নরসিংদীর মাটি খামচানো ইতিহাসকার : চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

এই মহান ইতিহাসকার ২০২১ সালের ৩০ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেছেন, নরসিংদীর সাটিরপাড়ার নিজ বাসভবনে। রেখে গেছেন অমূল্য সব লেখাপত্র আর গ্রন্থসমূহ। তাঁর এসব কর্মের সাথেই তিনি জড়িয়ে থাকবেন আরো বহু বহু কাল।

নরসিংদীর স্থানীয় ইতিহাস রচয়িতা লেখক সরকার আবুল কালাম মারা গেছেন চার বছর হয়ে গেলো। সদা জাগ্রত, কর্মতৎপরতায় নিবিষ্ট, ধ্যানী ও প্রাজ্ঞ লেখক ছিলেন তিনি। তাঁর লেখার এবং ব্যক্তিআচরণের প্রধান ভঙ্গি ও বৈশিষ্ট্য ছিলো নিরেট, নির্মল রসময়তা।

পেশায় ছিলেন শিক্ষক। নরসিংদী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছিলেন দীর্ঘদিন। তরুণ বয়সে ডিটেকটিভ গল্প লিখে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। নারী স্বাধীকার-কেন্দ্রিক অনবদ্য চরিত্র ‘চমন’ তাঁর গোয়েন্দা গল্প সিরিজ। পরে স্থানীয় ইতিহাস রচনায় মনোনিবেশ করেন। নরসিংদীর সর্বস্থানে তিনি হন্যে হয়ে খুঁজে বের করেন মানুষ ও তাদের জীবনের বহুরৈখিক ফসিল; যা পরবর্তী প্রজন্মকে গবেষণা করার জন্যে এগিয়ে নেবে নানান তথ্যে ও তত্ত্বে। তিনি বলতেন, তিনি মূলত কিশোরদের জন্যে লেখেন। অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে ফেরা কিংবদন্তীকে নূতন কথা ও রসে জারিত করে ‘গল্প’ বলা তাঁর প্রধান অভিপ্রায়।

আমরা জানি যে, স্থানীয় ইতিহাস বা ঐতিহাসিক খণ্ড খণ্ড উপাদান জোড়া দিয়েই জাতীয় ইতিহাস রচিত হয়। একটা জাতির প্রতিনিধিত্বশীল ছবি আঁকতে হলে প্রথমেই এসব স্থানীয় উপাদান প্রয়োজন হয়। সরকার আবুল কালাম এই স্থানীয় তথ্যাবলি সংগ্রহের একটা মহৎ প্রতিষ্ঠান ছিলেন। তাঁর ১৫/১৬ টা গ্রন্থ এই অঞ্চলের, বিশেষত মুঘল আমল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত একটা ছিন্ন খেরোখাতা হিসেবে অবশ্যই চিহ্নিত হবার যোগ্যতা রাখে। তিনি এমন কিছু ব্যক্তি, স্থান ও স্থাপনা-কেন্দ্রিক তথ্য পাঠকদের সামনে ফেলে রেখে গেছেন, যা কারো দ্বারা ‘পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস’ নির্মাণ করার জন্যে সহায়ক হবে।

সরকার আবুল কালাম এ-অঞ্চলের লোকসাহিত্য, লোকসাহিত্যিক, লোকজ ছড়া, প্রান্তিক নানা জাতিগোষ্ঠীর হদিস, স্বদেশী আন্দোলনের বিপ্লবী, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের একটা প্রতিনিধিত্বশীল জীবনী, এমনকি আধুনিক কবিদের নানান তথ্য ও জীবনী সহযোগে একটা বর্ণাঢ্য মিউজিয়াম গড়ে তুলেছিলেন দিনের পর দিন পরিশ্রম করে।

নরসিংদীর নাগরিক সমাজ তাঁকে সঙ্গত কারণেই শিকড়সন্ধানী লেখক, নরসিংদীর আলোর কণা, ঐতিহ্যের নাবিক ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত করেছেন।

সরকার আবুল কালামের এই যে এ-অঞ্চলের মাটি খামচিয়ে আপাতঘুমন্ত অথচ জীবন্ত ফসিল বের করে আনার ক্লান্তিহীন ঝোঁক ছিলো মৃত্যু অবধি, তা পৃথিবীর যেকোনো জাতির স্থানীয় ইতিহাস রচয়িতা ও গবেষকদের মধুর ঈর্ষার কারণ হওয়া খুব স্বাভাবিক।

এই মহান ইতিহাসকার ২০২১ সালের ৩০ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেছেন, নরসিংদীর সাটিরপাড়ার নিজ বাসভবনে। রেখে গেছেন অমূল্য সব লেখাপত্র আর গ্রন্থসমূহ। তাঁর এসব কর্মের সাথেই তিনি জড়িয়ে থাকবেন আরো বহু বহু কাল।

সরকার আবুল কালাম রচিত গ্রন্থসমূহ
১. নরসিংদীর শহীদ বুদ্ধিজীবী। ১৯৯১
২. নরসিংদীর গুণীজন। ২০০৩
৩. কিংবদন্তীর নরসিংদী। ২০০৩
৪. নরসিংদীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। ২০০৭
৫. কিংবদন্তীর নরসিংদী-২, মনীষীকথা। ২০১০
৬. কিংবদন্তীর নরসিংদী-৩, কন্যা জায়া জননী। ২০১১
৭. নরসিংদী জেলায় ইসলাম। ২০১২
৮. কিংবদন্তীর নরসিংদী-৪, কথা-উপকথা। ২০১৩
৯. কিংবদন্তীর নরসিংদী-৫, রামনগর থেকে জাহাঙ্গীরনগর। ২০১৩
১০. নরসিংদীর ভাষা ও লোকজীবন (ড. মনিরুজ্জামানের সাথে যৌথভাবে)। ২০১৫
১১. কিংবদন্তীর নরসিংদী (নির্বাচিত)। ২০১৬
১২. নরসিংদীর ঐতিহ্যকথা। ২০১৭
১৩. নরসিংদীর চরএলাকার মাটি ও মানুষ, ব্রিটিশ ও মুঘল আমল। ২০১৭

সরকার আবুল কালাম সম্পাদিত গ্রন্থসমূহ
১. পূর্ব্ববঙ্গে মহেশ্বরদী, সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থ। ২০১৪
২. নরসিংদীর লোক সংস্কৃতি লোক ঐতিহ্য, আবুল হোসেন পাঠান। ২০১৮
৩. বিদগ্ধ দিনের প্রান্তর, আজিজুল হাকিম (কাব্যগ্রন্থ)। ২০১৮

সম্মাননাসমূহ
১. কবিয়াল হরিচরণ স্মারক সম্মাননা ও সনদ ২০১০ (ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত কর্তৃক)
২. আবদুর রশীদ সাহিত্য পুরস্কার ও সম্মাননা ২০১০ (নীলাচলে কলাবিতান সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, মনোহরদী কর্তৃক)
৩. শেকড় সন্ধানী লেখক অভিধা ও সম্মাননা ২০১০ (আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল, নরসিংদী কর্তৃক)
৪. নরসিংদীর ঐতিহ্যের নাবিক অভিধা ও সম্মাননা ২০১৩ (ন্যাশনাল কলেজ অব এডুকেশন, নরসিংদী কর্তৃক)
৫. আলাউদ্দিন আল আজাদ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪ (আলাউদ্দিন আল আজাদ স্মৃতি পরিষদ, ঢাকা কর্তৃক)
৬. নরসিংদীর আলোর কণা অভিধা ও সম্মাননা ২০১৫ (নবধারা কণ্ঠশীলন, নরসিংদী কর্তৃক)
৭. সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্যে সম্মাননা স্মারক ২০১৯ (জেলা প্রশাসন, নরসিংদী কর্তৃক)
৮. সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্যে সম্মাননা স্মারক ২০১৯ (উন্মোচন সাহিত্য পরিষদ, নরসিংদী কর্তৃক)

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ