পাগল দ্বিজদাসের গান

বৈকুণ্ঠনাথ চক্রবর্তী। মাতৃহারা; পিতার আদরের দুলাল। দুই বিবাহ করেছিলেন। নিঃসন্তান। পালক পুত্র ছিলো। ছিলেন রাজকর্মচারী। জমিদারের সেরেস্তাদার। কালীগঞ্জ-আড়িখোলা খ্রিস্টান মিশন, নরসিংদীর শিবপুরের যোশর কাচারি বাড়ি, দেওয়ান শরীফ খাঁ-জয়নব বিবির নগর নরসিংহপুর— এসব জায়গায় তাঁর কর্ম ও সম্পর্ক ছিলো বলে জনশ্রুতি। জ্ঞানানন্দ গোস্বামী, যিনি মাস্টার দা’ সূর্যসেনের সাথী। তিনি একবার এসেছিলেন বৈকুণ্ঠনাথের কাছে। দুজনে মিলে গড়ে তুলেছিলেন শিক্ষালয় ‘শ্রীকৃষ্ণের পাঠশালা’, ‘শক্তিমঠ’, দেবালয় ও চিকিৎসালয়।

বৈকুণ্ঠনাথের আড়ালে থাকার স্বভাব ছিলো। তাঁর উপার্জন যথেষ্ট ছিলো। মানুষের পাশে দাঁড়াতেন সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে। ছিলেন রাজকর্মচারী। আসা-যাওয়ার পথে গান লিখতেন। জ্ঞানানন্দ গোস্বামীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ‘শক্তিমঠ’ থেকে প্রকাশ করা হয়েছিলো ‘পাগল দ্বিজদাসের গান’। সংরক্ষণের অভাবে অনেক গান হারিয়ে গেছে। তাঁর আত্মীয়-স্বজনের অধিকাংশই ভারতে চলে গেছেন। তাঁরা গানগুলো সাথে করে নিয়ে গেছেন বলে মনে করা হয়। পৈতৃক ভিটা জন্মস্থান পারুলিয়ায় তাঁর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। চিকিৎসালয় নেই। শক্তিমঠ নেই। তবে পাঠশালাটি আছে নবরূপে। অত্র এলাকার আলোকবর্তিকা ঐতিহ্যবাহী ‘পারুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে।

দ্বিজদাস ও জ্ঞানানন্দ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘শ্রীকৃষ্ণ পাঠশালা’, যা বর্তমানে ‘পারুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে পরিচিত

বৈকুণ্ঠনাথ চক্রবর্তী সম্পর্কে যতোটুকু জানা যায়, ততোই ধোঁয়াশা বাড়ে। তাঁর সম্পর্কে প্রকৃত সত্য ও বিস্তারিত জানা একান্ত প্রয়োজন। যার স্মৃতিচিহ্নসহ সব মুছে গেছে। এমন একজন মহামানবকে কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে এই সমাজ, এই রাষ্ট্রের কি কোনো দায়িত্ব নেই?

বৈকুণ্ঠ গান লিখতেন ‘দ্বিজদাস’ ছদ্মনামে। নিদারুণ জীবন বাস্তবতা ও স্পষ্টভাষ্যে। গানের কথায় গভীর জীবনবোধ নিরপেক্ষ বাস্তবতার আলোকে তাঁকে বস্তুবাদী বলে থাকেন অনেকে। এ-কথার সত্যতা কতোটা? জানতে হলে ডুব দিতে হবে দ্বিজদাসের গানের ভুবনে। তাঁর গানের কথায় যেমন সত্যতা আছে, আবার আছে ভাবনার উদ্রেককারী অনেক উপসর্গ। বরাক নদীর জল যেখান থেকে বাংলায় প্রবাহিত হয়, দ্বিজদাসের জন্মস্থান থেকে সে-পর্যন্ত তাঁর গানের ব্যপক প্রভাব। গ্রামীণ জনপদে ও পদাবলির আসরে তাঁর গান প্রাণে শিহরণ জাগায়। নাগরিক সমাজেও তিনি সমাদৃত। হালের জনপ্রিয় বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম, দূরবীন শাহ প্রমুখ তাঁর গানে গভীরভাবে প্রভাবিত। প্রখ্যাত বাউল সাধক সুনীল কর্মকারসহ বর্তমানের প্রায় সব বাউল শিল্পীর মুখেই ভাসে দ্বিজদাসের গান। হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখেছেন তাঁর গান নিয়ে। কবিয়াল হরিচরণ আচার্য্য সরাসরি দ্বিজদাসের দীক্ষায় ধন্য হয়েছেন। জ্ঞানানন্দ গোস্বামী বামপন্থী ছিলেন। দ্বিজদাসের বাড়ি পারুলিয়া এলাকার অনেকেই বামপন্থী স্বদেশী আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। তাঁর গানের কথাকে বামপন্থীরা একান্ত আপন বলেই মনে করেন। সেই সাথে তাঁকে বস্তুবাদী বলে থাকেন অনেকে। তাঁর বিখ্যাত গান :

কেহ শোনো বা না-শোনো, মানো বা না-মানো,
তাতে আমার নাই কোনো লাভ-লোকসান।

শুনে যারে ওরে পাগল দ্বিজদাসের গান।

 

দ্বিজদাসের ভাবনায় সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে অমীমাংসিত সাবলীল উচ্চারণ আছে এ-গানে। এক পর্যায়ে অকপট উচ্চারণ :

কেহ বলে আছ তুমি, কেহ বলে নাই,
আমি বলি থাকো থাকো না থাকলে নাই।
…মানতে মানতে শাস্ত্র— পাই না অন্ন বস্ত্র,
লোটা বটি অস্ত্র ক্রমে তিরোধান
শুনে যারে ওরে পাগল দ্বিজদাসের গান।।

এ-কথার উপর ভিত্তি করেই তাঁকে বস্তুবাদী বলাটা যৌক্তিক হবে? নিজ ধর্ম চেতনায় অন্তিম পর্ব শ্মশানের কথা বহুবার এসেছে তাঁর কথায় :

তরুলতা কন্যার সাথে বিয়া হবে বিধি মতে
সমন ঠাকুর ঘটক তাতে, রাজ ঝোটক সম্মেলন
কর হে বিয়ার আয়োজন।

তাঁর গানের প্রতিটি কথাই গভীর চিন্তার উদ্রেক ও সাধনার পথ উন্মোচিত করে।

আমি বিনে তোমার কিসের বড়াই
আবার
পঞ্চত্বের কালে, পঞ্চে পঞ্চ মিলে
পাঁচ গেলে, পাছে রলো না রলো না।

দর্শনে স্পর্শনে শ্রবণে কি ঘ্রাণে
কিছুতেই না হয় ঠিকানা।

এ-গানগুলো প্রতিটি ভাবুক হৃদয়ে ভাবনার খোরাক জোগায়। তাঁর গানে মানুষ ও গুরু ভজনার কথাও এসেছে সহজ সারল্যে।

মানুষে মানুষ বিরাজে খুঁজে নেওয়া বড় দায়
মানিক চিনে, দুই এক জনে, শ্রীমহাজনের কৃপায়।

সংসারের যাতনা ও পারিপার্শ্বিক প্রভাব দ্বিজদাসকে তিক্ত স্বাদ দিয়েছিলো ষোলোআনা। গানে যার যথার্থ প্রমাণ রয়েছে অনেকটা অংশজুড়েই :

সংসারের সংসারী, মাইনা নাই চাকরী
এ ঝকমারি করে দেখেছি
এবার হলো যা হবার, বাকি নাই রে আর
সকাল সকাল গেলে বাঁচি।

এই জীবন-সংসারের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণাও প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কথায়। মৃত্যু-শ্মশান-অন্তিম যাত্রাÑ এসবে আচ্ছন্নতা প্রকাশ পায় :

এই যে সংসার সকলই অসাড়

পবনের যেদিন গতি রুদ্ধ হবে
ভুজঙ্গ গিয়া গুরুকে দংশিবে
পতঙ্গ সেই দিন মাতঙ্গে নাশিবে
সিংহের হবে শিয়ালের ভয়
একদিন নিরাকার হবে জলে জলাময়।

লালনের গান আর দ্বিজদাসের গানের মৌলিক পার্থক্য হলো, লালন যেখানে ভাববাদী, দ্বিজদাস সেখানে যুক্তিবাদী। লালনের গানে সাধন-ভজনের সাথে কর্মপরিণতি ও মুক্তির বাসনায় করুণ মিনতি আছে। আর দ্বিজদাসের আছে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর নিঃসঙ্কোচ অভিপ্রায়। দ্বিজদাস বলেছেন :

আমি তোমার অধীন, হই চিরদিন, তোমার প্রত্যাশী
আনিয়াছ, আসিয়াছি, যেতে বললে তৈয়ার আছি
নাচাইতেছ, নাচিতেছি, বসতে বললে বসি
তুমি করাও আমি করি, না করাইলে কি আর পারি
কাঁদাও যখন কেঁদে মরি, হাসাইলে হাসি
আমি কিসে দোষী দয়াল আমি কিসে দোষী।

তাঁর জন্মস্থান নরসিংদী-পলাশ-পারুলিয়ায় পূর্ব থেকেই বাউল-ফকিরদের পদচারণা ছিলো। ছিলো কবিগানের চারণভূমি। নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষের মিলে-মিশে বাস। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁরা একসাথেই থাকে। স্বাভাবিকভাবেই তা দ্বিজদাসকেও প্রভাবিত করেছে। এক জায়গায় লিখেছেন :

রাম রহিম না জুদা ভাবো আসল ঠিক রাখিও ভাই।

ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে দ্বিজদাস গভীর জ্ঞান রাখতেন, যা তাঁর গানের কথায় বিভিন্ন জায়গায় এসেছে।

এক বিনে দুজন নাই।

আবার মৃত্যু নিয়ে তাঁর কতো চমৎকার অভিলাষ :

যে জন জানে, মরণ কি বিষয়
মধুরেণ সমাপণ, তার মরণ মধুমেয়।

জন্মান্তরবাদ, সমাজ-সংসার, যুক্তি, কামতত্ত্ব, মানুষ ভজন, শ্যামাসঙ্গীত, দেশাত্ববোধক প্রভৃতি বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যময় গানের ঝাপি নিয়ে বাংলা সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করে গেছেন দ্বিজদাস। অথচ আজ কোথাও তাঁর স্মৃতিচিহ্নটুকু পর্যন্ত নেই। এর ফলে একদিকে তাঁর মহামূল্যবান সৃষ্টিগুলো যেমন হারিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে হচ্ছে বিকৃত ব্যবহার। তাঁর সৃষ্টি-সঙ্গীত ও সামাজিক অবদানগুলো সংরক্ষণ করে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে রাষ্ট্র উদ্যোগী হবে, এটাই প্রত্যাশা। শেষ কথা, দ্বিজদাসের স্বপ্নের ভাষায় আশাবাদী উচ্চারণ :

সময়ে ফুল ফুটবে সত্য
গোড়ায় জল ঢাল নিত্য।


মো. জাকারিয়া
কবি ও গবেষক।

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ