বাঙলা অঞ্চল রিপন ইউসুফের প্রধানত চূড়ান্ত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো। রাজনৈতিক ও ভূখণ্ডগত বাংলাদেশের স্বর্ণোজ্জ্বল অতীতকে হৃদয়ে ও মগজে ধারণ করে বর্তমানের বিধ্বস্ত দিশাহীন বাংলাদেশের উন্নয়নের সমাধান খোঁজার চেষ্টায় রত ছিলো নিয়ত।
সাহিত্যের বাজারে পূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ যে সাধনার বিষয়, দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে একটা প্রকৃষ্ট মাহেন্দ্রক্ষণে এটা ঘটে— এই বোধবুদ্ধি রিপন ইউসুফের জানা ছিলো খুব যথাযথভাবেই। এমনিতেই দেশি-বিদেশি সাহিত্যপাঠের গহ্বরেই তার নিত্য পরিভ্রমণ ছিলো। মূলত সে লিখতো কবিতা, পরে গল্প, তারও পরে প্রবন্ধ। তবে গল্প নিয়ে বেশি সিরিয়াস ছিলো। জাতীয় বিভিন্ন পত্রিকায় গল্প ছাপা হবার পর আত্মবিশ্বাসও বেড়ে গিয়েছিলো। তার প্রথম গল্পগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত ছিলো, এবং প্রকাশনীর দ্বারে করাঘাত করা হচ্ছিলো মাত্র।
কিন্তু রিপন ইউসুফ সাহিত্যের পরিমণ্ডলে নিছক ‘সাহিত্য’ করার জন্যেই বিচরণ করতে চায় নাই। এরকম অভীপ্সা তার ছিলো না। সে একটা ফিলোসফি ধারণ করতো। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায় অনুভব করতো।
বাঙলা অঞ্চল রিপন ইউসুফের প্রধানত চূড়ান্ত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো। রাজনৈতিক ও ভূখণ্ডগত বাংলাদেশের স্বর্ণোজ্জ্বল অতীতকে হৃদয়ে ও মগজে ধারণ করে বর্তমানের বিধ্বস্ত দিশাহীন বাংলাদেশের উন্নয়নের সমাধান খোঁজার চেষ্টায় রত ছিলো নিয়ত। এবং সমাধান সে জানতোও। মূলত এগুলোই রিপন ইউসুফের লেখালেখি, পড়াশোনা আর চিন্তার নিয়মিত অনুষঙ্গ ছিলো।
চারপাশে এই যে রাষ্ট্র আর রাজনীতি বুঝে ফেলা প্রচুর মানুষের দঙ্গল, নিজেদের মগজে যতোটুকু ধারণক্ষমতা, ততোটুকু দিয়েই সমাজ-রাষ্ট্র-দর্শন ইত্যাদি নিজেদের বাপ-দাদা প্রভাবিত মতামত দ্বারা আদিষ্ট হয়ে উচ্চবাচ্য করা মানুষের মব, ৫৪ বছরেও বুদ্ধিজীবী আর তাত্ত্বিকদের ব্যর্থতার ভাগাড় এই আমার রাষ্ট্র, কেন এখনো ভাগাড়ই রয়ে যাবে— এইসব প্রশ্ন উত্থাপন আর উত্তর খোঁজার চিন্তার প্র্যাক্টিস রিপন ইউসুফের মজ্জাগত বিষয় ছিলো। মানুষেরা আসলে ভালো সমাধান চায়, কিন্তু এর বিপরীতে একেকজন বিএনপি, আওয়ামী লীগ, বাম আর হেফাজতের ভেতর এসবের সমাধান খোঁজে, এরকম ভাবনায় রিপন ইউসুফ প্রথমে আমোদ অনুভব করতো, পরে গভীরভাবে ভাবতো। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে রাষ্ট্রে, প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধপরায়ণতায় নিয়মিত ব্যস্ত থাকছে মানুষেরা, একই কাজ কিন্তু সবাই করছে, দুই বা তিনদলে বিভক্ত হয়ে একে অপরকে একই ভাষায় গালাগাল করছে— স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ এরকম বলে। এবং এসব তৎপরতাকে মানুষ ভাবছে রাজনীতি। এইসব তাৎপর্যহীন আচরণ আর এক্টিভিজম চলছে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী।
সাইত্রিশ বছরের একটা যুবক এক দশক নিবিষ্টভাবে পরিশ্রম ও সাধনা করে গেছে সাহিত্য, দর্শন, চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো শিল্পকলার এমনসব উৎকর্ষের সাথে, যা নিজের সাথে সাথে সমাজ-রাষ্ট্র বা মানুষের অন্তর্জগতে আলোড়ন তুলতে পারার মতো গৌরব বয়ে আনতে পারতো।
রিপন ইউসুফ সমাজ আর রাষ্ট্রকে আর সামাজিক বা রাজনৈতিক দর্শনকে পরিশুদ্ধ করার পথঘাট খুঁজে পেয়েছিলো বাঙলার একদম প্রাকআর্য যুগে। সেখান থেকেই মণিমুক্তা সংগ্রহ করে প্রচার করাই ছিলো তার সাহিত্য আর বক্তব্য আর চিন্তার প্রধান অভিপ্রায়। প্রস্তুতিও শেষ হয়ে গিয়েছিলো। এখন কেবল প্রকাশের পালা।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখ আমরা নির্ধারণ করেছিলাম ‘রিপন ইউসুফের একক বক্তৃতা’ আয়োজনের। বিষয় ছিলো ‘কেন জাতীয়তাবাদ; প্রসঙ্গ রাজনৈতিক বাংলাদেশ’। নরসিংদীতেই আয়োজন করার প্রস্তুতি সম্পন্ন ছিলো আমাদের। বর্তমান রাষ্ট্রের জন্যে এক আলোচিত বিষয় ছিলো এটা। উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর পর্বও ছিলো। জাতীয়তাবাদ নিয়া মানুষের যে আপ্ত কিছু ধারণা আর জ্ঞান, যে নিন্দা আর ভুল বোঝাবুঝির আস্তরণ, মূলত এগুলো নিরসনের চেষ্টা করা যুক্তি আর বাস্তবতার মাধ্যমে— এই আয়োজনের উদ্দেশ্য ছিলো এরকমই। কিন্তু হায়, জানুয়ারির শেষের দিকেই তার দুরারোগ্য ব্যাধি ধরা পড়ে এবং নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে থাকে। কেবল মনের জোরে পরবর্তী আট মাস টিকে ছিলো সে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এতোটা সক্রিয় ছিলো না রিপন ইউসুফ। সে যে-সোসাইটিতে বসবাস করতো, সেখানেও নয়। খুব অল্প মানুষের সাথেই কথা-গল্প-আড্ডা আর চিন্তা বিনিময় করতে পারতো।
রিপন ইউসুফ ৫ আগস্টের একদিন পর ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলো, অভ্যুত্থান বেহাত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল! আমরা এক বছর অতিবাহিত করার পর তার ভবিষ্যতবাণীর মর্ম বুঝতে পারছি।
এটা আমাদের জন্যে বড়ো বেদনার মতো বাজে যে, সাইত্রিশ বছরের একটা যুবক এক দশক নিবিষ্টভাবে পরিশ্রম ও সাধনা করে গেছে সাহিত্য, দর্শন, চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো শিল্পকলার এমনসব উৎকর্ষের সাথে, যা নিজের সাথে সাথে সমাজ-রাষ্ট্র বা মানুষের অন্তর্জগতে আলোড়ন তুলতে পারার মতো গৌরব বয়ে আনতে পারতো। অথচ সবকিছু একটা ব্যাগে ভরে আত্মপ্রকাশের রাস্তায় পা ফেলার সাথে সাথেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। আর দেখা গেলো না কোথাও। আমরা এটা জেনে ফেলেছি যে, সত্যিকার অর্থেই আর কখনো কোথাও তাকে দেখা যাবে না। কী হাস্যকর অদ্ভুত বিচারব্যবস্থা নিয়তির! মানুষজন্মের অ্যাবসার্ডিটি নিয়ে নূতন করে আর ভাবার কী আছে বুঝি না!
রিপন ইউসুফের অপ্রকাশিত সব লেখাপত্র শীঘ্রই প্রকাশিত হচ্ছে বলে জানি। তার চিন্তার প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত থাকবে সদা তার সেসব লেখার মধ্যেই।
সুমন ইউসুফ
সভাপতি, বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ, নরসিংদী