‘কাচারি’ শব্দটি একসময় আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত ছিলো। ‘কাচারি’ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একসময় কাচারি ছিলো অভিজাত জমিদারদের ছোটোখাটো বৈঠকখানা। জমিদার এস্টেটের যাবতীয় জমির খাজনা কাচারি বসিয়ে আদায় করা হতো। জমিদারগণ খাজনা আদায়কে জোরদার করার জন্যে মাঝে-মধ্যে কাচারিতে আসতেন। বলতে গেলে জমিদারিত্বের সময় কাচারিই ছিলো তাদের প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। জমিদারগণ বড়ো বড়ো শহরে থেকে বিলাসী জীবনযাপন করতো। আর ঐ-বিলাসিতার রসদের যোগান দেয়া হতো কাচারির মাধ্যমে লব্ধ নিরীহ প্রজা সাধারণের পরিশ্রমের রক্তমিশ্রিত অর্থ দিয়ে। কোনো কোনো এলাকায়, কোনো শৌখিন জমিদার হয়তো অট্টালিকা ও প্রাসাদোপম কিছু বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু খুব কম জমিদারই সেসব বাড়িতে থেকেছেন। সেসব বাড়ির কিছু অবশিষ্টাংশ এখনো দেখতে পাওয়া যায়, যা নিয়ে আমরা কাব্য করি, দেখতে যাই, পুলকিত হই। বাংলাদেশে এখনো অনেক নামকরা জমিদার বাড়ির ইট-সুরকির ভগ্নাংশ বিদ্যমান আছে। প্রজাহিতৈষী জমিদার একেবারেই ছিলো না, তা-ও নয়। তবে সংখায় কম।
আমার আলোচ্য বিষয় দত্তেরগাঁও কাচারি। এই কাচারিও একসময় জমিদারদের সুবিধার্থেই চালু হয়েছিলো। কবে, কখন দত্তেরগাঁও কাচারি চালু হয়েছিলো, এখন তা আর কেউ বলতে পারে না। অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে কাচারিটি সর্বশেষ খাজনা আদায় করে দিতো পুরাতন ঢাকায় বসবাসকারী জমিদার বাবু রশিক মোহন চক্রবর্তী ও বাবু মোহনী মোহন চক্রবর্তীকে। তারা ছিলেন সহোদর ভাই। সম্ভবত তাদের বাবা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে উচ্চমূল্য পরিশোধ করে বেনিয়া ইংরেজদের নিকট থেকে এ-জমিদারির পত্তন এনেছিলেন। কিন্তু তাদের ভ্রাতৃ-কলহের কারণে জমিদারি দুইভাগে ভাগ হয়ে দুইটি কাচারি সৃষ্টি করেছিলো। বড়ো কাচারি ও ছোটো কাচারি। খুব সম্ভবত, বড়ো ভাইয়ের বড়ো কাচারি এবং ছোটো ভাইয়ের ছোটো কাচারি। এখনো বড়ো কাচারি ও ছোটো কাচারি মানুষের মুখে মুখে রয়েছে।
দত্তেরগাঁও কাচারি নরসিংদীর শিবপুর উপজেলায় অবস্থিত। শিবপুর সদর হতে প্রায় ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে। দেশের অনেক কাচারিই আজ আগের অবস্থানে নেই। কিন্তু দত্তেরগাঁও কাচারিটির নামডাক অনেক বেশি। সেই জমিদার, জমিদারিত্ব ও পাইক-পেয়াদা না থাকলেও দত্তেরগাঁও কাচারি এলাকার মানুষের কাছে খুবই পরিচিত। দত্তেরগাঁও একটি বৃহত্তর গ্রাম, যার কেন্দ্রবিন্দু কাচারি। এখানে একটি ঐতিহ্যবাহী উচ্চ বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইউনিয়ন পরিষদের সুন্দর কমপ্লেক্স, দুই-তিনটি হাসপাতাল, বাজার, খেলার মাঠ, আগের পুকুর, কেন্দ্রীয় মসজিদ, ঈদগাহসহ অনেককিছু রয়েছে। তাছাড়া শিবপুর হতে পলাশ ও চরসিন্দুরগামী রাস্তার কেন্দ্রস্থলে হওয়ায় গুরুত্ব অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কাচারির দক্ষিণে বিশাল মাঠ (বন্দ) থাকায় কাচারির পরিবেশ বেশ মনোরম। এলাকার মানুষের মিলনমেলা এটি। এখানে এসে প্রত্যেকের মন আত্মতৃপ্তিতে ভরে ওঠে। গরমের দিনে শরীর জুড়ায়। গ্রামের মানুষের প্রতিদিন এই কাচারিতে না আসতে পারলে যেনো ভালোই লাগে না।
তখনকার দিনে কাচারিতে বহুমুখী কর্মকাণ্ড হতো। এখানে যাতায়ত ছিলো জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনির। লাঠিয়ালদের বড়ো বড়ো লম্বা গোঁফ থাকতো, যা দেখে সাধারণ মানুষ অতি সহজে ভয় পেতো। পাইক-পেয়াদা, নাজিম, গোমস্তার অভাব পড়তো না। এদের লালন করা হতো শুধুই সাধারণ প্রজাদের ভয় দেখানোর জন্যে, খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্যে। জমিদাররা স্থানীয়ভাবে চোর-বাটপারও পালন করতো, যাদের ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করা হতো। লাঠিয়াল বাহিনি লাঠিখেলা দেখাতো। উদেশ্য ছিলো, লাঠি খেলার অভিনব কৌশল দেখে মানুষ ভয় পেয়ে আগে আগেই যেনো খাজনাপাতি দিয়ে দেয়। চৈত্র-বৈশাখ মাসে পুণ্য নামের অনুষ্ঠান করা হতো। এ-সমস্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা নিজেদের পুণ্য হাসিল করতো। প্রজাদের গুড়, মুড়ি ও বাতাসা খাইয়ে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা হতো।
জমিদারদের জমিদারি দেখাশোনা করতো নায়েবরা। বিশেষ করে, সঠিকভাবে খাজনা আদায় করাই ছিলো নায়েবদের প্রধান কাজ। জমিদারের মনোরঞ্জন করে চলতে হতো তাদের। কোনো নায়েবের খাজনা আদায় সন্তোষজনক না হলে নিমিষেই জমিদাররা নায়েব পরিবর্তন করে ফেলতো। আবার নায়েবগণই ছিলেন জমিদারির নিম্নস্তরের প্রশাসক। তখনকার নায়েব পদটি উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ছিলো। নায়েব থেকে এ-দেশে নওয়াব উপাধি এসেছে বলেই জানা যায়। যতোটুকু জানা যায়, মুঘল আমলে এই নায়েব পদের সৃষ্টি। সেই আমলে সুবাহের প্রতিনিধি হিসেবে নায়েবগণই সবকিছুর দেখাশোনা করতেন। অনেক নায়েব ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন ছিলেন এবং জনগণ তাদের বিশ্বাসও করতেন। তারা সাধারণ প্রজাদের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হতেন। স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে প্রজা সাধারণের সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করাসহ খাজনাপাতি কমিয়ে দেয়া অথবা মওকুফের চেষ্টা করতেন। আবার এমনও নায়েব ছিলো, যারা প্রজাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করতো। যেকোনো প্রকারে খাজনা আদায় করে জমিদারদের খুশি রাখতো। জোর করে প্রজাদের গরু-ছাগলসহ অন্যান্য দ্রব্যাদি নিয়ে এসে সস্তা দামে বিক্রি করে খাজনা মিটাতো। অত্যাচার আর নির্যাতনে মানুষকে অশান্তিতে রাখতো। আমরা নাটক-সিনেমায় এখনো অত্যাচারী অনেক নায়েব দেখি। তারা কীভাবে জমিদারদের খুশি করে, তা-ও দেখি। বর্তমান সময়েও অনেক ভূমি অফিসে নায়েব রূপের পদ আছে, যাদের কীর্তি-কলাপের কথা আমরা প্রায়ই শুনি। তাদের অনেকে পুরাতন দিনের নিষ্ঠুর নায়েবদের প্রতিরূপ। সরকার সাধারণ মানুষের ভূমি রক্ষার্থে যুগোপযুগী আইন প্রণয়নের চেষ্টা করছে, যেটি খুবই আশাপ্রদ খবর। সেই সময় দত্তেরগাঁও কাচারিতে নায়েবরূপে কাজ করে অনেকেই সুপরিচিতি অর্জন করেছিলেন। তাদের অনেকের নাম এখনো মানুষের মুখে মুখে। কাচারির শেষদিকে এমন সুনাম অর্জনকারী কয়েকজন নায়েবগণের মধ্যে প্রথমেই আসে মরহুম আবদুল গফুর খানের নাম। অন্যান্য সুপরিচিত নায়েবের মধ্যে প্রয়াত রাম মোহন দত্ত, মরহুম অলফু খান, মরহুম জাফর আলী ভূঁইয়া, মরহুম আলমাছ খান, মরহুম তোফাচান, মরহুম আমীনউদ্দীন খান ও মরহুম রাইজউদ্দীন খানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৬ সালের পর জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের ফলে জমিদারসহ সবাই এসব কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েন।
দত্তেরগাঁও কাচারির ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমে অনেককিছুই বলা হয়েছে। আসলে একসময় সারাদেশে কাচারিগুলো ছিলো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমান সময়ে তা আর নেই। কিন্তু আমাদের দত্তেরগাঁও কাচারির নামডাক মনে হয় আগের চেয়েও বেশি। বড়ো কাচারির একটি পুকুর ব্যতিত এ-কাচারির স্থাপনা থেকে শুরু করে কোনোকিছুই অবশিষ্ট নেই। কিন্তু বর্তমান আধুনিক অবকাঠামোয় আমাদের কাচারি অপরূপ রূপে সজ্জিত। এই কাচারির জন্যে এলাকার সকল মানুষের মন ব্যাকুল হয়ে থাকে। কাচারির মাঠে ফুটবল খেলা নিয়ে অনেকেই স্মৃতিচারণ করেন। অনেকে খুঁজে বেড়ায় কাচারির, শৈশবের বন্ধুদের, খেলার সাথীদের অম্লমধুর স্মৃতি। বিদেশ-বিভূঁইয়ে থেকেও অনেকে স্বজনদের সাথে আলাপচারিতার ফাঁকে কাচারি প্রসঙ্গে কথা বলেন। সময়ের বিবর্তনে সবকিছুই শেষ হয়ে যায়, পরিবর্তন আসে। তবে আমাদের দত্তেরগাঁও কাচারির কথা মানুষের হৃদয় ও মন থেকে মুছে যাওয়া খুবই কঠিন হবে।
নূরুদ্দীন দরজী
সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার