রিপনের সাথে তর্কটা এখানো শেষ হয়নি, তার আগেই সে চলে গেলো; এভাবে চলে যাওয়ার অভ্যাস তার আগে ছিলো না। কে জানে কী হয়েছে, হুট করে এভাবে তর্কের মাঝপথে বিরতি দেয়াটা ভালো হয়নি; সবার তর্কের দম থাকে না, সবাই তর্ক বোঝেও না, তর্কের বিষয় রেখে অধিকাংশই ব্যক্তিগত বিষয়ে ঢুকে পড়ে, তারপর যা হবার তাই হয়; তর্ক ঢুকে পড়ে পরচর্চার কুৎসিত অন্ধ গলিতে। রিপন এমন অন্ধ গলির নোংরা ময়লা এড়িয়ে চলতে জানে। তাই রিপনের সাথে তর্কটা জরুরি।
কবিতা, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ, চিত্রকলা, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ নিয়ে আমাদের অনেক কথা বাকি আছে। কবিতা লিখে কি আসলেই কিছু হয়? কিংবা সিনেমা কতোটুকু ভূমিকা রাখে আসলে সমাজে? আর রাখলেই বা কী, কতোজন সেটি দেখতে যায়? এর থেকে বোধ হয় রাজনীতি অনেক সরাসরি বিষয়। রাষ্ট্র নিয়ে, ভবিষ্যত নিয়ে আলাপের একটা পথরেখা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু রাজনীতি কারা করে? কেন করে? কী তাদের রাজনীতি? দেশ, মানুষ, প্রকৃতি-প্রযুক্তির সাথে তাদের সংযোগ কেমন?
রেলস্টেশনের বটতলা কিংবা মেঘনার পাড়ে শ্মশানঘাট, থানারঘাট অথবা দূর নির্জন আড়িয়াল খাঁ নদীর ধারে কবি রিপন ইউসুফের সাথে অসংখ্য বিতর্ক এখনো বাকি।
এসব আলাপ আসলে অদরকারি। অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া মানুষের কোনো পথ নাই। তো মানুষের মুক্তির জন্যে কতো টাকা লাগে? কী পরিমাণ সম্পদ হলে মানুষ ভাবতে পারে যে, তার অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটেছে? এই মাত্রা কে নির্ধারণ করবে? মানদণ্ডের বাটখারা সেই লোকটাকেই-বা আমরা মানতে যাবো কেন? হিউম্যান সাইকোলজি এখানে কী বলে? ‘ডিজায়ার’ কি কোনো মাত্রায় পরিমাপ করা সম্ভব? দেল্যুজ তো বললো, মানুষের ‘ডিজায়ারিং মেশিন’-এর তো কোনো সমাপ্তি নাই। এটা কি যোগ দর্শনের ‘চিত্তবৃত্তি নিরোধ’? চিত্তবৃত্তি না থাকলে মানুষের থাকে কী? কিছু একটা তো থাকতে হবে।
কী আছে মানুষের? ঐ একটা মাথা, আর সেটা ভর্তি করা চিন্তা-দুশ্চিন্তা-কুচিন্তা। এই চিন্তার মালিক তো সে নিজে না, অন্য কেউ চিন্তা রেডি করে দেয়ার পর সে এক্সিকিউট করে বেড়াচ্ছে। চিন্তাও যদি নিজের না হয়, তাহলে কী আছে তার? শরীর? সেটি কি চিন্তার ফল? নাকি শরীরের ফল চিন্তা? শরীর না থাকলে কি তার চিন্তা থাকতো? চিন্তা না থাকলে কি তার শরীর থাকতো? ডিম আগে না মুরগি আগের দশা। ভাই, শেষ পর্যন্ত আমার সারভাইবাল কোশ্চেন, আমাকে তো নিজেকে বহন করে নিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু এর তো একটা ভিত্তি আছে, কোথাও দাঁড়াতে হয়, আমরা কি কোথাও দাঁড়াতে পারছি? আমাদের কোনো একটি পাটাতনে দাঁড়াতে দেয়া হচ্ছে না। কারা দিচ্ছে না, কেন দিচ্ছে না, সেটি তারা পারে কীভাবে? ঐ দেখবেন, কিছু বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বুদ্ধিজীবীর ভেক ধরে জাতিকে জ্ঞান দিচ্ছে, সে এই জ্ঞান কোথায় পাইলো, কিছু বিশ্ববিখ্যাত তাত্ত্বিকের নাম আওড়াতে দেখবেন, ঐ-সকল তাত্ত্বিকের কপি করে কিন্তু তার মতো আর দাঁড়াতে পারে না, কারণ তাদের দাঁড়াবার আলাদা শক্ত পাটাতন আছে, সেখানে আমার জায়গা হবে না, এটা মাথায় রাখতে হবে, সে তার জায়গা আমার জন্যে ছেড়ে দিবে না, কিন্তু আমি তো উদাম করে দাঁড়িয়ে আছি, সমস্যা এখানেই, আপনার মাটিতে আপনার পা নেই, ভেসে ভেসে বেশিদূর যাওয়া যাবে না, ধপাস করে পড়ে যাবেন, নাক-মুখ থেতলে যাবে।
অবশ্য এই থেতলানো মুখ পুঁজি করে আবার ভিক্ষা ভালো পাওয়া যায়, নিজেদের ভিক্ষুক হিসেবে রাখতে চাইলে, আর কোনোমতে ভিক্ষুদের সর্দারি বাগিয়ে নিতে পারলে এক জীবন ভালোই কেটে যেতে পারে। পশ্চিমের লোকজন বেশ দয়ালু হয়ে ওঠেছে, তারা সব শুষে নিলেও নিজেদের মলমূত্র সাফ করানোর জন্যে কামলা বাঁচিয়ে রাখে, আর বেঁচে থাকার মতো পরিমিত ভিক্ষা তারা দেয়, এই উদারতা তাদের আছে। পশ্চিমা তাত্ত্বিকের তৈরি করা তত্ত্ব ভিক্ষা করেও আমাদের একই দশা হচ্ছে, এসব পারলে বাদ দেন, নতুবা দূরে যান…
চা-সিগারেট কতোগুলো খাওয়া হয়, এই হিসেব কখনো করা হয়নি, রেলস্টেশনের বটতলা কিংবা মেঘনার পাড়ে শ্মশানঘাট, থানারঘাট অথবা দূর নির্জন আড়িয়াল খাঁ নদীর ধারে কবি রিপন ইউসুফের সাথে অসংখ্য বিতর্ক এখনো বাকি। বইমেলায় প্রকাশের অপেক্ষায় থাকা আমার পরবর্তী বইয়ের বিষয়টি নিয়েও জরুরি কথা আছে। বাঙালি, বঙ্গীয়, বৃহৎবঙ্গ, গ্লোবালাইজেশনের বিতর্কগুলো তো একটা পরিণতির দিকে নিতে হবে; রিপনের সিরিয়াস চরিত্রের ভেতর এই খামখেয়ালিটুকু আমি নিতে পারি না, সবারই ব্যক্তিগত কাজ আছে, ব্যক্তিগত জীবন আছে, তাই বলে তর্কের মাঝপথে যখন-তখন চলে যাওয়া যায় না।
যান, কাদের ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে ওঠছে, সেটাও সুযোগমতো দেখেন; বাঙালি বলার সমস্যাটুকুকে কারা পুঁজি করে অন্য ব্যবসা করে, কারা বিদ্বেষ উসকে দেয়, কারা এই শব্দে আদিবাসীদের নিয়ে রাজনীতির বড়ো দান বাগিয়ে নেয়, আমরা কি সেসব দেখিনি? আসলে কেউ সমাধান চায় না, ক্ষত বাঁচিয়ে রেখে নিজেদের বুদ্ধিজীবীতাকে উপভোগ করতে চায়। বস্তুত সমাধান কীভাবে আসতে পারে, তার কোনো ধারণাই তাদের নাই, থাকলে কই? এতো যে বড়ো বড়ো কথা, বড়ো বড়ো চিন্তা, অজস্র পরামর্শ, তাহলে আমাদের দিন দিন আরো অধঃপতন হচ্ছে কেন? সন্দেহ করেন, যারা কথা বলছে, তাদের প্রত্যেককে সন্দেহ করেন; হয় তারা জানে না, নির্বোধ অথবা অসৎ, এর বাইরে অন্য কিছু হলে আমরা তার কিছু না কিছু ফলাফল দেখতে পেতাম।
ফলাফল থাকবে কীভাবে? এখানে কি কেউ থাকে? এই মাটিতে কারো কোনো স্বপ্ন নেই, সব ধ্বংস হয়ে গেছে কবি সাহেব, কবিতা লেখেন, সিনেমা বানান, তত্ত্ব আওড়ান, একটা বেশ নান্দনিক জীবন উপভোগ করেন, আপনার তো দায়িত্ব নাই, অন্য কেউ আপনার জন্যে লালগালিচা পেতে দিবে, আপনি বিভিন্ন পোজে ছবি তুলবেন। চলেন, এর চেয়ে ভালো হয় সোহান-রাসেল-সুমনসহ একটা ছবি তুলি, ফেসবুকে দেওয়া যাবে, ‘আজকে দারুণ আলাপ হলো’, এই তো, প্রচার সর্বস্বতা, এর বাইরে কী? একটা সমাজ পাল্টাতে কয় জনম অপেক্ষা করতে হয়!
দ্রাবিড় সৈকত
কবি, চিত্রকর
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়