গিরিশচন্দ্র ও নরসিংদীর নারীশিক্ষা

‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি’ বলে বহুল ব্যবহৃত একটি প্রবাদ বাক্য রয়েছে। নরসিংদীর ঐতিহাসিক উপাদান খুঁজতে গিয়ে আমার জীবনে তেমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। সাটিরপাড়ার প্রজাহিতৈষী জমিদার, শিক্ষাব্রতী ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিত্ব ললিতমোহন রায় বিএবিএল সম্পর্কে উপাত্ত খুঁজতে গিয়ে জানতে পারি, তিনি ছিলেন নেতাজী সুভাষ বোসের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং স্বদেশী স্টিমার কোম্পানি ও সুগার মিলের মালিক। কলকাতা যাদবপুরস্থ বেঙ্গল ল্যাম্পস কারখানা বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অনুরোধে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি।

জমিদার ললিতমোহন রায় নরসিংদীর সাটিরপাড়ায় ব্রিটিশ আমলে একটি স্বদেশী সুগার মিল প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিটিশদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। মিলটি বেশিদিন না টিকলেও দেশপ্রেমের বিশেষ নিদর্শন বহন করেছিলো চিনি কলটি। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে পরিত্যক্ত সেই মিলের জায়গায় তিনি গড়ে তোলেন নারীশিক্ষার জন্যে একটি গার্লস স্কুল এবং তাঁর মা কমলকামিনী দেবীর নামে এর নামকরণ করেন ‘কমলকামিনী গার্লস স্কুল’। তখন নরসিংদী শহরে মেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষার জন্যে কোনো স্কুল কিংবা ইনস্টিটিউট ছিলো না। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি সাটিরপাড়ায় ‘কালী কুমার ইনস্টিটিউশন’ নামে একটি বালক বিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন। স্কুলটির খ্যাতি তখন ভারতবর্ষব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিলো। সেই আশা নিয়ে তিনি কমলকামিনী গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেও এর একযুগ পরই দেশভাগের হট্টগোল শুরু হয়। গার্লস স্কুলের সিংহভাগ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছিলো হিন্দু সম্প্রদায়ের। দেশভাগের কারণে তারা প্রায় সবাই ভারতের বিভিন্ন স্থানে (পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বিহার) চলে গেলে স্কুলটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতাও উঠে যায়। সঙ্গত কারণে স্কুলটি অনেকদিন বন্ধ থাকে। পরবর্তীতে সেখানে গার্লস স্কুলটি চালু হলেও রহস্যজনক কারণে কমলকামিনী নামটি পরিবর্তন করে সেখানে নরসিংদী বালিকা বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড ওঠে। এই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কাদের কারণে বাস্তবায়িত হয়েছিলো, তা আজো জানা যায় না।

সাটিরপাড়ার জমিদার ললিতমোহন রায়

একইভাবে আরেকটি গার্লস স্কুল মাধবদীতে নিঃশেষিত করা হয়েছিলো। সেখানকার শিক্ষানুরাগী নারী প্রিয়বালা গুপ্তা বস্ত্রশিল্পের পীঠস্থানটিকে শিক্ষায় আলোকিত করার জন্যে একটি গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মূলত পিছিয়ে পড়া নারী সমাজকে শিক্ষিত করে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে তিনি শিক্ষার পাশাপাশি আরো অনেক সামাজিক কাজ হাতে নেন। তাঁর স্মৃতিচারণামূলক ‘স্মৃতিমঞ্জুষা’ গ্রন্থে এ-সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ আছে। গ্রামের মানুষদের বিশেষ করে মেয়েদের স্বাবলম্বী করে তোলার জন্যে তাঁর কোনো বিকল্প ছিলো না। তাদেরকে অক্ষরজ্ঞান দেয়ার পাশাপাশি সেলাই শিক্ষা, কুশি কাটা ও বোনাসহ অন্যান্য হাতের কাজ শেখাতেন। এমনকি সাহিত্যচর্চার জন্যে হাতে লেখা পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। ‘কিশলয়’ নামে পত্রিকার তিনটি সংখ্যাও প্রকাশিত হয়েছিলো। এতে প্রিয়বালা গুপ্তার কয়েকটি শিশুতোষ কবিতা প্রকাশ পেয়েছিলো। তাঁর বড়ো ছেলে অজিত গুপ্ত পত্রিকাটি হাতে লিখতেন। অলঙ্করণ করেছিলেন রানু পাকড়াশী। এতে নিয়মিত লিখতেন বিপ্লবী সতীশচন্দ্র পাকড়াশী, অজিত গুপ্ত, হিরণবালা রায়, সাধনচন্দ্র তপাদার ও প্রিয়বালা গুপ্তা।

১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে প্রিয়বালা গুপ্তা তাঁর জীবনের বড়ো স্বপ্ন ‘মাধবদী শিশুশিক্ষা বিদ্যানিকেতন’ নিজবাড়িতে শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দাগ তখনো মুছে যায়নি। দুবেলা স্কুল বসতো। সকাল ০৭ টা থেকে ০৯ টা পর্যন্ত শিশু ও প্রথম শ্রেণি, অন্য শ্রেণিগুলো সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ০৪ টা পর্যন্ত চলতো। মাঝে একঘণ্টা খাবার বিরতি ছিলো। প্রথমদিকে তিনি একা শিক্ষকতা করলেও পরে পাড়ার দুয়েকজন শিক্ষিত ছেলে সাহায্য করতো। পরবর্তীতে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে রঞ্জন গুপ্ত ও ঢাকা সেন্ট গ্রেগরির ছাত্র সাধন তপাদার ও শংকর তপাদার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

প্রিয়বালা গুপ্তা

তারপর ছাত্রী সংগ্রহের জন্যে তিনি বাড়ি বাড়ি যেতে শুরু করেন। নিজের মেয়ে আরতি গুপ্তা ও কাশীপুরের শৈলবালা সাহাকে দিয়ে শুরু করেন ‘মাধবদী শিশুশিক্ষা বিদ্যানিকেতন’। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ কি এপ্রিলে ভর্তি হন কাশীপুরের স্বদেশী মালাদার, মাধবদীর সতী পাকড়াশী ও ননী পাকড়াশী। এভাবে ০৫ জন মেয়ে দিয়ে স্কুলটি শুরু হলেও পরবর্তীতে ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে শিশু শ্রেণির স্কুলটি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত খোলা হয়। ০৫ জন শিক্ষার্থী বেড়ে দাঁড়ায় ১৫০ জনে। মাধবদী ছাড়াও কোতয়ালীরচর, আটপাইকা, কাশীপুর, আলগী, নওপাড়া, বিরামপুর, আনন্দী, শেখেরচর ও ভগীরথপুর থেকে ছাত্রীরা দলে দলে এসে সেই স্কুলে ভর্তি হয়। তখন হিন্দুপ্রধান মাধবদী এলাকায় মুসলমান নারীশিক্ষা ছিলো না বললেই চলে। কিন্তু প্রিয়বালার স্কুলে মুসলমান শিক্ষার্থীরাও ভর্তি হতে শুরু করে। প্রথমদিকে কলুপাড়ার সুলতান মিঞা তার এক মেয়ে ও এক ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করতে আসেন। মেয়েদের স্কুল বিধায় সেখানে ছেলে ভর্তির নিয়ম ছিলো না। কিন্তু সুলতান মিঞার পীড়াপীড়ির কারণে শিশু ছেলেকে সেখানে ভর্তি নিয়েছিলেন। এরপর নওপাড়ার ভূঁইয়া বাড়ির খালেদা আখতার ১০ বছর বয়সে সেখানে ভর্তি হয়। খালেদা সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করে ঢাকা ইডেন কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন। পরে স্বামীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া চলে যান। সেখান থেকে তিনি প্রিয়বালা গুপ্তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। কিন্তু দেশভাগ ও অব্যাহত দাঙ্গার কারণে প্রিয়বালা গুপ্তা ও তাঁর পরিবারের পরিবেশ প্রতিকূলে চলে যেতে শুরু করে। বিশেষ করে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ভয়াবহ দাঙ্গার আঁচ লাগে মাধবদী অঞ্চলে। নিজের প্রিয় জন্মভূমি, স্বামীর বাড়ি, স্কুল আর সাধারণ মানুষের গভীর ভালোবাসা ছেড়ে তাঁকে সীমান্ত পার হতেই হলো। দুই ছেলে, দুই মেয়েকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নৈহাটিতে পা রাখলেন তিনি। এই নৈহাটিতে জন্ম সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। সিউড়ী বিদ্যাসাগর কলেজে শিক্ষক হিসেবে চাকুরি পান ছেলে রঞ্জন গুপ্ত। ছেলের সঙ্গে তিনি সিউড়ী চলে যান। সেখান থেকে আর তাঁর ফেরা হয়নি। পেছনে পড়ে থাকে স্বপ্নের স্কুল, টুল-বেঞ্চ আর প্রিয় শিক্ষার্থীরা। সুখের খবর এই যে, মাধবদীর বর্তমান প্রজন্মের উদ্যোগী দুই তরুণ শাহীনুর মিয়া এবং সুমন ইউসুফ প্রিয়বালা গুপ্তার স্কুলটি পুনর্জীবিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যে নরসিংদী জেলা প্রশাসন স্কুলের জন্যে জমিও বরাদ্দ করেছে।

উল্লেখ্য, মাধবদীতে প্রিয়বালা গুপ্তা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গার্লস স্কুলের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সেখানে আরেকটি স্বল্পায়ু গার্লস স্কুলের সন্ধান পাওয়া যায়। মাধবদীর খ্যাতনামা আইনজীবী প্রকাশ পাকড়াশীর ছেলে বেনু পাকড়াশী সেটি গড়ে তুলেছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। গ্রামে এসেই মুষ্টিভিক্ষার মাধ্যমে একটি অবৈতনিক গার্লস স্কুল খোলেন এবং দুজন শিক্ষক নিয়োগ দেন। দেড় বছরের মাথায় তা বন্ধ হয়ে যায়। পড়ে থাকে ব্ল্যাকবোর্ড আর বেঞ্চ। শেষদিকে এর সঙ্গে যুক্ত হন প্রিয়বালা গুপ্তা। তিনি চেষ্টা করেন স্কুলটি বাঁচাতে। কিন্তু এলাকার মানুষের অসহযোগিতায় তা সম্ভব হয়নি।

হিসাব করলে প্রিয়বালা গুপ্তার স্কুলটি জেলার তৃতীয় প্রাচীন গার্লস স্কুল। দ্বিতীয়টি ছিলো জমিদার, বিপ্লবী ও শিক্ষানুরাগী ললিতমোহন রায়ের প্রতিষ্ঠিত কমলকামিনী গার্লস স্কুল। তাহলে সবচে’ প্রাচীন গার্লস স্কুল কোনটি? এর খোঁজ করতে গিয়ে একটি বিস্মৃত ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। যা নরসিংদীর নারীশিক্ষার ইতিহাসে মাইলফলক। একইসাথে শিক্ষার ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে হবে। প্রাচীন গার্লস স্কুলটির সঙ্গে ভাই গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৪-১৯১০) ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কোরানের প্রথম বঙ্গানুবাদকারী (টিকা টিপ্পনীসহ) ও ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারক হিসেবে তিনি আজীবন নারীশিক্ষা, বিধবা বিবাহ ও কুসংস্কার রোধে কাজ করে গেছেন। তা থেকে জন্মভূমি পাঁচদোনাকেও বাদ দেননি। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন, ৪০ বছরেরও অধিক সময় গার্লস স্কুলটি চলেছিলো। পরবর্তীতে নানা বাধা-বিপত্তির কারণে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয়ভাবে অনুসন্ধান করে এবং নানা ঐতিহাসিক বইপত্তর ঘেঁটেও গিরিশচন্দ্র সেনের প্রতিষ্ঠিত সেই গার্লস স্কুলের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়নি। তারা কেনো নরসিংদীর প্রথম গার্লস স্কুলটির ইতিহাস লেখা থেকে বিমুখ ছিলেন, সেটাও একধরনের রহস্য। জেলার ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ ‘ঘোড়াশাল কাহিনী’, ‘পূর্ববঙ্গে মহেশ্বরদী’, ‘মহেশ্বরদী পরগণার ঐতিহাসিক প্রবন্ধাবলী’, ‘নরসিংদীর গুণীজন’ কিংবা ‘নরসিংদীর কবি-সাহিত্যিক’সহ কোথাও স্কুলটির কোনো বিবরণ নেই। গিরিশচন্দ্র সেন ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীতে এর উল্লেখ না করলে স্কুলটির কথা চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যেতো। গিরিশচন্দ্র সেনের বংশধর হিসেবে পরিচিত রনজিৎ কুমার সেন তাঁর ‘মাওলানা ভাই গিরিশচন্দ্র সেন’ বইয়ে গার্লস স্কুলটির কথা উল্লেখ করলেও সে-সম্পর্কে আর কোনো তথ্য উল্লেখ করতে পারেননি। তেমনি এডভোকেট মুখলেছুর রহমান চৌধুরীর লেখা ‘ভাই গিরিশচন্দ্র সেন পরিচিতি’ গ্রন্থেও স্কুলটি সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই।

১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত গিরিশচন্দ্রের আত্মজীবনীতে উল্লেখ করা হয়, “চল্লিশ বৎসরেরও অধিককাল হইতে পাঁচদোনার বালিকা বিদ্যালয়ের কার্য্য চলিতেছে।” এই হিসাবে দেখা যায়, ১৮৬৯ কিংবা ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা ফরাশগঞ্জের এক বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ইডেন ফিমেল স্কুলেরও আগে অজপাড়াগাঁ পাঁচদোনায় গিরিশচন্দ্র মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্কুলটি যাতে ভালোভাবে চলে, সেজন্যে তিনি কলকাতা থেকে বই-পুস্তক ও খেলার সামগ্রী পাঠাতেন। স্কুলটি সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত হয়েছিলো। অনেক মেয়ে বৃত্তি পেয়েছিলো। এখান থেকে লেখাপড়া শিখে অনেকে স্বামী বা বাবার ঘরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন, অনেকে উচ্চশিক্ষাও গ্রহণ করেছিলেন। রক্ষণশীল মহলের শত বাধা সত্ত্বেও গিরিশচন্দ্র স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আত্মজীবনীতে তিনি লেখেন, “বাল্যকাল হইতে স্ত্রী শিক্ষা বিষয়ে আমার বিশেষ উৎসাহ ও অনুরাগ। স্বদেশে গৃহে অবস্থানকালে প্রত্যেক পরিবারের বধূদিগের দুঃখ দুরবস্থা ও তাঁহাদের প্রতি শ্বাশুড়ী, ননদ প্রভৃতির অত্যাচার দর্শন করিয়া আমার মন অতিশয় ব্যথিত হইয়াছে। এইরূপ নিপীড়ন ও নির্য্যাতনের ভিতর থাকিয়া তাঁহাদের মনোবৃত্তি সকল স্ফুর্ত্তি পাইতেছিল না, জ্ঞান পিপাসা কিছুই চরিতার্থ হইতে ছিল না। ভদ্র সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যাগণও বধূরূপে দাসীর ন্যায় নিজ দায়িত্বে খাটিয়া গলদঘর্ম্ম হন, প্রায় কাহারও হইতে আদরযত্ন লাভ করেন না। কাজে একটু ত্রুটি হইলে গঞ্জনা ভোগ করেন, তাঁহাদিগকে নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করিতে হয়, তাঁহাদের মুখ ফুটিয়া কথা কহিবার স্বাধীনতাটুকু নাই। এ সকল দেখিয়া আমি মনে ক্লেশ পাইতাম, ভাবিতাম লেখাপড়া না শিখিলে, আত্মোন্নতি না হইলে, ইঁহাদের অবস্থার উন্নতি, স্বাধীন চিন্তা, মানসিক স্ফুর্ত্তি হওয়া অসম্ভব। লেখাপড়া শিক্ষার দ্বার উম্মুক্ত করিতে হইবে, ইহা ভাবিয়া আমি পাঁচদোনা গ্রামে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে সমদ্যোগী হই।”

গিরিশচন্দ্র সেন

গিরিশচন্দ্র সেনের জীবনে ময়মনসিংহ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। সেখানে তিনি পড়াশোনা করেন। কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন। সেখানেই তাঁর সঙ্গে ব্রাহ্ম সমাজের নেতা কেশবচন্দ্র সেনের পরিচয় হয়েছিলো। সেখানে তাঁর অন্যতম কীর্তি হলো একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। তিনি মুড়াপাড়ার জমিদার ও ময়মনসিংহের কালেক্টর অফিসের খাজাঞ্চি রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় তাঁর (রামচন্দ্রের) বাড়িতে একটি গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সে-স্কুলে শহরের অনেক ভদ্র পরিবার ও রামচন্দ্রের দু’কন্যা পড়াশোনা শুরু করেন। শিক্ষকতার বিনিময়ে গিরিশচন্দ্র কোনো অর্থ গ্রহণ করতেন না। কালেক্টর রেনাল্ড সাহেবের স্ত্রী দু’বার উক্ত স্কুল পরিদর্শন করেন এবং ছাত্রীদের জন্যে সেলাই কল ও খেলার সামগ্রী উপহার দেন। গিরিশচন্দ্র ময়মনসিংহ ছেড়ে চলে যাবার পর স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে পরবর্তীতে সেখানে সরকারি সহযোগিতায় ব্রাহ্ম সমাজের উদ্যোগে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যা এখনো সুনামের সঙ্গে টিকে আছে। যার শুরু হয়েছিলো ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই স্কুল পরিদর্শন করেছিলেন।

গিরিশচন্দ্র সেন মৃত্যুর আগে একটি উইল বা শেষ ইচ্ছাপত্র রেজিস্ট্রি করে যান কালীগঞ্জ সাব রেজিস্ট্রি অফিসে। সেই উইলে তিনি পাঁচদোনা ও তার আশেপাশের গ্রামগুলোর উন্নয়ন ও নারীশিক্ষার জন্যে অর্থ বরাদ্দ করে যান। তিনি তাঁর আয়কৃত অর্থ থেকে শতকরা ৭৫ টাকা জন্মভূমি পাঁচদোনা গ্রামের দুঃখিনী, বিধবা, নিরাশ্রয় বালক-বালিকা, দরিদ্র বৃদ্ধ, নিরুপায় রোগী এবং নিঃসম্বল ছাত্র ও ছাত্রীদের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বিদ্যাশিক্ষার জন্যে দান করেন। তিনি নারী জাগরণের জন্যে দীর্ঘদিন ‘মহিলা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সে-পত্রিকায় বেগম রোকেয়া নিয়মিত লিখতেন। বেগম রোকেয়াকে গিরিশচন্দ্র স্নেহ করে ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন। দুজন দুই ধর্মের হলেও তাঁদের সম্পর্ক প্রকৃতই ছিলো মা ও ছেলের।


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ