নরসিংদীর মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনির ভূমিকা

বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচে’ গর্ব এবং গৌরবের অধ্যায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার কর্তৃক গঠিত সেনাবাহিনি, ভারতে এবং দেশের অভ্যন্তরে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে জনগণ এই মহান যুদ্ধে নানাভাবে অংশগ্রহণ করে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সামগ্রিক বিবেচনায় ছিলো একটি জনযুদ্ধ।

আওয়ামী লীগ ছাড়াও ন্যাপ (মোজাফফর), ন্যাপ (ভাসানী), কমিউনিস্ট পার্টি এবং বাম ছাত্র সংগঠনগুলো মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। পাকিস্তানের ২৩ বছরের সংগ্রামের ইতিহাসে বাম রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশেষ করে, ’৬৯-এর গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগের ৬ দফার সাথে ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের ১১ দফা দাবি আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্ত হন। দেশ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যায়।

স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে সারা দেশের মতো নরসিংদী জেলাও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। নরসিংদী জেলার মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সাথে বাম রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র সংগঠনের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আলোচনার এই অংশে ন্যাপ (মোজাফফর), কমিউনিস্ট পার্টি (মনি সিং) এবং ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)-এর যৌথ গেরিলা বাহিনির অবদানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে নরসিংদী কলেজের রয়েছে ঐতিহাসিক অবদান। ১৯৭০-এর কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া গ্রুপের ভুলু-মুজিব পরিষদ বিজয়ী হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে নরসিংদী কলেজের ছাত্র-শিক্ষকেরা নানাভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকে। নরসিংদী কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী নৌ-বাহিনির সাবেক কমান্ডার আবদুর রউফ। তিনি ১৯৭১ সালে ভারতে যাওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষকদের সংগঠিত করাসহ নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি কলেজের দায়িত্বে ফিরে এলেও দেশ গড়ার সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্যে অধ্যক্ষের দায়িত্ব ছেড়ে তৎকালীন ন্যাপ (মোজাফফর) রাজনৈতিক দলে যোগদান করেন।

নরসিংদী সদর এবং নরসিংদী কলেজে ন্যাপ (মোজাফফর), ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন নেতৃত্বে এবং অংশগ্রহণে যাঁরা ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— হাবিবুল্লাহ বাহার, আবুল হাশিম মিয়া, আতাউর রহমান ভূঁইয়া এবং তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র শহীদুল্লাহ বাহার, নূরুল ইসলাম গেন্দু, আজিজ আহমেদ খান, বি এ রশিদ, আলী আহমেদ, রফিকুল ইসলাম, মজিবর রহমান, সামছুল হক ভূঞা, বদরুজ্জামান বদু ভূঞা, গাজী শাহাবুদ্দিন, যূথিকা চ্যাটার্জী, কার্তিক চ্যাটার্জী। যূথিকা চ্যাটার্জী ও কার্তিক চ্যাটার্জীর বাবা ছিলেন জিনারদীর বিজয় চ্যাটার্জী, যিনি ছিলেন প্রখ্যাত বাম রাজনীতিবিদ এবং যুক্তফ্রন্টের পার্লামেন্ট সদস্য। দেশের কৃষক-প্রজা এবং সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্যে জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশে এবং ভারতে অবস্থানকালীন তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।

হাবিবুল্লাহ বাহারের নেতৃত্বে নরসিংদী সদরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড়ো অংশ ভারতে ট্রেনিং গ্রহণ করে দেশে ফিরে যুদ্ধে অংশ নেন। এই দলের অন্যান্য সদস্যরা দেশের অভ্যন্তরে ট্রেনিং গ্রহণ করেন। ট্রেনিংয়ের প্রধান অস্ত্র ছিলো থ্রি নট থ্রি রাইফেল, স্টেনগান, এলএমজি ও হ্যান্ড গ্রেনেড।

দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর নরসিংদী মুক্ত হয়। নরসিংদী মুক্ত হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ভারতীয় মিত্রবাহিনির সাথে হাবিবুল্লাহ বাহারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনি নরসিংদী শহরে প্রবেশ করে এবং এই বাহিনির হাতে অনেক রাজাকার (যারা পালাতে পারেনি) আত্মসমর্পণ করে এবং তাৎক্ষণিক সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন রাজাকার মৃত্যুবরণ করে।

বিজয়ের প্রাক্কালে এই বাহিনির দুজন মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান এবং আবদুল হারিছ শহীদ হন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে রায়পুরা-বেলাব অঞ্চলেও বাম রাজনীতিবিদ ও জনগণের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। কৃষক আন্দোলনসহ সকল রাজনৈতিক আন্দোলনে রায়পুরা-বেলাব অঞ্চলের অংশগ্রহণ ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।

রায়পুরা অঞ্চলে কৃষকনেতা ফজলুল হক খোন্দকার একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন শীর্ষ সংগঠক। ১৯৭১ সালে তাঁর নেতৃত্বে রায়পুরার বহু যুবক-তরুণ মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করার জন্যে ভারতে চলে যান এবং ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি স্থানীয়ভাবে রায়পুরার ৫ টি স্থানে ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। তাঁর দলের অন্যতম মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন— আবদুল হালিম, আবদুল কুদ্দুস, পলাশতলীর হাশিম চেয়ারম্যান, রহিমাবাদের সুভাষ সাহা, প্রীতিরঞ্জন সাহা প্রমুখ। এই দলেরই দুজন সদস্য ঐতিহাসিক বেতিয়ারা যুদ্ধে শহীদ হন। তাঁরা হলেন— শহীদ জহিরুল হক দুদু এবং শহীদ বশিরুল ইসলাম।

মুক্তিযুদ্ধে বেলাব অঞ্চলে নেতৃত্ব দেন কৃষকনেতা আবদুল হাই, শামসুল হক (চেয়ারম্যান), বাবর আলী মাস্টার। এই দলের অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন বারৈচার আবদুল আলী মৌলভী, খালেক মাস্টার, আজিম উদ্দিন মস্তু, আবদুল কাদির, জিলানী কাদির প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বেলাব অঞ্চলে যুদ্ধের প্রধান ট্রেনিংকেন্দ্র ছিলো আবদুল হাইয়ের বাড়ি। বাড়িটি ট্রেনিং-বাড়ি হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। এছাড়াও আরো কয়েক স্থানে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। যুদ্ধকালীন জাতীয় পর্যায়ের বাম রাজনীতিবিদদের একটি প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র ছিলো এই বেলাব অঞ্চল।

নরসিংদী জেলার মনোহরদী অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ছিলেন আবদুর রশিদ তারা মাস্টার। তাঁর নেতৃত্বে একটি বিশাল বাহিনি মনোহরদী অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে বিশেষ অবদান রাখে। তাঁর দলের অন্যতম সংগঠক ও যোদ্ধারা ছিলেন— শামসুল ইসলাম (খিদিরপুর), আবুল হোসেন (বড়চাপা), আবু তাহের (বড়চাপা), কুদ্দুস মৃধা (একদুয়ারিয়া), এম এন রশিদ (চন্দনবাড়ী), নিত্য গোপাল রায় প্রমুখ।

মনোহরদী অঞ্চলের আরেকজন বাম রাজনীতিবিদ এবং মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষ সংগঠক ছিলেন ফয়েজ মাস্টার। পেশায় ছিলেন শিক্ষক। ছাত্রজীবনেই তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং একাধিকবার জেল খাটেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে তাঁর অবদান অনন্য।

নরসিংদী জেলায় মুক্তিযুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণে বিজয় ত্বরান্বিত হয়। আমরা পাই একটি স্বাধীন ও মুক্ত স্বদেশ।


গোলাম মোস্তাফা মিয়া
সাবেক অধ্যক্ষ, নরসিংদী সরকারি কলেজ

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ