‘পথের পাঁচালী’খ্যাত লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নরসিংদীর একটি টালিঘরে কয়েকদিন বসবাস করেছিলেন। টালির ঘরটি ছিলো স্থানীয় সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশন (হাইস্কুল)-এর একটি ছাত্রাবাস। ছাত্রাবাসের একটি অংশে শিক্ষকরাও বাস করতেন। তিনি যখন নরসিংদীতে আসেন, তখন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্যেই তিনি তৎকালীন ঢাকা জেলার অজপাড়াগাঁ নরসিংদীতে এসেছিলেন। নরসিংদী তখন একটি পুলিশ ফাঁড়ির অধীনস্থ ছোটো একটি গঞ্জ। মেঘনা নদীতীরের জনপদটির জমিদার ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা, শিক্ষাব্রতী ও আইনজীবী ললিতমোহন রায় বিএবিএল। তিনিই তাঁর পিতা জমিদার কালী নারায়ণ রায়ের নামের স্কুলটি ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন।
বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) কি শুধুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্যে নরসিংদী এসেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিভূতিভূষণের অকথিত একটি অধ্যায়ের সন্ধান পাওয়া যায়। সেটা হলো, তিনি ছিলেন ভারতীয় গোরক্ষিণী সভার প্রচারক। যার জন্যে তাঁকে বাংলা, ত্রিপুরা ও বার্মার বিভিন্ন এলাকা ভ্রমণ করতে হয়েছিলো। সেই ভ্রমণের অংশ হিসেবে তিনি নরসিংদী এসেছিলেন। একই সঙ্গে বন্ধুর আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন। মূলত গোসম্পদ রক্ষা এবং রোগগ্রস্ত ও দুর্বল গরুদের রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করার জন্যে গোরক্ষিণী সভা কাজ করতো। যার সভাপতি ছিলেন গিরিধারী লাল। সেই গোরক্ষার আদর্শ বুকে ধারণ করেই বর্তমানে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার ভারতকে বিতর্কের মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন।
অবশ্যই বিভূতিভূষণ গোরক্ষার প্রচারকাজে বেশিদিন সময় দেননি। এরপর তিনি খেলাৎচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে গৃহশিক্ষক, সচিব এবং তার ভাগলপুর জমিদার এস্টেটের সহ-ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকুরি করেন। কিছুদিন ধর্মতলাস্থ খেলাৎচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর যোগ দেন গোপালনগর স্কুলে। আমৃত্যু সেখানেই শিক্ষকতা করেছেন। লেখালেখি করেছেন দুহাতে। জন্ম দিয়েছেন পথের পাঁচালী (১৯২৮), অপরাজিত (১৯৩১), মেঘমাল্লার (১৯৩১), মৌরীফুল (১৯৩২), যাত্রাবদল (১৯৩৪), চাঁদের পাহাড় (১৯৩৭), কিন্নরদল (১৯৩৮), আরণ্যক (১৯৩৯), আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৪০), ইছামতী (১৯৫০) ও অশনি সংকেত (১৯৫৯) প্রভৃতি কালজয়ী গ্রন্থ। তাঁর লেখা উপন্যাস নিয়ে বেশকিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। জগদ্বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালী, অপরাজিত ও অশনি সংকেত চলচ্চিত্র নির্মাণ করে বিভূতিভূষণকে অন্যতম উচ্চতায় নিয়ে যান।

বিভূতিভূষণ যখন গোরক্ষিণী সভার প্রচারক হিসেবে কাজ করেন, তখন ভারতবর্ষের অনেক খ্যাতনামা লোক এর ব্যাপক সমালোচনা করেন। শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে মানুষের, বিশেষ করে মুসলমানদের খাবার পথে বাঁধা দেয়ার এই প্রচেষ্টায় ধর্মীয় বিভেদও সৃষ্টি হয়। স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ এতে ভীষণ রকম বিরক্ত হয়েছিলেন। একবার গোরক্ষিণী সভার সম্পাদক এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। স্বামীজী তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের সভার উদ্দেশ্য কী?” সম্পাদক জবাব দেন, “আমরা স্থানে স্থানে পিজরাপোল স্থাপন করছি। দুর্বল, রুগ্ন, জরাগ্রস্ত গোমাতাদের সেখানে রেখে পালন করি। তাছাড়া কসাইদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করি।” স্বামীজী বলেন, “উদ্দেশ্য সৎ সন্দেহ নেই। কিন্তু মধ্য ভারতে শুনেছি নাকি প্রায় ৯ লক্ষ লোক মারা গেছে অনাহারে। এই দুর্ভিক্ষ নিবারণে কতো টাকা সাহায্য করেছেন আপনারা?” সম্পাদক জবাব দেন, “দুর্ভিক্ষে সাহায্য আমরা করি না। গোমাতা রক্ষা করাই আমাদের পরম ধর্ম।” স্বামীজীর প্রশ্ন, “আর মানুষ মরে গেলে তার মুখে একমুঠো অন্ন দেওয়া বুঝি আপনাদের ধর্ম নয়?” সম্পাদকের জবাব, “মানুষ মরছে নিজের কর্মফলে, নিজের পাপে, নিজের…” স্বামীজী আবারো বলেন, “আর গোমাতারা? তারা যে কসাইদের হাতে পড়েন, সে-ও তো তাদের কর্মফলে। তবে আর তাদের বাঁচাবার কী দরকার?” সম্পাদক জবাব দেন, “তা আপনি যা বলেছেন তা সত্য, তবে শাস্ত্রে আছে, গাভী আমাদের মাতা।” স্বামীজী সবশেষে বলেন, “হ্যাঁ, গাভী যে আপনাদের মাতা, তা বুঝতে পারছি আমি, নইলে এমনসব ছেলে জন্মাবে কেনো?”
এমনসব প্রতিক্রিয়ার কারণে বোধহয় সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ গোরক্ষিণী সভার প্রচারক হিসেবে কাজ করতে সক্ষম হননি। তবে তিনি শুধুমাত্র চাকুরির খাতিরে এই ধরনের বিতর্কিত কাজে নিজেকে জড়িয়েছিলেন। তিনি পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলা ভ্রমণ শেষে বার্মার আরাকান অঞ্চলের মংডুতে পৌঁছান। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের শারদীয় পূজার কিছু আগে তিনি প্রচারকের চাকুরি নিয়েছিলেন। প্রখ্যাত মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী কেশোরাম পোদ্দারের অনুরোধে মাসিক ৫০ টাকা বেতনে তিনি চাকুরিটি নিয়েছিলেন। মংডু থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকা জেলার কিছু এলাকা ভ্রমণ শেষে তিনি কলকাতায় ফিরে যান। সেখানে গিয়েই তিনি গোরক্ষিণী সভার প্রচারক পদ থেকে ইস্তফা দেন। তখন তিনি থাকতেন ৪১ নম্বর মির্জাপুর স্ট্রিট (বর্তমানে সূর্যসেন স্ট্রিট)-এর মেস বাড়িতে।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুলাই বিভূতিভূষণ হরিনাভি স্কুলের মাস্টারি ছেড়ে নতুন করে চাকুরির খোঁজে কলকাতায় চলে আসেন। মেসে থেকেই চাকুরির খোঁজে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতেন। ঠিক সেই সময়ই প্রচারকের চাকুরিটা পেয়ে যান। কলকাতা শিয়ালদাহ রেলস্টেশন থেকে তিনি ট্রেনে কুষ্টিয়ার পথে পা রাখেন। এরপর একে একে কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল, ঢাকা, নোয়াখালী, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম ও বার্মা ভ্রমণ করেন। এসব স্থান থেকে তিনি গোরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়াদি প্রতিবেদন হিসেবে কলকাতায় সমিতি অফিসে পাঠাতেন। বিভূতিভূষণ তাঁর ভ্রমণ কাহিনি ‘অভিযাত্রিক’ গ্রন্থে তার উল্লেখ করলেও গোরক্ষা সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো উল্লেখ করেননি। হয়তোবা তিনি ইচ্ছা করেই তা চেপে গিয়েছিলেন। কোনো গবেষকও সেসব প্রতিবেদন খুঁজে বের করার প্রয়োজন বোধ করেননি। যে-কারণে একটি মূল্যবান উপাদান থেকে বাঙালি পাঠক সমাজ এখনো পর্যন্ত বঞ্চিত রয়েছেন।
তবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকা জেলার নরসিংদী জনপদে যে-ভ্রমণ করেছিলেন, তাঁর সুন্দর বিবরণ রয়েছে। ‘অভিযাত্রিক’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, গোরক্ষিণী সভার প্রচারকের কাজের পাশাপাশি তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে দেখার জন্যে সেখানে যান। একসঙ্গে সেখানকার গোসম্পদের খোঁজ নেয়া, কী পরিমাণ গরু পালন হয় কিংবা কসাইয়ের ছুরির নিচে কতোটি গোমাতার জীবন বিসর্জন দেয়া হচ্ছে, সেসব তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রতিবেদন আকারে কলকাতায় রিপোর্ট দেয়ার জন্যে তিনি মেঘনা তীরবর্তী এলাকাসমূহ ঘুরে দেখেন। সাটিরপাড়া মহল্লার গোচারণ ভূমি পায়ে হেঁটে অবলোকন করেন।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুলাইয়ের পর মাস্টারি ছেড়ে দিয়ে বিভূতিভূষণ গোরক্ষিণী সভার প্রচারক হিসেবে পূর্ববঙ্গে যে-ভ্রমণ করেছিলেন, তা একই বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিলো। সেটা তাঁর ‘অভিযাত্রিক’ বইয়েই উল্লেখ রয়েছে। সেখানে তিনি নরসিংদী ভ্রমণ সম্পর্কে নিজমুখে বলেন, “শীতলক্ষ্যা নদীর পুল পার হয়ে আবার ট্রেন এসে থামলো ঘোড়াশাল স্টেশন। ঘোড়াশাল থেকে ঢাকা জেলায় এখান থেকে কিছুদূরে নরসিংদি (নরসিংদী) গ্রামের হাই স্কুলে আমার এক বন্ধু হেডমাস্টার, অনেকদিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি, বিদেশ ভ্রমণের সময় পরিচিত বন্ধুজনের দেখাসাক্ষাৎ বড় আনন্দদান করে, সেজন্য ঠিক করেছিলাম ঢাকা যাবার পথে বন্ধুটির ওখানে একবার…।”
‘অভিযাত্রিক’ বইয়ে বিভূতিভূষণ নরসিংদী যাবার যে-বিবরণ দিয়েছেন, তাতে যৎসামান্য তথ্যগত ভুল রয়েছে। তিনি আখাউড়া দিয়ে ত্রিপুরা রাজ্য ভ্রমণ শেষে ট্রেনে নরসিংদী পৌঁছেছিলেন। যদি তাই হয়, তাহলে শীতলক্ষ্যা নদী ঘোড়াশালের আগে নয় যে, শীতলক্ষ্যা পেরিয়ে ঘোড়াশাল আসতে হবে। এখানে আরেকটি প্রশ্ন, তখন কি নরসিংদীতে কোনো রেলস্টেশন ছিলো না, যার কারণে তিনি ঘোড়াশাল স্টেশনে নেমে নরসিংদী এসেছিলেন। আবার তাঁর বর্ণনায় এসেছে ঘোড়াশাল থেকে নরসিংদী গ্রামের অবস্থান কিছুদূর। প্রকৃতপক্ষে ঘোড়াশাল থেকে নরসিংদীর দূরত্ব কিছুদূর নয়, কমপক্ষে ৬/৭ মাইল। তাই আমি মনে করি, বিভূতিভূষণ আসলে নরসিংদী রেলস্টেশনে নেমে সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশনে গিয়েছিলেন। স্টেশন থেকে স্কুলের দূরত্ব কিছুদূর।
আসলে তিনি নরসিংদী রেলস্টেশন আর ঘোড়াশাল রেলস্টেশন গুলিয়ে ফেলেছিলেন। কারণ, তিনি সেখানে গিয়েছিলেন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে। আর সেই ভ্রমণ কাহিনি তিনি ‘অভিযাত্রিক’ বইয়ে প্রকাশ করেছিলেন ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ২২ মার্চ। এর আগে তিনি পূর্ববঙ্গে ভ্রমণ কাহিনিটি কোনো পত্র-পত্রিকা কিংবা সাময়িকীতে প্রকাশ করেননি। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্সের অন্যতম কর্ণধার ও বিশিষ্ট লেখক গজেন্দ্রকুমার মিত্রের অনুরোধে তিনি ভ্রমণ কাহিনিটি লিখেছিলেন। তিনি তখন যে-ডায়েরি লিখেছিলেন, তার অবলম্বনেই ‘অভিযাত্রিক’ লেখেন। তিনি চোখের দেখা আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে সে-ডায়েরি রচনা করেছিলেন। তিনি মূলত নরসিংদী ভ্রমণ শেষে ট্রেনে ঢাকায় গিয়েছিলেন। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে স্টিমারে গোয়ালন্দ যান। গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনযোগে কলকাতার শিয়ালদা গিয়ে পৌঁছেন। তাই আমার ধারণা, তখন তার ডায়েরিতে ঘোড়াশাল রেলস্টেশন এবং শীতলক্ষ্যা নদীর উল্লেখ করেছিলেন। ‘অভিযাত্রিক’-এর পাণ্ডুলিপি করার সময় তথ্যের কিছুটা হেরফের হয়েছে। যা তাঁর সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত বিষয় ছিলো।
বিভূতিভূষণ নরসিংদীতে যখন যান, তখন জনপদটি অজপাড়াগাঁ। প্রশাসনিক কাঠামো বলতে সেখানে মেঘনা নদীর তীরে একটি কোতঘর (রাজস্ব কেন্দ্র) ও একটি ছোটো পুলিশ ফাঁড়ি ছিলো। মেঘনা ও হাড়িধোয়া নদীর সঙ্গমস্থল ঘেঁষে একটি ছোটো হাট বসতো, যা ‘কৃষ্ণগঞ্জ বাজার’ হিসেবে পরিচিত ছিলো। স্থানীয় জমিদার ললিতমোহন রায় বিএবিএল তাঁর দাদা কৃষ্ণচন্দ্র পাল (রায়)-এর নামে বাজারটি গড়ে তুলেছিলেন। পুলিশ ফাঁড়িটিও তাঁর উদ্যোগে গড়ে ওঠে। তবে অন্যান্য কাঠামো ছিলো গ্রামীণ, কাচা ঘরবাড়ি, মেঠোপথ। কৃষি এবং মৎস্য শিকার করে অধিকাংশ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতো। বিভূতিভূষণের বিবরণে সেই গ্রামীণ আবহ ফুটে ওঠেছে। তাঁর বর্ণনায় পাওয়া যায়, “অজপাড়াগাঁয়ের স্কুল। পূর্ববঙ্গের একটি ক্ষুদ্র গ্রাম স্কুলের শিক্ষক যাদের সকলেরই বাড়ি এখানে, হেডমাস্টার আর হেডপণ্ডিত এই দুজন মাত্র বিদেশী। আমার বন্ধু ছাত্রজীবনে পড়াশুনায় ভালো ছিলেন, খুব স্মার্ট, ভালো ক্রিকেট খেলোয়াড়, চেহেরাও খুব সুন্দর। এহেন স্টাইলবাজ, সুপুরুষ, ইংরেজিতে উঁচু সেকেন্ড ক্লাশ পাওয়া ছেলে মাত্র ষাট টাকা মাইনেতে এই সূদূর ঢাকা জেলার এক পাড়াগাঁয়ে এসে আজ তিন বছর পড়ে আছে। চাকুরির বাজার এমনি বটে।”
ইংরেজিতে এমএ করা মেধাবী বন্ধুর এই চাকুরি নিয়ে বিভূতিভূষণ হতাশা প্রকাশ করলেও নরসিংদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে বেশ প্রশংসা করেন, “এখানে আর কিছু না হোক প্রাকৃতিক দৃশ্য হিসাবে জায়গাটা ভাল। গ্রামের বাইরে দিগন্ত-বিস্তীর্ণ মাঠ মেঘনার তীর ছুঁয়েচে, তারই মাঝে মাঝে ছোট বেত ঝোপ, মাঝে মাঝে বুনো শটির গাছ। এদিকে একটা ছোট খাল। স্কুলের বাড়িটি এই ছোট খালের ধারে, বড় বড় ঘাসের বলের আড়ালে, নিকটে লোকালয় আছে বটে কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে হয় অস্ট্রেলিয়ায় বা দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মধ্যে এসে পড়েছি কোন মায়া বলে।”
বিভূতিভূষণ স্কুলের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, “স্কুল বাড়ির পাশে বোর্ডিং। তিন চারটি বড় বড় ঘর, সেগুলির মেঝে হয়নি এখনও, সুতরাং মাটির সঙ্গে প্রায় সমতল, অত্যন্ত নিচু ভিতরে ওপর বাড়িটা গাঁথা। আমার বন্ধুর কথামতো একটি ছেলে আমার সঙ্গে করে এনে বোর্ডিংয়ের একটা ঘরে বসিয়ে রেখে গেল। আমার বন্ধুটি এই ঘরে থাকেন। একটা কাঠের তক্তপোশ, তার ওপর আধমালা একটা বিছানা, আর তার ওপর খানকতক বই বিছানো। অন্যদিকে কতকগুলো চায়ের পেয়ালা, একটা স্টোভ, দুটি টিনের তোরঙ্গ, একজোড়া পুরোনো জুতো ইত্যাদি। হেডমাস্টারের জন্য বোর্ডিংয়ের এই ঘরটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বুঝলাম।”
বিভূতিভূষণের বন্ধুটির নাম কী? তিনি বন্ধুর স্বভাব-চরিত্র নিয়ে অনেক কথা বলেছেন, “কলকাতার পটুয়াটোলার মেসে থাকার সময় বন্ধুটি যে চালবাজি করতো, সাটিরপাড়া স্কুলেও সে চালবাজি অব্যাহত রেখেছে। শিক্ষকদের অবজ্ঞা করা, তাদেরকে কথায় কথায় ছোট করা এমন কি ওদের দিয়ে চা বানানো ও রান্নাবান্নার কাজ পর্যন্ত করিয়ে নিচ্ছেন। অথচ তিনি প্রচার করছেন, শিক্ষকরা অযোগ্য বলেই তাকে তোষামোদ করেন। অযথা তাদের থাকার ঘরে এসে নানা ফুটফরমাইশ খাটে।”
বিভূতিভূষণ সেই প্রধান শিক্ষকের নাম উল্লেখ না করলেও আমার গবেষণা ও অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, সেই হেডমাস্টারের নাম দীনেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এমএ। তিনি তিন বছর উক্ত স্কুলে ছিলেন। তিনি ছিলেন স্কুলের ষষ্ঠ হেড মাস্টার। করুণাময় গুহ বিএবিটি চলে যাওয়ার পর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ললিতমোহন রায় সংবাদপত্রে হেডমাস্টার চেয়ে বিজ্ঞাপন দিলে দীনেশচন্দ্র চাকুরির আবেদন করে উত্তীর্ণ হন। তিনি আসার আগে সাটিরপাড়া স্কুলের উপর অনেক ঝড়-তুফান যায়। একটি স্বার্থান্বেষী মহল ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে পুকুরের পূর্ব-পশ্চিম পাশে অবস্থিত স্কুলের টিনের চৌচালা দুটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। তখনকার প্রধান শিক্ষক করুণাময় গুহ ও প্রতিষ্ঠাতা ললিতমোহন রায়ের চেষ্টায় সেখানে স্থাপনা পুনর্নির্মিত হয়। স্কুলে হেডমাস্টারের তালিকা বোর্ডে করুণাময়ের পর জে এল লাহিড়ীর নাম রয়েছে। কিন্তু তিনি ছিলেন এমএবিটি। পরের জন ছিলেন সিম্পল এমএ। বিভুতিভূষণের বন্ধুও এমএ পাস ছিলেন। তাই আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যখন নরসিংদী আসেন, তখন সেখানকার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন দীনেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সাটিরপাড়া স্কুল ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে বিটি পাস করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি পেয়ে বিলেত চলে যান উচ্চশিক্ষার জন্যে। বিলেত থেকে এসে তিনি ভারত সরকারের শিক্ষা বিভাগে উচ্চতর পদে যোগ দিয়েছিলেন। এসব তথ্য বিভূতিভূষণের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়।
বিভূতিভূষণের নরসিংদীর স্মৃতিতে কিছু চমকপ্রদ বিষয় জানা যায়। তিনি সাটিরপাড়া গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলেন। স্কুলের ড্রয়িং মাস্টার হরনাথের সঙ্গে তার ভাব হয়ে গিয়েছিলো। এমনকি তাঁর বাড়িতে পর্যন্ত বেড়াতে গিয়েছিলেন। এমন সাদাসিদে মাটির মতো শিক্ষকের প্রেমে পড়ে তিনি সাটিরপাড়া স্কুলে শিক্ষকতার পেশা নেয়ার অভিমতও প্রকাশ করেছিলেন। ড্রয়িং মাস্টারের ভাইঝি মঞ্জুর সঙ্গে অনেক কথা বলেছেন। তার হাতে বানানো পান খেয়েছেন। তারপর হরনাথের স্ত্রীর হাতের চা-নাস্তা খেলেন, যা খেয়ে বিভূতিভূষণ ভীষণ প্রশংসা করেন।
নরসিংদী বেড়ানোর সময় বিভূতিভূষণ সাটিরপাড়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক, সহকারি শিক্ষকদের দেয়া একটি ভোজ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সে-উপলক্ষে এক এলাহি কাণ্ড ঘটেছিলো, যা তিনি অনেকদিন মনে রেখেছিলেন। স্কুলের হলে রান্নাবান্নার মহাকাণ্ড চলছে। সবই বিভূতিভূষণের সম্মানে হচ্ছে। বড়ো ডেকে পোলাও চড়েছে। প্রকাণ্ড বড়ো দুটি মাছ কোটা হচ্ছে। আরো দুয়েক ডেক পোলাও রাঁধবার মাল-মশলা ডালায় সাজানো রয়েছে। শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারী সবাই এসবের দেখভাল নিয়ে ব্যস্ত। কেউ তদারকি নিয়ে ব্যস্ত। কোথায় খাওয়ার পাতা সাজানো হবে, সব ঠিকঠাক করছেন। হেডমাস্টার আর বিভূতিভূষণকে মাঝখানে বসিয়ে সবাই খেতে লাগলেন। একই সঙ্গে চলছে নানান গল্প। একজন শিক্ষক বললেন, “আমাদের দেশ আপনার কেমন লাগলো?” বিভূতিভূষণ জবাব দিলেন, “বড় ভালো লেগেছে। পূর্ববঙ্গের লোকের প্রাণ আছে।”
এভাবে কয়েকটি দিন কেটে গেলো। তবে নরসিংদী ভ্রমণে তাঁর সবচে’ ভালো লাগার জিনিস ছিলো চাঁদনী রাতে মেঘনা নদীর অপূর্ব দৃশ্য অবলোকন, যা তিনি স্মৃতিকথায় লিখেছেন। এক সন্ধ্যায় বন্ধু হেডমাস্টারকে নিয়ে স্কুল থেকে সিকি মাইল পূর্বদিকে মেঘনার পাড়ে বেড়াতে গেলেন। জ্যোৎস্না রাতে মেঘনার তরঙ্গভঙ্গ দেখার লোভ সামলাতে পারলেন না বিভূতিভূষণ। তিনি ভ্রমণ কাহিনিতে বললেন, “বন্ধুকে নিয়ে আমরা গেলুম মেঘনার ধারে। ওপারে কি একটা গ্রাম, এপারে দিগন্ত-বিস্তীর্ণ প্রান্তর, মাঝে মাঝে বাঁশবন, বনঝোপ। নোয়াখালী জেলার মেঘনা যতখানি চওড়া দেখেছি, এখানে নদী তার চেয়ে ছোট। তবুও আমার মনে হলো জলরাশির এমন শোভা দেখেছিলুম শুধু কক্সবাজারের ও মংডুর সমুদ্রতীরে। সন্দ্বীপের তালাবন-শ্যাম-উপকূল-শোভা সেই এক সন্ধ্যায় স্টিমারের ডেক থেকে প্রত্যক্ষ করে মনে যে আনন্দ পেয়েছিলুম, আজও যেন সেই ধরনের আনন্দই আবার ফিরে এল মনে।”
বিভূতিভূষণ নরসিংদীর যে-মেঘনা অবলোকন করেছিলেন, সেটা বর্তমানে নেই। স্কুল থেকে সিকি মাইল দূরত্বের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, সেখানে এখন অসংখ্য ঘরবাড়ি, মিল-কারখানা, জুট মিল। তিনি যখন মেঘনার পাড়ে গিয়েছিলেন, তখন নদীর তীর ঘেঁষে শুধুমাত্র রামদাস বাউলের আখড়া ছিলো। আখড়াটি অনেক পুরোনো। ধারণা করা হয়, প্রায় ৪০০ বছর আগে রামদাস বাউল সেখানে অবস্থান করেছিলেন। তাঁর বংশধররা পরম্পরায় মেঘনা নদীর তীরে বসবাস করছেন। তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এলাকাটি বাউলপাড়া হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে সেখানে বাৎসরিক বাউল মেলা হয়ে আসছে। মেঘনার তীরে সে-মেলায় দেশ-বিদেশ থেকে বাউল সম্প্রদায়ের লোকজন অংশগ্রহণ করে থাকে। মেলা ছাড়াও আশ্রমধামে বাউলসঙ্গীত পরিবেশন হয়। রামদাস বাউল অসংখ্য গান রচনা করেছেন।
স্বল্প সময়ে বাংলা সাহিত্যের শক্তিশালী লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নরসিংদী ভ্রমণে এসে এখানকার মানুষের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। সুন্দর পরিবেশ তাঁর মনে গেঁথে যায়। যা তাঁর ভ্রমণ কাহিনিতে ফুটে ওঠেছে। তিনি স্কুলে শিক্ষকতা সূত্রে নরসিংদী থেকে যাবারও আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু নরসিংদীপ্রেমী এই সাহিত্যিকের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই স্থানীয়ভাবে। সাটিরপাড়া স্কুলের বোর্ডিংয়ে বিভূতিভূষণ বসবাস করলেও তার কোনো ডকুমেন্ট স্কুলে নেই। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেও এই সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বিভূতিভূষণ যে স্কুলে এসেছিলেন, সেটাও তাদের জানা নেই। তাই স্কুলের টালির ঘরের সামনে এই মহান সাহিত্যিকের একটি স্ট্যাচু নির্মাণ করা হলে বর্তমান প্রজন্ম ইতিহাসটা অন্তত জানতে পারবে।
আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক