কমরেড লোকমান ছিলেন এক অনিবার্য অনুসূর্য : সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি

রক্ত দাঁড়িয়ে যাও, বুক টানা দিয়ে, ভয়কে ভীষণ
লাঠিপেটা করে, সময়কে কাছা মেরে শক্ত
সাহসের ভেতর, ধূর্ত ধমকের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যাও তুমি,
অব্যক্ত অধিকার, এগিয়ে যাও বারবার;
তোমার মাথায় থাকবে ভয়ঙ্কর লাল নিশান,
তোমার চোখে থাকবে শ্যেনদৃষ্টি,
তোমার মুষ্টিবদ্ধ হাতে ভীষণ
কাঁপতে থাকবে পরিবর্তনের অঙ্গীকার, তুমি সামনে
এগিয়ে যাবে ঝঞ্ঝার মতো, তোমার স্পর্ধায়
ছিন্নভিন্ন হবে নষ্ট নৃপতির নিষ্ঠুর নিগ্রহ, পুরাতন এই গ্রহ।

যার কাছ থেকে আমরা আগুনের ব্যবহার শিখতাম, তার নাম মীর লোকমান। বেঁটে, পেটানো শরীর। স্ফীত বক্ষদেশ। গৈরিক আগুনের চুল্লির মতো দৃষ্টি। অহং চূর্ণ করার আত্মপ্রত্যয় ও তিমিরবিনাশী তীক্ষ্ণ আগুনফলা ছিলো তাঁর চোখে-মুখে। কমরেড লোকমান আমাদের এক অনিবার্য অনুসূর্য। নষ্ট সময়ের দেউড়িতে দাঁড়িয়ে আগুনের বর্ণমালা পড়াতেন আমাদের। কমরেড লোকমান বলতেন, ভেতরের ফ্যাসিবাদী ফসিল পোড়াতে মানুষের চোখে-বুকে আগুন পুষতে হয়, নুয়ে পড়া সময়কে সোজা করতে হৃৎ-আগুনের ব্যবহার জানতে হয়।

শূন্য দশকের তুখোড় সাহসী ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী লোকমান (নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ভিপি পদে নির্বাচন করেন) ২০১২ সালের পর কাঁধে তুলে নেন নরসিংদী জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। সাহস, আত্মপ্রত্যয় ও ত্যাগ-তিতিক্ষাকে পুঁজি করে দারুণ ধাবিত হন সামনের দিকে। সারাদেশে কৃষক নিগ্রহ, লাগামহীন দুর্নীতি, লুটপাট ও পুঁজিবাদের নগ্ন উত্থানের বিরুদ্ধে দারুণ প্রতিবাদী ছিলেন মীর লোকমান। শ্লোগানে শ্লোগানে কাঁপিয়ে দিতেন তখতে তাউশ।

এককালে আমাদের নরসিংদী ছিলো সাহসী সংগ্রামের পাদপীঠ। অগ্নিযুবক সতীশচন্দ্র পাকড়াশী, সোমেন চন্দ, মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ, সুন্দর আলী গান্ধী, বিপ্লবী রহমান মাস্টার, ফয়েজ মাস্টার, কৃষকনেতা ফজলুল হক খোন্দকারের এই নরসিংদী ছিলো সংগ্রাম ও বিপ্লবের  অগ্নিকুণ্ড। কালক্রমে সেই আগ্নেয়গিরি শীতল ও শান্ত হয়ে যায়, সেই সাহসী বিপ্লবীদের চেতনার চাতালে উত্থান ঘটে চরম সুবিধাভোগী, আত্মলীন, শিড়দাঁড়াহীন এক নব্য দালালচক্রের, যারা বিভিন্নভাবে ধ্বংস করেছে আমাদের তাঁতশিল্প, ধ্বংস করেছে আমাদের কৃষি, ধ্বংস করেছে আমাদের ভূ-রাজনীতি।

আওয়াজ যতো ছোটো ও ক্ষীণই হোক, তবু ভোগবাদী সমাজব্যবস্থার বিপরীতে সমগ্র বাংলাদেশে অবিরাম যে-প্রতিবাদী আওয়াজ উচ্চারিত হয়েছে, কমরেড লোকমান ছিলেন সেই আওয়াজে আমাদের নরসিংদীর এক শক্তিমান সান্ত্রী। বিশেষ করে, স্বাধীনতার পরে সারা দেশে ধীরে ধীরে চোর ও লুটেরা শ্রেণির উদ্ভব হয়। চোরাচালানি, মুনাফাখোরি, লাগামহীন ঘুষ-দুর্নীতির কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুর আর্তচিৎকার তখন তাদের কানে ঢোকেনি। তবু তখনো বাম রাজনীতির একটি প্রোজ্জ্বল শক্তিশালী শিখা আমাদের পথ দেখিয়ে গেছে। কিন্তু ১৯৯১ সালে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতনের পর আমাদের দেশেও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অপমৃত্যু হয়। ঝঞ্ঝাক্রান্ত জাহাজের মতো সীমাহীন সমুদ্রে দিকভ্রান্ত হয়েছে আমাদের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। তবু সারাদেশে প্রগতি ও প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে যে-আন্দোলন মাথা উঁচু করে এগিয়ে গেছে সাম্য ও শান্তির ঝাণ্ডা উড়িয়ে, তার নাম বাম আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বা কমিউনিস্ট আন্দোলন। আওয়াজ যতো ছোটো ও ক্ষীণই হোক, তবু ভোগবাদী সমাজব্যবস্থার বিপরীতে সমগ্র বাংলাদেশে অবিরাম যে-প্রতিবাদী আওয়াজ উচ্চারিত হয়েছে, কমরেড লোকমান ছিলেন সেই আওয়াজে আমাদের নরসিংদীর এক শক্তিমান সান্ত্রী। ততোক্ষণে রাজনীতি চলে যায় পুঁজিবাদীদের হাতে, একধরনের ভূঁইফোড় ব্যবসায়ীরা রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। সমাজতন্ত্রের বদলে মাঠে নামে ভোগবাদের বলগা ঘোড়া। সেই ঘোড়ার তীক্ষ্ণ খুঁড়ের তলে শ্রমজীবী মানুষ যখন নিষ্ঠুরভাবে দলিত হতে থাকে, ঠিক তখনই অনেকটা হেরাল্ডের মতো নরসিংদীর বাম রাজনীতিতে উদিত হন কমরেড লোকমান।

শূন্য দশকের তুখোড় সাহসী ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী লোকমান (নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ভিপি পদে নির্বাচন করেন) ২০১২ সালের পর কাঁধে তুলে নেন নরসিংদী জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। সাহস, আত্মপ্রত্যয় ও ত্যাগ-তিতিক্ষাকে পুঁজি করে দারুণ ধাবিত হন সামনের দিকে। সারাদেশে কৃষক নিগ্রহ, লাগামহীন দুর্নীতি, লুটপাট ও পুঁজিবাদের নগ্ন উত্থানের বিরুদ্ধে দারুণ প্রতিবাদী ছিলেন মীর লোকমান। শ্লোগানে শ্লোগানে কাঁপিয়ে দিতেন তখতে তাউশ।

‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক, নিপাত যাক’, ‘মৌলবাদের আস্তানা, ভেঙ্গে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’, ‘কেউ খাবে তো কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না’, ‘জাল যার জলা তার, লাঙ্গল যার জমিন তার’— এসব শ্লোগান দিতে দিতে মীর লোকমান যেন মিশে যেতেন ইকারুসের আকাশে।

কমরেড লোকমান একজন শ্লোগানসৈনিক, সম্মোহনী শক্তিসম্পন্ন আবৃত্তিশিল্পী ও চারণরাজনীতিবিদ। তবে ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন বেশ অগোছালো ও উদাসীন। জীবনের জটিল জিজ্ঞাসাকে অবজ্ঞা করতেন অবলীলায়। সেজন্যে হোক বা অন্য কোনো কারণে হোক, এই দ্রোহী সত্তা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন ২০১৮ সালের ২০ আগস্ট, মাত্র ঊনচল্লিশ বছর বয়সে। হঠাৎ এমন নান্দনিক নক্ষত্রের পতনে আমরা খুব ব্যথিত হয়েছি, তবে বিস্মিত হইনি। কারণ, এই দেশে দুপুরেও সন্ধ্যা নামে!

চেতনায় বেঁচে থাকো কমরেড।


মহসিন খোন্দকার
সাধারণ সম্পাদক, প্রগতি লেখক সংঘ, নরসিংদী

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ