লোকসংগীতের দেশ আমাদের এই জন্মভূমি। গাজীর পট এদের মধ্যে অন্যতম। আর এই গাজীর পটের অন্যতম বাদক ও গায়েন আমাদের নরসিংদীর হাজীপুর গ্রামের দুর্জন আলী। একজন নরসিংদীবাসী হিসেবে তিনি আমাদের করেছেন সম্মানিত। কিন্তু আমরা কয়জনইবা তাঁর সম্পর্কে জানি? ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি নীরবে চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। আজো অনেককিছুই মনে পড়ে তাঁকে নিয়ে।
উপন্যাসের মতো হাড়িধোয়া নদীর তীরে হাজীপুর গ্রাম। প্রধান সড়ক বলতে মাটির উপর ইটের বুনন। বাড়িগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলাশয় আর খোলা মাঠ দ্বারা আবৃত। রাস্তার ধারে ধারে নাম না জানা হরেক রকমের ছোটো ছোটো গাছপালা। গ্রীষ্মকালের রোদে চারদিকে যখন অস্বস্তি আর ক্লান্তির ছাপ, তখন সবার কাছে এক প্রশান্তির নাম ছিলো দুর্জন আলী ও তাঁর গাজীর পট। দুর্জন আলী ছিলেন এমনি একজন, যিনি মানুষের মাঝে আনন্দ বিলাতেন গাজীর পটের মাধ্যমে। যখনই কোনো বাড়িতে তাঁর আগমন ঘটতো, ঘরের গৃহিণীরা জমায়েত হতো বাড়ির উঠোনে। আর বাড়ির ছেলেমেয়েরা ছুটে আসতো মাঠ থেকে, রাস্তা থেকে। সেসব দুরন্ত ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমিও ছিলাম। এতোটাই আকর্ষণীয় ছিলো তাঁর পরিবেশনা যে, ছেলেমেয়েরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতো তাঁর গীত। কেউ কেউ চেষ্টা করতো তাঁর গাওয়া কয়েকটা লাইন মুখস্থ করে নিতে। এ যেনো ছিলো ছেলেমেয়েদের মনের আনন্দ। বিনিময়ে দুর্জন আলী পেতো প্রতিঘর থেকে একমুঠো করে চাল।
দুর্জন আলী ছিলেন একাকি মানুষ। অবিবাহিত হওয়ায় তাঁর ভাই কোনাই মিয়া, ভ্রাতুষ্পুত্র ও তাদের সন্ততিরাই ছিলো তাঁর আপনজন। তাদের ঘিরেই ছিলো তাঁর সংসার। সারা বছরের উপার্জনের জন্যে কখনো মজুরি খাটতেন, কখনোবা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাতা মেরামতের কাজ করতেন। করতেন কাঠমিস্ত্রীর কাজও। মৃত্যুর আগে তাঁর বয়স হয়েছিলো প্রায় চুরানব্বই (৯৪), কিন্তু ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। শেষ বয়সেও তাঁকে দেখতাম ফুটপাতে বসে ছাতা মেরামতের কাজ করছেন। সমগ্র জীবন কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করতে হয়েছে তাঁকে। অথচ এই দুর্জন আলীই ১৯৯৯ সালে ব্রিটেনে ‘বাংলাদেশ উৎসব’-এ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ২০১৫ সালে ‘ব্রহ্মপুত্র’ পত্রিকার জন্যে তাঁর সাক্ষাতকার নিতে গিয়ে ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের নামাঙ্কিত সার্টিফিকেট দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার।
সময়ের সাথে সাথে দুর্জন আলীর বয়স বাড়ে, বয়স বাড়ে হাজীপুরেরও। শেষ সময়ে তাঁকে দেখতাম বাজারের চায়ের স্টলে। একাকি। তাঁর পরনে থাকতো জীর্ণ কাপড়। অবশেষে ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি সবার অলক্ষ্যে নীরবে চলে গেলেন গাজীর পটের শেষ সূর্য দুর্জন আলী।
দুর্জন আলীর প্রসঙ্গ এলেই আরো বহু স্মৃতি মনের গোপন কুঠুরি থেকে জেগে ওঠে। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে ‘ব্রহ্মপুত্র | নরসিংদী জেলার মুখপত্র’ দুর্জন আলীকে প্রচ্ছদকাহিনি করে সংখ্যা প্রকাশ করে। সেই সংখ্যায়ও লিখেছিলাম আমার শৈশবের নির্মল আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ দুর্জন আলীকে নিয়ে। ‘একজন প্রকৃত শিল্পীর সান্নিধ্যে’ শিরোনামের সেই লেখাটি আবারো পাঠকের সামনে নিয়ে আসা খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলেই মনে করি।
________________________
একজন প্রকৃত শিল্পীর সান্নিধ্যে
ব্রহ্মপুত্র, প্রথম বর্ষ একাদশ সংখ্যা (০১ আগস্ট ২০১৫) থেকে
গাজীর পটের অন্যতম কুশীলব নরসিংদীর গায়েন দুর্জন আলীর বাড়ি হাজীপুর গ্রামের যে-পাড়ায়, সেখানে গিয়ে মন আর যেতে চাইছিলো না। মূল এলাকা থেকে যেনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ; নোংরা জল আর থিকথিকে কাদায় পূর্ণ বাড়িতে যাবার মূল রাস্তা। ‘মূল রাস্তা’ বলে আসলে কিছু নেইও। ঢাকা শহরের বস্তির চেয়েও ঘনবসতিপূর্ণ কয়েকটি টিনের চৌচালা ঘরের কোন দিক দিয়ে যাওয়া যাবে, তা ঠাহর করতে লেগে গেলো আধা ঘণ্টা। তারপর আছে প্রায় হাঁটুসমান নোংরা পানি পেরোনোর ধকল। তবু যাওয়া হলো। আমরা তিনজন। আমাদের পথ দেখিয়ে চলেছেন এলাকার প্রবীণ, মহৎ, আন্তরিকতাপূর্ণ একজন মানুষ। নাম নিরঞ্জন বাবু।
দুর্জন আলী বাড়ি নেই। অগত্যা ঘরে বসে অপেক্ষা করতে হলো। অপেক্ষা করতে করতে কথা হচ্ছিলো তাঁর ভাতিজার বউয়ের সাথে। তিনি আমাদের আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। ঘরের পুরো অংশে দরিদ্রতার ছাপ সুস্পষ্ট। কিন্তু এই মহিলার হাসি ও কথায় কোনো দরিদ্রতার চিহ্ন ছিলো না।

…অবশেষে দুর্জন আলী এলেন। আমাদের চক্ষু সার্থক হলো। খর্বাকৃতির হালকা-পাতলা গড়নের এক বৃদ্ধ। তবে চেহারায় মনীষীদের ছাপ। এক দেখায়ই ভালো লাগলো। দুর্জন আলী যে-ঘরটাতে থাকেন, সেটা কতোটা করুণাঘন, না দেখলে বোঝার উপায় নেই। কিন্তু মুখে তাঁর পরম তৃপ্তির হাসি। আমাদের দেখে খুব খুশি। কিছুটা গেয়ে শোনালেন। ইংল্যান্ড ভ্রমণের বর্ণনা দিতে দিতে সার্টিফিকেট খোঁজাখুঁজি করছেন আর বলে চলেছেন তাঁর প্রাজ্ঞতাপূর্ণ কথাবার্তা। কথোপকথনের এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “গাজীর গান কেনো গান! কী আছে এই গানে!” বললেন, “এটা গাইলে সুখ আসে মনে। জ্ঞান পাওয়া যায়।” এরচে’ বড়ো মহৎ কথা আর কী হতে পারে! নিজের মতো এই যে আত্মসুখ লাভ, এরচে’ মহৎ শিল্পী আর কে হতে পারে!
আমরা জিজ্ঞেস করি তার বর্তমান দুরবস্থা নিয়ে, কিন্তু এই বৃদ্ধ-তরুণ মহান শিল্পী এসব কথার ধারে-কাছেও গেলেন না। তিনি কেবল তার গাজী-কালু, পট ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে উৎসাহী। আর তাঁর মুখে লেগে আছে পরিতৃপ্তির হাসি।

তাঁর ভাতিজা ফজল মিয়া এলেন। তিনি বের করলেন শম্ভু আচার্য’র আঁকা পটচিত্র এবং শোনাতে লাগলেন আমাদের, চিত্র ধরে ধরে কাহিনি-গান। আমাদের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বারবার আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে দিতে লাগলো। ফজল মিয়া গ্রামে ঘুরে ঘুরে ভাঙা ছাতা ঠিকঠাক করেন। ফজল মিয়া যখন গান শুরু করেন, তখন দুর্জন আলী নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি, তিনিও শুরু করলেন ভাতিজার সঙ্গে। শরীরে এখন আর আগের শক্তি নেই, বোঝা যায়। কিন্তু মনের এক অদম্য অফুরন্ত শক্তির বলে এখনো তারুণ্য ধরে রেখেছেন প্রায় শতবর্ষী এক মহান গায়েন দুর্জন আলী।
আমরা ফিরে আসছি আবার সেই নোংরা কাদাপানি পেরিয়ে। কিছুটা এসে পেছন ফিরে দেখি দুর্জন আলী হাঁটুকাদা পেরিয়ে আমাদের পেছন পেছন আসছেন। উদ্দেশ্য, আমাদের দোকানে বসিয়ে চা-বিস্কিট খাওয়াবেন। আমরা ভাবি, ৬০/৭০ বৎসর ধরে এই অঞ্চলে এক ঐতিহ্য ধরে রাখা এই জীবন্ত কিংবদন্তীকে সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা তথাকথিত শিক্ষিত-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা কী দিয়েছি? একটা ভালোমতো থাকার ঘর নেই, চরম দীন-দরিদ্র অখ্যাত এক পাড়ায় বসে বসে হৃদয়ের ভেতর এই পরম সৌন্দর্য কীভাবে ধরে রাখেন এই বৃদ্ধ? তিনি এখনো কেবল দিতে চান। প্রাপ্তির খেদহীন এই শিল্পীর কাছে শেখার আছে অনেক কিছু।