ছোটোবেলা চরাঞ্চলের গ্রামের বাড়ি থেকে নানার বাড়ি চর্ণগরদী যাওয়া-আসার বিষয়টি বেশ রোমাঞ্চকর ছিলো। নৌকায় মেঘনা নদী পেরিয়ে নরসিংদী শহর হয়ে রেলস্টেশন দিয়ে চিনিশপুর রাজারদীর পরই পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের কোলে চর্ণগরদীর সৈয়দ বাড়িতে যখন যেতাম, তখন মনে মনে একটা উৎসব ভাব জাগতো। সৈয়দ বাড়ির পাশেই ছিলো খান বাড়ি। সেখানে জন্মেছিলেন সাবেক মন্ত্রী মোমেন খান, বিজ্ঞানী বাতেন খান ও সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আব্দুল মঈন খান।
ছোটোবেলায় নানার বাড়ির স্মৃতির সঙ্গে সঙ্গে রেলস্টেশনের গায়ে লেখা ‘নরসিংদী জং’ শব্দটি হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিলো। এই সংক্ষিপ্ত ‘জং’য়ের পূর্ণাঙ্গ শব্দ যে ‘জংশন’, তা অনেক পরে জেনেছিলাম। ইঞ্জিন ঘোরানো, বগি ধোয়ামোছা, গাড়িতে পানি নেয়া ও গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় জংশনে। নরসিংদী থেকে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানাধীন মদনগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করে শিল্পাঞ্চল ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র নরসিংদী ও প্রাচ্যের ড্যান্ডি নারায়ণগঞ্জকে যুক্ত করা হয়েছিলো। ফলে নরসিংদী পরিণত হয় জংশনে। কিন্তু অলাভজনক হওয়ায় প্রতিষ্ঠার ৭ বছরের মাথায় রেলপথটি বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৪ বছর পর রেলপথের পাত তুলে নেয়া হলে ৪৬.৬৯ কিলোমিটারের রেলপথটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
নরসিংদীতে প্রথম রেলপথ নির্মাণ শুরু হয়েছিলো ১৯১০ সালে, যা শেষ হয় ১৯১৪ সালে। আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি টঙ্গী-নরসিংদী-ভৈরব-আখাউড়া রেললাইনটি নির্মাণ করে। ঢাকা থেকে রেলপথ টঙ্গী পর্যন্ত নির্মিত হয়েছিলো ১৮৮৫ সালে। অবশ্য তখন রেলপথটি নারায়ণগঞ্জ থেকে শুরু করে ঢাকার ফুলবাড়িয়া হয়ে টঙ্গী থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ১৪৪ কিলোমিটার সম্প্রসারণ করা হয়েছিলো। টঙ্গী থেকে রেলপথটি ভৈরব পর্যন্ত সম্প্রসারণ কাজ শুরু হয় ২৫ বছর পর।
রেলপথ সম্প্রসারণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নরসিংদীতে বস্ত্র ও তাঁতশিল্প, কৃষিপণ্য, ফলমূল চাষে ব্যাপক বিপ্লব ঘটে। বিশেষ করে নরসিংদীর হাসনাবাদ, বাবুরহাট, মাধবদী এবং গোপালদী ও আড়াইহাজার এলাকা হয়ে ওঠে বস্ত্রশিল্পের প্রাণকেন্দ্র। মূলত বস্ত্রশিল্পের উন্নতির কথা মাথায় রেখেই নরসিংদী টু মদনগঞ্জ রেলপথটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়, যা ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে চালু হয়।
স্বল্প দূরত্বের এই রেলপথে মোট ১০ টি স্টেশন ছিলো। স্টেশনগুলো হলো : নরসিংদী জংশন, মাধবদী, মোল্লারচর, আড়াইহাজার, প্রভাকর্দী, নয়াপুর, কুড়িপাড়া, নবীগঞ্জ, বন্দর ও মদনগঞ্জ। এর মধ্যে পাকিস্তান আমলে মদনগঞ্জে পাট, ধান, চালের জমজমাট আড়ত ছিলো। অপরদিকে নরসিংদীতে তৈরি কাপড় ছিলো খ্যাতির শীর্ষে। এসব পণ্য সারাদেশে সরবরাহ করার লক্ষ্যেই ১৯৬৭ সালে সর্বপ্রথম নরসিংদী-মদনগঞ্জ রেলপথ নির্মাণের কথা ওঠে। পরবর্তীতে জরিপ ও যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করে রেলপথটি নির্মাণের জন্যে রেলপ্রকৌশলীরা মতামত দেন। এর প্রেক্ষিতে রেলপথ ও রেলস্টেশন নির্মাণ কাজ শেষ করে ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে রেলগাড়ি চলাচল শুরু করা হয়। কিন্তু ১৯৭৬ সালের দিকে এই পথে রেল চলাচল লোকসানে পরিণত হয়।
খায়রুল বশির নামে একজন রেল কর্মকর্তা নরসিংদী-মদনগঞ্জ রেলসড়কের লোকসান নিয়ে অনুসন্ধান চালান। তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি ও রেলপোর্টারের (কুলি) সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, নরসিংদী-মদনগঞ্জ রেলপথটি মূলত অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতির কারণে ডুবেছে। এই রেলপথটি এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছিলো যে, বন্ধ করে দেয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ ছিলো না। কোনো স্টেশনেই টিকেট চেক করা হতো না। পোর্টারদের নিয়ন্ত্রণে সবকিছু চলে গিয়েছিলো। তারাই স্টেশন নিয়ন্ত্রণ করতো এবং টিকেট চেক করতো। যাত্রীদের কাছ থেকে টিকেট সংগ্রহ করে তা পুনরায় কাউন্টারে বিক্রি করা হতো। তাদের এই মহাদুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলো বুকিং সহকারী, টিআইসি, একাউন্টস টিআইসি, এসিও এবং ডিপিও অফিসের আরএসিআই। বলা যায়, এই রেলপথের সব দুর্নীতির ভাগ রেলের উচ্চ পর্যায়ে যেতো। দুর্নীতিটা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো, রেলের চালকেরা পর্যন্ত এতে জড়িয়ে পড়েছিলো। ৫-১০ টাকা ঘুষের বিনিময়ে যাত্রীদের যত্রতত্র নামিয়ে দেয়া, এমনকি যাত্রীদের বাড়ির কাছে ট্রেন ব্রেক করার মতো ঘটনাও ঘটতো। দুর্নীতি চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলে সরকার রেলপথটি বন্ধ করে দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করে। সোনারগাঁওয়ের তৎকালীন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী ব্যারিস্টার রাবেয়া ভূঁইয়া এই রেলপথের দুর্দশা দেখে ব্যথিত হন। তিনি রেলপথ তুলে দিয়ে সেখানে স্থলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তখন থেকেই যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে ফাইল চালাচালি শুরু হয়।
নরসিংদী টু মদনগঞ্জ সেকশনের করুণ অবস্থা ১০ টি স্টেশনের উপর প্রভাব ফেলে। ১৯৭০ সালে রেলপথটি শুরুর সময় প্রতিটি স্টেশনে মাস্টার নিয়োজিত ছিলো। ১৯৭৭ সালে রেলপথটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে প্রত্যেক স্টেশন থেকে মাস্টার উইথড্র হতে থাকে। তখন বুকিং সহকারী স্টেশনের সব দায়িত্ব পালন করতেন। শুধুমাত্র মদনগঞ্জ স্টেশনে একজন স্টেশন মাস্টার ও একজন পয়েন্টম্যান নিয়োজিত ছিলো। তারা মদনগঞ্জে ইঞ্জিন ঘুরিয়ে অনট্রেন করতেন।
১৯৭৭ সালে রেলপথটি বন্ধ হয়ে গেলে পুরো অঞ্চলটি প্রায় জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে। এটি চোর-ডাকাতের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। রেলপথের লোহালক্কর, কাঠ, পাথর চুরি হতে থাকে। তখন থেকে লম্বা সময় ধরে এই ভয়ঙ্কর অবস্থা বিরাজমান ছিলো। জানা যায়, ১৯৮০ সালের দিকে মদনগঞ্জে চালের ব্যবসার পাশাপাশি পাটের ব্যবসায়ও ধস নামে। সঙ্গত কারণে সরকার রেলপথটি সংস্কার ও পুনরায় চালু করার চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে সেখানে বাস-ট্রাক চলাচলের উপযোগী সড়কপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করে।
পরবর্তীতে আশির দশকের শেষের দিকে রেললাইনের উপর সড়কটি নির্মিত হয়। বর্তমানে সড়কটি নরসিংদী টু নারায়ণগঞ্জ চলাচলের বিকল্প সড়ক হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
আপেল মাহমুদ
সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক