শিবপুরের বিভিন্ন স্থান-নামের উৎস সন্ধান | পর্ব ২

পুটিয়া
শিবপুরের গ্রাম ও গ্রামীণ সভ্যতার আলোচনায় এবার চলে এসেছি পুটিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ও ইতিহাস-ঐতিহ্য বিষয়ে। এ-ইউনিয়নে বহু গ্রাম রয়েছে এবং পুটিয়া গ্রামের নামেই পুটিয়া ইউনিয়ন হয়েছে। পুটিয়া নামটি কোথা থেকে বা কীভাবে এলো জানতে ইউনিয়নের প্রাক্তন একজন চেয়ারম্যানের সাথে আলোচনা হয়। শ্রদ্ধেয় চেয়ারম্যান এবং এলাকার অন্যান্যদের থেকে জানা যায়, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ব্রিটিশ শাসনামল ছিলো তখন। বেনিয়া ব্রিটিশদের নানাবিধ অত্যাচার-নির্যাতনে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেছিলো। এলাকায় যারা ইংরেজদের প্রতিনিধিত্ব করতো, তারা মানুষকে মানুষই মনে করতো না। অসহনীয় নির্যাতনের মধ্যে থেকে ইংরেজদের কথামতো চলতে হতো। তাদের বাধ্যগত না থাকলে সাধারণ মানুষের উপর স্টিম রোলার চলতো প্রতিনিয়ত। এমনিভাবে অত্যাচারিত হতে হতে আর মার খেতে খেতে এলাকার কয়েকজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি ফন্দি করলেন, মরলে মরবো, সাধারণ মানুষের উপর যে-ইংরেজ কর্তা এমন অত্যাচার করছে, তাকে কৌশলে পেটাতে হবে। একদিন সাদরে সেই ইংরেজ কর্তাকে দাওয়াত দিয়ে এনে এমন পিটুনি দিলো যে, সেই নরাধম ইংরেজ এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলো এবং আর কোনোদিন এলাকায় ফিরে আসেনি। তারপর যে-ই আসতো, একই কৌশলে পিটুনি দেয়া হতো। পিটুনির ধরন দেখে ইংরেজদের অনেকে ভয় পেয়ে আর এই এলাকায় আসতো না। এলাকা হয়ে যায় ইংরেজ-শূন্য। মানুষজন ইংরেজ তাড়ানোর সেই পিটুনির কৌশল দেখে খুব আনন্দ পেয়েছিলো। লোকজন একসাথে বসে হাসাহাসি করতো। ধীরে ধীরে পিটুনি বা কঠিন মার দেয়ার জায়গাকে ‘পিটাইয়া’ বলতে আরম্ভ করলো। ‘পিটাইয়া’ বলতে বলতে কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে এখনকার বিখ্যাত ‘পুটিয়া’, যে-পুটিয়া সারা বাংলাদেশের মানুষের নিকট এক নামে পরিচিত। নরসিংদী সদর সংলগ্ন এই ইউনিয়নের দক্ষিণ প্রান্তের মানুষজনের নিত্যদিনের চলাফেরা নরসিংদী শহরের সাথে। এ-ইউনিয়নের বুক চিরে চলে গেছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। পুটিয়া বাংলাদেশের অনত্যম বৃহৎ গরুর হাট। প্রতি শনিবার হাটের বিশালতা দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। দেশের দূর-দূরান্তের মানুষ এই হাটে আসেন পছন্দমতো গরু ক্রয় করতে।
পুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় : গ্রামটিতে সর্বাগ্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ঐতিহ্যবাহী পুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার সাল ১৯২০। তারও আগে এই জায়গায় টোল ও মক্তব ছিলো। পৃথিবী ছিলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে। তারপরও ১৯১৯ সালে শিক্ষা সংস্কারের আওতায় পৌর এলাকা ও গ্রামাঞ্চলের বিশেষ বিশেষ জায়গায় ইউনিয়ন কেন্দ্রিক প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক করার সামান্য চিন্তা থেকে বর্তমানের পুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এলাকার অনেক ছাত্র-ছাত্রী এখানে পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। পরবর্তীতে পুটিয়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা অনেক এগিয়েছে। মাদরাসা শিক্ষায়ও পুটিয়া অনেক এগিয়ে।

সৈয়দনগর
নাম থেকেই বোঝা যায়, এলাকায় সৈয়দ বংশের লোকজনের বসবাস ছিলো। সেই ‘সৈয়দ’ উপাধি থেকেই গ্রামের নামকরণ হয়েছে। তারও আগে এই গ্রামকে ‘সৈকারচর’ বলে মানুষ চিনতো। সম্ভবত গ্রামে সৈয়দদের বসবাস শুরু হলে তাদের উপাধি থেকে ‘সৈয়দনগর’ নামটি এসেছে। গ্রামটি খুবই পরিচিত এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে অবস্থিত হওয়ায় ব্যাপক পরিচিত। গ্রামের মানুষ শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বেশ অগ্রসর। সৈয়দনগরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি মাদরাসা রয়েছে।
সৈয়দনগর দড়িপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় : ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি প্রথমদিকে নৈশ বিদ্যালয় ছিলো। বিদ্যালয়ের জন্যে জমি দিয়েছেন মরহুম সাফিজ উদ্দিন, ডা. আ. ওহাব, মো. সামসুদ্দিন ও মো. আ. মান্নান মোল্লা। উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন মো. জামাল উদ্দিন, মো. ফজলুর রহমান, তমিজ উদ্দিন মাস্টার, মফিজ উদ্দিন ও রমিজ উদ্দিন। উল্লেখযোগ্য শিক্ষকগণের মধ্যে ছিলেন জনাব মো. জামাল উদ্দিন, জনাব মো. ফজলুর রহমান, জনাব আবু সাঈদ এবং জনাব আ. হান্নান মোল্লা। তাঁদের হাতে এলাকার বহু ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

মুন্সেফেরচর
এলাকাটিতে একসময় খুবই খরস্রোতা নদী ছিলো। ইংরেজদের স্বার্থে এলাকার ভূমি জরিপ করা একান্তভাবে দরকার হয়ে পড়ে। কিন্তু নদীতে পানি ও কোথাও বিচ্ছিন্ন চর থাকায় জরিপ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। তবু জরিপ করতে হবে বিধায় তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের স্থানীয় প্রতিনিধি জরিপের জন্যে একজন উচ্চপদস্থ মুন্সেফ পাঠান। উক্ত মুন্সেফ এলাকায় দীর্ঘদিন অবস্থান করে কঠিন জরিপ করতে চেষ্টা করেন। আশেপাশের এলাকা ও গ্রামের মানুষজন মুন্সেফকে জমি সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য দিতেন। মুন্সেফ সাহেবও জনগণের সাথে ভালো ব্যবহার করতেন, সম্মান দিতেন। এলাকাবাসীও তাকে সম্মান দিতে ভুল করেনি। সেই মুন্সেফ সাহেবের সম্মানার্থে তারা গ্রামের নাম রাখে মুন্সেফেরচর।
মুন্সেফেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় : ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ শাসনকালে মুন্সেফেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। শিক্ষায় অনুরাগী মরহুম আক্রাম আলী গাজী জমি দিয়েছেন। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে এখন বিদ্যালয়টি একটি ভালো অবস্থানে আছে। পুরোনো কৃতিত্বপূর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় মরহুম মো. আবদুস ছালাম খন্দকার, দুই দুইবার পুটিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. সালাহ উদ্দিন গাজী, চট্রগ্রাম মেরিন একাডেমির ইঞ্জিনিয়ার মো. মাসুদ মিয়া। নিবেদিতপ্রাণ ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ছিলেন জনাব আমিনুল ইসলাম, জনাব নাজমুল কবির আনোয়ার, জনাব জিন্নত আলী গাজী, জনাব মনির উদ্দিন গাজী এবং জনাব মো. কামাল গাজী।


লেখক : সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ