বাংলাদেশ খাল, বিল আর নদীর দেশ। নদীর তীর, খালের ধার ও বিলের পাড় বাঙালিদের ঠিকানা। নরসিংদীর শিবপুরে রয়েছে এমন একটি সুপরিচিত বিল। নলুয়া বিল। অনেকে বলেন নল্লা বিল। শিবপুরের মানুষ অথচ নলুয়া বিল চেনেন না, এমনটি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শিবপুর সদর ঘেঁষা উত্তরের এই বিলের পূর্ব পাশের গ্রামের নাম পূবেরগাঁও। ’৭১-এর বীর মুক্তিযোদ্ধা বেদন মৃধা এই পূবেরগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন। এ-বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্যে পূবেরগাঁওয়ের মানুষ গর্ব বোধ করেন। বিলের উত্তরে ঐ দেখা যায় মজলিশপুর গ্রাম। পশ্চিমে বসবাস করেন ধানুয়া, সৈয়দেরগাঁও এবং আবদুলখানা গ্রামের অধিবাসীরা। নলুয়া বিল এসব গ্রামের মানুষজনের নিত্যসঙ্গী, চলার সাথী। বিল হতে বাহিত নির্মল বাতাসে গ্রামবাসীগণ নিঃশ্বাস ফেলেন। সুন্দর পরিবেশ আর মৃদুমন্দ বাতাস এনে দেয় তাঁদের অফুরন্ত প্রাণোচ্ছল সজীবতা।
শিবপুর উপজেলায় এমন আরো অনেক বিল রয়েছে। বিখ্যাত চিনাদী বিল, গড়িয়া, দোপাথর, রমরমা, মলাডাঙ্গা, আতরকাঠি ও খাজ্জা বিলসহ পাহাড়ি অঞ্চলে ছোটো-বড়ো অনেক খরস্রোতা বিল এখনো কালের সাক্ষী হয়ে আছে। তবে নলুয়া বিলটি যেন সমধিক পরিচিত। এ-বিলের ধার বেয়ে চলে গেছে শিবপুর-চরসিন্দুর, শিবপুর-লাখপুরের অতি পুরাতন বৃহৎ পাকা রাস্তা। নলুয়া কলাগাছিয়া নদীর সাথে সংযোগ রক্ষা করে আছে সেই অতীতকাল থেকেই। বর্ষার সময় কলাগাছিয়া নদীতে নতুন পানি এলে নলুয়া প্রাণ ফিরে পায়। বিলের পশ্চিম পাড়ে এককালের হিন্দু তীর্থস্থানের মতো আঙ্গুলখোলা বাজার ছিলো। প্রতিবছর সেই বাজারে অনেক বড়ো বৈশাখী মেলা বসতো। খোলামেলা সুন্দর পরিবেশে তখনকার মেলার দিনে বিলপাড়ের মানুষেরা আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠতো। বিলের বড়ো-ছোটো নানা জাতের প্রচুর মাছকে কেন্দ্র করে আবদুলখানা গ্রামে মৎস্যজীবী পরিবার গড়ে ওঠেছিলো। বংশ পরম্পরায় এখনো এ-গ্রামে মৎস্য ব্যবসার সাথে জড়িত অনেক মানুষ। সেই সময় ছোটো ছোটো নৌকা ও জাল দিয়ে ট্রলিং পদ্ধতিতে মাছ ধরা হতো। রাতের বেলা মাছ ধরতে গিয়ে জেলেরা তাদের নিজস্ব স্টাইলে ভিন্ন ধরনের হাকডাক করতো। গেয়ে ওঠতো মাছকে ভয় দেখানো সঙ্গীত। দিনের বেলাও বিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে ছোটো ছেলেমেয়েসহ অনেকে মাছ ধরার দৃশ্য দেখে দেখে মুগ্ধ হতো। বিলপাড়ের বাসিন্দা মনু বর্মণের কাছ থেকে জানা যায়, তাঁর দাদা একবার প্রায় ২৫ কেজি ওজনের বিশাল একটি রুইমাছ এই বিল থেকে ধরেছিলেন। মনু তাঁর পূর্বপুরুষদের নলুয়া থেকে বড়ো বড়ো মাছ ধরার অনেক ঘটনা শুনেছেন। একসময় বিলে প্রচুর বোয়াল মাছও ছিলো। বৃষ্টির মৌসুমে রাতে অনেক বোয়াল মাছ ধানের জমিতে উঠে আসতো।
প্রতিবছর একাধিকবার মধুর মাছ ধরার পলো উৎসব হতো। চতুর্দিক হতে শত সহস্র মাছ শিকারি পলোসহ বিভিন্ন ধরনের জাল নিয়ে উচ্চস্বরে হাকডাক করতে করতে বিলে নামতো। মানুষজন সেই পলো বাওয়া থেকে প্রচুর মাছ নিয়ে আনন্দ ফুর্তিতে বাড়ি ফিরতো, মা-বোনেরা মাছ দেখে খুশি হতেন। কিন্তু বড়োই পরিতাপের বিষয় যে, এখন সেসব দিন যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। নেই আগের মাছ, শোনা যায় না জেলেদের হই-হুল্লোড়, কলকল নৌকা চলার শব্দ। নেই লগি-বৈঠার ঠনঠন আওয়াজ। জেলের ডাকে জেলেনি আর জেগে ওঠে না। নামে না আর পলো। হয় না মাছ ধরার উৎসব। সাজ সাজ রব যায় না দেখা। বাংলার অনেক বিলের সাথে নলুয়া বিলও নিজস্ব যৌবন হারিয়ে এখন মৃতপ্রায়। আগের মতো পানি আর আসে না। জোয়ারের সময় ঢেউ আর খেলে না। ছেলেমেয়ের দল শাপলা শালুক কুড়ানোর ছলে আর নাইতে যেতে পারে না। খাল-বিল-নদীর সেই দিনের রূপ হারিয়ে এখন প্রকৃতিতে দেখা দিয়েছে নেতিবাচক প্রভাব। প্রায় সময়ই বিল থাকে পানিশূন্য। বর্ষায় কিছু জোয়ার আর কিছু বৃষ্টির পানি এলে মাথা তুলে দাঁড়াতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। আর শুকনো মৌসুমে বলতে গেলে বিলের অনেকাংশ হাহাকার করে। মাছসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ছে দিনের পর দিন। বিলপাড়ের মানুষ ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস। অনেকে আবার বিলপাড়ে নতুন বাড়িঘরও তৈরি করেছে।
নলুয়া এখন দৈর্ঘ্যে এক কিলোমিটারের মতো। উত্তরদিকের অনেকটাই শুকিয়ে ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে। উত্তরদিকে শুকিয়ে যাওয়া ফসলি জমির বড়ো অংশের এখন নাম হয়েছে ‘রসুনিয়া’ বিল। অনেকে বলেন, ‘রউন্না’ বিল। হয়তো কোনো কৃষক বিলের উত্তরে জেগে ওঠা জমিতে রসুন চাষ করেছিলেন। সেখান থেকেই এই নাম। এখনো নলুয়া বিলের যে-সামান্য পরিধি রয়েছে, তার মধ্যখানে সারা বছরই কম-বেশি মাছ পাওয়া যায়। আরেক মৎস্য ব্যবসায়ী স্বপন চন্দ্র থেকে জানা যায়, এখনো প্রায় ৩০ টি মৎস্যজীবী পরিবার এ-বিল থেকেই তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করে বেঁচে আছে। প্রতিবছর বর্ষায় একটু-আধটু পানি এলে তুলনামূলক বেশি মাছ পেলে অনেকের দিন ভালো কাটে। অনেকে দেশের বিভিন্ন বাজার থেকে মাছ নিয়ে এসে এলাকাবাসীর মাছের চাহিদা পূরণ করে ও পুষ্টির যোগান দেয়।
বিলের পশ্চিম পাশে আমার মামার বাড়িতে শৈশবকালে কতো গিয়েছি। মামাতো-ফুফাতো ভাই-বোনেরা একসাথে দল বেঁধে নলুয়ার বর্ষার নতুন পানিতে মহানন্দে গোসল করেছি। সাঁতার কেটেছি, দূর থেকে দৌড়ে এসে লাফিয়ে পানিতে পড়েছি। কখনো শাপলা কুড়িয়ে নানির হাতে দিয়েছি। ছোটো ছোটো মাছ ধরার অনেক স্মৃতি মনে এসে দোল খায়। আবার কি আসবে ফিরে, সেইসব দিন, জেগে ওঠবে চিরায়ত বাংলার হারানো রূপ?
নূরুদ্দীন দরজী
সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার