Home Blog

দখল ও দূষণ কবলিত নরসিংদীর নদ-নদী

0

প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের একটা ভবিষ্যতবাণী ছিলো এমন, “বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হবে পানির সমস্যা।” অন্যদিকে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উইলিয়াম উইল কক্স তার ঐতিহাসিক বক্তৃতা ‘লেকচারস অন দি রিভার সিস্টেম অব বেঙ্গল’-এ মূলত ব্রিটিশ ভারতে নদীগুলোর গুরুত্ব এবং তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। বক্তৃতাটিতে তিনি এই অঞ্চলের নদীর ভবিষ্যত সমস্যাবলির কথা আলোচনা করেছিলেন। আসলে সভ্যতার প্রাচীন চিহ্ন বয়ে চলার পথ পরিক্রমায় নদী এক বহুমাত্রিক বিচিত্র প্রাকৃতিক সম্পদ। নদী ব্যতিত প্রাণ অচল। বয়সের দিক থেকেও বিবেচনা করলে নদী হচ্ছে মহাপ্রাচীন এক সত্তা। পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, মরুভূমি কিংবা মাটির মতোই নদী বিরাট শক্তিশালী। নদী সৃষ্টি করতে পেরেছে এমন কোনো জাতি পৃথিবীতে দেখানো যাবে না। কিন্তু নদী ধ্বংসের উদাহরণ অহরহ। আধুনিক টেকনোলজি আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড ছিলো নদী কেন্দ্রিক। নদীর অশেষ ব্যবহার মানুষের জীবনে কতোটুকু প্রভাব ফেলতো, সেটা বইপত্র ঘাটাঘাটি করলেই প্রমাণ মেলে। নদীর দর্শন মানবজাতির ইতিহাসের এক নিগূঢ় রহস্যে আবৃত। বিভিন্ন নদী-কেন্দ্রিক জাতির যে-ইতিহাস, তা মূলত মানবজাতির প্রাকৃতিক ইতিহাস। কিন্তু আধুনিক সভ্য জাতিকুল নদীকে শাসন করছে, দূষণ করছে এবং ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠছে। ফলে ভবিষ্যত প্রজন্মকে ঠেলে দিচ্ছে অবিরাম ধ্বংসের দিকে। নদী এখন রাজনীতির শিকার। পুঁজিবাদের লক্ষ্যবস্তু দেশের নদীগুলোর চেহারা এখন রুগণপ্রায়। মানবজাতির অস্তিত্বের নির্মাতা এসব নদ-নদী এখন মানুষের কাছে পরিত্যাজ্য। দুর্গন্ধ আর দূষণে নদীগুলোর দেহ থাকলেও প্রাণহীন। যে-নদী মানুষকে তার সুস্বাদু মাছ দিয়ে আমিষের চাহিদা মেটাতো, জলপথে অল্প খরচে দূর-দূরান্তে পণ্য আনা-নেয়ায় সাহায্য করতো, যে-নদী পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতো, আজ মানুষই তার বুকে ছুরি চালাচ্ছে।

নরসিংদীতে নদীর সংখ্যা
দেশে ৫৭ টি আন্তর্জাতিক নদ-নদী রয়েছে। কোনো কোনো পরিসংখ্যানে শাখা-প্রশাখাসহ বাংলাদেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৭০০ টিরও বেশি। সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী দেশে ২৩০ টি নদ-নদী আছে। শিশু একাডেমির শিশু বিশ্বকোষে বলা হয়েছে, দেশে নদ-নদী ৭০০ টি। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, নদ-নদীর সংখ্যা ৪০৫ টি। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) অনুসারে নরসিংদীতে ১১ টি নদী রয়েছে। মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা এবং আড়িয়াল খাঁর মতো নদীগুলো নরসিংদীর উপর দিয়ে বয়ে গেছে। পৃথিবীর সবখানে নদীকে কেন্দ্র করেই সভ্যতা ও সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে গড়ে ওঠেছে। নরসিংদীতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ভৌগোলিক গঠন, ভূতত্ত্ব, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ভাষা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, পৌরাণিক উপাখ্যান, ধর্মীয় তীর্থস্থান, গল্প-কাহিনি, কবিতা, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনব্যবস্থা, কৃষি ও মৎস্য পালন, ব্যবসা-বাণিজ্য, যাতায়াত, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকার এক বিশাল অনুষঙ্গ গড়ে ওঠেছে নরসিংদীর এসব নদীকে কেন্দ্র করেই। নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর তার জ্বলন্ত উদাহরণ। একসময় গ্রিসের সাথে নদীপথে এই অঞ্চলের বাণিজ্যের তথ্য মেলে হেরোডেটাসের ইতিহাসের বইয়ে। অন্যদিকে, পৃথিবীর শীর্ষ দূষিত নদীগুলোর অবস্থান এখন নদীমাতৃক বাংলাদেশেই। আর এর মধ্যে নরসিংদী অন্যতম। বিবিসির সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশের ৪৩৫ টি নদী এখন প্রকটভাবে হুমকির মুখে। ৫০-৮০ টি নদী বিপন্নতার শেষ প্রান্তে। যেখানে নরসিংদীর হাড়িধোয়া, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা এবং মেঘনার দূষণ প্রকট। আর এই দূষণ ক্রমাগত চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ শীতলক্ষ্যা আর মেঘনা ব্যতিত বাকি নদীগুলো শুকিয়ে যাবে। সেই সাথে ধ্বংস হবে বিরাট ইকোসিস্টেম এবং এর প্রভাব পড়বে জনসাধারণের উপর। দেশে নদী থেকে সৃষ্ট খালের সংখ্যাও বিশাল— ২৪ হাজার। নরসিংদীর খালগুলো হয় এখন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে অথবা শুকিয়ে যাচ্ছে। উইকিপিডিয়ার তথ্যানুসারে নরসিংদীতে মোট ১১ টি নদ-নদী রয়েছে। এর মধ্যে মূলত চারটি নদীই প্রধান। এগুলো হচ্ছে মেঘনা, শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র, আড়িয়াল খাঁ। অন্যদিকে, হাড়িধোয়া, পাহাড়িয়া, মরা ব্রহ্মপুত্র, নাগদা, সোনাখালী, কয়রা ও গঙ্গাজলী শাখা নদী। কয়রা ও গঙ্গাজলী এখন বিলুপ্তির পথে, ড্রেনের মতো অথবা কিছু কিছু জায়গায় দেখা মেলে এদের।

মোট দৈর্ঘ্য
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক প্রধান হাইড্রোলজিস্ট মো. আখতারুজ্জামান তালুকদার জানান, দেশে বর্তমানে ২০০ কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ নদী রয়েছে ১৪ টি, ১০০ থেকে ১৯৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদী রয়েছে ৪২ টি, ১০ থেকে ৯৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদী ৪৮০ টি এবং ১ থেকে ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদীর সংখ্যা ৩৭৬ টি। ১ কিলোমিটারেরও কম দৈর্ঘ্যের নদী রয়েছে ৪১ টি। সবচেয়ে বেশি নদী রয়েছে সুনামগঞ্জ জেলায়— ৯৭টি। নদ-নদীর এই তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। তালিকা তৈরিতে তথ্যের প্রধান উৎস ছিলো জেলা প্রশাসন। এছাড়া বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক ছয় খণ্ডে প্রকাশিত নদ-নদীর তালিকা সার্ভে অব বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত প্রশাসনিক ম্যাপ ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) ম্যাপ মাধ্যমিক (সেকেন্ডারি) উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয় এই গবেষণায়।

উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে মোট নৌপথের দৈর্ঘ্য ২৪,০০০ কিলোমিটার হলেও নৌপরিবহনযোগ্য নৌপথের দৈর্ঘ্য মাত্র ৫,৯৬৮ কিলোমিটার, তা-ও শুষ্ক মৌসুমে আবার সেটি কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৩,৮৬৫ কিলোমিটারে। নৌপথের সম্ভাব্য ন্যূনতম গভীরতার (Least Available Depth, LAD) উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের এই অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল গতিপথকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায় : শ্রেণি ১, শ্রেণি ২, শ্রেণি ৩ এবং শ্রেণি ৪। এদের সম্ভাব্য ন্যূনতম গভীরতা যথাক্রমে ৩.৬৬ মিটার, ২.১৩ মিটার, ১.৫২ মিটার এবং ১.৫২ মিটারের কম। এই চার ধরনের নৌপথের মধ্যে শ্রেণি ৪-এর নৌপথগুলি মূলত মৌসুমী আর বাকি নৌপথগুলি সারা বছর ধরে চালু থাকে। উপরের তথ্যসূত্রের আলোকে বলা যায়, নরসিংদীতে ১৩ থেকে ১৬৫ কিলোমিটারের নয়টি নদ-নদী রয়েছে। যেগুলো বর্ষা মৌসুমে নৌ চলাচলে সক্ষম, তার মোট দৈর্ঘ্য ৫৩৮ কিলোমিটার। আর এর মধ্যে সারা বছর নৌকা চলাচলে সক্ষম ১০০ কিলোমিটারের দৈর্ঘ্যের নদীপথ। আবার এসব নৌপথের অধিকাংশই মেঘনা, শীতলক্ষ্যা আর আড়িয়াল খাঁ নদীতে।

শিল্প কারখানা বৃদ্ধির ফলে প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। দূষিত হচ্ছে পানি। এই বিশাল পরিমাণ পানি সহজে পিউরিফাই করা সম্ভব নয়। কিন্তু নদীতে ফেলা ইন্ডাস্ট্রিয়াল বর্জ্য পদার্থের কারণে নদীর দূষণ রোধে বড়ো ভূমিকা রাখতে পারে ম্যানগ্রোভ।

কীভাবে দূষণ হচ্ছে
পৃথিবীর মাত্র ১ শতাংশ মিঠা বা স্বাদু পানি আমরা ব্যবহার করতে পারি। এই মিঠা পানির ৭০ শতাংশ ব্যবহার করা হয় কৃষিকাজে। কিন্তু নানা কারণে নদ-নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে এবং ধ্বংস হচ্ছে। ফলে পানির সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। এর মধ্যে দুটি কারণ উল্লেখযোগ্য। প্রথমত ভারতের বাঁধ, দ্বিতীয়ত দেশের শিল্প-কারখানা। ভারতের সাথে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নদীর সংখ্যা ৫৭ টি। দেশের প্রায় সবগুলো নদীই ভারত থেকে সৃষ্ট। এগুলো দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে পতিত হয়েছে। কিন্তু নব্য যুগে এসে ভারত তার অভ্যন্তরীণ চাহিদার কথা বলে উজানে বাঁধ নির্মাণ করে নদীর স্রোত ঘুরিয়ে দিচ্ছে। এতে ক্ষতির শিকার হচ্ছে ভাটির ভূমি বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যা ইচ্ছে, তাই করে যাচ্ছে ভারত। এটা নিয়ে ভারতের অনেক পরিবেশ বিজ্ঞানীও সতর্ক করেছিলো, ভারত সরকার তা কানে নেয়নি। আগে বর্ষার মৌসুমে ফসলের জমিগুলো পানিতে টইটুম্বুর করতো। সেখানে নতুন পানির সাথে জমিনে পলি জমতো। ফলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পেতো এবং ভালো ফসল ফলতো। কিন্তু এখন আর সেটা চোখে পড়ে না। অন্যদিকে আবর্জনা, রঙের পানি, কীটনাশক, অতিমাত্রায় নগরায়ন, শিল্প-অঞ্চল ইত্যাদির কারণে ও কর্তৃপক্ষের অবহেলায় দিন দিন বেড়েই চলেছে দূষণের মাত্রা। যত্রতত্র জলাশয় ভরাট করে কারখানা গড়ে তোলা হচ্ছে এবং সেই কারখানার দূষিত তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদ-নদীতে। জলাশয় ভরাটের ফলে একদিকে পরিবেশ ধ্বংসের মাধ্যমে, জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে জলাশয়গুলো ভরাটের কারণে তাপ শোষণের মাত্রা কমে এসেছে, যার দরুণ আজকাল এতো গরম লাগছে।

পানির ফরেনসিক পরীক্ষা
নরসিংদীর চারটি নদীতে ১২৯ টি তরল বর্জ্য পদার্থের প্রতিষ্ঠান থেকে রাসায়নিক বর্জ্যমিশ্রিত পানি সরাসরি নদীগুলোকে দূষিত করছে। নদীগুলো হচ্ছে মেঘনা, শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র এবং হাড়িধোয়া। এই নদীগুলোর PH (Potential Hydrogen) স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। পানির BOD (Biological Oxygen Demand) এবং COD (Chemical Oxygen Demand) অত্যন্ত উদ্বেগজনক অবস্থায় আছে। উল্লেখ্য, BOD একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। অন্যদিকে, COD একটি রাসায়নিক প্রক্রিয়া।

এবার বুড়িগঙ্গা নদীর ফরেনসিক রিপোর্টটি দেখে নেয়া যাক। “এই নদীর পানিতে অদ্রবণীয় ক্ষুদ্র কঠিন পদার্থ (টোটাল সাসপেন্ডেবল সলিডস, টিএসএস) পাওয়া গেছে ১০৮, ৫৭ ও ১৯৫। অথচ পানিতে এর আদর্শ মান ১০। বুড়িগঙ্গার শ্যামপুর এলাকার পানিতে অদ্রবণীয় ক্ষুদ্র কঠিন পদার্থ (টোটাল সাসপেন্ডেবল সলিডস, টিএসএস) পাওয়া গেছে ১০৮, ৫৭ ও ১৯৫। অথচ পানিতে এর আদর্শ মান ১০। গবেষকেরা বলছেন, এর মানে সম্পূর্ণরূপে মিশে না যাওয়া কঠিন পদার্থ নদীর পানিতে আস্তরণ তৈরি করছে, যা জলজ উদ্ভিদের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। পানিতে অক্সিজেন চাহিদার পরীক্ষায় দেখা যায়, রাসায়নিক অক্সিজেনের চাহিদা (সিওডি) ১৯০, ২২৭ ও ২৭৬। অথচ আদর্শমান হচ্ছে ৪। আর জৈবিক অক্সিজেন চাহিদা (বিওডি) ৮৭, ৭২, ও ১০৬। অথচ আদর্শ মান হিসেবে বিওডি থাকার কথা ০.২।” (সূত্র : আহমেদ দীপ্ত, প্রথম আলো)

উপরের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, নরসিংদীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদটি বুড়িগঙ্গা নদীর চেয়েও ভয়াবহ। এটা নরসিংদীর নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার। মাধবদী, শেখেরচর এবং সদরের আশপাশের এলাকায় মূলত ডাইং মিল এবং তরল বর্জ্য নিঃসরণকারী প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিদিন টনের টন রাসায়নিক বর্জ্যের পানি নদে পড়ছে। ফলে আশপাশের এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। ব্যাহত হচ্ছে জনজীবন। তাই সামগ্রিক বিষয়ের প্রেক্ষিতে অনুমান করা যায় যে, নরসিংদীর নদীগুলোর পানির কোয়ালিটি ইনডেক্স পরীক্ষা করলে এর দূষণ বুড়িগঙ্গার পানির সমপর্যায়ে হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। সরকারিভাবে জেলার নদ-নদীগুলোর পানির কোয়ালিটি ইনডেক্স পরীক্ষা করা জরুরি। তাহলেই নদ-নদীগুলো কতোটুকু রুগ্ণ, তা বেরিয়ে আসবে।

বর্জ্যপ্রবাহের উৎসসমূহ
নরসিংদী পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, নরসিংদীতে তরল বর্জ্য নিঃসরণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১২৯ টি। এর মধ্যে ETP (Effluent Treatment Plant) আছে ১১৭ টিতে। ৩ টি প্রতিষ্ঠানের কোনো ইটিপি নেই। ১ টি বন্ধ আছে এবং ৪ টি প্রতিষ্ঠানে নির্মাণাধীন। আর বাকি ৪ টির তথ্য পাওয়া যায়নি। এসব কারখানার তরল বর্জ্য সরাসরি নরসিংদীর নদীগুলোতে ফেলা হচ্ছে। মারাত্মকভাবে দূষণের শিকার নদীগুলো হচ্ছে মেঘনা, শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র এবং হাড়িধোয়া।

পত্রিকার স্থান সংকুলানের কথা বিবেচনা করে নিচে শুধু হাড়িধোয়া নদীতে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলার ফ্যাক্টরিগুলোর একটি তালিকা তুলে ধরা হলো।

১. থার্মেক্স গ্রুপ (৭ টি);
২. আবেদ টেক্সটাইল এন্ড ডাইং (৩ টি);
৩. আব্দুছ সোবান ডাইং (১ টি);
৪. শিল্পী ডাইং (১ টি);
৫. হাজী ডাইং (১ টি);
৬. রাজ্জাক ডাইং (১ টি);
৭. চৌধুরী ডাইং (১ টি);
৮. গ্রিন বাংলা ডাইং (১ টি);
৯. ক্রিয়েটিভ প্রাইম ডাইং (১ টি) এবং
১০. শায়লা ডাইং (১ টি)।

উল্লেখ্য, পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী থার্মেক্স গ্রুপের ৭ টি ফ্যাক্টরির বিপরীতে একটি সেন্ট্রাল ইটিপি, আবেদ টেক্সটাইল এন্ড ডাইংয়ের ৩ টি ফ্যাক্টরির বিপরীতে একটি সেন্ট্রাল ইটিপি এবং বাকিদের একটি করে ইটিপি রয়েছে। কিন্তু বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে সরেজমিনে গিয়ে এবং খবর নিয়ে জানা গেছে, কারোর ইটিপিই সচল নয়। এলাকাবাসীর মতে, তারা রাতের আঁধারে অথবা কোনো গোপন ড্রেনের মাধ্যমে বিষাক্ত তরল বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলছে। ফলে নদীর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। মাছ বিলুপ্তির পাশাপাশি জনজীবনেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে এই দূষণ প্রক্রিয়া। দূষিত পানির দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে অনেকে বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ দিয়েও কোনো বিচার পাচ্ছেন না। ফলে তারা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েই বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন।

নরসিংদীর প্রধান চারটি নদী দূষণ ও ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ
নরসিংদীর পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ জেলার অপরিকল্পিত কল-কারখানা। শত শত কল-কারখানা যত্রতত্র গড়ে ওঠেছে, যার ফলে নদীগুলোর এখন জীর্ণ-শীর্ণ দশা। নিচে জেলার গুরুত্বপূর্ণ চারটি নদীর দূষণ চিত্র নিয়ে আলোচনা করা হলো :

নরসিংদীর প্রাণকেন্দ্রের মধ্যদিয়ে বয়ে গেছে মৃতপ্রায় ব্রহ্মপুত্র এবং হাড়িধোয়া নদী দুটি। অন্যদিকে জেলার পূর্ব ও পশ্চিম দিক দিয়ে যথাক্রমে মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা দীর্ঘপথ অতিক্রম করেছে। নরসিংদীর এসব নদীতে একসময় শত শত নৌকা চলাচল করতো, যদিও মেঘনা ও শীতলক্ষ্যায় সেটা এখনো আছে। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র আর হাড়িধোয়া নদীতে তার দেখা মেলে না এখন আর। জেলেরা জীবিকা নির্বাহ করতো মাছ ধরে। নদীগুলো নানা প্রজাতির দেশীয় মাছে ভরপুর ছিলো একসময়। স্থানীয় আমিষের একটা বড়ো অংশ আসতো এই নদীগুলোর মাছ থেকে, যেটা বাৎসরিক জাতীয় আমিষের একটা ভালো অংশের যোগান দিতো। হাজার হাজার জেলে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো এই নদীগুলোর মাছ ধরে এবং বিক্রি করে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর যাবত নদীগুলো (প্রধানত দুটি নদী) আক্রমণের শিকার হয়েছে। প্রথমত নরসিংদীর বিভিন্ন কারখানার রঙমিশ্রিত তরল বর্জ্য নদীতে ফেলা। আর দ্বিতীয়ত নদী দখল। মূলত হাড়িধোয়া এবং ব্রহ্মপুত্র নদী দুটি এখন প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। জেলার ১২৯ টি তরল বর্জ্য নিঃসরণকারী ফ্যাক্টরি, ১২ টি অবৈধ ব্যাটারি ফ্যাক্টরি, প্রচুর মিষ্টির দোকানের রাসায়নিক বিষাক্ত বর্জ্য এবং শহরের ড্রেন দিয়ে আসা ময়লার পানি মূলত নদীগুলোকে দূষিত করছে। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি ডাইং ফ্যাক্টরি প্রতি টন ফেব্রিক ডাইংয়ের জন্যে ২০০ টন সফট ওয়াটার ব্যবহার করে। আর প্রতিটি কারখানা অন্তত দৈনিক কয়েক টন কাপড় ডাইং করে থাকে। এসব ডাইংয়ের ব্যবহৃত পানি সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। সেই হিসেবে হাড়িধোয়ার পাড়ের ১৮ টি ফ্যাক্টরি থেকে দৈনিক কমপক্ষে ফ্যাক্টরিপ্রতি সর্বনিম্ন ৫ টন কাপড় ধরলে ফ্যাক্টরিপ্রতি ১,০০০ টন তরল বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। সেই হিসেবে ১৮ টি ফ্যাক্টরি থেকে ১৮,০০০ টন রঙমিশ্রিত পানি নদীতে ফেলা হচ্ছে। তাহলে মাসে দাঁড়ায় ৫,৪০,০০০ টন। এবং এই পানি প্রবাহিত হয়ে এর মোহনা মেঘনা নদীতে গিয়ে পড়ছে। এটা নিঃসন্দেহে খুবই ভয়ঙ্কর ব্যাপার।

এবার আসা যাক আর্থিক ক্ষতির হিসাবে। নদীটির ধ্বংসকারী আঠারোটি ফ্যাক্টরির প্রতিটির বয়স গড়ে ১৫ থেকে ২০ বছর। তাহলে প্রতিটি ফ্যাক্টরি এই ১৫ থেকে ২০ বছরে আনুমানিক কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি করেছে শুধু হাড়িধোয়া অঞ্চলেই। হিসাবটি পরিবেশ, মানুষের জীবিকা, স্বাস্থ্য এবং কৃষিকে আনুষাঙ্গিক ধরে করা হয়েছে। আরেকটু পরিষ্কার করে বললে, বিশ বছর যাবত ফ্যাক্টরিগুলো যেভাবে নদী দূষণ করে আসছে, ফলে শত শত পরিবার যে-পরিমাণ হাঁস পালন করতো এবং এতে হাঁসের ডিম ও মাংস, শত শত জেলের মাছ ধরে জীবিকা, কৃষকের নদীর পানির বিকল্প হিসেবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ভূগর্ভের পানি তুলে সেচ কাজে ব্যবহার ইত্যাদি নানা বিষয় অন্তর্ভুক্ত এবং হিসাবটি ২০ বছর ধরে করতে হবে। উক্ত বছরগুলোতে এই নদীটি জাতীয় মোট কী পরিমাণ আমিষ হারিয়েছে, তা হিসাব করলে বের হয়ে আসবে। তাছাড়াও অসংখ্য মানুষ না জেনে-না বুঝে এখানে গোসল করছে। ফলে তাদের চর্মরোগসহ নানাবিধ পানিবাহিত রোগ হচ্ছে। কতো লোক শ্বাসকষ্টজনিত কারণে মারা পড়েছে কিংবা ভুগছে। ফলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে, সেই সাথে ঔষধপত্র। পানি দূষণের কারণে বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই নদীপাড়ের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা নিয়ে রাষ্ট্র কোনোদিন গবেষণা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে চোখে পড়েনি। হয়তো গবেষণা করলে বেরিয়ে আসতো, প্রতি বর্গমাইলে কী পরিমাণ মাছ থাকতো, সেই হিসেব এবং কী পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্র হারিয়েছে আর এ-যাবত কতো লোক অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ইত্যাদি।

নদী পাড়ে হাঁস পালন অর্থনীতি
নদীপাড়ের হাজার হাজার পরিবারের নারীরা হাঁস পালনের মাধ্যমে তাদের হাতখরচের যোগান দিতেন। হাঁস বিক্রি কিংবা হাঁসের ডিম বিক্রি করে সারা বছরই তারা নিজেদের স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করতেন। এটাকে ছোটো পরিসরে নদীপাড়ের অর্থনীতি বলা যেতে পারে। হাঁসের জন্যে অতিরিক্ত খাদ্যের প্রয়োজন পড়ে না। হাঁসগুলো নদী থেকে শামুক আর ছোটো মাছ খেয়ে পাকস্থলী পূর্ণ করে ঘরে ফেরে। যদি হাড়িধোয়া নদীকে ধরেই একটা আনুমানিক হিসাব করি, তাহলে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটা বের হয়ে আসবে। ৩৮ কিলোমিটার নদীটির পাড়ে হাজার হাজার পরিবারের বসবাস। তার মধ্য থেকে যদি ১,২০০ পরিবার অন্তত ৩ টি করে হাঁস পালন করে আর দৈনিক গড়ে ৩,০০০ ডিম দিলে বছরে (গড়ে ১৫ টাকা ধরে হিসেব করলে) এক কোটি চৌষট্টি লাখ পঁচিশ হাজার টাকা আসবে, যা ২০ বছরে বত্রিশ কোটি পচাশি লাখ টাকা। এখন যদি ব্রহ্মপুত্র নদের হিসাব করি, তাহলে এটি হাড়িধোয়ার তিনগুণ। তাহলে এই নদের পাড়ে হাঁসের ডিমের হিসাবটি দাঁড়ায় আটানব্বই কোটি পঞ্চান্নো লাখ টাকা। আর ১০৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের শীতলক্ষ্যাও প্রায় সাতানব্বই কোটি টাকার নদীপাড়ের ডিম অর্থনীতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ তো গেলো শুধু ডিমের হিসাব। যদি হাঁসের মাংসের হিসাব করা হয়, তাহলে প্রতিটি পরিবার বছরে গড়ে একটি করে হাঁস বিক্রি করলে এবং গড় মূল্য হাঁসপ্রতি অন্তত ৫০০ টাকা ধরে বছরে ছয় লাখ এবং বিশ বছরে এক কোটি বিশ লাখ টাকা হয়। সেই হিসেবে ব্রহ্মপুত্র তিন কোটি এবং শীতলক্ষ্যা আড়াই কোটির উপরে। তাহলে দেখা যাচ্ছে নদী দূষণের ফলে নদীপাড়ের এই অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। সেই সাথে পাড়ের জনবসতিও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

নদী দখল ও ভুলভাবে খনন
ব্রহ্মপুত্র, আড়িয়াল খাঁ, নাগদা, কলাগাছিয়া, সোনাখালী, হাড়িধোয়া ও কয়রা নদ-নদীগুলো বেহাত হয়ে যাচ্ছে। নাগদা, কয়রা ও সোনাখালীর অস্তিত্ব এখন বিভিন্ন সরকারি নথিপত্রে, বাস্তবে এর দেখা মেলা কষ্টকর। ব্রহ্মপুত্র ও হাড়িধোয়া বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল কর্তৃক দখল হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও যখন নদী খনন প্রকল্পের কাজ চলমান ছিলো, তখন এলাকার প্রভাবশালী মহল প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের দখলকৃত ভূমির পরিমাণ ঠিক রেখেছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নদীর ভূমি দখল করে প্লট বানিয়ে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী মহল। ঘটনাটি ব্রহ্মপুত্র ও হাড়িধোয়া দুই নদীর বেলায়ই দেখা গেছে। এগুলো মানুষের চোখে পড়লেও ভয়ের কারণে কেউ কোনো প্রতিবাদ করার সাহস করে না কেবল আক্রমণের শিকার হবে, এমনটা ভেবে। অন্যদিকে খনন কাজে সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো যে-ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেটা হলো নদীগুলো খনন করার সময় পাড় থেকে স্লোপ করে একটি ফুটপাতের মতো রাস্তা তৈরি করা হয়। পরে সেখান থেকে আবার কিছুটা স্লোপ করে মাটি কেটে নদীর তলদেশ সমান করা হয়। এতে নদীর প্রস্থ কমে আসে। ব্যাপারটি আরো সহজভাবে বললে, হাড়িধোয়ার ৬২ মিটার প্রস্থের নদীটি উপরের বর্ণনা অনুযায়ী খনন করার ফলে দুইপাশের প্রস্থ মিলে অর্ধেক নদী গায়েব করে ফেলা হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের উপর অসংখ্য ব্রিজকে কালভার্ট বানিয়ে ফেলা হয়েছে। এগুলো নদীর প্রস্থকে অনেক কমিয়ে দিয়েছে। নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার চরনগরদী বাজারের প্রবেশপথে ব্রহ্মপুত্রের ছোটো ব্রিজটিই তার চাক্ষুষ প্রমাণ। কালভার্টটি (কালভার্টের দৈর্ঘ্যকে ব্রিজ বলা যাচ্ছে না) আবার নদের তলদেশ থেকে কয়েক মিটার উপরে অবস্থিত। এটা কীসের জন্যে তৈরি করা হয়েছে, সেটা প্রকৌশল অধিদপ্তরের লোকজন আর ঠিকাদারগণ ভালো বলতে পারবেন। এটা পরিকল্পনা কমিশনের প্ল্যানে নদীর উপর ব্রিজের যে-ম্যাপ তৈরি করা হয়েছে, সেটা দেখলে বলা যাবে, তারা এই নদ থেকে কী পরিমাণ লুটপাট করেছে। এটা ঘটছে প্রশাসন, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং ঠিকাদারদের যোগসাজশে। যদি হাড়িধোয়া নদী ধরেই হিসাব করি, তাহলে বলা যায়, ৩৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৬২ মিটার প্রস্থের নদীটির আয়তন অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে নদীর পানি কমে গিয়ে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। নদীতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি থাকলে সেটা সূর্যের কড়া তাপকে শোষণ করে। ফলে, আবহাওয়া শীতল থাকে। অন্যদিকে, নদী দখলের মধ্য দিয়ে কেটে ফেলা হচ্ছে হাজার হাজার বৃক্ষ। এটা জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

হাড়িধোয়া নদীর বীরপুর অংশে ঘুরে দেখা যায়, নদীর সীমানা পিলার থেকে কমপক্ষে ১০০ ফুট নদীর জায়গা ভরাট করে বাড়িঘর করেছে অনেকে। সেই সাথে দেয়াল টেনে প্লট করেও রাখা আছে বিভিন্ন স্থানে। ছবির ডানপাশে হলুদ রঙের সীমানা পিলারটি দেখা যাচ্ছে | ছবি : গঙ্গাঋদ্ধি

গার্মেন্টস ও কল-কারখানার বর্জ্য
শিল্প কারখানা ও গার্মেন্টস খাত থেকে বিশ্বের ২০ শতাংশ বর্জ্যপানি ও ১০ শতাংশ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয়। বিশ্বব্যাপী যে-পরিমাণ পানি ব্যবহার হয়, তার প্রায় ২.৬% টেক্সটাইল মিলে ব্যবহার করা হয়। অনুমান করা হয় যে, টেক্সটাইল ইন্ড্রাস্ট্রিগুলোর ডাইং করার সময় প্রতি বছর ২.৪ ট্রিলিয়ন গ্যালন পানি লাগে। পোশাক শিল্প এবং ফ্যাশন ওয়াটার ফুটপ্রিন্ট অনুযায়ী এটি অনুমান করা হয় যে, বিশ্বব্যাপী ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পলিউশনের ২০% পলিউশন আসে টেক্সটাইলের ট্রিটমেন্ট এবং ডাইং ইন্ড্রাস্ট্রি থেকে। আনুমানিক ৮,০০০ প্রকারের সিনথেটিক কেমিক্যাল কাঁচামালকে টেক্সটাইল ম্যাটারিয়ালে পরিণত করতে ব্যবহৃত হয়।

প্রতি বছর, টেক্সটাইল মিলগুলো লক্ষ লক্ষ গ্যালন কেমিক্যাল কন্টামিনিটেড ইফ্লুয়েন্ট আমাদের নদীতে ডিসচার্জ করে। এটি অনুমান করা হয় যে, একটি টেক্সটাইল মিল প্রতি টন ফেব্রিকের ডাইংয়ের জন্যে ২০০ টন সফট ওয়াটার ব্যবহার করে। সুতরাং এটি কেবল পানি শোষণ করে না, কেমিক্যালগুলো পানিকে দূষিত করে, যা উন্নয়নশীল দেশের সর্বত্র পরিবেশগত ক্ষতি এবং রোগ— উভয়ই সৃষ্টি করে।

২০১৭ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, কেবলমাত্র ২০১৫ সালে, ফ্যাশন শিল্প ৭৯ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি কনজিউম করেছিলো, যা কি না ৩২ মিলিয়ন অলিম্পিক আকারের সুইমিংপুল পানি দ্বারা পরিপূর্ণ করার পক্ষে যথেষ্ট ছিলো। ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৫০% বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কনভেনশনাল টেক্সটাইল ডাইং এবং ফাইবার ফিনিশিং— উভয়ই ওয়াটার কনজিউমিং এবং পলিউটিং শিল্প। অনুমান করা হয় যে, (স্পিনিং, ডাইং, ফিনিশিংসহ) এক কেজি ফাইবার প্রসেস করতে (তুলা, পলিয়েস্টার এবং অন্যান্য ম্যাটারিয়ালস) ১০০ থেকে ১৫০ লিটার পানির প্রয়োজন।
ফ্যাশন শিল্প বর্তমানে সারা বছর ধরে যে-পরিমাণ পানি ব্যবহার করে, তা ১১০ মিলিয়ন মানুষের ৫ বছরের তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে যথেষ্ট।

ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এলেনমার্ক আর্থার ফাউন্ডেশন বলছে, প্রতি বছর ঢাকার চারপাশের নদীতে যে-পরিমাণ রঙ মিশছে, তা দিয়ে অলিম্পিকের ৩৭ মিলিয়ন সুইমিংপুল পূর্ণ করা সম্ভব। আর ঢাকার আশপাশের নদ-নদী বলতে নরসিংদীর ব্রহ্মপুত্র, হাড়িধোয়া, শীতলক্ষ্যা এবং মেঘনাকেও বোঝানো হয়েছে।

ইন্ডাস্ট্রিগুলো এসব ব্যবহৃত পানি নামমাত্র পরিশোধন করে সরাসরি নদীতে ফেলছে। এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত পানি নদীতে ফেলার ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। নির্বংশ হচ্ছে মাছসহ অসংখ্য জলজ প্রাণির জীবন। পশু-পাখির তৃষ্ণা মেটাবার জন্যে যে-পানির প্রয়োজন, সেটা ধ্বংস করা হচ্ছে। পশু-পাখির শরীরে অবলীলায় প্রবেশ করছে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ। ফলে পশু-পাখি বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে এবং প্রভাব পড়ছে বাস্তুসংস্থানের উপর। নদীর পানি ব্যবহার করে কৃষক যে-কৃষিকাজ করতেন, অতিমাত্রায় রঙের কারণে এখন আর সেই পানি ব্যবহার করতে পারছেন না। ফলে রাষ্ট্র বঞ্চিত হচ্ছে জিডিপি আর জাতীয় মোট আমিষ থেকে।

হোটেল ও বাসা-বাড়ির বর্জ্যের রস
দেশের প্রায় বেশিরভাগ শহর কিংবা বাজার নদীর পাড়ে গড়ে ওঠেছে। ছোটো-বড়ো অসংখ্য বাজারের বর্জ্য নদীর পাড়ে ফেলা হচ্ছে, যার পরিমাণ দৈনিক লক্ষ বা কোটি টন। এসব বর্জ্য থেকে প্রচুর জীবাণু মিশ্রিত রস নদীর পানির সাথে মিশে যাচ্ছে। এতে পানির দূষণ ঘটছে এবং সেই সাথে জীবাণু বিভিন্নভাবে মানবদেহে প্রবেশ করছে। বাজারের হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে ফেলে দেয়া খাদ্য পচে পানির সাথে মিশে নদীর দূষণ ঘটাচ্ছে। আবার অনেক বড়ো বড়ো ময়লার ভাগাড় আছে, যেগুলো নদীর পাড়ে অবস্থিত, সেগুলো থেকে গড়িয়ে পড়া বর্জ্যের রস গিয়ে পড়ছে নদীর পানিতে। এটা মারাত্মক ক্ষতিকর। কারণ, এসব বর্জ্যের রসে রয়েছে ক্ষতিকারক উপাদান। মূলত যারা যেভাবে পারছে, যত্রতত্র ময়লা ফেলছে। ফলে নদীর পাড়গুলোতে যাওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়ছে দুর্গন্ধের কারণে। এসব বর্জ্যের রস ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এগুলো থেকে সৃষ্টি হওয়া মশা-মাছি বাজারের পরিবেশ নষ্ট করছে। ক্ষতি করছে পরিবেশের। এখানে মূলত বাজারের ব্যবসায়ীরা দায়ী। তারা তাদের ব্যবহৃত বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে না ফেলে নিজেদের সুবিধামতো নদীর পাড়গুলোতে ফেলছে। দায়ী করা যায় পৌর কর্তৃপক্ষকেও। তাদের তদারকির অভাবে শহর, নগর, বাজার এবং বন্দরের নদীর পাড়গুলো কদাচার হয়ে গেছে। যদি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতো, তাহলে নদীর পাড়গুলোর এই বেহাল দশা হতো না।

ভেলানগর ব্রিজের পাশে স্তূপীকৃত বর্জ্য গড়িয়ে পড়ছে হাড়িধোয়া নদীতে | ছবি : গঙ্গাঋদ্ধি

মাইক্রোপ্লাস্টিক
সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ নদীগুলোতে প্রতি বর্গকিলোমিটার পানিতে ২৫ লাখেরও বেশি ভাসমান মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা (১-১০০০ ন্যানোমিটার) পাওয়া গেছে। এছাড়াও নদীর তলদেশের প্রতি কেজি পলিতে ৪৫০ টি পর্যন্ত এই ক্ষুদ্র কণা পাওয়া গেছে। এর অন্যতম কারণ প্রতিবেশি দেশ ভারতের দৈনিক ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বিভিন্ন নদীর অববাহিকার মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়া। পরবর্তীতে এসব প্লাস্টিকের কণা জোয়ারের টানে দেশের অভ্যন্তরে (যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীতে) প্রবেশ করে। বাংলাদেশ, ভারত এবং ভূটানের যৌথ অংশগ্রহণে গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছিলো।

এছাড়াও দেশের প্রতিটি শহর, বাজার, বন্দর কিংবা নগরের বাজারগুলো থেকে প্রচুর বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। নদীর পাড়ে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের বর্জ্য এবং পলিব্যাগ রোদের তাপে বা প্রাকৃতিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার কারণে গলে গিয়ে পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে নদীতে মিশে যাচ্ছে এবং বয়ে যাচ্ছে মাইলের পর মাইল। ফলে মানুষ যখন নদীতে গোসল করতে নামে, তখন অনায়াসেই তাদের শরীরে ঢুকে পড়ছে প্লাস্টিকের এসব ক্ষতিকর কণা। এসব প্লাস্টিকের কণা প্রবেশ করছে মাছের শরীরেও। আর মানুষ যখন এই মাছ বাজার থেকে কিনে আনে, সাথে কিনে আনে মাইক্রোপ্লাস্টিকও। এসব প্লাস্টিকের কারণে শরীরে নানাবিধ রোগবালাই হচ্ছে। মানুষ ও মাছ— উভয়ের প্রজননে প্রভাব ফেলছে এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক।

নেচার মেডিসিনে প্রকাশিত এক স্টাডি বলছে, ১-১০০০ ন্যানোমিটার সাইজের প্লাস্টিক (যথাক্রমে ন্যানো ও মাইক্রোপ্লাস্টিক) ব্রেনে জমা হতে পারে, এবং সেটা লিভার ও কিডনির তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে (৭-৩০ গুণ)! গবেষকদল ২০১৬ সালের একটা নমুনার সাথে এই নমুনা মিলিয়ে দেখেছেন যে, মাইক্রোপ্লাস্টিকের ডিপোজিট বেড়েছে বহুগুণ। মাইক্রোপ্লাস্টিক ও ন্যানোপ্লাস্টিক শুধু সামুদ্রিক মাছ বা প্রাণির চর্বিতেই থাকে না, আমাদের ঘর-বাড়ির পরিবেশেও থাকে, বাইরের বাতাসের চেয়ে একটু বেশি পরিমাণেই। এগুলো আসে গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক সামগ্রী থেকে। আমরা শ্বাসের সাথে তা গ্রহণ করি এবং আল্টিমেটলি এগুলো গিয়ে জমা হয় লিভার, কিডনি, ফুসফুস, প্লাসেন্টা (যেখান থেকে ভ্রূণেও যেতে পারে) এবং অস্থিমজ্জায়। আগে ভাবা হতো, শুধু ন্যানোপ্লাস্টিকই ব্লাড-ব্রেইন ব্যারিয়ার পাস করতে পারে। ব্যারিয়ার কী? রক্তবাহিকা ও মস্তিষ্কের টিস্যুর মধ্যকার ব্যারিয়ার, যেটা কি না এখন মাইক্রোপ্লাস্টিকও ভেদ করে যেতে পারে! এসব মাইক্রোপ্লাস্টিকের বেশিরভাগই আসে পলিইথিলিন থেকে, যেটা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত প্লাস্টিক।

এসবের উপস্থিতিকে কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজের জন্যে দায়ী করা হয়েছে। পাকস্থলির ক্যান্সার কোষকে প্লাস্টিকের সংস্পর্শে আসার পর আরো দ্রুত ছড়াতে দেখা গিয়েছে। ব্রেনে গিয়ে এরা কী তাণ্ডব চালাবে, সেটা না হয় সময়ই বলুক। কিন্তু চিকিৎসক ও গবেষকদের কপালে দুশ্চিন্তার যে-কয়েকটা বাড়তি ভাঁজ তৈরি হয়েছে ও হবে, তা বলাই বাহুল্য।

নরসিংদী সদর, মাধবদী এবং জেলার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বাজারের পাড়ে এমন অসংখ্য টন পলিথিন ফেলা হচ্ছে। ফলে রোদের কড়া তাপে সেগুলো গলে পড়ছে নদীতে। আর এভাবেই দূষণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে।

কৃষি
মানুষের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে খাদ্যের চাহিদাও বাড়ছে। আর খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে একই জমিতে বারবার ফসল ফলানো এবং পোকামাকড়হীন উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে বৃষ্টি হলে এসব জমির সার এবং কীটনাশক বৃষ্টির পানিতে ভেসে নদীতে গিয়ে পড়ছে। এভাবে জেলার লক্ষ লক্ষ হেক্টর জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। অথচ প্রাকৃতিক উপায়ে কী করে পোকামাকড়হীন উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়, সেদিকে কোনো কর্ণপাতই করা হচ্ছে না বা কর্তৃপক্ষ করছে না। গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিলে কৃষিবিজ্ঞান এক্ষেত্রে দারুণ সাফল্য অর্জন করতে পারতো। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা আর রাজনৈতিক ফ্যালাসির কারণে দেশের পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে এবং এটা হচ্ছে সকলের চোখের সামনেই। অথচ আজ থেকে শত বছর আগেও কয়েক কোটি মানুষ বাস করতো এদেশে। তখন কীটনাশকের এতো ব্যবহার হতো বলে এমন তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু তারা না খেয়ে ছিলো বা ফসল কম হতো এমনটা কখনোই বলা যাবে না। বরং আমাদের দেশে একটা প্রবাদ প্রচলন আছে যে, আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি। অর্থাৎ গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ এবং গোয়াল ভরা গরু আমাদের ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ করে রেখেছিলো। সারা বছর জমানো গরুর গোবর জমির উৎকৃষ্ট সার হিসেবে বিবেচিত। জমিতে গোবর ব্যবহার করলে যেমন প্রচুর ফসল পাওয়া যেতো, তেমনি আমাদের নদীগুলোও রাসায়নিক সার আর কীটনাশকের করাল থাবা থেকে রক্ষা পেতো। আর রাষ্ট্রের বেঁচে যেতো হাজার হাজার কোটি টাকা। অথচ এখন এগুলো পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে। সবুজের সমারোহ বাংলার পথে-ঘাটে চোখ মেললেই দেখা যেতো। বিশাল বড়ো বড়ো বন-জঙ্গল সার এবং কীটনাশকের ব্যবহার ছাড়াই হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে।

ড্রেনের বর্জ্য
মানুষ বাড়ার সাথে সাথে শহরের চাপও বাড়ছে। মূলত উন্নত জীবনযাপন আর শহরের অধিক কর্মসংস্থান গ্রাম থেকে মানুষকে শহরের দিকে নিয়ে আসে। ফলে অতিরিক্ত মানুষের আবাসস্থলের চাহিদা মেটাতে এবং ভাড়া পাওয়ার আশায় অসংখ্য ইট-পাথরের দালান একের পর এক গড়ে ওঠতে থাকে। ফলে শহুরে জীবনে নানাবিধ সংকট সৃষ্টি হতে থাকে। বিভিন্ন সমস্যার সাথে সাথে শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার উপরও চাপ পড়ে। কোটি কোটি মানুষ তাদের ব্যবহৃত পানি এবং বর্জ্য ড্রেনে ছেড়ে দেয়। আর এভাবেই শহরের শত শত কিংবা হাজার হাজার ড্রেন নদীতে তরল বর্জ্য নিয়ে আসে। কিন্তু কী পরিমাণ বর্জ্য একটি শহর কিংবা সারা দেশ থেকে ড্রেনের মধ্য দিয়ে নদীতে পড়ছে, সেটার হিসাব এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে হয়নি। আর এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো পদক্ষেপও নেয়া হয়নি এখনো পর্যন্ত। এটা নিয়ে আলোচনাই হয়নি কোথাও। এসব ড্রেনের বর্জ্য নদীগুলো দূষণেও কম ভূমিকা রাখছে না। শীতলক্ষ্যা নদীর আশপাশের এলাকায় গড়ে ওঠা প্রায় ৪০০ ফ্যাক্টরির তরল বর্জ্য বিভিন্ন ড্রেন আর নালার মাধ্যমে নদীতে পড়ছে। এর পরিমাণ প্রায় দৈনিক ২০ কোটি লিটার। হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং বাজারের বিশাল পরিমাণ বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে, যা নদীর দূষণকে আরো তরান্বিত করছে। ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা ও হাড়িধোয়া নদীতে প্রতি লিটার পানিতে ডিও মেনাস ডিজলভ অক্সিজেন থাকার কথা ৪-৬ মিলিগ্রাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বর্তমানে তা মাত্র ১-২ মিলিগ্রাম। এটা জলজ প্রাণির বেঁচে থাকার জন্যে একেবারেই নগণ্য। অনেক প্রতিষ্ঠান ইটিপি স্থাপন করলেও কার্যত এসব লোক দেখানো এবং রাতের বেলায় অপরিশোধিত পানি ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি নদীগর্ভে ফেলা হচ্ছে। আর এভাবেই দেশের অসংখ্য নদ-নদী মানুষের জীবনের ন্যায় অসুস্থতায় ভুগছে।

দূষণ রোধে ম্যানগ্রোভ
শিল্প কারখানা বৃদ্ধির ফলে প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। দূষিত হচ্ছে পানি। এই বিশাল পরিমাণ পানি সহজে পিউরিফাই করা সম্ভব নয়। কিন্তু নদীতে ফেলা ইন্ডাস্ট্রিয়াল বর্জ্য পদার্থের কারণে নদীর দূষণ রোধে বড়ো ভূমিকা রাখতে পারে ম্যানগ্রোভ। প্রাকৃতিক উপায়ে এটা সম্ভব। দেশের নদীগুলোর পানি পরীক্ষা করলে দেখা যাবে যে, Biological Oxygen Demand and Chemical Oxygen Demand অত্যধিক বেশি। এক্ষেত্রে ম্যানগ্রোভ প্রাকৃতিক ফিল্টার হিসেবে কাজ করতে পারে। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ চাইলে একটা পাইলট প্রকল্পের সূচনা করতে পারে। অনেকেই বলে থাকবেন, ম্যানগ্রোভ তো লবণাক্ত পানি ছাড়া জন্মায় না। হ্যাঁ, কথা সত্যি, এটা লবণাক্ত পানি ছাড়া জন্মায় না। কিন্তু কিছু প্রজাতি নিয়ে কলাকাতায় একটি পাইলট প্রকল্প চালু করে তারা সফল হয়েছে। তারা প্রমাণ পেয়েছে যে, ম্যানগ্রোভ ব্যাপকভাবে পানির দূষিত পদার্থ শুষে নেয় এবং পানি পরিষ্কার করে। পরিবেশবাদীরা শিল্পায়নের বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু সেটা হতে হবে সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায়। জেলার ১২৯ টি তরল বর্জ্য নিঃসরণকারী প্রতিষ্ঠান যদি একসাথে বসে আলোচনা সাপেক্ষে একটা ফান্ডিং করে এবং সেটা দিয়ে নদীর পাড়ে ম্যানগ্রোভ লাগায়, তাহলে ন্যূনতম হলেও ক্ষতি থেকে বাঁচা যেতো।

জার্মানির পানি পরিষ্কার করার পদ্ধতি
সম্প্রতি জার্মানির এরলাঙ্গেন-নুরেমবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাটারিয়াল সায়েন্টিস্ট মার্কুস হালিক পানি বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করে সফলতার মুখ দেখেছেন। তার উদ্ভাবিত পদ্ধতিটি এতোটাই কার্যকর যে, এটার মধ্য দিয়ে যতো প্রকার দূষিত পানি আছে, তার বর্জ্যকে পানি থেকে আলাদা করে ফেলে। তিনি ম্যাগনেটিক আয়রন অক্সাইড ন্যানো পার্টিকেল ব্যবহার করে অনেক ধরনের দূষণ অপসারণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তারা পার্টিকেলগুলোর পৃষ্ঠকে মলিকিউল দিয়ে আবৃত করে আর সেই কারণে পার্টিকেলগুলো বিভিন্ন ধরনের দূষণ শনাক্ত করতে পারে। পার্টিকেলগুলো ডিজেলের সাথে যুক্ত হয়ে জমাট বাঁধে, যা চুম্বক দিয়ে সহজেই টেনে বের করা যায়। এই ধরনের আরো কী কী পদ্ধতি আছে, রাষ্ট্রকে সেগুলো বিভিন্ন দেশের সাথে যোগাযোগ করে বের করতে হবে। এতে নদীগুলো কিছুটা হলেও বেঁচে যাবে।

নদীর লিভিং এনটিটি
বাংলাদেশের উচ্চ আদালত ২০১৯ সালে দেশের সব নদীকে ‘লিভিং এনটিটি বা জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ফলে এখন থেকে দেশের নদীগুলো মানুষ বা অন্যান্য প্রাণির মতোই আইনী অধিকার পাবে। আদালতের রায় অনুযায়ী নদীগুলো ‘জুরিসটিক পারসন বা লিগ্যাল পারসন’। এর মধ্য দিয়ে নদীগুলোরও মানুষের মতো মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে। নদীগুলোকে বাঁচাতে হলে সম্মিলিতভাবে সচেতন নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন সংগঠন একসাথে হয়ে একটা কঠোর আন্দোলনের দিকে যেতে পারে। এখানে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পেইন করে তরুণদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো যেতে পারে। নদীগুলো বাঁচানোর জন্যে সরকারকে বাধ্য করতে হবে এজন্যে যে, যারা নদী দূষণের সাথে জড়িত, তাদের সরকারি সুবিধা বাতিল করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আর বিভিন্ন কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে পড়ছে কি না, সেটা সর্বসাধারণের দেখার জন্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের সিসি ক্যামেরাগুলো ওপেন করে দেয়ার জন্যে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করা। কারণ সেখানেই একটা গণ্ডগোল আছে। দেশের পরিবেশ আন্দোলনের যেসব সংগঠন আছে, সেগুলো এক্টিভ করে তুলতে হবে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাকে মিডিয়ার মাধ্যমে সামনে নিয়ে আসতে হবে। নয়তো নদীগুলোকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। নদীর লিভিং এনটিটির সর্বোচ্চ ব্যবহার এখন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। দেশের নদ-নদী এবং জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কঠোর পরিবেশগত নীতি এবং আইন তৈরি করেছে। নিম্নলিখিত চারটি আইন এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক :

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, ১৯৯৫), বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ (বাংলাদেশ, ২০১৩ক), জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশন আইন ২০১৩ (বাংলাদেশ, ২০১৩খ) এবং বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭ (বাংলাদেশ, ২০১৭)।

কিন্তু এগুলোর প্রয়োগ নেই বললেই চলে। আর আইনগুলোরও সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। আইনগুলোতে শাস্তির বিধান এমনভাবে রাখা হয়েছে যে, এগুলো দেশের পরিবেশের সর্বনাশকারী পুঁজিবাদীদের পরিবেশ দূষণে আরো উৎসাহিত করছে। আইনগুলোতে বিশ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা জরিমানার বিধান এবং অনাদায়ে দুই মাস জেল থেকে দশ বছর পর্যন্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ যতো বড়ো অপরাধই করুক না কেন, টাকার জোরে তিনি পার পেয়ে যাবেন, এটি এমনই এক অদ্ভূত ও হাস্যকর আইন। টাকার জোরে যাতে অপরাধী পার পেয়ে যেতে না পারে, পরিবেশ বাঁচাতে সেই আইন তৈরি এখন অনিবার্য। শাস্তির বিধানে কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা রাখা উচিত। আর জেল হলে সেটা তাকে যেন ভোগ করতেই হয়, এমন আইন তৈরি করা ফরজ হয়ে গেছে। আর আইন তৈরির পর প্রয়োগ না হলে সেটা আরো ভয়ানক হবে। পানি আইন নীতিমালা এবং বিধিমালা— এসবের কোনোটাই বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত হয়নি, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। কয়েক বছর আগে হাড়িধোয়া নদী নিয়ে মামলা হয়েছিলো। কিন্তু এখনো সেই মামলার রায় আসেনি। নদী পুনরুদ্ধারে দেশের তিনটি পাইলট প্রকল্পের মধ্যে একটি হাড়িধোয়া। সেটিও জেলার প্রভাবশালী মহলের চাপের মুখে বন্ধ হয়ে গেছে। তাহলে এভাবে চলতে থাকলে দেশের যে বিপন্ন অবস্থা, এটা তো বাড়তেই থাকবে। আর এর ক্ষতির সম্মুখীন হবে সাধারণ ও প্রভাবশালী সকলের সন্তানেরা।

রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চাই
দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো থেকে এখন পর্যন্ত নদীগুলো রক্ষায় কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। সরকার আসে, সরকার যায়, কিন্তু নদী দূষণ চলতে থাকে আগের মতোই কিংবা তারচেয়ে বেশি। রাজনীতির সাথে জড়িত বহু নেতা রয়েছেন, যারা সরাসরি নদী দূষণের সাথে জড়িত। নদী নিয়ে সরকার যেভাবে কৃচ্ছসাধন করছে, এভাবে চলতে দিলে নদীগুলোর তলদেশ গরু-ছাগলের তৃণভূমিতে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না। নির্বাচনের ইশতেহারে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে কোনো দলই বিগত সময়ে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো যদি একসাথে বসে এটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে, তাহলে একটা মীমাংসা হতে বাধ্য। এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছার চরম ঘাটতি দেখছি। তারা পরিবেশ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করার পক্ষে নয়। ক্ষমতায় গেলে সবাই ভুলে যায়, কার কী দায়িত্ব বা কী প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলো। তাই এমন কিছু নিয়ে ভাবা উচিত, যেন তারা সেটা ভোলার অবকাশ না পান। এখানে বলে রাখা ভালো যে, কোনো দলই এটার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করে না এবং এটা যে প্রয়োজন, তার গুরুত্ব বিনাবাক্যে স্বীকার করে। কিন্তু জনগণের জন্যে কিছু করতে হলে সেটা তো দেখাতে হবে। তারা যেন পরিবেশ দূষণ রোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে সকলকে সাথে নিয়ে কিছু একটা করে, সেই বন্দোবস্ত এখনই করতে হবে। আগামীতে করতে চাইলে সেই ‘আগামী’ কবে আসবে, তা আমরা জানি না। আমরা জানতেও চাই না।


বালাক রাসেল
সম্পাদক, ঢেঁকি

দেশপ্রেমে ব্রতী আবুল হাসিম মিয়ার জীবনচরিত

একাত্তরের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠকদের সর্বদলীয় কমিটির আহ্বায়ক, প্রবীণ জননেতা এবং বাম রাজনীতিবিদ আবুল হাসিম মিয়াকে পাকিস্তানি সেনারা শিবপুর উপজেলার পুটিয়া ইউনিয়নের ভরতেরকান্দি গ্রামের শফিউদ্দিন মাস্টারের বাড়ি থেকে আটক করে। সেখান থেকে তাঁকে নরসিংদী টেলিফোন এক্সচেঞ্জে নিয়ে যায়। তাঁর উপর চালায় অমানবিক নির্যাতন। পা উপরে ও মাথা নিচে ঝুলিয়ে দাঁতের পাটিতে বেত মেরে ফেলে দেয়। এক সপ্তাহ এভাবে তাকে নির্যাতনের পর ছেড়ে দেয়া হয়।

নরসিংদী অঞ্চল বাম রাজনীতির তীর্থভূমি হিসেবে পরিচিত ছিলো। বহু বিপ্লবী রাষ্ট্র ও পুলিশের রোষানল থেকে বাঁচতে এখানে এসে আশ্রয় গ্রহণ করতেন। এটা ছিলো বামধারার রাজনীতিবিদ ও বিপ্লবীদের অভয়কেন্দ্র। গত শতকে নরসিংদী অঞ্চল দাঁপিয়ে বেড়ানো তেমনি একজন নিবেদিতপ্রাণ বামধারার রাজনীতিবিদ ছিলেন আবুল হাসিম মিয়া; সবার প্রিয় ‘হাসিম ভাই’। বনেদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও অতি সাদামাটা জীবনযাপন করেছেন সমগ্র জীবন। আর মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত রেখেছেন সর্বদা।

আবুল হাসিম মিয়া জন্মেছেন ১৯২০ সালে, দত্তপাড়ায়। রাজনৈতিক পরিবারে তাঁর জন্ম। নরসিংদীর অবিসংবাদিত রাজনৈতিক পুরুষ সুন্দর আলী গান্ধী তাঁর চাচা। সে-কারণে সর্বভারতীয় বহু নেতার সংস্পর্শে আসার সুযোগ পান তিনি।

আবুল হাসিম মিয়ার পিতা হাফিজ উদ্দিন ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও ধার্মিক ব্যক্তি। তাঁর চাচা সুন্দর আলী গান্ধী ছিলেন নরসিংদীর খ্যাতিমান ব্যক্তি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তাঁর ছিলো বলিষ্ঠ ভূমিকা। মহাত্মা গান্ধীর একনিষ্ঠ সৈনিক এবং অনুসারী ছিলেন বলে তিনি জনগণের কাছ থেকে ‘গান্ধী’ উপাধি পান। একদিকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, অন্যদিকে স্থানীয় সামন্ত প্রভু, জোতদার, মহাজন, সুদখোরদের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন আপসহীন। অসাম্প্রদায়িক ভূমিকার কারণে তাঁকে হিন্দু-মুসলমানদের ঐক্যের দূতও বলা হতো। গৌরবদীপ্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সুন্দর আলী গান্ধী ১৯৪৭ সালে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মরদেহ মেঘনা নদীর তীরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুল-মসজিদ-ঈদগাহের পাশে নিজ পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। হাসিম মিয়ার আরেক চাচা বেলায়েত হোসেন মাস্টার ছিলেন শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক। পারিবারিক বাতাবরণে তিনি বড়ো হন দেশসেবার ব্রত নিয়ে। দুজনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে সেই অঞ্চলের অনগ্রসর সম্প্রদায় এবং জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের শিক্ষা প্রদানের মানসে ১৯২৮ সালে নরসিংদী মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৩৮ সালে বিদ্যালয়টি নরসিংদী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে এটি ‘নরসিংদী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে পরিচিত।

নরসিংদী অঞ্চলের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী হিসেবেও পরিচিত ছিলেন বেলায়েত হোসেন মাস্টার। বাংলা, ইংরেজি— উভয় ভাষাতেই তিনি ঋদ্ধ ছিলেন। দুষ্প্রাপ্য, দুর্লভ এবং বিশ্বখ্যাত বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা পাঠ করে লাভ করতেন পরম তৃপ্তি ও প্রশান্তি। নরসিংদী সরকারি কলেজ, নরসিংদী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং মেঘনার তীরে স্থাপিত দাতব্য চিকিৎসালয়সহ বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার পেছনে তাঁর শ্রম ও ঘামের গন্ধ পাওয়া যায়। তাছাড়া স্থানীয় বাউলমেলার শীর্ষ আয়োজক হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেছেন। বেলায়েত হোসেন মাস্টারের অনেক গুণাবলি, বিশেষ করে, দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রহ, দুর্লভ পত্র-পত্রিকা পাঠ ও সংগ্রহ বংশগতভাবে তাঁর পুত্র শাহাদাত হোসেন মন্টুর ভেতরও জাগ্রত ছিলো। শাহাদাত হোসেন মন্টু এ-বছরের জুন মাসে পরপারের পথে পাড়ি দিয়েছেন।

আবুল হাসিম মিয়ার মেজো কাকা আবদুল হামিদের ছেলে আবদুল গফুর মিয়াও খুবই সাহসী ও বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ মহকুমার মুসলিম লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

হাসিম মিয়ার পিতামহ কেরামত আলী আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। দ্বীনি চেতনায়ও ঋদ্ধ ছিলেন। তিনি দত্তপাড়ায় এসে বসতি গড়ে তুলেছিলেন। প্রপিতামহ আরবাব আলী খান সিপাহী বিপ্লবের (১৮৫৭) সংগঠক ও তহবিল সংগ্রাহক ছিলেন।

শিক্ষা-সংস্কৃতি, সমাজসেবা ও রাজনীতিতে বিশাল পরিবারটি নিঃসন্দেহে সারা দেশে বিখ্যাত ছিলো বলাই যায়। পাক-ভারত উপমহাদেশের বরেণ্য ব্যক্তিগণ এই বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, ড. আচার্য কৃপানলি, ডা. বিধানচন্দ্র রায়, শরৎ বোস, রাসবিহারী বোস, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খান, খাজা নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী (বগুড়া), প্রফেসর মোজাফ্ফর আহমদ, কমরেড মণি সিংহ প্রমুখ।

পারিবারিক জীবন
আবুল হাসিম মিয়ার পিতা হাফিজ উদ্দিনের ছিলো দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর গর্ভের সন্তান আবদুল আজিজ (কালু মিয়া)। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভের তিন পুত্র সন্তান— আবুল হাসিম মিয়া, আবদুর রশিদ মিয়া ও আবদুল লতিফ মিয়া। দুই কন্যা সন্তান হলো মাজেদা বেগম ও ফিরোজা বেগম। আবুল হাসিম মিয়া ছাত্র জীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মেট্রিক পাশের পর রাজনৈতিক কারণে পড়াশোনা করা হয়নি। দেশপ্রেমের দীক্ষা নিয়ে সমাজের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন। রাজনৈতিক কারণেই তাঁর বিয়ে করা হয়নি। ছোটো ভাই আবদুল লতিফের সংসারের সাথে তিনি সম্পৃক্ত থাকেন।  তাঁর মা-ও ছোটো ভাইয়ের সংসারে যুক্ত ছিলেন। আবদুল লতিফের নরসিংদী বাজারের পাটপট্টিতে একটি লন্ড্রি ছিলো। পরবর্তীতে অন্য ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন তিনি। তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর ছোটো ভাই মারা যায়। ছোটো ভাইয়ের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। এরাই ছিলো তাঁর সন্তান। এদের লেখাপড়ার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সার্বক্ষণিক রাজনীতি করার কারণে স্থায়ীভাবে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন না। কিছু ঘনিষ্ঠজনের মাধ্যমে ব্যবসায় ক্ষুদ্র পুঁজি বিনিয়োগ করেছিলেন। তা থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ দিয়ে নিজের ও সংসারের খরচ মেটাতেন।

ভাতিজা ও ভাতিজিদের লেখাপড়ার জন্যে হারুন অর রশিদ ভূঁইয়াকে লজিং মাস্টার নিয়োগ করেছিলেন। হারুন সাহেবের বাড়ি ছিলো শিবপুরের বৈলাব গ্রামে। মাধবদীতে সুতার দোকানের কর্মচারী ছিলেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় হারুন অর রশিদ নরসিংদী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে প্রাইভেটে এসএসসি পাশ করেন। নরসিংদী কলেজের অনেক ছাত্র গ্রাম থেকে এসে আর্থিক কারণে মেসে অথবা ভাড়া বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতে পারতো না। আবুল হাসিম মিয়া বহু ছাত্রের লজিংয়ের ব্যবস্থা করে দেন। অপর ভাই আবদুর রশিদ মিয়ার ছেলেমেয়েরাও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে তাঁর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যথেষ্ট কাজে লেগেছে। ভাতিজি রাশিদা বেগম লাভলি সিদ্ধিরগঞ্জ রেবতি মোহন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। বর্তমানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত। ভাতিজা মিয়া মো. মঞ্জুর নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের (১৯৯৯-২০০০) ভিপি ছিলেন।

ভাষা আন্দোলনে অবদান
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নরসিংদী অঞ্চল যথেষ্ট সরব ছিলো। জনগণের সম্পৃক্ততা ছিলো গভীর। ফলে এই অঞ্চল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে নরসিংদীতে প্রতিশ্রুতিশীল রাজনীতিবিদদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল আজিজ, বিজয়ভূষণ চ্যাটার্জি, সেকান্দর আলী, আবুল হাসিম মিয়া, আহমেদুল কবীর, মোসলেহ উদ্দীন ভূঞা, আফতাব উদ্দিন ভূঞা, ফজলুল হক খোন্দকার, আফসার উদ্দিন ভূঞা, আবদুল করিম মিয়া ও কফিল উদ্দিন ভূঞা প্রমুখ।

২৩ ফেব্রুয়ারি দত্তপাড়ার ঐতিহাসিক ঈদগাহ ময়দানে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী উপস্থিত হন। সেদিন সন্ধ্যার পূর্বেই পুরো শহর মিছিলে-শ্লোগানে উদ্ভাসিত হয়। শুরু হয় গণগ্রেফতার ও পুলিশী নির্যাতন। সেদিন আবুল হাসিম মিয়া, সুরেশ পোদ্দার, আবুল ফজল মিয়া ও গৌরানন্দ সাহা গ্রেফতার হন।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সম্পৃক্ততা
সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশন (স্কুল এন্ড কলেজ)-এর পরিচালনা পরিষদের দুই মেয়াদে সদস্য ছিলেন আবুল হাসিম মিয়া। ১৯৭২-৭৫ ও ১৯৭৫-৭৮। তিনি নরসিংদী সরকারি কলেজের ও নরসিংদী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন। নরসিংদী উচ্চ বালিকা বিদ্যানিকেতনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং নরসিংদী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমানে সরকারি) দেশভাগের পর দ্বিতীয় পর্যায়ে চালু করার প্রধান উদ্যোক্তা। এছাড়া তিনি ব্রাহ্মন্দী মাধ্যমিক বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন।

কারাজীবন
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সামরিক আইন জারি করে। পাকিস্তানব্যাপী রাজনৈতিক নেতাদের কারারুদ্ধ করা হয়। সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশন স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্র মল্লিক (ফণী মল্লিক)-এর সাথে ছিলো আবুল হাসিম মিয়ার সখ্য। তিনি ছিলেন বামপন্থামনস্ক। আবুল হাসিম মিয়া, সুরেশ পোদ্দার, কার্তিক সাহা, সাত্তার, সরোজেন্দ্র লাল সাহা, মুস্তাফা সরোয়ার ও আবুল ফজল প্রমুখকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধে অবদান
একাত্তরের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠকদের সর্বদলীয় কমিটির আহ্বায়ক, প্রবীণ জননেতা এবং বাম রাজনীতিবিদ আবুল হাসিম মিয়াকে পাকিস্তানি সেনারা শিবপুর উপজেলার পুটিয়া ইউনিয়নের ভরতেরকান্দি গ্রামের শফিউদ্দিন মাস্টারের বাড়ি থেকে আটক করে। সেখান থেকে তাঁকে নরসিংদী টেলিফোন এক্সচেঞ্জে নিয়ে যায়। তাঁর উপর চালায় অমানবিক নির্যাতন। পা উপরে ও মাথা নিচে ঝুলিয়ে দাঁতের পাটিতে বেত মেরে ফেলে দেয়। এক সপ্তাহ এভাবে তাকে নির্যাতনের পর ছেড়ে দেয়া হয়। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে শর্ত জুড়ে দেয়, তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখতে পারবেন না। সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে নরসিংদী ছেড়ে যেতে হবে। তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনির কাছে দমে যাননি। ঢাকার মিরপুরে আত্মগোপনে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে থাকেন।

মস্কো ভ্রমণ
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের পরামর্শে ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে আবুল হাসিম মিয়াকে পার্টির তিন মাসের প্রশিক্ষণ ও সফরের জন্যে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রেরণ করা হয়। সেখানে তিনি সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের ফলে বিভিন্ন রাজ্যের জনগণ কেমন আছে, তা সচক্ষে দেখেন, তাদের সাথে কথা বলেন। মস্কোসহ সেই দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করেন।

জাতীয় স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ
আবুল হাসিম মিয়া ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নরসিংদী-রূপগঞ্জ আসনে পিডিপি’র প্রার্থী হয়ে ‘ছাতা’ প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ন্যাপে যোগদান করেন। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নরসিংদী সদর আসনে ন্যাপের প্রার্থী হিসেবে ‘কুঁড়েঘর’ প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। উপরের দুটি নির্বাচনে প্রচুর ভোট না পেলেও ভালো ও যোগ্য প্রার্থী হিসেবে সবাই তার প্রশংসা করেন।

নরসিংদী পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে ১৯৭৭ সালে ‘ঘড়ি’ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়লাভ করতে পারেননি। ১৯৯৩ সালে গণফোরাম গঠিত হলে তিনি উক্ত দলে যোগদান করেন এবং ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে ‘উদীয়মান সূর্য’ প্রতীকে অংশগ্রহণ করে স্বল্প সংখ্যক ভোট পান।

শেষকথা
১৯৯৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৭৯ বছর বয়সে আবুল হাসিম মিয়া চলে যান না ফেরার দেশে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৯ তারিখ তাঁর ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নরসিংদী প্রেসক্লাব মিলনায়তনে ‘আবুল হাসিম মিয়া স্মৃতি সংসদ’ স্মরণসভার আয়োজন করে এবং গুণীজনদের সম্মাননা প্রদান ও শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ করে।

যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতেন, তাদের সংখ্যা অল্প এবং এখন তারা বিলীয়মান প্রজাতি। আবুল হাসিম মিয়ার মৃত্যুর ২৫ বছর পরও তাঁর কর্মের জন্যে বেঁচে আছেন মানুষের হৃদয়ে।


রঞ্জিত কুমার সাহা
উপদেষ্টা, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি
সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নরসিংদীর সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা ও সীমাবদ্ধতা

সাহিত্যের গতিপথ ত্রিভঙ্গিম, সত্য, সুন্দর ও শৈল্পিক। নন্দন মাঠে অনুভূতির ভাষাগত বপনই সাহিত্য। প্রকৃতার্থে সাহিত্য হলো জীবনাচারের ভাষাগত শৈল্পিক প্রকাশ। ভাষা সৃষ্টির কাল থেকেই মানুষ ভাষাগত অনুভূতি প্রকাশের উপায় খুঁজছে আর সময়ান্তরে তা হয়েছে বিচিত্র।

মানুষের চিন্তাজগত বিচিত্র বলে এর ভাষাগত প্রকাশও বিচিত্র। হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ— এসব অনুভবের আক্ষরিক আঁচড়েই নান্দনিক হয় সাহিত্যের সোপান। কথা আর সাহিত্যের মধ্যে পার্থক্য হলো অলঙ্কার আর কাঠামো। যাকে আমরা সাহিত্য বলবো, তার ধর্ম অনুযায়ী ভাষাগত শরীর ও অলঙ্কার থাকা চাই। অনুভূতির জগত অনেকটা অদৃশ্যমান হলেও সাহিত্য দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান দুই ভঙ্গিমায় হাঁটাচলা করে।

প্রকৃতার্থে সাহিত্যের কোনো শিক্ষক বা গুরুজি নেই। কেউ কেউ বলে থাকেন, আছে, লাগে। আমার দৃষ্টিতে এসব লাগে না। যদি তেমনভাবে প্রয়োজন হতো, তাহলে লালন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল সাহিত্যচর্চা করতে পারতেন না। কিছুটা ভাষাজ্ঞান থাকার পরে পরিবেশ, পরিস্থিতি, স্বগত ভাবনার সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো অনুরণন পেলে চেতনার চাতালে হেসে ওঠে সাহিত্যের ফল্গুধারা।

লেখালেখির শিক্ষক হলো সাথের লেখক, সাথের কবি ও বোদ্ধা পাঠক। কবির সাথে কবির আড্ডা না হলে, লেখকের সাথে লেখকের কথা না হলে, শিল্পীর সাথে শিল্পীর দেখা না হলে সাহিত্য শাণিত হয় না, পরিশীলিত হয় না।

আবহমান কাল থেকে আমাদের নরসিংদীর নন্দন হলো তাঁতকাপড়, তরি-তরকারি ও নানান ফলমূল। তাই মনন প্রকর্ষণে সাহিত্য সংস্রবের পরিবর্তে পল্লবিত হয়েছে কৃষি অর্থাৎ মাটির মহিমাকীর্তন। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, মেঘনা, হাড়িধোয়া, আড়িয়াল খাঁ, কাঁকন ও পাহাড়িয়া নদীর পেলব পলল মানুষকে যতোটুকু আবেগী বা বিবাগী করেছে, তারচেয়ে বেশি করেছে কৃষিমুখী ও শিল্পমুখী। তাই সাহিত্য এখানে পরিযায়ী অথবা পরিব্রাজক গোছের। অতীতে কেউ কেউ ছিলেন দ্বিজ। বসবাস করতেন শহরে, অকস্মাৎ উঁকি দিতেন মফস্বলে। নরসিংদীর মাটি কামড়ে পড়ে থাকা, নরসিংদীর ধুলো-বালি মাখা, সর্বাঙ্গে নরসিংদীর রঙ-রসদ মাখা স্থির-স্থিতধী কবি-লেখক এখানে খুবই কম। শামসুর রাহমান, ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ, ড. মনিরুজ্জামান, ড. সফিউদ্দিন আহমেদ, হরিপদ দত্ত, সোমেন চন্দ, সাবির আহমেদ চৌধুরী, দ্রাবিড় সৈকত, এম আর মাহবুব, মোহাম্মদ সা’দত আলী, মাসুদ পথিক, স্নিগ্ধা বাউল— কেউ নরসিংদীতে বসবাস করতেন না বা করেন না।

এককালে নরসিংদী ছিলো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ। বিপ্লবী সতীশ চন্দ্র পাকড়াশী, সুন্দর আলী গান্ধী, ললিতমোহন রায়, সোমেন চন্দ, সুনীল বরণ রায়, সেকান্দর মাস্টার, বিজয়ভূষণ চ্যাটার্জি, জিতেন্দ্র কিশোর মৌলিকরা বিপ্লবী সংগঠন ‘অনুশীলন সমিতি’র মাধ্যমে এলাকায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন বেগবান করেছিলেন। এসব আন্দোলনের অগ্নিচ্ছটা ও আভা-বিভায় বেশ রক্তরাঙা হয়েছে এই অঞ্চলের শিল্প-সংস্কৃতি। সেই চেতনার রঙ-রসদে প্রতিবাদী ও বিপ্লবী সাহিত্যের সাথে পরিচিত হয়েছে এই অঞ্চলের বোদ্ধা পাঠক। তাই এই অঞ্চলের সাহিত্যকর্মকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন : বিপ্লবী চেতনার সাহিত্য, লোকসাহিত্য, মরমি বা ভাববাদী সাহিত্য, ধর্মসাহিত্য, আধুনিক ও উত্তরআধুনিক সাহিত্য।

সতীশ চন্দ্র পাকড়াশী, হরিচরণ আচার্য্য, সোমেন চন্দ, প্রিয়বালা গুপ্তা তাঁদের বোধভাবনায় ঘুরে-ফিরে এসেছে বিপ্লব, সংগ্রাম ও দ্রোহ। ঊনিশ শতকের ঊষালগ্নে কবি আজিজুল হাকিম, কবি বে-নজীর আহমেদ, কবি অক্রূর চন্দ্র ধর ছিলেন সাহিত্যাকাশের ধ্রুবতারা। মরমিয়া মানবতাবাদ ও ভাববাদের নিগূঢ় তত্ত্বলোকে নিবিষ্ট ছিলেন কাঙালি বাউল, দ্বিজ দাস ও সাবির আহমেদ চৌধুরী। তাঁদের সংগীত ও কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে সৃষ্টিতত্ত্ব ও দেহতত্ত্বের গূঢ়-গভীর বিশ্লেষণ। বিশ শতকের ঊষালগ্নের কবি, নাট্যব্যক্তিত্ব ও ইতিহাসকার অধ্যাপক সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থ আমাদের অনেক জ্ঞানগর্ভ সাহিত্যকর্ম উপহার দিয়েছেন। তাঁর লেখা ‘মহেশ্বরদীর ইতিহাস’ অতীত বীক্ষণের এক নতুন নেত্র। পরবর্তীতে নাট্যকার অক্রূর চন্দ্র ধর, অধ্যাপক জিয়াউদ্দিন আহমেদ, সন্তোষ শীল, শ্রী হীরেন্দ্র কৃষ্ণ দাস, জালাল উদ্দিন, অনুপ ভৌমিক, ইউনুছ মিয়া, আবুল হোসেন পাঠান, শাহ্ আলম, মতিউর রহমান, মহিউদ্দিন ভূঁইয়া হীরা, মোছলেহ উদ্দিন বাচ্চু প্রমুখ নরসিংদী নাট্য আন্দোলনকে শুধু বেগবানই করেননি, সৃষ্টি করেছেন নাটকের নতুন ধারা।

ইতিহাসচর্চা, গবেষণা ও অতীত বীক্ষণে যাঁরা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন, তাঁদের মধ্যে ত্রৈলোক্যনাথ ভট্টাচার্য, মুহাম্মদ ওসমান গণি, ড. মনিরুজ্জামান, ড. সফিউদ্দিন আহমেদ, সুরমা জাহিদ, সরকার আবুল কালাম, ইমাম উদ্দিন, শফিকুল আজগর ও সিরাজ উদ্দিন সাথীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ভাষা ও লোকসাহিত্য গবেষণায় ড. মনিরুজ্জামান, ধ্বনিতত্ত্ব ও বানানরীতিতে কালাম মাহমুদ, মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় সুরমা জাহিদ, ভাষা আন্দোলন গবেষণায় এম আর মাহবুব আমাদেরকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতকে যাঁরা অলঙ্কৃত করেছেন, তাঁদের মধ্যে ইংরেজ আমলে রেনুকা সেন, রমা রায় আর পাক আমলে ওস্তাদ কালু মিয়া, মফিজুল ইসলাম, অধ্যাপক মো. আবদুত তাহের, হালে হরিমোহন দেবনাথ, মতিউর রহমান চৌধুরী, আবুল হোসেন খোকন ও আসাদুজ্জামানের নাম অতি উজ্জ্বল। ধর্মীয় ভাবধারার লেখকদের মধ্যে ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। তাছাড়া মীর রহমত আলী, মৌলভী মোজাফফর হুছাইন, মৌলভী আবু তাহের, মৌলভী আব্দুল খালেক ও হাশেম খানের নাম উল্লেখযোগ্য।

লোকসাহিত্যে কবিয়াল হরিচরণ আচার্য্য এক বিস্ময়কর প্রতিভা। নরসিংদীর লোকসাহিত্যের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন লোকসাহিত্য গবেষক মোহাম্মদ হানীফ পাঠান ও মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান। কাদাখোঁচা পাখির মতো তাঁরা মাটি খুঁড়ে বের করেছেন লোকসাহিত্যের মানিক-রতন। তাছাড়া কিসসাকার দেওয়ান হাফিজ ও আবদুল হাকিম কুঁইড়া, পুঁথিকার দারোগ আলী, ভাটকবি মফিজ উদ্দিন নরসিংদীর লোকসাহিত্যের প্রাণপুরুষ।

আধুনিক কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে কবি শামসুর রাহমান এক ধ্রুবতারা। তিনি উভয় বাংলায় সমান জনপ্রিয় ও খ্যাতিমান। তাঁকে নাগরিক কবি, স্বাধীনতার কবি, মিথের কবি— এমন অনেক অভিধাই দেওয়া যায়। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান অবধি প্রতিটি জাতীয় আন্দোলনে তাঁর কবিতা আমাদের পথ দেখিয়েছে, যুগিয়েছে সাহস ও প্রেরণা। সাহিত্যের সব্যসাচী ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ এক বিস্ময়কর প্রতিভা। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তাঁর ছিলো সাবলীল সন্তরণ। কবিতা, নাটক, ছোটোগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এমনকি শিশুসাহিত্যেও নজর দিতে ভুলেননি। হরিপদ দত্ত আধুনিক কথাসাহিত্যের এক অতি উজ্জ্বল নক্ষত্র। অনুবাদ সাহিত্যে হুমায়ূন কবীর দিন দিন ছড়িয়ে দিচ্ছেন আপন ঔজ্জ্বল্য। তবে কবি শামসুর রাহমান ও কবি আলাউদ্দিন আল আজাদের পর নরসিংদীর সাহিত্যাকাশে তেমন দ্যুতিমান কবি-লেখকের আবির্ভাব হয়নি, তবু যাঁরা বর্তমানে নরসিংদীর আধুনিক সাহিত্যকে মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত করে যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে কবি দ্রাবিড় সৈকত, হাসনাইন হীরা, মাসুদ পথিক, স্নিগ্ধা বাউল, মহসিন খোন্দকার, সুমন ইউসুফ, রফিকুল নাজিম, মাহবুবুল আলম কনক, আখতার জামান, রিপন ইউসুফ, মনোয়ারা স্মৃতি ও দয়াল ফারুকের নাম অতি উজ্জ্বল। পাশাপাশি ছড়াসাহিত্যেও নরসিংদীতে বেশ কয়েকজন মেধাবী মুখ রয়েছে, তাঁদের মধ্যে ছড়াকার আবু আসাদ (প্রয়াত), এমদাদুল ইসলাম খোকন, মহসিন খোন্দকার ও ফজলুল হক মিলন প্রমুখ অন্যতম।

নরসিংদী শিল্প কল-কারখানার শহর। অনেকেই বলে থাকেন, লোহা-লক্কড়ের সাথে কবিতা যায় না, সাহিত্য বেমানান। কথাটি পুরোপুরি অসত্য নয়। তবে মূল সমস্যা এখানে নয়, মূল সমস্যা হলো মানুষের অধিক মাত্রায় মুদ্রামোহগ্রস্ততা। মুদ্রাকেন্দ্রিক জীবনযাপন ও প্রাচুর্যে মহাসুখ অনুভব করা।

কবি শামসুর রাহমান ও কবি আলাউদ্দিন আল আজাদের পর নরসিংদীর সাহিত্যাঙ্গন অনেকটা খা খা বিরানভূমি। প্রায় ত্রিশ লক্ষ জন-অধ্যুষিত এই জনপদে কম-বেশি ৩০০ জন কবি লেখক আছেন। অর্থাৎ দশ হাজারে একজন। সংখ্যা যা-ই হোক, আপত্তি নেই। কিন্তু এখানে কবি আছেন, কবিতা নেই। সাহিত্যিক আছেন, কিন্তু সাহিত্য নেই। জানি, এই কথায় অনেকে বেশ কষ্ট পাবেন। তবে অবস্থা ঠিক এমনই। হাতে গোনা কয়েকজনের কথা বাদ দিলে বাকিরা যার যার মতো লিখছেন। তাঁদের লেখার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। যাঁদের লেখা ঠিক সাহিত্য হয়ে ওঠেনি, এজন্যে তাদের সরাসরি দোষ দেয়া যায় না। সাহিত্যচর্চার জন্যে যে পরিবেশ-পরিস্থিতি দরকার, যে বলয় ব্যাপ্তি দরকার, আমাদের নরসিংদীতে এসবের খুবই অভাব। ষাট সত্তরের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে সাহিত্যচর্চার বলয় কেন্দ্র গড়ে ওঠেছিলো ঢাকার সদরঘাটের বিউটি বোর্ডিংকে কেন্দ্র করে। স্বাধীনতার পর আশির দশকে সেটি চলে আসে ঢাকার শাহবাগে। বর্তমানে এটি আরো বিস্তৃতি লাভ করে বাংলাবাজার, কাঁটাবন ও পাঠকসমাবেশে স্থান নিয়েছে। নরসিংদীতে সাহিত্যচর্চার তেমন সুন্দর কোনো বলয় কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। হালে নরসিংদীর খালপাড়ের বই-পুস্তক, গঙ্গাঋদ্ধি পত্রিকা, প্রগতি লেখক সংঘ, পরিশীলন সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ, নরসিংদী কবি সংসদ, নরসিংদী কবি-লেখক পরিষদ ও বেশ কিছু ফেসবুকভিত্তিক সাহিত্যচর্চা সংগঠন গড়ে ওঠেছে।

সাহিত্যচর্চার জন্যে দরকার স্থিরতা, দৃঢ়তা ও ভাবগাম্ভীর্যতা। কিন্তু মানুষ ও সমাজ এখন তুমুল অস্থির। সবাই ছুটছে যার যার মতো। কারো জন্যে কারো অপেক্ষা করার ফুরসত নেই। মানুষ ছোটো হতে হতে অতি ছোটো হয়ে ঢুকে গেছে একান্ত নিজের ভেতর। সমাজভাবনা, রাষ্ট্রভাবনা, সাহিত্যচর্চা অনেকের কাছে সময়ের অপচয় মনে হয়, বেশতি কাজ মনে হয়। অনেকেই বলে থাকেন, লেখালেখির কোনো শিক্ষক নেই। আমার দৃষ্টিতে লেখালেখির শিক্ষক হলো সাথের লেখক, সাথের কবি ও বোদ্ধা পাঠক। কবির সাথে কবির আড্ডা না হলে, লেখকের সাথে লেখকের কথা না হলে, শিল্পীর সাথে শিল্পীর দেখা না হলে সাহিত্য শাণিত হয় না, পরিশীলিত হয় না। প্রকৃত লেখককে সাধারণ মানুষের ও তাদের যাপিত জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভ্রমণ-পরিভ্রমণ করতে হয়। মানুষের জীবনগভীরে ডুব না দিয়ে জীবনঘনিষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি করা অসম্ভব। পদ্মার পাড়ে না গিয়ে শুধু বুদ্ধির নাড়াচাড়ায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ লেখেননি। এসব লিখতে গিয়ে নিশ্চয় তিনি পদ্মাপাড়ের মানুষের যাপিত জীবনকে হৃদয়ে গভীরভাবে ধারণ করেছিলেন। সত্যজিৎ রায় যে ‘পথের পাঁচালি’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, নিশ্চয় তিনি বিশতলার এসিকক্ষে বসে বানাননি। চলচ্চিত্রটির পরিবেশ-পরিস্থিতি, আবেশ-অনুভূতি নিশ্চয় হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন।

আজকাল অনেক কবি-লেখকই বসবাস করেন শহরের সুরম্য অট্টালিকায়, প্রাচুর্যপূর্ণ জীবনযাপন করেন। তাঁরা কখনো শ্রমিকের ঘর্মাক্ত শরীর দেখেন না, কৃষকের চাষাবাদ দেখেন না, জেলেদের জীবন দেখেন না, রোদ-বৃষ্টি দেখেন না, নিবিড়ভাবে ভুখা-নাঙ্গাদের জীবন-সংগ্রাম না দেখেই তাঁদেরকে নিয়ে কাব্যের ফুলঝুরি ছড়ান, সাহিত্য বানান— এটা সম্পূর্ণ ভাওতাবাজি। এক্ষেত্রে তাঁরা যতো ভালো লিখুক না কেন, কোথাও না কোথাও ফাঁক থেকে যাবে। এভাবে যাঁরা এগোচ্ছেন, আমার দৃষ্টিতে তারা কবি না, কবি সাজেন, তারা লেখক না, লেখক সাজেন। তাঁরা অনেকটা পোশাকি, খোলসজাত, সাহিত্যের ভাড়াটে, হৃদয়ে সাহিত্য নেই, প্রাণে মানুষ নেই, সাহিত্যের নাম ভাঙিয়ে চলেন। ঘন ঘন পদক নেন। যেনতেনভাবে নিজের শরীরে কবি-লেখক তকমা লাগান, তারপর বনে যান তথাকথিত বুদ্ধিজীবী। এসবের কারণেও আমাদের প্রকৃত সাহিত্যসেবী মাঠে মারা যাচ্ছে।


মহসিন খোন্দকার
সাধারণ সম্পাদক, প্রগতি লেখক সংঘ, নরসিংদী

শিল্পী ফণী দাস স্মরণে : তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম

0

ফণী দাস শুভ্র ও সুন্দরের এক মহান রূপকার। নরসিংদীর শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চায় আজ যেই সুকুমার জগত তৈরি হয়েছে, তার রূপকারদের মধ্যে ফণী দাস অন্যতম। নরসিংদী চারুভাস্কর্য শিল্পে তিনি রেখেছেন বিরল অবদান। তাঁর ছবি আঁকার বিশাল জগত জুড়ে ছিলো বাংলাদেশ, প্রকৃতি ও মুক্তিযুদ্ধ। তিনি ছবি আঁকতেন তেলরঙ, জলরঙ, পেন্সিল ও কালি-কলমে। তাঁর কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন শিল্পকলা পদক, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন পদক, নবধারা কণ্ঠশীলন পদক, নরসিংদী পৌরসভা কর্তৃক সম্মাননা পদক, বৈশাখী একাডেমি কর্তৃক সম্মাননা পদক, যুগান্তর-স্বজন সমাবেশ পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত একাত্ম ছিলেন শিল্পের সাধনায়।

ফণী ভূষণ দাসের জন্ম ১৩ জানুয়ারি ১৯৫৩, নরসিংদী জেলা সদরের টেকপাড়া (পূর্ব দত্তপাড়া) গ্রামে। তাঁর বাবার নাম গোবিন্দ চন্দ্র দাস, মায়ের নাম প্রেমদা দাস, স্ত্রীর নাম রুমা দাস, ছেলে মাইকেল দাস রনি, মেয়ে নীলা দাস সুইটি। তিনি নরসিংদী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে এসএসসি এবং নরসিংদী কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে এইচএসসি পাশ করেন। তিনি ঢাকা আর্ট কলেজ (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) থেকে ১৯৭৬ সালে বিএফএ স্নাতক এবং পরে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিল্পী কামরুল হাসান, শিল্পী রফিকুন নবী, স্থপতি শামীম শিকদারের মতো শিক্ষকের প্রিয় ছাত্র ছিলেন। এছাড়া তিনি কলকাতা আর্ট কলেজের কয়েকজন বিখ্যাত শিক্ষকের কাছ থেকে চারু ও ভাস্কর্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

শিবপুরের ইটাখোলায় শহীদ মিনারের কাছে নিহত পুলিশ সদস্যদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ, তাঁতশিল্প নগরী মাধবদীতে তাঁতশিল্পের উপর তাঁত ও মাকু দিয়ে ম্যানচেস্টার চত্বর নির্মাণ করেন। তাছাড়া নরসিংদী ও নরসিংদীর বাইরে ৩০-৩৫ টি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ফণী দাসের ভাস্কর্যের কারণে নরসিংদী পৌরসভা বাংলাদেশে নান্দনিক ভাস্কর্যের শহর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

ফণী দাস ছিলেন আমাদের সময়ের বর্ণাঢ্য, উজ্জ্বল, বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব। কালের স্বাক্ষী হয়ে নানাভাবে দেখেছেন জীবন ও কর্মকে। অলোকিত ও শাণিত করার চেষ্টা করেছেন চারপাশের সবাইকে। গত ১৪ এপ্রিল ২০২৪ (রবিবার), ১৪৩১ বঙ্গাব্দের প্রথম দিনে আমাদের কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। ফণী দাসের পুরো জীবন ছিলো সংগ্রামমুখর। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে অনেক সংগ্রাম করে লেখাপড়া করেছেন। লেখাপড়ার খরচ জোগাতে লেখাপড়ার পাশাপাশি টিউশনি করেছেন। ছবি এঁকেও কিছু আয়-রোজগার করেছেন। লেখাপড়া শেষ করে পরিবারের হাল ধরতে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি সুদীর্ঘকাল ইউ-এম-সি আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে ২০১০ সালে অবসর গ্রহণ করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি নরসিংদী শিল্পকলা একাডেমিতে তবলার প্রশিক্ষক হিসেবে চাকুরি করেন। তাঁর পুরো পরিবারই শিল্পী পরিবার। তিনি নিজে ভালো গান গাইতে পারতেন, লিখতে পারতেন, সুর করতে পারতেন। তাঁর ছোটো দুই বোন— শিপালী, দিপালী ও স্ত্রী রুমা দাস বাংলাদেশ রেডিও ও টিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী। স্বাধীনতার পর নরসিংদীতে এমন একটা সময় ছিলো, যখন ফণী দাসের পরিবার ছাড়া কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই হতো না। তাঁর একমাত্র ছেলে রনি মাধবদী গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের ইংরেজির শিক্ষক। একমাত্র মেয়ে আমেরিকার নাগরিক। গত বছরের জুন মাসে তাঁর বাবা-মাকে আমেরিকা নিয়ে যাবার কথা ছিলো। তাঁদের ভিসাও হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তার আগেই তিনি স্থায়ী ভিসা নিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।

ফণী দা’ আমার খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন, কাছের মানুষ ছিলেন, আত্মার মানুষ ছিলেন। বয়সে আমার থেকে অনেক বড়ো হলেও আমরা মিশেছি বন্ধুর মতো। গান, কবিতা, নাটক, দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে আমরা আলাপ করতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান নিয়ে তাঁর মধ্যে অনেক হতাশা ছিলো। তারপরও বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদী ছিলেন। ফণী দা’ ছিলেন রাজনীতি সচেতন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রগতিশীল মানুষ। এতো বড়ো একজন শিল্পী, কিন্তু তাঁর মধ্যে কোনো অহঙ্কার ছিলো না। চলাফেরা করতেন অতি সাধারণ মানুষের মতো। সমাজের সব মানুষের সাথে মিশতেন।

ফণী দা’র সাথে আমার পরিচয় ও চলাফেরা প্রায় দীর্ঘ ৩৫-৪০ বছর যাবত। প্রথম পরিচয়ের পর থেকে তাঁকে যেমন দেখেছি, মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত তেমনই দেখেছি। তিনি ছিলেন চিরতরুণ। ছোটোখাটো গড়নের মানুষ, সব সময় পরিষ্কার-পরিপাটি জামা-কাপড় পড়তেন, ক্লিনশেভ হয়ে থাকতেন। তিনি ছিলেন মৃদুভাষী, আস্তে আস্তে কথা বলতেন, খুব কম কথা বলতেন। সব সময় তাঁর মুখে হাসি লেগে থাকতো। পান-সিগারেটের প্রতি তাঁর আসক্তি ছিলো না। কিন্তু চা পান করতেন ঘন ঘন। এমনও হয়েছে, কাজের চাপে শুধু চা পান করে সারাদিন কাটিয়ে দিয়েছেন। ফণী দা’কে যখন প্রশ্ন করতাম, আচ্ছা দাদা, সেই ছোটোবেলায় আপনাকে যেমন দেখেছি, এখনো তেমনই আছেন কেমন করে? ফণী দা’ মুচকি মুচকি হাসতেন, কোনো উত্তর দিতেন না। আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আমার ভালোবাসা তুমি’ এবং দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনকে নিয়ে লেখা ‘তোমার মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দিয়েছে’। কাব্যগ্রন্থ দুটির কবিতার সাথে মিল রেখে কবিতার মধ্যে চমৎকার ইলাস্ট্রেশন করে দিয়েছেন। তাঁর এই ইলাস্ট্রেশনের কারণে বই দুইটি অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। নরসিংদীর সবচাইতে প্রাচীন সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘স্বরলিপি’ শিল্পীগোষ্ঠীর তিনি আমৃত্যু সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর সভাপতি ছিলেন অভিনেতা খালেকুজ্জামান ও সাবেক সচিব মুক্তিযোদ্ধা সামসুজ্জামান ভাই। স্বরলিপির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা হাবিব ভাই, আমিরুল ভাই, আসাদুজ্জামান খোকন, সরকার সগীর আহম্মেদ, বিদ্যুৎ ভৌমিক, শ্রীধাম কর্মকার, টিপু সুলতান, রতন ধর, সন্তোষ দা’, দিলীপ দা’, রুমা দাস, শিপালী, দিপালী, আকলিমা আক্তার, চিত্রা বিশ্বাস প্রমুখ। এই সংগঠনের নানা কর্মকাণ্ডে ফণী দা’র সাথে আমি জড়িত ছিলাম। তিনি অঙ্গীকার একাডেমি নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা গান গাওয়া শিখতো, ছবি আঁকা শিখতো, তবলা বাজানো শিখতো। নরসিংদীতে ফণী দা’ কিছু অসাধারণ শিল্পকর্ম নির্মাণ করেছেন, যা আজো নরসিংদীর ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঐতিহ্যবাহী সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশনের শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে ফণী দা’ রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে কর্কশিট, বাঁশ, কাঠ দিয়ে নানা রকম কারুকার্যময় শিল্পকর্ম করে একটা শতবর্ষী নান্দনিক মঞ্চ তৈরি করে নরসিংদীর মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু এই মঞ্চ দেখার জন্যে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভীড় করতেন। শতবর্ষী অনুষ্ঠানে তিনি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার ললিতমোহন রায়ের একটা ছেঁড়া, পুরাতন সাদা-কালো ছবি থেকে অসাধারণ সুন্দর একটি ছবি আঁকেন, যা এখন নরসিংদীর ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। সাটিরপাড়া স্কুলের সামনের দেয়ালে তিনি কিছু দৃষ্টিনন্দন টেরাকোটা শিল্পকর্মের কাজ করেছেন। তার মধ্যে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, জাতীয় পাখি দোয়েল, জাতীয় ফুল শাপলা, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ললিতমোহন রায়ের ছবি ইত্যাদি অন্যতম।

বিশ-তিরিশ বছর আগে বাংলাদেশের মুদ্রণশিল্প তেমন আধুনিক ছিলো না। নির্বাচন এলে শিল্পীরা কাপড়ে লিখে ছবি এঁকে ব্যানার বানাতেন। ফণী দা’কে দেখতাম কী চমৎকার করে হারিকেনের ভেতর প্রার্থীর ছবি রেখে মোমবাতির আলোয় প্রার্থীর ছবি এঁকে বড়ো বড়ো তোরণ নির্মাণ করতেন। মানুষ ভীড় করে এসব তোরণ ও ছবি দেখতো।

নরসিংদী সরকারি কলেজের শহীদ মিনারের সাথে ফণী দাসের ইতিহাসও জড়িয়ে আছে। প্রতি বছর একুশ এলেই প্রণব স্যার, মোহাম্মদ আলী স্যার, মোস্তাফা স্যার ফণী দাসকে কলেজে ডেকে আনতেন। তিনি কাপড়ের ক্যানভাসে ভাষা আন্দোলনের নানা রকম ছবি এঁকে, পোস্টার লিখে চারপাশ নান্দনিকভাবে সাজিয়ে তুলতেন। তাঁর ক্যানভাসে আঁকা ছবি, দেয়ালচিত্র, দেয়ালে লেখা কবিতার লাইন, আল্পনা দেখতে ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ মানুষেরা ভীড় করতো। নরসিংদী কলেজের শহীদ মিনার ছিলো তখন নরসিংদীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে নরসিংদী শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্লাব, অফিস-আদালত থেকে হাজার হাজার মানুষ এখানে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করতে আসতেন। একুশের প্রথম প্রহর থেকে সকাল পর্যন্ত আবৃত্তি, নাটক, গানসহ নানা রকম আয়োজন থাকতো। বিশেষ করে, ফণী দাসের শিল্পকর্মের কারণে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একুশের এক অনন্য আবহ তৈরি হতো।

নরসিংদীর বিখ্যাত চারুশিল্পী ফণী দাস নরসিংদীর প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের কল্যাণে পরিচিত হয়ে ওঠেন ভাস্কর হিসেবে। লোকমান হোসেন ফণী দাসকে দিয়ে নরসিংদী পৌরসভার সামনে তিন রাস্তার মোড়ে প্রথম ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ’ নির্মাণ করান। এই কাজের ঠিকাদার ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মনিরুজ্জামান ভাইয়ের প্রতিষ্ঠান। স্তম্ভটি উদ্বোধনের সময় উদ্বোধনী ফলকে প্রতিষ্ঠানের নাম ছিলো, কিন্তু শিল্পী হিসেবে ফণী দাসের নাম ছিলো না। এতে ফণী দাস খুব মনোকষ্টে ছিলেন। কিছুদিন পর আমি, ফণী দা’, রুমা বৌদি মেয়র লোকমান হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে অনুরোধ করি ভাস্কর্যের নামফলকে শিল্পীর নাম সংযোজন করতে। আমরা মেয়রকে বোঝাতে সক্ষম হই যে, কিছুদিন পর হয়তো ফণী দাস থাকবেন না, মেয়র লোকমান হোসেন থাকবেন না, কিন্তু এই ভাস্কর্য থাকবে। ভাস্কর্যে ফণী দাসের নাম থাকলে তা পরবর্তী প্রজন্ম জানবে এবং এই ভাস্কর্যের মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন। লোকমান হোসেন পরে ভাস্কর্যের নিচে আরেকটা নামফলক তৈরি করে ভাস্কর্য শিল্পী হিসেবে ফণী দাসের নাম সংযুক্ত করে দেন। এরপরে আর ফণী দাসকে এসব নিয়ে ভাবতে হয়নি। লোকমান হোসেন ফণী দাসকে দিয়ে একে একে শিক্ষা চত্বর, গোলাপ চত্বর, শাপলা চত্বর, রজনীগন্ধা চত্বর, ফোয়ারা চত্বর নির্মাণ করান। লোকমান হোসেনের মৃত্যুর পর তাঁর ছোটো ভাই মেয়র কামরুজ্জামানও ফণী দাসকে দিয়ে দোয়েল চত্বর, লোকমান হোসেনের সমাধি সৌধ নির্মাণ করান। শিবপুরের ইটাখোলায় শহীদ মিনারের কাছে নিহত পুলিশ সদস্যদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ, তাঁতশিল্প নগরী মাধবদীতে তাঁতশিল্পের উপর তাঁত ও মাকু দিয়ে ম্যানচেস্টার চত্বর নির্মাণ করেন। তাছাড়া নরসিংদী ও নরসিংদীর বাইরে ৩০-৩৫ টি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ফণী দাসের ভাস্কর্যের কারণে নরসিংদী পৌরসভা বাংলাদেশে নান্দনিক ভাস্কর্যের শহর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

১১ আগস্ট ২০১০ সালে স্থাপিত ভাস্কর্য ‘শিক্ষা চত্বর’
১৬ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে মাধবদীতে নির্মিত ‘ম্যানচেস্টার চত্বর’

তিনি ২০১০ সালে বাংলাভিশন টেলিভিশনে ‘আমার আমি’ অনুষ্ঠানে এবং ২০১৩ সালে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনে ‘ভোরের সকাল’ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অংশ নেন।

আমি ফণী দা’র সাথে সুদীর্ঘ ১২ বছর নরসিংদী পৌরসভার আয়োজনে অমর একুশে বইমেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছি। আমাদের সাথে বিচারক হিসেবে আরো ছিলেন কণ্ঠশিল্পী নাজির উদ্দিন আহম্মেদ ভাই। ফণী দা’ তাঁর দায়িত্বের প্রতি অত্যন্ত সচেতন ও নিষ্ঠাবান ছিলেন। প্রতিদিনই অনুষ্ঠান শুরুর আগে খাতা, কলম ও ডায়রি নিয়ে হাজির থাকতেন। অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাচ, গান, আবৃত্তি ও নাটকের সবকিছু ডায়রিতে নোট করে রাখতেন। নিরপেক্ষ বিচার করতেন। কারো অন্যায় অনুরোধ ও দাবির কাছে আপোষ করেননি।

ফণী দাস একজন স্বপ্নবাজ মানুষ ছিলেন। তাঁর অনেক স্বপ্নের কথা আমার সাথে শেয়ার করতেন। নতুন কোনো গান লিখলে সুর করে আমাকে শোনাতেন। খুব সুন্দর কণ্ঠ ছিলো তাঁর। উচ্চারণও ছিলো নিখুঁত। যেকোনো বিষয়ে তৎক্ষণাৎ গান লিখতে পারতেন। তাঁর একটি বড়ো স্বপ্ন ছিলো নিজের আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবি দিয়ে একটি প্রদর্শনী করার। ইতোমধ্যে অনেক ছবিও এঁকেছিলেন। আমাকে কিছু আঁকা ছবি দেখিয়েছেনও। তবলার প্রতি তাঁর একটা অন্য রকম আবেগ ছিলো। এ-আবেগ থেকে তবলার উপর একটা বই লেখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি। তাঁর লেখা গান নিয়ে তিনি একটি একক গানের অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিলেন। এক জীবনে মানুষ অনেক স্বপ্ন দেখে, তার বেশিরভাগই মানুষের অপূর্ণ থেকে যায়। ফণী দা’র দেখা স্বপ্ন তিনি পূরণ করতে না পারলেও আমাদের চোখে সেই স্বপ্ন তিনি এঁকে দিয়ে গেছেন। জানি না, এই স্বপ্নবাজ মানুষটি অদেখা ভুবনে কেমন আছেন। প্রার্থনা করি, যেখানে থাকুন, ভালো থাকুন, পরম করুণাময়ের করুণাধারায় সিক্ত থাকুন।


শাহ্ আলম
কবি ও নাট্যকার

প্রথিতযশা হোমিও চিকিৎসক ডা. চান মোহন মালাকার

0

নরসিংদী রেলস্টেশন সংলগ্ন খালপাড় থেকে ভেলানগর যাওয়ার রাস্তায় ব্রাহ্মন্দী গার্লস হাই স্কুল এন্ড কলেজের সামনেই মালাকার মোড়। মোড় ঘেঁষেই একতলা ভবনের উপরে সাইনবোর্ড ঝুলে আছে— ‘মালাকার হোমিও হল’। সকাল নয়টা বাজতেই রোগীদের ভীড় জমে ওঠে। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ— প্রায় সব বয়সী রোগীরাই এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। তবে বেশি সংখ্যক নারী ও শিশুরাই এখানে সেবা নিতে আসেন।

তৎসময়ে বসন্ত রোগের খুব প্রাদুর্ভাব দেখা দিতো। শীতের শেষে বসন্তের শুরুতে খুব প্রকট আকার ধারণ করতো, চারপাশে হু হু করে ছড়িয়ে পড়তো জলবসন্তের জীবাণু। নিম্ন শ্রেণির পেশাজীবীর মানুষ তখন অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে পারতেন না। তখনই ডা. চান মোহন মালাকার এই গরীব-অসহায়দের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতেন।

কালের পরিক্রমায় বদলে গেছে অনেক কিছুই। আজকের এই শহরের বুক চিরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট বিরাট সব বিল্ডিং, মার্কেট, শপিংমল, পরিবর্তিত হয়েছে রাস্তাঘাট। একটা সময় এসবের কিছুই ছিলো না, বলছি চল্লিশের দশকের কথা। এখানেই একটি টিনের ঘরে নিজ বাড়িতেই ডা. চান মোহন মালাকার শুরু করেছিলেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা। তাঁর জন্ম ২৮ অগ্রহায়ণ ১৩২৬ বঙ্গাব্দ। তিনি একজন ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান ছিলেন। তিনি সাটিরপাড়া কালী কুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন (বর্তমানে সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশন স্কুল এন্ড কলেজ)। তিনি যখন ক্লাশ নাইনে পড়তেন, তখন থেকেই হাতেখড়ি। ব্রাহ্মন্দীর তৎকালীন জমিদার জিতেন্দ্র কিশোর মৌলিকের পরিবার সেবামূলকভাবে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা প্রদান করতেন। গরীব-অসহায়দের সেখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হতো। তিনি সেখান থেকেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় হাতেখড়ি নেন। পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তান আমলে হোমিওপ্যাথিতে এইচএমবি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি নিজ বাড়িতেই এই চিকিৎসা শুরু করেন। তৎসময়ে বসন্ত রোগের খুব প্রাদুর্ভাব দেখা দিতো। শীতের শেষে বসন্তের শুরুতে খুব প্রকট আকার ধারণ করতো, চারপাশে হু হু করে ছড়িয়ে পড়তো জলবসন্তের জীবাণু। নিম্ন শ্রেণির পেশাজীবীর মানুষ তখন অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে পারতেন না। তখনই ডা. চান মোহন মালাকার এই গরীব-অসহায়দের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতেন। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে রোগীরা পায়ে হেঁটে, নৌকায় করে গ্রাম থেকে কাদামাটি পেরিয়ে এখানে আসতেন চিকিৎসার জন্যে। বেশিরভাগই নারী ও শিশু আসতো। শিশুরাই জলবসন্তে আক্রান্ত হতো বেশি। মায়েরা তাদের সন্তান নিয়ে সেই দূরের গ্রাম থেকে নদী পেরিয়ে পায়ে হেঁটে সন্তানের চিকিৎসার জন্যে এখানে আসতেন। তিনি কখনোই কারো কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিতেন না। যার যেমন সাধ্য ছিলো, তেমনই দিতেন। এছাড়াও তিনি যে-সকল মুমূর্ষু রোগীরা আসতে পারতো না, তাদেরকে বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতেন। এভাবেই মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে ডা. চান মোহন মালাকারের নাম। পুরো নরসিংদী জুড়েই ছড়িয়ে পড়ে তাঁর চিকিৎসা খ্যাতি। রোগীরা তাঁকে মালাকার ডাক্তার বলেই চিনতেন। দূর-দূরান্ত থেকে রোগীরা এসে মালাকার ডাক্তারের চেম্বার বা বাড়ির খোঁজ করতো। এভাবে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হতে থাকে মালাকার মোড়। অসংখ্য গুণের অধিকারী মহান হৃদয়ের এই মানুষটি ১৭ আশ্বিন ১৪০১ বঙ্গাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

ডা. চান মোহন মালাকারের ছয় সন্তান। তিন ছেলে এবং তিন মেয়ে। ছোটো ছেলে ডা. সঞ্জয় কুমার মালাকার। তিনিই এখন বাবার এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। তিনি জানান, “আমার বাবা ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় নিয়োজিত হোন। তখন কোনো দোকান ছিলো না, ফার্মেসির নাম ছিলো না, সাইনবোর্ড ছিলো না, বাড়িতে বসেই বাবা চিকিৎসাকার্য চালাতেন। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে রোগীরা আসতেন। তারপর সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছুর বদল হয়েছে। আইন কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। তখন ফার্মেসির নাম ও সাইনবোর্ড লাগানো হলো। আমি হোমিওপ্যাথিতে ডিএইচএমএস ডিগ্রি অর্জন করেছি। এখন আমাদের এখানে প্রতিদিনই ৭০-৮০ জন রোগী আসে।”

এছাড়াও কথা হয়েছে নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী স্যারের সঙ্গে। তিনি বলেন, “বাবু চান মোহন মালাকার একজন খ্যাতিসম্পন্ন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ও নিভৃতচারী সমাজসেবক ছিলেন। ডা. চান মোহন মালাকার দেশভাগ হওয়ার আগে থেকেই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করেন। তাঁর বড়ো ছেলে নারায়ণ মালাকার আমার বন্ধু ছিলো। আমরা একসাথে ব্রাহ্মন্দী বয়েজ স্কুলে পড়তাম। সেই সুবাদে তাঁদের বাসায় যাতায়াত ছিলো, তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তখন আমারও কোনো সমস্যা হলে তাঁর কাছ থেকে ঔষধ নিতাম। সকলের সাথেই খুব আন্তরিকতা ও নমনীয়তা বজায় রাখতেন। তাঁদের পুরো পরিবারটিই অসাম্প্রদায়িক ছিলো।”

নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তাফা মিয়া বলেন, “তৎকালীন সময়ে যে-ক’জন লোক সমাজে নেতৃত্ব দিতেন, তিনি তাদের মধ্যে একজন ছিলেন। তিনি সব সময়ই সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখতেন। তিনি সবথেকে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হিসেবে। তিনি নারীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে খুব সচেতন ছিলেন। তৎসময়ে নারীদের শিক্ষার খুব বেশি সুযোগ ছিলো না। তিনি সেটা উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি ব্রাহ্মন্দী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (এখন যেটা পরিবর্তিত হয়ে ব্রাহ্মন্দী গার্লস হাই স্কুল এন্ড কলেজ)-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। তৎকালীন চিনিশপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব জাহাদ আলী চেয়ারম্যান, ডা. চান মোহন মালাকার, সমসের ইঞ্জিনিয়ার, মধু ভূঁইয়া প্রমুখ সম্মিলিত চেষ্টায় এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।”

নরসিংদীতে বিলুপ্তির পথে পাট চাষ

0

ফাল্গুনের মাঝামাঝি (মার্চের প্রথম সপ্তাহ) থেকে পুরো চৈত্র মাস (এপ্রিলের মাঝামাঝি) পর্যন্ত চলে পাটের বীজ বপন। এই সময়টা ব্যস্ততার মধ্যেই কাটে কৃষকের। বীজ বপনের পর শুরু হয় পাটের চারার যত্ন, নিড়ানি দিয়ে ঘাস উপড়ে ফেলে চারা পাতলাকরণ করা হয়। কৃষকের হাতের ছোঁয়ায় পরম যত্নে বেড়ে ওঠে পাটের চারা। বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে যতোদূর চোখ যায়, পুরো গ্রীষ্মের মাঠ জুড়ে সবুজের সমারোহ, বাতাসে হেলেদুলে নেচে বেড়ায় পাট গাছ, এ যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার্থিব দৃশ্যপট। বর্ষার পানিতে আরো ফুলে-ফেঁপে ওঠে পাটের গাছ। চার মাস প্রতীক্ষার পর আষাঢ়ের পানিতে গাছ কেটে জাগ দিয়ে পচিয়ে কৃষক সংগ্রহ করেন পাট। সেই পাট রোদে শুকিয়ে কৃষকেরা ঘরে তুলে নেন। এ-সময় পাট বিক্রি করে বাড়তি আয় করেন কৃষক, যা দিয়ে পুরো বর্ষাটা কাটিয়ে আবার মাঠের ব্যস্ততায় ফিরে আসেন। এরকম চিত্রের দেখাই মিলতো এক যুগ আগের নরসিংদীর অধিকাংশ গ্রামে।

কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে সেসব সোনালি দিন। এখন আর বিস্তর ফসলের মাঠ জুড়ে দেখা মেলে না পাট ক্ষেতের। প্রতিনিয়ত পাট চাষে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন কৃষকেরা। বর্ষায় পর্যাপ্ত পানির অভাব, ভালো বীজের ঘাটতি, জমি চাষে খরচ বৃদ্ধি, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, বীজ ও সারের চড়া দাম— সব মিলিয়ে পাট চাষে গুণতে হয় বাড়তি খরচ।

কোনোরকমে খরচ উঠিয়ে, লাকড়ি হিসেবে পাটকাঠিই প্রাপ্য মুনাফা। কখনো কখনো পাটের ফলন কম হলে গুণতে হয় লোকসান। এসব কারণেই কৃষকেরা এখন পাট চাষে আগ্রহী না। প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে পাটের আবাদ।

রায়পুরা উপজেলার চর মধুয়ার কৃষক মোস্তফা মিয়া (৪৮) জানান, পাট চাষে এখন অনেক খরচ, পরিশ্রম বেশি, সেই অনুপাতে লাভ হয় না। তাই এখন শুধু লাকড়ির জন্যে অল্প পরিমাণ পাট চাষ করেন।

শিবপুর উপজেলার জাঙ্গালিয়ার কৃষক নূরু মিয়া (৫৯) জানান, আগে তিনি চার-পাঁচ বিঘা জমি পাট চাষ করতেন। এখন বর্ষায় তেমন পানি না হওয়ায় পাটের জাগ দিতে সমস্যা হয়। তাছাড়া ভালো বীজ পাওয়া যায় না, বেপারিরা পাটের দাম কম দেয়। পাট চাষ করে এখন আর লাভবান হওয়া যায় না। সেজন্যে এখন পাটচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

বিঘা প্রতি প্রায় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয় পাট চাষে। বিঘা প্রতি পাটের ফলন হয় ৫ থেকে ৬ মণ। বিপরীতে বাজারে পাটের দাম কম, ন্যায্য দামে পাট বিক্রি হয় না। বেপারির কাছে অল্প দামে বিক্রি করতে হচ্ছে পাট। গড়ে মণপ্রতি ১,৫০০ থেকে ২,০০০ টাকা পাওয়া যায়।

নরসিংদী সদরের নজরপুরের কৃষক সুলমান মিয়া (৫১) বলেন, “পাট চাষে এখন অনেক খরচ। আগে পাটের মণ বিক্রি করতাম আটশো থেকে এক হাজার টাকা, তখন শ্রমিকের মজুরি ছিলো দেড়শো-দুইশো। আর এখন পাটের মণ দেড়-দুই হাজার, শ্রমিকের মজুরি ছয়-সাতশো। সব মিলায়া খরচ অনেক বেশি, বিক্রি করে লাভ আসে না।”

কোনোরকমে খরচ উঠিয়ে, লাকড়ি হিসেবে পাটকাঠিই প্রাপ্য মুনাফা। কখনো কখনো পাটের ফলন কম হলে গুণতে হয় লোকসান। এসব কারণেই কৃষকেরা এখন পাট চাষে আগ্রহী না। প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে পাটের আবাদ।

নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নরসিংদীতে পাট চাষ হয় ৪,৪১৪ হেক্টর জমিতে। পরবর্তীতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৩,০৪৩ হেক্টর জমিতে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এর পরিমাণ আরো কমে আবাদী জমির পরিমাণ হয় ২,৬৮৫ হেক্টর। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২,৮৭০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করা হয়। ২০১৩ সালের আগের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এক দশকেই পাটের চাষ কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। আনুমানিক দুই দশকে প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে পাট চাষ।

এ-বিষয়ে কথা হয় নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক সালাউদ্দিন টিপুর সাথে। তিনি বলেন, “পাটের জীবনকাল একটু বেশি, একশো বিশ থেকে একশো তিরিশ দিন। পাট চাষে কৃষকের নিরুৎসাহিত হওয়ার অন্যতম কারণ পাটের দাম, পাটের দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় কৃষকরা পাট চাষ করে লাভবান হচ্ছেন না। সেজন্য আমরা চেষ্টা করছি যে, সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে ধান ও গম ক্রয়ের সাথে যদি পাটও ক্রয় করে, তাহলে কৃষকরা পাটের বাজারমূল্য ভালো পাবে। এছাড়াও নরসিংদীতে যেসব পাটকল আছে, সেখানে আমরা যোগাযোগ করছি, তারা যেন কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি পাট ক্রয় করে। এই প্রক্রিয়াটা হয়ে গেলে কৃষকের আর বেপারির কাছে কম দামে পাট বিক্রি করতে হবে না। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, পাটের উন্নতমানের ভালো বীজ কৃষকরা সংগ্রহ করতে পারছেন না, ফলে পাটের ফলন কম হচ্ছে। সেজন্য আমরা কৃষকদের ট্রেনিং দিচ্ছি, উন্নতমানের বীজ দিয়ে পাট চাষে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছি।”

নরসিংদীতে বিলাতি ধনিয়া চাষ : সম্ভাবনার নতুন পথ

0

নরসিংদী শাক-সবজি উৎপাদনসহ বিভিন্ন কৃষিজাত ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখানকার সবজি পুরো দেশব্যপী বিপণন করা হয়। বিশেষ করে, শিবপুর, বেলাব ও রায়পুরা উপজেলায় প্রচুর সবজি উৎপাদিত হয়।

বিলাতি ধনিয়া বা বাংলা ধনিয়া, যার বৈজ্ঞানিক নাম Petroselinum Crispum। এটি একটি মশলা জাতীয় ফসল। চাসনি পাতা হিসেবেও এর পরিচিতি আছে। এর পাতা সবুজ, লম্বাকৃতির, চারপাশে করাতের দাঁতের মতো খাঁজ কাটা। প্রখর সুগন্ধিযুক্ত, পুষ্টিগুণসম্পন্ন ও উন্নত ভেষজগুণে সমৃদ্ধ। নরসিংদী জেলার বেলাব, শিবপুর ও রায়পুরা উপজেলার ছায়াযুক্ত পতিত জমিতে বিলাতি ধনিয়ার চাষাবাদ হয়ে থাকে। বিশেষ করে, বেলাব-শিবপুর উপজেলার উয়ারী, বটেশ্বর, উজলাবো, রাঙ্গারটেক, জয়নগরসহ বেশকিছু এলাকায় কৃষকেরা বাণিজ্যিকভাবে এর চাষাবাদ শুরু করেছেন। এই এলাকার মাটি খুবই উর্বর, রসালো, পানি নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা আছে এবং ছায়াযুক্ত পরিবেশ থাকায় এখানে বিলাতি ধনিয়ার ভালো চাষাবাদ হয়। পুরো এলাকা জুড়েই রয়েছে বিভিন্ন ফলের গাছ— আম, কাঁঠাল, লটকন ও বিভিন্ন রকমের গাছপালা। এতো এতো গাছপালা থাকার ফলে জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ছায়া পড়ে। এসবকিছু মিলিয়ে এখানকার ভূমি এই ফসল উৎপাদনের জন্যে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে।

কৃষকেরা প্রথমে তিন-চারবার ভালো করে জমি চষে, মাটি ভেঙে ঝুরঝুরে করে, জমিতে পরিমাণমতো গোবর ও রাসায়নিক সার দিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে নেয়। তারপর জমিতে সেচের পানি দিয়ে মাটি রসালো করে বীজ বোনে। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস (মধ্য কার্তিক থেকে মধ্য ফাল্গুন) পর্যন্ত বীজ বোনা হয়। চারা গজানোর পর নিয়মিত নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে জমিতে সেচ প্রদান করা হয়, নির্দিষ্ট সময় পর পর ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করা হয়। চারা গজানোর ৪৫ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা হয়। গাছের নিচের দিকের বড়ো পাতাগুলো তুলে ডুবো পানিতে ধুয়ে আঁটি বেঁধে বিক্রির জন্যে প্রস্তুত করা হয়। প্রতিদিন বিকেলে কৃষকেরা পাতা তুলতে ব্যস্ত সময় পার করে। বিকেলে পাতা তুলে সন্ধ্যার মধ্যেই সমস্ত কাজ শেষ করে প্রস্তুতকৃত পাতা বিক্রি করে পরদিন সকালে। এভাবে পাতা তুললে দীর্ঘমেয়াদে নিয়মিত পাতা তোলা যায়।

আমার স্বামী চৌদ্দ গণ্ডা (একুশ শতক) জমিতে ধইন্যা লাগাইছেন। আমি প্রতিদিন বিকেলে পাতা তুলে ধুয়ে আঁটি বেঁধে দেই। অনেক পরিশ্রম লাগে। খরচ হইছে পঞ্চাশ হাজার টাকার বেশি। আশা করি, পাঁচ লাখ টাকার মতো বিক্রি করতে পারবো।

কৃষক লতিফ মিয়া (৫৫) বলেন, “বিলাতি ধনে চাষ করতে অনেক খাটুনি লাগে। নিয়মিত নিড়ানি দিতে হয়, জমিতে আগাছা হলে ফলন কম হয়।” তিনি আরো বলেন, “করতে পারলে লাভ আছে। খরচ কম, লাভ বেশি। গায়ে-গতরে খাটতে হয় বেশি। একবার লাগাইলে সারা বছর পাতা তোলা যায়।”

বটেশ্বরের কৃষক কফিল উদ্দীন খান (৪৮) জানান, “তিনি পাঁচ গণ্ডা (আট শতাংশ) জমি চাষ করেছেন। এখানে প্রায় বিশ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তিনি এখনো পর্যন্ত চল্লিশ হাজার টাকার পাতা বিক্রি করেছেন। পুরো সিজনে প্রায় দুই লাখ  টাকা বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন।”

প্রতি শতক জমি চাষাবাদ করতে ২,০০০-২,৫০০ টাকা খরচ হয়। আর পাতা সংগ্রহ করা যায় প্রায় ১৮০-২৫০ কেজি। প্রতি কেজি পাতা গড়ে ১০০-১২০ টাকা করে পাইকারি বিক্রি হয়। স্থানীয় বটেশ্বর বাজারে প্রতিদিন সকাল এগারোটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত হাট বসে। এখানে কৃষকের কাছ থেকে পাইকাররা পাতা কিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা ও বিভাগে আড়তদার এবং খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে। এছাড়াও মরজাল, বারৈচা ও শিবপুর বাজারে নিয়মিত কেনাবেচা হয়। বর্ষার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পূর্ণ উদ্যমে চলে এই কাজ। টানা দুই থেকে তিন মাস কৃষকেরা পাতা সংগ্রহ করতে পারেন। এছাড়াও বয়স্ক চারা থেকে বীজ সংগ্রহ করে সেই বীজ বিক্রি করেও আয় করা যায় বাড়তি টাকা।

কৃষক ফুলমতি (৫২) জানান, “আমার স্বামী চৌদ্দ গণ্ডা (একুশ শতক) জমিতে ধইন্যা লাগাইছেন। আমি প্রতিদিন বিকেলে পাতা তুলে ধুয়ে আঁটি বেঁধে দেই। অনেক পরিশ্রম লাগে। খরচ হইছে পঞ্চাশ হাজার টাকার বেশি। আশা করি, পাঁচ লাখ টাকার মতো বিক্রি করতে পারবো।”

এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে গাছপালা আছে। মাটির পুষ্টিগুণ খুবই ভালো, পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়, মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বেশি, পানি নিষ্কাশনের সুবিধা ভালো। অনেক গাছপালা, বাগান থাকার জন্যে পর্যাপ্ত ছায়া পাওয়া যায়। বিলাতি ধনে সরাসরি রোদে পড়লে পাতার কাঁটা শক্ত হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়। সেজন্যে আলাদা করে ছাউনির ব্যবস্থা করা লাগে। কিন্তু আমাদের এই অঞ্চলে এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। মাটির পুষ্টিগুণ ভালো হওয়ায় সার বেশি লাগে না। ফলে খরচ অনেকাংশে কমে যায় এবং উৎপাদন ভালো হয়। এই ফসল চাষে কৃষকের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অন্যান্য ফসল চাষে কৃষকদের বাড়তি রাসায়নিক সার ও মজুরির খরচ গুণতে হয়। বাড়ির আঙিনায়, বাগানের মধ্যে খালি জমি ইত্যাদি স্থানেই চাষ করা হয়। ফলে পরিবারের সকলে একসাথে হাত লাগিয়ে কাজ করতে পারে। কৃষকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বিলাতি ধনিয়া চাষে বিঘা প্রতি আনুমানিক খরচ ষাট থেকে সত্তর হাজার টাকা। আর ফসল সংগ্রহ করে বিক্রি করে আয় হবে আনুমানিক সাত থেকে আট লাখ টাকা। কৃষকের আরেকটু সচেতনতা ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সুনজর পড়লে আশা করা যায়, অন্যসব সবজির মতো এটিও হতে পারে একটি প্রধান অর্থকরী ফসল এবং এতে তৈরি হবে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার।

সাংবাদিকতার অগ্রদূত হাবিবুল্লাহ বাহার : প্রয়াণের ৩০ বছর

0

‘নরসিংদীর খবর’ ছিলো সাজানো-গোছানো এবং নিয়মিত প্রকাশনা। যার ফলে পত্রিকাটিকে নরসিংদীতে আধুনিক পত্রিকার পথিকৃৎ বলা হয়। অবশ্য হাবিবুল্লাহ বাহারের যোগ্যতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার গুণেই পত্রিকাটি সহজে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু বেশিদিন তিনি ‘নরসিংদী খবর’ পত্রিকাটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারেননি। মাত্র পাঁচ বছর পত্রিকাটির সম্পাদনায় যুক্ত থাকতে পেরেছিলেন। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে ১৯৯৫ সালের ২১ অক্টোবর তিনি পরলোকগমন করেন।

প্রবীণ সাংবাদিক হাবিবুল্লাহ বাহার (১৯৪৪-১৯৯৫) নরসিংদী অঞ্চলের সাংবাদিকতায় নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন। সেই জাগরণের মূল সূত্র ছিলো ‘সাপ্তাহিক নরসিংদীর খবর’ পত্রিকা। এর প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে স্থানীয় সাংবাদিকতার খোলনলচে পাল্টে দিয়েছিলেন তিনি। একসময় শহরের দু-চারজন মানুষ সাংবাদিকতা করতেন। কিন্তু ১৯৯০ সালে ‘নরসিংদীর খবর’ প্রকাশের মাধ্যমে সাংবাদিকতার ধারণাকে জেলা শহর থেকে থানা কিংবা ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন হাবিবুল্লাহ বাহার। প্রতিটি স্থানে সাংবাদিক কিংবা সংবাদের সোর্স নিয়োগ দিয়ে সংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের জগতে তিনি ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন। স্থানীয়ভাবে ‘নরসিংদীর খবর’ পত্রিকার আগেও কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিলো। সেগুলো ছিলো অনিয়মিত। কিন্তু ‘নরসিংদীর খবর’ ছিলো সাজানো-গোছানো এবং নিয়মিত প্রকাশনা। যার ফলে পত্রিকাটিকে নরসিংদীতে আধুনিক পত্রিকার পথিকৃৎ বলা হয়। অবশ্য হাবিবুল্লাহ বাহারের যোগ্যতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার গুণেই পত্রিকাটি সহজে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু বেশিদিন তিনি ‘নরসিংদী খবর’ পত্রিকাটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারেননি। মাত্র পাঁচ বছর পত্রিকাটির সম্পাদনায় যুক্ত থাকতে পেরেছিলেন। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে ১৯৯৫ সালের ২১ অক্টোবর তিনি পরলোকগমন করেন।

হাবিবুল্লাহ বাহার (১৯৪৪-১৯৯৫)

তাঁর মৃত্যুর পর অনেকেই ভেবেছিলো, হয়তো পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাবে। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক হলেও তারা তখনো শিশু। স্ত্রী সেতারা বেগম সরকারি চাকুরিতে থাকায় পত্রিকাটি চালানোর মতো সময় পাবেন কি না, সেটা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু এ-ধারণাকে অমূলক প্রমাণ করেছিলেন সেতারা বেগম। তিনি নরসিংদীর খবর পত্রিকাটিকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। সফলও হন। এখনো পর্যন্ত নরসিংদীর খবর জেলার একটি জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য পত্রিকার আসন দখল করে আছে।

হাবিবুল্লাহ বাহারের সঙ্গে আমার ছোটো একটি স্মৃতি রয়েছে। আমি তখন ঢাকায় জনপ্রিয় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে চাকুরি করি। একদিন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসে ভেলানগরস্থ ‘নরসিংদীর খবর’ পত্রিকার কার্যালয়ে যাই। সাংবাদিকতা ও লেখালেখি নিয়ে তাঁর সঙ্গে অনেক কথাবার্তা বলি। আপাদমস্তক একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন তিনি। সাম্যবাদের জন্যে আমৃত্যু রাজনীতি করে গেছেন। চলাফেরাও করতেন সাধারণ মানুষের মতো। তিনি আমাকে নরসিংদীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে প্রবন্ধ লেখার অনুরোধ করেন। আমি ঢাকা ফিরে প্রখ্যাত কবিয়াল হরিচরণ আচার্য্যকে নিয়ে একটি দীর্ঘ লেখা পাঠাই, যা হাবিবুল্লাহ বাহার অত্যন্ত যত্ন করে ছেপেছিলেন। পরে এই লেখাটি ত্রিপুরার আগরতলাস্থ ‘কবিগুণাকর হরিচরণ গবেষণাগার’ থেকে প্রকাশিত বইয়ে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছিলো।

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম মোস্তাফা মিয়া বলেন, “হাবিবুল্লাহ বাহার সাংবাদিক হিসেবে যতোটা না জনপ্রিয় ছিলেন, তার চেয়ে বেশি খ্যাতিমান ছিলেন ‘নরসিংদীর খবর’ প্রকাশ করে। পত্রিকাটি নরসিংদীর সাংবাদিকতার চরিত্র পাল্টে দিয়েছিলো। অনেক ভালো ভালো সাংবাদিকের জন্ম দিয়েছিলো পত্রিকাটি। এর নেপথ্য কারিগর ছিলেন কর্মযোগী হাবিবুল্লাহ বাহার।”

কথা প্রসঙ্গে গোলাম মোস্তাফা মিয়া আরো জানান, “একসময় নরসিংদীর সাংবাদিকতা ঝিমিয়ে পড়েছিলো। সেই ঝিমিয়ে পড়াদের মধ্যে হাবিবুল্লাহ বাহারও ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে একটি পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে সাংবাদিক সমাজকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। তিনি অকালে মারা না গেলে আরো অবদান রাখতে পারতেন। পরবর্তীতে নরসিংদীর খবরের হাল ধরেছিলেন তাঁর সুযোগ্য স্ত্রী সেতারা বেগম। এখনো তিনি পত্রিকাটি এগিয়ে নেয়ার জন্যে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন।”

হাবিবুল্লাহ বাহার অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ছিলেন। তিনি মুখে যা বলতেন, যতো কষ্টই হোক, তা-ই করতেন। তিনি নিজে সম-সাময়িক বিষয়ের উপর সম্পাদকীয় লিখতেন। কখনো কপি করতেন না। এখনো পর্যন্ত হাবিবুল্লাহ বাহারের নীতি-রীতিই ধারণ করে আছে পত্রিকাটি।

হাবিবুল্লাহ বাহারের সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়েছিলো ঐতিহ্যবাহী ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার মাধ্যমে। তিনি প্রথমদিকে ‘সংবাদ’-এর ছাপাখানায় ছোটো একটি চাকরি নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সাংবাদিকতা আর লেখালেখির পোকা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। সহকর্মী ও ‘সংবাদ’-এর বর্ষীয়ান সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে থাকেন। এক পর্যায়ে জন্মস্থান নরসিংদীতে ফিরে আসেন। দৈনিক সংবাদের নরসিংদী সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। জেলার সর্বত্র সংবাদ সংগ্রহের জন্যে দাপিয়ে বেড়াতে থাকেন।

কর্মবীর ছিলেন তিনি। শুধু সংবাদ পত্রিকার সংবাদদাতার করিডোরে সীমাবদ্ধ থাকতে চাননি। জেলা প্রেস ক্লাবকে নতুন করে গড়ে তোলা এবং সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭২ সালে গড়ে ওঠা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বাবু ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর ও বাবু নিবারণ রায়। একই সাথে তাঁরা প্রথম সভাপতি ও প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দীর্ঘ ২২ বছর (১৯৭২-১৯৯৪) একাধারে নিবারণ রায় সাধারণ সম্পাদক থাকলেও ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর (১৯৭২-১৯৭৪) এবং স্বপন কুমার সাহা (১৯৭৪-১৯৭৫)-এর পর সভাপতি হন হাবিবুল্লাহ বাহার। দুই মেয়াদে (১৯৭৫-১৯৭৯ ও ১৯৮০-১৯৯২) প্রায় ১৬ বছর তিনি নরসিংদী প্রেস ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

সাংবাদিকতা ছাড়া হাবিবুল্লাহ বাহার ‘ন্যাপ (মোজাফফর)’ রাজনৈতিক দলের নিষ্ঠাবান নেতা ছিলেন। নরসিংদীর গৌরবময় কৃষক আন্দোলনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিলো। খেটে খাওয়া কৃষক-শ্রমিকদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যে তিনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। নরসিংদী সরকারি কলেজে পড়াশোনার সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

তাঁর জন্ম পলাশ থানার গয়েশপুর গ্রামে হলেও তিনি ভেলানগরস্থ নানার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতেন। পরবর্তীতে সেখানেই স্থায়ী হন। সেখানেই গড়ে তোলেন নরসিংদীর খবর পত্রিকার কার্যালয়। লেখক-সাংবাদিকদের মিলনমেলায় পরিণত হয় স্থানটি। প্রবীণ শিক্ষক ও সাংবাদিক হলধর সাহা জানান, নরসিংদীর খবর পত্রিকার শুরুতে এর সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। তাঁর মতো আরো অনেক সাংবাদিক, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যমণি ছিলেন হাবিবুল্লাহ বাহার। ব্যক্তিত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে অনেক মানুষের প্রিয় ছিলেন তিনি। নরসিংদীর খবর প্রকাশ করে তিনি নরসিংদীর সাংবাদিকতায় জোয়ার সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি পত্রিকা প্রকাশ না করলে হয়তো স্থানীয় সাংবাদিকতা অনেকটা পিছিয়েই থাকতো।

নরসিংদীর খবর পত্রিকায় কাজ করেছেন এমন একাধিক সাংবাদিক জানান, হাবিবুল্লাহ বাহার অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ছিলেন। তিনি মুখে যা বলতেন, যতো কষ্টই হোক, তা-ই করতেন। তিনি নিজে সম-সাময়িক বিষয়ের উপর সম্পাদকীয় লিখতেন। কখনো কপি করতেন না। এখনো পর্যন্ত হাবিবুল্লাহ বাহারের নীতি-রীতিই ধারণ করে আছে পত্রিকাটি। বর্তমান সম্পাদক অধ্যাপক সেতারা বেগমও প্রাক্তন সম্পাদকের নীতি অনুসরণ করে নিজ হাতে সম্পাদকীয় লিখে যাচ্ছেন। যে-কারণে নরসিংদীর খবর পত্রিকাটি স্থানীয়ভাবে তার সূচনালগ্ন থেকে এখনো পর্যন্ত প্রথম সারিতে রয়েছে। পত্রিকাটি পাঠকেরা পকেটের পয়সা খরচ করে কেনেন এবং পড়েন।
আজ নরসিংদীর খবর পত্রিকাটি যে-শক্ত খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেটার ভিত রচনা করে গেছেন হাবিবুল্লাহ বাহার। কঠোর পরিশ্রমী এই মানুষটি নানা পেশা, নানা অভিজ্ঞতা থেকে যে-জ্ঞান আহরণ করেছিলেন, সেসব সাংবাদিকতায় কাজে লাগিয়ে গেছেন। কখনো কো-অপারেটিভ, কখনো এনজিও কর্মী, কখনো সরকারি কলেজের কর্মকর্তা হিসেবে কিংবা ছাপাখানার কর্মী হিসেবে কাজ করে নিজের জীবন মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করে গেছেন।

প্রখ্যাত সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান সরদার তাঁর লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইয়ে হাবিবুল্লাহ বাহার ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে কিছু তথ্য উল্লেখ করেছেন। ১৯৭১ সালে শাহজাহান সরদার তাঁর মনোহরদীর বাড়ি থেকে ত্রিপুরায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে যাবার আগে হাবিবুল্লাহ বাহারের ভেলানগরস্থ বাসায় রাত্রিযাপন করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রখ্যাত ন্যাপ নেতা কামাল হায়দার ও নারায়ণগঞ্জ বারের আইনজীবী ওয়াজউদ্দিন। পরের দিন নরসিংদী থেকে লঞ্চে নবীনগর হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তাঁরা ত্রিপুরা গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। হাবিবুল্লাহ বাহারের পরিবার সম্পর্কে শাহজাহান সরদার উল্লেখ করেন, “গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে শিবপুর পৌঁছি দু’ঘণ্টায়। সেখান থেকে বাসে নরসিংদীর ভেলানগর। কামাল হায়দারও এখানে এলেন। বড় ভাই ন্যাপ নেতা, ছোট ভাই ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। এখানে আরো একজন এলেন, নারায়ণগঞ্জ বারের উকিল ও আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট ওয়াজউদ্দিন। রাতে তাঁদের বাসায় থাকি, হাবিবুল্লাহ বাহার ও শহীদুল্লাহ বাহারের বাবা বেঁচে নেই। বৃদ্ধ মা ও ছোট বোন, মা ও ছোট বোন শুধু বাসায়। ২৫ এপ্রিল সকালে দুই ভাই মা ও বোনের কাছ থেকে বিদায় নেন।”

রাজনৈতিক জীবনে হাবিবুল্লাহ বাহার ছিলেন সর্বহারা কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির ত্রাণকর্তা। ক্ষণস্থায়ী জীবনে বহু কালজয়ী কর্মের সঙ্গে জড়িয়ে অমর হয়ে আছেন তিনি। কিন্তু স্থানীয়ভাবে বড়ো অবহেলিত এই মানুষটি। তাঁর কোনো স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি নরসিংদী শহরের কোথাও। প্রবীণ সাংবাদিক, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও নরসিংদীর কোনো সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন তাঁকে স্মরণ করেন না। কিন্তু তাঁকে স্মরণ করা, তাঁর কর্ম ও জীবনকে জনসম্মুখে তুলে আনা প্রাজ্ঞ ও সচেতন মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হওয়া উচিত ছিলো।


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

স্থানীয় সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর

0

স্বাধীনতার পরপর নরসিংদী ঢাকা জেলার একটি ছোটো থানা শহর। সাংবাদিকদের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিককে নিয়ে ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর গড়ে তোলেন নরসিংদী প্রেস ক্লাব। সবাই মিলে প্রধান সাংবাদিক হিসেবে তাঁকেই সভাপতি নির্বাচিত করেন।

একজন নির্লোভ ও মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ ছিলেন ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর (১৯২৫-১৯৮৩)। এসব বিশেষণের প্রভাব পড়েছিলো তাঁর কর্মজীবনে— সাংবাদিকতায়। দিনের পর দিন অভুক্ত থেকেও মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিরসনে তিনি আপোষহীন কলমযোদ্ধা ছিলেন। পকেটে টাকা নেই, পেটে ভাত নেই— এমন দারিদ্র্য তাঁর পেশায় পিছুটান আনতে পারেনি। ঢাকার নিকটবর্তী নরসিংদী জনপদে ঘুরে ঘুরে মানুষের দুঃখ-কষ্ট আর সমস্যা খুঁজে বেরিয়েছেন আমৃত্যু। সেসব সংবাদপত্রে প্রকাশ করে সমাধানের পথ সুগম করে গেছেন।

নরসিংদীর এমন কোনো গ্রাম কিংবা দুর্গম এলাকা ছিলো না, যেখানকার মানুষ ঈশ্বর চন্দ্রের নাম জানতেন না। তবে তিনি ‘ঈশ্বর বাবু’ নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। গায়ে হাফ-হাতা তিন পকেটঅলা শার্ট আর লুঙি, পায়ে চটি চাপিয়ে ভোরবেলা বাসা থেকে বের হতেন। পকেটে কলম আর নোটবুক ছিলো সর্বদা তাঁর সঙ্গী। মানুষের সব সমস্যা নিজের মাথায় নিয়ে ঘুরতেন। কীভাবে রিপোর্ট লিখলে মানুষ সেটা থেকে মুক্তি পাবে, সেই চিন্তা-ভাবনায় মগ্ন থাকতেন। কখনো নিজের সমস্যার কথা ভাবেননি। কখনো প্রচণ্ড ক্ষিধেয় কাহিল হয়ে পকেটের কোণ হাতড়ে খুচরো পয়সা পেলেও তা দিয়ে ভাত কিংবা রুটি খাওয়া সম্ভব ছিলো না। অগত্যা সামান্য মুড়ি কিনে ক্ষুধা নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। এভাবে জীবন ধারণ করতে গিয়ে সংসার-ধর্ম করার কথা তাঁর মনেই আসেনি। অকৃতদার জীবন বেছে নিয়েছিলেন নির্বিঘ্নে সাংবাদিকতা পেশা চালিয়ে যাবার জন্যে।

পাকিস্তান আমলে ঈশ্বর বাবু যখন সাংবাদিকতা শুরু করেন, তখন নরসিংদী ছিলো ঢাকা জেলাধীন নারায়ণগঞ্জ মহকুমার একটি মফস্বল থানা শহর। এর পার্শ্ববর্তী থানাগুলো, যেমন : শিবপুর, রায়পুরা, মনোহরদী, পলাশ ও বেলাব অবশ্য তেমন উন্নত ছিলো না। এসব এলাকার লোকজন কেনাকাটা কিংবা চিকিৎসা নিতে নরসিংদী থানা শহরে আসতেন। পরবর্তীতে নরসিংদী হয়ে ওঠে এসব থানার কেন্দ্রস্থল। এর ধারাবাহিকতায় থানা শহরটি প্রথমে মহকুমা, পরে জেলা শহরে পরিণত হয়। নৌকাঘাটা শিবপুর থানাধীন লালমাটির সভ্যতা ঘেরা একটি গ্রামের নাম। সেই গ্রামের সূত্রধর পরিবারে ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন ঈশ্বর বাবু। তাঁর বাবার নাম শ্যামাচরণ সূত্রধর। বাল্যকাল সে-গ্রামেই কাটে। বাবা কাঠের কাজ (আসবাবপত্র, গৃহনির্মাণ ও নৌকা বানানো) করে জীবিকা  নির্বাহ করতেন। কিন্তু ছেলেকে তিনি সূত্রধর বা মিস্ত্রি বানাতে চাননি। এভাবে এইচএসসি পাশ করার পর আর উচ্চশিক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে। পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। কিন্তু তখন তাঁর মাথায় কাজ করছিলো অন্য এক চিন্তা। মওলানা ভাসানী, মাওলানা আকরম খাঁ, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সন্তোষ গুপ্ত প্রমুখের বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনে আকৃষ্ট হন ঈশ্বর বাবু। বিশেষ করে, মানিক মিয়ার আপোষহীন ও সাহসী সাংবাদিকতা তাঁর মনে গেঁথে যায়। তাই তিনি মাস্টারি ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতা পেশা গ্রহণে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু গ্রামে থেকে এ-ধরনের সাংবাদিকতা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়েই নরসিংদী চলে আসেন। এখানে নেই তাঁর আশ্রয়, নেই কোনো আত্মীয়-স্বজন। অনেকটা ভবঘুরে জীবন বেছে নেন। পেটে ভাত না থাকলেও চোখে-মুখে সাংবাদিক হওয়ার দীপ্ত আলোর রশ্নি ভাসতে থাকে। সফলও হন। তখন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ দেশের সবচে’ জনপ্রিয় পত্রিকা এবং সেটির ভূমিকা ছিলো দুঃসাহসিক। এর সঙ্গেই যুক্ত হলেন ঈশ্বর বাবু। নরসিংদীর সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এভাবে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত  ইত্তেফাকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু ঠুনকো একটি ঘটনায় ইত্তেফাকের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য দেখা দেয়। ছেড়ে দেন প্রিয় ইত্তেফাক। এরপর সংযোগ ঘটে সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘বাসস’-এর সঙ্গে। ১৯৮৩ সালের ১৬ অক্টোবর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাসসের সঙ্গে ছিলেন তিনি।

বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনে মহকুমা প্রশাসক, মন্ত্রী, সচিব কিংবা ডিসি-এসপিদের সান্নিধ্যে জীবন কাটালেও ব্যক্তিগত জীবন ছিলো অত্যন্ত সাদামাটা এবং দারিদ্র্যে নিমজ্জিত। এরপরও পকেটে দু-চারশো টাকা থাকলে রাজা হয়ে যেতেন। আশেপাশের মানুষজন কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের যত্ন করে খাওয়াতেন। পকেট খালি থাকলেও চুপ করে বসে থাকতেন। না খেয়ে থাকলেও কিছু বলতেন না। তখন একমুঠো মুড়ি কিংবা চিড়া খেয়ে জীবনধারণ করতেন।

ঈশ্বর বাবুর ঘনিষ্ঠ শিষ্য নিবারণ রায় জানান, অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন ঈশ্বর বাবু। কোনো চাহিদা ছিলো না। টাকা থাকলে খেতেন, না থাকলে উপোস থাকতেন। বসবাস করতেন নরসিংদী শহরের পশ্চিম কান্দাপাড়াস্থ বিধুভূষণ দাসের এক ছাপড়াঘরে। ভাড়া ২০-২৫ টাকা মাত্র। চিরকুমার এ-মানুষটির ঘর-সংসার ছিলো না সত্যি, কিন্তু তিনি পুরো নরসিংদীবাসীকে নিজের সংসার মনে করতেন। অসহায়-গরীব মানুষকে নিজের সন্তানতুল্য মনে করতেন। কখনো তিনি সম্পদের পেছনে ছোটেননি। নিজের এক টুকরো জমি বরাদ্দের জন্যে ডিসি-এসপিকে অনুরোধ করেননি।

বর্ষীয়ান সাংবাদিক নিবারণ বাবু আরো জানান, “১৯৭৪ সালে তিনি ইত্তেফাক ছেড়ে দিলেও তিনি আমাকে সে-পত্রিকার সাংবাদিক হিসাবে নিয়োগ দিতে অনেক চেষ্টা করেন। সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে অনুরোধ করেন, আমাকে নরসিংদী প্রতিনিধি করার জন্য। তাঁর কাছ থেকে হাতে-কলমে সাংবাদিকতা শিখি। এমন সৎ সাংবাদিক আমি জীবনে দেখিনি। অনেক সময় উপোস থেকে আমাদের বাসায় যেতেন। কখনো মুখ ফুটে কিছু বলতেন না। আমার মা অনেক সময় তাঁকে জোর করে খাওয়াতেন। তিনি সাংবাদিকতার জন্য  জীবন বিলিয়ে গেছেন। কিন্তু নিজে কোনো কিছু প্রত্যাশা করেননি। দুঃখজনক বিষয় হলো, নরসিংদীর মানুষ তথা সাংবাদিক সমাজ এ-মহান ব্যক্তিটিকে ভুলে গেছে।”

নরসিংদী প্রেস ক্লাব সূত্রে জানা গেছে, উক্ত প্রেস ক্লাবের জন্ম ১৯৭২ সালে। স্বাধীনতার পরপর নরসিংদী ঢাকা জেলার একটি ছোটো থানা শহর। সাংবাদিকদের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিককে নিয়ে ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর গড়ে তোলেন নরসিংদী প্রেস ক্লাব। সবাই মিলে প্রধান সাংবাদিক হিসেবে তাঁকেই সভাপতি নির্বাচিত করেন। সাধারণ সম্পাদক হন বাবু নিবারণ রায়। এভাবে পথচলা শুরু হয় নরসিংদী প্রেস ক্লাবের। এরপর উক্ত প্রেস ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এবং দূতাবাস কর্মকর্তা স্বপন কুমার সাহা, ‘নরসিংদীর খবর’-এর সম্পাদক হাবিবুল্লাহ বাহারের মতো বরেণ্য সাংবাদিকরা। তাছাড়া উক্ত প্রেস ক্লাবের সঙ্গে জড়িত অনেকেই পরবর্তী জীবনে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। বর্তমানে নরসিংদী প্রেস ক্লাব সাংবাদিকদেরকে বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়ে যাচ্ছে। নিজস্ব বহুতল ভবনে বসে সাংবাদিকেরা পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি আড্ডা ও পরামর্শ করছেন। অথচ এর গোড়াপত্তন করে গেছেন ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর।

ঈশ্বর বাবুর শেষ জীবনটা ছিলো সবচে’ মর্মান্তিক। অর্থকষ্টে সঠিক চিকিৎসা পর্যন্ত করতে পারনেনি। আত্মীয়-পরিজনবিহীন অবস্থায় ডায়বেটিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কঠোর নিয়ম-নীতি আর ব্যয়বহুল ঔষধের অভাবে মধ্যবয়সেই ঝরে পড়েছিলেন তিনি। শরীরে আঘাতজনিত কারণে তিনি গ্যাংগ্রিনে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ডায়বেটিস থাকায় সেটা সহজে সেরে ওঠছিলো না। একপর্যায়ে সে-আঘাত ভয়াবহ রূপ ধারণ করে অর্থের অভাবে। শিষ্য নিবারণ বাবু স্বউদ্যোগে গুরুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেন। কিন্তু অবস্থাটা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো যে, সেখান থেকে তাঁর অবস্থা ভালোর দিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৩ সালের ১৬ অক্টোবর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে মৃত্যুবরণ করেন। তখন তাঁর জন্যে চোখের পানি ফেলার মতো একজন সহকর্মী কিংবা আত্মীয়ও ছিলো না। সে-সময় লাশ গ্রহণ এবং সৎকারের লোক খুঁজে পাচ্ছিলো না মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ। অবশেষে নিবারণ বাবু এবং তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা’র প্রচেষ্টায় একটি ট্রাকে করে প্রবীণ সাংবাদিক ঈশ্বর বাবুর লাশ নরসিংদীতে আনা হয়। এবার বিপত্তি বাধলো হিন্দু ধর্ম অনুসারে তাঁর মুখাগ্নি নিয়ে। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী, একজন নিকটাত্মীয় কিংবা সন্তানকে এ-দায়িত্ব পালন করতে হয়। কিন্তু সেখানে এমন কেউ ছিলেন না। এগিয়ে এসে শিষ্য নিবারণ রায় গুরু ঈশ্বর বাবুকে মেঘনা নদীতীরবর্তী শ্মশানে নিয়ে সৎকার করলেন। মুখাগ্নি করলেন নিজ হাতে। এভাবে একজন সাংবাদিকের ট্র্যাজেডিপূর্ণ ইতিহাসের জন্ম হলো নরসিংদীতে।

তিনি যখন মারা যান, তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে তাঁর লাশ গ্রহণের জন্যে কোনো আত্মীয়-স্বজন পাওয়া যায়নি। শিষ্যদের প্রচেষ্টায় তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিলো। এরপর হঠাৎ করে এই অকৃতদার মানুষটির আত্মীয়-স্বজনের আবির্ভাব ঘটে। মূলত তারা ঈশ্বর বাবুর ব্যাংক-ব্যালেন্সের খোঁজ করতে এসেছিলেন।

এই ত্যাগী ও বড়ো সাংবাদিককে নিয়ে ছোটো একটি স্মৃতি রয়েছে আমার। আমি তখন জন্মস্থান দিলারপুরের ছঘরিয়া পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি, তৃতীয় শ্রেণিতে। সে-সময় এক প্রচণ্ড ঝড়ে স্কুলগৃহটি উড়ে যায়। ফলে খোলামাঠে ক্লাশ করতে হতো আমাদের। এর মধ্যে একদিন হেডমাস্টার স্যার ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বললেন, আগামীকাল সবাই ভালো কাপড়-চোপড় পরে আসবে। আমরা ধরে নিই, আগামীকাল হয়তো স্কুল পরিদর্শক আসবেন। কিন্তু পরদিন দেখা গেলো, একজন সাংবাদিক কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে হাজির হলেন। খোলা মাঠে ক্লাশ নেয়ার দৃশ্য ধারণ করে সাংবাদিক সাহেব চলে গেলেন। পরদিন দেখলাম, ইত্তেফাক পত্রিকায় সেই ছবিসহ একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে। সংবাদের শুরুতে ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর নামটি রয়েছে। হেডস্যার পত্রিকা বগলদাবা করে স্কুলে হাজির। এর কিছুদিন পর জানতে পারলাম, সংবাদটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই স্কুলগৃহের নির্মাণকাজ শুরু হয়ে যায়। কাঁচা ঘর পাকা ভবনে রূপ নেয়। ঘটনাটি আমার মনে বেশ দাগ কাটে। তাৎক্ষণিকভাবে সাংবাদিক ঈশ্বর বাবুকে আমার কাছে সংবাদের জাদুকর মনে হয়েছিলো। একটিমাত্র সংবাদে উড়ে যাওয়া স্কুলগৃহ পাকা দালানে পরিণত হয়েছে। তাঁর এই কীর্তিতে আমার মনে একটি প্রশ্ন উঠেছিলো, সাংবাদিকেরা আসলে কি মানুষ, না অন্য গ্রহের জীব? ঈশ্বর বাবুর এই জাদুকরী কাণ্ডের প্রভাব পরবর্তীতে আমার পেশাগত জীবনের উপর পড়ে। সাংবাদিক হওয়ার সুপ্ত বাসনা মনে অঙ্কুরিত হতে থাকে। ভিন্ন এক নায়কের আসন লাভ করেন ঈশ্বর বাবু।

এ-নায়কের আর্থিক অবস্থা জানতে পারি আরো অনেক পরে। আমি তখন একটি জাতীয় দৈনিকের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত। ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে নরসিংদী প্রেস ক্লাবে আড্ডাচ্ছলে ঈশ্বর বাবু সম্পর্কে খোঁজ-খবর করি। ইত্তেফাকের সাংবাদিক নিবারণ বাবু ছাড়া অন্যান্য সাংবাদিকেরা তাঁর সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য জানেন না। তাঁর ঘনিষ্ঠ অনেক সাংবাদিক মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেকে বয়োবৃদ্ধ অবস্থায় আছেন। তাই তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের বিস্তারিত উপাত্ত জানা সম্ভব হয়নি। টুকরো টুকরো স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে ঈশ্বর বাবুর মর্মান্তিক এক কাহিনি জানা গেলো। তিনি যখন মারা যান, তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে তাঁর লাশ গ্রহণের জন্যে কোনো আত্মীয়-স্বজন পাওয়া যায়নি। শিষ্যদের প্রচেষ্টায় তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিলো। এরপর হঠাৎ করে এই অকৃতদার মানুষটির আত্মীয়-স্বজনের আবির্ভাব ঘটে। মূলত তারা ঈশ্বর বাবুর ব্যাংক-ব্যালেন্সের খোঁজ করতে এসেছিলেন। নরসিংদীতে কোনো সহায়-সম্পত্তি কেনা আছে কি না, তা-ও জানতে চেষ্টা করেন। কিন্তু অনেক অনুসন্ধান করেও নগদ অর্থ কিংবা জমি-জমার কোনো হদিস করতে পারেননি। সোনালী ব্যাংকে একটি একাউন্টের সন্ধান পেলেও সেখানে কানাকড়িও সঞ্চিত ছিলো না। বাড়ি-ঘরের খোঁজ করে জানতে পারেন, তিনি বড়ো সাংবাদিক হয়েও ছোটো একটি ভাড়া করা খুঁপড়ি ঘরে থেকেছেন। ঈশ্বর বাবুর টাকা-পয়সা আর সম্পত্তির অনুসন্ধান করতে এসে তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের বরং কিছু গাঁটের পয়সা খরচ হলো।

নরসিংদী প্রেস ক্লাব, বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা ও জেলা প্রশাসকের দপ্তরে খোঁজ করে প্রয়াত সাংবাদিক ঈশ্বর বাবুর কোনো স্মৃতিচিহ্ন পাওয়া যায়নি। এমনকি তাঁর প্রতিষ্ঠিত নরসিংদী প্রেস ক্লাবেও কোনো স্মৃতি সংরক্ষিত নেই। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে প্রেস ক্লাবে ছবি টাঙানোর রেওয়াজ থাকলেও সেটা বাস্তবায়িত হয়নি। ক্লাবের একাধিক সদস্য জানান, ঈশ্বর বাবুর ছবি রাখতে কারো আপত্তি নেই। কিন্তু তাঁর ছবি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে তাঁর এবং প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নিবারণ রায়— দুজনের ছবিই প্রেস ক্লাবে সংরক্ষণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মাখন দাস বলেন, “ঈশ্বর বাবু আমাদের অনুকরণীয় ছিলেন। তিনি নিঃস্বার্থভাবে লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে সাংবাদিকতা করে গেছেন। মৃত্যুর সময় তাঁর নিজের এক টুকরো জমিও ছিলো না। ব্যাংকে এক পয়সাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই এই মহৎ সাংবাদিকের স্মৃতি রক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সভায় আলোচনা হয়েছে। অচিরেই ক্লাবের পক্ষ থেকে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হবে। সেখানে প্রয়াত সব সাংবাদিকদের ছবিসহ জীবনী অন্তর্ভুক্ত থাকবে।”

নরসিংদীর ইতিহাস এবং নরসিংদীর গুণীজন সম্পর্কিত বেশ কিছু বই-পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। সেখানেও ঈশ্বর বাবু বেশ অবহেলিত। কোনো কোনো গ্রন্থে তাঁর নাম পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়নি। কোনো বইয়ের পাতায় বেশ দীনতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে দু-চার লাইন ব্যয় করা হয়েছে। এর মধ্যে শফিকুল আসগরের ‘নরসিংদীর ইতিহাস’ গ্রন্থে সাড়ে পাঁচ লাইনের বিবরণ দেয়া হলেও এতে কিছু তথ্যবিভ্রাট রয়েছে। তিনি ১৯৮৩ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে মৃত্যুবরণ করলেও সে-বইয়ে তাঁর মৃত্যুর সাল ১৯৮৫ সাল উল্লেখ করা হয়। মৃত্যুস্থান নরসিংদী শহর বলা হয়। তবে সরকার আবুল কালামের লেখা ‘নরসিংদীর গুণীজন’ বইয়ে ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধরের একটি স্কেচ দেয়া হয়েছে। জানতে পারি, কোনো-এক পত্রিকায় ছাপা হওয়া ঈশ্বর বাবুর অস্পষ্ট একটি ছবি থেকে স্কেচটি করানো হয়েছিলো। বইটিতে ঈশ্বর বাবুকে যথার্থ চারণ সাংবাদিক হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, “নরসিংদী যখন থানা, সাংবাদিক শব্দটিও বোধহয় সে সময় সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত ছিলো না, সে সময় তিনি সাদা হাফশার্ট আর লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়াতেন সংবাদের নেশায়। …চিরকুমার এ-চারণ সাংবাদিক দীর্ঘরোগ ভোগ করে চরম অবহেলা আর অবজ্ঞায় জীবনের শেষ সময় অতিবাহিত করেন।”

নরসিংদীর সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক গোলাম মোস্তাফা মিয়া ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর সম্পর্কে বলেন, “একজন খাঁটি চারণ সাংবাদিক বলতে যা বোঝায়, সেটা ছিলেন ঈশ্বর বাবু। তিনি হয়তো মোনাজাত উদ্দিনের মতো এতো ব্যাপকতা এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেননি, কিন্তু নরসিংদী জেলার প্রতিটি অঞ্চলে তিনি বিচরণ করেছিলেন। সংবাদপত্রের পাতায় সমস্যা, দুর্নীতি, অনিয়ম ও দেশের কথা তুলে ধরেছিলেন। তাই এক অর্থে তাঁকে নরসিংদীর মোনজাত উদ্দিন বলা যায়।”

এই মানুষটি সারাজীবন নিঃস্বার্থভাবে সাংবাদিকতা করে গেছেন। সাংবাদিকতা যে একটি উপাসনাতুল্য কর্মকাণ্ড, সেটা ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধরের জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়।


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

শিবপুরের বিভিন্ন স্থান-নামের উৎস সন্ধান | পর্ব ৪

বাড়ৈআলগী
সেই আমলে এলাকায় জায়গা জমির জরিপ চলছিলো। কিন্তু সঠিক তথ্য না পাওয়ায় জমি রেকর্ডভুক্ত করতে সমস্যা হচ্ছিলো। এলাকার মুরুব্বিরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অনেক মুরুব্বি অতীতের বর্ণনা দিতে পারতেন। তাদের মধ্যে ‘বাড়ৈ’ নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন। আবার আলগা থেকে হয়েছে ‘আলগী’। মুরুব্বি বাড়ৈ সাহেবের নামের সাথে ‘আলগী’ যোগ হয়ে হয়েছে ‘বাড়ৈআলগী’। অর্থাৎ তাদের এলাকাটি অন্যান্য এলাকা থেকে দূরবর্তী স্থানে স্বতন্ত্র বা আলগা ছিলো বলেই গ্রামের নাম বাড়ৈআলগী। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর এখানে ‘বাড়ৈআলগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একসময় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মরহুম আবদুল মান্নান বিদ্যালয়ের উন্নয়নে সচেষ্ট ছিলেন।

তেলিয়া
এই এলাকায় ব্যাপক হারে হিন্দু লোকের বসবাস ছিলো। কারো একজন হিন্দু ভদ্রলোকের নাম ছিলো তৈলচন্দ্র ওরফে তেলাচন্দ্র। আর এই নাম হতেই হয়েছে তেলিয়া। এছাড়া একসময় এলাকাটিতে প্রচুর তৈলবীজ উৎপাদন হতো। ওই বীজ থেকে উৎপাদিত তেলে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য এলাকায়ও সরবরাহ করা যেতো। সবচেয়ে উল্লেখ্য যে, এ-গ্রামে অনেক বড়ো একটি বটগাছ ছিলো। বটবৃক্ষটি দীর্ঘ বছর ধরে এলাকাসহ পথিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। ইতিহাসের সাক্ষী গাছটি এখন আর আগের মতো না থাকলেও এর ধ্বংসাবশেষ পথযাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ওই বটগাছের কারণে স্বর্গগত তৈলচন্দ্রের তেলিয়া গ্রাম শিবপুর ও নরসিংদীতে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছে।

ঝাউয়াকান্দী
গ্রামের নাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া না গেলেও এলাকাবাসী মনে করে, একসময় এখানে অনেক অনেক ঝাউ গাছ জন্মাতো। ঝাউ গাছ একপ্রকার সূচাগ্র ও রমণীয় সুন্দর বৃক্ষ বিশেষ। গাছের শাখা-প্রশাখা দেখতে খুবই সুন্দর। সারিবদ্ধ ঝাউগাছ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। আর এ-সমস্ত ঝাউগাছের কারণেই গ্রামের নাম ঝাউয়াকান্দী হয়েছে। এ গ্রামে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ঝাউয়াকান্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। ১৯২৩ সালে মোলভী সুবেদ আলী পণ্ডিত ও মরহুম খিদির বক্স এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সুবেদ আলী সাহেব নিজেই জমি দিয়েছিলেন। দক্ষিণমুখী বিদ্যালয়ের বর্তমান অবকাঠামোগত অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মনোহরদীর গোতাশিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব ওসমান গণি মাস্টার, জনাব নাসির উদ্দীন মোল্লা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। দুইটি গ্রামের নামে সমৃদ্ধ তেলিয়া ঝাউয়াকান্দী উচ্চ বিদ্যালয় ইতোমধ্যে এলাকার শিক্ষায় বিশেষ অবদান রেখে চলেছে।


লেখক : সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার