জনাব আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল, আপনি সুবিধাবঞ্চিত শিশু বা পথশিশুদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ‘পথকলি’ নামে। যতোদূর জানি, ২০১১ সালে প্রথম শুরু করেছেন। শুরুর গল্পটা জানতে চাই।
আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : আমি আসলে শিক্ষাজীবন থেকেই বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম। আমি স্কাউট করতাম। তখন আমরা প্রতিবারই শীতবস্ত্র বিতরণ করতাম। রেলস্টেশন, লঞ্চঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায়। ২০১১ সালে আমরা বটতলা পার হয়ে আল্লাহু চত্বরের দিকে গিয়েছিলাম শীতবস্ত্র বিতরণ করতে। সেখানে একটা মাদরাসা আছে, তার পাশে কয়েকটা টঙ দোকান আছে। সেখানে কিছু মানুষ জড়ো করে আমরা কাজ করছিলাম। হঠাৎ দেখি, একটা টঙের নিচে কিছু একটা নড়াচড়া করছে। রাত তখন প্রায় একটা বাজে। ভাবলাম কুকুর-টুকুর হবে হয়তো। কিন্তু টর্চ মেরে দেখি একটা বাচ্চা। শীতে একদম কাঁপতেছে, কান্না করতেছে। বের করে বাবা-মা’র কথা জিজ্ঞেস করলাম। বলতেছে, বাবা আরেক বিয়ে করে চলে গেছে, মা’রও বিয়ে হয়ে গেছে টঙ্গি। বাচ্চাটা সেখানেই বিভিন্ন হোটেলে পানি আনার কাজ করে দিনের বেলা। রাতে থাকার জায়গা নাই। তো বিষয়টা আমার খুব খারাপ লাগলো। ওর গায়ে একটা কম্বল জড়িয়ে দিলাম। তারপর সরকারি কলেজে দেখলাম আরো কিছু বাচ্চা পাঁচ টাকা-দশ টাকার জন্যে মানুষের হাতে-পায়ে ধরতেছে, আবার কেউ টাকা না দিলে তাদের সাথে খারাপ ব্যবহারও করছে। তো সব মিলিয়ে আমার মনে হলো, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর, এসব বাচ্চাদের নিয়ে কিছু কাজ করা যায়। তখন আমি নরসিংদী সরকারি কলেজের মূল ভবনের সামনের মাঠে একদিন এরকম আট-দশটা বাচ্চাকে নিয়ে বসি। তাদের সাথে কথাবার্তা বলি। তাদের বলি যে, প্রতিদিন আমরা বসবো। তারা তো আর এমনিতেই আসবে না। তাদের জন্যে চিপস-চকলেট নিয়ে যেতাম। এভাবে তারা আরো বাড়তে লাগলো। প্রথমদিকে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম, তারা যেন মানুষের কাছে এভাবে টাকা না চায়, মারামারি না করে। দেখলাম কাজ হচ্ছে। পরবর্তীতে ভাবলাম, পড়াশোনার দিকে তাদের নিয়ে যাই। প্রথম বসার প্রায় একবছর পর তাদের আমি অক্ষরজ্ঞান দেয়া শুরু করি। তখন পৌরপার্ক ছিলো না। কলেজের মূল ভবনের মাঠের বিভিন্ন জায়গায় তাদের নিয়ে বসতাম। পরে একটা সময় (২০১৫-১৬ হবে) কলেজে বহিরাগতদের প্রবেশে অনেকটা রেস্ট্রিকশন জারি হলে তাদের নিয়ে পার্কের দিকে চলে আসি।
তাদেরকে কী কী পড়ানো হতো?
আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : পার্কে আসার পর থেকে একজন হুজুর রাখি তাদের আরবি পড়ানোর জন্যে। পাশাপাশি আমি বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি পড়াতাম। সপ্তাহে তিনদিন বসতাম। শুক্র-শনি আমি পড়াতাম, আর একদিন হুজুর পড়াতো। সবাই ছিলো একদম বাচ্চা, ৫-১০ বছর বয়স। ফলে একেবারে প্রাথমিক অক্ষরজ্ঞান শিখানো হতো। এখনো এভাবেই চলছে। সেখান থেকে যাদেরকে উৎসাহী মনে হয়, তাদেরকে আশেপাশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি করিয়ে দিই। সেক্ষেত্রে ব্যাগ-ইউনিফর্মের খরচ আমরা বহন করি।
এই হারটা আসলে কেমন? মানে কেমন সংখ্যক শিশু আপনার এখান থেকে সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হচ্ছে প্রতি বছর?
আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : আমার এখানে শিশুর সংখ্যা প্রায় ৬৪। নিয়মিত আসে ৪০ জনের মতো। আবার খাবার বা কাপড় দেয়ার সময় সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ৮০-৯০ জনে। এদের মধ্য থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে ৪-৫ জনকে বিভিন্ন সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে পারি।
নানা সময়ে আমরা দেখেছি যে, নরসিংদীর সংস্কৃতিকর্মী থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত আপনার এই কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হয়েছেন, শিশুদের সাথে বসেছেন। তো তাদের কাছ থেকে কীরকম সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন?
আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : আচ্ছা, একটা বিষয় আমি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে রাখি। আমি যখন বাচ্চাদের নিয়ে বিশেষ কোনো ইভেন্ট করি, সেটা খাবার বা পোশাক যা-ই হোকÑ অনেক অতিথি থাকে তখন। এবং অতিথিদের নিয়ে আসার মূল কারণ হলো, বাচ্চাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাই যে, দেখো, উনারা পড়াশোনা করেছেন বলেই আজকে এমন এমন ভালো জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তোমরাও পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। মূলত তাদের উদ্বুদ্ধ করাই ছিলো আমার উদ্দেশ্য। আর আমার এখানে যে-অতিথিদের আমি নিয়ে এসেছি, তাদের কাছ থেকে আমি কোনো আর্থিক সহায়তা কখনোই নিইনি। তারপরও উৎসাহী অনেকে সহযোগিতা করতে চাইলে আমি তাদের বলি, আপনি একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করে দেন বা কাপড় কিনে দেন। তখন তারা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বাচ্চাদের খাবার বা কাপড় দিয়ে যান। সরাসরি আর্থিক কোনো সহায়তা আমি আজ পর্যন্ত কখনোই গ্রহণ করিনি। আমি নিজের বেতনের একটা নির্দিষ্ট অংশ বাচ্চাদের জন্যে জমিয়ে রাখি। সেখান থেকেই তাদের সমস্ত খরচ বহন করি।
দীর্ঘ সময় এই কাজ করতে গিয়ে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন কি?
আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : প্রথমদিকে বন্ধু-বান্ধবরা নানাভাবে নিরুৎসাহিত করতো। কারণ, এসব বাচ্চারা একটু নোংরাই থাকে, জামা-কাপড় ঠিক থাকে না, হাতে-পায়ে-চুলে ময়লা থাকে। এসব কারণে অনেকে তাদের সঙ্গ দেয়াটা পছন্দ করতো না। অনেকে বলতো, এগুলো নিজের প্রচারের জন্যে করে, কাজের কাজ কিছুই নাই। আবার অনেকে বলতো, টাকা-পয়সা হাতানোর জন্যে করে, ডোনেশন নিয়ে করে ইত্যাদি। তো একটা সময় পরে এসব মন্তব্য আর গায়ে মাখি না। নিজের জায়গায় সৎ থাকলে এগুলো কাজে প্রভাব ফেলে না।
আপনি তো একজন ব্যাংকার। পেশাগত জায়গায় আপনি অনেক ব্যস্তই থাকেন বলা যায়। সারা সপ্তাহের ব্যস্ততা শেষে ছুটির দিনগুলোতে আপনি ‘পথকলি’ নিয়ে মেতে থাকেন…
আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : আমি বলি, একটা সময় থাকে, মানুষ অনেক কষ্টের পরেও সেই সময়টায় আনন্দ পায় বা প্রশান্তি পায়, ‘পথকলি’ আমার জন্যে এরকমই। প্রাইভেট ব্যাংকে কাজ করার কারণে সারা সপ্তাহের যে-স্ট্রেস আমার মধ্যে জমা হয়, বাচ্চাগুলোর কাছে আসলে সেগুলো দূর হয়ে যায়। তাদের সাথে সময় কাটাতে আমি প্রশান্তি অনুভব করি। আমি বরং আরো উৎসাহিত হই।
আচ্ছা, ভিন্ন একটা প্রসঙ্গে কথা বলি। সুবিধাবঞ্চিত বা পথশিশুদের সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসার দায়িত্বটা তো ছিলো রাষ্ট্রের। কিন্তু করতে হচ্ছে আপনাকে বা আপনার মতো অনেকেই করে। এই ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : এটা সম্পূর্ণ সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে করি আমি। আমার যতোটুকু ক্ষমতা আছে, সেটুকু দিয়েই আমি চেষ্টা করছি। আমি মনে করি যে, প্রত্যেকের দায়বদ্ধতা রয়েছে সমাজের প্রতি। আমাদের রাষ্ট্র আসলে সবদিকে নজর রাখতে পারছে না। এই কারণেই নাগরিকদের কিছু কাজ করতে হয়। আমাদের নারী ও শিশু মন্ত্রণালয় আছে, সমাজসেবা অধিদপ্তর আছে। তারা যদি এসব শিশুদের সঠিক পরিচর্যার ভেতর দিয়ে নিতে পারতো, তাহলে তাদের অবস্থা এমন থাকতো না। আমরা যদি নরসিংদীর ‘বাঁধনহারা’র দিকে তাকাই, তারা কতো চমৎকার সব কাজ করছে। ছোটো ছোটো বাচ্চারা ‘যশোর রোড’-এর মতো নাটক মঞ্চস্থ করে ফেলছে। তার মানে হলো, এই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের যদি সঠিক পরিচর্যা করা যায়, তাহলে দৃশ্যপট একদম পাল্টে যাবে। আমি দেখলাম, এই বাচ্চাগুলোই মানুষের হাতে-পায়ে ধরছে, টাকা চাচ্ছে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, মারামারি করছে, মানুষের ধমক খাচ্ছে। সেই জায়গা থেকেই আমার মনে হলো, তাদের মধ্যে বোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করি, তাদের আত্মনির্ভরশীল করার চেষ্টা করি। ভাবনা ছিলো, তারা যাতে ভিক্ষাবৃত্তির দিকে না যায়, মাদকের দিকে না যায়। তো আমি আমার মতো করে তাদের নিয়ে কাজ করতে চেষ্টা করছি।
নানা সময়ে আপনার কাছ থেকে জানতে পেরেছি, আপনি বাচ্চাদের জন্যে স্থায়ী একটা ব্যবস্থা করতে চান। এই ব্যাপারে বাস্তব কোনো পদক্ষেপ কি গ্রহণ করেছেন?
আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : হ্যাঁ, এটা করার জন্যে কিছু পদক্ষেপ আমি নিয়েছি। আমাদের সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক যিনি আছেন এখানে, উনার সাথে কথা বলেছি, আমার এখানে যারা আছে, তাদের একটা প্রাথমিক তালিকাও জমা দিয়েছি। তাছাড়া তাদের মাসিক সভা হয় জেলা প্রশাসকের সাথে। সেখানেও আমি বিষয়টা উপস্থাপন করেছি।
এক্ষেত্রে স্থানীয় কোনো শিল্পপতি বা প্রশাসনের কারো কাছ থেকে কোনো আশ্বাস বা প্রতিশ্রুতি কি পেয়েছেন?
আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : আমাদের সাবেক একজন জেলা প্রশাসক, সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন, একবার তার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে নরসিংদী সরকারি কলেজের মঠে তিনি বাচ্চাদের সাথে ঘাসের উপরে বসেছিলেন। তাদের সাথে কথা বলেছেন, আদর করেছেন। তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, তাদের জন্যে একটা স্থায়ী ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন।
তিনি চলে যাবার পর যারা দায়িত্বে এসেছেন, তাদের সাথে আপনি কোনো যোগাযোগ বা এই বিষয়ের অগ্রগতি নিয়ে কোনো আলোচনা করেছেন কি?
আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : পরবর্তীতে জেলা প্রশাসক বদিউল আলমও আমাদের এখানে এসেছেন, বাচ্চাদের সাথে সময় কাটিয়েছেন। উনিও বলেছিলেন, বাচ্চাদের একটা ব্যবস্থা করবেন। এ-ব্যাপারে জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তার সাথে কথাও বলেছিলেন। কিন্তু বিষয়টা আর সামনে আগায় নাই। এছাড়া বাংলাদেশ বিটিএম-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আমাদের বড়ো ভাই আব্দুল্লাহ আল মামুনও আমাকে আশ্বস্ত করেছেন যে, যখন আমরা এই কাজে হাত দেবো, উনি আমাদের পাশে থাকবেন।
আরেকটা বিষয়, আপনি ‘পথকলি’ নিয়ে পত্র-পত্রিকা থেকে শুরু করে টিভি মিডিয়ায় পর্যন্ত একটা প্রচারের আলোয় আছেন, নানা সময়ে আমরা এগুলো দেখেছি। এসবের ফলে নরসিংদীর বাইরে থেকে কোনো ধরনের সহায়তার জন্যে যোগাযোগ করে কি কেউ?
আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল : হ্যাঁ, মাছরাঙা টেলিভিশনের ‘রাঙা সকাল’ অনুষ্ঠানে যাওয়ার পর এক ভদ্রলোক আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন, অর্থ সহায়তা দিতে চেয়েছেন। কিন্তু আমি নিইনি। কারণ, এভাবে সাহায্য-সহযোগিতা নেয়ার ব্যাপারটা সুবিধাবঞ্চিত ও পথশিশুদের একটা ব্যবসায় পরিণত করে ফেলে। অনেকে কিছু টাকা ডোনেশন দিয়ে বিশাল কৃতিত্ব নিতে চায়। ফলে মানুষের মধ্যে একধরনের সন্দেহ তৈরি হয়। মনে করে, পথশিশুদের আড়ালে বুঝি এসবই চলে। তাই আমি এ-ধরনের আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করি না।