নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী ‘হিমকবরী কেশ তৈল’

নানা কারণে নরসিংদীর যশ-খ্যাতি-সুনাম দেশব্যাপী ব্যাপ্ত। প্রাচীনকাল থেকে মসলিন, মিহি সুতি কাপড়, জামদানি, শাড়ি-লুঙ্গি, চাদর-গামছা প্রভৃতি বস্ত্র উৎপাদন ও বিপণন ক্ষেত্র হিসেবে নরসিংদী অঞ্চল খ্যাতির শীর্ষে ছিলো। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করে মৌর্য, গুপ্ত, সেন, পাল, সুলতানী ও মুঘল আমলে প্রাচীন নৌ-বন্দর উয়ারী-বটেশ্বর, বেলাব, মরজাল, পারুলিয়া, আনন্দী ও নরসিংদী বাজার ছিলো পণ্যদ্রব্য বেচাকেনা আর ক্রেতা-বিক্রেতা-ব্যবসায়ী-বণিকদের আনাগোনায় মুখরিত। ব্রিটিশ আমলের শেষদিকে উক্ত অঞ্চল ছিলো হস্তচালিত তাঁত, কুমারদের মাটির তৈজসপত্র, কৃষিপণ্যের মধ্যে নানা তরকারি, ফলমূলের মধ্যে, বিশেষ করে, অমৃতসাগর কলার একচ্ছত্র উৎপাদনস্থল। এর মধ্যে আয়ুর্বেদ পণ্য হিসেবে ‘হিমকবরী কেশ তৈল’ নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী পণ্যের পরিধি বৃদ্ধি করেছে। ব্রিটিশ আমলের শেষদিক থেকে শুরু করে আজ অবধি সারা বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে সমান জনপ্রিয় এই তৈল। মাথা ঠাণ্ডা রাখা, চুল কালো করা, খুশকি মুক্ত রাখা এবং বায়ুরোগের মহৌষধ হিসেবে ‘হিমকবরী’ বাংলার ঘরে ঘরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

জানা যায়, হিমকবরী তৈলের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মধুসূদন সাহা। তিনি সর্বত্র এম. সাহা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। একজন খ্যাতিমান আয়ুর্বেদশাস্ত্রী কবিরাজ হিসেবে সফল ফর্মুলায় তৈলটি তৈরি করে বাজারজাত করার সাথে সাথে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এতে তাঁর সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কালী কুমার হাই স্কুল থেকে এম. সাহা ১৯৩৭ সালে মেট্রিকুলেশন পাশ করে কলকাতা আয়ুর্বেদ কলেজে ভর্তি হন। অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে কবিরাজী পরীক্ষায় পাশ করে তিনি জন্মভূমি নরসিংদীতে চলে আসেন। তখন ঢাকা শহর ছিলো পূর্ববঙ্গবাসীর ভাগ্য বদলের একমাত্র অবলম্বন। সঙ্গত কারণে সবার প্রত্যাশা ছিলো, এম. সাহা ঢাকা শহরেই আয়ুর্বেদ প্রতিষ্ঠান দিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন। কিন্তু তিনি সেই প্রত্যাশা পায়ে ঠেলে নরসিংদীতে চলে আসেন এবং প্রতিষ্ঠা করেন আয়ুর্বেদ রিসার্চ সোসাইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তবে এম. সাহা তাঁর আয়ুর্বেদ ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন চর্মের ছত্রাকনাশক ক্রিম ‘পদ্ম মলম’ দিয়ে। উক্ত মলমটি এতোই কার্যকর ছিলো যে, তা দ্বিতীয়বার ব্যবহারের প্রয়োজন হতো না। খোসপাঁচড়া, দাউদ-একজিমা, ছুলি-ঘা যেকোনো রোগের অব্যর্থ ঔষধ ছিলো পদ্ম মলম।

এম. সাহার প্রতিভা ছিলো ব্যতিক্রমধর্মী। পদ্ম মলমের পাশাপাশি তিনি লেমন জাতীয় একটি কোল্ড ড্রিংকসের ফর্মুলা তৈরি করেন এবং তা উৎপাদন করে বাজারজাতও করেন। তৎসময়ে নরসিংদীর মতো একটি থানা সদরে এ-ধরনের আধুনিক পানীয়  উৎপাদন ও বাজারজাত করা ছিলো অকল্পনীয় ব্যাপার। এজন্যে তিনি কলকাতা থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করে নরসিংদীতে কারখানা নির্মাণ করেছিলেন। কোল্ড ড্রিংকসের কাঁচামাল, কেমিক্যাল প্রভৃতি কলকাতা থেকে আনা হতো। পদ্ম মলমের মতো কোল্ড ড্রিংকসটিও জনপ্রিয়তা পায়। গ্রাম-গঞ্জের মানুষের কাছে এম. সাহার কোল্ড ড্রিংকস ছিলো স্বপ্নের পানীয়। এরপর উৎপাদন শুরু করেন ‘কান্তা কেশ তৈল’ আর ‘হিমকবরী কেশ তৈল’। এম. সাহার নিজস্ব ফর্মুলা আর অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রতিটি পণ্যই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়।

এম. সাহার পিতার নাম ছিলো শশীমোহন সাহা। তিনি ছিলেন উক্ত আয়ুর্বেদ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। তাঁর অপর ভাই ছিলেন মিহির লাল সাহা, চুনি লাল সাহা ও যদু লাল সাহা। তারা সবাই কারখানা ও ব্যবসা পরিচালনা করতেন যৌথ উদ্যোগে। বর্তমানে নরসিংদীর সদর রোডস্থ প্রধান ডাকঘরের পাশে ‘হিমকবরী হাউস’ই হলো তাদের আদি বাড়ি, কারখানা ও বিক্রয় কেন্দ্র। তাদের আরেকটি বাড়ি ছিলো ডাক্তার হেমেন্দ্র সাহার মোড়স্থ মসজিদের সম্মুখে। অভিরাম মণ্ডল বাড়িটি এম. সাহার কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন।

জানা যায়, ভ্রাতৃ কলহের কারণে পাক আমলে তাদের আয়ুর্বেদ ব্যবসাটি দু’ভাগ হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠাতা এম. সাহা পদ্ম মলম, কান্তা কেশ তৈল ও লেমন কোল্ড ড্রিংকস নিজের কাছে রেখে শুধুমাত্র হিমকবরী কেশ তৈলটি তিন ভাইকে ভাগ করে দেন। কিন্তু শেষাবধি শুধুমাত্র হিমকবরী তৈলের খ্যাতিই বজায় থাকে।

এম. সাহা একজন ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিভাবান লোক হলেও তাঁর চিন্তাধারা ছিলো একটু অস্থির ধরনের। কোনো-একটা চিন্তাধারায় তিনি বেশি সময় নিবদ্ধ থাকতে পারেননি। তাছাড়া তিনি আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে সফল হলেও মার্কেটিং সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন। ফলে তাঁর উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণের ব্যর্থতার কারণে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। অপরদিকে হিমকবরী তৈলের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বিতে গিয়ে পৌঁছে। অপর তিন ভাইয়ের একটি গুণ ছিলো, তারা হিমকবরীর বদৌলতে প্রচুর অর্থ-যশ অর্জন করলেও আর দ্বিতীয় কোনো পণ্য উৎপাদনের কথা ভাবেননি। এর মধ্যে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন এম. সাহা পরিবারটি ভারতে চলে যান। যুদ্ধ শেষে অন্যরা ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার পরিকল্পনা করলেও যদু লাল সাহা নরসিংদীতে ফিরে আসেন। প্রোপ্রাইটর হিসেবে তিনি হিমকবরী কেশ তৈলের বাজার ধরে রাখেন। পরবর্তীতে তৈলের লেবেলে নিজেকে স্বত্বাধিকারী হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতা, অসাধু ব্যবসায়ীদের দাপটের মুখে তিনি ব্যবসাটা আগের মতো ধরে রাখতে পারেননি। ধর্মীয় উন্মাদনা আর সাম্প্রদায়িকতার হুঙ্কারের কারণে হতাশাগ্রস্ত যদু লাল সাহা সপরিবারে ২০০৩ সালে জোট সরকারের আমলে নীরবে-নিঃশব্দে প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে ভারতের বিরাটীতে পরবাসী হন। অবশ্য হিমকবরীর প্রতিষ্ঠাতা এম. সাহা অনেক আগেই সপরিবারে ভারতবাসী হয়েছিলেন।

এম. সাহার খ্যাতির নক্ষত্র মাটিতে পতিত হলেও তাঁর ছেলে  ডা. মাখন লাল সাহা গোল্ড মেডেল নিয়ে এমবিবিএস পাশ করে বর্তমানে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কৃতী সার্জন। তিনি ১৯৬৮ সালে সাটিরপাড়া কালী কুমার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে পাশ করেই কলকাতা প্রবাসী হয়েছিলেন। এই প্রতিভাবান হিন্দুদের দেশত্যাগ সত্যি মর্মান্তিক। এতে একদিকে এদেশে মেধাশূন্যতা দেখা দিচ্ছে, অপরদিকে আমাদের মানবিকতা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। একশ্রেণির মানুষের মানসিক, সামাজিক, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শারীরিক নিপীড়নের কারণে আরেক শ্রেণির মানুষ তার পিতৃভূমি ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

যদু লাল সাহা সপরিবারে দেশত্যাগ করার আগে হিমকবরী হাউস, বসতবাড়ি, তৈল উৎপাদনের ফর্মুলা, লাইসেন্স তথা গুডউইল সবকিছু নরসিংদীর স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ও সমাজসেবী সরোজ কুমার সাহার কাছে বিক্রি করে গেছেন। মালিকানা পরিবর্তিত হলেও ‘হিমকবরী’ এখনো উৎপাদিত হচ্ছে সীমিত পরিসরে। দিনাজপুর, রংপুর ও সিলেট অঞ্চলে বর্তমানে বাজারজাত করা হচ্ছে একসময়ের বাজার কাঁপানো এই তৈল।

কৃতজ্ঞতা
সাটিরপাড়া কালী কুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক প্রয়াত সত্যেন্দ্রনাথ মোদক


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ