মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রির কথাগুলো ইদানিং অনেকের মুখে মুখে ফিরছে। সেটার সোল এজেন্ট হয়ে ওঠেছিলো আওয়ামী লীগ। এজেন্ট হওয়ার কারণ, তারা মনে করে, তারাই দেশ স্বাধীন করেছে এবং এর সকল সুফল তারাই ভোগ করবে। তবে এ-কথা ঠিক, একাত্তরে দেশ স্বাধীন হয়েছিলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। যাদের অধীনে স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন দল, মত ও গোষ্ঠীর লোকজন অংশগ্রহণ করেছিলেন। এমন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, যাদের দলীয়, সাংস্কৃতিক কিংবা গোষ্ঠীগত পরিচয় ছিলো না। আমার আত্মীয় নইমুদ্দিন ভূঁইয়া একজন কৃষক ছিলেন। তিনি স্বাধীনতার জন্যে লাঙল ফেলে রেখে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। এমন দল-গোষ্ঠীহীন লাখ লাখ নইমুদ্দিনকে আওয়ামী লীগ অস্বীকার করে এককভাবে নিজের কৃতিত্ব ফলাতে চেয়েছে।
তেমনি আওয়ামী ঘরানার বাইরে দেশের বড়ো একটা জনগোষ্ঠী নিঃস্বার্থভাবে স্বাধীনতার জন্যে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। যাদের রাজনৈতিক পরিচয় আওয়ামী লীগের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলো না। দেশের বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন অনেক দল জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো। এদের সবচেয়ে বড়ো একটা ঘাঁটি ছিলো তৎকালীন ঢাকা জেলার পূর্বাঞ্চল হিসেবে খ্যাত নরসিংদী অঞ্চলে। যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ন্যাপ (ভাসানী)-র খ্যাতিমান নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া (১৯৪৩-২০১০)। তাঁর অধীনে শত শত বামপন্থী নেতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এই বামপন্থী মুক্তিবাহিনিটি স্থানীয়ভাবে ‘মান্নান ভূঁইয়া বাহিনি’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিলো। কিন্তু প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ হিসেবে মান্নান ভূঁইয়া নিজের মুখে কখনো ‘মান্নান ভূঁইয়া বাহিনি’ কথাটি উচ্চারণ করেননি। তিনি বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের সমান কৃতিত্বের অধিকারী মনে করতেন। মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সরাসরি রাজনৈতিক সহচর ছিলেন তিনি। জীবনের বড়ো একটা অংশ কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। শিবপুর কৃষক সম্মেলন, হাতিরদিয়া বাজার হাট-হরতাল সফল করে জাতীয় রাজনীতিতে পরিচিতি লাভ করেন। মান্নান ভূঁইয়া ছাড়াও শিবপুরের আসাদুজ্জামান আসাদ ভাসানী সমর্থক ও স্থানীয় কৃষক নেতা। মান্নান-আসাদের নেতৃত্বে শিবপুর, মনোহরদী, বেলাব ও রায়পুরায় ব্যাপক কৃষক আন্দোলন চলতে থাকে। তাঁদের সভা-সম্মেলনে ভাসানী সভাপতিত্ব করে জ্বালাময়ী বক্তব্য রেখেছিলেন। এই আসাদুজ্জামান আসাদ ঊনসত্তরে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে অভ্যুত্থানকে সফলতার পথে নিয়ে গিয়েছিলেন। শহীদ আসাদের মৃত্যুর পর মূলত স্থানীয় কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মান্নান ভূঁইয়া। ২০১০ সালের ২৭ জুলাই ফুসফুসে ক্যান্সার হয়ে মৃত্যু হলে রাজনীতির একটা অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটে। ধীর-স্থির ও গম্ভীর চিন্তা-চেতনা পোষণকারী এই রাজনৈতিক নেতার মৃত্যুতে দেশের রাজনীতিতে যে-শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা এখনো পূরণ হয়নি। বিশেষ করে, নরসিংদীর শিবপুরের মানুষ তাঁর অভাব হারে হারে টের পাচ্ছেন।
শিবপুর-মনোহরদীর বিভিন্ন এলাকায় তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে অবাক হয়েছি। ছাত্র জীবন থেকেই মান্নান ভূঁইয়া প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনায় পরিপক্বতা অর্জন করেছিলেন। মাছিমপুর গ্রামে এক সাধারণ কৃষক পরিবারে ১৯৪৩ সালের ১ মার্চ জন্ম নেয়া এ-রাজনৈতিক নেতাকে জাতীয় পর্যায়ে আসতে কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা করতে হয়েছে। গ্রামের প্রাইমারি স্কুল, শিবপুর স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে নরসিংদী কলেজে পড়াশোনা করেছেন তিনি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পাশাপাশি এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। পিতা আবদুল হাই ভূঁইয়া আপাদমস্তক একজন কৃষক ছিলেন। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও রাজনৈতিক প্রবল স্রোতে এ-পেশা ভেসে যায়। রাজনীতি তাঁর অস্থি-মজ্জায় বাসা বেঁধেছিলো। যার কারণে ছাত্র জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন।
নরসিংদী কলেজে পড়ার সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ছাত্র সংসদের সমাজ সেবা সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠক হিসেবে তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে জাতীয় রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৪-৬৫ সালে তিনি ডাকসু’র কার্যনিবার্হী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপ করতেন।
ছাত্র জীবন শেষে মান্নান ভূঁইয়া মূলত মওলানা ভাসানীর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ন্যাপে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ন্যাপের রাজনীতিতে থাকার সময় তিনি বেশিরভাগ সময় কৃষক সমিতির হয়ে গ্রামাঞ্চলের অবহেলিত কৃষকদের পক্ষে কাজ করেছেন। শিবপুর, মনোহরদী ও নরসিংদী সদরে অনেক বড়ো বড়ো কৃষক আন্দোলন করেছেন তিনি। কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বেশ কয়েক বছর তিনি বরেণ্য কৃষক নেতা জিতেন ঘোষ, হাতেম আলী খান, অন্নদা পাল ও সরদার ফজলুল করিম প্রমুখের সঙ্গে কাজ করেন।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অনেক উত্থান-পতন আর ঘাত-প্রতিঘাত থাকলেও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে। শিবপুর রণাঙ্গনকে তিনি শত্রুমুক্ত রেখেছিলেন। ভারতের কোনো সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়াই তিনি স্থানীয় এবং ঢাকার বেশকিছু বামপন্থী নেতাকর্মীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, যা ছিলো মুক্তিযুদ্ধের অনন্য নজির। নরসিংদী জেলার উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা হিসেবে খ্যাত সেই শিবপুর, বেলাব, মনোহরদী এবং রায়পুরার অংশবিশেষ ছিলো হাজার হাজার বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের বিচরণ ক্ষেত্র। কমিউনিস্ট, ন্যাপ ও সর্বহারা পার্টির নেতাকর্মীরা বেশ কিছু প্রশিক্ষণ ক্যাম্প, আশ্রয় শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রহ কেন্দ্র খুলে পুরো এলাকাটিকে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস মুক্তাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। প্রখ্যাত বামপন্থী নেতা ও লেখক হায়দার আকবর খান রনো, হায়দার আনোয়ার খান জুনো ও রাশেদ খান মেনন, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান তাঁর দলবলসহ শিবপুরের রণাঙ্গনে এসেছিলেন। একাধিক বামপন্থী নেতা সেই রণাঙ্গন নিয়ে বই কিংবা প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁরা সবাই মান্নান ভূঁইয়ার কমান্ডে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। ভারতের সাহায্য ছাড়া যে-কয়েকটি দল দেশের ভিতরে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো, তার মধ্যে মান্নান ভূঁইয়ার গ্রুপ ছিলো সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। বরিশাল পেয়ারা বাগান এলাকায় আরেকটি দল কোনো রকম সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাহায্য ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো। সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন কমরেড সিরাজ শিকদার।
‘শিবপুর মুক্তিযুদ্ধের এক সশস্ত্র ঘাঁটি’ শীর্ষক প্রবন্ধে হায়দার আনোয়ার খান জুনো বলেন, “একাত্তরের বেশ আগে থেকেই শিবপুর বামপন্থীদের একটা শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলো। মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে সেখানে জঙ্গি কৃষক সংগঠন গড়ে ওঠেছিলো। শিবপুরে বামপন্থী ছাত্র ইউনিয়নও খুব শক্তিশালী ছিলো। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে শিবপুর যথেষ্ট অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ঊনসত্তরের শহীদ আসাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায়ই শিবপুরে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন।”
পঁচিশে মার্চ পাক হানাদার বাহিনি নিরীহ মানুষের উপর হামলা চালালে মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে সে-হামলার প্রতিরোধ প্রস্তুতি নেয়া হয়। এপ্রিলের প্রথমদিকে পাঁচদোনায় ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে পাকিস্তানি মিলিটারির যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে ফেলে যাওয়া কিছু অস্ত্র এবং শিবপুর থানা লুট করে কিছু রাইফেল পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে সেসব অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়। মান্নান ভূঁইয়ার নির্দেশ পেয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার মজনু মৃধা ও হারিস মোল্লা প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পান। তদারকিতে ছিলেন ঝিনুক খান, কালা মিয়া, আবদুল আলী মৃধা, তোফাজ্জল হোসেন, মান্নান খান ও আওলাদ হোসেন প্রমুখ। শিবপুর থানা সদরে পাকিস্তানি আর্মির ক্যাম্প থাকায় বিপ্লবী মুক্তিযোদ্ধারা শিবপুর পাহাড়ি এলাকায় গোপনে সংগঠিত হয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করেন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বয়ান থেকে জানা যায়, শিবপুর, মনোহরদী, বেলাব ও রায়পুরা এলাকায় কয়েকটি দলে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো। তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় আলাদা হলেও সবাই মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন। যুদ্ধের ৯ মাস বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনির ছোটো ছোটো কিছু যুদ্ধ হয়েছিলো। তবে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধটি হয় ১৩ আগস্ট পুটিয়া বাজারে। নরসিংদীর টি এন্ড টি ভবনে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনির মূল ঘাঁটির সাথে শিবপুর এলাকার যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল ছিলো পুটিয়া ব্রিজ। মূলত এই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়ার জন্যেই পুটিয়া ব্রিজটি বিস্ফোরণে ধ্বংস করে মুক্তিযোদ্ধারা অপেক্ষা করতে থাকেন। তখনো পাক আর্মিরা সেখানে পৌঁছেনি। অনেকক্ষণ পর পাকবাহিনির বড়ো একটা দল সেখানে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে তরুণ যোদ্ধা ফজলু নিহত হন। তিনি শিবপুরের প্রথম শহীদ।
হায়দার আনোয়ার খান জুনোর লেখা ‘একাত্তরের রণাঙ্গন : শিবপুর’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেন। শিবপুরে বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সারাদেশে আলোচিত হয়েছিলো। শিবপুরে কোনো রাজাকার ছিলো না। দলমত নির্বিশেষে মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে সবাই যুদ্ধ করেছিলো। যদিও তারা অন্যান্য এলাকায়ও যুদ্ধ করেছেন। পুরো শিবপুরকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছিলো দীর্ঘ ৯ মাস পর। যুদ্ধ চলাকালীন শিবপুর এলাকায় কোনো ডাকাতি, ছিনতাই, চুরির ঘটনা ঘটেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কেউ জোরপূর্বক খাদ্য সামগ্রী ও নগদ তহবিল সংগ্রহ করেননি। ক্যাম্পগুলোতে মুক্তিযোদ্ধারা খাওয়া-দাওয়ার খুব কষ্ট করতেন। দলনেতা মান্নান ভূঁইয়া এসব কঠোর হস্তে দমন করে নিদের্শনা দিয়েছিলেন, “কোন ক্যাম্পের জন্য আলাদা ভাবে কিছু সংগ্রহ করা যাবে না। কেন্দ্রীয়ভাবে দেওয়া চাল, ডাল, তেল, নুনে চলতে হবে।” তাঁর কঠোর মনোভাবের কারণেই এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়নি। গ্রাম্য কোন্দল, মারামারিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ছোটোখাটো বিষয় মুক্তিযোদ্ধারাই মীমাংসা করতেন। বড়ো কোনো সমস্যা দেখা দিলে দলনেতা মান্নান ভূঁইয়া সমাধান করে দিতেন।
মান্নান ভূঁইয়া বাহিনির আরেকটি যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিলো চন্দনদিয়ায়। সেখানে হাবিলদার মজনু মৃধার দলের উপর পাকবাহিনি অর্তকিত হামলা চালায়। এই হামলায় মজনু মৃধা, আব্দুল আলী মৃধা, আমজাদ হোসেন, মানিক মিয়া, ইদ্রিস আলী, নজরুল ইসলামসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা হামলা মোকাবেলা করতে থাকেন। সেখানে বিভিন্ন পর্যায়ে তীব্র যুদ্ধ হয়। এতে পাকিস্তানি বাহিনির ৭ জন মারা গেলেও মান্নান ভূঁইয়া বাহিনির অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। মানিক ও ইদ্রিস শহীদ হন। আমজাদের পায়ে গুলি লাগে। নজরুল রাইফেলসহ পাকবাহিনির হাতে আটক হন।
মান্নান ভূঁইয়া বাহিনির এই সামান্য ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া হয়েছিলো ভরতেরকান্দি অভিযানের সময়। নরসিংদী থেকে শিবপুর ও মনোহরদীর সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা অক্ষত রাখার জন্যে সেখানকার সেতুটি পাকবাহিনি সার্বক্ষণিক পাহারা দিতো। তাই একে ধ্বংস করে হানাদার বাহিনির নির্বিঘ্ন যাতায়াত বিঘ্ন করার জন্যে মান্নান ভূঁইয়ার নির্দেশে হাবিলদার মজনু মৃধার নেতৃত্বে একটি চৌকষ দল বাছাই করা হয়। তাঁদের হাতে তুলে দেয়া হয় দুটি এলএমজি, দুটি স্টেনগান, একটি এসএমজি, কয়েকটি রাইফেল এবং কয়েকটি হ্যান্ড গ্রেনেড ও গোলাবারুদ। নির্দেশ দেয়া হয় ভরতেরকান্দি ব্রিজটি উড়িয়ে দিতে। ব্রিজটি পাকিস্তানি বাহিনির কঠোর নজরদারিতে ছিলো। দু’পাশে ছিলো বাংকার। গোয়েন্দা তথ্যে জানা যায়, ভোর ৬ টার দিকে পাহারারত পাকসেনারা বাংকার থেকে বেরিয়ে এসে হাঁটাহাঁটি করে। এই সময় বাংকারের দু’দিক থেকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করা হয়। প্রথম আক্রমণেই চারজন পাকিস্তানি ধরাশায়ী হয়। এরপর পাকিস্তানিরা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। পরে সেখানে ছয়টি মৃতদেহ পড়ে থাকে। বাংকার থেকে তিনটি চায়নিজ রাইফেল ও চার বাক্স গুলি উদ্ধার করা হয়। এরপর মান্নান বাহিনি বিস্ফোরকের সাহায্যে ব্রিজটি ধ্বংস করে দেয়।
ভরতেরকান্দি ব্রিজ ধ্বংসের অপারেশনে একটি মর্মান্তিক হৃদয়স্পর্শী ঘটনার অবতাড়না হয়। হাবিলদার মজনু মৃধা ও হায়দার আনোয়ার খান জুনো সেখান থেকে ফিরে আসার সময় একজন পাক আর্মিকে সেখানে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেন। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বাঁচার আশা না থাকলেও তাকে ধরাধরি করে পাশের একটি স্কুলঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন পাক আর্মি তাঁদের হাতে একটি পোস্টকার্ড তুলে দিয়ে বললো, “আমি জানি, আর বেশিক্ষণ বাঁচবো না। আমার একটা অনুরোধ, আমার বিবির কাছে এই পোস্টকার্ডটা পোস্ট করে দিও। আমার বিবি জানুক, আমি বেঁচে আছি।”
১২ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা নরসিংদীকে মুক্ত করেন। পরবর্তীতে টি এন্ড টি অফিসে অবস্থিত পাক আর্মির অফিসটি দখল করে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়। টি এন্ড টি অফিসের ভেতর থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। থরে থরে সাজানো রকেট লঞ্চার আর দুটি মর্টার, অনেক গোলাবারুদ আর গ্রেনেড। কিছুক্ষণ পর ভারতীয় বাহিনির হেলিকপ্টার নরসিংদীতে নামলো। অফিসারসহ ভারতীয় বাহিনির সদস্যরা টি এন্ড টি ভবনের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ তাঁদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়। শিবপুরে মান্নান ভূঁইয়া বাহিনিতে প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলো বলে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রবীণ রাশেদ খান মেনন সূত্রে জানা গেছে। তিনি এক চিঠিতে তাঁদেরকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন। চিঠির একাংশে উল্লেখ করেন, “মুক্তিযুদ্ধকালীন সর্ব সময় বর্তমান নরসিংদী জেলার শিবপুরে আমরা প্রধান কেন্দ্রস্থল করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘাঁটি স্থাপন করি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সাথে যুুদ্ধ করে শিবপুর অঞ্চলকে যুদ্ধের নয় মাস পুরোপুরিভাবে মুক্তি রাখে।” মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে রাশেদ খান মেননসহ আরো অনেক বামপন্থী জাতীয় বীর দেশমাতৃকার টানে জীবন উৎসর্গ করার জন্যে প্রত্যয় গ্রহণ করেছিলেন।
বর্ষীয়ান বামপন্থী নেতা হায়দার আকবর খান রনো তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “২৭ মার্চ সকালে কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন, আমি, বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের গাড়িতে করে ঢাকা ত্যাগ করি। শক্তিশালী কৃষক ঘাঁটিতে পৌঁছাই। গাড়িটি চালিয়ে নিয়ে যায় বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আনোয়ার খান জুনো। উল্লেখ্য, জহির রায়হান কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি তার গাড়িটি মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহারের জন্য আমাদের দান করেন। শিবপুরে আমরা হেডকোয়ার্টার করি। একই সঙ্গে বিভিন্ন কৃষক এলাকায় সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করার নিদের্শ দেই। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির অধীনের ১৪ টি মুক্ত আধামুক্ত এলাকা বা ঘাঁটি অঞ্চল গঠিত হয়েছিল। প্রায় ৩০ হাজার সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা আমাদের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের ভেতর থেকেই। ১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৬ খণ্ডে প্রকাশিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও দলিলপত্রে এই সংখ্যাটি উল্লেখ আছে। ১৪ টি ঘাঁটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা শতাধিক।”
হায়দার আকবর রনোর স্মৃতিচারণ থেকে আরো জানা যায়, সমন্বয় কমিটির অধীনস্থ ঘাঁটিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ঘাঁটি ছিলো শিবপুর, মনোহরদী, পলাশ, রায়পুরা ও নরসিংদীর কিয়দাংশ নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ এলাকা। সেখানে আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিলো একধরনের পাল্টা প্রশাসন। শিবপুরের যুদ্ধে সরাসরি সামরিক কমান্ডার ছিলেন হাবিলদার মজনু মৃধা, হায়দার আনোয়ার খান জুনো ও মান্নান খান। মে মাসেই শিবপুরের অন্তর্ভুক্ত পুটিয়ার যুদ্ধে প্রথম শহীদ হন ১৪ বছরের কিশোর মানিক। কাজী সিরাজ এক লেখায় দাবি করেছেন, মান্নান ভূঁইয়া ছিলেন শিবপুর, মনোহরদী, বেলাব ও রায়পুরা অঞ্চলের প্রকৃত সেনাপতি। তিনি তখন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির অন্যতম নেতা। এই সংগঠনের প্রধান নেতা ছিলেন কাজী জাফর আহমেদ। অন্য কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, মোস্তফা জামাল হায়দার প্রমুখ। সেই সংগঠনের ১৪ টি ঘাঁটির মধ্যে শিবপুর ঘাঁটিটি ছিলো হেডকোয়ার্টার, যার সেনাপতি ছিলেন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। তিনি ২৫ মার্চ বিকেলে শিবপুরে জনসভা করে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়ার কণ্ঠস্বর শোনার আগেই মান্নান ভূঁইয়া শিবপুরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে যোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন। এক্ষেত্রে বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের ভরসার স্থল ছিলো শিবপুর, ভারত নয়। দেশে থেকে প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধ করার জন্যে মান্নান ভূঁইয়া সবাইকে উৎসাহিত করতেন।
তখন বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের বাইরে যুদ্ধরত বেশ কয়েকটি গ্রুপ ছিলো। তার মধ্যে আওয়ামী লীগের গ্রুপটি ছিলো বৃহৎ। তাছাড়া পাঁচদোনার ন্যাভাল সিরাজের গ্রুপটি বিশেষভাবে আলোচিত ছিলো। তবে ন্যাভাল সিরাজ (বীর প্রতীক) খালেদ মোশাররফ ও মেজর হায়দার দ্বারা প্রভাবিত ছিলো বলে তিনি বামপন্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। যুদ্ধ জয়ের পর তিনি ন্যাপ (ভাসানী)-র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয় নোংরা রাজনীতির শিকার হয়ে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে নৃশংসভাবে খুন হন। শুধু ন্যাভাল সিরাজই নয়, যুদ্ধকালীন মান্নান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধেও নানা ষড়যন্ত্র ও মিথ্যা প্রচারণা হয়েছিলো। ভিন্ন মতাবলম্বী মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ রটিয়ে বেড়ায়, মান্না ভূঁইয়ার নেতৃত্বে নকশালরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা করছে। এই গুজবের কারণে মান্নান ভূঁইয়াকে হত্যারও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন কেউ কেউ। এই বিষয়ে হায়দার আনোয়ার খান জুনো তাঁর এক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “সেপ্টেম্বরের শেষের দিকেই বিএলএফ এর একটি দল শিবপুরে আসে মুক্তিবাহিনী বা এফএফ থেকে, এরা ছিল একটু ভিন্ন। মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিতেন বাঙালী সেনারা। কিন্তু বিএলএফ সদস্যরা প্রত্যক্ষভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। বিএলএফ এর ঐ দলের সঙ্গে ভারী অস্ত্রশস্ত্রও ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মান্নান ভূঁইয়াকে হত্যা করা। কিন্তু শিবপুরে এসে এবং কার্যক্রম দেখে তারা বুঝতে পারে, মান্নান ভূঁইয়াকে হত্যা করলে তারা কেউ অক্ষত অবস্থায় শিবপুর থেকে ফিরে যেতে পারবে না।”
হায়দার আনোয়ার খান জুনো ছিলেন শিবপুর মান্নান ভূঁইয়া বাহিনির সেকেন্ড ইন কমান্ড। তিনি তাঁর বইয়ে মান্নান ভূঁইয়া বাহিনির সদস্যদের একটি তালিকা দিয়েছেন এইভাবে : ন্যাভাল সিরাজ, মজনু মৃধা, মান্নান খান, ঝিনুক, আমজাদ, মিলন, ফজলু, বেনু, আফতাব, তোফাজ্জল হোসেন, তোফাজ্জল ভূঁইয়া, ইয়াসিন, ইদ্রিস, মানিক, মজিবুর রহমান, কফিল উদ্দিন, শাহ জাহান, শাহাবুদ্দিন, মিন্টু, সোলেমান, সিরাজ, হাবিবুর রহমান, সেন্ট আওলাদ, সাউদ ও ইকবাল প্রমুখ। তাঁদের সঙ্গে ঢাকার বাসিন্দা শেখ কাদের ও কুমিল্লার সন্তান কাজী গোফরানও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধকালীন সার্বক্ষণিক শিবপুরে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মান্নান ভূঁইয়া। তাঁকে অনুপ্রেরণা ও পরামর্শ দিতে সে-সময় শিবপুরে গেছেন কাজী জাফর আহমেদ রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, জহির রায়হান, মোস্তফা জামাল হায়দার, লুৎফুন্নেসা বিউটি, মাহবুবা রশিদা চপল, শাহরিয়ার আখতার বুলু শিবপুরের হেডকোয়ার্টারের অন্তর্ভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে শহীদ হন ফজলু, ইদ্রিস, মানিক মিয়ার উদ্দিন, সাদেক ও ইব্রাহিম।
স্বাধীনতার পর আবদুল মান্নান ভূঁইয়া দেশ গঠনে মন দেন। সেজন্যে তিনি প্রথমে কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা ভাবতে থাকেন। যারা মানুষের মুখে আহার যোগান, তাদের মুখেই খাদ্য জুটছে না। সঙ্গত কারণে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। কৃষক সমিতি প্রতিষ্ঠা করে এর শাখা সারা দেশে ছড়িয়ে দেন। তিনি দীর্ঘদিন মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭৭ সালের দিকে ন্যাপ ভাসানী ও কৃষক সমিতি থেকে বেরিয়ে এসে কিংবদন্তীতুল্য কৃষক-শ্রমিক নেতা কাজী জাফর আহমদের ইউপিপিতে যোগদান করেন। তবে মান্নান ভূঁইয়ার রাজনৈতিক জীবনের ইউটার্ন হয়ে থাকবে ১৯৭২ সালে শিবপুরে অনুষ্ঠিত কৃষক সম্মেলনটি। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক সক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছিলো সেই কৃষক সম্মেলনের মাধ্যমে, যা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে নরসিংদী এলাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ময়মনসিংহ এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। সম্মেলনটি সফল করার জন্যে বেশ কয়েকটি প্রস্তুতি সভা হয়, যাতে প্রতিদিন দেড়-দুই হাজার কৃষক উপস্থিত থাকতেন। ১৯৭২ সালে ২৯ ও ৩০ এপ্রিল দুইদিনব্যাপী সেই সম্মেলনে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিলো। সেখানে লাখ লাখ কৃষক উপস্থিত হয়েছিলো বলে সংবাদপত্রে লেখা হয়। ২৯ এপ্রিল মওলানা ভাসানী দীর্ঘক্ষণ বক্তব্য রেখেছিলেন, যা ‘তোমরা প্রস্তুত হও’ শিরোনামে বুকলেট হিসেবে ছাপা হয়। সেখানে ভাসানী বলেন, “বাংলার কৃষক! তোমরা প্রস্তুত হও, দুনিয়ার নিপীড়িত মানুষ, দুনিয়ার মজলুম মানুষ, দুনিয়ার নির্যাতিত মানুষ, শোষিত মানুষকে তোমরা মুক্ত কর। আমরা মুক্ত করবোই করব। শুধু বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য আমরা কৃষক সমিতি গঠন করিনি। শুধু বাংলাদেশের কৃষকদের মুক্তির জন্য কৃষক সমিতি গঠিত হয়নি। শুধু বাংলার মানুষের জন্য বাংলার কৃষক সমিতি গঠন করা হয়নি। দুনিয়ার কৃষক, দুনিয়ার মজলুম মানুষের জন্য বাংলার কৃষক সমিতি গঠন করা হয়েছে।”

৩০ এপ্রিল ঐতিহাসিক কৃষক সম্মেলনে লাখ লাখ কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের উদ্দেশ্যে মওলানা ভাসানী বলেন, “আজ আমাদের সর্বপ্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে, মা বোনের ইজ্জত দিয়ে যে স্বাধীনতা আপনারা অর্জন করেছেন, সে স্বাধীনতা ঠিকভাবে রক্ষার জন্য গোটা বাংলাদেশের মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-যুবক, কামার-কুমার, জেলে-তাতী, পিয়ন, আর্দালী সর্বস্তরের নিপীড়িত মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়াজ তুলুন, আগামী ১৬ মে তারিখে আওয়ামী লীগ সরকার যে শাসনতন্ত্র আপনাদের সামনে পেশ করবে, আপনাদের জন্য তৈরি করে পাঠাবে, এই সভা থেকে আমি জানিয়ে দিচ্ছি, শেখ মুজিবুর রহমান, গণতন্ত্রের নিয়মে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, যারা সংখ্যায় বেশি, তারাই দেশ শাসন করবে, তারাই দেশ পরিচালনা করবে। এই দেশের কৃষক-মজুরের সংখ্যা শতকরা ৯৫ ভাগ। তারাই এদেশের শাসক হতে পারে।” শিবপুরের কৃষক সম্মেলনে প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। তিনি মওলানা ভাসানীর পর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছিলেন। তাঁর বক্তব্যের একটি ছাপা বুকলেট সম্মেলনস্থলে বিতরণ করা হয়েছিলো। বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, “স্বাধীনতার অগ্রনায়ক মজলুম জনতার নির্ভীক সেনানী, কৃষকের নয়নমণি মওলানা ভাসানী নব্বই বছর বয়সেও এতো দূরে, শিবপুরে এসে আজিকার এই সম্মেলনের সভাপতির আসন গ্রহণ করে আমাদেরকে গৌরবান্বিত করে তুলেছেন। এ গৌরব শুধু আমাদের সংগঠনেরই নয়, এ গৌরব সমগ্র শিবপুরবাসীর। তিনি তাঁর সারা জীবনের অভিজ্ঞতা ও প্রখর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বর্তমান পর্যায়ের কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তারই ভিত্তিতে এই সম্মেলন রচনা করবে আগামী দিনের কাজের ধারা। বাংলাদেশের মহান নেতা মওলানা ভাসানীকে আমরা জানাই বিপ্লবী অভিনন্দন। শিবপুরবাসী তাঁকে জানায় তাদের প্রাণঢালা ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।”
আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক