মনজুর এলাহী। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), নরসিংদী জেলা। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, নরসিংদী সদর। তিনি বিশিষ্ট শিল্পপতি হিসেবেও পরিচিত। গত ১২ জুন ২০২৫ (বৃহস্পতিবার) তার এই সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেন সম্পাদক সুমন ইউসুফ।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এদেশের জনগণ আশা করেছে, বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির বন্দোবস্ত শুরু হবে। পুরোনো সব ধরনের ব্যবস্থা দূর হবে। তো জনগণের বিরাট একটা অংশের প্রতিনিধিত্বশীল দল হিসেবে বিএনপি বা আপনাদের পরিকল্পনা কী? আপনারা কীভাবে গড়ে তুলতে চান এই দেশকে?
মনজুর এলাহী : ধন্যবাদ আপনাকে সময়োপযোগী একটা প্রশ্ন করার জন্যে। সবচে’ বড়ো কথা হলো, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। এই দলের জন্মই হয়েছে এই দেশের মাটি ও মানুষের জন্যে কিছু করার জন্যে, এদেশের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে, এদেশের মানুষের ভোটাধিকার অর্জনের জন্যে, প্রতিটি নাগরিক যেন স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারে, নাগরিক অধিকার যেন ঠিকমতো পায়। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করাই হলো বিএনপির প্রথম এবং প্রধান কাজ। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী জনগণের চাহিদা।
সেই জায়গা থেকে জনগণের যে-চাহিদা, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র দ্বি-দলীয় বৃত্তের বাইরে গিয়ে মানুষ নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা খুঁজতেছিলো। এই অবস্থায় আপনাদের…
মনজুর এলাহী : এই জায়গায় একটা কথা বলে রাখি। এরকম একটা গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন আরেকটি রাজনৈতিক দল হবে, এটা কিন্তু মানুষের প্রত্যাশা ছিলো না। এতে মানুষ আরো আশাহত হয়েছে। কেন আশাহত হয়েছে? কারণ, বাঙালি বীরের জাতি। ১৯৪৭ সালে ছাত্র-যুবকেরা আন্দোলন-সংগ্রাম করে ইংরেজ শাসন থেকে মুক্ত করেছে আমাদের। তারপর ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ’৯০-এর গণ-আন্দোলনে ছাত্ররাই আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, জীবন দিয়েছে। তারা আবার স্ব স্ব জায়গায় চলে গিয়েছে। কেননা, তাদের ক্ষমতায় আসীন হবার ইচ্ছে ছিলো না। তারা দেশকে ভালোবেসে এসেছে, আবার ফিরে গিয়েছে। কিন্তু ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর মানে এবারই প্রথম এরকম ঘটনা ঘটলো। ছাত্ররা দল তৈরি করলো। রাষ্ট্রক্ষমতার স্বাদ পেতে চাইলো। আরেকটি বিষয়, এটা কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ছিলো। কিন্তু তারা ‘জনতা’ শব্দটি বাদ দিয়ে কেবল তারাই এই অভ্যুত্থান করেছে বলে ভাবতে লাগলো। ধরুন, একটা গাছ কাটতে কুড়ালের কোপ লাগে দশটা। আজকে সতোরো বছর ধরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র হাজার হাজার নেতাকর্মী খুন হয়েছে, গুম হয়েছে, মামলা খেয়েছে, জেল খেটেছে, বাড়ি-ব্যবসা-স্বজন হারা হয়েছে, দেশছাড়া হয়েছে স্বৈরাচারের আত্যাচার-নির্যাতনে। তো গত সতোরো বছরে আমরা নয়টা কোপ সেই স্বৈরাচারের গাছের গোড়ায় দিয়েছি। জুলাইয়ের এক মাসের আন্দোলনে দশ নম্বর কোপটা দেয়া হয়েছে। গাছটা পড়ে গেলো। তো এখন আপনি বলতে পারেন না যে, এই গাছ কাটার একমাত্র অবদান আপনার, আর কারো কোনো অবদান নেই। এটা ঠিক না।
মূলত আমার প্রশ্নটা ছিলো, বিএনপি’র পক্ষ থেকে আপনারা কীভাবে দেশ গঠনের কাজটা করতে চান? মানে আপনাদের পরিকল্পনাটা কী?
মনজুর এলাহী : সংস্কারের আলাপটা কিন্তু সরকার এখন বলছে। কিন্তু আমাদের নেতা জনাব তারেক রহমান কিন্তু ২০২২ সালেই এই ৩১ দফা প্রণয়ন করেছেন। এই ৩১ দফার পরে আপনি আর এমন কোনো বিষয় খুঁজে পাবেন না, যেখানে সংস্কারের প্রয়োজন আছে। তাহলে ভাবুন, যখন সংস্কারের কথা কেউ উচ্চারণও করেনি, তখনই আমাদের দল, আমাদের নেতা সংস্কারের আলাপ তুলেছিলেন। জনাব তারেক রহমান প্রস্তাব করেছেন যে, বাংলাদেশে একই ব্যক্তি পরপর দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। অথচ এখন থেকে উনার বয়স বিবেচনা করলে পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মতো বয়স উনার হয়তো আছে। সেই জায়গা থেকে উনি এই প্রস্তাব করেছেন। এমন নিঃস্বার্থ সংস্কারপ্রস্তাব আর হতে পারে না। আপনি যদি ৩১ দফা পড়েন, তাহলে এই প্রশ্ন আর আমাকে করার প্রয়োজন নেই।
সামনে তো নির্বাচন। মোটামুটি একটা সময় নির্ধারিত হয়েছে। কিছুটা এদিক-সেদিক হতে পারে। ভোটের জন্যে আপনারা জনগণের কাছে যাবেন। তাদের কাছে ভোট চাইবেন। তো জনগণের জন্যে আপনাদের কাজ কীরকম ছিলো, যেটার উপর ভিত্তি করে আপনারা ভোট চাইবেন? নাকি আপনারা ভাবছেন যে, আওয়ামী লীগ যেহেতু নাই, সুতরাং আপনারাই ক্ষমতার ভাগিদার?
মনজুর এলাহী : এটা নিন্দুকেরা বলে। বিএনপি এখনো পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলো চারবার, তখন কি আওয়ামী লীগ ছিলো না? আওয়ামী লীগের সাথে লড়াই করেই বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় চারবার এসেছে। আমরা তো কখনোই চাই নাই আওয়ামী লীগ ধ্বংস হয়ে যাক, তারা দেশ থেকে পালিয়ে যাক। তারা থাকলে তাদের সাথেও কম্পিটিশন করেই আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা করতাম। ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার দল বিএনপি না। জনগণের জন্যে এমন কোনো কাজ নাই, যেটা বিএনপি করে নাই। সমাজ সংস্কার বলেন, রাষ্ট্র সংস্কার বলেন, অবকাঠামো উন্নয়ন বলেন, সবকিছুতেই বিএনপির কাজ আছে। এভাবে বললে লিস্ট অনেক লম্বা হয়ে যাবে। সংক্ষেপে যদি বলি, এ-ধরনের কাজ করেছে বলেই জনগণ ভোট দিয়ে চারবার বিএনপিকে ক্ষমতায় এনেছে।
আপনাকে একটা বিষয়ে বলতে চাই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যদি বলি, তাহলে জনগণ আগের মতো চিন্তা করছে না। এই জায়গা থেকে বিএনপি যদি জনগণের নিকট সেবা পৌঁছে দেয়ার কাজটা করতে না পারে, তাহলে তো জনগণ আবারো মুখ ফিরিয়ে নেবে। এই ব্যাপারগুলো আপনাদের নজরে আছে কি না, জানতে চাই।
মনজুর এলাহী : আপনি খেয়াল করে দেখেন, পাঁচ তারিখের পরে তিনদিন কিন্তু সরকার ছিলো না। এটা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। সেই তিনদিনসহ পরবর্তী প্রায় দেড় থেকে দুই মাস সরকার গঠন হলেও ট্রাফিক ব্যবস্থা থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলার যে-অবনতি হয়েছিলো, তখন আমাদের দলের লোকেরা কিন্তু দিনে-রাতে জনগণের নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা করেছে। কেউ যেন কোনো সুযোগ নিতে না পারে, সেজন্যে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। এই কৃতিত্বটুকুও কিন্তু আপনারা দিচ্ছেন না আমাদের।
অনেকের মুখে একটা কথা চালু আছে যে, পুরোনো ফ্যাসিবাদ পালিয়ে গেছে, নতুন ফ্যাসিবাদ আবার আসতে চলেছে। এই ব্যাপারটাকে আপনারা কীভাবে ডিল করতে চান?
মনজুর এলাহী : এরকম কথা যদি চালু থাকে, তাহলে আমি বলবো ভালো। আর আমরা কিন্তু পেছনের দরোজা দিয়ে ক্ষমতায় বসতে চাচ্ছি না। আবার নির্বাচন হলে আমরাই নিশ্চিত ক্ষমতায় বসবো, এটাও বলছি না। এর আগেও কিন্তু তিনবার বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে। এবং তিন মাসের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার নজিরও আছে। বর্তমান সরকার দশ মাস অতিবাহিত হতে চললেও এখনো পর্যন্ত নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিতে পারছে না। আওয়ামী লীগ আগে বলতো, উন্নয়ন উন্নয়ন উন্নয়ন, পরে নির্বাচন। আর বর্তমান সরকার বলছে, সংস্কার সংস্কার সংস্কার, পরে নির্বাচন। তো আমরা যদি এরকমই খারাপ হই, তাহলে নির্বাচনের মাধ্যমেই তা প্রমাণ হয়ে যাবে। তখনই দেখা যাবে, জনগণ আমাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে নাকি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে মব জাস্টিস চলছে মারাত্মকভাবে। তাছাড়া গত দশ মাসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনির যে-নিস্পৃহ অবস্থান, বর্তমান সরকারেরও এসব ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেই বলে মনে হচ্ছে, আবার একটা বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে আপনারাও সরকারের নিকট জোরালো দাবি জানাচ্ছেন না কেন?
মনজুর এলাহী : এ-ব্যাপারে আপনার সাথে কম-বেশি আমিও একমত। এর মধ্যে আপনি দেখেন, গত পনেরো বছরে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ করে নাই, এমন কারো সরকারি চাকরি হয়েছে বলে দেখানো যাবে না। তো পাঁচ আগস্টের পরে মিনিমাম বিশ পার্সেন্ট অফিসার হয় স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছে অথবা পালিয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের নব্বই ভাগ লোকই আওয়ামী মনস্ক। যারা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে বা পালিয়ে গেছে, তাদের বাইরে যারা এখনো চাকরিতে আছে, তারা নিজেরাই চাচ্ছে না দেশ স্থিতিশীল থাকুক। শেখ হাসিনা বাইরে থেকে কীসের ভিত্তিতে বলে ফেলে যে, টুপ করে ঢুকে যাবে? যাই হোক, তাদের কবল থেকে আমরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসবো। আর মব জাস্টিস বর্তমান দেশের প্রেক্ষাপটে বন্ধ করা খুব কঠিন। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক সরকার না থাকলে জনমনে স্থিতিশীলতা আসে না। তাছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও স্থিতিশীলতা আসে না, বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। যেমন বিনিয়োগ সম্মেলন হলো, রেজাল্ট কিন্তু জিরো। আর ইউনুস সাহেব নানা দেশ ঘুরে যা নিয়ে আসছেন, সেগুলো কিন্তু বিনিয়োগ না। এর অন্যতম কারণ হলো, কোনো ইনভেস্টরই স্থিতিশীল সরকার না থাকলে ইনভেস্ট করবে না। এবং এসব কারণেই আমরা বারবার নির্বাচনের কথা বলছি।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলো। এই ব্যাপারে আপনাদের অবস্থান কী এখন?
মনজুর এলাহী : আওয়ামী লীগ বড়ো একটি রাজনৈতিক দল, আমাদের প্রতিপক্ষ একটা দল। এখন আমরা যদি বলি, তাদের নিষিদ্ধ চাই, তাহলে আপনারাই আবার বলবেন, আমরা ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চাইছি। বিএনপি’র চরিত্র কিন্তু এটা না। এখন দায়িত্বে তো আমরা নেই। বর্তমান সরকার তাদের বিচার-বিবেচনায় তাদের নিষিদ্ধ করেছে। এর কোনো দায়-দায়িত্ব আমরা নেবো না।
বিগত সরকার নানাভাবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে বিভাজিত করেছে। বর্তমান সময়েও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা ধরনের বিতর্কিত বক্তব্য-অবস্থান দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আপনাদের দলীয় অবস্থান কী?
মনজুর এলাহী : আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী না, তারা চাপা মারে। বরং যেই স্বপ্ন, সাধ, আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো, তার ধারে-কাছেও নেই আওয়ামী লীগ। গণতন্ত্র বলেন, বাকস্বাধীনতা বলেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলেন, ভোটাধিকার বলেন, এই সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলো আওয়ামী লীগ।
পাঁচ আগস্টের পর থেকেই জনগণের মুখে মুখে একটা কথা ছড়িয়ে পড়েছে যে, আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপি নরসিংদীসহ সারা দেশে ব্যাপকভাবে চাঁদাবাজিতে অংশ নিয়েছে। তারপর মামলা-বাণিজ্য করেছে। আবার পদবাণিজ্যের অভিযোগও আছে। এই ব্যাপারে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আপনার বক্তব্য কী?
মনজুর এলাহী : এগুলো অপপ্রচার। মুখরোচক গল্প। তারপরও যদি কারো বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির এরকম অভিযোগের প্রমাণ আপনি দিতে পারেন, তাহলে অবশ্যই আমরা দলীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। আর যোগ্যদেরই বিএনপি পদ দিয়ে থাকে। তখন যারা পদ পায় না, তারা পদবাণিজ্যের এসব গল্প ছড়িয়ে থাকে। ইতোমধ্যে সারা দেশে আমাদের হাজারের উপর নেতাকর্মী বহিষ্কৃত হয়েছে। সুতরাং আমাদের দলীয় অবস্থান এসবের বিরুদ্ধে। মূলত আমাদের দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে আমাদের প্রতিপক্ষ ভাইয়েরাই এসব ছড়াচ্ছে।