আমীরগঞ্জের ইতিহাস | পর্ব ৩

ফরাজে ও লাখেরাজ ভূমি ও পত্তনী মালিকানা ১৪৭ টাকা মূল্যে বিক্রয়ের সাফ কবলা হইয়াছে বির্দ্দরী মির্জা মোহাম্মদ, পিতা- মৃত মির্জা মোহাম্মদ কাজেম, সাকিন- চান্দখার পোল ও শ্রীমতি বনী বেগম, পতি- শ্রী মৌলভী মকরেম আলী, সাকিন- বড় কাটারা, থানা- সদর, জাতি- মোসলমান, পেশা- তালুকদারী, জেলা- ঢাকা স্থানে লিখিতং, শ্রী মীর গোলাম হোসেন, পিতা- মৃত ইয়াদ ওয়ারেছ আলী, জাতি- মোসলমান, পেশা- জমিদারী, সাকিন- গের্দ্দ হুসনি দালান, ঢাকা সদর, জেলা- ঢাকা কোট মৌজাস্থিত লাখেরাজ জমি ও পত্তনী ও মিরাশি জমি ও ওয়ার্কফ ইষ্টাটের মোল হেবা ও হাবেলী ঘর তৎতহতি জমিন ইসাদি বিক্রয় সাফ কবলা পত্র মিদং কার্যাঞ্চে আমি আমার কন্যা মৃত মরিয়ম নেছা বেগমের ওয়ারিশপ্রাপ্ত নিম্ন তফসিলের লিখিত চৌহদ্দি ভুক্ত ষোল আনি বিত্তের দুই আনা অংশ অন্যের নিরাপত্তে মালিক দখলকার আছি ঐ বিষাদির দুই আনা হিস্যা আমি আপন অধিকার মতে উচিত মূল্য মবলক ১৪৭ টাকাতে সাফ বিক্রয় করার উদ্যত হইলে, তোমরা উক্ত মৃত বেগমের পুত্র ও কন্যা ও আমার দৌহিত্র দৌহিত্রি বিধায় এবং মৃত বেগমের বক্রি দুই আনা অংশের মালিক তোমরা যথায় আমা হইতে ঐ দুই আনা অংশের খরিদ করার উদ্যত হওয়ায় আমি আমার প্রাপ্য দুই আনা অংশের মধ্যে এক আনা অংশ তুমি মির্জা মোহাম্মদ নিকট মং ৭৩ টাকা আট আনা মূল্যে ও এক আনা অংশ তুমি শ্রী মতি বনি বেগম নিকট মং ৭৩ টাকা আট আনা মূল্যে একুনে উভয়ের নিকট মং ১৪৭ একশত সাত চল্লিশ টাকা নগদ দস্ত বদস্ত বেবাক বুঝিয়া পাইয়া আপন ইচ্ছায় ও সৎজ্ঞানের রাজি রগবতে বহাল তবিয়তে সাফ বিক্রয় করিয়া লিখিয়া দিতেছি ও অঙ্গিকার করিতেছি যে, নিম্নের তপসিলের লিখিত বিষাদির আমার প্রাপ্ত দুই আনা অংশ কাত তোমরা উপরোক্ত অংশানুসারে আপন ২ পুত্র ওয়ারিশ ও স্থলবর্তি গণক্রমে অংশানুসারে সদর খাজনা ও মিউনিসিপালিটি টেকস মতে আদায় করিয়া আমার নাম খরিজে আপন ২ নাম অংশ মতে রেজিষ্ট্রারী করিয়া প্রজা উঠাইয়া কি বানাইয়া রাস্তা বাগান বানাইয়া হাবেলী ইসাদি ভাংগিয়া কি উক্ত নাল করিয়া প্রজাগণ হইতে কর কবুলিয়ত লইয়া দিঘি পুস্কনি খনন করিয়া দান বিক্রয় সর্ব প্রকার কন্যধিকারী হইয়া পরম সুখে ভোগ বিনিত্তগ দান বিক্রয় দখল তছরূপ করিতে রহেন। নিম্ন লিখিত বিষাদির আমার ওয়ারিশ প্রাপ্ত উক্ত দুই আনা অংশে আমি ও আমার পুত্র পৌত্রাদি ওয়ারিশ ও স্থবর্ত্তি গণ ও ভাবি উত্তরাধিকারীগণের সর্ব প্রকার দাবী দাওয়া সম্পূর্নরূপে রহিল না ও রহিলেক না, করিলে অগ্রাহ্য হইবেক। আর প্রকাশ থাকে যে, নিম্নের লিখিত ২/৩/৪/৫ নং সম্পত্তি ভিন্ন অন্য কোনো সম্পত্তি কেহর নিকট দায়বদ্ধ নাই। তপছিলের লিখিত ২/৩/৪/৫ নং সম্পত্তি দায়বদ্ধ থাকা ও বক্রি সম্পত্তি নির্দায় অবস্থায় থাকা এবং তপছিলের লিখিত সমস্ত সম্পত্তি কেহর নিকট কোন বয়, হেবা ও দান বিক্রয় মিরাশ পত্তনী কি দর পত্তনি কি কম জমায় ইজারা ইসাদি করি নাই ও দেই নাই তাহা তোমাদের নিকট প্রকাশ করায় তোমরা আমার আত্মীয় বিধায় আমার কথা বিশ্বাস করিয়া বিনা অনুসন্ধানে ও বিনা যাচাইতে খরিদ করিলা যদি খরিদের পর আমার উল্লেখিত কোন কার্য প্রকাশ পায় তাহাতে তোমাদের অনিষ্ট ঘটে তাহা হইলে আমি আইনানুসারে ফৌজদারিতে দণ্ডনিয় হইব, এতদ্বার্থে মূল্যের সমস্ত টাকা অংশানুসারে তোমাদের স্থানে নগদ দস্ত বদস্তে বুঝিয়া পাইয়া আপন ইচ্ছায় দলিলের সমস্ত মর্মর্থ ভাল মত পাঠ করিয়া ও বুঝিয়া শুনিয়া অত্র সাফ কবলা লিখিয়া দিলাম। ইতি সন ১৩০৮ সন ২১ শে অগ্রাহায়ন তপছিল সম্পত্তি ১/১২৬৯ সালের ১৪ ভাদ্রের লিখিত মৃতে ছৈয়দ আলী মেহেন্দী খা বাহাদুরের স্ত্রী মৃত মরিয়ম বেগম সাহেবার ওয়ার্কফ নামার লিখিত জেলা ঢাকার কালেক্টরীর তৌজি ভূক্ত ৯৯৬৫ নং জমিদারী তপে রন ভাওয়াল হিঃ। চার আনা ১৫ গন্ডা মরিয়ম বেগম ও আমিনদ্দিন হায়দর ও ৬৪৪৭ নং ডেয়ারা বন্দবস্ত ভূমি চরকান্দা ও পাবনীরা ও রায়পুরা পোলিশ স্টেশন ও সাব রেজিষ্টারের অধীন জোয়ার হাসনাবাদ তাহার চার আনা নয় গন্ডা ও ৯৯৫৪ নং তালুকের হিঃ চার আনা ১৫ গন্ডা অংশ স্থাবর তাহার মোতাউল্ল আমি গোলাম হোসেন ঐ মোতাউল্ল ইষ্টেটের হইতে মৃত মরিয়ম নেছা বেগম বার্ষিক ৬০ টাকা মালিকানা পাওয়ার অধিকারী ছিল। ঐ ৬০ টাকা মালিকানা ষোল আনা বয়সে মৃত মরিয়ম নেছা বেগমের ওয়ারিশ সূত্রে দুই আনা অংশ আমি অত্র সিকিউরিটি ঐ দুই আনা অংশের রাখা ৭ টাকা ৫ আনা বার্ষিক মালিকান বিক্রি করিলাম (১২৯৮ সালের ১৯ পৌষের লিখিত পত্তনী কবুলত পাট্টা আবু আহাম্মদ আবদুল বাছেদ লকনগ মোতউল্লির পক্ষে উনছ খান, পিতা মৃত মৌলভী আলীমুদ্দিন আহম্মদ নিকট প্রাপ্ত ৯৯৬৫ নং জমিদারী তপে রনভাওয়াল হিঃ চার আনা ১৫ গন্ডা জমিদারী বনামে আমিরদ্দিন হায়দর ও মরিয়ম বেগম সদর জমা ১৭১৯ টাকা ছয় আনা ৮ পাই জেলা ঢাকার রায়পুরার পুলিশ ষ্টেশন ও সাব রেজিষ্টারের অধিন পোক্তার চর মধুয়া মধ্যে মৌজা বিরগাও ও আলিয়াবাদ ও লক্ষীপুরা ও মরিয়ম নগর ও গাজীপুরা গং পোক্তার হাসনাবাদ মধ্যে মৌজা ফতেপুর, দরি হাইর খারা ও বির হাইর খারা ও জেলা ত্রিপুরার অধিন দাউদকান্দি থানা ও সাব রেজিষ্টারের অধীন পোক্তার মৃজার চর ও মৌজা আমিরাবাদ ও ভিটিগাও বাঘাকান্দি ও গোদাকান্দি মৌজা রায়পুর ও সিন্দি ও মুরাদনগর পোলিশ ষ্টেশন ও সাব রেজিষ্টারের অধীন মৌজে খোয়ার চর ও জেলা ফরিদপুরের অধিন পালঙ্গের থানা সাব রেজিষ্টারের অধীন মৌজে পাইকতলি ও শখিপুরা ৯৯৫৪ নং তালুক খলিলের রহমান সদর পক্ষে ২১০ টাকা ৭ আনা ২ পাই যে নিযুক্ত আছে উক্ত তালুকের ভুমি জেলা ঢাকার রায়পুরার পোলিশ ষ্টেশন ও সাব রেজিষ্টারের অধিন পোক্তার হাসনাবাদ মধ্যে মৌজে নলবাটা ও আমির গঞ্জ ও করিম গঞ্জ ও আগানগর ও হাসনাবাদ মৌজে পূর্ব পারা ও পশ্চিম পারা ও বিঃ পূর্ব পারা ও মির কান্দি ও নেবুর কান্দি ও আট কান্দি ও হাট হাসনাবাদ উক্ত জমিদারী (৯৯৬৫ নং তালুক) ও তালুকের (৯৯৫৪ খারেজী তালুক খলিলুর রহমান) সোলা আনার সে হিঃ ৭ আনা ৮ গন্ডা মৃত মরিয়ম নেছা বেগমের মৃত মাতা খায়রুন নেছা ওরফে নতে বেগমের ওয়ারিশি মতে ও মৃত মরিয়ম নেছা বেগমের পিতা মির গোলাম হোসেনের হেবা সূত্রে ২ আনা ৮ গন্ডা একুনে ১০ আনা অংশ জাহা উক্ত সন তারিখের পত্তনী কবুলত পাট্টা অনুসারে সদর খাজনা ও পথবর পাবলিক ওয়ার্ক ছেদ ও ডাক টেকস ইসাদি বাদে জমিদারীর বার্ষিক পত্তনী খাজনা ১০০ টাকা তালুকের বার্ষিক পত্তনী খাজনা ৪৪ টাকা একজাই মং ১৪৪ টাকা মালিকানা খাজনা উক্ত আবু আহাম্মদ আবদুল বাছেদ নিকট পাত্তা ন্যায় উক্ত মালিকানা খাজনার টাকার মধ্যে ষোল আনা রকমের ২ আনা অংশে বার্ষিক মং ১৮ টাকা পাত্তা জায় তাহা…

এমতাবস্থায় ৯,৯৬৫ নং জমিদারি ঢাকা কালেক্টরিতে প্রায় ১৪ বছর অংশীদারদের যথাযথ স্বত্ব বণ্টনাধীনে থাকে তদোপলক্ষে মীর গোলাম হোসেন সাহেব এর কতোক অংশ (সম্ভবত শুধু খলিলুর রহমানের তালুক থেকে সৃষ্ট ১৩,১৭৩ নং মহালটি) বাংলা ১৩১২ সনের ২৯ শ্রাবণ তারিখে ওয়াকফনামাভুক্ত সম্পত্তি দাউদকান্দি থানার কাশীপুর গ্রাম নিবাসী পোকন চন্দ্র কর্মকারের পুত্র রাজচন্দ্র কর্মকারের নামে পত্তনী বিলি করেন, যা আইনত বে-আইনি ও অগ্রহণযোগ্য। কারণ, গোলাম হোসেন মরিয়ম বেগমের ওয়াকফ সম্পত্তির তার প্রাপ্য সমুদয় স্বত্ব ইতোপূর্বে বাংলা ১৩০৮ সনের ২১ অগ্রহায়ণ তারিখে বিক্রি করে দিয়েছেন। তদানুসারে রাজচন্দ্র কর্মকার ও তাহার ভ্রাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্র ঐ-সকল সম্পত্তি দখল করতে থাকে। প্রায় চার বছর পর রাজচন্দ্র কর্মকার উক্ত পত্তনপ্রাপ্ত ১৩,১৭৩ নং মহালের তালুকদারির স্বত্বের আট আনা অংশ ঢাকার ১৩ নং বেচারাম দেউরী নিবাসী মৌলভী আলীমুদ্দিনের নিকট বাংলা ১৩১৬ সনের ২২ মাঘ তারিখে বিক্রি করে দেন। উল্লেখ্য যে, এই মৌলভী আলীমুদ্দিনের জন্মস্থান হাসনাবাদ গ্রামে, তার পিতার নাম মৌলভী জমির উদ্দিন। তিনি ঢাকার নবাব বাড়িতে মুন্সির চাকরি করতেন এবং বগুড়ার নবাব বাড়ির নবাব কন্যাকে ছলচাতুরির মাধ্যমে বিবাহ করেন। তিনি আটকান্দির কুঠিবাড়ি মসজিদ নির্মাণ করেন। উল্লেখ্য যে, আমার গ্রাম আমীরগঞ্জ ও করিমগঞ্জের ১৩,১৭৩ নং তৌজি বা মহালের সেটেলমেন্ট জরিপের সিএস পর্চায় পত্তনী তালুকদারের নাম রাজচন্দ্র কর্মকার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। রাজচন্দ্র কর্মকারের ৪৬৮ নং তালুকের অংশ আট আনা এবং মৌলভী আলীমুদ্দিনের ৪৬৯ নং তালুকের অংশ আট আনা ও রাজচন্দ্র কর্মকার আবার তার তালুক নং ৪৬৮-র আট আনার খাজনা আদায় করে দেয়ার শর্তে অর্ধেক অর্থাৎ চার আনা আমীরগঞ্জ নিবাসী সদর উদ্দিন বেপারী গংদের নিকট দরপত্তন দেন। অর্থাৎ সদর উদ্দিন গং রাজচন্দ্রের অবশিষ্ট পত্তনী তালুকের খাজনা আদায় বাবদ ৪৬৮-ক নামীয় তালুকের একটি মধ্যস্বত্ব লাভ করেন।

এদিকে মির্জা মোহাম্মদ, মরিয়ম বেগমের মৃত্যুর প্রায় ৩৩ বছর পর মরিয়ম বেগম পাবলিক ওয়াকফ এস্টেটের মালিকানা ও দখল পুনরুদ্ধার নেয়ার নিমিত্তে অপেক্ষমান থাকেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা কালেক্টরিতে ওয়াকফ এস্টেটের বেনিফিশিয়ারি ও মোতয়াল্লী হিসেবে নিজের আইনগত ভিত্তি ও মালিকানার অধিকার অর্জনের অপেক্ষমান থাকাবস্থায় বৃটিশ সরকার কর্তৃক ১৯১৩ সালে ভারতীয় মুসলমান ওয়াকফ ভেনিডেটিং আইন গঠিত হয় এবং ১৯৩৪ সালের বঙ্গীয় ওয়াকফ আইন জারি হয়। কিন্তু ইতোমধ্যে কোনো-এক সময়ে মির্জা মোহাম্মদের মৃত্যু হয়। মির্জা মোহাম্মদের মৃত্যুর পর তার পুত্র মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ ঢাকা কালেক্টরির তৌজিভুক্ত ৯,৯৫৪ নং মহালের ষোলো আনা (চার আনা ১০ গণ্ডা) ও ৯,৯৬৫ নং মহালের (তিন আনা ১০ গণ্ডা)-সহ অন্যান্য মহালকে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করার জন্যে ১৪ঃয ঈডঘ কলিকাতা হাইকোর্টে এক আর্জি দায়ের করেন। ফলে কলকাতা হাইকোর্ট ‘মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেট’কে পাবলিক ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে বৈধ প্রমাণ করেন। তারপর তিনি কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিংয়ে অবস্থিত বঙ্গীয় ওয়াকফ প্রশাসকের কার্যালয়ে ১৯৩৪ সালের বঙ্গীয় ওয়াকফ আইনের ৪৪ ধারা মোতাবেক মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেটকে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার লক্ষ্যে বঙ্গীয় ওয়াকফ কমিশনার সাহেব বাহাদুর বরাবর প্রয়োজনীয় দালিলিক প্রমাণাদিসহ দরখাস্ত দাখিল করেন। ফলে মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেটকে বঙ্গদেশীয় মহামান্য ওয়াকফ বোর্ড ও কমিশনার কর্তৃক উক্ত এস্টেট ওয়াকফ আইনের ৪৬ (ক) ধারার বিধান মোতাবেক ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে মীমাংসিত হইয়া ওয়াকফ বোর্ডে রক্ষিত রেজিস্ট্রারিতে ৪,৭২১ নং ওয়াকফ এস্টেট হিসেবে ইনরোলড হয়। পরবর্তীতে মির্জা মোহাম¥দ আশরাফ ২২ নভেম্বর ১৯৩৭ তারিখে সেন্ট্রাল কোর্ট, ২ চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ে অবস্থিত ওয়াকফ বোর্ডের কমিশনার বরাবর কমিশনার কর্তৃক পূর্বে প্রেরিত পত্র, যার স্মারক নং সি/৮২৫১, তারিখ ১০ নভেম্বর ১৯৩৭-এর জবাবে মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেটের তার মালিকানার স্বপক্ষে ঢাকা কালেক্টরির ৯,৯৫৪ ও ৯,৯৬৫ নং তৌজিভুক্ত তালুকদার ও কবুলিয়ত প্রজাদের দুটি পৃথক তালিকাসহ দালিলিক প্রমাণাদি দাখিল করে তাকে উক্ত ওয়াকফ স্টেটের দখলদারের ক্ষমতা প্রদান ও মোতওয়াল্লী হিসেবে গ্রহণ করার জন্যে আবেদন করেন। আবেদনে তিনি ৯,৯৫৪ নং মহালের চার আনা ১০ গণ্ডা (ষোলো আনা) ও ৯,৯৬৫ নং মহালের তিন আনা ১০ গণ্ডা (ষোলো আনা) শেয়ার দাবি করে নির্দিষ্ট প্রজাদের নিকট থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে তার নামে দুটি মহালের নাম জারি করতে এবং ঢাকা কালেক্টরির ‘ডি’ রেজিস্ট্রার সংশোধন করতে ঢাকা কালেক্টরকে আদেশ প্রদান করার জন্যে অনুরোধ করেন। মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে মরিয়ম বেগমের ওয়াকফ সম্পত্তির মূল্য উল্লেখ করেছেন তৎকালীন সময়ের ২,০৫,০০০ টাকা। উপর্যুক্ত বিষয়ের প্রামাণিক দলিলাদির ছায়ালিপি এই নিবন্ধের লেখকের নিকট রক্ষিত আছে।

অবশেষে মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ তার আবেদনের প্রেক্ষিতে মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেটের ৯,৯৫৪ ও ৯,৯৬৫ নং তৌজিভুক্ত তালুকের মোট দশ আনার স্বত্ববান ও মোতয়াল্লী হিসেবে ওয়াকফ আইনের ৪০ ধারার বিধান মোতাবেক বেঙ্গল ওয়াকফ বোর্ডের কমিশনার কর্তৃক গণ্য হন।

অতঃপর মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ সম্পূর্ণ ওয়াকফ এস্টেটের মোতয়াল্লীভাবে দখল করে ঢাকা দ্বিতীয় সাব-জজ আদালতের ১৯৪০ সালের ২১ নং দেওয়ানী মোকদ্দমা স্থাপনে ডিক্রি লাভ করেন এবং ঢাকা কালেক্টরিতে ওয়াকফকৃত উপর্যুক্ত মহাল (৯,৯৫৪ এর ১৩,১৭৩, ১৫,৭৮৩ ও ১৫,৭৮৪ এবং ৯,৯৬৫ নং মহাল) ও অন্যান্য মহালসমূহের নামজারিক্রমে মোতওয়াল্লীভাবে মালিক ও দখলকার হিসেবে ঢাকা কালেক্টরিতে রক্ষিত ‘ডি’ রেজিস্ট্রার সংশোধন হয়ে মির্জা মোহাম্মদ আশরাফের নাম লিপিবদ্ধ হয়। উক্ত দ্বিতীয় সাব-জজ আদালতের উক্ত মামলার রায় ও ডিক্রি দ্বারা মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেটের ওয়াকফ প্রভৃতির বিরুদ্ধে যেসব হস্তান্তর বা অষরবহধঃরড়হ হয়েছে, উক্ত সমুদয় হস্তান্তরই আইনত পণ্ড, ভুয়া, তঞ্চকী ও যোগসাজসী বলে সাব্যস্ত হয়েছে এবং উক্ত ডিক্রিবলে উপর্যুক্ত ওয়াকফ মহালান্তর্গত যে সমুদয় পত্তনী, সিকিমী পত্তনী, দত্ত পত্তনী বা অন্য প্রকার স্থায়ী মধ্যস্বত্বের লিপি সেটেলমেন্ট জরিপী (সিএস) রেকর্ডে প্রকাশ পায়, তা সমুদয়ই পণ্ড, ভুয়া, বে-আইনি, তঞ্চকী ও যোগসাজসী। অতঃপর তিনি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ঢাকার কোর্ট বরাবর বিবাদী রাজচন্দ্র কর্মকারের বিরুদ্ধে একটি মিস কেইস (নং ৬৪) দাখিল করেন, পূর্বের বে-আইনিভাবে নামজারি বাতিল ও মরিয়ম বেগমের ওয়াকফ এস্টেটের মোতওয়াল্লী হিসেবে তার ব্যক্তিগত বার্ষিক আর্থিক ভিত্তি নির্ধারণের জন্যে। বার্ষিক আর্থিক ভিত্তি নির্ধারণের পর মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ রাজচন্দ্র কর্মকার, আলীমুদ্দিন মৌলভী ও অন্যান্য ভূমধ্যধিকারীর নিকট অদ্যাবধি ১ নং তফসিলের তার আইনত প্রাপ্ত জোতের ষোলো আনার অর্থ এবং ২ নং তফসিলের সমুদয় পথকরসহ বকেয়া কর পরিশোধের জন্যে তাগাদাপত্র প্রেরণ করেন। কিন্তু বিবাদীগণ উক্ত টাকা পরিশোধ করেন নাই। ফলত পরবর্তীতে মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ উপর্যুক্ত বে-আইনি হস্তান্তরের জন্যে দাতা মীর গোলাম হোসেন ও হস্তান্তর গ্রহীতা পত্তনী তালুকদার রাজচন্দ্র কর্মকার, ভূমধ্যধিকারীর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চাহিয়া ঢাকা মুন্সেফ আদালতে এক নালিশী মামলা দায়ের করেন। এদিকে আমীরগঞ্জ, করিমগঞ্জ ও নলবাটায় রাজচন্দ্র কর্মকার থেকে চার আনা দরপত্তনধারী সদর উদ্দিন বেপারীগণ খাজনা আদায়ের চেষ্টা করলে আমীরগঞ্জ নিবাসী আফসার উদ্দিন মৌলভী, ছৈযুদ্দিন মৌলভী, সুরুজ খা এবং করিমগঞ্জের কাবিল মৃধা, পিতা : আলাবক্স মৃধা, ওয়াকফ সম্পত্তিতে বে-আইনিভাবে পত্তন পাওয়া জমিতে খাজনাদি পরিশোধে অস্বীকার করেন এবং সদর উদ্দিন বেপারী গংদের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ মুন্সেফ আদালতে নালিশী মামলা দায়ের করেন, যা এই প্রতিবেদক খাঁ বাড়ির রুকুন উদ্দিন খাঁ’র মুখে ও অন্যান্য বয়স্কদের মুখে শুনেছেন।

প্রাপ্ত উপর্যুক্ত কার্যাদি সমাধান্তে পূর্ব বাংলায় কৃষক প্রজা পার্টি আনিত জমিদারি উচ্ছেদ তথা রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এসে যাওয়ায় মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ জমিদার সাহেব মরিয়ম বেগমের জমিদারি ও খলিলুর রহমানের খারেজী তালুকের নিজ স্বত্ব ও মোতয়াল্লী হিসেবে বেশি সুবিধা করতে পারেননি। খাজনা আদায়ের রশিদ প্রমাণে দেখা যায়, এ-জনপদে মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ ২৪ আষাঢ় ১৩৬৫ বঙ্গাব্দ তারিখ পর্যন্ত কর্মচারীসহ নিজে খাজনাদি আদায় করতে পেরেছিলেন। অবশেষে মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ ১৯৮১ সনের ১৭ জুলাই ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন (মৃত্যুসনদ মোতাবেক)। মৃত্যুকালে তিনি পাঁচ ছেলে ও দুই কন্যা রেখে যান। প্রথম পুত্রের  নাম মির্জা খোরজো আয়ায, দ্বিতীয় পুত্রের নাম মির্জা খুসরু, তৃতীয় পুত্রের নাম মির্জা খোরুম, চতুর্থ পুত্রের নাম মির্জা দিলশাদ ও পঞ্চম পুত্রের নাম মির্জা নেহাল। কন্যাগণ হলেন নাজমা ও নিজাকাত। পুত্রদের মধ্যে দুজন জীবিত আছেন। একজন ইরানে বসবাস করেন এবং বাংলাদেশে মির্জা নেহাল সাহেব সপরিবারে বসবাস করছেন। জাতীয় পরিচয়পত্রে মির্জা নেহাল সাহেবের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে ১ নং ইটাওয়ালা ঘাট, ইসলামবাগ পশ্চিম, লালবাগ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা। এনআইডি নং ২৩৫৯১৪০০২৩। বর্তমানে তিনিই বাপ-দাদাদের হারানো জমিদারির প্রামাণি, দলিল-দস্তাবেদ সংরক্ষণ করছেন, যদি কখনো হারানো জমিদারি পুনরুদ্ধার বা ক্ষতিপূরণ আদায়ে প্রামাণ্য দলিল-দস্তাবেজের প্রয়োজন হয়।

উপর্যুক্ত আলোচনা, বিভিন্ন প্রামাণিক দলিল-দস্তাবেজ, তৎকালীন ভূমি বন্দোবস্ত, একসালা, দশসালা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন ও ওয়াকফ আল আওলাদ আইন পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, আমার আমীরগঞ্জ গ্রাম বা এ-জনপদে স্থানীয় কোনো ভূস্বামী জমিদার বা তালুকদার শ্রেণির কেউ ছিলো না। দাউদকান্দির রাজচন্দ্র কর্মকার এই জনপদের খলিলুর রহমান নামীয় খারেজী তালুকের কিয়দাংশ (যা মরিয়ম বেগমের জমিদারি ও পরে মরিয়ম বেগম ওয়াকফ এস্টেট হিসেবে গণ্য ছিলো) অবৈধভাবে মীর গোলাম হোসেন থেকে পত্তন নিয়েছেলেন। তবে একসময়ের হাসনাবাদ নিবাসী আটকান্দি মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মৌলভী আলীমুদ্দিন এবং তার সুযোগ্য পুত্র মৌলভী আবু আহম্মদ বাছেতের মির্জানগর, আটকান্দি, বীরকান্দি, আব্দুল্লাপুরসহ ঢাকার কেরানীগঞ্জের মতো দূর জনপদে কয়েকটি বৈধ তালুক ছিলো, যা তিনি ইংরেজ নীলকর ও মুঘল ঘরানার জমিদার থেকে পত্তন নিয়েছিলেন। আলীমুদ্দিন মৌলভী তার পত্নী (বগুড়ার নবাবের মেয়ে) বিয়োগের পর আমীরগঞ্জ ও করিমগঞ্জের ১৩,১৭৩ নং মহালের তার আট আনার অংশ ওয়াকফ করে দেওয়ায় উক্ত গ্রামদ্বয়ের রায়তদের কোনো খাজনা পরিশোধ করতে হয় নাই। অনেকেই আমীরগঞ্জের সদু বেপারী গংদের দৃষ্টিনন্দন দ্বিতল কোঠাবাড়ি ও একতলা বৈঠকখানা দর্শন করে সদু বেপারী গংদের জমিদার মনে করে বিভ্রান্ত হন। মূলত তারা ছিলেন হলুদ, গুড়, পাটের বেপারী ও রেলওয়ে জমির ইজারাদার এবং  অবৈধ ও বে-আইনিভাবে প্রাপ্ত পত্তনী তালুকদার রাজচন্দ্র কর্মকারের অবশিষ্ট আট আনা পত্তনী তালুকের চার আনার মধ্যস্বত্বাধিকারী, যা তারা রাজচন্দ্র কর্মকারের পক্ষে খাজনা আদায় করার শর্তে প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তবে মির্জা মোহাম্মদ আশরাফ মরিয়ম বেগমের জমিদারির আইনগত মোতওয়াল্লী হলে এবং আমীরগঞ্জ ও করিমগঞ্জের রায়তগণ সদু বেপারী গংদের খাজনা দিতে আপত্তি জানালে সদু বেপারী গং এই মধ্যস্বত্বের কোনো ফায়দা নিতে পারেন নাই। রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ পাশ হয়ে গেলে ১৯৫৭ সাল থেকে ভূমির মালিকানা হয়ে যায় রাষ্ট্রের। তখন থেকে বঙ্গীয় কৃষক ও রায়তগণ জমিদার ও তালুকদারদের পরিবর্তে রাষ্ট্রকে খাজনা দিতে শুরু করেন। (সমাপ্ত)


আমির হোসেন
গবেষক, আয়কর পরিদর্শক

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ