তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী, নাচোলের রাণীখ্যাত ইলা মিত্রের স্বামী কমরেড রমেন মিত্র দীর্ঘদিন নরসিংদীর রায়পুরায় আত্মগোপনে ছিলেন। তেভাগা আন্দোলনের জনক হাজী মোহাম্মদ দানেশ হলেও এই আন্দোলন সংগঠনের পেছনে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন রমেন মিত্রের স্ত্রী ইলা মিত্র। ইলা মিত্র ও তাঁর স্বামী রমেন মিত্র কমিউনিস্ট পার্টি থেকে নির্দেশ পেয়ে দিনাজপুর, রংপুর ও পাবনার বর্গাচাষিদের সংগঠিত করতে থাকেন। এ-আন্দোলনের এক পর্যায়ে উত্তেজিত বর্গাচাষিরা পিটিয়ে পাঁচ পুলিশ হত্যা করলে সরকার সেনাবাহিনি তলব করলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়।
তখন তেভাগা আন্দোলনের অনেক নেতাকর্মী গা ঢাকা দেন। রমেন মিত্র হুলিয়া মাথায় নিয়ে চলে আসেন নরসিংদীর রায়পুরায়। এসে আত্মগোপন করেন রায়পুরার হাসিমপুরের রমানন্দ সূত্রধরের বাড়িতে। রায়পুরায় আত্মগোপনে থেকেও রমেন মিত্র গোপনে সংগঠনের কাজ চালাতে থাকেন। রমেন মিত্রের সাথে পরিচিত হন তরুণ আব্দুস সাত্তার, হরিপদ কর্মকার ও ফজলুল হক খোন্দকার। আব্দুস সাত্তার মেম্বারের বাড়িও হাসিমপুর গ্রামে। তিনিই রায়পুরা আর কে আর এম উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র ফজলুল হক খোন্দকারকে রমানন্দ সূত্রধরের বাড়িতে নিয়ে যান রমেন মিত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে। রমেন মিত্র জমিদারের সন্তান, নিজেও ছোটোখাটো জমিদার, তবু তার কথাবার্তা শুনে তরুণ খোন্দকার খুব উজ্জীবিত হন। পরে অবশ্য কৃষকনেতা হাতেম আলী খানের কাছ থেকেও ফজলুল হক খোন্দকার বাম রাজনীতির দীক্ষা পান। ঐ-সময় খোন্দকার নবম শ্রেণির ছাত্র হলেও বয়সের দিক থেকে তখন তিনি বিশ বছরের যুবক। কারণ তিনি প্রায় দশ বছর কওমি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে রায়পুরা আর কে আর এম স্কুলে এসে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। মাদরাসার পড়ালেখা ছাড়ার কারণ হিসাবে তিনি পরবর্তীতে মন্তব্য করেছিলেন, মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা একমুখী, ক্রটিপূর্ণ ও গতানুগতিক।
ব্রিটিশ শাসনের শেষদিকে রায়পুরার পিরিজকান্দির সৃষ্টিধর খলিফার বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন নিষিদ্ধ বিপ্লবী সংগঠন ‘যুগান্তর’-এর সদস্য বিপ্লবী মধু ব্যানার্জি। সৃষ্টিধর খলিফারও রমানন্দ সূত্রধরের বাড়িতে যাতায়াত ছিলো। পলাশের বিজয় চ্যাটার্জি প্রায়ই রায়পুরায় এসে গোপন সভা করতেন। এসব গোপন সভা বসতো রমানন্দ সূত্রধরের বাড়িতে, কমরেড অজয় রায়ের স্ত্রী জয়ন্তী রায়ের বাড়িতে (কমরেড আকাশ পালের বোন), শ্রীরামপুরে কমরেড ফটিক রায় চৌধুরীর বাড়িতে, রহিমাবাদের রমেন ডাক্তারের বাড়িতে। রমানন্দ সূত্রধরের পূর্বপুরুষ ভীম সূত্রধরের মধ্যেও বিপ্লবী রক্তধারা প্রবাহিত ছিলো। তারই পৌত্র রমানন্দ সূত্রধর দাদার বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গোপনে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ঝাণ্ডা ধরে রেখেছিলেন।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা ঘোষণা করলে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা আরো টালমাটাল হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার ছয়দফাকে পাকিস্তান ভেঙে ফেলার ষড়যন্ত্র মনে করলে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। ইতিহাসে এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। সেই সময় থেকে সারা বাংলায় বিভিন্ন নেতাদের বিরুদ্ধে হুলিয়াসহ ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। এই সময়ে অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী অনেক দিন আত্মগোপনে থাকেন ভাটের চরের কমরেড শামসুল হক সাহেবের বাড়িতে এবং হাসিমপুরে রমানন্দ সূত্রধরের বাড়িতে। ষাটের দশকে অনেক বাম নেতা রায়পুরায় আত্মগোপনে ছিলেন। এদের মধ্যে কৃষকনেতা জিতেন ঘোষ, অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী, কমরেড সুচিত চক্রবর্তী, কমরেড নেপাল নাগ, রবি নিয়োগীসহ অনেকে।
রমানন্দের স্ত্রী রেণুবালা একজন করিৎকর্মা মহিলা ছিলেন। বিশেষ করে অতিথি-বেড়াল আপ্যায়নে তার জুরি মেলা ভার। এই সাহসী নারী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গুপ্তচরের কাজ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর আদান-প্রদানে নিঃশঙ্কচিত্তে সহযোগিতা করেছেন। রমেন মিত্র নরসিংদীর রায়পুরায় দ্বিতীয়বার আত্মগোপনে এসেও রমানন্দ সূত্রধরের বাড়িতেই থেকেছিলেন। তার কারণ হয়তো একটিই, রমানন্দের স্ত্রীর নির্ভেজাল আতিথেয়তা।
মহসিন খোন্দকার
সাধারণ সম্পাদক, প্রগতি লেখক সংঘ, নরসিংদী