কাজী, গোলাপের চাষ করতে চেয়েছিলো। সে গোলাপ ভালোবাসে। গোলাপের গন্ধ…
চাপিলা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়ার সময় তার প্রথম স্মরণ হয় লাল রঙের কথা। আর একখণ্ড পপলার কাঠের কথা। সে ভাত মাখাচ্ছিলো আর ভাবছিলো গতকাল বৃষ্টি হয়েছে কিনা। বৃষ্টি হলে দুলালি পায়ে নূপুর পড়তো। দুলালি কি কাল নূপুর পড়েছিলো? দুলালি কি কখনো নুপূর পড়তো? সে মনে করতে পারলো, দুলালির বুনি ছিলো বেশ বড়ো। আর চোখগুলোও!
কালবোশেখের ছেনালি শব্দ আসছে কানে। কাজী খাবার শেষে একটা সিগারেট ধরালো। শীত শীত করছে আর মনে পড়ছে দুলালির উদোম গতর। কাজী হঠাৎ–ই চোখ বন্ধ করলো। চোখ বন্ধ করলে তার আবার স্মরণ হয় লাল রঙের কথা। গোলাপের কথা।
একটা গোলাপের ছবি আঁকবো। কাজী ভাবলো।
একটা টকটকে লাল গোলাপের ছবি আঁকবো। আবার ভাবলো কাজী।
তিনদিন আগে শুরু হওয়া মাসের তৃতীয় দিনে এসে কাজী প্রথম তার ক্যানভাসে আঁচড় টানলো। আঁচড় টানলো টকটকে লাল রঙের। এরপর একদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো যখন, তখন কাজী আমাদের গোলাপের গল্প বলেছিলো। সে গল্প বলেছিলো ইসমাইল ভাইয়ের বৃদ্ধ এবং কালো ধোঁয়ায় জঙ ধরে ওঠা অতীত দিনের একটা চায়ের দোকানে বসে।
সে বললো, “দুলালির যোনিতে কিড়া ধরেছে। কিড়াগুলো সেখানে কিলবিল করছে। তাকে ডাক্তার দেখানো উচিত”।
কাজী চায়ে চুমুক দেয়। চায়ের জলে লেবুপাতা ভাসছে। আমরা লেবুপাতার গন্ধ পেলাম। আমরা গন্ধ পেলাম দুলালির কিড়ায় ধরে ওঠা যোনির।
“হ্যাঁ, দুলালির যোনিতে কিড়ায় ধরেছে”, কাজী বললো।
“কিড়াগুলি সেখানে কিলবিল করছে”, আবার বললো কাজী।
পুরোনো দিনের ঘুমের মতো দেখতে এই চায়ের দোকানটায় আমরা ছিলাম তিনজন। আমি, আমার বন্ধু আর কাজী। আমি সিগারেট টানছিলাম। আমি চাইছিলাম না আমার সিগারেট থেকে কাজীকে ভাগ দিই। কাজী আবার চায়ে চুমুক দেয়। চায়ের জলে লেবুপাতা ভাসছে। আমি তাকিয়ে থেকে দেখি, কাজীর হাতে লাল রঙ লেগে আছে। আর এই লাল রঙের জায়গাটায় আটকে আছে একটা শাদা রঙের কিড়া। আমার মনে হলো কিড়াটির কোনো মাথা নেই।
“হুঁ, কিড়াটির কোনো মাথা নেই”, আমার বন্ধু বললো।
আমি আমার বন্ধুর দিকে তাকাই, তাকে আমার কৈ মাছের মতো মনে হয়। তাকে মনে হয় মাটিতে আটকে পড়া একটা কৈ মাছের মতো!
“তোকে একটা কৈ মাছের মতো লাগছে”, আমি বলি।
“তোকে একটা মৃত কৈ মাছের মতো লাগছে”, আবার আমি বলি।
এরপর অনেকদিন আমরা আমাদের চোখ বন্ধ করে রাখি অথবা আমরা আর এরমধ্যে কাজীকে দেখতে পাইনি। সে ছিলো অদৃশ্য এবং আমরা ভাবলাম, সে এমনই। তখন, আবার অতীত দিনের মতোই ইহুদী আর মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেলো। আর যুদ্ধ লাগলো সেই একই পুরোনো এবং পবিত্র আর মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের জায়গা জেরুজালেমে। যদিও ইহুদীরা ছিলো আজীবন নির্যাতিত এবং কখনো নিজেদের একটা দেশ না পাওয়া জাতি। তবুও আমরা দেখলাম, তারা কেমন শক্তিশালী আর বেজন্মা একটা জাতি হয়ে ওঠলো!
আমি আর আমার বন্ধু, যাকে আমার মৃত কৈ মাছের মতো মনে হয়, আমরা আলাপ শুরু করি এই যুদ্ধ নিয়ে। আমরা আলাপ করি টাওয়াদীর গলির মোড়ে রবীন্দ্রনাথের চায়ের দোকানে বসে। রবীন্দ্রনাথ কখনো দুধ চা বিক্রি করেন না। কারণ হিসেবে তিনি আমাদের বলেন, তাঁর কোনো প্রেমিকা নেই। আমরা কেবল তাঁর দোকানে রঙ চা খাই। এবং মাঝে–মধ্যেই মুসলমান আর ইহুদীদের যুদ্ধ নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলি।
“গাজায় আজ একটা শিশু মারা গেছে”, আমার বন্ধু বললো, যাকে আমার মৃত কৈ মাছের মতো মনে হয়।
“শালা ইহুদীদের পাছা ফাটিয়ে দেয়া উচিত”, আবার আমার বন্ধু বললো, বলা বাহুল্য, যাকে আমার মৃত কৈ মাছের মতোই মনে হয়।
আমি তার কথার পিঠে কোনো কথার পেরেক ঠুকি না। আমি টিভিতে নিচের দিকে যমুনার জলের মতো বয়ে যাওয়া সংবাদ পড়তে থাকি। যেখানে বলছে এবং দেখাচ্ছেও, গুলিস্তানে এক কথা বলা কুকুর পাওয়া গেছে। সাংবাদিকের দল এই কথা বলা কুকুরের দিকে মাউথপিস বাড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কুকুরটি গলা খাঁকারি দিয়ে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। সে জনগণের সেবা করতে চায়। সে জনগণকে সাথে নিয়ে উন্নয়নের বিপ্লব করতে চায়। সে সবার ঘরে সমপরিমাণ মাংসের হাড়ের জোগান পৌঁছে দিতে চায় এবং এক্ষেত্রে সে বদ্ধপরিকর।
“শালারা সবসময় কুকুরের দিকেই মাইক বাড়ায়”, আমার বন্ধু বললো।
“কথা বলা কুকুরের দিকেই”, আবার আমার বন্ধু বললো।
তখন একটা প্রজাপতি এসে ঢুকলো চায়ের দোকানটায়। আর এর পেছন পেছন আমরা দেখলাম কাজীকে। কাজী আমাদের সামনে এসে, যেনো আমরা দেখতে পাইনি এমন করে জাদুকরের মতো শূন্য থেকে এক ছবি এনে বের করলো। আমরা ছবিটির দিকে তাকালাম, এরপর তাকালাম কাজীর দিকে, তারপর আবার ছবিটির দিকে। আমরা বিশ্বাস করতে চাইছিলাম যে, ছবিটা কাজীই এঁকেছে।
তখন কাজী বললো, “ছবিটা আমি এঁকেছি।”
শালা শুয়োরপুত্র করলো কী!
ছবি এতোটাই নিখুঁত যে, মনে হচ্ছে গোলাপের পাপড়ি থেকে কিড়াগুলো হয়তো এখনই জোর–বাতাসে উড়ে যাবে।
“তুমি এটা কেমন করে আঁকলে”, আমার বন্ধু জানতে চাইলো।
“এই গোলাপ আর এই কিড়াগুলো”, আবার আমার বন্ধু জানতে চাইলো।
আমি খেয়াল করলাম, কিড়াগুলোর কোনো মাথা নেই।
“হুঁ, কিড়াগুলোর কোনো মাথা নেই”, কাজী বললো।
“আমি আমার ছবিগুলো নিয়ে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করবো”, আবার বললো কাজী।
তখন কাজী ঠিক করে কলেজের পুকুরপাড়ের রাস্তার দুপাশে যে–গাছেরা রয়েছে, তাতেই দড়ি দিয়ে টাঙিয়ে সে এই আয়োজনটা করবে। পরদিন কাজী তার ছবিগুলো নিয়ে পুকুরপাড়ের রাস্তায় চলে এলে সে দেখে যে, এখানে কোনো গাছ নেই।
“এখানে তো গাছ ছিলো”, কাজীর মনে হয়।
“এখানে কি কোনোদিন গাছ ছিলো”, আবার মনে হয় কাজীর।
কাজী চারপাশে তাকিয়ে কী যেনো হাতড়ায়। তার চোখ তখন পৃথিবীর চোখ বলে মনে হয় না আমাদের। আমরা তাকিয়ে দেখি, সে তার ছবিগুলো নিয়ে হাঁটতে শুরু করে দেয়। সে হাঁটতে থাকে। আমরা এটা আমাদের জন্মের সময় পাওয়া চোখ দিয়ে দেখি। পরদিন মুর্দা দেখার মতো খবরের কাগজে পড়ি, কাজী হাঁটছে। এইদিন বিকেলে আমরা টিভিতে দেখতে পাই, কাজী হাঁটছে। তখন আমরা আরো দেখি যে, সে একা নয়, তার সাথে আরো অনেকেই হাঁটছে।
‘কাজী হাঁটছে’, এই আলোচনা আমরা এক সপ্তাহ ধরে করি।
এরপর আমরা যখন ভুলে যাবো বলে ঠিক করলাম অথবা যে–সময়ের পর ভুলে ফেলাটাই উচিত, সেই সময় আবার একটা প্রজাপতিকে দেখি চায়ের দোকানে এসে ঢুকতে। আর সেইসাথে আমাদের মনে পড়ে কাজীর কথা। আমরা জেনেছিলাম, কাজী কোনো–এক পাহাড়ি এলাকায় গিয়েছিলো।
“চল্ আমরা পাহাড়ে যাই”, আমার বন্ধু বললো।
“কাজী যে–পাহাড়টায় গেছে, তাতে”, আবার আমার বন্ধু বললো।
এরপর আমরা সেই পাহাড়টায় যাই। সেখানে আমরা সেই পাহাড়জুড়ে একধরনের গাছ দেখি।
“এইগুলা কী গাছ”, আমি জিজ্ঞেস করি।
“এটা কোন জাতের গোলাপ গাছ”, আবার জিজ্ঞেস করি আমি।
পুরো পাহাড়জুড়ে একই ধরনের আর পুরোনো দিনের গল্প বলে এমন গাছ; যা আমাদের বলে, এরা আসলে মানুষ বা এরা আসলে কাজী। আর এরা এখন প্রত্যেকেই গাছ। কেবলই গাছ। আর প্রত্যেক গাছেই ধরে আছে গোলাপ ফুল, যার পাপড়িগুলো কিড়ায় খাওয়া।