আক্রান্ত হলো মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প। প্রায় ৩০-৩৫ জন মানুষকে মাঠের মধ্যে দাঁড় করানো হলো। তাক করা সশস্ত্র বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর বন্দুক। সবাইকে ব্রাশফায়ার করতে উদ্যত। ট্রিগারে হাত। মুহূর্তেই একটি কণ্ঠ কথা বলে ওঠে উচ্চস্বরে। “দাঁড়ান, এখানে সবাই মুক্তিযোদ্ধা নয়। কেবল আমরা পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা। বাকি সবাই সাধারণ জনগণ। এদেরকে ছেড়ে দেন। আমাদের মেরে ফেলেন।” তারপর সবাই চুপ।
সবাই চেয়ে দেখলো কণ্ঠটা কার। আনোয়ারের। সবাই তাঁকে চেনে। শেখেরচরের আনোয়ার হোসেন। অকুতোভয় এক সাহসের নাম। আত্মত্যাগী এক দেশপ্রেমিক। তা না হলে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও মানুষের জীবন বাঁচানোর কর্তব্য ভুলে যেতেন না। এই সাহস আর ত্যাগের শিক্ষা সে গ্রহণ করেছিলো অনেক আগেই। আনোয়ার হোসেন ইন্টারমিডিয়েটে পড়তো নরসিংদী কলেজে। পড়াশোনার পাশাপাশি সামাজিক সংগঠনেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতো। শেখেরচরের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ‘ধূমকেতু সংঘ’ গড়ার পেছনে আনোয়ার হোসেনের চিন্তা, শ্রম, নিষ্ঠা জড়িত ছিলো। দেশমাতৃকার প্রতি মমত্ববোধ, দেশের শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মনোবাসনা এই সময়েই তাঁর ভেতর প্রোথিত হয়েছিলো। আনোয়ার হোসেনের পিতা মো. মিজানুর রহমান এ-ব্যাপারে তাঁকে উৎসাহ-উদ্দীপনা যোগাতেন।

আলগী তারিণী ভূঁইয়া বাড়ির ক্যাম্প। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেনি তখনো তেমনটা। সুচিন্তিতভাবে এই সময়টাই বেছে নিয়েছে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী আর এদেশীয় রাজাকারেরা। যেহেতু রাতেও একবার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের এই ক্যাম্পটি আক্রমণের।
ভোর। ১৮-১৯ জনের একট দলের ক্যাম্প। দু’-একজন পাহারায়। বাকি সবাই ঘুমে অচেতন। আলগীর আশেপাশের তিনটি গ্রাম ধরে তিন দিক দিয়ে ক্যাম্পটি ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি সেনারা। এই ক্যাম্পের অবস্থান রাস্তার সাথে লাগোয়া ছিলো এবং নিরাপত্তার দিক দিয়ে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো বলে আগেই জানিয়েছিলেন নরসিংদী সদরের সাব কমান্ডার ইমাম উদ্দিন। তিনি সন্ধ্যায় পরিদর্শন করেছিলেন ক্যাম্পটি।
মূলত নরসিংদী সদরের মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার নৌ-সৈনিক সিরাজ উদ্দিন আহমেদ, যিনি ন্যাভাল সিরাজ নামে পরিচিত। অকুতোভয় সাহসের মূর্ত প্রতীক ন্যাভাল সিরাজ মুক্তিযুদ্ধের পরে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন। ন্যাভাল সিরাজ এই ক্যাম্প আক্রমণের রাতে বালাপুর ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। সেখানেও পাক বাহিনী দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন।
আলগী, কাঁঠালিয়া আর বালাপুর— মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি ক্যাম্পই আক্রান্ত হয়েছিলো সেই রাতে।
আলগীর তারিণী ভূঁইয়া বাড়ির এই ক্যাম্প আক্রান্ত হয় ১৫ অক্টোবর ভোরের দিকে। আলগী বাজারের দক্ষিণ দিক দিয়ে হানাদার বাহিনী উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ— এই তিন দিক দিয়ে ঢুকে ঘিরে ফেলে ক্যাম্পটি। ভাগদীর আওলাদ হোসেন উত্তর দিকে পাহারায় ছিলেন। হঠাৎ উত্তর দিকের ক্যাম্পের খুব কাছে টর্চের আলো ফেলতেই আওলাদ বুঝতে পারে, তারা আক্রান্ত হয়েছে। সাথে সাথেই সে রাইফেলের গুলি ছোঁড়ে। হানাদার বাহিনীও তিন দিক দিয়ে গুলি ছোঁড়ে। আওলাদ আহত হয়ে সংলগ্ন পুকুরে পড়ে যায়। পরের দিন পুকুরেই তাঁর লাশ পাওয়া যায়।
চতুর্দিক থেকে মুহূর্মুহু স্টেনগান আর রাইফেলের গুলির বিকট চিৎকারে ঘুমন্ত-জাগ্রত এই ক্যাম্পের সকল মুক্তিযোদ্ধা আর স্থানীয় এলাকাবাসীর ঘুম উবে গিয়ে দৌড়াদৌড়ির হুলস্থূল লেগে যায়। আনোয়ার হোসেন এ-সময় গুলিতে আহত হয়ে পাশের পুকুরে পড়ে যায়, আওলাদের মতোই। পরে তাঁকে পুকুর থেকে আহত অবস্থায় উপরে তোলা হয়। বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধারাই পালাতে সক্ষম হয়। কেবল আনোয়ারসহ ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়ে।
সবাইকে মাঠের মধ্যে একত্রে দাঁড় করানো হয়। সাথে এলাকার আরো কিছু মানুষ। সবাইকে একসাথে ব্রাশফায়ার করে এখনি ঝাঁঝরা করে দেয়া হবে।
পরমুহূর্তেই সেই অমোঘ উচ্চারণ, যে-শব্দ আর বাক্যরাশির কারণে বেঁচে গেলো অনেকগুলো নিরীহ প্রাণ। আর পরিচয় পাওয়া গেলো শস্যদায়িনী শ্যামল বাংলামাতার এক সাহসী বীর আনোয়ার হোসেনের। “দাঁড়ান, এখানে সবাই মুক্তিযোদ্ধা নয়। কেবল আমরা পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা। বাকি সবাই সাধারণ জনগণ। মারতে হয় আমাদের মারুন। এদেরকে ছেড়ে দিন।” মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও শেষবেলায় আরো অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় আনোয়ার হোসেন অন্য সবার থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। যদিও প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধারই প্রাণের দাম সমান এই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে। মৃত্যু নিশ্চিত করে বর্বর পাক বাহিনী আনোয়ার হোসেনকে মাঠের এক কাঁঠালগাছে ঝুলিয়ে রেখেছিলো। বাকি পাঁচজনের লাশ মাঠে ছড়ানো ছিলো বৃক্ষচ্যুত পাতার মতো। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই গ্রামবাসী ক্যাম্পের মাঠে ছয় মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে লাশ হয়ে যেতে দেখে বেদনায় মুষড়ে পড়েন আর মুক্তিযোদ্ধারা লাভ করেন সাহস ও শক্তি। আনোয়ার হোসেনের সহযোদ্ধা বাকি পাঁচ শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— নেহাব গ্রামের মোহাম্মদ আলী, চাকশালের তাইজউদ্দিন পাঠান, কল্যাণদির সিরাজুল ইসলাম, কামারটেকের আব্দুস সালাম, ভাগদীর আওলাদ হোসেন।


এই সেই তারিণী ভূঁইয়া বাড়ির ক্যাম্প, মাঠ আর কাঁঠাল গাছ। এই গাছে আনোয়ার হোসেনকে মেরে ঝুলিয়ে রেখেছিলো বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী। মূল কাঁঠাল গাছটি ৫০ বছরেরও অধিক সময় টিকে ছিলো এখানে। পরে ভেঙে যায়, এবং একই স্থানে নতুন একটা কাঁঠাল গাছের চারা রোপণ করা হয় সেই বিভীষিকাময় ও গৌরবজনক ইতিহাসকে জাগরিত রাখতে। এই চারাটির নিচে মূল গাছের গোড়া এখনো অক্ষত রয়েছে। এই ঐতিহাসিক মাঠে ছয়জন শহীদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভও নির্মাণ করা হয় জেলা মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিলের সৌজন্যে, ২০১১ সালে। এই স্মৃতিস্তম্ভটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন আনোয়ার হোসেনের ভাই বিশিষ্ট শিল্পপতি মো. মোশাররফ হোসেন (সিআইপি) | ছবি : শহিদুল্লাহ পিয়াস

কান্দাপাড়া গ্রামের এক রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের এই ক্যাম্পটির খোঁজ-খবর পাক বাহিনীকে জানিয়েছিলো, এমনকি পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো— এরকম খবর পরদিন থেকেই মানুষের জানা হয়ে গিয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধের পর এই রাজাকারকে মুখে চুনকালি ও মাথা ন্যাড়া করে সারা এলাকা ঘোরানো হয়েছিলো শাস্তি হিসেবে। এই রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধারা মেরে ফেলতেই উদ্যত ছিলো। কিন্তু অনেক গ্রামবাসীর উপর্যুপরি অনুরোধ ও শহীদ আনোয়ার হোসেনের পিতা নিজে ক্ষমা করে দেয়ায় এই লঘু শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছিলো।
শহীদ আনোয়ারের সেই মৃত্যুপূর্ব কাতর আহ্বানে যাদের প্রাণ বেঁচে গিয়েছিলো, সেই সব কৃতজ্ঞ মানুষেরা প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর শহীদ আনোয়ারের পিতার কাছে এসে দেখা করতো (যতোদিন তিনি বেঁচে ছিলেন), কৃতজ্ঞ চিত্তে শ্রদ্ধা জানাতো এমন বীরের গর্বিত পিতা-মাতাকে। সেই সাথে সর্বদাই স্মরণ করতো আনোয়ার হোসেনের এই আত্মত্যাগকে।
শহীদ আনোয়ার হোসেনকে শেখেরচর মাদরাসা ও ঈদগাহ গোরস্থানে সমাহিত করা হয়েছিলো। প্রতি বছর ১৫ অক্টোবর তাঁর সমাধি ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়।

