Home Blog Page 2

শামসুর রাহমানের শেকড়ের টান

বাংলাদেশের অন্যতম কবি এবং এ-কালের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও অভিনন্দিত কবি শামসুর রাহমান। রবীন্দ্র-উত্তর তিরিশ পরবর্তী কাব্যজগত বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে অনন্য এক আন্দোলন। রবীন্দ্র-প্রভাব মুক্ত হয়ে শুরু হয় বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র পথচলা। এই ধারাবাহিকতায় জীবনানন্দ দাশের পরই পঞ্চাশের দশকে আধুনিকতার নতুন মাত্রা নিয়ে আবির্ভূত হন শামসুর রাহমান।

চল্লিশ দশকের শেষ পর্যায়ে এবং পঞ্চাশের দশকে তাঁর সদর্প আবির্ভাব হলেও পরবর্তী কয়েক দশকে কবি নানা মাত্রায়, ভাব-আঙ্গিকের বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিজেকে জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন আধুনিক কবি হিসেবে। কবিতার আলোচনায়, কবিদের আসরে তাঁর অবস্থান হয়ে যায় প্রথম সারিতে। কিন্তু এই কবি সম্পর্কে তাঁর শেকড়ের স্থানের মানুষদের একটি ভিন্ন অভিযোগ শুনতে পাওয়া যায়। তাদের বক্তব্য, “এতো জনপ্রিয় কবি, এতো প্রতিষ্ঠিত কবি, তাঁর শেকড়ের সাথে সম্বন্ধ নেই।”

তাঁর শেকড় নরসিংদী জেলার পাড়াতলী গ্রাম, কিন্তু নরসিংদীর সাথে কবির সম্পর্ক নেই, ‘কবি নরসিংদী আসেন না’ ইত্যাদি— বিভিন্ন সভার আলোচনা, নানা আড্ডার আলাপচারিতায় এসব কথা শুনে আমার মনে গভীর জিজ্ঞাসা তৈরি হয়। আসলে এইসব অভিযোগ কি সত্যি? কবি তাঁর শেকড়ের সাথে সম্বন্ধ রাখেন না? নাকি আমরাই কবির সাথে সম্বন্ধ তৈরি করিনি, কবিকে জানতে-বুঝতে চেষ্টা করিনি? কবির সৃষ্টিকর্মের সাথে আমাদের সম্বন্ধ তৈরি হয়নি? আমার ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের গবেষণায় এবং কবির কবিতা পাঠের মাধ্যমে আমার বোধ সৃষ্টি হয়— কবির সম্পর্কে এসব অভিযোগ সত্য নয়। বরং আমরাই তাঁর সৃষ্টিকর্মের অধ্যয়ন না করে, তাঁর জীবনাচরণের তথ্য না জেনে কবিকে অভিযুক্ত করে ফেলেছি। আমার ধারণা হয়েছে, কবি আমাদেরই লোক এবং একজন কালজয়ী শিল্পী হিসেবে কবি সারাদেশের ও পৃথিবীর মানুষের। এসব ভাবনা নিয়ে যখন তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে এবং আমিও কবিকে বেশি করে জানার চেষ্টা করছি, তখন আমি নরসিংদী কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপনার কাজে রত। কবির প্রতি এসব অভিযোগ-অনুযোগের কারণে আমার কষ্ট হতো এবং কবির শেকড়ের সাথে আমারো একটু যোগসূত্র ছিলো। সেই তাগিদে আমি কবিকে আরো বেশি করে জানার চেষ্টা করি। কবির শেকড় নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার পাড়াতলী গ্রাম। মেঘনা নদীর তীরলগ্ন পাড়াতলী তাঁর পৈতৃক নিবাস, তাঁর মূল ঠিকানা। যদিও জন্ম নিয়েছিলেন পুরান ঢাকার মাহুতটুলীতে ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর, নানার বাড়িতে। আমার গর্ব, আমার অহঙ্কার, আমার বাড়িও পাড়াতলী ইউনিয়নের মধ্যনগর গ্রামে।

কলেজের অধ্যাপনাকালে আমি শ্রেণিকক্ষের পাঠদান প্রক্রিয়ার বাইরেও কলেজের সকল সহপাঠক্রমিক কাজে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলাম অধ্যক্ষ মহোদয়ের তাগিদে। এবং নিজেরও ভালোলাগার তাগিদ ছিলো এসব কাজে যুক্ত হওয়ার মধ্যে। ১৯৭৮-৭৯ শিক্ষাবর্ষের জামান-নাসির পরিষদের ছাত্র সংসদের আমি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক। কলেজে তখন ছাত্র সংসদের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিভাগের মাধ্যমে সপ্তাহব্যাপী সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা এবং সাহিত্য উৎসব হতো। ছাত্র সংসদের সভায় আমি প্রস্তাব করলাম— এবার সাহিত্য উৎসবের সমাপনী এবং পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কবি শামসুর রাহমানকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানাতে চাই। প্রস্তাব সানন্দে এবং সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো। যথারীতি কবির সাথে আমরা যোগাযোগ করলাম এবং কবিও আগ্রহভরে অনুষ্ঠানে আসার সম্মতি দিলেন। বর্ণাঢ্য আয়োজনে কবিকে আমরা বরণ করলাম। সুন্দর অনুষ্ঠান হলো। কবি অনেক কথা বললেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করলেন। অনুষ্ঠান শেষে খাবার টেবিলে এবং কবির বিশ্রামের মুহূর্তগুলোতে আমি নানা আলোচনার সুযোগ নিলাম। সাহস করে বলেই ফেললাম—

“কবি, আপনার সম্পর্কে নরসিংদীবাসীর অনেকেরই অনুযোগ, আপনি নরসিংদীর সাথে সম্পর্ক রাখছেন না।”
কবি হেসে বললেন, “কেনো এই অনুযোগ? নরসিংদী তো আমার শেকড়। আমার অনেক কবিতায় আমার গ্রাম, আমার পূর্বপুরুষ, আমার মেঘনা-বিধৌত চরাঞ্চল, নরসিংদীর মাটি ও আমার নানা সুখ-দুঃখের স্মৃতির বিবরণ রয়েছে। আমার অনেক কবিতার জন্ম নরসিংদীর পাড়াতলী গাঁয়ের মাটিতে বসে।”
এবং কবি উল্টো অনুযোগ করলেন, “নরসিংদীর মানুষ তো আমাকে ডাকে না সভা-অনুষ্ঠানে, আমি তো নিয়মিত পাড়াতলী আসি, সময় কাটাই প্রকৃতির কোলে। আজ আপনারা ডেকেছেন, আমি এসেছি। আমাকে ডেকে কেউ পায়নি, এমন অভিযোগ তো করা যাবে না।”
আমি লজ্জিত হলাম। বললাম, “কবি, আপনি ঠিক বলেছেন, ব্যর্থতা আমাদের। আমরা আপনাকে জানার চেষ্টা করি না। আপনার কবিতা পড়ি না। আপনাকে কাছে পাওয়ার সুযোগ নিই না।”

এ-প্রসঙ্গে কবির বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘হৃদপদ্মে জ্যোৎস্না দোলে’র একটি কবিতা ‘পাড়াতলী গাঁয়ে যাই’র উল্লেখ না করে পারছি না। এই কবিতায় কবি তাঁর উৎস এবং শেকড়ের কথা বলেছেন অকপটে, কবিতার শিল্প আঙ্গিকে—

পাড়াতলী গাঁয়ে যাই
পাড়াতলী একটি গাঁয়ের নাম,
…পাড়াতলী আমাদের আদি বাসস্থান
বহুযুগ ধরে কল্লোলিত মেঘনা নদীর তীরে। এখানেই
ছিলেন আমার পিতা, পিতামহ, মাতামহ আর
প্রবীণ প্রপিতামহ আর বহু গুরুজন।
পাড়াতলী গাঁয়ে কখনো কখনো যাই গাঢ় আকর্ষণে
নিজের উৎসের আর পিতার নির্মিত
দালানে প্রবেশ করি কিছু স্মৃতির সুঘ্রাণ নিতে। দালানের
পাশেই পুরানো মসজিদ, মসজিদটির পাশে
কী নিঝুম গোরস্থান, যেখানে আমার পিতা, পিতামহ আর
মাতা গভীর, গভীরতম ঘুমে অচেতন এবং আমার প্রিয়
সন্তানও সেখানে আছে মাটির নিচে ঘুমপাড়ানিয়া
গানে মগ্ন দুনিয়ার মাঠের খেলার মায়া ভুলে।
*  *  *
মেঘনা নদীর ডাকে, আমার উৎসের
গভীর গভীর টানে মাঝে মাঝে আমি পাড়াতলী গাঁয়ে যাই।

তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘ভাঙ্গাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুঁকছে’র উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘তট ভাঙ্গার জেদ’, যার মধ্যেও রয়েছে শেকড়ের কথা এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কবি কবিতায় বলেছেন—

বলতে ভালো লাগে, আমার পূর্বপুরুষগণ
মেঘনা নদীর তীরবর্তী পাড়াতলী গাঁয়ের
বাসিন্দা ছিলেন। তাঁদের ছোটবড় কুঁড়ে ঘর
এখন নিশ্চিহ্ন, কিন্তু পুকুর আর পাকা মসজিদটি
আজ অব্দি রয়ে গেছে সগৌরবে। আমার
পিতার সৃষ্ট একটি দালান আর ইশকুল এখনও
দাঁড়ানো মাথা উঁচু করে।
*  *  *
দাদাজান, নানাজান, আব্বা আর বড় চাচা, আমার
এক সন্তানের এবং আরও কারও কবর রয়েছে সেখানে।
রাত্তিরে নিষ্প্রদীপ সেই উদাস কবরস্থানে জোনাকিরা ছড়ায়
আলো আর ঝিঁঝিঁ পোকা একটানা সুর হয়ে ঝরে চৌদিকে।

পূর্বপুরুষদের কদমি পুকুর আত্মজকে আমার
গিলেছে সেই কবে। এক ভরদুপুরে। আজও স্বগ্রামে
গেলে অতীত এবং বর্তমানের প্রতি নির্বিকার পুকুরটির কিনারে
গিয়ে বসি। গাছ গাছালি ঘেরা এই
জলাশয় সাক্ষী এখানে একাত্তরে হিংস্রতার তাড়া-খাওয়া
সন্ত্রস্ত হরিণের মতো জন্মশহর থেকে ছুটে এখানেই
নিয়েছিলাম ঠাঁই। এই পুকুর আমাকে দেখলেই, মনে হয়,
হাসে বাঁকা হাসি; তবু দিয়েছে যুগল কবিতা উপহার।
*  *  *
শহর লালিত পালিত এই আমার সত্তায় পাড়াতলী গাঁয়ের
পূর্বপুরুষদের শোণিতধারা প্রবাহমান
মেঘনার স্রোতের মতো। বুঝি তাই সমাজের বহুমুখী
নিপীড়ন, নির্দয় শাসকদের সন্ত্রাস আজ
ভেতর মেঘনার উত্তাল তরঙ্গমালা হয়ে জেগে ওঠে প্রতিবাদ
এগিয়ে চলার তেজ, প্রতিক্রিয়ার অনড় তট ভাঙ্গার জেদ।

এই কবিতায় কবি বলেছেন, ‘তবু দিয়েছে যুগল কবিতা উপহার’। এই যুগল কবিতা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকালীন কবির অসাধারণ সৃষ্টি এবং ব্যাপক জনপ্রিয় দুটি কবিতা— ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’। ১৯৭২ সালে প্রাকাশিত ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থের মুক্তিযুদ্ধের যুগল কবিতা। এ নিয়েও কবিকে প্রশ্ন করেছি—

“এ দুটি রচনা সম্পর্কে কিছু বলুন”।
কবি বলেছেন, “কবিতা লিখেছি ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে। আমার বিশ্বাস ছিলো, স্বাধীনতা আসবেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় একদিন গ্রামের বাড়িতে পুকুরপাড়ে বসেছিলাম। পুকুরে অনেকে গোসল করতে আসতো। কয়েকজন ছোটো ছেলেমেয়ে গোসল করছিলো সে-সময়। তাদের ঝাপাঝাপি, অবাধ সাঁতার আমার মনে এক ঝিলিক দিয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে কবিতার লাইন মনে এলো আমার। দ্রুত আমার চাচাত ভাইয়ের কাছ থেকে পেন্সিল আর কাগজ নিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করলাম, পাছে যদি লাইনগুলো হারিয়ে যায়। খুব অল্প সময়ে কবিতা দুটি লিখেছিলাম।”

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মহাকাব্যের বিশালতা ও ব্যাপকতা এবং বিস্তৃতি নিয়ে পাড়াতলী গাঁয়ে বসে লেখা কবিতা দুটি কবির জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে অন্যতম এবং ইতিহাসের দলিল। পাড়াতলী গাঁয়ে কবির পারিবারিক পুকুরে ডুবে তাঁর অকালে প্রয়াত সন্তানের একটি ছবিকে নিয়ে লিখিত কালজয়ী ও শিল্পউত্তীর্ণ কবিতা ‘একটি ফটোগ্রাফ’। কবিতাটি ‘এক ফোঁটা কেমন অনল’ কাব্যের অন্তর্গত এবং এককালে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

কবি শামসুর রাহমানের সৃষ্টিকর্মের এসব তথ্যই প্রমাণ দিচ্ছে, কবির শিকড়সম্বন্ধ কতো গভীর। কবি নিজেও বলেছেন, “নরসিংদীর সঙ্গে আমার একটি গভীর আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। এই জেলার রায়পুরা থানার পাড়াতলী গ্রামে আমার পূর্বপুরুষদের পবিত্র জন্মস্থান। তাই পাড়াতলী তথা নরসিংদীর স্মৃতি আমাকে আনন্দ দেয়, আমার সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতিগুলিকে আন্দোলিত করে।”

১৯৬০ সালে প্রকাশিত ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ নামে প্রথম কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে একজন রোমান্টিক কবি হিসেবে শামসুর রাহমানের সদর্প যাত্রা শুরু। কিন্তু কবি পরবর্তীতে দেশ, কাল, রাজনীতি, সমাজ সচেতন হয়ে ওঠেছেন। হয়ে ওঠেছেন জীবন সচেতন কবি এবং তাঁর কবিতার বিষয় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ভাষা আন্দোলন, বাংলা ভাষা ও বর্ণমালার প্রতি গভীর ভালোবাসা, গণ-আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধ, নানা সংগ্রামী চেতনা এবং স্বদেশ-মানবপ্রেম। কবি তাঁর কবিতায় স্বপ্ন দেখেছেন, আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, আবার স্বপ্ন ভঙ্গের আর্তিও প্রকাশ করেছেন। সব মিলিয়ে ভাব-আঙ্গিকে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের শিল্পধারার সমন্বয় করে কবি হয়ে ওঠেছেন কালজয়ী শিল্পী। অতিক্রম করেছেন অঞ্চল ও দেশকে। যথার্থ অর্থে যিনি কবি, তিনি যেখানেই জন্ম নেন না কেনো, তিনি তাঁর শিল্পকর্মের সফলতা দিয়ে কালজয়ী হয়ে যান। হয়ে যান অঞ্চলকে অতিক্রম করে দেশের, দেশকে অতিক্রম করে পৃথিবীর।
শামসুর রাহমান সেই কবি।


গোলাম মোস্তাফা মিয়া
সাবেক অধ্যক্ষ, নরসিংদী সরকারি কলেজ

ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশন

‘পথের পাঁচালী’খ্যাত লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নরসিংদীর একটি টালিঘরে কয়েকদিন বসবাস করেছিলেন। টালির ঘরটি ছিলো স্থানীয় সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশন (হাইস্কুল)-এর একটি ছাত্রাবাস। ছাত্রাবাসের একটি অংশে শিক্ষকরাও বাস করতেন। তিনি যখন নরসিংদীতে আসেন, তখন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্যেই তিনি তৎকালীন ঢাকা জেলার অজপাড়াগাঁ নরসিংদীতে এসেছিলেন। নরসিংদী তখন একটি পুলিশ ফাঁড়ির অধীনস্থ ছোটো একটি গঞ্জ। মেঘনা নদীতীরের জনপদটির জমিদার ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা, শিক্ষাব্রতী ও আইনজীবী ললিতমোহন রায় বিএবিএল। তিনিই তাঁর পিতা জমিদার কালী নারায়ণ রায়ের নামের স্কুলটি ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন।

বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) কি শুধুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্যে নরসিংদী এসেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিভূতিভূষণের অকথিত একটি অধ্যায়ের সন্ধান পাওয়া যায়। সেটা হলো, তিনি ছিলেন ভারতীয় গোরক্ষিণী সভার প্রচারক। যার জন্যে তাঁকে বাংলা, ত্রিপুরা ও বার্মার বিভিন্ন এলাকা ভ্রমণ করতে হয়েছিলো। সেই ভ্রমণের অংশ হিসেবে তিনি নরসিংদী এসেছিলেন। একই সঙ্গে বন্ধুর আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন। মূলত গোসম্পদ রক্ষা এবং রোগগ্রস্ত ও দুর্বল গরুদের রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করার জন্যে গোরক্ষিণী সভা কাজ করতো। যার সভাপতি ছিলেন গিরিধারী লাল। সেই গোরক্ষার আদর্শ বুকে ধারণ করেই বর্তমানে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার ভারতকে বিতর্কের মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন।

অবশ্যই বিভূতিভূষণ গোরক্ষার প্রচারকাজে বেশিদিন সময় দেননি। এরপর তিনি খেলাৎচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে গৃহশিক্ষক, সচিব এবং তার ভাগলপুর জমিদার এস্টেটের সহ-ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকুরি করেন। কিছুদিন ধর্মতলাস্থ খেলাৎচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর যোগ দেন গোপালনগর স্কুলে। আমৃত্যু সেখানেই শিক্ষকতা করেছেন। লেখালেখি করেছেন দুহাতে। জন্ম দিয়েছেন পথের পাঁচালী (১৯২৮), অপরাজিত (১৯৩১), মেঘমাল্লার (১৯৩১), মৌরীফুল (১৯৩২), যাত্রাবদল (১৯৩৪), চাঁদের পাহাড় (১৯৩৭), কিন্নরদল (১৯৩৮), আরণ্যক (১৯৩৯), আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৪০), ইছামতী (১৯৫০) ও অশনি সংকেত (১৯৫৯) প্রভৃতি কালজয়ী গ্রন্থ। তাঁর লেখা উপন্যাস নিয়ে বেশকিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। জগদ্বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালী, অপরাজিত ও অশনি সংকেত চলচ্চিত্র নির্মাণ করে বিভূতিভূষণকে অন্যতম উচ্চতায় নিয়ে যান।

ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) | ছবিসূত্র : ইন্টারনেট

বিভূতিভূষণ যখন গোরক্ষিণী সভার প্রচারক হিসেবে কাজ করেন, তখন ভারতবর্ষের অনেক খ্যাতনামা লোক এর ব্যাপক সমালোচনা করেন। শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে মানুষের, বিশেষ করে মুসলমানদের খাবার পথে বাঁধা দেয়ার এই প্রচেষ্টায় ধর্মীয় বিভেদও সৃষ্টি হয়। স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ এতে ভীষণ রকম বিরক্ত হয়েছিলেন। একবার গোরক্ষিণী সভার সম্পাদক এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। স্বামীজী তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের সভার উদ্দেশ্য কী?” সম্পাদক জবাব দেন, “আমরা স্থানে স্থানে পিজরাপোল স্থাপন করছি। দুর্বল, রুগ্ন, জরাগ্রস্ত গোমাতাদের সেখানে রেখে পালন করি। তাছাড়া কসাইদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করি।” স্বামীজী বলেন, “উদ্দেশ্য সৎ সন্দেহ নেই। কিন্তু মধ্য ভারতে শুনেছি নাকি প্রায় ৯ লক্ষ লোক মারা গেছে অনাহারে। এই দুর্ভিক্ষ নিবারণে কতো টাকা সাহায্য করেছেন আপনারা?” সম্পাদক জবাব দেন, “দুর্ভিক্ষে সাহায্য আমরা করি না। গোমাতা রক্ষা করাই আমাদের পরম ধর্ম।” স্বামীজীর প্রশ্ন, “আর মানুষ মরে গেলে তার মুখে একমুঠো অন্ন দেওয়া বুঝি আপনাদের ধর্ম নয়?” সম্পাদকের জবাব, “মানুষ মরছে নিজের কর্মফলে, নিজের পাপে, নিজের…” স্বামীজী আবারো বলেন, “আর গোমাতারা? তারা যে কসাইদের হাতে পড়েন, সে-ও তো তাদের কর্মফলে। তবে আর তাদের বাঁচাবার কী দরকার?” সম্পাদক জবাব দেন, “তা আপনি যা বলেছেন তা সত্য, তবে শাস্ত্রে আছে, গাভী আমাদের মাতা।” স্বামীজী সবশেষে বলেন, “হ্যাঁ, গাভী যে আপনাদের মাতা, তা বুঝতে পারছি আমি, নইলে এমনসব ছেলে জন্মাবে কেনো?”

এমনসব প্রতিক্রিয়ার কারণে বোধহয় সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ গোরক্ষিণী সভার প্রচারক হিসেবে কাজ করতে সক্ষম হননি। তবে তিনি শুধুমাত্র চাকুরির খাতিরে এই ধরনের বিতর্কিত কাজে নিজেকে জড়িয়েছিলেন। তিনি পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলা ভ্রমণ শেষে বার্মার আরাকান অঞ্চলের মংডুতে পৌঁছান। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের শারদীয় পূজার কিছু আগে তিনি প্রচারকের চাকুরি নিয়েছিলেন। প্রখ্যাত মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী কেশোরাম পোদ্দারের অনুরোধে মাসিক ৫০ টাকা বেতনে তিনি চাকুরিটি নিয়েছিলেন। মংডু থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকা জেলার কিছু এলাকা ভ্রমণ শেষে তিনি কলকাতায় ফিরে যান। সেখানে গিয়েই তিনি গোরক্ষিণী সভার প্রচারক পদ থেকে ইস্তফা দেন। তখন তিনি থাকতেন ৪১ নম্বর মির্জাপুর স্ট্রিট (বর্তমানে সূর্যসেন স্ট্রিট)-এর মেস বাড়িতে।

১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুলাই বিভূতিভূষণ হরিনাভি স্কুলের মাস্টারি ছেড়ে নতুন করে চাকুরির খোঁজে কলকাতায় চলে আসেন। মেসে থেকেই চাকুরির খোঁজে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতেন। ঠিক সেই সময়ই প্রচারকের চাকুরিটা পেয়ে যান। কলকাতা শিয়ালদাহ রেলস্টেশন থেকে তিনি ট্রেনে কুষ্টিয়ার পথে পা রাখেন। এরপর একে একে কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল, ঢাকা, নোয়াখালী, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম ও বার্মা ভ্রমণ করেন। এসব স্থান থেকে তিনি গোরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়াদি প্রতিবেদন হিসেবে কলকাতায় সমিতি অফিসে পাঠাতেন। বিভূতিভূষণ তাঁর ভ্রমণ কাহিনি ‘অভিযাত্রিক’ গ্রন্থে তার উল্লেখ করলেও গোরক্ষা সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো উল্লেখ করেননি। হয়তোবা তিনি ইচ্ছা করেই তা চেপে গিয়েছিলেন। কোনো গবেষকও সেসব প্রতিবেদন খুঁজে বের করার প্রয়োজন বোধ করেননি। যে-কারণে একটি মূল্যবান উপাদান থেকে বাঙালি পাঠক সমাজ এখনো পর্যন্ত বঞ্চিত রয়েছেন।

তবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকা জেলার নরসিংদী জনপদে যে-ভ্রমণ করেছিলেন, তাঁর সুন্দর বিবরণ রয়েছে। ‘অভিযাত্রিক’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, গোরক্ষিণী সভার প্রচারকের কাজের পাশাপাশি তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে দেখার জন্যে সেখানে যান। একসঙ্গে সেখানকার গোসম্পদের খোঁজ নেয়া, কী পরিমাণ গরু পালন হয় কিংবা কসাইয়ের ছুরির নিচে কতোটি গোমাতার জীবন বিসর্জন দেয়া হচ্ছে, সেসব তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রতিবেদন আকারে কলকাতায় রিপোর্ট দেয়ার জন্যে তিনি মেঘনা তীরবর্তী এলাকাসমূহ ঘুরে দেখেন। সাটিরপাড়া মহল্লার গোচারণ ভূমি পায়ে হেঁটে অবলোকন করেন।

১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুলাইয়ের পর মাস্টারি ছেড়ে দিয়ে বিভূতিভূষণ গোরক্ষিণী সভার প্রচারক হিসেবে পূর্ববঙ্গে যে-ভ্রমণ করেছিলেন, তা একই বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিলো। সেটা তাঁর ‘অভিযাত্রিক’ বইয়েই উল্লেখ রয়েছে। সেখানে তিনি নরসিংদী ভ্রমণ সম্পর্কে নিজমুখে বলেন, “শীতলক্ষ্যা নদীর পুল পার হয়ে আবার ট্রেন এসে থামলো ঘোড়াশাল স্টেশন। ঘোড়াশাল থেকে ঢাকা জেলায় এখান থেকে কিছুদূরে নরসিংদি (নরসিংদী) গ্রামের হাই স্কুলে আমার এক বন্ধু হেডমাস্টার, অনেকদিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি, বিদেশ ভ্রমণের সময় পরিচিত বন্ধুজনের দেখাসাক্ষাৎ বড় আনন্দদান করে, সেজন্য ঠিক করেছিলাম ঢাকা যাবার পথে বন্ধুটির ওখানে একবার…।”

‘অভিযাত্রিক’ বইয়ে বিভূতিভূষণ নরসিংদী যাবার যে-বিবরণ দিয়েছেন, তাতে যৎসামান্য তথ্যগত ভুল রয়েছে। তিনি আখাউড়া দিয়ে ত্রিপুরা রাজ্য ভ্রমণ শেষে ট্রেনে নরসিংদী পৌঁছেছিলেন। যদি তাই হয়, তাহলে শীতলক্ষ্যা নদী ঘোড়াশালের আগে নয় যে, শীতলক্ষ্যা পেরিয়ে ঘোড়াশাল আসতে হবে। এখানে আরেকটি প্রশ্ন, তখন কি নরসিংদীতে কোনো রেলস্টেশন ছিলো না, যার কারণে তিনি ঘোড়াশাল স্টেশনে নেমে নরসিংদী এসেছিলেন। আবার তাঁর বর্ণনায় এসেছে ঘোড়াশাল থেকে নরসিংদী গ্রামের অবস্থান কিছুদূর। প্রকৃতপক্ষে ঘোড়াশাল থেকে নরসিংদীর দূরত্ব কিছুদূর নয়, কমপক্ষে ৬/৭ মাইল। তাই আমি মনে করি, বিভূতিভূষণ আসলে নরসিংদী রেলস্টেশনে নেমে সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশনে গিয়েছিলেন। স্টেশন থেকে স্কুলের দূরত্ব কিছুদূর।

আসলে তিনি নরসিংদী রেলস্টেশন আর ঘোড়াশাল রেলস্টেশন গুলিয়ে ফেলেছিলেন। কারণ, তিনি সেখানে গিয়েছিলেন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে। আর সেই ভ্রমণ কাহিনি তিনি ‘অভিযাত্রিক’ বইয়ে প্রকাশ করেছিলেন ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ২২ মার্চ। এর আগে তিনি পূর্ববঙ্গে ভ্রমণ কাহিনিটি কোনো পত্র-পত্রিকা কিংবা সাময়িকীতে প্রকাশ করেননি। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্সের অন্যতম কর্ণধার ও বিশিষ্ট লেখক গজেন্দ্রকুমার মিত্রের অনুরোধে তিনি ভ্রমণ কাহিনিটি লিখেছিলেন। তিনি তখন যে-ডায়েরি লিখেছিলেন, তার অবলম্বনেই ‘অভিযাত্রিক’ লেখেন। তিনি চোখের দেখা আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে সে-ডায়েরি রচনা করেছিলেন। তিনি মূলত নরসিংদী ভ্রমণ শেষে ট্রেনে ঢাকায় গিয়েছিলেন। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে স্টিমারে গোয়ালন্দ যান। গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনযোগে কলকাতার শিয়ালদা গিয়ে পৌঁছেন। তাই আমার ধারণা, তখন তার ডায়েরিতে ঘোড়াশাল রেলস্টেশন এবং শীতলক্ষ্যা নদীর উল্লেখ করেছিলেন। ‘অভিযাত্রিক’-এর পাণ্ডুলিপি করার সময় তথ্যের কিছুটা হেরফের হয়েছে। যা তাঁর সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত বিষয় ছিলো।

বিভূতিভূষণ নরসিংদীতে যখন যান, তখন জনপদটি অজপাড়াগাঁ। প্রশাসনিক কাঠামো বলতে সেখানে মেঘনা নদীর তীরে একটি কোতঘর (রাজস্ব কেন্দ্র) ও একটি ছোটো পুলিশ ফাঁড়ি ছিলো। মেঘনা ও হাড়িধোয়া নদীর সঙ্গমস্থল ঘেঁষে একটি ছোটো হাট বসতো, যা ‘কৃষ্ণগঞ্জ বাজার’ হিসেবে পরিচিত ছিলো। স্থানীয় জমিদার ললিতমোহন রায় বিএবিএল তাঁর দাদা কৃষ্ণচন্দ্র পাল (রায়)-এর নামে বাজারটি গড়ে তুলেছিলেন। পুলিশ ফাঁড়িটিও তাঁর উদ্যোগে গড়ে ওঠে। তবে অন্যান্য কাঠামো ছিলো গ্রামীণ, কাচা ঘরবাড়ি, মেঠোপথ। কৃষি এবং মৎস্য শিকার করে অধিকাংশ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতো। বিভূতিভূষণের বিবরণে সেই গ্রামীণ আবহ ফুটে ওঠেছে। তাঁর বর্ণনায় পাওয়া যায়, “অজপাড়াগাঁয়ের স্কুল। পূর্ববঙ্গের একটি ক্ষুদ্র গ্রাম স্কুলের শিক্ষক যাদের সকলেরই বাড়ি এখানে, হেডমাস্টার আর হেডপণ্ডিত এই দুজন মাত্র বিদেশী। আমার বন্ধু ছাত্রজীবনে পড়াশুনায় ভালো ছিলেন, খুব স্মার্ট, ভালো ক্রিকেট খেলোয়াড়, চেহেরাও খুব সুন্দর। এহেন স্টাইলবাজ, সুপুরুষ, ইংরেজিতে উঁচু সেকেন্ড ক্লাশ পাওয়া ছেলে মাত্র ষাট টাকা মাইনেতে এই সূদূর ঢাকা জেলার এক পাড়াগাঁয়ে এসে আজ তিন বছর পড়ে আছে। চাকুরির বাজার এমনি বটে।”

ইংরেজিতে এমএ করা মেধাবী বন্ধুর এই চাকুরি নিয়ে বিভূতিভূষণ হতাশা প্রকাশ করলেও নরসিংদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে বেশ প্রশংসা করেন, “এখানে আর কিছু না হোক প্রাকৃতিক দৃশ্য হিসাবে জায়গাটা ভাল। গ্রামের বাইরে দিগন্ত-বিস্তীর্ণ মাঠ মেঘনার তীর ছুঁয়েচে, তারই মাঝে মাঝে ছোট বেত ঝোপ, মাঝে মাঝে বুনো শটির গাছ। এদিকে একটা ছোট খাল। স্কুলের বাড়িটি এই ছোট খালের ধারে, বড় বড় ঘাসের বলের আড়ালে, নিকটে লোকালয় আছে বটে কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে হয় অস্ট্রেলিয়ায় বা দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মধ্যে এসে পড়েছি কোন মায়া বলে।”

বিভূতিভূষণ স্কুলের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, “স্কুল বাড়ির পাশে বোর্ডিং। তিন চারটি বড় বড় ঘর, সেগুলির মেঝে হয়নি এখনও, সুতরাং মাটির সঙ্গে প্রায় সমতল, অত্যন্ত নিচু ভিতরে ওপর বাড়িটা গাঁথা। আমার বন্ধুর কথামতো একটি ছেলে আমার সঙ্গে করে এনে বোর্ডিংয়ের একটা ঘরে বসিয়ে রেখে গেল। আমার বন্ধুটি এই ঘরে থাকেন। একটা কাঠের তক্তপোশ, তার ওপর আধমালা একটা বিছানা, আর তার ওপর খানকতক বই বিছানো। অন্যদিকে কতকগুলো চায়ের পেয়ালা, একটা স্টোভ, দুটি টিনের তোরঙ্গ, একজোড়া পুরোনো জুতো ইত্যাদি। হেডমাস্টারের জন্য বোর্ডিংয়ের এই ঘরটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বুঝলাম।”

বিভূতিভূষণের বন্ধুটির নাম কী? তিনি বন্ধুর স্বভাব-চরিত্র নিয়ে অনেক কথা বলেছেন, “কলকাতার পটুয়াটোলার মেসে থাকার সময় বন্ধুটি যে চালবাজি করতো, সাটিরপাড়া স্কুলেও সে চালবাজি অব্যাহত রেখেছে। শিক্ষকদের অবজ্ঞা করা, তাদেরকে কথায় কথায় ছোট করা এমন কি ওদের দিয়ে চা বানানো ও রান্নাবান্নার কাজ পর্যন্ত করিয়ে নিচ্ছেন। অথচ তিনি প্রচার করছেন, শিক্ষকরা অযোগ্য বলেই তাকে তোষামোদ করেন। অযথা তাদের থাকার ঘরে এসে নানা ফুটফরমাইশ খাটে।”

বিভূতিভূষণ সেই প্রধান শিক্ষকের নাম উল্লেখ না করলেও আমার গবেষণা ও অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, সেই হেডমাস্টারের নাম দীনেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এমএ। তিনি তিন বছর উক্ত স্কুলে ছিলেন। তিনি ছিলেন স্কুলের ষষ্ঠ হেড মাস্টার। করুণাময় গুহ বিএবিটি চলে যাওয়ার পর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ললিতমোহন রায় সংবাদপত্রে হেডমাস্টার চেয়ে বিজ্ঞাপন দিলে দীনেশচন্দ্র চাকুরির আবেদন করে উত্তীর্ণ হন। তিনি আসার আগে সাটিরপাড়া স্কুলের উপর অনেক ঝড়-তুফান যায়। একটি স্বার্থান্বেষী মহল ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে পুকুরের পূর্ব-পশ্চিম পাশে অবস্থিত স্কুলের টিনের চৌচালা দুটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। তখনকার প্রধান শিক্ষক করুণাময় গুহ ও প্রতিষ্ঠাতা ললিতমোহন রায়ের চেষ্টায় সেখানে স্থাপনা পুনর্নির্মিত হয়। স্কুলে হেডমাস্টারের তালিকা বোর্ডে করুণাময়ের পর জে এল লাহিড়ীর নাম রয়েছে। কিন্তু তিনি ছিলেন এমএবিটি। পরের জন ছিলেন সিম্পল এমএ। বিভুতিভূষণের বন্ধুও এমএ পাস ছিলেন। তাই আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যখন নরসিংদী আসেন, তখন সেখানকার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন দীনেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সাটিরপাড়া স্কুল ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে বিটি পাস করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি পেয়ে বিলেত চলে যান উচ্চশিক্ষার জন্যে। বিলেত থেকে এসে তিনি ভারত সরকারের শিক্ষা বিভাগে উচ্চতর পদে যোগ দিয়েছিলেন। এসব তথ্য বিভূতিভূষণের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়।

বিভূতিভূষণের নরসিংদীর স্মৃতিতে কিছু চমকপ্রদ বিষয় জানা যায়। তিনি সাটিরপাড়া গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলেন। স্কুলের ড্রয়িং মাস্টার হরনাথের সঙ্গে তার ভাব হয়ে গিয়েছিলো। এমনকি তাঁর বাড়িতে পর্যন্ত বেড়াতে গিয়েছিলেন। এমন সাদাসিদে মাটির মতো শিক্ষকের প্রেমে পড়ে তিনি সাটিরপাড়া স্কুলে শিক্ষকতার পেশা নেয়ার অভিমতও প্রকাশ করেছিলেন। ড্রয়িং মাস্টারের ভাইঝি মঞ্জুর সঙ্গে অনেক কথা বলেছেন। তার হাতে বানানো পান খেয়েছেন। তারপর হরনাথের স্ত্রীর হাতের চা-নাস্তা খেলেন, যা খেয়ে বিভূতিভূষণ ভীষণ প্রশংসা করেন।

নরসিংদী বেড়ানোর সময় বিভূতিভূষণ সাটিরপাড়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক, সহকারি শিক্ষকদের দেয়া একটি ভোজ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সে-উপলক্ষে এক এলাহি কাণ্ড ঘটেছিলো, যা তিনি অনেকদিন মনে রেখেছিলেন। স্কুলের হলে রান্নাবান্নার মহাকাণ্ড চলছে। সবই বিভূতিভূষণের সম্মানে হচ্ছে। বড়ো ডেকে পোলাও চড়েছে। প্রকাণ্ড বড়ো দুটি মাছ কোটা হচ্ছে। আরো দুয়েক ডেক পোলাও রাঁধবার মাল-মশলা ডালায় সাজানো রয়েছে। শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারী সবাই এসবের দেখভাল নিয়ে ব্যস্ত। কেউ তদারকি নিয়ে ব্যস্ত। কোথায় খাওয়ার পাতা সাজানো হবে, সব ঠিকঠাক করছেন। হেডমাস্টার আর বিভূতিভূষণকে মাঝখানে বসিয়ে সবাই খেতে লাগলেন। একই সঙ্গে চলছে নানান গল্প। একজন শিক্ষক বললেন, “আমাদের দেশ আপনার কেমন লাগলো?” বিভূতিভূষণ জবাব দিলেন, “বড় ভালো লেগেছে। পূর্ববঙ্গের লোকের প্রাণ আছে।”

এভাবে কয়েকটি দিন কেটে গেলো। তবে নরসিংদী ভ্রমণে তাঁর সবচে’ ভালো লাগার জিনিস ছিলো চাঁদনী রাতে মেঘনা নদীর অপূর্ব দৃশ্য অবলোকন, যা তিনি স্মৃতিকথায় লিখেছেন। এক সন্ধ্যায় বন্ধু হেডমাস্টারকে নিয়ে স্কুল থেকে সিকি মাইল পূর্বদিকে মেঘনার পাড়ে বেড়াতে গেলেন। জ্যোৎস্না রাতে মেঘনার তরঙ্গভঙ্গ দেখার লোভ সামলাতে পারলেন না বিভূতিভূষণ। তিনি ভ্রমণ কাহিনিতে বললেন, “বন্ধুকে নিয়ে আমরা গেলুম মেঘনার ধারে। ওপারে কি একটা গ্রাম, এপারে দিগন্ত-বিস্তীর্ণ প্রান্তর, মাঝে মাঝে বাঁশবন, বনঝোপ। নোয়াখালী জেলার মেঘনা যতখানি চওড়া দেখেছি, এখানে নদী তার চেয়ে ছোট। তবুও আমার মনে হলো জলরাশির এমন শোভা দেখেছিলুম শুধু কক্সবাজারের ও মংডুর সমুদ্রতীরে। সন্দ্বীপের তালাবন-শ্যাম-উপকূল-শোভা সেই এক সন্ধ্যায় স্টিমারের ডেক থেকে প্রত্যক্ষ করে মনে যে আনন্দ পেয়েছিলুম, আজও যেন সেই ধরনের আনন্দই আবার ফিরে এল মনে।”

বিভূতিভূষণ নরসিংদীর যে-মেঘনা অবলোকন করেছিলেন, সেটা বর্তমানে নেই। স্কুল থেকে সিকি মাইল দূরত্বের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, সেখানে এখন অসংখ্য ঘরবাড়ি, মিল-কারখানা, জুট মিল। তিনি যখন মেঘনার পাড়ে গিয়েছিলেন, তখন নদীর তীর ঘেঁষে শুধুমাত্র রামদাস বাউলের আখড়া ছিলো। আখড়াটি অনেক পুরোনো। ধারণা করা হয়, প্রায় ৪০০ বছর আগে রামদাস বাউল সেখানে অবস্থান করেছিলেন। তাঁর বংশধররা পরম্পরায় মেঘনা নদীর তীরে বসবাস করছেন। তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এলাকাটি বাউলপাড়া হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে সেখানে বাৎসরিক বাউল মেলা হয়ে আসছে। মেঘনার তীরে সে-মেলায় দেশ-বিদেশ থেকে বাউল সম্প্রদায়ের লোকজন অংশগ্রহণ করে থাকে। মেলা ছাড়াও আশ্রমধামে বাউলসঙ্গীত পরিবেশন হয়। রামদাস বাউল অসংখ্য গান রচনা করেছেন।

স্বল্প সময়ে বাংলা সাহিত্যের শক্তিশালী লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নরসিংদী ভ্রমণে এসে এখানকার মানুষের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। সুন্দর পরিবেশ তাঁর মনে গেঁথে যায়। যা তাঁর ভ্রমণ কাহিনিতে ফুটে ওঠেছে। তিনি স্কুলে শিক্ষকতা সূত্রে নরসিংদী থেকে যাবারও আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু নরসিংদীপ্রেমী এই সাহিত্যিকের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই স্থানীয়ভাবে। সাটিরপাড়া স্কুলের বোর্ডিংয়ে বিভূতিভূষণ বসবাস করলেও তার কোনো ডকুমেন্ট স্কুলে নেই। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেও এই সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বিভূতিভূষণ যে স্কুলে এসেছিলেন, সেটাও তাদের জানা নেই। তাই স্কুলের টালির ঘরের সামনে এই মহান সাহিত্যিকের একটি স্ট্যাচু নির্মাণ করা হলে বর্তমান প্রজন্ম ইতিহাসটা অন্তত জানতে পারবে।


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

ভারতের অন্ধকার দূর করেছিলেন নরসিংদীর যে-দুজন ইঞ্জিনিয়ার

সুরেন রায় আর কিরণ রায় নরসিংদীর সাটিরপাড়া জমিদার বাড়ির সন্তান। জমিদারি এস্টেট দেখাশোনা বাদ দিয়ে তাঁরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান সুদূর জার্মানিতে। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরলেন এবং যোগ দিলেন কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু তাঁদের মাথায় খেলা করছিলো অন্য এক বৃহৎ পরিকল্পনা। শিক্ষকতার পাশাপাশি স্বদেশি চিন্তাধারায় কীভাবে ভারতবর্ষের শিল্প-কারখানায় অবদান রাখা যায়, তা নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা শুরু করলেন।

ইলেকট্রিক্যাল বিদ্যায় মেধার পরিচয় দিলেও তখন ভারতবর্ষে যন্ত্রপাতি ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি উৎপাদনের সহজ সুযোগ ছিলো না। তাই তাঁরা জার্মানিতে পড়ালেখা শেষ করে সেখানকার বিদ্যুৎ খাত এবং সরঞ্জাম তৈরির কারখানাগুলো ঘুরে-ফিরে দেখেন। এরপর দুই ভাই সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা দেশে ফিরে বৈদ্যুতিক বাতি তৈরি করবেন। সেইসাথে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল জার্মানি থেকে কীভাবে আমদানি করা যায়, সেসব নিয়ম-কানুন জেনে আসেন।

ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সুরেন ও কিরণ নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে চিন্তা-ভাবনা করতেন। কিন্তু তাঁদের আরেক ভাই হেমেন রায় ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত ও দক্ষ প্রশাসক। একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করা এবং সেখানে সুষ্ঠু উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ বিষয়ে হেমেন ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী। সুরেন-কিরণ-হেমেনের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত, বিদ্যোৎসাহী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী। দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুরে যখন ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তখন পূর্ববঙ্গের অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ ও জমিদারদের সঙ্গে নরসিংদীর সাটিরপাড়ার জমিদাররাও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। যে-কারণে সেই পরিবারের দুই সন্তান জার্মানি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে এসে সরকারি কোনো উচ্চ পদে যোগদান না করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকুরি গ্রহণ করেন।

তৎকালীন ঢাকা জেলার শহরতলী নরসিংদীর ‘রায় জমিদার’ পরিবারের মেধাবী দুই ইঞ্জিনিয়ার কেনো বৈদ্যুতিক বাতি তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিলেন? এর নেপথ্য কারণ কী ছিলো? এই বিষয়ে জমিদার পরিবারের ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, মূলত দেশপ্রেমের বোধ থেকে কারখানাটি গড়ে তোলা হয়েছিলো। সে-সময় ভারতবর্ষে স্বদেশিদের কোনো বাতি তৈরির কারখানা ছিলো না। পুরো ভারতবর্ষে আলো বিতরণের ক্ষেত্রে একচেটিয়া বাজার ছিলো ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে নেদারল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত ফিলিপস ইলেকট্রনিক্স কোম্পানির হাতে। তারা ভারতের বিভিন্ন শহরে আলোর জন্যে বাতি সরবরাহ করতো। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে কলকাতার চৌরঙ্গীতে রাস্তার দুধারে প্রথম বিজলি বাতি লাগানো হয়েছিলো। ১৯৩০-৪১ খ্রিস্টাব্দে ফিলিপস ইলেকট্রনিক্স কোম্পানি (ইন্ডিয়া) ৩২ নম্বর চৌরঙ্গী রোডে ৭৫ জন কর্মচারী নিয়ে প্রথম অফিস প্রতিষ্ঠা করে। এর পর থেকেই ল্যাম্পের বাজার ওদের হাতে চলে যায়।

ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে তখন সিংহভাগ কলকারখানার মালিক ছিলো বিদেশিরাই। বড়ো বড়ো পদ দখল করে আছে ব্রিটিশ আইসিএস অফিসাররা। এমতাবস্থায় বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায় দেশীয় মালিকানায় স্বদেশি কলকারখানা গড়ে তোলার আন্দোলন করে যাচ্ছেন। সাটিরপাড়ার জমিদার ললিতমোহন রায় ছিলেন তাঁর পরিচিত। নেতাজী সুভাষ বোসের সঙ্গে ললিতমোহন কংগ্রেস করতেন। বিপ্লবী আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাই প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তাঁকে একটি ইলেকট্রিক ল্যাম্প কারখানা স্থাপনের জন্যে অনুরোধ করেন।

সাটিরপাড়ার জমিদার ললিতমোহন রায়

ললিতমোহন রায়ের বাড়ির দুই ছেলে সুরেন ও কিরণ এই বিষয়ে জার্মানি থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে এসেছেন। তাই বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অনুরোধ ফেলতে পারলেন না তিনি। তাঁদের (সুরেন ও কিরণের) সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করে কলকাতার কসবা এলাকায় প্রথম কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ফিলিপস প্রতিষ্ঠার ঠিক পরপর ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের দিকে ‘বেঙ্গল ল্যাম্পস’-এর কারখানা চালু হয়। এই নামটি নেয়া হয় প্রফুল্ল চন্দ্রের ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস’ থেকে।

কলকাতায় বেঙ্গল ল্যাম্পসের কারখানা

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বেঙ্গল ল্যাম্পসকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রথমদিকে তারা টাংস্টেন ফিলামেন্ট বাল্ব তৈরি করতো। সেই সময় ফিলিপসের তৈরি সোডিয়াম-মার্কারির জোরালো আলো বাঙালির অন্দরমহলে অনেকটা বেমানান ছিলো। তাছাড়া স্বদেশি যুগে ‘বেঙ্গল’ শব্দটি সবার পছন্দ হলো। ফলে ফিলিপস শব্দটির জায়গায় বেঙ্গল শব্দটি জুতসই হয়ে ওঠে। বাজারে তরতর করে বেঙ্গল ল্যাম্পসের উৎপাদিত বাতির চাহিদা বেড়ে যায। নরসিংদীর সাটিরপাড়ার রায় জমিদার বাড়ির ইঞ্জিনিয়ারদের তৈরি ল্যাম্পের আলো বাঙালির ঘরে ঘরে জ্বলতে থাকে। কারখানা বড়ো হতে থাকে। প্রচুর বেকার লোকের কর্মসংস্থান ঘটে। এই প্রথম কোনো স্বদেশি কারখানার কাছে বিদেশি খ্যাতনামা ফিলিপস কোম্পানির পরাজয় হলো। আর বেঙ্গল ল্যাম্পসও ভারতবর্ষের প্রথম বাতি উৎপাদনকারী কারখানার তকমা অর্জন করে।

তৎকালীন কাগজে বেঙ্গল ল্যাম্পের বিজ্ঞাপন

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা অর্জনের পর বেঙ্গল ল্যাম্পস অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। তাদের বাতির চাহিদা এতোটাই বেড়ে যায় যে, কসবার কারখানার উৎপাদন দিয়ে সেই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছিলো না। তাই ‘বাঙালদের রাজধানী’ বা উদ্বাস্তুদের বস্তি অধ্যুষিত যাদবপুর এলাকায় বেঙ্গল ল্যাম্পসের বড়ো কারখানা গড়ে তোলা হয়। কসবা ও যাদবপুরের কারখানায় ওভারটাইম শুরু হয়। পরবর্তীতে বাংলার আলো পৌঁছে যায় সুদূর ব্যাঙ্গালোরেও। বেঙ্গল ল্যাম্পসের সোডিয়াম আর মার্কারি বাতি বাজার দখল করে নেয়। ১৯৬০-এর দশকে বেঙ্গল ল্যাম্প সর্বভারতীয় সবচে’ জনপ্রিয় বৈদ্যুতিক বাতিতে পরিণত হয়।

কিন্তু এরইমধ্যে বড়ো ভাই সুরেনের সঙ্গে সেজো ভাই কিরণের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বাঙালি সেন্টিমেন্টের কাছে রক্তের সম্পর্ক হেরে যায়। ফলে বেঙ্গল ল্যাম্পসে ভাঙন দেখা দেয়। নতুন কারখানা গড়ে ওঠে বেহালায়। বেঙ্গল ল্যাম্পের পাশাপাশি বাজারে আসে কিরণ ল্যাম্প। এই দ্বন্দ্বে বাঙালির নিজস্ব আলো কমতে থাকে। শেষাবধি এর হাল ধরেন সাটিরপাড়ার জমিদার বংশের শেষ উত্তরসুরী তপন কুমার রায় ও তাপস কুমার রায়। তখন কলকাতায় বামফ্রন্ট সরকারের মহাদাপট। বেঙ্গল ল্যাম্পসের মালিকেরা স্বদেশি আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন। তাঁদের দেশপ্রেম ছিলো প্রশ্নাতীত। যার কারণে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এগিয়ে আসেন। নানাভাবে কারখানাটি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্যে তিনি চেষ্টা-তদবীর করেন।

গত শতকের আট দশকের মাঝামাঝি সময় জ্যোতি বসুর একমাত্র ছেলে চন্দন বসু পড়াশোনা শেষ করার পর কোথায় চাকুরি করবেন, তা নিয়ে অনেকটা দ্বিধায় পড়েন। ঠিক তখনই তপন কুমার রায় এগিয়ে আসেন। চন্দন বসুকে বেঙ্গল ল্যাম্পসে চাকুরি দেন। একজন মুখ্যমন্ত্রীর ছেলে হয়ে কোথায় বড়ো বড়ো ব্যবসা-বাণিজ্য করবেন, মিল-কারখানা প্রতিষ্ঠা করবেন, সেখানে তিনি নাকি একটি কারখানায় চাকুরি করছেন। এ নিয়ে তখন রাজনৈতিক মহলে কাথাবার্তাও উঠেছিলো।

স্বাধীনতার প্রতীক স্বদেশি কারখানাটি রুগ্ন হয়ে ওঠলে তা দাঁড় করানোর জন্যে বামফ্রন্ট সরকার অনেক চেষ্টা করেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেঙ্গল ল্যাম্পসের বাতির ব্যবহার বৃদ্ধি করারও উদ্যোগ নেয়া হয়। রাজ্যের পূর্ত দপ্তর তাদের ল্যাম্প কিনতো। একপর্যায়ে তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্ত্তী ফাইলে নোট দেন, “জ্যোতি বসুর নির্দেশেই তাঁর পুত্রের চাকুরিস্থল বেঙ্গল ল্যাম্পসকে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো।” নোটটি প্রকাশ্যে আসার পর তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। যার ফলশ্রুতিতে পূর্তমন্ত্রীকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিলো। পরে পূর্তমন্ত্রী যতীনবাবু তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন, “জ্যোতিবাবু বললেন, বাঙালি কনসার্ন (বেঙ্গল ল্যাম্প) বলছে যখন, আপনি দেখুন ওদের কিছু অর্ডার বাড়িয়ে দেওয়া যায় কিনা। তবে ফাইলে এ ব্যাপারটার কোনও নোট রাখবেন না। যা আমাদের বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে।” মুখ্যমন্ত্রী বলার পরও পূর্তমন্ত্রী কেনো ফাইলে নোট দিয়েছিলেন? সেটা তিনি করেছিলেন এক আমলার পরামর্শে। তার নাম মোস্তাক মোর্শেদ (পূর্তসচিব)। তিনি মনে করেছিলেন, বেঙ্গল ল্যাম্পসকে বাড়তি বরাদ্দ দেয়ার বিষয়টি নিয়মবিরুদ্ধ। মূলত আমলার পরামর্শ শুনেই যতীনবাবু মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন। তবে জ্যোতি বসু তাঁর ছেলে চাকুরি করেন বলে নয়, মূলত একটি স্বদেশি কোম্পানিকে বাঁচানোর জন্যেই চেষ্টা করেছিলেন। এর খেসারত দিতে হয়েছিলো পূর্তসচিব মোস্তাক মোর্শেদকে। ঘটনার পর তাকে সচিবালয় থেকে সরিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ একটি বদলি করা হয়েছিলো।

১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুলাই বেঙ্গল ল্যাম্পসের কারখানা লে অফ ঘোষণা করা হয়। এরপর কারখানাটি খোলার জন্যে বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। ৪৮০ জন শ্রমিক যুগের পর যুগ অপেক্ষা করেও চাকুরি পাননি। দীর্ঘ ৪২ বছরে অনেক শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে কোনো ফল না পাওয়া গেলেও কারখানা ও শ্রমিক কলোনির কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি আত্মসাতের জন্যে বিভিন্ন চক্র সক্রিয় রয়েছে। জাল দলিল ও ভুয়া ওয়ারিশ সাজিয়ে সম্পত্তি হস্তান্তরের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। তপন কুমার রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র মেয়ে বিদেশে থাকার কারণে সম্পত্তি নিয়ে জালিয়াতিটা আরো বেশি হচ্ছে।


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

দত্তেরগাঁও কাচারির ইতিহাস-ঐতিহ্য

‘কাচারি’ শব্দটি একসময় আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত ছিলো। ‘কাচারি’ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একসময় কাচারি ছিলো অভিজাত জমিদারদের ছোটোখাটো বৈঠকখানা। জমিদার এস্টেটের যাবতীয় জমির খাজনা কাচারি বসিয়ে আদায় করা হতো। জমিদারগণ খাজনা আদায়কে জোরদার করার জন্যে মাঝে-মধ্যে কাচারিতে আসতেন। বলতে গেলে জমিদারিত্বের সময় কাচারিই ছিলো তাদের প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। জমিদারগণ বড়ো বড়ো শহরে থেকে বিলাসী জীবনযাপন করতো। আর ঐ-বিলাসিতার রসদের যোগান দেয়া হতো কাচারির মাধ্যমে লব্ধ নিরীহ প্রজা সাধারণের পরিশ্রমের রক্তমিশ্রিত অর্থ দিয়ে। কোনো কোনো এলাকায়, কোনো শৌখিন জমিদার হয়তো অট্টালিকা ও প্রাসাদোপম কিছু বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু খুব কম জমিদার‌ই সেসব বাড়িতে থেকেছেন। সেসব বাড়ির কিছু অবশিষ্টাংশ এখনো দেখতে পাওয়া যায়, যা নিয়ে আমরা কাব্য করি, দেখতে যাই, পুলকিত হ‌ই। বাংলাদেশে এখনো অনেক নামকরা জমিদার বাড়ির ইট-সুরকির ভগ্নাংশ বিদ্যমান আছে। প্রজাহিতৈষী জমিদার একেবারেই ছিলো না, তা-ও নয়। তবে সংখায় কম।

আমার আলোচ্য বিষয় দত্তেরগাঁও কাচারি। এই কাচারিও একসময় জমিদারদের সুবিধার্থেই চালু হয়েছিলো। কবে, কখন দত্তেরগাঁও কাচারি চালু হয়েছিলো, এখন তা আর কেউ বলতে পারে না। অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে কাচারিটি সর্বশেষ খাজনা আদায় করে দিতো পুরাতন ঢাকায় বসবাসকারী জমিদার বাবু রশিক মোহন চক্রবর্তী ও বাবু মোহনী মোহন চক্রবর্তীকে। তারা ছিলেন সহোদর ভাই। সম্ভবত তাদের বাবা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে উচ্চমূল্য পরিশোধ করে বেনিয়া ইংরেজদের নিকট থেকে এ-জমিদারির পত্তন এনেছিলেন। কিন্তু তাদের ভ্রাতৃ-কলহের কারণে জমিদারি দুইভাগে ভাগ হয়ে দুইটি কাচারি সৃষ্টি করেছিলো। বড়ো কাচারি ও ছোটো কাচারি। খুব সম্ভবত, বড়ো ভাইয়ের বড়ো কাচারি এবং ছোটো ভাইয়ের ছোটো কাচারি। এখনো বড়ো কাচারি ও ছোটো কাচারি মানুষের মুখে মুখে রয়েছে।

দত্তেরগাঁও কাচারি নরসিংদীর শিবপুর উপজেলায় অবস্থিত। শিবপুর সদর হতে প্রায় ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে। দেশের অনেক কাচারিই আজ আগের অবস্থানে নেই। কিন্তু দত্তেরগাঁও কাচারিটির নামডাক অনেক বেশি। সেই জমিদার, জমিদারিত্ব ও পাইক-পেয়াদা না থাকলেও দত্তেরগাঁও কাচারি এলাকার মানুষের কাছে খুবই পরিচিত। দত্তেরগাঁও একটি বৃহত্তর গ্রাম, যার কেন্দ্রবিন্দু কাচারি। এখানে একটি ঐতিহ্যবাহী উচ্চ বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইউনিয়ন পরিষদের সুন্দর কমপ্লেক্স, দুই-তিনটি হাসপাতাল, বাজার, খেলার মাঠ, আগের পুকুর, কেন্দ্রীয় মসজিদ, ঈদগাহসহ অনেককিছু রয়েছে। তাছাড়া শিবপুর হতে পলাশ ও চরসিন্দুরগামী রাস্তার কেন্দ্রস্থলে হ‌ওয়ায় গুরুত্ব অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কাচারির দক্ষিণে বিশাল মাঠ (বন্দ) থাকায় কাচারির পরিবেশ বেশ মনোরম। এলাকার মানুষের মিলনমেলা এটি। এখানে এসে প্রত্যেকের মন আত্মতৃপ্তিতে ভরে ওঠে। গরমের দিনে শরীর জুড়ায়। গ্রামের মানুষের প্রতিদিন এই কাচারিতে না আসতে পারলে যেনো ভালোই লাগে না।

তখনকার দিনে কাচারিতে বহুমুখী কর্মকাণ্ড হতো। এখানে যাতায়ত ছিলো জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনির। লাঠিয়ালদের বড়ো বড়ো লম্বা গোঁফ থাকতো, যা দেখে সাধারণ মানুষ অতি সহজে ভয় পেতো। পাইক-পেয়াদা, নাজিম, গোমস্তার অভাব পড়তো না। এদের লালন করা হতো শুধুই সাধারণ প্রজাদের ভয় দেখানোর জন্যে, খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্যে। জমিদাররা স্থানীয়ভাবে চোর-বাটপারও পালন করতো, যাদের ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করা হতো। লাঠিয়াল বাহিনি লাঠিখেলা দেখাতো। উদেশ্য ছিলো, লাঠি খেলার অভিনব কৌশল দেখে মানুষ ভয় পেয়ে আগে আগেই যেনো খাজনাপাতি দিয়ে দেয়। চৈত্র-বৈশাখ মাসে পুণ্য নামের অনুষ্ঠান করা হতো। এ-সমস্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা নিজেদের পুণ্য হাসিল করতো। প্রজাদের গুড়, মুড়ি ও বাতাসা খাইয়ে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা হতো।

জমিদারদের জমিদারি দেখাশোনা করতো নায়েবরা। বিশেষ করে, সঠিকভাবে খাজনা আদায় করাই ছিলো নায়েবদের প্রধান কাজ। জমিদারের মনোরঞ্জন করে চলতে হতো তাদের। কোনো নায়েবের খাজনা আদায় সন্তোষজনক না হলে নিমিষেই জমিদাররা নায়েব পরিবর্তন করে ফেলতো। আবার নায়েবগণ‌ই ছিলেন জমিদারির নিম্নস্তরের প্রশাসক। তখনকার নায়েব পদটি উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ছিলো। নায়েব থেকে এ-দেশে ন‌ওয়াব উপাধি এসেছে বলেই জানা যায়। যতোটুকু জানা যায়, মুঘল আমলে এই নায়েব পদের সৃষ্টি। সেই আমলে সুবাহের প্রতিনিধি হিসেবে নায়েবগণ‌ই সবকিছুর দেখাশোনা করতেন। অনেক নায়েব ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন ছিলেন এবং জনগণ তাদের বিশ্বাসও করতেন। তারা সাধারণ প্রজাদের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হতেন। স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে প্রজা সাধারণের সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করাসহ খাজনাপাতি কমিয়ে দেয়া অথবা মওকুফের চেষ্টা করতেন। আবার এমনও নায়েব ছিলো, যারা প্রজাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করতো। যেকোনো প্রকারে খাজনা আদায় করে জমিদারদের খুশি রাখতো। জোর করে প্রজাদের গরু-ছাগলসহ অন্যান্য দ্রব্যাদি নিয়ে এসে সস্তা দামে বিক্রি করে খাজনা মিটাতো। অত্যাচার আর নির্যাতনে মানুষকে অশান্তিতে রাখতো। আমরা নাটক-সিনেমায় এখনো অত্যাচারী অনেক নায়েব দেখি। তারা কীভাবে জমিদারদের খুশি করে, তা-ও দেখি। বর্তমান সময়েও অনেক ভূমি অফিসে নায়েব রূপের পদ আছে, যাদের কীর্তি-কলাপের কথা আমরা প্রায়‌ই শুনি। তাদের অনেকে পুরাতন দিনের নিষ্ঠুর নায়েবদের প্রতিরূপ। সরকার সাধারণ মানুষের ভূমি রক্ষার্থে যুগোপযুগী আইন প্রণয়নের চেষ্টা করছে, যেটি খুব‌ই আশাপ্রদ খবর। সেই সময় দত্তেরগাঁও কাচারিতে নায়েবরূপে কাজ করে অনেকেই সুপরিচিতি অর্জন করেছিলেন। তাদের অনেকের নাম এখনো মানুষের মুখে মুখে। কাচারির শেষদিকে এমন সুনাম অর্জনকারী কয়েকজন নায়েবগণের মধ্যে প্রথমেই আসে মরহুম আবদুল গফুর খানের নাম। অন্যান্য সুপরিচিত নায়েবের মধ্যে প্রয়াত রাম মোহন দত্ত, মরহুম অলফু খান, মরহুম জাফর আলী ভূঁইয়া, মরহুম আলমাছ খান, মরহুম তোফাচান, মরহুম আমীন‌উদ্দীন খান ও মরহুম রাইজ‌উদ্দীন খানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৬ সালের পর জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের ফলে জমিদারসহ সবাই এসব কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েন।

দত্তেরগাঁও কাচারির ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমে অনেককিছুই বলা হয়েছে। আসলে একসময় সারাদেশে কাচারিগুলো ছিলো খুব‌ই তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমান সময়ে তা আর নে‌ই। কিন্তু আমাদের দত্তেরগাঁও কাচারির নামডাক মনে হয় আগের চেয়েও বেশি। বড়ো কাচারির একটি পুকুর ব্যতিত এ-কাচারির স্থাপনা থেকে শুরু করে কোনোকিছুই অবশিষ্ট নেই। কিন্তু বর্তমান আধুনিক অবকাঠামোয় আমাদের কাচারি অপরূপ রূপে সজ্জিত। এই কাচারির জন্যে এলাকার সকল মানুষের মন ব্যাকুল হয়ে থাকে। কাচারির মাঠে ফুটবল খেলা নিয়ে অনেকেই স্মৃতিচারণ করেন। অনেকে খুঁজে বেড়ায় কাচারির, শৈশবের বন্ধুদের, খেলার সাথীদের অম্লমধুর স্মৃতি। বিদেশ-বিভূঁইয়ে থেকেও অনেকে স্বজনদের সাথে আলাপচারিতার ফাঁকে কাচারি প্রসঙ্গে কথা বলেন। সময়ের বিবর্তনে সবকিছুই শেষ হয়ে যায়, পরিবর্তন আসে। তবে আমাদের দত্তেরগাঁও কাচারির কথা মানুষের হৃদয় ও মন থেকে মুছে যাওয়া খুব‌ই কঠিন হবে।


নূরুদ্দীন দরজী
সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার

বিপ্লবীদের আত্মগোপনের অভয়কেন্দ্র ‘রায়পুরা’

বিপ্লবী ইলা মিত্র ও তাঁর স্বামী রমেন মিত্র

তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী, নাচোলের রাণীখ্যাত ইলা মিত্রের স্বামী কমরেড রমেন মিত্র দীর্ঘদিন নরসিংদীর রায়পুরায় আত্মগোপনে ছিলেন। তেভাগা আন্দোলনের জনক হাজী মোহাম্মদ দানেশ হলেও এই আন্দোলন সংগঠনের পেছনে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন রমেন মিত্রের স্ত্রী ইলা মিত্র। ইলা মিত্র ও তাঁর স্বামী রমেন মিত্র কমিউনিস্ট পার্টি থেকে নির্দেশ পেয়ে দিনাজপুর, রংপুর ও পাবনার বর্গাচাষিদের সংগঠিত করতে থাকেন। এ-আন্দোলনের এক পর্যায়ে উত্তেজিত বর্গাচাষিরা পিটিয়ে পাঁচ পুলিশ হত্যা করলে সরকার সেনাবাহিনি তলব করলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়।

তখন তেভাগা আন্দোলনের অনেক নেতাকর্মী গা ঢাকা দেন। রমেন মিত্র হুলিয়া মাথায় নিয়ে চলে আসেন নরসিংদীর রায়পুরায়। এসে আত্মগোপন করেন রায়পুরার হাসিমপুরের রমানন্দ সূত্রধরের বাড়িতে। রায়পুরায় আত্মগোপনে থেকেও রমেন মিত্র গোপনে সংগঠনের কাজ চালাতে থাকেন। রমেন মিত্রের সাথে পরিচিত হন তরুণ আব্দুস সাত্তার, হরিপদ কর্মকার ও ফজলুল হক খোন্দকার। আব্দুস সাত্তার মেম্বারের বাড়িও হাসিমপুর গ্রামে। তিনিই রায়পুরা আর কে আর এম উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র ফজলুল হক খোন্দকারকে রমানন্দ সূত্রধরের বাড়িতে নিয়ে যান রমেন মিত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে। রমেন মিত্র জমিদারের সন্তান, নিজেও ছোটোখাটো জমিদার, তবু তার কথাবার্তা শুনে তরুণ খোন্দকার খুব উজ্জীবিত হন। পরে অবশ্য কৃষকনেতা হাতেম আলী খানের কাছ থেকেও ফজলুল হক খোন্দকার বাম রাজনীতির দীক্ষা পান। ঐ-সময় খোন্দকার নবম শ্রেণির ছাত্র হলেও বয়সের দিক থেকে তখন তিনি বিশ বছরের যুবক। কারণ তিনি প্রায় দশ বছর কওমি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে রায়পুরা আর কে আর এম স্কুলে এসে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। মাদরাসার পড়ালেখা ছাড়ার কারণ হিসাবে তিনি পরবর্তীতে মন্তব্য  করেছিলেন, মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা একমুখী, ক্রটিপূর্ণ ও গতানুগতিক।

ব্রিটিশ শাসনের শেষদিকে রায়পুরার পিরিজকান্দির সৃষ্টিধর খলিফার বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন নিষিদ্ধ বিপ্লবী সংগঠন ‘যুগান্তর’-এর সদস্য বিপ্লবী মধু ব্যানার্জি। সৃষ্টিধর খলিফারও রমানন্দ সূত্রধরের বাড়িতে যাতায়াত ছিলো। পলাশের বিজয় চ্যাটার্জি প্রায়ই রায়পুরায় এসে গোপন সভা করতেন। এসব গোপন সভা বসতো রমানন্দ সূত্রধরের বাড়িতে, কমরেড অজয় রায়ের স্ত্রী জয়ন্তী রায়ের বাড়িতে (কমরেড আকাশ পালের বোন), শ্রীরামপুরে কমরেড ফটিক রায় চৌধুরীর বাড়িতে, রহিমাবাদের রমেন ডাক্তারের বাড়িতে। রমানন্দ সূত্রধরের পূর্বপুরুষ ভীম সূত্রধরের মধ্যেও বিপ্লবী রক্তধারা প্রবাহিত ছিলো। তারই পৌত্র রমানন্দ সূত্রধর দাদার বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গোপনে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ঝাণ্ডা ধরে রেখেছিলেন।

১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা ঘোষণা করলে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা আরো টালমাটাল হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার ছয়দফাকে পাকিস্তান ভেঙে ফেলার ষড়যন্ত্র মনে করলে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। ইতিহাসে এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। সেই সময় থেকে সারা বাংলায় বিভিন্ন নেতাদের বিরুদ্ধে হুলিয়াসহ ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। এই সময়ে অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী অনেক দিন আত্মগোপনে থাকেন ভাটের চরের কমরেড শামসুল হক সাহেবের বাড়িতে এবং হাসিমপুরে রমানন্দ সূত্রধরের বাড়িতে। ষাটের দশকে অনেক বাম নেতা রায়পুরায় আত্মগোপনে ছিলেন। এদের মধ্যে কৃষকনেতা জিতেন ঘোষ, অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী, কমরেড সুচিত চক্রবর্তী, কমরেড নেপাল নাগ, রবি নিয়োগীসহ অনেকে।

রমানন্দের স্ত্রী রেণুবালা একজন করিৎকর্মা মহিলা ছিলেন। বিশেষ করে অতিথি-বেড়াল আপ্যায়নে তার জুরি মেলা ভার। এই সাহসী নারী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গুপ্তচরের কাজ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর আদান-প্রদানে নিঃশঙ্কচিত্তে সহযোগিতা করেছেন। রমেন মিত্র নরসিংদীর রায়পুরায় দ্বিতীয়বার আত্মগোপনে এসেও রমানন্দ সূত্রধরের বাড়িতেই থেকেছিলেন। তার কারণ হয়তো একটিই, রমানন্দের স্ত্রীর নির্ভেজাল আতিথেয়তা।


মহসিন খোন্দকার
সাধারণ সম্পাদক, প্রগতি লেখক সংঘ, নরসিংদী

স্বশিক্ষিত প্রত্নবিদ ও লোকসাহিত্যের নিভৃতচারী সাধক মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান

নিভৃতচারী, আত্মপ্রচারবিমুখ, সত্যনিষ্ঠ, আদর্শবান, স্বশিক্ষিত ও সাদাসিধে একজন মানুষের নাম মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান। বাবা মোহাম্মদ হানীফ পাঠান সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং প্রত্নতত্ত্বের একজন বিরল প্রতিভাসম্পন্ন সাধক ছিলেন। ছিলেন শিক্ষা, সমাজসেবা সাময়িকপত্রের সম্পাদক, লোকসাহিত্য-সংস্কৃতির গবেষক। কথিত আছে, এই পাঠান পরিবার সুদূর আফগানিস্তান থেকে ষোড়শ শতকে ভারতে আসে এবং তাদের বংশধররা ভাগ্যান্বেষণে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বটেশ্বর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। বটেশ্বর বর্তমান বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার একটি বিখ্যাত গ্রাম। বটেশ্বরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম উয়ারী। উয়ারীবটেশ্বর খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থান এবং এখন দেশ-বিদেশখ্যাত। এই উয়ারী-বটেশ্বরকে দেশ-বিদেশখ্যাত করা এবং বর্তমান প্রত্নআলোচনা-প্রত্নগবেষণার জন্যে যিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন, তিনি হানীফ পাঠান। তাঁরই সুযোগ্য সন্তান মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান।

মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠানও বাবার আদর্শ ধারণ করে গ্রামের মানুষের জীবন আলোকিত করার জন্যে শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করেন। বাবা বাঙালি জাতির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শিকড় অনুসন্ধান করেছেন, লোকসাহিত্য-লোকশিল্প সংগ্রহে ব্রতী হয়েছিলেন। চর্চা করেছিলেন লোকসাহিত্যের। হাবিবুল্লাহ পাঠানও বাবার উত্তরাধিকার হিসেবে প্রত্ননির্দশন সংগ্রহ, প্রত্নগবেষণা এবং লোকসাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় ব্রতী হন। ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন : উয়ারী বটেশ্বর’ গ্রন্থের প্রসঙ্গকথায় হাবিবুল্লা পাঠান উল্লেখ করেন :

বাংলাদেশের প্রত্নক্ষেত্র সমূহের মধ্যে উয়ারী বটেশ্বর প্রাচীনতম। অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক সম্ভাবনা অদ্যাবধি সুধীজনদের অজ্ঞাত থেকে যেতো যদি শ্রদ্ধেয় পিতা মোহাম্মদ হানীফ পাঠান সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত না করতেন। ১৩৪০ (১৯৩৩) সালের পৌষ মাসে উয়ারী গ্রামে মাটি খননকালে আকস্মিকভাবে আবিষ্কৃত হয় অনেক ছাপাংকিত রৌপ্যমুদ্রা। এগুলোর অধিকাংশ শ্রমিকেরা বেনের কাছে বিক্রয় করে ফেলে। স্বল্প সংখ্যক মুদ্রা আব্বাজানের হস্তগত হয়। তিনি এগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করেপ্রাচীন মুদ্রা প্রাপ্তিশীর্ষক ছোট্ট সংবাদ সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে ছাপেন। এরপর থেকে স্থানের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল বেড়ে যায়। ছেলেবেলা তিনি এখানকার মাটিতে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা মূল্যবান পাথরের গুটিকা কুড়াতেন। দীর্ঘদিন তিনি মুদ্রা গুটিকাগুলো সযত্নে রক্ষা করেন।

১৯৫৫ সালে আমি যখন অধুনালুপ্ত বাজনাব সবুজ পল্লী হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন তিনি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। পিতাপুত্র একসঙ্গে স্কুলে যেতে উয়ারী গ্রাম অতিক্রমকালে তাঁকে প্রায়ই দেখতাম নিবদ্ধ দৃষ্টিতে পথে পথে কি খুঁজছেন। এভাবেই তিনি মূল্যবান পাথরের গুটিকা খুঁজে পেতেন। পিতার অনুসন্ধান তৎপরতায় আমার বালক মনের উৎসুক্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। যেদিন আমি বড়ো আকৃতির সুদৃশ্য দুটো গুটিকা খুঁজে পাই সেদিন আমার আনন্দ দেখে কে? তিনি প্রায়ই এখানকার প্রাপ্ত নিদর্শন কিংবদন্তী খ্যাত অসম রাজার গড়ের কাহিনী বলতেন। এমনি করে আমিও পিতার অনুসরণে নানা নিদর্শন সংগ্রহে তৎপর হয়ে উঠি। ১৯৫৫ সালের জানুয়ারীর প্রথম দিকে বটেশ্বর গ্রামে মাটিখননকালে কয়েকটি ত্রিকোণাকার লৌহকুঠার শ্রমিকরা পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে গেলে আমি সেগুলো কুড়িয়ে নিই। এগুলো আব্বাজানকে দেখালে তিনি স্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত হন এবং একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। প্রবন্ধটি দৈনিক আজাদ এর রবিবাসরীয় সংখ্যায় (৩০ জানুয়ারী ১৯৫৫) ‘পূর্ব পাকিস্তানে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতাশিরোনামে মুদ্রিত হয়। তিনি কিছু নিদর্শন সংগ্রহ করে প্রবন্ধটি লিখে যেন অলক্ষ্যে একটা গুরুদায়িত্ব আমার স্কন্ধে তুলে দেন। সে সময় থেকে শুরু করে অদ্যাবধি অঞ্চলের ঝোপে জঙ্গলে, খনিতস্থানে, চষাভূমিতে, পথেঘাটে অনেকটা নেশাগ্রস্তের মতো নানা নিদর্শন সংগ্রহে ব্যাপৃত থাকি।

এভাবেই প্রথমত বাবা মোহাম্মদ হানীফ পাঠান এবং পরবর্তীতে সন্তান মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠানের প্রকাশিত নানা লেখা, গ্রন্থ, জাদুঘরে নানা প্রত্ননিদর্শন জমা, প্রত্নগবেষকদের কাছে ধর্না— এসবের মাধ্যমে সকলের দৃষ্টিগোচরে আসে উয়ারী-বটেশ্বর। শুরু হয় প্রত্নতত্ত্ববিদদের পরিদর্শন, প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ এবং গবেষণা। শেষে ২০০০ সাল থেকে শুরু হয় প্রত্নখনন কাজ, যার নেতৃত্ব দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। এখনো পর্যন্ত অনেক দফায় খনন কাজের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ননিদর্শন পাওয়া গেছে। উয়ারী-বটেশ্বর এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল মিলিয়ে এই পর্যন্ত ৫০ টি প্রত্নস্থান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাথর, হাতিয়ার, মুদ্রা, পাথরের গুটি, পুঁতি, নানা ব্যবহার্য সামগ্রী, মৃৎপাত্র, গর্ত-বসতি, রাস্তা, দুর্গ-নগরী এবং প্রাচীনতম মহাজনপদ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসকে নতুন করে জানার ও লেখার পথ উন্মুক্ত করেছে।

এসব নিদর্শন আবিষ্কার, গবেষণাকর্ম, খনন-ইতিহাসসহ নানা প্রসঙ্গ নিয়ে সুফি মোস্তাফিজুর রহমান এবং মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠানের যৌথ প্রচেষ্টায় ‘উয়ারী-বটেশ্বর : শেকড়ের সন্ধানে’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১২ সালে, যা প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার ও আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার লাভ করে।

বাংলাদেশের শেকড়ের সন্ধান, বিশেষ করে উয়ারী-বটেশ্বরের প্রাচীন ইতিহাস অনুসন্ধানে তাঁর বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা, ইতিহাসখ্যাত দুটি গ্রন্থ (প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন : উয়ারী বটেশ্বর, ১৯৮৯ এবং উয়ারী-বটেশ্বর : শেকড়ের সন্ধানে, ২০১২) রচনা এবং প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ, জাদুঘরে সংরক্ষণ, প্রত্নগবেষণা ও খননকালে তাঁর সহায়তার সকল কর্মের জন্যে এই স্বশিক্ষিত বরেণ্য প্রত্নবিদকে ইতিহাস এবং ভবিষ্যত প্রজন্ম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

শিক্ষকতার পাশাপাশি মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ ও গবেষণা নিয়েই কর্মজীবন শেষ করেননি। তাঁর জীবনের আরেকটি বড়ো কাজ হচ্ছে বাবার মতো লোকসাহিত্যের সংগ্রহ ও গবেষণা। লোকসাহিত্য নিরক্ষর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর লোকমনের সৃজনশীল ফসল। লোকসাহিত্য অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষজনের বাণী সাধনা নয়। লোকসাহিত্য সাধারণ জনমানবের সুখ-দুঃখের বাস্তব অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, যার গভীর সম্বন্ধ বৃহত্তর জনমানবের শেকড়ের সাথে। সেদিক থেকে লোকসাহিত্যের গুরুত্ব অনেক। লোকসাহিত্যের অনেক শাখা। লোককাহিনি, লোককথা, ছড়া, রূপকথা, গীত, গীতিকা, প্রবাদ-প্রবচন, ধাঁধা ইত্যাদি। লোকসাহিত্যের এসব শাখার নিদর্শন সংগ্রহ এবং গবেষণা করেছেন হাবিবুল্লা পাঠান। তাঁর অধিকাংশ গবেষণা গ্রন্থই লোকসাহিত্য-সংস্কৃতিভিত্তিক। হাবিবুল্লা পাঠানের লোকসাহিত্য-নির্ভর প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা দেখলেই তা উপলদ্ধি করা যায় :

বাংলাদেশের লোককাহিনী, ১ম খণ্ড
(নরসিংদীর লোককাহিনী সংগ্রহ), ১৯৯৬

বাংলাদেশের লোককাহিনী, ২য় খণ্ড
(নেত্রকোণার লোককাহিনী সংগ্রহ), ১৯৯৭

বাংলাদেশের লোককাহিনী, ৩য় খণ্ড
(ব্রাক্ষণবাড়িয়ার লোককাহিনী সংগ্রহ), ১৯৯৮

নরসিংদীর কবি-সাহিত্যিক, ১৯৯৬

নরসিংদীর লৌকিক খেলাধুলা, ১৯৯৮

নরসিংদী-গাজীপুরের লোকঐতিহ্য
বিবাহ ও মেয়েলী ছড়াগীত, ২০০০

বাংলাদেশের ভাটকবি ও কবিতা, ২০১২

বাংলা প্রবাদে লোককাহিনী, ২০১২

নরসিংদীর স্থাননাম উৎস ও বৈশিষ্ট্য সন্ধান, ২০১৬

নরসিংদীর লোককবি, ২০১৮

প্রত্যেকটি গ্রন্থেই তাঁর কাজের সযত্ন স্বাক্ষর রয়েছে। দেরিতে হলেও লোকসাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার ২০২০’ পেয়েছেন। তাঁর এই সম্মানে আমরা নরসিংদীবাসী গর্বিত হয়েছি।

বাংলা লোকসাহিত্যের নানা নিদর্শন সংগ্রহ এবং সম্পাদনা খুব সহজ কাজ নয়। এক্ষেত্রেও হাবিবুল্লা পাঠানের যোগ্যতার স্বাক্ষর সুস্পষ্ট। বাংলাদেশের লোককাহিনী ৩ খণ্ডে প্রকাশিত গ্রন্থের প্রত্যেকটিতে তাঁর সম্পাদনাকর্ম, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকথা এবং কাহিনীগুলোর সযত্ন বিন্যাস লোকসাহিত্যের পাঠক-গবেষকদের মুগ্ধ করেছে। প্রথম খণ্ডে নরসিংদী অঞ্চলের, দ্বিতীয় খণ্ডে নেত্রকোণার এবং তৃতীয় খণ্ডে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা অঞ্চলের সংগৃহীত লোককাহিনী সন্নিবেশিত হয়েছে।

হাবিবুল্লা পাঠানের বাবা হানীফ পাঠান লোকসাহিত্যের অন্যতম শাখা বাংলা প্রবাদ সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও সম্পাদনায় অসাধারণ কাজ করেছেন, যা বিভিন্ন খণ্ডে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে এবং বাংলা লোকসাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠানও বাংলা প্রবাদ সংগ্রহপূর্বক তার সাথে প্রবাদের উৎস অনুসন্ধান এবং প্রতিটি প্রবাদের সাথে লোককাহিনী যুক্ত করে অসাধারণ গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। তাঁর একটি বিশেষ গবেষণামূলক কাজ বাংলাদেশের ভাটকবিতা সংগ্রহ, সংকলন ও সম্পাদনা। ‘নরসিংদীর স্থাননাম উৎস ও বৈশিষ্ট্য সন্ধান’ গবেষণা গ্রন্থটিও তাঁর পরিশ্রমী কাজের আরেকটি বড়ো স্বাক্ষর।

ব্যক্তিগত জীবনে হাবিবুল্লা পাঠান একজন সাদাসিধে ও সরল মানুষ। সাধারণ তাঁর জীবনযাপন। কিন্তু ব্যক্তিত্ব, বাচনভঙ্গি, জ্ঞান-প্রজ্ঞা-মননে সবাইকে মুগ্ধ করেন। কোনো ক্ষেত্রেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি ছিলো না। সকল ক্ষেত্রে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত এই মানুষটি অনেক উঁচু মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন।

স্বশিক্ষাই তো প্রকৃত শিক্ষা। স্বশিক্ষার মাধ্যমেই তো প্রকৃত মানুষ হওয়া যায়, যা পরিশেষে সুশিক্ষায় রূপ লাভ করে। কল্যাণকর ও সৃষ্টিশীল সুশিক্ষাই শ্রেষ্ঠ শিক্ষা। এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষাকে ধারণ করেই হাবিবুল্লা পাঠান সারাজীবন শিক্ষকতা করেছেন। প্রত্নগবেষণা এবং লোকসাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা করেছেন। অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হয়েছেন। জ্ঞানের শক্তিকে ধারণ করে দূর করেছেন সকল অন্ধকার। ইতিহাসের সত্য, সভ্যতার সত্য, জীবনের সত্যকে অনুসন্ধান করেছেন।

প্রকৃত অর্থে, সত্য এবং সুন্দরের প্রকাশই মানবধর্ম। সত্যই আলো, অসত্যই অন্ধকার। হাবিবুল্লা পাঠান ইতিহাসের, সভ্যতার এবং লোকজীবনের প্রকৃত সত্য এবং কল্যাণকে ধারণ করে বড়ো মাপের মানুষ হিসেবে সকলের মাঝে স্থান করে নিয়েছেন। নিভৃত পল্লীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেও হাবিবুল্লা পাঠান নীরব সাধনায় প্রত্নতত্ত্ব ও লোকসাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা এবং গবেষণা করে যে-ফসল রচনা করেছেন, সময়-ইতিহাস-ভবিষ্যত তাঁকে মর্যাদার সাথে বাঁচিয়ে রাখবে।


গোলাম মোস্তাফা মিয়া
সাবেক অধ্যক্ষ, নরসিংদী সরকারি কলেজ

শেখেরচর-বাবুরহাটের আদ্যোপান্ত

হোটেল এক্সের ছাদ থেকে তোলা বাবুরহাট বাজারের ছবি (প্যানোরোমা মুডে)

শেখেরচর-বাবুরহাট। সমগ্র বাংলাদেশের প্রধান বস্ত্রশিল্পকেন্দ্র। সারাদেশ হতে পাইকারি ব্যবসায়ীরা এই হাটে তাদের কাপড় কেনা-বেচা করে। পাবনা-সিরাজগঞ্জ বস্ত্রশিল্পের আরো দুটি কেন্দ্র, কিন্তু শেখেরচর হাটের মতো এতো বিশাল নয়।

শেখেরচর-বাবুরহাটের একাংশ

ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের একদম লাগোয়া পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে নরসিংদী জেলার শীলমান্দী ইউনিয়নে এটি অবস্থিত। এর আয়তন প্রায় ০.১৪ বর্গ কিলোমিটার। তবে আয়তন প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মানুষের চাহিদা বাড়ছে, আর এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশাই হচ্ছে তাঁতবস্ত্র উৎপাদন ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা। তাই প্রায় সবাই এ-ধরনের পেশায় আত্মনিয়োগ করছে। ফলে এই হাটের আয়তন দিন দিন বেড়েই চলেছে। শেখেরচর বাজার বণিক সমিতির দেয়া তথ্য অনুযায়ী এই হাটে স্থায়ী দোকানের সংখ্যা প্রায় তিন হাজারের মতো এবং প্রতি সপ্তাহে এখানে দুশো থেকে আড়াইশো কোটি টাকার লেনদেন হয়। বর্তমানে এই হাটের ব্যবসায়ীদের হাট-কর্তৃপক্ষকে কোনো প্রকার খাজনা দিতে হয় না। তারা সরাসরি সরকারি কোষাগারে রাজস্ব জমা দেন।

(ছবিতে) শেখেরচরবাবুরহাটের মানচিত্র
বহু জায়গায় খোঁজ-খবর ও দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরও শেখেরচর-বাবুরহাটের পুরোনো বা নতুন কোনো মানচিত্র পাওয়া যায়নি। সবশেষে গুগল ম্যাপ, জুম আর্থ এবং বাবুরহাটে সরেজমিন পরিদর্শনের ভিত্তিতে এই মানচিত্রটি তৈরি করা হয়েছে। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলে রাখি, ক্রমশ বাড়তে থাকা এই হাটের সীমানা নির্দেশে একেবারে নিখুঁত মাপ নেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে কিছুটা ভুল-ত্রুটির সম্ভাবনা থেকেই যায়।

সেই প্রাচীন তাম্রযুগ থেকেই এ-অঞ্চল বস্ত্রশিল্পের জন্যে প্রসিদ্ধ ছিলো। আদি মসলিনের সূতিকাগার ছিলো ঢাকা-সোনারগাঁ ও মহেশ্বরদী পরগণার গোটা অঞ্চল। বর্তমান নরসিংদী জেলা মহেশ্বরদী পরগণার অন্তর্ভুক্ত একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিলো।

মাধবদীর ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একসময় আড়ং বসতো। আনন্দী গ্রামের সন্নিকটে ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আড়ং নামের কাপড়ের এই হাট জমজমাট ছিলো। মাধবদী-শেখেরচর তাঁতশিল্পকেন্দ্র হওয়ার নেপথ্যে এই আড়ং নামের হাটের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। এই কাপড়ের হাট ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও এ-অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে হাট চলতে থাকে। কেননা, এ-অঞ্চলে সুতা থেকে কাপড় উৎপাদন প্রায় প্রতিটি গ্রামেই বিদ্যমান ছিলো। এসবের ফলাফলস্বরূপ গত শতকের তিরিশের দশকের প্রথমেই যখন মাধবদীর জমিদারদের দ্বারা সুতা-কাপড়ের হাট প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন একটা স্থায়ী রূপ পায়, যা অদ্যাবধি চলছে।

মাধবদী হাটে জমিদারদের সঙ্গে পাইকারদের খাজনাকেন্দ্রিক জটিলতায় যখন শেখেরচর বাজারের উৎপত্তি ঘটে, তখন থেকেই ধীরে ধীরে মাধবদী হাট ‘সুতার হাট’, আর শেখেরচর বাজার ‘কাপড়ের হাট’ হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করে।

শেখেরচর-বাবুরহাটে পাইকাররা শুরুতে নদীপথে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন করতো। পরবর্তীতে পঞ্চাশের দশকে মমিন মটর কোম্পানি নরসিংদী-তারাব সড়ক ও তাদের পরিবহন ব্যবসা শুরু করে। পাশাপাশি নরসিংদী-মাধবদী-নারায়ণগঞ্জ রুটে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলে পাইকাররা সড়ক ও রেলপথেও যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন করতে শুরু করে। নদী-সড়ক-রেলপথ একসাথে চালু থাকার কারণে বাবুরহাটের ব্যবসায়ের পরিধি হু হু করে বাড়তে থাকে। পরর্তীতে অবশ্য রেলপথটি বন্ধ হয়ে যায়।

মাধবদী আর শেখেরচর— এই দুই সুতা-কাপড়ের গুরুত্বপূর্ণ বাজারকে কেন্দ্র করে পঞ্চাশের দশক থেকেই গোটা অঞ্চলে সুতা থেকে কাপড় বুননের দেশি নানান যন্ত্রপাতি থেকে বিদেশি যন্ত্রপাতি আমদানি হতে শুরু করে এবং তা দ্বারা উন্নত মসৃণ কাপড় তৈরি শুরু হয়। এই মেশিনের বিপ্লব একদিনে হয়নি। ধীরে ধীরে নানান বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক ও গতিশীল বস্ত্র উৎপাদনে প্রবেশ করেছে এ-অঞ্চলের তাঁতীরা।

জাপানি তাঁতকল আমদানি করে মাধবদীর আলগী গ্রামের স্কুলশিক্ষক হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রথমে তাঁতে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন, এ-প্রসঙ্গে তাঁকে স্মরণ করা যাক। এরপর থেকে আজ অবধি নানা ধরনের চায়না-জাপানি-কোরিয়ান আধুনিক-উত্তরাধুনিক যন্ত্রপাতি দ্বারা বস্ত্র উৎপাদনের যে-ইতিহাস, তা এই গোটা অঞ্চলকে সুতা ও বস্ত্র উৎপাদনের এক মহাজোনে পরিণত করেছে।

শেখেরচর হাট সপ্তাহে তিনদিন বসে। এখন বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়ে শনিবার শেষ হয়। বৃহস্পতিবার ভোর হতেই সারাদেশ থেকে কাপড়ের পাইকাররা আসতে শুরু করে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা হাটে জনসমাগমের যে-বিস্তার শুরু হয়, তা অভাবনীয়। ভ্যান, রিকশা, নসিমন, ট্রাক, পিকআপ ইত্যাদি যানের এক মহাযুদ্ধ চলে দিনমান। এখানে গলির সংখ্যা কতো, এটা কেউ বলতে পারে না। একেক গলিতে একেক ধরনের বস্ত্র। নানা জাতের বস্ত্র, যা এই হাটে নিত্য কেনা-বেচা হয়, সেসবের নাম জানা যাক। শাড়ি, লুঙি, গামছা, থ্রি-পিছ, শার্টিং, বেডশিট, পর্দা, মশারি, ছাপা কাপড় (ভয়েল, পপলিন, টিসি, টরে, মার্কিন, লালসালু, ক্যানভাস, টুইল, পলিয়েস্টার ইত্যাদি)-সহ আরো বহু ধরনের কাপড় এখানে সহজেই আপনি পেয়ে যাবেন।

১৯৩৬ সালে এই শেখেরচর-বাবুরহাট প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে এই ৮৬ বছর ধরে চলা কাপড়ের হাটটি এই অঞ্চলের অর্থনীতির সার্বিক গতি পরিবর্তন করার সাথে সাথে জাতীয়ভাবেও প্রভূত ভূমিকা রেখেছে। এই হাট দুই কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত মাধবদীর সুতার হাটের অর্থনীতির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। মাধবদীতে সুতা কেনা-বেচা হয়, আগেই বলেছি। কটন, পলিয়েস্টার, টিসি, ডেনিমসহ যাবতীয় সুতার আইটেমের পাইকারি ও খুচরা বাজার এটা। এই সুতার বাজারের সাথে সরাসরি কানেক্টেড নারায়ণগঞ্জের মতো সর্ববৃহৎ সুতার বাজার। সারাদেশে সুতা উৎপাদনকারী কারখানা, অর্থাৎ স্পিনিং মিলগুলো আবার যুক্ত নারায়ণগঞ্জ ও মাধবদীর সাথে।

আসেন, এই বাজারগুলোর পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করি। মাধবদী বাজার থেকে নানা ধরনের সুতা কিনে বস্ত্র উৎপাদনকারী মেশিনঅলারা প্রথমে যে-কাপড় তৈরি করে, তা হলো ‘গ্রে কাপড়’। এটা মোটাদাগে শাদা রঙের হয়। এই কাপড় বিক্রি হয় মাধবদী হাটে। প্রধানত সপ্তাহে একদিন। মঙ্গলবার। এই মঙ্গলবারের গ্রে কাপড়ের বেচা-কেনার উপর নির্ভর করে সারা সপ্তাহের সুতার দর নির্ধারণ ও সুতা বিক্রির পরিমাণ। এই দর নির্ধারণ করে প্রধানত নারায়ণগঞ্জের বড়ো বড়ো সুতা ব্যবসায়ীরা (মাধবদীর বড়ো সুতার ব্যবসায়ীরাও কেউ কেউ যুক্ত থাকেন)। নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীদের সুতার সাপ্তাহিক লেনদেনের দিন হচ্ছে বুধবার। তারা বুধবার মাধবদী মোকাম করেন। তারপর মঙ্গলবারের গ্রে কাপড়ের বেচা-কেনার গতিপ্রকৃতি অবলোকন করে বৃহস্পতিবার পরের সপ্তাহের সুতার দর নির্ধারণ করেন।

এদিকে মাধবদীর ব্যবসায়ীদের গ্রে কাপড় ইতোমধ্যে নানা প্রক্রিয়া (সাইজিং, ডাইং, ক্যালেন্ডারিং ইত্যাদি)-র মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার শেখেরচরের হাটে ওঠে। এখানে বলে রাখা অতীব জরুরি যে, সপ্তাহের তিনদিন শেখেরচরের এই ছাপা কাপড়ের হাটের ভালো-খারাপের সাথে মাধবদী-নারায়ণগঞ্জের সুতার দর নির্ধারণ সরাসরি সম্পর্কিত। সুতা ব্যবসায়ীদের প্রথমেই চোখ থাকে, শেখেরচরের হাট কেমন গেলো এই সপ্তাহে! অর্থাৎ উপরের এই সাইকেল একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মাধবদী-নারায়ণগঞ্জের সমস্ত প্রক্রিয়ার সফল পরিসমাপ্তি ঘটে শেখেরচর হাটে এসে।

বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ ফ্যাশন হাউজগুলো বাবুরহাটের কাপড় দিয়েই তাদের সিংহভাগ চাহিদা পূরণ করে। ‘আড়ং’ নামের অত্যন্ত জনপ্রিয় ও স্বনামধন্য ফ্যাশন হাউজটি টিকেই আছে শেখেরচর-বাবুরহাটের সরবরাহকৃত কাপড় দ্বারা। শেখেরচরে প্রায় শতাধিক টেক্সটাইল আড়ংয়ে কাপড় সরবরাহ করে তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে। গত ২০ বছর ধরেই এটা চলছে এবং ক্রমশ এ-ধরনের টেক্সটাইল মিলের সংখ্যা শেখেরচর ও আশেপাশের এলাকায় বেড়েই চলেছে। আড়ংয়ে মাল দেয়াই তাদের প্রধান বাণিজ্যধরন। ফ্যাশন হাউজ ‘আড়ং’ প্রতিবছর শেখেরচরের ব্যবসায়ীদের নিয়ে বড়োসড়ো মিলনমেলার আয়োজন করে থাকে।

আবার চলে আসি শেখেরচর বাজারের ভেতরে। এই বাজারটিকে উপর থেকে দেখলে খুব ছোট্টো একটি বাজার বলেই মনে হয়। শেখেরচরের হাইরাইজ বিল্ডিং হোটেল এক্সের উপরে উঠে দেখেছি, বিল্ডিং আর টিনশেডের ব্যাপক বিস্তার, তবে আয়তন খুব বড়ো নয়। কিন্তু আসল ব্যাপারটা ঘটে বাজারের একদম ভেতরে প্রবেশ করলে। ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে থেকে হাটের ভেতর যেতে তিনটি প্রবেশমুখ রয়েছে। একটি মাজার বাসস্ট্যান্ড, আরেকটি মধ্য বাসস্ট্যান্ড এবং অন্যটি হলো মূল বাসস্ট্যান্ড (সেই ঐতিহাসিক বাঁকমোড়া নামক স্থান, যেখানে বাজারের গোড়াপত্তন হয়েছিলো)। যেদিক দিয়েই আপনি প্রবেশ করেন না কেনো, ভেতরে ঢোকামাত্রই গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাবেন। ঢাকা শহরের বায়ান্নো বাজার তিপান্নো গলির কথা শুনেছেন নিশ্চয়, কিন্তু এই আপাত ছোট্টো একটা বাজারে যে কয়টি গলি, তা বাজারে অবস্থানকারী দোকানিরাও ঠাহর করতে পারেন না। একেক আইটেমের নামে অবশ্য গলি বা পট্টি রয়েছে। যেমন : লুঙ্গি পট্টি, মশারি পট্টি, গামছা পট্টি, লট পট্টি ইত্যাদি।

শেখেরচর বাজারের আশেপাশের এলাকার লোকজন এই বাজারকে ধারণ করে গত ৮৬ বছরে প্রভূত উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে। তবে এই উন্নতি কেবল অর্থনৈতিক। পাশাপাশি শিক্ষা ও সংস্কৃতির তেমন কোনো উন্নয়ন ঘটেনি।

শেখেরচর-বাবুরহাটের বাজার এখন কেমন যাচ্ছে? অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা কেমন? আমরা অনেক ব্যবসায়ীর সাথে আলাপ করে জেনেছি, ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ ‘সুতার বাজার’। সুতা থেকে ছাপা কাপড় হয়ে শেখেরচরে আসতে যেসব প্রক্রিয়া রয়েছে, সুতার উচ্চ দামের কারণে সেসব ধাপেও খরচ দ্বিগুণ-তিনগুণ ধরতে হচ্ছে। গত এক বছর যাবত সুতার বাজার ভয়াবহ রকমের অস্থিতিশীল। বিশ্ববাজার বা তুলার দাম বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে মাধবদী-নারায়ণগঞ্জের বড়ো বড়ো সুতা ব্যবসায়ীরা সুতার দাম প্রতি সপ্তাহেই আকাশচুম্বী করে রাখে। সরকার এ-বিষয়ে কোনো মনিটরিং করে না। যার ভয়াবহ প্রভাব গোটা বস্ত্রশিল্পকে একটা নাজুক অবস্থায় ফেলে রাখছে।

প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার খ্যাত ‘শেখেরচর-বাবুরহাট’ তার দীর্ঘ ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতায় আপন মহিমায় সারা বাংলাদেশের তাঁতবস্ত্রের যোগান অব্যাহত রেখেছে। এটা শেখেরচর-মাধবদী তথা নরসিংদীর গৌরব।

গত শতকের প্রথমদিকে নরসিংদীর প্রজাঅন্তপ্রাণ জমিদার ললিতমোহন রায় তার দাদার নামে হাড়িধোয়া নদীর পাড়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘কৃষ্ণগঞ্জ’ বাজার। সবধরনের মনোহারি দ্রব্যের পাশাপাশি বাজারটিতে সুতা-কাপড়েরও ছোট্টো একটি বাজার গড়ে ওঠেছিলো। দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা কাপড়ের পসরা সাজিয়ে বসতো। কিন্তু বাজারের খাজনা বৃদ্ধির ধুয়া তুলে পাইকাররা এখানেই প্রথম অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং একজোট হয়ে মাধবদীর জমিদারের কাছে যায় তাদের কাপড়ের হাটের জায়গা দেয়ার জন্যে। জমিদার তাদের জায়গা দেয় এবং ধীরে ধীরে হাট জমজমাট হতে শুরু করে। আর তখনই একই বিপত্তি বাধে। আবার খাজনাকেন্দ্রিক জটিলতা। আবার বিদ্রোহ, অসন্তোষ। পাইকাররা আবার দুই কিলোমিটার উত্তরে তালুকদার হলধর সাহার কাছে হাটের জায়গার আবেদন করে এবং নতুন আরেকটি হাটের সৃষ্টি হয় ‘শেখেরচর-বাবুরহাট’।

মূলত পাইকারদের এই ক্রমশ অসন্তুষ্টির ফলাফলস্বরূপ মহেশ্বরদী পরগণার এই অঞ্চলে সুতা-কাপড়ের এক অভাবনীয় বাজার গড়ে ওঠে, যা এখন বাংলাদেশের প্রধান বস্ত্রবাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।

শেখেরচর-বাবুরহাটের এই বস্ত্রকেন্দ্র তার স্বমহিমায় টিকে থাকুক, এটাই প্রত্যাশা সবার।


আলোকচিত্র : শহিদুল্লাহ পিয়াস

শেখেরচর-বাবুরহাটের গোড়াপত্তনের কথা

ঐতিহাসিক `বাঁকমোড়া' নামক স্থান (বর্তমান মূল বাসস্ট্যান্ড), যেখানে শেখেরচর হাটের গোড়াপত্তন হয়েছিলো | ছবি : শহিদুল্লাহ পিয়াস

বাংলার তাঁতবস্ত্রশিল্পের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র শেখেরচর-বাবুরহাটের গোড়াপত্তন ঘটে বাংলা ১৩৪৩ সনের ৮ জ্যৈষ্ঠ (১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ)। সারা বাংলাদেশ, এমনকি বাংলাদেশের বাইরে থেকেও কাপড় ব্যবসায়ীগণ এই বাবুরহাটে বস্ত্র বেচা-কেনার জন্যে আসতেন। হাটটি ‘প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার’ বলে খ্যাত ছিলো একসময়।

বর্তমান শেখেরচর থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে মাধবদী গ্রাম। মূলত মাধবদীই ছিলো তাঁতবস্ত্র বেচা-কেনার প্রথম হাট। এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মাধবদীর তৎকালীন জমিদার গোপাল গুপ্ত, বিষাদ গুপ্ত, শৈলেন্দ্র গুপ্ত রায়। পাঁচ-ছয় পুরুষ ধরে তাদের জমিদারি। তিরিশের দশকের কাছাকাছি সময়ে এই মাধবদীর সুতা-কাপড়ের হাট প্রতিষ্ঠিত হয়। নরসিংদীর জমিদার ললিতমোহন রায়ের সাথে খাজনা সংক্রান্ত বিরোধ তৈরি হলে পাইকারগণ মাধবদীর জমিদারের শরণাপন্ন হন এখানে হাট বসানোর জন্যে। এ-সুযোগ মাধবদীর জমিদারগণ লুফে নেন। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে তাদের বিশাল জমি খালি পড়েছিলো। সেখানেই বসানো হলো হাট। এই হাটকে কেন্দ্র করে জমিদারদের শনৈ শনৈ উন্নতি হতে লাগলো। মাধবদীর বাবুদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বলে এই হাটের নামকরণ হয়ে যায় ‘বাবুরহাট’।

কয়েক বছর যেতেই একই বিপত্তি। জমিদারদের নায়েবরা গাইট প্রতি খাজনা (তোহা) দুই পয়সা করে বেশি আদায় করা শুরু করে। এটা মেনে নেয়া কষ্টকর ছিলো পাইকারদের কাছে। তারা বারবার জমিদারের নায়েবের কাছে আবেদন করতে লাগলো তোহা বৃদ্ধি না করতে। কিন্তু জমিদারের নায়েব তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করতেন না। বরং দুর্ব্যবহার করতেন এবং আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা করছিলেন। এমতাবস্থায় কাপড়ের পাইকাররা একজোট হয়ে তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে লাগলেন। একসময় এই অসন্তোষ বিস্ফোরিত হতে হতে তাদের নিয়ে গেলো মাধবদী থেকে দুই কিলোমিটার উত্তরে শেখেরচরের তালুকদার হলধর সাহার কাছে। তারা হলধর বাবু ওরফে কালু বাবুকে বুঝালো শেখেরচরে হাট প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব। হলধর বাবুও এই মহা সুযোগ হাতছাড়া করেননি। শেখেরচরের উত্তরে বাঁকমোড়া (বর্তমান মূল বাসস্ট্যান্ড) নামক স্থানে খোলা আকাশের নিচে কৃষিজমির উপর আরম্ভ হলো শেখেরচর-বাবুরহাট। তখন বাংলা ১৩৪৩ সন।

হলধর সাহা (কালু বাবু) এতো বড়ো হাট প্রতিষ্ঠার জন্যে পর্যাপ্ত পয়সা-কড়ির মালিক ছিলেন না। এজন্যে তিনি সাহায্য নেন বালাপুরের জমিদার কালীমোহন সাহার। হলধর সাহা ও কালীমোহন সাহা বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয় ছিলেন। শেখেরচর (ইমামগঞ্জ) হাটের ১৬ আনা মালিকানার মধ্যে ৪ আনার মালিক ছিলেন বাবু হলধর সাহা (কালু বাবু) এবং ১২ আনার মালিক ছিলেন বালাপুরের কালীমোহন সাহা। পরবর্তীতে তার দুই ছেলে বাবু আশুতোষ সাহা ও বাবু মনোরঞ্জন সাহা মালিকানাপ্রাপ্ত হন।

এই হাটটিও বাবুদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিধায় এটাও পরবর্তীতে বাবুরহাট নামে পরিচিতি পায়। অবশ্য শেখেরচর হাটের প্রথমে নাম ছিলো ‘ইমামগঞ্জের হাট’। এই নামকরণের পেছনে ছিলেন তখনকার নরসিংদীর সিংহপুরুষ গান্ধীবাদী স্বদেশি রাজনীতিবিদ সুন্দর আলী গান্ধী। তিনিও এই হাট প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সুন্দর আলী গান্ধীর পীরের নাম ছিলো ইমাম উদ্দিন। হলধর বাবুরা সুন্দর আলীর পরামর্শ চাইলে তিনি এই হাটের নাম তাঁর পীরের নামে ‘ইমামগঞ্জের হাট’ নামকরণ করেন। প্রথমদিকে জনসাধারণের মুখে মুখে ইমামগঞ্জের হাট, পাবলিকের বাজার, নয়াবাজার ইত্যাদি নামেও পরিচিত ছিলো।

শেখেরচর-ইমামগঞ্জের বাজার প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর থেকে মাধবদীতে বাবুদের হাট স্তিমিত হয়ে যেতে শুরু করে। পাইকাররা মাধবদী হাটে তাদের পসরা সাজায় না। দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই শেখেরচরে আসতে থাকে। আর এই মলিন ক্রেতাশূন্য হাট মাধবদীর বাবুরা মেনে নিতে পারেন না। তারা শেখেরচরের বিরুদ্ধে নানা অপতৎপরতা চালাতে থাকে। স্পষ্টত আশেপাশের আরো অনেক এলাকা দুই ভাগ হয়ে যায়। কেউ কেউ মাধবদীর জমিদারদের পক্ষে; আবার কেউ হলধর বাবুদের পক্ষে। ব্রহ্মপুত্রের উপর স্থাপিত বাঁশের সাঁকো দিয়ে শেখেরচর হাটের মানুষজন হাটে যাওয়া-আসা করতো। মাধবদীর জমিদার গোপালবাবুর লোকেরা বারবার সেই বাঁশের সাঁকো ভেঙে দিতে থাকে। লাঠিয়াল বাহিনি দিয়ে হাটুরেদের হাটে প্রবেশে বাধা দিতে থাকে। মাধবদীর জমিদারেরা সুন্দর আলী গান্ধীর কাছেও যায় অর্থের প্রলোভন দেখাতে, যাতে তিনি এই হাট ভেঙে দেন। কিন্তু কোনো কাজই হয়নি। দাঙ্গা-হাঙ্গামা-সংঘর্ষ ইত্যাদি চলতে চলতে একসময় কলিকাতা হাইকোর্টে মামলা পর্যন্ত গড়ায়। মামলায় শেষ পর্যন্ত মাধবদীর জমিদারেরা হেরে যান।

শেখেরচর হাটের প্রতিষ্ঠাতা হলধর সাহা দূর-দূরান্ত থেকে আসা হাটুরেদের জন্যে নানা জায়গায় টিউবওয়েলের ব্যবস্থা করেন, এমনকি স্থানে স্থানে নিরাপত্তার জন্যে লাঠিয়াল বাহিনিও নিয়োগ করেন।

এই হাট প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নিয়ে ডা. আ. গনি পদ্য রচনা করেন। এই পদ্য স্থানীয় কবিয়ালরা গ্রামে গ্রামে পাঠ করতেন। তেমনি একটি পদ্য পাঠকেরা পড়ে নিতে পারেন। পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতে পারেন ঐতিহ্যবাহী শেখেরচর-বাবুরহাটের গোড়াপত্তনের ইতিহাস এবং তৎসময়ে ঘটে যাওয়া বিচিত্র ঘটনার ভেতর।

মাধবদী হাট ভাঙ্গিয়া শেখেরচরে হাট বসায়
গোপাল বাবু দেখে নিরুপায়।
গোপালেরা তিন ভাই থাকত কলকাতায়
দেশ বিদেশে জমিদারী, মাধবদীতে জন্মবাড়ি
বাড়িতে রাখছে ম্যানেজার, সে করতো না সুবিচার
যত আছে আমলা ফইড়া, হাটটার খায় লুইটা পুইড়া
এইরূপ অত্যাচারে ফকিরের জমা ধরে।
বাবুর মা নিষেধ করে এই জমাটা ছাইড়া দিয়া
অন্য জমা লও বাড়াইয়া
ছয় পয়সা ছিল গাইটের জমা, করে নিল বার আনা
জমা যখন বাড়াইল, পাইকারগণে শুনতে পাইল
জগন্নাথ মাড়োয়ারী, সে তো গেল বাবুর বাড়ি
যাইয়া বলে ম্যানেজারে, জমা ধরেন কম করে,
অনেক অনুরোধ করে, কমাইতে নাহি পারে
কমাইতে চাইলে পরে, জমা চায় ৫ টাকা করে।
ইহা শুনে মাউরার ছাও, কারো সনে করে না রাও
সঙ্গে যত পাইকার ছিল, সবারে ডাকিয়া লইল
আসল তারা ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব পাড়ে
শেখেরচরের কালু বাবু
এইবার তো কইরাছে কাবু
৫ কানি ক্ষেত ধান ভাঙ্গিয়া হাটের জায়গা করে দিলরে
১৩৪৩ সনে জ্যৈষ্ঠ মাসের আষ্ট দিনে
ইমামগঞ্জের হাট আরম্ভ হইলরে…

কালু সায় কয় কৃষ্ণ সাহারে ডাইকা
পুলের জোগাড় কর তাড়াতাড়ি
গোপাল বাবু শুনতে পায়, জায়গা দিছে কালু সায়
হাট বসাইল কালী সায়।
থাকতেন তিনি ঢাকার বাড়ি, চইড়া আইল মটর গাড়ি
নামলেন গিয়া ভিতর বাড়ি
যাইয়া বলে মায়ের কাছে, মোদের হাট কেন ভাইঙ্গা গেছে
মায় ছেলেরে কয় তখন, শোন বাবা রাজনন্দন
বাড়িতে রাখছ ম্যানেজার, সে করে না সুবিচার
তার কারণে হাট গিয়াছে বললাম বাবা তোমার কাছে।
ডাইকা বলে ম্যানেজারেরে, হাট ভাঙ্গছে কী কারণে
ম্যানেজার কয় তখন, হাট ভাইঙ্গা দিছে পাইকারগণ
তখন বাবু চিন্তা করে।
অনেক চিন্তা কইরা সার
ডাকাইল পাইকার
পাইকারেরা চইলা আইল
তানগো কাছে জিজ্ঞাসিল
পাইকারগণ কয় তখন
শোনেন বাবু রাজনন্দন
৬ পয়সা ছিল গাইটের জমা
কইরা নিল বার আনা।
অনেক অনুরোধ করি
কমাইতে নাহি পারি
কমাইতে কইলে পরে
জমা চায় ৫ টাকা করে।
ইহা শুনে বাঘের ছাও
কারো সনে করে না রাও
বন্দুক ছিল ভিতর বাড়ি
আনে বন্দুক হাতে করে
ধরে বন্দুক ম্যানেজার মারিতেরে…

পাইকারগণে বলে তারে
মাইরেন না বাবু ম্যানেজারে।
পাইকারেরা প্রণাম দিয়া
যার যার দেশে যায় চলিয়া
গোপাল বাবু গর্জে ওঠে
মামলা করল হাইকোর্টেতে
লাগিলরে মামলার ঠাঁট
বিচার করে বড়লাট
হাটের কথা খ্যান্ত পাই
হাট তো রইল মামলায়
মাধবদী হাট ভাঙ্গিয়া শেখেরচরে হাট বসায়
গোপাল বাবু দেখে নিরুপায়।

যাই হোক, মামলা-মোকদ্দমা-শত্রুতা-সংঘাত পেরিয়ে শেখেরচর কাপড়ের হাট স্থিতাবস্থায় উপনীত হয় এবং সারাদেশে ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ এক বাণিজ্যকেন্দ্রে রূপ লাভ করে। নানা চড়াই-উৎড়াই আর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এটি বর্তমান অবস্থায় এসেছে। এই হাটের বিস্তৃতির পেছনে যাঁরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে রইলো অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা।


তথ্যসূত্র
১. ডা. আ. গনি (প্রয়াত);
২. ক্বারী আ. হাই (প্রয়াত) ও
৩. অলি বক্স মুন্সি (প্রয়াত)।


কে ফজলুল হক
প্রবীণ সাংবাদিক। সম্পাদক, সাপ্তাহিক নরসিংদীর সমাচার।

মোস্তাফিজুর রহমান শিপ্ত : প্রকৃতি ও পাখির ডানায় যার মনন

মোস্তাফিজুর রহমান শিপ্ত

শিপ্ত। মোস্তাফিজুর রহমান শিপ্ত। পেশায় একজন উদ্যোক্তা এবং ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার। ফটোগ্রাফিটা মাথায় নেশার মতো চেপে বসার শুরুটা ২০১৩ সালের মাঝামাঝি। ছোটোবেলায় বাবা পাখি পুষতেন। তখন থেকেই পাখির প্রতি একটা অনন্য ঝোঁক ছিলো তার। ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফিতে ঢুকে পড়ার মূল রসদটা হয়তো সেটাই ছিলো। আর সেই সুবাদে পশুপাখি ও প্রকৃতির দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের অনেক জেলায়। এই শখের প্রতি অকুণ্ঠ ঝোঁক আর নেশা তাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে বাংলার চেনা-অচেনা চর, খাল-বিল, জঙ্গল আর নানা জলাভূমিতে। একেকটা ছবির জন্যে কতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুর্গম পথে চলা, জলায়-কাঁদায় ঘাপটি মেরে বসে থাকা, কতো আঁচড়, কতো পোকামাকড়ের কামড়, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত একটা ক্লিক সেসব কষ্টকে একদম ম্লান করে দেয়। নতুন নতুন পাখির জীবন বৈচিত্র্য জানার পাশাপাশি তাদের ক্যামেরাবন্দী করার উন্মত্ত আকাঙ্ক্ষা তাকে সাহায্য করেছে প্রায় তিনশো প্রজাতির পাখির ছবি তুলতে। তিনি স্বপ্ন দেখেন, ক্রমে এই সংখ্যাটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে, ছবিতেও উঠে আসবে জীবন ও প্রকৃতির নানা বৈচিত্র্যের রূপকথন। অবশ্য এই স্পৃহা থেকে ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজ কর্মের ছাপ ফেলতে সমর্থ হয়েছেন এই গুণী শিল্পী, জয় করে এনেছেন বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার। বঙ্গবন্ধু ফটোগ্রাফার অফ দ্য ইয়ার ২০১৯, Photocrowd International ২০১৮, D’ Photocafe WNI World Photography Exibition ২০১৭-সহ আরো অসংখ্য সুকীর্তির স্বাক্ষরে পরিপূর্ণ তার সঞ্চয়ের ঝুলি। বিভিন্ন সময়ে The Daily Observer, ইত্তেফাক, প্রথম আলো-সহ বেশ কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায়ও এসেছে তার নাম।

ছবি তোলা এবং ছবির অর্জনগুলোর বেশিরভাগই ছিলো ছাত্রজীবনের। চাকুরিজীবনে প্রবেশের সাথে সাথে শখের জায়গাটা ধরে রাখা ক্রমশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। কিন্তু তার মন তো পড়ে থাকে সেই জলে-জঙ্গলেই। একটা সময় আর মনের সাথে পেরে ওঠতে পারলেন না। চাকুরি ছেড়ে দিলেন আর নিজেকে উন্মোচিত করলেন একজন উদ্যোক্তা হিসেবে। এতে করে শখের কাজেও পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন। বর্তমানে নরসিংদীর ইটাখোলায় প্রায় ১০০ জন প্রতিবন্ধী নিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি বিশ্বমানের কারু এবং হস্তশিল্প কারখানা, যেখানে দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন উপকরণ তৈরির সাথে সাথে অসংখ্য প্রতিবন্ধী আয়-রোজগার করছেন। নিজেদের অচলাবস্থার নির্মম পরিণতি আর অসহনীয় যন্ত্রণা কিছুটা হলেও লাঘব করতে পারছেন।

ফটোগ্রাফি মূলত একধরনের স্মার্ট শখ। এই শখের জায়গাটা পাকা করতে এবং ছবিপ্রেমী আরো অসংখ্য তরুণকে আলোকচিত্রের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে ২০১৯ সালে বেশ কয়েকজন উদ্যমী তরুণ-তরুণী নিয়ে গড়ে তোলেন ‘নরসিংদী ফটোগ্রাফিক সোসাইটি’। ইতোমধ্যে দুটি বেশ বড়োসড়ো চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন তারা সফলভাবেই সমাপ্ত করতে পেরেছে।

এই সবকিছুর পাশাপাশি ছোটো ভাই এবং বন্ধুদের নিয়ে গড়া একটা ইভেন্ট ফটোগ্রাফির প্রতিষ্ঠানও রয়েছে তার। আলাপচারিতায় নিশ্চিত বুঝতে পারি, প্রকৃতপক্ষেই একজন পাখি ও প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ তিনি। বর্তমান প্রকৃতির অস্থিতিশীল অবস্থার দরুন অনেকটা উদ্বিগ্ন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সমগ্র পৃথিবীর বৈশ্বিক উষ্ণতা লাগামহীন বেড়ে চলেছে। এমন যদি চলতে থাকে, তাহলে একদিন দেখা যাবে, প্রকৃতিও তার মুখ ফিরিয়ে নেবে, নষ্ট হয়ে যাবে আমাদের ইকোসিস্টেম। তিনি বলেন, “২০১৩-১৪ সালেও যেসব পাখি এ-দেশে দেখা যেতো, তাদের অনেকগুলোই এখন বিলীন। অনেক প্রজাতি চোখে পড়ে না আর। আবার অনেক প্রজাতির অস্তিত্ব শঙ্কার মুখে। তাই বেশি বেশি পাখিবান্ধব গাছ রোপণ করে পরিবেশের প্রতি আরো যত্নশীল হওয়া খুবই জরুরি।”  মোস্তাফিজুর রহমান শিপ্ত এখনো স্বপ্ন দেখেন, এই বাংলা আবারো সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা হয়ে ওঠবে; আর তার পথে-প্রান্তরে, জলে-জঙ্গলে তিনি দাপিয়ে বেড়াবেন বিচিত্র সব পশু-পাখির ছবি তোলার জন্যে।

এবারে দেখে নেয়া যাক মোস্তাফিজুর রহমান শিপ্তর ক্যামেরায় ধারণ করা বিচিত্র কিছু পাখির আলোকচিত্র, যা তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে তুলে এনেছেন।

লাল ঠেঙি
উল্টোঠুঁটি
বাবুই বাটন
তিলা বাজ
মাছরাঙা
উদয়ী ধলা-চোখ
মৌটুসী
লাল মুনিয়া
ছোটো জিরিয়ার বাচ্চা
সবুজ সুইচোরা
টিয়া

মোস্তাফিজুর রহমান শিপ্ত

    জন্ম | ১১ আগস্ট ১৯৯৫, ঘাগটিয়া, শিবপুর
বসবাস | মুন্সেফেরচর, ইটাখোলা, শিবপুর
   পেশা | উদ্যোক্তা ও ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার

ফেসবুক________
mostafijur.rahman.shipto
shiptophotography

ইনস্টাগ্রাম________
mostafij_shipto

ফ্লিকআর________
142386798@N08

পিন্টারেস্ট________
mostafijurrahmanshipto

ই-মেইল________
mustafizshipto07@gmail.com

নরসিংদীতে প্রবাহিত নদ-নদী ও নদীপাড়ের জনজীবন

আমি বসে বসে তাই ভাবি,
নদী কোথা হতে এল নাবি।
কোথায় পাহাড় সে কোনখানে,
তাহার নাম কি কেহই জানে।
               নদী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘নদী’ কবিতায় নদীর পুরো জন্মকথা বলে দিয়েছেন। নদী কেমন করে পাহাড়ের ঝর্নাধারা থেকে বেরিয়ে এঁকে-বেঁকে সমতলে নামে, তারপর সমতলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে পতিত হয়ে নদীর চলা শেষ হয়, নদীর মৃত্যু ঘটে। নদী হচ্ছে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে প্রবাহিত জলধারা। প্রাকৃতিক নিয়মে পাহাড়ের বরফগলা পানি এবং পাহাড় হতে যে-ঝর্নাধারার সৃষ্টি, সেই ঝর্নার পানির সাথে বৃষ্টির জলধারা মিলে নিচের দিকে গভীর খাতে সর্পিলাকারে প্রবাহিত হয়েই নদীর সৃষ্টি।

নদীকে কেন্দ্র করেই পৃথিবীর আদি সভ্যতার উদ্ভব, বিকাশ ও বিস্তৃতি। বাংলাদেশের সভ্যতা-সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ নদীকে অবলম্বন করেই। বাংলার প্রাচীন সভ্যতার প্রধান কেন্দ্র পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, উয়ারী-বটেশ্বর প্রাচীন নদীর পাড়েই গড়ে ওঠেছিলো। বাংলার সভ্যতার অগ্রযাত্রা, কৃষিনির্ভর জীবন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বন্দর, বাজার-হাট, যোগাযোগ, প্রতিদিনের জীবনযাপন, তার প্রসার ও বিস্তৃতি নদীকে ঘিরেই।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ৫৬ হাজার বর্গমাইল আয়তনের বাংলাদেশ নদীর পলিতে গড়ে ওঠা বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ। নদী বিধৌত বাংলাদেশে ছোটো-বড়ো নদীর সংখ্যা প্রায় তিনশো’র অধিক। সমস্ত দেশটি অসংখ্য নদী, উপনদী, শাখা এবং প্রশাখা নদী দ্বারা মাকড়সার জালের মতো আচ্ছাদিত। বাংলাদেশে প্রধান নদীপ্রবাহ হচ্ছে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। রাজনৈতিকভাবে দেশের একটি শ্লোগান আছে— ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’। বস্তুত, বাংলাদেশের প্রকৃত ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। পদ্মা এবং গঙ্গা নদী একই প্রবাহ। ভারতে এর জন্ম; সেখানে নাম ‘গঙ্গা’, বাংলাদেশে রাজশাহী বিভাগ দিয়ে প্রবেশের পর এই প্রবাহের নাম হয়েছে ‘পদ্মা’। একইভাবে ব্রহ্মপুত্র এবং যমুনাও একই প্রবাহ। ‘ব্রহ্মপুত্র’র খাত পরিবর্তন হয়েই ‘যমুনা’ নাম হয়েছে। মেঘনা এবং সুরমাও একই প্রবাহ। মূলত, বাংলাদেশের অসংখ্য নদী, যেগুলো সুন্দর সুন্দর নাম নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবাহিত হয়েছে, সেগুলো মূলত পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনা-ব্রহ্মপুত্র’র শাখা।

নরসিংদী জেলায় প্রবাহিত নদ-নদী
বাংলাদেশের নদী বাংলাদেশের প্রাণ। তদ্রুপ নরসিংদীর নদীগুলোও নরসিংদীর প্রাণ। নরসিংদীতে নদীর প্রধান প্রবাহ ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা এবং তাদের শাখা নদী শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ, কলাগাছিয়া, হাড়িধোয়া, গঙ্গাজলী, বানার, কয়রা। নরসিংদীর ব্যবসা-বাণিজ্য, নদীবন্দর গড়ে ওঠেছে ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, শীতলক্ষ্যার পাড়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। গঙ্গাজলী এবং কয়রা নদীর পাড়ে গড়ে ওঠেছিলো হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতা ‘উয়ারী-বটেশ্বর’। নদী দুটি আজ মৃত। ব্রহ্মপুত্র’রও একটি প্রধান প্রবাহ আজ মৃত, যা নরসিংদীর পারুলিয়া, চর্ণগরদী, পাঁচদোনা, শেখেরচর (বাবুরহাট), মাধবদী, মহজমপুর, লাঙ্গলবন্দ হয়ে শীতলক্ষ্যায় শেষ হয়েছে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র’র বড়ো প্রবাহটি কিশোরগঞ্জ জেলার সীমারেখা হয়ে মনোহরদী, বেলাব অতিক্রম করে ভৈরবের কাছে মেঘনায় মিলিত হয়েছে।

গঙ্গাজলী ও কয়রা নামক নদী দুটির অস্তিত্ব পুরোনো ও নতুন অনেক মানচিত্র খুঁজেও পাওয়া যায়নি। বেলাব উপজেলার ‘হাড়িসাঙ্গান’ গ্রামে নদী দুটির প্রবাহ এখনো বিদ্যমান। তবে তা খুবই ক্ষীণ ধারায় বহমান।

ব্রহ্মপুত্র
নরসিংদীর উপর দিয়ে প্রবাহিত অন্যতম নদ ব্রহ্মপুত্র। হিন্দুশাস্ত্রমতে, দেবতা ব্রহ্মা’র মানসপুত্ররূপে এর নাম হয়েছে ব্রহ্মপুত্র। ব্রহ্মপুত্র নদ উত্তর হিমালয়ে অবস্থিত কৈলাশ পর্বতশৃঙ্গের হিমবাহের অবিরত জলধারা থেকে উৎপত্তি লাভ করে তিব্বতের মানস সরোবরের সাথে মিলিত হয়ে উঁচু মালভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই প্রবাহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ঘুরে ভারতের অরুণাচল ও আসামে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কুড়িগ্রাম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ব্রহ্মপুত্র’র গতিপথ অতি বিচিত্র। কালের ধারায় বিভিন্ন পথে প্রবাহিত হয়েছে এটি। পুরোনো ব্রহ্মপুত্র’র প্রধান প্রবাহটি জামালপুর জেলার বাহাদুরাবাদ হয়ে শেরপুর জেলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে এসে মধুপুর গড় এলাকার কাছে বংশি ও তুরাগ নামে দুটি শাখা নদীর সৃষ্টি করেছে। মূল প্রবাহ ময়নমনসিংহ জেলায় প্রবেশ করে ময়মনসিংহ শহর ও গফরগাঁ’র পাশ দিয়ে সোজা দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার টোকের কাছে শীতলক্ষ্যা নদীকে শাখা হিসেবে জন্ম দিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর, পাকুন্দিয়া অতিক্রম করে নরসিংদী জেলায় প্রবেশ করে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়। একটি ধারা পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে নরসিংদী জেলার চালাকচর, বড়চাপা, পোড়াদিয়া ও বেলাব এসে আবার দুভাগে ভাগ হয়। ডানের ধারা নরসিংদীর আড়িয়াল খাঁ নামে এবং বামের প্রধান ধারা (পুরোনো ব্রহ্মপুত্র) তার অপরিবর্তিত নামে নরসিংদীর রায়পুরার সীমান্ত সংলগ্ন ভৈরব বাজারের পাশ দিয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। এটিই পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের প্রধান প্রবাহ নামে পরিচিত।

কিন্তু মেজর রেনেল কর্তৃক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ব্রহ্মপুত্র’র মূল প্রবাহের প্রধান স্রোতধারা মনোহরদী উপজেলার সর্ব-উত্তরে আড়ালিয়া নামক স্থানে দক্ষিণ দিক দিয়ে মনোহরদীর হাতিরদিয়া, শিবপুরের লাখপুর, পলাশ উপজেলার চরসিন্দুর, পারুলিয়া, চর্ণগরদী, জিনারদী হয়ে পাঁচদোনা, শীলমান্দী, শেখেরচর (বাবুরহাট), মাধবদী থেকে আড়াইহাজার উপজেলার পশ্চিম প্রান্ত বরাবর প্রবাহিত হয়ে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দের দক্ষিণ দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে শীতলক্ষ্যা-ধলেশ্বরী ও মেঘনা নদীর সঙ্গমস্থল কলাগাছিয়া নামক স্থানে মেঘনার সাথে মিলিত হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান তীর্থস্থান লাঙ্গলবন্দের কাছে নদীটি এখনো সচল। নদীর এই অংশে হিন্দু সমাজের পুণ্যস্নানের পঞ্চমীঘাট রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র’র এই প্রবাহের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে পাঁচদোনা, বানিয়াদী, মাধবদী, আলগী, মহজমপুর এবং মনোহরদীতে পুণ্যস্নানের ঘাট অতীতে থাকলেও এখন নদী শুকিয়ে যাওয়া এবং দূষণের কারণে তা স্নানের অনুপযোগী। এসব এখন ইতিহাস-কিংবদন্তীর অংশ।

পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ | ছবিটি নরসিংদী সদর উপজেলার শেখেরচর-বাবুরহাট অংশ থেকে তোলা

পুরাতন ব্রহ্মপুত্র’র এই প্রবাহের অংশে ব্রহ্মপুত্র’র পাড়ের খালি জায়গায় গড়ে ওঠেছে প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার খ্যাত বাংলাদেশের তাঁতবস্ত্রশিল্পের সবচাইতে বড়ো হাট। বস্ত্রশিল্পের সবচেয়ে বড়ো ব্যবসাকেন্দ্র শেখেরচরের বাবুরহাট, যা নরসিংদীকে দেশ ও দেশের বাইরে পরিচিত করেছে। নরসিংদী জেলার ব্র্যান্ডও হয়েছে ‘তাঁত শিল্পের মেলা/ নরসিংদী জেলা’। কথিত আছে, মাধবদীর ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একসময় আড়ং বসতো। আনন্দী গ্রামের সন্নিকটে ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আড়ং নামের কাপড়ের এই হাট জমজমাট ছিলো। মাধবদী-শেখেরচর তাঁতশিল্পকেন্দ্র হওয়ার নেপথ্যে এই আড়ং নামের হাটের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। …শেখেরচর বাবুরহাট ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের একদম লাগোয়া পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে নরসিংদী জেলার শিলমান্দী ইউনিয়নে অবস্থিত।

ব্রহ্মপুত্র নদের এই প্রবাহের ব্রহ্মপুত্রতীরের নরসিংদীর কৃতীসন্তান মাধবদীর পাকড়াশী বংশের অগ্নিযুগের বিপ্লবী সতীশ পাকড়াশী। পাঁচদোনার বাংলা ভাষায় পবিত্র কোরানের প্রথম অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, শিক্ষাবিদ ও সংস্কৃতিসাধক সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য। ভাটপাড়ার নিখিল ভারতের প্রথম আইসিএস স্যার কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত (কে জি গুপ্ত), পারুলিয়ার সাধকপুরুষ ও সঙ্গীতসাধক ও লোকসাহিত্যিক পাগল দ্বিজ দাস।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের যোগাযোগের একটি বড়ো মাধ্যম ছিলো নৌ-পথ। নরসিংদীর মনোহরদী থেকে নারায়ণগঞ্জের কলাগাছিয়া পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র’র এই প্রবাহ অংশে একসময় গয়নার নৌকা চলাচল করতো। এখন এই অংশের নদী মূলত মৃত। অনেক স্থানে নদীর অস্তিত্ব বোঝাও কঠিন। বর্তমান সরকার অন্যান্য নদীর মতো ব্রহ্মপুত্র’র এই অংশ খনন করলেও তা নদীর প্রবাহ তৈরি করার মতো অবস্থা হয়নি। অনেক জায়গায় এটি মৃত খালে পরিণত হয়েছে।

শীতলক্ষ্যা
শীতলক্ষ্যা নদী পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের অন্যতম প্রধান শাখা। ১৭৮০ সালে মেজর জেমস রেনেলের ব্রহ্মপুত্র নদ জরিপ তথ্য থেকে জানা যায়, কিশোরগঞ্জ জেলাধীন ঐতিহাসিক দুর্গশহর এগারসিন্দুরের কাছাকাছি গাজীপুর জেলার টোক নামক স্থানে ব্রহ্মপুত্র নদের একটি শাখা বানার নামে উৎপত্তি হয়ে নরসিংদী জেলার লাখপুরের কাছে শীতলক্ষ্যা নাম ধারণ করেছে। শীতলক্ষ্যা নদীটি নরসিংদী জেলার পশ্চিম সীমান্ত নির্ধারণ করেছে। নদীর পূর্ব তীরে নরসিংদী জেলার মনোহরদী, শিবপুর, পলাশ ও নরসিংদী সদর উপজেলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান গড়ে ওঠেছে। যেমন : মনোহরদী, হাতিরদিয়া, শিমুলিয়া, লাখপুর, চরসিন্দুর, ঘোড়াশাল, ডাঙ্গা বাজার প্রভৃতি নদীবন্দর। পশ্চিম প্রান্তে গাজীপুর জেলার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, ফতুল্লার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীটি নারায়ণগঞ্জ সদর হয়ে বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়ার কাছে ধলেশ্বরী নদীতে পতিত হয়েছে। শীতলক্ষ্যা নদী সর্বমোট ১০৮ কিলোমিটার দীর্ঘ। উৎস থেকে ধলেশ্বরী নদীতে পতিত হওয়া অবধি প্রবাহপথে শীতলক্ষ্যা নদীটি গাজীপুর, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান গড়ে তুলে প্রবাহিত হয়েছে। শীতলক্ষ্যা নদীর উভয় তীর বিস্তীর্ণ জনপদ, লাখ-কোটি মানুষের বসতি।

শান্ত এই নদী সম্পর্কে জনশ্রুতি, শীতল আর লক্ষ্মী— এই দুই বিশেষণেই শীতলক্ষ্যার নামকরণ। শীতলক্ষ্যা নদীর পানি বাংলাদেশের স্বাদু পানির নদ-নদীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ ও নির্মল। একমাত্র এই কারণেই শীতলক্ষ্যার তীরে গড়ে ওঠেছিলো ভুবনখ্যাত প্রাচীন মসলিন বস্ত্রশিল্প।

ইংরেজ আমলের সরকারি নথিপত্রে এই নদীকে তৎকালীন ঢাকা জেলার সুন্দরতম নদী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। শীতলক্ষ্যার পাড় উঁচু, ভরা বর্ষাতেও দুকূল ছাপিয়ে যায় না। নদীভাঙন নেই বললেই চলে। এজন্যেই এই নদীতীরে গ্রাম, বন্দর, ব্যবসাকেন্দ্রের পাশাপাশি উভয় কূলেই এখন ব্যাপক শিল্পায়ন— গড়ে ওঠেছে বহু কল-কারখানা। দেশ বিভাগের আগে শীতলক্ষ্যার পাড়ে বেশ কয়েকটি সোডা ওয়াটার, লেমনেড ইত্যাদি কারখানা গড়ে ওঠেছিলো। বর্তমানে এই নদীর উভয় তীর বাংলাদেশের শিল্প-বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। এরকম বাণিজ্যিক গৌরব বাংলাদেশের খুব কম নদীরই আছে। শীতলক্ষ্যার পাড়েই গড়ে ওঠেছে দেশের সুবৃহৎ নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর। গড়ে ওঠেছিলো আদমজী-সহ অসংখ্য পাটকল। নদীর নরসিংদী প্রান্তে রয়েছে চরসিন্দুর দেশবন্ধু চিনিকল, পলাশে প্রাণ কোম্পানির বিশাল শিল্পকারখানা, দুটি সারকারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র (ওয়াপদা), সিমেন্ট ফ্যাক্টরিসহ অগণিত ছোটো-মাঝারি-বৃহৎ শিল্পকারখানা।

নদীপাড়ের অনেক স্থান হয়ে ওঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। গড়ে ওঠেছে ছোটো-বড়ো রিসোর্ট। নদীর পশ্চিম প্রান্তে কালীগঞ্জের নাগরীতে রয়েছে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের এলাকা। রয়েছে পর্তুগিজ বণিকদের গড়া গির্জা।

একসময় এই শীতলক্ষ্যার নদীপথই ছিলো এই এলাকার সাথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের যোগাযোগের মাধ্যম। চলতো নৌকা-লঞ্চ-স্টিমার। গুরুত্বপূর্ণ এই নদীর ব্যস্ততা বর্তমানে অনেক কমে যাচ্ছে। শিল্পবর্জ্য নদীকে করেছে ব্যাপকভাবে দূষিত।

আড়িয়াল খাঁ
ব্রহ্মপুত্র নদের আরেকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ শাখা এবং সুন্দরতম নদী নরসিংদীর বুকে প্রবাহিত আড়িয়াল খাঁ নদ। আড়িয়াল খাঁ নদ কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী ও কুলিয়ারচর এবং নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার সীমান্ত এলাকায় পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের শাখা হিসেবে উৎপত্তি লাভ করে নরসিংদী জেলার মধ্যে উত্তর-দক্ষিণে এঁকে-বেঁকে প্রবাহিত হয়েছে। আড়িয়াল খাঁ নদ মনোহরদী উপজেলার উত্তর-পূর্ব পাশ দিয়ে বেলাব উপজেলার পোড়াদিয়া, পাটুলি, অন্যদিকে বিন্নাবাইদ হয়ে বেলাব বাজারের কাছে এসে আবার ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহের সাথে যুক্ত হয়ে আমলাব, চর উজিলাব অতিক্রম করে বারৈচার সন্নিকটে জংলী শিবপুর বাজারের নিকট নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলায় প্রবেশ করেছে। রায়পুরা উপজেলায় উত্তর বাখরনগর, চর মরজাল, যোশর বাজার, রাধাগঞ্জ বাজার, কুঠির বাজার হয়ে আদিয়াবাদ শতবর্ষী স্কুলের পাশ দিয়ে রহিমাবাদ, ডৌকারচর, হাসনাবাদ বাজার, আমীরগঞ্জ হয়ে একদিকে রায়পুরার নলবাটা, অন্যদিকে নরসিংদী সদরের হাজীপুর ইউনিয়নের খাসেরচরের কাছে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। মেঘনায় মিলিত হয়ে পশ্চিম দিকে নরসিংদী বাজারের পুরাতন থানার ঘাট পর্যন্ত প্রবাহের ধারা বজায় রেখে হাড়িধোয়া শাখা নদীকে জন্ম দিয়েছে। মেঘনায় মিলনস্থল থেকে নরসিংদী থানার ঘাট পর্যন্ত এলাকায় বর্ষাকালে নদীপ্রবাহের গতিময় ধারার দুটি নদীর পানির আলাদা আলাদা রঙ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়।

আড়িয়াল খাঁ নদের প্রবাহিত জেলা : কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী। প্রবাহিত উপজেলা : কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি, কুলিয়ারচর, নরসিংদী জেলার মনোহরদী, বেলাব, রায়পুরা ও নরসিংদী সদর। দৈর্ঘ্য প্রায় ১৯ কিলোমিটার, গড় প্রশস্ততা ৭৯ মিটার। নদীর প্রকৃতি সর্পিলাকার। নদীটিতে সারাবছরই পানির প্রবাহ থাকে। জুন-সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পানি প্রবাহের মাত্রা বেশি হলেও নদীপাড় নিমজ্জিত হয় না। তবে বর্তমানে নদীর তলদেশঅঞ্চল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীতীরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাচীন বাজার পোড়াদিয়া বাজার, বেলাব বাজার, জংলী শিবপুর বাজার, যোশর বাজার, রাধাগঞ্জ বাজার, কুঠির বাজার, রহিমাবাদ বাজার, হাসনাবাদ বাজার। বেলাব বাজারসহ অন্যান্য বাজারের গুরুত্বপূর্ণ পণ্য সোনালি আঁশ পাটসহ অন্যান্য পণ্য নদীপথে নরসিংদীতে আনা হতো। পাট জমা হতো নরসিংদীর মেঘনা ও আড়িয়াল খাঁ পাড়ের বড়ো বড়ো পাটগুদামে, আদমজী-সহ বড়ো বড়ো পাটকলে পাঠানোর জন্যে। এই নদীর উপর রয়েছে আমীরগঞ্জের ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলসেতু, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সেতু। বর্তমান সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে এই নদীই পণ্য পারাপার এবং নৌ-পথে যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন ছিলো। অধ্যাপক সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের ‘মহেশ্বরদীর ইতিহাস’ গ্রন্থের তথ্য থেকে জানা যায়, আড়িয়াল খাঁ তীরবর্তী মরজাল গ্রাম হইতে মৌর্য যুগের বহুতর রৌপ্যমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়। এর মধ্যে ৯০ টি মুদ্রা ঢাকা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এই স্থানে মৌর্য যুগের মুদ্রার আবিষ্কার হইতে বুঝা যায় যে, কত প্রাচীনকাল হইতে এই অঞ্চলে আর্যসভ্যতার বিস্তার হয়েছে।

আড়িয়াল খাঁ নদীর ঠিক পাড়ে সুন্দর খেলার মাঠসহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আদিয়াবাদ স্কুল, যে-স্কুল তার ঐতিহ্য নিয়ে শতবর্ষ পার করেছে। আর কাছাকাছি নদীপাড়ের রহিমাবাদ ছিলো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং পাকিস্তান পরবর্তী বাম রাজনীতিবিদদের গুরুত্বপূর্ণ আস্তানা।

গঙ্গাজলী ও কয়রা
গঙ্গাজলী ও কয়রা নদী দুটিও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। দুটি নদীই নরসিংদীর প্রাচীন নদী। বর্তমান বেলাব উপজেলায় অবস্থিত প্রাচীন সভ্যতার প্রত্নস্থান এই গঙ্গাজলী, কয়রা, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরেই গড়ে ওঠেছিলো। গঙ্গাজলী ও কয়রা— দুটি নদীই আজ মৃত এবং অস্তিত্বহীন। বেলাব-শিবপুর অঞ্চলে নদী দুটির কিছু মরা খাল এবং ছোটো খালের মতো অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। বেলাব’র হাড়িসাঙ্গান গ্রামে গঙ্গাজলীর একটি প্রবাহ এখনো দেখা যায়। নদীটির উপর একটি সেতুও রয়েছে।

নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার আশরফপুর গ্রামটি গঙ্গাজলী নদীর তীরে অবস্থিত বলে জানা যায়। সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে আশরফপুরে বৌদ্ধবিহার গড়ে ওঠার পেছনে গঙ্গাজলী নদীর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে বলে নরসিংদীর ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক আপেল মাহমুদ সাথী উল্লেখ করেছেন।

গঙ্গাজলী নদী | ছবিটি বেলাব উপজেলার হাড়িসাঙ্গান গ্রামের গঙ্গাজলী বাজার অংশ থেকে তোলা
কয়রা নদী | ছবিটি বেলাব উপজেলার হাড়িসাঙ্গান গ্রাম থেকে তোলা

সুফি মোস্তাফিজুর রহমান এবং মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান রচিত নরসিংদীর প্রত্নস্থান বিষয়ক গবেষণাগ্রন্থ ‘উয়ারী-বটেশ্বর : শেকড়ের সন্ধানে’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে : আড়াই হাজার বছর আগে নরসিংদী জেলার উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র নদ উপত্যকায় গড়ে ওঠে এক প্রাচীন জনপদ। …উয়ারী-বটেশ্বর নরসিংদী জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থান। …ইতিমধ্যে উয়ারী-বটেশ্বরের মানববসতি খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ শতকের বলে প্রমাণিত হয়েছে। উয়ারী-বটেশ্বর ছিলো নদীবন্দর, বাণিজ্যকেন্দ্র ও স্বল্পমূল্যবান পাথরের পুঁতি উৎপাদনকেন্দ্র। …পুরাতন ব্রহ্মপুত্রনদ এবং এর শাখা আড়িয়াল খাঁ, পাহাড়িয়া (কলাগাছিয়া), গঙ্গাজলী ও কয়রা এ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। …এখনো উয়ারী গ্রামের উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে প্রাচীন কয়রা নদীর সংকীর্ণ খাত। একসময় হয়তো এই নদীই ছিলো আরও প্রশস্ত। কয়রা নদীর আরও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ মিশেছে আড়িয়াল খাঁ (ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা) নদীর সঙ্গে। এই পুরাতন ব্রহ্মপুত্রই ছিল একদা ব্রহ্মপুত্র নদের মূল স্রোত। ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদের মূল গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যায়, ফলে এটি পরিচিত হতে থাকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ হিসেবে। বর্তমান আড়িয়াল খাঁ ও ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গমস্থল থেকে উয়ারী-বটেশ্বরের দূরত্ব চার কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে।
…সম্ভবত উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলের অধিবাসীরা পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের (কয়রা, গঙ্গাজলী, পাহাড়িয়া, আড়িয়াল খাঁ শাখাসহ) তীরবর্তী উর্বর উপত্যকা ভূমিতে কৃষিকাজের সেচের জন্য নদ-নদীর পানি ব্যবহার করত। মৎস্য শিকার, যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে নদ-নদীর ব্যবহার ছিল খুবই কার্যকর এবং বিকল্পরহিত। এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও সংস্কৃতিতে, তাদের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে এবং এ অঞ্চলে যে সমৃদ্ধ নগরব্যবস্থার প্রমাণ ইতিমধ্যে উন্মোচিত হয়েছে, তাতে এ অঞ্চলের নদ-নদীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

হাড়িধোয়া
নরসিংদীর একটি ছোটো নদী হাড়িধোয়া। আড়িয়াল খাঁ নদীটি খাসেরচর এবং নলবাটার মধ্য দিয়ে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়ে তার প্রবাহের গতিধারা পশ্চিম দিকে নরসিংদী পুরাতন থানার ঘাট পর্যন্ত এসে এই প্রবাহের নদীকে জন্ম দিয়েছে। নদীটি ছোটো হলেও নরসিংদীর একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। বর্তমানে শিল্পবর্জ্যে নদীটি চরমভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে।

নদীটির নামকরণ সম্পর্কে ইতিহাসবিদ-সাংবাদিক আপেল মাহমুদের বক্তব্য : হাড়িধোয়ার তীরে হাজীপুর ও নরসিংদী বাজারে একসময় কুমার ও পাল সম্প্রদায়ের লোকেরা বিপুল পরিমাণে মাটির জিনিসপত্র তৈরি করতো এবং উক্ত নদীতে সেগুলো ধোয়া-মোছার কাজ করতো। সম্ভবত এ হাড়ি-পাতিল ধোয়ার কাজ থেকে হাড়িধোয়া নামটি এসেছে। বর্তমানেও উক্ত নদীর তীরে অবস্থিত হাজীপুর ব্রিজের পশ্চিম পাশের জায়গাটি পাতিলবাড়ি হিসেবে পরিচিত। এই পাতিলবাড়ি থেকে শহরের হেমেন্দ্র সাহার মোড় পর্যন্ত সড়কের নাম হয়েছে পাতিল বাড়ি রোড।

হাড়িধোয়া নদী | ছবিটি নরসিংদী সদর উপজেলার পুরানপাড়া অংশ থেকে তোলা

নদীটি নরসিংদী বাজার, হাজীপুর, বৌয়াকুড়, আরশীনগর, বীরপুর, পুরানপাড়া, বাদুয়ারচর, পুটিয়া বাজার, ঘোড়াদিয়া, ভরতেরকান্দি, ভেলানগর, চিনিশপুর ও চর্ণগরদী হয়ে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে মিলিত হয়েছে। নদীটির প্রবাহিত জেলা : নরসিংদী। প্রবাহিত উপজেলা : নরসিংদী সদর, শিবপুর ও পলাশ। নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৮ কিলোমিটার। প্রশস্ততা গড়ে ৬১ মিটার। নদীটির গতিপ্রকৃতি সর্পিলাকার। নদীটি দেখতে খুবই সুন্দর, যদিও শিল্পবর্জ্যে দূষিত। তীরবর্তী স্থাপনা : নরসিংদী পৌরসভা ও বাজার, পুটিয়া বাজার, কালী বাজার। এই নদীর উপর দিয়ে পুরানপাড়ায় ঢাকা-নরসিংদী-চট্টগ্রাম রেলসেতু, ভেলানগরে ঢাকা-নরসিংদী-সিলেট মহাসড়কসহ অনেকগুলি সেতু রয়েছে। হাড়িধোয়ার পাড়ে বেশকিছু ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা গড়ে ওঠেছিলো। নদীটির উৎসস্থলের সাথেই নরসিংদী পাতিলবাড়ির সন্নিকটে দেশখ্যাত কবিয়াল ও বৈষ্ণবসাধক কবিগুণাকর হরিচরণ আচার্যের বসতবাড়ি, সমাধি এবং শ্রী শ্রী বিষ্ণুপ্রিয়া আশ্রম গড়ে তোলা হয়েছে। একটু অগ্রসর হলেই বৌয়াকুড় নদীপাড়ে সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য, আধ্যাত্মিক সাধক, গীতিকার সামসুদ্দিন আহমেদ এছাকের সমাধি এবং তাঁর গড়ে তোলা ‘আরশীনগর’। চিনিশপুরের ঐতিহাসিক কালীবাড়ী মন্দির ও আশ্রম, যেখানে একসময় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ছিলো।

নদীপাড়ের বীরপুর-পুরানপাড়ার হাজীপুর অংশে জেলেপাড়া রয়েছে। এই জেলেপাড়ার দিকে তাকালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’-তে বর্ণিত ঘনবসতিপূর্ণ জেলেপাড়ার বর্ণনার কথা স্মরণে আসে।

কলাগাছিয়া/পাহাড়িয়া
পাহাড়িয়া নামের এই নদীটি নরসিংদী জেলাধীন বেলাব-শিবপুর উপজেলার বিলাঞ্চল থেকে উৎপত্তি লাভ করে শিবপুর সদরের শিবপুর বাজারের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শিবপুরের পুরানদিয়া, পালপাড়া, ব্রাহ্মন্দী, খলাপাড়া বাজার, নোয়াদিয়া, জাঙ্গালিয়া হয়ে রায়পুরা উপজেলার ডৌকারচর দিয়ে আমীরগঞ্জের কাছে আড়িয়াল খাঁ নদীতে পতিত হয়েছে।

স্থানীয়ভাবে নদীটি কলাগাইছ্যা (কলাগাছিয়া) নদী নামে সর্বাধিক পরিচিত। নদীর উৎসমুখ বিলাঞ্চল, পতিত হয়েছে আড়িয়াল খাঁ নদীতে। প্রবাহিত হয়েছে নরসিংদী জেলার বেলাব, শিবপুর, রায়পুরা উপজেলার মধ্য দিয়ে। নদীর র্দৈঘ্য প্রায় ২৮ কিলোমিটার, প্রশস্ততা গড়ে ৫৭ মিটার। নদীর গতিপথ সর্পিলাকার। নদীতে সারাবছর পানির প্রবাহ দেখা যায়। তবে বর্ষা মৌসুমে এর প্রবাহমানতা অনেকটা বেড়ে যায়। নদীটি তুলনামূলকভাবে দুষণমুক্ত। শুকনো মৌসুমে নদীর পানিপ্রবাহের দু’পাশের শুকনো জায়গায় ধানের চারা উৎপাদন ও ধানের চাষে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বর্তমানে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। একসময় এই নদীতে লঞ্চ চলতো যাতায়াতের জন্যে। নদীর দুই পাড়ের জনপদে প্রচুর তরি-তরকারি, ফলমূল ও নানা কৃষিপণ্যের প্রচুর ফলনের পেছনে এই নদীর ভূমিকা রয়েছে। সর্পিলাকার এই নদীর গতিপথের দৃশ্য খুবই মনোরম। নরসিংদীর বিশিষ্ট ছড়াকার আবু আসাদ রচিত ‘বর্ষা এলো, বৃষ্টি এলো’ নামে গীতি-নৃত্যনাট্যে এই কলাগাছিয়া নদীর সুন্দর বর্ণনা রয়েছে।

মেঘনা
পৃথিবীর বৃহৎ নদীগুলোর অন্যতম মেঘনা এবং বাংলাদেশে প্রশস্ততায় বৃহত্তম নদী। হিমালয় বলয় বহির্ভূত নদী মেঘনা। আসামের পার্বত্য অঞ্চল থেকে জন্ম নিয়ে ‘বরাক’ নদী আসামের শেরপুরের কাছে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উত্তরের শাখা সুরমা পশ্চিম দিকে ছাতক, সিলেট ও সুনামগঞ্জের উপর দিয়ে ধীর ও সর্পিল গতিতে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করেছে। মেঘনা ভৈরব বাজারের কাছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হয়েছে। তারপর আরো দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে চাঁদপুরের কাছে পদ্মা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। আরো দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে নোয়াখালী ও ভোলা দ্বীপের মধ্য দিয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। সুরমাসহ মেঘনা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৫০ মাইল।

মেঘনা নদী মোট দুটি অংশে বিভক্ত। একটি মেঘনা আপার, অপরটি মেঘনা লোয়ার। উৎস থেকে শুরু করে চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলাধীন ষাটনল পর্যন্ত মেঘনা আপার। নরসিংদী জেলায় প্রবাহিত মেঘনার অংশটি আপার। চাঁদপুর থেকে শুরু করে মেঘনা-পদ্মার মিলিত স্রোত মেঘনা লোয়ার নামে পরিচিত।

মেঘনা পৃথিবীর বড়ো নদীগুলোর মতোই অনেক বেশি বৃষ্টির পানি বহন করে। খাসিয়া-জয়ন্তীয়া পাহাড়, শিলং উপত্যকা ও চেরাপুঞ্জির বৃষ্টির পানি বহন করে আনে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টির বিপুল জলরাশির জন্যে সিলেটে বড়ো বড়ো বিল বা হাওর তৈরি হয়েছে।

চাঁদপুরের কাছে পদ্মা-মেঘনার মিলনস্থলে এবং মেঘনার মোহনার বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যায়। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় মেঘনার নৌ-পথ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মেঘনার কোনো কোনো অংশে, বিশেষ করে ভৈরব-আশুগঞ্জ, নরসিংদী, আড়াইহাজার, দাউদকান্দি অংশের তীরে প্রচুর শিল্পকারখানাও গড়ে ওঠেছে। ভৈরবের রেলওয়ে সেতু, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সেতু, কুমিল্লার দাউদকান্দিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সেতুর যোগাযোগে বিশাল ভূমিকা রয়েছে। মেঘনা নদী নিয়ে দেশ-বিদেশের অনেক কবি-সাহিত্যিক কবিতা-গান রচনা করেছেন। মেঘনার অববাহিকায় রয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত উর্বর ফসলি জমি।

মেঘনা নদী কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবের কাছে এসে ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার সঙ্গমস্থলে নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার রামনগর-গৌরীপুর দিয়ে নরসিংদী জেলায় প্রবেশ করেছে। এখানে মেঘনার দুটি ধারা। মূল ধারাটি পূর্ব-দক্ষিণ পাড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ, নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর উপজেলার সীমান্ত এবং পশ্চিম-দক্ষিণ পাড়ে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চাঁনপুর, পাড়াতলী, বাঁশগাড়ী, মির্জানগর, চরমধুয়া হয়ে নরসিংদী সদর অতিক্রম করে দক্ষিণমুখী হয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অন্য ধারাটিও বিশাল প্রশস্ততায় রায়পুরার মহেষপুর, রায়পুরা সদর, শ্রীনগর, চরসুবুদ্ধি, নীলক্ষ্যা, চর আড়ালিয়া হয়ে নরসিংদী সদর উপজেলার নরসিংদী পৌরসভা এলাকা অতিক্রম করে শিলমান্দী, মহিষাশুড়া, পাইকারচর হয়ে মূল মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে। মাঝখানের চরে নরসিংদী সদর উপজেলার ৪ টি ইউনিয়ন নদীর পলিতে গড়ে ওঠেছে।

মেঘনা নদী | ছবিটি নরসিংদী সদর উপজেলার শেখ হাসিনা সেতুর করিমপুর অংশ থেকে তোলা | ছবিসূত্র : ইন্টারনেট

নরসিংদী জেলার রায়পুরা এবং নরসিংদী সদর উপজেলায় মেঘনা নদী প্রবাহিত হয়েছে। রায়পুরা এবং নরসিংদী সদরে বিশাল চরাঞ্চল গড়ে ওঠেছে মেঘনা নদীর পলিমাটিতে। রায়পুরায় চাঁনপুর, পাড়াতলী, শ্রীনগর, বাঁশগাড়ী, চরমধুয়া, মির্জাচর— এই ৬ টি ইউনিয়নের অসংখ্য গ্রাম মেঘনার দুই প্রবাহের মাঝখানে পলিতে গড়ে ওঠা বিশাল জনপদ। নদীর পশ্চিম প্রান্তের অংশেও মহেষপুর, চরসুবুদ্ধি, নীলক্ষ্যা, চর আড়ালিয়া, নদীর পলিতে গড়া জনপদ। নরসিংদী সদর উপজেলার ৪ টি ইউনিয়ন করিমপুর, নজরপুর, আলোকবালী, চরদিঘলদীর অসংখ্য গ্রামও নদীর মূল দুই প্রবাহের মাঝখানে গড়ে ওঠা চরাঞ্চল। মেঘনার প্রবাহের এই বিশাল চরাঞ্চলে মেঘনা নদীর মূল দুই প্রবাহের পাশাপাশি মেঘনার অসংখ্য শাখাও জালের মতো বিস্তৃত হয়ে আছে। নরসিংদীর মানচিত্রের দিকে তাকালে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। এই চরাঞ্চল নরসিংদীর জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিকে করেছে বৈচিত্র্যময়। এই বৈচিত্র্য নরসিংদীর ভূমিতে বিশেষভাবে দৃষ্টিযোগ্য। নরসিংদী জেলার উত্তর-পূর্ব দিকে লালমাটির পাহাড়, টিলা, ব্রহ্মপুত্র নদের পলিতে গড়া প্রাচীন সমতল ভূমি, বৃক্ষরাজির বনাঞ্চলের বৈচিত্র্যময় এলাকা। সেখানে কয়েক হাজার বছর পূর্বের উয়ারী-বটেশ্বরসহ অনেক প্রত্নস্থান আবিষ্কৃত হয়েছে। দক্ষিণ অংশে মেঘনার নতুন মাটির বিশাল চরাঞ্চল, যে-অঞ্চলের ভাষা, জীবনযাত্রা, প্রাকৃতিক পরিবেশ নরসিংদীকে বৈচিত্র্যমণ্ডিত করেছে।

নদীবেষ্টিত নরসিংদীর চরাঞ্চলের মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষি ও মাছ ধরা। সারা বছরই মাছ ধরার কাজ চলে। শীত মৌসুমে জালের মতো জড়িয়ে থাকা নদীর শাখা-প্রশাখায় প্রচুর মাছের ঘের থেকে বড়ো বড়ো মাছ ধরা হয়। নদীপাড়ের এই জনপদে ধান, পাট, গম, আলু, মরিচ, সরিষা ছাড়াও প্রধান অর্থকরী ফসল উচ্ছে, তরমুজ, বাঙ্গি, খিরা প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। আর রয়েছে গৃহপালিত পশু-পাখি। পানিবেষ্টিত এলাকা হিসেবে প্রচুর হাঁস পালিত হয় এই অঞ্চলে।

অতীতে চরাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের প্রধান বাহন ছিলো নৌকা এবং পায়ে হাঁটা। ঘরে ঘরে ছিলো নৌকা। বর্তমানে রাস্তাঘাট হয়েছে। নরসিংদী সদরের চরাঞ্চলের সাথে যোগাযোগের জন্যে মেঘনা নদীতে শেখ হাসিনা সেতু নির্মিত হয়েছে। এই সেতু মানুষের জীবনযাত্রার ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। নরসিংদীর মেঘনায় এখনো লঞ্চ চলে; নরসিংদী হতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মরিচা, বাঞ্ছারামপুর, সলিমগঞ্জ, নবীনগর রুটে। সিলেট, সুনামগঞ্জ থেকে ভৈরব বাজার-আশুগঞ্জ-নরসিংদী হয়ে মেঘনার নৌ-পথে ভারি-মাঝারি-ছোটো নৌ-যানে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনসহ সারাদেশের সাথে এখনো যোগাযোগ রয়েছে। একসময় নারায়ণগঞ্জ থেকে ভৈরব বাজারের মেঘনার নৌ-পথে স্টিমার চলতো। নরসিংদী অংশে গুরুত্বপূর্ণ ঘাট ছিলো ভঙ্গারচর (বালাপুর জমিদার বাড়ির ঘাট), নরসিংদী সদর ঘাট, হাইরমারা-মনিপুরা বাজার, রায়পুরা।

নরসিংদীর মেঘনা নদীবাহিত চরাঞ্চলের একটি অসুন্দর বিষয়ও যুগ যুগ ধরে বহন করতে হচ্ছে জনপদটিকে। সেটি হলো বংশগত-গোষ্ঠীগত-গ্রামগত বিরোধ ও অন্যান্য তুচ্ছ সমস্যা নিয়ে মারামারি-খুনখারাবি। ঘোষণা দিয়ে লাঠি, পুরকি, বল্লম, রামদা’, বাঁশের চিকন ফলাযুক্ত নানা অস্ত্র নিয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষ ও লড়াই, যা একটানা কয়েকদিনও চলে। সারাদেশের মানুষ এই লড়াইকে ট্যাঁটাযুদ্ধ হিসেবে চেনে।

এই চরাঞ্চলে অনেক গুণীজনেরও জন্ম হয়েছে, যাঁদের শৈশব কেটেছে নদীপাড়ের জীবনযাত্রায়। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম যোদ্ধা শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের নাম, যাঁর পৈতৃক নিবাস ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার মিলনস্থল রায়পুরার রামনগরে। একই গ্রামের সন্তান সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ আলাউদ্দিন আল আজাদ, মুক্তিযোদ্ধা ও আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন। রায়পুরার পাড়াতলী গ্রামের সন্তান ও আমাদের কালের শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি শামসুর রাহমানসহ অনেক গুণী মানুষের জন্ম ও শৈশবস্মৃতি নিয়ে বেড়ে ওঠা এই মেঘনার পাড়। কবি শামসুর রাহমান মেঘনা নদী নিয়ে তাঁর ‘একজন নদীর উদ্দেশে’ কবিতায় অসাধারণ ও আবেগময় অনুভূতি প্রকাশ করেছেন :

মাতামহ, পিতা নব্য জীবিকার টানে গ্রাম বাংলার ছোট
পাড়াতলী ছেড়ে, থই থই ধানশোভা,
মেঘনার তটভূমি, তরঙ্গে তরঙ্গে রৌদ্র-চাঁদিনীর ব্যালে
অনেক পেছনে রেখে ইট পাথরের
বেগানা শহরে ডেরা বাঁধলেন। শর্ষেক্ষেতময় প্রজাপতি, ঘুঘু,
মেঘনার ঢেউয়ের সঙ্গীত রক্তে দিয়েছে অদম্য কত দোলা।
* * *
মেঘনা আমার প্রিয়া কেন এমন ব্যাকুল ডাকো বারবার?
মেঘনা আমার শৈশবের, যৌবনের কতদিন করেছ হরণ
অনায়াসে, আমার ভেতরে
জাগিয়েছ কী বিপুল অগণিত ঢেউ,
আজও এই আমার নবীন বার্ধক্যের নানান প্রহরে
ঝলসে উঠছ তুমি, কখনও কখনও
তোমার নিকট যাই, ছুঁই
তোমার শরীর গাঢ় অনুরাগে, জানি
মৃত্যুর পরেও আমি দেখব তোমাকে ভাবীকালে
যুগযুগান্তরে বংশধরদের উৎসুক দৃষ্টিতে।

শেষকথা
জীবন নদীর মতোই গভীর ও বহমান। নরসিংদীর পুরো জনপদকে ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা এবং তাদের শাখা শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ, কলাগাছিয়া, হাড়িধোয়া, গঙ্গাজলী, কয়রা একেবারে মাকড়সার জালের মতো ঘিরে আছে নদীর বহমান ধারায়। এই নদীগুলোই নরসিংদীর প্রাণ, প্রাণের প্রবাহ। অথচ যে-নদীগুলো নরসিংদীর প্রাণ, নরসিংদীর জন-জীবনের প্রাণ, সেই নদীগুলো অনেক জায়গায় আজ মৃত। মানুষ ও প্রকৃতির বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় নদীর মৃত্যুঘণ্টা বাজছে। পয়ঃনালী, ড্রেনের দূষিত পানি, শিল্প ও কল-কারখানার বর্জ্য, লঞ্চ ও নৌ পরিবহনের জ্বালানি তেলের বর্জ্য নদীর পানিকে করেছে দূষিত। পাঁচদোনা-মাধবদীতে মৃত ব্রহ্মপুত্র’র ক্ষীণ প্রবাহে শিল্পবর্জ্য, হাড়িধোয়ার পানি ও মাটির দূষণ, শীতলক্ষ্যা-মেঘনার দূষিত পানি আমাদের নরসিংদীবাসীকে প্রতিনিয়ত কাঁদায়। একদিকে নদীর নাব্যতা কমছে, পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে নদী-পরিবেশ শিকার হচ্ছে দূষণের। নদী, নদীর মাটি, পানির প্রবাহ যেভাবে মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছে, তা থেকে আমরা নদীকে বাঁচাতে চাই। বাঁচাতে চাই নরসিংদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং দীর্ঘকালে গড়ে ওঠা জনপদকে। আর সত্যিকার অর্থেই যদি তা চাই, তাহলে চিন্তা-ভাবনা বা অপেক্ষার এখন আর অবকাশ নেই। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা মাথায় রেখে এখনই কাজে নেমে পড়তে হবে।


তথ্যসূত্র
১. মহেশ্বরদীর ইতিহাস, সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থ;
২. বাংলাদেশের নদ-নদী, মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক;
৩. বাংলাদেশের নদীকোষ, ড. অশোক বিশ্বাস;
৪. বাংলাদেশের নদী, মোকারম হোসেন;
৫. ঢাকার ইতিহাস, যতীন্দ্রমোহন রায়;
৬. উয়ারী-বটেশ্বর : শেকড়ের সন্ধানে, সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ও মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান;
৭. নদী সংখ্যা ১৯৯৯-২০০০, মীজানুর রহমান ত্রৈমাসিক পত্রিকা;
৮. নরসিংদীর নদ-নদীর বিবরণ, আপেল মাহমুদ সাথী।


গোলাম মোস্তাফা মিয়া
সাবেক অধ্যক্ষ, নরসিংদী সরকারি কলেজ