠেছিলো, যেগুলোর নেতৃত্বে ছিলো অনুশীলন সমিতি। বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষা নেবার জন্যে তাঁরা চিনিশপুর কালী মন্দিরকে বেছে নিয়েছিলেন। জঙ্গলাকীর্ণ সেই কালী মন্দিরটি জনমানবহীন থাকতো। এই সুযোগে বিপ্লবীরা সেখানে গিয়ে নিজের রক্তে তিলক এঁকে কালীমূর্তির সামনে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার দীক্ষা গ্রহণ করতেন। বিপ্লবী দল অনুশীলন সমিতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ললিতমোহন রায়ের নাম গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিলো। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হবার পর। ব্রিটিশ সরকারকে উৎখাতের জন্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের অভিযোগ এনে এই মামলা দায়ের হয় ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে।
ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে এই মামলার অন্যতম আসামী মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী তাঁর লেখা ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাকভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, উক্ত মামলার আইনজীবী ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস। তিনি মামলা উপলক্ষে কলকাতা থেকে ঢাকা আসতেন। ব্যারিস্টার দাসের আগমন উপলক্ষে ঢাকায় বিপ্লবীদের শোভাযাত্রা হতো। যখন জেলখানা থেকে বিপ্লবীদের কোর্টে আনা হতো, তখন তাঁদের গাড়ি ঘিরে শত শত বিপ্লবী পদযাত্রা করতো। দুই বছর ধরে চলা মামলাটির মূল তদারককারি ছিলেন সাটিরপাড়ার জমিদার ললিতমোহন রায়।
জমিদারি, স্টিমার ব্যবসা ও আইন পেশার বাইরেও ললিতমোহন রায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে মনোযোগ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করাকে তিনি দেশপ্রেম মনে করতেন। এক্ষেত্রে তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রখ্যাত স্বদেশি নেতা ও বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়। একদিন প্রফুল্লচন্দ্র জমিদার ললিত বাবুকে দেখে বললেন, জমিদারির পাশাপাশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলুন। দেশ শিল্পে সমৃদ্ধ না হলে স্বাধীনতা লাভ করে পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাবে না। কথাটি ললিত বাবুর বেশ মনে ধরলো। তাই তিনি চিন্তা-ভাবনা করে দুই ছেলেকে প্রযুক্তিবিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্যে আমেরিকা ও জার্মানিতে পাঠান। ভারতের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, লেখক ও কংগ্রেস নেতা কৃষ্ণা বসু ‘হারানো ঠিকানা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ললিতমোহন রায় তাঁর মেজো ছেলে সুরেন্দ্রকুমার রায়কে আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পাঠান। কিরণ রায়কে পাঠানো হলো কেমব্রিজের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)-তে। সুরেন রায়কে পাঠানো হলো জার্মানিতে, ইলেকট্রিক প্রযুক্তিতে মাস্টার্স করার জন্যে। সেটা ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। ছেলেরা বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পর ললিতমোহন রায় তাঁদেরকে কলকাতায় একটি ল্যাম্প কোম্পানি খোলার নির্দেশ দিলেন। উক্ত কোম্পানির নামকরণ করেন ‘বেঙ্গল ল্যাম্পস লিমিটেড’। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ল্যাম্প কারখানা স্থাপিত হয়। প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস’ নামের আদলে কোম্পানির নাম রাখা হয়। বেঙ্গল ল্যাম্পস প্রতিষ্ঠার আগে কলকাতার বৈদ্যুতিক বাতির বাজার নিয়ন্ত্রণ করতো নেদারল্যান্ডসভিত্তিক বৈদ্যুতিক বাতির কোম্পানি ‘ফিলিপস’। সেই ফিলিপসকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে যায় স্বদেশি বাল্ব তৈরির কারখানা বেঙ্গল ল্যাম্পস। কলকাতার যাদবপুর, কসবা, বেহালা ছাড়াও ব্যাঙ্গালোরে বেঙ্গল ল্যাম্পসের কারখানা স্থাপিত হয়। বিদেশি কোম্পানিকে পেছনে ফেলে একটি স্বদেশি কোম্পানির এগিয়ে যাবার বিষয়টি সে-সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেছিলো। নরসিংদীর জমিদার ললিতমোহন রায় এবং হেমেন রায় মিলে যে-সাফল্য অর্জন করেন, তা দেখে অনেক বাঙালি ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও বৃহৎ শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার জন্যে এগিয়ে এসেছিলেন।
কৃষ্ণা বসুর বিবরণ থেকে জানা যায়, কিরণ রায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী ছিলেন। পরে বেঙ্গল ল্যাম্পস প্রতিষ্ঠার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন। কিন্তু হিমালয় ভ্রমণ করতে গিয়ে তুষারপাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছিলো। সুরেন রায়ও যাদবপুর কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী এবং পরিচালনা পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সুরেন ও হেমেন রায় বেঙ্গল ল্যাম্পস ফ্যাক্টরির পাশেই সুসজ্জিত বাসভবন নির্মাণ করে বসবাস করতেন।
জানা যায়, দেশভাগ ও অব্যাহত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পূর্ববঙ্গ থেকে হাজার হাজার হিন্দু পরিবার পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তার বড়ো একটি অংশ দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর এলাকায় উদ্ধাস্তু হিসেবে বসবাস করতে থাকে। তাদের জন্যে ভারত সরকার সেখানে বেশকিছু উদ্ধাস্তু কলোনি প্রতিষ্ঠা করে দেয়। তখন বেঙ্গল ল্যাম্পসের পক্ষ থেকে উদ্ধাস্তুদের নানাভাবে সহযোগিতা করা হয়।
এর প্রতিদানও পেয়েছে ললিতমোহন রায়ের আত্মীয়-স্বজনেরা। নাতনি কৃষ্ণা বসু বারবার সংসদ নির্বাচনে জয় লাভ করেছেন যাদবপুর আসন থেকে। তাঁর ছেলে সুগত বসুও একই আসন থেকে জয় লাভ করেন। এর নেপথ্যে বেশকিছু কারণ ছিলো। প্রথম তিনটি কারণ হলো : এক. কৃষ্ণা বসু ও সুগত বসু নেতাজি সুভাষচন্দ্রের পারিবারিক লোক; দুই. দাদু (মাতামহ) ও তাঁর সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল ল্যাম্পসের সুনাম; তিন. যাদবপুর এলাকার সিংহভাগ মানুষ পূর্ববঙ্গের উদ্ধাস্তু, যাদের বড়ো একটি অংশ স্বাধীনতা যুদ্ধে বিপ্লবী দলের সদস্য হিসেবে নেতাজি ও ললিতমোহনকে শ্রদ্ধা করতেন।
কৃষ্ণা বসু প্রথম কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম যাদবপুর কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯৮ ও ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে তৃণমূল কংগ্রেস থেকে একই আসনে সাংসদ হিসেবে জয়লাভ করেন। মায়ের আসন থেকে তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে সুগত বসু ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে সাংসদ হন। তিনি একজন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ। আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তনী পরে আর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আগ্রহ দেখাননি। তারপর কবির সুমন ও মিমি চক্রবর্তী যাদবপুর থেকে সাংসদ হন। নেতাজিকে নিয়ে সুগত বসুর ইংরেজি ভাষায় গবেষণা রয়েছে।
কৃষ্ণা বসু দীর্ঘ ৪০ বছর কলকাতার খ্যাতনামা সিটি কলেজের শিক্ষক ছিলেন। কিছুদিন অধ্যক্ষ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তবে লেখালেখিতে তিনি বেশি সুনাম অর্জন করেছেন। নেতাজি সম্পর্কে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন, যা পাঠকের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। লিখেছেন একাধিক স্মৃতিকথা বিষয়ক গ্রন্থ। গ্রন্থগুলো হলো— ইতিহাসের সন্ধানে, এমিলিয়ে ও সুভাষ : এক অনন্য সম্পর্কের কাহিনি, পার্লামেন্টের অন্দরমহলে, চরণরেখা তব, প্রবন্ধ সংগ্রহ (১৯৫১-২০২০), প্রসঙ্গ সুভাষচন্দ্র, ছোটদের নেতাজি, হারানো ঠিকানা, ১৯৪৭ স্মৃতি-বিস্মৃতি, ভ্রমণ দেশে দেশে, এক নম্বর বাড়ি প্রভৃতি।
লেখালেখির পাশাপাশি কৃষ্ণা বসু নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর প্রধান ছিলেন, যার মাধ্যমে তিনি সুভাষ বসুর রাজনৈতিক আদর্শ ও দেশপ্রেমের ভাবনা-চিন্তাকে প্রসারিত করেছেন। সাংসদ থাকাকালে তিনি পার্লামেন্টরি স্ট্যান্ডিং কমিটি অন এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্সের চেয়ারম্যান, কমিটি অন অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন কমিটির সদস্য ছিলেন। তৃণমূল কংগ্রেসের সবচেয়ে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি সবার কাছ থেকে মাতৃসম সম্মান পেতেন।
লেখালেখির জন্যে কৃষ্ণা বসু প্রতিশ্রুতি পুরস্কার, সোপান পুরস্কার, শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার, উত্তর পথ পুরস্কার, কবি বিষ্ণু দে পুরস্কার, উৎসব পুরস্কার, আল্পনা আচার্য স্মৃতি পুরস্কার ও রাইটার ইন রেসিডেন্স সম্মাননা লাভ করেন। একজন কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও তিনি খ্যাতনামা ছিলেন। নিয়মিত লিখতেন আনন্দবাজার, সংবাদ প্রতিদিনসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকায় কলাম লিখে বেশ সুনাম অর্জন করেন।
আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক
১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি লাভ করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র— বাংলাদেশ। এ-দেশের সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগ, মৃত্যু আর রক্তের বিনিময়ে এটা সম্ভব হয়েছিলো। তবে এই স্বাধীনতা হঠাৎ করে শুরু হয়ে যায়নি। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই ধাপে ধাপে নানান তৎপরতা ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৯৭১ সালে এসে পরিণতি লাভ করে। গোটা দেশের মানুষ নিজেদের এই স্বাধীনতার পথে সম্মিলিতভাবে বিলিয়ে দিয়েছিলো অকুণ্ঠচিত্তে। আর এই বিলিয়ে দেয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবার আত্মলীনপথে অনেক রাজনৈতিক নেতার তৎপরতা প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলো।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলার দামাল সন্তানেরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকায় বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিল বের করে। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। সালাম, বরকত, রফিকের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। এই হত্যার প্রতিবাদে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে গোটা দেশ। নরসিংদী জেলায়ও এই হত্যার খবর পৌঁছামাত্র জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মতো ফুঁসে ওঠে জনতা। নরসিংদী, রায়পুরা, মনোহরদী, শিবপুর, পলাশ ও বেলাব থানার প্রতিটি স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল এবং সমাবেশের মাধ্যমে এ-ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। স্কুল-কলেজ, মিল-কারখানা এমনকি অফিস আদালতেও ধর্মঘট পালিত হয়।
এ-সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো নরসিংদীতে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়োজিত জনসভা। ২১ ফেব্রুয়ারির তিনদিন পর অনুষ্ঠিত এই জনসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। আওয়ামী লীগ নেতা মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে দত্তপাড়া ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত এই জনসভায় প্রচুর লোক সমাগম হয়। মওলানা ভাসানীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং অবিলম্বে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানান। জনগণ প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। এই জনসভা সংগঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া, আফসার উদ্দিন, আ. রাজ্জাক ভূঁইয়া, মতিউর রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। এই জনসভার জের হিসেবে মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করার জন্যে সরকার ঢাকা থেকে নরসিংদীতে প্রায় ২০০ পুলিশ ফোর্স পাঠায়। এই পুলিশ ফোর্স যখন ভাসানীকে গ্রেফতারের জন্যে নরসিংদী রেলস্টেশনে অপেক্ষা করছিলো, তখন স্টেশনের পশ্চিমে অবস্থিত বটতলার ওয়াজ উদ্দিন নামক একজন আওয়ামী লীগ কর্মী পুলিশ দেখে সন্দেহ পোষণ করেন। তিনি তৎক্ষণাৎ দত্তপাড়া থেকে যে-পথে মওলানা ভাসানী নরসিংদী স্টেশনে আসতে পারেন, সেই পথে এগিয়ে যান এবং পথিমধ্যে মওলানা ভাসানীসহ নেতৃবৃন্দকে আসতে দেখে পুলিশের উপস্থিতির খবর দেন। ফলে গ্রেফতার এড়াতে মওলানা ভাসানীকে হিন্দুপাড়ার ভেতর দিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। ৫-৬ দিন সেখানে আত্মগোপনে থাকার পর তাঁকে নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।
১৯৫৩ সালে ঈদগাহ ময়দানে আরো একটি বড়ো জনসভা হয়। এই জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। বিশেষ অতিথি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। নবীনগরের রফিকুল ইসলাম, আলী আহমেদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দও বক্তব্য রাখেন। শেরে বাংলা এ-সভায় সবাইকে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান। এই জনসভার উদ্যোক্তা ছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
ঐতিহাসিক দত্তপাড়া ঈদগাহ ময়দান | ছবি : নূর নিহাদ
১৯৫৩ সালে শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাভিত্তিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রামে যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং ১৯৫৪ সালের ৮ মার্চের সাধারণ নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই নির্বাচনে মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ নেতা সারা বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে ২১ দফার বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে তোলেন। এরই অংশ হিসেবে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, শেখ মুজিব নরসিংদী, শিবপুর, রায়পুরা ও মনোহরদীর হাতিরদিয়ায় গণসংযোগে আসেন এবং জনসভা করেন। তাঁদের গণসংযোগের ফলে সারা নরসিংদীতে গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়। নরসিংদী এলাকার নির্বাচনী প্রচারণায় মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া, আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া, আবুল হাশিম মিয়া, আতাউর রহমান ভূঁইয়া, আ. লতিফ ভূঁইয়া, আফতাব উদ্দিন ভূঁইয়া, কলিম উদ্দিন এডভোকেট, শহীদ উল্লাহ ভূঁইয়া, তোফাজ্জল হোসেন, ছাত্রনেতা গোফরান, জিয়াউল হক, নূর মোহাম্মদ, গৌরাঙ্গ পোদ্দার, নৃপেন্দ্র সাহা, সুরেন্দ্র দাস, তাবু মিয়া ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।
নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয় এবং যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থীরা প্রতিটি আসনে ভোটের বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে ৩ এপ্রিল যুক্তফ্রন্ট সরকার শপথ গ্রহণ করে ক্ষমতাসীন হয়। কিন্তু ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে এবং যুক্তফ্রন্ট সরকারকে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করে কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৩৫ সালে প্রণীত ভারত শাসন আইনের ৯২ (ক) ধারা বলে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে চক্রান্তমূলকভাবে ক্ষমতা কেড়ে নেয় এবং পূর্ব বাংলায় অনির্দিষ্ট কালের জন্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। শেরে বাংলাকে অন্তরীণ, মওলানা ভাসানী বিদেশে থাকায় স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে নিষেধাজ্ঞা এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ শত শত রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয় এবং কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এই নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়, আন্দোলন গড়ে ওঠে। নরসিংদীতেও এই আন্দোলন মারাত্মক রূপ লাভ করে। প্রতিবাদ, মিছিল, মিটিং, বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সমগ্র নরসিংদী। আন্দোলনের প্রচণ্ডতাকে দমনের জন্যে পাকিস্তান সরকার গ্রেফতার করে নরসিংদীর জননেতা আবুল হাশিম মিয়া, শীতল চন্দ্র দে, কার্তিক চন্দ্র সাহা, আবুল ফজল ভূঁইয়া, সুরেশ পোদ্দারসহ আরো কয়েকজন নেতাকে। মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া, হারুন-অর-রশিদ ভূঁইয়া, রহমান ভূঁইয়াসহ আরো কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতারের জন্যে তাঁদের বাড়িতে হানা দিয়ে ব্যর্থ হয়।
১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট। এই রিপোর্টে ২ বছরের ডিগ্রি কোর্সকে ৩ বছরে রূপান্তরিত করাসহ পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা সংকোচনের প্রস্তাব করা হয়। কাজেই এই রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্ররা শিক্ষা দিবস পালন উপলক্ষে প্রদেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়। নরসিংদীর প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই হরতাল পুরোপুরিভাবে পালিত হয়। এ-দিন ঢাকায় ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে তিনজন নিহত হলে নরসিংদীতেও তার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ধর্মঘট পালিত হয়। ইতোমধ্যেই আইয়ুব খান নিজের ক্ষমতার পথ নিষ্কণ্টক করতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ আবুল মনসুর আহমদ, মনসুর আলী ও শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ করলে অন্যান্য স্থানের মতো নরসিংদীতেও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এসব আন্দোলনের সময় নরসিংদীর দত্তপাড়া ঈদগাহ ময়দানে এক জনসভা হয়। এতে আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী বক্তৃতা করেন। এ-সময়ের আন্দোলনে নেতৃত্বে ছিলেন জানে আলম ভূঁইয়া, রিয়াজ উদ্দিন, আতাউর রহমান ভূঁইয়া, সাখাওয়াত হোসেন মিয়া ওরফে ইয়ার মোহাম্মদ, শামসুল হক ভূঁইয়া, হাবিবুল্লাহ বাহার, নারায়ণচন্দ্র সাহা, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, আবদুল মান্নান খান, ফজলুর রহমান ফটিক মাস্টার, আপেল মাহমুদ, আলী আকবর, নাজমুল হোসেন বাদল প্রমুখ ছাত্রনেতা। সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি এবং শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত নরসিংদীর ছাত্র-জনতা যখন উত্তেজিত, ঠিক সেই সময় মনোহরদী থানার হাতিরদিয়াতে একটি জনসভায় যোগ দেয়ার জন্যে রওনা হন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবদুস সবুর খান, ওয়াহিদুজ্জামান এবং নারায়ণগঞ্জের ডিসি আ. ছাত্তার। তারা গাড়িযোগে নরসিংদীর বর্তমান ফায়ার সার্ভিসের সামনে (মতান্তরে বৌয়াকুড়) পৌঁছালে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার একটি মিছিল তাদের গতি রোধ করে এবং তাদের গাড়ি ভাঙচুর করে। এরপর সারা নরসিংদীতে আইয়ুব খানের ফটো ভাঙা হয়। এ-ঘটনার প্রেক্ষিতে ছাত্রনেতা আতাউর রহমান ভূঁইয়া ও শামসুকে কলেজ থেকে ফোর্স টিসি দেয়া হয় এবং রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, নাজমুল হোসেন বাদল, শামসুল হুদা বাচ্চু ও আলী আকবরসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। পরে জনমত ও ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকার তাদের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাঙালির মুক্তিসনদ ‘ছয়দফা’ ঘোষণা করে এবং স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে। এ-সময় বাম আন্দোলন মস্কোপন্থী ও চীনপন্থী নামে দুই ধারায় বিভক্ত হলেও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন অব্যাহত রাখে তারা। ফলে আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে। নরসিংদীতে ছয়দফার পক্ষে মিছিল, মিটিং, শোভাযাত্রা চলতে থাকে। ছয়দফার জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে সরকার দমননীতির আশ্রয় নিয়ে শেখ মুজিবসহ কয়েকজন নেতাকে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে বন্দী করে এবং প্রদেশজুড়ে ধর-পাকড় শুরু করে। এর প্রতিক্রিয়ায় পূর্ব বাংলায় ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং প্রতিবাদে ৭ জুন হরতাল আহ্বান করা হয়। গোটা পূর্ব পাকিস্তানের সাথে নরসিংদীতেও ব্যাপক বিক্ষোভ হয়, সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। হরতালের দিন সরকার নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নেয়। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ধর্মঘটী জনতার উপর পুলিশ গুলি চালালে ১১ জন নিহত ও বহু লোক আহত হয়। শত শত লোককে গ্রেফতার করা হয়। প্রতিবাদে ১৭ থেকে ১৯ জুন সারাদেশে প্রতিবাদ দিবস পালন করা হয়। নরসিংদী জেলার প্রতিটি থানার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানায় মিছিল-সভা-সমাবেশের মাধ্যমে এই প্রতিবাদ দিবসকে সফল করে তোলা হয়। নরসিংদীর নেতৃবৃন্দের নির্দেশে জনতা নরসিংদী থেকে জিনারদী পর্যন্ত রেললাইন তুলে ফেলে। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে নরসিংদীতে রাজনৈতিক উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করে। তাঁদেরকে গ্রেফতারের পরপরই এই ষড়যন্ত্রমূলক মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ অন্যদের মুক্তির দাবিতে গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে। হরতাল, মিছিল, মিটিং, জনসভার মাধ্যমে আন্দোলন চলতে থাকে। নরসিংদীতে ১০ আগস্ট ছাত্র ধর্মঘট, ১৭ সেপ্টেম্বর সরকারি কলেজে কালো পতাকা উত্তোলন ও সভা করা হয়। ১৫ অক্টোবর সরকারি কলেজে আইয়ুব খানের উন্নয়ন দশক উপলক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হলে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্ররা এই সভা বর্জন করে এবং ‘দুর্গতির দশক’ হিসেবে একে আখ্যায়িত করে। ১০ নভেম্বর ন্যাপের উদ্যোগে জিন্নাহ পার্কে জনসভা হয়। ১১ ডিসেম্বর সর্বদলীয় কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৪ ডিসেম্বর হরতাল পালিত হয়। এছাড়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের উদ্যোগে পৃথক কর্মীসভা, শোভাযাত্রা, প্রতিবাদ সভা, জনসভা অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলে। এ-সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার খরচ মেটানোর জন্যে নরসিংদী জেলাবাসীর পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে টাকা প্রেরণ। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নরসিংদীর সর্বস্তরের জনগণের নিকট থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে কালীগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা ময়েজউদ্দীনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অর্থ প্রেরণ করে মামলার ব্যয় মেটানোর কাজে সহায়তা করেন।
১৯৬৮ সালে নরসিংদীর সবচেয়ে আলোড়িত ঘটনা মনোহরদী থানায় সংঘটিত ‘হাট হরতাল’। আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করতে মওলানা ভাসানী ২৯ ডিসেম্বর এসব এলাকায় হাট হরতাল পালনের ডাক দেন। এই হরতাল সফল করার জন্যে শিবপুর ও মনোহরদী এলাকায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল মান্নান খান, তোফাজ্জল হোসেন, ছাত্র ইউনিয়ন ও কৃষকনেতা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, কৃষক সমিতির নেতা তোফাজ্জল হোসেন শাহজাহান, আ. রশিদ তারা মাস্টার, আ. হাই ও সিরাজুল হক। স্থানীয় নেতা তোফাজ্জল হোসেন শাজাহানের নেতৃত্বে প্রথমে হরতালের পক্ষে পিকেটিং শুরু হয়। একটি রিকশায় দাঁড়িয়ে আসাদুজ্জামান বক্তব্য প্রদানকালে সকাল এগারোটায় পুলিশ পিকেটিংরত ছাত্র-জনতার উপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও ধর-পাকড় আরম্ভ করে। ফলে জনতা আরো মারমুখী হয়ে ওঠে। এমন অবস্থায় আবদুল মান্নান খানের নেতৃত্বে শিবপুর হতে বিপুল জনতার এক জঙ্গি মিছিল হাতিরদিয়ার জনতার সাথে মিলিত হয়ে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করে তোলে হাতিরদিয়া বাজার এবং গ্রেফতারকৃতদের ছাড়িয়ে আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। উত্তপ্ত অবস্থায় বিকেলের দিকে পুলিশ বাহিনি জনতার উপর বেপরোয়া গুলি চালায়। পুলিশের নির্মম গুলিবর্ষণে নিহত হয় নোয়াদিয়ার মো. মিয়া চান, সোনামুড়ার মো. হাছেন আলী ও বাসলীকান্দির মো. ছিদ্দিকুর রহমান নামে তিনজন কৃষক। মাথায় মারাত্মক আঘাতে আহত হন মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান এবং চান মিয়া, আক্কাছ আলী, মোতালেব ও কলেজ ছাত্র আ. হাইসহ আরো বেশ কয়েকজন কৃষক-জনতা। গ্রেফতার করা হয় কৃষকনেতা তোফাজ্জল হোসেন শাজাহান, ছাত্রনেতা তোফাজ্জল হোসেন, সেন্টু মোল্লা, মোক্তার হোসেন খান, শরীফ হোসেন এবং মাইকম্যান শাজাহানকে। গ্রেফতারকৃতদেরসহ মোট ১৮ জনকে আসামী করে পরে পুলিশ মামলা দায়ের করে। প্রধান আসামী ছিলেন আসাদের পিতা মৌলভী আবু তাহের। গ্রেফতার এড়িয়ে আসাদুজ্জামান ঢাকায় চলে আসেন এবং প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় ঘটনার বিবরণ দেন। ফলে ৩০ ডিসেম্বরের সংবাদপত্রগুলোতে ঘটনার বিস্তারিত খবর প্রকাশিত হয়। হাতিরদিয়ায় সংঘটিত পুলিশি হত্যা ও নির্যাতনের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সমগ্র নরসিংদী এলাকায় প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সারা এলাকায় বিক্ষোভ চলে ও প্রতিবাদ সভা হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে ২ জানুয়ারি ১৯৬৯ নরসিংদী কলেজে ছাত্র ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা হয়। ৩ জানুযারি কলেজের পুকুরঘাটে নরসিংদী শহরের সমস্ত স্কুল-কলেজের ছাত্রদের জমায়েত ও সভা হয়।
১৯৬৯ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আন্দোলন-সংগ্রামের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যুজ্জ্বল অধ্যায়। এ-সময়ই শুরু হয় তুমুল আন্দোলন এবং শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত বাঙালি তাদের আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে শুরু করে। ৪ জানুয়ারি ডাকসু কার্যালয়ে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (উভয় গ্রুপ) এবং ডাকসুর সমন্বয়ে পূর্ব বাংলার প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে ১১ দফা দাবিনামা পেশ করে। এরই অনুসরণে নরসিংদীতেও ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। এই পরিষদে যারা ছিলেন :
শামসুল হুদা বাচ্চু, ছাত্রলীগ, আহ্বায়ক
নূরুল ইসলাম গেন্দু, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য সচিব
হারাধন চন্দ্র সাহা, ছাত্রলীগ, সদস্য
আবদুল মতিন ভূঁইয়া, ছাত্রলীগ, সদস্য
সুভাষ চন্দ্র সাহা, ছাত্রলীগ, সদস্য
মানিক সাহা, ছাত্রলীগ, সদস্য
আবদুল গফুর, ছাত্রলীগ, সদস্য
ফজলুল কাদের চৌধুরী, ছাত্রলীগ, সদস্য
মো. আলী আকবর (নরসিংদী কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি), ছাত্রলীগ, সদস্য
মো. আবদুল আলী মৃধা, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), সদস্য
শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), সদস্য
মো. বজলুর রহমান, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), সদস্য
তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), সদস্য
নূরুল ইসলাম কাঞ্চন, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), সদস্য
যূথিকা চ্যাটার্জী, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
কার্তিক চ্যাটার্জী, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
রফিকুল ইসলাম, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
আজিজ আহমেদ খান, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
বি এ রশিদ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
মজিবর রহমান, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
মোশাররফ হোসেন, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
১১ দফা দাবির সমর্থনে ছাত্ররা ২০ জানুয়ারি সারা পূর্ব বাংলায় ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ছাত্র ধর্মঘট পালনকালে ঢাকায় এক ছাত্রমিছিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা নরসিংদীর অগ্নিপুরুষ আসাদুজ্জামান (আসাদ) গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। আসাদের হত্যাকাণ্ড ছাত্রসমাজসহ পূর্ব বাংলার সকল শ্রেণির মানুষকে প্রবল আঘাত করে। সারা নরসিংদীতে শোকের ছায়া নেমে আসে। পরদিন নরসিংদী কলেজে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং জানাজার আগে বিরাট জনসভা এবং জানাজা শেষে হাজার হাজার লোকের শোকমিছিল এলাকা প্রদক্ষিণ করে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শিবপুর, মনোহরদী, নরসিংদী, কালীগঞ্জ, রায়পুরা, আড়াইহাজার এলাকায় মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ সভা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। ফলে জনগণ সোচ্চার হয়ে ওঠে, ব্যাপকভাবে আন্দোলনমুখী হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
আসাদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ২২ জানুয়ারি নরসিংদীতে বিরাট মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সমাবেশে ২৪ জানুয়ারি (শুক্রবার) নরসিংদীতে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। ২৪ জানুয়ারি নরসিংদীর সকল অঞ্চলে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, কল-কারখানা, হাট-বাজার সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। নরসিংদী শহরে অভূতপূর্ব মিছিল হয় এবং বিকেলে তৎকালীন ইপিআরটিসি ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ-জনসভায় শোককে শক্তিতে পরিণত করার শপথ নেয়া হয় এবং সংগ্রামকে জীবনের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করার অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়। এই জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতা মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া, মতিউর রহমান ভূঁইয়া, ন্যাপের আবুল হাশিম মিয়া, আতাউর রহমান ভূঁইয়া, ছাত্রনেতা শামসুল হুদা বাচ্চু, আলী আকবর, হারাধন সাহা, আ. আলী মৃধা, আ. মতিন ভূঁইয়া, শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া, তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া, নূরুল ইসলাম গেন্দু, যূথিকা চ্যাটার্জী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সমাবেশে ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি নরসিংদীতে দু’দিনব্যাপী শোক দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি যথাযোগ্য মর্যাদায় শোক দিবস পালন করা হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ-দিন ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী যূথিকা চ্যাটার্জীর নেতৃত্বে নরসিংদীতে অনুষ্ঠিত হয় সরকার বিরোধী এক বিরাট মহিলা মিছিল। স্কুল-কলেজের ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সচেতন মহিলারা এই মিছিলে যোগ দেয়। নরসিংদীতে এটি ছিলো সর্বপ্রথম মহিলা মিছিল। ঘরের গৃহিণীদের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে এই মিছিল অনন্য ভূমিকা পালন করে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ইউ-এম-সি জুট মিলের শ্রমিকদের মিছিল, ২১ তারিখে কলেজ মাঠে এবং ২২ তারিখে মরিচাকান্দিতে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এসব আন্দোলনের ফলে আইয়ুব সরকার পিছু হটতে থাকে। ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিরোধী দলকে আলোচনায় আসার আহ্বান জানায়। সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয় প্রবল আন্দোলনের মুখে। ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। শেখ মুজিবসহ অন্যান্য অভিযুক্তরা মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬৯-এর এই গণ-অভ্যুত্থানে এশিয়ার লৌহমানব খ্যাত আইয়ুবের পতন ঘটে। আইয়ুবের পতন ত্বরান্বিত করার জন্যে এ-সময় নরসিংদীর বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয় আরো অনেক আন্দোলন, সংগ্রাম, জনসভা। এগুলোর মধ্যে ২০ ফেব্রুয়ারি আদিয়াবাদের জনসভা, ২৪ ফেব্রুয়ারি পাঁচদোনার জনসভা, ৪ মার্চ শহরের জিন্নাহ পার্কের জনসভা, ৬ মার্চ জয়নগরের জনসভা, ১১ মার্চ কাঁঠালিয়ার জনসভা অন্যতম। কাঁঠালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। তবুও তিনি আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এরপর ১২ মার্চ ‘ডাক’ (DAC : Democratic Action Committee)-র উদ্যোগে শিবপুরে অনুষ্ঠিত হয় এক বিরাট জনসভা। ১৪ মার্চ কালীগঞ্জের নাগরীতে অনুষ্ঠিত হয় এক ছাত্র-জনসভা। ১৬ মার্চ ঘোড়াশালের সান্তানপাড়ায়ও অনুষ্ঠিত হয় জনসভা। এ-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নরসিংদীসহ সারা দেশের আন্দোলনই আইয়ুবের পতনকে ত্বরান্বিত করে। এরপর ১৯৬৯ এর ২৫ মার্চ দেশে পুনরায় সামরিক শাসন জারি করা হয়। আইয়ুব খান চলে গেলো, ইয়াহিয়া খান এলো নতুন চক্রান্তের ছক নিয়ে। পাকশির শাহপুরে কমিউনিস্টদের আয়োজিত এক কৃষক সম্মেলনে ইতোমধ্যেই শ্লোগান ওঠে— শ্রমিক কৃষক অস্ত্র ধর, পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর।
রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় ১১ দফাকে সমর্থন করে শেখ মুজিবুর রহমান জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের দাবি জানান। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-শ্রমিক সংগঠন ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্যে জনগণের প্রতি আহ্বান জানায়। এরই মধ্যে বিভিন্ন ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠন এমনকি কোনো কোনো রাজনৈতিক দলও স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিত্যাগ করে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবিতে ক্রমে সোচ্চার হয়ে ওঠে। জনগণের কাছে পাকিস্তানি শাসকচক্রের বৈষম্য ও ষড়যন্ত্র পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় সারা দেশের মানুষও সোচ্চার হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলন প্রবল থেকে প্রবলতর হয়। নরসিংদীর বিভিন্ন স্থানে এ-সময় সংঘটিত হয় অনেক জঙ্গি মিছিল-মিটিং। এসব মিছিল-মিটিংয়ে সম্পৃক্ত হয় সর্বস্তরের জনগণ। মূলত, ছাত্রনেতারা এ-আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রমিক সংগঠন এবং সামাজিক সংস্থাসমূহও এ-সময় চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি জিন্নাহ পার্কে অনুষ্ঠিত হয় জনসভা। জানুয়ারির ১৫ তারিখ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর চট্টগ্রাম যাবার পথে নরসিংদী রেলস্টেশনে ছাত্ররা তাকে কালো পতাকা প্রদর্শন করে। ১৭ জানুয়ারি থেকে নরসিংদীতে পালন করা হয় ‘১১ দফা সপ্তাহ’। জনগণকে সচেতন ও সক্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে এ-সপ্তাহের সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। ২৪ জানুয়ারি নরসিংদীতে পালন করা হয় সর্বাত্মক হরতাল। জানুয়ারিতে হাসনাবাদ বাজারে অনুষ্ঠিত হয় এক জনসভা। এতে কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতারা বক্তব্য রাখেন। এই আন্দোলন আস্তে আস্তে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেবে বলে তারা বক্তব্য প্রদান করেন। এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণার জন্যে ৯ মার্চ নরসিংদীর শিক্ষকগণ পালন করেন ধর্মঘট। নরসিংদীর সকল বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ মিছিল করে এই ধর্মঘটে যোগ দেন। মিছিল শেষে ব্রাহ্মন্দী বিদ্যালয়ের মাঠে সভা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষকগণের কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১২ মার্চ মশাল মিছিল বের করা হয় এবং জিন্নাহ পার্কে জনসভার আয়োজন করা হয়। এই জনসভায় ঢাকা থেকে আগত হেনা দাস প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। এ-সময় রায়পুরার নারায়ণপুরে অনুষ্ঠিত হয় এক বিরাট জনসভা। এতে মওলানা ভাসানী প্রধান অতিথি ছিলেন। এ-জনসভায় ভাসানী জনগণের ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে সকলকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান।
২ এপ্রিল নরসিংদীর জন্যে একটি স্মরণীয় দিন। এ-দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নরসিংদীর ঈদগাহ ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বক্তব্য রাখেন। তিনি ৬ দফা দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্যে এবং আগামী নির্বাচনে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের জন্যে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। জনসভার পূর্বে নরসিংদী রেলস্টেশনে তাঁকে ছাত্র-জনতা বিপুল সংবর্ধনা জানায়।
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর ব্যাপক অত্যাচার-নিপীড়ন-হত্যাকাণ্ডে পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে প্রচণ্ড অসন্তোষের সৃষ্টি হয় এবং তার প্রতিবাদে সারা পূর্ব পাকিস্তানের সাথে নরসিংদীর জনগণও ২৬ মে হরতাল পালন করে। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত হয় অসংখ্য সভা-সমাবেশ। নরসিংদীসহ সারা দেশের প্রবল উত্তাল আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে বাধ্য হন। নির্বাচনী জোয়ারে জেগে ওঠে নরসিংদীসহ সারা পূর্ব বাংলার মানুষ। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১ মার্চ বেলা একটার সংবাদে রেডিও মারফত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার সাথে সাথে নরসিংদীর সর্বস্তরের জনগণ প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। নরসিংদী সদর থানাসহ প্রতিটি থানায়ই প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। প্রতিবাদ সভা, মিছিল, বিক্ষোভ প্রদর্শন ও নিন্দা জ্ঞাপন করে অধিবেশন আহ্বানের দাবি জানানো হয়।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ নরসিংদীর জন্যে একটি স্মরণীয় দিন। এ-দিন নরসিংদী শহরের মিতালী সিনেমা হলের সামনে আয়োজন করা হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের সভা। ২ মার্চ সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র সমাবেশ ব্যতিত পূর্ব পাকিস্তানের আর কোথাও তখনো পর্যন্ত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়নি। মিতালী সিনেমা হলের সামনে অনুষ্ঠিত বিরাট জনসভার জনপ্রতিনিধি হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতা জনাব মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে নরসিংদীতে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।
৩ মার্চ ১৯৭১, নরসিংদীর মিতালী সিনেমা হলের সামনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন
৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত ঘোষিত কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুযায়ী নরসিংদীতে প্রতিদিন সকাল ৬ টা থেকে বেলা ২ টা পর্যন্ত পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। নরসিংদী শহরসহ বর্তমান নরসিংদী জেলার প্রতিটি থানার সমস্ত দোকানপাট বন্ধ থাকে। বাস-রিকশা-গাড়িসহ কোনো যানবাহন চলাচল করেনি। নরসিংদী ও পলাশ থানার সকল কল-কারখানার উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকে। এ-সমস্ত কর্মসূচি চলাকালীন মিছিল, পথসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং জনসভার আয়োজন করা হয়। এমনি একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয় নরসিংদী কলেজ মাঠে। ৬ মার্চ অনুষ্ঠিত এই জনসভায় স্থানীয় রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতারা জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন এবং অধিকার আদায়ে যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকার জন্যে সবাইকে আহ্বান জানান। এসব কর্মসূচিতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্দোলন ক্রমশ জঙ্গি রূপ ধারণ করে।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশাল জনসমুদ্রে ভাষণে বলেন, তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। শেখ মুজিবের এই ঘোষণা উত্তাল জনসমুদ্র এবং সারা দেশের মানুষের মতো নরসিংদীর মানুষকেও প্রবলভাবে আন্দোলিত ও উজ্জীবিত করে তোলে। ঢাকায় বসবাসরত নরসিংদীর মানুষজন ছাড়াও নরসিংদী থেকে হাজার হাজার কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা এই জনসভায় যোগদান করে। রেলগাড়ি ছাড়াও শুধুমাত্র নরসিংদী থেকেই ১০০ টি বাসে করে জনগণ এই জনসভায় যোগ দেন।
১৬ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে মুজিব-ভুট্টো-ইয়াহিয়ার সমঝোতার প্রয়াস অব্যাহত থাকলেও জনগণ তখন রাজপথে ‘স্বাধীনতা’র মন্ত্রে আপোসহীন। আর এক্ষেত্রে ছাত্রসমাজের ভূমিকাই ছিলো সবচেয়ে অগ্রগণ্য। এরই মধ্যে ১৯ মার্চ সামরিক বাহিনি জয়দেবপুরে গুলিবর্ষণ করে নিরীহ মানুষকে হত্যা করলে নরসিংদীতে তার প্রতিবাদে মিছিল ও বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয় এবং ছাত্রসভার আয়োজন করা হয়।
এরপর ২৬ মার্চ; ইতিহাসের সেই ভয়াল কালরাত। ইয়াহিয়া-ভুট্টো গং সভ্যতার নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় বাংলার বুকে। শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং অবধারিতভাবে শুরু হয়ে যায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
সার্বিক তথ্য সহায়তা
১. মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন, নরসিংদী জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস;
২. এম আর মাহবুব, নরসিংদীর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও শীতলক্ষ্যা বিধৌত চরসিন্দুর নরসিংদীর একটি সরস জনপদ। সুদীর্ঘকাল থেকেই এখানে রয়েছে সাহসী জনবসতি। এখানকার উর্বর মাটিতে ফলে সমৃদ্ধ ফসল। একসময় ফলতো উন্নত লাল ধান। এখনো জন্মে ধান, পাট, বেগুন, মুলা আর চরাঞ্চলে গোলা আলু, বাঙ্গি, মটরশুঁটির মতো নানা ফসল। এখানকার কলা (বড়ো সাগর কলা) হয় অনেক সুস্বাদু। এখানে রয়েছে নরসিংদী জেলার বিখ্যাত কলার হাট। পশ্চিমে শীতলক্ষ্যার গুজি ও চিংড়ি মাছের সাথে পূর্বের ব্রহ্মপুত্রের শোল, বোয়াল, শিঙ, মাগুরের স্বাদ আর উদরপূর্তিতে কেটে যেতো চরসিন্দুরের মানুষের সুখের জীবন। দুদিকে বয়ে চলা শান্ত নদীর মৃদুমন্দ বাতাসে জুড়িয়ে যায় প্রাণ। শীতলক্ষ্যার পালতোলা নৌকায় ঢেউ দিয়ে চলে যেতো বাবলা-সহ সায়েদ কোম্পানির অন্যান্য লঞ্চগুলো। বাতাসে ভেসে বেড়াতো মাঝিমাল্লার গান। গুটি গুটি, কুটকুটে আওয়াজ তুলে গরুর গাড়ি আখ বোঝাই করে ছুটে চলতো এলাকার একমাত্র দেশবন্ধু সুগার মিলে। বর্ষায় নদী তীরের পল্লীগীতি ও ভাটিয়ালি গানের সুরের প্রতিধ্বনি করে শুকনো মৌসুমে বসতো লোকগীতি ও লোকসংস্কৃতির জমজমাট আসর। কলাপট্টিতে ‘রূপবান’, ‘আলোমতি’, ‘সাগর ভাসা’র করুণ কাহিনির অভিনয় দেখে ভাসতো মানুষ চোখের জলে।
একমাত্র চরসিন্দুর হতে লঞ্চে চড়ে নরসিংদীর উত্তরাঞ্চলের মানুষকে যাতায়াত করতে হতো ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ নরসিংদীর অন্যান্য এলাকায়। আবার অনেকে যাতায়াত করতো কষ্টকর গুণটানা নৌকায়। তখন অন্য কোনো যোগাযোগের ব্যবস্থা তেমন ছিলো না। সারাদিন চলাচলের পরও রাত ১২ টায় একটি লঞ্চ ছেড়ে যেতো ঘোড়াশাল হয়ে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে। সমগ্র মনোহরদী ও শিবপুরের অধিকাংশ মানুষ তাঁদের প্রয়োজনে রাতের ঐ-লঞ্চে কেউ ঘোড়াশাল নেমে ট্রেনে ঢাকা যেতো এবং বেশিরভাগ মানুষ যেতো নারায়ণগঞ্জে। তখন বর্তমান নরসিংদী জেলাটি ছিলো নারায়ণগঞ্জ মহকুমার অধীনে। মামলা-মোকদ্দমা ও অন্যান্য কাজে চরসিন্দুর হয়ে লঞ্চেই যেতে হতো। বর্তমান চরসিন্দুর ব্রিজের খানিকটা পূর্ব-দক্ষিণ কর্নারে ছিলো লঞ্চঘাট। আজো ব্রিজের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে পূর্বদিকে তাকালে ক্ষয়িষ্ণু লঞ্চঘাটের চিহ্ন দেখা যায়। যেন স্মরণ করিয়ে দেয় হারিয়ে যাওয়া দিনের কথা।
শীতলক্ষ্যা নদীতে ছিলো প্রচুর মাছ। আশেপাশের বাজারগুলো শীতলক্ষ্যার স্বাদযুক্ত মাছে ভরে যেতো। নদী সংলগ্ন পূর্বদিকের খাড়িতে ভুলপথে অনেক মাছ এসে রাতজাগা শিকারির হাতে ধরা পড়তো। মাঝে মাঝে ধরা পড়তো গুজি মাছ। আইড় মাছকে এলাকার মানুষ গুজি মাছ বলে। নদী ও খাড়ির মধ্যেকার চর ছিলো খুবই নয়নাভিরাম। ঐ-চরে হেঁটে হেঁটে ভ্রমণ পিপাসুর প্রাণ জুড়িয়ে যেতো। বিভিন্ন পার্বণে, বিশেষ করে ঈদের দিনগুলোতে খুব সকালে সমগ্র এলাকার মানুষ নদীতে মহাউৎসবে গরুকে গোসল করাতো। প্রতি শুক্র ও মঙ্গলবার প্রসিদ্ধ চরসিন্দুর হাট বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের মিলনমেলায় পরিণত হতো। বাজার থেকে কে কতো বড়ো মাছ কিনতে পারবে, চলতো এমন প্রতিযোগিতা। এমনসব সাংস্কৃতিক রূপ ধারণ ও লালন করে প্রাচীনকাল থেকেই চরসিন্দুর একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত জনপদ হিসেবে গড়ে ওঠতে থাকে।
চরসিন্দুর হাই স্কুল
এলাকার শিক্ষা বিস্তারে চরসিন্দুর হাই স্কুলই ছিলো একমাত্র অবলম্বন। শিক্ষায় অনেকটা পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্যে ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বর্তমানের চরসিন্দুর হাই স্কুলটি, যেটি ২০১৮ সালে সরকারিকরণ করা হয়েছে। চরসিন্দুরের মহান ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি মৌলভী ইয়াকুব আলী মিয়ার বদান্যতায় মনোরম ও দক্ষিণমুখী সুন্দর জায়গায় ‘জর্জ ইনস্টিটিউশন’ নামে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন ছিলো ব্রিটিশ আমল। ছিলো সদ্য প্রয়াত রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাবা-দাদাদের প্রতাপ। রাণীর বাবা ছিলেন ষষ্ঠ জর্জ এবং দাদা পঞ্চম জর্জ। তাদের নামে নামকরণ হলে অধিক আনুকূল্য পাওয়া যাবে, সম্ভবত এই আশায় স্কুলটির এমন নামকরণ করা হয়েছিলো।
জর্জ ইন্সটিটিউশন নামে এভাবেই পথচলা শুরু চরসিন্দুর হাই স্কুলের। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পাক-ভারত উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ তাড়ানোর আন্দোলন শুরু হলে স্কুলের নাম পরিবর্তিত হয়ে চরসিন্দুর ইংরেজি হাই স্কুল নাম ধারণ করে। পাঠদান চলছিলো তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্তু। সকল শ্রেণির বই আসতো কলকাতা শিক্ষা বোর্ড থেকে। এই স্কুলের সর্বপ্রথম এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা কেন্দ্র ছিলো নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজ। পরবর্তীতে গাজীপুর-নরসিংদী হয়ে স্বাধীনতার পর কয়েক বছর এ-স্কুলেই এসএসসি কেন্দ্র করা হয়েছিলো।
চরসিন্দুর হাই স্কুলের রয়েছে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ’৭১-এর স্বাধীনতার জন্যে মুক্তিযুদ্ধসহ অনেক আন্দোলনের বীরত্বে গাঁথা চরসিন্দুর হাই স্কুল। ’৭১ সালে স্কুল মাঠ ছিলো মুক্তিযুদ্ধের রিক্রুটিং ক্যাম্প। এখান থেকে দলে দলে লোকজন যেতো ভারতে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ অর্জন করতে। হানাদার বিরোধী সাধারণ মানুষের সম্মুখে যুদ্ধের মহড়া হতো চরসিন্দুরে।
ব্রিটিশ আমল থেকে এখন পর্যন্ত অনেক বিখ্যাত-প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বের পদার্পণে ধন্য স্কুলটি। পদার্পণ করেছেন বাংলার বাঘ খ্যাত শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। এসেছিলেন পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন, স্বাধীনতার পর অনেকের মধ্যে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানসহ বহু গুণীজন। শেরে বাংলার সাথে কিংবদন্তি শিল্পী আব্বাস উদ্দিন ও তাঁর সহযোগী বেদার উদ্দিন আহমেদ এসে গান শুনিয়ে সকলকে দারুণ মুগ্ধ করার কথা জানা যায়। শুরু থেকে বহু জ্ঞানপ্রদীপ শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণের ছায়াতলে থেকে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী তাদের জীবনপ্রদীপ প্রোজ্জ্বলিত করেছেন। করেছেন দেশ ও দেশের মানুষের সেবা। এ-স্কুলের স্বনামধন্য প্রধান শিক্ষকগণের মধ্যে মোক্তার হোসেন খান, ইয়াকুব আলী আওরঙ্গজেব, সৈয়দ ফজলুল হক অন্যতম। প্রথমদিকের শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষকদের মধ্যে স্বর্গীয় অম্বিকাচরণ ঘোষ ও অতীন্দ্র চরণ রক্ষিতের নাম এখনো বিদ্যালয়ের নামফলকে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাছাড়া আবদুল জলিল, আবদুল আউয়াল, নাদিরুজ্জামান ও হীরালাল মণ্ডলসহ অনেকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেক সহকারি শিক্ষক বিভিন্ন যশস্বী কর্মকাণ্ডের জন্যে এখনো মানুষের মুখে মুখে জীবন্ত রূপ হয়ে ফিরে আসেন।
স্কুলের অনেক ছাত্রছাত্রী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। মাননীয় জাতীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপ, আলহাজ্ব কামরুল আশরাফ খান পোটন ও জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহন এ-স্কুলেরই কৃতী ছাত্র। স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে বিচারপতি মুনসুরুল হক, যুগ্ম-সচিব নূরুজ্জামান ভূঁইয়া, মীর মোশারফ হোসেন এবং আরো অনেকে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত। ছাত্র ছিলেন ডা. ফজলুল করিম পাঠান ও ডা. অভিরাম চন্দ্র মণ্ডল, যারা চিকিৎসা ক্ষেত্রে এলাকায় প্রচুর অবদান রেখে কিংবদন্তী হয়ে আছেন।
সভাপতি ও সম্পাদক হিসেবে স্কুল পরিচালনার জন্যে মরহুম নূর উদ্দিন মিয়া, মফিজ উদ্দিন খান, ইয়াকুব আলী মিয়া, আবদুর রশিদ শিকদার ও নাসিরুদ্দিন শিকদার বেনু মিয়ার মতো অনেকে স্কুলটি উন্নত থেকে উন্নততর করেছেন, যার প্রতিফলন এখনো বিদ্যমান।
১৯৬৭ সালে গর্বের স্কুলটির ছাত্র ছিলাম আমি। তার আগের বছর এক দুর্বৃত্ত ছাত্রের ছুরিকাঘাতে নরসিংদী কলেজে ম্যাট্রিক পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রধান শিক্ষক মোক্তার হোসেন স্যার খুন হন। তখনকার টলটলায়মান অবস্থায় শিক্ষক ছিলেন মরহুম বেলায়েত হোসেন স্যার, হীরালাল স্যার, বজলুর রহমান স্যার, হাবিবুর রহমান খান বকুল স্যারসহ আরো অনেকে, যাদের নাম এই মুহূর্তে স্মরণে নেই। তবে খুব মনে আছে ময়মনসিংহ থেকে আসা একজন স্যারের কথা, যার আগমনে স্কুলটি দারুণভাবে প্রাণ ফিরে পায়। পরের বছর আমি এই স্কুল ছেড়ে নিজের গ্রামে নব প্রতিষ্ঠিত দত্তেরগাঁও হাই স্কুলে চলে আসি। স্বল্প সময় চরসিন্দুর স্কুলে পড়াশোনা করলেও তৎসময়ের বহু স্মৃতি অজান্তেই মনে এসে ভিড় করে। হীরালাল স্যার ও বেলায়েত স্যারের স্নেহ-আদরের কথা খুবই মনে পড়ে। তাঁদের অমৃত শিক্ষাসুধা পানে আকণ্ঠ তৃপ্ত ছিলাম। বহু আগে একদিন হীরালাল স্যারের বাড়ি গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করে কদমবুচি করেছিলাম। তিনি তখন অবসরে, বয়সে ভারাক্রান্ত। যতটুকু জানি, ছাত্রছাত্রীদের মাঝে তিনি হয়ে ওঠেছিলেন স্বর্গীয় দেবতাসম। শুনেছি, হীরালাল স্যার মৃত্যুবরণ করলে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে স্যারের মরদেহের খাটিয়ার পেছন পেছন শ্মশান পর্যন্ত ছুটেছিলো। লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিলো।
এই মহাবিশ্ব ও মহাকালের বিশালতার তুলনায় একজন মানুষের যাপিত জীবনের ব্যাপ্তি নেহায়েত নগণ্য। যারা একবার চলে যায়, কোনোদিন আর ফিরে আসে না। তারপরও অনিত্য ও নশ্বর এ-পৃথিবীতে অনেক কিছু অবিনশ্বর হয়ে থাকে মানব মনে, সৃষ্টির আহ্বানে। তেমনি হয়ে থাকবে চরসিন্দুর এবং চরসিন্দুর হাই স্কুল, এই প্রত্যাশা রেখে শেষ করছি।
হিমালয়ের কৈলাশ পর্বতশৃঙ্গ থেকে বয়ে আসা বিপুল জলরাশির স্রোতধারা ব্রহ্মপুত্র। সেই আদিকাল থেকে বহু জনপদ আর বিচিত্র গতিপথ পেরিয়ে মহেশ্বরদীকে অবগাহিত করেছে এই নদ। জনপদকে করেছে সমৃদ্ধ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালের আগে পরগণায় বিভক্ত ছিলো বারো ভূঁইয়ার এই দেশ। বর্তমান নরসিংদী জেলার বৃহৎ অঞ্চল তখন পরিচিত ছিলো মহেশ্বরদী পরগণা হিসেবে। শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড় জুড়ে বিস্তৃত এই জনপদ। এর পশ্চিম পাড়ে ভাওয়াল পরগণা। লক্ষ্যার পাড়ের এই দুই জনপদ— মহেশ্বরদী আর ভাওয়াল, গলাগলি হয়ে, এক হয়ে থেকেছে বহুকাল; ব্রিটিশ, পাকিস্তানি আমল ও বাংলাদেশের প্রথমদিকে বৃহত্তর ঢাকা জেলায়।
এই অঞ্চলটিতে ব্রহ্মপুত্র যে কতো বিশাল নদ ছিলো, এখন আর তা বোঝার উপায় নেই। এই ঊনবিংশ শতাব্দীতেও এখানে এর অস্তিত্ব ছিলো প্রবল প্রতাপে। ছিলো যাতায়াত আর যোগাযোগের প্রধান নদীপথ। মাধবদী আর পাঁচদোনায় ছিলো এর বন্দর। পাঁচদোনার মানুষ ভাই গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৪-১৯১০) তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ পাশ ঘেঁষে প্রবাহিত। এই নদীই এখানকার জীবন। এর জলপথে চলাচল করে মানুষ। দূর কিংবা নিকটবর্তী নগরে। এই পথে পালতোলা কিংবা গুণটানা নৌকা হচ্ছে বাহন। আরো লিখেছেন, পাঁচদোনা থেকে ঐ-রকম নৌকায় চড়ে তিনি ও তাঁর পরিবারের লোকেরা ময়মনসিংহ ও ঢাকা যেতেন। সময় লাগতো অনেক।
ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী শীতলক্ষ্যা। টলটলে মিষ্টি জলের নদী। এর পাড়ের প্রবীণ লোকেরা বলেন, শীতলক্ষ্যাকে সাত পাঁকে প্যাঁচিয়ে বিয়ে করেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। সেই আদিকালে। নদ আর নদীর এই প্যাঁচের মধ্যেই মহেশ্বরদীর অবস্থান। এর প্রভাবে এই অঞ্চলের মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনযাপন গড়ে ওঠেছে ভিন্ন মাত্রা নিয়ে; এই দুই নদ-নদী ও এদের শাখা-প্রশাখাকে ঘিরে।
শীতলক্ষ্যার পাড়ে জন্ম কৃতী সাহিত্যিক হরিপদ দত্তের; ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতে। খাতাপত্রে জন্ম ১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে। সেই হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার ছয় মাস আগে। কিন্তু তিনি বলছেন, পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিলো দুই বছর। সুতরাং তাঁর জন্ম ১৯৪৫ সালে হতে পারে। সেই হিসেবে বর্তমানে তাঁর বয়স ৭৮ বছর।
শীতলক্ষ্যার পাড়ের যে-গ্রামে তাঁর জন্ম, তার নাম খানেপুর। ঐ-গ্রামের অনূঢ়া নৈস্বর্গিক প্রকৃতিতে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা বর্ধিষ্ণু জোতদার পরিবারে। নদীর পাড় জুড়ে বিশাল ভূ-সম্পত্তি, প্রতাপ-প্রতিপত্তিশীল দত্ত পরিবারে। বাবা শরৎ দত্ত ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের চাকুরে; পাকিস্তান হবার পর তাঁর অঞ্চলের ইউনিয়ন বোর্ডের সদস্য। আইয়ুব খানের সময় মৌলিক গণতন্ত্রী (বিডি) মেম্বার। বাবা-মা’র একমাত্র পুত্রসন্তান হিসেবে এবং বনেদি পারিবারিক ঐতিহ্যের সুবাদে তাঁর শৈশব কেটেছে আদরে ও স্বাচ্ছন্দ্যে, পার্শ্ববর্তী নিম্নবর্গের হিন্দু ও মুসলমান সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে মিলেমিশে। পড়াশোনা নদীর ওপাড়ের ভাওয়াল জামালপুর স্কুলে। তারপর ঢাকায়। জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯৬৪-৬৫ সালে আইয়ুব খানের শাসনামলে শিল্পায়ন শুরু হয় শীতলক্ষ্যার পাড় জুড়ে, নদীপথে যোগাযোগের সুবিধার কথা বলে। নদীর পাড়ে অনেকটা দূরে আগে থেকেই ছিলো দেশবন্ধু সুগার মিল, চিত্তরঞ্জন কটন মিল ও পাক জুট মিল। এবার দত্তদের গ্রাম (খানেপুর-কাঁঠালিয়াপাড়া) নির্দিষ্ট হলো সারকারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও ফৌজিদের জুট মিলের জন্যে। হিন্দু জনসংখ্যাপ্রধান এই এলাকার অধিবাসীরা হঠাৎ করেই সরকারি অধিগ্রহণের দ্বারা ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ হলেন। হয়ে পড়লেন উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী। দত্ত পরিবার তাঁদের ভূ-স্বামীর মর্যাদা হারালো। শিল্পায়নের নতুন আর্থ-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে বহুকালের আধিপত্যও হারালো। বাড়ি-ভিটা, জমি হারানোদের শতকরা ৯০ ভাগই ছিলো হিন্দু পরিবার। তারা যা কিছু ক্ষতিপূরণ (পুরো ক্ষতিপূরণ মেলেনি তাদের নানা মারপ্যাঁচে) পেলেন, তা নিয়ে নতুন আবাসের খোঁজে সীমান্ত পাড়ি দিলেন প্রায় সবাই। দত্তবাবুরা গেলেন না। তাদের কেউ কেউ গেলেন অনেকটা দেরিতে, বাংলাদেশ হওয়ার কিছুকাল পরে। কিন্তু হরিপদ দত্ত গেলেন না। তিনি একাই থেকে গেলেন বিদ্রোহী হয়ে। বললেন, জন্মভূমি ছেড়ে যাবো কোথায়?
বাবা শরৎ দত্ত ছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি একান্ত অনুগত একজন। তিনি ১৯৪৭-এ দেশভাগের সময় পাকিস্তানকেই নিজ বাসভূমি মেনে নিয়েছেন। চারপাশের অন্য হিন্দুদের বলেছেন, এটাই আমাদের দেশ। এখানেই আমাদের পূর্বপুরুষের সবকিছু। এই জন্মভূমি ছেড়ে যাবো কোন দুঃখে? জাতপাত-ধর্ম নির্বিশেষে জনপ্রিয় সেই ঋজু মনের জনসেবক ভূ-সম্পত্তি, প্রতিপত্তি হারিয়েও পাকিস্তান ছাড়লেন না। বৃদ্ধ বয়সে বাংলাদেশ আমলে দেশ ছাড়লেন পরিবারের অন্যদের নিয়ে। বলা যায়, অনেকটা বাধ্য হয়েই। বয়োবৃদ্ধ বাবা-মা একমাত্র পুত্রকে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু হরিপদ দত্ত তো যাবেনই না। বিদায় বেলায় তাঁরা তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “সাবধানে থাকিস বাবা। ভালো থাকিস।”
হরিপদ দত্তের মানস সরোবরে ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’। রামায়ণে রাম যেমন ছোটো ভাই লক্ষণকে বলেছিলেন, “হে লক্ষণ, এমনকি এই স্বর্ণময় লঙ্কাও আমাকে আকৃষ্ট করে না। জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেয়।” এই আকুতি অনবরত প্রকাশ পেয়েছে তাঁর লেখায়, কথায় ও মিথস্ক্রিয়ায়। স্বপ্ন দেখেছেন শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন, জাতপাত, ধর্ম আর উঁচু-নিচুর ব্যবধানহীন মাতৃভূমির। সেই স্বপ্ন অনবরত ভেঙে চুরমার হয়েছে। এসবেরই প্রকাশ ঘটেছে তাঁর লেখালেখিতে।
লেখালেখির শুরু হয়েছিলো সেই স্কুলজীবন থেকেই। ঝোঁক ছিলো শিল্প-সাহিত্যের প্রতি। এমনটা প্রবাহমান থেকেছে জীবনভর। জীবিকার জন্যে অনেক পেশার ডালপালায় ভর করেছেন তিনি। শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘকাল। তবে এক জায়গায় নয়, বহু জায়গায়। উচ্চ বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও ফাজিল মাদরাসায়। ঝোঁকের বশে ডলার কামাতে উত্তর আমেরিকার দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় গিয়ে কায়িক শ্রমের জীবন চেখে দেখেছেন। কিন্তু কোনো অবস্থায়ই লেখালেখি ছাড়েননি। অনবরত লিখেছেন। এখনো লিখছেন। তাঁর ভাষায় ‘লেখাকে ভালোবেসে জীবনে বঞ্চিত হয়েছেন অনেক কিছু থেকে’।
১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘কত আঁখি জল’। ছাত্র থাকা অবস্থায়। তারপর থেকে ক্রমাগত অসংখ্য উপন্যাস, গল্পগ্রন্থ, প্রবন্ধ সাহিত্য, শিশু-কিশোর সাহিত্য যেন দুই হাতে লিখে গেছেন। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অসংখ্য বই, বহু প্রকাশনী থেকে। থামেননি একদম। তাঁর লেখার স্টাইল ও গভীরতা অনন্য মাত্রার। অন্য অনেকের চেয়েই ভিন্ন। তাঁর উপন্যাসের পটভূমি ও বিষয়বস্তু গতানুগতিক নয়। অপরূপ বর্ণনাশ্রয়ী, সুদক্ষ শব্দ কারিগরের অবাক করা বিশ্লেষণে ভরপুর। যেমনটা খুব কম লেখকের লেখায়ই দেখা মেলে।
নিঃসন্দেহে তিনি এই কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও শিশু-কিশোর সাহিত্যিক। শিশু-কিশোরদের জন্যে তাঁর লেখা ‘পাখি ও পতঙ্গরা যখন মানুষ ছিল’, ‘মায়ের কাছে ফেরা’ এককথায় অনবদ্য রচনা। উপন্যাস ‘জাতিস্মরের জন্মজন্মান্তর’, ‘চার পৃথিবীর মানুষ’, ‘মোহাজের’, ‘অন্ধকূপে জন্মোৎসব’, ‘চিম্বুক পাহাড়ের জাতক’, ‘দ্রাবিড় গ্রাম’ ইত্যাদি কালজয়ী রচনা।
প্রথম জীবনে সপরিবারে, পুরো গ্রামের আপনজনসহ বাড়ি-ভিটা থেকে উচ্ছেদ হওয়ার দুঃস্বপ্ন তাঁকে পরবর্তী জীবন জুড়ে যেন তাড়া করেছে। স্মৃতিপটে এঁটে থেকেছে। এরই প্রতিবিম্ব দেখা যায় তাঁর ‘শেকড়ছেঁড়া মানুষেরা’ উপন্যাসে। তিনি অন্যত্র লিখছেন, “আমার বাড়ি নেই, কিন্তু টিকে আছে আমার জন্ম গ্রামের অবশেষ অংশ। ওখানে আমি আজ অচেনা আগন্তুক।” আবার কোথাও নিজেকে ভেবেছেন ‘জন্ম উদ্বাস্তু’।
জীবনভর লড়াকু হরিপদ দত্তকেও একসময় হার মানতে হয়েছে। পড়ন্ত জীবন বেলায় তাঁকে মাতৃভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে হয়েছে। তাঁর অভিবাসন বিরোধী বিদ্রোহী মনকে বশ স্বীকার করতে হয়েছে জীবনের কঠিন বাস্তবতার কারণে। যেতে হয়েছে স্বজনদের আতিথেয়তায়। সীমান্তের ওপাড়ে।
নিজের জন্ম-সম্পর্ক নিয়ে অপূর্ব বর্ণনা রয়েছে তাঁর লেখায়। তিনি লিখছেন, “জাতিস্মরের চোখ দিয়ে আমি কল্পনা করতে পারি আমার জন্মগৃহ আর বিছানাকে। অন্ধকারাচ্ছন্ন সদ্য নির্মিত ছনের কাঁচা ক্ষুদ্রাকৃতি গুহাগৃহ। আলো-বাতাস অবরুদ্ধ ঘরের মেঝে সদ্য ফেলা লাল এঁটেল মাটির ফ্লোর। স্যাঁতস্যাঁতে। পাটশোলার বেড়ায় লেপে দেয়া গোবর-মাটির গন্ধ। আমার জন্মরক্ত জীর্ণ কাঁথা চুষে বাঁশের চাটাই ভেদ করে লাল মাটির ফ্লোর বেয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আমার জন্মরক্ত আর জন্মমাটিকে আলাদা করে কার সাধ্য?” কী অকাট্য বন্ধন! উল্লেখ্য, যে-সময় তাঁর জন্ম, সে-সময়টায় হিন্দু পরিবারে সন্তান প্রসব হতো তেমন অশুচি বা আঁতুড় ঘরে, যেমনটা তাঁর লেখায় উঠে এসেছে। যিনি সন্তান জন্ম দিচ্ছেন, সেই নারীকে ‘অশুচি’ গণ্য করে আলাদা ঐ-ঘরে নির্বাসিত করার এই ব্যবস্থাটি এখন আর নেই, আধুনিকতার ছোঁয়ায়।
হরিপদ দত্তের শেকড় গাড়া শীতলক্ষ্যার পাড়ের মহেশ্বরদীর পলাশের সেই খানেপুর গ্রামে, যেই গ্রাম আর আগের নৈস্বর্গিক রূপে নেই; কারখানার বিষাক্ত বাষ্পে নষ্ট পরিবেশ ও প্রতিবেশের এক ভিন্নতর জনপদ এখন। কিন্তু তাঁর স্মৃতিতে-মননে এখনো সেই অনূঢ়া প্রাকৃতিক স্বর্গ, যেখানে মানুষ আর পাখ-পাখালি, শিমুল আর পলাশ ফুলের রক্তিম রঙে নববধূর সাজে সেজে থাকে পুরোটা অঞ্চল। বিলগুলো ভরে থাকে পদ্ম আর শাপলায়। যেখানে শীতলক্ষ্যার জল মানস সরোবরের জলের মতো নির্মল। বয়ে চলে সদা কলকল রবে। দুই পাড়ের মানুষের জন্যে যে-নদীর রয়েছে অকৃপণ মাতৃস্নেহভরা অবদান। কবি বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, “শীতলক্ষ্যা তীরে গিয়েছিনু লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে। …যাব নাক সেথা আর, যদিও লক্ষ্মীপূর্ণিমা রাত ফিরিবে পুনর্বার।” এমন অভিমান করার একশো একটা কারণ থাকলেও হরিপদ দত্ত বারবার এই নদীর কথায় ফিরে এসেছেন। লিখেছেন, “আমি শীতলক্ষ্যার কাছে বারবার ফিরে যাই। এই নদীর জলেই মিশে আছে আমার হাজার বছরের পূর্বপুরুষের চিতাভস্ম।” তিনি লিখেছেন, “শীতলক্ষ্যা আমার জন্ম ঠিকানা।” একসময় একে নিয়ে লিখেছেন অনবদ্য এক উপন্যাস— ‘শীতলক্ষ্যা’।
হরিপদ দত্ত এই জনপদের গণমানুষের জাতীয় আকাঙ্ক্ষার লড়াই-সংগ্রামের জোয়ার-ভাটায় অবগাহন করেছেন। দেখেছেন, কী মহিমান্বিত চরিত্রবলে তাঁর এলাকার মানুষ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। দেখেছেন, কী উচ্চাশা নিয়ে এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন একাত্তরে। তিনি দেখেছেন, তাঁর এলাকায় একজনও রাজাকার হয়নি, মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন অনেকেই। অবশেষে তিনি এমনটাও প্রত্যক্ষ করে ভারাক্রান্ত হয়েছেন যে, মানুষের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তাঁর ভাষায়, “১৯৭১ সালে পৃথক দেশ গড়া হলো। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য তৈরি হলো না। সেভাবে দেশ গড়ে ওঠলো না। চীনে যেমন বিপ্লবের পর মানুষের মধ্যে একটা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এসেছিল, তেমনটা হলো না। ভেতর থেকে পাকিস্তানই রয়ে গেল। ধর্মের প্রশ্নে পাকিস্তান হয়েছিল, গণতন্ত্রের প্রশ্নে বাংলাদেশ হলো। কিন্তু সেই গণতন্ত্রের বাংলাদেশ হলো না।” আক্ষেপ করে বলছেন, “দেশ না, মানুষ ভাগ হয়ে গেল।” তিনি এর ব্যাখ্যায় বলছেন, “শ্রেণি-বৈষম্য, ধন-বৈষম্য, বর্ণপ্রথা আর ধর্মের দৈত্য বিভাজন তৈরি করেছে।” তিনি এ-ও দেখছেন যে, এখানকার শিল্প-সংস্কৃতি এখন ক্রমশ জড়তা আর ভীরুতায় নিমজ্জিত হচ্ছে। শিল্পীদের গ্রাস করছে এসব। জীবন ঘষে আগুন জ্বালাবার শক্তি লোপ পাচ্ছে যেন তাদের।
জীবনভর লড়াকু হরিপদ দত্তকেও একসময় হার মানতে হয়েছে। পড়ন্ত জীবন বেলায় তাঁকে মাতৃভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে হয়েছে। তাঁর অভিবাসন বিরোধী বিদ্রোহী মনকে বশ স্বীকার করতে হয়েছে জীবনের কঠিন বাস্তবতার কারণে। যেতে হয়েছে স্বজনদের আতিথেয়তায়। সীমান্তের ওপাড়ে। প্রায় এক যুগের সেই অভিবাসী জীবন কাটিয়ে এবার তিনি এসেছিলেন শেকড়ের তীব্র টানে। ফিরে গিয়েছিলেন সেই শীতলক্ষ্যার পাড়ে। লোকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, কেন ছেড়ে গেলেন? জবাবে তিনি বলেন, ছেড়েছি স্বজনদের চাপে বাধ্য হয়ে। বয়স ও স্বাস্থ্যগত সীমাবদ্ধতায়। একটি পত্রিকার সাথে সাক্ষাতকারে তিনি এ-কথাও বলেছেন যে, “লেখক হিসেবে দেশ ছাড়া আমার উচিত হয়নি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল দেশ ছেড়ে যাওয়া।”
এখন তিনি পশ্চিম বাংলায় থাকেন স্বজনদের সাথে। তিনি সেখানে নিজেকে উদ্বাস্তু মনে করেন। তাঁর মন পড়ে থাকে এখানে; মাতৃভূমিতে। তাঁর সাহিত্যিক মন পাখির মতো উড়ে বেড়ায় এর প্রান্তরে, গ্রাম-গ্রামান্তরে। তিনি বলেন, “আমার সাহিত্য সাধনা নিবেদিত আমার জন্মভূমির জন্য, জন্মের ঋণমুক্তির জন্য। আমার জন্মের দায় বাংলাদেশের, বিশ্বের অন্য কোনো দেশের জন্য নয়। তাই যা লিখেছি, যা লিখছি ও যা লিখবো, সবই বাংলাদেশের জন্য।”
ভীষণ আত্মপ্রচারবিমুখ ও একান্ত নিভৃতচারী এই সাহিত্যিকের যতোসব সৃষ্টি, সেগুলো ততোটা প্রচার পায়নি, যতোটা পাওয়া উচিত ছিলো। তাঁর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে বোদ্ধামহলে স্বীকৃতি মিলেছে বরাবরই। বাংলাদেশের প্রধান কবি, বাংলাদেশের হৃদয়ের কবি, নরসিংদীর মেঘনা পাড়ের মানুষ শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা ‘তিনজন যুবকের গর্জে ওঠা’ হরিপদ দত্তকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর সৃষ্টিকর্মের স্বীকৃতি দিয়ে। তবে সাধারণত যেভাবে তাঁর পরিচিতি ও খ্যাতি শাখা-প্রশাখা মেলার কথা ছিলো, তেমনটা যথাসময়ে হয়েছে, এই কথা বলা যাবে না। এর আরো বিস্তৃতি-লাভ উচিত ছিলো। তবে তেমনটা না হলেও জাতীয় পর্যায়ে তাঁর স্বীকৃতি মিলেছে বেশ আগেই। বাংলা একাডেমি তাঁকে পুরস্কৃত করেছে দুই দুইবার। প্রথমবার ২০০১ সালে সা’দত আলি আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার দিয়ে। পরে ২০০৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান তিনি।
হরিপদ দত্তের সাহিত্যকর্মের উপর এখন গবেষণা হচ্ছে। পিএইচডি করছেন কেউ কেউ। তরুণ প্রজন্মের কাছে আবেদন সৃষ্টি করছে তাঁর ভিন্নতর সৃজনশীল বিষয়গুলো। এর উপর ভর করে নিশ্চিন্তে বলা যায়, তাঁর সাহিত্যকর্ম কালোত্তীর্ণ হয়ে বাংলা সাহিত্যের ভুবনে বিরাজ করবে উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে। তবে তিনি তো এখনো লিখছেন। তাঁর সেইসব লেখাও ক্রমান্বয়ে যোগ হবে এই গ্যালাক্সিতে। আর এর মাঝেই অমরত্ব পাবেন মহেশ্বরদীর এই কৃতী সাহিত্যিক।
আদিয়াবাদ ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ রায়পুরা উপজেলার একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নৈসর্গিক দৃশ্যের অপরূপ রূপে সুশোভিত স্কুলটি আড়িয়াল খাঁ নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জ্ঞানের মশাল জ্বেলে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে শতবর্ষেরও অধিক সময় ধরে। আদিয়াবাদের সোনালি শিক্ষার বিস্তারে স্কুলটির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে আদিয়াবাদের মুসলিম কৃষকগণ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এদিকে মেধাবী ছাত্র আফসার উদ্দিন (বর্তমান সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু’র পিতা) পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় তাঁর মামা উমেদ আলী মুন্সি ভাগ্নেকে উচ্চ শিক্ষিত করার জন্যে স্থানীয় সচ্ছল কৃষকদের দ্বারস্থ হন। বৃটিশ আমলে তৎকালীন আদিয়াবাদ ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট জহির উদ্দিন মুন্সির প্রত্যক্ষ উদ্যোগে স্কুলটি যাত্রা শুরু করে ১৯১২ সাল হতে। ময়েজ উদ্দিন মোল্লা, মানিক সরকার, রওশন আলী মীর, ইয়াছিন আলী সরকার, জাফর আলী সরকার, হাড়াই প্রধান, কালাই শিকদারসহ আরো অনেকে স্কুল প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন।
প্রাথমিক অবস্থায় বাঁশের খুঁটি ও ছনের ছাউনি দিয়ে মক্তবে পাঠদানের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রথমবারের মতো ১৯১৭ সালে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেই অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে। প্রাথমিক অবস্থায় প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন বাবু শ্রী নলিনী কান্ত ঘোষ। প্রথমদিকে স্কুলের জন্যে ছাত্র-ছাত্রী সংগ্রহ করা হতো আশারামপুর, হাইরমারা, নিলক্ষ্যা, মনিপুর, চরসুবুদ্ধি, হাসনাবাদ, হাঁটুভাঙ্গা, বালুয়াকান্দি, পুটিয়া, সিরাজনগর, রাধাগঞ্জ, খৈনকুট, সৃষ্টিগড়, গোবিন্দপুরসহ আশেপাশের এলাকা হতে। কর্দমাক্ত কাঁচা রাস্তা ধরে স্কুলে আসতো শিক্ষার্থীরা।
১৯৬৫ সালে এলাকাবাসীর প্রচেষ্টায় স্কুলে পাকা দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়। এর দু’বছর পরই ১৯৬৭ সালে এ-প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জয়নাল আবেদিন ভূঁইয়া ও খোরশেদ আলম নামে দু’জন ছাত্র দ্বিতীয় গ্রেডে বৃত্তি লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধের বছরও তিনজন ছাত্র বৃত্তি লাভ করে। ছেষট্টির ছয়দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন জনাব খন্দকার আবু হান্নান। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্কুলটি একবার বন্ধ হয়ে যায় এবং কয়েক মাস পর আবার কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে অর্থাভাবে আবারো বন্ধ হয়ে যায় এবং পুনরায় সক্রিয় হয় সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু’র হস্তক্ষেপে, যিনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্কুলের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
১৯৯৫ সাল হতে কলেজ শাখা চালু করা হয়। তৎকালীন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এ.এস.এইচ.কে সাদেক এই কলেজ পরিদর্শনে এসে স্কুলের পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হন এবং ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত করেন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে জাতীয়করণ করে নেয়।
‘মালঞ্চ’ নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। সম্পাদক ছিলেন বিজ্ঞান শিক্ষক জনাব আবদুল কবির। পরবর্তী বছর ‘কল্পতরু’ নামে আরেকটি ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় তৎকালীন ছাত্র জয়নাল আবেদীনের সম্পাদনায়, যিনি কর্মজীবনে রাজউকের চেয়ারম্যান ছিলেন। কিন্তু ম্যাগাজিন দুটোর কোনো কপির সন্ধান পাওয়া যায়নি। ১৯৭৫ সালে বাংলার শিক্ষক মো. আবদুল হকের সম্পাদনায় ‘সৈকত’ এবং ১৯৯৯ সালে বাংলার শিক্ষক বেলায়েত হোসেনের সম্পাদনায় ‘অন্বেষা’ নামে ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। ২০১৬ সালে বর্তমান অধ্যক্ষ মো. নূর সাখাওয়াত হোসেন মিয়ার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘কলরব’। ২০১৭ সাল হতে কলেজ শাখা থেকে ‘স্মৃতির পাতায়’ ও স্কুল শাখা থেকে ‘বন্ধন’ নামে প্রতিবছর ধারাবাহিক সিরিজ ম্যাগাজিন প্রকাশিত হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটিতে পিঠা উৎসব, বৈশাখী মেলা, বিজ্ঞান মেলা, কৃষি মেলা, শিক্ষা উপকরণ মেলা, সাংস্কৃতিক সপ্তাহ পালন, সাপ্তাহিক সাংস্কৃতিক ক্লাশ, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কুইজ, চিত্রাঙ্কন, বৃক্ষরোপণ, ল্যাংগুয়েজ ক্লাবসহ অন্যান্য কার্যক্রম বিদ্যমান রয়েছে। প্রায় ৬৫ প্রজাতির গাছপালা ও ফুল রয়েছে স্কুলটিতে।
স্কুলের বর্তমান গভর্নিং বডির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন মিসেস কল্পনা রাজিউদ্দিন। সুদীর্ঘ ১৮ বছর ধরে অধ্যক্ষ হিসেবে আছেন মো. নূর সাখাওয়াত হোসেন মিয়া। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে সব মিলিয়ে ৫০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন। স্কুল শাখায় ১,১৫০ জন শিক্ষার্থীর পাশাপাশি কলেজ শাখায় প্রায় ৪০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।
এই প্রতিষ্ঠানটি দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের পদচারণায় ঋদ্ধ হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ও সমরেশ মজুমদার অন্যতম। কবি ও সাংবাদিক আজিজুল হাকিম এই স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন। এই স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক আবু সায়ীদ ছেরাজুদ্দাহার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে (সম্ভবত ১৯৪০ সালে) তাঁকে উদ্দেশ্য করে চার পঙক্তির একটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন, যেটি রবীন্দ্রভবন মহাফেজখানায় সংরক্ষিত আছে। (সূত্র : ড. মনিরুজ্জামান) বিষয়টি এই স্কুলের জন্যে অত্যন্ত গৌরবের।
বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির অকৃত্রিম অনুষঙ্গ ‘গাজীর পট’-এর গায়েন দুর্জন আলী, মৃত্যুবরণ করেন ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি। এ-বছর তাঁর মৃত্যুর ৮ বছর পূর্ণ হলো। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই মহান শিল্পী তাঁর কাজে পূর্ণ সক্রিয় ছিলেন। ছোটোখাটো দোহারা গড়নের এই মানুষটি খুবই বড়ো মনের ছিলেন। পেশা ছিলো বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাতা মেরামত করা। থাকতেন নরসিংদীর হাজীপুরে, এক জীর্ণ কুটিরে। সাথে থাকতেন তাঁর ছোটো ভাই আরেক কিংবদন্তী গায়েন কোনাই মিয়ার পুত্র ফজল মিয়া ও তাঁর পরিবার। জীর্ণাবস্থায়, দরিদ্রাবস্থায় দিনাতিপাত করেও এই শিল্পী মানুষটি তাঁর মনের ভিতরে অফুরান প্রেম ও মানবিকতার রসের ধারা বহমান রেখে চলতেন। ২০১৫ সালে, যখন তাঁর সাথে প্রথম সাক্ষাত ঘটে, তখনই পেয়েছিলাম এই শিল্পীমনের পরিচয়।
লোকশিল্প গবেষক তোফায়েল আহমদ কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামে ‘গাজীর পট’ দেখতে যান। আশুতোষ মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ দাবি করে, দুই বাংলার এই একটি গাজীর পটই অবশিষ্ট আছে। গবেষক তোফায়েল আহমদ এই তথ্য মেনে নিতে পারেননি। দেশে ফিরে খুঁজতে থাকলেন পটচিত্রী আর পট পরিবেশনা সম্প্রদায়। সারাদেশের পটচিত্রের ইতিবৃত্ত খুঁজতে গিয়ে লোকসংস্কৃতি গবেষক তোফায়েল আহমদ এবং তাঁর দলের সঙ্গী সমাজকর্মী হামিদা হোসেন, শিল্পী কালিদাস কর্মকার নরসিংদীর হাজীপুর গ্রামের বেদেপাড়ায় খুঁজে পান পটকুশীলব দুর্জন আলী এবং কোনাই মিয়াকে। এসব ঘটনা সেই সত্তর দশকের। তাঁদের সূত্র থেকেই ১৯৮০ সালে খুঁজে পাওয়া যায় মুন্সিগঞ্জের কমলাঘাটের কাঠপট্টির কালিন্দীপাড়ায় পটচিত্রী সুধীর আচার্য এবং তাঁর ছেলে শম্ভু আচার্যকে। দুর্জন আলীর কাছে যে-পটচিত্রটি দেখতে পেয়েছিলাম, তা শম্ভু আচার্যের আঁকা। বর্তমানে এই চিত্রটি গায়েন ফজল মিয়া ও তাঁর দল ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশে হাতেগোনা যে-ক’জন গাজীর পটশিল্পী ছিলেন, দুর্জন আলী ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অনেকে মনে করেন, তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গাজীর পটের শেষ সূর্যটি অস্তমিত হয়েছে।
দুর্জন আলীর জন্ম ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর ভাই কোনাই মিয়াও ছিলেন পটকুশীলব। দুর্জন আলী এবং কোনাই মিয়ার বাবা আনোয়ার আলী। কয়েক পুরুষ যাবত তাঁরা নরসিংদীর হাড়িধোয়া-মেঘনা নদীর তীরে হাজীপুর গ্রামের বেদেপাড়ায় বসবাসরত। তাঁদের পূর্বপুরুষের আবাসস্থল ছিলো বৃহত্তর কুমিল্লার রামচন্দ্রপুরের দুলালপুর গ্রাম। দুর্জন আলী ও কোনাই মিয়ার ওস্তাদ কুমিল্লার জাফরগঞ্জের আবদুল হামিদ। কোনাই মিয়া অনেক আগেই প্রয়াত হয়েছেন। তাঁদের পূর্বপুরুষ ছিলেন বেদে সম্প্রদায়ের। দুর্জন আলী কখনো ছাতা সেলাইয়ের কাজ করতেন, কখনো সবজি বিক্রি করতেন, কখনো করতেন মুটে-মজুরের কাজ। দুর্জন আলী ছিলেন নিঃসন্তান।
দুর্জন আলীর সৌভাগ্য হয়েছিলো, ১৯৯৯ সালে ব্রিটেনে ‘বাংলাদেশ উৎসব’-এ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে গাজীর পটের গায়েন হিসেবে যোগদান করার।
ফজল মিয়া ও তাঁর দল
দুর্জন আলীর মৃত্যুর সাথে সাথে এ-অঞ্চল থেকে একটা যুগের অবসান হয়ে গিয়েছিলো, এরকম ধারণা ছিলো আমাদের। কিন্তু সম্প্রতি দুর্জন আলীর ভাতিজা ফজল মিয়ার ‘গাজীর পট’ নিয়ে নতুন দল গড়ার কথা জেনে নতুন আশার সঞ্চার হলো। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে নরসিংদী পৌর পার্কে নরসিংদী জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘গাজীর পট আসর’ দেখে পরদিন চলে গেলাম তাঁর বাড়ি হাজীপুরে। নয় বছর পর সেই একই ঘর, একই পরিবেশ দেখে স্মৃতিকাতর হলাম। ফজল মিয়াকে অভিনন্দন জানালাম মহান শিল্পী দুর্জন আলীর এই কীর্তি ধরে রাখার জন্যে।
গাজীর পটের গায়েন ফজল মিয়া
ফজল মিয়ার ছেলে দুটো এখন বড়ো হয়েছে। তবে ততোটা বড়ো নয়। কিশোর বলা যায়। তাদের নিয়েই সে গঠন করেছে তাঁর গাজীর গীতের দল। তাঁর দলের সদস্যরা হলেন : বড়ো ছেলে মো. আবদুল্লাহ, ছোটো ছেলে মো. হাবিবুল্লাহ ও করতাল বাদক মো. আঙ্গুর মিয়া।
ফজল মিয়ার কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা ছিলো, কেন এখনো ধরে রেখেছেন এই শিল্পটি…? তিনি বলেন, “ভালো লাগে, মনে আনন্দ পাই, সেজন্যই এই গান করি।” এই বাক্য শুনে সহসা মনে পড়ে গিয়েছিলো নয় বছর আগের দুর্জন আলীর কাছে শোনা একই অমোঘ বাক্য, “সুখ আসে মনে, জ্ঞান পাওয়া যায়, এই জন্যই গাই।” একজন প্রকৃত শিল্পীর যথাযথ উপলব্ধি!
ফজল মিয়া আরো জানান, “বাপ-দাদারা এই গান কইরা গেছেন। তাঁদের স্মৃতিকে ধইরা রাখতে হইবো। এটা আমাদের সম্পদ। আমি যতোদিন বাঁইচা থাকমু, এই গান করমু। আমার মৃত্যুর পর আমার পোলারা করবো, যদি তারা চায়।”
ফজল মিয়া আলাপে আরো জানান, তিনি তাঁর পুরোনো পেশা ছাতা মেরামতের পাশাপাশি এখন গাজীর গীতকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। এখন নানা স্থান থেকে তাঁর ডাক আসে গান গাওয়ার জন্যে। গত এক-দেড় বছরের মধ্যে তিনি সোনারগাঁ, ময়মনসিংহ, ঢাকা ইত্যাদি জায়গায় গান করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়, শিশু একাডেমি মিলনায়তনে সম্প্রতি গাজীর গীত পরিবেশনের খবর তিনি জানান।
মহান শিল্পী দুর্জন আলীর স্মৃতি জাগরূক রাখতে ফজল মিয়া ও তাঁর দল বাংলাদেশের এই লোকপরম্পরার গীতধারাটিকে আর নরসিংদীর এই স্থানীয় সম্পদকে সবসময়ই ঊর্ধ্বে তুলে ধরবেন, পাশাপাশি আরো অনেকের মাঝে ছড়িয়ে দেবেন, এই প্রত্যাশা রেখেই নরসিংদীর হাজীপুরের পশ্চিমপাড়া তালতলার মাঠের পাশে তাঁর কুটির থেকে আমরা বেরিয়ে আসি।
নরসিংদী অঞ্চলকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে নরসিংদী নগরের রূপকার তৎকালীন সাটিরপাড়ার জমিদারি তালুকদার ললিতমোহন রায় তাঁর বাবার নামে ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউট’ ইংরেজি বিদ্যালয়। ফলে এই অঞ্চলে শিক্ষার যে-দ্বার উন্মোচন হয়েছিলো, তার ঠিক দুই বছর পর রায়পুরায় প্রতিষ্ঠা পায় আরেকটি ইংরেজি বিদ্যালয়, যার নাম ‘রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউট’ (বর্তমান নাম রায়পুরা রাজকিশোর রাধামোহন উচ্চ বিদ্যালয়)। ১৯০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি শুরু থেকেই আলোড়ন তুলেছিলো এন্ট্রান্স পরীক্ষার সাফল্যে। সমসময়ে গড়ে ওঠা সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউট এবং রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউট— বিদ্যালয় দুটি নরসিংদী অঞ্চলে শিক্ষার যে-নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলো এবং এখনো যে-আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে, তা নরসিংদীর ইতিহাস-ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
নরসিংদীর বরেণ্য লেখক ও গবেষকেরা নরসিংদীর ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে বহু তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা গ্রন্থ কিংবা নিবন্ধ লিখেছেন। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এবং আমি অত্যন্ত অবাক হয়েছি এই কারণে যে, সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থের লেখা ‘মহেশ্বরদীর ইতিহাস’সহ ইতিহাসের অন্যান্য গ্রন্থ ও গবেষণায় সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউটের সাথে আরো স্বনামধন্য শতবর্ষী বিদ্যালয়ের নাম-ইতিহাস থাকলেও রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউট সম্পর্কে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। হয়তো সঠিক তথ্যের অভাব কিংবা নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সেটি হয়ে ওঠেনি। কিন্তু রায়পুরার তাত্তাকান্দা গ্রামের ঐতিহ্যবাহী চৌধুরী বাড়ির জমিদার শ্রী রাজকিশোর পাল চৌধুরী এবং হাসিমপুর গ্রামের চৌধুরী বাড়ির জমিদার শ্রী রাধামোহন পাল চৌধুরী দুজনের নামের প্রথম অংশ নিয়ে ‘রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউট’ নামে এ-মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি রায়পুরার কুড়েরপাড় নামক স্থানে প্রতিষ্ঠা করেন। সংক্ষেপে একে ‘আর কে আর এম’ বলা হয়ে থাকে। বিদ্যালয়টির প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী নলিনী ঘোষ। তাঁর বাড়ি ছিলো কলকাতায়। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ।
উল্লেখ্য যে, রায়পুরারই আরেক শতবর্ষী শিক্ষালয় আদিয়াবাদ ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সিনিয়র শিক্ষক আমার নানা মরহুম মৌলভী আমির উদ্দিন আহমেদ নরসিংদী অঞ্চলের সর্বপ্রথম মুসলমান ছাত্র হিসেবে এন্ট্রান্স পাশের গৌরব অর্জন করেছিলেন কলকাতা মাদরাসা থেকে। একটি ডায়েরিতে তাঁর কিছু ছাত্রের মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার রেজাল্ট ও সন-তারিখ লেখা ছিলো। সেখান থেকেই এসব ক্ষেত্রে আমার আগ্রহ তৈরি হয়। তৎসময়কার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছাত্রদের তথ্য, বিদ্যালয়ের ইতিহাস জানার চেষ্টা থেকে আমি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে থাকি। তারই ধারাবাহিকতায় রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউটের এন্ট্রান্স ও মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার ফলাফল বের করি, যা ছিলো খুবই দুঃসাধ্য ও কঠিন একটি কাজ। আর এই কাজে আমি দিক-নির্দেশনা পেয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের অস্টিন পি স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান মানিকের নিকট থেকে, যিনি এসব বিষয়ে বিশদ গবেষণা করছেন।
রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউটের এন্ট্রান্স ও মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তখনকার সময় বিদ্যালয়টি কতোটা স্বনামধন্য ছিলো। এমনকি সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউটের সাথে যেন এক ধরনের অঘোষিত প্রতিযোগিতা ছিলো। এ-পর্যায়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯০৭-১৯০৯ সালের এন্ট্রান্স পরীক্ষা এবং ১৯১০-১৯১৩ ও ১৯১৫-১৯২০ সালের মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় রাজকিশোর রাধামোহন ইনস্টিটিউটের সাফল্যের স্বরূপ তুলে ধরবো।
এন্ট্রান্স পরীক্ষা, ১৯০৭
দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : রজনী কান্ত দত্ত (১৯ বছর ১ মাস) এবং তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : অভয়চরণ ভট্টাচার্য (১৯ বছর ৫ মাস)।
এন্ট্রান্স পরীক্ষা, ১৯০৮
দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ৩ জন : কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য (১৯ বছর ৭ মাস), অম্বিকাচরণ (১৬ বছর ৬) ও উপেন্দ্র নারায়ণ কারকুন (১৮ বছর ১ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : দীনেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য (১৭ বছর ৯ মাস)।
এন্ট্রান্স পরীক্ষা, ১৯০৯
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ২ জন : ক্ষিতিশ চন্দ্র ভট্টাচার্য (১৬ বছর ৮ মাস) ও যোগেন্দ্র চন্দ্র নাথ (১৭ বছর ১০ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ২ জন : পূর্ণচন্দ্র দত্ত (১৯ বছর ২ মাস) ও নবদ্বীপ চন্দ্র সাহা (১৬ বছর ১০ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১০
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ১ জন : নরেন্দ্রচন্দ্র দাস (১৭ বছর ১১ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : আলা উদ্দিন ভূঁইয়া (১৮ বছর ৪ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : নাছির উদ্দিন (১৯ বছর ২ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১১
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ২ জন : রাজমোহন দাস (১৬ বছর ৮ মাস) ও গঙ্গাচরণ সাহা (১৮ বছর ২ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : তমিজাদ্দিন (২০ বছর ২ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : অখিল চন্দ্র পাল (১৮ বছর ১০ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১২
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ১ জন : চন্দ্র কিশোর দে (২০ বছর ৮ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ২ জন : নূরাহাদ ভূঁইয়া (১৮ বছর ২ মাস) ও মথুচন্দ্র পাল (২০ বছর)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : আব্দুল গাফফার (২১ বছর ১০ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১৩
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ৬ জন : আব্দুল হাকিম (১৬ বছর ১১ মাস), আব্দুল মজিদ (১৮ বছর), মনমোহন ভট্টাচার্য (১৯ বছর ৯ মাস), নকুল চন্দ্র দাস (১৮ বছর ৮ মাস), ভুপেন্দ্র চন্দ্র কুমার রায় (১৬ বছর ৮ মাস) ও অক্ষয় কুমার রায় (১৬ বছর ৮ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ৬ জন : আব্দুল গাফফার (২১ বছর ২ মাস), আব্দুল গণি (১৭ বছর ৩ মাস), মদন মোহন ভট্টাচার্য (২১), জনাব আলী (১৯ বছর ২ মাস), অধর চন্দ্র পাল (১৮ বছর ১১ মাস) ও পূর্ণ চন্দ্র পাল (১৮ বছর ৪ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১৫
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ১ জন : তায়েব উদ্দিন (১৬ বছর ২ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : শামসুল হক (১৭ বছর ২ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১৬
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ২ জন : রাজেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী (১৭ বছর ৪ মাস) ও হরেন্দ্র লাল পাল (১৭ বছর ৫ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : গঙ্গা চন্দ্র বিশ্বাস (২১ বছর ৫ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১৭
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ২ জন : আহম্মেদ আলী (১৭ বছর ৪ মাস) ও সুরেশ চন্দ্র দাস (১৭ বছর ৫ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ৩ জন : আব্দুর রহমান মিয়া (২৩ বছর ৭ মাস), সুরেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী (১৮ বছর ৯ মাস) ও উপেন্দ্র কিশোর দত্ত (২২ বছর ১১ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ৩ জন : সচীন্দ্র লাল কর্মকার (১৭ বছর ১১ মাস), মোহাম্মদ জনাব আলী (১৬ বছর ৫ মাস) ও যতীন্দ্র কুমার রায় (১৯ বছর ১ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১৮
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ১ জন : মো. ইমদাদুল হক (১৮ বছর ১ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ২ জন : বশির উদ্দিন আহম্মেদ (১৯ বছর ৫ মাস) ও ইন্দ্র মোহন দাস (১৮ বছর ৪ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ১ জন : মনমোহন সাহা (১৮ বছর ২ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯১৯
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ৪ জন : ললিত কুমার দত্ত (২১ বছর ১ মাস), পরেশ চন্দ্র নাগ (১৭ বছর ২ মাস), সোনা মিয়া (১৬ বছর ১১ মাস) ও রজনীকান্ত তালুকদার (১৭ বছর ১০ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ১১ জন : আব্দুল গফুর ভূঁইয়া (২০ বছর ১ মাস), আব্দুর রহমান (১৭ বছর ৩ মাস), আব্দুস সোবহান (১৭ বছর ১১ মাস), হিরেন্দ্র কুমার দাস (২০ বছর ৩ মাস), অশ্বিনী কুমার গোস্বামী (২০ বছর ৪ মাস), জলধর কর্মকার (১৭ বছর), মুহাম্মদ সাহেব আলী (২০ বছর ৫ মাস), সুরেশ চন্দ্র পাল (১৭ বছর ৭ মাস), সুরেন্দ্র কুমার রায় (১৮ বছর ২ মাস), সফিউদ্দিন ভূঁইয়া (২০ বছর ১ মাস) ও ক্ষেত্র মোহন সাহা (২১ বছর ৭ মাস)।
মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, ১৯২০
প্রথম বিভাগে পাশ করেন ২ জন : হরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ (১৭ বছর ১০ মাস) ও ভরত চন্দ্র নাথ (১৮ বছর ১ মাস)। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন ৭ জন : আব্দুল আজিজ (১৮ বছর ১১ মাস), আব্দুল ওয়াহেদ (১৮ বছর ১০ মাস), ললিত মোহন দাস (২১ বছর ৫ মাস), অমর চন্দ্র পাল (২০ বছর ৪ মাস), অশ্বিনী কুমার রায় (১৯ বছর ১ মাস), নগেন্দ্র কুমার রায় (১৮ বছর ৪ মাস) ও অনন্ত কুমার শ্যাম (২২ বছর ৩ মাস)। তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন ২ জন : মুহাম্মদ নওয়াব আলী (১৭ বছর ২ মাস) ও মনিরউদ্দিন (১৮ বছর ৯ মাস)।
উল্লেখ্য যে, ১৯১০ সালে এই বিদ্যালয় থেকে প্রথম ২ জন মুসলমান ছাত্র মেট্রিকুলেশন পাশ করে। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর এলাকায় ব্যাপক সাড়া পড়ে এবং অতি অল্প সময়ে আশানুরূপ ফলাফলে দ্রুত শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পেতে থাকে। রায়পুরা ছাড়াও দেশের দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্রছাত্রী এসে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কারণে এক পর্যায়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের জন্যে আবাসিক বোর্ডিংয়ের ব্যবস্থা করেন এবং ১৯৬২ সালে স্থান সংকুলান না হওয়ায় কুড়েরপাড় থেকে তাত্তাকান্দায় মেঘনা নদীর শাখা কাঁকন নদীর তীরে পাগলনাথ মন্দিরের পাশে ৩ একর ৮১ শতাংশ জায়গায় গড়ে তোলেন বিদ্যালয়ের বর্তমান ক্যাম্পাস। ১২০ বছরের পুরোনো রায়পুরা রাজকিশোর রাধামোহন উচ্চ বিদ্যালয়টি সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে, এটাই কাম্য।
তথ্যসূত্র
১. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্যালেন্ডার (১৯০৮-১৯২৩) ও
২. কাঁকন, বিদ্যালয়ের এলামনাই এসোসিয়েশন কর্তৃক প্রকাশিত ম্যাগাজিন।
খন্দকার পারভেজ আহম্মদ (পিনু)
আহ্বায়ক, আমরা হাজীপুর ইউনিয়নবাসী
প্রিয় পাঠক, প্রত্নগবেষক ও লোকসাহিত্যিক মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠানের ভাটকবিদের নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার ফল তাঁর গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের ভাটকবি ও কবিতা’। এ-গ্রন্থ থেকে নরসিংদীর ভাটকবি মফিজ উদ্দিনকে নিয়ে এই লেখাটি প্রকাশ করা হলো। এই গ্রন্থের বিপুল পাঠ ও পরিচিতির স্বার্থে ও নরসিংদীর ঐতিহ্যপূর্ণ এক আখ্যানের সাথে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে আমাদের এ-উদ্যোগ।
‘কাব্য-কল্পলোকের সখি’র নাগাল পাবার একান্ত স্বপ্ন ও সাধনায় যিনি সমগ্র জীবন আত্মনিমগ্ন থেকেছেন, তিনি খ্যাতিমান ভাটকবি মফিজ উদ্দিন। তিনি সাবেক ঢাকা জেলার (বর্তমান নরসিংদী) শিবপুর থানার অন্তর্গত নোয়াদিয়া গ্রামে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পিতার নাম ইদ্রিছ আলী।
এই খ্যাতিমান কবি শতাধিক ক্ষুদ্র কবিতা পুস্তিকার রচয়িতা। তৎকালীন পাকিস্তানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদরূপে তিনি রচনা করেন ‘দর্জ্জালের সিংহাসন, অবশেষে পলায়ন’ (১৯৫৬)। পুস্তিকাটি তৎকালে বাজেয়াপ্ত হয় এবং এটি রচনা ও প্রকাশের জন্যে দেশদ্রোহিতার অপরাধে তাঁকে সপ্তাহকাল কারাভোগ করতে হয়। গ্রামের সাধারণ মানুষের জন্যে লেখা সুন্দর ও সহজবোধ্য কবিতায় তাঁর প্রতিবাদী রাজনৈতিক চেতনা প্রশংসনীয়।
: মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান, নরসিংদীর কবি সাহিত্যিক, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৪৯
পল্লীর শ্যামশোভায় বর্ধিত বালক মফিজ উদ্দিনের শৈশবেই সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটে অজস্র গ্রামীণ কবিতার মাধ্যমে। সেকালে গ্রামীণ জীবনের আকর্ষণীয় বিষয়ভিত্তিক দীর্ঘ কবিতা হাটে-বাজারে সুর করে আবৃত্তি হতো, স্বল্পমূল্যে দু-চার পয়সার কবিতার প্রচলন ছিলো। গ্রামের সাধারণ অর্ধশিক্ষিত যুবক-বৃদ্ধরা বাজার থেকে ফেরার পথে ঐসব কবিতা সাগ্রহে দু-চার পয়সা দিয়ে কিনে নিতো। মাঠে-ঘাটে রাখাল যুবকেরা এসব কবিতা সুর করে আবৃত্তি করতো। সে-যুগে মফিজ উদ্দিনের সাড়া জাগানো কবিতা বাজারে-বন্দরে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো।
কবির জীবন বৈচিত্র্যময়। মেট্রিক পাশ করে ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ড্রাইভার হিসেবে ট্রেনিং নিয়ে এক বছর এলাহাবাদে কাটান। পরে মর্দান থেকে সামরিক প্রশিক্ষণে নায়েক পদে উন্নীত হয়ে কবি সামরিক বাহিনির দায়িত্ব পালন উপলক্ষে বোলান, বসরা, বাগদাদ, কারবালা, কৃষ্ণা, ব্যবিলন, মুগল, মিশর, পোর্টসৈয়দ, ইতালি, ভেনিস প্রভৃতি বহু স্থানে গমন করেন। ১৯৪৮ সালে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করে দেশে ফিরে আসেন। অতঃপর তিনি আইয়ুবপুর ইউনিয়ন কাউন্সিলের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন একাধারে ছাব্বিশ বছর। তিনি ১৯৯৫ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের বরাদ্দকৃত কবি-সাহিত্যিকের সম্মানি বাবদ মাসিক পাঁচশত টাকা ভাতা লাভ করেছেন।
: শেখ ম. আ. খালিদ ও ডা. অছিউদ্দিন আহমেদ, নোয়াদিয়ার কবি মফিজ উদ্দিন, জাগরণ, নরসিংদী, ১৯৯৭
কবি তাঁর প্রকাশিত পুস্তিকাগুলোতে ‘মফিজ উদ্দিন মিঞা (প্রাক্তন সৈনিক)’ নামটি ব্যবহার করেছেন। তিনি কিছুকাল নরসিংদীর নিকটস্থ ভাগদি, অতঃপর চাঁদপাশা গ্রামে বসবাস করেন।
যুদ্ধফেরত সৈনিকের মানস চেতনায় রাজনীতি বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিলো। সে-প্রেক্ষিতেই তিনি রাজনীতিকে উপজীব্য করে অনেক কবিতা লিখেছেন, যেমন : কাশ্মীরের কবিতা ও হিন্দুস্থানের উল্টাবাজি, ইসলামি শাসনতন্ত্র রিপাবলিক রাষ্ট্রের কবিতা, একুশ দফার কবিতা, তাসখন্দের ৯ দফা, জিয়ার ১৯ দফার কবিতা, জাতির জনক শেখ মুজিবুরের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার আগমনের কবিতা। রাজনৈতিক বিষয় ছাড়াও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, প্রেমপ্রীতি ও ধর্মীয় বিষয় নিয়েও তিনি বহু কবিতা পুস্তিকা প্রণয়ন করেছেন।
কবি মফিজ উদ্দিন প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর কবি। তিনি কবিতার ‘গ্রামার বা ব্যাকরণ’ জানেন না। সে-কারণে তিনি সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষাতেই কবিতা রচনার প্রয়াস পান। কবিমন কল্পনাবিলাসী হলেও তিনি বাস্তব জগতেরই বাসিন্দা। মানুষের আনন্দ-বেদনার সমঅংশীদার তিনি। তাঁর হৃদয়ের অনিবার্য আকুলতা থেকেই কবিতার জন্ম হয়। সমাজের দুর্দশা নিরসনে কবিগণ ব্যাকুলচিত্ত থাকেন, অথচ সেই সমাজের মানুষদের কাছ থেকে তাঁরা যথাযোগ্য প্রতিদান পান না। দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনের এ-বিষাদঘন আত্মজৈবনিক চিত্র গ্রাম্য কবি মফিজ উদ্দিনের কবিতায় বিধৃত হয়েছে :
মনের কল্পনায় ছন্দ যোগায়, তাই তো কলম ধরি, জল্পনা সখির পিছে করি দৌড়াদৌড়ি। জানি না লেখাপড়া মন-মরা শক্তি-বল নাই, কবিতা লিখিতে তবু কলম চালাই। কবিতা লিখি তাই গ্রামার নাই, নাই সেই ব্যাকরণ, গ্রাম্য ভাষায় কাহিনীর সব দিয়ে যাই বর্ণন। লিখলে শুদ্ধ ভাষায় দেখা যায় গ্রামে থাকে যারা, কঠিন ভাষায় লিখলে আবার পড়তে চায় না তারা। তাই আদি অন্তে ভেবে চিন্তে গ্রাম্য ভাষা দিয়া, জীবিকানির্বাহ করি কবিতা বেচিয়া। তবে আমার মত লিখকগণ পল্লীগ্রামে থাকে, দারিদ্র্যতার জ্বালায় মরি সমাজ কি তা দেখে?
: শিক্ষা সভ্যতা গেল মারা, পৃষ্ঠা ২
প্রতিভাবান কবি মফিজ উদ্দিন মার্কসবাদের দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক ভাবাদর্শ তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিলো। তাঁর শ্রেণিচেতনা ছিলো অত্যন্ত প্রখর। এজন্যে চাষাভূষার অধিকার আদায়ে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। নিজেকে চাষা বলে পরিচয় দিতে তাঁর কোনো দ্বিধা ছিলো না। তাই তিনি লিখেছেন, “তোদের লাগি কাইন্দা মরে মফিজ উদ্দিন চাষী, কবে ফুটবে মুখে হাসি। খাটবি কত ভূতের বেগার বুদ্ধিহারার দল, এখন বুঝে শুনে চল, জমি তোদের লাঙল তোদের তোদের জন্মস্থান।”
কবি মফিজ উদ্দিনের সমাজ ও রাজনৈতিক চেতনা ছিলো অত্যন্ত ক্ষুরধার। গণমানুষের প্রতি তাঁর ছিলো অগাধ ভালোবাসা। এজন্যেই তিনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন এবং অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর কবিতায় সমকালীন রাজনীতি ও সমাজ প্রেক্ষিত এক সৌন্দর্যে উপস্থাপিত হয়েছে।
মফিজ উদ্দিন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ভাটকবি। তাঁর প্রকাশিত পুস্তিকাগুলোর একটি অসম্পূর্ণ তালিকা এখানে প্রদত্ত হলো :
— পানি বা গজব। প্রণেতা ও প্রকাশক। মুদ্রক : কোহিনূর প্রেস, নরসিংদী। প্র. সং ১০ ভাদ্র ১৩৬১/১৯৫৪, ৮ পৃষ্ঠা, মূল্য : দুই আনা। ১৩৬১ বঙ্গাব্দের ভয়াবহ বন্যার ধ্বংসলীলার বর্ণনা।
— ২১ দফার কবিতা ও চাষীর দুঃখ দুর্দশা। প্রকাশক : খন্দকার আফিরদ্দিন মিঞা, গ্রাম : ভাগদি, নরসিংদী। ১৯৫৪, ৮ পৃষ্ঠা।
— জব্বার মাস্টারের খুনের কবিতা (১ম খণ্ড), ১৩৬১/১৯৫৩, ৮ পৃষ্ঠা, মূল্য : দুই আনা। জব্বার মাস্টারের খুনের কবিতা (২য় খণ্ড), ১৩৬১, ১৯৫৪, ৮ পৃষ্ঠা, মূল্য : দুই আনা।
— অভাব না গজব, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির জুলুমের প্রতিফল কবিতা। প্রকাশক : খন্দকার আফিরদ্দিন মিঞা, গ্রাম : ভাগদি, নরসিংদী। ১৯৫৪, ৮ পৃষ্ঠা, মূল্য : দুই আনা।
— জামাল জরিনার প্রেমকাহিনী ও পুত্রের হাতে পিতার খুন। প্রণেতা, গ্রাম : ভাগদি, পো. : নরসিংদী, জিলা : ঢাকা। প্রকাশক : সিরাজ মিঞা, আশ্রবপুর, চক্রধা, ঢাকা। ১১ মাঘ ১৩৬১/১৯৫৪, ৮ পৃষ্ঠা, মূল্য : দুই আনা।
— নবী কাহিনী (বই নং ১), আখেরী নবীর জন্ম কাহিনী ও আমিনা বিবির খোয়াব। প্রকাশক : সিরাজুল ইসলাম সরকার। ২২ বৈশাখ ১৩৬২, ৮ মে ১৯৫৫, ৮ পৃষ্ঠা, মূল্য : দুই আনা।
— নবী কাহিনী (বই নং ২), শিশু নবী ও দাই হালিমার কাহিনী।
— কাশ্মীরের কবিতা ও হিন্দুস্থানের উল্টাবাজি। প্রকাশক : খন্দকার আফিরদ্দিন মিঞা, ভাগদি, নরসিংদী। চৈত্র ১৩৬২, এপ্রিল ১৯৫৫, ৮ পৃষ্ঠা, মূল্য : এক আনা।
— রঙমালার কবিতা। ১৯৫৬, ৮ পৃষ্ঠা।
— দর্জ্জালের সিংহাসন, অবশেষে পলায়ন। প্রকাশক : ফজর আলী খাঁ, গ্রাম : হিজলিয়া, নরসিংদী, ঢাকা। ২৫ আশ্বিন ১৩৬৩, ১৯৫৬, ৮ পৃষ্ঠা, মূল্য : দুই আনা।
— ইসলামি শাসনতন্ত্র রিপাবলিক রাষ্ট্রের কবিতা।
— ইসলাম ধর্মের ঠিকাদারের কাহিনী ও ফাঁসির মরার নসিহত।
— চরসিন্দুর হাইস্কুলের হেডমাস্টার মুক্তার খানের খুনের কবিতা (১ম খণ্ড)। ১৯৬৭, ৮ পৃষ্ঠা।
— চরসিন্দুর হাইস্কুলের হেড মাস্টার মুক্তার খানের খুনের পূর্ণ বিবরণ (২য় খণ্ড)। প্রকাশক : সিরাজ মিঞা, আশ্রবপুর, ঢাকা। মুদ্রক : কোহিনূর প্রেস, নরসিংদী। ৮ পৃষ্ঠা, মূল্য : বার পয়সা। কবিতাটি বাস্তব ঘটনা নিয়ে রচিত। রশীদ নামক জনৈক ছাত্র মেট্রিক টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করে। সে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্যে প্রবেশপত্র পেতে হেড মাস্টারকে বারম্বার চাপ প্রয়োগ করে। তিনি এই দুর্বল ছাত্রকে পাত্তা দেননি। এতে রশীদ ক্ষিপ্ত হয়ে ১৯৬৭ সালের ৬ এপ্রিল নরসিংদী কলেজ চত্বরে হেডমাস্টার মুক্তার খানকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। পরে ঘাতক রশীদ গণপিটুনিতে নিহত হয়।
— টেডি নারী যাহানারার প্রেমকাহিনী (১৯৬৭ ?)।
— সতাই মার গোপন প্রেমকাহিনী ও কারে কেবা মারতে পারে ঠাডা পড়ে নিজে মরে। প্রণেতা : মফিজ উদ্দিন (প্রাক্তন সৈনিক), নোয়াদিয়া, ঢাকা। প্রকাশক : সিরাজ মিয়া, আশ্রবপুর, শিবপুর, ঢাকা। ১৯৬৯, ৮ পৃষ্ঠা, মূল্য : বার পয়সা।
— চাঁদের কবিতা। প্রণেতা ও প্রকাশক : নোয়াদিয়া, ঢাকা। মুদ্রক : খান প্রিন্টিং প্রেস, বাবুবাজার, ঢাকা। ১৯৬৯, ৮ পৃষ্ঠা, মূল্য : বার পয়সা। এ্যাপেলো-১১ নভোযানে তিন নভোচারীর চন্দ্রে অবতরণের বিবরণ।
— চাঁদে যাহা দেখিলাম, ২য় খণ্ড।
— ১১ দফা ও আসাদ ভাইয়ের কবিতা।
— কবিতা— শিবপুরের অগ্নিকাণ্ডের নিদারুণ কাহিনী ও আগুনে পোড়ায় তিনজনের মৃত্যু। প্রকাশক : সিরাজ মিয়া, আশ্রবপুর, শিবপুর, ঢাকা। ১৯৬৯, ৮ পৃষ্ঠা, মূল্য : পঁচিশ পয়সা। শিবপুরের অগ্নিকাণ্ডে তিনজনের মৃত্যুর ঘটনার বর্ণনা।
— হাসু মিয়া ও হিরণবালার বিয়ার কবিতা। প্রণেতা : চাঁদপাশা, নোয়াদিয়া, ঢাকা। প্রকাশক : আবদুল আজিজ, খলিলাবাদ। ১৯৭০, ৮ পৃষ্ঠা, মূল্য : দুই আনা।
— যাদুগরণী চন্দ্রবানের যাদুর কারখানা। ১৯৭০, ৮ পৃষ্ঠা।
— দুই বিয়ার তিলিসমত ও দুঃখের কাহিনী। প্রণেতা : চাঁদপাশা, নোয়াদিয়া, জিলা : ঢাকা। প্রকাশক : সিরাজ উদ্দিন ও অন্যান্য, আশ্রবপুর, ঢাকা। মুদ্রক : সিদ্দিক প্রেস, ভৈরব। ১৯৭০, ৮ পৃষ্ঠা।
— ডাকু রুস্তম ও রেজিয়ার প্রেমকাহিনী (১ম খণ্ড, সিরিজ কবিতা)। বিজ্ঞাপিত পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয়েছিলো কি না জানা যায়নি।
— ইলেকশনের কাহিনী। ১৯৭০, ৮ পৃষ্ঠা।
— গোল ছাহেরার বিয়া ও মায়ের হাতে পুত্র খুন, ভাই ভাগ্নির ফাঁসি। প্রকাশক : সিরাজ উদ্দিন ও অন্যান্য, আশ্রবপুর, ঢাকা, মুদ্রক : সিদ্দিক প্রেস, ভৈরব। ১৯৭০, ৮ পৃষ্ঠা।
— বুড়া মিয়া জোয়ান বিবির আজব কারখানা কবিতা।
— (কোর্টের সামনে ঢাকার ঘটনা) শিক্ষা সভ্যতা গেল মারা, উকিলে উকিলকে মারে ছোরা। প্রণেতা : নোয়াদিয়া, ঢাকা। প্রকাশক : রুস্তম আলী, বৌয়াকুড়, নরসিংদী। মুদ্রক : রহমান প্রেস, নরসিংদী। ১৯৭৯, ৮ পৃষ্ঠা, প্রতি কপি ষাট পয়সা।
— মকদ্দমার রায়ে, ২য় খণ্ড।
— ভুট্টুর ফাঁসির কবিতা। প্রকাশক : মির রুস্তম আলী, বৌয়াকুড়, নরসিংদী। মুদ্রক : রহমান প্রেস, নরসিংদী। ১৯৭৯, ১৫ পৃষ্ঠা, মূল্য : এক টাকা পঁচিশ পয়সা।
— জাতির জনক শেখ মুজিবুরের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার আগমনের কবিতা। প্রকাশক : মির রুস্তম আলী, ব্রাহ্মন্দী, দাসপাড়া, নরসিংদী। ১৯৮১, ৮ পৃষ্ঠা, মূল্য : এক টাকা।
মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান
প্রত্নগবেষক ও লোকসাহিত্যিক
প্রিয় পাঠক, প্রত্নগবেষক ও লোকসাহিত্যিক মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠানের ভাটকবিদের নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার ফল তাঁর গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের ভাটকবি ও কবিতা’। এ-গ্রন্থ থেকে নরসিংদীর ভাটকবি দারোগ আলীকে নিয়ে এই লেখাটি প্রকাশ করা হলো। এই গ্রন্থের বিপুল পাঠ ও পরিচিতির স্বার্থে ও নরসিংদীর ঐতিহ্যপূর্ণ এক আখ্যানের সাথে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে আমাদের এ-উদ্যোগ।
“যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে, যে নদী মরুপথে/ হারালো ধারা,/ জানি হে জানি তাও/ হয় নি হারা”— প্রত্যন্ত গ্রামে নীরবে-নিভৃতে কাব্যসাধনায় আত্মমগ্ন লোককবি দারোগ আলীও হারিয়ে যাবার নয়, তিনি তাঁর অবদানের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন।
তিনি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার অন্তর্গত সাহাপুর গ্রামে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৪২৪ বঙ্গাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পিতা মুনসি রমজান আলী। পেশায় ছিলেন দলিল লিখক। দারোগ আলী ছিলেন এ-অঞ্চলের খ্যাতিমান পুঁথি রচয়িতা ও পাঠক এবং জারিগান গায়ক। তিনি তাঁর ওস্তাদ আবদুল বারিক সরকারের আন্তরিক সাহচর্যে পুঁথিপাঠ, রচনা ও জারিগান পরিবেশনায় অত্যন্ত দক্ষ হয়ে ওঠেন। তিনি চাঁদ সওদাগর, অরুণ শান্তি, স্বপন কুমার ও চম্পাকলি প্রভৃতি লোকনাট্য রচনা করেন, কিন্তু সেগুলো প্রকাশিত হয়নি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে তিনি দোভাষী পুঁথির আদলে ১৯৭২ সালে ‘বঙ্গ-বিষাদ পুঁথি’ রচনা করেন। পুঁথির নামকরণ ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে কবি লিখেছেন : “বাঙ্গালীদের চিরকাল দুঃখেতে কাটিল/ তাই সে পুস্তকের নাম বঙ্গ বিষাদ হইল।/ জিন্নার আমল হতে বাংলায় যা কিছু ঘটনা/ এ পুস্তকে কিছু কিছু করিনু বর্ণনা।”
১৩৮০ বঙ্গাব্দে (১৯৭৩) প্রকাশিত পুঁথিটির ভূমিকা লিখেছেন রায়পুরা থানার মুক্তিবাহিনির কমান্ডার মো. গয়েছ আলী। ছিয়ানব্বই পৃষ্ঠার পুঁথিটি পঁচিশটি উপশিরোনামে বিন্যস্ত ও ৩,৩৪২ পঙক্তিতে সমাপ্ত। এতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি নানা বিভেদ-বৈষম্য, শেখ মুজিবুরের পরিচয় ও ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট গঠন, আয়ুব খানের বাদশাহী ও ফলাফল, শেখ মুজিবের খেদ, শেখ মুজিবুর ও তাঁর সঙ্গীগণের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের ও তার ফলাফল, শেখ মুজিবকে উদ্ধারকল্পে বাঙ্গালীর প্রথম সংগ্রাম, শেখ মুজিব ও সঙ্গীগণ মুক্তি পায় এবং আয়ুব-মোনেমের অপসারণ, ভোটে ফেল করিয়া পাকিস্তানের চালাকি ও বাটপারি, ১৯৭১ সনে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ ঘোষণা ও পশ্চিমাদের গোপন ষড়যন্ত্র, ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে পাঞ্জাবিদের নিষ্ঠুরতা এবং বঙ্গবন্ধুর বন্দী হওয়ার বয়ান, হানাদারগণ বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী-পুত্রকে বন্দী করে নির্যাতন ও বাঙ্গালীদের উপর জুলুম অত্যাচার করে এবং মুক্তিযোদ্ধাগণ ট্রেনিং নিতে ভারতে যান, তার বিবরণ, বাঙ্গালীর মরণপণ মুক্তিযুদ্ধ, হাটুভাঙ্গার যুদ্ধ, বেলাব’র লড়াই, দুলালের কাহিনি, বিশ্বাসঘাতকতা, আজব ঘটনা, মুক্তির লড়াই কী চমৎকার, বঙ্গবন্ধু লায়লপুর কারাগারে বাংলার জন্য খেদ করে, তার বয়ান, ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ, হরিষে বিষাদ, মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন ও পাকসেনাদের আত্মসমর্পণ, রাজাকারের বিচার, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি লাভ ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তন প্রভৃতি বিষয় অতি সরল ও শ্রুতিমধুর ভাষায় বিবৃত হয়েছে।
দেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলির ক্রমাগ্রসর ধারা বর্ণনায় কবি যথেষ্ট ইতিহাস সচেতনতার স্বাক্ষর রেখেছেন। নামমাত্র লেখাপড়া জানা এক কবির পক্ষে ইতিহাসের সত্যাশ্রয়ী ঘটনার বিশ্লেষণী নৈপুণ্যে সত্যি বিস্মিত হতে হয়। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ইতোমধ্যে সহস্র গ্রন্থ রচিত হলেও প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর উপযোগী সহজবোধ্য ভাষায় লেখা ‘বঙ্গ-বিষাদ পুঁথি’টি বাংলাদেশের কোনো লোককবির একক ও বিরল ব্যতিক্রমী প্রয়াস। কবি তাঁর সংবেদনশীল হৃদয়ের গভীর অনুভূতি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শাণিত চেতনাকে ‘কালের কপোল তলে শুভ্র সমুজ্জ্বল’ করে রেখেছেন। পরিতাপের বিষয় এই যে, অদ্যাবধি সুশীল সমাজের কাছে পুঁথিটি প্রকাশের সংবাদ অজ্ঞাত, অনালোচিত ও অপাঙক্তেয় থেকে গিয়েছে। অথচ অতি সরল লোকজ ভাষায় বাংলার আবহমান ঐতিহ্যের সনাতনী ধারায় বাণীবদ্ধ এই কাব্যগ্রন্থটি এক অসামান্য সাহিত্য-কীর্তিরূপে গণ্য হতে পারতো।
প্রচলিত ধারা অনুসারে পুঁথির প্রারম্ভে প্রভুস্তুতি যুক্ত হয়। কিন্তু এ-পুঁথিটিতে দেশবন্দনাসূচক পদাবলি বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। কবি বাংলাদেশের মহিমাকীর্তনে এতো উচ্ছ্বসিত যে, তিনি লিখেছেন :
জেন্দেগী ভরিয়া কইলে তবু না হয় শেষ— এই যে আমার সোনার বাংলা সোনার বাংলাদেশ দেখিতে নয়ন জুড়ায় দেখতে লাগে বেশ। ছয় ঋতু বিরাজ করে এই বাংলাদেশে শরীর জুড়ায় তার বসন্ত বাতাসে। বসন্তে কোকিলায় ডাকে কুহু কুহু তানে এহেন কোকিলার রব নাই কোনখানে। নদনদী যত ইতি কি বলব সে কথা আনন্দে চালায়ে তরী যাই যথাতথা। খাদ্য লওয়াজেমায় ভরা সোনার বাংলা খানি এক মুখে কী বলতে পারি তাহার বাখানি। জেন্দেগী ভরিয়া কইলে তবু না হয় শেষ এহেন সোনার পুরী আমার বাংলাদেশ।
কবি পুঁথির প্রারম্ভে সংক্ষিপ্ত হামদ, নাত ও উৎসর্গ পৃষ্ঠার পরেই ‘শেখ মজিবরের পরিচয় ও ভাষা আন্দোলন’ শীর্ষক অধ্যায়টি যুক্ত করেছেন। ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমান সংগ্রামী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার সাংবিধানিক মর্যাদা প্রদান পর্যন্ত তিনি এক নিরাপোষ সংগ্রামী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এজন্যে তাঁকে জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছে।
“বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা এবং মুক্তির দাবিতে জেলবন্দি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমদ ১৬ ফেব্রুয়ারী (১৯৫২) কারাগারে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত হন। ১৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে তারা অনশন ভঙ্গ করেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব ও ১ মার্চ মহিউদ্দিন কারাগার থেকে মুক্তি পান।” : মাহবুবুল আলম, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ২০০১, পৃষ্ঠা ১৭
‘শেখ মজিবরের পরিচয় ও ভাষা আন্দোলন’ বিষয়ক পুঁথিটি পাঠকেরা পড়তে পারেন মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠানের ‘বাংলাদেশের ভাটকবি ও কবিতা’ গ্রন্থের ২য় খণ্ডের ২০৭ নং পৃষ্ঠা থেকে।
মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান
প্রত্ন-গবেষক ও লোকসাহিত্যিক
ছোটোবেলা চরাঞ্চলের গ্রামের বাড়ি থেকে নানার বাড়ি চর্ণগরদী যাওয়া-আসার বিষয়টি বেশ রোমাঞ্চকর ছিলো। নৌকায় মেঘনা নদী পেরিয়ে নরসিংদী শহর হয়ে রেলস্টেশন দিয়ে চিনিশপুর রাজারদীর পরই পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের কোলে চর্ণগরদীর সৈয়দ বাড়িতে যখন যেতাম, তখন মনে মনে একটা উৎসব ভাব জাগতো। সৈয়দ বাড়ির পাশেই ছিলো খান বাড়ি। সেখানে জন্মেছিলেন সাবেক মন্ত্রী মোমেন খান, বিজ্ঞানী বাতেন খান ও সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আব্দুল মঈন খান।
ছোটোবেলায় নানার বাড়ির স্মৃতির সঙ্গে সঙ্গে রেলস্টেশনের গায়ে লেখা ‘নরসিংদী জং’ শব্দটি হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিলো। এই সংক্ষিপ্ত ‘জং’য়ের পূর্ণাঙ্গ শব্দ যে ‘জংশন’, তা অনেক পরে জেনেছিলাম। ইঞ্জিন ঘোরানো, বগি ধোয়ামোছা, গাড়িতে পানি নেয়া ও গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় জংশনে। নরসিংদী থেকে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানাধীন মদনগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করে শিল্পাঞ্চল ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র নরসিংদী ও প্রাচ্যের ড্যান্ডি নারায়ণগঞ্জকে যুক্ত করা হয়েছিলো। ফলে নরসিংদী পরিণত হয় জংশনে। কিন্তু অলাভজনক হওয়ায় প্রতিষ্ঠার ৭ বছরের মাথায় রেলপথটি বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৪ বছর পর রেলপথের পাত তুলে নেয়া হলে ৪৬.৬৯ কিলোমিটারের রেলপথটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
নরসিংদীতে প্রথম রেলপথ নির্মাণ শুরু হয়েছিলো ১৯১০ সালে, যা শেষ হয় ১৯১৪ সালে। আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি টঙ্গী-নরসিংদী-ভৈরব-আখাউড়া রেললাইনটি নির্মাণ করে। ঢাকা থেকে রেলপথ টঙ্গী পর্যন্ত নির্মিত হয়েছিলো ১৮৮৫ সালে। অবশ্য তখন রেলপথটি নারায়ণগঞ্জ থেকে শুরু করে ঢাকার ফুলবাড়িয়া হয়ে টঙ্গী থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ১৪৪ কিলোমিটার সম্প্রসারণ করা হয়েছিলো। টঙ্গী থেকে রেলপথটি ভৈরব পর্যন্ত সম্প্রসারণ কাজ শুরু হয় ২৫ বছর পর।
রেলপথ সম্প্রসারণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নরসিংদীতে বস্ত্র ও তাঁতশিল্প, কৃষিপণ্য, ফলমূল চাষে ব্যাপক বিপ্লব ঘটে। বিশেষ করে নরসিংদীর হাসনাবাদ, বাবুরহাট, মাধবদী এবং গোপালদী ও আড়াইহাজার এলাকা হয়ে ওঠে বস্ত্রশিল্পের প্রাণকেন্দ্র। মূলত বস্ত্রশিল্পের উন্নতির কথা মাথায় রেখেই নরসিংদী টু মদনগঞ্জ রেলপথটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়, যা ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে চালু হয়।
স্বল্প দূরত্বের এই রেলপথে মোট ১০ টি স্টেশন ছিলো। স্টেশনগুলো হলো : নরসিংদী জংশন, মাধবদী, মোল্লারচর, আড়াইহাজার, প্রভাকর্দী, নয়াপুর, কুড়িপাড়া, নবীগঞ্জ, বন্দর ও মদনগঞ্জ। এর মধ্যে পাকিস্তান আমলে মদনগঞ্জে পাট, ধান, চালের জমজমাট আড়ত ছিলো। অপরদিকে নরসিংদীতে তৈরি কাপড় ছিলো খ্যাতির শীর্ষে। এসব পণ্য সারাদেশে সরবরাহ করার লক্ষ্যেই ১৯৬৭ সালে সর্বপ্রথম নরসিংদী-মদনগঞ্জ রেলপথ নির্মাণের কথা ওঠে। পরবর্তীতে জরিপ ও যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করে রেলপথটি নির্মাণের জন্যে রেলপ্রকৌশলীরা মতামত দেন। এর প্রেক্ষিতে রেলপথ ও রেলস্টেশন নির্মাণ কাজ শেষ করে ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে রেলগাড়ি চলাচল শুরু করা হয়। কিন্তু ১৯৭৬ সালের দিকে এই পথে রেল চলাচল লোকসানে পরিণত হয়।
খায়রুল বশির নামে একজন রেল কর্মকর্তা নরসিংদী-মদনগঞ্জ রেলসড়কের লোকসান নিয়ে অনুসন্ধান চালান। তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি ও রেলপোর্টারের (কুলি) সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, নরসিংদী-মদনগঞ্জ রেলপথটি মূলত অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতির কারণে ডুবেছে। এই রেলপথটি এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছিলো যে, বন্ধ করে দেয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ ছিলো না। কোনো স্টেশনেই টিকেট চেক করা হতো না। পোর্টারদের নিয়ন্ত্রণে সবকিছু চলে গিয়েছিলো। তারাই স্টেশন নিয়ন্ত্রণ করতো এবং টিকেট চেক করতো। যাত্রীদের কাছ থেকে টিকেট সংগ্রহ করে তা পুনরায় কাউন্টারে বিক্রি করা হতো। তাদের এই মহাদুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলো বুকিং সহকারী, টিআইসি, একাউন্টস টিআইসি, এসিও এবং ডিপিও অফিসের আরএসিআই। বলা যায়, এই রেলপথের সব দুর্নীতির ভাগ রেলের উচ্চ পর্যায়ে যেতো। দুর্নীতিটা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো, রেলের চালকেরা পর্যন্ত এতে জড়িয়ে পড়েছিলো। ৫-১০ টাকা ঘুষের বিনিময়ে যাত্রীদের যত্রতত্র নামিয়ে দেয়া, এমনকি যাত্রীদের বাড়ির কাছে ট্রেন ব্রেক করার মতো ঘটনাও ঘটতো। দুর্নীতি চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলে সরকার রেলপথটি বন্ধ করে দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করে। সোনারগাঁওয়ের তৎকালীন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী ব্যারিস্টার রাবেয়া ভূঁইয়া এই রেলপথের দুর্দশা দেখে ব্যথিত হন। তিনি রেলপথ তুলে দিয়ে সেখানে স্থলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তখন থেকেই যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে ফাইল চালাচালি শুরু হয়।
নরসিংদী টু মদনগঞ্জ সেকশনের করুণ অবস্থা ১০ টি স্টেশনের উপর প্রভাব ফেলে। ১৯৭০ সালে রেলপথটি শুরুর সময় প্রতিটি স্টেশনে মাস্টার নিয়োজিত ছিলো। ১৯৭৭ সালে রেলপথটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে প্রত্যেক স্টেশন থেকে মাস্টার উইথড্র হতে থাকে। তখন বুকিং সহকারী স্টেশনের সব দায়িত্ব পালন করতেন। শুধুমাত্র মদনগঞ্জ স্টেশনে একজন স্টেশন মাস্টার ও একজন পয়েন্টম্যান নিয়োজিত ছিলো। তারা মদনগঞ্জে ইঞ্জিন ঘুরিয়ে অনট্রেন করতেন।
১৯৭৭ সালে রেলপথটি বন্ধ হয়ে গেলে পুরো অঞ্চলটি প্রায় জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে। এটি চোর-ডাকাতের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। রেলপথের লোহালক্কর, কাঠ, পাথর চুরি হতে থাকে। তখন থেকে লম্বা সময় ধরে এই ভয়ঙ্কর অবস্থা বিরাজমান ছিলো। জানা যায়, ১৯৮০ সালের দিকে মদনগঞ্জে চালের ব্যবসার পাশাপাশি পাটের ব্যবসায়ও ধস নামে। সঙ্গত কারণে সরকার রেলপথটি সংস্কার ও পুনরায় চালু করার চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে সেখানে বাস-ট্রাক চলাচলের উপযোগী সড়কপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করে।
পরবর্তীতে আশির দশকের শেষের দিকে রেললাইনের উপর সড়কটি নির্মিত হয়। বর্তমানে সড়কটি নরসিংদী টু নারায়ণগঞ্জ চলাচলের বিকল্প সড়ক হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক