আদিয়াবাদ ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ রায়পুরা উপজেলার একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নৈসর্গিক দৃশ্যের অপরূপ রূপে সুশোভিত স্কুলটি আড়িয়াল খাঁ নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জ্ঞানের মশাল জ্বেলে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে শতবর্ষেরও অধিক সময় ধরে। আদিয়াবাদের সোনালি শিক্ষার বিস্তারে স্কুলটির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে আদিয়াবাদের মুসলিম কৃষকগণ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এদিকে মেধাবী ছাত্র আফসার উদ্দিন (বর্তমান সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু’র পিতা) পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় তাঁর মামা উমেদ আলী মুন্সি ভাগ্নেকে উচ্চ শিক্ষিত করার জন্যে স্থানীয় সচ্ছল কৃষকদের দ্বারস্থ হন। বৃটিশ আমলে তৎকালীন আদিয়াবাদ ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট জহির উদ্দিন মুন্সির প্রত্যক্ষ উদ্যোগে স্কুলটি যাত্রা শুরু করে ১৯১২ সাল হতে। ময়েজ উদ্দিন মোল্লা, মানিক সরকার, রওশন আলী মীর, ইয়াছিন আলী সরকার, জাফর আলী সরকার, হাড়াই প্রধান, কালাই শিকদারসহ আরো অনেকে স্কুল প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন।
প্রাথমিক অবস্থায় বাঁশের খুঁটি ও ছনের ছাউনি দিয়ে মক্তবে পাঠদানের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রথমবারের মতো ১৯১৭ সালে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেই অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে। প্রাথমিক অবস্থায় প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন বাবু শ্রী নলিনী কান্ত ঘোষ। প্রথমদিকে স্কুলের জন্যে ছাত্র-ছাত্রী সংগ্রহ করা হতো আশারামপুর, হাইরমারা, নিলক্ষ্যা, মনিপুর, চরসুবুদ্ধি, হাসনাবাদ, হাঁটুভাঙ্গা, বালুয়াকান্দি, পুটিয়া, সিরাজনগর, রাধাগঞ্জ, খৈনকুট, সৃষ্টিগড়, গোবিন্দপুরসহ আশেপাশের এলাকা হতে। কর্দমাক্ত কাঁচা রাস্তা ধরে স্কুলে আসতো শিক্ষার্থীরা।
১৯৬৫ সালে এলাকাবাসীর প্রচেষ্টায় স্কুলে পাকা দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়। এর দু’বছর পরই ১৯৬৭ সালে এ-প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জয়নাল আবেদিন ভূঁইয়া ও খোরশেদ আলম নামে দু’জন ছাত্র দ্বিতীয় গ্রেডে বৃত্তি লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধের বছরও তিনজন ছাত্র বৃত্তি লাভ করে। ছেষট্টির ছয়দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন জনাব খন্দকার আবু হান্নান। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্কুলটি একবার বন্ধ হয়ে যায় এবং কয়েক মাস পর আবার কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে অর্থাভাবে আবারো বন্ধ হয়ে যায় এবং পুনরায় সক্রিয় হয় সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু’র হস্তক্ষেপে, যিনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্কুলের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
১৯৯৫ সাল হতে কলেজ শাখা চালু করা হয়। তৎকালীন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এ.এস.এইচ.কে সাদেক এই কলেজ পরিদর্শনে এসে স্কুলের পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হন এবং ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত করেন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে জাতীয়করণ করে নেয়।
‘মালঞ্চ’ নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। সম্পাদক ছিলেন বিজ্ঞান শিক্ষক জনাব আবদুল কবির। পরবর্তী বছর ‘কল্পতরু’ নামে আরেকটি ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় তৎকালীন ছাত্র জয়নাল আবেদীনের সম্পাদনায়, যিনি কর্মজীবনে রাজউকের চেয়ারম্যান ছিলেন। কিন্তু ম্যাগাজিন দুটোর কোনো কপির সন্ধান পাওয়া যায়নি। ১৯৭৫ সালে বাংলার শিক্ষক মো. আবদুল হকের সম্পাদনায় ‘সৈকত’ এবং ১৯৯৯ সালে বাংলার শিক্ষক বেলায়েত হোসেনের সম্পাদনায় ‘অন্বেষা’ নামে ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। ২০১৬ সালে বর্তমান অধ্যক্ষ মো. নূর সাখাওয়াত হোসেন মিয়ার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘কলরব’। ২০১৭ সাল হতে কলেজ শাখা থেকে ‘স্মৃতির পাতায়’ ও স্কুল শাখা থেকে ‘বন্ধন’ নামে প্রতিবছর ধারাবাহিক সিরিজ ম্যাগাজিন প্রকাশিত হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটিতে পিঠা উৎসব, বৈশাখী মেলা, বিজ্ঞান মেলা, কৃষি মেলা, শিক্ষা উপকরণ মেলা, সাংস্কৃতিক সপ্তাহ পালন, সাপ্তাহিক সাংস্কৃতিক ক্লাশ, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কুইজ, চিত্রাঙ্কন, বৃক্ষরোপণ, ল্যাংগুয়েজ ক্লাবসহ অন্যান্য কার্যক্রম বিদ্যমান রয়েছে। প্রায় ৬৫ প্রজাতির গাছপালা ও ফুল রয়েছে স্কুলটিতে।
স্কুলের বর্তমান গভর্নিং বডির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন মিসেস কল্পনা রাজিউদ্দিন। সুদীর্ঘ ১৮ বছর ধরে অধ্যক্ষ হিসেবে আছেন মো. নূর সাখাওয়াত হোসেন মিয়া। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে সব মিলিয়ে ৫০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন। স্কুল শাখায় ১,১৫০ জন শিক্ষার্থীর পাশাপাশি কলেজ শাখায় প্রায় ৪০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।
এই প্রতিষ্ঠানটি দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের পদচারণায় ঋদ্ধ হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ও সমরেশ মজুমদার অন্যতম। কবি ও সাংবাদিক আজিজুল হাকিম এই স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন। এই স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক আবু সায়ীদ ছেরাজুদ্দাহার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে (সম্ভবত ১৯৪০ সালে) তাঁকে উদ্দেশ্য করে চার পঙক্তির একটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন, যেটি রবীন্দ্রভবন মহাফেজখানায় সংরক্ষিত আছে। (সূত্র : ড. মনিরুজ্জামান) বিষয়টি এই স্কুলের জন্যে অত্যন্ত গৌরবের।