মাধবদীর জমিদার সতী প্রসন্ন গুপ্ত’র রহস্যজনক করুণ মৃত্যুর ঘটনা

মাধবদী বাজারের একদম ভেতরে, মাধবদী কলেজের পাশে পুরোনো আমলের স্থাপত্যঘেরা কয়েকটা ঘর— এটা মাধবদীর জমিদার বাড়ি। লোকজনের কাছে ‘বাবুর বাড়ি’ নামে পরিচিত। বছর চার-পাঁচেক আগেও দুইদিকের প্রবেশপথে গেট ছিলো, জমিদারের নির্মিত। কিন্তু দুটো গেটই কী এক অজানা কারণে ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই জমিদারই মূলত মাধবদী বাজার হাট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজকে মাধবদীর যে তাঁতশিল্পে শনৈ শনৈ উন্নতি, তাতে জমিদারের প্রভূত ভূমিকা রয়েছে। শুধু তাই নয়, মাধবদী হাইস্কুল, স্কুল-মার্কেটসহ ব্রহ্মপুত্র-পারের বিশাল এলাকা জমিদারদের দানকৃত ও ফেলে যাওয়া সম্পত্তি।

মাধবদী বাবুর বাড়ি | ছবি : আদিব হোসেন

বর্তমানে জমিদার বাড়িটি মাধবদী কলেজের শিক্ষকদের কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভেতরে প্রবেশ করলে অনুভব করা যায় তিরিশের দশকের স্থাপত্যশৈলীর গুণ। এই বাড়ির সর্বশেষ মালিক ছিলেন জমিদারদের শেষ বংশধর শৈলেন্দ্রকুমার গুপ্তরায়। পূর্ববর্তী জমিদার সতী প্রসন্ন গুপ্তরায়ের ছেলে। বাবার নামেই তিনি ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মাধবদী সতী প্রসন্ন উচ্চ বিদ্যালয়।

জমিদার সতী প্রসন্ন গুপ্তের করুণ রহস্যজনক মৃত্যুর খবর বলতেই এই ভূমিকা শোনানো। তার আগে জমিদার বাড়ি সম্বন্ধে দুয়েক লাইন জানানো দরকার। জমিদার বাড়ি বা পরে বাবুর বাড়ির আগে নাম ছিলো মুন্সিবাড়ি। শেষ জমিদারের চার পুরুষ আগে এই বাড়ির মালিক মুন্সিয়ানা করে অনেক টাকাপয়সা করেছিলেন বলে তার নাম হয়ে যায় মুন্সি, আর বাড়ির নাম মুন্সিবাড়ি। তিনি জমিদারি শুরু করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর চার ছেলে জমিদারির মালিক হন। সবাই বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু প্রত্যেকেই নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। এরমধ্যে তৃতীয়জন এক পুত্রসন্তান দত্তক নিয়েছিলেন। এই দত্তক পুত্রই পরে এই জমিদারির হাল ধরেন। তার নাম সতী প্রসন্ন গুপ্ত।

সময়টা ১৯১৪/১৫ সালের। মাধবদী গ্রাম নেহাৎ একটা অজ পাড়াগাঁ। গ্রামের মাঝখানে ব্রহ্মপুত্রের শাখা বয়ে চলেছে। সবাই এটাকে খাল বলে। তবে ভরা বর্ষায় যৌবন উছলে পড়ে। গ্রামটা মুসলমান অধ্যুষিত হলেও হিন্দুরাই মূলত প্রভাব বিস্তার করেছিলো। গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরগুলি হিন্দুদের। গ্রামের উঠতি জমিদার হিন্দুধর্মাবলম্বী। জমিদার বাড়ির জ্ঞাতিসম্পর্কীয় রায়বাড়িও অবস্থাসম্পন্ন।

জমিদার সতী প্রসন্ন গুপ্ত ছিলেন সাদাসিধে সরল প্রকৃতির লোক। দত্তক হিসেবে তার এই বাড়ির সঙ্গে যোগ। লেখাপড়ায় সুবিধে করতে না পারলেও জমিদারির উপযুক্ত জ্ঞানবুদ্ধি তার ছিলো। দেখতে সুপুরুষ ছিলেন। পিতা বৃদ্ধ জমিদার পোষ্যপুত্র, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি পরিবেষ্টিত হয়ে স্বর্গগত হলেন। নবীন জমিদারের বয়স তখন সাইত্রিশ-আটত্রিশ মাত্র। পূর্ণ বয়সে বিবাহ করেছিলেন নারায়ণগঞ্জের এক মেয়েকে। ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্যে জমিদার গৃহিণীকে নারায়ণগঞ্জে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হতো। বাড়িতে একা জমিদার সতী বাবু আমলা-কর্মচারীসহ বিষয়সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নিয়ে।

সতী প্রসন্ন গুপ্ত রহস্যজনক করুণ মৃত্যু
জমিদারের প্রসাদপুষ্ট চাটুকারের দল সবসময় তাকে ঘিরে থাকতো। গান-বাজনা, হাসি-হুল্লোড় বাড়িতে লেগেই থাকতো। খালি বাড়ি। সুযোগ বুঝে কিছু দুষ্টুলোক এই আসরের মধ্যে ঢুকে গেলো। তাদের দৃষ্টি গেলো জমিদারের টাকা-পয়সার দিকে। অন্তরঙ্গ বন্ধুর মুখোশ পড়ে তারা জমিদারকে সম্মোহিত করে ফেললো। এরা ছিলো তার দিবারাত্রির সঙ্গী। আমোদ-প্রমোদের নানা উপকরণ তারা সরবরাহ করতো। জমিদার বাবু তাদের হাতে নিজেকে প্রায় সমর্পণ করে দিলেন। একদিন জমিদার বাবু ভাত খাওয়ার পর একটা পান খেলেন, তারপর অজ্ঞান হয়ে গেলেন। বহুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলো অনেক জল ঢালার পর। কিন্তু সেই থেকে শুরু। পান খাওয়ার ফলে মুখের ভেতর ঘামাচির মতো ছোটো ছোটো কী যেনো দেখতে পাওয়া গেলো। তার কিছুদিন পর বড়ো বড়ো গরম হাঁড়ির মাধ্যমে জমিদার বাবুর হাত-পা-পিঠসহ সমস্ত শরীর সেঁক দেয়ার চিকিৎসা চলতে লাগলো। প্রতিবেশিরা এসে দেখেন, দরোজা-জানালা বন্ধ করে সম্পূর্ণ গুমোট, বদ্ধ পরিবেশে জমিদারের উপর গরম বড়ো বড়ো হাঁড়ির সেঁক দেয়া চলছে। আর জমিদার বাবু চিৎকার করতে করতে ঘরের এপাশ থেকে ওপাশে দৌঁড়াচ্ছেন। কখনো কখনো বলছেন, “ওকে বলো, আমি আর টাকা দিতে পারবো না। ও শুধু টাকা চায়।” বলতে বলতে চিকিৎসকের দিকে ইঙ্গিত করছিলেন।

চিকিৎসকের পরামর্শ ছিলো জমিদার গিন্নিকে যেনো তার এই রোগের সংবাদ জানানো না হয়, কিন্তু অবিলম্বে জমিদার গিন্নি এ-সম্পর্কে জেনে দ্রুত ছেলেমেয়ে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ হতে রওনা দিলেন। এসে জমিদারের অবস্থা দেখে তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। তিনি এই চিকিৎসক বিদায় করলেন। জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তাকে এই সকল বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতা করেন পাশের রায়বাড়ির বড়োকর্তা। তিনি না থাকলে একা মহিলার পক্ষে সবকিছু সামাল দেয়া কঠিন হতো। তবে সবচে’ বড়ো কথা হলো, কিছু স্বার্থান্বেষী লোভী মানুষের কারণে, চিকিৎসকের সহযোগিতায় যে-আসুরিক অপচিকিৎসা দিনের পর দিন জমিদার বাবুর উপর চলেছে, তাতে তিনি ততোদিনে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন। পরিবারের সকল চেষ্টা, সেবা ইত্যাদির পরও ভালো হননি। প্রায় দুই বছর এই নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা থেকে জমিদারবাবু নিজেই নিজেকে মুক্তি দেন।

একদিন সকালবেলা বাড়ির কর্ত্রী অনেক ডাকাডাকি করেও সাড়াশব্দ পাচ্ছিলেন না। চাকররাও সারাদিন ডাকাডাকি করলো। কোনো সাড়া নেই। অবশেষে ডাকা হলো রায়বাড়ির কর্তাকে। তাকে জমিদারবাবু সমীহ করতেন। তার ডাক অগ্রাহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু তিনিও ব্যর্থ হলেন। পরে তিনি চাকরকে হুকুম দিলেন বাড়ির পেছন দিয়ে যেভাবেই হোক দরোজার ছিটকিনি খোলার ব্যবস্থা করতে। তাই করা হলো। দরোজা ভেঙে অবশেষে দেখা গেলো, জমিদারবাবু ফাঁস লাগিয়ে শূন্যে ঝুলছেন। মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সের টগবগে জমিদারের এই করুণ মৃত্যু দেখে সবাই বেদনায় মুষড়ে পড়লো। জমিদার বাবুর দুই সন্তান তখনো নাবালক।

গ্রামের সেই লোভী, বন্ধুর বেশে ষড়যন্ত্রকারীগণ উল্টো মামলা করলেন জমিদার গিন্নির বিরুদ্ধে। বলতে লাগলেন, তার বউই তাকে বিষ খাইয়ে ঝুলিয়ে এখন আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করছেন। পুলিশে বাড়ি গিজগিজ করছে। দুইদিন পর শবদাহের অনুমতি মিললো।

আদালতে মামলা চললো অনেকদিন। রায়বাড়ির বুড়োকর্তা সাক্ষ্য দিলেন। শেষপর্যন্ত তার সাক্ষ্যতেই জমিদার গিন্নি ছাড়া পেলেন স্বামী হত্যার কলঙ্ক থেকে। কিন্তু তাতেও বিপদ গেলো না। যতোদিন ছেলেরা সাবালক না হচ্ছে, ততোদিন ছেলেদের পক্ষে মা-ই জমিদারি কোর্ট অব ওয়ার্ডসে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হচ্ছিলো না। পরে রায়বাড়ির দুইকর্তা মিলে এক লক্ষ টাকা জামিনে আসন্ন কোর্ট অব ওয়ার্ডসের হাত থেকে জমিদারি রক্ষা করলেন। একা জমিদার গিন্নি দুই নাবালক সন্তান নিয়ে কতোগুলো অর্থলিপ্সু, ক্ষমাহীন চোখের সামনে দিন-রাত অতিবাহিত করেছেন।

শেষকথা
মাধবদীর জমিদার শৈলেন্দ্র গুপ্তরায় ১৯৪৬ সালে ব্রহ্মপুত্রের ওপারে বাবার নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন— ‘মাধবদী সতী প্রসন্ন উচ্চ বিদ্যালয়’। এর অনেক আগে থেকেই অবশ্য অন্য জায়গায় জমিদার গিন্নির তত্ত্বাবধানে একটা স্কুল চলেছিলো ‘মাধবদী এম ই স্কুল’ নামে। ওটাই ১৯৪৬ সালে স্থানান্তরিত হয় এবং পরের বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।

মাঝখানে ব্রহ্মপুত্রের জল অনেক গড়িয়েছে। নাবালক পুত্রেরা একসময় বড়ো হয়েছে, জমিদার হয়েছে, শান-শওকত বেড়েছে। মাধবদী হাট প্রতিষ্ঠা হয়েছে। জমিদারের বাড়িতে বড়ো বড়ো দেউরিসহ বিল্ডিং উঠেছে। আর জমিদার শৈলেন্দ্র গুপ্তরায় সাধারণ প্রজাদের এবং মুসলমান প্রজাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ছাতা হাতে চলার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। সে অন্য প্রসঙ্গ। এসব গল্প অন্য আরেকদিন করা যাবে।

দ্রষ্টব্য
রায়বাড়ির পুত্রবধূ প্রিয়বালা গুপ্তা তার শেষবয়সে আত্মজীবনী লেখেন ‘স্মৃতিমঞ্জুষা’ নামে। আত্মজীবনীটি তার পুত্র রঞ্জন গুপ্ত’র সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয় কলকাতার দে’জ পাবলিশার্স থেকে। পরবর্তীতে মাধবদীর ভাই গিরিশচন্দ্র সেন গণপাঠাগার বইটির পুনর্মুদ্রণ করে। এই লেখায় জমিদার সতী প্রসন্ন গুপ্ত’র মৃত্যুর ঘটনার বিভিন্ন তথ্য নেয়া হয়েছে উক্ত বই থেকেই।

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ