সাংবাদিকতার অগ্রদূত হাবিবুল্লাহ বাহার : প্রয়াণের ৩০ বছর

‘নরসিংদীর খবর’ ছিলো সাজানো-গোছানো এবং নিয়মিত প্রকাশনা। যার ফলে পত্রিকাটিকে নরসিংদীতে আধুনিক পত্রিকার পথিকৃৎ বলা হয়। অবশ্য হাবিবুল্লাহ বাহারের যোগ্যতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার গুণেই পত্রিকাটি সহজে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু বেশিদিন তিনি ‘নরসিংদী খবর’ পত্রিকাটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারেননি। মাত্র পাঁচ বছর পত্রিকাটির সম্পাদনায় যুক্ত থাকতে পেরেছিলেন। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে ১৯৯৫ সালের ২১ অক্টোবর তিনি পরলোকগমন করেন।

প্রবীণ সাংবাদিক হাবিবুল্লাহ বাহার (১৯৪৪-১৯৯৫) নরসিংদী অঞ্চলের সাংবাদিকতায় নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন। সেই জাগরণের মূল সূত্র ছিলো ‘সাপ্তাহিক নরসিংদীর খবর’ পত্রিকা। এর প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে স্থানীয় সাংবাদিকতার খোলনলচে পাল্টে দিয়েছিলেন তিনি। একসময় শহরের দু-চারজন মানুষ সাংবাদিকতা করতেন। কিন্তু ১৯৯০ সালে ‘নরসিংদীর খবর’ প্রকাশের মাধ্যমে সাংবাদিকতার ধারণাকে জেলা শহর থেকে থানা কিংবা ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন হাবিবুল্লাহ বাহার। প্রতিটি স্থানে সাংবাদিক কিংবা সংবাদের সোর্স নিয়োগ দিয়ে সংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের জগতে তিনি ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন। স্থানীয়ভাবে ‘নরসিংদীর খবর’ পত্রিকার আগেও কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিলো। সেগুলো ছিলো অনিয়মিত। কিন্তু ‘নরসিংদীর খবর’ ছিলো সাজানো-গোছানো এবং নিয়মিত প্রকাশনা। যার ফলে পত্রিকাটিকে নরসিংদীতে আধুনিক পত্রিকার পথিকৃৎ বলা হয়। অবশ্য হাবিবুল্লাহ বাহারের যোগ্যতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার গুণেই পত্রিকাটি সহজে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু বেশিদিন তিনি ‘নরসিংদী খবর’ পত্রিকাটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারেননি। মাত্র পাঁচ বছর পত্রিকাটির সম্পাদনায় যুক্ত থাকতে পেরেছিলেন। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে ১৯৯৫ সালের ২১ অক্টোবর তিনি পরলোকগমন করেন।

হাবিবুল্লাহ বাহার (১৯৪৪-১৯৯৫)

তাঁর মৃত্যুর পর অনেকেই ভেবেছিলো, হয়তো পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাবে। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক হলেও তারা তখনো শিশু। স্ত্রী সেতারা বেগম সরকারি চাকুরিতে থাকায় পত্রিকাটি চালানোর মতো সময় পাবেন কি না, সেটা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু এ-ধারণাকে অমূলক প্রমাণ করেছিলেন সেতারা বেগম। তিনি নরসিংদীর খবর পত্রিকাটিকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। সফলও হন। এখনো পর্যন্ত নরসিংদীর খবর জেলার একটি জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য পত্রিকার আসন দখল করে আছে।

হাবিবুল্লাহ বাহারের সঙ্গে আমার ছোটো একটি স্মৃতি রয়েছে। আমি তখন ঢাকায় জনপ্রিয় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে চাকুরি করি। একদিন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসে ভেলানগরস্থ ‘নরসিংদীর খবর’ পত্রিকার কার্যালয়ে যাই। সাংবাদিকতা ও লেখালেখি নিয়ে তাঁর সঙ্গে অনেক কথাবার্তা বলি। আপাদমস্তক একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন তিনি। সাম্যবাদের জন্যে আমৃত্যু রাজনীতি করে গেছেন। চলাফেরাও করতেন সাধারণ মানুষের মতো। তিনি আমাকে নরসিংদীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে প্রবন্ধ লেখার অনুরোধ করেন। আমি ঢাকা ফিরে প্রখ্যাত কবিয়াল হরিচরণ আচার্য্যকে নিয়ে একটি দীর্ঘ লেখা পাঠাই, যা হাবিবুল্লাহ বাহার অত্যন্ত যত্ন করে ছেপেছিলেন। পরে এই লেখাটি ত্রিপুরার আগরতলাস্থ ‘কবিগুণাকর হরিচরণ গবেষণাগার’ থেকে প্রকাশিত বইয়ে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছিলো।

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম মোস্তাফা মিয়া বলেন, “হাবিবুল্লাহ বাহার সাংবাদিক হিসেবে যতোটা না জনপ্রিয় ছিলেন, তার চেয়ে বেশি খ্যাতিমান ছিলেন ‘নরসিংদীর খবর’ প্রকাশ করে। পত্রিকাটি নরসিংদীর সাংবাদিকতার চরিত্র পাল্টে দিয়েছিলো। অনেক ভালো ভালো সাংবাদিকের জন্ম দিয়েছিলো পত্রিকাটি। এর নেপথ্য কারিগর ছিলেন কর্মযোগী হাবিবুল্লাহ বাহার।”

কথা প্রসঙ্গে গোলাম মোস্তাফা মিয়া আরো জানান, “একসময় নরসিংদীর সাংবাদিকতা ঝিমিয়ে পড়েছিলো। সেই ঝিমিয়ে পড়াদের মধ্যে হাবিবুল্লাহ বাহারও ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে একটি পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে সাংবাদিক সমাজকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। তিনি অকালে মারা না গেলে আরো অবদান রাখতে পারতেন। পরবর্তীতে নরসিংদীর খবরের হাল ধরেছিলেন তাঁর সুযোগ্য স্ত্রী সেতারা বেগম। এখনো তিনি পত্রিকাটি এগিয়ে নেয়ার জন্যে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন।”

হাবিবুল্লাহ বাহার অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ছিলেন। তিনি মুখে যা বলতেন, যতো কষ্টই হোক, তা-ই করতেন। তিনি নিজে সম-সাময়িক বিষয়ের উপর সম্পাদকীয় লিখতেন। কখনো কপি করতেন না। এখনো পর্যন্ত হাবিবুল্লাহ বাহারের নীতি-রীতিই ধারণ করে আছে পত্রিকাটি।

হাবিবুল্লাহ বাহারের সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়েছিলো ঐতিহ্যবাহী ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার মাধ্যমে। তিনি প্রথমদিকে ‘সংবাদ’-এর ছাপাখানায় ছোটো একটি চাকরি নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সাংবাদিকতা আর লেখালেখির পোকা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। সহকর্মী ও ‘সংবাদ’-এর বর্ষীয়ান সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে থাকেন। এক পর্যায়ে জন্মস্থান নরসিংদীতে ফিরে আসেন। দৈনিক সংবাদের নরসিংদী সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। জেলার সর্বত্র সংবাদ সংগ্রহের জন্যে দাপিয়ে বেড়াতে থাকেন।

কর্মবীর ছিলেন তিনি। শুধু সংবাদ পত্রিকার সংবাদদাতার করিডোরে সীমাবদ্ধ থাকতে চাননি। জেলা প্রেস ক্লাবকে নতুন করে গড়ে তোলা এবং সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭২ সালে গড়ে ওঠা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বাবু ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর ও বাবু নিবারণ রায়। একই সাথে তাঁরা প্রথম সভাপতি ও প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দীর্ঘ ২২ বছর (১৯৭২-১৯৯৪) একাধারে নিবারণ রায় সাধারণ সম্পাদক থাকলেও ঈশ্বর চন্দ্র সূত্রধর (১৯৭২-১৯৭৪) এবং স্বপন কুমার সাহা (১৯৭৪-১৯৭৫)-এর পর সভাপতি হন হাবিবুল্লাহ বাহার। দুই মেয়াদে (১৯৭৫-১৯৭৯ ও ১৯৮০-১৯৯২) প্রায় ১৬ বছর তিনি নরসিংদী প্রেস ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

সাংবাদিকতা ছাড়া হাবিবুল্লাহ বাহার ‘ন্যাপ (মোজাফফর)’ রাজনৈতিক দলের নিষ্ঠাবান নেতা ছিলেন। নরসিংদীর গৌরবময় কৃষক আন্দোলনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিলো। খেটে খাওয়া কৃষক-শ্রমিকদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যে তিনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। নরসিংদী সরকারি কলেজে পড়াশোনার সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

তাঁর জন্ম পলাশ থানার গয়েশপুর গ্রামে হলেও তিনি ভেলানগরস্থ নানার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতেন। পরবর্তীতে সেখানেই স্থায়ী হন। সেখানেই গড়ে তোলেন নরসিংদীর খবর পত্রিকার কার্যালয়। লেখক-সাংবাদিকদের মিলনমেলায় পরিণত হয় স্থানটি। প্রবীণ শিক্ষক ও সাংবাদিক হলধর সাহা জানান, নরসিংদীর খবর পত্রিকার শুরুতে এর সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। তাঁর মতো আরো অনেক সাংবাদিক, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যমণি ছিলেন হাবিবুল্লাহ বাহার। ব্যক্তিত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে অনেক মানুষের প্রিয় ছিলেন তিনি। নরসিংদীর খবর প্রকাশ করে তিনি নরসিংদীর সাংবাদিকতায় জোয়ার সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি পত্রিকা প্রকাশ না করলে হয়তো স্থানীয় সাংবাদিকতা অনেকটা পিছিয়েই থাকতো।

নরসিংদীর খবর পত্রিকায় কাজ করেছেন এমন একাধিক সাংবাদিক জানান, হাবিবুল্লাহ বাহার অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ছিলেন। তিনি মুখে যা বলতেন, যতো কষ্টই হোক, তা-ই করতেন। তিনি নিজে সম-সাময়িক বিষয়ের উপর সম্পাদকীয় লিখতেন। কখনো কপি করতেন না। এখনো পর্যন্ত হাবিবুল্লাহ বাহারের নীতি-রীতিই ধারণ করে আছে পত্রিকাটি। বর্তমান সম্পাদক অধ্যাপক সেতারা বেগমও প্রাক্তন সম্পাদকের নীতি অনুসরণ করে নিজ হাতে সম্পাদকীয় লিখে যাচ্ছেন। যে-কারণে নরসিংদীর খবর পত্রিকাটি স্থানীয়ভাবে তার সূচনালগ্ন থেকে এখনো পর্যন্ত প্রথম সারিতে রয়েছে। পত্রিকাটি পাঠকেরা পকেটের পয়সা খরচ করে কেনেন এবং পড়েন।
আজ নরসিংদীর খবর পত্রিকাটি যে-শক্ত খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেটার ভিত রচনা করে গেছেন হাবিবুল্লাহ বাহার। কঠোর পরিশ্রমী এই মানুষটি নানা পেশা, নানা অভিজ্ঞতা থেকে যে-জ্ঞান আহরণ করেছিলেন, সেসব সাংবাদিকতায় কাজে লাগিয়ে গেছেন। কখনো কো-অপারেটিভ, কখনো এনজিও কর্মী, কখনো সরকারি কলেজের কর্মকর্তা হিসেবে কিংবা ছাপাখানার কর্মী হিসেবে কাজ করে নিজের জীবন মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করে গেছেন।

প্রখ্যাত সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান সরদার তাঁর লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইয়ে হাবিবুল্লাহ বাহার ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে কিছু তথ্য উল্লেখ করেছেন। ১৯৭১ সালে শাহজাহান সরদার তাঁর মনোহরদীর বাড়ি থেকে ত্রিপুরায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে যাবার আগে হাবিবুল্লাহ বাহারের ভেলানগরস্থ বাসায় রাত্রিযাপন করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রখ্যাত ন্যাপ নেতা কামাল হায়দার ও নারায়ণগঞ্জ বারের আইনজীবী ওয়াজউদ্দিন। পরের দিন নরসিংদী থেকে লঞ্চে নবীনগর হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তাঁরা ত্রিপুরা গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। হাবিবুল্লাহ বাহারের পরিবার সম্পর্কে শাহজাহান সরদার উল্লেখ করেন, “গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে শিবপুর পৌঁছি দু’ঘণ্টায়। সেখান থেকে বাসে নরসিংদীর ভেলানগর। কামাল হায়দারও এখানে এলেন। বড় ভাই ন্যাপ নেতা, ছোট ভাই ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। এখানে আরো একজন এলেন, নারায়ণগঞ্জ বারের উকিল ও আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট ওয়াজউদ্দিন। রাতে তাঁদের বাসায় থাকি, হাবিবুল্লাহ বাহার ও শহীদুল্লাহ বাহারের বাবা বেঁচে নেই। বৃদ্ধ মা ও ছোট বোন, মা ও ছোট বোন শুধু বাসায়। ২৫ এপ্রিল সকালে দুই ভাই মা ও বোনের কাছ থেকে বিদায় নেন।”

রাজনৈতিক জীবনে হাবিবুল্লাহ বাহার ছিলেন সর্বহারা কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির ত্রাণকর্তা। ক্ষণস্থায়ী জীবনে বহু কালজয়ী কর্মের সঙ্গে জড়িয়ে অমর হয়ে আছেন তিনি। কিন্তু স্থানীয়ভাবে বড়ো অবহেলিত এই মানুষটি। তাঁর কোনো স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি নরসিংদী শহরের কোথাও। প্রবীণ সাংবাদিক, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও নরসিংদীর কোনো সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন তাঁকে স্মরণ করেন না। কিন্তু তাঁকে স্মরণ করা, তাঁর কর্ম ও জীবনকে জনসম্মুখে তুলে আনা প্রাজ্ঞ ও সচেতন মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হওয়া উচিত ছিলো।


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ