সড়কের পাশে হোন্ডা রেখে তিনি কাঠের পুলটি সবেমাত্র পার হয়েছেন, এমন সময় তাঁর উপর অতর্কিতে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। তিনি খালের পানিতে ঝাঁপ দেন। হয়তো ভেবেছিলেন, পানির নিচে ডুব দিয়ে তিনি বহুদূর চলে যাবেন, যেমনটা তিনি করেছিলেন পাকিস্তানিদের ক্যাম্প আক্রমণ করার বেলায়। কিন্তু এবার তা হলো না। খালে অতোটা পানি ছিলো না। তাঁর উপর আবার গুলি হয়। সঙ্গী কৃষককর্মী লিয়াকত ঝাঁপ দিয়ে পড়ে নিজের শরীর দিয়ে তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পারেননি।
সে এক উত্তাল সময়। যিনি বা যারা সেই সময়ের মধ্য দিয়ে যাননি, তিনি বা তারা এর ছোঁয়া পাননি। এমন কারো পক্ষে তা পুরোপুরি অনুভব করাও সম্ভব নয়। সময়টা সত্যিই আমাদের জাতির জন্যে অপরিসীম গৌরবের। বীরের জাতি হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হওয়ার সময় ছিলো তখন। এমন সময় কোনো জাতির জীবনে বোধ হয় একবারই আসে।
সত্তর সালের নির্বাচনে জয়লাভ আর পশ্চিম পাকিস্তানিদের তা মেনে না নেয়া, মার্চে অসহযোগ আন্দোলন, ২৫ মার্চের গণহত্যা পেরিয়ে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠলো চারদিকে। শহর, বন্দর, গ্রাম, গঞ্জ— সর্বত্র। উদ্দাম সেই ঢেউ আজকের নরসিংদীর জনপদকেও তোলপাড় করলো। তখনকার নরসিংদী অবশ্য এখনকার মতো ছিলো না। নরসিংদী ছিলো একটি থানা; ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জ মহকুমার। রায়পুরা, শিবপুর, মনোহরদীও একই মহকুমায়। অন্যদিকে, পলাশ ছিলো কালীগঞ্জ থানাধীন, ঢাকা সদরের উত্তর মহকুমায়। পলাশের ডাঙ্গা ইউনিয়ন ছিলো রূপগঞ্জ থানাধীন। নরসিংদীর ভূ-প্রকৃতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও তখন ভিন্নরকম ছিলো। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র পাকা সড়ক ডেমরা-ভূলতা-মাধবদী-পাঁচদোনা হয়ে নরসিংদী। ডেমরায় শীতলক্ষ্যা নদীতে ছিলো ফেরি পারাপারের ব্যবস্থা। বিকল্প ছিলো রেলপথ।
পাকিস্তানের নৌ-বাহিনিতে কর্মরত নরসিংদী থানার নেহাব গ্রামের সিরাজ উদ্দিন আহমেদ তখন ছুটিতে তাঁর গ্রামের বাড়িতে। মার্চ মাসের ঘটনাবলি তাঁকে ছুঁয়ে যায়। রক্তে আগুন ধরায়। পঁচিশে মার্চের পর তিনি বিদ্রোহ করেন। এলাকার ছাত্র-যুবকদের সঙ্গে নিয়ে তিনি গেরিলা বাহিনি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু অস্ত্র পাবেন কোথায়? সেই সুযোগও এসে পড়লো সহসাই।

পাকিস্তান সেনাবাহিনিতে কর্মরত বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সীমান্তরক্ষী ইপিআরের বিদ্রোহী অফিসার ও সৈনিকেরা ডেমরায় প্রতিরোধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এপ্রিলের প্রথমদিকে। পরে তাঁরা পিছু হটে নরসিংদীতে আসেন। এই দলের নেতা ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান। তাঁরা ঢাকা-নরসিংদী সড়কের বাগবাড়িতে অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে তোলেন। সিরাজ উদ্দিন আহমেদ তাঁদের সাথে যোগ দেন। পরে পাকিস্তানি বাহিনি নরসিংদী অভিমুখে অগ্রসর হলে ৯ এপ্রিল এখানে প্রচণ্ড লড়াই বাঁধে। এই অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লড়াই। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের ভারি অস্ত্রের গোলাবর্ষণের সামনে টিকতে না পেরে তাঁরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। অবস্থান নেয় পাঁচদোনার পালবাড়িতে। ১০ এপ্রিল পাঁচদোনায় তাঁরা অগ্রসরমান পাকিস্তানি বাহিনিকে প্রতিরোধ করে। প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি বাহিনি পিছু হটে বাবুরহাটে অবস্থান নেয়। ঢাকা থেকে বাড়তি সৈন্যবহর এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। অনেক রাত অবধি যুদ্ধ চলে। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে এলে তাঁরা শেষ পর্যন্ত অবস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ঐ-সময় তাঁদের সঙ্গে যেসব অস্ত্রশস্ত্র ছিলো, সিরাজ সাহেব সেগুলো চেয়ে নেন। এই অস্ত্র তাঁর গেরিলা বাহিনি গঠনে সহায়ক হয়। তিনি নেহাব গ্রামে যুবকদের ট্রেনিং দেন এবং শক্তিশালী ক্যাম্প গড়ে তোলেন। গেরিলাদের কমান্ডার হিসেবে ‘ন্যাভাল সিরাজ’ নামে তিনি লোকমুখে পরিচিতি পান।
এ-সময় নরসিংদী থানার নেহাব’র পাশাপাশি শিবপুরেও গেরিলা বাহিনি গড়ে ওঠে। ২৫ মার্চের পর শিবপুরে ছাত্র-জনতা থানার অস্ত্র দখলে নিয়ে ঐ-বাহিনি গড়ে তোলেন। এর সংগঠক ছিলেন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। ন্যাভাল সিরাজের সাথে শিবপুর কেন্দ্রের যোগাযোগ স্থাপিত হয় অল্প সময়েই। শিবপুরে গেরিলা বাহিনিতে যোগ দেয়া যুবকের সংখ্যা ছিলো অনেক। কিন্তু তাদের অস্ত্রশস্ত্র তেমন ছিলো না। এ-সময় ঢাকার পিলখানায় ইপিআরের অস্ত্রাগার লুট করে নিয়ে আসে একদল বিদ্রোহী ইপিআর। তারা সেই অস্ত্র ডেমরা থেকে একটি লঞ্চে করে নিয়ে আসেন ডাঙ্গায়। তাঁদের নেতা ছিলেন হাবিলদার হারুন। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের মানুষ। ডাঙ্গায় ন্যাভাল সিরাজের সাথে তাঁদের যোগাযোগ হয়। তাঁদের সেই অস্ত্রের কিছু ডাঙ্গায় নামিয়ে নিজের ক্যাম্পে নেন তিনি। বাকি অস্ত্র ঐ-লঞ্চে করেই শীতলক্ষ্যা নদী দিয়ে তিনি নিয়ে যান প্রথমে চরসিন্দুর ও পরে হাতিরদিয়া নামক স্থানে। উদ্দেশ্য শিবপুরে নেয়া। হাতিরদিয়ায় তিনি এবং হাবিলদার হারুন সেসব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার গেরিলা বাহিনির জন্যে তাঁকে দেন। আর এর ফলে এপ্রিল মাস থেকেই বর্তমান নরসিংদী জেলায় মুক্তিযুদ্ধের দুইটি শক্তিশালী কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। নেহাব ও শিবপুরে।
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়— কবির কথার মতোই ছিলো সেই সময়টা। নরসিংদীর তরুণদের কাছেও। সাহসী তরুণেরা যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে এই দুই কেন্দ্রে ভিড় করার পাশাপাশি সীমান্ত পেরিয়ে আগরতলা যাচ্ছেন ট্রেনিং নিতে। তিনি তখন ছাত্রদের একটি দল পাঠালেন আগরতলায়। উদ্দেশ্য ট্রেনিং নিয়ে তারা বিস্ফোরক, মাইন ও গ্রেনেড জাতীয় সমরাস্ত্র নিয়ে আসবেন। গেরিলা যুদ্ধের জন্যে এসব বেশ জরুরি, যা তাঁর কাছে নেই।
এ-সময় আমরাও আজকের পলাশ (তখনকার কালীগঞ্জ থানাধীন) থেকে অজানা পথ পাড়ি দিয়ে আগরতলা যাই। ১৮ এপ্রিল। কিছুদিন পর সেখানকার কলেজটিলা থেকে বাছাই হয়ে ট্রেনিং নিতে যাই মতিনগরে, মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টারে। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ। তাঁর গড়ে তোলা স্টুডেন্টস কোম্পানিতে আমাদের ট্রেনিং শুরু হয় মতিনগরের টিলার চূড়ায়। অল্প কিছুদিন পর এর স্থান পরিবর্তন হয় মেলাঘরে। এখানে একই কোম্পানির ঢাকা প্লাটুনে পরিচয় ঘটে নরসিংদী, রায়পুরা ও শিবপুর থানা থেকে যাওয়া আমাদেরই মতো ছাত্র-তরুণদের সাথে। তারা অনেকেই ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বেশ ক’জন নরসিংদী কলেজের।
মেলাঘরে ট্রেনিং শেষে যখন অস্ত্রশস্ত্রসহ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছে, তখন ন্যাভাল সিরাজ গেলেন ওখানে। গেলেন আমাদের অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আসতে। সেদিন আমাদের লাইন ধরে দাঁড় করানো হয়। সামনে দাঁড়িয়ে সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, মেজর এটিএম হায়দার ও আমার অপরিচিত ন্যাভাল সিরাজ। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করছি, তিনি কে? পাশে দাঁড়ানো কেউ একজন বললেন, তিনি নরসিংদী থেকে এসেছেন। সাদা হাফশার্ট গায়ে পরা নরসিংদীর ঐ-ভদ্রলোকটিই যে ন্যাভাল সিরাজ, তা জানতে বেশি দেরি হলো না। সেক্টর কমান্ডার আমাদের বললেন, স্টুডেন্টস কোম্পানির ঢাকা প্লাটুনের ঢাকা শহরের যোদ্ধারা প্রথম দল হিসেবে কয়দিন আগে গিয়েছে। এবার ঐ-প্লাটুনের দ্বিতীয় দল হিসেবে তোমাদের যাওয়ার পালা। থানাভিত্তিক দল গঠিত হলো। নরসিংদী, শিবপুর, রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার— এই চার থানার জন্যে। পাশের কালীগঞ্জ ও রায়পুরা থানার দল গঠনের প্রয়োজনীয় সংখ্যক যোদ্ধা না থাকায় তাদের এই চার থানায় অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া হলো। চার থানার চারজন থানা কমান্ডার হলেন যথাক্রমে মুহম্মদ ইমামউদ্দিন, আবদুল মান্নান খান, আবদুল জব্বার খান পিনু ও আবদুস সামাদ। আঞ্চলিক কমান্ডার নিয়োগ করা হলো ন্যাভাল সিরাজকে। অতঃপর আমরা ন্যাভাল সিরাজের নেতৃত্বে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ, বিস্ফোরক ও অস্ত্র নিয়ে উল্লেখিত চার থানায় এলাম। আমরাই গোটা অঞ্চলে ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসা প্রথম মুক্তিযোদ্ধা দল।
আমরা এসে নেহাব ও শিবপুরে স্থানীয়ভাবে ট্রেনিং নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিলেমিশে পাকিস্তানি বাহিনির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছি। একেক থানায় একেকভাবে। তবে আগাগোড়া আমাদের আঞ্চলিক কমান্ডার ছিলেন ন্যাভাল সিরাজ। বেশ পরে প্রত্যেক থানায় আরো কিছু মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ এসেছে ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে। তবে তাঁরা ছিলেন ভিন্ন কমান্ডের অধীন।
নরসিংদীতে মুক্তিযুদ্ধ আর ন্যাভাল সিরাজ অনেকটা সমার্থক। সেই যুদ্ধ শুরুর সময় থেকে নরসিংদী মুক্ত হওয়া অবধি। প্রথম যুদ্ধ বাগবাড়িতে, ৯ এপ্রিল। এই যুদ্ধে তিনি ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউরের সাথে। পরের দিন ১০ এপ্রিল পাঁচদোনার যুদ্ধে তিনি ছিলেন অসীম সাহসী বীরের ভূমিকায়। এরপর পাঁচদোনায় আরো দুইবার যুদ্ধ হয়েছে দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি বাহিনির সাথে। সম্মুখ যুদ্ধ। ১৬ আগস্ট ও ১০ অক্টোবর। উভয় যুদ্ধে তাঁর বীরত্বের জুড়ি মেলা ভার। তাঁর অকুতোভয় নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা লড়েছেন জীবন বাজি রেখে। হানাদার বাহিনির বুকে কাঁপন ধরিয়েছেন তিনি ও তাঁর যোদ্ধারা। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ দিয়েছেন, শত্রুর প্রাণ নিয়েছেন, অস্ত্র কেড়ে নিয়ে সেই অস্ত্রে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়েছেন।
তাঁর কমান্ডে শিবপুরের মুক্তিযোদ্ধারা পুটিয়া ব্রিজ উড়িয়েছেন। সেদিনই পুটিয়ার যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনির ক্যাপ্টেন সেলিমসহ ৩১ জনকে হত্যা করা হয়। তিনি নিজে ১৩ ও ১৪ আগস্ট জিনারদী ও মূলপাড়ার যুদ্ধে শত্রুবাহিনিকে কুপোকাত করেছেন। ২০ আগস্ট চিনিশপুরের তিতাস গ্যাস লাইনের স্টেশন এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে অবাক করার মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন। রাতের বেলা গ্যাস স্টেশনটি প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে ১৫-২০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত জনপদকে যেভাবে আলোকিত করেছিলো, তা ছিলো যুদ্ধের এক অবাক করা অভিজ্ঞতা। নরসিংদী শহর ও ঘোড়াশালে অবস্থানকারী পাকিস্তানি বাহিনি ঐ-অবস্থায় ভয়ে ভীত হয়ে ক্যাম্প ছেড়ে দিগ্বিদিক ছুটেছিলো।
পাকিস্তানি বাহিনি তাঁকে হত্যা ও উচ্ছেদের চেষ্টা করেছে প্রথম থেকে শেষাবধি। দুর্ধর্ষ এই পদাতিক বাহিনি ভারি অস্ত্র নিয়ে অন্তত তিনবার তাঁর হেডকোয়ার্টার নেহাব গ্রাম আক্রমণ করেছে। কিন্তু আপামর জনসাধারণ আর অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন-মরণ প্রতিরোধের মুখে প্রতিবারই তারা ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর কৌশলের কাছে পরাভূত হয়েছে শত্রুরা। গেরিলা যুদ্ধের ক্ষেত্রে এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
ন্যাভাল সিরাজের কমান্ডের চার থানার মুক্তিযোদ্ধারা যার যার এলাকায় অনেক সাহসী যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তন্মধ্যে রূপগঞ্জের নাগরীর অভিযান উল্লেখ করার মতো। মাধবদী ও ঘোড়াশালের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ উড়ানোর অপারেশনও এখানে উল্লেখ করা যায়। এছাড়া ন্যাভাল সিরাজ তাঁর কমান্ড এলাকার বাইরেও অনেক দুঃসাহসিক অভিযানে গিয়েছেন সেসব এলাকার জনগণের আগ্রহে। তেমন অভিযান তিনি চালিয়েছেন পূবাইল ও তালটিয়ায়। দুটি অভিযানেই পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনিকে বহন করে নিয়ে যাওয়া ট্রেন আক্রমণ করেন এবং ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের হতাহতের ঘটনা ঘটে। অপর আরেকটি অভিযানে কালীগঞ্জের মসলিন কটন মিলে শত্রুদের ক্যাম্প আক্রমণ করে তিনি তাদের হটিয়ে দেন। তারা মিল ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। অবশেষে ১২ ডিসেম্বর তাঁর নেতৃত্বে নরসিংদী ও শিবপুর থানার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত অভিযানে নরসিংদী শত্রুমুক্ত হয়। সেদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনির জীবিত ২১ জন বন্দী হয়েছিলো তাঁর দলের হাতে।
নরসিংদীর মুক্তিযুদ্ধে কিংবদন্তিতে পরিণত হয় ন্যাভাল সিরাজ। লোকজনের মুখে মুখে তখন তাঁর সাহসিকতা ও বীরত্বের জয়গান, গল্পকথা। যুদ্ধ শুরুর আগে অনেকটা অপরিচিত নৌ-বাহিনি কর্মকর্তা সিরাজ উদ্দিন আহমেদ যুদ্ধ শেষে এক কীর্তিমান জনপ্রিয় মানুষ। তাঁকে একনজর দেখার জন্যে লোকেরা ভিড় করেন সর্বত্র। তিনি যেখানে যান, সেখানেই মানুষের ঢল নামছে। এই দৃশ্য আমি দেখেছি। এবং এমন জনপ্রিয়তা ও খ্যাতিই তাঁর কাল হয়েছিলো পরবর্তীতে।
সে-সময় আমি অনুভব করেছি, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে সমাজ মানসে রূপান্তর ঘটেছে। রণাঙ্গনে জীবন বাজি রাখা, মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসা মানুষগুলোর অনেকের চিন্তায় নতুন স্বপ্ন এসে উঁকি দিচ্ছে। সেই স্বপ্ন মুক্তিযুদ্ধের সময় বেড়ে ওঠা রাষ্ট্রভাবনার। রাষ্ট্র হবে সাম্য ও মৈত্রীর। রাষ্ট্র হবে শোষণহীন, যাতে থাকবে প্রত্যেক মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর নিশ্চয়তা। এমন স্বপ্ন তো সমাজতান্ত্রিক সমাজের।
পাশাপাশি দেখেছি, সামাজিক নতুন দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠছে। মুক্তিযুদ্ধকালে যারা দেশের ভেতরে ছিলেন না, যুদ্ধে প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা পালন করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ দেখেননি, তারা ভাবছেন, মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠারা তাদের পথের কাঁটা। এছাড়া যারা প্রাণের ভয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেনি, চুপটি মেরেছিলেন, কিন্তু মনে মনে ভিন্ন ভাবনা ছিলো, সেই মোড়লরাও নানা রকম কূটচালে নামলেন। উভয়েরই প্রতিপক্ষ যেন মুক্তিযুদ্ধের ‘হিরো’রা। তাদের এক অদ্ভুত মৈত্রী দেখা গেলো মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। এই দ্বন্দ্বের নিরসন হলো না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে হাজারো সমস্যার মাঝে এ নিয়ে ভাবার সময় কারো ছিলো না।
এমন এক প্রেক্ষাপটে ন্যাভাল সিরাজ নৌ-বাহিনির চাকরিতে আর যোগ দিতে গেলেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন রাজনীতি করবেন। তবে চলমান জোয়ারে গা ভাসিয়ে নয়। তাঁর রাজনীতি হবে গণমানুষের পক্ষের, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। সেই স্বপ্ন নিয়ে তিনি মওলানা ভাসানীর দলে যোগ দিলেন। এতে কারো কারো ভ্রু কুচকালো। কিন্তু তিনি কি কোনোকিছুর পরোয়া করেন? না, মোটেও না। একটা পুরোনো হোন্ডার পিঠে চড়ে তিনি সংগঠনের কাজে, মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণের প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা দিতে ঘুরে বেড়ান। আর যেখানে যান, সেখানেই মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হন। তিনি তাতে আরো উজ্জীবিত হন।
১৯৭২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, আড়াইহাজার থানার পুরিন্দায় সাংগঠনিক সফরে যান সেখানকার কিছু লোকের অনুরোধে। হাই স্কুল ভবনে আয়োজন। যেতে হয় পাশের খাল পেরিয়ে। সড়কের পাশে হোন্ডা রেখে তিনি কাঠের পুলটি সবেমাত্র পার হয়েছেন, এমন সময় তাঁর উপর অতর্কিতে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। তিনি খালের পানিতে ঝাঁপ দেন। হয়তো ভেবেছিলেন, পানির নিচে ডুব দিয়ে তিনি বহুদূর চলে যাবেন, যেমনটা তিনি করেছিলেন পাকিস্তানিদের ক্যাম্প আক্রমণ করার বেলায়। কিন্তু এবার তা হলো না। খালে অতোটা পানি ছিলো না। তাঁর উপর আবার গুলি হয়। সঙ্গী কৃষককর্মী লিয়াকত ঝাঁপ দিয়ে পড়ে নিজের শরীর দিয়ে তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পারেননি। দুজনেই গুলিতে নিহত হন। দিবালোকে। চক্রান্তকারীদের নীল নকশায়। এমন ঘটনায় সেদিন পুরো জনপদ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এ যেন এক কমান্ডারের জীবনের ট্র্যাজেডি নয়, পুরো মুক্তিযুদ্ধের ট্র্যাজেডি। যেই বীর যোদ্ধাকে পাকিস্তানি বাহিনি সর্বশক্তি নিয়োজিত করেও কাবু করতে পারেনি, তাঁকেই জীবন দিতে হলো স্বাধীন দেশে ঈর্ষাকাতর সংকীর্ণমনা চক্রান্তকারীদের হাতে। তা-ও দেশ মুক্ত হওয়ার নয় মাসের মাথায়।
এই হত্যার প্রতিবাদে মানুষ ফুঁসে ওঠেছিলো। বিশাল প্রতিবাদ সভা হয়েছিলো ঘোড়াশাল হাই স্কুল আর পাঁচদোনা কে জি গুপ্ত হাই স্কুল মাঠে। দুইটি প্রতিবাদ সভায়ই আমি উপস্থিত ছিলাম। তাঁর ভক্ত সাধারণ মানুষ আর মুক্তিযোদ্ধারা বুক ভাসিয়ে কেঁদেছিলেন। পাঁচদোনার সভায় বয়োবৃদ্ধ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী এসেছিলেন। বক্তৃতা করে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কে জি গুপ্ত স্কুলের মাঠের এক কোণেই এখানকারই মানুষ এই সাহসী বীরকে অন্তিম শয়ানে শায়িত করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসী বীরত্বের জন্যে ন্যাভাল সিরাজ বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত হন স্বাধীনতার পরপরই। নরসিংদীতে জন্মগ্রহণকারী আরো কয়েকজন এ-কারণে খেতাব পেয়েছেন। তবে ন্যাভাল সিরাজই একমাত্র বীর, যিনি নরসিংদীর মাটিতে যুদ্ধ করার কৃতিত্বে-কীর্তিতে তারকা হয়েছিলেন। অন্যরা কেউ যুদ্ধে নরসিংদীতে ছিলেন না, ভূমিকা রেখেছেন অন্য কোথাও। সেদিক থেকে তিনি আছেন অনন্য এক উচ্চতায়, নরসিংদীর মাটির গভীরে শিকড় গেড়ে। তাই যতদিন এই অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা হবে, ততদিন তাঁর স্মৃতি আর অমর কীর্তি ভাস্বর হয়ে থাকবে।
বীরের এই শোণিত ধারার গৌরবগাথা আমরা যেন ভুলে না যাই।
সিরাজ উদ্দিন সাথী
ন্যাভাল সিরাজের সহযোদ্ধা
প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব

