ভারতের অন্ধকার দূর করেছিলেন নরসিংদীর যে-দুজন ইঞ্জিনিয়ার

সুরেন রায় আর কিরণ রায় নরসিংদীর সাটিরপাড়া জমিদার বাড়ির সন্তান। জমিদারি এস্টেট দেখাশোনা বাদ দিয়ে তাঁরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান সুদূর জার্মানিতে। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরলেন এবং যোগ দিলেন কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু তাঁদের মাথায় খেলা করছিলো অন্য এক বৃহৎ পরিকল্পনা। শিক্ষকতার পাশাপাশি স্বদেশি চিন্তাধারায় কীভাবে ভারতবর্ষের শিল্প-কারখানায় অবদান রাখা যায়, তা নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা শুরু করলেন।

ইলেকট্রিক্যাল বিদ্যায় মেধার পরিচয় দিলেও তখন ভারতবর্ষে যন্ত্রপাতি ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি উৎপাদনের সহজ সুযোগ ছিলো না। তাই তাঁরা জার্মানিতে পড়ালেখা শেষ করে সেখানকার বিদ্যুৎ খাত এবং সরঞ্জাম তৈরির কারখানাগুলো ঘুরে-ফিরে দেখেন। এরপর দুই ভাই সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা দেশে ফিরে বৈদ্যুতিক বাতি তৈরি করবেন। সেইসাথে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল জার্মানি থেকে কীভাবে আমদানি করা যায়, সেসব নিয়ম-কানুন জেনে আসেন।

ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সুরেন ও কিরণ নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে চিন্তা-ভাবনা করতেন। কিন্তু তাঁদের আরেক ভাই হেমেন রায় ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত ও দক্ষ প্রশাসক। একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করা এবং সেখানে সুষ্ঠু উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ বিষয়ে হেমেন ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী। সুরেন-কিরণ-হেমেনের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত, বিদ্যোৎসাহী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী। দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুরে যখন ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তখন পূর্ববঙ্গের অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ ও জমিদারদের সঙ্গে নরসিংদীর সাটিরপাড়ার জমিদাররাও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। যে-কারণে সেই পরিবারের দুই সন্তান জার্মানি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে এসে সরকারি কোনো উচ্চ পদে যোগদান না করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকুরি গ্রহণ করেন।

তৎকালীন ঢাকা জেলার শহরতলী নরসিংদীর ‘রায় জমিদার’ পরিবারের মেধাবী দুই ইঞ্জিনিয়ার কেনো বৈদ্যুতিক বাতি তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিলেন? এর নেপথ্য কারণ কী ছিলো? এই বিষয়ে জমিদার পরিবারের ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, মূলত দেশপ্রেমের বোধ থেকে কারখানাটি গড়ে তোলা হয়েছিলো। সে-সময় ভারতবর্ষে স্বদেশিদের কোনো বাতি তৈরির কারখানা ছিলো না। পুরো ভারতবর্ষে আলো বিতরণের ক্ষেত্রে একচেটিয়া বাজার ছিলো ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে নেদারল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত ফিলিপস ইলেকট্রনিক্স কোম্পানির হাতে। তারা ভারতের বিভিন্ন শহরে আলোর জন্যে বাতি সরবরাহ করতো। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে কলকাতার চৌরঙ্গীতে রাস্তার দুধারে প্রথম বিজলি বাতি লাগানো হয়েছিলো। ১৯৩০-৪১ খ্রিস্টাব্দে ফিলিপস ইলেকট্রনিক্স কোম্পানি (ইন্ডিয়া) ৩২ নম্বর চৌরঙ্গী রোডে ৭৫ জন কর্মচারী নিয়ে প্রথম অফিস প্রতিষ্ঠা করে। এর পর থেকেই ল্যাম্পের বাজার ওদের হাতে চলে যায়।

ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে তখন সিংহভাগ কলকারখানার মালিক ছিলো বিদেশিরাই। বড়ো বড়ো পদ দখল করে আছে ব্রিটিশ আইসিএস অফিসাররা। এমতাবস্থায় বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায় দেশীয় মালিকানায় স্বদেশি কলকারখানা গড়ে তোলার আন্দোলন করে যাচ্ছেন। সাটিরপাড়ার জমিদার ললিতমোহন রায় ছিলেন তাঁর পরিচিত। নেতাজী সুভাষ বোসের সঙ্গে ললিতমোহন কংগ্রেস করতেন। বিপ্লবী আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাই প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তাঁকে একটি ইলেকট্রিক ল্যাম্প কারখানা স্থাপনের জন্যে অনুরোধ করেন।

সাটিরপাড়ার জমিদার ললিতমোহন রায়

ললিতমোহন রায়ের বাড়ির দুই ছেলে সুরেন ও কিরণ এই বিষয়ে জার্মানি থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে এসেছেন। তাই বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অনুরোধ ফেলতে পারলেন না তিনি। তাঁদের (সুরেন ও কিরণের) সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করে কলকাতার কসবা এলাকায় প্রথম কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ফিলিপস প্রতিষ্ঠার ঠিক পরপর ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের দিকে ‘বেঙ্গল ল্যাম্পস’-এর কারখানা চালু হয়। এই নামটি নেয়া হয় প্রফুল্ল চন্দ্রের ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস’ থেকে।

কলকাতায় বেঙ্গল ল্যাম্পসের কারখানা

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বেঙ্গল ল্যাম্পসকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রথমদিকে তারা টাংস্টেন ফিলামেন্ট বাল্ব তৈরি করতো। সেই সময় ফিলিপসের তৈরি সোডিয়াম-মার্কারির জোরালো আলো বাঙালির অন্দরমহলে অনেকটা বেমানান ছিলো। তাছাড়া স্বদেশি যুগে ‘বেঙ্গল’ শব্দটি সবার পছন্দ হলো। ফলে ফিলিপস শব্দটির জায়গায় বেঙ্গল শব্দটি জুতসই হয়ে ওঠে। বাজারে তরতর করে বেঙ্গল ল্যাম্পসের উৎপাদিত বাতির চাহিদা বেড়ে যায। নরসিংদীর সাটিরপাড়ার রায় জমিদার বাড়ির ইঞ্জিনিয়ারদের তৈরি ল্যাম্পের আলো বাঙালির ঘরে ঘরে জ্বলতে থাকে। কারখানা বড়ো হতে থাকে। প্রচুর বেকার লোকের কর্মসংস্থান ঘটে। এই প্রথম কোনো স্বদেশি কারখানার কাছে বিদেশি খ্যাতনামা ফিলিপস কোম্পানির পরাজয় হলো। আর বেঙ্গল ল্যাম্পসও ভারতবর্ষের প্রথম বাতি উৎপাদনকারী কারখানার তকমা অর্জন করে।

তৎকালীন কাগজে বেঙ্গল ল্যাম্পের বিজ্ঞাপন

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা অর্জনের পর বেঙ্গল ল্যাম্পস অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। তাদের বাতির চাহিদা এতোটাই বেড়ে যায় যে, কসবার কারখানার উৎপাদন দিয়ে সেই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছিলো না। তাই ‘বাঙালদের রাজধানী’ বা উদ্বাস্তুদের বস্তি অধ্যুষিত যাদবপুর এলাকায় বেঙ্গল ল্যাম্পসের বড়ো কারখানা গড়ে তোলা হয়। কসবা ও যাদবপুরের কারখানায় ওভারটাইম শুরু হয়। পরবর্তীতে বাংলার আলো পৌঁছে যায় সুদূর ব্যাঙ্গালোরেও। বেঙ্গল ল্যাম্পসের সোডিয়াম আর মার্কারি বাতি বাজার দখল করে নেয়। ১৯৬০-এর দশকে বেঙ্গল ল্যাম্প সর্বভারতীয় সবচে’ জনপ্রিয় বৈদ্যুতিক বাতিতে পরিণত হয়।

কিন্তু এরইমধ্যে বড়ো ভাই সুরেনের সঙ্গে সেজো ভাই কিরণের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বাঙালি সেন্টিমেন্টের কাছে রক্তের সম্পর্ক হেরে যায়। ফলে বেঙ্গল ল্যাম্পসে ভাঙন দেখা দেয়। নতুন কারখানা গড়ে ওঠে বেহালায়। বেঙ্গল ল্যাম্পের পাশাপাশি বাজারে আসে কিরণ ল্যাম্প। এই দ্বন্দ্বে বাঙালির নিজস্ব আলো কমতে থাকে। শেষাবধি এর হাল ধরেন সাটিরপাড়ার জমিদার বংশের শেষ উত্তরসুরী তপন কুমার রায় ও তাপস কুমার রায়। তখন কলকাতায় বামফ্রন্ট সরকারের মহাদাপট। বেঙ্গল ল্যাম্পসের মালিকেরা স্বদেশি আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন। তাঁদের দেশপ্রেম ছিলো প্রশ্নাতীত। যার কারণে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এগিয়ে আসেন। নানাভাবে কারখানাটি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্যে তিনি চেষ্টা-তদবীর করেন।

গত শতকের আট দশকের মাঝামাঝি সময় জ্যোতি বসুর একমাত্র ছেলে চন্দন বসু পড়াশোনা শেষ করার পর কোথায় চাকুরি করবেন, তা নিয়ে অনেকটা দ্বিধায় পড়েন। ঠিক তখনই তপন কুমার রায় এগিয়ে আসেন। চন্দন বসুকে বেঙ্গল ল্যাম্পসে চাকুরি দেন। একজন মুখ্যমন্ত্রীর ছেলে হয়ে কোথায় বড়ো বড়ো ব্যবসা-বাণিজ্য করবেন, মিল-কারখানা প্রতিষ্ঠা করবেন, সেখানে তিনি নাকি একটি কারখানায় চাকুরি করছেন। এ নিয়ে তখন রাজনৈতিক মহলে কাথাবার্তাও উঠেছিলো।

স্বাধীনতার প্রতীক স্বদেশি কারখানাটি রুগ্ন হয়ে ওঠলে তা দাঁড় করানোর জন্যে বামফ্রন্ট সরকার অনেক চেষ্টা করেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেঙ্গল ল্যাম্পসের বাতির ব্যবহার বৃদ্ধি করারও উদ্যোগ নেয়া হয়। রাজ্যের পূর্ত দপ্তর তাদের ল্যাম্প কিনতো। একপর্যায়ে তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্ত্তী ফাইলে নোট দেন, “জ্যোতি বসুর নির্দেশেই তাঁর পুত্রের চাকুরিস্থল বেঙ্গল ল্যাম্পসকে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো।” নোটটি প্রকাশ্যে আসার পর তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। যার ফলশ্রুতিতে পূর্তমন্ত্রীকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিলো। পরে পূর্তমন্ত্রী যতীনবাবু তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন, “জ্যোতিবাবু বললেন, বাঙালি কনসার্ন (বেঙ্গল ল্যাম্প) বলছে যখন, আপনি দেখুন ওদের কিছু অর্ডার বাড়িয়ে দেওয়া যায় কিনা। তবে ফাইলে এ ব্যাপারটার কোনও নোট রাখবেন না। যা আমাদের বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে।” মুখ্যমন্ত্রী বলার পরও পূর্তমন্ত্রী কেনো ফাইলে নোট দিয়েছিলেন? সেটা তিনি করেছিলেন এক আমলার পরামর্শে। তার নাম মোস্তাক মোর্শেদ (পূর্তসচিব)। তিনি মনে করেছিলেন, বেঙ্গল ল্যাম্পসকে বাড়তি বরাদ্দ দেয়ার বিষয়টি নিয়মবিরুদ্ধ। মূলত আমলার পরামর্শ শুনেই যতীনবাবু মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন। তবে জ্যোতি বসু তাঁর ছেলে চাকুরি করেন বলে নয়, মূলত একটি স্বদেশি কোম্পানিকে বাঁচানোর জন্যেই চেষ্টা করেছিলেন। এর খেসারত দিতে হয়েছিলো পূর্তসচিব মোস্তাক মোর্শেদকে। ঘটনার পর তাকে সচিবালয় থেকে সরিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ একটি বদলি করা হয়েছিলো।

১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুলাই বেঙ্গল ল্যাম্পসের কারখানা লে অফ ঘোষণা করা হয়। এরপর কারখানাটি খোলার জন্যে বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। ৪৮০ জন শ্রমিক যুগের পর যুগ অপেক্ষা করেও চাকুরি পাননি। দীর্ঘ ৪২ বছরে অনেক শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে কোনো ফল না পাওয়া গেলেও কারখানা ও শ্রমিক কলোনির কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি আত্মসাতের জন্যে বিভিন্ন চক্র সক্রিয় রয়েছে। জাল দলিল ও ভুয়া ওয়ারিশ সাজিয়ে সম্পত্তি হস্তান্তরের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। তপন কুমার রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র মেয়ে বিদেশে থাকার কারণে সম্পত্তি নিয়ে জালিয়াতিটা আরো বেশি হচ্ছে।


আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ