নরসিংদীর লোকউৎসব ও লোকমেলা

ওরস
নরসিংদী জেলাধীন নরসিংদী সদর উপজেলার কাবুল শা’ (রা.)-এর মাজার, বেলাব উপজেলার আমলাব বাজারে হজরত শাহ আলী শাহ (রা.)-এর মাজার, ভাটেরচর দক্ষিণপাড়া ভূঁইয়া শাহ বাড়ির দরবার শরীফ মাজার, শিবপুর উপজেলার কুমরাদী গ্রামের শাহ মনসুরের মাজারে বছরের বিভিন্ন সময় ওরস অনুষ্ঠিত হয়। ওরস উপলক্ষে স্থানীয়সহ বিভিন্ন এলাকার মানুষের সমাগম হয়।

হযরত মাওলানা কাবুল শা’ (রা.)-এর মাজারের ওরস
প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের ১২ তারিখে কাবুল শা’ মাজারে ওরস অনুষ্ঠিত হয়। দেড়শো বছর আগে নরসিংদী পৌরসভার তরোয়ায় হযরত মাওলানা কাবুল শা’ (রা.)-এর মাজারের এই স্থানটি জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিলো। জঙ্গলের ভেতর এই রওজা অর্থাৎ মাজার পাওয়া যায়। আজ থেকে ১৭ বছর আগে এই মাজারের ভবনের পিলার তৈরি করার সময় মাটির নিচে ইটের দেয়াল পাওয়া যায়।

হযরত মাওলানা কাবুল শা (রা.)-এর মাজারের খাদেম মো. হারুন-অর-রশীদ খান বলেন, “আমার দাদা হাজী সামাদ খান বিয়াল্লিশ বছর এই মাজারের খাদেমগিরি করেন। এরপর আমার বাবা মেহের খান পঁচিশ বছর এবং আমি আটত্রিশ বছর যাবত এই মাজারের খাদেমগিরি করছি। প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মাজারে মিলাদ মাহফিল এবং জিকির হয়। প্রতিদিন মানত পূর্ণ হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১২-১৪ জন তোবারক নিয়ে আসেন। তোবারক খিচুড়ি-বিরিয়ানি আসে। দোয়া পড়ে তোবারক প্রথমে পশুপাখির জন্য মাজারের উঠানের এক কোণায় দেয়া হয়। এরপর মাজারে আগত ভক্তদের মধ্যে তোবারক বিতরণ করা হয়।”

কথিত আছে, মাজার আবিষ্কারের সময় থেকে দুটি পাথর ছিলো। পাথর দুটো চারকোণা আকৃতির। মাজারের পাশে পূর্ব দিকের চাকলার দীঘিতে পাথর দুটো নামতো। আবার দীঘি থেকে উপরে উঠে আসতো। পাথরের মাঝখানটা একটু ঢালু। মানুষ অজু করার জন্যে পাথরের ঢালু অংশে হাত দিলে পানি উঠতো। কেউ একজন একটি পাথরের এক কোণা ভেঙে ফেলে। দ্বিতীয় পাথরটি চাকলার দীঘিতে নেমে যায়। পাথরটি আর উপরে উঠে আসেনি। যে-পাথরটি নামেনি, সেটিতে পঞ্চাশ বছর যাবত আর পানি উঠে না।

মানুষ মূলত বিভিন্ন মানত নিয়ে এখানে আসে। বিভিন্ন এলাকার মানতকারীরা বৃহস্পতিবার হরদম মিষ্টান্ন, খিচুড়ি, বিরিয়ানির তবারক কাবুল শা’ (রা.)-এর মাজারে এনে দেয়। মানতকারীরা দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তবারক নিয়ে আসে। মাজার প্রাঙ্গণে প্রতিদিনই বিকালে প্লাস্টিকের কাগজ বিছিয়ে মারফতি-ফকিরি গানের আসর বসে। শ্রোতারা গায়কদের চারপাশ ঘিরে বসে-দাঁড়িয়ে আসর উপভোগ করেন। গায়কদের মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে মোরা গায়, অন্যরা ঘোসায় টান দেয়।

হজরত শাহ আলী শাহ (রা.)-এর মাজারের ওরস
হজরত শাহ আলী শাহ (রা.)-এর মাজারে বছরে একদিন ওরস করা হয়। তবে সময় নির্ধারিত নেই। জানা যায়, ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাগদাদ থেকে ৩৬০ জনের মধ্যে তিনজন আউলিয়া নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার আমলাব বাজারে এসে আস্তানা গাড়েন। এই তিনজন আউলিয়ার মধ্যে হজরত শাহ আলী শাহ (রা.), ওয়ালি শাহ এবং আরেকজন আউলিয়া (নাম জানা যায়নি) ছিলেন। তাঁদের এখানে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁদের সমাধিস্থলেই এ-মাজার গড়ে ওঠে।

সব বয়সি নারী-পুরুষ যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী মানত করেন। প্রতিদিনই সকাল-সন্ধ্যা মোমবাতি জ্বালিয়ে ভক্তরা যার যার বাসনা মানত করেন। মানত পূর্ণ হলে গরু, ছাগল, মুরগি দিয়ে তৈরি খিচুড়ি, বিরিয়ানি, সিন্নি দেয়। সন্ধ্যা ৭ টার পর মাজারের ফটক বন্ধ করে দেয়া হয়।

ভাটেরচর দক্ষিণপাড়া শাহ বাড়ির দরবার শরীফের ওরস
বেলাব উপজেলার ভাটেরচর গ্রামের দক্ষিণপাড়ায় শাহ বাড়ির দরবার শরীফে প্রতিবছর চৈত্র মাসের ২০ তারিখ ওরস অনুষ্ঠিত হয়। এই গ্রামের শাহ মোহাম্মদ শাহ সুফী আবু তালেব হোসেন চিশতিয়া এবং শাহ সুফী পীরে কামেল আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া চিশতিয়া— পিতা-পুত্র দুজনেই পীর ছিলেন। শাহ সুফী পীরে কামেল আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া চিশতিয়া ভৈরবের জগন্নাথপুরের পীর শাহ করিম শাহ সুফী আব্দুল করিম চিশতিয়ার মুরিদ হন। শাহ সুফী পীরে কামেল আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া চিশতিয়ার ছেলে শাহ মোহাম্মদ আবু কায়সার চিশতিয়া ১৯৯৩ সালে সিলেটের শায়েস্তাগঞ্জের ১২০ আউলিয়ার দরবারের মতুয়ালির শাহ সুফী শফিকুল হাসান চিশতিয়ার মুরিদ হন।

১৯৯০ সাল থেকে প্রতিবছর চৈত্র মাসের ২০ তারিখ (৩ এপ্রিল) ভাটেরচর দক্ষিণপাড়ার শাহ বাড়ি দরবার শরীফ মাজারে ওরস উদযাপিত হয়। দুইদিন ধরে সারা দিন-রাত ওরস চলে।

নরসিংদীর বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের রহিমাকান্দির শফিকের দল, ভাটেরচরের নওয়াব মিয়ার দল, মীর কাশেমের দল, সোহরাব হোসেনের দল, লক্ষ্মীপুরের আবু জাহেরের দল ওরসে বাউল গান, ফকিরি, মারফতি, নবীতত্তত্বের গান পরিবেশন করেন।

হাসান পাগলার মাজারের ওরস
ময়মনসিংহের নান্দাইল থেকে হাসান পাগলা সিলেটের পীর সিদ্দিক আলী মাওলানার সাথে নরসিংদীর বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের ভাটেরচর গ্রামে আসেন। পীর সিদ্দিক আলী হাসান ফকিরকে এ-গ্রামের বাসিন্দা গোলাপ মিয়ার কাছে রেখে যান। এখানে তিনি ফকিরি গান-বাজনা আর জিকির করতেন, মসজিদে আজান দিতেন। এলাকার মানুষের কাছে তিনি আধ্যাত্মিক ব্যক্তি হিসেবে সুপরিচিত হন। কারো কোনো রোগ-বালাই হলে তারা তার কাছে যেতেন। তিনি ফুঁ দিয়ে দিলে রোগমুক্তি ঘটতো। পঞ্চাশ বছর তিনি এই এলাকায় আউলিয়ার কাজ করেন। ১৯৯২ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। ভাটেরচর গ্রামেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। তার সমাধিস্থানে গড়ে ওঠে মাজার, যেখানে প্রতি বছর ওরস হয়।

পার্বণ
পার্বণ নিয়ে বাংলাদেশে একটি কথার প্রচলন রয়েছে। হিন্দুদের ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’। এখানে তেরো শব্দটি তেরো সংখ্যা অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। তেরো শব্দটি এখানে বহু অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রকৃত অর্থে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ সারা বছর জুড়ে অনেক ব্রত পার্বণের অনুষ্ঠান করে থাকে। এমন অনেক লৌকিক দেব-দেবীর পূজা বছরের নির্দিষ্ট দিন ছাড়াও প্রতি মাস এবং সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে করা হয়। মঙ্গলচণ্ডী পূজা সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার, লক্ষ্মী পূজা সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার এবং শনি পূজা সপ্তাহের প্রতি শনিবার বাড়ির উঠোনে বা বারান্দায় তুলসি গাছের তলায় করা হয়। নরসিংদী জেলায়ও এসব পূজার প্রচলন রয়েছে।

পদ্মপুরাণ
লোকায়ত দেবী পদ্মা বা মনসা বিষয়ক আখ্যানের পরিবেশনা ‘পদ্মপুরাণ’। সাধারণত বাংলা বছরের শ্রাবণ সংক্রান্তি অর্থাৎ শ্রাবণ মাস জুড়ে এই পুরাণ নরসিংদী অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে পরিবেশিত হয়ে থাকে। এ-ধরনের আখ্যান পরিবেশনার জন্যে সাধারণত বাড়ির উঠোন, ঘর, চতুর্দিকে খোলা নাটমন্দির অথবা মন্দির প্রাঙ্গণের খোলা স্থানে এ-গান পরিবেশন করা হয়। শ্রাবণ মাস জুড়ে বেলা তিনটার পর পদ্মপুরাণ পরিবেশন করা হয়। একটি জলচৌকির উপর পদ্মপুরাণ রাখা হয়। শ্রাবণ মাসের প্রতিদিন গানের সুরে একজন নারী পদ্মপুরাণ পরিবেশন করেন। তাকে ঘিরে বসে এলাকার অন্য নারী অর্থাৎ গৃহিণীরা। পদ্মপুরাণের সামনে একটি থালায় চিনি, বাতাসা আর একটি গ্লাসে জল রাখা হয়। অনেকে ফল-মিষ্টিও দিয়ে থাকে। আগরবাতি জ্বালানো হয়। যিনি ইচ্ছা করেন, তার ঘরেও পদ্মপুরাণ পড়া হয়। এভাবে কয়েক ঘর ঘুরেও পদ্মপুরাণ শেষ করা হয়। যারা এই আখ্যান শোনেন, তাদের সবার হাতে ফুল, দূর্বা থাকে।

বেলাব উপজেলার জাংগুয়া গ্রামে মনসা পূজার দিন পদ্মপুরাণের আখ্যান শেষ করা হয় না। মনসা মূর্তি অথবা অষ্টনাগ বিসর্জনের দিন পদ্মপুরাণের আখ্যান শেষ করা হয়।

মনসা পূজা
সর্পের দেবী মনসা। শ্রাবণ সংক্রান্তিতে শ্রী শ্রী মনসা দেবী ও অষ্টনাগ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পহেলা শ্রাবণ পদ্মপুরাণ পাঠ শুরু হয়, শেষ হয় পহেলা ভাদ্রে। মন্দির অথবা যে-বাড়িতে পদ্মপুরাণের আখ্যান পরিবেশন করা হয়, সেই বাড়িতে মনসা মূর্তি অথবা নাগ দিয়ে মনসা পূজা করা হয়।

নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলায় মনসা মূর্তি দিয়ে পূজা করা হয়। শাপলা ফুলের মালা গেঁথে মনসা মূর্তির গলায় পরিয়ে দেয়া হয়।

বেলাব উপজেলার জংগুয়া গ্রামের দেবনাথ সম্প্রদায় মনসার মূর্তি দিয়ে পূজা করে। পোড়ামাটির ঘটে সিঁদুরের ফোঁটা দেয়া পাঁচ পাতাবিশিষ্ট আম্রপল্লব রাখা হয়। ঘটের গায়ে পাঁচ ফোঁটা সিঁদুর দেয়া হয়। ঘটের উপর ফুল, বেলপাতা, ধান, দূর্বা, আস্ত নারকেল এবং গামছা রাখা হয়। নরসিংদী উপজেলার বৌয়াকুড় গ্রামে জেলে সম্প্রদায়ের লোকেরা মনসা মূর্তি দিয়ে পূজা করে।

বিশ্বকর্মা পূজা
শিল্পের প্রতিষ্ঠাতা দেবতা বিশ্বকর্মা। নরসিংদী জেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের কুমার-কামার, বণিক, তাঁতী, স্বর্ণকার শ্রেণির নর-নারীরা এই পূজা উদযাপন করে থাকেন। শিবপুর উপজেলার নর-নারীরা এই পূজা উদযাপন করে থাকেন বেশি। পঞ্জিকা মতে, বিশ্বকর্মা পূজা ষড়শীতি সংক্রান্তি অর্থাৎ ৩১ ভাদ্র অনুষ্ঠিত হয়। সমৃদ্ধির জন্যে এই পূজা করা হয়। এ-পূজা মূলত তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থানে করা হয়। সেখানে মাটির তৈরি এক থেকে দেড় ইঞ্চি লম্বা বিশ্বকর্মার মূর্তি অথবা বিশ্বকর্মার ছবি স্থাপন করা হয়। অবস্থাপন্ন বণিক, মৃৎশিল্পী এবং কর্মকাররা মূর্তি নিয়ে বিশ্বকর্মা পূজা করে থাকে। পূজার সময় ঢাক, ঢোল, কাঁসর, ঘণ্টা বাজানো হয়। নরসিংদী সদর উপজেলার বৌয়াকুড়ে বিশ্বকর্মা পূজা ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্রেই অনুষ্ঠিত হয়।

লক্ষ্মী পূজা
ধনের দেবী লক্ষ্মী। আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা অর্থাৎ পঞ্চমী তিথিতে লক্ষ্মী পূজা হয়। একে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজাও বলা হয়। দেবী দূর্গার বিসর্জনের পঞ্চম দিনে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। যদিও সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার এই পূজা প্রায় প্রত্যেক হিন্দু বাড়িতে করা হয়। নরসিংদী অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আশ্বিন মাসের পঞ্চমী তিথিতে লক্ষ্মী মূর্তি দিয়ে পূজার প্রচলন রয়েছে।

বেলাব উপজেলার জংগুয়া গ্রামে দেবনাথ সম্প্রদায়ের লোকেরা লক্ষ্মী পূজায় দুটি ডোল যাবার দেয়। ডোল যাবার দুটি কলাপাতার উপর বসানো হয়। একটিতে ধান, দ্বিতীয়টিতে সিদ্ধ চাল দেয়া হয়। এ-সম্প্রদায়ের লোকেরা লক্ষ্মীর মূর্তি নিয়ে পূজা করে। তবে পূজায় আল্পনা করে না।

শিবপুর উপজেলার যোশর গ্রামের পাল সম্প্রদায়ের মধ্যে মূর্তি নিয়েই লক্ষ্মী পূজা করার প্রচলন রয়েছে।

শিবপুর উপজেলার কামরাব গ্রামের পাল সম্প্রদায়ের মধ্যে চালের গুঁড়া নিয়ে তৈরি চষির নাড়ু লক্ষ্মী দেবীকে নিবেদন করার চল রয়েছে, যা নরসিংদী অঞ্চলের অন্য কোথাও দেখা যায় না।

নরসিংদী সদর উপজেলার বৌয়াকুড় গ্রামের খালপাড়া জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে লক্ষ্মী পূজায় সেওইর নাড়ু দেয়া হয়। ভাত চালন দিয়ে ডলে রোদে শুকিয়ে বালু অথবা তেল দিয়ে ভাজা হয়। ভাজা সেওই গুড়ে পাক দিয়ে নাড়ু তৈরি করা হয়।

কার্তিক পূজা
কার্তিক শস্য দেবতাদের মধ্যে সর্বপ্রধান। ৩০ কার্তিক কার্তিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। কার্তিক মাসের শেষদিন ফসল তোলার মৌসুমের আগে করা হয় বলে এই দেবতার নাম কার্তিক। এই প্রতিমা দেব সেনাপতি কার্তিকের মতোই দেখতে। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ নারীরা আনুষ্ঠানিকভাবে এই ব্রত বা পূজা করে থাকে। মাটির মূর্তি দিয়ে কার্তিক পূজা করা হয়। মূর্তির উপর নতুন গামছা রাখা হয়। ব্রতিনী কার্তিকের মূর্তির সামনে তিনটি বড়ো ঘট স্থাপন করে থাকে। প্রতিটি ঘটের গায়ের মাঝখানে পাঁচটি সিঁদুরের ফোঁটা দেয়া হয়। প্রথম ঘটে পুরান চাল, দ্বিতীয় ঘটে আতপ চাল এবং তৃতীয় ঘটে জলপাই, তেঁতুল, মূলা, বেগুন, আলু, বিভিন্ন সবজি দিয়ে পূর্ণ করা হয়। একধরনের কাঁটা গাছ কার্তিকের প্রতিমার পেছনে মাটির মধ্যে পোঁতা হয়।

নবান্ন
অগ্রহায়ণ মাসে জমিতে ধান পাকলে নতুন ধানের চাল দিয়ে পিঠা ও মিষ্টান্ন রান্না করা হয়। জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে ছেলে বা মেয়েশিশুকে কাঁচি দিয়ে জমিতে পাঠানো হয়। জমিতে পাঠানোর আগে শিশুটিকে স্নান করানো হয়। কারো সাথে কথা না বলে শিশু ধানের পাঁচটি হিজা কেটে মাথায় করে বাড়িতে নিয়ে আসে। এই পর্যন্ত সে কথা বলবে না। একটি পোড়ামাটির ঘটে জল ভরে জলচৌকির উপর বসানো হয়। এই ঘটে ধানের হিজা ডুবিয়ে রাখা হয়। ধানের হিজায় পাঁচটি সিঁদুরের ফোঁটা দেয়া হয়। এভাবে এটি ঘরে রাখা হয়। চালের গুঁড়া জলে গুলিয়ে জলচৌকির সামনে আল্পনা করা হয়। জলচৌকির সামনে থেকে আঁকতে আঁকতে ঘরের দোর পর্যন্ত এসে শেষ করা হয়।

জমি থেকে প্রথম যে-ধান ঘরে তোলা হয়, তা আতপ চাল করা হয়। এই চাল থেকে কিছু চালের গুঁড়া কুটে পাঁচটি চিতল পিঠা বানানো হয়। দুধ দিয়ে নতুন চালের মিষ্টান্ন রান্না করা হয়। পরে এই পিঠা-মিষ্টান্ন পরিবারের সদস্য এবং প্রতিবেশিদের খেতে দেয়া হয়।

বেলাব উপজেলার যুগি সম্প্রদায়ের মধ্যে অগ্রহায়ণ মাসে প্রথম যে-ধান ঘরে উঠে, তা নবান্নের জন্যে আলাদা করে রাখে। রোববার অথবা বৃহস্পতিবার উপবাস করে ঐ-ধানের চালের গুঁড়ি দিয়ে দুপুরবেলা চিতল পিঠা এবং চাল দিয়ে মিষ্টান্ন রান্না করা হয়। চালের গুঁড়ি জলে গুলিয়ে ঘর ও উঠোনে ফুল, কলসি, ধানছড়া, পানগাছ ইত্যাদি আল্পনা আঁকা হয়। ঘরের মতুম পালার সামনে আল্পনা আঁকা হয়। এখানে একটি থালায় পাঁচটি চিতল পিঠা ও মিষ্টান্ন দিয়ে লক্ষ্মী দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়।

মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরাও অগ্রহায়ণ মাসে প্রথম যে-ধান ঘরে তোলে, তা দিয়ে নবান্ন উৎসব করে।

শারদীয় দুর্গোৎসব
হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় অনুষ্ঠান দুর্গা পূজা। শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে মায়ের আগমন। মায়ের আগমনে নরসিংদী শহরে বাগবিতান, সেবা সংঘ, বিজয়া সংসদ, যুব সংঘ, সাটিরপাড়া মহামায়া সংঘ, নরসিংদী ক্রীড়াচক্র, নোয়াদিয়া আদ্যাশক্তি মন্দির, ব্রাহ্মন্দী ও শিক্ষা চত্বর মন্দিরে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। নরসিংদীর সবচেয়ে বড়ো মণ্ডপ বাগবিতান ক্লাব। এখানে অষ্টমীর দিন তিথি অনুযায়ী কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বারো বছরের নিচে মেয়েশিশুকে মা দুর্গা সাজিয়ে কুমারী পূজা করা হয়।

নরসিংদীর রায়পুরার পশ্চিমপাড়া, বটতলাহাটি, তাত্তাকান্দা, হাশিমপুর, কড়িতলা, পিরিচকান্দি, রহিমাবাদ, আমীরগঞ্জ ইত্যাদি এলাকায় দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মণ্ডপগুলোতে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে ভক্তদের মাঝে খিচুড়ি, লাবড়া, ফল-ফলাদির প্রসাদ বিতরণের পাশাপাশি সন্ধ্যায় আরতি নাচেরও আয়োজন করা হয়।

শিবপুরে নৌকাঘাটা, জয়নগর, কামরাব, আজকিতলা, যোশর ইত্যাদি এলাকায় দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মণ্ডপগুলোতে সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত দুপুরে ভক্তদের মাঝে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। সন্ধ্যায় এলাকার হিন্দু যুবকরা আরতি নাচে অংশ নেয়। মনোহরদীর রামপুরের মিঠাগড়, সিদ্ধেশ্বরী বাড়ি, পশ্চিমপাড়ায় দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। খিদিরপুর, সরিতপুরেও পূজা হয়। প্রত্যেক মণ্ডপে কাপড় এবং আলোকসজ্জা করা হয়। সন্ধ্যায় এসব মণ্ডপে আরতি নাচের প্রতিযোগিতা করা হয়।

বেলাব’র বিশটি পূজা মণ্ডপে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বেলাব মন্দির, বেলাব সুতারপাড়া মন্দির, নারায়ণপুর, গোবিন্দপুর, চর উজিলাব সুতারবাড়ি, কাশিমনগর, বিন্নাবাইদ ইত্যাদি মন্দিরে পূজা হয়।

ঈদ উৎসব
ঈদ নরসিংদীর মুসলমান সম্প্রদায়ের একটি বড়ো ধর্মীয় উৎসব। ঈদের নামাজের ইমামতি করেন মসজিদের ইমাম। নামাজ শেষে ঈদগাহ ময়দানে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। এতে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

রায়পুরা উপজেলার তাত্তাকান্দা জামে মসজিদের ঈদগাহ ময়দানে ঈদের বৃহত্তম জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া রায়পুরা থানার হাফেজিয়া মাদরাসা প্রাঙ্গণ, শ্রীরামপুর মদিনা মসজিদ, কুলাতলী গ্রামের ঈদগাহ মাঠ, চরাঞ্চলের ফকিরাচর মাদরাসা মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। রায়পুরা উপজেলার ২৪ টি ইউনিয়নের প্রত্যেকটিতে চার থেকে পাঁচটি ঈদগাহ ময়দানে ঈদের জামাত হয়।

শিবপুর উপজেলার জয়নগর বিলপাড় ঈদগাহ ময়দান, জয়নগর ধনাইয়া ঈদগাহ মাঠ, যোশর কামারটেক ঈদগাহ মাঠ, কামরাব জয়নগর ঈদগাহ মাঠ, সুজাতপুর ঈদগাহ মাঠ, আজকিতলা ঈদগাহ মাঠ, দরিপুরা ঈদগাহ মাঠ, শিবপুর ঈদগাহ মাঠ, চৌঘরিয়া ঈদগাহ মাঠ, খরিয়া ঈদগাহ মাঠে মুসল্লিরা ঈদের নামাজ আদায় করেন।

পীরপুর ঈদগাহ মাঠ মনোহরদীর খিদিরপুর ইউনিয়নে সবচেয়ে বড়ো ঈদগাহ মাঠ। এছাড়াও পূর্ব রামপুর ঈদগাহ মাঠ, পশ্চিম রামপুর ঈদগাহ মাঠ, চরসাগরদি ঈদগাহ মাঠ, চর আহমদপুর ঈদগাহ মাঠ, খিদিরপুরের দরগা ঈদগাহ মাঠে ঈদের দিন নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা।

নরসিংদী সদরে গাবতলী জামিয়া কাশেমিয়া মাদরাসা ঈদগাহ ময়দান, নরসিংদী পৌর ঈদগাহ ময়দান, দত্তপাড়া ঈদগাহ ময়দান, ট্রেজারি মাঠ, মাধবদী পৌর ঈদগাহ ময়দান ইত্যাদি ঈদগাহ ময়দানে নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।

লোকমেলা
লোকমেলা গ্রামবাংলার মানুষের আনন্দ বিনোদনের জন্যেই শুধু নয়, এটি লোকউৎসবও বটে। সমাজকে ঐক্যবদ্ধ ও সংহত রাখতে মেলার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এর সাথে জড়িত থাকে লোকসমাজের নানা ধরনের প্রথা, বিশ্বাস-সংস্কার আর উৎসব। লোকসংস্কৃতি এবং লোকশিল্পও লোকমেলার একটি অংশ।

নরসিংদী সদর উপজেলার বাউল ঠাকুরের আখড়াবাড়ির দক্ষিণে মেঘনা নদীর পাড়ে মাঘী পূর্ণিমার আগে অথবা পরের বুধবার বাউল ঠাকুরের মেলা বসে। নরসিংদী সদর উপজেলার তরোয়া পৌরসভায় হযরত মাওলানা কাবুল শা’ (রা)-এর মাজারে ১২ ফাল্গুন কাবুল শা’ মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

বাউল ঠাকুরের মেলা
নরসিংদী সদর উপজেলার বাউলপাড়ায় শ্রী শ্রী বাউল ঠাকুরের আখড়াধামে বাংলা ৯৪০ সাল থেকে বাউল ঠাকুরের মেলা শুরু হয়। বাউল ঠাকুরের আখড়াবাড়ির দক্ষিণে মেঘনা নদীর পাড়ে এই মেলা বসে। প্রতিবছর মাঘী পূর্ণিমার আগে অথবা পরের বুধবার এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাউল ঠাকুর মাঘী পূর্ণিমার এই দিনে যজ্ঞ করতেন। এর স্থায়ীত্বকাল কমপক্ষে দশদিন। দেশ-বিদেশের বাউল ঠাকুরের মতাবলম্বী বাউলশিল্পীরা এই মেলায় অংশ নেয়। আখড়াবাড়ির ঠাকুরের মন্দিরের সামনে আটচালায় বাউলশিল্পীদের আসর বসে। বাউল ঠাকুরের শিষ্যরা এই মেলায় আসেন। শিষ্য ও সেবায়েতগণ যৌথভাবে মেলায় আগত বাউলদের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করেন। বুধবার দুপুরবেলা বাউল ঠাকুরের মহাপ্রসাদ মেলায় আগত ভক্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়। বাউল ঠাকুরের শিষ্যরা মেলায় বাউল ঠাকুরের গান, কীর্তন বেহালা, করতাল, খোল, সারিন্দা, একতারা, মন্দিরা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে পরিবেশন করে। বাউল ঠাকুরের রচিত গান লিখিত নয়, মুখে মুখে শিষ্যরা আত্মস্থ করেছেন।

প্রায় একশত বছর তিনি এখানে অবস্থান করেন এবং এখানে সমাধিস্থ হন। তিনি একাই এখানে আসেন। বাউল ঠাকুরের শিষ্যরা বিক্রমপুর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। নরসিংদী সদরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বেশিরভাগই ঠাকুরের মত পোষণ করেন।

কাবুল শামেলা
তরোয়ার হযরত মাওলানা কাবুল শা’ (রা.)-এর মাজারে ১২ ফাল্গুন মেলা বসে। মাজারের প্রাচীরের সীমানা ঘেঁষে মেলা বসে। সাতদিন ধরে এই মেলা চলে।

১৩৫৯ সালে কাবুল শা’ মাজারে কাবুল শা’ মেলা শুরু হয়। এই নিয়ে জনশ্রুতি রয়েছে। এ-প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা কাবুল শা’ (রা.)-এর মাজারের খাদেম মো. হারুন-অর-রশীদ খান বলেন, “হাজী আব্দুল সামাদ খানের মেজো ছেলে সালামত খান স্বপ্নে নির্দেশ পান, ফাল্গুন মাসের ১২ তারিখে কাবুল শা’ মাজারে মিলাদ মাহফিল তোবারক জিকির সামা করার। একে ঘিরেই এখানে দুইদিনব্যাপী মেলা বসতো। এই মেলায় ফকির পাগল, সালে মজনু সবাই সমবেত হতেন। দুইদিন থেকে মেলার মেয়াদ বেড়ে বর্তমানে সাত দিন হয়েছে।”

কালীবাড়ি মেলা
নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার রায়পুরা সদরে পশ্চিমপাড়া গ্রামের কালী মন্দিরের সামনে কাকন নদীর পাড়ে ফাল্গুন মাসে দোল পূর্ণিমার বারো দিন পর কালীবাড়ি মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একদিন এই মেলা বসে।

তাত্তাকান্দা অষ্টমী মেলা
রায়পুরা উপজেলার তাত্তাকান্দা গ্রামের আর কে আর এম উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে কাকন নদীর পাড়ে অষ্টমী তিথিতে ২৬ চৈত্র তাত্তাকান্দা অষ্টমী মেলা বসে। এই মেলা দু’দিনব্যাপী চলে।

গাছতলা মেলা
রায়পুরা উপজেলার বটতলাহাটি গ্রামের বটগাছতলায় পহেলা বৈশাখে গাছতলা মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলার সময়কাল একদিন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই মেলা। পহেলা বৈশাখের দিন সকালবেলা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা বটগাছতলায় পূজা দেয়। বাইশ বছর ধরে এই মেলা চলছে।


সহায়ক গ্রন্থ
বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি : নরসিংদী, বাংলা একাডেমি

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ