চরসিন্দুর ও চরসিন্দুর হাই স্কুল

পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও শীতলক্ষ্যা বিধৌত চরসিন্দুর নরসিংদীর একটি সরস জনপদ। সুদীর্ঘকাল থেকেই এখানে রয়েছে সাহসী জনবসতি। এখানকার উর্বর মাটিতে ফলে সমৃদ্ধ ফসল। একসময় ফলতো উন্নত লাল ধান। এখনো জন্মে ধান, পাট, বেগুন, মুলা আর চরাঞ্চলে গোলা আলু, বাঙ্গি, মটরশুঁটির মতো নানা ফসল। এখানকার কলা (বড়ো সাগর কলা) হয় অনেক সুস্বাদু। এখানে রয়েছে নরসিংদী জেলার বিখ্যাত কলার হাট। পশ্চিমে শীতলক্ষ্যার গুজি ও চিংড়ি মাছের সাথে পূর্বের ব্রহ্মপুত্রের শোল, বোয়াল, শিঙ, মাগুরের স্বাদ আর উদরপূর্তিতে কেটে যেতো চরসিন্দুরের মানুষের সুখের জীবন। দুদিকে বয়ে চলা শান্ত নদীর মৃদুমন্দ বাতাসে জুড়িয়ে যায় প্রাণ। শীতলক্ষ্যার পালতোলা নৌকায় ঢেউ দিয়ে চলে যেতো বাবলা-সহ সায়েদ কোম্পানির অন্যান্য লঞ্চগুলো। বাতাসে ভেসে বেড়াতো মাঝিমাল্লার গান। গুটি গুটি, কুটকুটে আওয়াজ তুলে গরুর গাড়ি আখ বোঝাই করে ছুটে চলতো এলাকার একমাত্র দেশবন্ধু সুগার মিলে। বর্ষায় নদী তীরের পল্লীগীতি ও ভাটিয়ালি গানের সুরের প্রতিধ্বনি করে শুকনো মৌসুমে বসতো লোকগীতি ও লোকসংস্কৃতির জমজমাট আসর। কলাপট্টিতে ‘রূপবান’, ‘আলোমতি’, ‘সাগর ভাসা’র করুণ কাহিনির অভিনয় দেখে ভাসতো মানুষ চোখের জলে।

একমাত্র চরসিন্দুর হতে লঞ্চে চড়ে নরসিংদীর উত্তরাঞ্চলের মানুষকে যাতায়াত করতে হতো ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ নরসিংদীর অন্যান্য এলাকায়। আবার অনেকে যাতায়াত করতো কষ্টকর গুণটানা নৌকায়। তখন অন্য কোনো যোগাযোগের ব্যবস্থা তেমন ছিলো না। সারাদিন চলাচলের পরও রাত ১২ টায় একটি লঞ্চ ছেড়ে যেতো ঘোড়াশাল হয়ে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে। সমগ্র মনোহরদী ও শিবপুরের অধিকাংশ মানুষ তাঁদের প্রয়োজনে রাতের ঐ-লঞ্চে কেউ ঘোড়াশাল নেমে ট্রেনে ঢাকা যেতো এবং বেশিরভাগ মানুষ যেতো নারায়ণগঞ্জে। তখন বর্তমান নরসিংদী জেলাটি ছিলো নারায়ণগঞ্জ মহকুমার অধীনে। মামলা-মোকদ্দমা ও অন্যান্য কাজে চরসিন্দুর হয়ে লঞ্চেই যেতে হতো। বর্তমান চরসিন্দুর ব্রিজের খানিকটা পূর্ব-দক্ষিণ কর্নারে ছিলো লঞ্চঘাট। আজো ব্রিজের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে পূর্বদিকে তাকালে ক্ষয়িষ্ণু লঞ্চঘাটের চিহ্ন দেখা যায়। যেন স্মরণ করিয়ে দেয় হারিয়ে যাওয়া দিনের কথা।

শীতলক্ষ্যা নদীতে ছিলো প্রচুর মাছ। আশেপাশের বাজারগুলো শীতলক্ষ্যার স্বাদযুক্ত মাছে ভরে যেতো। নদী সংলগ্ন পূর্বদিকের খাড়িতে ভুলপথে অনেক মাছ এসে রাতজাগা শিকারির হাতে ধরা পড়তো। মাঝে মাঝে ধরা পড়তো গুজি মাছ। আইড় মাছকে এলাকার মানুষ গুজি মাছ বলে। নদী ও খাড়ির মধ‌্যেকার চর ছিলো খুবই নয়নাভিরাম। ঐ-চরে হেঁটে হেঁটে ভ্রমণ পিপাসুর প্রাণ জুড়িয়ে যেতো। বিভিন্ন পার্বণে, বিশেষ করে ঈদের দিনগুলোতে খুব সকালে সমগ্র এলাকার মানুষ নদীতে মহাউৎসবে গরুকে গোসল করাতো। প্রতি শুক্র ও মঙ্গলবার প্রসিদ্ধ চরসিন্দুর হাট বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের মিলনমেলায় পরিণত হতো। বাজার থেকে কে কতো বড়ো মাছ কিনতে পারবে, চলতো এমন প্রতিযোগিতা। এমনসব সাংস্কৃতিক রূপ ধারণ ও লালন করে প্রাচীনকাল থেকেই চরসিন্দুর একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত জনপদ হিসেবে গড়ে ওঠতে থাকে।

চরসিন্দুর হাই স্কুল
এলাকার শিক্ষা বিস্তারে চরসিন্দুর হাই স্কুলই ছিলো একমাত্র অবলম্বন। শিক্ষায় অনেকটা পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্যে ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বর্তমানের চরসিন্দুর হাই স্কুলটি, যেটি ২০১৮ সালে সরকারিকরণ করা হয়েছে। চরসিন্দুরের মহান ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি মৌলভী ইয়াকুব আলী মিয়ার বদান্যতায় মনোরম ও দক্ষিণমুখী সুন্দর জায়গায় ‘জর্জ ইনস্টিটিউশন’ নামে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন ছিলো ব্রিটিশ আমল। ছিলো সদ্য প্রয়াত রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাবা-দাদাদের প্রতাপ। রাণীর বাবা ছিলেন ষষ্ঠ জর্জ এবং দাদা পঞ্চম জর্জ। তাদের নামে নামকরণ হলে অধিক আনুকূল্য পাওয়া যাবে, সম্ভবত এই আশায় স্কুলটির এমন নামকরণ করা হয়েছিলো।

জর্জ ইন্সটিটিউশন নামে এভাবেই পথচলা শুরু চরসিন্দুর হাই স্কুলের। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পাক-ভারত উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ তাড়ানোর আন্দোলন শুরু হলে স্কুলের নাম পরিবর্তিত হয়ে চরসিন্দুর ইংরেজি হাই স্কুল নাম ধারণ করে। পাঠদান চলছিলো তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্তু। সকল শ্রেণির বই আসতো কলকাতা শিক্ষা বোর্ড থেকে। এই স্কুলের সর্বপ্রথম এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা কেন্দ্র ছিলো নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজ। পরবর্তীতে গাজীপুর-নরসিংদী হয়ে স্বাধীনতার পর কয়েক বছর এ-স্কুলেই এসএসসি কেন্দ্র করা হয়েছিলো।

চরসিন্দুর হাই স্কুলের রয়েছে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ’৭১-এর স্বাধীনতার জন্যে মুক্তিযুদ্ধসহ অনেক আন্দোলনের বীরত্বে গাঁথা চরসিন্দুর হাই স্কুল। ’৭১ সালে স্কুল মাঠ ছিলো মুক্তিযুদ্ধের রিক্রুটিং ক্যাম্প। এখান থেকে দলে দলে লোকজন যেতো ভারতে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ অর্জন করতে। হানাদার বিরোধী সাধারণ মানুষের সম্মুখে যুদ্ধের মহড়া হতো চরসিন্দুরে।

ব্রিটিশ আমল থেকে এখন পর্যন্ত অনেক বিখ্যাত-প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বের পদার্পণে ধন্য স্কুলটি। পদার্পণ করেছেন বাংলার বাঘ খ্যাত শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। এসেছিলেন পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন, স্বাধীনতার পর অনেকের মধ্যে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানসহ বহু গুণীজন। শেরে বাংলার সাথে কিংবদন্তি শিল্পী আব্বাস উদ্দিন ও তাঁর সহযোগী বেদার উদ্দিন আহমেদ এসে গান শুনিয়ে সকলকে দারুণ মুগ্ধ করার কথা জানা যায়। শুরু থেকে বহু জ্ঞানপ্রদীপ শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণের ছায়াতলে থেকে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী তাদের জীবনপ্রদীপ প্রোজ্জ্বলিত করেছেন। করেছেন দেশ ও দেশের মানুষের সেবা। এ-স্কুলের স্বনামধন্য প্রধান শিক্ষকগণের মধ্যে মোক্তার হোসেন খান, ইয়াকুব আলী আওরঙ্গজেব, সৈয়দ ফজলুল হক অন্যতম। প্রথমদিকের শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষকদের মধ্যে স্বর্গীয় অম্বিকাচরণ ঘোষ ও অতীন্দ্র চরণ রক্ষিতের নাম এখনো বিদ্যালয়ের নামফলকে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাছাড়া আবদুল জলিল, আবদুল আউয়াল, নাদিরুজ্জামান ও হীরালাল মণ্ডলসহ অনেকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেক সহকারি শিক্ষক বিভিন্ন যশস্বী কর্মকাণ্ডের জন্যে এখনো মানুষের মুখে মুখে জীবন্ত রূপ হয়ে ফিরে আসেন।

স্কুলের অনেক ছাত্রছাত্রী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। মাননীয় জাতীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপ, আলহাজ্ব কামরুল আশরাফ খান পোটন ও জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহন এ-স্কুলেরই কৃতী ছাত্র। স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে বিচারপতি মুনসুরুল হক, যুগ্ম-সচিব নূরুজ্জামান ভূঁইয়া, মীর মোশারফ হোসেন এবং আরো অনেকে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত।  ছাত্র ছিলেন ডা. ফজলুল করিম পাঠান ও ডা. অভিরাম চন্দ্র মণ্ডল, যারা চিকিৎসা ক্ষেত্রে এলাকায় প্রচুর অবদান রেখে কিংবদন্তী হয়ে আছেন।

সভাপতি ও সম্পাদক হিসেবে স্কুল পরিচালনার জন্যে মরহুম নূর উদ্দিন মিয়া, মফিজ উদ্দিন খান, ইয়াকুব আলী মিয়া, আবদুর রশিদ শিকদার ও নাসিরুদ্দিন শিকদার বেনু মিয়ার মতো অনেকে স্কুলটি উন্নত থেকে উন্নততর করেছেন, যার প্রতিফলন এখনো বিদ্যমান।

১৯৬৭ সালে গর্বের স্কুলটির ছাত্র ছিলাম আমি। তার আগের বছর এক দুর্বৃত্ত ছাত্রের ছুরিকাঘাতে নরসিংদী কলেজে ম্যাট্রিক পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রধান শিক্ষক মোক্তার হোসেন স্যার খুন হন। তখনকার টলটলায়মান অবস্থায় শিক্ষক ছিলেন মরহুম বেলায়েত হোসেন স্যার, হীরালাল স্যার, বজলুর রহমান স্যার, হাবিবুর রহমান খান বকুল স্যারসহ আরো অনেকে, যাদের নাম এই মুহূর্তে স্মরণে নেই। তবে খুব মনে আছে ময়মনসিংহ থেকে আসা একজন স্যারের কথা, যার আগমনে স্কুলটি দারুণভাবে প্রাণ ফিরে পায়। পরের বছর আমি এই স্কুল ছেড়ে নিজের গ্রামে নব প্রতিষ্ঠিত দত্তেরগাঁও হাই স্কুলে চলে আসি। স্বল্প সময় চরসিন্দুর স্কুলে পড়াশোনা করলেও তৎসময়ের বহু স্মৃতি অজান্তেই মনে এসে ভিড় করে। হীরালাল স্যার ও বেলায়েত স্যারের স্নেহ-আদরের কথা খুবই মনে পড়ে। তাঁদের অমৃত শিক্ষাসুধা পানে আকণ্ঠ তৃপ্ত ছিলাম। বহু আগে একদিন হীরালাল স্যারের বাড়ি গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করে কদমবুচি করেছিলাম। তিনি তখন অবসরে, বয়সে ভারাক্রান্ত। যতটুকু জানি, ছাত্রছাত্রীদের মাঝে তিনি হয়ে ওঠেছিলেন স্বর্গীয় দেবতাসম। শুনেছি, হীরালাল স্যার মৃত্যুবরণ করলে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে স্যারের মরদেহের খাটিয়ার পেছন পেছন শ্মশান পর্যন্ত ছুটেছিলো। লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিলো।

এই মহাবিশ্ব ও মহাকালের বিশালতার তুলনায় একজন মানুষের যাপিত জীবনের ব্যাপ্তি নেহায়েত নগণ্য। যারা একবার চলে যায়, কোনোদিন আর ফিরে আসে না। তারপরও অনিত্য ও নশ্বর এ-পৃথিবীতে অনেক কিছু অবিনশ্বর হয়ে থাকে মানব মনে, সৃষ্টির আহ্বানে। তেমনি হয়ে থাকবে চরসিন্দুর এবং চরসিন্দুর হাই স্কুল, এই প্রত্যাশা রেখে শেষ করছি।


নূরুদ্দীন দরজী
সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ