১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি লাভ করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র— বাংলাদেশ। এ-দেশের সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগ, মৃত্যু আর রক্তের বিনিময়ে এটা সম্ভব হয়েছিলো। তবে এই স্বাধীনতা হঠাৎ করে শুরু হয়ে যায়নি। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই ধাপে ধাপে নানান তৎপরতা ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৯৭১ সালে এসে পরিণতি লাভ করে। গোটা দেশের মানুষ নিজেদের এই স্বাধীনতার পথে সম্মিলিতভাবে বিলিয়ে দিয়েছিলো অকুণ্ঠচিত্তে। আর এই বিলিয়ে দেয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবার আত্মলীনপথে অনেক রাজনৈতিক নেতার তৎপরতা প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলো।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলার দামাল সন্তানেরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকায় বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিল বের করে। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। সালাম, বরকত, রফিকের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। এই হত্যার প্রতিবাদে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে গোটা দেশ। নরসিংদী জেলায়ও এই হত্যার খবর পৌঁছামাত্র জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মতো ফুঁসে ওঠে জনতা। নরসিংদী, রায়পুরা, মনোহরদী, শিবপুর, পলাশ ও বেলাব থানার প্রতিটি স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল এবং সমাবেশের মাধ্যমে এ-ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। স্কুল-কলেজ, মিল-কারখানা এমনকি অফিস আদালতেও ধর্মঘট পালিত হয়।
এ-সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো নরসিংদীতে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়োজিত জনসভা। ২১ ফেব্রুয়ারির তিনদিন পর অনুষ্ঠিত এই জনসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। আওয়ামী লীগ নেতা মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে দত্তপাড়া ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত এই জনসভায় প্রচুর লোক সমাগম হয়। মওলানা ভাসানীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং অবিলম্বে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানান। জনগণ প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। এই জনসভা সংগঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া, আফসার উদ্দিন, আ. রাজ্জাক ভূঁইয়া, মতিউর রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। এই জনসভার জের হিসেবে মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করার জন্যে সরকার ঢাকা থেকে নরসিংদীতে প্রায় ২০০ পুলিশ ফোর্স পাঠায়। এই পুলিশ ফোর্স যখন ভাসানীকে গ্রেফতারের জন্যে নরসিংদী রেলস্টেশনে অপেক্ষা করছিলো, তখন স্টেশনের পশ্চিমে অবস্থিত বটতলার ওয়াজ উদ্দিন নামক একজন আওয়ামী লীগ কর্মী পুলিশ দেখে সন্দেহ পোষণ করেন। তিনি তৎক্ষণাৎ দত্তপাড়া থেকে যে-পথে মওলানা ভাসানী নরসিংদী স্টেশনে আসতে পারেন, সেই পথে এগিয়ে যান এবং পথিমধ্যে মওলানা ভাসানীসহ নেতৃবৃন্দকে আসতে দেখে পুলিশের উপস্থিতির খবর দেন। ফলে গ্রেফতার এড়াতে মওলানা ভাসানীকে হিন্দুপাড়ার ভেতর দিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। ৫-৬ দিন সেখানে আত্মগোপনে থাকার পর তাঁকে নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।
১৯৫৩ সালে ঈদগাহ ময়দানে আরো একটি বড়ো জনসভা হয়। এই জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। বিশেষ অতিথি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। নবীনগরের রফিকুল ইসলাম, আলী আহমেদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দও বক্তব্য রাখেন। শেরে বাংলা এ-সভায় সবাইকে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান। এই জনসভার উদ্যোক্তা ছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।

১৯৫৩ সালে শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাভিত্তিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রামে যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং ১৯৫৪ সালের ৮ মার্চের সাধারণ নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই নির্বাচনে মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ নেতা সারা বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে ২১ দফার বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে তোলেন। এরই অংশ হিসেবে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, শেখ মুজিব নরসিংদী, শিবপুর, রায়পুরা ও মনোহরদীর হাতিরদিয়ায় গণসংযোগে আসেন এবং জনসভা করেন। তাঁদের গণসংযোগের ফলে সারা নরসিংদীতে গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়। নরসিংদী এলাকার নির্বাচনী প্রচারণায় মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া, আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া, আবুল হাশিম মিয়া, আতাউর রহমান ভূঁইয়া, আ. লতিফ ভূঁইয়া, আফতাব উদ্দিন ভূঁইয়া, কলিম উদ্দিন এডভোকেট, শহীদ উল্লাহ ভূঁইয়া, তোফাজ্জল হোসেন, ছাত্রনেতা গোফরান, জিয়াউল হক, নূর মোহাম্মদ, গৌরাঙ্গ পোদ্দার, নৃপেন্দ্র সাহা, সুরেন্দ্র দাস, তাবু মিয়া ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।
নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয় এবং যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থীরা প্রতিটি আসনে ভোটের বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে ৩ এপ্রিল যুক্তফ্রন্ট সরকার শপথ গ্রহণ করে ক্ষমতাসীন হয়। কিন্তু ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে এবং যুক্তফ্রন্ট সরকারকে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করে কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৩৫ সালে প্রণীত ভারত শাসন আইনের ৯২ (ক) ধারা বলে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে চক্রান্তমূলকভাবে ক্ষমতা কেড়ে নেয় এবং পূর্ব বাংলায় অনির্দিষ্ট কালের জন্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। শেরে বাংলাকে অন্তরীণ, মওলানা ভাসানী বিদেশে থাকায় স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে নিষেধাজ্ঞা এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ শত শত রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয় এবং কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এই নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়, আন্দোলন গড়ে ওঠে। নরসিংদীতেও এই আন্দোলন মারাত্মক রূপ লাভ করে। প্রতিবাদ, মিছিল, মিটিং, বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সমগ্র নরসিংদী। আন্দোলনের প্রচণ্ডতাকে দমনের জন্যে পাকিস্তান সরকার গ্রেফতার করে নরসিংদীর জননেতা আবুল হাশিম মিয়া, শীতল চন্দ্র দে, কার্তিক চন্দ্র সাহা, আবুল ফজল ভূঁইয়া, সুরেশ পোদ্দারসহ আরো কয়েকজন নেতাকে। মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া, হারুন-অর-রশিদ ভূঁইয়া, রহমান ভূঁইয়াসহ আরো কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতারের জন্যে তাঁদের বাড়িতে হানা দিয়ে ব্যর্থ হয়।
১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট। এই রিপোর্টে ২ বছরের ডিগ্রি কোর্সকে ৩ বছরে রূপান্তরিত করাসহ পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা সংকোচনের প্রস্তাব করা হয়। কাজেই এই রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্ররা শিক্ষা দিবস পালন উপলক্ষে প্রদেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়। নরসিংদীর প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই হরতাল পুরোপুরিভাবে পালিত হয়। এ-দিন ঢাকায় ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে তিনজন নিহত হলে নরসিংদীতেও তার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ধর্মঘট পালিত হয়। ইতোমধ্যেই আইয়ুব খান নিজের ক্ষমতার পথ নিষ্কণ্টক করতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ আবুল মনসুর আহমদ, মনসুর আলী ও শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ করলে অন্যান্য স্থানের মতো নরসিংদীতেও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এসব আন্দোলনের সময় নরসিংদীর দত্তপাড়া ঈদগাহ ময়দানে এক জনসভা হয়। এতে আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী বক্তৃতা করেন। এ-সময়ের আন্দোলনে নেতৃত্বে ছিলেন জানে আলম ভূঁইয়া, রিয়াজ উদ্দিন, আতাউর রহমান ভূঁইয়া, সাখাওয়াত হোসেন মিয়া ওরফে ইয়ার মোহাম্মদ, শামসুল হক ভূঁইয়া, হাবিবুল্লাহ বাহার, নারায়ণচন্দ্র সাহা, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, আবদুল মান্নান খান, ফজলুর রহমান ফটিক মাস্টার, আপেল মাহমুদ, আলী আকবর, নাজমুল হোসেন বাদল প্রমুখ ছাত্রনেতা। সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি এবং শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত নরসিংদীর ছাত্র-জনতা যখন উত্তেজিত, ঠিক সেই সময় মনোহরদী থানার হাতিরদিয়াতে একটি জনসভায় যোগ দেয়ার জন্যে রওনা হন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবদুস সবুর খান, ওয়াহিদুজ্জামান এবং নারায়ণগঞ্জের ডিসি আ. ছাত্তার। তারা গাড়িযোগে নরসিংদীর বর্তমান ফায়ার সার্ভিসের সামনে (মতান্তরে বৌয়াকুড়) পৌঁছালে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার একটি মিছিল তাদের গতি রোধ করে এবং তাদের গাড়ি ভাঙচুর করে। এরপর সারা নরসিংদীতে আইয়ুব খানের ফটো ভাঙা হয়। এ-ঘটনার প্রেক্ষিতে ছাত্রনেতা আতাউর রহমান ভূঁইয়া ও শামসুকে কলেজ থেকে ফোর্স টিসি দেয়া হয় এবং রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, নাজমুল হোসেন বাদল, শামসুল হুদা বাচ্চু ও আলী আকবরসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। পরে জনমত ও ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকার তাদের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাঙালির মুক্তিসনদ ‘ছয়দফা’ ঘোষণা করে এবং স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে। এ-সময় বাম আন্দোলন মস্কোপন্থী ও চীনপন্থী নামে দুই ধারায় বিভক্ত হলেও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন অব্যাহত রাখে তারা। ফলে আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে। নরসিংদীতে ছয়দফার পক্ষে মিছিল, মিটিং, শোভাযাত্রা চলতে থাকে। ছয়দফার জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে সরকার দমননীতির আশ্রয় নিয়ে শেখ মুজিবসহ কয়েকজন নেতাকে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে বন্দী করে এবং প্রদেশজুড়ে ধর-পাকড় শুরু করে। এর প্রতিক্রিয়ায় পূর্ব বাংলায় ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং প্রতিবাদে ৭ জুন হরতাল আহ্বান করা হয়। গোটা পূর্ব পাকিস্তানের সাথে নরসিংদীতেও ব্যাপক বিক্ষোভ হয়, সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। হরতালের দিন সরকার নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নেয়। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ধর্মঘটী জনতার উপর পুলিশ গুলি চালালে ১১ জন নিহত ও বহু লোক আহত হয়। শত শত লোককে গ্রেফতার করা হয়। প্রতিবাদে ১৭ থেকে ১৯ জুন সারাদেশে প্রতিবাদ দিবস পালন করা হয়। নরসিংদী জেলার প্রতিটি থানার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানায় মিছিল-সভা-সমাবেশের মাধ্যমে এই প্রতিবাদ দিবসকে সফল করে তোলা হয়। নরসিংদীর নেতৃবৃন্দের নির্দেশে জনতা নরসিংদী থেকে জিনারদী পর্যন্ত রেললাইন তুলে ফেলে। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে নরসিংদীতে রাজনৈতিক উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করে। তাঁদেরকে গ্রেফতারের পরপরই এই ষড়যন্ত্রমূলক মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ অন্যদের মুক্তির দাবিতে গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে। হরতাল, মিছিল, মিটিং, জনসভার মাধ্যমে আন্দোলন চলতে থাকে। নরসিংদীতে ১০ আগস্ট ছাত্র ধর্মঘট, ১৭ সেপ্টেম্বর সরকারি কলেজে কালো পতাকা উত্তোলন ও সভা করা হয়। ১৫ অক্টোবর সরকারি কলেজে আইয়ুব খানের উন্নয়ন দশক উপলক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হলে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্ররা এই সভা বর্জন করে এবং ‘দুর্গতির দশক’ হিসেবে একে আখ্যায়িত করে। ১০ নভেম্বর ন্যাপের উদ্যোগে জিন্নাহ পার্কে জনসভা হয়। ১১ ডিসেম্বর সর্বদলীয় কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৪ ডিসেম্বর হরতাল পালিত হয়। এছাড়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের উদ্যোগে পৃথক কর্মীসভা, শোভাযাত্রা, প্রতিবাদ সভা, জনসভা অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলে। এ-সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার খরচ মেটানোর জন্যে নরসিংদী জেলাবাসীর পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে টাকা প্রেরণ। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নরসিংদীর সর্বস্তরের জনগণের নিকট থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে কালীগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা ময়েজউদ্দীনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অর্থ প্রেরণ করে মামলার ব্যয় মেটানোর কাজে সহায়তা করেন।
১৯৬৮ সালে নরসিংদীর সবচেয়ে আলোড়িত ঘটনা মনোহরদী থানায় সংঘটিত ‘হাট হরতাল’। আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করতে মওলানা ভাসানী ২৯ ডিসেম্বর এসব এলাকায় হাট হরতাল পালনের ডাক দেন। এই হরতাল সফল করার জন্যে শিবপুর ও মনোহরদী এলাকায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল মান্নান খান, তোফাজ্জল হোসেন, ছাত্র ইউনিয়ন ও কৃষকনেতা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, কৃষক সমিতির নেতা তোফাজ্জল হোসেন শাহজাহান, আ. রশিদ তারা মাস্টার, আ. হাই ও সিরাজুল হক। স্থানীয় নেতা তোফাজ্জল হোসেন শাজাহানের নেতৃত্বে প্রথমে হরতালের পক্ষে পিকেটিং শুরু হয়। একটি রিকশায় দাঁড়িয়ে আসাদুজ্জামান বক্তব্য প্রদানকালে সকাল এগারোটায় পুলিশ পিকেটিংরত ছাত্র-জনতার উপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও ধর-পাকড় আরম্ভ করে। ফলে জনতা আরো মারমুখী হয়ে ওঠে। এমন অবস্থায় আবদুল মান্নান খানের নেতৃত্বে শিবপুর হতে বিপুল জনতার এক জঙ্গি মিছিল হাতিরদিয়ার জনতার সাথে মিলিত হয়ে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করে তোলে হাতিরদিয়া বাজার এবং গ্রেফতারকৃতদের ছাড়িয়ে আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। উত্তপ্ত অবস্থায় বিকেলের দিকে পুলিশ বাহিনি জনতার উপর বেপরোয়া গুলি চালায়। পুলিশের নির্মম গুলিবর্ষণে নিহত হয় নোয়াদিয়ার মো. মিয়া চান, সোনামুড়ার মো. হাছেন আলী ও বাসলীকান্দির মো. ছিদ্দিকুর রহমান নামে তিনজন কৃষক। মাথায় মারাত্মক আঘাতে আহত হন মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান এবং চান মিয়া, আক্কাছ আলী, মোতালেব ও কলেজ ছাত্র আ. হাইসহ আরো বেশ কয়েকজন কৃষক-জনতা। গ্রেফতার করা হয় কৃষকনেতা তোফাজ্জল হোসেন শাজাহান, ছাত্রনেতা তোফাজ্জল হোসেন, সেন্টু মোল্লা, মোক্তার হোসেন খান, শরীফ হোসেন এবং মাইকম্যান শাজাহানকে। গ্রেফতারকৃতদেরসহ মোট ১৮ জনকে আসামী করে পরে পুলিশ মামলা দায়ের করে। প্রধান আসামী ছিলেন আসাদের পিতা মৌলভী আবু তাহের। গ্রেফতার এড়িয়ে আসাদুজ্জামান ঢাকায় চলে আসেন এবং প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় ঘটনার বিবরণ দেন। ফলে ৩০ ডিসেম্বরের সংবাদপত্রগুলোতে ঘটনার বিস্তারিত খবর প্রকাশিত হয়। হাতিরদিয়ায় সংঘটিত পুলিশি হত্যা ও নির্যাতনের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সমগ্র নরসিংদী এলাকায় প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সারা এলাকায় বিক্ষোভ চলে ও প্রতিবাদ সভা হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে ২ জানুয়ারি ১৯৬৯ নরসিংদী কলেজে ছাত্র ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা হয়। ৩ জানুযারি কলেজের পুকুরঘাটে নরসিংদী শহরের সমস্ত স্কুল-কলেজের ছাত্রদের জমায়েত ও সভা হয়।
১৯৬৯ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আন্দোলন-সংগ্রামের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যুজ্জ্বল অধ্যায়। এ-সময়ই শুরু হয় তুমুল আন্দোলন এবং শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত বাঙালি তাদের আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে শুরু করে। ৪ জানুয়ারি ডাকসু কার্যালয়ে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (উভয় গ্রুপ) এবং ডাকসুর সমন্বয়ে পূর্ব বাংলার প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে ১১ দফা দাবিনামা পেশ করে। এরই অনুসরণে নরসিংদীতেও ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। এই পরিষদে যারা ছিলেন :
শামসুল হুদা বাচ্চু, ছাত্রলীগ, আহ্বায়ক
নূরুল ইসলাম গেন্দু, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য সচিব
হারাধন চন্দ্র সাহা, ছাত্রলীগ, সদস্য
আবদুল মতিন ভূঁইয়া, ছাত্রলীগ, সদস্য
সুভাষ চন্দ্র সাহা, ছাত্রলীগ, সদস্য
মানিক সাহা, ছাত্রলীগ, সদস্য
আবদুল গফুর, ছাত্রলীগ, সদস্য
ফজলুল কাদের চৌধুরী, ছাত্রলীগ, সদস্য
মো. আলী আকবর (নরসিংদী কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি), ছাত্রলীগ, সদস্য
মো. আবদুল আলী মৃধা, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), সদস্য
শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), সদস্য
মো. বজলুর রহমান, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), সদস্য
তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), সদস্য
নূরুল ইসলাম কাঞ্চন, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), সদস্য
যূথিকা চ্যাটার্জী, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
কার্তিক চ্যাটার্জী, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
রফিকুল ইসলাম, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
আজিজ আহমেদ খান, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
বি এ রশিদ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
মজিবর রহমান, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
মোশাররফ হোসেন, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), সদস্য
১১ দফা দাবির সমর্থনে ছাত্ররা ২০ জানুয়ারি সারা পূর্ব বাংলায় ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ছাত্র ধর্মঘট পালনকালে ঢাকায় এক ছাত্রমিছিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা নরসিংদীর অগ্নিপুরুষ আসাদুজ্জামান (আসাদ) গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। আসাদের হত্যাকাণ্ড ছাত্রসমাজসহ পূর্ব বাংলার সকল শ্রেণির মানুষকে প্রবল আঘাত করে। সারা নরসিংদীতে শোকের ছায়া নেমে আসে। পরদিন নরসিংদী কলেজে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং জানাজার আগে বিরাট জনসভা এবং জানাজা শেষে হাজার হাজার লোকের শোকমিছিল এলাকা প্রদক্ষিণ করে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শিবপুর, মনোহরদী, নরসিংদী, কালীগঞ্জ, রায়পুরা, আড়াইহাজার এলাকায় মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ সভা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। ফলে জনগণ সোচ্চার হয়ে ওঠে, ব্যাপকভাবে আন্দোলনমুখী হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
আসাদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ২২ জানুয়ারি নরসিংদীতে বিরাট মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সমাবেশে ২৪ জানুয়ারি (শুক্রবার) নরসিংদীতে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। ২৪ জানুয়ারি নরসিংদীর সকল অঞ্চলে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, কল-কারখানা, হাট-বাজার সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। নরসিংদী শহরে অভূতপূর্ব মিছিল হয় এবং বিকেলে তৎকালীন ইপিআরটিসি ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ-জনসভায় শোককে শক্তিতে পরিণত করার শপথ নেয়া হয় এবং সংগ্রামকে জীবনের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করার অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়। এই জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতা মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া, মতিউর রহমান ভূঁইয়া, ন্যাপের আবুল হাশিম মিয়া, আতাউর রহমান ভূঁইয়া, ছাত্রনেতা শামসুল হুদা বাচ্চু, আলী আকবর, হারাধন সাহা, আ. আলী মৃধা, আ. মতিন ভূঁইয়া, শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া, তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া, নূরুল ইসলাম গেন্দু, যূথিকা চ্যাটার্জী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সমাবেশে ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি নরসিংদীতে দু’দিনব্যাপী শোক দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি যথাযোগ্য মর্যাদায় শোক দিবস পালন করা হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ-দিন ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী যূথিকা চ্যাটার্জীর নেতৃত্বে নরসিংদীতে অনুষ্ঠিত হয় সরকার বিরোধী এক বিরাট মহিলা মিছিল। স্কুল-কলেজের ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সচেতন মহিলারা এই মিছিলে যোগ দেয়। নরসিংদীতে এটি ছিলো সর্বপ্রথম মহিলা মিছিল। ঘরের গৃহিণীদের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে এই মিছিল অনন্য ভূমিকা পালন করে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ইউ-এম-সি জুট মিলের শ্রমিকদের মিছিল, ২১ তারিখে কলেজ মাঠে এবং ২২ তারিখে মরিচাকান্দিতে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এসব আন্দোলনের ফলে আইয়ুব সরকার পিছু হটতে থাকে। ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিরোধী দলকে আলোচনায় আসার আহ্বান জানায়। সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয় প্রবল আন্দোলনের মুখে। ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। শেখ মুজিবসহ অন্যান্য অভিযুক্তরা মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬৯-এর এই গণ-অভ্যুত্থানে এশিয়ার লৌহমানব খ্যাত আইয়ুবের পতন ঘটে। আইয়ুবের পতন ত্বরান্বিত করার জন্যে এ-সময় নরসিংদীর বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয় আরো অনেক আন্দোলন, সংগ্রাম, জনসভা। এগুলোর মধ্যে ২০ ফেব্রুয়ারি আদিয়াবাদের জনসভা, ২৪ ফেব্রুয়ারি পাঁচদোনার জনসভা, ৪ মার্চ শহরের জিন্নাহ পার্কের জনসভা, ৬ মার্চ জয়নগরের জনসভা, ১১ মার্চ কাঁঠালিয়ার জনসভা অন্যতম। কাঁঠালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। তবুও তিনি আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এরপর ১২ মার্চ ‘ডাক’ (DAC : Democratic Action Committee)-র উদ্যোগে শিবপুরে অনুষ্ঠিত হয় এক বিরাট জনসভা। ১৪ মার্চ কালীগঞ্জের নাগরীতে অনুষ্ঠিত হয় এক ছাত্র-জনসভা। ১৬ মার্চ ঘোড়াশালের সান্তানপাড়ায়ও অনুষ্ঠিত হয় জনসভা। এ-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নরসিংদীসহ সারা দেশের আন্দোলনই আইয়ুবের পতনকে ত্বরান্বিত করে। এরপর ১৯৬৯ এর ২৫ মার্চ দেশে পুনরায় সামরিক শাসন জারি করা হয়। আইয়ুব খান চলে গেলো, ইয়াহিয়া খান এলো নতুন চক্রান্তের ছক নিয়ে। পাকশির শাহপুরে কমিউনিস্টদের আয়োজিত এক কৃষক সম্মেলনে ইতোমধ্যেই শ্লোগান ওঠে— শ্রমিক কৃষক অস্ত্র ধর, পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর।
রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় ১১ দফাকে সমর্থন করে শেখ মুজিবুর রহমান জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের দাবি জানান। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-শ্রমিক সংগঠন ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্যে জনগণের প্রতি আহ্বান জানায়। এরই মধ্যে বিভিন্ন ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠন এমনকি কোনো কোনো রাজনৈতিক দলও স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিত্যাগ করে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবিতে ক্রমে সোচ্চার হয়ে ওঠে। জনগণের কাছে পাকিস্তানি শাসকচক্রের বৈষম্য ও ষড়যন্ত্র পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় সারা দেশের মানুষও সোচ্চার হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলন প্রবল থেকে প্রবলতর হয়। নরসিংদীর বিভিন্ন স্থানে এ-সময় সংঘটিত হয় অনেক জঙ্গি মিছিল-মিটিং। এসব মিছিল-মিটিংয়ে সম্পৃক্ত হয় সর্বস্তরের জনগণ। মূলত, ছাত্রনেতারা এ-আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রমিক সংগঠন এবং সামাজিক সংস্থাসমূহও এ-সময় চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি জিন্নাহ পার্কে অনুষ্ঠিত হয় জনসভা। জানুয়ারির ১৫ তারিখ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর চট্টগ্রাম যাবার পথে নরসিংদী রেলস্টেশনে ছাত্ররা তাকে কালো পতাকা প্রদর্শন করে। ১৭ জানুয়ারি থেকে নরসিংদীতে পালন করা হয় ‘১১ দফা সপ্তাহ’। জনগণকে সচেতন ও সক্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে এ-সপ্তাহের সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। ২৪ জানুয়ারি নরসিংদীতে পালন করা হয় সর্বাত্মক হরতাল। জানুয়ারিতে হাসনাবাদ বাজারে অনুষ্ঠিত হয় এক জনসভা। এতে কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতারা বক্তব্য রাখেন। এই আন্দোলন আস্তে আস্তে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেবে বলে তারা বক্তব্য প্রদান করেন। এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণার জন্যে ৯ মার্চ নরসিংদীর শিক্ষকগণ পালন করেন ধর্মঘট। নরসিংদীর সকল বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ মিছিল করে এই ধর্মঘটে যোগ দেন। মিছিল শেষে ব্রাহ্মন্দী বিদ্যালয়ের মাঠে সভা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষকগণের কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১২ মার্চ মশাল মিছিল বের করা হয় এবং জিন্নাহ পার্কে জনসভার আয়োজন করা হয়। এই জনসভায় ঢাকা থেকে আগত হেনা দাস প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। এ-সময় রায়পুরার নারায়ণপুরে অনুষ্ঠিত হয় এক বিরাট জনসভা। এতে মওলানা ভাসানী প্রধান অতিথি ছিলেন। এ-জনসভায় ভাসানী জনগণের ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে সকলকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান।
২ এপ্রিল নরসিংদীর জন্যে একটি স্মরণীয় দিন। এ-দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নরসিংদীর ঈদগাহ ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বক্তব্য রাখেন। তিনি ৬ দফা দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্যে এবং আগামী নির্বাচনে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের জন্যে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। জনসভার পূর্বে নরসিংদী রেলস্টেশনে তাঁকে ছাত্র-জনতা বিপুল সংবর্ধনা জানায়।
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর ব্যাপক অত্যাচার-নিপীড়ন-হত্যাকাণ্ডে পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে প্রচণ্ড অসন্তোষের সৃষ্টি হয় এবং তার প্রতিবাদে সারা পূর্ব পাকিস্তানের সাথে নরসিংদীর জনগণও ২৬ মে হরতাল পালন করে। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত হয় অসংখ্য সভা-সমাবেশ। নরসিংদীসহ সারা দেশের প্রবল উত্তাল আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে বাধ্য হন। নির্বাচনী জোয়ারে জেগে ওঠে নরসিংদীসহ সারা পূর্ব বাংলার মানুষ। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১ মার্চ বেলা একটার সংবাদে রেডিও মারফত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার সাথে সাথে নরসিংদীর সর্বস্তরের জনগণ প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। নরসিংদী সদর থানাসহ প্রতিটি থানায়ই প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। প্রতিবাদ সভা, মিছিল, বিক্ষোভ প্রদর্শন ও নিন্দা জ্ঞাপন করে অধিবেশন আহ্বানের দাবি জানানো হয়।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ নরসিংদীর জন্যে একটি স্মরণীয় দিন। এ-দিন নরসিংদী শহরের মিতালী সিনেমা হলের সামনে আয়োজন করা হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের সভা। ২ মার্চ সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র সমাবেশ ব্যতিত পূর্ব পাকিস্তানের আর কোথাও তখনো পর্যন্ত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়নি। মিতালী সিনেমা হলের সামনে অনুষ্ঠিত বিরাট জনসভার জনপ্রতিনিধি হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতা জনাব মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে নরসিংদীতে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।

৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত ঘোষিত কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুযায়ী নরসিংদীতে প্রতিদিন সকাল ৬ টা থেকে বেলা ২ টা পর্যন্ত পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। নরসিংদী শহরসহ বর্তমান নরসিংদী জেলার প্রতিটি থানার সমস্ত দোকানপাট বন্ধ থাকে। বাস-রিকশা-গাড়িসহ কোনো যানবাহন চলাচল করেনি। নরসিংদী ও পলাশ থানার সকল কল-কারখানার উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকে। এ-সমস্ত কর্মসূচি চলাকালীন মিছিল, পথসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং জনসভার আয়োজন করা হয়। এমনি একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয় নরসিংদী কলেজ মাঠে। ৬ মার্চ অনুষ্ঠিত এই জনসভায় স্থানীয় রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতারা জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন এবং অধিকার আদায়ে যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকার জন্যে সবাইকে আহ্বান জানান। এসব কর্মসূচিতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্দোলন ক্রমশ জঙ্গি রূপ ধারণ করে।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশাল জনসমুদ্রে ভাষণে বলেন, তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। শেখ মুজিবের এই ঘোষণা উত্তাল জনসমুদ্র এবং সারা দেশের মানুষের মতো নরসিংদীর মানুষকেও প্রবলভাবে আন্দোলিত ও উজ্জীবিত করে তোলে। ঢাকায় বসবাসরত নরসিংদীর মানুষজন ছাড়াও নরসিংদী থেকে হাজার হাজার কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা এই জনসভায় যোগদান করে। রেলগাড়ি ছাড়াও শুধুমাত্র নরসিংদী থেকেই ১০০ টি বাসে করে জনগণ এই জনসভায় যোগ দেন।
১৬ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে মুজিব-ভুট্টো-ইয়াহিয়ার সমঝোতার প্রয়াস অব্যাহত থাকলেও জনগণ তখন রাজপথে ‘স্বাধীনতা’র মন্ত্রে আপোসহীন। আর এক্ষেত্রে ছাত্রসমাজের ভূমিকাই ছিলো সবচেয়ে অগ্রগণ্য। এরই মধ্যে ১৯ মার্চ সামরিক বাহিনি জয়দেবপুরে গুলিবর্ষণ করে নিরীহ মানুষকে হত্যা করলে নরসিংদীতে তার প্রতিবাদে মিছিল ও বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয় এবং ছাত্রসভার আয়োজন করা হয়।
এরপর ২৬ মার্চ; ইতিহাসের সেই ভয়াল কালরাত। ইয়াহিয়া-ভুট্টো গং সভ্যতার নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় বাংলার বুকে। শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং অবধারিতভাবে শুরু হয়ে যায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
সার্বিক তথ্য সহায়তা
১. মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন, নরসিংদী জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস;
২. এম আর মাহবুব, নরসিংদীর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস।