পৃথিবী পুড়ে যাচ্ছে, তাপমাত্রা সকল রেকর্ড ভেঙে নতুন উচ্চতায় স্থাপিত হচ্ছে। এবারের গরম হয়তো মানুষকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে তার চারপাশের প্রকৃতি নিয়ে। কিংবা হয়তো বরাবরের মতোই অন্তত আমাদের দেশের প্রবণতা অনুযায়ী সমস্ত দায়-দায়িত্ব সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। কিন্তু স্বস্তি কি আদৌ আসবে? প্রকৃতিকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে না দিলে প্রকৃতি তার যথাযথ শোধ নিবে, এর বাইরে যাওয়ার কোনো পথ মানুষের প্রজ্ঞা-প্রযুক্তি এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি। তাই নিজেদের বাঁচার স্বার্থেই প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে।
প্রতি বর্ষায় বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃক্ষ রোপিত হচ্ছে, তবু কেনো আমরা এর বিশেষ কোনো সুফল পাচ্ছি না? আমাদের বৃক্ষরোপণ পদ্ধতিই কিংবা বৃক্ষ বিষয়ক প্রাথমিক জ্ঞানের অভাবই আমাদের সুফল বঞ্চিত করছে। আমরা জানি, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার প্রাথমিক একটি উদ্যোগ হলো বৃক্ষরোপণ। আসলে কি তাই? বৃক্ষরোপণ কি আমাদের প্রকৃতিকে রক্ষা করতে পারে? পরিসংখ্যানবিদগণ হয়তো অনেক রকম পরিসংখ্যান দেবেন। যেমন, একটি দেশের ভূমির শতকরা অন্তত পঁচিশ ভাগ বনভূমি থাকা দরকার। বাংলাদেশে এর এক তৃতীয়াংশও নেই। এখন আমরা যদি সবার সম্মিলিত উদ্যোগে পঁচিশ শতাংশ বনাঞ্চল আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরে তৈরি করে ফেলতে পারি, তাহলে কি আমাদের পরিবেশ ভালো হয়ে যাবে?
আমাদের বৃক্ষরোপণ বিষয়ক ধারণায় কিছু মৌলিক গলদ আছে। তাই প্রথমত আমাদের পক্ষে পঁচিশ শতাংশ বনাঞ্চল পুনর্নির্মাণ সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, যদি আমরা পঁচিশ শতাংশ বনাঞ্চল নির্মাণ করতেও পারি, সেই বনই আমাদের মানুষ থেকে পশু বানিয়ে ছাড়বে। সুফল অনেক দূরের ব্যাপার, বনবৃদ্ধির কুফলই আমরা সামলাতে পারবো না। এর প্রধান কারণ আমরা সাদামাটাভাবে জেনেছি যে, বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা করা যায়। আমাদের দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি শ্লোগান হলো ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’। পরিতাপের বিষয় হলো, আমরা গাছ লাগিয়েই পরিবেশকে একেবারে খাদের কিনারায় নিয়ে এসেছি।
আমরা বলতে চাই, আপনারা দয়া করে গাছ লাগানো বন্ধ করুন। যদি দেশের মানুষের কল্যাণ কামনা করেন, যদি আপনার পরিবেশ নিয়ে কিছুটা মায়া-মমতা থাকে, তাহলে গাছ লাগানো বন্ধ করুন। কারণ, আপনারা গত আশির দশক থেকে এখন পর্যন্ত গাছ লাগিয়ে বাংলাদেশের পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান ও মননশীলতার যে-বিপুল পরিমাণ ক্ষতি সাধন করেছেন, তা স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে আরো অন্তত বিশ বছর লেগে যাবে। আর যদি ক্রমাগত গাছ লাগাতে থাকেন, তাহলে এই দেশটার অন্তত প্রাকৃতিক কোনো ভবিষ্যত নেই, একথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়।
আমরা গাছ লাগানোর নামে বাংলাদেশের বাস্তুসংস্থান, পরিবেশ-প্রতিবেশ, পুষ্টি, বৃক্ষ-অর্থনীতি, প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক, পাখি-পতঙ্গসহ জমির ফসল, পুকুরের মাছ, পশুখাদ্যের শৃঙ্খলা, সবকিছুতেই একটি বড়ো বিপর্যয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি। কারণ, আমরা ব্যাপকহারে লাগিয়েছি মেহগনি, ইউক্যালিপ্টাস, রেইনট্রি, একাশিয়া, শিশু ইত্যাদি। এসব গাছ আমাদের পরিবেশের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর। দ্রুত বর্ধনশীল, লাভজনক, অল্প আয়াস ও অল্প জায়গায় বেশি রোপণযোগ্য ইত্যাদি বিবিধ বিভ্রান্তিকর প্রচারণা এবং প্ররোচনায় আমরা এসব বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে আমাদের পরিবেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছি। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অতি উর্বর মাটিকে আমরা ইউক্যালিপ্টাসের মাধ্যমে মুড়িয়ে দিয়েছি। ইউক্যালিপ্টাস অতিমাত্রায় পানি শোষণকারী একটি গাছ, যেটি কোনো কোনো এলাকার মরুকরণের জন্যে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। এর পাতা, এর গঠন পাখি-পতঙ্গ, মানুষ-প্রাণিকুল কারো জন্যেই বিশেষ কিছু রাখে না আমাদের পরিবেশে। ফুল-ফল তো নেই-ই, আছে কাঠ, তা-ও আবার নিম্ন মানের। অথচ উত্তরাঞ্চল আমাদের আম-জাম-লিচুসহ সকল ফলের প্রধান যোগানদাতা। উত্তরাঞ্চলের মাটিকে অনুর্বর করে দেয়ার যে-ষড়যন্ত্র, সেটি এখনো চলমান আছে। দেশের অধিকাংশ সরকারি নার্সারিতে ব্যাপকহারে উৎপাদিত হচ্ছে এসব ক্ষতিকর গাছের চারা, যা স্বল্পমূল্যে অথবা বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে বিভিন্ন বৃক্ষরোপণ অভিযানে পরিবেশ বাঁচানোর নামে! আমাদের পরিবেশবিদগণ, পরিবেশ রক্ষাকারীগণ মহাউৎসাহে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশ ধ্বংসে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন ক্রমাগত।
উত্তরাঞ্চলকে ধ্বংস করা হচ্ছে ইউক্যালিপ্টাস রোপণের মাধ্যমে, আর মধ্যাঞ্চলে ব্যাপকভাবে রোপিত হচ্ছে রাক্ষুসে বৃক্ষ রেইনট্রি। রেইনট্রি অন্তত দশ থেকে পনেরোটি দেশীয় প্রজাতির জায়গা দখল করে সগর্বে বিস্তার করে তার ডালপালা। নিম্ন মানের কাঠসহ ক্ষতিকর পাতা ঝরানোর মাধ্যমে রেইনট্রি ক্রমাগত কমিয়ে দিচ্ছে আমাদের ফসল ও মাছের উৎপাদন। আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টি সহজেই আমরা অনুধাবন করতে পারি না। কারণ, আমরা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে অতিরিক্ত সার-কীটনাশক প্রয়োগ করে উৎপাদন ঠিক রাখছি, পাশাপাশি মাছের জন্যেও লাগছে অতিরিক্ত খাবার। পশুখাদ্য, মানুষের পুষ্টি চাহিদা আর পাখির খাবার বা বাসস্থানের বালাই নেই। সার-কীটনাশকে ফসল ও বিভিন্ন বর্জ্যে মাছ ও মুরগী পালনের মাধ্যমে নিজেদের জন্যে তৈরি করছি বিষাক্ত খাবার। আমাদের দেশে ইতোমধ্যেই ক্যান্সার প্রায় মহামারি আকার ধারণ করেছে এসব বিষাক্ত খাবারের প্রতিক্রিয়ায়। অথচ রেইনট্রির বদলে দেশীয় ফলের গাছ পুরো চিত্রটাই উল্টে দিতে পারে। কিন্তু সেটি সম্ভব হচ্ছে না, কারণ, আমরা অগ্রপশ্চাদ বিবেচনা না করেই বৃক্ষরোপণ করে পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করছি।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে মেহগনির। প্রায় প্রত্যেক সরকারি-বেসরকারি নার্সারিতে কোটি কোটি মেহগনির চারা রোপিত হবার অপেক্ষায় থাকে প্রতিবছর। যদিও এই গাছগুলো সারাদেশেই সহজলভ্য, কিন্তু অঞ্চলভেদে কোনো কোনো প্রজাতির রাজত্ব লক্ষ্য করা যায়। মেহগনির বিষাক্ত ফল ও পাতা আমাদের পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান ব্যাপকভাবে ধ্বংসের জন্যে প্রধানত দায়ী। আমরা সরলমনে বৃক্ষরোপণের উৎসাহে, পরিবেশের প্রতি ভালোবাসায় এই বৃক্ষগুলো রোপণ করলেও এসব প্রজাতির বৃক্ষ রোপণের পরামর্শদাতারা আমাদের মতোই সরলমনে এদেরকে এই উর্বর ভূমিতে পুনর্বাসিত করেনি। তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশই এসব প্রজাতি নির্বাচন। বাংলাদেশ বন বিভাগের নার্সারিগুলো সাধারণত ফলের চারা উৎপাদন করে না (স্বল্প পরিমাণে ব্যতিক্রম আছে)। বন বিভাগের জনপ্রিয় ধারণাগুলোর একটি হলো সামাজিক বনায়ন। আমাদের বক্তব্য হলো, সমাজকে বন বানিয়ে দয়া করে আমাদের পশু বানাবেন না। বন বনেই থাকুক, সমাজের বন হয়ে ওঠা আর সমাজের মানুষের পশু হয়ে ওঠার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। আমরা বৃক্ষকে যখন শুধুই টাকা উপার্জনের উৎস হিসেবে বিবেচনা করতে শিখি, তখন আমাদের মনুষ্যত্বকে ছাপিয়ে পশুত্বই জোরালো হয়ে ওঠে। বৃক্ষ কেবলি টাকার উৎস নয়, প্রকৃতি শুধুই আমাদের স্বার্থ পূরণের উপায় নয়। কিন্তু যখনই একান্ত ব্যক্তিগত বিবেচনায় একটি কাঠের গাছ লাগানো হয়, মানুষ পশুত্বের দিকে একধাপ এগিয়ে যায়। কেননা, সেখানে ঐ-ব্যক্তির স্বার্থের বাইরে সমাজে বসবাসকারী অন্য কারো জন্যে আর কিছুই থাকে না। ফলের গাছে যেমন মানুষ-পশু-পাখি সবার জন্যে অল্প পরিমাণে হলেও খাদ্য-আশ্রয়-বাসস্থানের ব্যবস্থা থাকে, কাঠের গাছের চরিত্র এর বিপরীত। মানুষকে পশু বানানোর একটি সুদূরপ্রসারী প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে সামাজিক বনায়ন এবং সর্বত্র কাঠের গাছ রোপণের মাধ্যমে।
আমাদের অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনাহীন বৃক্ষপ্রেম পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্যে প্রধানত দায়ী। সরকারি মহল থেকে এর সরাসরি উৎসাহ যোগানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষ ভালো বিবেচনায় এসব প্ররোচনায় একপ্রকার ফাঁদেই পা দিচ্ছে বলা যায়। সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে আমরা কথা বলে জেনেছি, তাদেরও বিশেষ কোনো ভাবনা নেই এসব বিষয়ে। অনেকটাই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলছে আমাদের পরিবেশ সুরক্ষার আন্দোলন। প্রতিটি বৃক্ষের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য আছে, যার সাথে সংশ্লিষ্ট বাস্তুসংস্থানের সম্পর্ককে বিবেচনায় না নিলে উপকারের বদলে সেটি ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে এর ভয়াবহ প্রভাব আমরা নানাভাবেই দেখতে পাই। প্রতিবছর ঝড়ের কবলে পড়ে হাজার হাজার পাখি মারা যাচ্ছে। কারণ, এসব বৃক্ষ পাখির আশ্রয় হিসেবে উপযোগী নয়। আমাদের সাতচল্লিশ (৪৭) শতাংশ মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। কারণ, মূল খাবারের সাথে দেশীয় ফলের যোগান পর্যাপ্ত নয়। দেশে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার বিদেশি ফল আমদানির মাধ্যমে দেশের একটি বিরাট আকারের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত পশুখাদ্যের অভাবও পূরণ করতে হচ্ছে আমদানির মাধ্যমে। নিজেদের গাছের ফল আত্মীয়-প্রতিবেশিকে দেয়ার মাধ্যমে যে-হৃদ্যতার সংস্কৃতি ছিলো, তা-ও বিলুপ্তির পথে শুধুমাত্র কাঠের গাছ রোপণের ব্যাপকতার কারণে। এভাবে মেহগনি-ইউক্যালিপ্টাস-রেইনট্রি-শিশু-একাশিয়া রোপণের মাধ্যমে শুধু পরিবেশ নয়, আমরা সারা দেশের বাস্তু-ভবিষ্যত, অর্থ-পুষ্টি, মনন-মায়া সমস্ত কিছু ধ্বংসের আয়োজনে অতি উৎসাহের সাথে অংশগ্রহণ করে চলেছি। তাই আবারো বলছি, আপনারা দয়া করে বৃক্ষরোপণ বন্ধ করুন। নিজ হাতে পরিবেশ-প্রকৃতির, মানুষের, দেশের ক্ষতি করবেন না।
দ্রাবিড় সৈকত
সহকারি অধ্যাপক, চারুকলা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়