প্রিয় পাঠক, প্রত্নগবেষক ও লোকসাহিত্যিক মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠানের ভাটকবিদের নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার ফল তাঁর গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের ভাটকবি ও কবিতা’। এ-গ্রন্থ থেকে নরসিংদীর ভাটকবি দারোগ আলীকে নিয়ে এই লেখাটি প্রকাশ করা হলো। এই গ্রন্থের বিপুল পাঠ ও পরিচিতির স্বার্থে ও নরসিংদীর ঐতিহ্যপূর্ণ এক আখ্যানের সাথে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে আমাদের এ-উদ্যোগ।
“যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে, যে নদী মরুপথে/ হারালো ধারা,/ জানি হে জানি তাও/ হয় নি হারা”— প্রত্যন্ত গ্রামে নীরবে-নিভৃতে কাব্যসাধনায় আত্মমগ্ন লোককবি দারোগ আলীও হারিয়ে যাবার নয়, তিনি তাঁর অবদানের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন।
তিনি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার অন্তর্গত সাহাপুর গ্রামে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৪২৪ বঙ্গাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পিতা মুনসি রমজান আলী। পেশায় ছিলেন দলিল লিখক। দারোগ আলী ছিলেন এ-অঞ্চলের খ্যাতিমান পুঁথি রচয়িতা ও পাঠক এবং জারিগান গায়ক। তিনি তাঁর ওস্তাদ আবদুল বারিক সরকারের আন্তরিক সাহচর্যে পুঁথিপাঠ, রচনা ও জারিগান পরিবেশনায় অত্যন্ত দক্ষ হয়ে ওঠেন। তিনি চাঁদ সওদাগর, অরুণ শান্তি, স্বপন কুমার ও চম্পাকলি প্রভৃতি লোকনাট্য রচনা করেন, কিন্তু সেগুলো প্রকাশিত হয়নি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে তিনি দোভাষী পুঁথির আদলে ১৯৭২ সালে ‘বঙ্গ-বিষাদ পুঁথি’ রচনা করেন। পুঁথির নামকরণ ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে কবি লিখেছেন : “বাঙ্গালীদের চিরকাল দুঃখেতে কাটিল/ তাই সে পুস্তকের নাম বঙ্গ বিষাদ হইল।/ জিন্নার আমল হতে বাংলায় যা কিছু ঘটনা/ এ পুস্তকে কিছু কিছু করিনু বর্ণনা।”
১৩৮০ বঙ্গাব্দে (১৯৭৩) প্রকাশিত পুঁথিটির ভূমিকা লিখেছেন রায়পুরা থানার মুক্তিবাহিনির কমান্ডার মো. গয়েছ আলী। ছিয়ানব্বই পৃষ্ঠার পুঁথিটি পঁচিশটি উপশিরোনামে বিন্যস্ত ও ৩,৩৪২ পঙক্তিতে সমাপ্ত। এতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি নানা বিভেদ-বৈষম্য, শেখ মুজিবুরের পরিচয় ও ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট গঠন, আয়ুব খানের বাদশাহী ও ফলাফল, শেখ মুজিবের খেদ, শেখ মুজিবুর ও তাঁর সঙ্গীগণের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের ও তার ফলাফল, শেখ মুজিবকে উদ্ধারকল্পে বাঙ্গালীর প্রথম সংগ্রাম, শেখ মুজিব ও সঙ্গীগণ মুক্তি পায় এবং আয়ুব-মোনেমের অপসারণ, ভোটে ফেল করিয়া পাকিস্তানের চালাকি ও বাটপারি, ১৯৭১ সনে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ ঘোষণা ও পশ্চিমাদের গোপন ষড়যন্ত্র, ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে পাঞ্জাবিদের নিষ্ঠুরতা এবং বঙ্গবন্ধুর বন্দী হওয়ার বয়ান, হানাদারগণ বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী-পুত্রকে বন্দী করে নির্যাতন ও বাঙ্গালীদের উপর জুলুম অত্যাচার করে এবং মুক্তিযোদ্ধাগণ ট্রেনিং নিতে ভারতে যান, তার বিবরণ, বাঙ্গালীর মরণপণ মুক্তিযুদ্ধ, হাটুভাঙ্গার যুদ্ধ, বেলাব’র লড়াই, দুলালের কাহিনি, বিশ্বাসঘাতকতা, আজব ঘটনা, মুক্তির লড়াই কী চমৎকার, বঙ্গবন্ধু লায়লপুর কারাগারে বাংলার জন্য খেদ করে, তার বয়ান, ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ, হরিষে বিষাদ, মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন ও পাকসেনাদের আত্মসমর্পণ, রাজাকারের বিচার, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি লাভ ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তন প্রভৃতি বিষয় অতি সরল ও শ্রুতিমধুর ভাষায় বিবৃত হয়েছে।
দেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলির ক্রমাগ্রসর ধারা বর্ণনায় কবি যথেষ্ট ইতিহাস সচেতনতার স্বাক্ষর রেখেছেন। নামমাত্র লেখাপড়া জানা এক কবির পক্ষে ইতিহাসের সত্যাশ্রয়ী ঘটনার বিশ্লেষণী নৈপুণ্যে সত্যি বিস্মিত হতে হয়। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ইতোমধ্যে সহস্র গ্রন্থ রচিত হলেও প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর উপযোগী সহজবোধ্য ভাষায় লেখা ‘বঙ্গ-বিষাদ পুঁথি’টি বাংলাদেশের কোনো লোককবির একক ও বিরল ব্যতিক্রমী প্রয়াস। কবি তাঁর সংবেদনশীল হৃদয়ের গভীর অনুভূতি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শাণিত চেতনাকে ‘কালের কপোল তলে শুভ্র সমুজ্জ্বল’ করে রেখেছেন। পরিতাপের বিষয় এই যে, অদ্যাবধি সুশীল সমাজের কাছে পুঁথিটি প্রকাশের সংবাদ অজ্ঞাত, অনালোচিত ও অপাঙক্তেয় থেকে গিয়েছে। অথচ অতি সরল লোকজ ভাষায় বাংলার আবহমান ঐতিহ্যের সনাতনী ধারায় বাণীবদ্ধ এই কাব্যগ্রন্থটি এক অসামান্য সাহিত্য-কীর্তিরূপে গণ্য হতে পারতো।
প্রচলিত ধারা অনুসারে পুঁথির প্রারম্ভে প্রভুস্তুতি যুক্ত হয়। কিন্তু এ-পুঁথিটিতে দেশবন্দনাসূচক পদাবলি বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। কবি বাংলাদেশের মহিমাকীর্তনে এতো উচ্ছ্বসিত যে, তিনি লিখেছেন :
জেন্দেগী ভরিয়া কইলে তবু না হয় শেষ—
এই যে আমার সোনার বাংলা সোনার বাংলাদেশ
দেখিতে নয়ন জুড়ায় দেখতে লাগে বেশ।
ছয় ঋতু বিরাজ করে এই বাংলাদেশে শরীর জুড়ায় তার বসন্ত বাতাসে।
বসন্তে কোকিলায় ডাকে কুহু কুহু তানে
এহেন কোকিলার রব নাই কোনখানে। নদনদী যত ইতি কি বলব সে কথা
আনন্দে চালায়ে তরী যাই যথাতথা। খাদ্য লওয়াজেমায় ভরা সোনার বাংলা খানি
এক মুখে কী বলতে পারি তাহার বাখানি।
জেন্দেগী ভরিয়া কইলে তবু না হয় শেষ
এহেন সোনার পুরী আমার বাংলাদেশ।
কবি পুঁথির প্রারম্ভে সংক্ষিপ্ত হামদ, নাত ও উৎসর্গ পৃষ্ঠার পরেই ‘শেখ মজিবরের পরিচয় ও ভাষা আন্দোলন’ শীর্ষক অধ্যায়টি যুক্ত করেছেন। ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমান সংগ্রামী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার সাংবিধানিক মর্যাদা প্রদান পর্যন্ত তিনি এক নিরাপোষ সংগ্রামী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এজন্যে তাঁকে জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছে।
“বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা এবং মুক্তির দাবিতে জেলবন্দি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমদ ১৬ ফেব্রুয়ারী (১৯৫২) কারাগারে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত হন। ১৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে তারা অনশন ভঙ্গ করেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব ও ১ মার্চ মহিউদ্দিন কারাগার থেকে মুক্তি পান।”
: মাহবুবুল আলম, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ২০০১, পৃষ্ঠা ১৭
‘শেখ মজিবরের পরিচয় ও ভাষা আন্দোলন’ বিষয়ক পুঁথিটি পাঠকেরা পড়তে পারেন মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠানের ‘বাংলাদেশের ভাটকবি ও কবিতা’ গ্রন্থের ২য় খণ্ডের ২০৭ নং পৃষ্ঠা থেকে।
মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান
প্রত্ন-গবেষক ও লোকসাহিত্যিক