মানিকদী
শিবপুরের দুলালপুর ইউনিয়নের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ‘মানিকদী’ বহুল পরিচিত ও শিক্ষায় অগ্রসরমান একটি গ্রাম। ব্রিটিশ আমলের আগে থেকেই এ-গ্রামের মানুষ শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে অনেক এগিয়ে ছিলো। শিক্ষার হার বেশি থাকায় চাকরি-বাকরিতেও তারা অগ্রগামী ছিলো। এ-গ্রামের নামকরণ প্রসঙ্গে জানা যায়, এলাকাটি ছিলো হিন্দুপ্রধান। তৎসময়ে হিন্দুদের মধ্যে কোনো-এক সদ্বংশীয় প্রভাব ও প্রতিপত্তিশালী স্বর্গীয় মানিক বাবুর নামানুসারে গ্রামের নাম রাখা হয়েছিলো ‘মানিকদী’। গ্রামের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ। সুপ্রিম কোর্টের একসময়ের যশস্বী এডভোকেট মরহুম মোজাফ্ফর আহমেদ এবং তাঁর ছেলে স্বনামধন্য বিচারপতি মরহুম মাসুক আহমদ মানিকদীরই কৃতী সন্তান। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব অন্তিম চন্দ্র সেনের কাছ থেকে জানা যায়, মানিকদী গ্রামটি একসময় নদীতে ডুবে ছিলো। এখানে ক্রমাগত চর পড়ে। চরে উর্বর ফসল ফলতো। এমন ফসল ফলার কারণে অন্যান্য এলাকার মানুষদের এই এলাকা আকর্ষণ করতো ও টেনে নিয়ে আসতো। সেই উর্বর ফসলের কারণে মানুষজন বলতো ‘এখানে মানিক ফলে’। আর এভাবেই গ্রামটি পেয়ে যায় ‘মানিকদী’ নাম। এ-গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মানিকদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৯ সালেরও পূর্বে। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্বর্গীয় সুরেন্দ্র চন্দ্র দাশ। সুরেন্দ্র বাবু এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকও ছিলেন। প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন আবদুল কুদ্দুস পণ্ডিত। জমিদাতা ছিলেন মরহুম সেকান্দর আলী। বিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোক্তার হোসেন, জেলা রেজিস্ট্রার মাহমুদুর রহমান রিপন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাহমিনা বেগম, জেলা কৃষি অফিসার বাদল চন্দ্র ঘোষ এবং জীবন বীমা করপোরেশনের পরিচালক সুধাংশু চন্দ্র ঘোষ।
ভিটিচিনাদী
বিখ্যাত, সুপরিচিত এবং দৃষ্টিনন্দন চিনাদী বিলের পূর্বপাড়ে চিনাদী বিলের সৌন্দর্য, সম্পদ ও মৎস্য আহরণের সুবিধা পেয়ে এখানে ব্যাপক হারে মানুষের বসবাস আরম্ভ হয়েছিলো। বসবাসের জন্যে বিলের পাড়ে বাড়ি বানানোর প্রয়োজন হয়। বাড়ি বানানোর আগে ভিটি তৈরি করতে হতো। জোরেশোরে মানুষের মধ্যে ভিটি তৈরি শুরু হয়েছিলো। ভিটি তৈরির ধুমধাম থেকেই গ্রামের নাম হয়ে যায় ‘ভিটিচিনাদী’। গ্রামটি এখনো হিন্দু অধ্যুষিত এবং প্রায় ষাট ভাগ হিন্দুদের বসবাস রয়েছে। গ্রামের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিটিচিনাদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৯৬৯ সালে। স্থানীয় নিরীহ মৎস্যজীবী মানুষের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুলালপুর তথা শিবপুরের কিংবদন্তীতুল্য চেয়ারম্যান মরহুম মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ। শিক্ষানুরাগী এই চেয়ারম্যান বিদ্যালয়ের জন্যে জমিরও ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন মরহুম রইস উদ্দিন ভূঁইয়া। প্রখ্যাত ভেটেরিনারি ডাক্তার বদর উদ্দীন এ-বিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র ছিলেন।
গড়বাড়ি
শিবপুরের বর্তমান গড়বাড়ি এলাকা একসময় সুপ্রসিদ্ধ ভাওয়াল রাজার এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। এলাকায় দুটি মৌজা ছিলো, যার একটি ‘গুদ্দ মহেশ্বরদী’ এবং অপরটি ‘নগর মহেশ্বরদী’। এই দুটি নামের মৌজা এখনো চালু রয়েছে। কিন্তু একসময় গড়বাড়ি এলাকা নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়। অর্থাৎ এলাকা মৌজাভুক্ত করতে সমস্যায় পড়তে হয়। কোন এলাকা কোন মৌজার অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তা নিয়েই ছিলো বিভ্রান্তি। এই পরিস্থিতিতে এলাকার জন্যে একটি গড় হিসেব করার পরামর্শ পাওয়া যায়। পরামর্শ মোতাবেক গড় করা থেকেই গ্রামের নাম হয়েছে ‘গড়বাড়ি’। গড়বাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন অভিজ্ঞ ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের সাথে আলোচনা করে একই অভিমত পাওয়া যায়। গড়টি করার পরামর্শ এসেছিলো ভাওয়াল রাজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে। অর্থাৎ গড় করে সমীকরণের মাধ্যমে মৌজাভুক্ত করা হয়েছিলো এলাকাটিকে। এলাকায় সুপরিচিত নাজির বাড়ির শিক্ষক জনাব আবদুল বাছেদ নাজিরের নিকট থেকে জানা যায় গড়বাড়ির বিভিন্ন ঐতিহ্যের কথা। ভাওয়াল রাজের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়বাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় ১৯৩৯ সালে। প্রথমদিকে বিদ্যালয় ভবন ছিলো স্থানীয় ঠাকুর বাড়িতে। প্রথম জমিও দিয়েছিলেন ঠাকুর বাড়ির কেউ একজন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, প্রতিষ্ঠার সময় বিদ্যালয়ের নাম ছিলো ‘গুদ্দ মহেশ্বরদী ফ্রি মডেল স্কুল’। পাশাপাশি ক্যাম্পাসে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর গড়ে ওঠেছে এম এ রশিদ উচ্চ বিদ্যালয়। উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও জমিদাতা মোহাম্মদ আবদুর রশিদ স্বয়ং। এ-দুটি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল অর্জন করে যারা জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিপ্লব নাজির।
সাতপাইকা
সাতপাইকা অঞ্চলটি একসময় হিন্দু অধ্যুষিত ছিলো। হিন্দুদের একটি সুপরিচিত বাড়ি ছিলো ঠাকুর বাড়ি। মজার বিষয় হলো, এলাকায় কোনো জমিদার বা জমিদারি ছিলো না। কিন্তু এখানে পাইকদের বসবাস ছিলো। জানা যায়, অন্যান্য সব এলাকার জমিদারদের পাইকেরা বর্তমান সাতপাইকা এলাকায় বাড়িঘর নির্মাণ করে বসবাস করতো। ওই সমস্ত পাইকদের মধ্যে সাতজন ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী ও নামিদামি। আর সেই পাইকদের মধ্যে প্রভাবশালী সাতজন পাইকের কারণে গ্রামের নাম হয়ে যায় ‘সাতপাইক’, যার বর্তমান নাম ‘সাতপাইকা’। সেই গ্রামের এক সাহসী ব্যক্তির নাম ছিলো গোপাল গুপ্ত। গোপাল গুপ্ত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় যোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ স্পাইদের বিশেষ তৎপরতার কারণে দুভার্গ্যবশত গোপাল গুপ্ত এলাকা ছেড়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। সাতপাইকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি মোটামুটি পুরাতন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৩০ সালে। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জহর উদ্দীন প্রধান ও জাব্বার প্রধান। প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন স্বর্গীয় ঈশ্বর চন্দ্র দাশ। জমি দিয়েছিলেন জহর উদ্দীন প্রধান ও জাব্বার প্রধান। সাতপাইকা স্কুলের স্বনামধন্য ছাত্র ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মিয়ার উদ্দীন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মিয়ার উদ্দীন ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে শিবপুরের পুটিয়া রণাঙ্গনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। মিয়ার উদ্দীনের ভাই এবং বাংলাদেশ গ্লাস ও সিরামিকসের প্রিন্সিপাল মুসলেউদ্দীনও সাতপাইকা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। সচিব আবু বকর সিদ্দিক এ-স্কুলেরই ছাত্র। সাতপাইকা গ্রামের অভিজ্ঞ মুরুব্বি সাবেক ব্যাংক ম্যানেজার তাইজদ্দিন সাহেবের কাছ থেকে গ্রাম ও স্কুল সংক্রান্ত অনেক তথ্য পাওয়া গেছে।
লেখক : সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার