স্থানীয় সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর

স্বাধীনতার পরপর নরসিংদী ঢাকা জেলার একটি ছোটো থানা শহর। সাংবাদিকদের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিককে নিয়ে ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর গড়ে তোলেন নরসিংদী প্রেস ক্লাব। সবাই মিলে প্রধান সাংবাদিক হিসেবে তাঁকেই সভাপতি নির্বাচিত করেন।

একজন নির্লোভ ও মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ ছিলেন ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর (১৯২৫-১৯৮৩)। এসব বিশেষণের প্রভাব পড়েছিলো তাঁর কর্মজীবনে— সাংবাদিকতায়। দিনের পর দিন অভুক্ত থেকেও মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিরসনে তিনি আপোষহীন কলমযোদ্ধা ছিলেন। পকেটে টাকা নেই, পেটে ভাত নেই— এমন দারিদ্র্য তাঁর পেশায় পিছুটান আনতে পারেনি। ঢাকার নিকটবর্তী নরসিংদী জনপদে ঘুরে ঘুরে মানুষের দুঃখ-কষ্ট আর সমস্যা খুঁজে বেরিয়েছেন আমৃত্যু। সেসব সংবাদপত্রে প্রকাশ করে সমাধানের পথ সুগম করে গেছেন।

নরসিংদীর এমন কোনো গ্রাম কিংবা দুর্গম এলাকা ছিলো না, যেখানকার মানুষ ঈশ্বর চন্দ্রের নাম জানতেন না। তবে তিনি ‘ঈশ্বর বাবু’ নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। গায়ে হাফ-হাতা তিন পকেটঅলা শার্ট আর লুঙি, পায়ে চটি চাপিয়ে ভোরবেলা বাসা থেকে বের হতেন। পকেটে কলম আর নোটবুক ছিলো সর্বদা তাঁর সঙ্গী। মানুষের সব সমস্যা নিজের মাথায় নিয়ে ঘুরতেন। কীভাবে রিপোর্ট লিখলে মানুষ সেটা থেকে মুক্তি পাবে, সেই চিন্তা-ভাবনায় মগ্ন থাকতেন। কখনো নিজের সমস্যার কথা ভাবেননি। কখনো প্রচণ্ড ক্ষিধেয় কাহিল হয়ে পকেটের কোণ হাতড়ে খুচরো পয়সা পেলেও তা দিয়ে ভাত কিংবা রুটি খাওয়া সম্ভব ছিলো না। অগত্যা সামান্য মুড়ি কিনে ক্ষুধা নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। এভাবে জীবন ধারণ করতে গিয়ে সংসার-ধর্ম করার কথা তাঁর মনেই আসেনি। অকৃতদার জীবন বেছে নিয়েছিলেন নির্বিঘ্নে সাংবাদিকতা পেশা চালিয়ে যাবার জন্যে।

পাকিস্তান আমলে ঈশ্বর বাবু যখন সাংবাদিকতা শুরু করেন, তখন নরসিংদী ছিলো ঢাকা জেলাধীন নারায়ণগঞ্জ মহকুমার একটি মফস্বল থানা শহর। এর পার্শ্ববর্তী থানাগুলো, যেমন : শিবপুর, রায়পুরা, মনোহরদী, পলাশ ও বেলাব অবশ্য তেমন উন্নত ছিলো না। এসব এলাকার লোকজন কেনাকাটা কিংবা চিকিৎসা নিতে নরসিংদী থানা শহরে আসতেন। পরবর্তীতে নরসিংদী হয়ে ওঠে এসব থানার কেন্দ্রস্থল। এর ধারাবাহিকতায় থানা শহরটি প্রথমে মহকুমা, পরে জেলা শহরে পরিণত হয়। নৌকাঘাটা শিবপুর থানাধীন লালমাটির সভ্যতা ঘেরা একটি গ্রামের নাম। সেই গ্রামের সূত্রধর পরিবারে ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন ঈশ্বর বাবু। তাঁর বাবার নাম শ্যামাচরণ সূত্রধর। বাল্যকাল সে-গ্রামেই কাটে। বাবা কাঠের কাজ (আসবাবপত্র, গৃহনির্মাণ ও নৌকা বানানো) করে জীবিকা  নির্বাহ করতেন। কিন্তু ছেলেকে তিনি সূত্রধর বা মিস্ত্রি বানাতে চাননি। এভাবে এইচএসসি পাশ করার পর আর উচ্চশিক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে। পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। কিন্তু তখন তাঁর মাথায় কাজ করছিলো অন্য এক চিন্তা। মওলানা ভাসানী, মাওলানা আকরম খাঁ, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সন্তোষ গুপ্ত প্রমুখের বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনে আকৃষ্ট হন ঈশ্বর বাবু। বিশেষ করে, মানিক মিয়ার আপোষহীন ও সাহসী সাংবাদিকতা তাঁর মনে গেঁথে যায়। তাই তিনি মাস্টারি ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতা পেশা গ্রহণে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু গ্রামে থেকে এ-ধরনের সাংবাদিকতা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়েই নরসিংদী চলে আসেন। এখানে নেই তাঁর আশ্রয়, নেই কোনো আত্মীয়-স্বজন। অনেকটা ভবঘুরে জীবন বেছে নেন। পেটে ভাত না থাকলেও চোখে-মুখে সাংবাদিক হওয়ার দীপ্ত আলোর রশ্নি ভাসতে থাকে। সফলও হন। তখন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ দেশের সবচে’ জনপ্রিয় পত্রিকা এবং সেটির ভূমিকা ছিলো দুঃসাহসিক। এর সঙ্গেই যুক্ত হলেন ঈশ্বর বাবু। নরসিংদীর সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এভাবে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত  ইত্তেফাকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু ঠুনকো একটি ঘটনায় ইত্তেফাকের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য দেখা দেয়। ছেড়ে দেন প্রিয় ইত্তেফাক। এরপর সংযোগ ঘটে সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘বাসস’-এর সঙ্গে। ১৯৮৩ সালের ১৬ অক্টোবর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাসসের সঙ্গে ছিলেন তিনি।

বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনে মহকুমা প্রশাসক, মন্ত্রী, সচিব কিংবা ডিসি-এসপিদের সান্নিধ্যে জীবন কাটালেও ব্যক্তিগত জীবন ছিলো অত্যন্ত সাদামাটা এবং দারিদ্র্যে নিমজ্জিত। এরপরও পকেটে দু-চারশো টাকা থাকলে রাজা হয়ে যেতেন। আশেপাশের মানুষজন কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের যত্ন করে খাওয়াতেন। পকেট খালি থাকলেও চুপ করে বসে থাকতেন। না খেয়ে থাকলেও কিছু বলতেন না। তখন একমুঠো মুড়ি কিংবা চিড়া খেয়ে জীবনধারণ করতেন।

ঈশ্বর বাবুর ঘনিষ্ঠ শিষ্য নিবারণ রায় জানান, অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন ঈশ্বর বাবু। কোনো চাহিদা ছিলো না। টাকা থাকলে খেতেন, না থাকলে উপোস থাকতেন। বসবাস করতেন নরসিংদী শহরের পশ্চিম কান্দাপাড়াস্থ বিধুভূষণ দাসের এক ছাপড়াঘরে। ভাড়া ২০-২৫ টাকা মাত্র। চিরকুমার এ-মানুষটির ঘর-সংসার ছিলো না সত্যি, কিন্তু তিনি পুরো নরসিংদীবাসীকে নিজের সংসার মনে করতেন। অসহায়-গরীব মানুষকে নিজের সন্তানতুল্য মনে করতেন। কখনো তিনি সম্পদের পেছনে ছোটেননি। নিজের এক টুকরো জমি বরাদ্দের জন্যে ডিসি-এসপিকে অনুরোধ করেননি।

বর্ষীয়ান সাংবাদিক নিবারণ বাবু আরো জানান, “১৯৭৪ সালে তিনি ইত্তেফাক ছেড়ে দিলেও তিনি আমাকে সে-পত্রিকার সাংবাদিক হিসাবে নিয়োগ দিতে অনেক চেষ্টা করেন। সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে অনুরোধ করেন, আমাকে নরসিংদী প্রতিনিধি করার জন্য। তাঁর কাছ থেকে হাতে-কলমে সাংবাদিকতা শিখি। এমন সৎ সাংবাদিক আমি জীবনে দেখিনি। অনেক সময় উপোস থেকে আমাদের বাসায় যেতেন। কখনো মুখ ফুটে কিছু বলতেন না। আমার মা অনেক সময় তাঁকে জোর করে খাওয়াতেন। তিনি সাংবাদিকতার জন্য  জীবন বিলিয়ে গেছেন। কিন্তু নিজে কোনো কিছু প্রত্যাশা করেননি। দুঃখজনক বিষয় হলো, নরসিংদীর মানুষ তথা সাংবাদিক সমাজ এ-মহান ব্যক্তিটিকে ভুলে গেছে।”

নরসিংদী প্রেস ক্লাব সূত্রে জানা গেছে, উক্ত প্রেস ক্লাবের জন্ম ১৯৭২ সালে। স্বাধীনতার পরপর নরসিংদী ঢাকা জেলার একটি ছোটো থানা শহর। সাংবাদিকদের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিককে নিয়ে ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর গড়ে তোলেন নরসিংদী প্রেস ক্লাব। সবাই মিলে প্রধান সাংবাদিক হিসেবে তাঁকেই সভাপতি নির্বাচিত করেন। সাধারণ সম্পাদক হন বাবু নিবারণ রায়। এভাবে পথচলা শুরু হয় নরসিংদী প্রেস ক্লাবের। এরপর উক্ত প্রেস ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এবং দূতাবাস কর্মকর্তা স্বপন কুমার সাহা, ‘নরসিংদীর খবর’-এর সম্পাদক হাবিবুল্লাহ বাহারের মতো বরেণ্য সাংবাদিকরা। তাছাড়া উক্ত প্রেস ক্লাবের সঙ্গে জড়িত অনেকেই পরবর্তী জীবনে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। বর্তমানে নরসিংদী প্রেস ক্লাব সাংবাদিকদেরকে বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়ে যাচ্ছে। নিজস্ব বহুতল ভবনে বসে সাংবাদিকেরা পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি আড্ডা ও পরামর্শ করছেন। অথচ এর গোড়াপত্তন করে গেছেন ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর।

ঈশ্বর বাবুর শেষ জীবনটা ছিলো সবচে’ মর্মান্তিক। অর্থকষ্টে সঠিক চিকিৎসা পর্যন্ত করতে পারনেনি। আত্মীয়-পরিজনবিহীন অবস্থায় ডায়বেটিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কঠোর নিয়ম-নীতি আর ব্যয়বহুল ঔষধের অভাবে মধ্যবয়সেই ঝরে পড়েছিলেন তিনি। শরীরে আঘাতজনিত কারণে তিনি গ্যাংগ্রিনে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ডায়বেটিস থাকায় সেটা সহজে সেরে ওঠছিলো না। একপর্যায়ে সে-আঘাত ভয়াবহ রূপ ধারণ করে অর্থের অভাবে। শিষ্য নিবারণ বাবু স্বউদ্যোগে গুরুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেন। কিন্তু অবস্থাটা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো যে, সেখান থেকে তাঁর অবস্থা ভালোর দিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৩ সালের ১৬ অক্টোবর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে মৃত্যুবরণ করেন। তখন তাঁর জন্যে চোখের পানি ফেলার মতো একজন সহকর্মী কিংবা আত্মীয়ও ছিলো না। সে-সময় লাশ গ্রহণ এবং সৎকারের লোক খুঁজে পাচ্ছিলো না মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ। অবশেষে নিবারণ বাবু এবং তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা’র প্রচেষ্টায় একটি ট্রাকে করে প্রবীণ সাংবাদিক ঈশ্বর বাবুর লাশ নরসিংদীতে আনা হয়। এবার বিপত্তি বাধলো হিন্দু ধর্ম অনুসারে তাঁর মুখাগ্নি নিয়ে। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী, একজন নিকটাত্মীয় কিংবা সন্তানকে এ-দায়িত্ব পালন করতে হয়। কিন্তু সেখানে এমন কেউ ছিলেন না। এগিয়ে এসে শিষ্য নিবারণ রায় গুরু ঈশ্বর বাবুকে মেঘনা নদীতীরবর্তী শ্মশানে নিয়ে সৎকার করলেন। মুখাগ্নি করলেন নিজ হাতে। এভাবে একজন সাংবাদিকের ট্র্যাজেডিপূর্ণ ইতিহাসের জন্ম হলো নরসিংদীতে।

তিনি যখন মারা যান, তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে তাঁর লাশ গ্রহণের জন্যে কোনো আত্মীয়-স্বজন পাওয়া যায়নি। শিষ্যদের প্রচেষ্টায় তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিলো। এরপর হঠাৎ করে এই অকৃতদার মানুষটির আত্মীয়-স্বজনের আবির্ভাব ঘটে। মূলত তারা ঈশ্বর বাবুর ব্যাংক-ব্যালেন্সের খোঁজ করতে এসেছিলেন।

এই ত্যাগী ও বড়ো সাংবাদিককে নিয়ে ছোটো একটি স্মৃতি রয়েছে আমার। আমি তখন জন্মস্থান দিলারপুরের ছঘরিয়া পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি, তৃতীয় শ্রেণিতে। সে-সময় এক প্রচণ্ড ঝড়ে স্কুলগৃহটি উড়ে যায়। ফলে খোলামাঠে ক্লাশ করতে হতো আমাদের। এর মধ্যে একদিন হেডমাস্টার স্যার ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বললেন, আগামীকাল সবাই ভালো কাপড়-চোপড় পরে আসবে। আমরা ধরে নিই, আগামীকাল হয়তো স্কুল পরিদর্শক আসবেন। কিন্তু পরদিন দেখা গেলো, একজন সাংবাদিক কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে হাজির হলেন। খোলা মাঠে ক্লাশ নেয়ার দৃশ্য ধারণ করে সাংবাদিক সাহেব চলে গেলেন। পরদিন দেখলাম, ইত্তেফাক পত্রিকায় সেই ছবিসহ একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে। সংবাদের শুরুতে ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর নামটি রয়েছে। হেডস্যার পত্রিকা বগলদাবা করে স্কুলে হাজির। এর কিছুদিন পর জানতে পারলাম, সংবাদটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই স্কুলগৃহের নির্মাণকাজ শুরু হয়ে যায়। কাঁচা ঘর পাকা ভবনে রূপ নেয়। ঘটনাটি আমার মনে বেশ দাগ কাটে। তাৎক্ষণিকভাবে সাংবাদিক ঈশ্বর বাবুকে আমার কাছে সংবাদের জাদুকর মনে হয়েছিলো। একটিমাত্র সংবাদে উড়ে যাওয়া স্কুলগৃহ পাকা দালানে পরিণত হয়েছে। তাঁর এই কীর্তিতে আমার মনে একটি প্রশ্ন উঠেছিলো, সাংবাদিকেরা আসলে কি মানুষ, না অন্য গ্রহের জীব? ঈশ্বর বাবুর এই জাদুকরী কাণ্ডের প্রভাব পরবর্তীতে আমার পেশাগত জীবনের উপর পড়ে। সাংবাদিক হওয়ার সুপ্ত বাসনা মনে অঙ্কুরিত হতে থাকে। ভিন্ন এক নায়কের আসন লাভ করেন ঈশ্বর বাবু।

এ-নায়কের আর্থিক অবস্থা জানতে পারি আরো অনেক পরে। আমি তখন একটি জাতীয় দৈনিকের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত। ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে নরসিংদী প্রেস ক্লাবে আড্ডাচ্ছলে ঈশ্বর বাবু সম্পর্কে খোঁজ-খবর করি। ইত্তেফাকের সাংবাদিক নিবারণ বাবু ছাড়া অন্যান্য সাংবাদিকেরা তাঁর সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য জানেন না। তাঁর ঘনিষ্ঠ অনেক সাংবাদিক মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেকে বয়োবৃদ্ধ অবস্থায় আছেন। তাই তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের বিস্তারিত উপাত্ত জানা সম্ভব হয়নি। টুকরো টুকরো স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে ঈশ্বর বাবুর মর্মান্তিক এক কাহিনি জানা গেলো। তিনি যখন মারা যান, তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে তাঁর লাশ গ্রহণের জন্যে কোনো আত্মীয়-স্বজন পাওয়া যায়নি। শিষ্যদের প্রচেষ্টায় তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিলো। এরপর হঠাৎ করে এই অকৃতদার মানুষটির আত্মীয়-স্বজনের আবির্ভাব ঘটে। মূলত তারা ঈশ্বর বাবুর ব্যাংক-ব্যালেন্সের খোঁজ করতে এসেছিলেন। নরসিংদীতে কোনো সহায়-সম্পত্তি কেনা আছে কি না, তা-ও জানতে চেষ্টা করেন। কিন্তু অনেক অনুসন্ধান করেও নগদ অর্থ কিংবা জমি-জমার কোনো হদিস করতে পারেননি। সোনালী ব্যাংকে একটি একাউন্টের সন্ধান পেলেও সেখানে কানাকড়িও সঞ্চিত ছিলো না। বাড়ি-ঘরের খোঁজ করে জানতে পারেন, তিনি বড়ো সাংবাদিক হয়েও ছোটো একটি ভাড়া করা খুঁপড়ি ঘরে থেকেছেন। ঈশ্বর বাবুর টাকা-পয়সা আর সম্পত্তির অনুসন্ধান করতে এসে তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের বরং কিছু গাঁটের পয়সা খরচ হলো।

নরসিংদী প্রেস ক্লাব, বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা ও জেলা প্রশাসকের দপ্তরে খোঁজ করে প্রয়াত সাংবাদিক ঈশ্বর বাবুর কোনো স্মৃতিচিহ্ন পাওয়া যায়নি। এমনকি তাঁর প্রতিষ্ঠিত নরসিংদী প্রেস ক্লাবেও কোনো স্মৃতি সংরক্ষিত নেই। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে প্রেস ক্লাবে ছবি টাঙানোর রেওয়াজ থাকলেও সেটা বাস্তবায়িত হয়নি। ক্লাবের একাধিক সদস্য জানান, ঈশ্বর বাবুর ছবি রাখতে কারো আপত্তি নেই। কিন্তু তাঁর ছবি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে তাঁর এবং প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নিবারণ রায়— দুজনের ছবিই প্রেস ক্লাবে সংরক্ষণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মাখন দাস বলেন, “ঈশ্বর বাবু আমাদের অনুকরণীয় ছিলেন। তিনি নিঃস্বার্থভাবে লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে সাংবাদিকতা করে গেছেন। মৃত্যুর সময় তাঁর নিজের এক টুকরো জমিও ছিলো না। ব্যাংকে এক পয়সাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই এই মহৎ সাংবাদিকের স্মৃতি রক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সভায় আলোচনা হয়েছে। অচিরেই ক্লাবের পক্ষ থেকে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হবে। সেখানে প্রয়াত সব সাংবাদিকদের ছবিসহ জীবনী অন্তর্ভুক্ত থাকবে।”

নরসিংদীর ইতিহাস এবং নরসিংদীর গুণীজন সম্পর্কিত বেশ কিছু বই-পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। সেখানেও ঈশ্বর বাবু বেশ অবহেলিত। কোনো কোনো গ্রন্থে তাঁর নাম পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়নি। কোনো বইয়ের পাতায় বেশ দীনতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে দু-চার লাইন ব্যয় করা হয়েছে। এর মধ্যে শফিকুল আসগরের ‘নরসিংদীর ইতিহাস’ গ্রন্থে সাড়ে পাঁচ লাইনের বিবরণ দেয়া হলেও এতে কিছু তথ্যবিভ্রাট রয়েছে। তিনি ১৯৮৩ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে মৃত্যুবরণ করলেও সে-বইয়ে তাঁর মৃত্যুর সাল ১৯৮৫ সাল উল্লেখ করা হয়। মৃত্যুস্থান নরসিংদী শহর বলা হয়। তবে সরকার আবুল কালামের লেখা ‘নরসিংদীর গুণীজন’ বইয়ে ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধরের একটি স্কেচ দেয়া হয়েছে। জানতে পারি, কোনো-এক পত্রিকায় ছাপা হওয়া ঈশ্বর বাবুর অস্পষ্ট একটি ছবি থেকে স্কেচটি করানো হয়েছিলো। বইটিতে ঈশ্বর বাবুকে যথার্থ চারণ সাংবাদিক হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, “নরসিংদী যখন থানা, সাংবাদিক শব্দটিও বোধহয় সে সময় সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত ছিলো না, সে সময় তিনি সাদা হাফশার্ট আর লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়াতেন সংবাদের নেশায়। …চিরকুমার এ-চারণ সাংবাদিক দীর্ঘরোগ ভোগ করে চরম অবহেলা আর অবজ্ঞায় জীবনের শেষ সময় অতিবাহিত করেন।”

নরসিংদীর সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক গোলাম মোস্তাফা মিয়া ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর সম্পর্কে বলেন, “একজন খাঁটি চারণ সাংবাদিক বলতে যা বোঝায়, সেটা ছিলেন ঈশ্বর বাবু। তিনি হয়তো মোনাজাত উদ্দিনের মতো এতো ব্যাপকতা এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেননি, কিন্তু নরসিংদী জেলার প্রতিটি অঞ্চলে তিনি বিচরণ করেছিলেন। সংবাদপত্রের পাতায় সমস্যা, দুর্নীতি, অনিয়ম ও দেশের কথা তুলে ধরেছিলেন। তাই এক অর্থে তাঁকে নরসিংদীর মোনজাত উদ্দিন বলা যায়।”

এই মানুষটি সারাজীবন নিঃস্বার্থভাবে সাংবাদিকতা করে গেছেন। সাংবাদিকতা যে একটি উপাসনাতুল্য কর্মকাণ্ড, সেটা ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধরের জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়।


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ