মোহাম্মদ আজম। লেখক ও গবেষক। বর্তমানে তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। আজ (১৬ এপ্রিল ২০২৫, বুধবার) নরসিংদী সরকারি মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত ‘আধুনিক বাংলা কাব্যের ধারাক্রমে জসীমউদ্দীনের বিশিষ্টতা’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সেখানেই ‘গঙ্গাঋদ্ধি’র পক্ষ থেকে তাঁর এই ছোট্টো সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করা হয়। সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন সম্পাদক সুমন ইউসুফ।
বাংলাদেশে এখন প্রচুর লেখক-কবি বা বুদ্ধিজীবীদের ফ্যাসিবাদের বয়ান রচনাকারী বা বিগত সরকারের সমর্থক নাম দিয়ে বাংলা একাডেমি, পাঠ্যপুস্তক বা আরো নানা পরিসর থেকে বাদ দেয়ার যে-সংস্কৃতি চালু আছে, এটা কি ইনক্লুসিভ জাতি বা রাষ্ট্র নির্মাণের সহায়ক হচ্ছে?
মোহাম্মদ আজম : না। যদি ব্যাপারটা এরকমই হয় যে, শুধু একজনকে ট্যাগ দিয়ে বাদ দেয়া হচ্ছে, তাহলে সেটা ডেফিনেটলি ইনক্লুসিভ রাষ্ট্র গঠনের অন্তরায়। কিন্তু একটা কথা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, বিগত সরকারের অপরাধপ্রবণতার সঙ্গে, অন্যায়ের সঙ্গে, বাড়তি ও অন্যায় সুবিধা নেয়ার সঙ্গে যদি কেউ যুক্ত থাকে, তারও একটা ফয়সালা আগে হওয়া উচিত। সেটা হওয়ার পরে এসবের সাথে যারা যুক্ত ছিলো না, তাদেরকে এক্সক্লুড করা কোনো কাজের কথা নয়।
এগুলো যাচাই-বাছাইয়ের জন্যে আপনারা কি নির্মোহ-নিরপেক্ষ কোনো পদ্ধতি চালু করেছেন?
মোহাম্মদ আজম : আপনি যদি বাংলা একাডেমির কথা বলেন, তাহলে আমি বলবো, আমরা একেবারে শতভাগ নির্মোহ থাকতে পারছি, সেই দাবি আমি করবো না। কিন্তু আমরা ডেফিনেটলি কাজ করি। বাংলা একাডেমি এমন বিষয় নিয়ে কাজ করে, যেটার সাথে বিশেষজ্ঞতার সম্পর্ক আছে। ফলে আমরা কোনো একটা পক্ষযুক্ত যে-কাউকে এনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারি না। আমাদের বিশেষজ্ঞতার একটা লেভেল মেনটেইন করতে হয়। এবং সেক্ষেত্রে আমরা এমন অনেককেই আমাদের লেখালেখি বা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, যাদেরকে আর যা-ই হোক, আওয়ামী বিরোধী বলা যাবে না।
আমি উদাহরণস্বরূপ বলি সাইমন জাকারিয়ার বিষয়টা। আপনারা ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ার মব ট্রায়াল থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, সেগুলো কি যথাযথ হচ্ছে?
মোহাম্মদ আজম : কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে, সেই ব্যাপারটা হলো, বাংলা একাডেমি তো কোনো আইনী প্রতিষ্ঠান না। বাংলা একাডেমি পুলিশ নিয়োগ করে ব্যারিকেড দিয়ে কোনো সেমিনার করতে পারে না। ফলে যখন বিপুল পরিমাণ লোক কোনো একটা ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে, তখন আমাদের সাময়িকভাবে সেই সিদ্ধান্তটা পরিবর্তন করতে হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, তিনি অন্য কোনো কাজ করছেন না। তার মানে এই নয় যে, তিনি আর কখনোই কাজ করবেন না। তার মানে এই নয় যে, তাদের দাবির সাথে আমরা একমত পোষণ করেছি।
অনুষ্ঠান থেকে বাদ দেয়ার পরে তো তাদের দাবির সাথে একাত্মতা পোষণ করাই হলো…
মোহাম্মদ আজম : না, একাত্মতা পোষণ হলো না। আমরা যেটা করলাম, সেটা হলো, একটা অনুষ্ঠান আমাদের নির্দিষ্ট সময়ে করতে হবে, এটা একটা ফিজিক্যাল প্রেজেন্স। সেখানে একটা মারামারি বা ফ্যাসাদের যে-ঝুঁকি, সেই ঝুঁকিটা আমরা কাটালাম মাত্র। এর মানে এই নয় যে, আমরা তাদের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছি।
এটা আপনি স্পষ্ট করে বলছেন?
মোহাম্মদ আজম : এক্সাক্টলি দ্যাট।
বাংলাদেশে সমাদৃত তিনজন লেখককে বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্যে নাম ঘোষণা করেও বাদ দিয়েছেন…
মোহাম্মদ আজম : না। সেলিম মোরশেদের যে-ব্যাপারটা, সেটার সাথে বাকি দুজনের ব্যাপারটা এক নয়। সেলিম মোরশেদ তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে পরিষ্কারভাবে লম্বা বয়ান দিয়েছেন। এবং সেখানে নির্বাচক, বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ এবং সমস্ত কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু বাকি দুজনের ওই সময়ের গণহত্যা বা অন্যায় কর্মকাণ্ডে, যেটা কোনো নৈতিক অন্যায় নয়, ফৌজদারী অন্যায়, সেই ব্যাপারে তাদের অবস্থান কখনো কখনো অস্পষ্ট এবং কখনো কখনো সরাসরি ঐকমত্যমূলক। তো সেই সময় আমরা যে-পর্যালোচনা করেছি, সেখানে এসব প্রমাণিত হওয়ায় আমাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
এই বিষয়ে আমার শেষ প্রশ্ন, বাংলা একোডেমি পুরস্কার নিয়ে প্রতিবারই কোনো-না-কোনো বিতর্ক হয়। এগুলো এড়ানো কি সম্ভব নয়? আপনি যেহেতু এখন দায়িত্বে আছেন, আপনার কী মনে হয়?
মোহাম্মদ আজম : কথা হলো যে, এই জিনিস একেবারে আমি বা বাংলা একাডেমি— এই পার্টিকুলার আসপেক্ট থেকে আলাপ করলে আমরা ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করতে পারবো না। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের রাষ্ট্রের সমস্যা হলো স্ট্রাকচার তৈরি না হওয়ার সমস্যা, প্রতিষ্ঠান তৈরি না হওয়ার সমস্যা। প্রতিষ্ঠান তার দীর্ঘ ইতিহাসের মধ্যে সেই মর্যাদা অর্জন করে, যে-মর্যাদা দশজনের স্বীকৃতি পায়। আমাদের এখানে এই বিতর্ক শুধু বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়েই হয় না। প্রথমত, একটা পুরস্কার অন্তত আপনি দেখাতে পারবেন না, যে-পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক হয় নাই। তার মানে, বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক যে-অপূর্ণতা, এবং তার সাথে স্বীকৃতির যে-সম্পর্ক, জনসম্মতির যে-সম্পর্ক, এটার যে-অভাব, এই পুরো ব্যাপারটি নিয়ে আলাপ না করলে আমরা এর কোনো সুরাহা করতে পারবো না। আমি বলবো যে, আমাদের পুরো সংস্কৃতির মধ্যে এই ব্যাপারটা নিয়ে ঘোরতর সংকট আছে। আমাদের কাজ হবে, প্রতিষ্ঠানকে জোরালো করে, কাঠামোকে জোরালো করে এই সংস্কৃতিকে অতিক্রম করে যাওয়া।
আচ্ছা, সরকারের বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এজেন্ডা বাস্তবায়নই কি বাংলা একাডেমির প্রকৃত কাজ? সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতির মনন এবং সৃজন বিকাশে বাংলা একাডেমি কি কাজ করতে পারবে বলে মনে করেন আপনি?
মোহাম্মদ আজম : প্রথম কথা হলো যে, স্বায়ত্তশাসন শব্দটি আপনি যে-ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেছেন, আপনি আগে, বামপাশে, ‘সম্পূর্ণ’ শব্দটি যোগ করেছেন, তার মানে হলো, এই বিষয়ে আপনারই দ্বিধা আছে। এখন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান মানেই রাষ্ট্রের আওতা বহির্ভূত প্রতিষ্ঠান নয়। রাষ্ট্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে স্বায়ত্তশাসিত হিসেবে কাজ করতে দেয় সিম্পলি এই কারণে যে, রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক মতাদর্শ সাপেক্ষে যেন প্রভাবিত না হয়। যাতে করে সেই প্রতিষ্ঠান দীর্ঘমেয়াদী কাজ করতে পারে। যেমন ইউনিভার্সিটি। ইউনিভার্সিটি দীর্ঘমেয়াদে কাজ করে। আবার বাংলা একাডেমি, আমরা ধরে নিই যে, এটি একটি গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান, গবেষণামূলক রচনাবলি প্রকাশ করবে এবং নতুন নতুন গবেষণার উদ্যোগ নেবে। এই প্রতিষ্ঠান যদি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন একটি দল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে গবেষণা বলে যে-ব্যাপারটা, সেটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্যে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে। কিন্তু কথাটা বুঝতে হবে যে, স্বায়ত্তশাসিত কথাটা কোথাও অ্যাবস্যুলিউট না। আপনি যদি পার্টিকুলার উদাহরণ দিতে পারেন যে, বাংলা একাডেমি গত সাত মাসে রাষ্ট্রের ধ্বজাধারী হয়ে কী কী কাজ করেছে, তাহলে ব্যাপারটা সম্পর্কে আমার বলতে আরো সুবিধা হবে। একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে যে, বাংলা একাডেমি সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় বাজেটে পরিচালিত এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বায়ত্তশাসিত একটি প্রতিষ্ঠান। এই পুরো অংশটা বাদ দিয়ে আপনি যদি শুধু ‘স্বায়ত্তশাসিত’ শব্দটি ব্যবহার করেন, তাহলে কিন্তু ব্যাখ্যাটা হচ্ছে না। যদি এর আর্থিকভাবে সম্পূর্ণ স্বনির্ভরতা থাকতো, তাহলে সে যেই স্বায়ত্তশাসন ভোগ করতে পারতো, আর্থিকভাবে সরকারের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অঙ্গীভূত একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেই মাপের স্বায়ত্তশাসন ভোগ করাটা সম্ভব নয়।
বাংলা একাডেমির পুরোনো ধারাবাহিকতার জায়গা থেকে একটি প্রশ্ন করতে চাই। সেটি হলো, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আপনার উপর কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করছে কি না?
মোহাম্মদ আজম : ব্যক্তি এখানে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো কাঠামো এবং ইনস্টিটিউশন। আমি গত সাত মাসে প্রধানত যে-চেষ্টাটা করেছি, সেটা হলো, আমি একটা বই পুনর্প্রকাশ হবে কি না, পুনর্মুদ্রণ হবে কি না, এই বিষয়েও নিজে কোনো সিদ্ধান্ত জানাইনি। আমি কাগজে বরাবরই লিখে দিয়েছি আমার সংশ্লিষ্ট বিভাগকে যে, এই বইয়ের পুনর্মুদ্রণের সম্ভাবনা যাচাই করে আমাকে জানান। তার মানে, আমি এটাকে ইনস্টিটিউট আকারে ডেভেলপ করার জন্যে কাজ করছি। এটার কোনো সুফল ভবিষ্যতে হয়তো দেখা গেলেও যেতে পারে।
বাংলা একাডেমি সাহিত্যকে বাংলার প্রান্তে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে কী কাজ করছে? এ-ব্যাপারে আপনার পরিকল্পনা কী?
মোহাম্মদ আজম : বাংলার প্রান্তীয় অঞ্চলে সাহিত্যকে ছড়িয়ে দেয়ায় বাংলা একাডেমির কাজ আসলে খুবই অপ্রতুল। এবং এটা বাংলা একাডেমির বর্তমান যে-স্ট্রাকচার, সেই স্ট্রাকচারে আসলে সম্ভব নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে আসলে যেটা মনে করি, রাষ্ট্রীয় যেকোনো সাংগঠনিক, কাঠামোগত আয়োজন উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে বিস্তার করা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বর্তমান কাঠামো অনুযায়ীই সম্ভব। এবং এটাই করা উচিত। সেক্ষেত্রে প্রত্যেক উপজেলাতেই একটি কালচারাল হাব তৈরি করা জরুরি, যেখানে পাবলিক লাইব্রেরি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, শিল্পকলা একাডেমি এবং বাংলা একাডেমির এটলিস্ট প্রতিনিধিত্ব থাকবে। তার মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ে সমস্ত কর্মকাণ্ড সাধিত হবে। একমাত্র এ-ধরনের একটি কাঠামো যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্র তৈরি করে, এটা কোনো আদর্শবাদী বা কাল্পনিক সিদ্ধান্ত নয়, সরকার চাইলে এই সিদ্ধান্ত আজকেই নিতে পারে, তাহলেই একমাত্র এই কাজটা হতে পারে। বাংলা একাডেমির বর্তমান যে-কাঠামো, সেই কাঠামোতে বাংলাদেশের প্রান্ত পর্যন্ত সাহিত্যকে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়।
আমার শেষ প্রশ্নটি হলো, বর্তমান সরকার আসার পরেও যেসব নিয়োগ হয়েছে, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, বাসস— এগুলো তো আসলে উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া হলো। তাহলে কি পুরোনো ধারাবাহিকতাই বহাল থাকলো না?
মোহাম্মদ আজম : এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে পৃথিবীর কোথাও অন্য কোনো পদ্ধতি আছে কি না, আমি জানি না। তবে কেউ কেউ প্রস্তাব করেছে যে, ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন সার্চ কমিটি করা হয়, এরকম একটা সার্চ কমিটি করা যেতে পারে। সমস্ত পৃথিবীর অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, এটা বেটার পদ্ধতি হতে পারে, এটা অসম্ভব নয়।