আতাউর রহমান ভূঁইয়া : নীতিনিষ্ঠ এক রাজনীতিক ও শিক্ষকের ছবি

১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাস। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি এবং শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত নরসিংদীর ছাত্র-জনতা যখন উত্তেজিত, ঠিক সেই সময় মনোহরদী থানার হাতিরদিয়াতে একটি জনসভায় যোগ দেয়ার জন্যে রওনা হন মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবদুস সবুর খান, ওয়াহিদুজ্জামান এবং নারায়ণগঞ্জের ডিসি আ. ছাত্তার। তারা গাড়িযোগে নরসিংদীর বৌয়াকুড়ে বর্তমান ইনডেক্স প্লাজার সামনে পৌঁছালে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার একটি মিছিল তাদের গতি রোধ করে এবং তাদের গাড়ি ভাঙচুর করে। এরপর সারা নরসিংদীতে আইয়ুব খানের ফটো ভাঙা হয় একের পর এক। মন্ত্রীদের গাড়ি ভাঙচুরের পরপরই সারা নরসিংদী পুলিশে ছেয়ে যায়। এই ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন যে-কয়েকজন ছাত্রনেতা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন আতাউর রহমান ভূঁইয়া।

সেদিন নেতৃত্বে থাকা ছাত্ররা গ্রেফতার এড়িয়ে পালিয়ে গেলেও আতাউর রহমান ভূঁইয়া ও শামসুল হক ভূঁইয়াকে কলেজ থেকে ফোর্স টিসি দেয়া হয় এবং রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, নাজমুল হোসেন বাদল, শামসুল হুদা বাচ্চু ও আলী আকবরসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এর প্রতিবাদে পরবর্তী টানা সাতদিন কলেজে কোনো ছাত্র আসেনি। নরসিংদীর তৎকালীন জিন্নাহ পার্কে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী মঞ্চ) রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত মিটিং চলে। কাজী জাফরসহ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতারাও সেই মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। এই জনমত ও ছাত্র আন্দোলনের মুখে কলেজ প্রশাসন ১৫-১৬ দিন পর তাঁদের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।

নরসিংদী কলেজে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা ছিলো আতাউর রহমান ভূঁইয়ার সাহসিকতার আরেকটি নমুনা। কলেজ প্রশাসনের সাথে সম্পৃক্ত তৎকালীন প্রতিক্রিয়াশীল কুচক্রী মহলের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে কলেজ চত্বরে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন কর্তৃক স্থাপিত কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর উঠিয়ে উক্ত স্থানে ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিস্মারক শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করা হয় তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে।

প্রসঙ্গত, আতাউর রহমান ভূঁইয়া যখন নরসিংদী কলেজে পড়তেন, তখন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক ও পণ্ডিত দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। নানা কারণে তিনি অধ্যক্ষ মহোদয়ের প্রিয়পাত্রে পরিণত হন। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ আতাউর রহমানকে তাঁর সাথে শিক্ষক কোয়ার্টারের (তখন টিনের ঘর ছিলো, বর্তমানে কলেজ মাঠের পশ্চিমপাশে অবস্থিত) বারান্দার ঘরে থাকতে বলেন। আতাউর রহমানও রাজি হয়ে যান এবং থাকা শুরু করেন। সেই রুমে বসেই তিনি ’৬২-র শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের প্রতিবাদে উক্ত আন্দোলনের কর্মপরিকল্পনা করতে থাকেন। অধ্যক্ষ জনাব আজরফ তা কোনোভাবেই টের পাননি। তবে ঘটনার পর প্রশাসনের চাপেই তিনি দুজনকে ফোর্স টিসি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠনের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈরী আচরণ প্রকাশ পেতে থাকে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এই বিমাতাসুলভ আচরণের প্রথম বিরোধী অবস্থান। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের বিজয় বাঙালির নেতৃত্বের শক্ত খুঁটি স্থাপন করে দেয়। পঞ্চাশের দশকের এই দুটি আন্দোলন বাঙালির চেতনা জাগ্রত করেছিলো। তখন থেকেই বাংলাদেশের জনগণ চিন্তা-মননে, প্রথা-প্রতিষ্ঠানে এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে সজাগ হয়ে ওঠতে থাকে। ঠিক সেই সময়ই বেড়ে ওঠা আতাউর রহমান ভূঁইয়ার।

শাসকের তোষণের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা ও জনগণের দাবি আদায়ে রাজপথে তাণ্ডব চালানো এই রাজনীতিক ১৯৪০ সালের ১ ডিসেম্বর নরসিংদী জেলাধীন শিবপুর উপজেলার বৈলাব গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আবদুস সোবহান ভূঁইয়া এবং মা মেরী আক্তার। আতাউর রহমান ভূঁইয়া ১৯৫৬ সালে গাজীপুরের জয়দেবপুরের রাণী বিলাসমনি হাই স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন এবং জগন্নাথ কলেজে আইএ ক্লাশে ভর্তি হন। সেখানেই তাঁর রাজনীতির শুরু। গণ-মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়নের মিটিং-মিছিলে তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে তদানীন্তন পাকিস্তানের আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে। সরকারবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় তিনি গ্রেফতার হবার আশঙ্কায় পড়েন। সেই কারণে জগন্নাথ কলেজ পরিত্যাগ করে চলে আসেন নরসিংদী। ১৯৬০ সালে তিনি পুনরায় আইএ ক্লাশে ভর্তি হন নরসিংদী কলেজে। তখন কলেজের পরিবেশ আজকের মতো ছিলো না। উত্তরপাশের ভবনটাই শুধুমাত্র ছিলো। আর বর্তমান ছাত্রাবাসটি ছিলো টিনের।

নরসিংদী কলেজে ভর্তি হয়েই আবুল হাশিম মিয়ার সংস্পর্শে এসে তিনি ছাত্র ইউনিয়নকে সংগঠিত করার কাজে নেমে পড়েন। এর পূর্বে নরসিংদী কলেজের ছাত্ররাজনীতি এতোটা সুশৃঙ্খলভাবে চালিত হচ্ছিলো না। আতাউর রহমান ভূঁইয়া ছাত্র ইউনিয়নকে সুগঠিত করলে এবং পাশাপাশি ছাত্রলীগও সক্রিয়ভাবে মাঠে নামলে কলেজের ছাত্ররাজনীতি একটি আদর্শভিত্তিক অবস্থানে চলে আসে। তৎসময়ে আতাউর রহমানসহ অন্যান্য ছাত্রনেতারা মুসলিম লীগ ও ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের নজর এড়াতে মেঘনা পাড়ি দিয়ে করিমপুরে গিয়ে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা-পরিকল্পনা করতেন।

নরসিংদী কলেজে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা ছিলো আতাউর রহমান ভূঁইয়ার সাহসিকতার আরেকটি নমুনা। কলেজ প্রশাসনের সাথে সম্পৃক্ত তৎকালীন প্রতিক্রিয়াশীল কুচক্রী মহলের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে কলেজ চত্বরে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন কর্তৃক স্থাপিত কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর উঠিয়ে উক্ত স্থানে ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিস্মারক শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করা হয় তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। তখন ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হোসেন বাদল ও শামসুল হক ভূঁইয়া ছিলেন এই কাজে আতাউর রহমান ভূঁইয়ার অন্যতম সহযোগী। তখনকার মুসলিম লীগের জাঁদরেল নেতা রহমান ভূঁইয়া, তোফাজ্জল মৌলভী’র বিরুদ্ধে গিয়ে কলেজে শহীদ মিনার স্থাপন মোটেও সহজ কাজ ছিলো না। এসব কাজ করতে গিয়ে তিনি পাকিস্তানপন্থী দলগুলোর স্থানীয় নেতাকর্মী ও প্রশাসনের বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন।

এসব বাধা তাঁকে মোটেও দমাতে পারেনি। বরং ফুঁসিয়ে দিয়েছে বহুগুণে। রাজনৈতিক তৎপরতার ফলস্বরূপ ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, নরসিংদী জেলা শাখা’র সভাপতির দায়িত্ব পান আতাউর রহমান ভূঁইয়া। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট। এই রিপোর্টে ২ বছরের ডিগ্রি কোর্সকে ৩ বছরে রূপান্তরিত করাসহ পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা সংকোচনের প্রস্তাব করা হয়। কাজেই এই রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্ররা শিক্ষা দিবস পালন উপলক্ষে প্রদেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়। নরসিংদীর প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই হরতাল পুরোপুরিভাবে পালিত হয়। এ-দিন ঢাকায় ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে তিনজন নিহত হলে নরসিংদীতেও তার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ধর্মঘট পালিত হয়। ইতোমধ্যেই আইয়ুব খান নিজের ক্ষমতার পথ নিষ্কণ্টক করতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ আবুল মনসুর আহমদ, মনসুর আলী ও শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ করলে অন্যান্য স্থানের মতো নরসিংদীতেও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এসব আন্দোলনের সময় নরসিংদীর দত্তপাড়া ঈদগাহ ময়দানে এক জনসভা হয়। এতে আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী বক্তৃতা করেন। এ-সময়ের আন্দোলনে নেতৃত্বে ছিলেন আতাউর রহমান ভূঁইয়া, জানে আলম ভূঁইয়া, রিয়াজ উদ্দিন, সাখাওয়াত হোসেন মিয়া ওরফে ইয়ার মোহাম্মদ, শামসুল হক ভূঁইয়া, হাবিবুল্লাহ বাহার, নারায়ণচন্দ্র সাহা, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, আবদুল মান্নান খান, ফজলুর রহমান ফটিক মাস্টার, আপেল মাহমুদ, আলী আকবর, নাজমুল হোসেন বাদল প্রমুখ ছাত্রনেতা। মন্ত্রীদের গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়ে আতাউর রহমান ভূঁইয়া পালিয়ে চলে যান রায়পুরার শ্রীনিধিতে। সেখানে বন্ধু হুমায়ূনের বাড়িতে ৮-১০ দিন আত্মগোপনে থাকার পর সেখান থেকেও পালিয়ে যান।

১৯৬২ সালেই তিনি নরসিংদী কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। পাশ করার পর নরসিংদী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মোতাহের হোসেন ও ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা কাজী জাফরও এ-ব্যাপারে সহায়তা করেন। কিন্তু এখানকার রাজনৈতিক অবস্থা ও মানুষের উন্নয়নের জন্যে নরসিংদীর স্থানীয় প্রগতিশীল রাজনীতিকরা তাঁকে নরসিংদী কলেজেই পড়াশোনার নির্দেশ দেন। তিনিও রাজি হয়ে যান এবং নরসিংদী কলেজেই বিএ পাশকোর্সে ভর্তি হন। সেই সময়ই ১৯৬৫ সালে আইয়ুব খানের বিপক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা ফাতেমা জিন্নাহ’র পক্ষে নরসিংদী স্টেশনে হাজার হাজার মানুষের সামনে বক্তৃতা দিয়ে আলোচিত হন।

১৯৬৫ সালে তিনি বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড ডিগ্রি লাভ করেন।

তারপর আতাউর রহমান ভূঁইয়া আদর্শিক কারণে ও আবুল হাশিম মিয়া, জিতেন ঘোষ, জ্ঞান চক্রবর্তীসহ রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশ মোতাবেক মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। ব্রাহ্মন্দী স্কুলসহ বিভিন্ন বিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকার পর ১৯৬৬ সালে নরসিংদী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। এই পাইলট স্কুলে শিক্ষকতা করার সময়ই তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এ যোগদান করেন।

প্রসঙ্গত, ১৯৬৭ সালে ন্যাপ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পিকিংপন্থী মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এবং মস্কোপন্থী আবদুল ওয়ালীর নেতৃত্বে ন্যাপের দুইটি ধারা গঠিত হয়। ওয়ালী ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তান অংশের সভাপতি নির্বাচিত হন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। তখন থেকেই এ-অঞ্চলে মস্কোপন্থী এই দলটি ‘ন্যাপ (মোজাফফর)’ নামে পরিচিতি পেতে থাকে। পরবর্তীতে সচেতন ছাত্র ও প্রগতিশীল রাজনীতিকদের মধ্যে ন্যাপ (ভাসানী) ও ন্যাপ (মোজাফফর) জনপ্রিয় হতে থাকে। আতাউর রহমান ভূঁইয়া বৈষম্যহীন ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ন্যাপ (মোজাফফর)-কে বেছে নেন।

শিক্ষক থাকা অবস্থায়ই তিনি ’৬৬-র ছয়দফা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান আন্দোলনে নরসিংদীতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও ছিলো তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ। ৪ এপ্রিল নরসিংদী বাজারে পাকবাহিনির বোম্বিংয়ের পর তিনি নরসিংদী ছেড়ে চলে যান। শিবপুরে তাঁর গ্রামের বাড়িতে কিছুদিন আশ্রয়গ্রহণের পর বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে থাকেন এবং স্থানীয়ভাবে হাবিবুল্লাহ বাহারের নেতৃত্বে ট্রেনিং গ্রহণ করেন। ট্রেনিংয়ের প্রধান অস্ত্র ছিলো থ্রি নট থ্রি রাইফেল, এলএমজি, স্টেনগান ও হ্যান্ড গ্রেনেড। হাবিবুল্লাহ বাহারের এই বাহিনির অন্যান্য সদস্যের মধ্যে আবুল হাশিম মিয়া, তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র শহীদুল্লাহ বাহার, নূরুল ইসলাম গেন্দু, আজিজ আহমেদ খান, বি এ রশিদ, আলী আহমেদ, রফিকুল ইসলাম, মজিবর রহমান, সামছুল হক ভূঞা, বদরুজ্জামান বদু ভূঞা, গাজী শাহাবুদ্দিন, যূথিকা চ্যাটার্জী, কার্তিক চ্যাটার্জী, গোলাম মোস্তাফা মিয়া প্রমুখও ছিলেন।

এখানে আরেকটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। যুদ্ধকালীন নরসিংদী কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন আগরতলা মামলার আসামী কমান্ডার আবদুর রউফ। তাঁকে এই কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেবার পেছনেও রয়েছে আতাউর রহমান ভূঁইয়ার বিশেষ অবদান। এ-প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “তখন আমি অভিভাবক প্রতিনিধি হিসেবে কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য ছিলাম। আরো ছিলেন রফিক খন্দকার, আদম আলী মাস্টার। আমরা ছিলাম প্রগতির পক্ষে। বাকিরা প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষে। তৎকালীন এসডিও’র সাথে প্রায় ঝগড়া করেই আমরা রউফ সাহেবকে কলেজের দায়িত্বে আনার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করি। মিটিংয়ে এসডিও আমাদের প্রশ্ন করেছিলো, একজন ষড়যন্ত্র মামলার আসামিকে কেন আমরা কলেজের দায়িত্বে আনতে চাই? তখন আমরা বলি যে, আগরতলা মামলার আসামি বলেই আমরা তাঁকে এই কলেজের অধ্যক্ষ করতে চাই।”

স্বাধীন দেশে আবারো আতাউর রহমান ভূঁইয়া শিক্ষকতায় ফেরেন। প্রায় ১৯ বছর পাইলট স্কুলে শিক্ষকতার পর ১৯৮৩ সালে তিনি নরসিংদী উচ্চ বালিকা বিদ্যানিকেতনের প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং বিদ্যালয়টিকে একটি মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপ দেন। উক্ত প্রতিষ্ঠানে তিনি ছিলেন প্রায় ৬ বছর। এর মধ্যে ১৯৮০-৮১ শিক্ষাবর্ষে তিনি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও তিনি ন্যাপের পক্ষ থেকে সরাসরি অংশ নেন। এ-সময় সামরিক শক্তির নানা প্রলোভনেও তিনি তাঁর আদর্শ থেকে একচুলও নড়েননি। বরং ন্যায়নিষ্ঠ রাজনীতিক ও শিক্ষকের ভূমিকায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।

পরবর্তীতে চিনিশপুর ইউনিয়নের তখনকার চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিন ভূঁইয়ার অনুরোধে তিনি নরসিংদীর ঘোড়াদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এই স্কুলটিকেও তিনি যথারীতি শূন্য থেকে টেনে তোলেন। তাঁর সময়েই মূলত ঘোড়াদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় উন্নতির শিখরে আরোহণ করে। ২০০০ সালে অবসর গ্রহণের কথা থাকলেও তাঁর স্বীয় দক্ষতা ও বিচক্ষণতার কারণে বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদ তাঁর চাকুরির মেয়াদ ক্রমান্বয়ে ৫ (২+২+১) বছর বাড়িয়ে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। চাকুরির বর্ধিত সময়সীমা উত্তীর্ণ হবার পরও একান্তই বিদ্যালয়ের প্রয়োজনে আরো ২ বছর তিনি রেক্টর হিসেবে উক্ত বিদ্যালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। সবশেষে তিনি ২০০৭ সালে ঘোড়াদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় এবং শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসরগ্রহণ করেন।

দীর্ঘ এই শিক্ষকজীবনে তিনি বহু ছাত্রের জীবন গড়ে দিয়েছেন। সবচে’ পরিলক্ষিত যে-বিষয়টি, সেটি হলো তিনি শুধুমাত্র একটি বিদ্যালয়ে পাঠদান ও প্রশাসনিক কাজেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি, তার সাথে উক্ত এলাকার সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনেও ভূমিকা রেখেছেন। আর এ-কারণেই রাজনীতি ও দলীয় পরিচয়ের বাইরেও তিনি নিজের আরেকটি পরিচয় স্বতন্ত্রভাবে দাঁড় করাতে পেরেছেন এবং তা বেশ সাফল্যের সাথে। তাছাড়া শিক্ষক আন্দোলনের সাথেও ছিলো তাঁর সংযোগ। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, নরসিংদী জেলা শাখা’র সভাপতি ছিলেন দীর্ঘদিন।

আতাউর রহমান ভূঁইয়া ছাত্ররাজনীতিতে তুখোড় সময় পার করার পর নিজেকে একজন আদর্শ ও প্রগতিশীল শিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলার দিকেই মনোযোগ দিয়েছেন বেশি।  বৈষম্যমুক্ত-শোষণহীন ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের আন্দোলনে এখনো ভূমিকা পালনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর ভূমিকা অব্যাহত রয়েছে। এসব সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘নবধারা কণ্ঠশীলন অ্যাওয়ার্ড ২০১৪’ লাভ করেন।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ঐক্য ন্যাপের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন মানুষের মুখে এখনো শোনা যায়, আতাউর রহমান ভূঁইয়া যখন মাইক নিয়ে নরসিংদী বাজারে বের হতেন, তখন সকল দোকানদার-ব্যবসায়ীরা দোকানের দরোজায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন শুধুমাত্র তাঁর যৌক্তিক ও দাপুটে কণ্ঠস্বর শোনার জন্যে।

তাঁর সময়ের বহু রাজনীতিক যেখানে আদর্শ, ব্যক্তিত্ব এবং গণমানুষের মুক্তির স্বপ্ন বিকিয়ে দিয়ে ভোগ-দখলের রাজনীতির পালে মিশে গেছেন, সেখানে একজন আতাউর রহমান ভূঁইয়া মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের আদর্শ, ব্যক্তিত্ব, স্বপ্ন, সত্তাকে ভাঁজ হয়ে যাওয়া চামড়ার নিচে বয়ে বেড়িয়েছেন। আর এ-কারণেই তিনি সবসময় প্রাসঙ্গিক।

আগামীর প্রজন্ম তাঁকে যদি না চেনে, না জানে, তাহলে সত্যিকার অর্থেই আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেলবো নরসিংদীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের বাঁক-বদলের আলোকরেখা।

আতাউর রহমান ভূঁইয়া দুই পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা সুলতানা প্রায় ৪৪ বছর ব্রাহ্মন্দী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। বর্তমানে তিনি প্রয়াত। আতাউর রহমান ভূঁইয়া ২০২৪ সালের ২১ মে মৃত্যুবরণ করেন।


তথ্যসূত্র
১. নরসিংদী জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন;
২. ‘নবধারা কণ্ঠশীলন অ্যাওয়ার্ড ২০১৪ ও কৃতি শিক্ষার্থী সংবধর্না’ স্মরণিকা;
৩. ব্রহ্মপুত্র, ডিসেম্বর ২০২২ সংখ্যা এবং
৪. আতাউর রহমান ভূঁইয়ার সাক্ষাতকার।

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ