হিমালয়ের কৈলাশ পর্বতশৃঙ্গ থেকে বয়ে আসা বিপুল জলরাশির স্রোতধারা ব্রহ্মপুত্র। সেই আদিকাল থেকে বহু জনপদ আর বিচিত্র গতিপথ পেরিয়ে মহেশ্বরদীকে অবগাহিত করেছে এই নদ। জনপদকে করেছে সমৃদ্ধ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালের আগে পরগণায় বিভক্ত ছিলো বারো ভূঁইয়ার এই দেশ। বর্তমান নরসিংদী জেলার বৃহৎ অঞ্চল তখন পরিচিত ছিলো মহেশ্বরদী পরগণা হিসেবে। শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড় জুড়ে বিস্তৃত এই জনপদ। এর পশ্চিম পাড়ে ভাওয়াল পরগণা। লক্ষ্যার পাড়ের এই দুই জনপদ— মহেশ্বরদী আর ভাওয়াল, গলাগলি হয়ে, এক হয়ে থেকেছে বহুকাল; ব্রিটিশ, পাকিস্তানি আমল ও বাংলাদেশের প্রথমদিকে বৃহত্তর ঢাকা জেলায়।
এই অঞ্চলটিতে ব্রহ্মপুত্র যে কতো বিশাল নদ ছিলো, এখন আর তা বোঝার উপায় নেই। এই ঊনবিংশ শতাব্দীতেও এখানে এর অস্তিত্ব ছিলো প্রবল প্রতাপে। ছিলো যাতায়াত আর যোগাযোগের প্রধান নদীপথ। মাধবদী আর পাঁচদোনায় ছিলো এর বন্দর। পাঁচদোনার মানুষ ভাই গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৪-১৯১০) তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ পাশ ঘেঁষে প্রবাহিত। এই নদীই এখানকার জীবন। এর জলপথে চলাচল করে মানুষ। দূর কিংবা নিকটবর্তী নগরে। এই পথে পালতোলা কিংবা গুণটানা নৌকা হচ্ছে বাহন। আরো লিখেছেন, পাঁচদোনা থেকে ঐ-রকম নৌকায় চড়ে তিনি ও তাঁর পরিবারের লোকেরা ময়মনসিংহ ও ঢাকা যেতেন। সময় লাগতো অনেক।
ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী শীতলক্ষ্যা। টলটলে মিষ্টি জলের নদী। এর পাড়ের প্রবীণ লোকেরা বলেন, শীতলক্ষ্যাকে সাত পাঁকে প্যাঁচিয়ে বিয়ে করেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। সেই আদিকালে। নদ আর নদীর এই প্যাঁচের মধ্যেই মহেশ্বরদীর অবস্থান। এর প্রভাবে এই অঞ্চলের মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনযাপন গড়ে ওঠেছে ভিন্ন মাত্রা নিয়ে; এই দুই নদ-নদী ও এদের শাখা-প্রশাখাকে ঘিরে।
শীতলক্ষ্যার পাড়ে জন্ম কৃতী সাহিত্যিক হরিপদ দত্তের; ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতে। খাতাপত্রে জন্ম ১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে। সেই হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার ছয় মাস আগে। কিন্তু তিনি বলছেন, পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিলো দুই বছর। সুতরাং তাঁর জন্ম ১৯৪৫ সালে হতে পারে। সেই হিসেবে বর্তমানে তাঁর বয়স ৭৮ বছর।
শীতলক্ষ্যার পাড়ের যে-গ্রামে তাঁর জন্ম, তার নাম খানেপুর। ঐ-গ্রামের অনূঢ়া নৈস্বর্গিক প্রকৃতিতে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা বর্ধিষ্ণু জোতদার পরিবারে। নদীর পাড় জুড়ে বিশাল ভূ-সম্পত্তি, প্রতাপ-প্রতিপত্তিশীল দত্ত পরিবারে। বাবা শরৎ দত্ত ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের চাকুরে; পাকিস্তান হবার পর তাঁর অঞ্চলের ইউনিয়ন বোর্ডের সদস্য। আইয়ুব খানের সময় মৌলিক গণতন্ত্রী (বিডি) মেম্বার। বাবা-মা’র একমাত্র পুত্রসন্তান হিসেবে এবং বনেদি পারিবারিক ঐতিহ্যের সুবাদে তাঁর শৈশব কেটেছে আদরে ও স্বাচ্ছন্দ্যে, পার্শ্ববর্তী নিম্নবর্গের হিন্দু ও মুসলমান সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে মিলেমিশে। পড়াশোনা নদীর ওপাড়ের ভাওয়াল জামালপুর স্কুলে। তারপর ঢাকায়। জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯৬৪-৬৫ সালে আইয়ুব খানের শাসনামলে শিল্পায়ন শুরু হয় শীতলক্ষ্যার পাড় জুড়ে, নদীপথে যোগাযোগের সুবিধার কথা বলে। নদীর পাড়ে অনেকটা দূরে আগে থেকেই ছিলো দেশবন্ধু সুগার মিল, চিত্তরঞ্জন কটন মিল ও পাক জুট মিল। এবার দত্তদের গ্রাম (খানেপুর-কাঁঠালিয়াপাড়া) নির্দিষ্ট হলো সারকারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও ফৌজিদের জুট মিলের জন্যে। হিন্দু জনসংখ্যাপ্রধান এই এলাকার অধিবাসীরা হঠাৎ করেই সরকারি অধিগ্রহণের দ্বারা ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ হলেন। হয়ে পড়লেন উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী। দত্ত পরিবার তাঁদের ভূ-স্বামীর মর্যাদা হারালো। শিল্পায়নের নতুন আর্থ-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে বহুকালের আধিপত্যও হারালো। বাড়ি-ভিটা, জমি হারানোদের শতকরা ৯০ ভাগই ছিলো হিন্দু পরিবার। তারা যা কিছু ক্ষতিপূরণ (পুরো ক্ষতিপূরণ মেলেনি তাদের নানা মারপ্যাঁচে) পেলেন, তা নিয়ে নতুন আবাসের খোঁজে সীমান্ত পাড়ি দিলেন প্রায় সবাই। দত্তবাবুরা গেলেন না। তাদের কেউ কেউ গেলেন অনেকটা দেরিতে, বাংলাদেশ হওয়ার কিছুকাল পরে। কিন্তু হরিপদ দত্ত গেলেন না। তিনি একাই থেকে গেলেন বিদ্রোহী হয়ে। বললেন, জন্মভূমি ছেড়ে যাবো কোথায়?
বাবা শরৎ দত্ত ছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি একান্ত অনুগত একজন। তিনি ১৯৪৭-এ দেশভাগের সময় পাকিস্তানকেই নিজ বাসভূমি মেনে নিয়েছেন। চারপাশের অন্য হিন্দুদের বলেছেন, এটাই আমাদের দেশ। এখানেই আমাদের পূর্বপুরুষের সবকিছু। এই জন্মভূমি ছেড়ে যাবো কোন দুঃখে? জাতপাত-ধর্ম নির্বিশেষে জনপ্রিয় সেই ঋজু মনের জনসেবক ভূ-সম্পত্তি, প্রতিপত্তি হারিয়েও পাকিস্তান ছাড়লেন না। বৃদ্ধ বয়সে বাংলাদেশ আমলে দেশ ছাড়লেন পরিবারের অন্যদের নিয়ে। বলা যায়, অনেকটা বাধ্য হয়েই। বয়োবৃদ্ধ বাবা-মা একমাত্র পুত্রকে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু হরিপদ দত্ত তো যাবেনই না। বিদায় বেলায় তাঁরা তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “সাবধানে থাকিস বাবা। ভালো থাকিস।”
হরিপদ দত্তের মানস সরোবরে ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’। রামায়ণে রাম যেমন ছোটো ভাই লক্ষণকে বলেছিলেন, “হে লক্ষণ, এমনকি এই স্বর্ণময় লঙ্কাও আমাকে আকৃষ্ট করে না। জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেয়।” এই আকুতি অনবরত প্রকাশ পেয়েছে তাঁর লেখায়, কথায় ও মিথস্ক্রিয়ায়। স্বপ্ন দেখেছেন শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন, জাতপাত, ধর্ম আর উঁচু-নিচুর ব্যবধানহীন মাতৃভূমির। সেই স্বপ্ন অনবরত ভেঙে চুরমার হয়েছে। এসবেরই প্রকাশ ঘটেছে তাঁর লেখালেখিতে।
লেখালেখির শুরু হয়েছিলো সেই স্কুলজীবন থেকেই। ঝোঁক ছিলো শিল্প-সাহিত্যের প্রতি। এমনটা প্রবাহমান থেকেছে জীবনভর। জীবিকার জন্যে অনেক পেশার ডালপালায় ভর করেছেন তিনি। শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘকাল। তবে এক জায়গায় নয়, বহু জায়গায়। উচ্চ বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও ফাজিল মাদরাসায়। ঝোঁকের বশে ডলার কামাতে উত্তর আমেরিকার দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় গিয়ে কায়িক শ্রমের জীবন চেখে দেখেছেন। কিন্তু কোনো অবস্থায়ই লেখালেখি ছাড়েননি। অনবরত লিখেছেন। এখনো লিখছেন। তাঁর ভাষায় ‘লেখাকে ভালোবেসে জীবনে বঞ্চিত হয়েছেন অনেক কিছু থেকে’।
১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘কত আঁখি জল’। ছাত্র থাকা অবস্থায়। তারপর থেকে ক্রমাগত অসংখ্য উপন্যাস, গল্পগ্রন্থ, প্রবন্ধ সাহিত্য, শিশু-কিশোর সাহিত্য যেন দুই হাতে লিখে গেছেন। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অসংখ্য বই, বহু প্রকাশনী থেকে। থামেননি একদম। তাঁর লেখার স্টাইল ও গভীরতা অনন্য মাত্রার। অন্য অনেকের চেয়েই ভিন্ন। তাঁর উপন্যাসের পটভূমি ও বিষয়বস্তু গতানুগতিক নয়। অপরূপ বর্ণনাশ্রয়ী, সুদক্ষ শব্দ কারিগরের অবাক করা বিশ্লেষণে ভরপুর। যেমনটা খুব কম লেখকের লেখায়ই দেখা মেলে।
নিঃসন্দেহে তিনি এই কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও শিশু-কিশোর সাহিত্যিক। শিশু-কিশোরদের জন্যে তাঁর লেখা ‘পাখি ও পতঙ্গরা যখন মানুষ ছিল’, ‘মায়ের কাছে ফেরা’ এককথায় অনবদ্য রচনা। উপন্যাস ‘জাতিস্মরের জন্মজন্মান্তর’, ‘চার পৃথিবীর মানুষ’, ‘মোহাজের’, ‘অন্ধকূপে জন্মোৎসব’, ‘চিম্বুক পাহাড়ের জাতক’, ‘দ্রাবিড় গ্রাম’ ইত্যাদি কালজয়ী রচনা।
প্রথম জীবনে সপরিবারে, পুরো গ্রামের আপনজনসহ বাড়ি-ভিটা থেকে উচ্ছেদ হওয়ার দুঃস্বপ্ন তাঁকে পরবর্তী জীবন জুড়ে যেন তাড়া করেছে। স্মৃতিপটে এঁটে থেকেছে। এরই প্রতিবিম্ব দেখা যায় তাঁর ‘শেকড়ছেঁড়া মানুষেরা’ উপন্যাসে। তিনি অন্যত্র লিখছেন, “আমার বাড়ি নেই, কিন্তু টিকে আছে আমার জন্ম গ্রামের অবশেষ অংশ। ওখানে আমি আজ অচেনা আগন্তুক।” আবার কোথাও নিজেকে ভেবেছেন ‘জন্ম উদ্বাস্তু’।
জীবনভর লড়াকু হরিপদ দত্তকেও একসময় হার মানতে হয়েছে। পড়ন্ত জীবন বেলায় তাঁকে মাতৃভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে হয়েছে। তাঁর অভিবাসন বিরোধী বিদ্রোহী মনকে বশ স্বীকার করতে হয়েছে জীবনের কঠিন বাস্তবতার কারণে। যেতে হয়েছে স্বজনদের আতিথেয়তায়। সীমান্তের ওপাড়ে।
নিজের জন্ম-সম্পর্ক নিয়ে অপূর্ব বর্ণনা রয়েছে তাঁর লেখায়। তিনি লিখছেন, “জাতিস্মরের চোখ দিয়ে আমি কল্পনা করতে পারি আমার জন্মগৃহ আর বিছানাকে। অন্ধকারাচ্ছন্ন সদ্য নির্মিত ছনের কাঁচা ক্ষুদ্রাকৃতি গুহাগৃহ। আলো-বাতাস অবরুদ্ধ ঘরের মেঝে সদ্য ফেলা লাল এঁটেল মাটির ফ্লোর। স্যাঁতস্যাঁতে। পাটশোলার বেড়ায় লেপে দেয়া গোবর-মাটির গন্ধ। আমার জন্মরক্ত জীর্ণ কাঁথা চুষে বাঁশের চাটাই ভেদ করে লাল মাটির ফ্লোর বেয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আমার জন্মরক্ত আর জন্মমাটিকে আলাদা করে কার সাধ্য?” কী অকাট্য বন্ধন! উল্লেখ্য, যে-সময় তাঁর জন্ম, সে-সময়টায় হিন্দু পরিবারে সন্তান প্রসব হতো তেমন অশুচি বা আঁতুড় ঘরে, যেমনটা তাঁর লেখায় উঠে এসেছে। যিনি সন্তান জন্ম দিচ্ছেন, সেই নারীকে ‘অশুচি’ গণ্য করে আলাদা ঐ-ঘরে নির্বাসিত করার এই ব্যবস্থাটি এখন আর নেই, আধুনিকতার ছোঁয়ায়।
হরিপদ দত্তের শেকড় গাড়া শীতলক্ষ্যার পাড়ের মহেশ্বরদীর পলাশের সেই খানেপুর গ্রামে, যেই গ্রাম আর আগের নৈস্বর্গিক রূপে নেই; কারখানার বিষাক্ত বাষ্পে নষ্ট পরিবেশ ও প্রতিবেশের এক ভিন্নতর জনপদ এখন। কিন্তু তাঁর স্মৃতিতে-মননে এখনো সেই অনূঢ়া প্রাকৃতিক স্বর্গ, যেখানে মানুষ আর পাখ-পাখালি, শিমুল আর পলাশ ফুলের রক্তিম রঙে নববধূর সাজে সেজে থাকে পুরোটা অঞ্চল। বিলগুলো ভরে থাকে পদ্ম আর শাপলায়। যেখানে শীতলক্ষ্যার জল মানস সরোবরের জলের মতো নির্মল। বয়ে চলে সদা কলকল রবে। দুই পাড়ের মানুষের জন্যে যে-নদীর রয়েছে অকৃপণ মাতৃস্নেহভরা অবদান। কবি বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, “শীতলক্ষ্যা তীরে গিয়েছিনু লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে। …যাব নাক সেথা আর, যদিও লক্ষ্মীপূর্ণিমা রাত ফিরিবে পুনর্বার।” এমন অভিমান করার একশো একটা কারণ থাকলেও হরিপদ দত্ত বারবার এই নদীর কথায় ফিরে এসেছেন। লিখেছেন, “আমি শীতলক্ষ্যার কাছে বারবার ফিরে যাই। এই নদীর জলেই মিশে আছে আমার হাজার বছরের পূর্বপুরুষের চিতাভস্ম।” তিনি লিখেছেন, “শীতলক্ষ্যা আমার জন্ম ঠিকানা।” একসময় একে নিয়ে লিখেছেন অনবদ্য এক উপন্যাস— ‘শীতলক্ষ্যা’।
হরিপদ দত্ত এই জনপদের গণমানুষের জাতীয় আকাঙ্ক্ষার লড়াই-সংগ্রামের জোয়ার-ভাটায় অবগাহন করেছেন। দেখেছেন, কী মহিমান্বিত চরিত্রবলে তাঁর এলাকার মানুষ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। দেখেছেন, কী উচ্চাশা নিয়ে এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন একাত্তরে। তিনি দেখেছেন, তাঁর এলাকায় একজনও রাজাকার হয়নি, মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন অনেকেই। অবশেষে তিনি এমনটাও প্রত্যক্ষ করে ভারাক্রান্ত হয়েছেন যে, মানুষের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তাঁর ভাষায়, “১৯৭১ সালে পৃথক দেশ গড়া হলো। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য তৈরি হলো না। সেভাবে দেশ গড়ে ওঠলো না। চীনে যেমন বিপ্লবের পর মানুষের মধ্যে একটা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এসেছিল, তেমনটা হলো না। ভেতর থেকে পাকিস্তানই রয়ে গেল। ধর্মের প্রশ্নে পাকিস্তান হয়েছিল, গণতন্ত্রের প্রশ্নে বাংলাদেশ হলো। কিন্তু সেই গণতন্ত্রের বাংলাদেশ হলো না।” আক্ষেপ করে বলছেন, “দেশ না, মানুষ ভাগ হয়ে গেল।” তিনি এর ব্যাখ্যায় বলছেন, “শ্রেণি-বৈষম্য, ধন-বৈষম্য, বর্ণপ্রথা আর ধর্মের দৈত্য বিভাজন তৈরি করেছে।” তিনি এ-ও দেখছেন যে, এখানকার শিল্প-সংস্কৃতি এখন ক্রমশ জড়তা আর ভীরুতায় নিমজ্জিত হচ্ছে। শিল্পীদের গ্রাস করছে এসব। জীবন ঘষে আগুন জ্বালাবার শক্তি লোপ পাচ্ছে যেন তাদের।
জীবনভর লড়াকু হরিপদ দত্তকেও একসময় হার মানতে হয়েছে। পড়ন্ত জীবন বেলায় তাঁকে মাতৃভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে হয়েছে। তাঁর অভিবাসন বিরোধী বিদ্রোহী মনকে বশ স্বীকার করতে হয়েছে জীবনের কঠিন বাস্তবতার কারণে। যেতে হয়েছে স্বজনদের আতিথেয়তায়। সীমান্তের ওপাড়ে। প্রায় এক যুগের সেই অভিবাসী জীবন কাটিয়ে এবার তিনি এসেছিলেন শেকড়ের তীব্র টানে। ফিরে গিয়েছিলেন সেই শীতলক্ষ্যার পাড়ে। লোকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, কেন ছেড়ে গেলেন? জবাবে তিনি বলেন, ছেড়েছি স্বজনদের চাপে বাধ্য হয়ে। বয়স ও স্বাস্থ্যগত সীমাবদ্ধতায়। একটি পত্রিকার সাথে সাক্ষাতকারে তিনি এ-কথাও বলেছেন যে, “লেখক হিসেবে দেশ ছাড়া আমার উচিত হয়নি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল দেশ ছেড়ে যাওয়া।”
এখন তিনি পশ্চিম বাংলায় থাকেন স্বজনদের সাথে। তিনি সেখানে নিজেকে উদ্বাস্তু মনে করেন। তাঁর মন পড়ে থাকে এখানে; মাতৃভূমিতে। তাঁর সাহিত্যিক মন পাখির মতো উড়ে বেড়ায় এর প্রান্তরে, গ্রাম-গ্রামান্তরে। তিনি বলেন, “আমার সাহিত্য সাধনা নিবেদিত আমার জন্মভূমির জন্য, জন্মের ঋণমুক্তির জন্য। আমার জন্মের দায় বাংলাদেশের, বিশ্বের অন্য কোনো দেশের জন্য নয়। তাই যা লিখেছি, যা লিখছি ও যা লিখবো, সবই বাংলাদেশের জন্য।”
ভীষণ আত্মপ্রচারবিমুখ ও একান্ত নিভৃতচারী এই সাহিত্যিকের যতোসব সৃষ্টি, সেগুলো ততোটা প্রচার পায়নি, যতোটা পাওয়া উচিত ছিলো। তাঁর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে বোদ্ধামহলে স্বীকৃতি মিলেছে বরাবরই। বাংলাদেশের প্রধান কবি, বাংলাদেশের হৃদয়ের কবি, নরসিংদীর মেঘনা পাড়ের মানুষ শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা ‘তিনজন যুবকের গর্জে ওঠা’ হরিপদ দত্তকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর সৃষ্টিকর্মের স্বীকৃতি দিয়ে। তবে সাধারণত যেভাবে তাঁর পরিচিতি ও খ্যাতি শাখা-প্রশাখা মেলার কথা ছিলো, তেমনটা যথাসময়ে হয়েছে, এই কথা বলা যাবে না। এর আরো বিস্তৃতি-লাভ উচিত ছিলো। তবে তেমনটা না হলেও জাতীয় পর্যায়ে তাঁর স্বীকৃতি মিলেছে বেশ আগেই। বাংলা একাডেমি তাঁকে পুরস্কৃত করেছে দুই দুইবার। প্রথমবার ২০০১ সালে সা’দত আলি আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার দিয়ে। পরে ২০০৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান তিনি।
হরিপদ দত্তের সাহিত্যকর্মের উপর এখন গবেষণা হচ্ছে। পিএইচডি করছেন কেউ কেউ। তরুণ প্রজন্মের কাছে আবেদন সৃষ্টি করছে তাঁর ভিন্নতর সৃজনশীল বিষয়গুলো। এর উপর ভর করে নিশ্চিন্তে বলা যায়, তাঁর সাহিত্যকর্ম কালোত্তীর্ণ হয়ে বাংলা সাহিত্যের ভুবনে বিরাজ করবে উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে। তবে তিনি তো এখনো লিখছেন। তাঁর সেইসব লেখাও ক্রমান্বয়ে যোগ হবে এই গ্যালাক্সিতে। আর এর মাঝেই অমরত্ব পাবেন মহেশ্বরদীর এই কৃতী সাহিত্যিক।
সিরাজ উদ্দিন সাথী
প্রাবন্ধিক, গবেষক