বাংলার তাঁতবস্ত্রশিল্পের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র শেখেরচর-বাবুরহাটের গোড়াপত্তন ঘটে বাংলা ১৩৪৩ সনের ৮ জ্যৈষ্ঠ (১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ)। সারা বাংলাদেশ, এমনকি বাংলাদেশের বাইরে থেকেও কাপড় ব্যবসায়ীগণ এই বাবুরহাটে বস্ত্র বেচা-কেনার জন্যে আসতেন। হাটটি ‘প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার’ বলে খ্যাত ছিলো একসময়।
বর্তমান শেখেরচর থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে মাধবদী গ্রাম। মূলত মাধবদীই ছিলো তাঁতবস্ত্র বেচা-কেনার প্রথম হাট। এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মাধবদীর তৎকালীন জমিদার গোপাল গুপ্ত, বিষাদ গুপ্ত, শৈলেন্দ্র গুপ্ত রায়। পাঁচ-ছয় পুরুষ ধরে তাদের জমিদারি। তিরিশের দশকের কাছাকাছি সময়ে এই মাধবদীর সুতা-কাপড়ের হাট প্রতিষ্ঠিত হয়। নরসিংদীর জমিদার ললিতমোহন রায়ের সাথে খাজনা সংক্রান্ত বিরোধ তৈরি হলে পাইকারগণ মাধবদীর জমিদারের শরণাপন্ন হন এখানে হাট বসানোর জন্যে। এ-সুযোগ মাধবদীর জমিদারগণ লুফে নেন। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে তাদের বিশাল জমি খালি পড়েছিলো। সেখানেই বসানো হলো হাট। এই হাটকে কেন্দ্র করে জমিদারদের শনৈ শনৈ উন্নতি হতে লাগলো। মাধবদীর বাবুদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বলে এই হাটের নামকরণ হয়ে যায় ‘বাবুরহাট’।
কয়েক বছর যেতেই একই বিপত্তি। জমিদারদের নায়েবরা গাইট প্রতি খাজনা (তোহা) দুই পয়সা করে বেশি আদায় করা শুরু করে। এটা মেনে নেয়া কষ্টকর ছিলো পাইকারদের কাছে। তারা বারবার জমিদারের নায়েবের কাছে আবেদন করতে লাগলো তোহা বৃদ্ধি না করতে। কিন্তু জমিদারের নায়েব তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করতেন না। বরং দুর্ব্যবহার করতেন এবং আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা করছিলেন। এমতাবস্থায় কাপড়ের পাইকাররা একজোট হয়ে তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে লাগলেন। একসময় এই অসন্তোষ বিস্ফোরিত হতে হতে তাদের নিয়ে গেলো মাধবদী থেকে দুই কিলোমিটার উত্তরে শেখেরচরের তালুকদার হলধর সাহার কাছে। তারা হলধর বাবু ওরফে কালু বাবুকে বুঝালো শেখেরচরে হাট প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব। হলধর বাবুও এই মহা সুযোগ হাতছাড়া করেননি। শেখেরচরের উত্তরে বাঁকমোড়া (বর্তমান মূল বাসস্ট্যান্ড) নামক স্থানে খোলা আকাশের নিচে কৃষিজমির উপর আরম্ভ হলো শেখেরচর-বাবুরহাট। তখন বাংলা ১৩৪৩ সন।
হলধর সাহা (কালু বাবু) এতো বড়ো হাট প্রতিষ্ঠার জন্যে পর্যাপ্ত পয়সা-কড়ির মালিক ছিলেন না। এজন্যে তিনি সাহায্য নেন বালাপুরের জমিদার কালীমোহন সাহার। হলধর সাহা ও কালীমোহন সাহা বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয় ছিলেন। শেখেরচর (ইমামগঞ্জ) হাটের ১৬ আনা মালিকানার মধ্যে ৪ আনার মালিক ছিলেন বাবু হলধর সাহা (কালু বাবু) এবং ১২ আনার মালিক ছিলেন বালাপুরের কালীমোহন সাহা। পরবর্তীতে তার দুই ছেলে বাবু আশুতোষ সাহা ও বাবু মনোরঞ্জন সাহা মালিকানাপ্রাপ্ত হন।
এই হাটটিও বাবুদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিধায় এটাও পরবর্তীতে বাবুরহাট নামে পরিচিতি পায়। অবশ্য শেখেরচর হাটের প্রথমে নাম ছিলো ‘ইমামগঞ্জের হাট’। এই নামকরণের পেছনে ছিলেন তখনকার নরসিংদীর সিংহপুরুষ গান্ধীবাদী স্বদেশি রাজনীতিবিদ সুন্দর আলী গান্ধী। তিনিও এই হাট প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সুন্দর আলী গান্ধীর পীরের নাম ছিলো ইমাম উদ্দিন। হলধর বাবুরা সুন্দর আলীর পরামর্শ চাইলে তিনি এই হাটের নাম তাঁর পীরের নামে ‘ইমামগঞ্জের হাট’ নামকরণ করেন। প্রথমদিকে জনসাধারণের মুখে মুখে ইমামগঞ্জের হাট, পাবলিকের বাজার, নয়াবাজার ইত্যাদি নামেও পরিচিত ছিলো।
শেখেরচর-ইমামগঞ্জের বাজার প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর থেকে মাধবদীতে বাবুদের হাট স্তিমিত হয়ে যেতে শুরু করে। পাইকাররা মাধবদী হাটে তাদের পসরা সাজায় না। দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই শেখেরচরে আসতে থাকে। আর এই মলিন ক্রেতাশূন্য হাট মাধবদীর বাবুরা মেনে নিতে পারেন না। তারা শেখেরচরের বিরুদ্ধে নানা অপতৎপরতা চালাতে থাকে। স্পষ্টত আশেপাশের আরো অনেক এলাকা দুই ভাগ হয়ে যায়। কেউ কেউ মাধবদীর জমিদারদের পক্ষে; আবার কেউ হলধর বাবুদের পক্ষে। ব্রহ্মপুত্রের উপর স্থাপিত বাঁশের সাঁকো দিয়ে শেখেরচর হাটের মানুষজন হাটে যাওয়া-আসা করতো। মাধবদীর জমিদার গোপালবাবুর লোকেরা বারবার সেই বাঁশের সাঁকো ভেঙে দিতে থাকে। লাঠিয়াল বাহিনি দিয়ে হাটুরেদের হাটে প্রবেশে বাধা দিতে থাকে। মাধবদীর জমিদারেরা সুন্দর আলী গান্ধীর কাছেও যায় অর্থের প্রলোভন দেখাতে, যাতে তিনি এই হাট ভেঙে দেন। কিন্তু কোনো কাজই হয়নি। দাঙ্গা-হাঙ্গামা-সংঘর্ষ ইত্যাদি চলতে চলতে একসময় কলিকাতা হাইকোর্টে মামলা পর্যন্ত গড়ায়। মামলায় শেষ পর্যন্ত মাধবদীর জমিদারেরা হেরে যান।
শেখেরচর হাটের প্রতিষ্ঠাতা হলধর সাহা দূর-দূরান্ত থেকে আসা হাটুরেদের জন্যে নানা জায়গায় টিউবওয়েলের ব্যবস্থা করেন, এমনকি স্থানে স্থানে নিরাপত্তার জন্যে লাঠিয়াল বাহিনিও নিয়োগ করেন।
এই হাট প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নিয়ে ডা. আ. গনি পদ্য রচনা করেন। এই পদ্য স্থানীয় কবিয়ালরা গ্রামে গ্রামে পাঠ করতেন। তেমনি একটি পদ্য পাঠকেরা পড়ে নিতে পারেন। পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতে পারেন ঐতিহ্যবাহী শেখেরচর-বাবুরহাটের গোড়াপত্তনের ইতিহাস এবং তৎসময়ে ঘটে যাওয়া বিচিত্র ঘটনার ভেতর।
মাধবদী হাট ভাঙ্গিয়া শেখেরচরে হাট বসায়
গোপাল বাবু দেখে নিরুপায়।
গোপালেরা তিন ভাই থাকত কলকাতায়
দেশ বিদেশে জমিদারী, মাধবদীতে জন্মবাড়ি
বাড়িতে রাখছে ম্যানেজার, সে করতো না সুবিচার
যত আছে আমলা ফইড়া, হাটটার খায় লুইটা পুইড়া
এইরূপ অত্যাচারে ফকিরের জমা ধরে।
বাবুর মা নিষেধ করে এই জমাটা ছাইড়া দিয়া
অন্য জমা লও বাড়াইয়া
ছয় পয়সা ছিল গাইটের জমা, করে নিল বার আনা
জমা যখন বাড়াইল, পাইকারগণে শুনতে পাইল
জগন্নাথ মাড়োয়ারী, সে তো গেল বাবুর বাড়ি
যাইয়া বলে ম্যানেজারে, জমা ধরেন কম করে,
অনেক অনুরোধ করে, কমাইতে নাহি পারে
কমাইতে চাইলে পরে, জমা চায় ৫ টাকা করে।
ইহা শুনে মাউরার ছাও, কারো সনে করে না রাও
সঙ্গে যত পাইকার ছিল, সবারে ডাকিয়া লইল
আসল তারা ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব পাড়ে
শেখেরচরের কালু বাবু
এইবার তো কইরাছে কাবু
৫ কানি ক্ষেত ধান ভাঙ্গিয়া হাটের জায়গা করে দিলরে
১৩৪৩ সনে জ্যৈষ্ঠ মাসের আষ্ট দিনে
ইমামগঞ্জের হাট আরম্ভ হইলরে…
কালু সায় কয় কৃষ্ণ সাহারে ডাইকা
পুলের জোগাড় কর তাড়াতাড়ি
গোপাল বাবু শুনতে পায়, জায়গা দিছে কালু সায়
হাট বসাইল কালী সায়।
থাকতেন তিনি ঢাকার বাড়ি, চইড়া আইল মটর গাড়ি
নামলেন গিয়া ভিতর বাড়ি
যাইয়া বলে মায়ের কাছে, মোদের হাট কেন ভাইঙ্গা গেছে
মায় ছেলেরে কয় তখন, শোন বাবা রাজনন্দন
বাড়িতে রাখছ ম্যানেজার, সে করে না সুবিচার
তার কারণে হাট গিয়াছে বললাম বাবা তোমার কাছে।
ডাইকা বলে ম্যানেজারেরে, হাট ভাঙ্গছে কী কারণে
ম্যানেজার কয় তখন, হাট ভাইঙ্গা দিছে পাইকারগণ
তখন বাবু চিন্তা করে।
অনেক চিন্তা কইরা সার
ডাকাইল পাইকার
পাইকারেরা চইলা আইল
তানগো কাছে জিজ্ঞাসিল
পাইকারগণ কয় তখন
শোনেন বাবু রাজনন্দন
৬ পয়সা ছিল গাইটের জমা
কইরা নিল বার আনা।
অনেক অনুরোধ করি
কমাইতে নাহি পারি
কমাইতে কইলে পরে
জমা চায় ৫ টাকা করে।
ইহা শুনে বাঘের ছাও
কারো সনে করে না রাও
বন্দুক ছিল ভিতর বাড়ি
আনে বন্দুক হাতে করে
ধরে বন্দুক ম্যানেজার মারিতেরে…
পাইকারগণে বলে তারে
মাইরেন না বাবু ম্যানেজারে।
পাইকারেরা প্রণাম দিয়া
যার যার দেশে যায় চলিয়া
গোপাল বাবু গর্জে ওঠে
মামলা করল হাইকোর্টেতে
লাগিলরে মামলার ঠাঁট
বিচার করে বড়লাট
হাটের কথা খ্যান্ত পাই
হাট তো রইল মামলায়
মাধবদী হাট ভাঙ্গিয়া শেখেরচরে হাট বসায়
গোপাল বাবু দেখে নিরুপায়।
যাই হোক, মামলা-মোকদ্দমা-শত্রুতা-সংঘাত পেরিয়ে শেখেরচর কাপড়ের হাট স্থিতাবস্থায় উপনীত হয় এবং সারাদেশে ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ এক বাণিজ্যকেন্দ্রে রূপ লাভ করে। নানা চড়াই-উৎড়াই আর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এটি বর্তমান অবস্থায় এসেছে। এই হাটের বিস্তৃতির পেছনে যাঁরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে রইলো অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্র
১. ডা. আ. গনি (প্রয়াত);
২. ক্বারী আ. হাই (প্রয়াত) ও
৩. অলি বক্স মুন্সি (প্রয়াত)।
এ কে ফজলুল হক
প্রবীণ সাংবাদিক। সম্পাদক, সাপ্তাহিক নরসিংদীর সমাচার।