সারোয়ার তুষার। লেখক ও কলামিস্ট। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। তারই পথ ধরে নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছেন ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নামে। এই সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক তিনি। নরসিংদীর ঘোড়াশালের কৃতি সন্তান সারোয়ার তুষার সম্প্রতি নরসিংদী এসেছিলেন, এক অনুষ্ঠানে। তারই এক ফাঁকে ‘গঙ্গাঋদ্ধি’র পক্ষ থেকে তাঁর সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয় গত ৪ জানুয়ারি ২০২৫ (শনিবার)। সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন সম্পাদক সুমন ইউসুফ। সঙ্গে ছিলেন নাজমুল আলম সোহাগ।
সুমন ইউসুফ : জনাব সারোয়ার তুষারকে গঙ্গাঋদ্ধি’র পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাদের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্যে। আমি প্রথমেই বুঝে নিতে চাই, এই যে জুলাইয়ের আন্দোলন, এটা বিপ্লব নাকি অভ্যুত্থান?
সারোয়ার তুষার : আচ্ছা, বিপ্লব না অভ্যুত্থান, এই তর্কটা আমার কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। আমরা যখন বলি যে, এটা বিপ্লব না, তখন আমাদের মাথায় থাকে চীন বিপ্লব বা রুশ বিপ্লব অথবা ইরানী বিপ্লব। সেগুলোর সাথে তুলনা করে আমরা বলি, এটা বিপ্লব না। কারণ, এখানে সেরকম কোনো ভ্যানগার্ড পার্টি নাই বা কোনো-একটা পার্টির আন্ডারে এটা হয় নাই। কিন্তু, আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা হচ্ছে, এটাকে পুরোপুরি বিপ্লব বলা না গেলেও আমরা এখনো পর্যন্ত একটা বিপ্লবী প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। আপনি দেখবেন যে, রাষ্ট্র সংস্কার, সংবিধান পুনর্গঠনের কথা বলা হচ্ছে। রাষ্ট্র সংস্কার করতে হবে, সংবিধান বদলাতে হবে, আগস্টের তিন তারিখে ফ্যাসিবাদের বিলোপ এবং আর যেন কেউ স্বৈরাচারী হয়ে ওঠতে না পারে— অভ্যুত্থানের আগেও এই কথাগুলো বলা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, আমরা ফ্যাসিবাদ থেকে গণতন্ত্রের দিকে যাচ্ছি। আমাদের কিন্তু অনেকেরই ধারণা, আমরা একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ছিলাম। তারপর শেখ হাসিনা এসে এটাকে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় রূপ দিয়েছে। কিন্তু এই ঘটনা সত্যি নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মের পর থেকে কখনোই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়নি। আমাদের এখানে নির্বাচন ছিলো। ‘নির্বাচন’ আর ‘গণতন্ত্র’ এক জিনিস না। রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক না হয়, তাহলে নির্বাচন গণতন্ত্র আনতে পারে না। আমাদের সাংবিধানিকভাবেই একটা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিলো। যেহেতু আওয়ামী লীগের একটা সাংস্কৃতিক ন্যারেটিভ ছিলো, যার মাধ্যমে শেখ হাসিনা সেটাকে ফ্যাসিবাদে পরিণত করতে পেরেছে। বিপ্লব বলতে আমাদের মাথায় শুধু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কাজ করে। কিন্তু ফরাসি বিপ্লব কিংবা মার্কিন বিপ্লব, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিপ্লব— এগুলো কিন্তু আসলে গণতান্ত্রিক বিপ্লব।
সুমন ইউসুফ : এগুলো বাদ দিয়ে আমি যদি বলি, বিপ্লবের কমন সিম্পটম বলতে সাধারণ মানুষ বোঝে যে, সমাজটা আগে তৈরি হতে হবে। সমাজটা গঠনমূলকভাবে তৈরি হওয়ার পরে বিপ্লব হয় বা বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। এদিক থেকে…
সারোয়ার তুষার : সেটাই বললাম, আমরা এখনো একটা বিপ্লবী প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি, পুরোটা আমরা এখনো সারতে পারছি না। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতান্ত্রিক করার চেষ্টা চলছে এবং তারপর কালচারের দিক থেকে করতে হবে, মানে সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ করতে হবে। সামাজিকভাবে এমনকি ধর্মীয় পুনর্গঠন, ধর্মের বিভিন্ন বিষয়, ধর্মের বিভিন্ন ইন্টারপ্রিটেশন কীভাবে আমরা ইনকর্পোরেট করবো— এটাকে এক্সক্লোড করতে অনেক সমস্যা হয়। এসব দিক থেকে আমি মনে করি, আমরা একটা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি, যেটা শুরু হয়ে গেছে পাঁচ আগস্টের মধ্য দিয়ে। এখনো আমাদের সেটা শেষ হয় নাই। ফলে পাঁচ আগস্ট বিপ্লব হয়েছে কি হয় নাই, তারচে’ বড়ো কথা এই যে, গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়েছে পাঁচ আগস্ট ফ্যাসিজমের উৎখাতের মধ্য দিয়ে। এখন ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ করতে পারলেই আমরা বিপ্লবকে পূর্ণাঙ্গ করতে পারবো বা সফল করতে পারবো। যদি আমরা সেটা না করতে পারি, তাহলে ব্যবস্থাটা আবার টিকে থাকবে। আমার একটা তর্ক ছিলো। আপনি বলতেছেন বিপ্লব নাকি অভ্যুত্থান? আমি তো দেখতেছি, এটাকে পলিটিক্যাল পার্টিগুলো একটা রেজিমের পরিবর্তন হিসেবে দেখতেছে, মানে শুধু ক্ষমতার হাতবদল। তাদের গণঅভ্যুত্থানের আইডিয়াই নাই। গণঅভ্যুত্থান কিন্তু স্ট্যাটাসের দিক থেকে বিপ্লবের চে’ কম কিছু না। বিপ্লব একটা নীরব প্রক্রিয়া। এখন দুনিয়ার যেসব জায়গায় বিপ্লব হইছে, আমরা যেগুলোকে বিপ্লব বলতে চাই, সেগুলো ছিলো মূলত রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। রাশিয়ায়, চীনে, ইরানে আপনি এমনটা দেখবেন। কিন্তু ইউরোপে বিপ্লবটা এক-দুইদিনে হয় নাই, তিনশো-চারশো বছর ধরে হয়েছে। আবার ধরেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র। এই উপমহাদেশে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম একটা সিগনিফিক্যান্সের ব্যাপার। এটা হইছে কিন্তু বুদ্ধিভিত্তিক কর্মকাণ্ডগুলোর ফলে আমাদের যে স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়েছে, এজন্যেই বাংলাদেশ হইছে। অনেকে মনে করেন যে, পাকিস্তান আন্দোলন, নানা ঘাত-প্রতিঘাত কতোগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আসলে কিন্তু ব্যাপারটা সেরকম না। আমাদের সমাজের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা বা সুর সবসময়ই আছে। এটা পুরোপুরি বামপন্থী স্টাইলে হতে হবে, এমন না। এমনটা হয় না সব সময়। বাংলাদেশের অস্তিত্বের গুরুত্বটা কী! এই চেতনাটা সব সময় আছে এবং এটা আছে বলেই কিন্তু যখন এখানে ফ্যাসিজম দাঁড়ায়, তখন এই ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে সমাজে শক্তি তৈরি হয়। সেটা যেভাবেই হোক। যেমন, এবার কিছু ছাত্র নেতৃত্ব দিলো। এটা কিন্তু হতে পেরেছে সমাজে বিপ্লবী একটা মনোভাব আছে বলেই।
সুমন ইউসুফ : মোটামুটি বোঝা গেছে ব্যাপারটা। আপনারা দ্বি-দলীয় বৃত্তের বাইরে নতুন একটা রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ করার চিন্তা-ভাবনা করতেছেন এবং কর্মতৎপরতায় আপনারা এগিয়েও যাচ্ছেন। বিভিন্ন জেলা ও থানায় কমিটি দিচ্ছেন এবং কেন্দ্রীয়ভাবে বিভিন্ন কর্মতৎপরতা আছে। এটা খুবই দরকার বলে জনগণ মনে করে। কারণ গণমানুষের গত তিপ্পান্নো বছরের একটি আকাঙ্ক্ষার জায়গা ছিলো যে, দ্বি-দলীয় শাসন ব্যবস্থার বাইরে সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা তাদের দরকার। আপনারা এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই নেমেছেন বলে আমরা মনে করছি। আপনাদের আদর্শ এবং উদ্দেশ্য কী? গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার রূপ কীরকম হবে? এসবকিছু নিয়ে আপনাদের লড়াইটা কোন জায়গায়?
সারোয়ার তুষার : এখানে বাংলাদেশের যে-রাজনৈতিক দলগুলো, শুধু বাংলাদেশ না, উপমহাদেশে যেসব রাজনৈতিক দল আছে, তাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, তাদের কোনো রাষ্ট্রপ্রকল্প নাই। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের একটা থিসিস আছে, যেটা বই আকারে বের হয়েছে। সেখানে তিনি একটা কথা বলেছেন, ভারতীয় উপমহাদেশে কোনো রাজনৈতিক দল নাই। অথচ তখন কংগ্রেস ছিলো, মুসলিম লীগ ছিলো। তিনি এগুলোকে রাজনৈতিক দল বলতে চাচ্ছেন না। কেন? কারণ, এদের কোনো রাষ্ট্রপ্রকল্প নাই। এরা মূলত কিছু দেন-দরবার করে। আর হাল আমলে আমাদের বাংলাদেশ হওয়ার পরে, রাজনৈতিক দলগুলো শুধু নির্বাচন বোঝে, আর কিছু বুঝতে চায় না। যেমন ধরেন, এখনো দ্রুত নির্বাচনের জন্যে প্রেশার ক্রিয়েট করা হচ্ছে। এটা কিন্তু সমাজে অস্থিরতা তৈরি করছে। এই সমস্ত বিষয় নিয়ে আমাদের একটা মূল্যায়ন আছে এবং আমাদের একটা উপলব্ধি আছে। সেখান থেকে আমরা মনে করি, আমাদের এমন একটা রাজনৈতিক দল হতে হবে, যে আসলে প্রথমত বাংলাদেশে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রকল্প হাজির করবে— এই হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রকল্প, জনগণের সাথে রাষ্ট্রের এই সম্পর্ক। এই যে বিষয়টা, এটা কিন্তু আপনি আমাদের এখানে দেখবেন না। এখানে রাজনৈতিক দলের যে-আইডিয়াটা থাকে, সেটা হলো, আপনি যদি আমার লোক হোন, আমি ক্ষমতায় গেলে আপনি এই এই সুবিধা পাবেন, আর অন্য সবাই সেটা পাবে না। এই কনসেপ্টকে চরম জায়গায় নিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ধরেন, আপনি একটা দল করেন এবং আপনার দল ক্ষমতায় নাই, কিন্তু আপনি সমাজে নিরাপদে আছেন এবং আপনার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পারছেন। এই যে আইডিয়া, এটা দরকার। এই কনসেপ্টকেই আমরা বলছি ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’। বাংলাদেশপন্থী সকল শক্তি, তাদের যার যার রাজনীতি থাকবে। কিন্তু কতোগুলো বিষয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে রাজনীতি করবো না। যেমন অভ্যুত্থান হলো। অভ্যুথানের পরে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটেছে। এই ফ্যাসিবাদ আমরা ফিরে আসতে দেবো না। এজন্যেই বলা হচ্ছে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ। জাতীয় নাগরিক কমিটি থেকে আমরা চাচ্ছি, বিভিন্ন মতের মানুষ এখানে আসছে এবং তারা যার যার রাজনীতি ছেড়েই আসছে। এটাকে আমরা বলছি যে, পোস্ট ইডিওলজিক্যাল বা ভাবাদর্শিক-উত্তর সময়। মানে হচ্ছে, তেরো সালের আগে পরে বাংলাদেশে বাইনারি রাজনীতি ছিলো। শাহবাগ বনাম শাপলা, ধর্ম বনাম প্রগতি, বিজ্ঞান বনাম মৌলবাদ— এরকম। আমরা যে-রাজনীতি করতে চাই, অর্থাৎ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হয়ে ওঠা, একটা পলিটিক্যাল কমিউনিটি হয়ে ওঠার যে-রাজনীতি, এর জন্যে এটা অনেক ক্ষতিকর। কিন্তু বিভাজন ছিলো মূলত একটাই, সেটা হলো ফ্যাসিজম বনাম জনগণ। এখানে আর কোনো বিভক্তির দরকার নাই। এই জনগণের পক্ষের কোনো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাইনি, যেটাকে অনেকে বলে গণরাজনৈতিক ধারা কিংবা আপনি অন্য কোনো ভাষায়ও বলতে পারেন। এখানে জনগণের সব সময়ই একটা আলাদা এজেন্ডা আছে। এটা কিন্তু সব সময় উপেক্ষিত। এই যে এখন যেমন বলা হচ্ছে, নির্বাচন দিয়ে দিলে যারা ক্ষমতায় আসবে, তারা জনগণের চাওয়া পূরণ করে ফেলবে। ব্যাপারটা এরকম না। জনগণের চাওয়া যে আলাদা, এটার প্রমাণ আমি আপনাকে ভুরি ভুরি দিতে পারবো। একটা উদাহরণ দিই, গত জানুয়ারির আগে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে আন্দোলন করলো বিরোধী দল। কিন্তু আপনি খেয়াল করে দেখেন, বাংলাদেশের জনগণ সেই আন্দোলনে সাড়া দেয় নাই। এখন বাংলাদেশের জনগণ কি ভোট দিতে চায় না? ডেফিনেটলি ভোট দিতে চায়। বাংলাদেশের জনগণ যে সাত জানুয়ারির নির্বাচনকে গ্রহণ করে নাই, তার প্রমাণ হচ্ছে যে, পাঁচ শতাংশ মানুষও ভোট দিতে যায়নি। যদি বিশ শতাংশও ভোট দিতে যাইতো, তাহলে আওয়ামী লীগ সেটাকে বিরাট সাকসেসফুল নির্বাচন দেখাইতো। কিন্তু লাখ লাখ মানুষ জুলাই মাসে রাস্তায় নামলো। মাত্র ছয় মাসের মধ্যে। ঘটনাটা কী প্রমাণ করলো? প্রমাণ করলো যে, মানুষ ভোটাধিকার চায়। কিন্তু ভোটের দাবিতে তারা রাস্তায় জীবন দিবে না। আপনি একটা রাজনৈতিক দল। আপনি ভোটের অধিকারে রাস্তায় আন্দোলন করছেন। আপনি যদি সেটা আদায় করতে পারেন আপনার শক্তি দিয়ে, তাহলে মানুষ গিয়ে ভোট দিয়ে আসবে। কিন্তু এর জন্যে জীবন দিবে না। মানুষ জীবন দিবে কীসের জন্যে? মানুষ জীবন দিয়েছে জুলাই মাসে। দেখেন, পুলিশ বলছে, স্যার, একটা গুলি করি একটা মরে, আরো দশটা সামনে আসে। অথচ ঢাকা শহরের কোথাও একসাথে দশ লাখ লোক জড়ো হয় নাই তিন তারিখের আগে। শেখ হাসিনাকে শেষ পর্যন্ত পালাতে হলো এবং রাজনৈতিক দলগুলো কিন্তু ২৬ জুলাই পর্যন্ত বলেছে যে, তাদের এই আন্দোলনের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নাই। তাদের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করেছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু আন্দোলন হইছে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে। এই যে জনগণের একটা আলাদা চাওয়া সব সময়ই ছিলো। জনগণ দেখেন কতো রেডিক্যাল। চল্লিশের দশকেও পাকিস্তান আন্দোলনের সময় কিংবা আপনি তার সামনে একটা এজেন্ডা ঠিক করলে তারা তা আদায় করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। যেমন আপনি ছয় দফা ঠিক করেছেন, জনগণ দেশ স্বাধীন করেছে। আপনি বলেছেন যে, ভারতের মধ্যে আমাদের মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি হতে হবে, যেহেতু আমরা মাইনরিটি, আমাকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে, তারা পাকিস্তান আন্দোলন করে ফেলেছে। রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি, সেনাবাহিনি— এরকম যতোগুলো পক্ষ আছে, তার মধ্যে জনগণ সব থেকে অগ্রসর পক্ষ। সে যেকোনো পরিবর্তনের জন্যে সব সময় মুখিয়ে থাকে। আবার দেখেন যে, পরিচিত রাজনৈতিক দল ডাকলো, সে আসলো না। কিন্তু অপরিচিত ছাত্ররা ডাকলো, সে রাস্তায় নেমে পড়লো। এই পার্থক্যটা থেকে বোঝা যায় যে, জনগণের একটা আলাদা এজেন্ডা আছে। এই এজেন্ডা কেউ কখনো রাজনীতিতে পিক করে নাই। আমরা সেই চেষ্টা করতেছি। সেটা হচ্ছে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ। ভাষাটা নতুন, আইডিয়াটা নতুন। এটা অনেকের বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো এটা মানতে পারছে না। এটার মানে কী? সংস্কার কেন করতে হবে? নির্বাচন দিয়ে দিলেই তো হয়ে যায়। কিন্তু আমরা মনে করি, যেসব কারণে বাংলাদেশে বারবার অভ্যুত্থান করতে হয়, সেগুলোই তো নিরসন হয়নি। অভ্যুত্থান তো আমরা এবারই প্রথম করলাম না। আন্দোলন আমরা এবারই প্রথম করলাম না। কিন্তু আমরা যদি নূর হোসেনের সাথে জাস্টিস করতাম, তাহলে তো আবু সাঈদকে জীবন দিতে হতো না। নূর হোসেন তো চাইছিলেন, গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক। স্বৈরাচার কিন্তু নিপাত গেছে। তো জনগণের এই চাওয়া ছাত্র-তরুণদের পক্ষেই পূরণ করা সম্ভব বলে আমরা মনে করছি। আমাদের সমাজে ছাত্ররা হচ্ছে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ভ্যানগার্ড। এখন তরুণদের রেডিক্যাল পরিবর্তন মানেই হচ্ছে জনগণের বৃহত্তর পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা। আপনি বলতে পারেন, এর মধ্যে শ্রমিক এজেন্ডা কোথায়, এর মধ্যে কৃষক এজেন্ডা কোথায়? এখন এগুলো পরিষ্কারভাবে নাই। কিন্তু আস্তে আস্তে আসবে।
সুমন ইউসুফ : জনগণের যেই এজেন্ডার কথা আপনি বললেন, এটা আপনাদের নাগরিক কমিটিতে কীভাবে রূপায়িত করবেন? পরিকল্পনা কী?
সারোয়ার তুষার : প্রাথমিক পরিকল্পনা হচ্ছে এই পরিবর্তনের জন্যে জনগণকে সংগঠিত করা। আমি যে-কথাগুলো বললাম, এগুলো আপনাদের কারোরই বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না। কারণ আপনারা সবাই বোঝেন যে, এই পরিবর্তনগুলো বাকি আছে। এই পরিবর্তনগুলো লাগবে আমাদের। এখন জাতীয় নাগরিক কমিটি প্লাটফর্মে আমরা এটাকে গোছাচ্ছি। পরবর্তীতে আমাদের যখন দলটা হবে, সেখানে কর্মসূচির মধ্যে এই বিষয়গুলো থাকবে। শ্রমিকের বা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার চাওয়া। কোন কোন বিষয়গুলো তাদের আটকে রাখছে, সেগুলো নিরসন করার মাধ্যমে আমরা চাই একটা বড়সড় পরিবর্তন। আমাদের রোডম্যাপটা হচ্ছে, সামনে যে-নির্বাচন হবে, সেটা হতে হবে গণপরিষদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। কারণ, আমরা মনে করি, এই সংবিধান প্রাসঙ্গিক না। নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে একটা রাষ্ট্র নির্মাণ করতে হবে। সেই রাষ্ট্রের অধীনে সংসদ নির্বাচন হবে।
নাজমুল আলম সোহাগ : গণপরিষদ নির্বাচনকে অনেকে বলতেছে সংবিধান সভার নির্বাচন।
সারোয়ার তুষার : একই কথা।
সুমন ইউসুফ : আপনারা কি আগামী মানে সামনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন?
সারোয়ার তুষার : আমরা মনে করি, সামনের নির্বাচনটা হওয়া উচিত গণপরিষদ নির্বাচন মানে সংসদ নির্বাচন। গণপরিষদ নির্বাচন হচ্ছে ঐ সংবিধান প্রণয়নের প্রশ্নে। তো সেটার জন্যে অবশ্যই আমরা প্রস্তুতি নিতেছি। আমাদের সেই প্রস্তুতি আছে। ড. ইউনুস যেটা বলেছেন, ’২৬-এর জুনে কিংবা ’২৫-এর ডিসেম্বরের মধ্যে। কিন্তু বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো এই সময়টা দিতে চায় না। একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার কাজ হচ্ছে সংস্কার করা, সে দুই বছরের কম সময় থাকবে, এই ইঙ্গিত দেয়ার পরও তাকে আপনি কতো রকমের ডিস্টার্ব করতেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত যা-ই ঘটুক, আমরা নির্বাচনে অংশ নিবো। তবে আমরা মনে করি, এই বছরের রাজনীতি হবে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিতে।
নাজমুল আলম সোহাগ : আপনারা তো গণতন্ত্রের কথা খুব বলছেন। আপনারা নাগরিক কমিটিতে যে-সিদ্ধান্তগুলো নেন, অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, নাগরিক কমিটি নাকি ক্লাবের মতো আচরণ করছে। এ-ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
সারোয়ার তুষার : না! এগুলো ঠিক কথা না। আমাদের পরিষ্কার একটা অর্গানোগ্রাম আছে।
সুমন ইউসুফ : আপনার দলের যে-আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মপরিকল্পনার কথা বললেন, সবকিছুর বিপরীতে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল এবং সমাজে বিদ্যমান স্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে লড়াই করে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছাতে পারবেন? অলরেডি আপনাদের বিরুদ্ধে একটা কথা প্রচলিত যে, আপনারা কিংস পার্টি। এক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থান কী?
সারোয়ার তুষার : কিংস পার্টি কথাটা যদি সত্যি হয়, তাহলে তো আপনার আগের প্রশ্নটা ঠিক না যে, আমরা পারবো কি না? কিংস পার্টি পারবে না কেন? আপনার প্রশ্নটা হতে পারতো যে, এতো বড়ো কায়েমি স্বার্থবাদী রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে আপনারা কি পারবেন? যদি আমরা কিংস পার্টি হই, তাহলে তো এটা খুব সহজেই হওয়ার কথা, যেহেতু আমাদের কাছে সরকারের সকল ক্ষমতা আছে। সারা দেশে আমরা যখন সাধারণ কর্মীসভা করছি, সেখানেও হামলার শিকার হচ্ছি। বরিশালে এই ঘটনা ঘটেছে। আমরা এখনো পর্যন্ত সেই অর্থে রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠিনি। শুধু প্রস্তুতিমূলক কাজ করছি। এটাই অনেকের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠছে। কিংস পার্টির যে-তর্কটা, সেটা একেবারেই আমাদের উদ্যম নষ্ট করার জন্যে করছে। আমাদেরকে হীনমন্যতায় ভোগানোর জন্যে করছে। আমি মনে করি, কিংস পার্টি হওয়ার মতো কোনো শর্ত এখন বাংলাদেশে নাই।
সুমন ইউসুফ : জনগণের মধ্যে বেশি প্রতিভাত যে, ছাত্ররা আন্দোলন করেছে, ছাত্ররা ইউনুস সাহেবকে বসাইছে এবং আপনারা ঐ-লিগ্যাসি ধারণ করছেন। কিংস পার্টির আলাপটা ওখান থেকেই উঠে আসে।
সারোয়ার তুষার : প্রথম কথা হচ্ছে, কিংস পার্টি করানোর মতো শর্ত এই সরকারের নাই। অবশ্য শুরু থেকে এই সরকার ছাত্রদের সরকারই ছিলো। উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রেও ছাত্রদের ভূমিকা ছিলো। প্রথমদিকে জনগণও যেভাবে ছাত্রদের সাথে ছিলো, পরবর্তীতে জনগণ যার যার কাজে ফেরত গেছে। ছাত্ররা যে আবার রাজনীতি করবে, জনগণের তো এই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা নাই। এখন আবার জনগণকে একত্রিত করার চেষ্টা চলছে এবং ছাত্ররা যখনই প্রোক্লেমেশনের কথা বলেছে, তখন জনগণ সাড়া দিতে শুরু করেছে। সেদিন আমাদের জমায়েতে ছিলো প্রায় এক লাখ মানুষ। সেদিন যদি আমরা প্রোক্লেমেশন জারি করতাম, তাহলে সেই জমায়েতটা চার-পাঁচ লাখ হয়ে যেতো। আমাদের দাবি সরকার গ্রহণ করেছে, অর্থাৎ আমাদের একপ্রকার থামিয়ে দেয়া হলো। ছাত্ররা কিংস পার্টি করতেছে, এটা একেবারেই সত্যি না। আমার একটা হাইপোথিসিস এরকম, যখন বাংলাদেশে একটা সরকার গঠিত হয়, সেখানে বিরোধী একটা দল থাকে। কিন্তু এই সরকার তো সেভাবে হয়নি। এই সরকারের তো কোনো বিরোধী দল নাই। ফলে এখানে ক্ষমতার দুটি পক্ষ আমরা দেখতে পাই। একদিকে জনগণ, জনক্ষমতা! আরেকটা হচ্ছে স্টাবলিশমেন্টের ক্ষমতা। এটা সব সময়ই আগানো-পিছানো আছে। স্টাবলিশমেন্ট একটু আগায়, জনগণ একটু পিছায়। আবার জনগণ একটু আগায়, স্টাবলিশমেন্ট একটু পিছায়। এই যে প্রোক্লেমেশন, এটা দিতে পারলে জনগণের মধ্যে ঐতিহাসিক মৈত্রী তৈরি হতো। আবার কিন্তু জনক্ষমতাটা আগায়া যেতো। এই যে সংবিধান বাতিল করতে চাওয়া, এটাও কিন্তু এর সাথে সম্পর্কিত। ফলে আমি বলবো যে, ছাত্ররা আসলে সরকারের মধ্যে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে।
নাজমুল আলম সোহাগ : আপনার কাছে জানতে চাই যে, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটা ফ্যাসিবাদ সরালেন, আরেকটা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের আকাঙ্ক্ষার যে-জায়গা, মাজার ভাঙা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগ ও সংগীত বিভাগ বন্ধ করে দিতে হবে, এইটা মোকাবেলা বা মীমাংসা করার জন্যে নাগরিক কমিটির পলিসি কীরকম?
সারোয়ার তুষার : আমরা বলছি যে, আমরা যেকোনো ধরনের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। ফ্যাসিবাদ মানে হচ্ছে একটা জাতিবাদের উৎকট প্রকাশ। জাতিবাদটা শুধু সেক্যুলার জাতিবাদ হয় না। এটা ধর্মীয় জাতিবাদও হয়। ধর্মীয় জাতিবাদটাও আধুনিক জিনিস। অনেকে মনে করে, এটা হচ্ছে প্রাক আধুনিক আর সেক্যুলার জাতিবাদ হচ্ছে আধুনিক। আসলে দুটোই আধুনিক। ইসলামের কথা যদি বলেন, ইসলামে কোনো রাষ্ট্রধারণা নাই। ইসলামকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের ধারণা তো মডার্ন ধারণা। এটা আমাদের সমাজে আছে, এটা সত্য। আগস্টের পাঁচ তারিখের পরে কিছু বিশৃঙ্খলাও তৈরি হয়েছে। মাজার ভাঙার কোনো দরকার ছিলো না। ধর্মে এটা ঠিক নাকি বেঠিক, এই বিষয়ের বাইরে যদি আমরা যাই, ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার দিক থেকে যদি দেখি, আমাদের সিরিয়াস বদনাম হইছে। ইন্ডিয়া সিরিয়াসলি প্রোপাগান্ডা করতে পারছে। যারা এই কাজ করেছে, তারা আমাদের জন্যে সিরিয়াস ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি যারা, যেমন আলেম-ওলামারা এটা নিয়ে শক্ত কিছু বলে না যে, এটা করা যাবে না। তাদেরকে এই দায় নিতে হবে। অন্যান্য যা কিছু হচ্ছে, যেমন মোরাল পুলিশিং, এটা করা যাবে না, ওইটা করা যাবে না— এগুলো কিছু হচ্ছে। যেহেতু একটা অ্যানার্কিক পরিস্থিতি বিরাজ করতেছে। তো আমি মনে করি, এই বিষয়গুলো সামনে করতে পারবে না। কারণ আপনি সংগ্রাম করছেন আর এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষের একটা ঐতিহাসিক চৈতন্যের বা ঐতিহাসিক স্পিরিট তৈরি হয়। মানুষ এটা থেকে পেছনে যেতে পারে না। যেমন, এবার আপনি রাজাকার বলেছেন, মানুষ ক্ষেপে গেছে। তো সামনে যখন আপনি বারবার বলবেন তুমি শাহবাগী, তুমি নাস্তিক, এগুলো মানুষের পছন্দ হবে না। এগুলোর সমাধান একদিনে হবে না। আস্তে আস্তে হবে। ফলে এখন যারা এই ধরনের কাজ করতেছে, তারা মনে করতেছে সফল হবে। আল্টিমেটলি তারা সফল হবে না। কারণ, ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব বা ব্যক্তির মর্যাদার ব্যাপারে সমাজে একটা কনশাসনেস তৈরি হয়েছে যে, আপনি কাউকে অপমান করতে পারবেন না, কাউকে ট্যাগ দিতে পারবেন না। কতোগুলো জিনিস আমরা অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছি। আপনি কাউকে কোনো ট্যাগিং দিতে পারেন না। আপনি শিবির ট্যাগ দিয়ে কাউকে মারতে পারবেন না, আবার শাহবাগী ট্যাগ দিয়েও কাউকে মারতে পারবেন না।
সুমন ইউসুফ : এই সরকার ক্ষমতায় আসার অলরেডি পাঁচ মাস হয়ে গেছে। এখন আমরা দেখতেছি, মোহভঙ্গ ঘটছে অনেকের। সমাজের মানুষের মোহভঙ্গ হচ্ছে। এবং সরকার সুশাসন ও সেবাপ্রদানের জায়গায় কোনো সফলতা দেখাতে পারছে না। এই ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
সারোয়ার তুষার : হ্যাঁ, মোহভঙ্গ আছে বা থাকতে পারে। তাহলে আপনার আলাপটা হবে যে, আমাদের এই পরিস্থিতিটা পার হওয়ার জন্যে বা সংস্কার করার জন্যে আমাকে আরো শক্তপোক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু আপনি যদি বলেন, সংস্কার বাদ দেন, ইলেকশন দেন। তাহলে তো সবই বেহাল হবে। অথচ, বিএনপি কিন্তু গণমানুষের দিকে থাকতে পারতো, বৈপ্লবিক একটা অবস্থান নিতে পারতো। কিন্তু বিএনপি এটা করতে চাইছে না কেন? কারণ, তারা আসলে কোনো পরিবর্তন করতে চায় না। এরই সাথে আরো অন্যান্য ভূ-রাজনৈতিক বিষয়-আশয় আছে, ইন্ডিয়ার সিগনাল আছে।
নাজমুল আলম সোহাগ : ইন্ডিয়ার সিগনালটা কী? এটা ক্লিয়ার করেন।
সারোয়ার তুষার : আমি মনে করি, ইন্ডিয়ার প্রথম ভাবনা ছিলো, আওয়ামী লীগকে তারা রিইনস্টল করতে পারবে। সেটার সম্ভাবনা আপাতত নাই। এখন তারা বিএনপি’র মাধ্যমে ইন্ডিয়ার ব্লকটাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। ইন্ডিয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ খুব দ্রুত কামব্যাক করতে পারবে। এখন বিএনপি বলতেছে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা যাবে না, আওয়ামী লীগকে ভোটে অংশ নিতে দেন। কতো বিপজ্জনক কথা! জনগণ আগস্টের পাঁচ তারিখে যে-রায় দিয়েছে, সেটার তাহলে কী করবেন? অলরেডি আওয়ামী লীগকে জনতা পরাজিত করেছে। আবার কেন ভোট দিয়ে তাকে পরাজিত করতে হবে?
সুমন ইউসুফ : এই বিষয়ে একটা সাদা পর্যবেক্ষণও আছে। সেটা হচ্ছে, আপনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেবেন না কেন? তারা ফ্যাসিবাদী হলে বা অপরাধী হলে তাদের বিচার হবে। বিচারের তো কোনো লক্ষণ দেখি না। আপনারা ইনক্লুসিভ বা সমন্বিতকরণের কথাবার্তা বলছেন, সবাইকে নিয়েই তো এগিয়ে যাবেন। তাহলে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না কেন?
সারোয়ার তুষার : কারণ, নাৎসিবাদের পতনের পরে জার্মানির কী অবস্থা হবে, এটার জন্যে আপনি হিটলারের পরামর্শ নেন নাই। আওয়ামী লীগ যতোগুলো গণহত্যা করেছে, এই জুলাইয়ের গণহত্যা, শাপলার হত্যাকাণ্ড, পিলখানা হত্যাকাণ্ড, এছাড়াও বিগত সময়ে যতো গুম-খুন হয়েছে, এগুলোর তো আলাদা বিচারের ব্যবস্থা আছেই। এগুলো বাদেও বিগত তিনটা নির্বাচন যে আপনি হাইজ্যাক করলেন, মানুষকে আপনি ভোট দিতে দিলেন না, জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিলেন, এগুলো তো ফৌজদারি অপরাধ। এখানে তো আওয়ামী লীগ দল হিসেবে অংশগ্রহণ করেছে। তো দল হিসেবে তাকে শাস্তি দিবেন না? তাকে তো বিচারের আওতায় আনতে হবে। এগুলো না করে যখন কেউ নির্বাচনের কথা বলে, তখন মনে হবে যে, আওয়ামী লীগকে আপনি শুধু একটা বিরোধী দল হিসেবে ট্রিট করতেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ এখন ডেমোক্রেটিক ফ্রেমওয়ার্কে নাই। এখন সে ডেমোক্রেটিক ফ্রেমওয়ার্কে আসতে পারবে কি না, সেটা নির্ভর করবে এই বিচারের রায়ের উপর। এই আওয়ামী লীগের সেন্ট্রাল কমিটি পুরোপুরি ডিজেবল করতে হবে। কারণ এটা ক্রিমিনাল সিন্ডিকেট। তারা যতোগুলো স্থানীয় নির্বাচন করেছে, এগুলো ডিসমেন্টাল করতে হবে। তারপর আপনি আওয়ামী লীগকে বলেন, দল গুছিয়ে আসতে।
সুমন ইউসুফ : আপনার অনেক লেখায় বা পত্রিকার বিভিন্ন কলামে দেখেছি, বা আপনাদের কথাবার্তায়ও একটা বিষয় জারি রেখেছেন, ’২৪ এবং ’৭১— দুইটা ঘটনাকে একিভূত করার যে-চেষ্টা আপনাদের, এটার তাৎপর্য কী?
সারোয়ার তুষার : আমরা জারি রাখছি বলতে, আমাদের বোঝাপড়া হচ্ছে, গত ৬০-৭০ বছরের মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো অর্জন আমাদের ‘মুক্তিযুদ্ধ’। আমরা এটাকে ধারণ করি এবং নিজেদেরকে এর উত্তরাধিকার মনে করি। কিন্তু আওয়ামী লীগ এটাকে দলীয়করণ করেছে। তারা মুক্তযুদ্ধের নামে সকল কর্মকাণ্ড করেছে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী। আমরা দেখেছি যে, জনগণ এবং মুক্তিযুদ্ধের মাঝখানে আওয়ামী লীগ একটা দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তো এখন জনগণের মালিকানা বা জনগণের অর্জনটাকে স্বীকার করতে গেলে ’২৪ একটা সুযোগ হয়ে এসেছে। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আপনি আবার বলতে পারছেন যে, ’৭১ ছিলো জনগণের একটা অর্জন। এই যে আমরা এতোক্ষণ রাষ্ট্রপ্রকল্পের কথা বললাম, এটা কিন্তু ’৭১-এর আকাঙ্ক্ষারই রাষ্ট্রপ্রকল্প। সেটা হয় নাই। আওয়ামী লীগ সেটা হতে দেয় নাই। কারণ ’৭১-এর আকাঙ্ক্ষার মধ্যে তো কোনো ভোটবিহীন সরকার থাকতে পারে না। আমরা বলছি যে, ’২৪ মানে ’৭১-এ ফেরার একটা রাস্তা তৈরি হইছে। এতোদিন আওয়ামী লীগ এটার প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড়িয়েছিলো। এজন্যে আমরা বলছি যে, ’৭১ আর ’২৪ একটা লিগ্যাসির মধ্যে আছে। ’২৪ আর ’৭১ এক জিনিস না। ’২৪ হচ্ছে ’৭১-এর ধারাবাহিকতা। আমাদের তো মুক্তির সংগ্রাম চলছে। ১৯৭১ সালে যে-কারণে এতো মানুষ জীবন দিলো। যে-ধরনের রাষ্ট্রপ্রকল্প জনগণ চেয়েছিলো, সেটা তো তারা পায়নি। তো ’২৪-এ এসে আবার সেই সুযোগ এসেছে।
সুমন ইউসুফ : কিন্তু সেটা ’৭১-এর বিরোধী শক্তিকে সাথে নিয়ে কীভাবে সম্ভব?
সারোয়ার তুষার : ’৭১-এর বিরোধী শক্তি কাকে সাথে নিছি?
সুমন ইউসুফ : যেমন জামায়াতে ইসলাম। আপনাদের নানা কথাবার্তায় তো তাদেরকে ছাড় দেন। তাদের বিষয়ে তো আপনাদের কোনো কংক্রিট বিরোধী অবস্থান নাই।
সারোয়ার তুষার : জামায়াতে ইসলামের ’৭১-এর ভূমিকা নিয়ে তাদেরকে দলগতভাবে ক্ষমা চাইতে হবে— এটাই আমাদের অবস্থান। যেহেতু আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও আমরা এ-কথা বলি। কিন্তু এটাও ঠিক যে, জামায়াতে ইসলামের ক্ষেত্রে আপনি একটা মিস ফায়ার করেছেন, ২০১৩ সালে, ইন দ্য নেম অব যুদ্ধাপরাধীর বিচার।
সুমন ইউসুফ : যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়া যা-ই ঘটুক না কেন, আমি বলছি তাদের রাজনৈতিক যে-স্ট্যান্ড ছিলো ১৯৭১ সালে, সেটার কথা। তারা বাংলাদেশ কনসেপ্টেরই বিরোধী ছিলো। এখন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দলটা বাংলাদেশ কনসেপ্টের বিরোধী, তাহলে তারা কীভাবে এই দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায়?
সারোয়ার তুষার : তাদের অবশ্যই এই নামে রাজনীতি করা উচিত না। কারণ, এই দল ১৯৭১-এ বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলো। তাদের পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। আমাদের অবস্থান হচ্ছে, ১৯৭১-এর ব্যাপারে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া যাবে না। ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানে তাদের দলের অনেক লোকজন ছিলো। এখন একটা সুযোগ এসেছে তাদের। ’৭১-এর যে-ভুল, সেটা যদি প্রকাশ্যে তারা স্বীকার করে, তাহলে কিন্তু সমাজে আবার নরমালাইজড হতে পারে। কিন্তু তারা তাদের ভুল স্বীকার করতেছে না। এজন্যে সমাজে তাদের উপর এই চাপটা জারি রাখতে হবে। কিন্তু আমরা তাদের সাথে আছি বা তাদেরকে নিয়ে আছি বা তাদের ব্যাপারে নমনীয় আছি, এরকম কোনো কিছু নাই। তাদেরকে নিয়ে আওয়ামী লীগের যে-রাজনীতি, আমরা আবার সেই ট্র্যাপেও পড়তে চাই না।
সুমন ইউসুফ : মানুষের মধ্যে এটা প্রচারিত আছে যে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটিতে ইসলামী ছাত্র শিবিরের অনেক কর্মী আছে এবং জামায়াতে ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতা আছে।
সারোয়ার তুষার : ছাত্র শিবির করতো এমন লোক আমাদের সংগঠনে আছে, এটা আমরা কখনোই অস্বীকার করিনি। মানে সাবেক শিবির। সে তো তার রাজনীতি ছেড়ে দিয়েই এসেছে। আমাদের এখানে বাম সংগঠনের কর্মীও আছে। আবার আমাদের মতো মধ্যমপন্থীরাও আছে। এটা একটা মিশ্র অবস্থান। আরো বেশ কিছু গুঞ্জন আছে, যেগুলো বিএনপি প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে যে, নাগরিক কমিটি জামায়াতে ইসলামের সাথে মিলে গেছে।
সুমন ইউসুফ : আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিব— দুটি বিষয় ’৭১-এর সাথে জড়িত। কোনোভাবেই মুছে ফেলার বিষয় না। আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে অপশাসন কায়েম করেছে, ফ্যাসিজম চালু করেছে। আবার এর পতনও ঘটেছে। কিন্তু ঐতিহাসিক কারণে আমরা ’৭১ থেকে আওয়ামী লীগকে বা শেখ মুজিবকে বাদ দিবো কেন? বি-আওয়ামীকরণ বিষয়টা যে আপনি বলেছেন আপনার এক লেখায়, এই বিষয়টার সাথে বোঝাপড়া কীরকমভাবে হবে?
সারোয়ার তুষার : আওয়ামী লীগকে বাদ দেয়ার কথা হয় নাই। আমার কথা ছিলো, মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের দলীয় ইতিহাস লেখা সম্ভব কি না। আমার অবস্থান হচ্ছে, সম্ভব না। তারা যে-ইতিহাসটা আপনাকে গত পনেরো বছর গেলাইছে, সেখানে তার দলের অন্য কেউ আছে? তাজউদ্দীন সাহেব, মওলানা ভাসানী, সিরাজুল আলম খান— তারা কি আছে?
সুমন ইউসুফ : কোথায় নাই? আপনি মাধ্যমটা চিহ্নিত করছেন কোনটা?
সারোয়ার তুষার : তাদের গল্পের যে-আউটলুক, সেখানে পুরোটাই শেখ মুজিব। অন্য কেউ তো নাই।
সুমন ইউসুফ : শেখ মুজিব তো কেন্দ্রেই ছিলো। আপনি ১৯৭১ সালের কথা ধরলে মওলানা ভাসানীসহ অন্যান্যরা নিজেরা সাইড হয়ে শেখ মুজিবকে উপরে রেখেছে। শেখ মুজিব তো শুধু আওয়ামী লীগের বিষয় না। বাকি যাদের কথা বললেন, তারা তো নিজের জায়গায়ই ছিলো এবং আছে। কোন মাধ্যমগুলোতে তাদের বিতাড়িত করে শেখ মুজিব উপরে আছে?
সারোয়ার তুষার : গত পনেরো বছর কী ইতিহাস চর্চা করানো হয়েছে আমাদের? ইতিহাসের কোন বয়ানটা তৈরি করা হয়েছে? এমনকি শেখ মুজিবকে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের নেতা হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছে। আপনারা তো বদরুদ্দীন উমর পড়েছেন ভালো করে। উনি তো এগুলোর মীমাংসা করেছেন অনেক আগে যে, এগুলো সত্যি না। আর ’৭১-এর ক্ষেত্রে শেখ মুজিব তো জানতেন না, দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে। তার নামে একটা ঘটনা ঘটছে, এটা সত্যি। কিন্তু উনি তো পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র কায়েম করার জন্যে গণপরিষদ চাইছেন। আমি তো সেখানে খারাপ কিছু দেখছি না। কারণ উনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে আমাদের জন্যে তো সেটা খারাপ কিছু না। কিন্তু উনি তো দেশ স্বাধীন করতে চান নাই। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। পরে উনি নতুন দেশে এসে প্রধানমন্ত্রী হইছেন।
সুমন ইউসুফ : ১৯৭১-এর এক দশক আগে থেকে সকল আন্দোলন-সংগ্রামে এবং নানা ধরনের বৈষম্য বিরোধিতায় সবাই শেখ মুজিবকে সামনে রাখছে। তাদের কথা হচ্ছে, সে আমাদের প্রতিনিধি। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রতিনিধি হচ্ছে শেখ মুজিব। মওলানা ভাসানীসহ সবাই এই কথা বলেছে। তো শেখ মুজিব যদি স্বাধীনতা না চায়, তাহলে তো কেউই চায় নাই।
সারোয়ার তুষার : কেউ চায় নাই— কথাটা সত্য না। বাংলাদেশের ছাত্র-তরুণ, এমনকি আওয়ামী লীগের ভেতর যারা তরুণ, তারা চাইছে। তারা শেখ মুজিবকে পোস্টার হিসেবে বা আইকন হিসেবে দাঁড় করাইছে। সাতই মার্চের ভাষণে তাকে জোর করে স্বাধীনতার কথা বলাইছে। এই ইতিহাসগুলো তো এখন এভেইলেবল। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, আমি যে বি-আওয়ামীকরণের কথা বলি, সেখানে আমি বলতে চেয়েছি যে, ইতিহাসে আওয়ামী লীগের একচেটিয়াকরণ করা হইছে। এখান থেকে বের হয়ে আপনাকে প্রকৃত ইতিহাস লিখতে হবে। সেখানে আওয়ামী লীগ যতোটুকু আছে, ততোটুকু বলতে হবে। কিন্তু আপনাকে তো এই কথাটাও বলতে হবে, ছয় মার্চে শেখ মুজিব পাকিস্তানের কনস্যুলেট জেনারেলের কাছে বলেছেন যে, আমার দলের মিলিট্যান্ট বা জঙ্গি, যারা একটু বেশি উগ্র বা রেডিক্যাল, তারা আমাকে স্বাধীনতার ঘোষণা করার জন্যে চাপ প্রয়োগ করছে, আপনারা আমাকে গ্রেফতার করুন। এগুলো তো মহিউদ্দিন আহমেদ সাহেবের বইপত্র পড়লেই পাবেন। এগুলো বহুল চর্চিত ব্যাপার। ফলে আওয়ামী লীগ আদৌ মুক্তিযুদ্ধ চাইছে কি না, ভারতে আওয়ামী লীগ কী করেছে, এগুলো তো এখন আর কোনো গোপন কথা না। এগুলো এখন সকল মেইনস্ট্রিম বইয়ের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। সেক্টর কমান্ডারদের বইপত্রে পাওয়া যাচ্ছে। আপনি যখন যথাযথভাবে আলোচনা করবেন ইতিহাস নিয়ে, তখন এইসব বিষয়গুলো বেরিয়ে আসবে।
সুমন ইউসুফ : আপনি যে-কথাগুলো বলছেন, এগুলো তো একটা ইতিহাস সার্ভ করার পার্শ্ব আলাপ।
সারোয়ার তুষার : আপনি এগুলোকে পার্শ্ব আলাপ বলতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়ে যখন আলাপ করবো, আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র কায়েমের জন্যে ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত ছিলো, যুদ্ধের কোনো পরিকল্পনা তাদের ছিলো না। দেশ যখন স্বাধীন হইছে, আওয়ামী লীগ সামনে ছিলো। অন্যদেরকে সে সামনে আসতে দেয় নাই। অন্য বামপন্থী দলগুলো দেশের ভেতর থেকেই স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করেছে। এই বিষয়গুলো কিন্তু আমরা সামনে আনতে পারি নাই। এটা না আনতে পারার কারণেই আপনাদের এখন মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগকে বাদ দেয়া হচ্ছে। পুরো ইতিহাসটাকে সামনে আনেন, মানুষকে চর্চা করতে দেন। দেখেন, আওয়ামী লীগ কোথায় দাঁড়ায়। আওয়ামী লীগের প্রবাসী সরকারের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে কমিটেড ছিলো এক থেকে দুজন লোক। তার মধ্যে একজন তাজউদ্দীন আহমদ। সেই তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের সাথে ৭ দফায় এমন চুক্তি করেছে, প্রায় দেশ বিক্রি করে দেয়ার মতোন। আওয়ামী লীগ দলটাকে আপনার বুঝতে হবে। এইটা পেটি বুর্জোয়া বা লুম্পেনদের দল। ইতিহাসকে এমনভাবে আইরনি করা হয়েছে যে, রুমি, আজাদদের মতো রেডিক্যাল বামপন্থীরাও শেখ মুজিবকে ক্রিটিক্যালি সমর্থন দিতে বাধ্য হইছে। আমাদের এই ইতিহাস নিয়ে কোনো সমস্যা নাই। মুশকিল হচ্ছে, আপনি ইতিহাসকে যেভাবে একচেটিয়া দলীয়করণ করছেন। ’৭২ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে সমাজে তুমুল ক্ষোভ আছে। ইতিহাসে এগুলো যুক্ত করতে হবে। তাহলে ইতিহাসটা অবমুক্ত হবে। তখন আপনি ইতিহাসের সত্য বয়ান সামনে আনতে পারবেন।
সুমন ইউসুফ : কিন্তু পাঁচজন লোকের মধ্য থেকে শেখ মুজিবকে আউট করে ফেললেন, সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী-যোগেন মণ্ডল— উনাদের রাখলেন। তাহলে এই ব্যবস্থাটা কি নতুন করে আওয়ামী লীগের ধারাবাহিকতা হচ্ছে না?
সারোয়ার তুষার : নাহ্। এই দায় আওয়ামী লীগের। আজকে যে মুজিব বাদ পড়তেছে, কারণ, আওয়ামী লীগ যেভাবে শেখ মুজিবকে ব্যবহার করেছে, তাতে মুজিবীয় একটা কাল্ট তৈরি হইছে। আপনি যখন আবার ইতিহাসের আট-দশজন ক্যারেক্টারের মধ্যে মুজিবও ছিলো, এভাবে বসাতে পারবেন, তখন ইতিহাসটা স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসবে।
সুমন ইউসুফ : আপনি শেখ মুজিবকে বাদ দিলে তো ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে।
সারোয়ার তুষার : বাদ দেয়া হচ্ছে না তো। ওই পাঁচজনের মধ্যে নাই।
সুমন ইউসুফ : ওই পাঁচজনের মধ্যে শেখ মুজিব থাকবে না কেন?
সারোয়ার তুষার : সে যে মুজিববাদ আকারে সমাজের মধ্যে বা আওয়ামী লীগের মধ্যে আছে, এখন সেটার সমালোচনা হচ্ছে। তার যে দেবায়ন ঘটেছে, মানে দেবতারূপ নিয়েছে, সেটার সমালোচনা হলে শেখ মুজিব স্বাভাবিক ইতিহাসের ক্যারেক্টার হিসেবে হাজির হবে। এইটুকু আগে হইতে দেন।
সুমন ইউসুফ : এইটা তো ব্যাপক গ্রে স্ট্যান্ড।
সারোয়ার তুষার : না। আমার কাছে সেরকম মনে হয় না। শেখ মুজিবকে অযথাই দেবতা বানানো হয়েছে। গত ১৫ বছর তাকে কাল্ট করে দুঃশাসন হয়েছে।
সুমন ইউসুফ : এখন তাকে যথাযথ জায়গায় নেয়া দরকার। যথাযথ জায়গায় নেয়ার জন্যে আপনাদের স্ট্যান্ড হলো, তাকে বাদ দিতে হবে?
সারোয়ার তুষার : এখনো রক্তের দাগ শুকায়নি। আপনি এখনি তাকে আনা শুরু করবেন, যখন আওয়ামী লীগ নাই। তাহলে ব্যাপারটা ঠিক হয় না। আগে ইতিহাসের এই বিষয়গুলো মীমাংসা করতে হবে। তখন উনি অটোমেটিক্যালি ইতিহাসে ফেরত আসবেন।
সুমন ইউসুফ : আচ্ছা, অন্য প্রসঙ্গে যাই। বাংলাদেশের মিডিয়া কি এখন স্বাধীন? আপনি কী মনে করেন?
সারোয়ার তুষার : মিডিয়া সব সময়ই তার স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত। এক্ষেত্রে তার পলিটিক্যাল ইকোনমি মাথায় রাখা ইম্পর্ট্যান্ট, আগে যারা তাকে ফাইন্যান্স করতো, এখনো তারাই করে। তাদের সব সময়ই একটা এজেন্ডা থাকে। এখন তো সরকারের দিক থেকে তাদেরকে কোনো চাপ দিয়ে রাখা হয় নাই। কিন্তু তার ক্যারেক্টার সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। সে ওইটার সাপেক্ষেই এখনকার কিছু কিছু পরিস্থিতি তুলে ধরে।
সুমন ইউসুফ : ভয় কাজ করে তাদের মধ্যে। তারা তো এখনো বাতাবি লেবু, কয়েকটা চ্যানেল বা পত্রিকা বাদ দিয়ে। বেশিরভাগই তো আগের মতোই আছে। এখন আপনি বলতে পারেন যে, সরকার থেকে তো কল দিয়ে তাকে বলেনি, আপনি এই নিউজটা করবেন না। কিন্তু অটো একটা সেন্সর কাজ করে। এটা তো ভয় থেকে।
সারোয়ার তুষার : না। এটা তারা তাদের স্বার্থ থেকে করে। সে তার স্বার্থ অনুযায়ী রঙ বদলাচ্ছে কেবল। মিডিয়ার অর্থ সংস্থান কোথা থেকে হচ্ছে— এটা যতোক্ষণ পর্যন্ত ফয়সালা না হবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত আমরা যে-ধরনের মিডিয়া চাই, তেমনটা পাবো না। আমরা শুধুমাত্র সরকারের দিকে তাক করি। কারা টাকা দিচ্ছে? কেন দিচ্ছে? একটা বিজনেস হাউজ কেন মিডিয়া পাবে? এই বিষয়গুলোর ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত আমরা যে-ধরনের ভূমিকা মিডিয়ার কাছে চাই, সেটা পাবো না।
সুমন ইউসুফ : আপনারা যে-জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন, এই জাতীয় ঐক্য কীভাবে হবে এখন এই অবস্থায়? একটা ন্যারেটিভে কি ঐক্য হওয়া সম্ভব?
সারোয়ার তুষার : কতোগুলো বিষয় আপনাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। নিজেদের মধ্যে অনেক রাজনীতি থাকবে। একটা পোস্ট পলিটিক্যাল পজিশন থেকে পলিটিক্যাল জার্নিটা শুরু হবে। আপনি কতোগুলো বিষয় নিয়ে রাজনীতি করবেন না। অনেক বয়ান থাকবে। অনেকের অনেক এম্বিশন থাকবে। কিন্তু ন্যূনতম কতোগুলো ঐক্য থাকবে। এটা এখন প্রক্রিয়াধীন আছে। এখনই, চার-পাঁচ মাসে এর ফয়সালা করতে পারবো না। আমরা এখন নাজুক সিচুয়েশনে আছি, ক্ষমতার কাড়াকাড়ি আছে। আমাদের আরেকটু সামনে আগাতে হবে। জাতীয় ঐক্যটা হচ্ছে এরকম, বিজেপি আর কংগ্রেস কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নে একমত হয়ে যায়। আমাদেরকে সেরকম কিছু করতে হবে। মানে বিএনপি আমাদেরকে পরাজিত করতে চাইবে। আমরা বিএনপিকে পরাজিত করতে চাইবো। এখানে কোনো দোষ নাই। আবার এর মধ্যে আছে আওয়ামী লীগের প্রশ্ন, বিচারের প্রশ্ন— এগুলো করতে হবে। এগুলো না করে কেউ যখন বলে যে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসুক, তখন এটা ভুল হয়ে যায়। আমাদের মিনিমাম একটা জায়গায় আসতে হবে যে, এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে রাজনীতি করবো না। আমরা মনে করি, এটা আস্তে আস্তে সম্ভব হবে। কারণ, আলোচনাগুলো জারি আছে। আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা একটা জায়গায় যেতে পারবো।