রাকিবুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি ‘এখন’ টেলিভিশনের রিপোর্টার এবং ‘বাংলা ট্রিবিউন’-এর নরসিংদী জেলা প্রতিনিধি। নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেছেন। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সক্রিয়ভাবে মাঠে থেকে সংবাদ সংগ্রহের কাজ করেছেন। সেই আন্দোলন ও সাংবাদিকতা বিষয়ে তার সাথে আলাপ হয় গত ১৮ জুন ২০২৫ (বুধবার)। সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেছেন সম্পাদক সুমন ইউসুফ।
গত বছর জুলাইয়ে যে-অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হিসেবে আমরা এটিকে অভিহিত করি। নরসিংদীতে সাংবাদিক হিসেবে আপনি মাঠে তৎপর ছিলেন। আপনি কী দেখেছেন? কী জেনেছেন? নরসিংদীতে কীভাবে শুরু হলো এবং কারা ছিলো?
রাকিবুল ইসলাম : নরসিংদীতে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায় কোটা বিরোধী শিক্ষার্থীরা, যারা চাকরি প্রত্যাশী বা বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা দিচ্ছিলো। এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীন নেতাকর্মীদের বাধায় যারা যেতে পারেনি, তারাই মূলত কাজগুলো শুরু করেছিলো। শুরুর দিকে নরসিংদী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিলো বেশি। তারপর একেবারে স্কুল ও বেসরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরাও এই আন্দোলনে যোগ দেয়। যখন মোটামুটি শুরুটা হয়ে গেছে, ভালো একটা জমায়েত নিয়ে শিক্ষার্থীরা জেলখানার মোড় অবরোধ করে, তখন পুলিশ লাঠিচার্জ করে, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। তখন এই অবস্থা দেখে স্থানীয় জনতাও এখানে যোগ দিতে শুরু করে। ১৮ জুলাই যখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনির গুলিতে প্রথম তাহমিদ শহীদ হলো, তখন পুরো নরসিংদীব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো এবং আন্দোলনের তীব্রতা আরো বেড়ে গেলো। তার ঠিক পরদিনই ১৯ জুলাই বিক্ষোভকারীরা নরসিংদী জেলা কারাগারের গেট ভাঙচুর ও কারাগারে আগুন লাগিয়ে দেয়। সেদিন এই ঘটনার সময় আমি নরসিংদী পাবলিক লাইব্রেরির এখানে ছিলাম, পুলিশ সেখানে ব্যারিকেড দেয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই রাস্তা দিয়ে চলাচল নিষেধ করে দেয়, তাদেরকে এখানে আটকে দেয়া হয়। আন্দোলনকারীরা উপজেলার মোড় থেকে আবাসিক এরিয়ার ভিতর দিয়ে বিভিন্ন গলির রাস্তা দিয়ে জেলখানার মোড়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। সেদিন শিক্ষার্থীদের সাথে অনেক গার্ডিয়ানও আন্দোলনে যোগ দেয়। অনেক মেয়েরা তাদের ব্যাগের ভেতরে রুটি বেলার বেলন নিয়ে আসে। এখানে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ছিলো।
কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানার ছিলো?
রাকিবুল ইসলাম : না। রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে কোনো আন্দোলনকারী আমি দেখি নাই। তবে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত এরকম অনেককেই দেখেছি, তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলন করেছে।
১৯ জুলাই জেলখানায় হামলা করা হয়েছে। কারা হামলা করেছে বলে আপনার মনে হয়?
রাকিবুল ইসলাম : জেলখানায় যেদিন হামলা হয়েছে সেদিন আমি আমার এসাইনমেন্টের কাজে আশেপাশেই ছিলাম। এর মধ্যে খবর পেলাম জেলখানা ভাঙা হয়েছে। সেখানে আমার দুজন বন্ধু ছিলো, আমি তাদেরকে কল দেই। তারা আমাকে বলে যে, এদিকে আইসেন না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন আসা যাবে না? তারা বলে যে, অবস্থা ভয়াবহ, সাংবাদিকদের জন্যও জায়গাটা সেইফ না। পরে আমি ভেলানগর বাজারের এখানে আমার বাইক রেখে, আমার ক্যামেরাম্যানকে দাঁড় করিয়ে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি গেলাম। দেখলাম, জেলখানায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। তো অনেকের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে এখানে প্রথমে যারা হিট করেছে, তারা কেউ এখানকার স্থানীয় শিক্ষার্থী না।
তাহলে কারা করলো?
রাকিবুল ইসলাম : কারা করেছে, এটা এখনো স্পষ্ট না। তাদেরকে কেউ চিনে না, তাদের সম্পর্কে কেউ জানে না। জেলখানার সামনে আইডিকার্ড পরিহিত কোনো শিক্ষার্থী আমি দেখি নাই।
১৯ জুলাইয়ের পর থেকে একেবারে ৩-৪ আগস্ট পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য ছিলো জেলখানার মোড়। ঐ-সময় কারা সেখানে ছিলো বা কোন শ্রেণির মানুষ এই তৎপরতায় বেশি সরব ছিলো? কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পার্টির লোকজন কি ছিলো?
রাকিবুল ইসলাম : আমি একটু বিস্তারিত বলি, ১৯ জুলাই জেলখানা ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডের পরদিন সকালে আমি ও আমার আরেকজন সহকর্মী পিয়াল ভাই সেখানে গিয়ে দেখি, তখনো আগুন জ্বলতেছে। আমরা মূল গেটের সাথের দেয়াল টপকে সেখানে প্রবেশ করি। আমরা সাংবাদিক পরিচয় হাইড করে যাই। ভিতরে গিয়ে দেখি অনেক লোকজন হাঁটাহাঁটি করছে। সেখানে উপস্থিত কেউ শিক্ষার্থী ছিলো না, তারা হচ্ছে কয়েদি। অনেক কয়েদি জেলখানা ভাঙচুরের সময় পালিয়ে গেছে, যাদের সাজার বয়স কম, দুই-তিন মাস, তারা পালিয়ে যায়নি। কারণ হচ্ছে, তাদেরকে যদি নতুন করে এরেস্ট করে, তখন যদি সাজার মেয়াদ বাড়ে, এই ভয়ে। এজন্যে তারা জেলার খুঁজতেছে। তারা কী করবে, থাকবে নাকি চলে যাবে? এরকম কনফিউশানে তারা সেখানে হাঁটাচলা-ছোটাছুটি করছিলো। এই অবস্থায় জামাত-শিবির বলেন বা আওয়ামী বিরোধী যে-দলের কথাই বলেন, তাদেরকে মার্ক করার মতো কোনো নেতা বা কর্মী আমি দেখি নাই। আগস্টের ১, ২, ৩ তারিখ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সমাগম ছিলো। সেই সাথে আওয়ামী বিরোধী যেসব দল ছিলো, তাদেরও অংশগ্রহণ ছিলো।
আন্দোলন বিমুখ করতে সরকারি দলের যে-তৎপরতা ছিলো, সেখানে কারা ছিলো এবং কী রকম প্রতিরোধ তারা করেছে?
রাকিবুল ইসলাম : এখানে পুলিশ ছিলো অগ্রগামী। তারা শুরুতে ডিফেন্সিভ থাকলেও পরবর্তীতে আন্দোলনকারীদের সাথে খুব বাজে আচরণ শুরু করে, রাস্তাঘাটে এবং যেসব জায়গায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, সেসব জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে ফোন চেক করা শুরু করে। এই প্রক্রিয়ায় তাদেরকে সহযোগিতা করেছে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা, স্পেসিফিকলি যদি বলি, ছাত্রলীগের অনেক নেতারা পুলিশের সাথে থেকে এই কাজে সহযোগিতা করেছে। আমার যেটা মনে হয়, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সাথে মিলে পরামর্শ করেই পুলিশ এই তৎপরতা চালিয়েছে। আন্দোলনকারীদের ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে, পুলিশ সেখানে চুপ করে ছিলো।
এই অভ্যুত্থানে পুরো নরসিংদী জেলায় কতোজন শহীদ হয়েছেন?
রাকিবুল ইসলাম : স্পেসিফিক কোনো তথ্য নাই।
জেলা প্রশাসক ১৯ জন বলেছেন। তাদের প্রত্যেকের নাম-ঠিকানা আছে?
রাকিবুল ইসলাম : হ্যাঁ, জেলা প্রশাসকের নিকট নাম-ঠিকানাসহ পুরো তালিকা আছে। সেখানে আহতদের তিনটা গ্রেডে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এবং আহত ও নিহতের পরিবারকে প্রণোদনাও দিয়েছে।
কী পরিমাণ সাংবাদিক সেই সময় তৎপর ছিলো?
রাকিবুল ইসলাম : সাংবাদিকের কথা যদি বলি, নরসিংদীতে প্রচুর সাংবাদিক। জেলা প্রেসক্লাবের সদস্যই প্রায় ৭০ জন। এর মধ্যে ৩০-৩৫ জন এক্টিভ। তো আন্দোলন চলাকালীন আমি চার-পাঁচজনকেও মাঠে পাই নাই। আমিসহ তিন-চারজন মাঠে দৌড়াইছি। তখন পরিস্থিতি অনেক ভয়ের ছিলো, গুলি খাওয়া, আহত হওয়ার ভয় ছিলো। আবার রাজনৈতিক অনেক ব্যাপার ছিলো, শিক্ষার্থীরা অনেক সাংবাদিককে ইগনোর করছিলো, ভুয়া বলে সরিয়ে দিচ্ছিলো। আবার অনেক সাংবাদিককে দেখেছি পুলিশের ও তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের দালালি করতে। দালালি করতে বলতে, আমার কাছে একজন সাংবাদিক কিছু শিক্ষার্থীর ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, এরা কারা? মূলত ব্যাপারটা হচ্ছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনি তার কাছে এদের পরিচয় জানতে চাইছে। তো সে আমাকে বেশ কয়েকটা ছবি ফরোয়ার্ড করলো এবং তাদের বেশ কিছু তথ্য জানতে চাইলো। এর মধ্যে আমি সবাইকে চিনি না, দুয়েকজনকে চিনেছি। কিন্তু সঙ্গত কারণে আমি কোনো তথ্য দিইনি।
তিনি কোন পত্রিকার বা কোন টেলিভিশনের?
রাকিবুল ইসলাম : তিনি একটা টেলিভিশনের সংবাদকর্মী। আমি তার নাম প্রকাশ করতে পারছি না। আমার বাসা নরসিংদী সরকারি কলেজের পাশে, শিক্ষার্থীদের সাথে আমার পরিচয় আছে। সেই হিসেবে কয়েকজন সাংবাদিক আমার কাছে তাদের তথ্য জানার জন্যে বিভিন্ন সময় তাদের ছবি পাঠাতো।
তারা কি জাতীয় লেভেলের প্রমিনেন্ট সাংবাদিক? নাম বলা যাবে কি? তারা কি আপনার সিনিয়র?
রাকিবুল ইসলাম : হ্যাঁ, তারা আমার সিনিয়র এবং জাতীয় লেভেলের। আমি তাদের নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। এই সংখ্যাটা কিন্তু বেশি না, দুই-তিনজন। একটা বিষয় আমাকে খুব অবাক করেছে যে, আমরা এতো সাংবাদিক, একটা মানববন্ধন হলে বা একটা রাজনৈতিক প্রোগ্রাম হলে আমরা এতোগুলা সাংবাদিক যাই। কিন্তু আন্দোলনের সময় মাঠে এতো সাংবাদিক পাইনি, চার-পাঁচজন সাংবাদিকই মাঠে ছিলো এবং কয়েকজন ক্যামেরাম্যানকে দেখেছি।
তারা যায় নাই কেন? তারা যদি নির্ধারিত জাতীয় পত্রিকা বা মিডিয়ার কর্মী হয়ে থাকে, তাদের কি এই আন্দোলন কভার করার কথা না? কর্তৃপক্ষ কি তাদের কাছে চায় নাই?
রাকিবুল ইসলাম : কর্তৃপক্ষ চাইছে। ওই যে বললাম, কেউ হচ্ছে ক্যামেরাপার্সন বা হেল্পিং হ্যান্ড পাঠাইছে। এরকম একজন আরেকজনের কাছ থেকে একটা ফুটেজ শেয়ার নিয়েছে। মূলত আমি যেটা আশা করেছিলাম যে, আট-দশজন সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত থাকবে, ওই সময় দৌড়াদৌড়ি-গোলাগুলি পরিস্থিতিটা স্বচক্ষে দেখবে। আমি আসলে এরকম ব্যাপারটা পাই নাই।
অনেককেই তো পান নাই। যাদেরকে পেয়েছেন, তাদের নাম কি বলা যায়?
রাকিবুল ইসলাম : তখন আমি ছিলাম, আশিকুর রহমান পিয়াল (সময় টিভি), আইয়ূব ভাই (যমুনা টিভি), বাংলাভিশনের লক্ষ্মণ দা’ ছিলো, ডিবিসি নিউজের তোফায়েল আহমেদ স্বপন ভাই, ডেইলি স্টারের জাহিদুল ইসলাম ভাই ছিলেন আর মাছরাঙা টেলিভিশনের বদরুল ভাই (বর্তমানে স্টার নিউজে কর্মরত) যতোটা সম্ভব, ছিলেন। এছাড়া আর নিবেদিতপ্রাণ কাউকে খুব একটা পাই নাই। এর বাইরে যাদেরকে পেয়েছিলাম, তাদের মধ্যে আবার অনেকে দালালি করেছে।
আপনি বলছেন, তাদের মধ্যেও আবার কয়েকজন দালালি করেছে। আবার তাদের সাথে কথা বললে ব্যাপারটা এমন হবে কি না যে, আপনিও দালালি করেছেন?
রাকিবুল ইসলাম : এমন হলে আমার কিছু করার নাই। কারণ হচ্ছে, আমি আমার জায়গা থেকে কাজ করার চেষ্টা করেছি।
আপনার অফিস আপনাকে কী নির্দেশনা দিয়েছিলো?
রাকিবুল ইসলাম : অফিস আমাকে যা ঘটছে, সরাসরি সেটাই কভার করে পাঠানোর কথা বলেছে।
কোনো পক্ষে না। জাস্ট ঘটনা কী ঘটতেছে, সেটাই?
রাকিবুল ইসলাম : হ্যাঁ, কোনো পক্ষে না। যখন নেট ছিলো না, শাটডাউন চলছে। আমি টেলিভিশনে খবর দেখতে পারছি না। তখনো আমি আমার মতো করে অফিসে নিউজ পাঠাইছি। আমি জেলখানা ভাঙার নিউজের কথাটাই বলি। ওই নিউজটাও আমি দেখতে পারি নাই। কিন্তু আমি তখনো অফিসে নিউজ পাঠাইছি। অফিস আমাদেরকে অনেক সাপোর্ট দিছে, কোনো বাধা ছিলো না।
পাঁচ আগস্ট আমাদের দেশে গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে। এরপরে আমাদের বাংলাদেশ ভিন্ন একটা প্রেক্ষাপটে চলে গেছে। এই সময়টাতে সাংবাদিকতার নতুন রূপরেখা স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে তৈরি হইছে। নতুন চিন্তা, নৈতিক স্খলন এবং পুনর্জাগরণ নানান দিক দিয়েই নতুনভাবে সংগঠিত হয়েছে। পাঁচ আগস্টের পরে স্থানীয় সাংবাদিকদের অবস্থা কী?
রাকিবুল ইসলাম : পাঁচ আগস্টের পরে নরসিংদীতে মোটামুটি সবাই ট্রাই করছে। সত্যি বলতে, সবাই চেষ্টা করেছে ভালো কাজ করার। অনেকেই হাফ ছেড়ে বাঁচছে যে, আইসিটি এক্টের নানাবিধ সমস্যা ছিলো, তো এইটা থেকে অনেকে বেঁচে যাবে বা বেঁচে গেছে, এই ধরনের চিন্তা-ভাবনা করে অনেকে টুকটাক নিউজ করেছে। বাট একটা জিনিস খেয়াল করলাম, ওই যে বললাম, আন্দোলনের সময় পাঁচজনকেও পাই নাই, পাঁচ আগস্টের পরে অন্তত পঞ্চাশজন হবে যে, তারা বলতেছে, এই করছে সেই করছে। এবং বৈষম্য বিরোধী সাংবাদিক ফোরাম টাইপের প্রচার-প্রচারণাও আমি ফেসবুকে দেখলাম। এখন তারা কারা? তাদেরকে আন্দোলনের সময় তো আমি দেখি নাই। হয় তারা এমন জায়গায় ছিলো, যেখানে আমি ছিলাম না বা যেখানে আমি ছিলাম, সেখানে তারা ছিলো না। এখন মূল ঘটনাই তো ছিলো নরসিংদী জেলখানার মোড়ে। এইটা ছিলো নরসিংদীর আন্দোলনের কেন্দ্র। সেখানে তো আমি ছিলাম। তারা কই ছিলো? কোথায় থেকে সাংবাদিকতা করেছে, আমি জানি না।
আপনি যে হাফ ছেড়ে বাঁচার কথা বললেন, এখানে দুইটা দিক আছে। একটা হচ্ছে, আমি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে পারি নাই উপরের চাপের কারণে বা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে। আপনি অনেক লম্বা একটা লিস্টের ইঙ্গিত দিলেন যে, তারা পুরোনো রেজিমের দালালি করেছে। পাঁচ আগস্টের পরে ওই দালালগুলো হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। আরেকটা হচ্ছে যে, এখন আবার নতুন করে পল্টি নেয়া। কোনটা হচ্ছে?
রাকিবুল ইসলাম : না! যারা সাংবাদিকতা করতে চায়, তারা হাফ ছেড়ে বাঁচছে। এর মানে তো এই না যে, আপনি আন্দোলনের সময় থাকতে পারেন নাই, কারণ তখন অনেক ভয় ছিলো, নানাবিধ কারণ ছিলো, এখন আপনি পাঁচ আগস্টের পরে আইসা বৈষম্য বিরোধী সাংবাদিক ফোরাম করবেন। এগুলোর তো দরকার নাই। ডেইলি স্টারের সাংবাদিক জাহিদ ভাই, তিনি তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর হাতে মাইর খাইছেন, বাংলাভিশনের লক্ষ্মণ দা’রে ঘুষি দিছে, আমারে কাঠ নিয়ে মারতে আসছে, অন্য আরেকজন এসে সেই আঘাত ফিরাইছে। এই যে, এরকম ঘটনা আমাদের যাদের সাথে হইছে, আমরা তো এতো লাফালাফি করছি না। তারা কেন লাফালাফি করছে, যারা তখন ছিলো না, যাদের দেখি নাই? সুতরাং তাদের কোনো উদ্দেশ্য আছে। আগে যেরকম দালালি করেছে, হইতে পারে, এবারও দালালি বা নিজেকে জাহির করতে চাইছে।
প্রায় এক বছর হয়ে গেছে। এক বছরে অনেক কিছু প্রকাশ হয়ে যাওয়ার কথা এবং হয়েছেও। তো ওই সাংবাদিকেরা খোলস পাল্টে নতুন কারো দালালি করতেছে, এরকম?
রাকিবুল ইসলাম : হ্যাঁ, এরকমই করতেছে।
স্পষ্ট করে বলছেন?
রাকিবুল ইসলাম : হ্যাঁ, একদম। যেহেতু আমরা সাংবাদিকতা করি, আওয়ামী লীগ বলেন, বিএনপি বলেন, জামাত বলেন, যেকোনো দলের নেতাকর্মীদের সাথে আমরা বসতে পারি, কথা বলতে পারি। একটা ভালো সম্পর্ক বা হাই-হ্যালোর সম্পর্ক থাকতেই পারে। এই জায়গা থেকে বের হয়েও আমি দেখেছি, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক যাদের ছিলো, এখন তারাই আবার খোলস পাল্টে আওয়ামী বিরোধী যেসব রাজনৈতিক দল আছে, তাদের সাথে মেশার ট্রাই করছে এবং মিশে যাচ্ছে।
নরসিংদীতে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিক কয়জন আছে বা কী রকম আছে বলে আপনার মনে হয়? যেকোনো দলই আসুক, আমি আমার পক্ষ থেকে একদম নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করে যাবো, এরকম? নাকি কর্তৃপক্ষ এসব ব্যপারে চাপ দেয় না?
রাকিবুল ইসলাম : কর্তৃপক্ষ চাপ দিলে দালাল সোজা হইতে বাধ্য। যেমন ধরেন, আমি দালালি করি, তো আমার কর্তৃপক্ষ যদি বলে আমাকে স্ট্রেট কাজ করতে, সেহেতু চাকরি বাঁচাতে হলে স্ট্রেট কাজ করতে হবে। কর্তৃপক্ষ যদি চাপ দেয়, তাহলে এই সংকট অনেকটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। আর বস্তুনিষ্ঠতার যে-সংজ্ঞা, এটা একেকজন একেকভাবে দেখে। আমার কাছে মনে হয়, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা পরে আসবে, আগে আসবে হচ্ছে যে, একটা নিউজ, একটা স্টোরি বা এইটা নিয়ে একটু চিন্তা করা, নিজস্ব গবেষণা করা, এইটাই আমাদের মাঝে নাই। এই অভাবটা আমাদের সবার আছে। আপনি যেটা বলছেন যে, আমি কোনো পক্ষ নিলাম না, জাস্ট ঘটনা যা, সেটাই বললাম। এরকম সাংবাদিক নরসিংদীতে দশ-বারোজন আছে। কিন্তু তারা হয়তো কাজ করে না, আলসেমি করে, তাদের আর্থিক সঙ্কট আছে, আবার অনেকে আছে, যাদের শুধু সাংবাদিকতা করে চলে না, আশেপাশে বিজ্ঞাপন নেয়ার ট্রাই করে। এখন আমি আপনার কাছ থেকে বিজ্ঞাপন নিলে তো আপনার বিরুদ্ধে ঠাসঠাস দুয়েকটা কথা বলতে পারি না। এরকম কিছু জায়গায় একটু ছাড় দিতে হয়। তখনই প্রকৃত সাংবাদিকতা মার খায়।
এই যে এতো দলাদলি, ‘নরসিংদী প্রেস ক্লাব’ আছে, এরপর আবার আলাদা করে একটা ‘নরসিংদী জেলা প্রেস ক্লাব’ আছে, আবার এর বাইরে আপনারা নতুন নতুন নামে করছেন ‘এক্টিভ জার্নালিস্ট’। এগুলোর কারণটা কী?
রাকিবুল ইসলাম : এখানে হচ্ছে কমিউনিকেশন গ্যাপ, নিজেদের মধ্যে কমিউনিকেশন গ্যাপ থাকার ফলেই এরকমটা হচ্ছে। আর নরসিংদী প্রেস ক্লাব এবং জেলা প্রেস ক্লাব এখন একই। নরসিংদী জেলা প্রেস ক্লাবের এখন আর কোনো এক্টিভিটি নাই। আর ‘এক্টিভ জার্নালিস্ট’ যেটা আছে, এটা হচ্ছে একটা মেসেঞ্জার গ্রুপ। এইটা কোনো সংগঠন বা ফেসবুক পেইজ বা গ্রুপ না। আমরা এখানে যারা সাংবাদিকতা করি, আমাদের প্রতিটা টেলিভিশনের বা সংবাদ মাধ্যমের যেহেতু আলাদা করে এতো বেশি লোকবল বা প্রটোকল নাই, সেজন্যে আমরা পুরো জেলার খবরগুলো পাওয়ার জন্যে নিজেদের এই গ্রুপে এড করে রাখি, কোনো একটা ঘটনা ঘটলে সেটা দ্রুত জানানোর জন্যে। তারপর আমরা সেটা নিয়ে নিউজ করি বা যার যার কাজ করি।
পাঁচই আগস্টের এক বছর চলে গেছে। এখন আপনারা যারা সাংবাদিকতা করছেন, আপনারা কি সঠিক খবর পৌঁছাচ্ছেন? আপনার এবং অনেকের ভাষ্যমতেই, আগে একটা স্বৈরতান্ত্রিক চাপ ছিলো। ওই চাপটা এখন থাকার কথা না।
রাকিবুল ইসলাম : অফিস যে আমাদের চাপ দিতো, ব্যাপারটা এমন না, আমরাই একটা মেন্টাল প্রেশারে থাকতাম।
এই মেন্টাল প্রেশার কি এখন আছে?
রাকিবুল ইসলাম : না। এখন নাই। ব্যক্তিগতভাবে আমার নাই। তবে অনেকের মেন্টাল প্রেশার আছে। আমার মেন্টাল প্রেশার কেন নাই? কারণ হচ্ছে, যেহেতু আমি কারো কাছে যাই না, ব্যক্তিগতভাবে কারো সাথে আর্থিক কোনো লেনদেন করি না। সেহেতু আমার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নাই।
এখন তো দেখা যায় যে, অনেক সাংবাদিক বিএনপির দিকে ঝুঁকে গেছে, তাদের নেতৃবৃন্দের দালালি করার চেষ্টা করতেছে বা করছে। এরকম পরিস্থিতিতে সাংবাদিকতা কেমন হচ্ছে?
রাকিবুল ইসলাম : এখন আওয়ামী বিরোধী যে-শক্তিগুলো আছে, তাদের সাথে যারা হাত মেলাচ্ছে, তারা ভালো করে সাংবাদিকতা করতে পারছে না।
সাংবাদিক সত্তার বাইরেও আপনি একজন নাগরিক। একজন নাগরিক হিসেবে আপনার অনেক প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির জায়গা আছে। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পরে আসলে আমরা কী পাইছি? সামনে আরো কিছু পাওয়ার আশা আছে কি না? এই এক বছরে সংক্ষেপে আপনার এনালাইসিসটা কী?
রাকিবুল ইসলাম : আগস্টের পাঁচ তারিখ বিকেলে আমার কাছে মনে হইছে, হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে হইছে যে, খুব দ্রুত হানাহানি-সংঘাত কমে যাবে। কিন্তু যেটা প্রত্যাশা ছিলো, তার সাথে প্রাপ্তির মিল নাই। প্রত্যাশা করেছিলাম, চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক কারবারি— এগুলো থাকবে না। কিন্তু এগুলো কমে নাই। চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ এখনো হচ্ছে। কিন্তু আমরা আসলে সাধারণ মানুষ হিসেবে যেটা প্রত্যাশা করেছি সেটা পাই নাই। আমি আসলে নির্বাচন হবে, অমুক দল তমুক দল ক্ষমতায় আসবে— এগুলো বুঝি না। আমি একজন সাংবাদিক হিসেবে, মানুষ হিসেবে বুঝি যে, আমি স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করবো, খাবো-দাবো, ঘুমাবো, আমার কাজটা করবো। রাষ্ট্র আমাকে নিরাপত্তা দেবে। এটাই আমি চাই। কিন্তু এখনো সেটা পাইনি।