“পৃথিবীতে জন্ম মানেই মৃত্যু। আমাদের জীবন এবং পার্থিব অস্তিত্বের প্রারম্ভ জন্ম দিয়ে এবং এর অনিবার্য সমাপ্তি মৃত্যুতে।”— এই মহাসত্য আমাদের মানতেই হবে, কিন্তু মৃত্যু যখন হয় অকালে, তখন তা মানতে কষ্ট হয়, নানা প্রশ্নে মন জর্জরিত হয়, হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়।
মানুষের জীবনের আয়ুষ্কাল খুব বেশি নয়। শত বছরের উপরের সংখ্যা গণনার মধ্যে আসে না। আশি-নব্বই বছর বাঁচার সংখ্যাও কম। জীবন চলার নানা পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু সম্ভবত বর্তমানে সত্তরের মতো। রিপন ইউসুফ এই বেঁচে থাকার জীবন-সংগ্রামে সেই আয়ুও পেলো না। রিপন মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীতে এসেছিলো ১৯৮৮ সালের ১৯ মার্চ (যদিও স্কুলের একজন শিক্ষক এসএসসি রেজিস্ট্রেশনে তার জন্মসাল ১৯৯১ উল্লেখ করে দেন)। আর পৃথিবী ছেড়ে, আমাদের ছেড়ে চির বিদায় নিয়েছে ২০২৫ সালের ১৯ জুলাই, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে, শেষ বিকেলে। ৩৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ইহজগত থেকে অনন্তে যাত্রা। তার এই অকাল প্রয়াণের শোক আমরা বন্ধু-স্বজন, আত্মীয়-পরিজন— সবাই মেনে নিয়েছি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে, আর স্মরণ করছি তার স্মৃতিকে।
রিপন ইউসুফের পৈতৃক বাড়ি নরসিংদীর মেঘনার চরাঞ্চল নজরপুর ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামে। জন্ম নিয়েছেন নরসিংদী শহরের বৌয়াকুড়ে। শৈশব-যৌবন কেটেছে নরসিংদী শহরেই। লেখাপড়া শুরু শিশুবাগ বিদ্যাপীঠ থেকে, তারপর ব্রাহ্মন্দী কামিনী কিশোর মৌলিক উচ্চ বিদ্যালয়, নরসিংদী সরকারি কলেজ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রথমে শান্তা মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়াশোনা করেছেন ফ্যাশন ডিজাইনের উপর। তারপর সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে।
রিপন ইউসুফের বাবা জাহাঙ্গীর আলম ডাক বিভাগের পরিদর্শক পদে চাকরিরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। নরসিংদী সদরের চিনিশপুর ইউনিয়নস্থ টাওয়াদী গ্রামে বাড়ি করে পরিবার নিয়ে থাকতেন। রিপনের মা গৃহিণী, বাবার অনুপস্থিতিতে মা-ই ছেলেদের নিয়ে সংসারের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। রিপনরা দুই ভাই— রাসেল ওয়ালিদ বড়ো, রিপন ছোটো।
লেখালেখিতেও রিপন তার সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, অনুবাদেও তার হাত ভালো ছিলো। এসব মাধ্যমে ছোটো ছোটো করে লেখাগুলোর মধ্যে তাকে আলাদা করে চেনা যেতো। রূপক-প্রতীকে সুনিপুণ অলঙ্কৃত শব্দ ব্যবহারে তার লেখাগুলো অন্যদের থেকে আলাদা এবং শিল্পমর্যাদায় উন্নীত হতে পেরেছে বলে আমি মনে করি।
রাসেল ও রিপন ভাই হলেও সম্পর্ক ছিলো বন্ধুত্বের, পরস্পরের বোঝাপড়া ছিলো অনেক সুন্দর। রাসেল বিয়ে করেছে, একটি কন্যা সন্তানও এসেছে এই পরিবারে। সবাইকে নিয়ে মায়ের নেতৃত্বে সংসার চলছিলো পরিকল্পিতভাবে। এর মধ্যে রিপনের দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া এবং অকালে চির বিদায়ে পরিবারটি নতুন জীবন-সংগ্রামের মুখোমুখি হয়েছে।
রিপনের সাথে আমার পরিচয় নরসিংদী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব থেকে ২০০৯ সালের শেষে অবসর নেয়ার পর। নাজমুল আলম সোহাগ (আমার স্নেহভাজন ছাত্র) নরসিংদীর খালপাড় চেয়ারম্যান মার্কেটে বই-পুস্তক লাইব্রেরি দেয়ার পর সেখানে দিনের নানা সময়ের আড্ডায় বসতাম। সেখানে রিপনও আসতো। আসতো জহির মৃধা, মাইনুল, মিরু, প্রণব, লিংকন, সনেট, শাদমান শাহিদ, সুমন ইউসুফ, শাহীন সোহান, মীর লোকমান, মমিন আফ্রাদ, অনির্বাণ মাহবুব, রাসেল ওয়ালিদসহ আরো অনেকে, যাদের অধিকাংশ আমার ছাত্র। জীবন চলার পথে শিশু, প্রবীণ, আমার সহকর্মীরা যেমন আমার বন্ধু, তেমনি আমার তরুণ ছাত্ররা, ছাত্রতুল্যরাও আমার সবচাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই বন্ধুদের আড্ডায় রিপন ইউসুফ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। এই দৃষ্টি আকর্ষণের প্রথম এবং প্রধান বিষয় ছিলো বই। নতুন বইয়ের সন্ধান তার কাছে পাওয়া যেতো। আমি ছাত্রজীবন থেকেই বই পাগল ছিলাম। এ নিয়ে অনেক গল্প-কথা আছে। এখনো বই পড়া-বই সংগ্রহ করার অভ্যাস চলমান। রিপনের বই পড়া এবং বই সংগ্রহের নেশা ছিলো। প্রথমত বই পড়া, নতুন বইয়ের সন্ধান এবং সংগ্রহের আগ্রহের মিল থেকেই তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। আমার লাইব্রেরিতে আড্ডায় বসা, রিপনের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতেও তার নিজস্ব কক্ষে আড্ডায় বসে আমাদের আলাপচারিতা বাড়তে থাকে। আলাপচারিতায় প্রাধান্য পায় সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, চলচ্চিত্র। এসব বিষয়ে দুর্লভ এবং নতুন বই আমি রিপনের মাধ্যমে সংগ্রহ করার সুযোগ পাই। অনেক বই, যেগুলোর হার্ডকপি (সরাসরি প্রিন্ট কপি) পাওয়ার সুযোগ ছিলো না, সেগুলো অনলাইন থেকে বের করে নিজে পড়তো এবং আমাকেও পিডিএফ করে পড়ার ব্যবস্থা করে দিতো। এসব বিষয়ে জ্ঞানের জগতে তার সাথে আমার একটি ভিন্নমাত্রিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
বইকেন্দ্রিক আড্ডার পাশাপাশি চলচ্চিত্র নিয়ে কথা, চলচ্চিত্র দেখা সমতালে চলতে থাকে। প্রায় সকল জনরার ছবি দেখার অভ্যাস ছিলো তার। বইয়ের মতো চলচ্চিত্র নিয়েও অনেক আগ্রহ ছিলো রিপন ইউসুফের। সারা পৃথিবীর সকল ভাষার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র দেখার বাসনা থেকে সে ল্যাপটপে ডাউনলোড করতো ছবিগুলো। আমি সেখান থেকে পেনড্রাইভে করে টেলিভিশনের বড়ো পর্দায় দেখতাম নিয়মিত। কখনো কখনো রিপনও আমার সাথে থাকতো। রিপন বাড়িতে দেখতো তার মোবাইল এবং ল্যাপটপে। অনেক ছবি ভাষার সমস্যার কারণে বুঝতে অসুবিধা হতো, সেগুলো নিয়ে তার সাথে কথা হতো। ছবি দেখতে দেখতে চলচ্চিত্রকে বোঝার অনেক পরিপক্বতা এসেছিলো রিপনের। তানভীর মোকাম্মেলের চলচ্চিত্র বিষয়ক অনেক কর্মশালায় অংশ নিয়ে চলচ্চিত্র বিষয়ে তার শিক্ষা চলচ্চিত্রকে ভালোভাবে বোঝার শক্তি তৈরি করেছিলো। তার সাথে এ-বিষয়ে যুক্ত হয়ে আমিও অসংখ্য পেনড্রাইভে পাগলের মতো প্রায় কয়েক শতক ভালো মানের দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র সংগ্রহ করে ফেলি। সাথে সাথে আমার পাঠাগারে চলচ্চিত্র বিষয়ক বইয়ের সংখ্যাও অনেক পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। নরসিংদী শিল্পকলা একাডেমির চলচ্চিত্র সংসদেও রিপনকে যুক্ত করে ফেলি। সেখানে চলচ্চিত্র উৎসবের ছবি ছাড়াও বিভিন্ন সময় পর্দায় অনেক ছবি দেখার সুযোগ তৈরি হয়। রিপনের মাধ্যমে আমার কয়েক শতক ছবির সংগ্রহের তালিকা থেকে বিশ্বসেরা কয়েকটি চলচ্চিত্রের নাম উল্লেখ না করে পারছি না। ‘মন্তাজ’-এর সফল পরীক্ষামূলক ছবি রাশিয়ার পরিচালক সের্গেই আইজেনস্টাইনের ‘দ্য ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’, চার্লি চ্যাপলিনের ‘মডার্ন টাইমস’, ইতালির পরিচালক ভিত্তরিও ডিসিকার ‘বাইসাইকেল থিভস’, ‘টু উইমেন’, ‘সানফ্লাওয়ার’, জাপানের পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়ার ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ফ্রান্সের পরিচালক জ্যাঁ রেঁনেয়ার ‘দ্য রিভার’, আলফ্রেড হিচককের ‘দ্য বার্ডস’, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ছবি ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ছবি ‘দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কাউয়াই’, ‘ব্যালাড অব অ্যা সোলজার’, ব্রাজিলের ছবি ‘সিটি অব গড’, ইরানের পরিচালক মাজিদ মাজেদি’র ‘চিলড্রেন অব হ্যাভেন’, দক্ষিণ কোরিয়ার পরিচালক কিম কি দুকের মহামতি গৌতম বুদ্ধের দর্শন নিয়ে অসাধারণ ছবি ‘স্প্রিং-সামার-ফল-উইন্টার অ্যান্ড স্প্রিং’।
এভাবে বাংলাদেশ, ভারত, আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান, ইতালি, স্পেন, ইসরাইল, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, ইরান, কোরিয়াসহ সারা পৃথিবীর ছবি আমরা দেখেছি। ছবি পর্যালোচনা করেছি। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, বাংলাদেশের তারেক মাসুদের ছবি দেখা এবং আলোচনা প্রাধান্য পেতো। রিপন আজ নেই, সবই যেন স্মৃতির পাতায় জমা হয়ে গেলো। আর শূন্যতা আর একাকিত্বের মধ্যে পড়ে গেলাম আমি।
রিপনের লেখালেখির পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণের আকাঙ্ক্ষাও ছিলো প্রবল। চলচ্চিত্র পরিচালকদের সাথে যুক্তও হয়েছিলেন। নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করেছিলেন। পরীক্ষামূলকভাবে শর্টফিল্ম নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছিলেন। ‘দৃশ্যকল্পদ্রুম’ প্রযোজনা সংস্থার মাধ্যমে তার নির্মিত শর্টফিল্ম ‘রাস্তার কোণার লোক’-এর মধ্যে আমরা তার সম্ভাবনার চিহ্ন পেয়েছিলাম।
লেখালেখিতেও রিপন তার সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, অনুবাদেও তার হাত ভালো ছিলো। এসব মাধ্যমে ছোটো ছোটো করে লেখাগুলোর মধ্যে তাকে আলাদা করে চেনা যেতো। রূপক-প্রতীকে সুনিপুণ অলঙ্কৃত শব্দ ব্যবহারে তার লেখাগুলো অন্যদের থেকে আলাদা এবং শিল্পমর্যাদায় উন্নীত হতে পেরেছে বলে আমি মনে করি।
দীর্ঘ লেখার সুযোগ নেই, ‘গঙ্গাঋদ্ধি’তে প্রকাশিত তার শেষ কয়েকটি লেখা নিয়ে সংক্ষিপ্ত করে কিছু বলা যায়। ‘গঙ্গাঋদ্ধি’র ডিসেম্বর ২০২৪ সংখ্যায় তার প্রকাশিত কবিতা ‘রাষ্ট্র, তোমারে ধরতে চেষ্টা করতেছি, পারতেছি না’ কবিতাটি দেখতে পারি :
দিন দিন তুমি কেমন বিটকয়েন হইয়া যাইতেছো রাষ্ট্র! কেমন ক্রিপ্টোময়, নাগালের বাইরে। তোমারে ধরতে চেষ্টা করতেছি। পারতেছি না। এই মৃতপ্রায় হেমন্তের দিনগুলোতে তোমারে নিয়া ভাবতে বসলে প্রটোকল মাইনিং কইরা চলতে হয়। না জানি কোন ট্যাগের টেলিগ্রাম আসে! অথচ আমরা ভাবছি ভবিষ্যত হইবে ক্যাশলেস, বাইন্যান্সময়। আর মনোনয়ন পাবে, সমতার বন্দোবস্ত। কিন্তু তাকায়া দেখি পুরোনো চিন্তার নতুন নতুন এয়ারড্রপ। সত্যিই, দিন দিন তুমি কেবল বিটকয়েনই হইয়া উঠতেছো রাষ্ট্র, এক্কেরে নাগালের বাইরে। তোমারে বাঁধতে পারতেছি না এমন কোনো ব্লকচেইনে, যেখানে রাষ্ট্র হবে না কেবল ক্ষমতাবানদের, রাষ্ট্র হবে না কেবল শুয়োরের বাচ্চাদের!
ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই, রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কণ্ঠে প্রতিনিয়ত যা ধ্বনিত হচ্ছে, তারই ভিন্নমাত্রিক কবিতার শৈল্পিক আঙ্গিকে প্রকাশ। নরসিংদী জেলার কাগজ ‘গঙ্গাঋদ্ধি’র ত্রৈমাসিক সাহিত্য সাময়িকী ‘গগনশিরীষ’ ২০২৫-এর মে সংখ্যায় রিপনের প্রকাশিত গল্প ‘একটি লাশের তদন্ত’। গল্পটি আমার খুবই ভালো লেগেছে। রূপক-প্রতীকের খোলসে এই ছোটো পরিসরের গল্পটিতে তার সৃষ্টিশীল সাহিত্যরূপের স্বাদ পেয়েছি।
‘গগনশিরীষ’-এর দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রবন্ধ আঙ্গিকে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা ‘কেন ভূমিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ; প্রসঙ্গ রাজনৈতিক বাঙলাদেশ’ ছাপা হয়েছে। প্রবন্ধটিতে বাঙালির ইতিহাস পর্ব বিশ্লেষণে ভূমিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব ও যুক্তিগ্রাহ্যতা তুলে ধরেছেন সুন্দরভাবে এবং প্রবন্ধের শেষ অংশে ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের’ বাস্তবতা উল্লেখ করে স্পষ্টত বলেছেন, “ভবিষ্যত পৃথিবীর ‘পুঁজি’ স্বাভাবিকভাবেই ‘প্রযুক্তি’। ‘প্রযুক্তি’ই নিয়ন্ত্রণ করবে ভবিষ্যত।” রাজনৈতিক বাংলাদেশে কল্যাণকর জীবনের জন্যে পরিবর্তিত ‘পুঁজি’তে আমাদের অবস্থান কী হবে, এই প্রশ্ন রেখে প্রবন্ধটি শেষ করেছেন। বিষয়টি আমাদের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অনুবাদেও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন রিপন। ‘গঙ্গাঋদ্ধি’র প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় মার্কিন লেখক ও কার্টুনিস্ট জেমস থারবার (১৮৯৪-১৯৬১)-এর Fables for Our Time and Famous Poems Illustrated গ্রন্থের The Rabbits Who Caused All The Trouble গল্পটির বাংলা অনুবাদ ‘খরগোশের বাচ্চারা, যারা ছিলো সমস্ত ফ্যাসাদের মূলে’ প্রকাশিত হয়েছে। ছোটোগল্পটি খুবই অল্প কথার। কিন্তু গল্প শেষে অসাধারণ একটি ম্যাসেজ রয়েছে, “এই পৃথিবীতে পালিয়ে যাওয়াদের কোনো স্থান নেই। …দৌড়াও। যতোদূর দৌড়াতে পারো।”
পূর্বেই বলেছি, রিপনের লেখালেখি শিল্পের মানে উত্তীর্ণ। রিপন নেই, আমরা যারা আছি, আমাদের দায়িত্ব তার অল্প পরমায়ুর জীবনে যেসব সাহিত্যকর্ম রয়েছে, তা দ্রুত গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে তার সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখা।
রিপন আড্ডাপ্রিয় মানুষ ছিলো। আড্ডা আমারও পছন্দ। আমাদের আড্ডা ছিলো ঘরে-বাইরে। আড্ডা হলো পছন্দমতো জায়গায় একত্রে বসে অবাধ ও স্বতঃস্ফূর্ত কথোপকথন, যা প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখে, যেখান থেকে প্রাণ নতুন করে জন্ম লাভ করে। রিপন আড্ডা দিতো নজরপুরের চেঙ্গাতলী বাজারের চায়ের দোকানে, বদরপুর ব্রিজ সংলগ্ন চায়ের দোকানে, বটতলা বাজারের চায়ের দোকানে, গ্রন্থকল্পদ্রুম, বই-পুস্তক লাইব্রেরিসহ আরো অনেক স্থানে। টেলিফোনে জানতে চাইতাম, রিপন তুমি কোথায়? উত্তর আসতো চেঙ্গাতলী, বদরপুর, বটতলা বাজার। এই তিন জায়গাতেই আড্ডা বেশি চলতো, বিদায়বেলায় বই-পুস্তক ও ছাপাঘরে। আড্ডায় শুধু নানা বিষয়ে কথোপকথনই নয়, চলতো শিল্প-সাহিত্যের চর্চাও।
রিপন আজ নেই, মনে পড়ছে অনেক কথা, অনেক স্মৃতিময় সময়। পারিবারিক-ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আমার সাথে পরামর্শ করতো। বাবার অনুপস্থিতিতে মা, বড়ো ভাইকে নিয়ে সংসার পরিচালনা বিষয়ে কথা হতো। কথা হতো একটি মানসম্মত বইয়ের দোকান গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ‘গ্রন্থকল্পদ্রুম’ প্রতিষ্ঠা বিষয়ে, সিনেমা নির্মাণ প্রসঙ্গে, আমাকে নিয়ে ‘মৃদুস্বরের উজ্জ্বল আলো’ গ্রন্থ প্রকাশ বিষয়ে। গ্রন্থটি প্রকাশে সুমন ইউসুফ, শাহীন সোহান, শাহীনুর মিয়ার সাথে রিপন ইউসুফেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অংশগ্রহণ ছিলো। একদিন দীর্ঘসময় তার জীবনের কথা, একটি মেয়েকে ভালোবাসার কথা, জীবনের নানা পরিকল্পনার কথা শুনেছিলাম— সবই আজ স্মৃতি।
২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে রিপন অসুস্থ হয়ে পড়লো। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ‘সিআইডিপি’ নামক দুরারোগ্য ব্যাধি শনাক্ত হলো। ডাক্তারই তাকে বলেছিলো, এই রোগ ভালো হওয়ার নয়, নানা উপসর্গ নিয়ে জীবনের সমাপ্তি ঘটবে। শুরুও হয়েছিলো সেসব অবস্থা : হাঁটতে না পারা, চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলা। সে চেষ্টা করেছিলো মানসিক শক্তি নিয়ে সব মোকাবেলা করার। মা-বড়ো ভাই রাসেল চিকিৎসার কোনো ত্রুটি করেনি। আমরাও ডাক্তারদের সাথে কথা বলেছি। ডাক্তারদের কথা, চিকিৎসা চলবে, কিন্তু রোগের চির মুক্তি ঘটবে না। অসুস্থতার সময়গুলোতে তার মনের অবস্থার কথা ভাবতে গিয়ে হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
একদিন সময় এলো। জীবনের অনেক স্বপ্নকে অপূর্ণ রেখে হলো তার চির বিদায়। নবীপুর কবরস্থানে নির্জনে ঘুমিয়ে আছে রিপন ইউসুফ। তার আত্মার শান্তি হোক।
গোলাম মোস্তাফা মিয়া
সাবেক অধ্যক্ষ, নরসিংদী সরকারি কলেজ