শামসুর রাহমানের শেকড়ের টান

বাংলাদেশের অন্যতম কবি এবং এ-কালের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও অভিনন্দিত কবি শামসুর রাহমান। রবীন্দ্র-উত্তর তিরিশ পরবর্তী কাব্যজগত বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে অনন্য এক আন্দোলন। রবীন্দ্র-প্রভাব মুক্ত হয়ে শুরু হয় বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র পথচলা। এই ধারাবাহিকতায় জীবনানন্দ দাশের পরই পঞ্চাশের দশকে আধুনিকতার নতুন মাত্রা নিয়ে আবির্ভূত হন শামসুর রাহমান।

চল্লিশ দশকের শেষ পর্যায়ে এবং পঞ্চাশের দশকে তাঁর সদর্প আবির্ভাব হলেও পরবর্তী কয়েক দশকে কবি নানা মাত্রায়, ভাব-আঙ্গিকের বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিজেকে জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন আধুনিক কবি হিসেবে। কবিতার আলোচনায়, কবিদের আসরে তাঁর অবস্থান হয়ে যায় প্রথম সারিতে। কিন্তু এই কবি সম্পর্কে তাঁর শেকড়ের স্থানের মানুষদের একটি ভিন্ন অভিযোগ শুনতে পাওয়া যায়। তাদের বক্তব্য, “এতো জনপ্রিয় কবি, এতো প্রতিষ্ঠিত কবি, তাঁর শেকড়ের সাথে সম্বন্ধ নেই।”

তাঁর শেকড় নরসিংদী জেলার পাড়াতলী গ্রাম, কিন্তু নরসিংদীর সাথে কবির সম্পর্ক নেই, ‘কবি নরসিংদী আসেন না’ ইত্যাদি— বিভিন্ন সভার আলোচনা, নানা আড্ডার আলাপচারিতায় এসব কথা শুনে আমার মনে গভীর জিজ্ঞাসা তৈরি হয়। আসলে এইসব অভিযোগ কি সত্যি? কবি তাঁর শেকড়ের সাথে সম্বন্ধ রাখেন না? নাকি আমরাই কবির সাথে সম্বন্ধ তৈরি করিনি, কবিকে জানতে-বুঝতে চেষ্টা করিনি? কবির সৃষ্টিকর্মের সাথে আমাদের সম্বন্ধ তৈরি হয়নি? আমার ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের গবেষণায় এবং কবির কবিতা পাঠের মাধ্যমে আমার বোধ সৃষ্টি হয়— কবির সম্পর্কে এসব অভিযোগ সত্য নয়। বরং আমরাই তাঁর সৃষ্টিকর্মের অধ্যয়ন না করে, তাঁর জীবনাচরণের তথ্য না জেনে কবিকে অভিযুক্ত করে ফেলেছি। আমার ধারণা হয়েছে, কবি আমাদেরই লোক এবং একজন কালজয়ী শিল্পী হিসেবে কবি সারাদেশের ও পৃথিবীর মানুষের। এসব ভাবনা নিয়ে যখন তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে এবং আমিও কবিকে বেশি করে জানার চেষ্টা করছি, তখন আমি নরসিংদী কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপনার কাজে রত। কবির প্রতি এসব অভিযোগ-অনুযোগের কারণে আমার কষ্ট হতো এবং কবির শেকড়ের সাথে আমারো একটু যোগসূত্র ছিলো। সেই তাগিদে আমি কবিকে আরো বেশি করে জানার চেষ্টা করি। কবির শেকড় নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার পাড়াতলী গ্রাম। মেঘনা নদীর তীরলগ্ন পাড়াতলী তাঁর পৈতৃক নিবাস, তাঁর মূল ঠিকানা। যদিও জন্ম নিয়েছিলেন পুরান ঢাকার মাহুতটুলীতে ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর, নানার বাড়িতে। আমার গর্ব, আমার অহঙ্কার, আমার বাড়িও পাড়াতলী ইউনিয়নের মধ্যনগর গ্রামে।

কলেজের অধ্যাপনাকালে আমি শ্রেণিকক্ষের পাঠদান প্রক্রিয়ার বাইরেও কলেজের সকল সহপাঠক্রমিক কাজে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলাম অধ্যক্ষ মহোদয়ের তাগিদে। এবং নিজেরও ভালোলাগার তাগিদ ছিলো এসব কাজে যুক্ত হওয়ার মধ্যে। ১৯৭৮-৭৯ শিক্ষাবর্ষের জামান-নাসির পরিষদের ছাত্র সংসদের আমি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক। কলেজে তখন ছাত্র সংসদের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিভাগের মাধ্যমে সপ্তাহব্যাপী সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা এবং সাহিত্য উৎসব হতো। ছাত্র সংসদের সভায় আমি প্রস্তাব করলাম— এবার সাহিত্য উৎসবের সমাপনী এবং পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কবি শামসুর রাহমানকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানাতে চাই। প্রস্তাব সানন্দে এবং সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো। যথারীতি কবির সাথে আমরা যোগাযোগ করলাম এবং কবিও আগ্রহভরে অনুষ্ঠানে আসার সম্মতি দিলেন। বর্ণাঢ্য আয়োজনে কবিকে আমরা বরণ করলাম। সুন্দর অনুষ্ঠান হলো। কবি অনেক কথা বললেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করলেন। অনুষ্ঠান শেষে খাবার টেবিলে এবং কবির বিশ্রামের মুহূর্তগুলোতে আমি নানা আলোচনার সুযোগ নিলাম। সাহস করে বলেই ফেললাম—

“কবি, আপনার সম্পর্কে নরসিংদীবাসীর অনেকেরই অনুযোগ, আপনি নরসিংদীর সাথে সম্পর্ক রাখছেন না।”
কবি হেসে বললেন, “কেনো এই অনুযোগ? নরসিংদী তো আমার শেকড়। আমার অনেক কবিতায় আমার গ্রাম, আমার পূর্বপুরুষ, আমার মেঘনা-বিধৌত চরাঞ্চল, নরসিংদীর মাটি ও আমার নানা সুখ-দুঃখের স্মৃতির বিবরণ রয়েছে। আমার অনেক কবিতার জন্ম নরসিংদীর পাড়াতলী গাঁয়ের মাটিতে বসে।”
এবং কবি উল্টো অনুযোগ করলেন, “নরসিংদীর মানুষ তো আমাকে ডাকে না সভা-অনুষ্ঠানে, আমি তো নিয়মিত পাড়াতলী আসি, সময় কাটাই প্রকৃতির কোলে। আজ আপনারা ডেকেছেন, আমি এসেছি। আমাকে ডেকে কেউ পায়নি, এমন অভিযোগ তো করা যাবে না।”
আমি লজ্জিত হলাম। বললাম, “কবি, আপনি ঠিক বলেছেন, ব্যর্থতা আমাদের। আমরা আপনাকে জানার চেষ্টা করি না। আপনার কবিতা পড়ি না। আপনাকে কাছে পাওয়ার সুযোগ নিই না।”

এ-প্রসঙ্গে কবির বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘হৃদপদ্মে জ্যোৎস্না দোলে’র একটি কবিতা ‘পাড়াতলী গাঁয়ে যাই’র উল্লেখ না করে পারছি না। এই কবিতায় কবি তাঁর উৎস এবং শেকড়ের কথা বলেছেন অকপটে, কবিতার শিল্প আঙ্গিকে—

পাড়াতলী গাঁয়ে যাই
পাড়াতলী একটি গাঁয়ের নাম,
…পাড়াতলী আমাদের আদি বাসস্থান
বহুযুগ ধরে কল্লোলিত মেঘনা নদীর তীরে। এখানেই
ছিলেন আমার পিতা, পিতামহ, মাতামহ আর
প্রবীণ প্রপিতামহ আর বহু গুরুজন।
পাড়াতলী গাঁয়ে কখনো কখনো যাই গাঢ় আকর্ষণে
নিজের উৎসের আর পিতার নির্মিত
দালানে প্রবেশ করি কিছু স্মৃতির সুঘ্রাণ নিতে। দালানের
পাশেই পুরানো মসজিদ, মসজিদটির পাশে
কী নিঝুম গোরস্থান, যেখানে আমার পিতা, পিতামহ আর
মাতা গভীর, গভীরতম ঘুমে অচেতন এবং আমার প্রিয়
সন্তানও সেখানে আছে মাটির নিচে ঘুমপাড়ানিয়া
গানে মগ্ন দুনিয়ার মাঠের খেলার মায়া ভুলে।
*  *  *
মেঘনা নদীর ডাকে, আমার উৎসের
গভীর গভীর টানে মাঝে মাঝে আমি পাড়াতলী গাঁয়ে যাই।

তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘ভাঙ্গাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুঁকছে’র উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘তট ভাঙ্গার জেদ’, যার মধ্যেও রয়েছে শেকড়ের কথা এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কবি কবিতায় বলেছেন—

বলতে ভালো লাগে, আমার পূর্বপুরুষগণ
মেঘনা নদীর তীরবর্তী পাড়াতলী গাঁয়ের
বাসিন্দা ছিলেন। তাঁদের ছোটবড় কুঁড়ে ঘর
এখন নিশ্চিহ্ন, কিন্তু পুকুর আর পাকা মসজিদটি
আজ অব্দি রয়ে গেছে সগৌরবে। আমার
পিতার সৃষ্ট একটি দালান আর ইশকুল এখনও
দাঁড়ানো মাথা উঁচু করে।
*  *  *
দাদাজান, নানাজান, আব্বা আর বড় চাচা, আমার
এক সন্তানের এবং আরও কারও কবর রয়েছে সেখানে।
রাত্তিরে নিষ্প্রদীপ সেই উদাস কবরস্থানে জোনাকিরা ছড়ায়
আলো আর ঝিঁঝিঁ পোকা একটানা সুর হয়ে ঝরে চৌদিকে।

পূর্বপুরুষদের কদমি পুকুর আত্মজকে আমার
গিলেছে সেই কবে। এক ভরদুপুরে। আজও স্বগ্রামে
গেলে অতীত এবং বর্তমানের প্রতি নির্বিকার পুকুরটির কিনারে
গিয়ে বসি। গাছ গাছালি ঘেরা এই
জলাশয় সাক্ষী এখানে একাত্তরে হিংস্রতার তাড়া-খাওয়া
সন্ত্রস্ত হরিণের মতো জন্মশহর থেকে ছুটে এখানেই
নিয়েছিলাম ঠাঁই। এই পুকুর আমাকে দেখলেই, মনে হয়,
হাসে বাঁকা হাসি; তবু দিয়েছে যুগল কবিতা উপহার।
*  *  *
শহর লালিত পালিত এই আমার সত্তায় পাড়াতলী গাঁয়ের
পূর্বপুরুষদের শোণিতধারা প্রবাহমান
মেঘনার স্রোতের মতো। বুঝি তাই সমাজের বহুমুখী
নিপীড়ন, নির্দয় শাসকদের সন্ত্রাস আজ
ভেতর মেঘনার উত্তাল তরঙ্গমালা হয়ে জেগে ওঠে প্রতিবাদ
এগিয়ে চলার তেজ, প্রতিক্রিয়ার অনড় তট ভাঙ্গার জেদ।

এই কবিতায় কবি বলেছেন, ‘তবু দিয়েছে যুগল কবিতা উপহার’। এই যুগল কবিতা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকালীন কবির অসাধারণ সৃষ্টি এবং ব্যাপক জনপ্রিয় দুটি কবিতা— ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’। ১৯৭২ সালে প্রাকাশিত ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থের মুক্তিযুদ্ধের যুগল কবিতা। এ নিয়েও কবিকে প্রশ্ন করেছি—

“এ দুটি রচনা সম্পর্কে কিছু বলুন”।
কবি বলেছেন, “কবিতা লিখেছি ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে। আমার বিশ্বাস ছিলো, স্বাধীনতা আসবেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় একদিন গ্রামের বাড়িতে পুকুরপাড়ে বসেছিলাম। পুকুরে অনেকে গোসল করতে আসতো। কয়েকজন ছোটো ছেলেমেয়ে গোসল করছিলো সে-সময়। তাদের ঝাপাঝাপি, অবাধ সাঁতার আমার মনে এক ঝিলিক দিয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে কবিতার লাইন মনে এলো আমার। দ্রুত আমার চাচাত ভাইয়ের কাছ থেকে পেন্সিল আর কাগজ নিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করলাম, পাছে যদি লাইনগুলো হারিয়ে যায়। খুব অল্প সময়ে কবিতা দুটি লিখেছিলাম।”

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মহাকাব্যের বিশালতা ও ব্যাপকতা এবং বিস্তৃতি নিয়ে পাড়াতলী গাঁয়ে বসে লেখা কবিতা দুটি কবির জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে অন্যতম এবং ইতিহাসের দলিল। পাড়াতলী গাঁয়ে কবির পারিবারিক পুকুরে ডুবে তাঁর অকালে প্রয়াত সন্তানের একটি ছবিকে নিয়ে লিখিত কালজয়ী ও শিল্পউত্তীর্ণ কবিতা ‘একটি ফটোগ্রাফ’। কবিতাটি ‘এক ফোঁটা কেমন অনল’ কাব্যের অন্তর্গত এবং এককালে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

কবি শামসুর রাহমানের সৃষ্টিকর্মের এসব তথ্যই প্রমাণ দিচ্ছে, কবির শিকড়সম্বন্ধ কতো গভীর। কবি নিজেও বলেছেন, “নরসিংদীর সঙ্গে আমার একটি গভীর আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। এই জেলার রায়পুরা থানার পাড়াতলী গ্রামে আমার পূর্বপুরুষদের পবিত্র জন্মস্থান। তাই পাড়াতলী তথা নরসিংদীর স্মৃতি আমাকে আনন্দ দেয়, আমার সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতিগুলিকে আন্দোলিত করে।”

১৯৬০ সালে প্রকাশিত ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ নামে প্রথম কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে একজন রোমান্টিক কবি হিসেবে শামসুর রাহমানের সদর্প যাত্রা শুরু। কিন্তু কবি পরবর্তীতে দেশ, কাল, রাজনীতি, সমাজ সচেতন হয়ে ওঠেছেন। হয়ে ওঠেছেন জীবন সচেতন কবি এবং তাঁর কবিতার বিষয় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ভাষা আন্দোলন, বাংলা ভাষা ও বর্ণমালার প্রতি গভীর ভালোবাসা, গণ-আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধ, নানা সংগ্রামী চেতনা এবং স্বদেশ-মানবপ্রেম। কবি তাঁর কবিতায় স্বপ্ন দেখেছেন, আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, আবার স্বপ্ন ভঙ্গের আর্তিও প্রকাশ করেছেন। সব মিলিয়ে ভাব-আঙ্গিকে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের শিল্পধারার সমন্বয় করে কবি হয়ে ওঠেছেন কালজয়ী শিল্পী। অতিক্রম করেছেন অঞ্চল ও দেশকে। যথার্থ অর্থে যিনি কবি, তিনি যেখানেই জন্ম নেন না কেনো, তিনি তাঁর শিল্পকর্মের সফলতা দিয়ে কালজয়ী হয়ে যান। হয়ে যান অঞ্চলকে অতিক্রম করে দেশের, দেশকে অতিক্রম করে পৃথিবীর।
শামসুর রাহমান সেই কবি।


গোলাম মোস্তাফা মিয়া
সাবেক অধ্যক্ষ, নরসিংদী সরকারি কলেজ

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ